Bangla - সামাজিক গল্প

স্বপ্নের আলোয় শিউলি

Spread the love

মৌসুমী ধর চক্রবর্তী


শিউলির বয়স এখন পঁয়তাল্লিশ। একটা সরকারি প্রাথমিক স্কুলে পড়ান তিনি। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার প্রত্যন্ত এক গ্রামে ওঁর বসবাস—চারপাশে ইটভাটার ধোঁয়া, জলাভূমির নিঃশব্দতা, আর শালবনের ঘন ছায়ায় ঘেরা জনপদ। এখানকার রাস্তাগুলো বর্ষায় কাদায় ভরে যায়, গ্রীষ্মে ধুলো উড়তে থাকে, আর শীতে শীতল হাওয়া হাড়ে হাড়ে কাঁপিয়ে দেয়। অথচ এই সব কিছুর মাঝেও শিউলি যেন এক টলমলে আলো, যিনি কখনও নিভে যান না।

তাঁর সকাল শুরু হয় খুব ভোরে। মাটি ছোঁয়া ধোঁয়া আর পাখির ডাকের মধ্যেই শুরু হয় রান্না-বান্না, বাড়ির কাজ। তারপর শাড়ি পরে ঝোলা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে হাঁটা শুরু করেন প্রায় তিন কিলোমিটার দূরের স্কুলের দিকে। অনেক সময় রাস্তার ধারে বসে থাকা একপাটি চায়ের দোকানে থেমে কড়া লাল চা খেয়ে নেন—চোখে যেন সেই চায়ের মতোই তীব্র জেগে থাকা দৃঢ়তা।

স্কুলে তিনি পড়ান প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি অবধি সমস্ত ক্লাসেই—কারণ শিক্ষকসংখ্যা অপ্রতুল। তাঁর ক্লাসে কখনও কড়া নিয়ম, কখনও আবার রূপকথার গল্প, কখনও বা হিন্দি সিনেমার গান। বাচ্চারা ওঁকে ভালোবাসে। কারণ শিউলি ওদের শুধু পড়ান না, ওদের মন বোঝেন। কারো ঘরে খাবার নেই, কারো বাবা নেই, কেউ আবার স্কুলে আসতে ভয় পায়—শিউলি প্রত্যেকটা শিশুকে আলাদা করে বোঝেন, ভালোবাসেন।

তাঁর নিজের জীবনটা শুরু থেকেই সহজ ছিল না। বাবা ছিলেন ভ্যানচালক, মা ছিলেন গৃহবধূ। দারিদ্র‍্যের কড়াল গ্রাসে প্রতিদিনের লড়াই ছিল রুটিনের অংশ। ছোটোবেলা কেটেছে অশোকতলা বস্তিতে। বৃষ্টির দিনে ছাদ থেকে জল পড়ত মাথায়, শীতের রাতে কাঁথা ভাগ করে শোয়া—এই সব কিছুর মধ্যেও শিউলির মা বলতেন, “তুই লেখাপড়া শিখ, মেয়ে। আমি না পারলেও তুই পারবি।”

চতুর্থ শ্রেণির একদিনের কথা শিউলির খুব মনে আছে। সেদিন স্কুলে ইংরেজির পরীক্ষা ছিল। অথচ আগের দিন রাতে মোমবাতি নিভে যাওয়ায় অন্ধকার ঘরে বসে পড়তে পারেনি। সকালে স্কুলে গিয়ে শিক্ষক জিজ্ঞেস করেন, “পড়া হয়নি কেন?” শিউলি মাথা নিচু করে বলে, “আলো ছিল না স্যার।” স্যার চুপ করে থাকেন। পরে তাঁর টেবিল থেকে একটা টর্চ দিয়ে বলেন, “এটা রাখো, যতদিন লাগবে।” এই ঘটনার পর থেকেই শিউলি বুঝে যায়, আলো না থাকলেও কেউ যদি পাশে দাঁড়ায়, তা হলে পথ তৈরি হয়ে যায়। সেই শিক্ষকই পরে তাঁর প্রথম গাইড, প্রথম অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠেন।

বাবা মারা যান যখন শিউলি ক্লাস টেনে পড়ে। ভ্যান চালাতে গিয়ে হঠাৎ ব্রেন স্ট্রোক। কয়েক দিনের মধ্যেই নিঃশেষ। তারপর হঠাৎ করেই যেন সময় থেমে যায়। সংসারে মা, তিন ভাইবোন—সবচেয়ে বড়ো শিউলি। পরিবারের সব দায়িত্ব তখন তাঁর কাঁধে। স্কুলের পড়া, ভাইবোনের দেখাশোনা, বাজার করা, রান্না, রাতে মায়ের পাশে বসে থাকা—সব মিলিয়ে দিনের শেষে নিজের জন্য একটু সময় ছিল না বললেই চলে।

তবে তিনি হাল ছাড়েননি। দুপুরে খাওয়ার সময়টুকু কমিয়ে পড়া চালিয়ে যেতেন, টিফিনের সময় খাতার কোণে অংক কষতেন। পাড়ার লাইব্রেরিতে বসে পুরনো ম্যাগাজিন থেকে তথ্য লিখে রাখতেন। টিফিনের জন্য বাঁচিয়ে রাখা দশ টাকার কয়েন জমিয়ে মাস শেষে কিনতেন পুরনো বই। শিউলির মনে হত, জ্ঞানই একমাত্র অস্ত্র—যেটা দারিদ্র্য, সমাজের অবহেলা, আর ভাগ্যের আঘাতের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে।

মাধ্যমিকে ভালো ফল করে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন। সেই সময়ই শুরু হয় টিউশন পড়ানো। সকালবেলা সাড়ে পাঁচটায় উঠে রান্না করে, ভাইবোনদের তৈরি করিয়ে, সাইকেল চালিয়ে যেতেন কলেজে। ফেরার পথে দুটো জায়গায় টিউশন পড়িয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতেন। মাঝে মাঝে ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়ত, জ্বর আসত, তবুও ক্লাস মিস করতেন না। কলেজের শিক্ষকেরা ওঁকে চিনতেন ‘লড়াকু মেয়ে’ নামে।

সেই সময়ই গ্রামে এক ছোট্ট সাংস্কৃতিক মঞ্চ গড়ে তোলেন। নাম দেন ‘স্বপ্নসন্ধ্যা’। ছোটো ছেলেমেয়েদের গান শেখাতেন, কবিতা আবৃত্তি করাতেন, ছোট নাটক করাতেন। অনেকেই বলেছিল, “এই বয়সে এসব করে কী হবে?” কিন্তু শিউলি বলতেন, “আমরা স্বপ্ন না দেখলে, এ বাচ্চাগুলো স্বপ্ন দেখতে শিখবে কবে?”

গ্রামে তখনও মেয়েদের শিক্ষার দিকে উৎসাহ ছিল না। মেয়েরা ক্লাস সেভেন অবধিই পড়ে, তারপর বিয়ে। কিন্তু শিউলির প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে ছবিটা বদলায়। তিনি একবার একটি মিটিংয়ে বলেছিলেন, “একটা মেয়ে যদি নিজে দাঁড়াতে না পারে, তাহলে তার বাচ্চার ভবিষ্যৎই বা কীভাবে দাঁড়াবে?” এই কথাটা পরে পাড়ার মন্দিরের দেওয়ালে কেউ লিখে দিয়েছিল। গ্রামের লোকেরা আজও বলেন, “দিদিমণির কথা বদলে দিয়েছে এই পাড়াকে।”

এইভাবে নিজেকে গড়ে তুলেছেন শিউলি। জীবন তাকে নানা দিক থেকে আঘাত করেছে, কিন্তু সে থামেনি। বরং শিখেছে প্রতিটি কষ্টই যেন এক একটি পাথর, যা দিয়ে নিজের জীবনের সিঁড়ি তৈরি করতে হয়।

আজও যখন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরেন, তখনও একঝাঁক বাচ্চা তাঁর পেছনে ছুটে আসে, কেউ আঁচল ধরে বলে, “দিদিমণি, কাল গল্প বলবেন তো?” কেউ বলে, “আমার মা বলেছে, আপনি না থাকলে আমি স্কুলেই যেতাম না।” শিউলির চোখে জল আসে না, কারণ কাঁদলে সময় নষ্ট হয়। তাঁর হাসি যেন বলে—জীবন এখনো বাকি, পথ এখনো অনেক লম্বা।

এইভাবেই শিউলি হয়ে উঠেছেন এক সংগ্রামী প্রতীক—যাঁর জীবনের গল্প হাজার হাজার মেয়ে, মা, শিক্ষিকার মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়। তিনি জানেন, তাঁর পায়ের নিচে জমা কাঁটাগুলো তাঁকেই শিখিয়েছে—কীভাবে ফুলে যেতে হয় অন্ধকারেও।

শিউলির জীবনে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা এসেছিল যখন সে ক্লাস টেনে পড়ে। পিতার মৃত্যু যেন এক মুহূর্তে সবকিছু বদলে দিল। গ্রামের এক সাধারণ পরিবারে বড় হয়ে ওঠা শিউলির জীবনে এই ঘটনা যেন একটি মোড় ঘুরিয়ে দিল চিরতরে। পিতা শ্যামল ঘোষ ছিলেন একজন পরিশ্রমী মানুষ—জলভূমির পাড়ে মাছ চাষ করতেন, মাঝে মাঝে ভাড়ায় গাড়ি চালাতেন, আর যা আয় হতো, তা দিয়েই কোনওরকমে চলত পাঁচ জনের সংসার। কিন্তু হঠাৎ একদিন কাজ থেকে ফিরে রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। শিউলির মা, গৌরী দেবী, তখনই বুঝেছিলেন—কিছু একটা অশুভ ঘটতে চলেছে।

গ্রামে ডাক্তার দেখিয়ে যখনও সুস্থতার আশা মিলল না, তখন তাঁরা শ্যামলবাবুকে জেলা হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু বাঁচানো গেল না। পেটের গভীরে বাসা বেঁধে থাকা এক অজানা রোগ, যে নীরবে কেটেছে এতগুলো বছর—তারই কাল হয়ে উঠল শিউলির পিতার জন্য। হাসপাতালের শীতল বিছানায় মৃত্যুর আগে শ্যামলবাবু শুধু বলেছিলেন, “শিউলি, তুই মা আর ভাই-বোনদের দেখে রাখিস। তোকে পারতেই হবে।”

এই কথা শিউলির কানে যেন এখনো বাজে। তখনও সে শিশু, কিন্তু সময় তাকে বড় করে দিয়েছিল এক নিমেষে। মাত্র পনেরো বছরের কাঁধে এসে পড়ল একটি গোটা সংসারের বোঝা। ছোট দুই ভাই—বিকাশ আর পিন্টু তখন ক্লাস ফোর আর ক্লাস ওয়ানে পড়ে। মা, গৌরী দেবী, হারিয়ে ফেলেছিলেন নিজের ভিতরের সাহসটুকু। প্রতিদিন কাঁদতেন, দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন, নীরব থাকতেন। সংসার যেন এক বিশাল পাহাড়, যা একা শিউলির উপরে এসে পড়েছিল।

সকালে উঠেই শিউলি ঘুম থেকে ডেকে তুলত ভাইদের, তৈরি করত জলখাবার, রান্না করত দুপুরের খাবার, তাদের ইউনিফর্ম ইস্ত্রি করত। এরপর ভাইদের পাঠিয়ে দৌড়ে নিজে যেত স্কুলে। কিন্তু প্রায়ই দেরি হত, কোনওদিন ক্লাসের অর্ধেকটা মিস হয়ে যেত। শিক্ষকরা প্রথমে রেগে যেতেন, পরে বুঝে গিয়েছিলেন পরিস্থিতি। তাঁদের অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন—কেউ বই দিতেন, কেউ বাড়িতে একবেলা খেতে ডাকতেন।

স্কুলের পরেও বিশ্রামের সময় ছিল না। ফিরেই কাপড় ধুতো, জল ভরত, সন্ধের রান্না প্রস্তুত করত। তারপর সন্ধেবেলায় যেত পাশের গ্রামে টিউশন পড়াতে। ছোটদের অংক, বাংলা, ইংরেজি শেখাত। যে কটা টাকা পেত, তা দিয়েই সংসারের নুন, তেল, সাবান কিনত। পয়সা জমিয়ে রাখত ভাইদের নতুন বই কেনার জন্য। নিজের কিছু প্রয়োজন হলে, পুরনো জামা পরেই চলত।

শিউলির জীবনে সেই সময়কার সন্ধ্যারা ছিল বিশেষ অর্থবহ। অনেক বাড়িতে টিউশন করার সময় কিছু ঘরের দরজায় অপমানও সইতে হয়েছে। কারও গলায় উঠেছে কটু কথা—“তোর বাবার তো ছিল না! এখন তোরা এসেছ আমাদের দয়া নিতে?” কারও ঘর থেকে পেটভরে খেয়ে ফিরেছে, কারও ঘর থেকে ফিরেছে ভিজে চোখে। তবুও সে থামেনি। সে জানত—পড়াশোনা চালাতে না পারলে, জীবনে কিছু হবে না।

মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় ছিল আরেক লড়াই। রান্নাঘরের জানালার পাশে রাখা টেবিলে রাতের পর রাত জেগে পড়েছে। মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়ত বইয়ের উপরেই। মা তখন শরীর খারাপ নিয়ে বিছানায়, ভাইয়েরা তখনও ছোট। অনেক সময় গ্রামের মাস্টারমশাই, প্রভাসবাবু এসে সাহায্য করেছেন—প্রশ্নপত্র এনে দিয়েছেন, নিজের হাতে প্রশ্ন সমাধান করিয়েছেন। তাঁর উৎসাহে এবং নিজের পরিশ্রমে শিউলি ভালো নম্বর পেয়েই পাশ করে মাধ্যমিক। সেদিন পুরো গ্রামে আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছিল। এক প্রতিবেশী বলেছিলেন, “শ্যামলদার মেয়ে সত্যিই আমাদের গর্ব।”

তারপর শুরু হল উচ্চ মাধ্যমিকের পথচলা। কিন্তু সেই সঙ্গে বেড়ে চলল সংসারের চাপও। টিউশন বাড়াতে হল। বিকেল থেকে সন্ধে পর্যন্ত টানা পাঁচটা বাড়িতে পড়াতে হত। অনেক সময় বাসে জায়গা না পেয়ে পায়ে হেঁটে ফিরতে হয়েছে তিন চার কিলোমিটার পথ। শীতে, বর্ষায়, গরমে—থেমে থাকেনি তার চলা। কলেজে ভর্তি হতেই আবার আরেক সমস্যা। ভর্তি ফি, ইউনিফর্ম, বইপত্র—সবই টাকা চাই। তবুও থামেনি সে। এক NGO-তে কিছু কাজ জুটিয়ে নিয়েছিল—গ্রামে গিয়ে ছোটদের পড়ানো, স্বাস্থ্যবিধি শেখানো, পোলিও ক্যাম্পে সাহায্য করা—এই সব কাজের বিনিময়ে সামান্য টাকা পেত।

কলেজে ভর্তি হয়ে এক নতুন জগতে প্রবেশ করল শিউলি। কিন্তু তার দিন কখনও অন্যদের মত ছিল না। সকালে ভাইদের নিয়ে ব্যস্ততা, তারপর কলেজে দৌড়, বিকেল-সন্ধে টিউশন, আর রাত করে ফিরেই পড়াশোনা। অনেক সময় বিদ্যুৎ থাকত না। মোমবাতি জ্বেলে পড়তে হত। খালি পেটে ঘুমোতে হত কোনোদিন, কারণ চাল ছিল না। কিন্তু নিজের স্বপ্নটাকে সে মরতে দেয়নি। শিক্ষক হতে হবে—এই ছিল সংকল্প। সমাজকে কিছু দিতে হবে—এই ছিল লক্ষ্য।

বন্ধুদের মধ্যে অনেকে জানত না তার এই যুদ্ধের কথা। কলেজে তার চোখে কখনও ক্লান্তি দেখা যেত না, মুখে হাসি লেগেই থাকত। কেউ কেউ বলত, “তুই কি কোনো সমস্যা ছাড়া জন্মেছিস?” অথচ ভিতরে ছিল ঝড়। তার সেই হাসি ছিল নিজের দুর্বলতাকে আড়াল করার রক্ষা কবচ।

ধীরে ধীরে কলেজ জীবন শেষ করল সে। ফাইনাল ইয়ারে ছিল সবচেয়ে কঠিন সময়। তখন একদিকে চাকরির পরীক্ষা, অন্যদিকে ভাইদের মাধ্যমিক, মায়ের অসুস্থতা। কিন্তু জীবন তাকে শিখিয়েছিল—চাপের মধ্যেই আলো খুঁজে নিতে হয়। সেই সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত যেন আগুনের মধ্যে দিয়ে হাঁটা। কিন্তু শিউলি কখনও পিছিয়ে যায়নি। শিক্ষিকার চাকরির জন্য পরীক্ষা দিল, প্রশিক্ষণ নিল, আর একদিন খবর এল—সে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার এক সরকারি প্রাথমিক স্কুলে চাকরি পেয়েছে।

সেই খবর শুনে মা কেঁদে ফেলেছিলেন। প্রতিবেশীরা একে একে এসে অভিনন্দন জানিয়েছিল। ছোট ভাইয়েরা আনন্দে দৌড়ে এসেছিল বোনকে জড়িয়ে ধরতে। গ্রামের মাস্টারমশাই বলেছিলেন, “তুই শুধু নিজের জন্য নয়, আমাদের গ্রামের মেয়েদের জন্যও উদাহরণ।”

বাবার মৃত্যুর পর সেই সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়েছিল যে সংগ্রাম, সেই পথ ধরে শিউলি আজ নিজেকে গড়ে তুলেছে। তার মধ্যে নেই কোনও গর্ব, নেই বাহুল্য। কিন্তু আছে এক অদম্য শক্তি, যা তাকে দাঁড় করিয়েছে এক অন্য উচ্চতায়।

এই অধ্যায়ের শেষে শিউলি বসে থাকে এক বিকেলের শান্ত আলোয়, বারান্দার চৌকাঠে। তার চায়ে চুমুক দিতে দিতে সে ভাবে—“বাবার সেই কথা, আজও আমায় চালায়… ‘তুই পারতেই হবে।’”

মায়ের মৃত্যুর খবরটা শিউলির জীবনের আরেকটা অন্ধকার অধ্যায় খুলে দিয়েছিল। তখন সে কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। সেই সময়টায় সংসার, কলেজ, টিউশন আর নিজের মানসিক শক্তিকে একসাথে টেনে নিয়ে চলার দায়িত্ব ছিল পুরোপুরি ওঁর কাঁধে। বাবা তো আগেই চলে গিয়েছেন। মা ছিলেন একমাত্র মানসিক ভরসা, সেই ভরসাটাও চলে গেল।

মা চলে যাওয়ার পর, ঘরের পরিবেশটাই যেন একলাফে আরও নিস্তব্ধ হয়ে উঠেছিল। ঘরে তখন বিকাশের বয়স বারো, রাজীবের দশ। ছোট ছোট দুই ভাইয়ের চোখে একধরনের ভয়, নির্ভরতার অভাব স্পষ্ট ছিল। শিউলি বুঝে গিয়েছিলেন, এই ঘরটা, এই সংসারটা, এই দুই ভাইয়ের ভবিষ্যৎ সব এখন তাঁরই উপর নির্ভর করছে।

শিউলি সকালবেলা উঠেই রান্না করতেন—ভাত, ডাল, একটা সবজি আর কচিকাঁচাদের জন্য আলাদা ডিম বা ডালনা। ভাইদের মুখে একটুখানি হাসি এনে দিতে পারলে তাঁর নিজের ক্ষুধা যেন কিছুটা কমে যেত। তারপর ভাইদের স্কুলের ব্যাগ গুছিয়ে দিয়ে নিজেও ছুটতেন কলেজে। কিন্তু প্রতিদিন ক্লাসে থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব হত না। তাই তিনি বন্ধুদের কাছ থেকে নোটস জোগাড় করতেন, লাইব্রেরিতে বসে নিজে নিজে পড়ে নিতেন, আর রাতে আলো নিভিয়ে ভাইদের পাশেই বসে নিজের খাতা খুলতেন।

কলেজে তাঁর মতো এমন মেয়েরা খুব কম ছিল। বেশিরভাগের পরিবার ছিল স্বচ্ছল, আর যারা স্বচ্ছল না, তারা মাঝপথেই পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। কিন্তু শিউলির মধ্যে যেন এক অদ্ভুত ধৈর্য ছিল। সে জানত, আজ যদি সে নিজেকে ধরে রাখতে পারে, তবে কাল সে নিজের ভাইদের জীবন গড়ে দিতে পারবে।

মায়ের মৃত্যুর পর পাড়ার লোকেরা সাহায্য করেছিল কিছুদিন। একজন প্রতিবেশী মাসিমা দুপুরে দুটো রুটি পাঠিয়ে দিতেন শিউলির জন্য। পাড়ার মাস্টারমশাই হরিদাসবাবু বলেছিলেন, “তুই চাইলেই আমার মেয়েকে পড়াতে পারিস। আমি মাসে চল্লিশ টাকা দেবো।” সে টাকাটা নিয়ে শিউলি ভাইদের জন্য বই আর খাতা কিনেছিল।

একটা NGO-তে কাজ করতেন শিউলি, যেখানে বাচ্চাদের আঁকা শেখানো হতো, বয়স্ক মহিলাদের সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। ওখান থেকে পাওয়া সামান্য টাকাটা দিয়েই সংসারের বাজার চলত। নিজের জামাকাপড় কখনো নতুন কেনেননি। পাড়ার দিদির পুরনো শাড়ি আর চুড়িদারেই তাঁর চলত।

বিকাশ একটু বড় হতেই সে নিজেই স্কুলের পর পাড়ার এক চায়ের দোকানে বসত, সেখান থেকে মাসে পঁচিশ টাকা পেত। রাজীব বাড়ির কাছের এক পানের দোকানে খবরের কাগজ বিলি করত। এইভাবে তিনজনে মিলেই গড়েছিল ছোট একটা পরিবারের একটানা বেঁচে থাকার ইতিহাস।

বেশ কয়েক বছর পরে, বিকাশ যখন হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করল, তখন শিউলি তাঁকে বলেছিল, “তুই যদি ইচ্ছে করিস, বিএসএফে যেতে পারিস।” বিকাশ অবাক হয়ে বলেছিল, “দিদি, আমি পারবো?” — শিউলি কাঁধে হাত রেখে বলেছিল, “আমরা কেউই কিছু পারতাম না রে। পারতে শিখেছি কেবল একটাই কারণে—কারণ আমরা হেরে যাইনি।”

তারপর বিকাশ ফর্ম ফিল আপ করল, রানাঘাটে ট্রেনিং দিল এক বছর, আর সেখান থেকে সে চণ্ডীগড় চলে গেল। কয়েক মাস পর একদিন চিঠি এল—”দিদি, আমি এবার বিএসএফে জয়েন করছি। তুমি গর্ব করো আমার ওপর।” — শিউলি সেই চিঠি বুকের মধ্যে চেপে ধরে বলেছিলেন, “তোর গর্বই তো আমার সব।”

রাজীবও তখন উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছে। টিউশন করে, কিছু বৃত্তি পেয়েও চালাচ্ছে। তারপর একদিন, সে ব্যাংকের পরীক্ষা দিল আর চাকরি পেয়ে গেল এক জাতীয়কৃত ব্যাংকে। সেই দিন রাজীব বলেছিল, “দিদি, আজ তুই চাকরি করিস না হলেও চলবে। আমি আছি।” — কিন্তু শিউলি তখনই একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি পেয়ে গেছেন। গ্রামেরই এক স্কুল। বলেছিলেন, “আমার কাজই আমার পরিচয়। আমি চালিয়ে যাবো।”

ভাইয়েরা কখনো দিদির অবদান ভুলে যায়নি। প্রতি রাখি পূর্ণিমায় তারা এখনো বাড়ি আসে, দিদির হাতে রাখি বাঁধে, নতুন শাড়ি দেয়। শিউলি চোখে জল নিয়ে হাসেন, বলেন, “তোমরা আমার গর্ব, আমার ছায়া।”

তবে নিজের ব্যক্তিগত জীবনের জায়গায় তিনি যেন সবসময়ই একা। একসময় পাড়ার লোকেরা, আত্মীয়স্বজনরা অনেক কথা বলত, “বিয়ে করিসনি কেন রে? এতদিন একা একা কীভাবে থাকিস?” — শিউলি কেবল হেসে বলতেন, “জীবনটাই তো আমার সঙ্গী। ভালোবাসা মানেই যে কোনো মানুষ হবে, এমন তো নয়। আমি ভালোবাসি আমার ভাইদের, আমার ছাত্রছাত্রীদের, আমার স্কুলঘরকে। ওরাই আমার সংসার।”

তাঁর এই একাকীত্বের মধ্যেও কোথাও যেন পূর্ণতা আছে। প্রতি সন্ধ্যায় স্কুল থেকে ফিরে তিনি এক কাপ চা করে বারান্দায় বসেন, শালবনের ফাঁকে সূর্য ডুবে যাওয়া দেখেন। পাশের বাড়ির ছোট্ট টুকাই এসে বলে, “শিউলি দিদিমণি, গল্প শোনাবে?” — শিউলি তখন গল্প শোনান—ভালবাসার গল্প, হার না মানা মেয়েদের গল্প, আর সেইসব জীবনের গল্প যেখানে সাহস মানে না শুধু রক্ত, না শুধু চোখের জল, বরং জীবনের প্রতিটা বাঁককে শক্ত করে ধরে থাকা।

আজ শিউলি পঁয়তাল্লিশ। তিনি কখনো বিয়ে করেননি, কোনোদিন কারোর হাত ধরে চলেননি, কিন্তু তবু তিনি একজন জীবন্ত ইতিহাস। যিনি শিক্ষা দিয়েছেন, স্বপ্ন দেখিয়েছেন, আর দেখিয়েছেন কীভাবে একা এক পথ চলা যায়, যেখানে গন্তব্য নয়—চলার পথটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।

কলেজে পড়ার সময় শিউলির জীবনে একটা নতুন রঙ লেগেছিল। দিনের পর দিন শুধু সংগ্রাম, দায়িত্ব, আর বাস্তবের ধাক্কা সামলাতে সামলাতে তার ভেতরের কিশোরী মেয়েটা যেন হারিয়েই গিয়েছিল। কিন্তু প্রথম বর্ষের ক্লাসে দেখা হয়েছিল সৌম্যর সঙ্গে। কলকাতার একটি স্বনামধন্য কলেজে বাংলায় অনার্স পড়তে এসেছিল শিউলি। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার গ্রাম থেকে প্রথমবার শহরে এসে পড়া—তা নিজেই এক নতুন অভিজ্ঞতা। আর সেই নতুন শহরের গা-ছোঁয়া আলোয় সৌম্যর মতো একজন বন্ধুর উপস্থিতি ছিল যেন এক চিলতে মেঘের আড়ালে সূর্যের ঝলকানি।

সৌম্য ছিল একেবারে অন্যরকম। অন্যান্য ছেলেরা যেমন হইচই করত, শ্রেণীকক্ষে দুষ্টুমি করত, কিংবা ফাঁকা পিরিয়ডে ক্যান্টিনে আড্ডা মারত, সৌম্য ঠিক তেমন ছিল না। তার চোখে ছিল গভীরতা, কথায় ছিল সহানুভূতি। ক্লাসের ফাঁকে সে গল্প করত জীবন নিয়ে, বই নিয়ে, সমাজ নিয়ে। সে কবিতা লিখত, আর কবিতার মধ্যেই যেন প্রকাশ পেত তার ভেতরের আলো-আঁধারি অনুভব। শিউলির সঙ্গে তার প্রথম আলাপ হয় কলেজ লাইব্রেরিতে। দুজনেই সুকুমার রায়ের বই খুঁজছিল। এক বইয়ের খোঁজে দেখা হয়ে গিয়েছিল এক নতুন বন্ধুর।

সেই বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতায় রূপ নেয়। কলেজ শেষে দুজনেই মাঝেমাঝে পার্ক স্ট্রিটের এক ছোট্ট কফির দোকানে গিয়ে বসত। দুজনে মিলে কফি খেতে খেতে স্বপ্ন দেখত—গ্রামের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা শেখানো, একদিন গ্রামে ফিরে গিয়ে একটা এনজিও খোলা, স্কুলে বাচ্চাদের সৃজনশীলতা শেখানো ইত্যাদি। সৌম্য মাঝে মাঝে বলত, “শিউলি, তোকে দেখে আমি সাহস পাই। এত কিছু সামলাচ্ছিস, তবু এত শান্ত, এত মাটির কাছাকাছি।” শিউলির চোখ ঝলমল করে উঠত তখন। সে নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করছিল—একজন নারী হিসেবে, একজন স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে, একজন মানুষ হিসেবে।

তাদের বন্ধুত্বে ছিল নির্ভরতা, ছিল নীরব অনুভবের এক অদৃশ্য বন্ধন। আর সেই বন্ধনের গভীরতা প্রথম প্রকাশ পেল এক বসন্ত বিকেলে, যখন কলেজের বার্ষিক সাহিত্য সভার পর কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে সৌম্য বলেছিল, “শিউলি, তুই চাইলে আমি তোর পাশে থাকতে চাই, সবসময়। শুধু বন্ধু হিসেবে নয়, জীবনের সঙ্গী হয়ে।”

শিউলি চমকে উঠেছিল। তার চোখে জল এসে গিয়েছিল, ঠোঁট কাঁপছিল। মনে হয়েছিল, এক মুহূর্তের জন্য জীবন যেন তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই এক অনুশোচনার ঢেউ এসে সব ঢেকে দিল। সেই মুহূর্তে তার মনের পর্দায় ভেসে উঠেছিল ভাইবোনদের মুখ, মায়ের মুখ, দায়িত্বের ভারে কুঁজো হয়ে যাওয়া নিজের ভবিষ্যৎ।

“সৌম্য,” শিউলি বলেছিল ধীরে, “তুই খুব ভালো। আমি তোকে অপমান করতে চাই না। কিন্তু আমি তো একা নই। আমার সঙ্গে আছে আমার সংসার, আমার ছোট ভাইবোনদের দায়িত্ব। তোর সঙ্গে থাকলে তোকেও সেই বোঝা টানতে হবে। আর সেটা তো ঠিক হবে না, তাই না?”

সৌম্য চুপ করে গিয়েছিল। সে বুঝেছিল শিউলির কথা। তার চোখে ছিল এক অদ্ভুত প্রশ্রয়, কিন্তু সেই প্রশ্রয়ের আড়ালেই ছিল গভীর কষ্ট।

এরপর আর সৌম্য আসেনি। ক্লাসে আসত ঠিকই, কিন্তু শিউলির সঙ্গে আর চোখে চোখ মেলাত না। তাদের দেখা হত, কিন্তু কথা হত না। ধীরে ধীরে তাদের মাঝের সেই আবেগের সেতু ভেঙে পড়ে। কলেজ শেষ হয়, শিউলি নিজের পথে চলে যায়। চাকরির খোঁজে, জীবনের সংগ্রামে আবার ডুবে যায় সে। সৌম্যর সঙ্গে আর কোনোদিন তার দেখা হয়নি। কোথায় আছে সে, কী করছে, বিয়ে করেছে কি না—সবই এখন রহস্য।

তবু কোনো কোনো সন্ধেয়, যখন শিউলি জানলার ধারে বসে চা খায়, বা যখন ক্লান্তিতে চোখ বুজে থাকে, তখন হঠাৎ সৌম্যর মুখ ভেসে ওঠে। মনে পড়ে সেই কথাগুলো—“তুই চাইলে আমি তোর পাশে থাকতে চাই…”। শিউলি তখন হালকা হেসে ফেলে। বলে, “ভালো থেকো, সৌম্য। তুই থাকিস নিজের মতো, তুই তো ভালোবাসতে জানিস।”

এই ভালোবাসাটুকুই শিউলির মনে রয়ে গেছে। তার কোনো নাম নেই, কোনো সামাজিক স্বীকৃতি নেই, কিন্তু তবু সে একান্ত নিজস্ব। জীবনের একান্ত এক কোণে রাখা সযত্নে রাখা এক টুকরো স্মৃতি।

শিউলি জানে, জীবনের পথে চলার সময় সবাই সঙ্গে থাকে না। কেউ কেউ আসে, একটুখানি পাশে হেঁটে আবার হারিয়ে যায়। কিন্তু তবু তাদের স্পর্শ থেকে যায়, তাদের বলা কথা থেকে যায়। সেই কথা, সেই চোখের ভাষা হয়তো একা পথ চলার সাহস দেয়।

আর শিউলি, সে তো সেই সাহসেই বাঁচে, সেই সাহসেই বেঁচে থাকে।

শীতকাল। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার প্রান্তিক গ্রাম এখন ধূলিধূসরিত রোদে নরম হয়ে আসে। গ্রাম্য রাস্তার ধারে শুকনো পাতার গন্ধ, বাঁশবনের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি মারে দুপুরবেলার কুয়াশা। শিউলি এখনো সেই একই স্কুলে পড়ান, যেখানে তিন দশকের বেশি সময় ধরে তিনি একনিষ্ঠভাবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ছাত্রছাত্রীরা তাঁকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। কিন্তু আজকের দিনটা অন্যরকম।

সকালে স্কুলে পৌঁছেই হেডস্যার তাঁকে একটি খাম দেন। ভিতরে একটি চিঠি—একটি NGO-এর তরফ থেকে আমন্ত্রণপত্র। আগামী সপ্তাহে কলকাতায় একটি জাতীয় স্তরের শিশু ও নারী শিক্ষা নিয়ে সম্মেলন। সেখানেই তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে—’একজন সংগ্রামী, প্রান্তিক নারী শিক্ষিকা হিসেবে’—জীবনের অভিজ্ঞতা শোনানোর জন্য। চিঠির নিচে নাম—’সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়, কর্মসূচী সমন্বয়কারী, চাইল্ডহ্যাভেন ইন্টারন্যাশনাল’।

নামটা দেখে শিউলির হাত কেঁপে ওঠে।

সৌম্য?

চোখ বুজলেই ভেসে ওঠে সেই কলেজের দিনগুলো। এক চুপচাপ, চিন্তাশীল ছেলে, যার চোখে ছিল স্বপ্ন, মুখে ছিল একরাশ নরম ভাষা। আর ছিল গভীর এক বন্ধুত্ব, আর একটুখানি ভাঙা ভালোলাগা—যা আজও সময়ের ধুলোর নিচে চাপা পড়ে যায়নি।

তিনি চিঠি বার বার পড়েন। শিউলি নিশ্চিত হন, এই সৌম্য সেই কলেজের সৌম্যই। ক’দিন ধরে একটা অদ্ভুত উত্তেজনা আর দ্বিধা নিয়ে কাটে তাঁর সময়। যাবেন? না যাবেন না? অনেক ভেবে তিনি রাজি হন। নিজের জীবনের প্রতিটি অধ্যায় যে সংগ্রামের, তা যদি নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করতে পারে, তাহলে একবার সেই পুরনো বন্ধুটিকেও দেখে নেওয়া যাক।

কলকাতা, সম্মেলনের দিন। গরম জামার ভিতর শিউলির শরীরটা একটু থরথর করছে। শীত নয়, বরং স্মৃতি আর অচেনা আলোয় ভরা সেই পুরোনো শহরের উত্তেজনা। শিশু ভবনের এক বিশাল মিলনকেন্দ্রে অনুষ্ঠান। দর্শকদের মাঝে নানা রকম মুখ, কেউ শিক্ষক, কেউ সমাজকর্মী, কেউ স্কুলের বাচ্চা। সবার মধ্যে বেশ ক’জন বিদেশি প্রতিনিধি।

বক্তৃতার আগে তাঁকে একটি কক্ষে বসতে বলা হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজা খুলে কেউ ঢোকে। শিউলি মাথা তুলে দেখেন—একটি মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন, চোখে ফ্রেমের চশমা, গলায় ল্যামিনেটেড কার্ড, পরনে উজ্জ্বল নীল কুর্তা। মুখে একরাশ বিস্ময় আর নরম হাসি—সৌম্য।

“তুই—” শিউলির কণ্ঠ যেন কোথাও হারিয়ে যায়।

“হ্যাঁ, আমি। জানতাম না তুই আসবি কি না। কিন্তু চিঠিটা লিখেই শান্তি পেলাম। তুই এসেছিস দেখে মনে হচ্ছে, এখনও সময়টা হারায়নি,”—সৌম্যর গলায় একরাশ আবেগ।

তারপর কথা হতে থাকে। পুরোনো দিনের মতোই—কিন্তু এখন অনেকটা পরিণত, অনেকটা শান্ত। সৌম্য জানায়, শিউলির সেই সিদ্ধান্ত, সেই আত্মত্যাগ—তাঁর জীবনের অন্যতম মোড় ঘোরানো ঘটনা।

“তুই যেদিন বললি, ‘তুই খুব ভালো, কিন্তু আমার সংসার আছে’, আমি অনেক কেঁদেছিলাম শিউলি। কিন্তু তোর কথাটা মাথা থেকে যাচ্ছিল না। তোকে হারিয়ে আমি নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলাম। ভাবলাম, যদি তোকে পাবো না, তাহলে তোকে নিয়ে স্বপ্নগুলো তো বাঁচিয়ে রাখতে পারি। সেই থেকেই আমি এই কাজগুলো শুরু করি।”

শিউলি চুপ করে থাকেন। চোখের কোণে এক ফোঁটা জল জমে। তার মুখে এক নরম হাসি।

“সৌম্য, আমি তো ভেবেছিলাম, তুই রেগে গেছিস। কতবার মনে হয়েছে, হয়তো ভালোবাসাটা একটু একটু করে তোর জীবনেও ভেঙে গেছিল।”

“ভাঙে তো! কিন্তু ভাঙা জায়গা দিয়েই তো আলো আসে, তাই না?”—সৌম্যর মুখে সেই পুরোনো আলোর রেখা।

সেদিন শিউলি যখন মঞ্চে উঠে নিজের গল্প বলেন—তাঁর কন্ঠে ছিল না কোনো দম্ভ, ছিল কেবল সত্য। বলেছিলেন, “আমি কোনওদিন ভাবিনি, বাঁচার এই যুদ্ধটা আমায় একদিন সম্মান এনে দেবে। আমি কেবল করেছিলাম আমার কর্তব্য। কিন্তু আমার মতো হাজার শিউলি আছে, যারা এখনও লড়ছে। তাদের গল্প শোনাতে, তাদের পাশে দাঁড়াতে—আজ আমি এসেছি।”

অডিটোরিয়ামে তখন এক নৈঃশব্দ্যের ঢেউ। তারপর একটানা করতালি।

সৌম্য পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। চোখে জল নিয়ে।

সেদিনের শেষে, গাড়িতে চেপে ফিরছিলেন শিউলি। শহরের আলো তখন ধীরে ধীরে ফিকে হচ্ছে। পাশের সিটে সৌম্য। কথা হয় না বেশি। শুধু সৌম্য বলেন, “শিউলি, তুই যদি চাস, আমি তোর পাশে আবার থাকতে পারি। নাহ, বোঝা নয়। একসাথে হাঁটার কথা বলছি।”

শিউলি জানেন না, তাঁর জীবনের একাকীত্বে এই আলো আসবে কি না। শুধু জানেন, চলতে চলতে এমন একটা বাঁক আসতে পারে—যেখানে পুরোনো কারো হাতটা আবার নিজের দিকে বাড়িয়ে দেওয়া যায়। অন্তত সাহসটুকু যেন থাকে।

পুনর্মিলন কখনও কখনও ঠিক সময়েই আসে, আবার কখনও আসে অনেক দেরিতে—ঠিক যখন জীবনের অনেকখানি পথ পার হয়ে গেছে, কাঁধে জমে উঠেছে ক্লান্তির ধুলো, আর মনের ভিতরে গড়ে উঠেছে এক নিঃশব্দ উপত্যকা। কিন্তু শিউলি ও সৌম্যের ক্ষেত্রে এই পুনর্মিলন যেন একটা নতুন সূর্যোদয়ের মতো ছিল।

সেই দিনটির কথা এখনও শিউলির মনে অম্লান। স্কুলের মঞ্চে নিজের জীবনের কথা বলতে বলতে যখন তিনি থেমে গেলেন, তখন সামনে বসা সৌম্যর চোখেও ছিল জল। অনুষ্ঠান শেষে সৌম্য কাছে এসে দাঁড়ায়, মাথা নোয়ায় এক পুরনো শ্রদ্ধায়। শিউলি প্রথমে কিছু বলতে পারেন না। শুধু চুপ করে দেখেন সেই চেনা মুখটাকে—যে মুখ একদিন বুকের মধ্যে জমে থাকা স্বপ্নগুলোর মতোই হঠাৎ মিলিয়ে গিয়েছিল।

“অনেকদিন পর,” সৌম্য মৃদু স্বরে বলেছিল।

শিউলি হাসেন, সেই পুরনো নরম হাসি। “হ্যাঁ, অনেক অনেক দিন।”

তারপর এক কাপ চা খেতে বসা। গ্রামের সেই নতুন খোলা চায়ের দোকানে, সন্ধের আলোয় আধো অন্ধকারে বসে তারা ফিরে তাকায় সেই পুরনো কলেজ জীবনের দিকে। কেমন করে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল, কেমন করে দুজনে মিলে স্বপ্ন বুনেছিল গ্রামের শিক্ষা নিয়ে, শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। এবং কেমন করে সেই বন্ধুত্ব একদিন হঠাৎ থেমে গিয়েছিল।

সৌম্য এবার আর কিছু লুকোয় না। “তোর উত্তরটা শুনে আমি বুঝেছিলাম—তুই যা করছিস, সেটা শুধু নিজের জন্য না, একটা গোটা ভবিষ্যতের জন্য। আমি পেছনে টানতে চাইনি তোকে। কিন্তু তোর অনুপ্রেরণায় আমি নিজে পথ খুঁজে পেয়েছিলাম।”

সেই সন্ধ্যাটা শেষ হয় অনেক কথার আদানপ্রদান দিয়ে। তারা ঠিক করে, এবার থেকে যোগাযোগ রাখবে। সেই সিদ্ধান্ত জীবনের নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করে।

প্রথমে চিঠি চালাচালি শুরু হয়। দুজনেই খুব যত্ন করে লিখত সেই চিঠিগুলো—শুধু খবরের জন্য নয়, বরং অনুভবের জন্য। শিউলি লিখত ছাত্রছাত্রীদের কথা, স্কুলে ঘটে যাওয়া ছোটখাটো মুহূর্তের কথা, গ্রামের শালবনের শান্ত বাতাসে ভেসে আসা পাখির কুহুতার কথা। সৌম্য লিখত তার বিদেশ ভ্রমণ, শিশুদের জন্য বিভিন্ন প্রকল্পের কথা, আর মাঝে মাঝে নিজের নিঃসঙ্গতার কথা—যেটা সে বুঝেছে শিউলিকে না পেয়ে।

একদিন, সৌম্য লিখেছিল, “জীবনের অনেক কিছুই পেয়েছি, কিন্তু তুই আমার জীবনের সেই অসমাপ্ত কবিতা, যেটা আমি শুধু অনুভব করেছি—পড়তে পারিনি কখনও।”

শিউলি উত্তর দিয়েছিল, “সব কবিতা বুঝে পড়া যায় না সৌম্য। কিছু কবিতা শুধু লেখা হয় মনের ভিতরে, শব্দহীনভাবে।”

এভাবেই কাটতে থাকে দিন। ফোনে কথাবার্তা শুরু হয়, কখনও কখনও ভিডিও কল। সৌম্য যখন শহরে আসে, এক-আধদিনের জন্য গ্রামে এসে দেখা করে। দুজনেই জানত, সময় বদলেছে, বয়স বেড়েছে, চেহারায় রেখা পড়েছে, কিন্তু সম্পর্কের এক নিরবিচার আন্তরিকতা এখনও রয়ে গেছে।

একদিন বিকেলে, স্কুলের পর শিউলি যখন নিজের বাগানে বসে বই পড়ছিলেন, সৌম্য এলেন। হাতে ছোট্ট একটি ক্যাকটাস গাছ, বলল, “তোর জন্য এনেছি—এই গাছটা যেমন কঠোর অবস্থায়ও টিকে থাকে, তুইও তেমন।”

শিউলি হেসে বললেন, “তবে তুমি কি সেই মরুভূমির বৃষ্টি?”

সৌম্য একটু থেমে বলল, “হতে পারি, যদি তুই চাস।”

তাদের এই পরিণত বন্ধুত্বের মাঝে কোনও চঞ্চলতা ছিল না, ছিল না অস্থিরতা—ছিল এক নিঃশব্দ সম্মতি, এক ধরনের নির্ভরতা, যেটা সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে জন্ম নেয়।

একদিন রাতে ফোনে সৌম্য জিজ্ঞেস করল, “তুই এখনও একা থাকিস কেন?”

শিউলি বলল, “জীবনের অনেক কিছু একা কাটিয়ে ফেলেছি। এখন তো একা থাকার অভ্যাস হয়ে গেছে। তবে তুই থাকলে মন্দ লাগবে না।”

সৌম্য বলল, “তুই চাইলে আমি আবার তোর পাশে আসতে পারি। এবার শুধু বন্ধু হয়ে নয়, একজন সঙ্গী হয়ে।”

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে শিউলি। তারপর বলে, “সঙ্গী তো অনেক আগে থেকেই ছিলি। এবার শুধু সময় এসেছে সেটা মেনে নেওয়ার।”

এইভাবে তাদের জীবন এক নতুন দিকে মোড় নেয়। তারা কোনও ঘোষণা করেনি, কোনও শোরগোল করেনি। শুধু একসঙ্গে পথ চলতে শুরু করেছে—যেখানে কোনও আক্ষেপ নেই, নেই অতীতের ভার—আছে কেবল ভবিষ্যতের এক নরম আলো।

শিউলির জীবনসঙ্গী ছিল তার নিজের সংগ্রাম, তার দায়িত্ব। এবার সেই সঙ্গীতের মাঝে সৌম্যর শান্ত স্বর জুড়ে গেল—একটি পরিপূর্ণ সুর হয়ে।

টুম্পা—একটা নাম, এক আশার প্রতীক, এক সময়কার সেই ছোট্ট খুকি, যে প্রতিদিন কাঁচা পায়ে হেঁটে স্কুলে আসত। গায়ের রঙ শ্যামলা, চোখে চিরন্তন কৌতূহল, আর মুখে একরাশ আত্মবিশ্বাস। তার মা স্থানীয় একটি ইটভাটায় কাজ করত, বাবা ছিল না। সংসারে অভাবের তীব্রতা এতটাই যে, অনেক সময় দুবেলা খাওয়াও জোটত না। তবুও টুম্পা নিয়মিত স্কুলে আসত, বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে বসে থাকত। তার চোখের চাহনিতে ছিল স্বপ্নের দীপ্তি।

শিউলি তখনই বুঝেছিলেন, এই মেয়েটির মধ্যে আলাদা কিছু আছে। তার চোখে যে দৃঢ়তা, তা কোনো সাধারণ শিশুর নয়। তিনি কাছে টেনে নিয়েছিলেন টুম্পাকে, একটু একটু করে বোঝাতে শুরু করেছিলেন শিক্ষা মানে কী, জীবন মানে কী। তিনি জানতেন, এই মেয়েটিকে যদি ধরে রাখা যায়, যদি তাকে পথ দেখানো যায়, তবে সে একদিন অনেকদূর যাবে।

প্রথম দিকে টুম্পা পড়াশোনায় খুব একটা ভালো ছিল না। কিন্তু শিউলি কখনও তাকে তিরস্কার করতেন না। বরং তিনি পাশে বসে ধৈর্য নিয়ে বোঝাতেন—অক্ষরের মাধুর্য, শব্দের গঠন, ইতিহাসের গল্প, কবিতার অনুভব। ধীরে ধীরে টুম্পা বদলে যেতে শুরু করল। দ্বিতীয় শ্রেণিতে যখন সে প্রথম শ্রেণিতে উঠল, তখন পরীক্ষায় প্রথম হয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছিল।

তারপর একে একে সময় কেটে গেল। টুম্পার মা চেয়েছিলেন মেয়েটি ছোট থেকেই কাজে লেগে যাক, কিছু আয় হোক, সংসারে সাহায্য হোক। কিন্তু শিউলি রোজ সন্ধেবেলা গিয়ে কথা বলতেন তাঁর সঙ্গে। বলতেন, “ওর চোখে যে আলোর রেখা আমি দেখেছি, তা মাটির ওপরের ধুলোয় ঢেকে দিলে চলবে না। বরং সেই আলো দিয়েই পথ আলোকিত হবে।”

একদিন টুম্পা নিজেই বলেছিল, “দিদিমণি, আমি মাস্টারমশাই হতে চাই। আপনার মতো পড়াতে চাই। আমার মতো মেয়েদের বড় হতে সাহায্য করতে চাই।”

সেই কথা শিউলির মনে গেঁথে গিয়েছিল। এরপর মাধ্যমিকে ভালো ফল, উচ্চমাধ্যমিকে সম্মানজনক নম্বর, তারপর কলেজে ভর্তি হওয়া—এই সবগুলো ধাপেই শিউলি পাশে ছিলেন ছায়ার মতো। কোনোদিন কাকডাকা ভোরে তাকে নিয়ে কলেজের ভর্তি ফর্ম জমা দিতে যাওয়া, কোনোদিন হোস্টেল খুঁজে বের করা, আবার কোনোদিন পরীক্ষার আগে গভীর রাত পর্যন্ত টেলিফোনে সাহস জোগানো—সবটাই করে গেছেন নিঃশব্দে, নিঃস্বার্থভাবে।

এখন টুম্পা কলকাতার একটি সরকারি কলেজে বাংলা বিভাগে পড়ছে। বছর দুই পরেই এম.এ করবে। স্বপ্ন দেখে স্কুলে পড়াবে, গ্রামে ফিরে মেয়েদের শিক্ষিত করবে, যেন কেউ আর কচিকাঁচা বয়সে স্কুল ছেড়ে না দেয়।

প্রতি মাসে একবার সে গ্রামের বাড়িতে আসে। আর এলেই ছুটে যায় প্রিয় দিদিমণির কাছে। একদিন বিকেলে স্কুলের মাঠে বসে টুম্পা বলেছিল, “দিদিমণি, আপনি না থাকলে আমি এতদূর আসতেই পারতাম না।”

শিউলি একটু হেসে মাথায় হাত রেখেছিলেন, “তুই যে আমার স্বপ্ন, মা। তোর জন্যেই তো আমি আছি।”

সেই সন্ধেয় মাঠে বসে দু’জনে অনেক কথা বলেছিল। টুম্পা বলেছিল তার কলেজের বন্ধুদের কথা, শিক্ষকদের কথা, পছন্দের কবিতার কথা। শিউলি চুপচাপ শুনেছিলেন। চোখে একটানা তাকিয়ে ছিলেন মেয়েটার মুখের দিকে—যার মুখে এখন আত্মবিশ্বাস, যার কথায় লক্ষ্য আছে, যার চোখে জ্বলজ্বল করে ভবিষ্যতের দীপ্তি।

শিউলি জানতেন, তাঁর জীবন সংগ্রামের এই জয়টুকুই সবচেয়ে বড় পুরস্কার। একটা ছোট্ট অঙ্কুর থেকে এক মহীরুহ হয়ে ওঠা টুম্পার মাঝে যেন তিনি নিজের উত্তরসূরি দেখতে পান। এবং সেই অনুভবই তাঁকে চালিয়ে নিয়ে যায় আরও বহু সন্তানের কাছে, আরও বহু ভবিষ্যতের কাছে।

শিউলির জীবন কেবল নিজের ছিল না কখনও, সে ছিল সকলের। আর টুম্পা যেন ছিল সেই স্বপ্ন, যার মধ্যে দিয়ে নিজের সব না-পাওয়া পূর্ণতা খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি।

বছর গড়িয়ে চলেছে সময়ের নিয়মে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সেই ছোট্ট গ্রামে শিউলির জীবনও তার নিজস্ব গতিতে এগোচ্ছে। সময় যেন কখনও গলা জড়িয়ে ধরে, আবার কখনও একলা ফেলে দেয়। তবুও, শিউলি ছিলেন তাঁর মতো করে, সবার চেনা, শ্রদ্ধেয় “দিদিমণি”। যিনি শুধু বইয়ের পাতা শেখান না, শেখান মানুষ হয়ে বাঁচার মন্ত্র।

বয়স তো আর চুপ করে থাকে না। তা পায়ের জোর কমায়, চোখের দৃষ্টি ধোঁয়াটে করে তোলে। আর একদিন হঠাৎই সরকারি কাগজ আসে। অবসর। শব্দটা অনেক সহজ, কিন্তু তার মধ্যে লুকিয়ে থাকে এক জীবন কাটিয়ে দেওয়ার পরিসমাপ্তি। শিউলি কাগজটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। চোখের সামনে ভেসে ওঠে তাঁর প্রথম দিনের স্কুলে যাওয়া, সেই ভাঙাচোরা ভবন, পাকা রাস্তা না থাকা, ছাত্রছাত্রীদের খালি পা, ধুলো-মাটি, আর নিজের দুচোখ ভরা স্বপ্ন।

স্কুলে যে দিনটা তাঁর শেষ কর্মদিবস, সেই দিনটিকে যেন গ্রামের মানুষ ভোলেনি। সকালে স্কুলে পৌঁছাতেই দেখা যায়, গেটের বাইরে থেকে শুরু করে পুরো বারান্দা সাজানো হয়েছে রঙিন কাগজের ফেস্টুনে। ক্লাস ফাইভের ছোট্ট টিটো হাতে একটা ফুলের মালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে টুম্পা, এখন কলেজ পড়ুয়া, সে-ও এসেছে।

সেদিন স্কুলে পড়ানো বন্ধ। পুরোটাই উৎসব। কেউ কেউ গান গায়, কেউ কবিতা পড়ে, পুরনো ছাত্ররাও এসেছেন অনেক দূর থেকে। কেউ এখন বড় অফিসার, কেউ শিক্ষক, কেউ আবার বিদেশে থাকেন। কিন্তু সবার মুখে একই কথা—”আমরা আজ যা কিছু, দিদিমণির জন্যই।”

সেই পুরনো সহকর্মী অনিমেষবাবু মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেন, “শিউলিদি শুধু একজন শিক্ষিকা নন, উনি আমাদের সকলের আশ্রয়। আমি যখন প্রথম স্কুলে যোগ দিই, একটা শব্দ ঠিক করে উচ্চারণ করতে পারতাম না। উনি ধৈর্য ধরে আমাকে শেখাতেন। আজ আমি গর্ব করে বলি, আমি শিউলিদির সহকর্মী ছিলাম।”

শিউলি বসে থাকেন প্রথম সারিতে। চোখে জল, মুখে একটা শান্ত হাসি। চারপাশের এই ভালোবাসা যেন তাঁকে অনেকটা ছোটবেলার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। সেই ক্লাস টেনের ছাত্রী, বাবার মৃত্যুর পর যে মেয়ে ঘাড়ে সংসার নিয়েও পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছিল, আজ সেই মেয়েকে সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান জানাচ্ছে।

শেষে তাঁকে অনুরোধ করা হয় কিছু বলার জন্য। শিউলি উঠে দাঁড়ান। কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন, “আমি আজ কিছুই বলতে পারছি না। শুধু এটুকু বলি, আমি কখনও শিক্ষক হতে চাইনি, হতে বাধ্য হয়েছিলাম। কিন্তু যখন বুঝলাম, এই ছোট ছোট মুখগুলো আমার দায়িত্ব, তখন আর পিছনে ফিরে তাকাইনি। আমি চাই, তোমরা সবাই ভালো মানুষ হও। চাকরি হও না হও, টাকা থাক না থাক, ভালো মানুষ হয়ে ওঠা সবচেয়ে জরুরি। আমার জীবনকে যদি কিছু বলতে হয়, আমি বলব—তোমরা আমার স্বপ্ন ছিলে, আমি শুধু সেই স্বপ্নকে আঁকড়ে বেঁচে ছিলাম।”

চারদিক তখন নিস্তব্ধ। কারও চোখে জল, কেউ আবার হাততালি দেয়। শিউলি জানেন, এই স্কুল তাঁর শরীরের একটা অংশ হয়ে গেছে। অবসর মানে হয়তো আর অফিসের টেবিল থাকবে না, কিন্তু এই ছাত্রছাত্রীরা, এই স্মৃতি, এই মাটির গন্ধ—সবকিছুই তাঁর সঙ্গে থাকবে আজীবন।

উৎসবের শেষে গ্রামের মহিলারা হাতে মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে আসে। “দিদিমণি, আপনি না থাকলে আমাদের মেয়েগুলো পড়তই না। আপনি বারণ না করলে ওদের তো অনেক আগে বিয়ে হয়ে যেত।” — এই কথাগুলো শিউলির বুকটা গরম করে দেয়। তিনি জানেন, এতদিনের পরিশ্রম বৃথা যায়নি।

সন্ধের দিকে বাড়ি ফেরেন তিনি। পায়ে হালকা ব্যথা, হাতে উপহার হিসেবে পাওয়া ফুল আর বই। কিন্তু মনে এক ধরনের প্রশান্তি। এক জীবনের কর্মফল যেন তিনি চোখে দেখতে পাচ্ছেন। দেয়ালে রাখা বাবার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে কপালে হাত ঠেকান। যেন বলছেন, “তোমার দায়িত্ব আমি শেষ করেছি, বাবা।”

রাতে টুম্পা এসে বলেন, “দিদিমণি, আপনি এখন আর স্কুল যাবেন না, ভাবতেই পারছি না।” শিউলি হেসে বলেন, “জীবনে একটা সময় আসে, যখন আমাদের হাত ছেড়ে অন্যদের হাত ধরতে দিতে হয়। তুইও একদিন কারও দিদিমণি হবি, তখন বুঝবি।”

চাঁদের আলোয় সেদিন গ্রামটা যেন একটু বেশি আলো করে থাকে। শিউলির ঘরেও আলো জ্বলে—আত্মতুষ্টির, ভালোবাসার, জীবনের আলো।

অবসরের ঘন্টা বেজে গেছে অনেকদিন। সরকারী চাকরির শেষ দিনে স্কুলের মাঠে দাঁড়িয়ে যখন ছাত্রছাত্রীদের চোখের জলে বিদায় নিয়েছিলেন শিউলি, তখনই ঠিক করেছিলেন—এই থেমে যাওয়া তাঁর নয়। জীবনের এই নতুন অধ্যায় হবে অন্যরকম, আরও আপন, আরও উজ্জ্বল। অবসর মানে তো কাজ শেষ হয়ে যাওয়া নয়—বরং আরও এক নতুন দিশার শুরু।

তিন মাস পর, গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তের একচিলতে টিনের ঘরটায় একটা নতুন নামের প্ল্যাকার্ড ঝোলে—”স্বপ্নশালা”। সাদা কালিতে হাতে লেখা সেই বোর্ড, নিচে ছোট করে লেখা, “শিশু ও কিশোর শিক্ষাকেন্দ্র – শিউলি মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে”। বাড়িরই একটা পুরনো ঘর, যেখানে একসময় চালার নিচে চাল ডাল রাখা হত, পরে ভাইয়েরা আলাদা হয়ে গেলে ঘরটা ফাঁকা পড়ে ছিল। সেখানেই বাঁশের কাঠামোতে কাঠের খাট বসিয়ে, ইট দিয়ে খুঁটি গেড়ে, ছাদে টিন লাগিয়ে শিউলি তৈরি করেছেন তাঁর নতুন স্কুল। স্কুল নয়—স্বপ্নের উঠোন।

প্রথম দিন এসেছিল চারজন। তিনটে বাচ্চা, একটা ছোটো মেয়ে আর তার ভাই, আর একজন কিশোর। নাম তার বাপন। তার বাবার সঙ্গে সে বাজারে যায় সবজি বিক্রি করতে। স্কুলে যাওয়া হয়নি কখনও। কিন্তু হঠাৎ একদিন সন্ধেবেলা স্বপ্নশালার বোর্ড দেখে সে ঢুকে পড়েছিল ঘরে। শিউলি তখন ছাদে দাঁড়িয়ে থাকলেও বাপনের চোখে দেখা গিয়েছিল নির্ভয় কৌতূহল।

“তুই আসবি রোজ?”

বাপন মাথা নেড়েছিল। “হ্যাঁ, দিদিমণি। আমি শিখতে চাই।”

সেই থেকেই শুরু। দিনে দিনে সংখ্যাটা বাড়তে লাগলো। গ্রামের বাচ্চারা প্রথমে কৌতূহলে আসতো, তারপর থেকে যেত। খেলার ছলে শেখানো শিউলির স্টাইল একেবারে আলাদা। তিনি বলতেন, “অ আ ক খ শিখতে হলে প্রথমে শব্দ শুনো, গল্প জানো, তারপর আঁকো। আঁকার মধ্যে দিয়েই তো সবচেয়ে ভালো শেখা যায়।”

সেই ঘরে ছোট ছোট কাঠের ডেস্ক, রঙিন চটের আসন, একটা ব্ল্যাকবোর্ড, কিছু রং পেন্সিল আর শিউলির প্রাণ। দিনের একেকটা সময় একেক গ্রুপের। সকালে বাচ্চারা, বিকেলে কিশোর-কিশোরীরা, আর সন্ধেবেলা গ্রামের কিছু যুবক-যুবতী এসে ইংরেজি শেখে, কেউ চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়।

শিউলির পাশে তখন নিয়মিত দাঁড়ায় টুম্পা। সে এখন কলেজ ফাইনাল ইয়ারে। বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়ছে। শিউলি ওকে বলেন, “তুই তো এদের থেকে বয়সে বড়, কিন্তু ওদের জগতটা তোরই চেনা। তুই গল্প বল, ছড়া শোনাস, গান শেখাস।” টুম্পা সানন্দে রাজি হয়। কখনও কখনও সে নিজেই ক্লাস নেয়, কখনও বাচ্চাদের হাত ধরে অ আ শেখায়।

একদিন বিকেলে সৌম্য এলেন। হাতে একটা প্যাকেট। ভেতরে কয়েকটা নতুন বই, কিছু কপি আর রঙিন পেন। বাচ্চারা তাঁকে দেখে হইহই করে উঠল। সৌম্য হাসলেন, “এরা তো একেবারে গোলাপের মতো ফুটছে, শিউলি। তুই যে কী তৈরি করছিস, জানিস?”

শিউলি মুচকি হাসলেন। “তুই তো বলেইছিস, স্বপ্ন বুনতে সাহায্য করাটাই তো সবচেয়ে বড় কাজ। আর এটা তোরও স্বপ্ন ছিল না?”

সৌম্য বললেন, “হ্যাঁ, ছিল। কিন্তু তুই যে এটা বাস্তব করে তুললি, সেটা ভেবেই গর্ব হয়।”

দুজনেই নিরিবিলি বসে থাকেন ছাদে। সামনের আকাশটা সোনালি হলুদ হয়ে এসেছে। শিউলি চা এনে দেন। চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠছে, ঠিক যেমন স্বপ্নশালার প্রতিটি কোণে নতুন স্বপ্নের ধোঁয়া ঘোরাফেরা করছে।

গ্রামের মানুষেরাও ধীরে ধীরে স্বপ্নশালাকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন। একদিন পঞ্চায়েতের এক সদস্য এসে বলেন, “শিউলি দিদি, আপনার মতো মানুষ থাকলে তো আমাদের গ্রাম অনেকদূর যাবে।”

আরেকদিন বিকেলে এক মা এসে বলেন, “আমার মেয়ে তো এখন অ আ লেখে। আপনার কাছে না এলে তো হয়তো সবজি বেচতে পাঠাতাম।”

শিউলি কেবল বলেন, “সব কাজই সম্মানজনক, কিন্তু পছন্দটা যেন ওর হয়। জোর করে কিছু নয়।”

এইভাবেই চলতে থাকে। শিউলির দিন এখন শুরু হয় সকাল ছ’টায়। প্রাতঃস্মরণ, গাছগুলোতে জল দেওয়া, বইয়ের ধুলো ঝাড়া, নতুন নতুন গল্প খোঁজা। টুম্পা ওঁর ডান হাত হয়ে উঠেছে। একদিন বলল, “দিদিমণি, স্বপ্নশালার জন্য একটা ছোট ব্লগ খুলি? ছবি তুলে দিই, ছোট গল্প লেখি, বাচ্চাদের আঁকা পোস্ট করি।”

শিউলি একটু থেমে বলেন, “তুই যা ভালো বুঝিস, কর।”

দুই প্রজন্মের এই বন্ধন এখন ‘স্বপ্নশালা’-র প্রাণ। গ্রামের অনেক মেয়ে এখন এসে বলে, “আমরা টুম্পাদির মতো হতে চাই।”

একদিন বিকেলে বাপন এসে বলে, “দিদিমণি, আমি পুলিশের চাকরির পরীক্ষায় বসবো। আপনি তো বলেছিলেন, স্বপ্ন দেখলে, তার দিকে হেঁটে যেতে হয়। আপনি পাশে থাকবেন তো?”

শিউলি চোখ মুছেন, বলেন, “আমি সবসময় আছি, বাপন।”

সৌম্য মাঝে মাঝে আসেন, নিজের অফিসের ব্যস্ততা সামলে সময় করে বেরিয়ে আসেন। কখনও নতুন বই আনেন, কখনও ছোট প্রজেক্টের জন্য সাহায্যের খোঁজ করেন। একদিন বলেন, “স্বপ্নশালাকে একটা ট্রাস্টে রূপান্তর করি? আরও ভালোভাবে ফান্ডিং হবে, সরকারি রেজিস্ট্রেশন পাবে।”

শিউলি একটু চুপ করেন। “ট্রাস্ট, হ্যাঁ—কিন্তু আমি চাই এটা যেন মাটির সংলগ্ন থাকে। ছাপার কাগজে না, এই শিশুদের চোখে যেন আমাদের কাজের মানে থাকে।”

সৌম্য সম্মত হন।

এইভাবেই ‘স্বপ্নশালা’ হয়ে ওঠে এক প্রাণময় প্রতিষ্ঠান—কেবল শিক্ষা নয়, সাহস, আশার বাতিঘর।

শিউলি, যিনি জীবনের সবচেয়ে বড় সময়টা ব্যয় করেছেন অন্যের জন্য, এখন নিজের স্বপ্নগুলো অন্যদের চোখে ফুটে উঠতে দেখছেন। তাঁর ক্লান্ত চোখের কোণে এখন আর হতাশা নেই, আছে এক শান্ত তৃপ্তি। সেই তৃপ্তি, যা আসে কেবল তখনই, যখন একজন শিক্ষক দেখেন—তাঁর বন্ধু।

১০

রাত প্রায় সাড়ে দশটা। চারদিকে নিস্তব্ধতা। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সেই ছোট্ট গ্রামটা তখন গভীর নিদ্রায়। শুধু শিউলির জানালার পাশে রাখা ছোট্ট ল্যাম্পটার আলো এখনো জ্বলছে। জানালার বাইরে অন্ধকার গাছের ছায়া লম্বা হয়ে মাটিতে আঁকা দেয় যেন।

শিউলি জানালার ধারে বসে আছেন। হাতে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা। কাপটা তিনি নিজেই বানিয়েছেন, আদা দেওয়া, সামান্য চিনি কম—যেমনটা তাঁর পছন্দ। এই সময়টা এখন তাঁর প্রিয়। সারাদিন ‘স্বপ্নশালা’ নিয়ে হুলস্থুল, টুম্পার সাথে পরিকল্পনা, সৌম্যের ফোন, গ্রামের কিশোরদের নিয়ে আলোচনা—সবশেষে এই নিঃশব্দ একান্ত সময়টা যেন তাঁর নিজের আত্মার সঙ্গে দেখা করার মতো।

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তিনি আকাশের দিকে তাকান। আজ আকাশে তারার ভিড় কম, মেঘ জমেছে হালকা। শিউলি মনে করেন, এ আকাশ অনেকটা তাঁরই মতো—একসময় মেঘে ঢাকা ছিল, এখন একটু একটু করে আলো দেখছে। তাঁর জীবনের প্রতিটি পর্ব যেন এক একটি ভোরের পূর্বরাত্রি। সব আলো একদিনে আসেনি, কিন্তু এসেছে। তাতে ছিল সংগ্রাম, একাকিত্ব, এবং ত্যাগ।

শিউলি জানেন, সব মানুষ প্রেম পায় না, কিন্তু সবাই প্রেম দিতে পারে। তিনিও তাই করেছেন। ভাইদের পড়ানো, মায়ের সেবা, গ্রামের মেয়েদের উদ্বুদ্ধ করা, ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য নিজেকে উজাড় করে দেওয়া—এইসব তাঁর একান্ত নিজস্ব ভালোবাসার প্রকাশ।

আজ এই মধ্যরাতেও তিনি নিঃসঙ্গ নন। পাশে সেই পুরোনো সোফায় পড়ে আছে সৌম্যের লেখা কিছু চিঠি। একটি চিঠিতে লেখা ছিল:

> “তোর সেই একাগ্রতা আর নিরব ত্যাগ আমাকে মানুষ করেছে, শিউলি। তুই যদি না থাকতিস, আমি হয়তো এতদূর ভাবতেই পারতাম না।”

 

এই চিঠিগুলিই যেন তাঁর জীবনের ডায়েরি। তিনি কখনো জবাব দেন না চিঠিতে। শুধু পড়েন, মনের গোপনে রেখে দেন। ফোনে কথা হয় মাঝে মাঝে, সৌম্য আসে কখনো সখনো—কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো দাবি নেই, নেই কোনো প্রশ্ন। শুধু একটি অনির্বচনীয় বন্ধন আছে, যা গড়ে উঠেছে সময়ের পরীক্ষায়, ত্যাগের প্রগাঢ় ভিতের উপর।

শিউলি জানেন, জীবনের শেষের দিকে এসে অনেকেই শুন্যতা অনুভব করেন। তিনি করেন না। কারণ, তাঁর জীবনের শেষভাগে নতুন করে শুরু হয়েছে এক স্বপ্নের অধ্যায়। ‘স্বপ্নশালা’ এখন গ্রামের আলো হয়ে উঠছে। আজ বিকেলে পাঁচটা মেয়ে এসে বলছিল—”দিদিমণি, আমরা গানের দল বানাতে চাই। আপনি আমাদের গান শেখাবেন?” আরেকজন বলছিল, “আমি চিত্রকলা শিখতে চাই। মেলা হবে, আমরা স্টল দেবো।”

শিউলি হাসেন। তাঁদের কথা শুনতে শুনতে নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে—যখন বাবার মৃত্যুর পরও স্কুল যাওয়া ছাড়েননি, মা-র কপালে হাত বুলিয়ে ভোরে উঠে রান্না করে ভাইবোনদের স্কুলে পাঠিয়ে নিজে স্কুলে দৌড়েছিলেন। এখন মনে হয়—সব কিছুই যেন সার্থক। কারণ এইসব মুখগুলোতে তিনি দেখতে পান নিজের স্বপ্নের প্রতিফলন।

রাতে টুম্পা ফোন করেছিল। বলে,

“দিদিমণি, আজ একজন বলছিল—আপনাকে দেখে আমাদের সাহস হয়। আপনি না থাকলে আমরা হয়তো নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারতাম না।”

শিউলি কেবল মৃদু হেসে বলেন,

“আমি তো ছিলামই তোমাদের জন্য। এখন তুমিই তো আমার মতো হয়ে যাচ্ছ।” টুম্পা বলে, “আপনার জায়গা কেউ নিতে পারবে না। আপনি আমার জীবনের আলো।”

এই কথাগুলো তাঁর আত্মায় জ্বালায় চুপিচুপি আলো। যে আলো গায়ে লাগে না, কিন্তু হৃদয় উষ্ণ করে। এই আলোই শিউলিকে জাগিয়ে রাখে প্রতিদিন, নতুন করে বাঁচার জন্য।

তিনি জানেন, এই পৃথিবীতে হয়তো তাঁর নাম কেউ জানবে না, পত্রিকায় ছাপা হবে না তাঁর ছবি, তবু যারা তাঁর সংস্পর্শে এসেছে, তাদের হৃদয়ে তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন। তাঁর শেখানো অ আ ক খ-এর মধ্যেই থাকবে মানবতার পাঠ, ভালোবাসার পাঠ।

চায়ের কাপ ফাঁকা হয়ে এসেছে। তিনি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ান, জানালাটা বন্ধ করে দেন। কিন্তু মনের জানালা বন্ধ হয় না। আজ তাঁর মনে হয়—এক জীবনে সব পাওয়া যায় না ঠিকই, কিন্তু কাউকে কিছু দেওয়ার মতো যদি থাকে, তাহলে সেই জীবন ব্যর্থ নয়।

এই শান্ত রাতের আকাশে তখন একফালি তারা জ্বলছিল। যেন সেই তারাটাই শিউলির জীবনের প্রতীক—চুপিচুপি আলো, গভীর আকাশের বুকে এক বিন্দু আশার মতো।

 

 

1000023582.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *