সায়ন দত্ত
সেই বর্ষার দুপুরটা ছিল অবিশ্বাস্যরকম নীরব, যেন কলকাতার ক্যাম্পাস চত্বরও আজ একটু হেঁসে বলছে, “চুপ করে থাকো, কেউ আসছে…”। তন্ময় দত্ত সেদিন হোস্টেল থেকে বেরিয়েছিল একটা ছেঁড়া ছাতা হাতে, আর নিজের কল্পনার ভারে ভারাক্রান্ত মনে। ক্লাস বাতিল, ফোনে নেট নেই, আর মাথার ভেতর ঘুরছে পুরনো অর্ধেক লেখা কবিতার লাইন, “ভিজে রাস্তায় হারিয়ে গেল যে পদচিহ্ন, সে কি আবার ফিরবে?” সে হেঁটে যাচ্ছিল মূল ফটকের দিকে, কিন্তু জানত না সে হাঁটছে অন্য এক জগতে প্রবেশের পথে। কলেজের পিছনের সরু গলিটা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তার চোখে পড়ে একটি কাঠের সাইনবোর্ড – হাতের লেখা, কিন্তু যেন একশো বছর আগের কালি দিয়ে লেখা—”Stardust Café – মনে রাখা না রাখার মাঝখানে।” তন্ময়ের ভ্রু কুঁচকে গেল, এমন জায়গা তো আগে চোখে পড়েনি! জানালাগুলো ঘোলাটে কাঁচে ঢাকা, ভিতরের আলো কেমন রঙ বদলানো ধরনের, আর দরজার পাশে রাখা একটি ছোট্ট ঘণ্টা নিজে থেকেই বেজে উঠল, যেন কাউকে ডাকছে।
তন্ময় যখন ঢুকল, তখন ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে ছিল চায়ের ধোঁয়া আর এক ধরণের নরম, হলুদ আলো যা বাইরের কুয়াশাকে দূরে ঠেলে রাখে। অদ্ভুতভাবে শান্ত, নিঃশব্দ এক জগৎ—যেন শব্দ হারিয়ে গিয়েছে কোথাও। দেয়ালে ঝুলছে সাদা-কালো কিছু ছবি, যার মধ্যে কয়েকটা দেখে মনে হয় তার নিজেরই শৈশব, অথচ নিশ্চিত নয় সে। কাউন্টারের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল একজন মধ্যবয়সী মানুষ, শাদা চুল, চোখে গোল ফ্রেমের চশমা, হাসি তাঁর ঠোঁটের কোণে যেন স্থায়ী বাসিন্দা। তিনি কিছু না বলেই এগিয়ে দিলেন একটি কফির কাপ, যার চারপাশে কাগজ মোড়া, কাগজের গায়ে লেখা—“মৌমিতা – বর্ষা ২০১১”। তন্ময় কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু লোকটা বলল, “শুধু শুনো, উত্তর খুঁজো না আজ। তুমি যা খুঁজছো, সেটা আগে তোমায় খুঁজে বের করবে।” চুমুক দিতেই তন্ময় যেন হঠাৎ নিজেকে দেখতে পেল এক পুরনো ছাদে, বৃষ্টির মাঝে ভিজে যাচ্ছে একটি মেয়ে যার চোখে সেই চিরপরিচিত বিষাদ। কে সে? সে নিজেই জানে না। কিন্তু সেই দৃশ্য যেন তার মনের কোনে জড়িয়ে থাকা স্মৃতির ধুলো ঝেড়ে দিল। এই ক্যাফে শুধু কফি দেয় না, এই ক্যাফে স্মৃতি খোঁজে।
সেদিনই প্রথম দেখা তার অরুন্ধতীর সঙ্গে—কাচের ভেতর শেষ বেঞ্চের কোণে বসে, সে তখন একটি কাপ হাতে চুপ করে তাকিয়ে ছিল বাইরের বৃষ্টির দিকে। তন্ময়ের মনে হয়েছিল, মেয়েটির চুলে যেন ভেজা পাতার ঘ্রাণ মিশে আছে, আর চোখে কোনো এক পুরনো গল্পের ছায়া। সে হাসল, কিন্তু তন্ময় বুঝে উঠতে পারল না সে কি বর্তমান? না কি কোনো অতীতের আবছা ছবি? অরুন্ধতী বলল, “সবাই ভাবে ভুলে যাওয়াই সবচেয়ে সহজ কাজ, অথচ মনে রাখা না রাখার মাঝখানে যত গভীর দুঃখ লুকিয়ে থাকে, তা কেউ বোঝে না।” সে চায়ে চুমুক দিল, আর বলতে শুরু করল একটি গল্প—একটা ছেলের, যে হারিয়েছিল তার মা’র শেষ চিঠি। তন্ময় থমকে গেল। কারণ সে জানত, এই গল্প সে কাউকে বলেনি কখনো। ক্যাফের আলো তখন একটু গাঢ় হয়ে এসেছে, আর ঘরের কোণে বসে থাকা এক ছায়ামূর্তি তখন যেন মাথা ঝাঁকিয়ে বলছে—‘হ্যাঁ, এইটুকু মনে রাখা দরকার ছিল।’ তন্ময় জানত না কোথায় যাচ্ছে এই পথ, কিন্তু জানত—এখানে প্রতিটি কাপ, প্রতিটি গল্প, তাকে একটু একটু করে নিয়ে যাচ্ছে নিজেরই বিস্মৃত এক অংশের দিকে। আর অরুন্ধতী? সে কি সত্যিই এখানে আছে, না কি কেবল এক স্মৃতির ধুলোবালির ভেতর গড়া এক কল্পনা?
–
ঘড়ির কাঁটা সন্ধ্যা ছয়টা ছুঁতে না ছুঁতেই স্টারডাস্ট ক্যাফেটা যেন অন্য এক রঙে রঙিন হয়ে উঠত, জানালার ধারে বসা যে ক’জন মানুষ ছিল, তাদের গলার আওয়াজ নিঃশব্দে মিলিয়ে যেত ধোঁয়ার সুরে। তন্ময় আবার সেই টেবিলটিতেই বসল, যেখানে কাল অরুন্ধতী বসে ছিল। আজ তার সামনে সেই চেয়ারটা খালি, কিন্তু তবু সে যেন সেই নিঃশব্দ হাসি শুনতে পাচ্ছিল। ড্যানিয়েল কাকা আজও কিছু না বলে কফির কাপ এগিয়ে দিলেন, কাগজে লেখা—“অনির্বাণ – শীতকাল ২০০৪”। তন্ময় এবার আর প্রশ্ন করেনি, শুধু চোখ বন্ধ করে কফির গন্ধটা শুঁকে এক চুমুক দিল, আর সঙ্গে সঙ্গে যেন চারপাশের জগতটা ঘুরে গেল। একটা পুরনো চারতলা বাড়ির ছাদ, সূর্য ডোবার আগে শেষ আলোয় ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক ছোট্ট ছেলে, তার হাতে একটা টিফিন বক্স, তার সামনে দাঁড়িয়ে একজন বৃদ্ধা, যিনি বলছেন—“খালি পেট নিয়ে বই মুখস্থ হয় না, বাবু।” সেই দৃশ্য শেষ হতে না হতেই তন্ময়ের গা ছমছম করে উঠল—এটা তো তার ছোটবেলার কোনো দিন, যেটা সে অনেক আগেই ভুলে গেছিল। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো—এই ক্যাফে কীভাবে এসব জানে?
ঠিক তখনই দরজা খোলার শব্দে তন্ময় চমকে উঠল। অরুন্ধতী এসে ঢুকল, তার পরনে ধূসর রঙের সোয়েটার, চোখে কিছু একটার ভার যেন টান টান করে রেখেছে দৃষ্টি। সে ধীরে ধীরে হেঁটে এল, তন্ময়ের উল্টোদিকে বসল আর হালকা গলায় বলল, “আজ আকাশটা খুব নরম লাগছে না?” তন্ময় কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু অরুন্ধতী নিজেই বলে উঠল, “তুমি কি কখনো এমন কাউকে ভুলে গেছো, যার কথা মনে পড়লেই নিজেরই অপরাধবোধ হয়?” তন্ময়ের গলা শুকিয়ে এল। সে জানত না কেন, কিন্তু সে যেন ধীরে ধীরে ঢুকে যাচ্ছে এমন এক আত্মিক ধাঁধার মধ্যে, যেখানে উত্তর নেই—শুধু অনুভূতির দোলাচল। অরুন্ধতী আজ নতুন এক গল্প বলল—এক বৃদ্ধ পিয়ানোবাদকের, যে ভুলে গিয়েছিল কোন গানটা তার মৃত স্ত্রীর প্রিয় ছিল। সে প্রতিদিন ক্যাফেতে এসে বাজাত, কিন্তু কোনওদিন সেই সুর খুঁজে পায়নি। “তুমি জানো,” বলল অরুন্ধতী, “ভুলে যাওয়া অনেক সময় ভালোবাসার চেয়ে বেশি কষ্ট দেয়।” তখনই তন্ময়ের মনে হল—এই ক্যাফেটা আসলে এক সংগ্রহশালা, যেখানে মানুষরা ভুলে যাওয়া টুকরোদের ভেতর দিয়ে নিজেদের খুঁজে ফেরে।
বৃষ্টি থেমেছে, জানালার বাইরে এখনো টুপটাপ জল পড়ছে ছাউনির টিনে। ঘরজুড়ে এক ধরনের সুর বেজে চলেছে—না, সেটা কোনও বাদ্যযন্ত্র নয়, যেন এই কাফেরই শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ। তন্ময় প্রথমবার অনুভব করল, এই ঘরটা বেঁচে আছে। আর অরুন্ধতী, যে তাকিয়ে আছে বাইরের অন্ধকারে, সে হয়তো জানে এই ঘরের প্রতিটি কোণে কী আছে, কে বসে থাকে কোন টেবিলে, কে কোন কাপ পায়। “আমি এই ক্যাফেতে প্রথম এসেছিলাম যখন আমার বয়স সাত,” সে হঠাৎ বলে উঠল। “সেদিন আমি বাবাকে ভুলে ফেলেছিলাম—আমার চোখের সামনে, স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ছিলেন, অথচ আমি মনে করতে পারিনি উনি কে।” তন্ময়ের শরীর কেঁপে উঠল। সে জানত, এই মেয়েটার গল্পগুলো হয়তো শুধু গল্প নয়—এই স্মৃতিগুলো তার নিজের, অথবা আরও গভীর কোনো অস্তিত্বের অংশ। বাইরে দূরে কোনও ট্রামের ঘণ্টা বাজল, আর ক্যাফের ভেতর হঠাৎ বাতি একটু মিটমিট করে উঠল, যেন ইশারা দিল—আরও এক স্মৃতি আসতে চলেছে।
–
তন্ময় এবার ক্যাফেতে ঢোকার আগে থমকে দাঁড়ায়। স্টারডাস্ট ক্যাফের দরজাটা আজ যেন একটু বেশি ভারী মনে হলো তার কাছে—কেমন একটা নিঃশব্দ চাপ, যা মনে করিয়ে দেয় কোনো পুরনো বইয়ের পাতা খুলতে গিয়ে হঠাৎ পুরোনো গন্ধে ডুবে যাওয়ার অনুভূতি। ভিতরে ঢুকেই সে দেখে আজ আলোটা কিছুটা নরম, কিছুটা ফিকে। ড্যানিয়েল কাকা কাউন্টারে নেই, কাউন্টারের পাশেই রাখা একটা ছোট রেডিও থেকে ধীরে ধীরে ভেসে আসছে এক পুরনো রবীন্দ্রসঙ্গীত—“সাঁঝের আলো লাগলো গায়ে…”। জানালার ধারে বসে আছে অরুন্ধতী, মাথা নিচু করে টেবিলের ওপর রাখা ছোট্ট একটা চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে। আজ তার চোখে সেই চিরচেনা কুয়াশা নেই, আছে এক ধরণের ভয়, যেন নিজের মধ্যেই কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে সে। তন্ময় চুপ করে তার সামনে গিয়ে বসল, কিছু না বলেই। একটু পরে অরুন্ধতী মুখ তুলল—তন্ময়ের মনে হলো তার চোখ যেন আরও কিছু পুরনো হয়ে গেছে আজ।
“তুমি কি জানো,” সে হঠাৎ বলে উঠল, “স্মৃতি অনেক সময় শব্দের চেয়েও ভারী হয়ে পড়ে?” তন্ময় মাথা নেড়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু অরুন্ধতী নিজেই বলল, “আজ একটা কাপ এসেছে, যার ওপর নাম নেই, শুধু লেখা—‘ভোরবেলা, জানালার পাশে’। আমি জানি এটা কার।” সে একটানা তাকিয়ে থাকল তন্ময়ের দিকে, কিন্তু তন্ময় বুঝতে পারল না সে কি প্রশ্ন করছে, না শুধু একটা শূন্যতার ভাগ নিচ্ছে। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর সে বলতে শুরু করল একটি গল্প—একটা ছোট মেয়ে, যে প্রতিদিন স্কুলে যাবার আগে বাবার মুখে একটা নির্দিষ্ট হাসি খুঁজত। একদিন বাবার মুখে সেই হাসি আর ছিল না, আর মেয়েটা বুঝে গেছিল, সে চলে যাচ্ছে। “কিন্তু,” অরুন্ধতী বলল, “বাবা কখনও কিছু বলেনি, মেয়েটার দিকেও তাকায়নি—শুধু ভোরবেলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল একমনে। সেই দৃশ্যটাই রয়ে গেছে আজও, বাকিটা ঝাপসা।” তন্ময়ের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। সে জানে না কেন, কিন্তু তার মাথায় তখন ঘুরছিল নিজের ছোটবেলার একটা সকাল, মায়ের রান্নাঘরের শব্দ, আর জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা বাবার ছায়া, যে নাকি কোনো কথা না বলেই একদিন চলে গিয়েছিল। দুটো স্মৃতি যেন একসঙ্গে মিশে যাচ্ছে, আর এই ক্যাফে সেই মিলনের স্থান।
হঠাৎই ক্যাফের বাতি কাঁপল, দরজা খুলে কেউ ঢুকল—এক বৃদ্ধ, মাথায় উলের টুপি, চোখে জলজমা দৃষ্টি। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল কাউন্টারের দিকে, সেখানে রাখা কাপের ওপর হাত রাখল আর বলল, “আজ আমি আমার স্ত্রীর সেই কথাটা শুনতে এসেছি, যেটা সে শেষবার বলেছিল কিন্তু আমি শুনিনি।” ড্যানিয়েল কাকা তখন আবার কোথা থেকে যেন উদয় হয়ে কাপটা এগিয়ে দিলেন। বৃদ্ধ এক চুমুক দিতেই চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল—সে ফিসফিস করে বলল, “সে বলেছিল—‘তুমি আবার যদি জন্মাও, আমায় ভুলে এসো না।’” ক্যাফেতে তখন আর কোনো শব্দ ছিল না, শুধু কাপের ধোঁয়ার মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছিল কিছু অদেখা, অথচ খুব চেনা মুহূর্ত। তন্ময় চুপ করে তাকিয়ে ছিল অরুন্ধতীর দিকে। সে জানে, অরুন্ধতী শুধু গল্প শোনায় না—সে বাঁচে প্রতিটি হারানো মুহূর্তের ভেতর দিয়ে। আর এই স্টারডাস্ট ক্যাফে? এটা হয়তো কোনো জায়গা নয়, এটা হয়তো সময়ের মাঝখানে একটা ছায়াপথ—যেখানে প্রতিটি মানুষ আসে একটু ভুলতে, আর কিছুটা মনে রাখতে।
–
তন্ময় আজ একটু তাড়াতাড়িই চলে এসেছিল ক্যাফেতে, কিন্তু আজ যেন অন্য কিছু ছিল বাতাসে—কোনো এক অজানা অস্থিরতা, যা তাকে সারা দিন ধরে খোঁচা দিয়ে চলেছিল। ক্লাসে মন ছিল না, বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু শব্দগুলো যেন তার নিজের ছিল না। আজ দুপুর থেকেই মাথায় একটা পুরনো সুর ঘুরছিল—তন্ময় নিশ্চিত ছিল এটা কোনোদিন শুনেছে সে, কিন্তু মনে করতে পারছিল না কোথায়। স্টারডাস্ট ক্যাফের দরজায় পৌঁছে সে দেখল জানালাগুলোতে আজ পর্দা টানা নেই। ভিতরে আলো কিছুটা বেশি, আর সেই নরম সুরটা সত্যিই বাজছে রেকর্ড প্লেয়ারে—একটা ভাঙা সুর, যার প্রতিটি টান যেন কোথাও গিয়ে থেমে যায়। ড্যানিয়েল কাকা আজ ক্যাফের এক কোণে বসে আছেন, সামনে একটা খোলা ডায়েরি, আর তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে হালকা গলায় বললেন, “আজ তোমার জন্য কিছু লেখা হয়নি কাপের গায়ে। আজ তুমি নিজে লিখবে।”
তন্ময় একটু চমকে গেল। নিজে লিখবে মানে? সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে টেবিলে বসল, আর সামনে রাখা খালি কফির কাপটাকে দেখল। সাদা কাপ, কোনো নাম নেই, কোনো তারিখ নেই, শুধু এক সরু রেখায় আঁকা একটি ছোট্ট চাঁদের ছবি। অরুন্ধতী তখন কোথা থেকে এসে তার উল্টোদিকে বসেছে, চুপচাপ, চোখে একটা আশ্চর্য রকমের স্থিরতা। “তুমি কি জানো,” সে বলল, “আমরা অনেক সময় নিজেদের ভুলে যাই, কিন্তু নিজের ভেতরে জমে থাকা গল্পগুলো ঠিক ঠিক মনে থাকে।” তন্ময় একটু হেসে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি সব গল্প মনে রাখতে পারো?” অরুন্ধতী বলল, “না, আমি শুধু সেই গল্পগুলো মনে রাখি যেগুলো কেউ মনে রাখতে চায় না, কিন্তু হারাতে ভয় পায়।” এই কথার পরেই সে হঠাৎ করে বলল, “আজ তোমাকে একটা ছবি আঁকতে হবে নিজের মনের মধ্যে—সেই ছবির মধ্যে যে প্রথম শব্দটা ভেসে উঠবে, সেটাই হবে আজকের স্মৃতি।” তন্ময়ের চোখ বন্ধ করতেই সে দেখতে পেল এক পুরনো ছাদ, লাল রঙের পায়রা, আর মায়ের কণ্ঠ—”তুমি যদি হারিয়ে যাও, আমি বাতাসে খুঁজে নেব।” তার চোখ খুলতেই বুঝে গেল—আজকের কাপটা আসলে তার নিজেরই এক পুরনো খোঁজ।
ক্যাফের বাতি একটু মৃদু হয়ে এলো, বাইরে বৃষ্টি নামছে টুপটাপ, আর চারপাশের দেয়ালে ঝুলে থাকা ছবিগুলো যেন আজ একটু বেশি জীবন্ত মনে হচ্ছে। হঠাৎ করেই এক তরুণী ঢুকল, যার চোখে তন্ময় স্পষ্টভাবে দেখল সেই একই ছবি—একটা হারিয়ে যাওয়া বিকেলের ছায়া। মেয়েটি ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে ড্যানিয়েল কাকার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি আমার দাদার গলা শুনতে চাই, শেষবারের মতো।” কাকা কফির কাপটা এগিয়ে দিলেন, মেয়েটি চুমুক দিতেই সে অস্ফুট স্বরে বলল, “সে বলেছিল—‘তুই সব সময় আমার চেয়ে বেশি সাহসী ছিলি।’” সেই কথা শোনার পর মেয়েটির চোখ থেকে জল পড়ল না, বরং মুখে এক ধরণের শান্তি ফুটে উঠল। তন্ময় আজ বুঝল—এই ক্যাফেতে কেউ আসে শুধু ভালোবাসার জন্য নয়, অনেকে আসে নিজেদের হারিয়ে যাওয়া খুঁটিনাটি ফিরে পাওয়ার জন্য। আর অরুন্ধতী? সে এখন তাকে দেখছে, একদৃষ্টে, যেন বোঝাতে চাইছে—”তোমার গল্পটাও সময় এসেছে সামনে আনার।” তন্ময় বুঝল, তার কফির কাপ আজ শুধু একটি স্মৃতির বাহক নয়—এটা হতে চলেছে একটা স্বীকারোক্তি।
–
তন্ময়ের মনে হচ্ছিল যেন সে কোনো অনন্ত গল্পের ভিতরে আটকে গেছে—যেখানে প্রত্যেকটি কাপ একটি অধ্যায়, প্রতিটি চুমুক একটি বিস্মৃত পৃষ্ঠা। আজ ক্যাফেতে ঢুকেই সে বুঝতে পারল কিছু বদলে গেছে। বাতাসে একধরনের কাঁচা কাঁচা গন্ধ, যেন পুরনো চিঠিপত্র জলে ভিজে গেছে। দেয়ালে ঝোলানো ছবিগুলো আজ একটু বেঁকে গেছে, আর জানালার কাঁচে জমে আছে জলবিন্দুর মতো আবছা মুখ। ড্যানিয়েল কাকা আজ তাকে দেখেই বললেন, “আজ ক্যাফেতে কেউ আসবে না, শুধু তুমি আর সে।” তন্ময় বুঝতে পারল কার কথা বলা হচ্ছে। অরুন্ধতী আজ একটু দেরি করেই ঢুকল, কিন্তু তার চোখে সেই গভীরতা ছিল না—বরং একধরনের ফাঁপা শূন্যতা, যা সে আগের কোনোদিন দেখেনি। সে আজ চুপ করে ছিল, কফির কাপটায় চুমুক না দিয়েই বসে ছিল, শুধু বলল, “তুমি কি কখনো এমন কাউকে ভালোবেসেছো, যাকে পাওয়ার আগে থেকেই হারিয়ে ফেলার ভয় তৈরি হয়ে গেছিল?”
তন্ময় প্রথমে কিছু বলতে পারেনি। তারপর আস্তে করে বলল, “তোমাকে।” অরুন্ধতী চোখ তুলল না, কিন্তু হাতটা ধীরে ধীরে কাপে রেখে বলল, “তাহলে তুমি জানো না, আমি আদৌ আছি কিনা।” এই কথার পরেই ক্যাফের বাতি নিভে গেল এক মুহূর্তের জন্য, আর তন্ময় শুনতে পেল এক চাপা কাঁপুনি নিজের বুকের ভেতরে। চারপাশে নীরবতা ঘনীভূত হয়ে উঠল, আর সেই নীরবতার মাঝে তন্ময় অনুভব করল—এই মুহূর্তটা কোনো বাস্তব সময়ের অংশ নয়, এটা সেই স্মৃতির শূন্যস্থান, যেখানে ভালোবাসা আর ক্ষতি হাত ধরাধরি করে বসে থাকে। অরুন্ধতী আস্তে করে বলল, “তুমি জানো, আমি কে?” তন্ময় মাথা নেড়ে বলল, “তুমি সেই সব কথা, যেগুলো কেউ কাগজে লেখে না, শুধু মনে রাখে। তুমি সেই ভোরের ছায়া, যেটা প্রতিদিন দেখা যায় কিন্তু কেউ মনে রাখে না।” অরুন্ধতী হেসে বলল, “তুমি ঠিকই বলেছো, আমি হয়তো বাস্তবে নেই, কিন্তু এই ক্যাফেটা যতদিন আছে, আমি ততদিন থাকবো—তোমার, আর সবার ভেতরে।”
ঠিক তখনই দরজার পাশে রাখা ঘণ্টাটা আবার বেজে উঠল। তন্ময় তাকিয়ে দেখল, কেউ ঢুকছে না, কিন্তু ঘণ্টা বেজেই চলেছে। ড্যানিয়েল কাকা এগিয়ে এসে বললেন, “যারা নিজেদের সত্যি সত্যি হারিয়ে ফেলে, তাদের ডাক এভাবেই আসে।” তন্ময়ের মনে হলো, আজ এই ক্যাফেটা তাকে একটা শেষ চুমুক দিতে বলছে, একটা গল্প শেষ করার আগে যেমন শেষ লাইনটা লেখার দরকার পড়ে। সে তার কাপটা হাতে নিল, এবার কোনো লেখা নেই, কোনো নাম নয়—শুধু একটা বিন্দু, যেন শুরুর আগে এক নিঃশ্বাস। চুমুক দিতেই তার চোখের সামনে ফুটে উঠল সেই পুরনো সন্ধ্যা, যখন সে প্রথম অরুন্ধতীকে দেখেছিল—না, ক্যাফেতে নয়, তার স্কুলের লাইব্রেরির বারান্দায়। সেই মেয়েটিই অরুন্ধতী, কিন্তু তার নাম ছিল অন্য কিছু। সে মারা গিয়েছিল বহু বছর আগে, একটি ট্র্যাজেডির ঘটনায়, যেটা তন্ময় ভুলে গিয়েছিল সম্পূর্ণভাবে। এখন সে বুঝল, স্টারডাস্ট ক্যাফে তাকে শুধু তার স্মৃতিগুলো ফেরত দেয়নি, তাকে তার ভালোবাসার অতীতও ফিরিয়ে দিয়েছে। আর অরুন্ধতী? সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল, জানালার দিকে এগিয়ে গিয়ে একবার ফিরে তাকাল, হেসে বলল, “তুমি মনে রেখেছো, সেটাই ছিল আমার মুক্তি।” এরপর, সে ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে গেল আলো-ছায়ার মাঝে।
–
স্টারডাস্ট ক্যাফেতে আজ অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। যেন প্রতিটি চেয়ার, প্রতিটি টেবিল, এমনকি দেওয়ালে টাঙ্গানো ছবিগুলোর চোখেও এক ধরণের প্রশ্ন—তন্ময় আজ একা এসেছে, কিন্তু তার পাশে বসে থাকা অরুন্ধতীর চেয়ারে এখন শুধুই ছায়া। ছায়া, যা আলোয় নেই, কিন্তু স্মৃতিতে রয়ে গেছে। ড্যানিয়েল কাকা আজও কফির কাপ এগিয়ে দিলেন, কিন্তু এবার কাপের গায়ে লেখা শুধু একটি লাইন—“সব মনে থাকলে কি বাঁচা যেত?” তন্ময় একটুও অবাক হয়নি, শুধু ধীরে ধীরে বসে পড়ল টেবিলটায়, কাপটা হাতে তুলে নিল, আর চুমুক দেবার আগেই চোখ বন্ধ করল। ভিতরে ভেসে এল অরুন্ধতীর গলা, সেই মৃদু, ছায়াঘেরা স্বর—“ভুলে যাও, তবেই মনে থাকবে।” আর সেই মুহূর্তেই তার মনে পড়ে গেল সেই রাত, যখন অরুন্ধতীর পরিবার হারিয়ে যায় এক ভয়ানক দুর্ঘটনায়, আর তন্ময় তখনই চুপিসারে প্রতিজ্ঞা করেছিল—এই মেয়েটির কোনো স্মৃতি যেন কখনও তাকে ভাঙতে না পারে। কিন্তু ভাগ্য এক অদ্ভুত পরিহাস, সে-ই হারিয়ে ফেলেছিল তাকে, আর আবার এই ক্যাফের মাধ্যমে খুঁজে পেয়েছিল।
ড্যানিয়েল কাকা তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, “তুমি কি জানো তন্ময়, স্টারডাস্ট ক্যাফে সব সময় থাকেনা… এটা আসে তখনই, যখন কেউ তার অতীতকে সামলাতে প্রস্তুত থাকে।” তন্ময় কিছু বলল না, কিন্তু তার চোখে তখন এক অদ্ভুত শান্তি। সে জানে, ক্যাফে হয়তো আজ শেষ দিনের মতো খুলেছে তার জন্য, কারণ এখন তার গল্প সম্পূর্ণ। দেয়ালের ছবি গুলো একে একে আলাদা হয়ে যাচ্ছে কাঠের প্যানেল থেকে, যেন তারা নিজেরা নিজেদের জায়গা খুঁজে নিচ্ছে স্মৃতির অন্য কোনো অলিন্দে। জানালার কাঁচে জমে থাকা বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়ছে নিচে, আর তার প্রতিফলনে তন্ময় দেখতে পাচ্ছে সেই সব মুখ—অনির্বাণ, মৌমিতা, সেই বৃদ্ধ পিয়ানোবাদক, মেয়েটি যে ভাইয়ের শেষ কথা শুনতে এসেছিল, এবং সব শেষে, অরুন্ধতী—এক ফিকে আলোয় জড়ানো মুখ, যে আসলে সময়ের বাইরের কেউ। এই ক্যাফে শুধু এক জায়গা নয়, এটা এক অনুভব, এক নীরব স্বীকারোক্তি, যে কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়, কিন্তু ভালোবাসা যদি সত্যি হয়, তা স্মৃতির আড়ালেও জায়গা করে নেয়।
তন্ময় ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল, কাপটা রেখে দিল টেবিলে। তার গায়ে কোনো লেখা নেই, কিন্তু তার ভেতরে এখনও কিছুটা উষ্ণতা রয়ে গেছে—যেন স্মৃতির শেষ চুমুকের পরেও কিছু না বলা থেকে যায়। ক্যাফে থেকে বেরিয়ে সে পেছন ফিরে তাকাল—দরজা বন্ধ, আলো নিভে গেছে, আর সেই কাঠের বোর্ডটা এবার আর ঝুলছে না, মাটিতে পড়ে আছে। কিন্তু তন্ময় জানে, স্টারডাস্ট ক্যাফে হারায় না, শুধু তারা পালটে যায় সময়ের দরজা ধরে। তার মনে হচ্ছে, সে এখন যে কোনো ট্রেনের জানালার পাশে বসে থাকলেও, কোনো এক গন্ধ, কোনো এক সুর বা কোনো একটা চোখের চাহনি তাকে আবার ফিরিয়ে আনবে সেই কাফেতে। আর অরুন্ধতী? সে আজও কোথাও আছে—হয়তো অন্য কোনো গল্পে, অন্য কোনো তন্ময়ের অপেক্ষায়, কারো এমন একজন হয়ে, যাকে পাওয়া মানে নিজেকে খুঁজে পাওয়া।
–
স্টারডাস্ট ক্যাফে হয়তো বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু তন্ময়ের ভেতরে তার দরজাগুলো আজও খোলা। সময় পেরিয়ে গেছে কয়েক মাস, কলেজ শেষ, বন্ধুদের ভিড় পাতলা হয়ে গেছে, হোস্টেলের ঘর ফাঁকা, আর তন্ময় এক অন্য রুটিনে ঢুকে পড়েছে—নতুন শহর, নতুন কাজ, কিন্তু প্রতিদিন রাতে, সে নিজের ডেস্কে একটা পুরনো কাপ রাখে, যেটা দেখতে স্টারডাস্ট ক্যাফের কাপের মতোই। তাতে সে চা খায় না, কফিও না—সে শুধু তাকিয়ে থাকে কাপটার দিকে, আর ভাবে, আজ যদি কোনো গল্প জেগে ওঠে, তবে সেটা কাদের স্মৃতি হবে? অরুন্ধতী ফিরে আসেনি, কিন্তু তার গলার সেই ধীর স্বর এখনও মাঝরাতে ভেসে আসে, “তুমি যদি ভুলে যাও, আমি তোমার স্বপ্নে আসবো না।” একদিন, এক অদ্ভুত সন্ধ্যায়, কলকাতার বাইরে এক পুরনো রেলস্টেশনে তন্ময় দাঁড়িয়ে ছিল—ট্রেন মিস হয়ে গেছে, বৃষ্টি শুরু। হঠাৎ পাশের চায়ের দোকানের ঘোলাটে কাচে সে দেখতে পেল কিছু শব্দ—“Stardust Café – মনে রাখা না রাখার মাঝখানে।” তার বুক ধড়ফড় করে উঠল, সে ছুটে গেল সামনে, কিন্তু কাচটা শুধু তারই প্রতিবিম্ব ফিরিয়ে দিল, কোনো দরজা নয়, কোনো আলো নয়।
তবে সেই রাতেই তার সঙ্গে দেখা হল এক অচেনা তরুণীর, যার হাতে ছিল একটি পুরনো নোটবুক—হুবহু সেইরকম, যেমনটা তন্ময় ব্যবহার করত গল্প লেখার জন্য। মেয়েটি কাঁপা গলায় বলল, “এইখানে একটা ছেলেকে বসে বসে গল্প লিখতে দেখতাম, সে একদিন আমাকে বলেছিল—সব হারিয়ে গেলেও, গল্প রয়ে যায়।” তন্ময়ের গলা শুকিয়ে এল, কারণ সে নিশ্চিত—এটি তারই লেখা নোটবুক, কিন্তু মেয়েটিকে সে চেনে না। মেয়েটি বলল, “এইখানে একটা কাফে ছিল আগে… আমার মা বলতেন, সেখানে গেলে মানুষ ভুলে যেতে পারে যাকে মনে রাখতে ভয় পায়।” সেই মুহূর্তে তন্ময়ের মনে হলো—স্টারডাস্ট ক্যাফে কেবল একটি ঠিকানায় বাঁধা কিছু নয়, বরং এই ক্যাফে এক ধরণের উত্তরাধিকার, যা এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে বয়ে চলে নির্ভরতা, সংবেদন আর বিস্মরণের ছায়ায়। সে নোটবুকটা হাতে নিল, আর পাতাগুলো উল্টে দেখল—শেষ পাতায় লেখা, “যে সত্যিই হারিয়ে যায়, সে কোনো না কোনো গল্পে ফিরে আসে।” তার চোখ জ্বলে উঠল, সে বুঝল—অরুন্ধতী তাকে কোথাও থেকে বলছে, “লিখে যাও, তবেই আমি থাকব।”
পরদিন সকালেই তন্ময় এক নতুন কাজ শুরু করল—নামহীন, ঠিকানাহীন একটি ওয়েব ম্যাগাজিন, যেখানে সে পাঠকদের কাছে চেয়ে নেয় তাদের ‘ভুলে যাওয়া গল্প’। নাম দিল: “Cup No. Infinity”। সে জানত না কে পড়ছে, কে লিখছে, তবু প্রতিটি লেখা যেন তার বুকের ভেতর ছুঁয়ে যায়। সে প্রতিটি লেখায় অরুন্ধতীর ছায়া খুঁজে বেড়ায়—কখনো কথায়, কখনো নীরবতায়। কয়েক সপ্তাহ পর, এক অদ্ভুত সন্ধ্যায়, তার ইনবক্সে আসে একটি অচেনা মেইল—বিষয়: “Stardust never dies.” মেইল খুলে সে দেখে শুধু একটি ছবি—এক কাপ ধোঁয়া ওঠা কফি, কাপের গায়ে লেখা সেই চিরচেনা বাক্য: “ভুলে যাও, তবেই মনে থাকবে।” আর তার নিচে সই—অ. তন্ময় চুপ করে বসে থাকে অনেকক্ষণ। তারপর সে নিজের কাঁপা হাতে নতুন একটা গল্প লিখতে শুরু করে—এইবার তার নামহীন চরিত্র নয়, এইবার সে লিখে অরুন্ধতীর নাম, তার চোখ, তার কণ্ঠস্বর, আর সেই চায়ের কাপ, যা একদিন তাকে নিজেকেই ফিরিয়ে দিয়েছিল। আর তখন সে বুঝে যায়—স্টারডাস্ট ক্যাফে হয়তো আর আগের জায়গায় নেই, কিন্তু সে রয়ে গেছে হৃদয়ের সেই অলক্ষ্মিত গলিতে, যেখানে গল্পেরা ধোঁয়া হয়ে ভেসে বেড়ায়, আর ভালোবাসা হারিয়ে না গিয়ে হয়ে ওঠে… স্মৃতির চায়ের শেষ চুমুক।
–
স্টারডাস্ট ক্যাফের গল্প শেষ হয় না—শুধু সময়ের সঙ্গে তার রূপ পাল্টায়, গন্ধ বদলায়, কিন্তু থেকে যায় এক অদৃশ্য রেখায় আঁকা এক চায়ের কাপের মতো। তন্ময়ের জীবনও বদলে গেছে। এখন সে শহরের ব্যস্ত রাস্তায় হাঁটে, অফিসের কাঁচের ঘরে মিটিং করে, বইমেলায় নতুন লেখকদের খুঁজে ফেরে, অথচ রাত্রির নির্জনতায় একটা শূন্য চেয়ার তাকে ঘিরে রাখে—সেই চেয়ার, যেখানে একসময় বসত অরুন্ধতী, বা অন্তত সেই স্মৃতির ছায়া, যে তাকে শোনাত অদ্ভুত, অপূর্ব সব বিস্মৃতির গল্প। Cup No. Infinity এখন বহু পাঠকের ভরসার জায়গা, কেউ কেউ এটাকে “অনলাইন স্টারডাস্ট ক্যাফে”ও বলে। তন্ময় প্রতিদিন নতুন নতুন লেখা পড়ে, আর মনে মনে খোঁজে সেই কণ্ঠস্বর, যেটা বলবে—“এই গল্পটা তোমার জন্য।” অনেক সময় চোখ বেয়ে জল পড়ে, অনেক সময় সে হেসে ওঠে নিজের অজান্তে, আর একদিন সে বুঝতে পারে—স্মৃতি কখনো একা আসে না, তার সঙ্গে একটা নিরব সত্যও থাকে, যে ভালোবাসা হারিয়ে গেলেও, তার ছায়া থেকে যায় কোনো এক অনন্ত সন্ধ্যায়।
সেই সন্ধ্যাটি এসেছিল। এক বছরের মাথায়। শহরের এক ছোট বইমেলায় তন্ময়কে ডাকা হয়েছিল গল্প পাঠের জন্য। সে প্রথমে অস্বীকার করেছিল, কিন্তু পরে মনে পড়ল, অরুন্ধতী একবার বলেছিল—“তোমার কণ্ঠটাই একদিন কাউকে মনে করিয়ে দেবে, সে ভুলে যাওয়ার আগে কী ভালোবাসত।” বইমেলার ছোট্ট মঞ্চে দাঁড়িয়ে, সে নিজের লেখা নয়, পাঠ করল এক পাঠকের লেখা গল্প—এক অচেনা মেয়ের লেখা, যার চরিত্রের নাম ছিল ‘তন্ময়’। দর্শকদের চোখে জল, কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না। পাঠ শেষ করে সে যখন নামছে, তখন এক বৃদ্ধা এগিয়ে এল—চোখে চশমা, হাতে একটি চিঠি। বললেন, “এই চিঠিটা অনেক বছর আগে কেউ আমার ছেলেকে লিখেছিল, কিন্তু সে আর ফিরল না। আমি শুধু চাই কেউ ওটা পড়ে, জেনে নিক—ভুলে যাওয়া মানে কখনো অবহেলা নয়।” তন্ময় চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়ল। অক্ষরগুলি কাঁপা কাঁপা, কিন্তু শেষ লাইনে লেখা: “যদি আর দেখা না হয়, এই গল্পটাই হয়ে থাক আমাদের স্টারডাস্ট।” তন্ময়ের ঠোঁট ফাঁটা হাসিতে কাঁপল, চোখ ঝাপসা হয়ে এল। সে জানে না চিঠিটা কে লিখেছিল, কে পেয়েছিল, কিন্তু সে বুঝে গেল—স্টারডাস্ট ক্যাফে এখন শুধু ক্যাফে নয়, এটা হয়ে উঠেছে এক অনুভব, এক উত্তরাধিকার, যা সঞ্চিত হয় গল্পে, চোখে, নিঃশ্বাসে।
রাত্রে, বাড়ি ফিরে সে তার ডেস্কে বসল। পুরনো নোটবুক খুলল, আর একটানা লিখতে লাগল—না, এবার সে গল্প নয় লিখছে, সে লিখছে স্মৃতি, সত্য, আর সে মহিলাটিকে, যে তার জীবনের সবচেয়ে অলীক অথচ সবচেয়ে বাস্তব ভালোবাসা। শেষ লাইনে সে লিখল:
“তুমি যদি এখন কোথাও থাকো, জানো, আমি মনে রেখেছি। তুমি যদি আর না-ও ফিরে আসো, এই গল্পে তুমি চিরকাল থাকো। আর যদি কখনো আবার দেখা হয়, আমি তোমাকে বলব—তুমি যা ভুলে গিয়েছিলে, আমি সেটা আগলে রেখেছি।”
লেখা শেষ করে সে কফির কাপটা সামনে আনল, তাতে ধোঁয়া নেই, চা নেই, শুধু একটুকরো কাগজ—যাতে আঁকা একটা ছোট্ট চাঁদ আর লেখা:
“Stardust never dies.”
***