মৃত্যুঞ্জয় নস্কর
এক
সকালটা ছিল একেবারে অন্যরকম। শীতকালীন সকালের হালকা কুয়াশা এখনো খেলার মাঠের চারপাশে ঝুলে আছে, অথচ স্কুলের করিডোরে অস্বাভাবিক একটা গুঞ্জন। টিফিনের আগেই খবরটা ছড়িয়ে পড়েছিল—এইবারের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বড় মঞ্চনাটক হবে “সিরাজউদ্দৌলা”। সাধারণত প্রতি বছর নাচ-গান, আবৃত্তি আর ছোটখাটো নাটিকা হয়, কিন্তু ঐতিহাসিক নাটক করার সিদ্ধান্তটা ছিল একেবারে চমকপ্রদ। খবর শুনেই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটা উত্তেজনার ঢেউ বয়ে গেল। ক্লাসে বসে কেউ মন দিয়ে পড়াশোনা করছিল না, সবাই ফিসফিস করে আলোচনা করছে—কে কোন চরিত্রে মানাবে, কে নায়ক হতে পারে, কে আবার খলনায়ক! এমনকি যারা সাধারণত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেয় না, তারাও এবার আগ্রহী হয়ে উঠেছে, যেন এই নাটকের সঙ্গে যুক্ত হওয়া মানে একটা বিশেষ সম্মান।
শিক্ষকরা জানতেন, নাটক পরিচালনা করার দায়িত্ব যাবে সুবীর স্যারের ওপরেই। তিনি ইংরেজি পড়ান, কিন্তু নাটক তাঁর প্রাণের জিনিস। নাটকের খবর ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন তাঁর চোখে আলাদা একটা উজ্জ্বলতা খেলে গেল। তিনি জানতেন, “সিরাজউদ্দৌলা” হালকা নাটক নয়—ইতিহাস, আবেগ, নাটকীয়তা, সবকিছু মিলিয়ে এটাকে দাঁড় করাতে হলে দরকার শৃঙ্খলা আর প্রচুর রিহার্সাল। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের প্রতিক্রিয়া দেখে তাঁর মনে এক ধরনের আশ্বাস তৈরি হলো। ক্লাসের ভেতরে ভেতরে শুরু হলো হিসেব—রাহুল লম্বা আর গম্ভীর চেহারার, ওকে দিলে সিরাজ চরিত্রে মানাবে; অর্পিতা বা শ্রেয়সী নায়িকার চরিত্রে মানাবে; বাবনকে দিলে কোনো কৌতুকমিশ্রিত সৈনিকের চরিত্র ভালো হবে, কারণ ওর মুখ দেখলেই সবাই হেসে ফেলে। এমনকি খুদে ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের মাঝেও উৎসাহ দেখা গেল—ওরা ভাবছে, হয়তো সৈন্যের ভিড়ে বা মঞ্চসজ্জায় কাজ করতে পারবে। স্কুলজুড়ে যেন এক ধরনের আনন্দোচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ল, যার উৎস ছিল এই নাটকের খবর।
টিফিনের সময় মাঠে দাঁড়িয়ে ছাত্ররা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আলোচনা করছে। কেউ বলছে, “দেখিস, রাহুলকেই দেবে সিরাজ বানাবে।” কেউ আবার যুক্তি দিচ্ছে, “না না, অভিনয়ের ট্যালেন্ট হলে সৌরভ অনেক ভালো, ওর ডায়লগ বলার ভঙ্গিটা অসাধারণ।” মেয়েদের দলে তখন অর্পিতার নাম ঘুরে বেড়াচ্ছে—সে বরাবরই নাটকপ্রেমী, আর সবাই জানে, যদি নায়িকার চরিত্র সে পায় তাহলে নাটক জমে যাবে। ক্লাস ফোরের টুকটুকি পর্যন্ত উত্তেজিত হয়ে দিদিমণিকে জিজ্ঞেস করছে, “আমাদেরও কি ছোট্ট কোনো চরিত্র দেওয়া হবে?”—এই প্রশ্নে শিক্ষকরা মুচকি হাসছেন। সেদিন ক্লাসে ঠিকমতো পড়াশোনা হয়নি, কারণ সবাই নাটকের ভূমিকায় কে কোথায় থাকবে সেটা নিয়েই ব্যস্ত। যেন সারা স্কুলটা একটাই নাটকের মহড়া শুরু করে দিয়েছে, অথচ এখনো নির্বাচনের কাজও হয়নি। এই উত্তেজনার আবেশে সকালটা কেটে গেল, আর ছাত্রছাত্রীদের চোখে একটাই ঝলকানি—যদি নাটকের মঞ্চে নিজের জায়গাটা নিশ্চিত করা যায়!
দুই
রাহুল সবসময়ই একটু চুপচাপ প্রকৃতির ছেলে। ক্লাসে খুব বেশি চোখে পড়ে না, পড়াশোনায় মোটামুটি ভালো, খেলাধুলায়ও মাঝেমধ্যে অংশ নেয়, কিন্তু নাটক-সংস্কৃতির দলে তাকে কখনোই তেমন কেউ ভাবেনি। তাই যেদিন সুবীর স্যার চূড়ান্তভাবে ঘোষণা করলেন যে “সিরাজউদ্দৌলা” চরিত্রে রাহুল অভিনয় করবে, সেদিন স্কুলের অনেকেই অবাক হয়ে গেল। সুবীর স্যার ব্যাখ্যা দিলেন—রাহুলের চেহারা লম্বা, হাঁটার ভঙ্গি রাজকীয়, আর সবচেয়ে বড় কথা, তার গলা ভারী ও জোরালো। সিরাজের মতো চরিত্রে এই গলার জোর খুব দরকার। অন্য ছাত্ররা মেনে নিলেও রাহুল নিজের ভেতরে এক অদ্ভুত দোলাচলে পড়ে গেল। বাইরে থেকে চেহারা ও গলার জোর থাকলেও ভেতরে সে জানে—সে কখনো বড় দর্শকের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলেনি, অভিনয় তো দূরের কথা। মহড়া শুরুর প্রথম দিনেই সে ঘেমে উঠলো, হাত-পা কাঁপতে লাগলো, ডায়লগ মুখস্থ করা থাকলেও জিভ জড়িয়ে গেল। অর্পিতা তখন মুচকি হেসে বলেছিল, “দেখো, প্রিন্সরা কিন্তু ভয় পায় না।” কথাটা হালকা ঠাট্টা হলেও রাহুলের ভেতরে সেটা আরও চাপ তৈরি করেছিল।
দিনগুলো কেটে যেতে লাগলো মহড়ার মধ্যে দিয়ে। প্রতিদিন স্কুল ছুটির পর অডিটোরিয়ামে মহড়া বসত। স্যার হাতে স্ক্রিপ্ট নিয়ে বসতেন, আর ছাত্রছাত্রীরা পালা করে অভিনয় করত। রাহুল শুরুতে হোঁচট খাচ্ছিল বারবার, কিন্তু ধীরে ধীরে তার ভেতরে আত্মবিশ্বাস জন্মাতে লাগলো। তবে তার মনে সবসময় একটা ভয় লেগেই থাকতো—ডায়লগ ঠিকঠাক মনে থাকবে তো? দর্শকের সামনে দাঁড়ালে কি কণ্ঠস্বর আটকে যাবে না? বাড়িতে সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মহড়া করত, মায়ের শাড়ির আঁচল টেনে নিয়ে নিজের মাথায় চাপিয়ে মজা করে মুকুট বানাত, আর বাবার পুরোনো খাতা হাতে নিয়ে ডায়লগ আওড়াত। মা প্রথমে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেও পরে হেসে বলতেন, “আমার ছেলে তো একেবারে নওয়াব হয়ে গেছে।” বাবা আবার খানিকটা সিরিয়াস ভঙ্গিতে উৎসাহ দিতেন—“মঞ্চে দাঁড়াতে পারলে ভয় কেটে যাবে। শুধু মনে রেখো, তুমি যদি আত্মবিশ্বাসী হও, দর্শকও তোমাকে সিরাজ বলে বিশ্বাস করবে।” এইসব উৎসাহ রাহুলের ভেতরে সাহস জাগাত, তবু রাতের বেলা বিছানায় শুয়ে সে বারবার ডায়লগগুলো মুখে আওড়াত আর মনে মনে ভাবতো—যদি ভুল হয়, যদি সবাই হাসতে শুরু করে?
তবুও একটা অদ্ভুত জেদ জন্মেছিল তার মধ্যে। সে জানতো, এই চরিত্রটা একটা সুযোগ, যা হয়তো আর কোনোদিন তার জীবনে আসবে না। ক্লাসে যারা সবসময় তাকে অবহেলা করে, তারাও এখন তাকে “নায়ক” বলে ডাকছে। মাঠে খেলার সময় বন্ধুরা তাকে ঠাট্টা করে বলে উঠত, “এই যে নওয়াব, আমাদের সঙ্গে ফুটবল খেলবে তো?”—এই ঠাট্টার ভেতরেও রাহুল একরকম গর্ব অনুভব করত। তবে চাপও ছিল বিশাল। স্যারের চোখ সবসময় তার দিকে, নায়িকার ডায়লগের পরপরই তার সংলাপ আসছে, আর যদি সেখানে ভুল হয় তবে পুরো দৃশ্য ভেঙে যাবে। রাহুল তাই ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিতে লাগলো—আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলা, গভীর গলায় আবেগ মিশিয়ে ডায়লগ বলা, এমনকি স্কুলের ফাঁকা ক্লাসরুমে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে মহড়া দেওয়া। ধীরে ধীরে সে নিজেকে গড়ে তুলতে লাগলো সিরাজের চরিত্রে, তবে টেনশনটা এক মুহূর্তের জন্যও তাকে ছাড়েনি। রাতের বেলা চোখ বন্ধ করলেই তার মনে হতো, মঞ্চে দাঁড়ানো, হাজারো চোখ তাকিয়ে আছে, আর হঠাৎ করে তার মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে। এই ভয়ই তার যাত্রার সঙ্গী হয়ে থাকলো—নায়ক হওয়ার গৌরব আর ব্যর্থ হওয়ার আতঙ্কের মাঝামাঝি এক দ্বন্দ্বে ভেসে চলা এক কিশোর রাহুল।
তিন
অর্পিতা নাটক শুনলেই ভেতরে ভেতরে প্রাণ খুলে যায়। ছোটবেলা থেকেই সে স্কুলের প্রতিটি অনুষ্ঠানে অংশ নেয়—কখনো কবিতা আবৃত্তি, কখনো নাচ, কখনো ছোট নাটকে কোনো দুষ্টু মেয়ের চরিত্র। তার মা সবসময় বলতেন, “তুই একদিন অভিনেত্রী হবি।” যদিও সেটা মজা করেই বলা হতো, তবু অর্পিতার ভেতরে একরকম বিশ্বাস জন্মেছিল যে মঞ্চ তার নিজের জায়গা। তাই যখন সুবীর স্যার নাম ঘোষণা করে বললেন যে সে “সিরাজউদ্দৌলা” নাটকে লুটফুন্নিসা বেগমের চরিত্রে অভিনয় করবে, অর্পিতা যেন উচ্ছ্বাসে লাফিয়ে উঠল। এটা শুধুই একটা চরিত্র নয়, বরং গোটা নাটকের আবেগের কেন্দ্রবিন্দু। ইতিহাসের পাতায় লুটফুন্নিসা বেগম ছিলেন সাহসী ও দুঃখিনী নারী, যিনি নওয়াব সিরাজের পাশে থেকে তাকে শেষ অবধি সমর্থন করেছিলেন। অর্পিতার মনে হলো, এই চরিত্রটা করলে সে নিজের অভিনয় প্রতিভা সবার সামনে তুলে ধরতে পারবে। সে সন্ধেবেলা বাড়িতে বসে বই ঘেঁটে সিরাজের ইতিহাস পড়তে লাগল, ইউটিউবে ডকুমেন্টারি দেখল, যেন চরিত্রটা একেবারে নিজের ভেতরে ধারণ করতে পারে।
তবে মহড়ায় গিয়ে প্রথম দিন থেকেই সে বুঝতে পারল, রাহুলকে নিয়ে কিছুটা সমস্যা আছে। রাহুলকে বেছে নেওয়া হয়েছে নওয়াব সিরাজের চরিত্রের জন্য, আর সেটাই স্বাভাবিক—চেহারা, গলার জোর, সবই তার আছে। কিন্তু সমস্যা হলো আত্মবিশ্বাস। মহড়ার সময় অর্পিতা যখন ডায়লগ বলত, চোখে চোখ রেখে আবেগের সঙ্গে উচ্চারণ করত, তখন রাহুল যেন হকচকিয়ে যেত। তার হাত কাঁপত, কণ্ঠস্বর থেমে যেত, মাঝে মাঝে তো ডায়লগ ভুলেও যেত। শুরুতে অর্পিতা ভেবেছিল, নতুন হওয়ার কারণে একটু নার্ভাসনেস। কিন্তু কয়েকদিন কাটতে না কাটতেই সে বুঝল, রাহুল সত্যিই ভেতরে ভেতরে দারুণ অস্থির। অর্পিতা মনের ভেতরে একটা দ্বিধায় পড়ল—নায়ক যদি এইভাবে গুলিয়ে যায়, তাহলে নাটকের ভবিষ্যৎ কী হবে? সুবীর স্যারও এটা টের পাচ্ছিলেন, তাই বারবার রাহুলকে ধমক দিয়ে বলছিলেন, “কণ্ঠে জোর আনো, বুক চিতিয়ে দাঁড়াও, তুমি নওয়াব!” তবু রাহুলের চোখে সেই আতঙ্ক থেকেই যেত।
অর্পিতা তখন এক অদ্ভুত দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিল। সে ভাবল, যদি রাহুলকে সাহায্য করা যায়, যদি তাকে সাহস দেওয়া যায়, তবে নাটকটা বাঁচানো সম্ভব। তাই মহড়ার পরে সে রাহুলের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলতে শুরু করল। বলত, “দেখো, তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি যদি চরিত্রটা নিই সিরিয়াসলি, তাহলে তুমি কেন পারবে না? আমরা তো দু’জনেই একসঙ্গে আছি।” অনেক সময় সে হেসে ঠাট্টা করে বলত, “এই যে নওয়াব, যদি ডায়লগ ভুলে যাও, আমি কিন্তু মঞ্চেই তোমাকে টেনে তুলব।” তার এই খুনসুটি, আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গি রাহুলকে ধীরে ধীরে একটু সাহস দিতে শুরু করল। অর্পিতা বুঝত, তার দায়িত্ব শুধু নিজের চরিত্রকে নিখুঁত করা নয়, নায়ককেও আত্মবিশ্বাসী করে তোলা। তাই প্রতিদিন বাড়ি ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যতটা নিজের ডায়লগের মহড়া দিত, ততটাই ভাবত, রাহুলের চোখে চোখ রেখে কীভাবে তাকে শক্তি দেওয়া যায়। অর্পিতার মনে হচ্ছিল, লুটফুন্নিসা চরিত্রটা তার নিজের জীবনের সঙ্গেই যেন মিলে গেছে—সিরাজকে যেমন সমর্থন দিয়েছিল ইতিহাসে, তেমনি রাহুলকে সমর্থন দিয়ে যেতে হবে মঞ্চে। সেই উপলব্ধিই তাকে নাটকের প্রতি আরও নিবেদিত করে তুলল, আর মহড়ার প্রতিটি দিনে সে রাহুলের দিকে তাকিয়ে অনুপ্রেরণা ছড়িয়ে যেতে লাগল, যেন দুজনের কাঁধেই একসঙ্গে নাটকের ভার বহন করা হয়।
চার
সুবীর স্যার স্কুলে ইংরেজি পড়ালেও তাঁর ভেতরের আসল পরিচয় হলো নাট্যপ্রেমী মানুষ। তিনি ছাত্রজীবনে থিয়েটারে যুক্ত ছিলেন, কলেজে নামডাকও করেছিলেন অভিনয়ের জন্য। এখন শিক্ষক হলেও তাঁর হৃদয়ের বড় অংশ জুড়ে আছে নাটক, মঞ্চ, আলো আর দর্শক। স্কুলে যখনই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা হয়, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্যে আলোচনা ছাড়াই দায়িত্ব চলে আসে সুবীর স্যারের কাঁধে। তিনি এটাকে দায়িত্ব বলেও মনে করেন না—এটা তাঁর ভালোবাসা। কিন্তু ভালোবাসার জায়গায় তিনি কোনো আপস করেন না। নাটক মানে তাঁর কাছে নিখুঁত অভিনয়, মঞ্চে শৃঙ্খলা, সংলাপে সঠিক উচ্চারণ, আর আবেগে গভীরতা। তাই “সিরাজউদ্দৌলা” নাটক মঞ্চস্থ করার ঘোষণার পর থেকে তিনি যেন অন্যরকম হয়ে উঠলেন। হাতে মোটা স্ক্রিপ্ট, চোখে কঠোর দৃষ্টি, আর মুখে সেই চেনা ডাক—“সাইলেন্স! এইভাবে নাটক হয় নাকি?”—ছাত্রছাত্রীরা জানে, সুবীর স্যারের হাতে নাটক মানে অনেক গর্জন, অনেক ধমক, তবে শেষে একেবারে ঝকঝকে পরিবেশনা।
তবে ছাত্ররা যে সবাই তাঁর মতো গম্ভীর নয়, সেটা মহড়া শুরুর প্রথম দিনেই পরিষ্কার হয়ে গেল। কেউ মঞ্চে দাঁড়িয়ে হেসে গড়াগড়ি খায়, কেউ আবার ডায়লগ মুখস্থ না করেই আসরে হাজির। রাহুলের ডায়লগে তো মাঝেমধ্যেই গুলিয়ে যায়, অর্পিতা সিরিয়াস থাকলেও অন্যরা পেছনে ফিসফিস করে, হাসাহাসি করে। একদিন বাবন নামের ছাত্র, যে সৈনিকের চরিত্র পেয়েছে, সে নাকি মঞ্চে ঢুকেই ঘোষণা করে বসেছিল, “মহারাজ, দাড়ি কেমন লাগছে?”—সঙ্গে সঙ্গে পুরো হল হেসে উঠেছিল। সুবীর স্যার প্রথমে লাল মুখ করে গর্জে উঠলেন, “এটা কোনো সার্কাস নাকি? নাটক করতে এসেছ না খেলা করতে?” কিন্তু পরক্ষণেই তিনি বুঝলেন, এরা তো আসলে বাচ্চা, ওদের খেলাধুলো না থাকলে নাটকের প্রাণটাই শুকিয়ে যাবে। তবু তিনি কাউকে ছাড় দেন না—প্রতিদিন সবাইকে দাঁড় করিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মহড়া করান, ভুল হলে বারবার থামিয়ে দেন। তাঁর গলায় শাসন থাকলেও চোখে একটা মমতা লুকিয়ে থাকে, যা ছাত্ররা একসময় টের পায়।
দিনগুলো গড়িয়ে যেতে যেতে ছাত্ররা প্রথমে ভেবেছিল, সুবীর স্যার হয়তো একদিন পরে আর এত গর্জন করবেন না, অভ্যাস হয়ে যাবে। কিন্তু তারা ভুল প্রমাণিত হলো। প্রতিটি মহড়াতেই তিনি সমান কড়া, সমান শাসক। মঞ্চে হইচই হলে তিনি বই ছুঁড়ে ফেলে বলতেন, “নাটক কোনো হালকা ব্যাপার নয়, এটা ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি, বুঝেছ?” আবার যখন রাহুল ভয় পেয়ে ডায়লগ ভুলে যেত, তিনি দাঁত চেপে বলতেন, “সিরাজ যদি ভয় পেত, তবে পলাশীর যুদ্ধে দাঁড়াতে পারত?” এভাবেই ইতিহাসের উদাহরণ টেনে টেনে তিনি ছাত্রদের উজ্জীবিত করতেন। অনেকসময় তাঁর রাগে কারো চোখে জল চলে আসত, তবু সবার মনে একটা বিশ্বাস জন্মেছিল—স্যার চাইছেন নাটকটা সত্যিই অসাধারণ হোক। আসলে এই গর্জনই তাঁর প্রশিক্ষণের ধরণ, এই শাসনের আড়ালেই তাঁর ভালোবাসা। ছাত্ররা হয়তো ভয়ে স্যারের সামনে চুপ করে যেত, কিন্তু ভিতরে ভিতরে তারা জানত, সুবীর স্যার ছাড়া নাটক সম্ভব নয়। তিনি শুধু নাটকের পরিচালক নন, তিনি নাটকের প্রাণশক্তি, যিনি প্রতিদিন নিজের আবেগ ঢেলে দিচ্ছেন, যাতে শেষমেশ মঞ্চে আলো জ্বলার সঙ্গে সঙ্গে “সিরাজউদ্দৌলা” স্কুলের ইতিহাসে অমর হয়ে যায়।
পাঁচ
নাটকের দলে বাবনের ভূমিকা ছিল খুবই ছোট—একজন নামহীন সৈনিক, যে নাটকে দু’একটা সংলাপ বলে পরে ভিড়ের মধ্যে মিশে যায়। কিন্তু ছোট চরিত্রে অভিনয় পেলেও বাবন কখনও সেটিকে ছোট করে দেখেনি। বরং রিহার্সালের প্রথম দিন থেকেই সে তার স্বভাবসুলভ হাস্যরস দিয়ে পুরো নাট্যদলকে মাতিয়ে তোলে। অন্যরা সংলাপ মুখস্থ করতে ব্যস্ত, কিন্তু বাবনের চোখে যেন সবকিছুতেই কৌতুক লুকিয়ে থাকে। রিহার্সালের মাঝখানে হঠাৎই সে কোনো সংলাপ উল্টোপাল্টা বলে সবাইকে অট্টহাস্যে ভেঙে ফেলে। একদিন তো সে সৈনিকের পোশাক পরে হেঁটে আসার সময় এতটা বাড়াবাড়ি করে কাত হয়ে হাঁটছিল যে, পরিচালক সুবীর স্যার পর্যন্ত হেসে ফেলেন। যদিও তিনি রাগারাগি করে তাকে ধমকালেন, তবুও ভেতরে ভেতরে বুঝলেন—এই ছেলেটির মধ্যে আলাদা এক প্রাণশক্তি আছে, যা নাটকের পরিবেশকে সবসময় চাঙা করে রাখে। বাবনের সংলাপ কম হলেও রিহার্সাল হলে উপস্থিত প্রত্যেকের কাছে তার গুরুত্ব অনেক বড় হয়ে উঠল। সবার মনে হলো, যতক্ষণ বাবন আছে, ততক্ষণ এই অনুশীলনের চাপ আর ক্লান্তি যেন ছোঁয়াও যাবে না।
তবে শুধু হাস্যরস নয়, বাবনের ভেতরে লুকিয়ে ছিল একধরনের অভিনয়ের সহজাত প্রতিভা। তার সংলাপ খুবই ছোট হওয়ায় প্রথমদিকে কেউ বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি, কিন্তু সে যে অঙ্গভঙ্গি, মুখভঙ্গি আর দেহভঙ্গি দিয়ে সংলাপগুলো পরিবেশন করত, তাতে আলাদা এক মাত্রা যোগ হতো। মাঝে মাঝে সে নিজের সংলাপ ভুলে গিয়ে এমন কিছু অপ্রত্যাশিত কথা বলে ফেলত, যা মূল নাটকের কাহিনির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক না থাকলেও দর্শকদের সামনে হাসির রোল তুলতে বাধ্য করত। একদিনের রিহার্সালে তার এই আচরণ দেখে সহপাঠীরা এতটাই হেসেছিল যে, সুবীর স্যার rehearsal বন্ধ করে পাঁচ মিনিট বিরতি ঘোষণা করতে বাধ্য হন। বাবনের মধ্যে যেন একটা অদ্ভুত ম্যাজিক ছিল—যে কোনো পরিবেশকে আনন্দে ভরিয়ে তোলার ক্ষমতা। অনেক সময় যখন অন্যরা সংলাপ মুখস্থ করতে গিয়ে ভ্রূকুটি করত বা অস্থির হয়ে উঠত, বাবন তখন একখানা ছোট্ট রসিকতা করে বাতাসটা হালকা করে দিত। ঠিক যেন সে জানত—নাটক শুধু অভিনয় নয়, একধরনের দলগত অভিজ্ঞতা, যেখানে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়াটাই মূল উদ্দেশ্য।
তবে মজার বিষয় হলো, রিহার্সালে সে যতই কৌতুক করে থাকুক না কেন, নাটক মঞ্চে ওঠার সময় বাবন কিন্তু একেবারেই অন্য মানুষ হয়ে যেত। তার চোখে মুখে তখন কোনো খেয়ালিপনা থাকত না, বরং একধরনের গম্ভীর শৃঙ্খলা ফুটে উঠত। সুবীর স্যার একদিন ক্লাসের সামনে স্পষ্ট বলেছিলেন—“এই নাটকটা সফল হওয়ার জন্য শুধু বড় চরিত্র নয়, ছোট চরিত্রগুলোও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বাবন হয়তো মাত্র দুই লাইন বলবে, কিন্তু যদি সে সেটা সঠিকভাবে না বলে, তবে গোটা দৃশ্যটাই ফাঁপা হয়ে যাবে।” এই কথার পর থেকে বাবন নিজের ভূমিকা আরও গুরুত্ব দিয়ে নিতে শুরু করল। হাসি-ঠাট্টা চলতে থাকলেও সে বুঝতে পারল, মঞ্চে দাঁড়ানো মানে দায়িত্ব। সেই দায়িত্বকে সম্মান জানিয়ে সে নিজের ছোট্ট চরিত্রটিকে বড় করে তুলল। তার এই দ্বৈত স্বভাব—রিহার্সালে হাসির খোরাক, আর মঞ্চে শৃঙ্খলাবদ্ধ অভিনেতা—পুরো নাট্যদলের কাছে অনুপ্রেরণা হয়ে উঠল। বাবন যেন প্রমাণ করে দিল, চরিত্র বড় বা ছোট নয়, চরিত্রকে কেমনভাবে বাঁচানো যায়, সেটাই আসল শিল্প।
ছয়
নাটকের প্রস্তুতি যত এগোতে থাকে, ছাত্রছাত্রীদের ভেতরে ততই এক অদ্ভুত উন্মাদনা জন্ম নেয়। মঞ্চসজ্জার দায়িত্ব নেওয়ার পর সবাই যেন একেবারে শিল্পীর মতো হয়ে ওঠে। স্কুলের আঁকাআঁকির খাতা থেকে শুরু করে পুরোনো সংবাদপত্র, রঙিন কাগজ, কাঠের টুকরো—যা কিছু পাওয়া যায়, তারা ব্যবহার করতে শুরু করে। কেউ কাগজে রঙ মেখে রাজার সিংহাসনের নকশা আঁকছে, কেউ বা চুন-সুরকি মিশিয়ে মাটির তৈরি একটা দুর্গ বানানোর চেষ্টা করছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, তলোয়ার বানানোর সময় তারা নিজেরাই হাসাহাসি করছে, যেন কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, বরং একেবারে নাটকের মঞ্চেই তারা সৈনিক। অর্পণ লম্বা একটা কাঠি নিয়ে বলল, “এই হচ্ছে আমার যুদ্ধের তলোয়ার, এক আঘাতে শত্রুপক্ষ ধ্বংস!” বাকি সবাই হো হো করে হেসে উঠল। সিংহাসনের কাজটাও দারুণ উৎসাহে এগোতে থাকে। পুরোনো একটা ভাঙা চেয়ারকে সোনালি রঙের কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে রাজসিংহাসন বানানো হয়, আর মাথার ওপরে একটা কার্ডবোর্ড কেটে লাগানো হলো, যেন সেটাই ঝকমকে মুকুটের ছায়া ফেলে। ছাত্রছাত্রীরা এ কাজ করতে করতে নিজেদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক করছে—“মুকুটটা উঁচু হবে”, “না, ছোট হলেই ভালো দেখাবে”—তবু মজা এমনই যে রাগ-ঝগড়াও হাসির রসে গলে যায়। প্রত্যেকের মনে তখন একটাই চিন্তা—স্কুলের অনুষ্ঠানে যখন পর্দা উঠবে, সবাই যেন অবাক হয়ে যায় এই অভিনব মঞ্চসজ্জা দেখে।
মঞ্চসজ্জার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন চরিত্রের সাজগোজ নিয়েও শুরু হয় হুল্লোড়। দাড়ি তৈরির পরিকল্পনা ছিল আলাদা। কয়েকজন ছাত্র খুঁজে বের করল এক পুরোনো গামছা, সেটা টুকরো টুকরো করে কাটল, আর তুলো নিয়ে সেলাই করে বানিয়ে ফেলল ‘রাজদাড়ি’। প্রথমে সেটা মুখে লাগাতেই দারুণ হাসির উদ্রেক হলো, কারণ দাড়িটা এতই বড় হয়ে গিয়েছিল যে পুরো মুখটাই ঢেকে ফেলেছিল। নাটকের ‘রাজা’ চরিত্রে অভিনয় করা সৌমিক যখন সেটা পরে আয়নার সামনে দাঁড়াল, সবাই একযোগে হেসে উঠল। কেউ বলল, “তুই রাজা না, যেন জঙ্গলের বাঘ!” কেউ আবার মজা করে বলল, “এ দাড়ি পরে নাটক নয়, সার্কাস করলে ভালো হত।” তবুও সবাই বুঝতে পারল, এই দাড়িটাই আসল আকর্ষণ হতে চলেছে। মেয়েরাও পিছিয়ে ছিল না। তারা রাজকন্যার মুকুট বানাতে লেগে গেল রঙিন কাগজ, ঝিলমিলি টেপ আর কাঁচের টুকরো দিয়ে। মঞ্চে ঝলমলে আলো পড়লেই এই মুকুট যেন রত্নখচিত মনে হয়, সেই ভেবেই তারা কাজ করছিল। সাজগোজের সময় অনেকেই নিজের কল্পনা যোগ করছিল—কে যেন বলল, “তলোয়ারটা চকচকে করলে ভালো হয়”, আরেকজন বলল, “না, রঙিন করলে বেশি জমবে।” এইসব মতবিরোধের মাঝেও যে প্রাণোচ্ছ্বল উচ্ছ্বাস ভেসে বেড়াচ্ছিল, তা পুরো ক্লাসরুমকে উৎসবের মাঠে পরিণত করেছিল।
সবচেয়ে বড় মজা হলো, এইসব কাজ করতে করতে ছাত্ররা যেন নাটকের ভেতরেই ঢুকে গেল। মঞ্চসজ্জা শেষ হলে তারা নাটকের সংলাপের সঙ্গে মিলিয়ে সাজসজ্জার ব্যবহার প্র্যাকটিস করত। একে একে সবাই তলোয়ার হাতে দাঁড়াত, রাজা সিংহাসনে বসত, রাজকন্যা মুকুট পরে হাসত, আর প্রজারা অভিনয় করত করতালি দিয়ে। প্রত্যেকে নিজের কাজ নিয়ে গর্বিত—কারো হাতে বানানো মুকুট, কারো আঁকা পটভূমি, কারো রঙ করা তলোয়ার—সব মিলে যেন এক অপেশাদার শিল্পীদের দল তৈরি হয়েছে। এমনকি শিক্ষকও এসে দাঁড়িয়ে দেখলেন, আর অবাক হয়ে বললেন, “তোমরা তো একেবারে পেশাদার দলের মতো কাজ করছ।” সেই প্রশংসায় ছাত্ররা আরও উৎসাহ পেল, আর নতুন উদ্যমে লেগে গেল শেষ মুহূর্তের কাজ গুছিয়ে নিতে। তুলো দিয়ে বানানো দাড়ি, গামছার টুকরো, সোনালি কাগজে মুড়ানো সিংহাসন—সব মিলিয়ে সেই ছোট্ট স্কুলের মঞ্চ যেন হয়ে উঠল রূপকথার রাজ্য। পর্দা উঠবে, আলো জ্বলবে, আর তাদের স্বপ্নময় পৃথিবী সকল দর্শকের সামনে প্রাণ পাবে—এই আশাতেই তারা কাজের ফাঁকে ফাঁকে হাসি-ঠাট্টায় ভরে তুলল পরিবেশ। নাটকের মূল কাহিনির বাইরে এই মঞ্চসজ্জাই যেন হয়ে উঠেছিল আরেকটা আলাদা নাটক, যার মজা তারা চিরকাল মনে রাখবে।
সাত
শেষ মহড়ার দিন স্কুলের মিলনায়তন যেন একেবারেই ভিন্ন এক মঞ্চে রূপান্তরিত হয়েছিল। ছাত্রছাত্রীদের উত্তেজনা, আলো-আঁধারির খেলা, আর রঙিন পোশাকের সমাহারে পরিবেশটা যেন সত্যিকারের নাট্যমঞ্চে দাঁড়িয়ে গেছে। সকলে প্রস্তুত, শেষ মুহূর্তের খুঁটিনাটি ঠিকঠাক করতে ব্যস্ত। রাহুল, যে নাটকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করছে, নিজের সাজপোশাক ও সংলাপ নিয়ে গভীর মনোযোগী। মঞ্চের পিছনে সুবীর স্যার প্রত্যেককে ডাক দিয়ে তাদের সংলাপ শুনছেন, নির্দেশ দিচ্ছেন কোথায় বিরতি দিতে হবে, কোথায় চোখের ভঙ্গি বদলাতে হবে। কিন্তু এর মাঝেই সবার চোখ পড়ে রাহুলের দিকে। রাহুলের চরিত্রের জন্য তাকে নকল সাদা দাড়ি পরতে হয়েছে, যা পুরোটা নাটকের গম্ভীরতার সঙ্গে মানানসই। কিন্তু সমস্যা হলো, এই দাড়িটা বেশ ঝামেলার—কখনো খসে পড়ে, কখনো গলার দিকে চুলকায়, আবার কখনো সংলাপ বলার সময় মুখ ঢেকে ফেলে। মহড়া শুরুর আগে সবাই হেসে বলেছিল, “দেখিস, নাটকের দিন যেন এই দাড়ি না খসে যায়!” রাহুল গম্ভীর মুখ করে বলেছিল, “চিন্তা করিস না, আমি সামলে নেব।” কিন্তু ভাগ্য যেন অন্য কিছুর অপেক্ষায় ছিল।
মহড়ার মাঝপথে যখন দৃশ্যটা একেবারে গম্ভীর হয়ে উঠেছে, রাহুলের প্রবল আবেগের মুহূর্তে ঠিক তখনই দাড়িটা হঠাৎ নিচে সরে গিয়ে আধখানা ঝুলে পড়ে। মুহূর্তে মঞ্চে উপস্থিত সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল, তারপর একসাথে অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল। কাঁধ ধাক্কা খেয়ে বাবন মাটিতে বসে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, মীনা মুখ চেপে রেখেছে কিন্তু তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। দর্শক আসনে বসে মহড়ার খুঁটিনাটি দেখতে থাকা সহপাঠীরাও হেসে লুটোপুটি খেতে লাগল। অথচ রাহুল তখন ভীষণ অপ্রস্তুত। সে চেষ্টাও করছিল দাড়ি ঠিক করে নিয়ে সংলাপ চালিয়ে যেতে, কিন্তু তার কণ্ঠ আটকে যাচ্ছিল হাসির শব্দে। একসময় সে বিরক্ত হয়ে দাড়ি খুলে ফেলল, আর তখন হইচই আরও বেড়ে গেল। পুরো মিলনায়তন কেঁপে উঠল ছাত্রদের হাসির শব্দে, কেউ কেউ চিৎকার করে বলল, “ওরে, দাড়ি পালালো!” আবার কেউ বলল, “দেখো, মুছকি হাসি দিয়েছে দাড়িও।” কিন্তু এই আনন্দমুখর দৃশ্যের মধ্যে হঠাৎ দেখা গেল সুবীর স্যারের কঠিন মুখ। তিনি চুপচাপ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “যদি আরেকবার এমন বিপত্তি ঘটে, তাহলে নাটকই বন্ধ করে দেবো!” মুহূর্তেই যেন সব হাসি থেমে গেল, চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে এলো।
ছাত্রছাত্রীরা প্রথমে স্যারের কথায় চুপ মেরে গেলেও ভেতরে ভেতরে এক অদ্ভুত দোটানায় ছিল। একদিকে তারা জানত স্যার রাগারাগি করলেও নাটকের প্রতি তার ভালোবাসাই তাকে এতটা কঠোর করে তোলে, অন্যদিকে রাহুলের দাড়ি খসে যাওয়ার ঘটনা এমন এক মজার পরিস্থিতি তৈরি করেছিল যা কেউই সহজে ভুলতে পারবে না। পরের মিনিটগুলোতে সুবীর স্যার সবার সামনে দাঁড়িয়ে ধমক দিয়ে বললেন, “মঞ্চে ওঠা মানেই দায়িত্ব নেওয়া। দর্শকরা হাসবে, কান্না করবে, কিন্তু তোমাদের ভুল নিয়ে তারা মজা পাবে না। মনে রেখো, একটিমাত্র অসাবধানতা গোটা নাটককে নষ্ট করে দিতে পারে।” তার কণ্ঠে এত দৃঢ়তা ছিল যে, এক মুহূর্তের জন্য সবাই ভয়ে আঁতকে উঠল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে রাহুল গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “স্যার, দাড়িটা আমি আঠা দিয়ে ভালো করে আটকাবো। কালকের নাটকে আর কোনো সমস্যা হবে না।” তার কথা শুনে সবার মুখে আবার হাসির রেখা ফুটে উঠল, আর বাবন চুপিচুপি বলে ফেলল, “আঠা না দিয়ে পেরেক মেরে দিস, তাহলেই বাঁচবি।” কথাটা শুনে আবারও হাসির রোল উঠল, কিন্তু এবার স্যারও মৃদু হেসে ফেললেন। সেই মুহূর্তেই সবাই বুঝল, নাটক শুধু অভিনয় নয়—এ একসাথে শেখার, ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার, এবং হাসি-ঠাট্টার মধ্যেও শৃঙ্খলা বজায় রাখার এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।
আট
প্রদর্শনীর দিন সকাল থেকেই স্কুলের চারপাশে একটা আলাদা উত্তেজনা জমে উঠেছিল। ছাত্রছাত্রীদের কোলাহল, শিক্ষকদের দৌড়ঝাঁপ, সাজপোশাক নিয়ে সবার ব্যস্ততা—সবকিছুই যেন বাতাসে মিলেমিশে এক অদ্ভুত সুর তৈরি করেছিল। হলঘরের সামনে দর্শক আসতে শুরু করেছে, অভিভাবকরা, প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী, এমনকি পাশের স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারাও চলে এসেছেন নাটক দেখতে। মঞ্চের পিছনে তখন ছাত্ররা একেবারে নার্ভাস, কেউ মেকআপ ঠিক করছে, কেউ শেষ মুহূর্তের সংলাপ ঝালিয়ে নিচ্ছে, কেউ আবার চুপচাপ প্রার্থনা করছে। রাহুলও এর ব্যতিক্রম নয়। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বারবার নিজের মুখটা দেখছে। গলায় গামছা দিয়ে ঘাম মুছছে, মেকআপ ঠিকঠাক হয়েছে কিনা সেটা যাচাই করছে। তার চরিত্র ছিল নাটকের অন্যতম গুরুতর ভূমিকা—একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতা, যিনি দর্শকদের সামনে দীর্ঘ আবেগমথিত ডায়লগ বলবেন। সেই চরিত্রে প্রাণ আনতে অনেক পরিশ্রম করেছে সে, বিশেষ করে কণ্ঠস্বর আর আবেগে জোর দেওয়ার ক্ষেত্রে। আর এই চরিত্রের একটা অন্যতম আকর্ষণ ছিল তার মুখভর্তি নকল দাড়ি। এই দাড়িটাই যেন তাকে নাটকের চরিত্র থেকে আলাদা করে তুলে ধরত। রাহুল বারবার দাড়িটা হাত দিয়ে ঠিক করছে, আঠা ঠিকমতো লেগেছে কিনা সেটা দেখছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার মনে একটা অদ্ভুত অস্বস্তি কাজ করছিল—যেন কিছু একটা গড়বড় হবেই।
পর্দা উঠতেই নাটক শুরু হলো। প্রথম দৃশ্যগুলো বেশ স্বাভাবিকভাবে চলতে থাকল। বাবন, যে সবসময় মজা করে, অবিশ্বাস্যভাবে সিরিয়াস হয়ে নিজের ছোট্ট চরিত্রটা সুন্দরভাবে অভিনয় করে গেল। দর্শকরাও হাততালি দিল। তারপর ধীরে ধীরে গল্প এগোতে লাগল। রাহুলের প্রবেশের পালা এল। সে যখন মঞ্চে উঠল, তখন একেবারে অন্য এক মানুষ মনে হচ্ছিল তাকে। চোখে আগুন, মুখে দৃঢ়তা, কণ্ঠে অনর্গল আবেগ। দর্শকরা মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে গেল তার শক্তিশালী অভিনয়ে। সে দাঁড়িয়ে গর্জন করে ডায়লগ বলতে লাগল—দেশপ্রেম, ত্যাগ, সাহস আর স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার কথা। এমন সময়, ঠিক নাটকের মাঝামাঝি গিয়ে ঘটল সেই অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা। রাহুল যখন গলা ফাটিয়ে বলছে—“আমরা আমাদের মাতৃভূমির জন্য প্রান দিতেও পিছপা হব না”—তখনই তার ঠোঁটের নিচ থেকে দাড়িটা আস্তে আস্তে খসে পড়তে শুরু করল। প্রথমে কেউ খেয়াল করল না। কিন্তু হঠাৎ করেই গম্ভীর আলোচনার মাঝে দাড়িটা পুরোটা খসে মেঝেতে পড়ে গেল। মুহূর্তেই পুরো হলঘরে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা তৈরি হলো, তারপর হঠাৎ করেই হাসির বিস্ফোরণ। দর্শকরা হেসে গড়াগড়ি খেতে লাগল, কেউ আবার চিৎকার করে বলল, “আরে দাড়িও স্বাধীনতা চাইছে!” শিক্ষকেরা মুখ চেপে হাসি চাপতে লাগলেন, আর নাটকের অন্য অভিনেতারা ভেতরে ভেতরে একেবারে অস্থির হয়ে উঠল।
রাহুল প্রথমে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। সে বুঝতেই পারছিল না কি করবে। তার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, বুক ধড়ফড় করছিল। এত পরিশ্রম, এত রিহার্সাল, আর সেই আবেগময় মুহূর্তে এভাবে দাড়ি পড়ে যাওয়া—সব কিছু যেন তাকে এক নিমেষে মাটিতে ফেলে দিল। দর্শকের হাসির ঢেউ একের পর এক এসে তার মনোবল ভেঙে দিচ্ছিল। কিন্তু সেকেন্ড কয়েক পরই রাহুল যেন ভেতরের এক নতুন শক্তি খুঁজে পেল। সে দাড়ির দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্ত থেমে গেল, তারপর দাড়িটা তুলে হাতে নিয়ে বলল—“এই দাড়ি পড়ে গেলেই বা কী, আমাদের সাহস তো কখনও পড়ে যায় না!” মুহূর্তেই দর্শকদের হাসি হাততালিতে পরিণত হলো। শিক্ষকরা উঠে দাঁড়িয়ে করতালি দিলেন, সহপাঠীরা মঞ্চের পেছন থেকে উল্লাস করে চিৎকার করল। রাহুল নতুন করে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল এবং আবার ডায়লগ চালিয়ে গেল। শেষ দৃশ্য পর্যন্ত সে অসাধারণ অভিনয় করল। দর্শকেরা বারবার করতালি দিতে থাকল, আর শেষে যখন নাটক শেষ হলো, তখন পুরো হলঘর দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাল। পরে পর্দা নামার পরেও সবাই রাহুলকে ঘিরে ধরল। শিক্ষকেরা বললেন, “সত্যিকারের অভিনেতা সে-ই, যে মঞ্চে হোঁচট খেলেও দাঁড়িয়ে যায়।” সেই দিন থেকে রাহুলের দাড়ি-কাণ্ড স্কুলের হাসির খোরাক হয়ে উঠলেও একইসঙ্গে সেটা একটা শিক্ষা হয়ে রইল—আসল অভিনয় মানে মঞ্চে যে কোনও পরিস্থিতিকে নিজের কৌশলে সামলে নেওয়া। আর রাহুল, যে একসময় ভয়ে কেঁপে উঠেছিল, সেদিন মঞ্চেই নিজের আত্মবিশ্বাস খুঁজে পেল।
নয়
অর্পিতা প্রথম সারির অভিনেত্রী হলেও, স্কুলের এই নাটকের মঞ্চে এসে বারবার নার্ভাস হয়ে যাচ্ছিল। সেদিন অডিটোরিয়ামে দর্শকের ভিড় স্বাভাবিক দিনের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। চারদিকে শিক্ষক-শিক্ষিকা, অভিভাবক, সহপাঠীরা সবাই বসে আছে। আলো নিভে আসতেই তার মনে হল বুকের ভেতরটা যেন ঢাকের মতো ধুপধাপ করছে। রিহার্সালে কতবার ডায়লগ বলেছে, কতবার আয়নার সামনে অনুশীলন করেছে, তবু মঞ্চে দাঁড়িয়ে মুখ খুলতেই তার গলা শুকিয়ে গেল। প্রথমে ঠিকভাবে বললেও, মাঝপথে এসে হঠাৎ সুবীর স্যারের লেখা এক সংলাপ এমন মজার ভঙ্গিতে বেরিয়ে এলো যে, সে নিজেই হেসে ফেলল। দর্শক আসন থেকে ফিসফিসানি শুরু হল, কেউ কেউ চাপা গলায় হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করছে। অর্পিতা চেষ্টা করল সংলাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে, কিন্তু হাসি থামানো গেল না। ঠিক তখনই বাবন, যার হাতে একেবারে তুচ্ছ সৈনিকের ভূমিকাই ছিল, মঞ্চের ভেতর থেকে হঠাৎ কৌতুক ছুঁড়ে দিল—“মহারাজ, যদি যুদ্ধ শুরু হবার আগেই আমরা সবাই হেসে মরে যাই, শত্রুর সঙ্গে লড়বে কে?” এই অপ্রত্যাশিত সংলাপে পুরো অডিটোরিয়াম হেসে ফেটে পড়ল। অর্পিতার হকচকানো মুহূর্তের অস্বস্তি নিমেষেই মিলিয়ে গেল।
সুবীর স্যার মঞ্চের এক পাশে বসে ছিলেন, হাতে স্ক্রিপ্ট। তিনি জানতেন, এই দৃশ্যে সামান্য হালকা হাসি থাকলেও বাবনের সংলাপ একেবারেই লেখা ছিল না। প্রথমে তিনি বিরক্ত হয়ে কপালে হাত ঠেকালেন, মুখে চাপা বিরক্তি ফুটে উঠল। কিন্তু অডিটোরিয়ামের উল্লাস আর বাচ্চাদের সংক্রামক হাসি দেখে তিনিও আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। অজান্তেই ঠোঁটে হালকা হাসি এসে গেল। নিজের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এই অকস্মাৎ প্রাণশক্তি দেখে মনে হল, হয়তো এই ভুলই নাটকটাকে আরও বাস্তব করে তুলেছে। কারণ জীবনের মঞ্চে তো এমনিতেই সবকিছু স্ক্রিপ্ট মেনে চলে না—কখনও না-চাইতেও মানুষ হেসে ফেলে, কাঁদতে শুরু করে, কিংবা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। তাই হয়তো দর্শকরাও এই ভুলকে ভুল হিসেবে দেখল না, বরং নাটকেরই অংশ হিসেবে উপভোগ করল। অর্পিতা ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল, হাসি চাপা দিয়ে নতুন করে সংলাপ বলার চেষ্টা করল। আর মঞ্চের পাশে বাবন নিজের ছোট্ট সৈনিকের পোশাকে দাঁড়িয়ে আরও একবার ফিসফিস করে বলল, “চিন্তা করিস না, সব সামলে নেব।” সেই ফিসফিসানি শুধু অর্পিতা নয়, চারপাশের অন্য অভিনেতাদের মনও হালকা করে দিল।
এরপর থেকে নাটক এগোতে থাকল নতুন ছন্দে। ছোট ছোট অপ্রস্তুত ভুলগুলো যেন এক অদৃশ্য সুতোর মতো অভিনেতাদের আরও একত্রে বেঁধে ফেলছিল। অর্পিতা, বাবন, আর বাকিরাও মনে মনে ঠিক করল—স্ক্রিপ্ট ভুল হলেও এখন তারা ভয় পাবে না, বরং মঞ্চের মজা উপভোগ করবে। দর্শকরাও হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছিল বারবার। সুবীর স্যার নিজের ভেতরের শিক্ষক সত্তাকে খানিকটা সরিয়ে রেখে শুধু দর্শক হয়ে নাটক দেখতে শুরু করলেন। তার চোখে জল এসে যাচ্ছিল হাসির কারণে, তবু তিনি অনুভব করলেন—এই হাসিই আসলে নাটকের প্রাণ, যা লিখিত সংলাপের বাইরে গিয়েও দর্শকের হৃদয় জয় করতে পারে। নাটক শেষ হলে সবাই মঞ্চ থেকে নেমে একে অপরকে আলিঙ্গন করল, অর্পিতা হেসে বলল, “আজ ভুল না করলে এত মজা হত না।” বাবন ঠোঁটে চওড়া হাসি ঝুলিয়ে বলল, “আমার জন্যেই তো নাটক হিট হল।” সুবীর স্যার মাথা চাপড়ালেন তাকে, কিন্তু চোখে ভরা ছিল স্নেহ। নাটকটা হয়তো নির্ভুল ছিল না, কিন্তু অপ্রস্তুতির মধ্য দিয়েই তা হয়ে উঠল স্মরণীয়, হাসি আর উচ্ছ্বাসে ভরা এক অভিনয়যাত্রা।
দশ
নাটক শেষ হওয়ার পরেও যেন সেই হাসি-ঠাট্টার প্রতিধ্বনি সারা স্কুলজুড়ে ছড়িয়ে থাকে। পুরো অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাওয়ার পর মঞ্চের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা ছাত্র-শিক্ষক সবার মুখেই হাসির ছাপ—কেউ ভ্রু উঁচু করে সেই মুহূর্তটা মনে করছে, কেউ আবার এতক্ষণ পরও পেট ধরে হেসে চলেছে। রাহুল নিজের মুখে হাত দিয়ে বসেছিল, যেন ভাবছিল—“এ কি করলাম আমি!” নাটকের চূড়ান্ত দৃশ্যে দাড়ি খসে পড়ার ঘটনাটা এতটা অপ্রত্যাশিত আর মজাদার হয়ে উঠেছিল যে সেটাই হয়ে গেল পুরো অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ। দর্শকাসনে বসে থাকা ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে অভিভাবক, এমনকি শিক্ষকরাও হেসে লুটোপুটি খেয়েছিলেন। নাটকের আসল কাহিনি কে কতটা বুঝেছে সেটা নিয়ে আর তেমন আলোচনা হয়নি, বরং সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল সেই একটাই ঘটনা—রাহুলের “দাড়ি-কাণ্ড”। এই অনিচ্ছাকৃত ভুলই নাটককে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেল, আর রাহুল হয়ে উঠল অজান্তেই অনুষ্ঠানের হিরো। তবে, মঞ্চ থেকে নেমে আসার সময় তার মনে হয়েছিল সে বুঝি সব শেষ করে ফেলেছে—শিক্ষকেরা বকবেন, বন্ধুদের হাসির খোরাক হবে, এবং তার নিজের আত্মসম্মানও ভেঙে যাবে। কিন্তু তার ঠিক উল্টো হলো। সবাই এতটাই হাসিখুশি মেজাজে নিল যে রাহুলের মনে ধীরে ধীরে স্বস্তির হাওয়া বইতে লাগল।
পরদিন সকালেই পুরো স্কুলে “দাড়ি-কাণ্ড” ভাইরাল হয়ে গেল। কেউ মোবাইলে রেকর্ড করা ভিডিও আপলোড করে দিল স্কুলের গ্রুপে, কেউ আবার স্ক্রিনশট বানিয়ে মিম বানিয়ে ফেলল। একেবারে রাতারাতি রাহুল হয়ে গেল অনিচ্ছাকৃত কমেডি-হিরো। ক্লাসে ঢুকতেই সবাই একসঙ্গে হাততালি দিয়ে তার নাম ধরে ডাকল, কেউ মজা করে দাড়ি লাগানো ভঙ্গিতে তার দিকে তাকাল, আবার কেউ “দাড়ি দাদা” বলে নতুন নামও দিয়ে দিল। প্রথমদিকে একটু অস্বস্তি লাগলেও রাহুল বুঝল বিষয়টা আসলে নেতিবাচক নয়, বরং সবাই মজা করে তার সঙ্গেই ভাগ করছে। শিক্ষকরা পর্যন্ত তাকে দেখে হেসে ফেলছিলেন, তবে কেউই বকা দেননি। বরং নাট্যশিক্ষক মিসেস ঘোষ রাহুলকে আলাদা করে ডেকে বললেন—“রাহুল, তোমার ওই ভুলটাতেই নাটক জমে উঠেছিল। কখনও কখনও মঞ্চে ছোটখাটো ভুলই দর্শকদের মনে থেকে যায়, আর তোমার ঘটনা সেইরকমই।” এই প্রশংসা রাহুলকে এক অদ্ভুত আত্মবিশ্বাসে ভরিয়ে দিল। সে বুঝল, মঞ্চে নিখুঁত অভিনয় করার চেয়ে দর্শকদের মনে হাসি বা আবেগের জায়গা করে নেওয়া অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেই দিন থেকে স্কুলের করিডর যেন হয়ে উঠল তার হাঁটার রেড কার্পেট—যেদিকে যাচ্ছিল, সেদিক থেকেই হাসির শব্দ, হাততালি, আর অগণিত ঠাট্টা-মশকরা। তবু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এগুলোর কোনোটাই তাকে ছোট করে দেয়নি; বরং সে অনুভব করল, সবাই তাকে নতুনভাবে চিনেছে, ভালোবেসেছে।
সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে একা বসে রাহুল স্মৃতিগুলো মনে করছিল। তার মনে হলো, হয়তো এই ঘটনাই একদিন তার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে থাকবে। ছোট্ট একটা স্কুল নাটক, যেখানে সে মূল চরিত্রও ছিল না, সেখানেই ঘটে যাওয়া এক অনিচ্ছাকৃত ভুল তার পরিচিতি বদলে দিয়েছে। বাবা-মা টিভির সামনে বসে বারবার সেই ভিডিও দেখছিলেন, মা হেসে চোখে জল এনে ফেলছিলেন, আর বাবা হেসে বলছিলেন—“আমার ছেলেটা কিন্তু পুরো হলে ঝড় তুলে দিয়েছে।” রাহুলের বুকের ভেতর তখন গর্বে ভরে উঠছিল, যদিও সে জানত এটা পরিকল্পিত ছিল না। কিন্তু জীবন কখনো কখনো এরকম অপ্রত্যাশিত মুহূর্তই উপহার দেয়, যা থেকে থেকে যায় সারা জীবনের স্মৃতিতে। নাটকের পরে সেই স্মৃতিই রাহুলকে শিখিয়ে দিল—ভুল করলেও সেটাকে হাসি-ঠাট্টার মাধ্যমে আপন করে নেওয়া যায়। আর মানুষের মনে জায়গা করে নিতে সবসময় নিখুঁত হতে হয় না; কখনও কখনও হাস্যকর হতে পারাটাই সবচেয়ে বড় জেতা। সেই রাতেই ডায়েরি খুলে সে লিখল—“আজ আমি বুঝলাম, মঞ্চে মানুষ যেমন তার সংলাপ দিয়ে বাঁচে, তেমনি ভুল দিয়েও হাসির জন্ম দিতে পারে। যদি সেটা সত্যি হয়, তবে আমি আজকের দিনে সবচেয়ে সৌভাগ্যবান অভিনেতা।” নাটক শেষ হলেও, তার স্মৃতি চিরকাল থেকে যাবে বন্ধুদের, শিক্ষকদের, আর স্কুলের ইতিহাসে এক রঙিন কাহিনি হয়ে।
সমাপ্ত




