Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

সোনালী ডানার চিঠি

Spread the love

অর্ণিকা সেন


পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম সরভুমি, যেখানে শহরের কোলাহল পৌঁছায়নি, যেখানে লাল মাটির রাস্তা সরু হয়ে সাপের মতো পেঁচিয়ে গেছে মাঠের বুক চিরে, আর দূরে দূরে তালগাছ, খেজুরগাছ মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সরভুমির আকাশ বড় খোলা— সেখানে মেঘেরা প্রতিদিন গল্প বলে, পাখিরা ডানা মেলে উড়ে যায় দূর অজানায়, আর সন্ধ্যা হলে ধীরে ধীরে আঁধার নামে, সেই আঁধারে জোনাকিরা আলো জ্বালে। এ গ্রামেরই এক মাটির ঘরে জন্ম রেখা মণ্ডলের। তার বাবা জগদীশ মণ্ডল— গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের প্রাক্তন পিয়ন, এখন বয়সের ভারে জমিতে কাজ করেন। মা সরলা মণ্ডল সারা দিন সংসারের কাজ সামলান, মাঠ থেকে সবজি আনে, ঘরের আঙিনায় মাটির চুলোয় রান্না করেন। রেখা ছোটবেলা থেকেই একটু অন্যরকম। যেখানে গ্রামের মেয়েরা লুকিয়ে লুকিয়ে আয়নায় মুখ দেখে, সেলাই শিখে, বরের স্বপ্ন দেখে, রেখা সেখানেই বাবার ফেলে দেওয়া পুরনো খবরের কাগজ কুড়িয়ে কুড়িয়ে পড়ে, খবরের শব্দগুলো বুঝতে চেষ্টা করে। সন্ধ্যা হলে বাড়ির উঠোনে বসে সে কাগজের পাতা মেলিয়ে রাখে, আর মনে মনে ভাবে— এ কাগজে একদিন তার নিজের লেখা ছাপা হবে। স্কুলে হরেকৃষ্ণ স্যার ওর হাতের লেখা দেখে মুগ্ধ হয়ে বলেন, “তুই তো ভালই লিখিস। কাগজে লেখা বের করলে তো নাম হবে, রেখা!” সেই কথার রেশ ধরে রেখা খাতার পাতা ভরিয়ে ভরিয়ে লিখতে শুরু করে গ্রামের কথা— হরগৌরীর কুয়োর ধারে বসা বউঝিরা, শীতের ভোরে মাঠে চাষিরা, বর্ষায় প্লাবিত নদীর কূল, আর তাদের জীবনযুদ্ধ। গ্রামের মাটির ঘরের মধ্যে থেকেই তার চোখে বড় পৃথিবীর স্বপ্ন আঁকা হতে থাকে।

বছরের পর বছর কেটে যায়। রেখা স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে। স্কুলের শেষদিনে হরেকৃষ্ণ স্যার বলেছিলেন, “রেখা, তুই যে কাগজে কলম চালাবি, আমি জানি। কিন্তু গ্রামের গণ্ডি পেরোতে হবে। শহরে যেতে হবে, মানুষ চিনতে হবে, জীবনের কথা শিখতে হবে।” সেই কথাগুলো তার মনে গেঁথে যায়। বাড়িতে মা চায় মেয়েটা বিয়ে করুক, সংসার সামলাক। বাবা দোটানায় পড়েন— মেয়ের লেখাপড়া শেষ করানো নাকি বিয়ে দেওয়া? কিন্তু রেখার চোখে তখন অন্য স্বপ্ন। সে খবরের কাগজে সাংবাদিকদের লেখা দেখে ভাবে, ওর হাতের লেখা, ওর কথা একদিন এরকম ছাপা হবে, মানুষ পড়বে। কলেজে ভর্তি হয় সে, সিউড়ির এক সরকারি কলেজে সাংবাদিকতা অনার্স নিয়ে। প্রতিদিন লাল মাটির রাস্তা পেরিয়ে, রোদে-গরমে হাঁপিয়ে গিয়ে সে কলেজে পৌঁছায়। সেখানে নতুন জগৎ তার জন্য খুলে যায়। কলেজ লাইব্রেরির পুরনো পত্রিকাগুলো যেন তার বন্ধু হয়ে ওঠে। আনন্দবাজার পত্রিকা, দ্য টেলিগ্রাফ, দেশ, পরিচয়— কত খবর, কত লেখা সে পড়ে ফেলে। ক্লাস শেষে লাইব্রেরির কোণে বসে সে নোটবইতে টুকে রাখে নানান তথ্য, শিরোনাম, রিপোর্টের ভাষা। বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে শোনে— “এই পড়াশোনা করে কী হবে? মেয়েরা ঘর সামলায়, রান্না করে, সেলাই করে। বিয়ের বয়স হচ্ছে, মানুষ কী বলবে?” কিন্তু রেখার মুখে উত্তর নেই, চোখে দৃঢ় সংকল্প। সে চুপ করে খবরের কাগজের পাতা মেলায়, লিখে চলে তার ছোট ছোট রিপোর্ট— গ্রামের বন্যা, হাটের ঝগড়া, চাষিদের মিছিল, ইস্কুলে বেতন বাড়ানোর আন্দোলন। এ লেখা কেবল তার খাতায় সীমাবদ্ধ, তবু তার মনের ভেতর সেগুলো আকাশের মতো বড় হয়ে ওঠে।

কলেজের দেওয়াল পত্রিকায় প্রথমবার তার লেখা ছাপা হয়— আমাদের গ্রাম: স্বপ্নের চাষাবাদ। সেই দিনটা রেখার জীবনের মাইলফলক। সহপাঠীরা পড়ে প্রশংসা করে, স্যাররা বলেন, “লিখতে থাকিস, তোর কলম থামাবি না।” কিন্তু বাড়িতে সে খবর পৌঁছায় না। বরং গ্রামের লোকের কটুক্তি বাড়তে থাকে— “মেয়েটা দিনরাত কাগজে মুখ গুঁজে বসে থাকে। এমন মেয়েকে বিয়ে করবে কে?” মা ক্রমে চুপ করে যান, কিন্তু চোখের কোণে লুকিয়ে রাখা জল শুকোয় না। বাবা মাঝেমধ্যে রাতের খাবার খেতে খেতে বলেন, “রেখা, তুই শহরে চলে যা। এখানকার গণ্ডি তোর জন্য নয়। তোর স্বপ্ন তো বড়।” বাবার সেই কথা শুনে রেখার চোখ ভিজে যায়, কিন্তু মুখে দৃঢ়তা থাকে। স্নাতক শেষ হতেই সে বাবার দেয়া সামান্য টাকাপয়সা, মায়ের নিজের হাতে সেলাই করা কাপড়ের থলে, আর বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে কলকাতার পথে রওনা হয়। হাওড়া ব্রিজের নিচ দিয়ে গঙ্গার ঢেউ দেখেই তার মনে হয়, জীবন এক নতুন স্রোতে গা ভাসাতে শুরু করল। প্রথম প্রথম শহরের কোলাহল, ট্রামের ঘণ্টি, মেট্রোর ভিড়, মানুষের অসংখ্য মুখ তাকে বিভ্রান্ত করে। বাগবাজারের এক মহিলা হোস্টেলের ছোট্ট ঘরে আশ্রয় মেলে তার। এরপর শুরু হয় কাজ খোঁজার লড়াই। এক পত্রিকা অফিস থেকে আরেক অফিসে ঘোরা, প্রতিটি দরজায় নক করা, লেখা জমা দেওয়া, আর প্রতিবার ফিরে আসা— এই হয় তার নিত্যদিনের সঙ্গী। অনেকেই বলে, “অভিজ্ঞতা নেই, নতুনদের নেওয়া যায় না।” কেউ কেউ মিষ্টি হেসে কুপ্রস্তাব দেয়। রেখা তবু ভাঙে না। রাতে হোস্টেলের ছোট্ট ঘরে বসে সে লিখে চলে নতুন রিপোর্ট— হকারদের কথা, ফুটপাথে ঘুমানো শিশুদের গল্প, শহরের নিস্তেজ অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা অন্যায়ের ছবি।

রেখা বুঝতে শেখে, শহরের যুদ্ধ গ্রামের যুদ্ধের চেয়ে ভয়ঙ্কর। এখানে মানুষ মুখে কিছু বলে, মনে কিছু লুকিয়ে রাখে। পত্রিকা অফিসের সিনিয়র রিপোর্টাররা চোখের চাহনি আর কথার আড়ালে যা বোঝাতে চায়, তা সে খুব তাড়াতাড়ি বুঝে ফেলে। প্রথমবার এক অফিসে রাতে ডেকে পাঠানো হয় রিপোর্ট চেকের নাম করে। রেখা একরকম বুদ্ধি করে সেই জাল থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে আনে। এরপর সে আর সুযোগের আশায় পত্রিকা অফিসে দৌড়ায় না। সে ঠিক করে, তার লড়াই সে নিজেই গড়বে। সে ছোট ছোট বিষয় নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করে, সোশাল মিডিয়ায় লিখতে শুরু করে। রাতে হোস্টেলের জানালার পাশে বসে, দূরের চাঁদের আলোতে কাগজের পাতা ভরিয়ে ভরিয়ে লিখে চলে— শহরের লুকানো অন্ধকার, বঞ্চিতদের ব্যথা, ছোট্ট সুখের গল্প। কিছুদিন পর তার লেখাগুলো এক নতুন আশার সঞ্চার করে— মানুষ পড়ে, শেয়ার করে, প্রশংসা করে। একদিন সকালবেলায় তার মেলবক্সে আসে প্রথম পাঠকের চিঠি— এক কলেজ পড়ুয়া মেয়ে লিখেছে, “আপনার লেখা পড়ে সাহস পাই। আপনার মতো হতে চাই।” রেখার চোখের জল গড়িয়ে পরে, আর সে জানে— এই লড়াই বৃথা নয়। এই যুদ্ধই তাকে একদিন নিয়ে যাবে সেই জায়গায়, যেখানে সত্যের পাশে দাঁড়ানো সাংবাদিক হিসেবে তার নাম লেখা থাকবে।

কলকাতা শহরের প্রতিটি সকাল যেন রেখার জন্য এক নতুন লড়াইয়ের ডাক। বাগবাজারের হোস্টেলের জানালা খুললেই সে দেখতে পায় দূরে গঙ্গা পাড়, ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে নামা মানুষ, ভোরের কুয়াশায় হারিয়ে যাওয়া নৌকার ছায়া। তবে এসবের ফাঁকে তার মন ঘুরপাক খায় মেট্রো স্টেশনের গুমোট ভিড়, পত্রিকা অফিসের নির্লজ্জ প্রস্তাব, আর অভিজ্ঞতার অজুহাতে কাজ না দেওয়া সম্পাদকদের মুখ মনে করে। প্রতিদিন সকালে সে হোস্টেলের ভাঙা আয়নায় মুখ দেখে বলে, “আজও হারব না।” হাতে থাকে পুরনো ফাইলে রাখা তার লেখা— চাঁদনি চক হকারদের গল্প, মহাজনের সুদের ফাঁদে আটকে যাওয়া এক বিধবার জীবন, কিংবা শিয়ালদহ স্টেশনে রাত কাটানো ছেলেমেয়েদের কথা। এই লেখা নিয়ে সে রওনা হয় এক অফিস থেকে আরেক অফিসে— চৌরঙ্গি, এসপ্ল্যানেড, ধর্মতলা ঘুরে ঘুরে। কেউ দেখে হেসে বলে, “মেয়েরা এই লাইনে কদ্দুর যাবে!” কেউ আবার হাত বাড়িয়ে দেয় অন্য অভিসন্ধির ইঙ্গিত। প্রথম প্রথম অপমান হজম করতে গিয়ে চোখ ভিজে উঠত রেখার, কিন্তু এখন সে শক্ত হয়ে গেছে। পকেটে শুধু মেট্রোর ভাড়া আর হাল্কা ভাত-ডালের টিফিন, তবু তার বুক ভরা সাহস। সে ঠিক করে, এ শহরে সত্যের কলম সে চালাবেই— কাগজের পাতা একদিন তার লেখা ছাড়াই পূর্ণ হবে না।

দিন যায়, রাত আসে। শহরের অজানা অলিগলি যেন তার আপন হয়ে ওঠে। দুপুরে নর্থ কোলকাতার এক ছোট কাগজের অফিসে সে প্রথমবার কাজ পায়— বিনা বেতনে স্ট্রিংগার হিসেবে। কাজ শুধু খবর জোগাড় করা, ছবি তোলা, আর লেখা জমা দেওয়া। সম্পাদক বাবু স্পষ্ট বলে দেন, “নাম হবে, অভিজ্ঞতা হবে, বেতন? পরে দেখব।” রেখা মুখের কোণে হালকা হাসি নিয়ে রাজি হয়ে যায়, কারণ তার কাছে নাম আর অভিজ্ঞতাই এখন মূল পুঁজি। রাতভর সে শিয়ালদহ স্টেশনের ফুটপাথে বসে ভিখারিদের গল্প শোনে, লঞ্চঘাটের মজুরদের বেদনার কথা লিখে রাখে। তার খাতার পাতায় জমা হতে থাকে কলকাতার অজানা ইতিহাস— ভাঙা ঘরের কষ্ট, অন্ধকার গলির কান্না। প্রথমবার তার লেখা ছাপা হয়— ছোট্ট এক রিপোর্ট: “স্টেশন চত্বরে শিশুশ্রম”। নামটা নিচে ছোট অক্ষরে— রেখা মণ্ডল। হোস্টেলে ফিরে সে সেই কাগজের কাটিং বালিশের তলায় লুকিয়ে রাখে, আর সারারাত ঘুম আসে না— এই আনন্দের ঘুম। কিন্তু আনন্দ বেশিক্ষণ টিকে না। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সে বুঝে যায়, নাম পাওয়া যত সহজ, মর্যাদা পাওয়া তত নয়। অফিসের এক সিনিয়র তাকে অন্ধকারে আলাদা করে ডেকে বলে, “আরও এগোতে হলে বুঝে চলতে হবে, স্মার্ট হতে হবে।” রেখা সেদিন সোজা বলে, “আমার কলমই আমার স্মার্টনেস।” এরপর শুরু হয় ঠাণ্ডা প্রতিশোধ— তার লেখা কেটে দেওয়া, ছবি না ছাপা, অফিসে অপমান। তবু সে হারে না।

এরই মধ্যে রেখা জানতে পারে, শহরের বড় কাগজগুলো ফ্রিল্যান্স রিপোর্টার খুঁজছে। সে ঝাঁপিয়ে পড়ে নতুন আশায়। দিনের পর দিন সে বসে থাকে বড় পত্রিকার অফিসের রিসেপশনের সামনে, রিপোর্টারদের ওঠা-নামা দেখে, সাহস করে হাতে লেখা রিপোর্ট জমা দেয়। কেউ দেখে নেয়, কেউ ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু একদিন ভাগ্য মুখ তুলে চায়। এক প্রখ্যাত সাপ্তাহিকের সহসম্পাদক তার লেখা পড়ে ডেকে পাঠায়। “তোমার লেখায় কাঁচা জিনিস আছে, কিন্তু সততা আছে। একটা কাজ দিচ্ছি— পাড়ার পুজোর রিপোর্ট করো, তবে অন্যভাবে। যা সবাই লেখে, তা নয়। মানুষের কথা নিয়ে এসো।” রেখা রাতভর ঘুরে বেড়ায় উত্তর কলকাতার পাড়া-পুজো, দেখে কারও মুখের হাঁসি, কারও গোপন কান্না। সে গল্প লেখে এক ঠাকুর গড়ার মিস্ত্রির— যিনি নিজের ঘরে দুর্গাপুজো করতে পারেননি কোনোদিন, আর এবারও শারদীয়ার রাতে প্যান্ডেলের পেছনে বসে চুপচাপ চা খেয়েছেন। লেখা ছাপা হয়, পাঠক চিঠি পাঠায়, সম্পাদক প্রশংসা করেন। এ যেন রেখার জন্য প্রথম আলো, যে আলো কাগজের শহরে তার নতুন লড়াইয়ের দিশা দেখায়।

কিন্তু এই লড়াই সহজ হয় না। প্রতিদিন তাকে কুৎসিত প্রস্তাব, হিংসা, ষড়যন্ত্রের জালে লড়তে হয়। সহকর্মীদের অনেকেই মুখে হাসে, মনে বিদ্বেষ পোষে। “গ্রামের মেয়ে শহরে কাগজের রাজনীতি বুঝবে?” এই কথাই ওরা প্রায় বলেই ফেলে। একবার এক বড় রিপোর্টারের পাশে বসে কফি খেতে খেতে সে শুনে ফেলে, “ওর সাহস তো কম নয়! একদিন টিকতে পারবে না।” এসব শুনে প্রথমে কষ্ট পায় রেখা, পরে নিজের হাত মুঠো করে শক্ত করে। সে বুঝে যায়, শহর তাকে সহজে জায়গা দেবে না, কিন্তু এই শহরের কাগজের পাতায় সত্যের জন্য সে লড়বেই। তার কলম কেবল খবরের জন্য নয়, লুকিয়ে থাকা বেদনার জন্য, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার জন্য। রাতে হোস্টেলের ছোট্ট ঘরে বসে দূরের আলো-আঁধারি শহরের দিকে তাকিয়ে সে ভাবে— “আমার লড়াই শুরু হয়েছে মাত্র। আর আমাকে অনেক পথ যেতে হবে।” দূরে শিয়ালদহ স্টেশনের হুইসেল বেজে ওঠে, আর রেখা জানে, এক নতুন সকাল অপেক্ষা করছে তার জন্য।

কলকাতার নভেম্বরের কুয়াশা ছাওয়া সকালে রেখা তার হাতে ছোট নোটবুক আর এক পুরনো পেন নিয়ে বেরিয়ে পড়ে, মনে একটাই লক্ষ্য— এক সত্যকে জনসমক্ষে আনা। বড় পত্রিকার সহসম্পাদক তাকে যে কাজ দিয়েছেন, সেটি সাধারণ কোনো খবর নয়— শহরের নামী এক বৃদ্ধাশ্রমে বৃদ্ধাদের উপর নির্যাতনের গোপন কাহিনি বের করতে হবে। গোপন উৎস থেকে খবর এসেছে, সেখানে সরকারি অনুদানের টাকায় চলে অন্যায়ের বাণিজ্য। রেখার বুকের ভেতর হাল্কা শঙ্কা বাজতে থাকে, কিন্তু পায়ের দৃঢ়তা কমে না। সারা দিন ধরে সে ঘুরে বেড়ায় সেই বৃদ্ধাশ্রমের চারপাশে— দেখছে, শোনছে, গোপনে নোট নিচ্ছে। বৃদ্ধাদের ক্লান্ত চোখ, ভাঙা বিছানা, আর একপাশে গুমোট অন্ধকার ঘরে তালা দেওয়া ঘরগুলো যেন শতকথা বলে। বিকেলে সে আলাপ করে বৃদ্ধা সরস্বতী দেবীর সঙ্গে— কাঁপা কাঁপা হাতে সরস্বতী দেবী বললেন, “আমাদের কথা কেউ শোনে না মা, তুমিই যদি শোনো…” সেই কথায় রেখার চোখ ভিজে যায়। সে ভাবে, এই শহরের অন্ধকারের পেছনের সত্যই তার কলমের শক্তি হবে।

রাত নামে, শহরের বাতি একে একে জ্বলে ওঠে। রেখা হোস্টেলের ঘরে ফিরে আসে, কিন্তু তার মাথায় ঘুরতে থাকে বৃদ্ধাশ্রমের সেই দৃশ্যগুলো। সে নোটবুক খুলে রাতভর লিখতে থাকে— সরস্বতী দেবীর কথা, লুকানো কষ্ট, সরকারি অনুদানের টাকা লোপাটের তথ্য, কেয়ারটেকারদের অমানবিক আচরণ। লিখতে লিখতে সে যেন সেই বৃদ্ধাদের কষ্ট নিজের হৃদয়ে অনুভব করে। ভোরবেলা সে রিপোর্ট সম্পূর্ণ করে পত্রিকা অফিসে মেইল করে পাঠিয়ে দেয়। সহসম্পাদক পড়ে বললেন, “দারুণ কাজ করেছ। এবার ছবি তোলার কাজটাও করতে পারবে?” রেখা হেসে বলল, “করব, স্যার।” পরদিন ভোরে আবার সে বৃদ্ধাশ্রমে যায়— ক্যামেরার লেন্সের পেছন থেকে সে বন্দি করে ফেলে ভাঙা ঘর, বৃদ্ধাদের ক্লান্ত মুখ, নোংরা রান্নাঘর। ছবি আর রিপোর্ট একসঙ্গে জমা দেয়। কয়েকদিনের মধ্যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়— শহর তোলপাড় হয়। প্রশাসন তদন্তের আশ্বাস দেয়।

কিন্তু সত্যের পেছনে ছুটে যাওয়ার দাম দিতে হয়। রিপোর্ট বেরোনোর পর থেকেই রেখার উপর অজানা ফোন কল আসতে থাকে— “চুপচাপ থাকো, বেশি বাড়াবাড়ি কোরো না”, “নিজের ভালোটা বোঝো।” প্রথমে সে ভয় পায়, রাতে ঘুম আসে না। কিন্তু সে জানে, এই ভয়ই তার শক্তি হবে। হোস্টেলের বাকি মেয়েরা তাকে সাহস জোগায়— “তুমি আমাদের গর্ব রেখা!” সহসম্পাদক তাকে ডেকে বলেন, “এ শহরে সত্য বলার দায় সহজ নয়। তুমি সত্যিকারের সাংবাদিক হতে চলেছ।” সেই প্রশংসা রেখার মনোবল আরও বাড়িয়ে তোলে। সে ঠিক করে, একের পর এক শহরের অন্ধকার কোণ থেকে সত্যকে টেনে বের করবে। এবার তার লক্ষ্য রেল স্টেশন চত্বরে শিশুদের দালাল চক্র। সে রাতভর শিয়ালদহ স্টেশনে ঘুরে ঘুরে সেই শিশুদের ছবি তোলে, গল্প শোনে, আর লিখে চলে— এই শহরের মুখোশ খুলে দেওয়ার জন্য।

রাতের কলকাতা যেন আর তার জন্য ভয়াবহ নয়, বরং নতুন রিপোর্টের ক্ষেত্র। শিয়ালদহের গলি, হাওড়ার ব্রিজের নিচ, মেট্রোর গেটের পাশে বসা হকাররা তার লেখার চরিত্র হয়ে ওঠে। সে এখন বুঝতে পারে, তার কলম কেবল কাগজ ভরাতে নয়, মানুষের মুখোশ খুলে দিতে, অন্যায়ের শিকড় উপড়ে ফেলতে। সহসম্পাদক তাকে বলে, “তোমার মতন সাংবাদিক এই শহর চায়।” সেই কথায় রেখার চোখে জল আসে, কিন্তু সে জানে— এই লড়াই চলবে, অনেক পথ বাকি। দূরে রাতের কলকাতায় ট্রামের ঘণ্টি বেজে ওঠে, আর রেখা জানে, তার লড়াই অন্ধকার পেরিয়ে আলোয় পৌঁছাবেই। সে জানালার বাইরে চেয়ে থাকে, দূরে গঙ্গার ওপর জেগে থাকা হাওড়া ব্রিজের আলো তার নিজের জীবনের আলোর মতো জ্বলজ্বল করে।

বৃদ্ধাশ্রমের সেই রিপোর্ট যখন শহরের নামজাদা পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হয়, তখন কলকাতার অলিগলিতে, চায়ের দোকানে, বাসস্ট্যান্ডে সেই কাগজের পাতা খুলে মানুষ চোখ বড় করে পড়তে থাকে রেখার লেখা। “অমানবিকতার আস্তানা: বৃদ্ধাশ্রমের গোপন কাহিনি”— এই শিরোনামে বের হওয়া প্রতিবেদনে যেন নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। কিন্তু রেখার জীবনে শান্তি আসে না; বরং চারপাশে শ্বাসরুদ্ধ করা চাপ আরও ঘনিয়ে আসে। অফিসের অনেকেই মুখে বাহবা দিলেও চোখে পড়ে যায় হিংসার ছায়া। একদিন সহকর্মী শমীক হালকা হেসে বলল, “নতুন মেয়ে, প্রথমেই বড় খবর ফাটিয়ে দিল… সাবধান থেকো, শহর ভালো মেনে নেবে না।” রেখা হাসল, কিন্তু ভেতরে বুঝল, এই শহরে সত্যি বলার দাম দিতে হয়। রাতে হোস্টেলের জানালায় দাঁড়িয়ে সে দেখে দূরের হাওড়া ব্রিজের আলো, আর ভাবে— এই আলো কি তার জন্যও জ্বলে? নাকি এই শহরের অদৃশ্য দেয়ালগুলো তাকে চিরকাল বন্দি করে রাখবে? সেদিন রাতেই অজানা নম্বর থেকে ফোন আসে, কড়া কণ্ঠস্বর, “তুমি বেশি জানার চেষ্টা কোরো না।” রেখা প্রথমে ভয় পায়, তারপর ভেতর থেকে উঠে আসে এক অদম্য শক্তি। সে নিজেই নিজেকে বলে, “যা শুরু করেছি, তা শেষ করব।”

রিপোর্টের জেরে বৃদ্ধাশ্রমে তদন্ত শুরু হয়। প্রশাসনের গাড়ি এসে দাঁড়ায় সেই ভাঙা বাড়িটার সামনে। বৃদ্ধারা জানলার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখে, যেন আশার আলো ফিরে এসেছে। সরস্বতী দেবী একদিন রেখাকে ফোন করে বলেন, “মা, তোর জন্যই বোধহয় শেষ বয়সে কিছু সুবিচার পাব।” সেই কথায় রেখার গলা বুজে আসে। সে জানে, সত্যের জন্য লড়াইটা শুধু তার একার নয়— এই শহরের হাজারো নির্যাতিত মানুষেরও। এই সাফল্যের মধ্যেই সে নতুন আরেক দায়িত্ব পায়— স্টেশনের গুমোট অন্ধকারে বসে থাকা পথশিশুদের গল্প শোনার, তাদের জীবনের গোপন যন্ত্রণাগুলোকে জনসমক্ষে আনার। রাতের শিয়ালদহ স্টেশনের কুয়াশা ঢাকা প্ল্যাটফর্মে সে বসে থাকে— গায়ে ছেঁড়া চাদর জড়ানো ছোট্ট ছেলে টুকাই বলে, “দিদি, লিখে দিও, আমরা কীভাবে বাঁচি।” রেখার কলম চলে— শিশুশ্রম, পাচার চক্র, আর স্টেশনের অন্ধকারে গিলে খাওয়া স্বপ্নের গল্পগুলো কাগজে আঁকা হতে থাকে। যখন সেই লেখা ছাপা হয়, শহরের প্রশাসন আবারও নড়েচড়ে বসে। কিন্তু সঙ্গে আসে আরও হুমকি, আরও ষড়যন্ত্র। রেখা জানে, এই অদৃশ্য দেয়াল ভাঙা সহজ নয়, কিন্তু তার কলমে সেই শক্তি আছে। রাতে সে জানালার বাইরে চেয়ে থাকে, দূরের গঙ্গার ঢেউ আর হাওড়া ব্রিজের আলো যেন তাকে বলে, “পথ থামাস না, দেয়াল পেরিয়ে চল।”

কলকাতার জানুয়ারির কুয়াশা ঘেরা রাতগুলোয় রেখার লড়াই যেন আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। বৃদ্ধাশ্রমের রিপোর্ট আর শিয়ালদহ স্টেশনের শিশুদের কাহিনির পর শহরের রাজনৈতিক মহল, দালাল চক্র আর ক্ষমতাবানদের চোখে সে যেন এক বিষফোঁড়া। বড় পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর ভেতরেই কেউ কেউ তার সাহসকে হিংসা করতে শুরু করেছে। কেউ অগোচরে বলছে— “ওই গ্রামের মেয়েটা বেশি বাড়ছে না?” সহকর্মীদের কেউ কেউ মুখে হাসে, পেছনে ষড়যন্ত্রের জাল বুনে। এর মধ্যেই রেখা এক ভয়াবহ ঘটনার খবর পায়। শহরের এক পুরনো জুটমিলের ভেতর শ্রমিকদের আন্দোলন চলছে— মালিক পক্ষ বেতন দিচ্ছে না ছ’মাস ধরে। শ্রমিকেরা ক্ষোভে ফুঁসছে, আর মিলের বাইরে পুলিশের বড় জটলা। সহসম্পাদক তাকে ডেকে বলেন, “রেখা, এই কাজটা তোমার জন্য। ভেতরের খবর নিয়ে এসো, কিন্তু সাবধান, ওখানকার বাতাবরণ ভাল নয়।” রেখা মনে মনে ভাবে, এও তার কলমের পরীক্ষা। পরদিন সকাল থেকে সে জুটমিলের গলিঘুঁজির ভেতর ছুটে বেড়ায়। মজুরদের গলায় কান পাতে— কেউ ফিসফিসিয়ে বলে, “আমরা খালি পেটে দিন কাটাই, আমাদের কথা লিখে দাও।” কেউ চোখের জল মুছে বলে, “লিখে দাও বোন, যাতে সরকার শোনে।” রেখা লিখতে থাকে তাদের কথা, ছবি তোলে ভাঙা মেশিনের, কালচে স্যাঁতসেঁতে দেওয়ালের। কিন্তু এতেই তার লড়াই শেষ নয়। রিপোর্ট অফিসে জমা দেওয়ার পরই অজানা নম্বর থেকে হুমকি আসতে থাকে— “বেশি লিখিস না, সাবধান থাক।” রাতে হোস্টেলে সে বিছানায় শুয়ে থাকে, জানলার ফাঁক দিয়ে দেখে দূরের কুয়াশায় ঢাকা শহর, আর ভাবে— তার কলম বন্ধ করতে চাইছে যারা, তাদের মুখোশ খুলে দিতেই হবে। রাতে স্বপ্নে সে দেখে, কাগজের পাতা জ্বলছে আগুনে, আর সে ছুটছে সেই আগুনের পেছনে— সত্যের খোঁজে, সাহসের খোঁজে।

রেখার রিপোর্ট ছাপা হয়, শহর জেগে ওঠে। শ্রমিক আন্দোলনের খবর প্রশাসনের টেবিল পর্যন্ত পৌঁছে যায়। কিছু টিভি চ্যানেলও সেই খবর তুলে ধরে, আর সেই সঙ্গে আসে আরও হুমকি, আরও ষড়যন্ত্র। একদিন সন্ধ্যায় সে অফিস থেকে ফিরছে, হঠাৎ দুজন লোক অন্ধকার গলিতে ঘিরে ধরে, “তোর মতন মেয়েদের উচিত বাড়িতে চুপচাপ বসে থাকা।” রেখা ভয় পায় না, জোর গলায় বলে, “আমার কলমের জবাব ওভাবে পাওয়া যাবে না।” তারা চলে যায়, কিন্তু রেখা বুঝে যায়, শহরের অন্ধকার তার চারপাশে ঘনিয়ে আসছে। সহসম্পাদক তাকে ডেকে বলেন, “রেখা, তুমি চাইলে অন্য বিটে যেতে পারো, নিরাপদ থাকবে।” রেখা মৃদু হাসে, “যেখানে সত্যের দরজা বন্ধ, আমি সেখানেই লিখব।” এরপর সে নতুন এক অন্যায়ের খবর নিয়ে নামে— শহরের এক সরকারি হাসপাতালের ভেতর ওষুধ চুরির কাণ্ড। রাতভর সে হাসপাতালের বারান্দায় বসে থাকে, লুকিয়ে ছবি তোলে, ওয়ার্ডবয়ের গল্প শোনে, রুগিদের আর্তনাদ কানে তোলে। রিপোর্ট তৈরি হয়— অন্যায় ফাঁস হয় পত্রিকার পাতায়। কিন্তু আগুনের ছায়া তার পেছন ছাড়ে না। অফিসের কেউ কেউ মুখে বলে, “তোমার মতো সাহসী সাংবাদিক দরকার ছিল শহরে,” কিন্তু পেছনে লুকিয়ে থাকে তাদের ভয় আর হিংসা। হোস্টেলে ফিরলে মেয়েরা তাকে ঘিরে ধরে, “তুমি আমাদের অনুপ্রেরণা রেখা!” রেখা জানে, তার লড়াই শেষ হয়নি, বরং সত্যের জন্য তার এই যুদ্ধ চলবে, যতক্ষণ না শহরের প্রতিটি অন্ধকার কোণ আলোয় ভরে ওঠে। সে জানলার বাইরে দেখে, দূরে গঙ্গার ওপারে হাওড়া ব্রিজের বাতিগুলো জ্বলছে— যেন তার স্বপ্নের মশাল হয়ে।

রাতের কলকাতা যেন আরও বেশি অচেনা হয়ে উঠেছে রেখার কাছে। বৃদ্ধাশ্রম, স্টেশন, হাসপাতাল—সব জায়গায় রিপোর্টিং করতে করতে সে বুঝতে পেরেছে, এই শহর শুধু ইট, পাথর, বাতি আর কোলাহলের নয়; এর গভীরে আছে এক অদৃশ্য অন্ধকার, যেখানে মুখোশ পরে থাকে মানুষ। একদিন সকালে অফিস থেকে ডেকে পাঠানো হয় রেখাকে। সহসম্পাদক বললেন, “রেখা, এবার তোমার কাজ হবে শহরের বস্তিগুলোয় চলা এক সরকারি প্রকল্পের বাস্তব চিত্র তুলে আনা। উপরের মহল বলছে, সব ঠিক আছে। কিন্তু ভেতরে কী লুকিয়ে আছে, সেটাই বের করতে হবে।” রেখা জানে, এ সহজ হবে না। শহরের অজস্র বস্তি পেরিয়ে সে যখন টালিগঞ্জের এক বস্তিতে পৌঁছায়, তখন দুপুরের রোদ চড়চড়ে, আর ঘামে তার শাড়ি ভিজে গেছে। কিন্তু চোখে তার স্পষ্ট লক্ষ্যের দীপ্তি। কাঁচা রাস্তা, নর্দমার গন্ধ, ভাঙা টিনের ঘরগুলো পেরিয়ে সে কথা বলে বস্তির মানুষদের সঙ্গে। লাবণী নামে এক মাঝবয়সী নারী বলে, “ম্যাডাম, ওরা আসে ছবি তোলে, কথা শোনে, তারপর আর কিছু হয় না।” রেখা নোট করে, ছবি তোলে, আর ভাবে, এই মুখোশ খুলে দিতে হবে। বিকেল গড়িয়ে যায়, বস্তির একপাশে কুয়াশার মতো ধোঁয়া ভেসে ওঠে—চুলার ধোঁয়া, পুড়ে যাওয়া স্বপ্নের ধোঁয়া।

পরের কয়েকদিন রেখা একের পর এক বস্তি ঘুরে তথ্য জোগাড় করতে থাকে। সে দেখে, সরকারি প্রকল্পের নামে যে টাকার পাহাড় এসেছে, তার একফোঁটাও পৌঁছায়নি মানুষের হাতে। ঘরের টিন বদলায়নি, নর্দমা ঢেকেনি, স্কুলের রঙ করা দেয়ালে ফাটল ধরেছে। কিন্তু রিপোর্টিং-এর কাজ সহজ নয়। একদিন সন্ধ্যায় বস্তির বাইরে থেকে ফেরার পথে দুই অচেনা লোক তার পথ আটকে দাঁড়ায়। এক জন হেসে বলে, “সব খবর লিখতে হয় না। বুঝে চলো।” রেখা শক্ত গলায় বলে, “যা সত্য, তা-ই লিখব।” তারা চলে যায়, কিন্তু রেখা বুঝতে পারে, শহরের মুখোশ খুলতে গেলে এমন হুমকি আসবেই। অফিসে ফিরে সে লেখে সেই গল্পগুলো, সেই প্রতারণার চিত্র, তুলে ধরে মানুষের কথাগুলো। রিপোর্ট ছাপা হয়—“মুখোশের শহর: বস্তির মানুষ কোথায় তাদের অধিকার?” শহর আবার তোলপাড় হয়। প্রশাসনকে জবাব দিতে হয়। আর রেখা জানে, তার লড়াই এভাবেই চলবে, যতক্ষণ না প্রতিটি মুখোশ ফেটে সত্যের মুখ দেখা যায়। জানালার বাইরে তাকিয়ে সে দেখে, হাওড়া ব্রিজের আলোয় ভিজে আছে রাতের আকাশ, আর সেই আলো যেন তাকে বলে, “লিখে যা, যতক্ষণ না শহর জাগে।”

শহরের মুখোশ খুলতে গিয়ে রেখা এবার পৌঁছায় সেই অজানা অন্ধকার জগতে, যেখানে রাতের নিস্তব্ধতায় ঘটে যায় অগণিত অন্যায়। বস্তির রিপোর্ট প্রকাশের পর যেন অদৃশ্য এক অশান্তি ছড়িয়ে পড়েছে শহরের বাতাসে। অফিসের করিডরে পা ফেলতে ফেলতে সে অনুভব করে কত চোখ তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে, কত চোখ তীক্ষ্ণ বিদ্রুপ ছুড়ে দিচ্ছে। সহকর্মী শমীক একদিন ফিসফিস করে বলে, “এই শহরের ক্ষমতাবানদের জ্বালাতে নেই… সাবধান।” কিন্তু রেখা জানে, সে থামবে না। সেই সন্ধ্যায় সম্পাদক ডেকে পাঠিয়ে নতুন দায়িত্ব দেয়—এক যৌন-পাচার চক্রের গোপন কাহিনি অনুসন্ধান। শহরের দক্ষিণ প্রান্তের এক গলিপথ থেকে শুরু হয় তার ছায়া-যাত্রা। রাতে সঙ্গী হয় ক্যামেরা, নোটপ্যাড আর বুকের গভীরে লুকানো সাহস। গলির অন্ধকারে রেখা দেখে ছোট ছোট ঘর, যেখানে নীল আলো জ্বলছে, আর দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে ক্লান্ত মুখ, ভীতু চোখ। অল্প বয়সী মেয়েদের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে—এক অজানা আর্তি যেন।

রেখা ধীরে ধীরে কথা বলে সেই মানুষদের সঙ্গে—যাদের জীবনের গল্প সমাজের কাগজে আসে না। এক বৃদ্ধা, নাম মুনিয়াদি, বলে, “মা, আমরা তো পুতুল, যে যেমন চায়, নাচিয়ে নেয়। কেউ দেখেও দেখে না।” রেখা নোট করে, ছবি তোলে নীরবে, আর ভিতরে ভিতরে কাঁপতে থাকে। সে শোনে কিভাবে গ্রামের কিশোরীরা চাকরির আশায় শহরে এসে ফাঁদে পড়েছে, কিভাবে দালালরা একে একে তাদের জীবন কেড়ে নিয়েছে। সেই রাতে হোস্টেলে ফিরে সে আর ঘুমোতে পারে না। জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে, দেখে দূরের গঙ্গার ধারে আলো-আঁধারি। মনে হয়, এই আলো কি সত্যিই আছে তাদের জন্যও? অফিসে ফেরার পর সে শুরু করে লিখতে—একটার পর একটা গল্প, মুখোশের শহরের গোপন ছায়ার গল্প। রিপোর্টে লেখা হয়, “কলকাতার অন্ধকার গলিতে শিকলবন্দি স্বপ্ন।” এ লেখা ছাপা হতেই শহরে তোলপাড় হয়। কিন্তু হুমকিও বাড়ে। ফোনে অচেনা গলা শোনায়, “বেশি জানার চেষ্টা কোরো না। শেষ করে দেব।”

হুমকি, ষড়যন্ত্র, অপমান—সব পেরিয়ে রেখা আরও সাহস নিয়ে নামল এই অন্ধকারের গভীরে। এবার সে সহযোগিতা চায় কিছু সমাজকর্মীর, যারা বছর ধরে এই চক্রের বিরুদ্ধে লড়ছে। তারা নিয়ে যায় রেখাকে শহরের আরও গহীন বস্তিতে, যেখানে রাত হলে মেয়েদের গায়েব করে দেওয়া হয়। সেখানে সে কথা বলে সীমা নামের এক কিশোরীর সঙ্গে, যে বলল, “আমাকে বাঁচান দিদি… লিখে দিন যাতে আর কেউ এই ফাঁদে না পড়ে।” সীমার কথা শোনার পর রেখা স্থির করে, এবার সে এই চক্রের শিকড় পর্যন্ত যাবে। রাতের কলকাতার গলিপথ, বস্তি, পতিতালয়, লাল আলোয় ভেজা জানালা—সব তার চোখে স্পষ্ট হতে থাকে। অফিসে ফিরে সে লেখে সেই রিপোর্ট, যেখানে প্রথমবার প্রশাসনের মাফিয়ার যোগসাজশের নাম আসে। রিপোর্ট বেরোলে শহরের বড় বড় মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। কেউ সমর্থন করে, কেউ নিন্দা, কিন্তু রেখা জানে—এ লড়াই তার নিজের নয়, সীমাদের জন্য, সেই অগণিত স্বপ্নের জন্য যা এই শহরের অন্ধকার গলিতে শিকলবন্দি।

শহর যেন কেঁপে ওঠে রেখার রিপোর্টে। চায়ের দোকানে, বাসস্ট্যান্ডে, অফিসের করিডরে তার লেখা পড়ে মানুষ বলে, “এই মেয়েটা সাহসী। সত্যি লিখছে।” কিন্তু অন্ধকারও আরও ঘনায়। অফিস ফেরার পথে একদিন অজানা এক গলি থেকে বেরিয়ে আসে তিনজন লোক, তাদের চোখে হিংস্রতা, মুখে শ্বাসরুদ্ধ করা গালিগালাজ। তারা সামনে দাঁড়িয়ে বলে, “শেষবার বলছি, থেমে যা।” রেখা শক্ত গলায় জবাব দেয়, “যা সত্য, তা লিখবই।” তারা চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। সেই রাতে হোস্টেলে ফিরে রেখা জানালার ফাঁক দিয়ে চেয়ে থাকে দূরের হাওড়া ব্রিজের দিকে। বাতাসে ভেসে আসে গঙ্গার ঢেউয়ের শব্দ, আর সেই শব্দ যেন তাকে বলে, “তুমি একা নও, সাহস করে এগিয়ে চলো।” তার কলমে আঁকা হয় শহরের ছায়ার গল্প, আর সে জানে, এই যাত্রা থামবে না যতক্ষণ না সত্যি জাগে শহর।

রেখার কলমে লেখা শহরের অন্ধকারের গল্প যেন এক ঝড় তুলেছিল। পত্রিকার প্রথম পাতায় যখন ছাপা হলো যৌন-পাচার চক্রের ভেতরের কাহিনি, তখন চারদিক থেকে সাড়া পড়ল। পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্তারা প্রেস ব্রিফিংয়ে বলল, “আমরা তদন্ত শুরু করেছি।” কিন্তু রেখা জানত, এই কথার পেছনে লুকিয়ে আছে দ্বিধা, লুকিয়ে আছে ভয়ের ছায়া। অফিসের করিডর জুড়ে হঠাৎ নেমে এল অস্বস্তির বাতাস। কেউ কেউ মুখ ফিরিয়ে নিল, সহকর্মী শমীক বলল, “রেখা, এত বড় খেলায় পা দিও না। তোমার বিপদ হবে।” কিন্তু রেখা জানত, এখন পিছু হটলে তার নিজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা হবে। সেই রাতে হোস্টেলে ফেরার পথে, সেই অন্ধকার গলিতে, যেখান দিয়ে সে প্রতিদিন যায়, অজানা ছায়ারা তাকে ঘিরে ধরল। কারা যেন বলল, “শেষ করে দেব তোকে, থেমে যা।” রেখা দৌড়ে পালিয়ে হোস্টেলের দিকে ছুটল। বুকের ভেতর তখন কেবল একটা আওয়াজ—“আমি লিখব, আমি থামব না।”

পরদিন সকালেই অফিসে বসে সে রিপোর্ট লেখার কাজে নেমে পড়ল। মাথায় তখন শুধু সীমার কণ্ঠস্বর—“দিদি, আমাকে বাঁচান।” সে লিখল সেইসব মেয়েদের গল্প, যারা রাতের অন্ধকারে হারিয়ে যায়, লিখল সেইসব ভাঙা ঘরগুলোর কথা যেখানে স্বপ্নেরা দমবন্ধ হয়ে মরে। রিপোর্টের শিরোনাম রাখল— “শহরের ছায়া-প্রেতের কারাগারে স্বপ্ন”। লিখল কিভাবে প্রশাসন আর রাজনীতির অদৃশ্য হাত মিলে তৈরি করেছে এক অন্ধকার জাল, যে জালে বন্দি কিশোরী জীবন। লেখা শেষ করে সে জানত, এবার হুমকি আরও বাড়বে, কিন্তু সে ভয় পায়নি। রিপোর্ট বেরনোর দিন সকালেই ফোন এল অচেনা নম্বর থেকে, “তুমি থেমে যা, নয়তো তোকে শেষ করে দেব।” রেখা ফোন কেটে দিল, জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখল গঙ্গার ওপর ঝলমল করছে সকালবেলার রোদ, আর সেই আলো যেন বলছে, “সত্যের শক্তিই বড়।”

সন্ধ্যায় অফিস ছেড়ে বেরোনোর সময় লক্ষ্য করল, কেউ একজন পিছু নিচ্ছে। গলির ধারে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি চোখে হিংস্র চাহনি নিয়ে তাকাল, হঠাৎ সামনে এসে বলল, “তুমি খুব সাহস দেখাচ্ছ? সাহসের দাম আছে।” রেখা স্থির গলায় বলল, “যা সত্য, তা লিখবই।” ছেলেটি বিদ্রূপের হাসি হেসে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। সেই রাতে হোস্টেলে ফিরে ঘরের দরজা বন্ধ করে সে জানালার পাশে বসে লিখতে শুরু করল নিজের ডায়েরিতে—তার ভিতরের ভয়, লড়াই আর বিশ্বাসের কথা। বাইরে তখন শহরের বাতাসে ভেসে আসছে গাড়ির হর্ন, দূরের ট্রামের ঘণ্টা, আর গঙ্গার ঢেউয়ের মৃদু শব্দ। রেখা জানত, এই শহর যত মুখোশ পরে থাকুক, সে একদিন সব খুলে দেবে।

পরদিন সকালেই পত্রিকার অফিসে রিপোর্ট বেরনোর পর তোলপাড় শুরু হল। বড় বড় টিভি চ্যানেল, সংবাদপত্র, সোশ্যাল মিডিয়া সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল রেখার লেখা। সীমা আর সেই মেয়েদের গল্প ছুঁয়ে গেল হাজারো মানুষের হৃদয়। কিন্তু সেই সঙ্গে বাড়ল প্রতিশোধের ছায়া। হোস্টেলের সামনে অজানা লোকের ভিড়, ফোনে আসা হুমকি আরও তীব্র হল। সহকর্মী শমীক পাশে এসে ফিসফিস করে বলল, “রেখা, এবার থামো। এই লড়াই তোমার একার নয়।” কিন্তু রেখা জানত, এই লড়াই একার হয় না, এই লড়াই সত্যের জন্য, সেই অগণিত কণ্ঠের জন্য যারা চুপ করে থাকে, যারা চুপ থাকতে বাধ্য হয়। রাতের শহরে হাওড়া ব্রিজের আলো দূর থেকে যেমন শহরকে জাগিয়ে রাখে, রেখার কলমও তেমন জাগিয়ে রাখবে শহরের বিবেক।

রেখার প্রতিটি রিপোর্ট যেন শহরের অন্ধকারকে উল্টে দেয়, যেন প্রতিটি শব্দ একেকটি শিলাখণ্ডের মতো আছড়ে পড়ে ক্ষমতাবানদের পাপাচারের প্রাসাদে। কিন্তু সেই সত্যের আলোকছটা যত ছড়িয়ে পড়ে, ততই অন্ধকার শক্তির চোখে সে হয়ে ওঠে এক অশান্তির নাম। অফিসের করিডর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে সে টের পায়—মুখ ফিরিয়ে নেওয়া সহকর্মীদের নীরবতা, ঠোঁট চেপে ধরা শাসককুলের শীতল চাহনি আর ফোনের ওপার থেকে ভেসে আসা অজানা গলার গর্জন। একদিন রাত্তিরে কাজ সেরে হোস্টেলে ফিরতে ফিরতে সে লক্ষ্য করে, পেছনে পেছনে আসছে দুটো ছায়ামূর্তি—যারা শুধু তার পদক্ষেপের শব্দ শোনে আর থেমে থেমে ফিসফিস করে, “এই সাহসী কলম থামিয়ে দিতে হবে।” সেই রাতে জানালার ফাঁক দিয়ে হাওড়া ব্রিজের আলো দূর থেকে জ্বলজ্বল করে ওঠে আর রেখার বুকের ভেতরে জেগে ওঠে দৃঢ় সংকল্প—সে থামবে না।

সকালে অফিসে পৌঁছে ডেস্কে বসতেই দেখে টেবিলের ওপর রাখা এক সাদা খাম। ভেতরে এক চিঠি—“আর একবার লিখলে, তোর লাশ পড়ে থাকবে গঙ্গার ঘাটে।” চিঠি হাতে নিতেই হাত কেঁপে ওঠে, কিন্তু চোখের ভাষায় একটুকু ভয় নেই। সে চিঠি রেখে দেয় নোটবুকের ভেতর, যেন এই হুমকি-চিঠি আরও একবার তার লড়াইয়ের সাক্ষী হয়ে থাকবে। দুপুরে সম্পাদক ডেকে পাঠান, বলেন, “রেখা, তোর কলম আগুন জ্বালিয়েছে। কিন্তু নিজের নিরাপত্তার কথাও ভাব।” রেখা হাসে, বলে, “স্যার, এ লড়াই শুধু আমার নয়, সীমাদের লড়াই, যাদের কণ্ঠস্বর নেই। যদি থামি, তাহলে আর কারা লিখবে?” এরপর সে আরও গভীরে ডুব দেয় সেই অন্ধকারে। শহরের দক্ষিণ প্রান্তের এক গলিতে, সমাজকর্মী রত্নার সঙ্গে গিয়ে সে কথা বলে কিছু কিশোরীর সঙ্গে, যারা বিগত কয়েক মাসে পাচার হওয়ার মুখ থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তাদের চোখে থাকে আতঙ্কের ছায়া, আর ঠোঁটে থাকে অব্যক্ত আর্তি। রেখা তাদের কাহিনি লিখতে শুরু করে—প্রতিটি লাইনে থাকে তাদের কান্না, তাদের লাঞ্ছনা আর আশার ঝলক।

রিপোর্ট বেরোতেই শহরের চেনা মুখগুলোতে দেখা যায় অস্বস্তি। মন্ত্রীর গাড়ির কাচের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে শীতল দৃষ্টি, পুলিশের গলায় মিশে যায় দ্বিধা আর মিডিয়ার মাইকের সামনে শুরু হয় মুখরোচক প্রতিশ্রুতির বৃষ্টি। কিন্তু রাত নামলেই অন্ধকার আরও ঘনিয়ে আসে। সেই রাতে হোস্টেলের সামনে অজানা এক গাড়ি থামে, দরজা খুলে বেরিয়ে আসে দুটো মুখোশধারী লোক। রেখা তখন জানালার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখে, বুকের ভেতরে কেঁপে ওঠে শঙ্কা, কিন্তু কলমটা হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে। লোকগুলো কিছুক্ষণ ঘুরে ফিরে অদৃশ্য হয়। সেই রাতের নিস্তব্ধতায় গঙ্গার ঢেউয়ের শব্দে সে শপথ করে, “আমার কলম শহরের বিবেককে জাগিয়েই ছাড়বে।” পরদিন কলেজের ছেলেমেয়েরা মিছিল করে তার লেখা নিয়ে, ব্যানারে লেখা থাকে—“যে সত্যের জন্য লড়াই, তার পাশে আমরা আছি।” রাখঢাকহীন ভাষায় সে লিখে যায় আরও গভীর সত্য, নাম করে লিখে দেয় দালালদের, প্রশাসনের বেঈমানদের, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকদের নাম।

প্রতিশোধের আঁধার এবার আরও তীব্র রূপ নেয়। ফোনে বারবার অচেনা গলা শোনায়, “শেষবার বলছি, থেমে যা।” অফিসে বসে বসে সে দেখে, কত সহকর্মীর চোখে ভয়, কতজন চুপচাপ দূরে সরে যায়। কিন্তু রেখা জানে, এই লড়াই একার নয়। সে বুঝতে পারে, তার কলমের প্রতিটি শব্দই শহরের অন্ধকারের দেওয়ালে আঘাত করছে। রাতের বেলা সে যখন হোস্টেলের ছাদে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন হাওড়া ব্রিজের আলোগুলো যেন দূর থেকে তার যুদ্ধে আশীর্বাদ করে। সেই আলোয় ভেসে আসে সীমার কণ্ঠস্বর, ভেসে আসে সেইসব স্বপ্নের মুখ, যারা মুক্তির অপেক্ষায়। রেখা জানে, যে অন্ধকার যতই ঘনিয়ে আসুক, সত্যের দীপশিখা তা ভেদ করবেই।

১০

শহরের ভেতর অন্ধকার আর আলোর যুদ্ধ যেন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে, আর সেই লড়াইয়ের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে রেখা—একজন মফস্বলের মেয়ে, যে সাহস আর কলমের জোরে বৃহৎ শহরের মুখোশ খুলতে শুরু করেছে। অজানা হুমকির ভয়, সমাজের কুৎসিত রাজনীতির ছায়া, সহকর্মীদের দ্বিধা আর পুলিশের নীরবতার মাঝেও রেখা থেমে যায় না। অধ্যায় ১০-এর শুরুতেই সে পৌঁছে যায় সেই বস্তিতে, যেখানে সমাজের অন্ধকার কাহিনি লুকিয়ে থাকে ধুলো মাখা ঝুপড়ির দেয়ালে, লুকিয়ে থাকে সেই মেয়েগুলোর চোখে, যাদের শৈশব রাতের অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। রেখা তাদের গল্প শোনে, খাতায় লিখে রাখে প্রতিটি বেদনা, প্রতিটি অন্যায়ের কথা। সে দেখে কিভাবে দালালেরা প্রশাসনের ছত্রছায়ায় নিরাপদে ব্যবসা চালিয়ে যায়, কিভাবে রাজনৈতিক নেতাদের মদতে নিঃশব্দে ফুরিয়ে যায় স্বপ্ন। সেই রাতে অফিসে ফিরে সে রিপোর্ট লেখা শুরু করে; তার প্রতিটি শব্দ যেন আগুনের শিখা হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। সে লিখে দেয় দালালের নাম, লিখে দেয় সেই নেতাদের পরিচয়, যাদের ছত্রছায়ায় এই চক্র বেঁচে থাকে। পত্রিকা অফিসে যখন রিপোর্ট জমা দেয়, সম্পাদক ভয়ে শিউরে ওঠেন, বলেন, “রেখা, এ তো আগুনে হাত দেওয়া।” রেখা মৃদু হেসে বলেন, “যেখানে অন্যায়ের অন্ধকার, সেখানে আলোর দীপ জ্বালাতেই হবে।” রিপোর্ট প্রকাশিত হতেই শহরে তোলপাড় শুরু হয়। মিছিল নামে রাস্তায়, কলেজের ছাত্রছাত্রীরা ব্যানার হাতে শ্লোগান তোলে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় রেখার লেখা। কিন্তু সেইসঙ্গে বাড়ে শত্রু, বাড়ে হুমকি। এক রাতে হোস্টেলের ঘরে ফেরার পথে গলির অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসে কয়েকজন মুখোশধারী যুবক, তাদের হাতে লাঠি, চোখে হিংস্রতা। তারা ঘিরে ধরে রেখাকে, শাসায়, “থামবি না তো শেষ করে দেব।” রেখা বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়, চোখে অশ্রু নয়, সাহসের আগুন। সেই সময় একদল ছাত্র এসে পৌঁছে যায়, তাড়িয়ে দেয় দুষ্কৃতীদের। রেখা বোঝে, সত্যের পথে সে একা নয়, তার পাশে আছে হাজারো বিবেকবান মানুষ। পরদিন সকালেই সে থানায় যায়, অভিযোগ দায়ের করে, আর পুলিশের মুখে স্পষ্ট দ্বিধা দেখে। তবু সে পিছু হটে না। সে আরও গভীরে ডুব দেয়, খুঁজে বের করে সেই লাল আলোয় হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের যন্ত্রণার কথা, লিখে ফেলে রিপোর্টের দ্বিতীয় কিস্তি। এই কিস্তিতে সে তুলে আনে সেইসব হোটেলের নাম, সেইসব প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর নাম, যাদের ছত্রছায়ায় এই অন্ধকার জগত বেঁচে থাকে। পত্রিকা বের হলে শহরের বাতাসে এক নতুন আলোড়ন ওঠে, আর প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্তারা বাধ্য হয় কড়া পদক্ষেপ নিতে। কয়েকজন দালাল ধরা পড়ে, কিছু রাজনৈতিক মুখোশ খুলে যায়, কিন্তু রেখা জানে লড়াই শেষ হয়নি। সে হোস্টেলের ছাদে দাঁড়িয়ে হাওড়া ব্রিজের আলো দেখে মনে মনে বলে, “আমার কলম যতদিন চলবে, ততদিন এই অন্ধকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলবে।”

১১

শহর যেন সেদিন অন্যরকম ছিল। ভোরের আলো ফোটার আগেই রেখার ফোনে এক অচেনা নাম্বার থেকে আসা একমাত্র বার্তা তার বুকের ভেতর কাঁপন ধরিয়ে দিল—“আজ তোর শেষ দিন।” বার্তাটি দেখে প্রথমে কিছুক্ষণের জন্য স্থির হয়ে গেল সে। তারপর নিজের অন্তরের শক্তিকে জাগিয়ে তুলল। জানত, সত্যকে রক্ষা করতে হলে নিজের জীবনকেও তুচ্ছ করতে হবে। সকালে অফিসে পৌঁছেই সে দেখে তার ডেস্কে একটি খামে ভরা পত্র পড়ে আছে। খাম খুলে বেরিয়ে আসে এক কালো কাগজ, তাতে কেবল আঁকা এক কফিনের ছবি আর লাল কালি দিয়ে লেখা—“খবরদার!” সহকর্মীরা ভীত, সম্পাদক বললেন, “রেখা, এখনই পুলিশি প্রোটেকশন চাই। এরা যেকোনো সময় ক্ষতি করতে পারে।” কিন্তু রেখা মাথা নাড়ে, বলে, “স্যার, পুলিশি প্রোটেকশন চাইব, কিন্তু থামব না। আমার কলম চলবে। এখন যদি থামি, তাহলে যারা আমার লেখা পড়ে সাহস পেয়েছে, তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা হবে।”

সেই দিনেই সে আবার পথে নামে, পায়ে পায়ে চলে যায় শহরের সেই লাল আলোয় ঢাকা অন্ধকার পাড়ায়। গলির অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা মেয়েগুলোর মুখ তুলে ধরে, খাতায় লেখে তাদের নিঃশব্দ আর্তনাদ। কিন্তু আজ গলির বাতাস অন্যরকম, সেখানে ভেসে আসে শ্বাসরোধ করা ভয়ের গন্ধ। হঠাৎ এক ঘুপচি থেকে বেরিয়ে আসে দুজন মুখোশধারী, হাতে ধারালো ছুরি। চোখে তাদের হিংস্রতা, ঠোঁটে শাসানি—“আজ এখানেই শেষ তোর অভিযান!” রেখার বুকের ভেতর শ্বাস আটকে আসে, কিন্তু সে পেছাতে চায় না। সেই মুহূর্তে আশপাশের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে কিছু সাহসী নারী—যারা রেখার লেখা পড়ে নিজেদের শক্তি খুঁজে পেয়েছে। তারা লাঠি, হাড়িকাঠি যা পেয়েছে তা হাতে নিয়ে দাঁড়ায় রেখার পাশে। আততায়ীরা হকচকিয়ে সরে যায় অন্ধকারে। রেখা বুঝে যায়—তার লড়াই একা নয়, সত্যের পক্ষে মানুষ এখন জেগে উঠছে।

ফেরার সময় সে পুলিশের দ্বারস্থ হয়, সব ঘটনা জানিয়ে দেয়। পুলিশের অফিসার প্রথমে গা বাঁচিয়ে কথা বললেও, শেষ পর্যন্ত সংবাদমাধ্যমে চাপের মুখে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু হয়। রেখা অফিসে ফিরে আবার রিপোর্ট লেখা শুরু করে—এবার সে শুধু কাহিনি নয়, তুলে আনে প্রমাণ, সাক্ষাৎকার, ছবি, যেগুলো অস্বীকার করা যায় না। তার লেখা শহরের প্রতিটি ঘরে আলোড়ন তোলে। কিন্তু সেইসঙ্গে বাড়ে তার জীবনের ঝুঁকি। এক রাতে হোস্টেলে ফেরার পথে সে দেখে তার কাঁধ ছুঁয়ে দিয়ে যায় এক অচেনা মানুষ, ফিসফিসিয়ে বলে, “আজ রাত্রে তোর ঘুম আসবে না।” রেখা জানে অন্ধকারের শক্তি এখন মরিয়া, কিন্তু তার ভেতরের আলোর শক্তি আরও জেগে ওঠে। সে নিজের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দূরের আকাশে তারা দেখে মনে মনে বলে, “যতদিন বেঁচে আছি, ততদিন সত্যের জন্য এই লড়াই চলবে।”

সকাল হতেই শহরের বাতাসে এক নতুন উন্মাদনা ছড়ায়। রেখার লেখা রিপোর্টের ভিত্তিতে বড়সড় ধরপাকড় অভিযান শুরু হয়। কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, দালাল, এমনকি কিছু পুলিশ অফিসারকেও গ্রেপ্তার করা হয়। শহরের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে, মোমবাতি মিছিল করে, ব্যানার হাতে শ্লোগান তোলে—“আমরা তোমার পাশে আছি, রেখা।” হাওড়া ব্রিজের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গার স্রোতের মতো যেন শহরের বিবেক জেগে ওঠে। কিন্তু রেখা জানে, যুদ্ধ শেষ হয়নি। অন্ধকারের শিকড় অনেক গভীরে, অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। সে রাতে ডায়েরি খুলে লেখে, “ছায়ার ফাঁদে ফেলে রাখতে চেয়েছিল ওরা, কিন্তু আলোর পথে এগিয়ে চলার শপথ আমি নিয়েছি। আমার কলম যতদিন চলবে, ততদিন শহরের অন্যায়ের মুখোশ খুলে যাবে।” সেই লেখা পরে শহরের এক বিপ্লবী কবিতা হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ছাত্রছাত্রীদের মুখে মুখে, দেয়াল লিখনে। সত্যের জন্য রেখার এই লড়াই এক নতুন ইতিহাস তৈরি করতে শুরু করে।

১২

শহর তখন যেন এক অদ্ভুত দ্বিধার মধ্যে। একদিকে ধরপাকড় অভিযানে ফাঁস হচ্ছে একের পর এক অপরাধের জাল, অন্যদিকে অন্ধকারের শক্তি আরও হিংস্র হয়ে উঠছে। রেখা বুঝে যায়, শেষ লড়াইটা সবচেয়ে কঠিন। সেই ভোরবেলা সে নিজের ডেস্কে বসে চুপচাপ লিখতে থাকে এক চিঠি—যা শহরের প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছাবে, প্রতিটি বিবেককে নাড়া দেবে। চিঠির নাম দেয়—“সোনালী ডানার চিঠি”। সেখানে সে লেখে, “আমি শুধু এক সাংবাদিক নই, আমি শহরের মুখ। আমার কলম শহরের প্রতিটি অসহায় মুখের আওয়াজ। আমি জানি, আমার লড়াই আজ নয়, কাল হয়তো আমার জীবন কেড়ে নেবে এই অন্ধকার। কিন্তু তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ—যদি আমি না থাকি, তবু তোমরা সত্যের পক্ষে থেকো। অন্যায়ের মুখোশ খুলে দাও।” সে চিঠি পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় ছাপার জন্য দিয়ে আসে, এবং তখনই বোঝে, অন্ধকারের ছায়া তার চারপাশ ঘিরে ফেলছে।

সেদিন রাতের অন্ধকার অন্যরকম ছিল। শহরের বাতাসে এক অজানা আতঙ্কের গন্ধ। রেখা হোস্টেলের জানালায় দাঁড়িয়ে দূরের গঙ্গার স্রোত দেখতে দেখতে নিজের মনের কথা ডায়েরিতে লিখে যায়—“যদি আজই শেষ হয় আমার যাত্রা, তবু আমার কথাগুলো থেকে যাবে।” হঠাৎ সে টের পায়, জানালার নিচে অচেনা ছায়ারা নড়াচড়া করছে। বুকে এক অজানা সাহস সঞ্চয় করে সে নিচে নামে। দরজা খুলতেই একদল মুখোশধারী মানুষ তাকে ঘিরে ধরে। কিন্তু সেই মুহূর্তে হোস্টেলের মেয়েরা, প্রতিবেশী মানুষ, এবং সেই মিছিলের ছাত্রছাত্রীরা সেখানে ছুটে আসে। তারা শ্লোগান তোলে, “রেখার গায়ে হাত দিলে শহর জ্বলে উঠবে।” মুখোশধারীরা পালিয়ে যায়। রেখা অনুভব করে, তার চিঠি কেবল কাগজের চিঠি নয়—এ শহরের বিবেক জাগানোর সোনালী ডানা হয়ে উঠেছে।

পরদিন শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে সেই চিঠি। মানুষ মোমবাতি হাতে মিছিল করে, দেয়াল লিখনে উঠে আসে রেখার ভাষা। খবরের কাগজের প্রথম পাতা, টিভি চ্যানেলের স্ক্রল—সব জায়গায় “সোনালী ডানার চিঠি”। প্রশাসন অবশেষে নতিস্বীকার করে, বড় বড় অপরাধীর বিরুদ্ধে মামলা শুরু হয়। রেখা সংবাদ সম্মেলনে দাঁড়িয়ে বলে, “এই শহরের মানুষই আমার শক্তি। আমার জীবনের সব ঝুঁকি তাদের জন্যই, যারা নির্ভয়ে বাঁচতে চায়।” সাংবাদিক সম্মেলন শেষ হতেই সে পায় হাতে লেখা এক ছোট্ট চিরকুট—“তুমি জিতেছ। কিন্তু অন্ধকার শেষ হয়নি।” রেখা সেটি হাতে নিয়ে হেসে ফেলে, চোখে জল আসে—কারণ সে জানে, লড়াই চলবেই, কিন্তু এখন তার পাশে রয়েছে হাজার মানুষ।

শেষ রাতে হাওড়া ব্রিজের নিচে বসে সে আকাশের তারা গোনে, মনে মনে ভাবে—এই শহর, এই নদী, এই বাতাস সাক্ষী থাকবে তার লড়াইয়ের। সেই রাতের বাতাসে যেন ভেসে আসে সেই চিঠির শব্দ—“সোনালী ডানার চিঠি।” সে জানে, সত্যের জন্য লড়াই শেষ হয় না। শহরের প্রতিটি গলিতে, প্রতিটি চোখে, প্রতিটি শিশিরভেজা সকালে সেই লড়াই নতুন করে শুরু হবে। রেখার কলমের কালি, তার সাহস, আর তার লেখা হয়ে থাকবে শহরের এক অমর ইতিহাস। এবং সেই ইতিহাসের প্রতিটি পাতায় লেখা থাকবে—“যে কলম সত্যের জন্য চলে, তাকে কোনো অন্ধকার থামাতে পারে না।”

-সমাপ্ত-

 

1000030449.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *