Bangla - ভূতের গল্প

সেপাইয়ের কণ্ঠস্বর

Spread the love

আলাপ মুখার্জি মুর্শিদাবাদের এক প্রাচীন কেল্লার দিকে পা বাড়ালেন, যেখানে নবাবি আমলের ছায়া আজও বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। কেল্লার ভেতরের দেয়ালগুলো যেন সময়ের সঙ্গে মিশে গিয়ে ধুলো আর ছাইয়ের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে অতীতের গল্প। প্রতিটি পাথরের ছেদ, ভাঙা দেয়াল আর কুমড়ো করা তালের দরজা আলাপকে এক অদ্ভুত উত্তেজনা দিচ্ছিল। তিনি একদিকে গবেষক মন নিয়ে এখানে এসেছেন, ইতিহাসের খুঁটিনাটি অধ্যয়ন করতে; অন্যদিকে তার হৃদয়ে ঝাঁঝালো কৌতূহল কাজ করছিল। স্থানীয়রা তাকে নানা গল্প শোনিয়েছে—কেল্লার ভেতর রাত হলে বন্দুকের আওয়াজ শোনা যায়, কখনও দেখা যায় এক অদৃশ্য সেপাই পাহারা দিচ্ছে। আলাপ প্রথমে সেইসব গল্পকে কল্পনার জায়গা মনে করেছিলেন, কিন্তু কেল্লার প্রাচীন দুর্গযন্ত্র এবং গভীর অন্ধকার তাকে ভাবাচ্ছিল—হয়তো এসব গল্পের মধ্যে কিছু সত্যও আছে। তিনি কেল্লার প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে বাতাসের ভিজা গন্ধ অনুভব করলেন, যেন ধুলো-মাটি এবং ইতিহাসের মিলনস্থল থেকে এক অদৃশ্য ডাক আসছে। তার প্রতিটি পদক্ষেপে পাথরের ফাটলগুলো যেন অতীতের গুঞ্জন ফুঁটে দিতে চায়, আর বাতাসে ভেসে আসে এক অজানা কণ্ঠের পুনরাবৃত্তি—‘সতর্ক থেকো।’

রাতের ছায়া কেল্লার ভেতরে ধীরে ধীরে বাড়ছিল। আলাপ অজানা এক উত্তেজনার সঙ্গে কেল্লার ভেতরে প্রবেশ করলেন। দেওয়ালের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে দিয়ে হালকা বাতাস বইছিল, আর পেছনের প্রবেশপথ থেকে আলো ম্লানভাবে ভেসে আসছিল। হঠাৎ, দূর থেকে বন্দুকের একটি আওয়াজ ভেসে এলো। আলাপ স্থির হয়ে দাঁড়ালেন; মনে হলো, তার চারপাশে সমস্ত বাতাস এবং অন্ধকারে রহস্যময় শক্তি কাজ করছে। স্থানীয়রা যে গল্প শোনিয়েছে, তা কেবল গল্প নয়, বাস্তবতার অংশ। তিনি পাথরের ঘরে ঢুকে, প্রতিটি কোণ ও ছাদ খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। সেখানে কোনো সেপাই বা পাহারাদার দেখা যায়নি, অথচ হঠাৎ আলোর মধ্যে একটি ছায়া অদ্ভুতভাবে নড়াচড়া করছিল। আলাপ বুঝতে পারলেন, ইতিহাস শুধু বইয়ে বা কাগজে থাকে না—এটি এখানে, এই কেল্লার দেয়াল, ধুলো, এবং প্রতিটি ছায়ার মধ্যে বেঁচে আছে। তার কণ্ঠস্বরও যেন ঐ অদৃশ্য শক্তির কাছে কম্পমান হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারল যে, রাতের এই কেল্লা শুধু অতীতের স্মৃতি নয়, বরং একটি প্রাচীন সতর্কবার্তা বহন করছে—যা শুধুমাত্র সাহসী গবেষকই অনুধাবন করতে পারে।

এভাবেই আলাপ রাতের অন্ধকারে কেল্লার ভেতর ভ্রমণ শুরু করলেন। তার মনে হলো, বন্দুকের আওয়াজ কেবল ভয় তৈরি করার জন্য নয়, বরং এটি যেন অতীতের কথা বলার এক রহস্যময় উপায়। তার পায়ের আওয়াজ এবং হৃদয়ের স্পন্দন একাকার হয়ে গেল। স্থানীয়দের হুঁশিয়ারির কথা মনে পড়ল—কেল্লার ভেতরে রাতের সময় প্রবেশ করা বিপজ্জনক। কিন্তু আলাপকে এই রহস্যময়তা আরো আকর্ষণীয় মনে হচ্ছিল। তিনি জানতেন, এখানে যা কিছু খুঁজে পাবেন তা নবাবি ইতিহাসের অনেক অজানা সত্য উদঘাটন করবে। এক মুহূর্তে তিনি অনুভব করলেন, কেল্লার দেয়াল শুধু পাথরের তৈরি নয়; বরং এটি ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষ্য, যা রাতের অন্ধকারে নতুন করে জীবন লাভ করে। রাত গড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আলাপের মধ্যে ভয়ের সঙ্গে কৌতূহল এবং উত্তেজনার মিশ্রণ তৈরি হলো। কেল্লা যেন তাকে ডাকছিল—‘এসো, দেখো যা ইতিহাস লুকিয়ে রেখেছে।’ আর আলাপ সেই ডাকে সাড়া দিয়ে আরও গভীরে প্রবেশ করলেন, যেখানে রহস্য, অতীত এবং নীরবতার এক অনন্য সংমিশ্রণ অপেক্ষা করছিল।

মুর্শিদাবাদের সন্ধ্যা নেমে আসে শান্ত ও রহস্যময় আকারে। আলাপ মুখার্জি কেল্লার প্রথম রাতের অভিজ্ঞতার উত্তেজনা এখনও তার মনকে উত্তোলিত করছিল। ঠিক তখনই তিনি ইরা দত্তের সঙ্গে দেখা করলেন—একজন স্থানীয় স্কুলশিক্ষিকা, যিনি কেল্লা সংক্রান্ত নানা কিংবদন্তি এবং ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত। ইরার চোখে ছিল একটি জোরালো সতর্কবার্তার ঝিলিক, যা প্রথম দেখায় তাকে শুধুমাত্র বন্ধুত্বপূর্ণ মনে হলেও আলাপ বুঝতে পারলেন এটি গভীর সতর্কতার ইঙ্গিত বহন করছে। তিনি বললেন, “আপনি যদি সত্যিই ইতিহাস জানতে চান, কেল্লার ভেতরে রাতের সময় একা প্রবেশ করবেন না। বহুবার যারা এখানে এসেছেন, তারা টর্চ ফেলেছেন এবং দেখেছেন এক অদ্ভুত ছায়া—একজন সেপাই কেল্লার প্রাচীর ধরে টহল দিচ্ছে। কিন্তু যতই কাছে যাও, সে মিলিয়ে যায়, যেন কখনোই বাস্তবের অংশ ছিল না।” আলাপ প্রথমে এটিকে কল্পনার জায়গা মনে করেছিলেন, কিন্তু ইরার গভীর চোখে এক অদ্ভুত বাস্তবতার ঝিলিক তাকে বুঝিয়ে দিল—এখানে অতীত শুধু বইয়ে নয়, বরং জীবন্ত এবং সক্রিয়। ইরার কথায় কেল্লার দেয়াল, ছায়া, এবং বাতাস যেন একত্রে এক প্রাচীন সতর্কবার্তা পরিবেশন করছে। তিনি আরও যোগ করলেন, “আপনাকে এটি শুধু ইতিহাস মনে হলে অনেক কিছু হাতছাড়া হবে। সেপাই কেবল পাহারা দেয় না; সে দেখায় কেল্লার অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা সত্য।”

ইরার কথায় আলাপের কৌতূহল আরও গভীর হলো। তিনি নিজের গবেষক মনকে জাগ্রত রাখলেন, তবে ইরার সতর্কবার্তা তাকে সবসময় মেপে চলার অনুপ্রেরণা দিল। কেল্লার ভেতরের বাতাসে তখনো ধূলিমাখা ইতিহাসের গন্ধ ছিল—যা রাতের অন্ধকারে আরও প্রবলভাবে ভেসে আসছিল। ইরা আলাপকে নিয়ে কেল্লার চারপাশ ঘুরলেন, বিভিন্ন প্রবেশপথ, প্রাচীন কামরা, এবং সেই সব খোলাখুলা দিকগুলো দেখালেন, যেখান থেকে সেপাই কখনো কখনো টহল দিত। তিনি জানালেন, “দেখুন, এই দেওয়ালগুলো শুধু পাথরের তৈরি নয়; প্রতিটি ফাটল, ছেদ, এবং বাঁকা পথ যেন অতীতের স্মৃতি বহন করছে। সেপাই হয়তো সেই স্মৃতির রক্ষক। তাকে দেখা মানে শুধু ভয় নয়, বরং ইতিহাসের সঙ্গে এক অদৃশ্য সংযোগ তৈরি করা।” আলাপ মন দিয়ে শুনলেন, এবং অনুভব করলেন যে কেল্লার রাত কেবল ভয়ঙ্কর নয়, বরং এটি এক রহস্যময় শিক্ষালয়, যেখানে প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি শব্দ ইতিহাসের ভাষা। ইরার উপস্থিতি আলাপকে নির্ভরযোগ্যতা এবং সতর্কতা দিয়ে অনুপ্রাণিত করছিল—যদি তিনি একা বা অবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করতেন, সেপাইয়ের ছায়া তার জন্য শুধুই ভয়ঙ্কর হতে পারত; কিন্তু ইরার নির্দেশনা তার জন্য একটি মানচিত্রের মতো কাজ করছিল, যা রাতের কেল্লার অন্ধকারে তার পথপ্রদর্শক হয়ে উঠল।

রাত গভীর হতে থাকায় কেল্লার ভিতরের রহস্য আরও প্রকটভাবে প্রকাশ পেতে লাগল। আলাপ ইরার কথার প্রভাব অনুভব করছিলেন—যে সতর্কবার্তা তিনি দিয়েছেন, তা কেবল ভয় দেখানোর জন্য নয়, বরং কেল্লার অদৃশ্য নিয়ম ও ইতিহাস বোঝার জন্য ছিল। ইরা আলাপকে বুঝালেন, “যে সেপাইটিকে আপনি দেখবেন, সে একেবারেই অদৃশ্য নয়। তার উপস্থিতি নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট আলোর সঙ্গে মিলে যায়। সে যেন দেখায়, অতীত কখনো সরাসরি দেখা যায় না—শুধু তার ছায়া এবং সংস্পর্শ অনুভূত হয়।” আলাপ কেল্লার দেয়াল ধরে ধীরে ধীরে এগোতে লাগলেন, মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করলেন যে, এই রাতে তিনি শুধু ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহ করবেন না, বরং ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষ্য দেখবেন। ইরার সতর্কবার্তা তার মনে একটি অদ্ভুত এক ধরনের সমঝোতা তৈরি করল—ভয় এবং কৌতূহলের একসাথে মিশ্রণ। প্রতিটি পদক্ষেপে তার মন সতর্ক থাকলেও চোখ উন্মুক্ত ছিল, আশেপাশের অন্ধকারে প্রতিটি ছায়া খুঁজে দেখছিল। তিনি বুঝতে পারলেন, কেল্লার রাতের অন্ধকারে, ইতিহাস শুধু বই বা প্রাচীরের উপর খোদিত নয়; এটি এখানে, শ্বাস-প্রশ্বাস, বাতাস, ছায়া এবং ধূলিকণার মধ্যে সক্রিয়ভাবে উপস্থিত। সেই রাতের ভেতরে, আলাপ শুধু ইতিহাসের গবেষক নন; তিনি এক নতুন রহস্যের সাক্ষী, যেখানে অতীত এবং বর্তমান এক অদৃশ্য নৃত্য রচনা করছে, এবং সেই নৃত্যের প্রতিটি ধাপ তাকে আরও গভীরভাবে কেল্লার রহস্যের সঙ্গে সংযুক্ত করছে।

মুর্শিদাবাদের পুরোনো কেল্লার স্যান্ডস্টোনের দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে আলাপ মুখার্জি ধীরে ধীরে মোশারফ আলির কথা শুনতে শুরু করলেন। মোশারফ, যিনি বহু বছর ধরে পর্যটকদের কেল্লার ভেতরের ইতিহাস ও কিংবদন্তি শোনান, তার চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি ছিল—যা জানাল, তিনি শুধু গল্প বলেন না; তিনি সেই গল্পের অংশ। তিনি আলাপকে বোঝালেন, কেল্লার দেয়াল, প্রবেশপথ, এবং ঘরের প্রতিটি কোণ যেন অতীতের সেক্রেটারি—যারা শোনায়, দেখায়, এবং কখনও কখনও ভয় দেখায়। মোশারফের কণ্ঠে যেন এক ধরনের ভারীতা এবং রহস্য লুকিয়ে আছে। তিনি বললেন, “একবার গভীর রাতে আমি কেল্লার গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ, দূরের অন্ধকার থেকে বন্দুকের আওয়াজ শুনলাম। আমার পায়ের নীচে ধূলিকণার কণ্ঠ যেন থেমে গেল। আমি তাকালাম, কিন্তু কিছুই দেখা যায়নি—শুধু একটি হালকা ছায়া দৌড়ে গেল। তখনই বুঝলাম, এই কেল্লা শুধু প্রাচীন ইট-পাথরের তৈরি নয়; এটি অতীতের জীবন্ত সাক্ষ্য বহন করছে।” আলাপ তার কথায় অবাক হলেও একই সঙ্গে আরও কৌতূহলী বোধ করলেন। তাঁর গবেষক মন বলছিল, “এই অভিজ্ঞতাগুলো শুধু গল্প নয়; এটি ইতিহাসের ভেতরের জীবন্ত চিহ্ন।” মোশারফের প্রতিটি কথায় যেন কেল্লার রাতের অন্ধকার তার চারপাশে জাগ্রত হচ্ছে, এবং আলাপকে বুঝতে হলো যে, ইতিহাস শুধুই বই এবং নথি নয়; এটি প্রায়শই ভয়, রহস্য এবং অজানা সত্যের মধ্যে লুকিয়ে থাকে।

মোশারফের আরও কয়েকটি গল্প শোনার সময় আলাপ বুঝতে পারলেন, কেল্লার রাতে পর্যটকরা যে ভয় অনুভব করেন, তা কেবল তাদের কল্পনা নয়; বরং এটি বহু অভিজ্ঞতার ফল। তিনি বললেন, “একজন পর্যটক একবার টর্চ জ্বালিয়ে দেখেছে, হঠাৎ তার সামনে একটি ছায়া অদ্ভুতভাবে ঘুরে গেল। সে যতই এগিয়ে গিয়েছিল, ছায়াটি মিলিয়ে গেছে। অনেকেই এই অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে এসেছে, এবং আমি নিজেও বারবার দেখেছি—একটি অদৃশ্য সেপাই কেল্লার দেয়াল ধরে টহল দিচ্ছে।” আলাপ ধীরে ধীরে অনুভব করলেন যে কেল্লার এই অদৃশ্য রক্ষক বা সেপাই শুধু গল্পের অংশ নয়; এটি কেল্লার গভীর ইতিহাসের অংশ, যা রাতের অন্ধকারে নতুন রূপ ধারণ করে। মোশারফের চোখে সেই দৃঢ় বিশ্বাস দেখা যাচ্ছিল যে কেল্লার এই রহস্যময় উপস্থিতি অতীতের শক্তির প্রতিফলন। আলাপের মধ্যে কৌতূহল এবং ভয়ের এক ধরনের মিলিত অনুভূতি তৈরি হলো—একই সঙ্গে তাকে আতঙ্কিত করছিল এবং অনুপ্রাণিত করছিল। তিনি বুঝতে পারলেন, যে কোনো পদক্ষেপ কেল্লার অন্ধকারে তাকে শুধু ইতিহাসের কাছাকাছি নিয়ে যাবে না, বরং সে অতীতের ভয় এবং রহস্যের সঙ্গেও সংযুক্ত হবে।

রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আলাপ এবং মোশারফ কেল্লার একেবারে গভীর অংশে প্রবেশ করলেন। মোশারফ আলি ধীরে ধীরে বিভিন্ন প্রাচীন দরজা ও কামরার গল্প শোনালেন—যেখানে নবাবি সময়ে সৈন্যদের তদারকি, কেল্লার রাজ্যসংক্রান্ত ষড়যন্ত্র, এবং কিছু অজানা হত্যাকাণ্ডের গল্প অন্তর্ভুক্ত ছিল। তার কণ্ঠে প্রতিটি ঘটনা যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে। আলাপ অনুভব করলেন যে এই গল্পগুলো কেবল ভয়ঙ্কর নয়, বরং কেল্লার ইতিহাসকে জীবন্ত করে তোলার উপায়। তিনি মোশারফের চোখের দিকে তাকালেন এবং দেখলেন এক অদ্ভুত দৃঢ় বিশ্বাস—যে বিশ্বাসে তিনি জানেন, এই কেল্লা রাতে নিজেই কথা বলে, ছায়ার মাধ্যমে নিজের অতীত প্রকাশ করে। আলাপও ধীরে ধীরে বোঝলেন যে, গবেষক হিসেবে তার কাজ শুধু তথ্য সংগ্রহ করা নয়; তাকে বুঝতে হবে কেল্লার ইতিহাসের ভেতরের অনুভূতি, ছায়া, এবং গোপন রহস্যগুলো। মোশারফের গল্প শেষে আলাপের মধ্যে কৌতূহল আরও প্রগাঢ় হয়ে উঠল। তিনি ঠিক করলেন যে, রাতের অন্ধকার, সেপাইয়ের অদৃশ্য উপস্থিতি, এবং বন্দুকের অনিশ্চিত আওয়াজ সবই তাকে ইতিহাসের এক নতুন জগতে নিয়ে যাবে—যেখানে শুধু তথ্য নয়, বরং অনুভূতি, রহস্য, এবং অতীতের জীবন্ত কাহিনি জাগ্রত হবে।

রাতের অন্ধকার কেল্লার চারপাশে ধীরে ধীরে নেমে আসে, বাতাসে সেই অদ্ভুত নীরবতা ভেসে থাকে যা কেবল প্রাচীন ইতিহাসের সঙ্গে সংযুক্ত স্থানেই থাকে। আলাপ মুখার্জি, সুবীর সেনগুপ্ত এবং ইরা দত্ত একসঙ্গে কেল্লার ভেতরে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রত্যেকের মনে ছিল এক ধরনের উত্তেজনা, ভয় এবং কৌতূহলের মিশ্রণ। তারা ধীরে ধীরে প্রবেশপথ পার হচ্ছিল, পায়ের আওয়াজ প্রতিধ্বনি করছে খোলা কংক্রিট ও প্রাচীন পাথরের দেয়ালে। কেল্লার ভিতরের অন্ধকার যেন তাদের চারপাশে ঢেকে দিয়ে প্রতিটি কোণ, প্রতিটি ছায়াকে আরও রহস্যময় করে তুলছিল। হঠাৎ আলাপ টর্চ জ্বালালেন, এবং আলো ভেসে গেল কেল্লার প্রাচীর ধরে। আর সেখানেই, অদ্ভুত এক দৃশ্য তাদের চোখে ধরা দিল—একজন সেপাই বন্দুক কাঁধে ধরে ধীরে ধীরে প্রাচীরের পাশ দিয়ে হাঁটছিল। তার চোখ বা মুখ দেখা যাচ্ছিল না; শুধু অবচেতনভাবে সে প্রাচীরের ধার ধরে চলছিল, যেন অতীতের এক রক্ষকের প্রাত্যহিক টহল। তিনজন স্থির হয়ে দাঁড়ালেন, তাদের হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে উঠল। আলাপ অনুভব করলেন, যে ইতিহাসের প্রতিটি ঘটনা তিনি অধ্যয়ন করেছেন, তা যেন আজকের রাতের ভেতরে নতুন রূপ ধারণ করছে।

তারা যতই কাছে এগোতে লাগলেন, সেপাইটি ঠিক তখনই অদৃশ্য হয়ে গেল। যেন কেউ কেল্লার বাতাসের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে তাকে। আলাপ, সুবীর এবং ইরা একে অপরের দিকে তাকালেন, সবাইকে বুঝতে দিচ্ছিল যে কেল্লার রাত কেবল ভয়ের জন্য নয়; এটি ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষ্য, যা কখনো সরাসরি দেখা যায় না, শুধু অনুভূত হয়। আলাপের মনে কাজ করল যে, স্থানীয়দের গল্প এবং মোশারফের অভিজ্ঞতা সবই সত্য—এই সেপাই কেবল গল্প নয়, বরং কেল্লার ইতিহাসের প্রহরী। ইরা ধীরে ধীরে বললেন, “দেখলেন, এটাই আমি বলছিলাম—যতই এগো, সে কখনোই দেখা যায় না। তার উপস্থিতি প্রায়শই ছায়া, আলো এবং আমাদের চোখের খেলা।” সুবীর তাদের কণ্ঠস্বর শান্ত রাখার চেষ্টা করছিল, তবে তার চোখে উত্তেজনা এবং কৌতূহল স্পষ্ট। তারা বুঝতে পারলেন যে, এই রাত কেবল কৌতূহল উস্কে দেয়ার জন্য নয়; বরং এটি তাদেরকে কেল্লার গভীর অন্ধকারের সঙ্গে মানিয়ে নিতে শেখাচ্ছে, যেখানে অতীতের ছায়া আজও জীবন্ত। আলাপ নিজেকে প্রস্তুত করলেন, জানিয়ে যে তিনি শুধু তথ্য সংগ্রহ করছেন না, বরং ইতিহাসের সাথে এক অদৃশ্য সংযোগ স্থাপন করছেন।

রাতের গভীরতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পদক্ষেপ আরও ধীরে এবং সতর্ক হয়ে উঠল। আলাপ, সুবীর, এবং ইরা কেল্লার প্রাচীন কামরা ও ভাঙা দেয়ালের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেলেন। প্রতিটি মোড়ে, প্রতিটি প্রাচীরের ছায়ায় তাদের মনে হলো সেপাই এখনও তাদের চারপাশে আছে, যদিও তাকে দেখা যায় না। তারা বুঝতে পারলেন যে এটি শুধুই ভয় নয়; বরং ইতিহাসের একটি অদৃশ্য উপস্থিতি, যা কেবল সাহসী পর্যবেক্ষককে উপলব্ধি করতে দেয়। আলাপের মনে কাজ করল, এই সেপাই কেবল অতীতের পাহারাদার নয়; এটি কেল্লার আত্মা, ইতিহাসের সচেতন প্রহরী, যা রাতের অন্ধকারে নিজেকে প্রকাশ করে। এই প্রথম রাতের অভিজ্ঞতা আলাপকে একটি গভীর উপলব্ধি দিল—কেল্লা শুধুমাত্র পাথর, ইট এবং ধুলো নয়; এটি ইতিহাসের জীবন্ত প্রমাণ, যা ছায়া, বাতাস, এবং অদৃশ্য উপস্থিতির মাধ্যমে আজও নিজের গল্প বলছে। তারা ধীরে ধীরে কেল্লার গভীরতম অংশে প্রবেশ করলেন, যেখানে অন্ধকার এবং ছায়ার মিলন, ভয় এবং কৌতূহলের এক অনন্য সংমিশ্রণ সৃষ্টি করছিল, এবং আলাপ বুঝতে পারলেন যে এই রাত কেবল প্রথম অধ্যায়—একটি দীর্ঘ রহস্যের যাত্রার সূচনা।

রাতের অন্ধকার কেল্লার প্রতিটি কোণকে ঘিরে রাখে, বাতাসে ধূলিমাখা ইতিহাসের গন্ধ ভেসে আসে, আর পাথরের দেয়াল যেন নিজেদের মধ্যে নিঃশব্দে ফিসফিস করছে। আলাপ, ইরা এবং সুবীর গভীর অন্ধকারের মধ্যে এগোচ্ছিলেন, তাদের পায়ের আওয়াজ প্রতিধ্বনি করছে খোলা প্রাঙ্গণ ও ফাটলযুক্ত দেয়ালে। হঠাৎ, অন্ধকারের মধ্যে কোথা থেকে যেন বন্দুকের একাধারে গর্জন শোনা গেল। আলাপ থমকে গেলেন, টর্চের আলো আরও শক্ত করে ধরে ধরলেন। ইরা কেঁপে উঠলেন, আর সুবীর মৃদু কণ্ঠে বললেন, “শব্দটি প্রকৃতিতে সম্ভব না—আমরা নিশ্চয়ই ভুল শুনছি।” কিন্তু মুহূর্তেই তাদের কানে ভেসে এলো একটি গভীর, ভারী কণ্ঠস্বর—“পাহারা ছাড়বো না।” শব্দটি এতটাই বাস্তব, এতটাই কাছের, যে তাদের হৃদয় যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। তারা স্থির হয়ে দাঁড়ালেন, শ্বাসকষ্ট, কাঁপুনি, এবং আতঙ্কের মিশ্রণে। আলাপ অনুভব করলেন যে এই কণ্ঠস্বর কেবল শব্দ নয়; এটি ইতিহাসের অদৃশ্য প্রহরীর উপস্থিতি, যা রাতের অন্ধকারে নিজেকে ঘোষণা করছে।

সুবীর চেষ্টা করলেন বিজ্ঞান এবং যুক্তির আলোকে কাজে লাগাতে। তিনি বললেন, “দেখুন, হয়তো প্রতিধ্বনি বা বাতাসের শব্দের খেলাই এটি—আমরা অতিরিক্ত কল্পনা করছি।” তিনি চারপাশ ঘুরে দেখলেন, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অন্ধকারের কোণগুলো পর্যবেক্ষণ করলেন, কিন্তু সেখানে কিছুই দেখা গেল না। তবে আলাপ এবং ইরা কোনোভাবেই যুক্তি মেনে নিতে পারলেন না। তাদের শরীরে শিউরের অনুভূতি ছড়িয়ে গেল, এমন এক শীতল হিম যে বাতাসের সঙ্গে মিশে তাদের ভেতর ভয় ছড়িয়ে দিচ্ছিল। আলাপ কণ্ঠরোধ করলেন এবং শুধু টর্চের আলো দিয়ে প্রতিটি কোণ খুঁজতে লাগলেন। ইরা বারবার বললেন, “আমরা একা নই, শুনছেন কি? সে আমাদের ওপর নজর রাখছে। আমাদের চলাফেরা, আমাদের পদক্ষেপ, সব সে জানে।” আলাপ বোঝতে পারলেন যে, কেল্লার অন্ধকার কেবল শূন্য নয়; এটি সচেতন, জীবন্ত এবং সজাগ। বন্দুকের শব্দ আর কণ্ঠস্বর যেন অতীতের স্মৃতি এবং বর্তমানের বাস্তবতার এক অদ্ভুত সংযোগ তৈরি করছে।

ভয় এবং উত্তেজনার মধ্যে তারা কেল্লার গভীরে প্রবেশ করতে লাগলেন। সুবীর আবারও যুক্তির সন্ধান করলেন—প্রাচীরের খাঁজ, বাতাসের ধারা, শব্দের প্রতিধ্বনি সব কিছু পরীক্ষা করলেন। কিন্তু আলাপ এবং ইরা প্রায়শই স্তব্ধ হয়ে তাকালেন, অনুভব করলেন যে কণ্ঠস্বর এবং বন্দুকের আওয়াজ কেবল প্রকৃতির খেলা নয়; এটি কেল্লার আত্মা, ইতিহাসের পাহারাদার, যা রাতের অন্ধকারে নিজেকে প্রকাশ করছে। তাদের ধীরে ধীরে বোঝা শুরু হলো, ভয় শুধু আতঙ্ক নয়; এটি ইতিহাসের এক জীবন্ত প্রমাণ, যা শুধু সাহসী পর্যবেক্ষককে উপলব্ধি করার সুযোগ দেয়। রাতের প্রতিটি ধাপ তাদের মনে করিয়ে দিচ্ছিল—কেল্লা শুধুমাত্র পাথরের তৈরি নয়; এটি অতীত, বর্তমান এবং অদৃশ্য ইতিহাসের এক অবিচ্ছিন্ন মিলন। আলাপের চোখে উত্তেজনা এবং ভয়ের মিশ্রণ দেখা গেল, ইরা কেঁপে উঠেছেন, এবং সুবীর চেষ্টা করছেন যুক্তি খুঁজতে; তবু তারা সবাই জানতেন, এই রাত কেবল প্রথম ধাপ নয়—এটি এক দীর্ঘ, রহস্যময় যাত্রার সূচনা, যেখানে সেপাইয়ের কণ্ঠস্বর তাদেরকে ইতিহাসের অদৃশ্য ও ভয়ঙ্কর দিকের সঙ্গে পরিচয় করাবে।

আলাপ মুখার্জি গভীর রাতের অন্ধকারে কেল্লার ভেতরের ঘূর্ণায়মান বাতাস ও ধুলিমাখা দেয়ালগুলোর মধ্যে তার গবেষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি প্রাচীন নথিপত্র, খোদাই করা পাথরের স্ল্যাব এবং বিভিন্ন গোপন কক্ষ খুঁটিয়ে দেখছিলেন, যা নবাবি আমলের ইতিহাসকে আজও জীবন্ত রাখে। একসময় তিনি প্লাসির যুদ্ধের পরের ঘটনা সম্পর্কিত এক নথি পেলেন। পড়তে পড়তে তার রক্ত শীতল হয়ে গেল, কারণ নথিতে বর্ণিত ছিল—যুদ্ধের পর বহু সিপাহীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। প্রতিটি শব্দে ইতিহাসের সেই ভয়ঙ্কর বাস্তবতা তার মনে প্রবেশ করছিল। সে বোঝতে পারল যে কেল্লার দেয়াল, যা এতদিন শুধু প্রাচীর মনে হতো, আসলে অতীতের ক্রোধ, দমনের গল্প, এবং মৃত সিপাহিদের আত্মার সাক্ষ্য বহন করছে। আলাপের চোখে দৃঢ়তা এবং কৌতূহল একসাথে জেগে উঠল; তিনি অনুভব করলেন যে শুধুমাত্র গবেষণার মাধ্যমে তিনি এই ইতিহাসের গভীর রহস্য উন্মোচন করতে পারবেন, যেখানে শুধু তথ্য নয়, বরং মৃতদের ছায়া এবং তাদের অভিজ্ঞতাও ধরা পড়ে।

পড়াশোনার মধ্যেই আলাপ ধীরে ধীরে উপলব্ধি করলেন যে, কেল্লার এই অদৃশ্য সেপাই—যে রাতের অন্ধকারে প্রাচীর ধরে টহল দিত—শুধু একটি কিংবদন্তি নয়। এটি সেই তরুণ সিপাহী, যে শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত কেল্লার প্রাচীর পাহারা দিয়েছিল। তার আত্মা আজও যেন ইতিহাসের সঙ্গে সংযুক্ত থেকে রাতের অন্ধকারে ঘুরে বেড়ায়। আলাপ অনুভব করলেন, প্রতিটি ধুলোমাখা কক্ষ, প্রতিটি ফাটল এবং প্রতিটি বাঁকা গলিপথ যেন সেই তরুণ সিপাহির উপস্থিতিকে সংরক্ষণ করে। তার মনে ভয় এবং বিস্ময়ের এক ধরনের মিশ্রণ তৈরি হলো। বাতাসের মধ্যে হঠাৎ শীতল শ্বাসের অনুভূতি, দূরের দেয়াল ধরে ভেসে আসা অদৃশ্য ছায়া—সবই তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল যে অতীত কখনও নিঃশেষ হয় না। এটি শুধু ইতিহাস নয়; এটি জীবন, মৃত্যু, দায়িত্ব এবং অদৃশ্য উপস্থিতির এক অনন্ত সমাহার। আলাপ স্থির হয়ে দাঁড়ালেন, তার হাতের নথিগুলো যেন তাকে অতীতের ভয়ঙ্কর মুহূর্তের সঙ্গে সংযুক্ত করে।

রাত গভীর হতে হতে কেল্লার অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে গেল। আলাপ বুঝতে পারলেন যে এই সেপাইয়ের আত্মা শুধুমাত্র ইতিহাসের প্রহরী নয়; এটি কেল্লার নীরব রক্ষক, যা অতীতের সকল হত্যাকাণ্ড এবং যুদ্ধের ক্ষতকে স্মরণ করায়। তিনি ধীরে ধীরে তার গবেষণার নোটবুক খুললেন, প্রতিটি তথ্যকে পর্যবেক্ষণ করলেন এবং সেই তরুণ সিপাহির গল্পের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলেন। মনে হলো, কেল্লার প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি অন্ধকার কোণ, প্রতিটি ছায়া—সবই তাকে অতীতের সঙ্গে সংযুক্ত করছে। আলাপ অনুভব করলেন, শুধু পর্যবেক্ষণ বা নথি পড়লেই ইতিহাস বোঝা যায় না; তাকে অনুভব করতে হবে, ভয়কে সম্মুখীন হতে হবে, এবং সেই ভয়কে তার গবেষণার অংশ করতে হবে। তার মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল, এই কেল্লা শুধু পাথরের তৈরি নয়; এটি অতীতের ছায়া, যা রাতের অন্ধকারে যেকোনো মুহূর্তে জীবন্ত হয়ে ওঠে, এবং সেই ছায়ার মাধ্যমে ইতিহাসকে নতুনভাবে অনুভব করানো সম্ভব। এই রাতে আলাপ বুঝতে পারলেন, ইতিহাস কখনো নিঃশব্দ নয়—এটি ছায়া, বাতাস, শব্দ এবং অদৃশ্য উপস্থিতির মধ্য দিয়ে আজও কথা বলে, এবং কেবল সাহসী পর্যবেক্ষকই তা শুনতে এবং উপলব্ধি করতে পারে।

মুর্শিদাবাদের প্রাচীন কেল্লার ছায়ায় মোশারফ আলি আলাপ, ইরা ও সুবীরকে একেবারে নীরবভাবে তার জীবনের এক গভীর, অজানা অধ্যায় খুলতে শুরু করলেন। তিনি ধীরে ধীরে কণ্ঠ নিচু করে বললেন, “অনেক বছর আগে, আমি এক বন্ধু নিয়ে এই কেল্লায় প্রবেশ করেছিলাম রাতের অন্ধকারে। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল কেবল কৌতূহল মেটানো—কেল্লার ইতিহাস আরও কাছে থেকে দেখা। আমরা ভেবেছিলাম এটি শুধু অভিজ্ঞতার খেলা, কিন্তু সেই রাত আমাদের জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার মুহূর্ত হয়ে দাঁড়ায়।” আলাপ মন দিয়ে শুনছিলেন, আর ইরা এবং সুবীর হঠাৎ স্থির হয়ে গেলেন। মোশারফের চোখে একটি গভীর দুঃখ এবং অদ্ভুত আতঙ্কের ছাপ ছিল, যা তার কথায় জেগে উঠছিল। তিনি বললেন, “আমরা ঢুকেছিলাম সেই গেটে, যেখানে আজও সেপাইদের ছায়া টহল দেয়। সেই রাতে আমার বন্ধু হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি তাকে চেয়েছিলাম ধরে রাখতে, ডাক দিয়েছিলাম, কিন্তু সে আর কখনো ফিরে আসেনি। আমি একা বের হই, কিন্তু মনে হয় সেই রাত থেকে কেল্লার অন্ধকার আমাদের প্রায়শই চোখে ভেসে উঠে।” আলাপ বুঝতে পারলেন যে মোশারফ শুধু কিংবদন্তি শোনাচ্ছেন না; তিনি তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সত্য প্রকাশ করছেন।

মোশারফের স্বীকারোক্তি আলাপ ও ইরার মনে এক অদ্ভুত আতঙ্ক এবং কৌতূহলের মিশ্রণ জাগাল। তিনি বললেন, “আমি বিশ্বাস করি, সেই বন্ধুর অদৃশ্য উপস্থিতি—যে আমি কখনো খুঁজে পাইনি—কেল্লার অন্ধকারে এখনও প্রহরা দিচ্ছে। সে কেবল আমার বন্ধু নয়; এটি এক অশান্ত আত্মা, যে রাতের অন্ধকারে সতর্কতা ও ভয় ছড়ায়।” আলাপের মধ্যে ধীরে ধীরে উদয় হলো উপলব্ধি, যে এই কেল্লার সেপাইয়ের ছায়া শুধু অতীতের কল্পনা নয়; এটি সেই অশান্ত আত্মার নিদর্শন, যাকে কেউ শান্ত করতে পারেনি। ইরা হালকা কণ্ঠে বললেন, “আপনি কি বুঝতে পারছেন, আলাপ? কেল্লা শুধু ইতিহাস নয়; এটি একটি জীবন্ত স্মৃতি, যা এখনো পথপ্রদর্শক এবং প্রহরী হিসেবে কাজ করে। আমরা যে পদক্ষেপ নিই, তা সেই অতীতের সাথে সরাসরি সংযুক্ত।” সুবীর প্রথমে যুক্তির সাহায্য খুঁজতে চাইলেন, চেষ্টা করলেন এটিকে প্রতিধ্বনি বা মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব হিসেবে ব্যাখ্যা করতে, কিন্তু মোশারফের দৃঢ় অভিজ্ঞতা তাকে বুঝিয়ে দিল যে, এখানে কিছু এমন আছে যা মাত্র বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না।

রাত গভীর হতে থাকল, আর আলাপ বুঝতে পারলেন যে মোশারফের স্বীকারোক্তি শুধুমাত্র একটি ব্যক্তিগত কাহিনি নয়; এটি কেল্লার অদৃশ্য ইতিহাসের অংশ। সেই বন্ধুর অদৃশ্য উপস্থিতি, সেপাইয়ের টহল এবং অশান্ত আত্মার গল্প একত্রে এক অদ্ভুত ভৌতিক ও বাস্তব অনুভূতি তৈরি করছিল। আলাপ ধীরে ধীরে উপলব্ধি করলেন, ইতিহাস কখনো নিঃশব্দ নয়—এটি জীবন্ত, সচেতন এবং প্রায়শই আতঙ্ক ও সতর্কতার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। মোশারফের চোখে দৃঢ় বিশ্বাস দেখা যাচ্ছিল যে কেল্লা শুধুমাত্র পাথর বা দেয়ালের সমষ্টি নয়; এটি অতীতের ভয়ঙ্কর স্মৃতি, যা রাতের অন্ধকারে জীবন্ত হয়ে ওঠে। আলাপ, ইরা এবং সুবীর সবাই স্থির হয়ে দাঁড়ালেন, বোঝতে পারলেন যে এই রাত, এই স্বীকারোক্তি এবং এই কেল্লা—সব মিলিয়ে তাদেরকে ইতিহাসের অদৃশ্য, রহস্যময় এবং ভয়ঙ্কর দিকের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। তারা জানলেন যে, রাতের প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি শব্দ এবং প্রতিটি প্রাচীরের ফাটল তাদেরকে অতীতের অশান্ত আত্মার সঙ্গে সরাসরি মিলিয়ে দিচ্ছে, এবং কেবল সাহসী পর্যবেক্ষকই তা উপলব্ধি করতে পারে।

দ্বিতীয় রাতের অন্ধকার কেল্লার প্রাচীরগুলোকে আরও গভীর এবং রহস্যময় করে তুলেছে। আলাপ মুখার্জি, ইরা দত্ত এবং সুবীর সেনগুপ্ত নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে কেল্লায় প্রবেশ করলেন—গভীর রাতের ভেতর সেপাইয়ের অদৃশ্য উপস্থিতি ও কেল্লার অতীতের রহস্যকে চোখে দেখার জন্য। তবে প্রথম থেকেই তারা বুঝতে পারলেন যে এই রাত আগের রাতের চেয়ে ভয়ঙ্কর হবে। বাতাসে ঘোলা ধূলি, প্রতিটি ফাটল এবং প্রতিটি বাঁকা গলিপথ যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তারা ধীরে ধীরে কেল্লার ভেতর পা বাড়াচ্ছিল, টর্চের আলোতে অন্ধকারে ছায়া নাচছিল। হঠাৎ, কোথা থেকে যেন বন্দুকের গর্জন ছুটে এলো। শব্দটি এতই প্রকট এবং কাছের, যে আলাপের হৃদয় যেন দম বন্ধ হয়ে যায়। তার শরীর অজ্ঞানভাবে কাঁপতে লাগল; মনে হলো যেন প্রতিটি ফোঁটা রক্ত থমকে দাঁড়িয়েছে। আলাপ স্থির হয়ে দাঁড়ালেন, চারপাশের অন্ধকার এবং প্রতিটি ছায়ার দিকে তাকিয়ে—তাদের মনে ভয় এবং বিস্ময়ের একসাথে মিশ্রণ জাগল।

হঠাৎ, সেই পরিচিত ছায়া—সেপাই—দেখা দিল প্রাচীর ধরে হাঁটতে, কাঁধে বন্দুক ধারণ করে। আলাপ ধীরে ধীরে সেপাইয়ের দিকে এগোতে চাইলেন, কিন্তু তার পায়ের ধাক্কা যেন মাটিতে আটকে গেছে। বন্দুকের গর্জন আরও প্রকট হয়ে উঠল, এবং আলাপ অনুভব করলেন যেন তার প্রাণ নিজেই ঝুঁকি নিয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি চিৎকার করতে চাইলেন, কিন্তু কণ্ঠ গলা আটকে গেছে; মনে হলো, ইতিহাসের ভয়ঙ্কর স্মৃতি তার চারপাশে ঘূর্ণায়মান হয়ে উঠেছে। ইরা এবং সুবীর সতর্ক হয়ে আলাপকে টেনে নিলেন, তার শরীরকে শক্ত করে ধরে রাখলেন যেন কোনো ক্ষতি না হয়। তারা বুঝতে পারলেন যে কেল্লার রাত কেবল কল্পনা নয়; এটি বাস্তব, এবং অতীতের অশান্ত আত্মা বা সেপাইয়ের উপস্থিতি তাদের সামনে জীবন্ত। আলাপ ধীরে ধীরে বুঝতে পারলেন, যে যে ভয় তারা অনুভব করছে, তা শুধুমাত্র আতঙ্ক নয়; এটি কেল্লার ইতিহাসের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত।

ভয়, উত্তেজনা, এবং বাস্তবতার এক অনন্য সংমিশ্রণে তারা ধীরে ধীরে কেল্লার গভীরে প্রবেশ করল। আলাপের মনে আসল উপলব্ধি হলো—এই কেল্লা শুধুমাত্র পাথর এবং দেয়ালের সমষ্টি নয়; এটি অতীতের ভয়ঙ্কর ঘটনাবলী, ইতিহাসের অশান্ত আত্মা এবং অদৃশ্য প্রহরীর মিলন। বন্দুকের গর্জন, সেপাইয়ের ছায়া, এবং রাতে প্রতিটি অন্ধকার কোণ—সবই তাদের মনে করিয়ে দিচ্ছিল যে, এই গল্প, যা শুরুতে শুধু কিংবদন্তি মনে হয়েছিল, তা আজ প্রকৃত রূপে তাদের সামনে হাজির হয়েছে। ইরা এবং সুবীর আলাপকে টেনে নিরাপদ স্থানে নিয়ে গেলেন, তাদের শরীর কাঁপছে, শ্বাস নিয়ন্ত্রণ করতে কষ্ট হচ্ছে। আলাপ স্থির হয়ে দাঁড়ালেন, চারপাশের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে, বোঝার চেষ্টা করলেন—কেল্লার ইতিহাস কেবল নথি বা পাথরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি জীবন্ত, সচেতন এবং রাতের অন্ধকারে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করে। সেই রাত তাদের মনে করিয়ে দিল যে ইতিহাস কখনো নিঃশব্দ নয়; এটি ছায়া, শব্দ, আতঙ্ক এবং ভয়ঙ্কর উপস্থিতির মাধ্যমে আজও কথা বলে, এবং কেবল সাহসী ও সতর্ক পর্যবেক্ষকই তা উপলব্ধি করতে পারে। এই মুহূর্তে, তারা বুঝলেন যে কেল্লার ভয়ঙ্কর কিংবদন্তি শুধুমাত্র গল্প নয়—এটি বাস্তব, এবং তাদের সামনেই জীবন্ত।

কেল্লার অন্ধকারে প্রবেশ করে আলাপ ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করলেন যে, তার সামনে যা ঘটছে, তা শুধুই রহস্য বা কল্পনা নয়। প্রাচীরের খাঁজ, ভাঙা দরজা, এবং প্রতিটি ছায়া যেন তাকে অতীতের গল্প শোনাচ্ছে। বহু বছর আগের ইতিহাসের খণ্ডচিত্রগুলো ধীরে ধীরে জীবন্ত হয়ে উঠছিল। আলাপ নথি ও প্রাচীন খোদাই করা পাথরের তথ্যের মধ্যে গভীর গবেষণা করছিলেন, এবং হঠাৎ সে এমন কিছু প্রমাণ পেলেন যা তার ধারণার সীমা ছাড়িয়ে গেল। নথিতে লেখা ছিল, যে তরুণ সিপাহী, যিনি শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত কেল্লার প্রাচীর ধরে পাহারা দিতেন, তিনি প্রকৃতপক্ষে শপথবদ্ধ ছিলেন—কখনও ছেড়ে যাবেন না। যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যু হলেও তার কর্তব্যবোধ এবং শপথ তাকে অদৃশ্য আকারে কেল্লার ভেতরে অবিরাম টহল দিতে বাধ্য করেছে। আলাপের চোখে বিস্ময় এবং ভয় একসাথে জেগে উঠল, কারণ তার সামনে স্পষ্ট হয়ে গেল যে কেল্লার অদৃশ্য সেপাই কোনো ভৌতিক খেলা নয়; এটি ইতিহাসের এক শপথবদ্ধ প্রহরী, যার কর্তব্যবোধই তাকে এখনও জীবন্ত রাখছে।

আলাপ আরও গভীরে নথি ও প্রমাণ খুঁজে দেখলেন। কেল্লার প্রতিটি দেওয়াল, ফাটল এবং ঘর যেন সেই শপথবদ্ধ সিপাহির গল্প বলে। হঠাৎ তার কানে ভেসে এলো সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর—“পাহারা ছাড়বো না।” এবার আলাপ বুঝতে পারলেন যে এটি শুধু ভয় দেখানোর জন্য নয়; এটি দায়িত্বের আর্তি, এক অনন্ত শপথের প্রতিফলন। কণ্ঠস্বরের গভীরতা, প্রায়শই ঝরঝরে আওয়াজ, এবং বন্দুকের হালকা প্রতিধ্বনি— সব মিলিয়ে তাকে বোঝাল যে সেপাই কখনও শান্ত হতে পারেনি। আলাপ অনুভব করলেন, ইতিহাস কখনো নিঃশব্দ নয়; এটি শপথ, দায়িত্ব, এবং কর্তব্যের অনুভূতি নিয়ে এখনও জীবন্ত। ইরা এবং সুবীরও স্থির হয়ে চারপাশের অন্ধকার পর্যবেক্ষণ করছিলেন, বোঝার চেষ্টা করছিলেন যে কেবল ইতিহাসের তথ্যই নয়, বরং কর্তব্যবোধ এবং শপথও কেল্লায় একটি শক্তিশালী উপস্থিতি তৈরি করে। তারা তিনজন স্থির হয়ে দাঁড়ালেন, বুঝলেন যে ইতিহাসের জীবন্ত অংশ আজও তাদের চারপাশে ঘুরছে।

রাত আরও গভীর হয়ে এলো, আর আলাপ বুঝতে পারলেন যে এই শপথবদ্ধ আত্মা শুধু অতীতের স্মৃতি নয়; এটি কেল্লার নীরব রক্ষক, ইতিহাসের অশান্ত প্রহরী, যা রাতের অন্ধকারে নিজেকে প্রকাশ করে। আলাপ ধীরে ধীরে উপলব্ধি করলেন যে এই কেল্লা শুধুমাত্র পাথর, দেয়াল বা ধুলো নয়; এটি এক জীবন্ত স্মৃতি, যার সঙ্গে শপথ, দায়িত্ব এবং ইতিহাসের অশান্ত আত্মা জড়িত। বন্দুকের প্রতিধ্বনি, সেপাইয়ের ছায়া, এবং কণ্ঠস্বর—সবই তার মনে করিয়ে দিচ্ছিল যে কেবল সাহসী পর্যবেক্ষকই এই ইতিহাসকে জীবন্তভাবে অনুভব করতে পারে। আলাপ, ইরা এবং সুবীর ধীরে ধীরে কেল্লার প্রতিটি কোণে এগোতে লাগলেন, বোঝার চেষ্টা করলেন যে, শপথবদ্ধ সিপাহির আত্মা তাদের সামনে শুধুমাত্র ভয় দেখাচ্ছে না; বরং এটি কর্তব্যের, সততার এবং ইতিহাসের এক অনন্ত শিক্ষা উপস্থাপন করছে। এই রাত তাদের মনে করিয়ে দিল, ইতিহাস কখনো নিঃশব্দ নয়; এটি শপথ, দায়িত্ব, এবং অদৃশ্য উপস্থিতির মাধ্যমে আজও কথা বলে, এবং কেবল তারা যারা মনোযোগ দিয়ে শুনতে পারে, তারা তা উপলব্ধি করতে পারে।

শেষ রাতের অন্ধকার কেল্লার প্রতিটি কোণকে আরও গভীর, রহস্যময় এবং তীক্ষ্ণ করে তুলেছে। আলাপ মুখার্জি এবং ইরা দত্ত কেল্লার অন্ধকার ঘরে প্রবেশ করেন, হৃদয়ে এক মিশ্র অনুভূতি—ভয়, উত্তেজনা, কৌতূহল এবং সহানুভূতি। তারা জানতেন যে আজকের রাতই শেষ সুযোগ, যেখানে তারা সেপাইয়ের আত্মার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করতে পারেন এবং হয়তো তাকে মুক্তি দিতে পারেন। বাতাসে ধুলোমাখা ইতিহাসের ঘ্রাণ, ভাঙা প্রাচীরের ফিসফিসানো শব্দ, এবং দূরের ফাটল দিয়ে হালকা প্রতিধ্বনি—সব মিলিয়ে একটি জীবন্ত, অদ্ভুত পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। আলাপ ধীরে ধীরে টর্চ জ্বালালেন, এবং ইরা কণ্ঠে হালকা প্রার্থনা শুরু করলেন। বাতাস যেন স্থির হয়ে গেল, প্রতিটি শব্দ তাদের চারপাশে ভেসে এল, যেন অতীতের প্রতিধ্বনি আজও তাদের শোনার জন্য উপস্থিত। তারা দু’জন মিলিতভাবে প্রার্থনা চালিয়ে গেলেন, হৃদয়ে বিশ্বাস এবং ভয়কে একসাথে ধারণ করে।

হঠাৎ আলাপ টর্চের আলো ফেললেন, এবং অবাক হয়ে দেখলেন—সেপাই আবারও প্রাচীর ধরে দাঁড়িয়ে আছে, কাঁধে বন্দুক নিয়ে। তবে এবার তার উপস্থিতি ভয়ঙ্কর নয়; বরং একটি ধীর, সম্মানসূচক সালাম। আলাপ ও ইরা স্থির হয়ে তাকালেন, তাদের হৃদয় শীতল হলেও শান্তি অনুভব করছিল। সেপাই ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগল, তার ছায়া বাতাসের সঙ্গে মিশে গেল, যেন অতীত এবং বর্তমান এক হয়ে গেল। শব্দ থেমে গেল—বন্দুকের গর্জন নেই, কণ্ঠস্বর নেই, শুধু কেল্লার নীরবতা। আলাপের মনে উদয় হলো উপলব্ধি, যে সেপাইয়ের আত্মা হয়তো মুক্তি পেয়েছে। তবে একই সঙ্গে একটি অদ্ভুত সংশয়ও জন্ম নিল—কে জানে, হয়তো পরের রাতে সে আবারও পাহারা দিতে ফিরে আসবে। কেল্লার ইতিহাস, কর্তব্যবোধ, এবং অশান্ত আত্মার সঙ্গে এই সংযোগ সম্ভবত কখনো পুরোপুরি শেষ হয় না।

রাত গভীর হতে হতে কেল্লার প্রতিটি ছায়া ও প্রতিধ্বনি ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এলো। আলাপ এবং ইরা ধীরে ধীরে কেল্লার মধ্য দিয়ে বের হতে লাগলেন, তাদের মনে শীতলতা এবং প্রশান্তির এক মিশ্র অনুভূতি। তারা বুঝতে পারলেন যে, ইতিহাস কখনো নিঃশব্দ নয়; এটি জীবন্ত, সচেতন, এবং প্রায়শই রহস্যময় ভয় ও সতর্কতার মাধ্যমে কথা বলে। এই রাত তাদের মনে করিয়ে দিল যে অতীতের শপথবদ্ধ আত্মা, কর্তব্যবোধ, এবং ইতিহাসের ছায়া কেবল ভয়ের জন্য নয়; বরং এটি আমাদের শেখায় সম্মান, সততা, এবং অনন্ত দায়িত্বের মূল্য। আলাপ টর্চ বন্ধ করে কেল্লার বাইরে তাকালেন, বোঝার চেষ্টা করলেন—সেপাই সত্যিই মুক্তি পেল, নাকি কেবল একটি মুহূর্তের জন্য অদৃশ্য হয়ে গেল? কেল্লার নীরবতা তাদের কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর দেয়নি। তবে তারা জানতেন, এই রাত, এই অভিজ্ঞতা, এবং এই অদৃশ্য সংযোগ ইতিহাসের প্রতি তাদের দৃষ্টিকোণ চিরকাল পরিবর্তন করে রেখেছে, এবং তাদের মনে গেঁথে গেছে এক অবিস্মরণীয় গল্প—যা মুক্তি নাকি অভিশাপ, তা হয়তো কেবল সময়ই জানাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *