জিনিয়া
পর্ব ১
শুক্রবার বিকেল। অফিসের ক্লান্তি গায়ে মেখে তিশা এসেছিল গড়িয়াহাটের এক ছোট্ট কফিশপে। বাইরের ট্র্যাফিকের আওয়াজ, হর্ণ, পাঁপড়ির দোকানের চিৎকার—সব মিলিয়ে শহরটা তখনও জেগে, ব্যস্ত, যেন কেউ ঘুমোতে দিচ্ছে না। তিশা এক কোণে বসে ল্যাপটপ খুলে ছবি এডিট করছিল, কানে হেডফোন।
তার টেবিলে ছিল একটা ছোট্ট ডায়েরি, যেটায় মাঝে মাঝে সে হঠাৎ করে কিছু লিখে রাখে। কখনও কোনও মুখের রেখা, কখনও কোনও গন্ধ, কখনও কোনও রঙ। ওর মনে হয়, এসব জিনিস হারিয়ে গেলে নিজেকেই হারিয়ে ফেলবে।
“সরি, এই চেয়ারটা ফাঁকা?”
তিশা কাঁধ তুলে তাকিয়ে দেখে, একটা মেয়ের গলা। সাদা কুর্তি, গলায় ঝুলছে একটা ল্যাপটপ ব্যাগ। চোখে ক্লান্তি, মুখে অদ্ভুত এক নির্ভরতার ছায়া।
“হ্যাঁ, বসুন,” তিশা বলল।
মেয়েটি বসে বলল, “আমার নাম শৈলী। আশেপাশে কোথাও বসার জায়গা নেই। কাজটা এখান থেকেই শেষ করতে হবে।”
“তিশা,” হাত বাড়িয়ে দিল সে।
হাত মেলানোর পর দুজনেই হাসল।
শৈলী জানাল, সে সল্টলেকে একটা আইটি কোম্পানিতে কাজ করে। আজ বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হবে, তাই রাস্তাতেই কিছু কাজ শেষ করার চেষ্টা।
তিশা বলল, “আমি ফ্রিল্যান্সার। ছবি তুলি, আর মাঝে মাঝে লেখালিখি করি।”
“ভালোই তো, নিজের মতো করে সময় বেছে নেওয়া যায়।”
“হ্যাঁ, তবে আয়টা খুব নিজের মতো করে হয় না সবসময়,” হাসল তিশা।
শৈলীও হাসল, কিন্তু তার চোখে তখন অন্যরকম আলো। কফি এসে গেল। দুজনেই নিজের নিজের মগে চুমুক দিতে দিতে নীরবতা ভাগ করে নিল।
“তুমি সবসময় এই ক্যাফেতে আসো?”
“না, আজ একটু এলাম। বাইরে থেকে এসে মেঘের গন্ধ পেয়েছিলাম, ভাবলাম কিছুটা সময় নিজের সঙ্গে কাটাই।”
তিশার কথা শুনে শৈলী তাকিয়ে রইল। যেন ওর মধ্যেই কোথাও লুকিয়ে আছে কোনও হারিয়ে যাওয়া বিকেল।
“তুমি একা থাকতে পছন্দ করো?”
“আমি বলব না যে একা থাকি, বরং নিজের মতো করে থাকি। তুমি?”
শৈলী চোখ নামিয়ে বলল, “আমি কিছুটা গুছিয়ে চলি। অন্যদের মতো। আর মাঝে মাঝে ভাবি, আমি কী চাই সেটাও জানি না।”
এই কথায় হালকা একটা থেমে থাকা এল। দুজনের কফির কাপে তখনও ধোঁয়া ছিল, কিন্তু কথোপকথনের তাপ যেন আস্তে আস্তে শরীরে ছড়িয়ে পড়ছিল।
“তোমার গলায় একটু বিষাদ থাকে,” তিশা বলল, একটু দ্বিধা নিয়ে।
“তোমার গলায় অনেকটা সাহস,” বলল শৈলী।
তিশা একটু অবাক হলেও হেসে ফেলল। ওর এতদিনের মধ্যে কেউ এত স্পষ্ট করে এটা বলেনি।
“সাহস জিনিসটা হয়তো আসে যখন ভয় পাওয়া ছেড়ে দিতে হয়।”
“ভয়গুলো কীভাবে ফেলে আসো?”
“একেকবার একেকভাবে। ছবি দিয়ে, গল্প লিখে, বা স্রেফ কাউকে পাশে বসিয়ে…”
শৈলী একটু চুপ করে ছিল, তারপর বলল, “আজ তাহলে তুমি আমার পাশে বসে থাকো। আমি আমার ভয়গুলো একটু সরিয়ে রাখতে চাই।”
এই কথায় কিছু একটা নড়ে উঠল তিশার ভেতরে। হয়তো অনেকদিনের পর এমন কথা কেউ বলল, যেটা কোনো প্রেমের কবিতা নয়, কিন্তু তার থেকেও বেশি।
বাইরে তখন হালকা বৃষ্টি পড়ছে। কাচের গায়ে জল গড়িয়ে পড়ছে, তার ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে আলোগুলো অস্পষ্ট।
শৈলী বলল, “আমি তো সবসময় ভেবেছি, ভালোবাসা মানে এক ছকে বাঁধা সম্পর্ক। কিন্তু এখন বুঝি, কখনও কখনও সেটা কফির কাপ ভাগ করে নেওয়ার চেয়েও গভীর হতে পারে।”
তিশা কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলল, “তুমি কথা ভালো বলো।”
“তুমি চুপ ভালো থাকো। তবুও আমি বুঝে যাই তুমি কী ভাবো।”
শৈলী তাকাল তিশার দিকে। তিশার চোখ তখন জানালার বাইরে, অথচ তার চোখে দেখা যাচ্ছিল শৈলীর প্রতিবিম্ব।
“আজকের বিকেলটা মনে থাকবে, তিশা?”
“হয়তো অনেকদিন পর আমি এই বিকেলটা খুঁজব, শুধু তোমার জন্য,” বলল তিশা ধীরে।
শৈলী একটু হাসল। “আজ তাহলে একটা গল্পের শুরু হল?”
তিশা বলল, “হতে পারে, অথবা হতে পারে একটা ভুল বোঝারও। কিন্তু যেটাই হোক, তাতে কিছু যায় আসে না। কারণ, এখন এই মূহূর্তটা সত্যি।”
বাইরে বৃষ্টি বেড়ে গেল। দুজনেই ছাতা ছাড়াই বেরিয়ে পড়ল। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হাত ছোঁয়াচ্ছিল হালকা করে, যেন না ছোঁওয়ারই মতো করে।
তবে মন বুঝে গিয়েছিল, এই গল্পটা এখন আর শুধুই গল্প নয়। এটা তাদের গল্প।
পর্ব ২
গড়িয়াহাট থেকে রাসবিহারী পর্যন্ত হাঁটতে হাঁটতেই তিশা আর শৈলীর কথাবার্তা থামছিল না। মাঝে মাঝে তারা থামছিল ট্র্যাফিক সিগন্যালে, কখনও পাঁপড়ির দোকানে, কখনও আবার শুধু কোনও ভাঙা ফুটপাথে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিকে দেখতে।
তিশার মনে হচ্ছিল, এই হাঁটা, এই মুহূর্তগুলো—সবকিছু যেন ঠিক জায়গায় বসছে। শহরটা তখন ভিজছে, ভিজছে তাদের কাঁধ, চুল, হাত। তবু দুজনেই যেন কোনও কিছুতে বিরক্ত নয়।
“তুমি ছাতা আনো না?” শৈলী জিজ্ঞেস করল।
“ছাতা আনলে বৃষ্টির গন্ধটা কমে যায়। আমি বরং ভিজে যাই,” তিশা হাসল।
শৈলী বলল, “তুমি এই শহরের অদ্ভুত কবি।”
তিশা উত্তর দিল না। শুধু তাকিয়ে রইল শৈলীর চোখে। ওই চোখের মধ্যে মিশে আছে ক্লান্তি, বাস্তব, এবং একটা না বলা দীর্ঘশ্বাস।
“তুমি কেমন করে এতটা নির্ভরতা তৈরি করো?” শৈলী হঠাৎ বলল।
“আমি তো কিছুই করিনি,” তিশা বলল, “তুমি শুধু জায়গা খুঁজছিলে। আমি হয়তো একটা ফাঁকা বেঞ্চ, বা একটা চুপচাপ জানালা।”
শৈলী কিছু বলল না। তাদের হাঁটা থেমে গিয়েছিল তখন। দাঁড়িয়ে ছিল একটা বাস স্টপের পাশে। একটা খালি বেঞ্চ, পেছনে পুরনো পোস্টার, আর চারপাশে ভিজে কুয়াশার গন্ধ।
শৈলী বসে পড়ল। তিশাও পাশে। একটু সময় কাটল।
“তোমার কি কখনও মনে হয়… মানে, তুমি কি কখনও ভেবেছো যে তোমার কাউকে ভালো লাগছে, যাকে হয়তো ভালোবাসা উচিত নয়?”
তিশার গলা নিচু হয়ে এল। “তোমার কী মনে হয়, ভালোবাসার জন্য কোনও নিয়ম থাকে?”
শৈলী হাসল, কিন্তু সে হাসিতে ছিল কাঁপন। “আমার মা আজও বিশ্বাস করে, বিয়ের জন্য পাত্র-পাত্রী খুঁজতে হবে জাত, বর্ণ, আয় দেখে। অথচ আমি…”
“তুমি কাকে দেখো?” তিশা জিজ্ঞেস করল আস্তে।
“আমি দেখতে থাকি চোখের দিকে। আর আমি তোমার চোখের মধ্যে নিজের একটুকু খুঁজে পাই।”
এই কথাটার পর আর কোনও শব্দ হয়নি। রাস্তার গাড়ির আওয়াজ, বৃষ্টির ফোঁটা, ট্রাফিক লাইটের রং—সবকিছু যেন একটু স্তব্ধ হয়ে গেল।
তিশা ধীরে ধীরে বলল, “তুমি কি ভয় পাও?”
“হ্যাঁ,” শৈলী বলল। “তোমার কাছে না, কিন্তু আমার নিজের কাছে। আমি ভয় পাই আমি কে, আর আমার চেনা পৃথিবীটা যদি সেটা না মানে?”
তিশা শৈলীর হাত ধরল। খুব জোরে নয়, কিন্তু এমনভাবে, যেন বলে, তুমি একা নও।
“তোমার সঙ্গে থাকতে হলে কী করতে হবে আমাকে?” শৈলী প্রশ্ন করল।
“আমার পাশে থাকতে হবে, যেমন আজ আছো। বাকি সব ঠিক হয়ে যাবে,” বলল তিশা।
“তুমি কি কখনও কারও সঙ্গে ছিলে, এরকমভাবে?”
তিশা একটু চুপ করে থেকে বলল, “হ্যাঁ, একবার। কলেজে পড়ার সময়। কিন্তু তখন সমাজ, পরিবার—সব কিছু মিলে আমাকে বোঝাল, এটা ঠিক নয়। তাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু মন তো কখনও ছাড়ে না, তাই?”
শৈলী বলল, “আমি কাউকে কখনও এমনভাবে ছুঁইনি, যেমন এখন তোমাকে ছুঁই। অথচ ভয় হয়—এটা যদি ভুল হয়?”
“ভালোবাসা কখনও ভুল হতে পারে না,” তিশা বলল, দৃঢ় গলায়। “যদি সেটা কারও ক্ষতি না করে, যদি সেটা কারও জীবন কেড়ে না নেয়, তাহলে সেটাই তো জীবনের সবচেয়ে সত্যি অনুভব।”
একটা বাস এসে থামল। দরজা খুলে গেল, শীতল আলো পড়ল দুই মুখের ওপর। তিশা বলল, “তুমি যদি যাও, যেতে পারো।”
শৈলী তাকিয়ে রইল তিশার দিকে। তারপর বলল, “তুমি কি চাইছো আমি যাই?”
তিশা হেসে বলল, “আমি চাই তুমি থাকো। কিন্তু তবুও বলব, তুমি যদি যাও, আমিও বুঝব।”
বাস আবার চলতে শুরু করল, কিন্তু শৈলী উঠল না। তার কাঁধে হাত রাখল তিশা। তারপর দুজনেই হেঁটে চলল আরেকটু সামনে।
“আমি জানি না ভবিষ্যৎ কী হবে,” শৈলী বলল। “কিন্তু আমি চাই, অন্তত আজকের রাতটা… শুধু আমাদের হোক।”
তিশা ধীরে মাথা নেড়ে বলল, “চল, আমাদের বিকেলটাকে রাত করে তুলি।”
তারা চলতে লাগল—শহরের বুক চিরে, ভেজা রাস্তায়, কিছু অসমাপ্ত প্রশ্ন আর সদ্য জন্ম নেওয়া সাহস নিয়ে।
পর্ব ৩
বৃষ্টিতে ভিজে তিশা আর শৈলী পৌঁছেছিল তিশার সাউথ কলকাতার ফ্ল্যাটে—দোতলার পুরনো বাড়ি, জানালায় লোহার গ্রিল, বারান্দায় শুকোতে রাখা পুরনো সালোয়ার-কামিজ আর কিছু শুকনো ফুলগাছ।
“তোমার বাড়ি যেন একটা সিনেমার সেট,” শৈলী বলল, ভেতরে ঢুকে গায়ের জল মুছতে মুছতে।
“আর তুমি আমার অতিথি নও, ঠিক যেন পুরনো কোনো গল্পের ফিরে আসা,” তিশা বলল, মুচকি হেসে।
ঘরের ভেতর আলোর স্যাঁতসেঁতে হলুদ ছায়া। একটা ল্যাম্প, পুরনো কাঠের বুকশেলফ, আর খাটের ওপরে ছড়ানো কিছু কাপড় আর ডায়েরি।
শৈলী তাকিয়ে বলল, “তুমি তো গুছিয়ে রাখো না একদম!”
“ভালোবাসা যেমন, ঠিক তেমনই ঘর—অগোছালো, অথচ তাতে একটা স্বস্তি থাকে,” তিশা হেসে উত্তর দিল।
শৈলী বসে পড়ল খাটে। চুলের ফোঁটাগুলো কাঁধ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে, শাড়ির আঁচলে জলছাপ।
তিশা ওর দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর একটা তোয়ালে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এই নাও, সর্দি লেগে যাবে।”
“তুমি এত যত্ন করো কেন?”
“কারণ, কেউ একদিন আমারও করেছিল। কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি। এখন শুধু শেখার চেষ্টা করি—কাউকে যদি ভালোবাসি, তাকে যেন বুঝিয়ে বলতে পারি।”
শৈলী জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বাইরে বৃষ্টি আর অন্ধকারে শহরের আলো চোখে ঝাপসা দেখাচ্ছে। দূরের কুকুরের ডাক, বৃষ্টির ছাদে পড়া আওয়াজ—সব কিছু মিলিয়ে যেন কোনও এক অন্তরঙ্গ মিউজিক বাজছে ঘরের মধ্যে।
“তুমি কি চাইছো আমি আজ এখানে থাকি?”
তিশা একটু থেমে বলল, “তুমি কি চাইছো থাকো?”
“আমি চাই, কিন্তু ভয় পাই—এই রাতটা যদি কাল ভুল বলে মনে হয়?”
“ভুল যদি হয়েও থাকে, অন্তত এই রাতটা সত্যি হবে।”
তিশা একটা গরম চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিল শৈলীর দিকে। তারা একসাথে বসে জানালার পাশে, দুই কাপ চায়ের ভাপ আর নীরবতার গন্ধে।
“তোমার প্রথম ভালোবাসা কেমন ছিল?”
তিশা একটু চুপ করে বলল, “অনেক চিঠি, অনেক ভয়, অনেক লুকিয়ে দেখা। কিন্তু একসময় মনে হয়েছিল, হয়তো জীবন এগোবে না এসব নিয়ে। তাই চুপ করে দিয়েছিলাম। সে আজ বিয়েও করে ফেলেছে। আর আমি… রয়ে গেছি নিজের গন্ধে।”
“তুমি একা থাকো?”
“না, আমি নিজের সঙ্গে থাকি। আর মাঝে মাঝে কেউ এসে বসে পাশে। কেউ দীর্ঘদিন থাকে না। কিন্তু তুমি আজ একটু বেশিদিন থেকে গেলে, মন্দ হবে না,” বলল তিশা।
শৈলী ধীরে হাত রাখল তিশার হাতের ওপরে। কিছুই বলেনি। শুধু তিশার দিকে তাকিয়ে রইল—যেন চোখ দিয়েই বলছে, আমিও থাকব। শুধু আজ নয়, যতদিন তুমি থাকতে দাও।
তিশার চোখে জল জমে উঠল।
“আমি সাহসী নই, শৈলী। আমি শুধু অভিনয় করি। ভিতরে ভিতরে আমি ভীষণ ভাঙা।”
“ভাঙা জিনিসই তো সবচেয়ে সুন্দর হয়। কারণ ওতে আলো ঢোকে,” বলল শৈলী ধীরে।
রাত তখন গভীর। তারা একে অপরের পাশে বসে ছিল, কোনও চুম্বন নয়, কোনও উচ্চারণ নয়—শুধু নিঃশ্বাসের ভিতর দিয়ে একে অপরের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল।
মেঘলা ঘরের অন্ধকারে, হয়তো কোনও অভিমানের গল্প শুরু হচ্ছিল। আবার হয়তো কোনও নতুন বিশ্বাস জন্ম নিচ্ছিল।
বাইরে তখনও বৃষ্টি। কিন্তু ঘরের ভেতরে, প্রথমবারের মতো, তারা খুঁজে পাচ্ছিল আলো।
পর্ব ৪
সকালের আলো জানালার ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকছে, দেয়ালের ওপর পড়া আলো-ছায়ার খেলা দেখে মনে হচ্ছে কেউ বুঝি রং তুলিতে আঁকছে কোনও স্বপ্নের ছবি। শৈলী ঘুম ভাঙার আগেও সেই আলোটা অনুভব করছিল, চোখ খুলে দেখল পাশে তিশা নেই, শুধু বিছানার চাদরে একটু ভাঁজ আর গায়ে রয়ে যাওয়া তিশার গন্ধ।
সে উঠে পড়ল। চুল এলোমেলো, চোখে ঘুমের ধোঁয়া। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই দেখতে পেল, তিশা দাঁড়িয়ে আছে লোহার রেলিং ধরে, এক হাতে কফির কাপ, আর অন্য হাতে ছোট্ট একটা ক্যামেরা।
“ভোর বেলা ছবিও তোলো?”
তিশা ঘুরে তাকাল, হেসে বলল, “আলো যখন এমন কোমল, তখন ক্যামেরা না ধরলে পাপ হয়।”
শৈলী পাশে এসে দাঁড়াল। তিশা তার দিকে একটা কাপ বাড়িয়ে দিল।
“ভেবেছিলাম তুমি চলে যাবে চুপচাপ,” বলল তিশা।
“সেই সাহস আমার নেই। আর হয়তো ইচ্ছেও নেই আর,” বলল শৈলী।
তিশার চোখে প্রশান্তি। “থাকলে ভালো লাগে,” সে বলল।
হঠাৎ পেছন থেকে এক নারীকণ্ঠ, “তিশা! দরজায় কারা যেন ডেকেছিল। কেউ এসেছে বুঝি?”
তিশা হেসে বলল, “আমার বাড়িওয়ালি। উনি জানেন না আমি কে কার সঙ্গে থাকি। একটু সাবধানে চলতে হয়।”
শৈলী বুঝে ফেলল, দেয়ালের ওপাশে শুধু শব্দ নয়, আছে হাজারটা না বলা প্রশ্ন।
তিশা দরজাটা খুলে ফিসফিস করে বলল, “তুমি যদি আরেকটু থাকো, তোমায় হয়তো আমার রুমমেট বলে চালিয়ে দিতে পারি।”
শৈলী হেসে ফেলল। “আচ্ছা, চালিয়ে দাও না। আমার তাতে আপত্তি নেই।”
তারা আবার ঘরে ঢুকল। সকালের নরম আলোয় তাদের মধ্যে কোনও আড়াল ছিল না। বিছানার চাদর ঠিক করতে করতে শৈলী হঠাৎ বলল, “তুমি কি চাইবে আমি আরও কিছুদিন এখানে থাকি?”
তিশা একটু থেমে বলল, “তুমি যদি মনে করো, এই দেয়ালের ভেতর তুমি নিঃশ্বাস নিতে পারবে, তবে আমি চাই তুমি থাকো।”
শৈলী তার দিকে এগিয়ে এসে বলল, “আমি চিরদিন ঘর সাজিয়ে থেকেছি। আজ প্রথমবার মনে হচ্ছে, কারও ঘরে নিজেকে খুঁজে পাচ্ছি।”
তিশা কিছু বলল না। শুধু দু’হাতে ওর গাল ছুঁয়ে বলল, “আমি ভয় পাই, এই শহর, এই সমাজ, এই নিয়মগুলো—সব কিছু যেন আমাদের গিলে ফেলতে চায়।”
“তবে না হয় আমরা একে অপরের ঘর হয়ে থাকি। বাইরে যত কিছুই হোক, ভেতরে যেন আমরা ঠিক থাকি,” বলল শৈলী।
বাইরের বাড়িওয়ালির পায়ের শব্দ, পাশের ফ্ল্যাটে প্রেশার কুকারের হুইসেল, একটা বাচ্চার কান্না—সব মিলিয়ে যেন এক শহরের বাস্তবতা তাড়া করে ফিরছিল।
কিন্তু এই ঘরের মধ্যে, একটা শান্ত কোলাহল জন্ম নিচ্ছিল—যেখানে ভালোবাসা শব্দে নয়, নীরবতায় প্রকাশ পায়।
“তোমার পছন্দের গান কী?” শৈলী হঠাৎ জিজ্ঞেস করল।
“‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ও গো বিদেশিনী।’ কেন জানি না, নিজেকে মাঝেমধ্যে ওই বিদেশিনী বলেই মনে হয়,” তিশা হাসল।
“তোমার সঙ্গে থাকলে আমিও সেই বিদেশে ঘুরে বেড়াতে চাই,” বলল শৈলী।
সেদিনের সকালের আলোটা ছিল একান্ত, যেন শহরের ব্যস্ততা তাদের ছুঁতে পারেনি। কিন্তু তারা জানত, এভাবে চিরকাল চলবে না। দেয়ালের ওপাশে শুধু শব্দ নয়, আছে গুঞ্জন, প্রশ্ন, সমাজের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।
তবু তারা ঠিক করল, যতক্ষণ সম্ভব, তারা নিজেদের গল্পটা বাঁচিয়ে রাখবে। কারণ সব ভালোবাসা হয়তো ঘোষণা করা যায় না, কিন্তু চুপিচুপি বাঁচিয়ে রাখা যায়।
পর্ব ৫
রবিবার দুপুর। শহর তখন অদ্ভুত রকমের নিস্তব্ধ। গলির মাথার চায়ের দোকান বন্ধ, পাশের বাড়ির জানালাগুলো আধখোলা, আর রাস্তায় মাঝে মাঝে ভেসে আসছে কোনও দূরবর্তী ট্রামের ঘন্টাধ্বনি।
তিশা আর শৈলী সেই নিস্তব্ধ দুপুরে পাশাপাশি বসে ছিল বারান্দায়। একটা পাতলা চাদর পা অবধি টেনে রেখেছে তারা। টেবিলের ওপর রাখা দুটো মাটির কুলহড়ে আমপানা, আর একপাশে খোলা একটা বই—অরুন্ধতী রায়ের The Ministry of Utmost Happiness।
“এই বইটা আমি প্রথমবার পড়তে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিলাম,” বলল তিশা।
“কোন অংশে?” জিজ্ঞেস করল শৈলী।
“যেখানে অনুগ্রহণ বলছে—‘কেউ কাউকে একা ফেলে যেতে চায় না, কিন্তু কেউ কারো হয়ে থাকতে পারেও না’—সেই জায়গাটা। সেটা আমি আজও ভুলতে পারি না।”
শৈলী বইটা বন্ধ করে বলল, “তুমি আমার হয়ে থাকতে পারবে?”
তিশা তাকাল শৈলীর দিকে। ওর চোখে কোনও নাটকীয়তা ছিল না, ছিল শুধু একখানি নরম সত্য—যেটা প্রশ্নের চেয়ে জবাব অনেক বেশি দাবি করে।
“আমি চেষ্টা করব,” বলল তিশা। “প্রতিদিন, যতটুকু পারি। কিন্তু হ্যাঁ, আমিও মানুষ, আমারও ভাঙা যায়, আমিও ক্লান্ত হই।”
শৈলী হেসে বলল, “তুমি ক্লান্ত হলে, আমি তোমার হয়ে থাকব। আমরা পালা করে পারব, তাই না?”
তারা একে অপরের কাঁধে মাথা রেখে বসে থাকল কিছুক্ষণ। বাইরের গাছে কোকিল ডাকছে। একটা ছায়া ঘরের মেঝেতে এগিয়ে এসে সরে যাচ্ছে—সময়ের মতো, জীবনের মতো।
“আজ দুপুরে আমার বাড়ি থেকে ফোন এসেছিল,” বলল শৈলী।
“কি বলল?” তিশা একটু সরে এসে প্রশ্ন করল।
“মা জিজ্ঞেস করছিল, আমি কেন এতদিন ধরে বিষণ্ণ। ওদের মনে হচ্ছে, আমি কিছু লুকোচ্ছি।”
“তুমি কি বলেছো কিছু?”
“না। কী বলব? কীভাবে বলব? বললেই কি ওরা বুঝবে?”
তিশা গভীরভাবে তাকাল শৈলীর দিকে। তারপর বলল, “তুমি যখন প্রস্তুত হবে, তখন বলবে। কাউকে বোঝানোর দায়িত্ব তোমার নয়। কিন্তু নিজের সত্যটা বাঁচিয়ে রাখাটা জরুরি।”
“আমার ভয় হয়, মা যদি জানতে পারে আমি একজন মেয়েকে ভালোবাসি…”
তিশা হাত ধরল শৈলীর। “তোমার ভয় আমি বুঝি। আমারও হয়েছিল একসময়।”
“তোমার বাবা-মা জানে?”
“জানে না। আমি জানাতে পারিনি। এখন আর সাহস হয় না। তবে আমার বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ জানে, আর ওরাই আমার পরিবার হয়ে উঠেছে।”
শৈলী চোখ নামিয়ে বলল, “আমি জানি না, কতটা এগোতে পারব এই সম্পর্ক নিয়ে। তবু… তোমার পাশে থাকতে চাই।”
“তোমার থাকা-টাই যথেষ্ট,” বলল তিশা।
একটা থালা থেকে আমচূর্ণ তুলে মুখে দিল শৈলী। “তুমি রান্না করো ভালো?”
“ভালো বলতে যা বোঝায় না। তবে চেষ্টা করি। ভালোবাসার মতোই—প্রতিবার একটু একটু করে শেখা।”
শৈলী হেসে ফেলল। “তুমি যদি একদিন আমার সঙ্গে থেকো, আমি তোমাকে রান্না শিখিয়ে দেব। আর তুমি আমাকে শেখাবে কীভাবে একটা ছবি তোলা যায় এমনভাবে, যাতে দেখা না গেলেও মন বোঝা যায়।”
তিশা মাথা নাড়ল, “ডিল।”
দুপুরটা ততক্ষণে নরম হয়ে এসেছে। আলো আর ছায়ার ফাঁকে, তারা নিজেদের জীবনের গল্পটাকে ঘোষণা ছাড়াই লিখে ফেলছিল—একটা ঘোষণা ছাড়াই শুরু হওয়া সম্পর্ক, একরকম সখ্য, একরকম ভরসা।
বাইরে তখন হালকা বাতাস বইছে। কোথাও কোনও শব্দ নেই, শুধু দুটি মানুষের নিঃশ্বাসের ভেতরে শব্দ হয়ে গুনগুন করে উঠছে ভালোবাসার গান।
পর্ব ৬
তিশা ঘরের পুরনো ট্রাঙ্ক খুলে বের করল একটা ছোট্ট কাঠের বাক্স। ভিতরে কিছু চিঠি, ধূলো জমা পোষ্টকার্ড, কিছু রঙিন টিকেট—ট্রাম, মেট্রো, কিংবা পুরনো সিনেমার। সবকিছুর গায়ে সময়ের গন্ধ, স্মৃতির ধুলো, আর অজানা এক নিঃশব্দ আর্তি।
“তুমি এখনো চিঠি লেখো?” শৈলী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ, যদিও পাঠাই না। কিছু লেখা থাকে শুধু নিজের জন্য,” তিশা বলল।
“মানে?”
“মানে, অনেক কিছু বলা যায় না মুখে। তাই লিখে ফেলি। আর যদি কেউ কখনও পড়ে ফেলে, তবে সেটা তার পাওয়ার কথা ছিল।”
শৈলী ধীরে ধীরে একটা চিঠি তুলে নিল। পুরনো হলুদ খামে লেখা—‘যদি কখনও ফিরে আসো’।
“পড়তে পারি?”
তিশা একটু থমকে গেল। তারপর মাথা নাড়িয়ে বলল, “পারো। আজ পারো।”
শৈলী চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করল—
“তুমি চলে যাওয়ার পর অনেকদিন আমি ভাবতাম, যদি একটা সুযোগ পেতাম আবার বলার—আমি ভালোবাসি।
আমি জানতাম না এটা অন্যরকম ভালোবাসা, সমাজ না মানা ভালোবাসা, চোখ লুকিয়ে ভালোবাসা। শুধু জানতাম, তুই চোখ মেলে তাকালে আমি ভেতর থেকে নড়ে উঠতাম।
তোকে আমি দোষ দিই না। তুই ভয় পেয়েছিলি, আমিও পেয়েছিলাম।
কিন্তু তোকে হারিয়ে আমি শিখেছি—ভালোবাসা শব্দে আটকে থাকে না, সে রয়ে যায় চোখে, ছোঁয়ায়, নিঃশ্বাসে।
যদি কখনও ফিরে আসিস, জানিস, আমি এখনও তোর জন্য একটা জানালা খুলে রেখেছি।”
চিঠিটা পড়ে শৈলী একটু চুপ করে রইল। তার চোখে জল জমে উঠেছে, কিন্তু সে মুখ ফিরিয়ে নিল।
“তুমি কী করে এতটা নিঃশব্দে অনুভব ধরে রাখতে পারো?”
“কারণ আমি জানি, কেউ তো আছেই, যে একদিন অনুভব পড়বে। আর এখন, তুমি তো আছো,” বলল তিশা।
শৈলী চিঠিটা বুকের কাছে টেনে ধরল। “আমি তোকে হারাতে চাই না, তিশা।”
“তাহলে হারিয়ে যাস না,” বলল তিশা নরম গলায়।
শৈলী একটু চুপ করে রইল, তারপর বলল, “আমিও একটা চিঠি লিখেছিলাম একসময়। কিন্তু কাউকে দেখাইনি। আজ তোমায় দেখাতে ইচ্ছে করছে।”
সে ব্যাগ থেকে একটা ছেঁড়া ডায়েরি পাতা বের করল। পৃষ্ঠার কোণাগুলো ভাঁজ, কলমের কালি ফ্যাকাশে।
“প্রিয় তুমি,
আমি জানি না, তুমি কে। হয়তো তুমি এখনো আমার জীবনে আসোনি, অথবা এসেছ, আমি চিনিনি।
কিন্তু আমি প্রতিদিন অপেক্ষা করি সেই চোখের, যেটা আমার মুখের কথা না শুনেও বুঝে যাবে আমি কী বলছি।
আমি চাই, তুমি আমার ভয়গুলোকে বলো—তুমি পাশে আছো। আমি চাই, তুমি আমায় এমনভাবে ছুঁও, যেন কিছুই বলতে না হয়।
যদি তুমি আমাকে খুঁজে পাও, আমায় জানিও। আমি এখানেই থাকব, অপেক্ষায়।”
তিশা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল পাতাটার দিকে। তারপর বলল, “তুমি জানো, আমি অনেকদিন পর এমন কাউকে পেয়েছি, যার জন্য এই বাক্স খোলা যায়।”
“তাহলে বাক্সটা এখন থেকে আমাদের দু’জনের,” বলল শৈলী।
তারা চুপচাপ বসে রইল চিঠির মাঝে, অতীত আর বর্তমানের মেলবন্ধনে। শহরের ভেতর, একটা ঘরে, দুটো মেয়ে—নিজেদের হারানো চিঠি থেকে নতুন গল্প গড়তে শুরু করল।
চিঠিগুলো এখন আর লুকোনো থাকল না। বরং, ওগুলো হয়ে উঠল প্রেমের একেকটা স্তর—যার কোনও ঘটা করে ঘোষণা নেই, কিন্তু গভীরে গেঁথে যায় চিরকালের মতো।
পর্ব ৭
সন্ধে নামার ঠিক আগে, যখন জানালার ফাঁক দিয়ে আসা আলোটা সোনালি থেকে ধূসর হয়ে যেতে থাকে, তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখাটা অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে।
শৈলী দাঁড়িয়ে ছিল আয়নার সামনে। ওর চোখে kajal, ঠোঁটে হালকা লিপবাম, গলায় একটা সাদামাটা সিলভার চেইন। চুল বেঁধে ফেলেছে লুজ বানের মতো করে। দেখে মনে হচ্ছিল, যেন কোনও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগের প্রস্তুতি চলছে।
তিশা পেছন থেকে এসে বলল, “তুমি আয়নার দিকে এতক্ষণ তাকিয়ে আছো কেন?”
“নিজেকে দেখছিলাম। ভাবছিলাম, এই মুখটা যদি আমি আমার মাকে দেখাই, সে চিনতে পারবে তো?”
তিশা একটু থেমে বলল, “তুমি কি বলতে চাও, আজ তুমি বলবে ওনাকে?”
শৈলী মাথা নাড়ল। “না। আজ না। কিন্তু আজ একটা rehearsel করতে চাই—নিজের সঙ্গে, আয়নার সঙ্গে। যেন যেদিন সত্যিই বলব, ভয়টা একটু কম লাগে।”
“তুমি জানো, ভয় পেলে আমার কাঁধ আছে। আর আয়নার ওই চোখের পাশে আরেকজোড়া চোখ, যারা শুধু দেখবে না, বুঝবেও,” তিশা বলল।
শৈলী আয়নার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কি ভাবো, আমাদের এই সম্পর্কটা শুধু আমাদের মধ্যে থাকবে?”
তিশা একটু চুপ করে বলল, “আমি চাই এটা বাঁচুক। সমাজ জানুক বা না জানুক, আমরা যেন একে মর্যাদা দিতে পারি। কিন্তু হ্যাঁ, আমাদের গল্পটা সবার গল্পের মতো নয়। তাই এর ভারও আলাদা।”
“আমার ভয় হয়, আমি কি পারব এই ভার বইতে?”
তিশা ওর কাঁধে হাত রাখল। “তুমি একা বইবে না। আমরা দু’জনে মিলেই এগোব।”
একটা ঘড়ির শব্দ কানে এল—টিক টিক করে সময় এগোচ্ছে। হঠাৎ করেই সময়টা ভারি হয়ে উঠল।
শৈলী বলল, “আমার মায়ের সঙ্গে আজ একটু বেশি কথা হয়েছে। উনি বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন, আমার বন্ধুবান্ধবের মধ্যে কেউ কি ‘বিশেষ’ আছে?”
“তুমি কী বললে?”
“বললাম, আছে। কিন্তু বলিনি, সে একটা মেয়ে। শুধু বললাম, তার চোখে আমি নিজেকে খুঁজে পাই।”
তিশা হাসল। “এটাও তো একটা সাহস।”
“তুমি কি কখনও নিজেকে আড়াল করেছো খুব কাছের কারো থেকে?”
তিশা ধীরে বলল, “হ্যাঁ। আমার নিজের কাছ থেকেই সবচেয়ে বেশি। অনেক সময় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে চিনতেই পারিনি। মুখটা আমার ছিল, কিন্তু চোখে থাকত সমাজ, ভয়, প্রত্যাখ্যান। এখন একটু একটু করে আমি নিজের মুখ ফিরে পাচ্ছি—তোমার চোখ দিয়ে।”
এই কথায় শৈলী হঠাৎ তিশার মুখটা দু’হাতে ধরে আয়নার সামনে দাঁড় করাল।
“দেখো, এই তুমি। পুরোপুরি তুমি। সাহস, ভালোবাসা আর আলোয় ভরা তুমি।”
তিশা হাসল না, কাঁদলও না—শুধু আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকল। আর আয়নার প্রতিবিম্বে সেই প্রথম, ও নিজেকে সম্পূর্ণ মনে হল।
“চলো, আজ একটা ছবি তুলি,” শৈলী বলল।
“কেন?”
“কারণ, আজকের দিনটা আমাদের গল্পে থাকবে। না ইনস্টাগ্রামে, না ফেসবুকে। শুধু আমাদের ছোট্ট বাক্সে—লুকোনো চিঠির পাশে।”
তারা দাঁড়াল জানালার কাছে। ক্যামেরার সেলফ-টাইমার সেট করে তিশা তাড়াতাড়ি এসে দাঁড়াল শৈলীর পাশে। ঘাড়ে মাথা রেখে দুজনেই ক্যামেরার দিকে তাকাল না—তারা তাকিয়ে ছিল পরস্পরের চোখে।
ক্লিক।
ছবিটা তোলা হয়ে গেল। ফ্রেমে রয়ে গেল এক জোড়া নিঃশব্দ প্রতিজ্ঞা, একরাশ ভরসা, আর এমন এক প্রেম, যা আয়নার প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে জানে—ভয়ে না কুঁকিয়ে, বরং মাথা উঁচু করে।
পর্ব ৮
দেড় মাস কেটে গেছে। দিনগুলো কেমন যেন ছাপ ফেলেনি ক্যালেন্ডারের পাতায়, অথচ তিশা আর শৈলীর জীবনে প্রতিটা মুহূর্ত যেন একেকটা অধ্যায় হয়ে রয়ে গেছে। সকালে একসাথে উঠে চা খাওয়া, দুপুরে কাজের ফাঁকে বারান্দায় দু’দণ্ড কথা, আর রাতে গান শুনতে শুনতে একে অপরের নিঃশ্বাস গোনা—সবকিছু একধরনের চুপচাপ প্রেমের মতন।
কিন্তু আজ তারা ফিরছে সেই প্রথম জায়গায়—গড়িয়াহাটের সেই কফিশপে, যেখানে তাদের দেখা হয়েছিল একেবারে শুরুতে।
“তুমি জানো তো,” বলল শৈলী, “আমি কখনও ভাবিনি, আমি কোনওদিন এমনভাবে কাউকে ধরে রাখতে পারব।”
তিশা হেসে বলল, “তুমি তো আমায় ধরে রাখোনি, আমি নিজেই থাকতে চেয়েছি। এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”
কফিশপে সেই পুরনো টেবিলটা খালি ছিল। তারা গিয়ে বসতেই সেই পরিচিত ওয়েটার এসে হাসল। “দিদিরা তো অনেকদিন পর এলেন!”
তিশা হেসে বলল, “হ্যাঁ, এই জায়গাটা আমাদের প্রথম দৃষ্টির সাক্ষী। আবার একটু ফিরে দেখতে এলাম।”
অর্ডার চলে গেল। কফির গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
“তুমি জানো, সেই প্রথম দিন তোমার চোখে একটা অদ্ভুত কষ্ট দেখেছিলাম,” বলল শৈলী।
“তুমি তো তখনই চিনে ফেলেছিলে আমায়,” মুচকি হেসে উত্তর দিল তিশা।
“চিনেছিলাম ঠিকই, কিন্তু ভয় পেয়েছিলাম। কারণ, তোমার চোখে আমি নিজেকে দেখতে পেয়েছিলাম।”
তাদের চারপাশে শহরের কথাবার্তা, মিউজিক, মানুষের হাসি—সব চলছিল নিজের মতো করে। কিন্তু তারা যেন এক আলাদা বলয়ের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল—যেখানে শুধুই তারা ছিল।
“আমার মা এখনো জানে না,” বলল শৈলী হঠাৎ।
“চাপে আছো?”
“না। শুধু একটা অপরাধবোধ মাঝেমধ্যে আসে—যেন ওর কাছে আমি মিথ্যে বলছি। অথচ আমি জানি, এখনো বলার মতো শক্তি আমার হয়নি।”
তিশা হাত ধরল ওর। “যেদিন তুমি প্রস্তুত হবে, আমি পাশে থাকব। কিন্তু নিজেকে দোষ দিও না। আমরা সবাই আলাদা সময় নিই সত্যি মেনে নেওয়ার জন্য।”
একটু চুপচাপ সময় গেল। কফি চলে এল। তারা দু’জনে একসাথে কাপ তুলল—এই একটানা ছন্দ, যেন তারা অনেকদিন ধরে একে অপরের সঙ্গে ছিল।
“তুমি কি ভাবো, এই সম্পর্কটা বাইরে নিয়ে যাওয়া উচিত?” শৈলী জিজ্ঞেস করল।
“তুমি যদি চাও, আমরা একদিন বাইরে হাঁটতে পারি হাত ধরা অবস্থায়। না লুকিয়ে, না ভয় পেয়ে,” বলল তিশা।
“তখন যদি কেউ আমাদের দেখে?”
“তখন ওদের দেখে আমি বলব—এটাই ভালোবাসা। কোনও ব্যাখ্যা ছাড়া, কোনও অনুমতি ছাড়াই,” তিশা বলল এক নিঃশ্বাসে।
তাদের মাঝখানে তখন একটা নতুন আত্মবিশ্বাস জন্ম নিচ্ছিল। একসময় এই কফিশপেই তারা ছিল দুই অচেনা মানুষ, আজ তারা নিজেদের তৈরি সম্পর্কের ছায়ায় রোদ খুঁজে নিচ্ছে।
“আমরা কি পারব এমন করে এগিয়ে যেতে?”
“পারব,” বলল তিশা, “কারণ আমরা পিছিয়ে থাকিনি। শুধু একটু সময় নিয়েছি নিজেকে বোঝার জন্য।”
কফি শেষ হয়ে এলো। শৈলী চুপ করে বসে রইল কিছুক্ষণ, তারপর বলল, “আমাদের ভালোবাসা কি কারও থেকে কম?”
“একটুও না। বরং অনেক বেশি সত্য, কারণ এটা আমাদের ভয় পেরিয়ে আসা ভালোবাসা,” বলল তিশা।
তারপর তারা একসঙ্গে হাঁটতে শুরু করল। শহরের রাস্তায়, ট্র্যাফিকের আওয়াজে, মানুষজনের ভিড়ে—তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাঁটছিল। হাতে হাত ছিল না, কিন্তু মনে মনে জানত, এই সম্পর্ক এখন আর প্রথম দেখা নয়—এটা দ্বিতীয় দেখা, বুঝে ফেলা, আর সাহস নিয়ে এগিয়ে যাওয়া।
পর্ব ৯
কলকাতার আকাশ সকাল থেকেই কেমন অস্থির। গা-ছমছমে রোদ, মাঝেমধ্যে হাওয়া বইছে, আর কাকের ডাকটা যেনও অন্যরকম করে বাজছে কানে। শৈলী জানত, আজ কিছু একটা ঘটবে। তিশা বারবার বলেছিল, “ভয় পেয়ো না, তুমি প্রস্তুত হলে তবেই বলবে,” কিন্তু শৈলী জানত—প্রস্তুত বলেই কখনও পুরোপুরি হয় না, শুধু একটা মুহূর্ত এসে দাঁড়ায়, যেটা ঠেলে নিয়ে যায় অজানা দিকে।
আজ সেই মুহূর্ত।
সকালে শৈলী ফোন করেছিল মাকে। কথা বলার ধরনেই মা বুঝে গিয়েছিলেন, কিছু একটা হচ্ছে।
“তুই কি ঠিক আছিস?”
“হ্যাঁ, মা,” শৈলী বলেছিল, কিন্তু গলার কাঁপন ঢাকতে পারেনি।
“তোর কণ্ঠে যেন কিছু চাপা কথা শুনছি আজকাল,” মা বলেছিলেন।
আর তখনই শৈলী বলে ফেলেছিল, “মা, আমি একজনকে ভালোবাসি।”
“তাহলে তো ভালই। ছেলেটা কী করে?”
এই প্রশ্নটার জন্য শৈলী তৈরি ছিল, কিন্তু উত্তরটা বলার সময়ও ওর গলা কেঁপে গিয়েছিল।
“সে ছেলে নয়, মা। সে মেয়ে। ওর নাম তিশা।”
ওপাশে অনেকক্ষণ চুপচাপ। এতটাই চুপ যে শৈলী নিজের বুকের ধুকধুকানিও শুনতে পাচ্ছিল স্পষ্ট।
“তুই পাগল হয়েছিস?” মা বলেছিলেন অবশেষে। গলায় একটা ঝাঁজ, একটা অস্থিরতা।
“না মা, আমি অনেক ভেবে বলছি। আমি ওকে ভালোবাসি।”
“এটা পাপ শৈলী। এটা সমাজ মানবে না, পরিবার মানবে না, আমি মানতে পারব না!”
শৈলী চুপ করেছিল। ও জানত এই কথাগুলো আসবে। তবুও, শুনতে খারাপ লাগে—জন্মদাত্রী মা’র মুখে নিজের ভালোবাসাকে ‘পাপ’ বললে বুকটা কেমন ফাঁকা হয়ে যায়।
“মা, আমি তো কাউকে কষ্ট দিতে চাইনি। আমি শুধু নিজেকে ঠকাতে পারি না আর। আমি তিশাকে ছাড়া বাঁচতে পারি না।”
“তুই কী বলছিস এসব! মেয়েদের সঙ্গে এমন করে থাকা যায় না!”
“কিন্তু মা, আমি তো মেয়েই। তবুও আমার ভালোবাসার অধিকার আছে, তাই না?”
“তুই যে আমার মেয়ে, আজ মনে হচ্ছে সে সত্যি নয়।”
ফোনটা কেটে গিয়েছিল।
শৈলী স্থির বসে ছিল বাথরুমের দরজা বন্ধ করে। বাইরের ঘরে তখন তিশা নিশ্চিন্তে গান শুনছিল—অঞ্জন দত্তের “ভোরবেলা খোলা হাওয়া গায়ে মেখে ছাদে যাই…” বাজছে।
অদ্ভুত লাগছিল শৈলীর—একদিকে গান, আরেকদিকে এমন ভাঙা সংলাপ।
তিশা যখন দেখল, অনেকক্ষণ ধরে শৈলী বেরোচ্ছে না, সে দরজায় টোকা দিল।
“শৈলী? সব ঠিক তো?”
দরজা খুলল শৈলী। চোখ লাল, মুখ নিস্তেজ। তিশা তাকে দেখে কিছু জিজ্ঞেস করল না, শুধু নিজের বুকে টেনে নিল।
শৈলী কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ও আমাকে ‘অচেনা’ বলে দিল। আমি মায়ের কাছে অপরিচিত হয়ে গেলাম আজ।”
“তুমি তোমার সত্য বলেছো, সেটাই সবচেয়ে বড় সাহস। কিন্তু এখন তুমি আমার কাছে পরিচিত, চেনা, আর নিজের হয়ে ওঠা একজন মানুষ।”
“তুমি কি নিশ্চিত, আমরা ঠিক করছি?”
“না, আমি নিশ্চিত না। কিন্তু আমি এটুকু জানি, তুমি যদি হাত ছাড়ো না, তাহলে আমি বাকি সবকিছু সামলে নেব।”
বাইরে তখন মেঘ গাঢ় হয়ে এসেছে। আকাশ ভারী, পেঁজা তুলোর মতো নয়—ধরছে না, ঝরছেও না। ঠিক তেমনি একটা সম্পর্ক, যা অনেক কিছু চেপে রাখতে রাখতে একটা সময়ে নিজেকে ফাটিয়ে দেয়।
“আমি কিছুদিন একা থাকতে চাই,” বলল শৈলী হঠাৎ।
তিশা হতবাক হলেও মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক আছে। তুমি সময় নাও। কিন্তু জানবে, আমি এখানেই থাকব। একই জায়গায়। একই রকম করে।”
শৈলী শুধু বলল, “আমার ভয় হচ্ছে, আমি যদি আর না ফিরি?”
তিশা হেসে বলল, “তবে সেই প্রথম বিকেলটা আমার থাকবে। বাকিটা তোমার হাতে।”
সেদিন সন্ধেয় আকাশ ঝড় তুলল না, বৃষ্টি এল না। শুধু একটা ঘর ফাঁকা হল, আর একটা হৃদয় অপেক্ষা করতে শিখল—ভয় আর ভালোবাসার মধ্যবর্তী ভারসাম্যে।
পর্ব ১০
তিশার ঘরটা কেমন অচেনা লাগছিল আজকাল। জানালার বাইরের গাছটা, কফির কাপ, বারান্দার ছায়া—সব যেন শূন্য হয়ে গেছে। শৈলী চলে যাওয়ার পর প্রথম কয়েকদিন প্রতিটা জিনিসে ওর গন্ধ ছিল। এখন যেন গন্ধটা থেকেও নেই, মনে হয়, কোনও অনুপস্থিতি গা-ছুঁয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
তিশা নিজেকে ব্যস্ত রাখার ভান করত—ছবি তুলত, ডায়েরি লিখত, বারান্দায় চুপচাপ বসে গান শুনত। কিন্তু ভেতরের খালি জায়গাটা আর পুরোনো মতো থাকত না।
একদিন ডায়েরিতে লিখল—
“ভালোবাসা মানে শুধু থাকা নয়। ভালোবাসা মানে কাউকে মুক্তি দেওয়ার সাহস। কিন্তু তবু, কেউ ফিরে আসুক, এই কামনা যে বেঁচে থাকে, সে তো অস্বীকার করা যায় না।”
এক সন্ধেয় ফোনে অদ্ভুত একটা শব্দ পেল তিশা—একটা হঠাৎ বাজা রিং, অচেনা নাম্বার। তবুও উত্তরে শৈলীর গলা।
“আমি তোর ভাঙা কফির কাপটা মিস করি,” বলল শৈলী।
তিশা কিছুক্ষণ কিছু বলল না। শুধু কানে সেই গলাটা শুনে বুকের মধ্যে সাড়া পড়ল।
“তুই কেমন আছিস?” শৈলী জিজ্ঞেস করল।
“একটা জানালার মতো আছি, যেটার পর্দা সরানো নেই, কিন্তু আলো ঢুকছে না।”
ওপাশে নীরবতা।
“আমি মাকে বলেছি, আমি তোর কাছে ফিরতে চাই। ও কষ্ট পেয়েছে, চিৎকার করেছে, এমনকি কান্নাও। তবুও আমি এবার বলেছি—আমার ভালোবাসার কাছে আমি মিথ্যে বলতে পারব না।”
তিশা বলল, “তুই তো সেই প্রথম দিনও চেয়েছিলি, শুধু সাহসটা পায়নি। আজ তো তুই সাহস নিয়ে ফিরছিস।”
“তুই কি আমার জন্য অপেক্ষা করছিলি?”
“প্রতিটা সন্ধ্যে, প্রতিটা কফির চুমুক, আর প্রতিটা শীতল বালিশ—সব তোর অপেক্ষাতেই ছিল।”
“আমি তোর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি এখন,” বলল শৈলী।
তিশা তখনই দরজার দিকে ছুটল। খুলে দাঁড়াতেই দেখল—সামনে সেই চেনা মুখ। চোখে হালকা জল, মুখে একটুকরো ভেজা হাসি, হাতে সেই পুরোনো চিঠির বাক্স।
“আমি বুঝেছি, ভালোবাসা কোনও লুকোনো চিঠি নয়, এটা এমন কিছু যা খোলাখুলিই থাকা উচিত। তুই যদি এখনো আমায় জায়গা দিস, আমি এবার থাকব। পালাব না আর,” বলল শৈলী।
তিশা কিছু না বলে ওর হাত ধরল। দুই হাতের ভাঁজে আরেকবার জীবনের ছন্দ ফিরে এল।
ঘরের ভিতর ঢুকে ওরা একসঙ্গে বসে রইল। বারান্দার আলো এসে পড়ল মুখে, আর সেই মুহূর্তে তারা বুঝল—ফিরে আসা মানে আবার শুরু নয়, ফিরে আসা মানে এবার সত্যি করে থাকা।
পর্ব ১১
কলকাতা তখন বসন্তের শেষ ছোঁয়া। গাছে গাছে কচি পাতা, গরমটা এখনও কামড় বসায়নি। রাস্তায় প্রেমিক-প্রেমিকাদের জোড়া দেখা যায় হাতে হাত রেখে হাঁটতে, কেউ কফিশপে, কেউ বইমেলার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে।
তিশা আর শৈলী হাঁটছিল দক্ষিণ কলকাতার এক চেনা গলিতে—মধ্যে মধ্যে মোড় ঘুরছে, কিন্তু তাদের সম্পর্কটা যেন এবার আর কোনও বাঁক নিচ্ছে না, বরং সোজা এগিয়ে যাচ্ছে।
“তুই জানিস, আমি এখন আর ভয় পাই না?” বলল শৈলী হঠাৎ।
“কোন জিনিসে ভয় পেতিস?”
“লোকের চোখে, মায়ের অভিমান, নিজের ভেতরের কুয়াশা। এখন বুঝি, সবটাই অস্থায়ী। আর যে জিনিসটা স্থায়ী, সেটা তুই।”
তিশা একটু হেসে বলল, “আমি কোনও কিছুতে স্থায়ী নই, কিন্তু তোর পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে আমি চিরকাল চাইব।”
“আমরা কি এবার সত্যি করে বাঁচতে পারব? এই শহরের মধ্যে, এই নিয়মের মাঝে?”
তিশা বলল, “আমরা শহরের মতোই। বাইরে থেকে গোলমেলে, ব্যস্ত, কখনও থেমে যাওয়া, কিন্তু ভিতরে একটুকরো শান্তি খুঁজে নেওয়া।”
দুজনেই একটা পার্কের বেঞ্চে বসে পড়ল। পাশেই ছোট্ট শিশুরা দৌড়াচ্ছে, একপাশে চটের দড়িতে পটেটো চিপস বিক্রি হচ্ছে। এই জীবন, এই শহর—সবকিছু নতুন লাগছিল।
“তুই এখন কি চাস আমাদের সম্পর্কটা নিয়ে?”
শৈলী মাথা গুঁজে বলল, “একটা ঠিকানা। মানে, কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, ‘তুই কোথায় থাকিস?’ আমি যেন বলতে পারি—তিশার পাশে।”
তিশা বলল, “ঠিকানা শুধু বাড়ির নাম্বার নয়। ঠিকানা মানে যার কাছে ফিরে যাওয়া যায়, নির্বাক হয়ে, ভেঙে পড়ে, অথবা চুপচাপ থেকে। আমি তোর সেই ঠিকানা হতে চাই।”
“তুই কি আমার মাকে আবার দেখতে পারবি কোনওদিন?”
“হ্যাঁ, যদি তুই আমার পাশে দাঁড়াস। ও যদি বুঝতে চায়, আমি বলব—তোর মেয়েকে আমি ভালোবাসি। কোনও লুকোছাপা নয়, কোনও লজ্জা নয়।”
তারা উঠল। হেঁটে চলল সাউথ সিটির পাশ দিয়ে, নিউমার্কেট ঘুরে, কফি হাউসের কাছাকাছি। শহরের প্রতিটা কোণ যেন তাদের চেনে।
“তুই জানিস, আমরা যে কফিশপে প্রথম দেখা করেছিলাম, ওখানে এখন রেনোভেশন চলছে,” বলল তিশা।
“তাহলে ঠিকই তো,” শৈলী হেসে বলল, “আমাদের প্রথম দেখা জায়গাটাও এবার নতুন হচ্ছে। যেমন আমাদের সম্পর্কটা নতুন করে তৈরি হচ্ছে।”
তারা চলতে চলতে একটা দেয়ালে চোখ পড়ল। সেখানে লেখা—
“Love is love. কেউ চুরি করে না। শুধু সাহস করে।”
তারা দাঁড়িয়ে গেল। শৈলী বলল, “এই শহরটা কি আমাদের ভালোবাসবে?”
তিশা বলল, “তুই ভালোবাসিস তো? তাহলে শহরটা আমরা হয়ে উঠব একদিন।”
হাত ধরল ওরা। এবার আর আড়াল নয়, এবার প্রকাশ।
এই শহর, এই প্রেম—সবটাই সত্যি।
পর্ব ১২
আকাশ হালকা ছাইরঙা, বাতাসে গরম আর আর্দ্রতার মিশেল—কলকাতার জুন মাস এমনই। বিকেলটা ধীরে ধীরে নামছে, যেন কাঁধে রাখা একটা পুরনো ব্যাগের ওজন নামিয়ে রাখা হচ্ছে।
তিশা আর শৈলী আজ আবার ফিরেছে সেই প্রথম কফিশপে। রেনোভেশন হয়ে গেছে, নতুন কাঠের টেবিল, আলোর রঙ বদলেছে, দেয়ালে আরও কিছু ছবি টাঙানো হয়েছে। কিন্তু ভেতরের সেই নির্জনতাটা ঠিক রয়ে গেছে—যেখানে একজন আরেকজনের দিকে তাকালে বাইরের সব শব্দ হারিয়ে যায়।
ওরা আজ এখানে এসেছে একটা চিঠি রাখতে।
না, কাউকে পাঠানোর জন্য নয়।
না, কাগজে লেখা কিছু লুকিয়ে রাখার জন্যও নয়।
আজ তারা একটা চিঠি লিখেছে একসাথে। তাদের দুজনের নামে। তাদের সময়ের নামে।
তিশা বলল, “তুই লিখবি, নাকি আমি?”
“তুই শুরু কর। তোকে দিয়েই তো শুরু হয়েছিল,” হাসল শৈলী।
তিশা কলম তুলে লিখতে লাগল—
“এই চিঠি তাদের জন্য, যারা কোনও এক ভিজে বিকেলে কাউকে দেখেছিল একটু বেশিক্ষণ।
যারা জানত না, ভালোবাসা কোনও ছকের মধ্যে ফেলা যায় না।
যারা প্রথমবার কারও চোখে নিজেকে খুঁজে পেয়েছিল।
যারা ভয় পেয়েছিল, তবু সেই ভয়কে হাত ধরে এগিয়েছিল।
এই চিঠি তাদের জন্য, যারা বলতেও ভয় পেয়েছে, এবং বলার পর চুপ করে অপেক্ষা করেছে।
যারা জানে, সম্পর্ক মানে ঘটা করে বলা নয়—সচেতনভাবে থাকা। প্রতিদিন, প্রতিবার।
আমরা তিশা আর শৈলী, এই শহরের দুই মেয়ের গল্প, যারা শুধু ভালোবেসেছে।
যেমন ভাবে রোদ ভালোবাসে জানালার কাঁচ,
যেমন ভাবে চুপ থাকা ভালোবাসে ভেতরের কণ্ঠস্বর।
আমরা হয়তো সমাজের চোখে ‘বিচ্যুতি’,
কিন্তু নিজেদের চোখে আমরা—সমাপ্তি ছাড়া এক গল্প।”
শৈলী তিশার হাত থেকে কলমটা নিল।
“তুই যখন আমায় প্রথম বলেছিলি, ভয় পেও না, তখন আমি বুঝেছিলাম, তুই আমার মতোই।
তুই যে মাকে সম্মান করিস, এবং একইসাথে নিজের সত্যকে বাঁচিয়ে রাখতে চাস, সেটা আমি দেখেছি।
আমরা যতবার দূরে গিয়েছি, ঠিক ততবার নিজেদের দিকে ফিরেছি।
এই চিঠি আমাদের সেই যাত্রার প্রমাণ, যেখানে প্রেম ছিল, প্রশ্ন ছিল, আর ছিল দুইজন মানুষের ধৈর্য।
যারা পড়ে, তারা জেনে রাখুক—আমরা আজ আছি। একসাথে।
আর এই চিঠি কোনো চুপি চুপি লুকানো অনুভব নয়—এটা আমাদের স্বীকৃতি।”
তারা চিঠিটা মুড়িয়ে একটা সাদা খামে ভরল। তারপরে ক্যাফের টেবিলের নিচে, দেওয়ালের কোণে থাকা ছোট কাঠের তাকটায় সেটা রেখে দিল।
ক্যাফের মালিকের ছেলে এসে জিজ্ঞেস করল, “দিদি, এটা কী?”
তিশা একটু হেসে বলল, “একটা ছোট্ট চিঠি। কেউ যদি ভালোবাসার গল্প খুঁজে পায় কোনওদিন, সে হয়তো এটায় মুখ গুঁজে কেঁদে ফেলবে। অথবা সাহস পাবে।”
ছেলেটা কিছু না বলে মাথা নেড়ে চলে গেল।
শৈলী তখন চুপচাপ তিশার হাত ধরল। বলল, “আজ, আমি কোনও লুকোচুরি চাই না। আমি চাই, আমরা যেন নিজেদের মতো করে এই শহরে বাঁচতে পারি।”
“আমরা তো শুরু করেছি আগেই,” বলল তিশা। “আজ শুধু আরও একধাপ এগোলাম।”
“আমার মা এখনো স্বীকার করেন না, কিন্তু কথা বলেন, খাবার পাঠান। হয়তো একদিন ও বুঝে নেবে। সময় চাই শুধু।”
“তাহলে তুই কি মনে করিস, এই গল্পটা এবার শেষ হতে পারে?”
“না,” বলল শৈলী, “এই গল্পের কোনও শেষ নেই। কারণ এটা গল্পের মতো নয়—এটা জীবন।”
তারা বাইরে বেরিয়ে এল। আকাশে তখন সোনালি রোদ আর মেঘের লুকোচুরি। রাস্তায় কেউ তাদের দিকে তাকাল, কেউ না তাকিয়েই চলে গেল।
তবে এই প্রথম, শৈলী নিজে থেকে তিশার হাত ধরল।
খুব স্বাভাবিকভাবে।
একটা ছোট হাসি নিয়ে।
যেন বলছে—এই পথটা, এই বিকেলটা, এই শহরটা—সবকিছু এখন আমাদের নামে লেখা।
শেষ
				
	

	


