শুভ্রজিত ঘোষাল
অধ্যায় ১ – সূর্যের ডাক
২১শ শতকের শেষ দিকে, পৃথিবীর মহাকাশ পর্যবেক্ষণ প্রযুক্তি এমন এক উচ্চতায় পৌঁছেছে, যেখানে সূর্যের ক্ষুদ্রতম পরিবর্তনও শনাক্ত করা সম্ভব। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের (ISRC) কলকাতা শাখায় সেই রাতে সবকিছুই ছিল স্বাভাবিক। রাত দুইটা পেরিয়ে গেছে, পর্যবেক্ষণ ঘরে শুধুই যন্ত্রের মৃদু শব্দ, আর কম্পিউটার স্ক্রিনে অনবরত ভেসে আসা ডেটা। হঠাৎ, স্যাটেলাইট “সৌরবিকাশ–৭” থেকে আসা লাইভ ফিডে দেখা গেল এক অদ্ভুত সিগন্যাল—তীব্র তাপের সমুদ্রের মাঝে যেন একটি স্থির, ঠান্ডা বিন্দু। ডিউটি অফিসার প্রথমে ভাবলেন, হয়তো সেন্সর ত্রুটি। কিন্তু চেক করার পর দেখা গেল, সব সিস্টেম ঠিকঠাক কাজ করছে। সঙ্গে সঙ্গেই খবর পাঠানো হল ড. সৌম্যদীপ রায়ের কাছে, যিনি সৌর-অভ্যন্তরের চৌম্বক তরঙ্গের অন্যতম বিশেষজ্ঞ। গভীর রাতে ফোন পেয়ে সৌম্যদীপের ভ্রু কুঁচকে উঠল—এমন ঠান্ডা স্পটের কথা তিনি শুধু তত্ত্বে কল্পনা করেছেন, বাস্তবে কখনও দেখেননি। দ্রুত গাড়ি নিয়ে তিনি গবেষণাগারে পৌঁছে যান, সঙ্গে ডাকা হল সৌর পদার্থবিদ ও নভোচারী ইরা বসুকে, যিনি সেই সময় নিকটবর্তী ট্রেনিং সেন্টারে ছিলেন।
গবেষণাগারে পৌঁছে সৌম্যদীপ আর ইরা মনোযোগ দিয়ে ডেটা বিশ্লেষণ শুরু করলেন। পর্দায় ভেসে উঠল সূর্যের উচ্চ-রেজোলিউশনের থার্মাল ম্যাপ—প্রচণ্ড তাপের লালচে কমলা রঙের সমুদ্রে একটি সাদা খণ্ড যেন জমে আছে। স্কেলে দেখা গেল, ঐ অংশের তাপমাত্রা সূর্যের গড় পৃষ্ঠতলের তুলনায় কয়েক মিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াস কম। “অসম্ভব… সূর্যের উপরে বরফ?”—ইরা অবাক হয়ে বলে উঠল। সৌম্যদীপ গম্ভীর স্বরে জবাব দিলেন, “বরফ নয়… কিন্তু তাপ হঠাৎ কমে যাওয়ার পেছনে কিছু আছে। হয়তো চৌম্বক অস্থিরতা, হয়তো অন্য কিছু।” আরও কাছ থেকে ছবি তোলার জন্য তাঁরা স্যাটেলাইটের ফোকাস বাড়ালেন। ধীরে ধীরে সেই অংশের চিত্র স্পষ্ট হতে লাগল—খণ্ডটি সত্যিই বরফের মত চকচকে, প্রতিফলিত আলো চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। বরফের নিচে যেন কিছু নড়ছে, যদিও তাপমাত্রা অনুযায়ী কোনও প্রাণের অস্তিত্ব থাকা অসম্ভব।
ডেটা বিশ্লেষণের মাঝেই সৌম্যদীপের মনে পড়ল তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একটি তত্ত্বের কথা—‘কোল্ড পকেট হাইপোথিসিস’, যা তাঁর পরামর্শদাতা অধ্যাপক সমরেশ রায় প্রস্তাব করেছিলেন। তত্ত্বটি বলেছিল, সূর্যের গভীরে অজানা কারণে মাঝে মাঝে অতি ঠান্ডা অঞ্চল সৃষ্টি হতে পারে, যা কয়েক মিনিট থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। বিজ্ঞানসমাজে এই ধারণা ততটা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি, কারণ এমন কোনও প্রমাণ কখনও পাওয়া যায়নি। কিন্তু আজ, এই চিত্র যেন সেই তত্ত্বের জীবন্ত সাক্ষ্য। ইরা চুপচাপ সৌম্যদীপের মুখের দিকে তাকাল—তাঁর চোখে ভয়ের চেয়ে কৌতূহল বেশি। বাইরে তখন ভোরের আভা ফুটে উঠছে, কিন্তু গবেষণাগারের ভেতরে উত্তেজনা এতটাই প্রবল যে সময়ের বোধ যেন হারিয়ে গেছে। সব কম্পিউটার স্ক্রিনে একই ছবি—সূর্যের হৃদয়ে এক অসম্ভব শীতল খণ্ড, যার ভেতরে রহস্যময় ছায়া।
অবশেষে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন, বিষয়টি গোপন রাখা হবে যতক্ষণ না এর উৎস এবং প্রকৃতি নিশ্চিতভাবে জানা যায়। সৌম্যদীপ জানতেন, এমন আবিষ্কারের খবর ছড়িয়ে পড়লে আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষণা সংস্থা থেকে শুরু করে সেনাবাহিনী পর্যন্ত সক্রিয় হয়ে উঠবে, আর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। ইরা প্রস্তাব করলেন, অবিলম্বে কেন্দ্রীয় মিশন বোর্ডে রিপোর্ট পাঠাতে হবে এবং বিশেষ অভিযাত্রী দল গঠন করতে হবে। সৌম্যদীপ ধীরে মাথা নাড়লেন, “হ্যাঁ, আমাদের সেখানে যেতে হবে। শুধু ডেটা দেখে উত্তর মিলবে না—সূর্যের পৃষ্ঠে পা রেখেই এই রহস্যের সমাধান করতে হবে।” সেই মুহূর্তে, মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হল—যেখানে মানুষের সাহস, বিজ্ঞান আর অজানার প্রতি অদম্য কৌতূহল একসাথে মিলিত হয়ে ডাক দিচ্ছিল, সরাসরি সূর্যের অন্তঃস্থলে যাত্রার জন্য।
অধ্যায় ২ – অভিযানের ডাক
গবেষণাগারের রিপোর্ট পাওয়ার পরপরই দিল্লিতে অবস্থিত ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় মিশন বোর্ডে জরুরি বৈঠক ডাকা হল। ভোরের আলো ফোটার আগেই দেশের সেরা বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিবিদ এবং সামরিক উপদেষ্টারা ভার্চুয়াল কনফারেন্সে যোগ দিলেন। স্ক্রিনে ভেসে উঠল সূর্যের সেই অস্বাভাবিক ঠান্ডা অঞ্চলের ছবি—দেখে অনেকেই প্রথমে চুপ করে গেলেন। অবশেষে কথা বললেন মিশন কমান্ডার রণবীর কুণ্ডু, প্রাক্তন এয়ারফোর্স পাইলট, যিনি মহাকাশ অভিযানের ক্ষেত্রে অসামান্য সাহস ও শৃঙ্খলার জন্য পরিচিত। তাঁর গলা দৃঢ়, “আমাদের এই ঘটনাটি সরাসরি যাচাই করতে হবে। যত ডেটা বিশ্লেষণই হোক, মাঠপর্যায়ে গিয়ে দেখা ছাড়া এর প্রকৃতি বোঝা সম্ভব নয়। আমি প্রস্তাব দিচ্ছি, অবিলম্বে একটি বিশেষ অভিযাত্রী দল প্রস্তুত করা হোক, যারা সূর্যের পৃষ্ঠে নেমে এই অঞ্চল পরীক্ষা করবে।” বোর্ডরুমে কয়েক মুহূর্ত নীরবতা নেমে এল। অনেকেই ঝুঁকি নিয়ে প্রশ্ন তুললেন—সূর্যের তাপ, বিকিরণ, এবং অপ্রত্যাশিত চৌম্বকীয় ঝড়ের মধ্যে অভিযান চালানো প্রায় অসম্ভব। কিন্তু রণবীরের চোখে দ্বিধার ছাপ ছিল না; তিনি জানতেন, মানব ইতিহাসের এই বিরল সুযোগ হাতছাড়া করা মানে অজানার কাছে আত্মসমর্পণ।
অভিযানের সদস্য তালিকা তৈরি হতে শুরু করল। সৌম্যদীপ রায় ও ইরা বসুর নাম প্রথমেই রাখা হল, কারণ তারা এই অস্বাভাবিকতার প্রথম পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক। তৃতীয় সদস্য হিসেবে প্রস্তাব করা হল অধ্যাপক সমরেশ রায়ের নাম—একজন কিংবদন্তি সৌর পদার্থবিদ, যিনি তিরিশ বছর আগে ‘কোল্ড পকেট হাইপোথিসিস’ তত্ত্ব দিয়েছিলেন। বয়স এখন ষাট পেরিয়েছে, তবে মনের জোর ও বৈজ্ঞানিক অভিজ্ঞতা তাঁকে এই অভিযানে অপরিহার্য করে তুলেছে। সমরেশ নিজেও খবর শুনে উত্তেজিত—জীবনের প্রায় পুরোটা সময় তিনি এই তত্ত্ব প্রমাণ করার জন্য ব্যয় করেছেন, আর আজ হাতে এসেছে সোনার সুযোগ। তাঁর চোখে ছিল এক অদ্ভুত দীপ্তি, যেন বহু বছরের অপূর্ণ স্বপ্ন এক লাফে ধরা দিয়েছে। অভিযানের প্রযুক্তি প্রধান হিসেবে বেছে নেওয়া হল নীলাঞ্জন দত্তকে—মাত্র সাতাশ বছরের তরুণ, কিন্তু জটিল মহাকাশযন্ত্র নির্মাণে অসামান্য দক্ষ। নীলাঞ্জনের কাজ হবে এমন একটি ল্যান্ডার বানানো, যা সূর্যের প্রচণ্ড তাপ ও বিকিরণ সহ্য করতে পারবে, একইসঙ্গে সেই ঠান্ডা অঞ্চলে গিয়ে স্থিতিশীলভাবে দাঁড়াতে সক্ষম হবে।
নীলাঞ্জন ল্যান্ডারের নকশা তৈরি শুরু করলেন পরের দিনই। প্রচলিত সৌর-রোধী প্রযুক্তি এখানে যথেষ্ট নয়; সূর্যের গড় তাপমাত্রা সহ্য করার পাশাপাশি, ল্যান্ডারকে এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে হঠাৎ তাপমাত্রা পতন ও চৌম্বক ক্ষেত্রের অস্থিরতাও সহ্য করতে পারে। তিনি এক নতুন ধরণের তাপরোধক আবরণ ডিজাইন করলেন, যা কার্বন-কম্পোজিট ও হালকা টাইটানিয়ামের মিশ্রণে তৈরি। এই আবরণ বাইরে থেকে আসা অতিরিক্ত তাপ প্রতিফলিত করবে এবং ভেতরের তাপমাত্রা স্থিতিশীল রাখবে। একইসঙ্গে, ল্যান্ডারের পায়ায় লাগানো হবে বিশেষ মাইক্রো-অ্যাঙ্কর, যা সূর্যের পৃষ্ঠে প্রবল গ্যাসীয় প্রবাহের মাঝেও ল্যান্ডারকে স্থির রাখবে। নীলাঞ্জন জানতেন, প্রযুক্তি যতই নিখুঁত হোক, এক ফোঁটা ভুলই পুরো মিশন ধ্বংস করে দিতে পারে। তাই তিনি দিনরাত এক করে কাজ করলেন, পরীক্ষার পর পরীক্ষা চালালেন, এবং প্রতিটি যন্ত্রাংশকে সূর্যের অনুকরণে তৈরি চেম্বারে পরীক্ষা করলেন।
এদিকে, রণবীর কুণ্ডু দলের মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতির তত্ত্বাবধান শুরু করলেন। সূর্যের কাছাকাছি যাত্রা পৃথিবীর কক্ষপথের বাইরে দীর্ঘ সময় অবস্থান করার সমান, যেখানে তাপ, বিকিরণ ও গ্যাসীয় ঝড় প্রতিটি মুহূর্তে বিপদের সম্ভাবনা তৈরি করবে। দলের প্রতিটি সদস্যকে বিশেষ স্যুট, তাপ সহনশীলতার প্রশিক্ষণ, এবং জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলার মহড়া দেওয়া হল। সমরেশের শারীরিক সক্ষমতা নিয়ে প্রথমে সন্দেহ ছিল, কিন্তু কঠোর প্রশিক্ষণে তিনি প্রমাণ করলেন—মনোবল থাকলে বয়স কোনও বাধা নয়। অভিযানের তারিখ স্থির হওয়ার পর, সবাই বুঝতে পারল—এটি কেবল একটি বৈজ্ঞানিক মিশন নয়, বরং মানব সাহস, কৌতূহল ও ঐক্যের এক কঠিন পরীক্ষা। সূর্যের দিকে যাত্রা করার জন্য কাউন্টডাউন শুরু হল, আর প্রতিটি হৃদস্পন্দনে যেন শোনা যাচ্ছিল সেই অগ্নিময় আহ্বান—“এসো, আমার রহস্য উন্মোচন করো।”
অধ্যায় ৩ – সূর্যের পথে
অভিযানের দিন ভোরে, শ্রীহরিকোটার উৎক্ষেপণ কেন্দ্র যেন এক বিশাল নাট্যমঞ্চে পরিণত হয়েছে। চারপাশে টানটান উত্তেজনা, প্রতিটি সেকেন্ড যেন গুনে গুনে যাচ্ছে। বিশাল সৌরযান সুর্যবাহন-১ উৎক্ষেপণ প্যাডে প্রস্তুত—এর গায়ে ঝকঝক করছে তাপপ্রতিরোধক আবরণ, যা নীলাঞ্জন দত্তের মাসব্যাপী নিরলস পরিশ্রমের ফল। যাত্রার আগে সংক্ষিপ্ত ব্রিফিংয়ে রণবীর কুণ্ডু দলকে স্মরণ করিয়ে দিলেন, “আমরা ইতিহাস লিখতে যাচ্ছি, কিন্তু ইতিহাস লেখার পথে প্রতিটি মুহূর্তই মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করাবে। শৃঙ্খলা, একে অপরের প্রতি আস্থা আর ঠান্ডা মাথা—এটাই আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে।” কয়েক মিনিট পরে উৎক্ষেপণের কাউন্টডাউন শুরু হল, আর ধীরে ধীরে চারপাশ কেঁপে উঠল বিশাল ইঞ্জিনের গর্জনে। ৩… ২… ১… ইগনিশন! মুহূর্তের মধ্যে অগ্নিময় ধোঁয়া আর গ্যাসের মেঘ ছিঁড়ে আকাশের দিকে ধাবিত হল সুর্যবাহন-১, সঙ্গে নিয়ে পাঁচজন মানুষের স্বপ্ন, সাহস ও কৌতূহল।
মহাকাশযানের ভিতরে প্রথম কয়েক ঘণ্টা দলটি ব্যস্ত ছিল বিভিন্ন সিস্টেম পরীক্ষা ও স্থিতিশীল করতে। সৌম্যদীপ জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখতে পেলেন, পৃথিবী ধীরে ধীরে ছোট হয়ে যাচ্ছে—নীল-সবুজ গোলকটি যেন দূরের কোনও স্মৃতিচিহ্নে পরিণত হচ্ছে। তাঁর মনের মধ্যে একসাথে ভিড় করছে শত প্রশ্ন—এমন ঠান্ডা অঞ্চল কীভাবে সূর্যের মতো উষ্ণ জ্যোতিষ্কে গঠিত হল? এর উৎস কি প্রাকৃতিক, নাকি বহিরাগত কোনও শক্তির প্রভাব? মনে পড়ল, বৈজ্ঞানিক জীবনে তিনি যত রহস্যই দেখেছেন, এমন অভিজ্ঞতা কখনও হয়নি। ইরা বসু তার বিপরীতে বসে যন্ত্রপাতির পাঠ নেওয়ার ফাঁকে এক ঝলক জানালার বাইরে তাকালেন; তাঁর চোখে একসাথে ভয় ও উত্তেজনার ঝিলিক। ভয়—কারণ সূর্যের কাছাকাছি যাওয়া মানে মানুষের সহনক্ষমতার সীমা ছুঁয়ে ফেলা। উত্তেজনা—কারণ তিনি জানেন, যদি এই মিশন সফল হয়, মানবজাতি সৌরজগত সম্পর্কে এক নতুন অধ্যায় উন্মোচন করবে।
মহাকাশযান ধীরে ধীরে পৃথিবীর কক্ষপথ ছেড়ে সূর্যের দিকে অগ্রসর হতে লাগল। বাহ্যিক যোগাযোগ সীমিত করে দেওয়া হয়েছে, যাতে কেবল প্রয়োজনীয় ডেটা ও নির্দেশনা আদানপ্রদান হয়। দীর্ঘ যাত্রার একঘেয়েমি ভাঙতে মাঝে মাঝে নীলাঞ্জনের কণ্ঠ ভেসে আসে, “সব সিস্টেম সবুজ… তবে সূর্যের দিকে যত এগোচ্ছি, বিকিরণের মাত্রা তত বেড়ে চলেছে। মনে হচ্ছে, যেন আমরা কোনও অগ্নিপাহাড়ের দিকে উড়ে চলেছি।” সমরেশ রায় নীরবে ডেটা পর্যবেক্ষণ করছিলেন; তাঁর মুখে গভীর মনোযোগের ছাপ, যেন প্রতিটি সংখ্যার মধ্যে তিনি কোনও প্রাচীন ভাষা পড়ছেন। হঠাৎ তিনি বললেন, “দেখো, এই চৌম্বকীয় তরঙ্গের প্যাটার্ন… সাধারণ ঝড়ের মতো নয়। এর গতি ও তীব্রতা আলাদা—আমাদের সাবধানে এগোতে হবে।” রণবীর সাথে সাথে নেভিগেশন সিস্টেমে কিছু পরিবর্তন করে যাত্রাপথ সামান্য ঘুরিয়ে নিলেন, যাতে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল এড়ানো যায়।
যাত্রার তৃতীয় দিনে, জানালার বাইরে সূর্য যেন আর কেবল একটি দূরের নক্ষত্র নয়—এখন সে এক জীবন্ত দানব, তীব্র আলো আর অগ্নিঝড়ে ঘূর্ণায়মান। সৌম্যদীপের মনে হল, তারা যেন এক অদৃশ্য সীমানা পেরিয়ে এসেছে, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম নতুনভাবে পরীক্ষা দিচ্ছে। সেই সাদা ঠান্ডা খণ্ডের কথা মনে পড়তেই বুকের ভিতর অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল—কয়েক দিন পরে তারা ঠিক তার সামনে দাঁড়াবে। ইরা তখন শান্ত গলায় বললেন, “যদি সত্যিই বরফ হয়, তবে সেটা কেবল বিজ্ঞান নয়… হয়তো জীবন সম্পর্কেও আমাদের ধারণা পাল্টে দেবে।” সৌম্যদীপ উত্তর দিলেন না, কেবল জানালার বাইরে তাকিয়ে রইলেন—সূর্যের ক্রমবর্ধমান দীপ্তি তাঁর চোখে পড়ছিল, কিন্তু মনে হচ্ছিল, এই আলোয় শুধু তাপ নয়, কোনও অজানা রহস্যও লুকিয়ে আছে, যা তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
অধ্যায় ৪ – অগ্নির মাঝে বরফ
সূর্যের উত্তপ্ত পৃষ্ঠ থেকে মাত্র কয়েকশো কিলোমিটার দূরে এসে মহাকাশযানের জানালা দিয়ে তাকিয়ে সবাই নিঃশ্বাস আটকে রাখল। চারদিক যেন আগুনের ঢেউ—লাল, কমলা, সোনালি আভা ছড়িয়ে অসংখ্য প্লাজমার বিস্ফোরণ উঠছে। কিন্তু এই দাউদাউ আগুনের মাঝখানে চোখে পড়ল এক বিস্ময়কর দৃশ্য—একটি বিশাল বরফখণ্ড, যেন সূর্যের মাঝে এক জমাটবাঁধা হ্রদ। এই অস্বাভাবিকতা তাদের প্রত্যেককে শিহরিত করল। মহাকাশযানের স্ক্যানার একসাথে তাপমাত্রা ও গঠন পরীক্ষা করল, কিন্তু ফলাফল আরও অবিশ্বাস্য—বরফের তাপমাত্রা প্রায় মাইনাস একশো ডিগ্রি সেলসিয়াস। সূর্যের এমন তীব্র তাপে এই বরফ অটুট থেকে গেছে কীভাবে? বিজ্ঞানী ইশান একপ্রকার স্তম্ভিত, আর কমান্ডার তনুজা মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে বললেন, “এটা আমাদের সব তত্ত্ব ভেঙে দিচ্ছে।” তারা ধীরে ধীরে ল্যান্ডিং গিয়ার নামিয়ে বরফের কিনারায় অবতরণ করল, যেন এই অসম্ভব ঘটনাটির কেন্দ্রে ঢুকে পড়ছে।
পা রাখা মাত্রই সবাই অনুভব করল, তাপের সঙ্গে এই জমাট শীতের তফাত যেন দুই ভিন্ন গ্রহের বাতাসে দাঁড়ানোর মতো। বরফের উপর ভেসে থাকা কুয়াশা একধরনের নীল আভা ছড়াচ্ছিল, যা অদ্ভুতভাবে সূর্যের আলোকে প্রতিফলিত করছিল না বরং শুষে নিচ্ছিল। তীব্র আলোয় চোখ ঝলসে যাওয়ার কথা, কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে যেন এক প্রকার প্রশান্ত অন্ধকারের ভিতরে থাকা যায়। দলটি সতর্কভাবে এগিয়ে গেল। প্রতিটি পদক্ষেপে বরফের নিচে ফাটল ধরার মতো শব্দ হচ্ছিল, কিন্তু কোথাও তা ভেঙে পড়ার আভাস নেই। হঠাৎ নীচের গভীরে কিছু নড়াচড়ার শব্দ ভেসে এল। সোনার সেন্সর নেমে বরফের পুরুত্ব মেপে জানাল—প্রায় বিশ মিটার গভীরে কিছু বড় আকৃতির বস্তু রয়েছে, যা আকারে মানুষের মতো হলেও পুরোপুরি অপরিচিত গঠনবিশিষ্ট। কেউ কি এখানে আটকে আছে, নাকি তারা কোনো অজানা প্রাণী আবিষ্কার করতে চলেছে?
তারা বরফ খুঁড়ে ভেতরে প্রবেশের প্রস্তুতি নিল। কিন্তু বরফের গঠন ছিল অদ্ভুতভাবে শক্ত—এটি সাধারণ জলবরফ নয়, বরং কোনো অজানা খনিজ মিশ্রিত যৌগ যা লেজার ড্রিলেও সহজে কাটছে না। ড্রিলের তাপ বরফে লাগলে একধরনের ধাতব গন্ধ ছড়াচ্ছিল, এবং বরফের ভেতর থেকে যেন মৃদু গুঞ্জন ভেসে আসছিল—যেন কারও ঘুমন্ত নিশ্বাস। বিজ্ঞানী মায়া সেই শব্দ রেকর্ড করে ফ্রিকোয়েন্সি বিশ্লেষণ করতে লাগলেন, আর ধীরে ধীরে বুঝতে পারলেন, এটা কোনো প্রাকৃতিক কম্পন নয়—বরং কোনো প্রকার সংকেত, যার ধ্বনি-প্যাটার্ন মানুষের হার্টবিটের মতো। ঠিক তখনই বরফের গভীরে থাকা অবয়বগুলোর মধ্যে একটি নড়ে উঠল, আর বরফের স্বচ্ছ স্তরের আড়ালে তারা দেখতে পেল—দুটি উজ্জ্বল নীল চোখ হঠাৎ খুলে গেল। সেই চোখের দৃষ্টি সরাসরি তাদের ভেদ করল, আর পুরো দলের শরীরে ঠান্ডার চেয়েও বেশি শীতল শিহরণ বয়ে গেল।
কমান্ডার তনুজা সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে পিছিয়ে আসতে বললেন, কিন্তু ইশান থামতে পারলেন না—তিনি লেজার ড্রিলের শক্তি বাড়িয়ে দিলেন। বরফ ধীরে ধীরে গলতে শুরু করল, আর সেই অবয়বটি স্পষ্ট হতে লাগল। দেখা গেল, এটি মানুষের মতো হলেও ত্বকের রঙ রূপালি, চুল নেই, আর পুরো শরীর জুড়ে অদ্ভুত খোদাই করা নকশা, যেন কোনো অজানা ভাষার প্রতীক। বরফের বাধা ভাঙতেই একটি ঠান্ডা বাতাসের ঢেউ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল, যা মহাকাশযানের ধাতব গায়েও কুয়াশা জমিয়ে দিল। আর সেই সত্তা ধীরে ধীরে চোখ খুলে শ্বাস নিতে শুরু করল, কিন্তু তার ঠোঁটে কোনো শব্দ এলো না—বরং দলের প্রত্যেকের মাথার ভেতর সরাসরি একটি কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হল, “তোমরা এসে গেছ… আগুনের মাঝে জমাট থাকা শেষ প্রহরীকে জাগিয়ে তুলেছ।” মুহূর্তেই সবাই বুঝে গেল, তারা শুধু কোনো বরফখণ্ড আবিষ্কার করেনি—বরং সূর্যের অন্তর্গত এক প্রাচীন রহস্যের দ্বার খুলে ফেলেছে, যার ফলাফল অজানা এবং সম্ভবত বিপজ্জনক।
অধ্যায় ৫ – অচেনা জীবের ছায়া
বরফের স্তর কাটতে কাটতে সমরেশ আর রণবীর বুঝতে পারছিলেন—এ কোনো সাধারণ বস্তু নয়। সাদা বরফের নিচে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছিল সোনালি আভা, যেন সূর্যের আলো বরফের ভেতরে বন্দি হয়ে আছে। বরফ ভাঙার প্রতিটি আঘাতে একটি স্ফটিকসদৃশ শব্দ হচ্ছিল, যা শূন্য, ঠান্ডা বাতাসে অদ্ভুতভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর, যখন বরফ প্রায় পুরোপুরি সরে গেল, দেখা গেল—এক অদ্ভুত জীব নিথর হয়ে পড়ে আছে। তার ত্বক সোনার মতো দীপ্ত, কিন্তু ধাতব নয়; বরং যেন কোনো অজানা প্রাণীর চামড়া, যার মধ্যে থেকে আলো নিজেই বেরিয়ে আসছে। শরীরের গঠন মানুষের মতো, কিন্তু মুখের আকৃতি ভিন্ন—চোখ দুটি বড়, গভীর, আর তাতে এমন এক স্থিরতা, যেন তারা চিরন্তন সময়ের নীরব সাক্ষী। রণবীর এগিয়ে এসে হাত রাখতেই অবাক হয়ে দেখলেন—জীবটির দেহ উষ্ণ, অথচ কোনো শ্বাসপ্রশ্বাস নেই। সমরেশ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “এ শুধু একটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার নয়, ইতিহাসের দিকচিহ্নই পাল্টে দিতে পারে।”
জীবটির উপস্থিতি পুরো দলকে বিভ্রান্ত করেছিল। অভিযানের সদস্যরা একে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, কিন্তু কেউ হাত দেওয়ার সাহস পাচ্ছিলেন না। তুষারের গভীরে এমন জীবের অস্তিত্ব কারো কল্পনাতেও ছিল না। কারও মুখে ফিসফিস শব্দ ভেসে এল—”এ কি মানুষের পূর্বপুরুষ? নাকি অন্য কোনো গ্রহের বাসিন্দা?” কিন্তু কোনো উত্তর পাওয়া গেল না, কেবল বরফের গুহার দেয়ালে ঝুলে থাকা অদ্ভুত নীল শ্যাওলা আর বাতাসে হিমেল গন্ধ। রণবীরের মনে হচ্ছিল, জীবটির চোখ বন্ধ হলেও, ভেতরে কোথাও যেন তারা জ্বলছে—যেন সে এখনো দেখছে, শুনছে, সব অনুভব করছে। সমরেশ কৌতূহলী দৃষ্টিতে একে পর্যবেক্ষণ করছিলেন, হাতে থাকা ছোট্ট সেন্সর দিয়ে তাপমাত্রা মাপলেন—অবিশ্বাস্যভাবে স্বাভাবিক। ঠান্ডায় যেখানে মানুষের দেহ কয়েক মিনিটে জমে যাবে, সেখানে এই জীব যেন উষ্ণ এক কক্ষের ভেতরে শুয়ে আছে।
অভিযান দলের অন্যরা নিরাপত্তার যুক্তি দেখিয়ে বলছিল, “এটাকে এখানে ফেলে রাখা ভালো, হয়তো বিপজ্জনক হতে পারে।” কিন্তু রণবীর দৃঢ় স্বরে জানালেন, “আমরা এতদূর এসেছি আবিষ্কারের জন্য, ভয়ে পিছিয়ে যেতে নয়।” সমরেশও তার সাথে একমত হলেন। তাই সবাই মিলে সতর্কতার সাথে জীবটিকে বিশেষ ইনসুলেটেড স্ট্রেচারে তুলে আনল। হিমেল বাতাসে ধোঁয়ার মতো বাষ্প বের হচ্ছিল জীবটির দেহ থেকে, কিন্তু সেটা ঠান্ডার কারণে নয়, যেন কোনো অজানা শক্তি ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে আসছে। জাহাজে তোলার আগে রণবীর একবার শেষবারের মতো জীবটির মুখের দিকে তাকালেন। ঠোঁটের কোণে হালকা বাঁক, যেন অদৃশ্য এক হাসি—এমন এক হাসি যা একদিকে রহস্যময়, অন্যদিকে অশরীরী অনুভূতি জাগায়।
জাহাজের কেবিনে স্থানান্তরের পর সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও, অজানা শঙ্কা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। সমরেশ তার ডায়েরিতে লিখলেন—“আজ আমরা এমন এক জীবের মুখোমুখি হয়েছি, যা মানব ইতিহাসের পরিসীমা ছাড়িয়ে যায়। এর অস্তিত্ব মানে আমাদের অতীত সম্পর্কে যা জানি, তা নতুন করে ভাবতে হবে। কিন্তু এর সাথে কি বিপদও আসছে?” রণবীর জানালার বাইরে বরফঢাকা সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলেন, মনে হচ্ছিল অন্ধকার দিগন্তের ওপারে কেউ যেন নীরবে তাকিয়ে আছে। দূরে মেঘের আড়ালে চাঁদ লুকিয়ে গেল, আর সমুদ্রের ঢেউ যেন কোনো অচেনা গানের সুর তুলল—যেন পৃথিবীও জানে, তারা আজ যা খুঁজে পেয়েছে, তা কেবল আবিষ্কার নয়, বরং এক অদৃশ্য গল্পের সূচনা।
অধ্যায় ৬ – রহস্যের বীজ
সূর্য তখন ঠিক মাথার উপরে, অথচ অদ্ভুতভাবে আলোতে যেন একটা অস্থিরতা। চাঁদের ধুলোময় ভূমি আর দূরের ধূসর পাহাড়ের ঢালে ছায়াগুলি ক্রমশ দুলে উঠছিল, যেন কোনও অদৃশ্য হাত সেগুলো টেনে-ছিঁড়ে দিচ্ছে। ল্যান্ডারের ভিতরে নীলাঞ্জন ও ইরা মনোযোগ দিয়ে যন্ত্রপাতির ডাটা যাচাই করছিলেন। কিন্তু হঠাৎ মনিটরের স্ক্রিনে সতর্কতা সংকেত জ্বলে উঠল—‘Solar Magnetic Storm Detected’। তীব্র ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গের ধাক্কায় বাইরের অ্যান্টেনা কেঁপে উঠল, এবং সেই সাথে গোটা কাঠামোতে একধরনের ধাতব গুঞ্জন শোনা গেল। নীলাঞ্জন তাড়াতাড়ি কম্পনমাপীর ডায়াল চেক করলেন, আর ইরা জানালেন যে যোগাযোগ ব্যবস্থা কয়েক সেকেন্ডের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়েছে। বাইরের দৃশ্যপটে ধুলো বাতাসের মতো ভেসে উঠছে, যদিও চাঁদে বাতাস নেই। এ যেন সূর্যের অদৃশ্য হাত এসে ধুলোকে ঝাঁকিয়ে দিচ্ছে। এসময় তাদের চোখ পড়ল ল্যান্ডারের পেছনের সেই জীবটির উপর—যেটিকে তারা মৃত ভেবেছিল।
সেই প্রাণীটির দেহ এতক্ষণ নিশ্চল ছিল, ঠান্ডা ও ধূসর, যেন বহু শতাব্দীর শূন্যতার মধ্যে শুকিয়ে যাওয়া কোনও প্রাচীন জীবাশ্ম। কিন্তু সূর্যের চৌম্বক ঝড়ের প্রথম আঘাতেই নীলাঞ্জনের চোখে পড়ল এক অদ্ভুত পরিবর্তন। প্রাণীটির হাতের আঙুলগুলো সূক্ষ্মভাবে কেঁপে উঠল, যেন স্নায়ুর ভেতরে কোথাও জীবনধারা আবার প্রবাহিত হচ্ছে। নীলাঞ্জন অবাক হয়ে ইরাকে ডাকলেন, কিন্তু ইরা প্রথমে ভেবেছিলেন, হয়তো ঝড়ের কারণে আলো-ছায়ার প্রতিফলন ঘটছে। কিন্তু তারপরেই তিনি স্পষ্ট দেখতে পেলেন—একটি সূক্ষ্ম নড়াচড়া, আঙুলের জোড়ায় হালকা ভাঁজ, যেন কোনও গভীর নিদ্রায় থাকা প্রাণ ধীরে ধীরে জেগে উঠতে চাইছে। দু’জনের চোখে তখন একসাথে মিলল আতঙ্ক ও বিস্ময়। তারা জানতেন, চাঁদে জীবনের অস্তিত্ব নিয়ে এতদিন যে সব বৈজ্ঞানিক অনুমান চলেছে, তা প্রায় সবই মৃত বা অকার্যকর জীবাণুর স্তরে সীমাবদ্ধ। কিন্তু এখানে তারা দেখছেন এমন কিছু, যা এই ধারণাকে সম্পূর্ণ ওলটপালট করে দিতে পারে।
ঝড় ততক্ষণে তীব্রতর হচ্ছিল। বাইরের তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি হঠাৎ বদলে গেল, এবং সেই সাথে ল্যান্ডারের ভিতরেও একধরনের বৈদ্যুতিক কাঁপন অনুভূত হচ্ছিল। প্রাণীটির দেহে তখনও কোনও বড়সড় নড়াচড়া নেই, কিন্তু তার ত্বকের গায়ে সূক্ষ্ম রূপালি ঝিলিক দেখা যাচ্ছিল, যেন কোনও ধাতব খনিজ সূর্যালোকে জেগে উঠছে। নীলাঞ্জন হঠাৎ অনুভব করলেন, এর নিস্তব্ধতা আসলে মৃত্যু নয়—বরং কোনও দীর্ঘস্থায়ী স্থবিরতা, যা হয়তো কেবল নির্দিষ্ট মহাজাগতিক পরিবেশেই ভাঙে। ইরা ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে প্রাণীটির কাঁধের কাছে সেন্সর লাগালেন, আর মনিটরে দেখতে পেলেন অত্যন্ত ক্ষীণ কিন্তু স্পষ্ট এক তরঙ্গ—যেন হৃদস্পন্দনের মতো। সেই মুহূর্তে তাঁদের মনে গভীর প্রশ্ন জন্ম নিল—যদি এটা সত্যিই জীবিত হয়, তবে এর জাগরণ কি কেবলই প্রাকৃতিক? নাকি কোনও অজানা উদ্দেশ্যে এই জাগরণ ঘটছে? চৌম্বক ঝড় কি কেবল একটা কাকতালীয় প্ররোচনা, নাকি সূর্যের সাথে এর জীববৃত্তান্তের কোনও গভীর সম্পর্ক আছে?
ল্যান্ডারের ভিতর তখন নিস্তব্ধতা ভেদ করে শোনা যাচ্ছিল কেবল ইলেকট্রনিক যন্ত্রের হালকা শব্দ আর বাইরে ধুলোর কণার ধাক্কাধাক্কি। ইরা নীলাঞ্জনের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন, “এটা মৃত নয়… এটা অপেক্ষা করছিল।” তাঁর কণ্ঠে ছিল শঙ্কা ও এক অদ্ভুত শ্রদ্ধা। নীলাঞ্জনের মনে পড়ল পৃথিবীর পুরনো কিংবদন্তি—যেখানে ঘুমন্ত দেবতা শতাব্দীর পর শতাব্দী পরে কোনও মহাজাগতিক আহ্বানে জেগে ওঠেন। তাঁদের সামনে হয়তো সেই রূপকথার বাস্তব প্রতিচ্ছবি দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে সূর্যের ঝড় এখনও চলছে, আর ল্যান্ডারের কাঁপন থামেনি। প্রাণীটির আঙুলের নড়াচড়া তখন আরও স্পষ্ট, যেন একটুখানি সময় পেলেই এটি পুরো দেহ নড়িয়ে বসে পড়বে। তাঁদের মনের ভেতরে তখন ভয়, কৌতূহল আর বিজ্ঞানসুলভ তাগিদ একসাথে জেগে উঠছিল—এ যেন চাঁদের বুকে রোপিত এক রহস্যের বীজ, যা খুব শিগগিরই অঙ্কুরিত হতে চলেছে।
অধ্যায় ৭ – পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন
মাসব্যাপী মহাকাশ অভিযানের পর অবশেষে দলের পায়ের নিচে আবারও পৃথিবীর মাটি। বিশাল এয়ারবেসে অবতরণের মুহূর্তে সবার চোখে স্বস্তি ও গর্বের ছাপ, কিন্তু সেই সঙ্গে লুকানো আছে অদ্ভুত এক উদ্বেগ—যে জীবটিকে তারা অচেনা গ্রহ থেকে নিয়ে এসেছে, তার ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে কেউই নিশ্চিত নয়। সৌম্যদীপ, দলের প্রাণিবিজ্ঞানী, পুরো সময়টা সেই স্বচ্ছ কাঁচের কন্টেইনারে রাখা জীবটির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। গায়ে হালকা নীলাভ আভা, নড়াচড়া নেই বললেই চলে, কিন্তু শ্বাসপ্রশ্বাসের মতো এক ধরনের ক্ষীণ কম্পন মাঝে মাঝে দেখা যায়। সরকারি নির্দেশে সরাসরি জীবটিকে গোপন সৌর গবেষণাগারে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে প্রবল নিরাপত্তা ও বৈজ্ঞানিক সরঞ্জামের মাঝে তাকে রাখা হয়। বাইরের পৃথিবী কিছুই জানে না—সংবাদমাধ্যমে শুধু বলা হয়েছে, দলটি একটি ‘বিরল মহাজাগতিক নমুনা’ নিয়ে ফিরেছে। গোপন কক্ষের মোটা কাঁচের ভেতরে আবদ্ধ প্রাণীটিকে ঘিরে যেন নীরব অথচ ঘন একটি রহস্যের পর্দা নেমে আসে।
প্রথম কিছুদিন সবকিছুই ছিল স্বাভাবিক—পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ, এবং বৈজ্ঞানিক নথিভুক্তি। কিন্তু সপ্তম রাতে সৌম্যদীপ নিজের শিফটে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলেন, যা তাঁর নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিল। কক্ষের আলো ক্ষীণ হয়ে এলে জীবটির চোখের ভেতর হঠাৎই মৃদু আলো জ্বলে উঠল, যেন দুইটি ছোট্ট তারার মতো। সেই আলো কেবল স্থির নয়, যেন স্পন্দিত হচ্ছে—একটি ছন্দে, যা মানুষের হৃদস্পন্দনের মতো শোনায়। তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন, হয়তো আলোর প্রতিফলন বা যন্ত্রের গোলমাল। কিন্তু যখন তিনি কাছে এগোলেন, তখন গায়ে দেখা গেল হালকা কিন্তু স্পষ্ট কিছু চিহ্ন ফুটে উঠছে—রেখা, বৃত্ত ও ত্রিভুজের জটিল বিন্যাস। সেগুলি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে লাগল, যেন জীবটির ত্বকই কোনো প্রাচীন লিপি দিয়ে ঢাকা। সৌম্যদীপ হঠাৎ মনে করতে পারলেন, এই ধরনের কিছু চিহ্ন তিনি তাঁর কলেজজীবনে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃত পুঁথিতে দেখেছিলেন—বিশেষ করে ‘অথর্ব বেদ’-এর কিছু গোপন মন্ত্রে ব্যবহৃত প্রতীক। ঠাণ্ডা ঘাম তাঁর কপালে জমে গেল; একটি মহাজাগতিক প্রাণীর গায়ে কীভাবে পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতার ভাষার ছাপ থাকে?
পরদিন সকালে তিনি এই ঘটনার কথা প্রধান বিজ্ঞানী অনিরুদ্ধ সেনগুপ্তকে জানালেন। কিন্তু সেনগুপ্ত প্রথমে বিষয়টি উড়িয়ে দিলেন, বললেন—”আলো আর ছায়ার খেলা, সৌম্যদীপ। রাতের বেলা মস্তিষ্কও কখনও কখনও বিভ্রম সৃষ্টি করে।” কিন্তু সৌম্যদীপ থামলেন না; তিনি গোপনে সেই প্রতীকগুলির ছবি তোলেন এবং পুরনো সংস্কৃত লিপির সঙ্গে তুলনা শুরু করেন। তুলনায় দেখা যায়, অন্তত তিনটি প্রতীক প্রায় হুবহু মিলছে—যার অর্থ দাঁড়ায় ‘দ্বার’, ‘আত্মা’, এবং ‘গমন’। এই শব্দগুলির একসঙ্গে উপস্থিতি তাঁকে আরও অস্থির করে তোলে। মনে হচ্ছিল, জীবটি কেবল একটি বৈজ্ঞানিক বিস্ময় নয়—এটি যেন একটি বার্তা বহন করছে, যা পৃথিবীরই কোনও প্রাচীন অতীতের সাথে যুক্ত। রাতে শিফটে থাকার সময় তাঁর মনে হতে লাগল, জীবটির চোখের আলো যেন তাঁকে এক অদৃশ্য শক্তি দিয়ে ডাকছে—কোনো রহস্য উন্মোচনের জন্য।
সপ্তাহের শেষের দিকে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। গবেষণাগারের অন্যান্য সদস্যরা জানাতে শুরু করেন, তাঁরা রাতের বেলা কাচের পেছন থেকে ক্ষীণ শব্দ শুনতে পান—যেন গম্ভীর স্বরে কেউ সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণ করছে। যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষা করলে কোনো অডিও সিগনাল ধরা পড়ে না, কিন্তু মানুষের কানে তাতে স্পষ্ট শব্দ শোনা যায়। সৌম্যদীপ বুঝলেন, এটি হয়তো শুধু ভৌত নয়—মনোজগতের মধ্যেই কোনো প্রভাব ফেলছে। তিনি ভয় এবং কৌতূহলের মাঝামাঝি এক অবস্থায় পড়ে যান। তাঁর মনে হচ্ছিল, এই জীবটি হয়তো এমন এক সেতু, যা মানুষের সভ্যতার প্রাচীনতম স্মৃতিকে মহাজাগতিক কোনো উৎসের সাথে যুক্ত করে। কিন্তু সরকার এবং গবেষণাগার কি এই সত্য প্রকাশের সাহস রাখবে? আর যদি রাখে না, তবে তাঁর একার পক্ষে এই রহস্য উন্মোচন সম্ভব হবে কি? এই প্রশ্নগুলির উত্তর তখনও তাঁর কাছে ছিল না—শুধু চোখের সেই ক্ষীণ আলো এবং প্রতীকগুলির গভীরে লুকিয়ে থাকা বার্তা তাঁর সমস্ত চিন্তাকে গ্রাস করে রেখেছিল।
অধ্যায় ৮ – সূর্যের ভাষা
সমরেশের হাত কাঁপছিল না, কিন্তু চোখে ছিল সেই একাগ্রতা যা বহু বছরের গবেষক জীবনে কেবল কয়েকবারই এসেছিল। ইরার দেওয়া তামাটে পাতের উপর খোদাই করা প্রতীকগুলো তিনি ধীরে ধীরে নোটবুকে কপি করছিলেন, আর সঙ্গে সঙ্গে পুরনো সংস্কৃত, পালি, এবং অজানা গোপন চিহ্নের সঙ্গে মিল খুঁজছিলেন। প্রতিটি চিহ্ন যেন এক অদ্ভুত দ্বান্দ্বিক ভাষায় সাজানো, যেখানে কিছু অংশ সূর্যের রশ্মির মতো ছড়ানো রেখা এবং কিছু অংশ বরফের স্ফটিকের মতো সূক্ষ্ম। প্রাথমিক অনুবাদের পর তাঁর ঠোঁট ফাঁক হয়ে গেল—“অগ্নি আমার শত্রু, বরফ আমার জীবন।” ইরা অবাক হয়ে বললেন, “মানে কী? সূর্যের ভিতরে তো কেবল অগ্নি আর প্লাজমা, সেখানে বরফ কোথা থেকে আসবে?” সমরেশ কেবল মাথা নাড়লেন, “তুমি ভুল ভাবছ, হয়তো এটি প্রতীকী। অথবা হয়তো আমরা সূর্যকে যা জানি, তা পুরোটা সত্য নয়।” ইরার মনে পড়ল, দুই রাত আগে স্বপ্নে তিনি এক অদ্ভুত আলো দেখেছিলেন—তা ছিল না আগুনের উজ্জ্বলতা, বরং ঠান্ডা, নীলচে এক দীপ্তি, যা তাঁর দিকে হাত বাড়াচ্ছিল। সেই স্বপ্ন কি এই লেখার সঙ্গে কোনও যোগসূত্র রাখে?
তারা রাতভর আলোচনা চালিয়ে গেল। সমরেশ যুক্তি দিলেন, প্রাচীন সভ্যতাগুলোর অনেকেই প্রতীকী ভাষায় মহাজাগতিক সত্য প্রকাশ করত। হয়তো কোনও হারিয়ে যাওয়া সভ্যতা সূর্যের গভীরে এক অদৃশ্য স্তর আবিষ্কার করেছিল, যেখানে প্রচলিত অগ্নির জগৎকে পরাভূত করে এক ধরনের “বরফ” বিদ্যমান। ইরা বিস্মিত হলেন, “মানে এক ঠান্ডা সূর্য? এ তো পদার্থবিদ্যার নিয়ম ভেঙে দেয়।” সমরেশ চুপচাপ জানালেন, “পদার্থবিদ্যা মানুষ আবিষ্কার করেছে, কিন্তু মহাবিশ্ব নিজের নিয়মে চলে।” ইরার মনে এক শিহরণ বয়ে গেল—যদি এই প্রতীক সত্য হয়, তবে হয়তো তারা এমন এক শক্তির খোঁজে রয়েছে যা আগুনকে নিঃশেষ করতে পারে, এমনকি নক্ষত্রের জীবনও থামিয়ে দিতে পারে। এই শক্তি যদি ভুল হাতে যায়, তবে মানবজাতি ধ্বংসের মুখে পড়তে পারে। তাই এই রহস্য উন্মোচন যত বড় আবিষ্কার, তত বড় বিপদও।
ভোরের দিকে যখন প্রথম আলো ঘরে ঢুকল, ইরা জানালেন তাঁর আরেকটি সন্দেহ—“তুমি কি ভেবেছ, এই বার্তাটি আমাদের জন্য নয়?” সমরেশ তাকালেন, “মানে?” ইরা বললেন, “যদি এটি আসলে সূর্যের গভীরে থাকা কোনও সত্তার বার্তা হয়, যা পৃথিবীর কাছে সাহায্য চাইছে? অগ্নি যদি তার শত্রু হয়, তবে হয়তো কোনও বিপর্যয় আসছে, যা সেই সত্তাকে ধ্বংস করবে।” এই চিন্তা সমরেশকে চুপ করিয়ে দিল। মানুষের ইতিহাসে বহুবার আকাশের প্রতীক ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে অশুভ পরিণতি এসেছে—হয়তো এবারও তেমন কিছু হতে চলেছে। কিন্তু একটি প্রশ্ন তাঁদের মাথায় ঘুরছিল—যদি সূর্যের গভীরে সত্যিই কোনও জীবন থাকে, তবে তারা কিভাবে এই বার্তা পৃথিবীতে পাঠাল? আর কে প্রথমে তা ধরে ফেলেছিল? পুরনো নথি ঘেঁটে সমরেশ খুঁজে পেলেন, শত বছর আগে আর্কটিক অভিযানে এক ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী নাকি তুষারের নিচে একই রকম এক ফলক পেয়েছিলেন, কিন্তু সেটি আর কখনও জনসমক্ষে আসেনি।
দিনের শেষে, যখন তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো মানমন্দিরে গিয়ে বিশাল দূরবীক্ষণ যন্ত্রে সূর্যের পর্যবেক্ষণ করছিলেন, ইরার চোখে পড়ল—এক ক্ষুদ্র কালো ছায়া ধীরে ধীরে সূর্যের পৃষ্ঠে সরে যাচ্ছে। সেটি কোনও গ্রহ নয়, ধূমকেতুও নয়; বরং এক নিখুঁত জ্যামিতিক গঠন, যেন কেউ বা কিছু ইচ্ছাকৃতভাবে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। সমরেশের গলায় শ্বাস আটকে গেল, “হয়তো… এটাই সেই সভ্যতা। আর হয়তো তারা আমাদের প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় আছে।” ইরা চুপ করে গেলেন, কিন্তু তাঁর মনের গভীরে এক অদ্ভুত টান অনুভূত হচ্ছিল—যেন সূর্যের সেই ঠান্ডা দীপ্তি তাঁকে ডাকছে। সেই মুহূর্তে দু’জনেই জানলেন, এই বার্তা কেবল কোনও প্রাচীন রহস্য নয়—এটি আসন্ন ভবিষ্যতের সংকেত, আর তাঁদের হাতে রয়েছে এর উত্তর খুঁজে বের করার শেষ সুযোগ।
অধ্যায় ৯ – সত্যের দ্বারপ্রান্তে
বরফখণ্ডের ভেতরে বরাবরই শুয়ে থাকা সেই জীবটি ধীরে ধীরে চেতনা ফিরে পাচ্ছিল। প্রথমে তার আঙুলের মতো অঙ্গগুলো কেঁপে উঠল, তারপর চোখের পাতায় হালকা টান পড়ল। ড. সৌম্যদীপ, মায়া ও অনির্বাণ শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল কাঁচের আড়াল থেকে। তাদের মনে তখন হাজারটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে—এই অজানা প্রাণীটি আদৌ কী, কোথা থেকে এসেছে, আর কেনই বা বরফের ভেতরে এতদিন লুকিয়ে ছিল। জীবটির চেহারায় তখন এক ধরনের শান্ত গাম্ভীর্য ফুটে উঠেছিল, যেন সে মানুষের ভাষা না বুঝলেও পরিস্থিতি বুঝতে পারছে। মায়া ধীরে ধীরে মনিটরের পাশে বসে তার জীবনীশক্তির গ্রাফ দেখতে লাগল—হার্টবিট ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হচ্ছে, কিন্তু সেই সাথে অদ্ভুতভাবে বেড়ে চলেছে শরীরের তাপমাত্রা। মনে হচ্ছিল, কোনো গভীর অভ্যন্তরীণ শক্তি তাকে জাগিয়ে তুলছে।
তারপর জীবটি তার অদ্ভুত, আলোকিত চোখ দিয়ে মায়ার দিকে তাকাল। কোনো শব্দ বেরোল না, তবুও সবার মনে একইসাথে এক ধরনের ছবি ভেসে উঠল—সূর্যের পৃষ্ঠে একটি ভয়ংকর শক্তির ঢেউ জমা হচ্ছে, যা একসময় বিস্ফোরিত হবে। অনির্বাণ বিস্ময়ে বলে উঠল, “এটা… আমাদের সাথে যোগাযোগ করছে… মানসিকভাবে।” ড. সৌম্যদীপ দ্রুত নোট নিতে লাগলেন, কিন্তু জীবটির পরবর্তী চিত্র তাদের শিরদাঁড়া ঠান্ডা করে দিল—বিস্ফোরণের পর আগুনের বিশাল বল ছুটে আসছে, এবং কয়েক মাসের মধ্যে তা পৃথিবীকে গ্রাস করবে। এরপরে দেখা গেল মহাদেশগুলো ভেঙে পড়ছে, সমুদ্র বাষ্প হয়ে যাচ্ছে, আর আকাশ কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে। এই দৃশ্য যেন সরাসরি তাদের মস্তিষ্কে প্রবেশ করল, কোনো স্ক্রিন বা প্রজেকশনের প্রয়োজন ছাড়াই।
জীবটির নড়াচড়ায় বোঝা যাচ্ছিল, সে আতঙ্কিত নয়—বরং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সে আরও কিছু ছবি দেখাল—দূরের কোনো গ্রহ বা নক্ষত্র থেকে বেরিয়ে আসা এক উজ্জ্বল আলোর রথের মতো যান, যা মহাশূন্যের পথে চলেছে। অনির্বাণ অনুমান করল, “এটাই নিশ্চয় ওর যান… বরফখণ্ড ছিল তার আড়াল।” কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেল—সে কেন পৃথিবীতে এসেছে? জীবটির পরবর্তী সংকেত সব প্রশ্নের উত্তর দিল—সে এসেছে এই বিপর্যয় ঠেকাতে। সূর্যের সেই এনার্জি স্পাইক স্বাভাবিক নয়, এটি কোনো মহাজাগতিক বিকৃতি বা অন্য শক্তির হস্তক্ষেপের ফল। সেই শক্তিকে থামানোর জন্য তাকে পৃথিবীর মানুষদের সাহায্য দরকার। বারবার সে হাতের মতো অঙ্গ নাড়িয়ে এক ধরনের বৃত্তাকার চিহ্ন দেখাল, যা হয়তো কোনো যন্ত্র বা স্থানকে বোঝাচ্ছে, যেখানে সে বিস্ফোরণ ঠেকানোর কাজ শুরু করবে।
মায়া ফিসফিস করে বলল, “মানে আমরা এখন এমন এক পরিস্থিতিতে… যেখানে একজন ভিনগ্রহী আমাদের রক্ষক।” কিন্তু ড. সৌম্যদীপের চোখে তখন অন্য চিন্তা—যদি সরকারের কাছে এই খবর যায়, তারা নিশ্চয়ই জীবটিকে বন্দি করে ফেলবে, আর সেই সময় অপচয় পৃথিবীর মৃত্যু নিশ্চিত করবে। জীবটি ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে তাদের দিকে সংকেত দিল, যেন বলছে—সময় ফুরিয়ে আসছে, এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। অনির্বাণের বুক ধকধক করছিল; সে জানত, পরের কয়েকটি দিনই নির্ধারণ করবে মানবজাতির ভবিষ্যৎ। বাইরে বরফঝড়ের শব্দে ল্যাব কেঁপে উঠছিল, আর ভেতরে—এক অজানা মহাজাগতিক মিত্রের সঙ্গে মানুষের প্রথম সংলাপ চলছিল, যা হয়তো পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে পারবে… অথবা সেই শেষ আশাটুকুও কেড়ে নেবে।
অধ্যায় ১০ – সূর্যবন্দীর মুক্তি
ফয়সালা নিতে কারও বেশি সময় লাগল না—যে সত্তা তাদের সামনে বসে আছে, সে-ই একমাত্র যে আগত বিস্ফোরণ থামাতে পারবে। কিন্তু এর মানে তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে সেই নরকতুল্য তপ্ত জগতে, যেখান থেকে সে এসেছিল। রণবীর জানত, এই মিশন শুধু বিপজ্জনক নয়, প্রায় আত্মঘাতী। তবুও তার চোখে ছিল এক দৃঢ়তা—যদি তারা ব্যর্থ হয়, তবে পৃথিবীর সবুজ বন, নীল সমুদ্র, প্রতিটি জীবনের শ্বাস থেমে যাবে। ইরা নিঃশব্দে তার পাশে এসে দাঁড়াল, হাতে জীবটির জন্য প্রস্তুত বিশেষ তাপরোধক চেম্বার। জীবটি তাদের দিকে তাকাল, তার সোনালি চোখে যেন কোনও ভয় নেই—শুধু এক অনড় শান্তি। মনে হচ্ছিল, সে জানে এই মুহূর্তের জন্যই তার জন্ম হয়েছে। মহাকাশযান সূর্যসেনা ধীরে ধীরে উৎক্ষেপণ প্যাড থেকে উঠল, গর্জন করে আকাশ পেরিয়ে গেল, আর পেছনে ফেলে এল পৃথিবীর শেষ ভোর।
সূর্যের কাছে আসতেই অগ্নির জলোচ্ছ্বাসের মতো প্লাজমা তাদের চারপাশে ছুটে যাচ্ছিল। প্রতিটি কম্পন যেন জানিয়ে দিচ্ছিল, সূর্যের অন্তর্গত সেই বিস্ফোরণ আর বেশি দেরি নেই। ইরা জীবটির দিকে তাকাল—তার শরীরে তখন তীব্র সোনালি আভা ছড়িয়ে পড়ছে, যেন সে সূর্যের শক্তি নিজের মধ্যে টেনে নিচ্ছে। রণবীর ককপিট থেকে সমরেশের কণ্ঠ শুনতে পেল—“কেন্দ্রীয় বরফপকেটে পৌঁছালে ওকে মুক্ত করো, বাকিটা সে সামলাবে।” কিন্তু বরফপকেটে পৌঁছনোর পথ সহজ ছিল না; সূর্যের তীব্র চৌম্বক ঝড় মহাকাশযানকে দুলিয়ে দিচ্ছিল, যন্ত্রপাতি বারবার সতর্ক সংকেত দিচ্ছিল। তবুও রণবীর দমে গেল না—প্রতিটি নিয়ন্ত্রণ লিভারে তার হাত যেন আরও শক্ত হয়ে উঠল। জীবটি চেম্বারের ভেতর থেকে ইঙ্গিত করল, যেন তাদের ধৈর্য ধরতে বলছে।
অবশেষে সেই স্থান এসে গেল—সূর্যের তপ্ত সমুদ্রের মাঝে এক অদ্ভুত শ্বেতবিন্দু, যা আগুনের জগতে অসম্ভব এক ঠান্ডার দ্বীপ। রণবীর যন্ত্র চালিয়ে দরজা খুলে দিলেন, আর ইরা চেম্বার থেকে জীবটিকে মুক্ত করল। মুহূর্তেই তার চারপাশে তীব্র আলো ফেটে বেরোল, যেন তার দেহ নিজেই এক নক্ষত্রে রূপ নিচ্ছে। সে ধীরে ধীরে সামনে ভেসে গেল, হাত দুটি ছড়িয়ে দিল, আর চারপাশে তৈরি করল এক বিরাট আলোকগোলক। পরের মুহূর্তে সেই আলোকগোলক সূর্যের গভীরে প্রবেশ করল, আর প্রচণ্ড বিস্ফোরণের মতো এক আলো ছড়িয়ে পড়ল সবদিকে। রণবীর চোখ রক্ষা করার জন্য ভিসর নামিয়ে নিলেন, কিন্তু আলো এতটাই তীব্র ছিল যে মনে হচ্ছিল, মহাবিশ্বের সব শক্তি এই এক বিন্দুতে মিলে গেছে। যন্ত্রপাতির পরিমাপ দেখাল—তাপমাত্রা ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হচ্ছে, চৌম্বক ঝড় থেমে গেছে, আর এনার্জি স্পাইক সম্পূর্ণ মিলিয়ে গেছে।
কিছুক্ষণ পর সব শান্ত হয়ে এলো। সূর্য যেন আগের মতোই জ্বলছে, কিন্তু জানালার বাইরে তাকাতেই ইরা বুঝল—কিছু বদলে গেছে। বরফপকেট আর নেই, আর সেই সোনালি চোখের জীবটিও কোথাও নেই। শুধু সূর্যের পৃষ্ঠে মাঝে মাঝে এক ক্ষুদ্র ঝিলমিল আলো দেখা দিচ্ছিল, যেন বিদায়ের হাতছানি দিচ্ছে। রণবীর চুপচাপ পাইলট সিটে বসে রইলেন, কথা বলতে পারলেন না। তারা পৃথিবীর দিকে ফেরার পথ ধরল, কিন্তু মনে হচ্ছিল, তারা শুধু এক অচেনা নক্ষত্রযাত্রীকে হারিয়ে আসেনি—হারিয়েছে এমন এক বন্ধু, যার আত্মত্যাগ মানবজাতির ইতিহাসে চিরকাল লেখা থাকবে। পৃথিবী তখনও জানত না, যে সকাল তাদের সামনে আসছে, তা এসেছে এক অচেনা সত্তার নীরব ত্যাগের বিনিময়ে; আর সূর্যের আলোয় সেই স্মৃতি চিরকাল ঝিলমিল করে থাকবে, এক সূর্যবন্দীর মুক্তির গল্প হয়ে।
সমাপ্ত