Bangla - প্রেমের গল্প

সুরে ভেজা দিনগুলি

Spread the love

ঋষভ পাল


পর্ব ১

আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টি যখন কলকাতার রাস্তায় ঝমঝমিয়ে নামল, তখন সত্যক ছিল ছাদে। ধানসিড়ির গলি নম্বর চার—এই ছোট্ট গলির পাঁচতলা পুরনো বাড়িটার একদম ওপরে দাঁড়িয়ে সে মেঘের শব্দ শুনছিল। কলেজ বন্ধ, বাইরের রাস্তায় ছাতার নিচে জুটে যাওয়া প্রেমিকদের ভিড়, আর একা দাঁড়িয়ে থাকা সত্যকের কানে তখন কেবল একটা গানের সুর বাজছিল—“রিমঝিম গিরে সাওন…”

সত্যকের গলা ছিল ভালো। ছোট থেকেই ক্লাসিকাল সংগীত শিখেছে মা’র কাছে। কিন্তু মা আর নেই। গানের সুরটাও যেন এখন অনেকটাই ম্লান। গানের প্রতিটা শব্দ আজকাল তাকে তিক্ত মনে হয়, কারণ মায়ের সঙ্গেই গানটা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে মধুর অভ্যাস।

হঠাৎ করেই পেছন থেকে কেউ ডাকল, “তুমি সত্যক তো?”
সে ঘুরে দাঁড়াল। ছাতা হাতে, চোখে গোল ফ্রেমের চশমা, ভেজা চুল গাল ছুঁয়ে নামছে। মেয়েটির মুখ চিনতে একটু সময় লাগল।
“আমি ঊর্মি। তোমার পাশের বিল্ডিং থেকে। ছোটবেলায় মিউজিক কম্পিটিশনে একসঙ্গে অংশ নিয়েছিলাম… মনে আছে?”
সত্যক মাথা নাড়ল। মনে পড়ে গেল। সেই ‘সুরসপ্তক’ গানের প্রতিযোগিতা। ঊর্মির কণ্ঠ ছিল অলোকসন্ধ্যা মিত্রর মত—একটা ভারি, মেঘলা সুর।

ঊর্মি ছাতাটা নামিয়ে ছাদের ঘাসে দাঁড়াল। “তোমার গান এখনো শুনি মাঝে মাঝে। ফেসবুকে যেটা দিয়েছিলে ‘মন মাঝি তোর নাম…’ খুব ভালো লেগেছিল।”
সত্যক একটু হেসে বলল, “তুমি এখনও গান গাও?”
ঊর্মি চোখে আঙুল দিয়ে চশমার কাচ মুছল। “গাই, কিন্তু মঞ্চে নয়। বর্ষায় গলা খারাপ হয় প্রায়ই।”
দুজনেই কিছুক্ষণ নীরব থাকল। বৃষ্টির শব্দ যেন তাদের কথা বলার স্পেস নিচ্ছিল।

“তুমি জানো,” সত্যক বলল, “এই বৃষ্টির দিনে আমার মনে হয় গানগুলো নতুন করে জন্ম নেয়। একই রাগ, একই সুর—তবুও নতুন লাগে।”
ঊর্মি মাথা ঝাঁকাল। “আচ্ছা, একটা কথা বলি? একটা বর্ষার নাটক করছি আমাদের ক্লাবে। গান আর গল্প মিলিয়ে। চলো না, একসঙ্গে কাজ করি।”
সত্যক একটু চমকে উঠল। “নাটক মানে? আমি তো কখনো স্টেজে…”
ঊর্মি হেসে ফেলল, “স্টেজে না নামলে গানের প্রাণটা বোঝা যায় না। আর নাটকটা পুরোটাই বর্ষার গান দিয়ে তৈরি করছি—‘সুরে ভেজা দিনগুলি’ নামে। পরিচালক আমাদেরই সংগীত শিক্ষক অনিরুদ্ধদা। তুমি থাকলে গল্পটা আরও প্রাণ পাবে।”

সত্যক কিছু বলল না। মা’র ছবি চোখে ভেসে উঠল। তিনি বলতেন, “একটা গান তখনই সম্পূর্ণ হয়, যখন সেটা কাউকে ছুঁয়ে যায়।” হয়তো এটাই সেই সুযোগ। কাউকে ছোঁয়া, নিজেকে খুঁজে পাওয়া।

ঊর্মি পকেট থেকে একটা ছোট ডায়েরি বার করল। “আজ বিকেলে অডিশন, আমাদের ক্লাবঘরে—পুরনো লাইব্রেরির পাশেই। আসবে?”
সত্যক হাসল। “চেষ্টা করব।”

ঊর্মি চলে গেল। সত্যক ছাদে দাঁড়িয়ে মেঘের নিচে চোখ বন্ধ করল। মাথার ভেতর তখন অনিরুদ্ধদার নাম ঘুরছে। তিনি এক সময় বড় মঞ্চে গাইতেন, এখন সংগীত শেখান। মা অনেক গল্প বলতেন তাঁকে নিয়ে।

সত্যক ঘরে নেমে এল। আলমারির একদম নিচে রাখা মায়ের হারমোনিয়ামটা বার করল। অনেক দিন পরে ধুলোমাখা সাদা-কাটা হাতলটা ছুঁয়ে দেখল। টকটকে সুরে একটা “আনন্দ ধ্বনি” বেজে উঠল ঘরে। আশ্চর্য, হারমোনিয়াম যেন নিজের ইচ্ছেতেই জেগে উঠল।

বিকেলের দিকে, হাতে ডায়েরি নিয়ে সত্যক পৌঁছোল ক্লাবঘরে। বাইরে তখনো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। এক ঝাঁক ছেলেমেয়ে ভেতরে গলা সাধছে, কেউ কেউ স্ক্রিপ্ট পড়ছে। দেওয়ালে বড় করে লেখা—“সুরে ভেজা দিনগুলি—সংগীতনাট্য, পরিচালনায় অনিরুদ্ধ ঘোষ।”

ঊর্মি সত্যককে দেখে এগিয়ে এল। “এসেছো! অনিরুদ্ধদা তো ভিতরেই আছেন। এসো, ওঁর সঙ্গে দেখা করি।”

ঘরে ঢুকতেই কণ্ঠস্বর ভেসে এল—“শুধু বর্ষা নয়, সেই বর্ষার অনুভবটাই চাই। চোখে যেন বৃষ্টি নামে, কণ্ঠে যেন শ্রাবণের হাহাকার থাকে।”

অনিরুদ্ধদা ছিলেন লম্বা, গাঢ় চুলের, গলায় একটি পুরনো সুরের হার। চোখে একরাশ ক্লান্তি, কিন্তু কণ্ঠে সুরের আগুন।
ঊর্মি বলল, “দাদা, উনি সত্যক। খুব ভালো গায়।”
অনিরুদ্ধদা সত্যকের দিকে তাকালেন, “তুমি কি সেই সত্যক, মল্লিকবাড়ির ছেলে?”
সত্যক অবাক। “আপনি চিনলেন কী করে?”
“তোমার মা আমার একসময়ের ছাত্রী ছিলেন। অসামান্য গায়িকা। ছোটবেলায় তোমায় দেখেছি তাঁর সঙ্গে। তোমার গলায় এখন ওঁর সুরই শুনব আমি।”

সত্যক চুপ করে রইল। বুকের ভেতর কি যেন একটা কেঁপে উঠল। হারিয়ে যাওয়া সুর যেন ফের ফিরে এল।
অনিরুদ্ধদা বললেন, “গাও দেখি কিছু। শ্রাবণী কোনো একটা—তোমার পছন্দ মতো।”
সত্যক চোখ বন্ধ করল। আর গলা দিয়ে বেরিয়ে এল—“আজ জোছনায় ভেজা রাতে, তোমার গান শুনি চুপচাপ…”

ঘর জুড়ে নেমে এল নিস্তব্ধতা।
বৃষ্টির শব্দ থেমে গেছে যেন।
শুরু হল সুরে ভেজা দিনগুলির প্রথম অধ্যায়।

পর্ব ২

সত্যক পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে খেয়াল করল, বুকটা আজ হালকা লাগছে। অনেকদিন পরে যেন ভিতরটা ঝাড়ামোছা হয়েছে। ছাদে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখল, কালকের বৃষ্টির জল এখনও টালির ফাঁকে জমে আছে, আর দূরের কুমারটুলির দিক থেকে কেউ বেহালায় ‘মেঘে ঢাকা তারা’ বাজাচ্ছে। সে জানে, এই বেহালার সুরটা নিশ্চয়ই কারও মন ভাঙা গল্প থেকে জন্ম নিয়েছে।

নিচে ক্লাবঘরে আজ রিহার্সাল ডাকা হয়েছে। অনিরুদ্ধদা বলেছিলেন—“সকাল দশটায় সবাই যেন উপস্থিত থাকে। আজ স্ক্রিপ্ট রিডিং আর প্রথম গানের সুর ধরানো হবে।”

সত্যক প্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে পড়ল। গলির মুখে ঊর্মির সঙ্গে দেখা। হাতে চায়ের কাপ, চোখে একরাশ ঘুম। “তুমি তো একেবারে প্রস্তুত হিরোদের মতো!” হেসে বলল সে।
সত্যক মাথা চুলকে বলল, “আগে গানটা পারি, তারপর না হয় নায়ক হই।”

ক্লাবে পৌঁছে সত্যক দেখতে পেল, সবাই জড়ো হয়ে গিয়েছে। টেবিলের ওপর স্ক্রিপ্টের কপি, পাশে হারমোনিয়াম, তানপুরা, আর দেয়ালে টাঙানো নাটকের পোস্টার—“সুরে ভেজা দিনগুলি: এক সংগীতনাট্য যেখানকার প্রতিটি সংলাপ বর্ষার সুরে লেখা।”

অনিরুদ্ধদা চেয়ারে বসে চশমা পরে স্ক্রিপ্ট পড়ছেন। মাথা তুলেই বললেন, “চলো, শুরু করি। প্রথম গানটা ধরাব আজ—‘শ্রাবণের দিনে আমি গান গাই’। এটা আমাদের নাটকের খোলা জানালার মতো, যেখানে দর্শকরা প্রথম ঢুকবে।”

ঊর্মি তখন নিজের গলাটা খাঁটি করছিল। সত্যকের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল—“একটু নার্ভাস লাগছে?”
“নয়, একটু বেশিই,” সত্যক বলল।

রিহার্সাল শুরু হল। অনিরুদ্ধদা প্রথমে স্ক্রিপ্ট পড়ে শোনালেন, তারপর সবাই মিলে তালে তালে গান ধরলেন। হারমোনিয়ামের সুরে ভেসে উঠল গানের শুরুটা—

“শ্রাবণের দিনে, ভিজে যায় গলি, মনটাও ভেজে, তোমার কণ্ঠছবি…”

সত্যক তার গলা মেলাল। সুর যেন গলা থেকে বেরিয়ে বুক ছুঁয়ে বেরিয়ে আসছিল। সে টের পেল, মায়ের শেখানো নিয়মে সুরের শুদ্ধতা যেমন জরুরি, তেমনই দরকার সুরে অনুভব। সেই অনুভবটা আজ ঊর্মির চোখে দেখল সে—গান গাওয়ার সময় তার চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, যেন সুরের ভেতর সে হারিয়ে যাচ্ছে।

গান শেষ হতেই অনিরুদ্ধদা বললেন, “সত্যক, তোমার গলায় মাটি আছে, জল আছে, কিন্তু আগুন চাই। সুরের মধ্যে একরাশ যন্ত্রণা চাই। মনে রেখো, এই নাটক প্রেমের নয়, এই নাটক ঋতুর প্রেমের কথা বলে। এখানে বর্ষা তার ভালোবাসা খুঁজছে।”

সত্যক মাথা নাড়ল। সে বুঝতে পারছিল, বর্ষা এখানে একটা চরিত্র। মেঘ, বৃষ্টি, বাতাস—সব যেন এই নাটকের নায়ক-নায়িকা।

বিরতির সময় সত্যক এক কোণে বসে স্ক্রিপ্টটা পড়ছিল। হঠাৎ ঊর্মি পাশে এসে বলল, “একটা কথা বলি?”
সত্যক তাকাল।
“তুমি যখন গাইলে, আমার মনে হচ্ছিল যেন জানালার ধারে কেউ বসে পুরোনো চিঠি পড়ছে। খুব কম মানুষের গলায় এ রকম নস্টালজিয়া থাকে। তোমার গলায় সেটা আছে।”

সত্যক হেসে বলল, “তোমার গলায়ও তো সেই একই অনুভব। তুমি যেন বৃষ্টির গন্ধ গাইতে পারো।”
ঊর্মি চুপ করে গেল। তারপর বলল, “আমার গলায় সেই গন্ধটা এসেছিল মায়ের মৃত্যুর পর। আমি যখন প্রথম ‘আজি ঝর ঝর মুখর বাদরে’ গাইলাম, মঞ্চে দাঁড়িয়ে হঠাৎ কাঁদতে শুরু করেছিলাম। দর্শক বুঝল না, কিন্তু আমি জানি—ওটা ছিল আমার মাকে খুঁজে পাওয়া।”

সত্যকের বুকটা টনটন করল। দুজনেই একরকম ব্যথা থেকে গানকে খুঁজে পেয়েছে। হয়তো সেই ব্যথাই তাদের কাছে সুর হয়ে এসেছে।

সন্ধে ঘনিয়ে এল। রিহার্সালের শেষে অনিরুদ্ধদা বললেন, “আগামী কাল আমরা আমাদের নাটকের দ্বিতীয় গান ধরাব—যেখানে বর্ষা ফিরে আসার অপেক্ষা করে। একঘণ্টা রিহার্সালের আগে সবাই যেন বৃষ্টিতে একবার ভিজে আসে। আমি চাই, তোমাদের গলার মধ্যে সত্যিকারের জলের স্পর্শ থাকুক।”

সত্যক বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবছিল, এই নাটক হয়তো তার নিজের একটা পথ। মা বলতেন, “গান শুধুই সুর না, ওটা আত্মার ভাষা।”
এখন সত্যক সেটা বুঝতে পারছে।

ঘরে ফিরে হারমোনিয়ামের ঢাকনা খুলে দিল। চুপচাপ নিজের ঘরেই গান ধরল—“শ্রাবণ এসো, ফিরে এসো…”

বাইরে তখন বৃষ্টি পড়ছিল নিঃশব্দে, কিন্তু সত্যকের ঘরে গানের ভেতর দিয়ে শব্দ হচ্ছিল জীবনের।

পর্ব ৩

পরদিন সকালে মেঘলা আকাশের নিচে গলির ছেলেমেয়েরা ছাতা নিয়ে ক্লাবের দিকে হাঁটছিল। সত্যকের কাঁধে হারমোনিয়ামের কভার চাপা, মুখে স্নিগ্ধ একরাশ প্রস্তুতির ছাপ। আজকের দিনটা আলাদা। আজকের রিহার্সালে নাটকের কেন্দ্রীয় গান—‘বর্ষা অপেক্ষা করে’—ধরানো হবে।

ঊর্মি আগেই এসে গিয়েছে। এক কোণে বসে চুল শুকোচ্ছে। চোখেমুখে চিন্তার ছাপ, একদম শূন্যতা ঘেরা দৃষ্টি। সত্যক এগিয়ে গিয়ে বলল, “ভালো আছো?”
ঊর্মি মাথা নাড়িয়ে বলল, “সারারাত ঘুমোইনি। জানো সত্যক, আমার ভেতরটা কেমন যেন হাহাকার করছে। বৃষ্টি পড়লেও যেন ভিজছি না।”
সত্যক হেসে বলল, “তাহলে তো গানেই সেই অনুভূতি ফুটিয়ে তুলতে হবে। বৃষ্টির হাহাকার দিয়েই তো তৈরি হবে আমাদের বর্ষা।”

অনিরুদ্ধদা এসে পড়লেন। আজ তাঁর চোখে একটা অদ্ভুত তীব্রতা ছিল। তিনি একবার সবদিক দেখে নিয়ে বললেন, “আজকের গানটা একান্ত অন্তর থেকে গাইতে হবে। নাটকে এই গানটা যখন বাজে, তখন বর্ষা নিজেই মঞ্চে এসে দাঁড়ায়। সে কাউকে খুঁজছে—একটা পুরোনো গান, একটা হারানো সুর, একটা ফেলে আসা প্রেম।”

সত্যক একটু পিছিয়ে বসে গলা খাঁটি করল। হারমোনিয়ামের রিডে আঙুল ছুঁইয়ে বাজাতে শুরু করল এক মেঘলা স্বর।
ঊর্মির গলা ভেসে এল প্রথমে—
“এসো না আর, এসো না তুমি
আমার পত্রঘেরা দিনগুলি ভিজে গেছে খুব…
তবুও মন চায় অপেক্ষা করতে,
যেন সুরে তোমার ছায়া পড়ে…”

গানের প্রতিটি লাইন যেন হৃদয়ের ঘর পেরিয়ে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। সত্যক গলা মেলাল—
“বর্ষা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে,
জানালার গা ছুঁয়ে…
তুমি ফিরে এলে, হয়তো সে গান পাবে ঠিক ঠিক…”

অনিরুদ্ধদার চোখে জল এসে গেল। তিনি থামিয়ে বললেন, “এই হচ্ছে সুরের ম্যাজিক। এই হচ্ছে আত্মা থেকে গাওয়া গান।”

সবার হাততালির মধ্যে এক মুহূর্তে যেন ঘরটা থেমে গেল। কেউ কেউ নীরব দাঁড়িয়ে। এই গান আর পাঁচটা নাট্যগীতের মতো নয়। এটা যেন একটা মোমের বাতি, যেটা জ্বলছে মনের মধ্যে।

বিরতিতে ক্লাবঘরের বারান্দায় সত্যক আর ঊর্মি পাশাপাশি বসে চা খাচ্ছিল। চা ঠান্ডা হয়ে আসছিল, কিন্তু তাদের মধ্যে কথার তাপ ছিল গম্ভীর।
ঊর্মি হঠাৎ বলল, “জানো, আমার মায়ের একটা স্বপ্ন ছিল—আমি যেন কোনও একদিন বড়ো মঞ্চে বর্ষার গান গাই। কিন্তু তখন আমি সুর হারিয়ে ফেলেছিলাম। এখন মনে হয়, সেই স্বপ্নটা হয়তো এই নাটক দিয়ে পূর্ণ হবে।”
সত্যক বলল, “আমার মায়েরও এমনই স্বপ্ন ছিল। তিনি চাইতেন আমি গান ছাড়ি না, কিন্তু কলেজ, চাকরি, দুঃখ সব মিলে গান হারিয়ে গিয়েছিল। আজ আবার খুঁজে পেয়েছি।”

ঊর্মি হঠাৎ হাত রাখল সত্যকের হাতের উপর। “তুমি জানো, সত্যিকারের গান তখনই হয় যখন আমরা ভেতর থেকে কাউকে ডাকি। আমার মনে হয় আমরা একে অপরের সেই ডাক হতে পারি।”
সত্যক চমকে তাকাল। তার বুকের ভেতর কোথা থেকে যেন বৃষ্টির শব্দ উঠতে লাগল—নয় সেই বৃষ্টির যা জানালায় পড়ে, বরং যা হৃদয়ে ঝরে।

বিকেলে অনিরুদ্ধদা বললেন, “পরের রিহার্সালে আমরা মঞ্চে প্রথম walkthrough করব। নাটকের ফর্ম, আলোর ব্যবহার, সাউন্ড এন্ট্রি—সব। প্রস্তুত থেকো সবাই।”

সত্যক আর ঊর্মি যখন ক্লাব থেকে বেরোচ্ছে, তখন রাস্তায় হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ছাতা না থাকলেও তারা দাঁড়ায়নি। হাঁটতে হাঁটতে সত্যক বলল, “আজ মনে হচ্ছে সত্যিই সুরে ভেজা দিনগুলো শুরু হয়েছে।”
ঊর্মি হাসল, “ভিজে যাওয়া মানেই তো সব নতুন করে শুরু হওয়া।”

পেছনে ক্লাবঘরটা বন্ধ হয়ে গেল, কিন্তু তার মধ্যে বেজে চলল সুর—
“বর্ষা অপেক্ষা করে,
হৃদয়ের জানালায় দাঁড়িয়ে…
একদিন হয়তো সেও গান হবে।”

পর্ব ৪

রিহার্সালের চতুর্থ দিন। ক্লাবঘরের কাঠের জানালা খোলা, বাইরে ধানসিড়ির গলির কাঁদামাটি ভিজে আছে বৃষ্টিতে। মেঘলা আলোয় ঘরের ভেতরটা এক অদ্ভুত রঙে রাঙা—আধা আলো, আধা অন্ধকার। এর মধ্যেই অনিরুদ্ধদা বললেন, “আজ থেকে আমরা মঞ্চে নামব। স্ক্রিপ্টের বাইরে বেরিয়ে নিজেদের চরিত্রকে অনুভব করতে হবে। যে যেমন বৃষ্টি চেনে, সে তেমন করে বৃষ্টিকে গাইবে, বলবে, ছুঁবে।”

ঘরের মাঝখানে ছোট একটা অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি হয়েছে। দড়ি টেনে একটা পর্দা ঝোলানো হয়েছে। পাশে স্ট্যান্ডিং মাইক্রোফোন, দুই প্রান্তে স্পটলাইটের ছায়া। এই প্রথম সত্যক বুঝতে পারল, সুর শুধুই শোনা নয়—এটা চোখের ভেতর দিয়ে ঢুকে যায়, শরীরের মধ্যে দিয়ে বয়ে যায়।

ঊর্মি সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে এসেছে, মুখে হালকা মেকআপ। আজ ওর দৃশ্য—বর্ষার প্রাক্তন প্রেমিকের জন্য অপেক্ষার মুহূর্ত। চরিত্রের নাম মেঘলা।
সত্যকের চরিত্র বৃষ্টিধ্বনি—একটা অসমাপ্ত গান, যা প্রেমিককে খুঁজে ফিরে।

অনিরুদ্ধদা বললেন, “তোমরা দুজন একসঙ্গে মঞ্চে যাবে। শব্দ থাকবে না, শুধু হারমোনিয়াম। সেই সুরেই কথা হবে, চোখে হবে সংলাপ।”

সত্যক মঞ্চে উঠে দাঁড়াল। তার শরীরটা যেন কেঁপে উঠল। এই প্রথম সে অনুভব করল, মঞ্চ একটা জীবন্ত প্রাণী—এখানে দাঁড়ানো মানে নিজেকে উন্মোচিত করা, পোশাক খুলে আত্মাকে মেলে ধরা।

ঊর্মি ধীরে ধীরে মঞ্চের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। বৃষ্টির শব্দ তখন রেকর্ডারে বাজছিল—টিনের চালে পড়া একটানা বৃষ্টি। হারমোনিয়ামের রিডে সত্যকের আঙুল থরথর করছিল। সুরটা সে তুলল—
“আবার যদি ফিরে আসো…
চুপিচুপি পায়ে,
আমি থাকব জানালায়…
ভেজা চুলে, হাত বাড়িয়ে…”

ঊর্মির চোখে তখন জল। ওর ঠোঁট নড়ছে না, কিন্তু চোখে ঝরে পড়ছে সংলাপ। সত্যক দেখল, ওর ভেতরে এক অবিরাম বর্ষা চলছে, যার ভাষা কেবল সুরেই ধরা যায়।

এই প্রথমবার দর্শক না থাকা সত্ত্বেও সত্যকের মনে হল, কেউ একজন ওদের দেখছে। হয়তো মা, হয়তো সময়, হয়তো সুর।

রিহার্সাল শেষে সবাই নীরব। অনিরুদ্ধদা বললেন, “তোমাদের এই দৃশ্যটাই আমাদের নাটকের কেন্দ্রবিন্দু। ‘সুরে ভেজা দিনগুলি’ শুধু গান নয়, এটা প্রেম আর প্রতীক্ষার গল্প। বর্ষা এখানে আসবে, আবার চলে যাবে, কিন্তু তার সুর থেকে যাবে সত্য আর মেঘলার চোখে।”

সত্যক আর ঊর্মি ক্লাবের পিছনের গলিতে হেঁটে চলেছে। বাতাসে এখন কদমফুলের গন্ধ। হঠাৎ সত্যক বলল, “ঊর্মি, তোমার অভিনয় দেখে আমার মনে হল তুমি মেঘলা নও, তুমি বর্ষা নিজে। শুধু ভিজিয়ে যাও, কিছু নিয়ে যাও না।”
ঊর্মি একটু থেমে বলল, “তুমি যদি বৃষ্টিধ্বনি হও, আমি তো নিজের কানেই তোমাকে খুঁজি। কখনও ছাদে, কখনও জানালায়, কখনও গানে…”

এইসব কথার মধ্যেই দুজন একসঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ল একটা চা দোকানের সামনে। দু’কাপ চা হাতে নিয়ে, ভিজে ছাতার তলায় দাঁড়িয়ে, সত্যক হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “তোমার মনে হয়, বর্ষার মতো কোনও অনুভূতি বারবার ফিরে আসে?”
ঊর্মি বলল, “আসেই তো। নাহলে আমরা বারবার ভিজে পড়ি কেন? নাহলে গান গাই কেন?”

সত্যক কিছু বলল না। শুধু চুমুক দিল চায়ে। আর ভাবল—এই নাটকটা শুধু বর্ষা নিয়ে নয়, এ একটা পরিপক্ব ভালোবাসা, যা বলে না, শুধু বাজে।

ফিরে এসে সে হারমোনিয়াম নিয়ে বসল। আজকের নতুন সুরটা নিজের মতো করে বাজাতে শুরু করল—
“যে ফিরে আসে না, তার অপেক্ষায়ও সুর হয়।
যে বলে না কিছু, তার চোখেই গল্প থাকে।”

পর্ব ৫

পরদিন সকালে মেঘ আর রোদ্দুর দুটোই আড়ি-ভাঁজে আকাশে খেলা করছিল। সত্যক যখন বারান্দায় বসে হারমোনিয়াম খুলছিল, তখন তার চোখে পড়ে গেল একটা হলুদ খাম। কারা যেন ভুল করে তাদের পোস্টবক্সে ফেলে গেছে। খামের ওপরে লেখা: ঊর্মি সেন, ধানসিড়ি ক্লাব নাট্যদল, গলি নম্বর ৪।

সত্যক প্রথমে খামটা রেখে দিতে চাইল, কিন্তু কৌতূহল ছাড়ল না। সে জানত, ব্যক্তিগত চিঠি খোলা অনুচিত, কিন্তু কোথাও একটা সুর যেন তাকে ঠেলে দিচ্ছিল, ওই খামের ভিতর লুকোনো গান খুঁজে বের করতে।

সে চিঠিটা ঊর্মিকে দিতে ক্লাবে গেল। রিহার্সালের আধঘণ্টা আগেই সে পৌঁছে গেল সেখানে। ক্লাবঘর তখন ফাঁকা, শুধু সামনের দেয়ালে নতুনভাবে আঁকা হয়েছে পোস্টার:
“সুরে ভেজা দিনগুলি – এক সংগীতনাট্য”
পাশেই সত্যক আর ঊর্মির ছবি আঁকা—মেঘলা দিনের মধ্যে দুজন দাঁড়িয়ে, চোখে বৃষ্টি।

ঊর্মি এল কিছুক্ষণ পর। সত্যক চিঠিটা বাড়িয়ে দিল। “তোমার নামে একটা চিঠি ছিল আমাদের পোস্টবক্সে।”
ঊর্মি চুপ করে সেটা নিল। কিন্তু কোনো কথা না বলে ব্যাগে ঢুকিয়ে দিল।

“পড়বে না?” সত্যক জিজ্ঞেস করল।
ঊর্মি বলল, “না… এই ধরনের চিঠিগুলো আমি পড়ি না। এগুলো আমার বাবার লেখা। তিনি অনেক বছর আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু প্রতিটি বছর বর্ষায় একটা করে চিঠি পাঠান—পুরনো ঠিকানায়। হয়তো মনে করেন, আমি পড়ি।”

সত্যক স্তব্ধ হয়ে গেল। চিঠির ভেতরে কোথাও যে একটা সুর লুকিয়ে আছে, সে সেটা টের পাচ্ছিল এখন। কিন্তু সে সুরটা আসলে সংলাপ নয়, অক্ষম ক্ষমা।

ঊর্মি বলল, “আমার মায়ের মৃত্যুর পরে ওনি চলে যান—একটি কথাও না বলে। শুধু প্রতিবার বর্ষায় এই চিঠি পাঠান, যেন বৃষ্টির মতো একরকম অভিমান রেখে যান।”

সত্যক বলল, “তবে তুমি চিঠিটা খুলে পড়ো না কেন? হয়তো কোনো গান আছে তাতে।”

ঊর্মি একটু হেসে বলল, “জানো, চিঠিটা না পড়ে রেখে দিলে ওটা চিরকাল অসমাপ্ত থাকে—যেমন একটা অসমাপ্ত গান। পড়ে ফেললে হয়তো আর ব্যথা থাকবে না, কিন্তু সেই সুরটা হারিয়ে যাবে।”

এমন সময় অনিরুদ্ধদা এসে পড়লেন। আজকের রিহার্সালে সাউন্ড টেস্ট হবে। নাটকে এক জায়গায় সত্যকের একক গান আছে—যেখানে সে একা বসে ভাঙা হারমোনিয়াম নিয়ে নিজের গল্প গায়। সেই গানটা আজ রেকর্ড হবে।

ঘরে সব প্রস্তুত। সত্যক হারমোনিয়াম নিয়ে বসল। স্টুডিও-রেকর্ডার চালু হল। আলো একপাশে ফোকাস করল, বাকি ঘর অন্ধকার।

সত্যক চোখ বন্ধ করল। মাথায় তখন ঊর্মির সেই চিঠির গল্পটা ঘুরছে, আর গলার ভিতর থেকে একটা সুর বেরিয়ে এল—
“তুমি চিঠি লেখো, আর আমি সুর দিই…
তুমি ফিরে আসো না, কিন্তু প্রতিধ্বনি ফেলে যাও।
আমি প্রতিবার সেই ধ্বনিকে গান বানাই,
আর অপেক্ষা করি, কখন তুমি গাইবে…”

সাউন্ড রেকর্ড থামল। সবাই স্তব্ধ। অনিরুদ্ধদা বললেন, “এটা শুধু গান না—এটা একটা পূর্ণ প্রেমপত্র। আমি চাই এই গানটাই নাটকের কেন্দ্রে থাকুক।”

ঊর্মির চোখে তখন জল। সে আস্তে বলল, “তুমি জানো, সত্যক, আজ প্রথমবার ইচ্ছে করছে চিঠিটা খুলে পড়ি। কারণ আজ মনে হচ্ছে কেউ একজন আমার হয়ে সেই চিঠির জবাব গেয়েছে।”

সত্যক কিছু বলল না। শুধু চুপচাপ হারমোনিয়ামের কভারটা চাপা দিল। মনে মনে ভাবল—শব্দ দিয়ে নয়, সুর দিয়েই সম্পর্কের চিঠিগুলো লেখা উচিত।

সন্ধ্যার দিকে আকাশে আবার মেঘ জমেছে। দুজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ক্লাবঘরের ছাদে। দূর থেকে বজ্রপাতের শব্দ আসছে। বৃষ্টি নামেনি এখনও।
ঊর্মি বলল, “তুমি গান লিখো না কেন?”
সত্যক বলল, “তুমি চিঠি পড়লে, আমি গান লিখব।”

পর্ব ৬

কলকাতার আকাশ আজ সকাল থেকে বড্ড গম্ভীর। না ঠিক মেঘলা, না একদম রৌদ্রোজ্জ্বল। যেন কোনো পুরোনো গান শুনে বুকটা ভার হয়ে আছে। ক্লাবঘরে যাওয়ার পথে সত্যক ভাবছিল—ঊর্মি চিঠিটা পড়বে কি না। গতকাল রেকর্ডিংয়ের পরে ওর চোখে যে আলোটা দেখা গিয়েছিল, সেটাকে কোনো ভাষায় বোঝানো যায় না, কেবল সুরেই বোঝা যায়।

আজকের রিহার্সাল একটু আলাদা। আজ মঞ্চে প্রেমের প্রথম দৃশ্য। নাটকে, মেঘলা যখন প্রথম বৃষ্টিধ্বনিকে ছুঁয়ে দেখে, তখন কীভাবে আবেগ বদলে যায়, সেই রসায়নটা তৈরি হবে আজ। অনিরুদ্ধদা আগেই সাবধান করে দিয়েছেন—“ভালোবাসা দেখানো সহজ, অনুভব করানো কঠিন। প্রেম শুধু সংলাপ নয়, কখনও সেটা এক সেকেন্ডের চোখাচোখি, কখনও নিঃশব্দে পাশে দাঁড়ানো।”

ঊর্মি এদিন কেমন চুপচাপ। মঞ্চে ওঠার আগে একবারও গলা সাধল না। সত্যক খেয়াল করল, ওর ব্যাগে সেই চিঠিটা নেই। হয়তো আজ সকালে পড়ে এসেছে।

রিহার্সাল শুরু হল। মঞ্চে আলো নেমে এল। দৃশ্য শুরু—একটা পুরোনো ট্রামে মেঘলা বসে আছে জানালার ধারে। বাইরে মেঘ, ভিজে শহর, আর ভিতরে বৃষ্টিধ্বনি—সত্যক—হঠাৎ উঠে এসে বলে—

“তুমি কি জানো, বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে গেলে শব্দ পেছনে থাকে না?”
ঊর্মি তাকায় না, শুধু বলে—
“তুমি কি প্রতিধ্বনি হতে চাও, না স্মৃতি?”
সত্যক ধীরে বলে—
“আমি একটা অসমাপ্ত গান, যে চিঠির উত্তরের অপেক্ষায়।”

আলো ঝাপসা হয়ে যায়। তারপর সত্যক গলা মেলায় এক নতুন গান—

“প্রথম বৃষ্টি, প্রথম ডাক
চুপিচুপি চিঠির পাতায়
তোমার নামে লেখা প্রেম
আমার সুরে ভেজে যায়…”

ঊর্মির চোখে জল এসে যায়। নাটক চলছে, কিন্তু সে জানে এই গানের কথা কেবল সংলাপ নয়। এই গান সেই চিঠির উত্তর, যা সে গতরাতে পড়ে ফেলেছে। চিঠিতে তার বাবা লিখেছিলেন—

“ঊর্মি, যদি কোনওদিন তুমি আবার গান গাও, জানবে, আমি আছি—তোমার গলার ভেতর, তোমার প্রতিটি প্রণয়ে, প্রতিটি প্রতীক্ষায়। ভুল হয়ে গিয়েছিল, ছেড়ে চলে গিয়ে। কিন্তু তুমি যদি কোনও একদিন আমাকে ক্ষমা করো, আমি জানি সেটা গানের মধ্যেই হবে।”

রিহার্সাল শেষে ঘরে ফিরে সত্যক ভাবছিল, আজকের গানটা সে কোথা থেকে পেল? কেউ শেখায়নি, লিখেওনি—এটা যেন হৃদয়ের ভেতর থেকে এসেছিল। এমন এক ভাষা, যা কেবল একজন বুঝতে পারে। সেই একজন—ঊর্মি।

রাত দশটার সময় ফোনে একটা মেসেজ এল—
ঊর্মি:
আজ আমি বাবার চিঠিটা পড়েছি। আর তারপর তোমার গানটা শুনেছি বারবার। মনে হল তুমি না গেয়েছ, আমার হয়ে কেউ কথা বলেছে। সত্যক, তুমি যদি লেখ, আমি গাই।

সত্যকের মুখে একটুকরো শান্ত হাসি ফুটে উঠল। জানালার বাইরে তখন হালকা ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে। সে জানে, ভালোবাসা সবসময় চুম্বন বা আলিঙ্গন চায় না—কখনও কখনও সেটা শুধু চিঠির মতো, যার উত্তর একটা সুরে লেখা হয়।

হারমোনিয়াম খুলে সে গাইতে শুরু করল—

“তুমি ছিলে এক চিঠি, আমি এক গান
দুটো আলাদা পৃষ্ঠা, একই দাগে খান…
আজ বর্ষার রাতে সেই পৃষ্ঠা মিলল
চুপিচুপি তোমার নামে আমার সুর লিখল…”

পর্ব ৭

সকালে ক্লাবঘরের দরজা খুলতেই সত্যক দেখল ভেতরটা যেন অন্যরকম। চেনা আলোর বদলে একটু কোমল আলো জ্বলছে, মেঝেতে কার্পেট বিছানো, এক কোণে রাখা ফুলদানিতে সাদা কদমফুল।
ঊর্মি আগেই এসে বসে আছে মঞ্চের পেছনে। ওর হাতে একটা নোটবুক, সাদা পৃষ্ঠায় কিছু লেখা—মাঝে মাঝে গলার নিচে আঙুল রাখছে, কিছু শব্দ বারবার পড়ছে ঠোঁটে।

সত্যক আস্তে গিয়ে বলল, “আজকের সকালটা বড্ড গম্ভীর মনে হচ্ছে।”
ঊর্মি চমকে তাকাল। “না, আজ শুধু আগের দিনের মতন নয়। আজ নিজের লেখা গান প্রথম গাইব মঞ্চে। আর জানো? গানটা তোমার জন্য।”

সত্যক একটু থমকে গেল। “আমার জন্য?”
ঊর্মি হেসে বলল, “হ্যাঁ। তুমি না থাকলে আমি হয়তো বাবার চিঠিটা খুলতাম না, আর সেই চিঠি না পড়লে এই গানটা জন্ম নিত না।”

অনিরুদ্ধদা এসে গম্ভীর গলায় বললেন, “আজ নাটকের সেই মুহূর্ত—যখন বৃষ্টিধ্বনি আর মেঘলা একে অপরের সামনে সত্যিটা কবুল করে। প্রেম, অভিমান, আর ক্ষমার সুর একসঙ্গে বাজবে। গানটা হবে একরকম মুক্তি।”

রিহার্সাল শুরু হল। সত্যক মঞ্চের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। স্ক্রিপ্টে লেখা:
“বৃষ্টিধ্বনি এসে মেঘলার সামনে দাঁড়ায়। বলে না কিছু, শুধু তার গলার সুরে প্রশ্ন রাখে। আর মেঘলা তখন গানে উত্তর দেয়।”

ঊর্মির কণ্ঠে সেই নতুন গান—

“তুমি ছিলে দূরে, কিন্তু শব্দ ছিল পাশে
আমি শুনেছি, না শোনার ভান করেছি…
আজ যদি বলো, আমি গাই
তোমার প্রতিটি না-বলা কথার সুর হয়ে থাকি…”

গান শেষ হতে না হতেই সত্যক বলল, “তুমি জানো, একটা গান কবে শেষ হয়?”
ঊর্মি তাকাল।
“যখন সে আর কাউকে খুঁজে পায় না। কিন্তু আজ তোমার গানে আমি নিজেকে খুঁজে পেলাম। তাই এই গানটা কখনই শেষ হবে না। প্রতিবার বর্ষা এলে, এ গানের আবার শুরু হবে।”

অনিরুদ্ধদা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “বাঃ। আমি এমন সংলাপ চাইনি স্ক্রিপ্টে, কিন্তু এখন আর কাটব না। এটা থেকেই যাবে। কারণ, জীবনের মতো নাটকও মাঝে মাঝে নিজেই তার শব্দ লিখে ফেলে।”

রিহার্সাল শেষে সবাই拍 হাততালি দিল। কেউ কেউ বলল, “এই নাটকটা শুধু নাটক নয়, একটা অনুভব।”

সন্ধ্যায় সত্যক আর ঊর্মি ছাদে উঠল। আকাশে তখন হালকা মেঘ, আলো কমছে ধীরে ধীরে।
ঊর্মি বলল, “তুমি জানো, সত্যক, আমি ভয় পাই। নাটক শেষ হলে হয়তো এই অনুভবটা হারিয়ে যাবে।”
সত্যক বলল, “গান যদি একবার জন্ম নেয়, সেটা হারায় না। শুধু সময় পেলে আবার ফিরে আসে। যেমন বৃষ্টি, যেমন প্রেম, যেমন তুমিও।”

ঊর্মি চুপ করে তার দিকে তাকাল। তারপর বলল, “তাহলে নাটকটা শেষ হওয়ার পর আমরা নতুন গান শুরু করব, তাই তো?”
সত্যক বলল, “হ্যাঁ, আগের দিনের মতন নয়—একদম নতুন করে। এবার আমরা মিলে লিখব, মিলে গাইব।”

নীচে ক্লাবঘরে আলো জ্বলেছে। পোস্টারে লেখা নাটকের নামটা এবার সত্যিকারের হয়ে উঠেছে—
“সুরে ভেজা দিনগুলি”—এক গল্প, এক চিঠি, এক প্রেম, যা বর্ষার মতো ফিরে ফিরে আসে।

পর্ব ৮

নাটকের দিন। ধানসিড়ি ক্লাবঘরের সামনের ছোট্ট মঞ্চ আজ আলোকিত, ছাতার মতো ছাউনির নিচে বসে একরাশ মানুষ। কারও হাতে ফুল, কারও চোখে উৎসাহ, কারও মুখে কান্না চেপে রাখা উত্তেজনা। কলকাতার আকাশ আজ শান্ত, যেন বৃষ্টি নিজেও অপেক্ষা করছে এই সুরময় সন্ধ্যার জন্য।

সত্যক ব্যাকস্টেজে দাঁড়িয়ে, ধাতব গলার মধ্যে হাত বুলিয়ে নিচ্ছে। মঞ্চে নামার আগে আজ আর নার্ভাস লাগছে না, বরং একরকম মিষ্টি টান টান অনুভূতি—যে অনুভব শুধু তখনই আসে যখন কেউ নিজের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে অন্য কারও হয়ে দাঁড়ায়।

ঊর্মি সাদা শাড়িতে। চুলে কদমফুল, চোখে কালো কাজল, ঠোঁটে একটুকরো গান। ওর চরিত্র—মেঘলা—আজ মঞ্চে সবার সামনে নিজের সমস্ত অপেক্ষা, অভিমান, ভালোবাসা খুলে দেবে।

অনিরুদ্ধদা চুপচাপ দাঁড়িয়ে। তিনি শুধু বললেন, “ভয় নেই। আজ তোমরা গাইবে, আর বাকি আমরা শুনব। মঞ্চ নয়, আজ তোমাদের হৃদয় হচ্ছে নাটকের আসল কেন্দ্র।”

পর্দা উঠল।

প্রথম দৃশ্য—সাদা আলোয় সত্যক একা দাঁড়িয়ে হারমোনিয়াম নিয়ে গাইছে—
“যেখানে তোমার ছায়া পড়ে,
সেখানেই আমি বৃষ্টি খুঁজি…”

ঊর্মি মঞ্চে প্রবেশ করে। চোখে একরাশ ঝড় পেরোনো ক্লান্তি। দর্শক নিঃশব্দ। কারও গলা শুকিয়ে আসছে, কারও চোখের কোণে জল জমছে।

দ্বিতীয় দৃশ্য—চিঠির গান।
ঊর্মি গাইছে—
“তুমি যদি লিখো, আমি গাই
তোমার প্রতিটি নীরবতা আমার সুর হয়ে থাকুক…”

আর সত্যক সেই সুরে মেলাচ্ছে তার গলা।
“তুমি চলে যাওয়া নয়, ফিরে আসার প্রতিধ্বনি।
আমি সেদিকেই চেয়ে থাকি, যেখানে তুমি গানের মতো ভেসে আসো…”

শেষ দৃশ্য—আলো ম্লান, বৃষ্টির শব্দ প্লেব্যাকে। সত্যক আর ঊর্মি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। সত্যক বলে,
“তুমি কি জানো, বৃষ্টি সব সময় ভেজায় না?
কখনও সে মনে রেখে যায়, গান হয়ে থাকে।”

ঊর্মি ধীরে বলে,
“তাহলে এই ভালোবাসাটাও সুরে ভিজে থাকুক,
নাটক শেষ হলেও—আমাদের গল্প চলুক…”

পর্দা নামে। হাততালির ঝড়। কেউ উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে, “বাহ্! কী অপূর্ব!”
অনিরুদ্ধদার চোখে জল। তিনি বললেন, “আজ আমার শিক্ষকতা সার্থক। গান শুধু গান নয়, ভালোবাসা, স্মৃতি আর ক্ষমার ভাষা হয়ে উঠেছে আজ।”

সত্যক আর ঊর্মি এক কোণে দাঁড়িয়ে। দূর থেকে কেউ একটা কদমফুল ছুড়ে দিল মঞ্চের দিকে। সত্যক বলল, “এটা হয়তো আমার মায়ের পক্ষ থেকেও একটা আশীর্বাদ।”
ঊর্মি হাত ধরল সত্যকের। “আজকের পর, আমরা আর আগের মতো থাকব না।”
সত্যক বলল, “না। কারণ এখন আমরা একসঙ্গে গাই।”

রাত দশটায় ক্লাবঘর ফাঁকা হয়ে গেল। আলো নিভে এল। সত্যক আর ঊর্মি ছাদে উঠে শেষবারের মতো শহরটাকে দেখল। আকাশে তখন নতুন মেঘ জমছে।
ঊর্মি বলল, “আবার বৃষ্টি নামবে। তবে এবার আমরা আলাদা হব না।”
সত্যক হেসে বলল, “না। এবার আমরা একসঙ্গে সেই সুর লিখব, যেটা পরের বছর বর্ষায় নতুন নাটক হবে।”

নিচে তখনও ক্লাবঘরের জানালায় একটা আলো জ্বলছে। মেঝেতে পড়ে আছে সেই পোস্টার—
“সুরে ভেজা দিনগুলি”
পাশে ছোট করে লেখা,
“একটা অসমাপ্ত গান, যেটা শেষ হয় ভালোবাসার মধ্যে।”

(শেষ)

Lipighor_1750507440061.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *