Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

সুবর্ণযাত্রা

Spread the love

ঐশানী সেন


পর্ব : দাসীর যাত্রা শুরু

আরাকানের ছোট্ট এক উপকূলগ্রাম। চারদিকে পাহাড় আর সমুদ্রের মিলন, নারকেল গাছের ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে থাকে কুটির। সেই গ্রামেই বাস করত কিশোরী মেয়ে মায়ারী। বয়স মাত্র ষোলো, চোখদুটো ঝকঝকে কালো, কপালে যেন সর্বদা একটা অবুঝ কৌতূহলের রেখা। মায়ারী ছিল মৎস্যজীবীর মেয়ে। প্রতিদিন সকালবেলা বাবার সঙ্গে সাগরে মাছ ধরতে যেত, মা ঝুড়ি বুনত আর ছোট ভাইটির যত্ন নিত। গ্রামজীবন ছিল সরল, অথচ সাগরের অনিশ্চয়তা সর্বদা তাদের বুকে ভয় জাগিয়ে রাখত।

সেই ভয়াবহ রাতটা আজও গ্রামের লোকেরা ভুলতে পারেনি। দূর সমুদ্র থেকে হঠাৎ কিছু অচেনা পালতোলা জাহাজ এসে ভেড়ে। ওরা ছিল পর্তুগিজ দাসব্যবসায়ী। আগুন লাগানো হয় কুটিরে, যারা প্রতিরোধ করে তাদের শিকল পড়িয়ে ধরে নিয়ে যায়। মায়ারীর চোখের সামনে পুড়ে যায় তার বাবার নৌকা, আগুনে অদৃশ্য হয় মায়ের চিৎকার। হঠাৎ এক মোটা হাত তার গলা চেপে ধরে, আরেকটি হাত তার কোমরে শিকল বেঁধে ফেলে। সমস্ত পৃথিবী যেন মুহূর্তে অন্ধকার হয়ে আসে।

পরদিন ভোরে সে নিজেকে খুঁজে পেল এক অদ্ভুত কাঠের ঘরে— জাহাজের গাঢ় অন্ধকার নীচতলায়। চারপাশে একঝাঁক অচেনা মুখ, কারো চোখে ভয়, কারো চোখে কান্না জমে আছে। লবণাক্ত জল আর ঘামের গন্ধে ভরা সেই অচিন্তনীয় পরিবেশে মায়ারীর শ্বাসরোধ হয়ে আসছিল। সে বুঝে গেল— তাদের সবাইকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দাস হিসেবে বিক্রি করার জন্য।

উপরতলায় নাবিকদের চিৎকার ভেসে আসছিল। কেউ পর্তুগিজে হুকুম দিচ্ছে, কেউ আবার বাংলার ভাঙা উচ্চারণে বন্দীদের গালমন্দ করছে। মায়ারীর কানে শব্দগুলো পরিষ্কার না হলেও ভয়ের মানে সে ঠিকই বুঝতে পারছিল। মাঝে মাঝে ভারী পায়ের শব্দ নেমে আসত সিঁড়ি দিয়ে, লোহার চাবুক ঝলসে উঠত যে কোনো বন্দীর পিঠে।

প্রথম কয়েক দিন কেটে গেল অবিশ্বাস্য আতঙ্কের মধ্যে। কচি বয়সেই মায়ারী বুঝতে পারল— এখানে কাঁদলে লাভ নেই। চোখ শুকিয়ে গিয়ে যেন পাথর হয়ে উঠল তার ভেতর। একবার এক বৃদ্ধা তাকে বলল ফিসফিস করে, “ভগবানকে ডাকো মা। সমুদ্রের বুকেও তাঁর কান আছে।” মায়ারী অর্ধেক বিশ্বাস, অর্ধেক অন্ধ ভয়ের মধ্যে সেই অচেনা ভগবানকে ডাকা শুরু করল।

জাহাজের ওপরে মাঝে মাঝে আকাশ দেখা যেত। একদিন প্রহরীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে মায়ারী দড়ির ফাঁক দিয়ে তাকাল। নীল আকাশ, দিগন্তজোড়া সমুদ্র, উড়ে চলা সাদা পাখিরা— সবকিছু এত অচেনা অথচ মায়াবী। মনে হল, এই দিগন্ত হয়তো তার জন্যও খোলা, যদিও এখন সে বন্দী।

কিন্তু সমুদ্র বড় নিষ্ঠুর। এক রাতে হঠাৎ বজ্রপাত আর ঝড়ের তাণ্ডব শুরু হল। জাহাজ দুলতে লাগল ভয়ানকভাবে। বন্দীদের মধ্যে হাহাকার উঠল। কেউ প্রার্থনা করছে, কেউ আবার শিকল ভেঙে পালাতে চাইছে। মায়ারী আঁকড়ে ধরল কাঠের খুঁটি, বুকের ভেতর শুধু একটাই শব্দ— “বাঁচতে চাই, বাঁচতে চাই।”

ঝড় সামলে জাহাজ আবার ভেসে উঠলেও চারদিকে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এল। প্রহরীরা কয়েকজন মৃতদেহ টেনে বাইরে ফেলে দিল সমুদ্রে। তখনই মায়ারীর মনে হল— তার ভাগ্য বোধহয় এখানেই শেষ হবে না। কোথাও না কোথাও এই অমানুষিক যাত্রার গন্তব্য আছে।

এরই মাঝে সে পরিচিত হল আরেক তরুণ বন্দীর সঙ্গে— নাম রহিম, বয়স সতেরো। ও ছিল বাংলার চট্টগ্রাম থেকে ধরা পড়া। রহিম মৃদু গলায় তাকে বাংলা শেখাতে লাগল— “পানি মানে জল, খাই মানে খাওয়া।” ধীরে ধীরে ভাষার ফাঁক পেরিয়ে দু’জনের মধ্যে জন্ম নিল এক অদৃশ্য সখ্যতা। অন্ধকার নীচতলায় তারা স্বপ্ন দেখতে শুরু করল— একদিন মুক্ত হয়ে আবার মাটির ঘরে ফিরে যাবে।

কিন্তু সমুদ্রের যাত্রা এত সহজ নয়। বন্দীদের ফিসফিসানিতে খবর ছড়াল— এই জাহাজ যাচ্ছে বাংলার হুগলির বন্দরঘাটে। সেখানে নাকি পর্তুগিজরা তাদের বিক্রি করে দেবে বণিকদের হাতে। মায়ারীর মনে ভয় ঢুকে গেল আবার। মুক্তি মানে কি তবে অন্য এক শৃঙ্খল?

তার চোখের সামনে ভেসে উঠল নিজের গ্রাম, মা-বাবার মুখ, সেই ছোট ভাইয়ের হাসি। বুকের ভেতর হাহাকার জমে গেল। তবুও সে নিজেকে শক্ত করল। মনে মনে বলল— “যেখানেই যাই, আমি বাঁচব। আমি একদিন স্বাধীন হব।”

রাত গভীর হলে ঢেউয়ের শব্দে আচ্ছন্ন অন্ধকারে সে আকাশের দিকে তাকাল। তার চোখে তখন জ্বলছিল এক অদম্য দীপ্তি। দাসীর যাত্রা শুরু হয়ে গেছে— আর সেই যাত্রাই হয়তো ইতিহাসের পাতা বদলে দেবে।

পর্ব : জাহাজের বন্দীজীবন

জাহাজের ভেতরের নীচতলা যেন অন্ধকার গুহা। কাঠের খুঁটি, শিকল আর স্যাঁতসেঁতে গন্ধে ভরে থাকে চারপাশ। মায়ারী প্রথম কয়েক দিন মনে করেছিল হয়তো মৃত্যুই একমাত্র পরিণতি। কিন্তু দিন যেতে যেতে সে বুঝল, এখানে মৃত্যু আসছে ধীরে ধীরে— ক্ষুধা, রোগ আর অবহেলার পথ ধরে।

সকালে একবার আর রাতে একবার বন্দীদের গলা ভরে দেওয়া হত গুঁড়ো চালের ভাত, তাতেও পাথর আর কাঁকরের মতো শক্ত দানা লেগে থাকত। জলের বদলে দেওয়া হত লবণাক্ত তরল, যেটা খেলে পেট আরো খারাপ হয়ে যেত। অনেকেই সেই জল খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ত, কেউ কেউ কাশির দমকে শুয়ে শুয়েই নিস্তেজ হয়ে যেত। মৃতদেহগুলো প্রহরীরা টেনে নিয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ে ছুড়ে ফেলত। একটা শরীর জলে ভাসতে ভাসতে অদৃশ্য হলে বাকিরা ঠাণ্ডা আতঙ্কে চুপচাপ তাকিয়ে থাকত।

মায়ারী সেই দৃশ্যগুলো একেবারে চোখ মেলে দেখত না। তার বুক কেঁপে উঠত, কিন্তু সে নিজের মনে স্থির করে নিয়েছিল— আমি মরব না। আমার দেহটা আমি বাঁচিয়ে রাখব। আমি আবার মাটির গন্ধ পাব।

রহিমও তাকে বারবার সাহস দিত। বলত, “মায়ারী, ভয় পেও না। এরা আমাদের কোথাও নিয়ে যাচ্ছে, বিক্রি করবে ঠিকই, কিন্তু তাতে জীবন অন্তত থাকবে। জীবন থাকলে একদিন মুক্তিও আসবে।”

ওর কথায় আশার আভাস থাকলেও, প্রতিদিনের যন্ত্রণা আশাকে ঢেকে দিতে চাইত। বন্দীদের এক সারিতে বসিয়ে রাখা হত, পিঠে চাবুকের দাগ থাকত অনেকের। কোনো বন্দী একটু জোরে কাঁদলে বা চিৎকার করলে প্রহরীরা সাথে সাথে চাবুক নামাত। সেই শব্দটা যেন চামড়ার ভেতর দিয়ে হাড় পর্যন্ত কেটে যেত।

একদিন এক তরুণী বন্দী অসুস্থ হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। তার গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছিল না। প্রহরীরা এসে তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে শিকল কেটে দিল, তারপর মৃত মনে করে ফেলে দিল উপরের ডেকে। মায়ারীর বুকের ভেতর ভয়ংকর শূন্যতা তৈরি হল। সে নিজেকে প্রতিজ্ঞা করল— কিছু হোক, আমি এই অন্ধকারে পড়ে থাকব না, আমাকে বাঁচতে হবে।

রাতগুলো ছিল আরো কঠিন। ঢেউয়ের শব্দ, কাঠের কর্কশ কেঁপে ওঠা, আর অন্ধকারে বন্দীদের চাপা কান্না। কেউ কেউ প্রার্থনা করত নিজের ঈশ্বরকে ডেকে— কেউ বুদ্ধকে, কেউ আল্লাকে, কেউ শিব-কালিকে। মায়ারীও গোপনে ঠোঁট নড়াত। কাকে ডাকে জানত না, তবু ডাকত— “আমাকে বাঁচাও।”

কখনো কখনো প্রহরীরা নিচে নেমে আসত মদের নেশায় টলতে টলতে। বন্দীদের নিয়ে কটূক্তি করত, কারো মাথায় লাথি মারত, কারো কাপড় টেনে হাসত। সেই মুহূর্তগুলোই ছিল সবচেয়ে অপমানজনক। মায়ারী তখন চোখ বন্ধ করে বসে থাকত, যাতে কেউ তার দিকে দৃষ্টি না দেয়।

তবুও অদ্ভুতভাবে মানুষেরা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে শুরু করেছিল। যে বৃদ্ধা একদিন মায়ারীকে ভগবানের কথা বলেছিল, সে মাঝে মাঝে ওকে আঁকড়ে ধরত— “মা, ভয় পেও না, তুই আমার মেয়ের মতো।” আরেকজন পুরুষ বন্দী চুপচাপ গান গাইত, অচেনা ভাষায়, হয়তো নিজের গ্রামের সুর। সেই সুরের ভেতর লুকিয়ে থাকত স্মৃতি, আর সেই স্মৃতিই তাদের বাঁচিয়ে রাখত কিছুটা।

মায়ারীর ভিতরেও স্মৃতি খেলে যেত। বাবার হাসি, মায়ের রান্নার গন্ধ, ভাইয়ের দুষ্টুমি। অন্ধকারেও সে অনুভব করত গ্রামের সকালের আলো, সমুদ্রের তীরে ছুটে যাওয়া বাতাস। সেইসব স্মৃতি তার চোখে জল আনলেও, একইসাথে বুকের ভেতর শক্তি জাগাত।

কিছুদিন পর বন্দীরা টের পেল জাহাজ ধীরে ধীরে পশ্চিম দিকে এগোচ্ছে। হাওয়া বদলেছে, প্রহরীদের কথাবার্তায় নতুন নাম শোনা গেল— “হুগলি।” রহিম ফিসফিস করে বলল, “ওরা আমাদের বাংলার এক বন্দরঘাটে নিয়ে যাচ্ছে। ওখানেই নাকি এরা বিক্রি করে।” মায়ারী শোনামাত্রই কেঁপে উঠল। অচেনা শহর, অচেনা মানুষ— তার সামনে আবারও এক নতুন ভাগ্য অপেক্ষা করছে।

তবুও বন্দীদের ভেতর একটা নতুন সাড়া পড়ল। কিছুজন মনে করল, স্থলে পৌঁছালে অন্তত শিকল থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। কেউ আবার বলল, “ওখানে হয়তো কাজ করানো হবে, কিন্তু খাবার মিলবে। অন্তত এভাবে শুয়ে শুয়ে মরতে হবে না।”

এইসব কথার ভেতরেও মায়ারী টের পাচ্ছিল— তাদের ভাগ্য বাণিজ্যের হিসাবের খাতায় লেখা হচ্ছে। তাদের জীবন মানে অন্য কারও মুনাফা। তবুও সে মনে মনে বলল— “আমি কারও পণ্য নই। আমি মানুষ। আমি একদিন পালাব।”

এক রাতে আকাশ ছিল নির্মল, জানলার ফাঁক দিয়ে অল্প তারার আলো ঢুকেছিল। রহিম মায়ারীর পাশে বসে বলল, “তুই কি জানিস, তারার পথ ধরে নাবিকরা দিক ঠিক করে?” মায়ারী অবাক হয়ে তাকাল। ও আগে এসব জানত না। রহিম তার গ্রামের কথা বলতে শুরু করল— নদী, খেজুরগাছ, মায়ের ডাকা আজান। মায়ারীও বলতে লাগল তার গ্রামের কথা— নারকেল গাছ, সমুদ্রের ঢেউ, ভাইয়ের দুষ্টুমি।

অন্ধকারে দু’জনের কথোপকথন যেন তাদের জীবিত রাখল। পরদিন প্রহরীরা যখন চিৎকার করে খাবার ছুড়ে দিল, তখন মায়ারীর মনে হল— সে কেবল নিজের জন্য নয়, রহিমের জন্যও বাঁচতে হবে।

কিন্তু বন্দীদশার নিষ্ঠুরতা থামছিল না। একদিন হঠাৎ একজন প্রহরী নীচে নেমে এসে বিনা কারণে এক ছেলেকে চাবুক মারতে লাগল। ছেলেটি চিৎকার করতে করতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। সবাই নিশ্চুপ হয়ে দেখল, কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পেল না। মায়ারী তখন নিজের মুঠি আঁকড়ে ধরল। ভেতরে ভেতরে সে নিজেকে শক্ত করছিল।

দিনগুলো ক্রমে একই রকম— খিদে, ভয়, প্রহার আর অপেক্ষা। তবুও মায়ারী বুঝল, মানুষ কত শক্তিশালী হতে পারে। একসময় যে সে ভয়ে কাঁপত, এখন সে নিজের কান্না দমিয়ে রাখতে শিখেছে। সে শুধু ভাবে, “যতক্ষণ শ্বাস আছে, আমি হার মানব না।”

সমুদ্রের বুকের এই দীর্ঘ বন্দীজীবন ধীরে ধীরে তাকে নতুন মানুষ করে তুলছিল। ভয় তাকে দমিয়ে রাখছিল ঠিকই, কিন্তু বুকের ভেতর জন্ম নিচ্ছিল এক অদ্ভুত সাহস। অন্ধকারের ভেতরেই সে টের পাচ্ছিল— তার যাত্রা কেবল বেঁচে থাকার নয়, নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করারও।

পর্ব : জলদস্যুদের আক্রমণ

দিনের পর দিন সমুদ্রের বুক চিরে এগিয়ে চলেছে জাহাজ। বন্দীদের জীবন যেন স্থির হয়ে গেছে—সকাল-বিকেল একটুখানি ভাত, লবণাক্ত জল, আর শিকল-ঝংকারে মোড়া অন্ধকার। তবুও প্রত্যেকের চোখে এক অদ্ভুত প্রতীক্ষা। কেউ ভাবে মৃত্যুর অপেক্ষা, কেউ ভাবে হয়তো মুক্তির, আবার কেউ কেবল ভাবতে চায় না কিছুই।

মায়ারীর মনে কেমন যেন অস্থিরতা জমে উঠছিল। আকাশে হাওয়া বদলাচ্ছিল, প্রহরীদের আচরণেও টানটান সতর্কতা। রাত হলে তারা বারবার মশাল হাতে ডেকের দিকে উঠে যাচ্ছিল। নিচে বসে থাকা বন্দীরা বুঝতে পারছিল না কী ঘটছে, কিন্তু ঢেউয়ের তীব্র শব্দে বুক কেঁপে উঠছিল সবার।

এক রাতে হঠাৎ করেই অচেনা গর্জন ভেসে এল সমুদ্র থেকে—ঢোলের মতো আওয়াজ, তারপর ভেসে এল চিৎকার। বন্দীরা একে অপরের দিকে তাকাল। রহিম ফিসফিস করে বলল, “ওরা জলদস্যু… হয়তো আরবরা।”

হঠাৎ উপরের দিক থেকে ধুপধাপ শব্দ নামতে লাগল। গর্জনময় আওয়াজে বন্দুক ছোঁড়া হচ্ছে। জাহাজ দুলতে শুরু করল প্রচণ্ডভাবে। বন্দীদের বুক কেঁপে উঠল। অন্ধকারে কান্না, প্রার্থনা আর চিৎকার একসাথে মিশে গেল। মায়ারী চোখ বন্ধ করে কাঠের খুঁটি আঁকড়ে ধরল, মনে হচ্ছিল যেকোনো মুহূর্তে সবকিছু ভেঙে পড়বে।

ডেকের ওপর শুরু হল রক্তক্ষয়ী লড়াই। প্রহরীরা বন্দুক আর তলোয়ার হাতে প্রতিরোধ করছে, আরব জলদস্যুরা ছোট নৌকা ভরে উঠে পড়েছে জাহাজে। তাদের মাথায় পাগড়ি, চোখে ভয়ংকর দীপ্তি, হাতে বাঁকা তরবারি। তলোয়ারের ঝলক আর মানুষের আর্তনাদ মিলে ভেসে আসছিল নিচে।

হঠাৎ এক বিস্ফোরণ কেঁপে দিল গোটা জাহাজ। বন্দীরা ছিটকে পড়ল এদিক-ওদিক। মায়ারীর কানে গর্জন, চিৎকার, আর ধোঁয়ার গন্ধ। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। রহিম চিৎকার করে বলল, “মায়ারী, মাথা নিচু কর!” দু’জনেই মাটিতে গা এলিয়ে রাখল।

কিছুক্ষণ পরেই অন্ধকারে দরজা ভেঙে পড়ল। দু’জন আরব জলদস্যু ঢুকে পড়ল। তাদের চোখে হিংস্র ক্ষুধা। বন্দীদের দিকে তাকিয়ে তারা চেঁচিয়ে উঠল অচেনা ভাষায়। শিকল ভাঙতে শুরু করল। ভয় আর উত্তেজনায় বন্দীরা ছুটে গেল আলোর দিকে। কেউ উপরের ডেকে দৌড় দিল, কেউ আবার সমুদ্রের ঢেউয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

মায়ারী স্থির দাঁড়িয়ে ছিল। সে জানত—অচেনা হাতে ধরা পড়া মানেই হয়তো আবার অন্য এক দাসত্ব। কিন্তু পালানোর সুযোগ থাকলেও সে সমুদ্রের বুকের দিকে ঝাঁপ দিতে পারল না। তার বুকের ভেতর তখন শুধু একটা আওয়াজ—“আমি মরতে চাই না।”

হঠাৎ এক জলদস্যুর চোখ পড়ে তার দিকে। সে এগিয়ে এসে শিকল টেনে ছিঁড়ে দিল। মুহূর্তেই মায়ারীর শরীরে একটা জোরালো ধাক্কা লাগল। জলদস্যু তাকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছিল। ভয়, লজ্জা আর অমানিশার মধ্যে মায়ারীর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল।

ঠিক তখনই আরেকজন জলদস্যু এসে দাঁড়াল তার সামনে। বয়সে তরুণ, চোখে অদ্ভুত এক দয়া। সে হাত বাড়িয়ে মায়ারীকে দাঁড় করাল, তারপর অন্যজনকে কিছু একটা কঠিন স্বরে বলল। দুইজনের মধ্যে ঝগড়া শুরু হল। শেষে তরুণ জলদস্যুটি মায়ারীকে পাশে টেনে রাখল, যেন তাকে রক্ষা করছে।

মায়ারী কিছুই বুঝতে পারছিল না। তার বুক কাঁপছিল, শরীর শিউরে উঠছিল। কিন্তু সেই তরুণের চোখে অদ্ভুত এক দৃঢ়তা ছিল। মনে হচ্ছিল, অন্তত এই মুহূর্তে সে মায়ারীর ক্ষতি হতে দেবে না।

ডেকের ওপর তখনো লড়াই চলছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে কাঠের মেঝে, চিৎকারে ফেটে পড়ছে আকাশ। বন্দীরা দিকভ্রান্তের মতো দৌড়াচ্ছে। কেউ সমুদ্রে ঝাঁপ দিচ্ছে, ঢেউ সঙ্গে সঙ্গে গিলে ফেলছে।

মায়ারীকে নিয়ে তরুণ জলদস্যুটি ডেকের এক কোণে দাঁড়াল। সেখান থেকে সমুদ্রের অসীম অন্ধকার দেখা যাচ্ছিল। ঢেউ একের পর এক ধাক্কা মারছে জাহাজে। বজ্রপাত আকাশ চিরে ফেলছে। মায়ারী ভয়ে কাঁপলেও টের পাচ্ছিল—তার হাত শক্ত করে ধরা আছে।

ঘণ্টাখানেক ধরে যুদ্ধ চলল। অবশেষে আরব জলদস্যুরা জয়ী হল। প্রহরীদের অনেকেই মারা গেল, কেউ কেউ সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পালাল। বন্দীরা একে অপরকে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল। জলদস্যুরা জাহাজের দখল নিল।

কিন্তু জয়লাভের পরই নতুন ভয়ের শুরু হল। জলদস্যুরা বন্দীদের দিকে তাকাল শিকারির মতো চোখে। অনেককে আবার শিকল পরিয়ে ফেলল। কেউ কেউ জোর করে টেনে নিয়ে গেল ওপরের কেবিনে। মায়ারীর বুক আবার থমথমে হয়ে উঠল। সে ভেবেছিল হয়তো এবারই শেষ।

কিন্তু সেই তরুণ জলদস্যু তাকে নিজের আড়ালে রাখল। চুপচাপ বলল অচেনা ভাষায় কিছু একটা, যেটার অর্থ মায়ারী বুঝতে না পারলেও টোন শুনে মনে হল—আশ্বাস দিচ্ছে। তার ঠোঁট কেঁপে উঠল, বুকের ভেতর কান্না জমে গেল। সে শুধু মাথা নোয়াল।

রাতের শেষে যুদ্ধ থেমে গেল। জাহাজ কাত হয়ে ধীরে ধীরে ভেসে চলল। আকাশে তখনও মেঘের দল ভাসছে। চারদিকে রক্ত আর বারুদের গন্ধ, সমুদ্রের ঢেউ যেন সবকিছু ধুয়ে নিতে চাইছে।

মায়ারী সেই রাতে আর ঘুমোতে পারল না। চোখের সামনে ভাসছিল তলোয়ারের ঝলক, চিৎকার, আর অদ্ভুত সেই তরুণের চোখ। তার মনে হচ্ছিল—এক ভীষণ অমানিশার ভেতরেও হয়তো কারও দয়া এখনও বেঁচে আছে।

ভোরের আলো ফুটল সমুদ্রের বুক জুড়ে। বন্দীরা ক্লান্ত, ভীত আর অনিশ্চিত। জলদস্যুরা দখল নেওয়ার আনন্দে হৈচৈ করছে। আর মায়ারী দাঁড়িয়ে আছে ডেকের এক কোণে, যেখানে আকাশ আর সমুদ্র মিলেছে। তার বুকের ভেতর তখন এক অদ্ভুত অনুভূতি—ভয়, বিস্ময়, আর ক্ষীণ এক আশার আলো।

সে জানত, যাত্রা এখনও শেষ হয়নি। বরং নতুন এক অধ্যায় শুরু হল।

পর্ব : ঝড়ের রাত

দিন কয়েক ধরে সমুদ্র অদ্ভুতভাবে শান্ত ছিল। বন্দীরা নিজেদের ভাগ্য মেনে নিয়ে নিশ্চুপ বসেছিল, আর আরব জলদস্যুরা জাহাজের ডেক দখল করে তলোয়ার ঝুলিয়ে হাঁটাহাঁটি করছিল। মাঝে মাঝে ওরা নিজেদের ভাষায় উল্লাস করে গান গাইত, সুরগুলো সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে মিশে অদ্ভুত কানে বাজত। তবুও শান্তি বলতে কিছুই ছিল না, কারণ প্রত্যেকেই জানত—এ শান্তি ঝড়ের আগের নিস্তব্ধতা হতে পারে।

মায়ারী মনে করেছিল, হয়তো জলদস্যুদের হাতে পড়ার পর আরও ভয়ংকর দিন আসবে। কিন্তু আশ্চর্যভাবে সেই তরুণ জলদস্যুটি তাকে রক্ষা করে চলেছিল। মায়ারী তার নাম জানতে পারেনি, ভাষাও বোঝেনি, শুধু চোখের দৃষ্টিতে টের পেয়েছিল—এই মানুষটি অন্তত তাকে ক্ষতি করবে না। মাঝে মাঝে সে খাবারের ভাগ থেকে একটু আলাদা করে তার দিকে এগিয়ে দিত, যেন অন্ধকারে এক ক্ষীণ আলো।

রহিমও মায়ারীর কাছ থেকে দূরে যায়নি। ওর সাহসী গলায় বলত, “দেখিস, মায়ারী, এরা যতই শক্তিশালী হোক, একদিন আমাদের কোথাও পৌঁছে নামাতেই হবে। তখন সুযোগ পেলে আমরা পালাব।” মায়ারী মাথা নাড়ত, কিন্তু বুকের ভেতর সবসময়ই ভয় আর অস্থিরতা গুমরে থাকত।

ঠিক সেই সময়েই সমুদ্রের চেহারা বদলাতে শুরু করল। প্রথমে আকাশে জমল কালো মেঘ। সূর্য ঢেকে গিয়ে চারপাশে ধূসর ছায়া নেমে এল। তারপর হাওয়া বাড়ল, জাহাজ দুলে উঠতে লাগল। জলদস্যুরা চেঁচাতে লাগল দড়ি টানতে, পাল নামাতে। বন্দীরা নীচে গাদাগাদি করে বসে বুঝতে পারছিল—এবার আসছে সেই ভয়ানক ঝড়, যার কথা তারা এতদিন শুনেছে।

ঝড় শুরু হল হঠাৎ করেই। বজ্রপাত আকাশ চিরে ফেলল, মেঘের গর্জনে সমুদ্র কাঁপতে লাগল। বিশাল ঢেউ একের পর এক ধাক্কা মারছিল জাহাজের গায়ে। কাঠের খুঁটি কেঁপে উঠছিল, যেন কোনো মুহূর্তেই ভেঙে পড়বে। অন্ধকারে বন্দীরা চিৎকার করছিল, কেউ প্রার্থনা করছিল, কেউ আবার নিজের মাথা ঠুকে ফেলছিল ভয়ে।

মায়ারী খুঁটির সঙ্গে আঁকড়ে ধরেছিল রহিমকে। তাদের শরীর ঠাণ্ডা ঘামে ভিজে যাচ্ছিল। বাতাস এত জোরে বইছিল যে নিশ্বাস নেওয়াই কষ্ট হচ্ছিল। উপরের ডেক থেকে ভেসে আসছিল নাবিকদের আর্তচিৎকার—“দড়ি ধরো! পাল বাঁচাও!”—কিন্তু ঝড়ের গর্জনের ভেতর সব শব্দ হারিয়ে যাচ্ছিল।

এক সময় বিশাল ঢেউ উঠে এসে জাহাজের অর্ধেক ঢেকে দিল। বন্দীদের উপর ছিটকে এল জল। কেউ কেউ ভেসে গেল অন্ধকারে। মায়ারীর মনে হল, এভাবেই হয়তো তারা সবাই ডুবে মরবে। সে চোখ বন্ধ করে কাঁপতে কাঁপতে প্রার্থনা করল—“যে আছিস, আমাকে বাঁচা।”

হঠাৎ এক প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে জাহাজ কাত হয়ে গেল। বন্দীরা গড়িয়ে পড়ল একে অপরের ওপর। অন্ধকারে কারো হাত কারো শরীর আঁকড়ে ধরল, সবাই কেবল বাঁচতে চাইছিল। মায়ারীর মাথা লেগে গেল কাঠের খুঁটিতে, সে অচেতন হয়ে পড়ার মতো অবস্থা। ঠিক তখনই রহিম তার হাত শক্ত করে ধরে টেনে তুলল।

ঝড় থামার কোনো লক্ষণ ছিল না। আকাশে একটার পর একটা বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল, ঢেউয়ের ফেনা ঝড়ের সঙ্গে মিশে সাদা আলো ছড়িয়ে দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল সমুদ্র যেন তাদের পুরোটা গ্রাস করতে চাইছে।

এমন সময় মায়ারীর কানে এল সেই তরুণ জলদস্যুর গলা। সে অচেনা ভাষায় চেঁচিয়ে কিছু বলছিল, বন্দীদের দিকে ইশারা করছিল যেন মাথা নিচু করে বসতে। তারপর নিজে এসে মায়ারীর সামনে দাঁড়াল, শরীর দিয়ে আড়াল করল তাকে। মায়ারীর বুক কেঁপে উঠল, সে জানত না কেন এই মানুষটি বারবার তাকে রক্ষা করতে চাইছে।

ঝড় চলল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কাঠের জাহাজ ভেঙে পড়বে ভেবে প্রত্যেকেই আতঙ্কে ছিল। মাঝে মাঝে ডেক থেকে পড়ে যাচ্ছিল কাঠের টুকরো, দড়ি ছিঁড়ে উড়ছিল বাতাসে। বন্দীদের মধ্যে কয়েকজন আবার নিস্তেজ হয়ে শুয়ে পড়েছিল। হয়তো তারা আর উঠতে পারবে না।

অবশেষে ভোরের আলো ফুটল। আকাশ ধীরে ধীরে ফ্যাকাশে হল, ঝড় কিছুটা থামল। সমুদ্র তখনও অশান্ত, কিন্তু অন্তত ভয়াবহ গর্জন থেমে এসেছে। বন্দীরা ক্লান্ত, ভিজে, কাঁপতে কাঁপতে শুয়ে রইল। কেউ কথা বলল না। মনে হচ্ছিল, তারা সবাই মৃত্যুর কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে, আর কেবল ভাগ্যের দয়া তাদের বাঁচিয়ে রেখেছে।

মায়ারী চোখ খুলে দেখল, আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা রোদ। ভেজা চুল থেকে জল গড়িয়ে পড়ছিল, ঠোঁট কাঁপছিল ক্লান্তিতে। কিন্তু বুকের ভেতর ধুকপুক করছিল এখনও। সে টের পেল—সে বেঁচে আছে। চারপাশে তাকিয়ে দেখল, রহিম এখনও তার হাত ধরে আছে, আর সেই তরুণ জলদস্যুটি কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে।

এই ঝড় যেন তাদের সবাইকে বদলে দিল। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে প্রত্যেকে একে অপরের দিকে নতুন চোখে তাকাল। মায়ারীর মনে হল—মানুষ কেবল নিজের জন্য বাঁচে না, কখনও কখনও অন্য কারও চোখে ভেসে ওঠা আশা তাকে বাঁচিয়ে রাখে।

কিন্তু ঝড় পেরিয়ে যাওয়ার পরও অস্থিরতা থামল না। সমুদ্রের বুক এখনও অচেনা। জাহাজ অর্ধেক ভেঙে গেছে, অনেক নাবিক মারা পড়েছে। জলদস্যুরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে দূর দিগন্তে তাকিয়ে আছে। হয়তো তারা নতুন কোনো বন্দরের খোঁজ করছে, যেখানে গিয়ে আবার বন্দীদের বিক্রি করবে।

মায়ারী জানত না সামনে কী আছে। কিন্তু ঝড়ের সেই রাত তাকে ভেতরে ভেতরে শক্ত করে তুলেছিল। এখন আর সে শুধু কাঁপতে কাঁপতে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছে না। তার চোখে ঝিলিক পড়েছে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা।

সে মনে মনে বলল—“যত ঝড় আসুক, যত ঢেউ গর্জাক, আমি মরব না। আমি বাঁচব। আমার যাত্রা শেষ হবে না এখনও।”

সমুদ্রের বুক তখন নিস্তব্ধ হলেও, মায়ারীর ভেতরে শুরু হয়ে গিয়েছিল এক নতুন যুদ্ধ—আত্মমুক্তির যুদ্ধ।

পর্ব : হুগলির ঘাটে পৌঁছানো

ঝড় থেমে যাওয়ার পর সমুদ্রের বুক যেন ক্লান্ত হয়ে নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছিল। ঢেউ তখনও উঁচু হচ্ছিল বটে, কিন্তু সেই ভয়ংকর গর্জন আর বজ্রপাতের সন্ত্রাস আর ছিল না। কয়েকদিনের ভ্রমণ শেষে বন্দীরা টের পেল, জাহাজ ধীরে ধীরে নদীর মোহনায় ঢুকছে। নোনাজল মিলছে মিঠে জলের সঙ্গে, হাওয়ায় ভেসে আসছে ভিন্ন রকমের গন্ধ—পাকা ধানের, ভিজে মাটির, আর মানুষের ভিড়ের।

প্রথম আলো ফুটতেই বন্দীরা শুনল—জাহাজের ডেক থেকে জলদস্যুরা চেঁচাচ্ছে, দূরে কোনো বন্দর দেখা যাচ্ছে। বন্দীরা একে অপরের চোখে তাকাল, ভয়ের সঙ্গে মিশে গেল অদ্ভুত উত্তেজনা। অচেনা এক শহর, অচেনা ভাগ্য—কিন্তু অন্তত সমুদ্রের অশেষ অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পাওয়া যাচ্ছে।

মায়ারী শিকলের আড়াল থেকে তাকাল বাইরে। আকাশে তখন লাল সূর্য উঠছে। সামনে নদীর বিস্তীর্ণ বুক জুড়ে ছোট ছোট নৌকা চলাফেরা করছে। কোথাও দেখা যাচ্ছে পাকা ঘাট, কোথাও আবার কাদার ধারে দাঁড়িয়ে মানুষ। দূরে এক বিশাল নগরীর আভাস—উঁচু মিনার, গম্বুজ আর গির্জার মতো সাদা দালান। রহিম মৃদু স্বরে বলল, “ওটাই হুগলি।”

হুগলি—মুঘল বাংলার ব্যস্ত বন্দরশহর। এখানে পর্তুগিজ, ডাচ, আরব, আর্মেনিয়ান, সব জাতির বণিকেরা আসে বাণিজ্যের জন্য। মশলা, কাপড়, রুপা, লবণ, এমনকি মানুষও বেচাকেনা হয় এখানে। বন্দীদের অনেকেই নাম শোনামাত্রই শিউরে উঠল। কারও চোখে আবার ক্ষীণ আশার আলো—হয়তো এখানে মুক্তি পাওয়া যাবে, হয়তো কোনো সদয় বণিক তাদের কিনে নিয়ে কাজ দেবে।

কিন্তু জাহাজ ঘাটে ভেড়ার আগে আবারও ভয়ের স্রোত বয়ে গেল। জলদস্যুরা বন্দীদের একে একে ওপরে তুলে আনল। তাদের শরীর ভিজে, ক্ষতবিক্ষত, চোখে অজানা আতঙ্ক। উপরে উঠে তারা প্রথমবার দেখল হুগলির ব্যস্ততা। ঘাটে তখন ভিড় লেগে আছে—মুঘল সৈন্য, পর্তুগিজ ব্যবসায়ী, বাংলার মাঝি, এমনকি কয়েকজন ইউরোপীয় গির্জার যাজকও দাঁড়িয়ে। সবাই কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে বন্দীদের দিকে।

মায়ারীর বুক কেঁপে উঠল। এত মানুষ, এত কোলাহল—তবুও সে নিজের মধ্যে একা। রহিম তার হাত ধরেছিল আঁকড়ে। তাদের চোখে তখন একটাই প্রশ্ন—এখন কী হবে?

ঘাটে নামতেই শুরু হল দরকষাকষি। জলদস্যুরা তাদের বিজয়ের গল্প বলতে লাগল, আর ব্যবসায়ীরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বন্দীদের শরীর দেখছিল। কার শরীর মজবুত, কার কাজ করার মতো শক্তি আছে—এই হিসেবেই তাদের দাম নির্ধারিত হচ্ছিল। যেন মানুষ নয়, গরু-ছাগল।

একজন মোটা পর্তুগিজ বণিক মায়ারীর দিকে আঙুল তুলে বলল কিছু। তার চোখে ছিল শিকারির দৃষ্টি। মায়ারী ভয়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে গেল। কিন্তু ঠিক তখনই সেই তরুণ জলদস্যুটি এগিয়ে এল, কিছুটা রূঢ় কণ্ঠে আপত্তি জানাল। দু’জনের মধ্যে কথাকাটাকাটি হল। শেষ পর্যন্ত মায়ারীকে সে বিক্রি হতে দিল না, বরং তাকে অন্য এক দলে ঠেলে দিল—যেখানে স্থানীয় বাঙালি বণিকেরা বন্দী কিনছিল।

কয়েক ঘণ্টা ধরে এভাবেই ভাগ হয়ে গেল বন্দীদের দল। রহিমকে নিয়ে গেল এক কৃষক, বলল মাঠে কাজ করাবে। মায়ারীর বুক ভেঙে গেল, কিন্তু চোখের জলে সে বিদায় জানাল। রহিম চুপচাপ মাথা নোয়াল, যেন নিঃশব্দে প্রতিজ্ঞা করল—“আবার দেখা হবে।”

অবশেষে মায়ারীকে কিনে নিল এক ধনী বাঙালি বণিক। বয়স পঞ্চাশের কোঠায়, মাথায় সাদা পাগড়ি, হাতে মোটা সোনার আংটি। তার সঙ্গে ছিল দাসী-চাকর আর এক গম্ভীর চেহারার স্ত্রী। তারা মায়ারীকে দেখে একে অপরের সঙ্গে পরামর্শ করে দাম চুকিয়ে দিল। তারপর গরুর গাড়িতে তুলে নিল তাকে।

হুগলির ঘাট থেকে মায়ারী যখন বেরোল, তখন শহরের কোলাহল স্পষ্ট হয়ে উঠল। রাস্তার দু’পাশে দোকানপাট, বাজারে কাপড়ের স্তূপ, মশলার গন্ধে বাতাস ভারী। আরেকদিকে দেখা যাচ্ছিল মুঘল সৈন্যদের টহল, তাদের ঝকঝকে অস্ত্র রোদে চকচক করছিল। মাঝে মাঝে গির্জার ঘণ্টাধ্বনি বাজছিল, তার সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল আজানের ডাক। অদ্ভুত এক মিলনক্ষেত্র—যেখানে ধর্ম, জাতি আর বাণিজ্য একসঙ্গে জড়িয়ে গেছে।

মায়ারী গাড়ির ভেতর বসে সব দেখছিল স্তব্ধ হয়ে। সে বুঝতে পারছিল না—এ শহর তার জন্য মুক্তি আনবে, নাকি নতুন দাসত্ব। তার বুকের ভেতর হাহাকার জমে উঠছিল, কিন্তু চোখে তখনও অদ্ভুত এক দীপ্তি।

বণিকের বাড়ি ছিল হুগলির ভেতরে, এক বিশাল প্রাসাদের মতো। উঁচু ফটক, ভিতরে প্রশস্ত আঙিনা, চারপাশে লাল ইটের দালান। সিঁড়ি বেয়ে যখন তাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল, সে দেখল অন্য দাসীরা কাজ করছে—কেউ ঝাড়পোঁছ দিচ্ছে, কেউ রান্নাঘরে ব্যস্ত। তাদের চোখে ক্লান্তি, মুখে নীরবতা।

বণিকের স্ত্রী তাকে এক নজরে দেখে বলল, “তুমি এখান থেকে যাবে না। কাজ করতে হবে, নিয়ম মানতে হবে। পালানোর চেষ্টা করলে শাস্তি পাবে।” তার ঠাণ্ডা কণ্ঠে মায়ারীর বুক কেঁপে উঠল।

তবুও সেদিন রাতে, যখন সে উঠোনের কোণে বসে আকাশের দিকে তাকাল, তখন টের পেল—এ শহর অন্যরকম। এখানে নদীর গন্ধ, মানুষের ভিড়, আর আকাশে ভেসে থাকা তারা যেন তাকে ডাকছে। বন্দীদশার ভেতর থেকেও সে প্রথমবার মনে করল—হয়তো এখানেই শুরু হবে তার নতুন জীবন।

মায়ারী জানত না সামনে কী আছে। কিন্তু হুগলির ঘাটে পৌঁছে তার যাত্রা নতুন মোড় নিয়েছে। সমুদ্রের ঝড় থেকে বেঁচে এসে, জলদস্যুদের হাত থেকে বাঁচিয়ে, এখন সে দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের আরেক অধ্যায়ে—যেখানে তার নিজের ভাগ্য জড়িয়ে যাবে বাংলার বাণিজ্য আর ষড়যন্ত্রের সঙ্গে।

পর্ব : নতুন জীবনের শুরু

হুগলির প্রাসাদসদৃশ সেই বাড়িতে ঢোকার মুহূর্তেই মায়ারীর বুকের ভেতর জমে উঠেছিল অদ্ভুত শূন্যতা। চারপাশে সে যা দেখছিল সবই তার কাছে নতুন—লাল ইটের উঁচু দেওয়াল, কারুকার্য করা জানালা, প্রশস্ত বারান্দা, আর উঠোনের মাঝখানে পাথরের ফোয়ারা। নদীর ধারে ছোট্ট গ্রামে বেড়ে ওঠা মায়ারীর চোখে এ যেন এক অনির্বচনীয় ভুবন। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে মিশে ছিল আতঙ্ক—এ প্রাসাদ তার কাছে আশ্রয়, নাকি কারাগার?

বণিকের নাম ছিল গোপাল দত্ত। শহরের নামকরা বাণিজ্য পরিবার, যারা পর্তুগিজদের সঙ্গে লেনদেন করে নীল, মশলা আর হাতির দাঁত রপ্তানি করত। ধনদৌলতের অহংকার তার শরীরী ভঙ্গিতেই স্পষ্ট ছিল। গোপালের স্ত্রী—অদিতি দেবী—গম্ভীর স্বভাবের নারী, মুখে সর্বদা ঠাণ্ডা শাসন। তিনি মায়ারীকে প্রথম দেখেই বলেছিলেন, “এখানে নিয়ম মেনে চলতে হবে। যে যেমন কাজ পাবে, তেমন করবে। মাথা উঁচু করার দরকার নেই।”

মায়ারীকে প্রথমে রান্নাঘরে পাঠানো হল। রান্নাঘর ছিল বিরাট, একদিকে ধোঁয়া ওঠা চুল্লি, অন্যদিকে বিশাল মাটির হাঁড়ি-পাতিল। কয়েকজন দাসী আগে থেকেই কাজ করছিল। তাদের মুখে বিস্ময় আর কৌতূহল—নতুন মেয়েটি কোথা থেকে এসেছে, কী তার কাহিনি? কেউ প্রশ্ন করতে চাইলেও মায়ারী শুধু মাথা নিচু করে নীরব থাকল। সে জানত, নিজের অতীত বললে লাভ নেই। এখন তার কাজ কেবল বেঁচে থাকা।

প্রথম দিন থেকেই তাকে শেখানো হল নতুন নিয়ম। ভোরে উঠে উঠোনে জল ছিটোতে হবে, তারপর রান্নাঘরে কাজ, দুপুরে অদিতি দেবীর ঘরে সেবা, সন্ধ্যায় আবার গৃহস্থালির ব্যস্ততা। তার শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ত, কিন্তু অদ্ভুতভাবে সে ধীরে ধীরে শিখে নিচ্ছিল। বাংলার ভাষা, যা রহিম তাকে শেখাতে শুরু করেছিল, এখন দাসীদের মুখে মুখে আরো স্পষ্ট হচ্ছিল। মায়ারী শব্দগুলো আঁকড়ে ধরে মনে রাখতে লাগল। “জল,” “ভাত,” “চুপ কর”—এসব শব্দই ধীরে ধীরে তার জগৎ হয়ে উঠছিল।

তবুও প্রতিটি রাত মায়ারীর কাছে এক অন্য অধ্যায় ছিল। যখন সব কাজ শেষ হয়ে যেত, সে উঠোনের কোণে বসে আকাশের দিকে তাকাত। সমুদ্রযাত্রার ভয়ংকর ঝড়ের স্মৃতি তখনও তার চোখে ভাসত। কিন্তু একইসঙ্গে মনে পড়ত রহিমের কথা—“একদিন আমরা পালাব।” সেই স্মৃতি তার বুকের ভেতর এক অদ্ভুত জেদ জাগাত।

কয়েক মাস কেটে গেল এভাবেই। মায়ারীর কপাল কালো থেকে সোনালি হয়ে উঠছিল হুগলির রোদে, হাতের আঙুল শক্ত হয়ে যাচ্ছিল কাজের চাপে। তবুও তার চোখের দীপ্তি নিভে যায়নি। অন্য দাসীরা মাঝে মাঝে ফিসফিস করে বলত, “ওর ভেতর অন্য রকম সাহস আছে।”

একদিন সন্ধ্যায় অদিতি দেবী তাকে ডেকে বললেন, “তুমি ভালো কাজ করছো। কিন্তু মনে রেখো, এই বাড়ি তোমার আশ্রয়। বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করলে সর্বনাশ হবে।” মায়ারী মাথা নোয়াল, কিন্তু মনে মনে বলল—এ আশ্রয় হয়তো একদিন পালানোর পথও করে দেবে।

মায়ারীর সঙ্গে বাড়ির ছোট্ট মেয়েটির সম্পর্ক গড়ে উঠল। নাম ছিল কুমু। বয়স মাত্র দশ, কিন্তু কৌতূহল আর দুষ্টুমিতে ভরা। সে মায়ারীর হাত ধরে বলত, “তুমি অন্যদের মতো নও। তোমার চোখে অন্য কিছু আছে।” কুমু তাকে বই দেখাত, গান শোনাত, আর গোপনে প্রশ্ন করত—“তুমি কোথা থেকে এসেছো?” মায়ারী শুধু হেসে বলত, “দূর সমুদ্রের ওপার থেকে।”

এভাবে ধীরে ধীরে মায়ারীর নতুন জীবন গড়ে উঠছিল। সে শিখছিল শুধু কাজ নয়, নতুন এক সমাজের নিয়মও। দেখছিল কিভাবে বণিকেরা পর্তুগিজদের সঙ্গে দরকষাকষি করছে, কিভাবে মুঘল সৈন্যেরা এসে খাজনা নিচ্ছে, কিভাবে গির্জার ঘণ্টাধ্বনি আর মসজিদের আজান একসঙ্গে মিশে যাচ্ছে হুগলির আকাশে।

কিন্তু এই নতুন জীবনের আড়ালে সে টের পাচ্ছিল এক গভীর ষড়যন্ত্রের ছায়া। পর্তুগিজরা ধীরে ধীরে শহরে নিজেদের দখল বাড়াচ্ছিল। গোপাল দত্তদের মতো বণিকেরা লাভের জন্য তাদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছিল। কিন্তু সাধারণ মানুষের চোখে ছিল আতঙ্ক—যদি একদিন এদের অত্যাচার সীমা ছাড়ায়?

মায়ারী এসব সরাসরি বুঝতে পারত না, কিন্তু তার কান সব শুনছিল। রাতে দাসীরা যখন আড্ডা দিত, তখন ফিসফিস করে বলত—“শুনেছো, কাল রাতে পর্তুগিজরা নদীর ধারে এক গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে।” কেউ বলত, “মুঘলরা যদি আক্রমণ করে, তখন কী হবে?” এইসব কথাই মায়ারীর বুকের ভেতর অস্থিরতা বাড়িয়ে তুলত।

একদিন কুমু তাকে গোপনে বলল, “মা-বাবা অনেক কিছু লুকোয়। ওরা শুধু বাণিজ্যের কথা ভাবে। কিন্তু আমি দেখেছি, নদীর ধারে সৈন্যরা জড়ো হচ্ছে।” মায়ারী স্তব্ধ হয়ে গেল। সে বুঝতে পারল—এ শহর শুধু বাণিজ্যের কেন্দ্র নয়, এখানে ইতিহাসও তৈরি হচ্ছে, রক্ত দিয়ে।

তবুও তার নিজের জীবনে ছোট ছোট পরিবর্তন হচ্ছিল। একদিন অদিতি দেবী তাকে নতুন কাপড় দিলেন—সাদা শাড়ি, লাল পাড়। মায়ারী আয়নায় নিজেকে দেখে অবাক হয়ে গেল। আরেক দাসী মৃদুস্বরে বলল, “তুই এখন দেখতে বাঙালি মেয়ের মতো।” সে নিজের চোখে সেই রূপ দেখে হঠাৎ কেঁদে ফেলল। কারণ মনে পড়ল তার আরাকানের গ্রাম, মা-বাবা, সেই হারিয়ে যাওয়া শৈশব।

তবে কান্নার ভেতরও সে নিজেকে শক্ত করল। ভাবল—হয়তো নতুন জীবনের এটাই শুরু। সে আর আগের মতো ভয়ে কাঁপতে থাকা দাসী নয়। সে এখন ভাষা শিখছে, মানুষের রীতি শিখছে, এমনকি নিজের ভেতরের সাহসও আবিষ্কার করছে।

দিন শেষে এক রাতে কুমু তাকে ফিসফিস করে বলল, “তুমি পালাবে না তো?” মায়ারী হাসল—“এখন না। কিন্তু একদিন আমি আমার পথ খুঁজে নেব।”

সেদিন রাতে আকাশে চাঁদ উঠেছিল পূর্ণিমার মতো উজ্জ্বল। মায়ারী উঠোনে বসে তাকিয়ে রইল। তার চোখে সেই আলোয় ভেসে উঠল ভবিষ্যতের আভাস—এক অদ্ভুত যাত্রা, যেখানে সে আর শুধু দাসী থাকবে না।

হুগলির এই প্রাসাদ তার কাছে এখন দ্বিমুখী—একদিকে শৃঙ্খল, অন্যদিকে মুক্তির প্রস্তুতি। আর মায়ারী জানত, তার নতুন জীবনের শুরু হয়ে গেছে।

পর্ব : ষড়যন্ত্র বিশ্বাসঘাতকতা

হুগলির প্রাসাদের ভেতরে দিনগুলো আপাত শান্তির মতো কাটলেও, শহরের বাতাসে তখন ষড়যন্ত্রের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছিল। নদীর ঘাটে প্রতিদিন ভিড় জমত—পর্তুগিজ ব্যবসায়ী, ডাচ বণিক, আর্মেনিয়ান দালাল, আর মুঘল সৈন্য। একদিকে মসজিদের আজান ভেসে আসত, অন্যদিকে গির্জার ঘণ্টা। এই মিশ্র সুরের আড়ালে লুকিয়ে ছিল লোভ আর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব।

মায়ারী তখন প্রায় পুরোপুরি বাংলায় কথা বলতে শিখে ফেলেছিল। রান্নাঘরে কাজ করতে করতে, দাসীদের সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলতে বলতে সে ভাষার সঙ্গে তাল মেলাতে শিখেছিল। নতুন পরিচয় তৈরি হচ্ছিল তার—মায়ারী, এক পরিশ্রমী দাসী, যার চোখে অদ্ভুত দৃঢ়তা। কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে বুঝতে পারছিল, এ শহরে কিছু অশুভ চলছে।

গোপাল দত্ত প্রাসাদের প্রভু হয়তো বাইরে যতটা ধীরস্থির বণিক, ভেতরে তিনি ছিলেন লোভের দাস। প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় তাঁর ঘরে বসত গোপন বৈঠক। পর্তুগিজ ব্যবসায়ীরা আসত, সঙ্গে থাকত দোভাষী। দাসীদের সেখানে প্রবেশাধিকার ছিল না, কিন্তু মায়ারী রান্নাঘরের পাশের করিডোরে দাঁড়িয়ে কান পাতত। টুকরো টুকরো কিছু শব্দ সে বুঝতে পারত—“লাভ,” “মুঘল,” “অস্ত্র,” “চুক্তি।” তার মনে হতো, এ শুধু বাণিজ্য নয়, এর মধ্যে লুকিয়ে আছে ভয়ংকর পরিকল্পনা।

একদিন রাতে কুমু এসে ফিসফিস করে বলল, “আমি বাবাকে দেখেছি। ওরা বলছিল, যদি মুঘলদের সঙ্গে বিরোধ বাড়ে, তবে পর্তুগিজদের হাতে নিজেদের নিরাপদ রাখতে হবে।” মায়ারী অবাক হয়ে তাকাল। এত বড় শহরের নিয়তি ঠিক হচ্ছে এইসব গোপন বৈঠকে!

কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতার ছায়া শুধু রাজনীতি বা বাণিজ্যে ছিল না, তা ঢুকে পড়েছিল মানুষের সম্পর্কেও। রান্নাঘরের দাসী বীণা একদিন মায়ারীকে আলাদা করে বলল, “সাবধান, এখানে সবাই বন্ধু নয়। কেউ কেউ তোমাকে বিপদে ফেলতে চাইবে।” মায়ারী প্রথমে গুরুত্ব দেয়নি, কিন্তু কয়েকদিন পরই সে টের পেল কথার সত্যতা।

এক রাতে, সে জল আনতে গিয়েছিল উঠোনের কুয়ো থেকে। হঠাৎ পিছন থেকে কেউ ফিসফিস করে বলল, “তুই কি ভেবেছিস, তুই আমাদের থেকে আলাদা? তুই বেশি বুদ্ধিমান? সাবধান, প্রভুর কানে যদি তোর নাম পৌঁছে দিই, তবে সর্বনাশ হবে।” মায়ারী ঘুরে তাকাল, দেখল রান্নাঘরের আরেক দাসী—সুধা। তার চোখে ছিল হিংসা আর ঘৃণা। মায়ারী চুপ করে গেল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে বুঝে গেল—এ বাড়িতে কেবল প্রভুদের ষড়যন্ত্র নয়, দাসীদের মাঝেও বিশ্বাসঘাতকতা চলছে।

দিন যেতে যেতে ষড়যন্ত্রের রূপ আরও স্পষ্ট হতে লাগল। গোপাল দত্ত প্রাসাদে অস্ত্র জমা হতে লাগল—তলোয়ার, বন্দুক, বারুদ। সেগুলো গোপনে আনা হত, পর্তুগিজরা রাতের অন্ধকারে পৌঁছে দিত। মায়ারী একবার রান্নাঘরের পথে হাঁটতে হাঁটতে দেখল, কয়েকজন চাকর বড় বড় বাক্স টেনে নিয়ে যাচ্ছে গুদামে। তার কানে এল গোপালের কণ্ঠ—“সবকিছু প্রস্তুত রাখো। সময় এলে কাজে লাগবে।”

কুমু একদিন মায়ারীর হাতে একটা ছোট কাগজ গুঁজে দিল। তাতে আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা—“পর্তুগিজদের বিশ্বাস কোরো না।” মায়ারী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “এটা কোথা থেকে?” কুমু ফিসফিস করে বলল, “একজন অচেনা লোক আমাকে দিয়েছিল ঘাটে। বলেছিল, এটা তোমাকে দিতে।”

মায়ারীর বুক কেঁপে উঠল। কে সেই অচেনা লোক? রহিম? নাকি অন্য কেউ? কাগজটা তার বুকের ভেতর আরও অস্থিরতা তৈরি করল।

তবে বিশ্বাসঘাতকতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ সে পেল এক গভীর রাতে। সে রান্নাঘরে হাঁড়ি ধুচ্ছিল, হঠাৎ শুনল অদিতি দেবীর কণ্ঠ। প্রাসাদের অন্দরমহলে তিনি এক পর্তুগিজ ব্যবসায়ীর সঙ্গে গোপনে কথা বলছিলেন। “আমরা মুঘলদের শাসন থেকে মুক্তি চাই,” তিনি বলছিলেন। “যদি তোমরা আমাদের রক্ষা করো, তবে আমরা সোনা আর জমি দিয়ে দেব।”

মায়ারী থমকে গেল। প্রাসাদের গৃহিণী, যিনি বাইরে এত শীতল, তিনিও বিশ্বাসঘাতকতার খেলায় জড়িত! সে টের পেল, এ শহরের মাটিই যেন ফেটে যাচ্ছে। একদিকে মুঘলদের ক্ষমতা, অন্যদিকে পর্তুগিজদের লোভ, আর মাঝখানে আটকে আছে সাধারণ মানুষ।

কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত ঘটনাটি ঘটল কয়েকদিন পর। মায়ারী এক বিকেলে ঘাটে গিয়েছিল কাপড় ধুতে। হঠাৎ শুনল পরিচিত এক কণ্ঠ—“মায়ারী!” সে ঘুরে তাকাল। ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে রহিম। তার শরীর শুকিয়ে গেছে, চোখে ক্লান্তি, কিন্তু মুখে অদ্ভুত দীপ্তি। সে সংক্ষেপে বলল, “আমি এখন মুঘলদের সঙ্গে আছি। এখানে বড় লড়াই আসছে। সাবধান থেকো।”

মায়ারীর বুক ধক করে উঠল। রহিম জীবিত! সে কিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু তখনই গোপাল দত্তের এক চাকর দেখে ফেলল তাদের কথা বলা। পরদিনই অদিতি দেবী মায়ারীকে ডেকে বললেন, “শুনেছি তুমি বাইরে গিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলেছো। যদি আবার এমন করো, তবে তোমাকে শাস্তি পেতে হবে।”

মায়ারী মাথা নিচু করে রইল, কিন্তু তার বুকের ভেতর তখন একটাই প্রতিজ্ঞা—সে সত্যিই কারও কাছে ফাঁস করবে না রহিমকে। কারণ সে জানত, এ লড়াই শুধু বন্দীদের নয়, পুরো শহরের।

ষড়যন্ত্র, গোপন বৈঠক, অস্ত্র জমা—সব মিলিয়ে হুগলি তখন আগ্নেয়গিরির মতো ফুঁসছিল। মায়ারী টের পাচ্ছিল, ইতিহাসের এক অদ্ভুত ঝড় আসছে। আর সেই ঝড়ে তার নিজের জীবনের মোড়ও বদলে যাবে।

পর্ব : বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ

শীতকাল নামছিল হুগলির আকাশে। ভোরে নদীর বুক থেকে কুয়াশা উঠে এসে ঢেকে দিত ঘাট আর গলিঘুঁজির পথ। কিন্তু সেই কুয়াশার ভেতর দিয়েই ছড়িয়ে পড়ছিল বিদ্রোহের গুজব। কেউ বলত, মুঘল সুবাদার শহরে গোপনে সৈন্য জড়ো করছে। কেউ আবার বলত, পর্তুগিজরা মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য দুর্গ মজবুত করছে। বাজারে বাজারে, গলির আড্ডায়, এমনকি দাসীদের ফিসফিসানিতেও তখন একটাই শব্দ ভাসছিল—“বিদ্রোহ।”

মায়ারীর দিনগুলো তখনও কাজের ভেতরে কেটে যাচ্ছিল, কিন্তু তার চোখ-কান সবসময় খোলা থাকত। রান্নাঘরে হাঁড়ি ধোয়ার সময়, উঠোনে জল ছিটানোর সময়, কিংবা অদিতি দেবীর ঘরে কাজ করতে করতে—সে টের পেত, শহরটা এক অদৃশ্য আগুনে জ্বলছে।

এক রাতে দাসীদের মধ্যে একজন হঠাৎ তাকে বলল, “তুমি জানো, কাল রাতে নদীর ধারে গোপনে মিটিং হয়েছে? মুঘলরা গ্রামের মানুষদের ডাকছে, বলছে পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে।” মায়ারী চমকে উঠল। মনে পড়ল রহিমের কথা—“এখানে বড় লড়াই আসছে।”

সেদিন রাতেই, কাপড় শুকোতে দিতে গিয়ে মায়ারী দেখল আকাশের নিচে গোপাল দত্তের আঙিনায় কিছু অচেনা লোক বসে আছে। আলো-আঁধারিতে তাদের হাতে চকচক করছে তলোয়ার। গোপাল দত্ত আর পর্তুগিজ দোভাষী তাদের কিছু বুঝিয়ে দিচ্ছে। মায়ারীর বুক কেঁপে উঠল। এই প্রাসাদ শুধু বাণিজ্যের কেন্দ্র নয়, ষড়যন্ত্রের আস্তানা হয়ে উঠেছে।

পরদিন সকালে কুমু তাকে ডেকে ফিসফিস করে বলল, “তুমি জানো, মুঘলরা শহরের ভেতরে গোপনে গুপ্তচর পাঠাচ্ছে। তারা খুঁজছে কে পর্তুগিজদের সঙ্গে মিলে গেছে।” মায়ারী অবাক হয়ে তাকাল। তার মনে হল, এ শহরটা যেন দাবার বোর্ড, আর প্রতিটি মানুষ গুটি। যে যখন সুবিধা বুঝছে, তখন দিক বদলাচ্ছে।

কিন্তু বিদ্রোহের আগুন প্রথম দেখা দিল শহরের সাধারণ মানুষের ভেতর। নদীর ঘাটে মাঝিরা একসঙ্গে জড়ো হল। তারা চিৎকার করে বলল, “আমরা পর্তুগিজদের জাহাজ টানব না আর! আমাদের মেয়ে-বউদের ওরা ধরে নিয়ে যায়, আমাদের জমি দখল করে!” এই চিৎকার ছড়িয়ে পড়ল বাজার থেকে মহল্লায়।

মায়ারী এসব খবর শুনে টের পেল—অদ্ভুত এক স্রোত বইছে। সাধারণ মানুষ, যারা এতদিন ভয় পেত, তারাও আর সহ্য করতে পারছে না। তারা মুখ খুলছে, বিদ্রোহের ডাক দিচ্ছে।

সেই রাতে রহিম আবারও তার সামনে এল। এবার প্রাসাদের উঠোনের আড়ালে, চাঁদের আলোয়। সে বলল, “আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। মুঘল সেনারা শিগগিরই আক্রমণ করবে। কিন্তু আমাদের দরকার ভিতরের খবর। তুমি পারবে আমাদের সাহায্য করতে?”

মায়ারী প্রথমে দ্বিধায় পড়ল। সে দাসী, তার ক্ষমতা কতটুকু? কিন্তু রহিমের চোখের দীপ্তি দেখে তার বুকের ভেতর সাহস জেগে উঠল। সে বলল, “আমি চেষ্টা করব।”

সেদিন থেকে মায়ারীর জীবন নতুন মোড় নিল। দিনে সে দাসীর কাজ করত, রাতে কানে-কানে শোনা ষড়যন্ত্রের খবর মনে রাখত। কখন গোপাল দত্ত কার সঙ্গে বৈঠক করছে, কোথায় অস্ত্র রাখা হচ্ছে—এসব সে ছোট ছোট টুকরো তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করল। তারপর কুমুর সাহায্যে সেগুলো রহিমের কাছে পৌঁছে দিত।

কুমু নিজেও ভয় পাচ্ছিল, কিন্তু বলত, “তুমি যদি বিদ্রোহীদের সাহায্য করো, তবে একদিন হয়তো আমাদেরও মুক্তি আসবে।” তার নিষ্পাপ চোখে মায়ারী টের পেত আশার আলো।

কিন্তু বিপদের ছায়া সবসময় ঘনিয়ে থাকত। একদিন হঠাৎ সুধা, সেই ঈর্ষাপরায়ণ দাসী, তাকে ধরে ফিসফিস করে বলল, “তুই কার সঙ্গে কথা বলিস বাইরে? আমি কিন্তু প্রভুর কাছে সব বলে দেব।” মায়ারীর শরীর শিউরে উঠল। কিন্তু সে চুপ করে সরে গেল। জানত, একটা ভুল মানেই সর্বনাশ।

এদিকে শহরে উত্তেজনা বাড়ছিল। এক বিকেলে বাজারে হঠাৎ মারামারি লেগে গেল পর্তুগিজ সৈন্য আর কয়েকজন মাঝির মধ্যে। রক্ত ঝরল, কয়েকজন মারা গেল। খবর ছড়িয়ে পড়তেই মানুষের ভিড় চিৎকারে ফেটে পড়ল—“পর্তুগিজদের আর সহ্য করব না!”

সেই রাতে শহরের আকাশে দেখা গেল আগুন। কেউ বলল, বিদ্রোহীরা পর্তুগিজদের গুদাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। কেউ আবার বলল, এটা পর্তুগিজদেরই ষড়যন্ত্র, যাতে বিদ্রোহীদের ফাঁসানো যায়। যাই হোক, শহরটাকে এক অদৃশ্য আগুন গ্রাস করতে শুরু করল।

প্রাসাদেও অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ল। গোপাল দত্ত রাতে দেরি করে বৈঠক করছিলেন। অদিতি দেবীর মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠেছিল। আর দাসীরা ফিসফিস করে বলছিল, “যুদ্ধ আসছে। আমরা কোথায় যাব?”

মায়ারী তখন নিজের মধ্যে ভিন্ন এক রূপ পাচ্ছিল। সে আর কেবল দাসী নয়। সে হয়ে উঠছিল বিদ্রোহীদের চোখ-কান। প্রত্যেকটা খবর, প্রতিটি গোপন ফিসফিস সে মনে রাখত। তার বুকের ভেতর জ্বলছিল এক অদ্ভুত আগুন—মুক্তির আগুন।

এক রাতে রহিম তাকে ফিসফিস করে বলল, “তুমি যদি এটা পারো, তবে আমাদের আক্রমণ সফল হবে। তুমি জানতে পারো কি, কখন গোপাল দত্ত আর পর্তুগিজরা অস্ত্র পাঠাচ্ছে দুর্গে?” মায়ারী চোখ বন্ধ করে মাথা নেড়ে সম্মতি দিল।

সেদিন থেকে তার প্রতিটি মুহূর্ত হয়ে উঠল বিপজ্জনক। একদিকে প্রাসাদের শাসন, অন্যদিকে বিদ্রোহীদের দায়িত্ব। অদ্ভুতভাবে সে নিজের ভেতর শক্তি খুঁজে পাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, তার অতীতের সব যন্ত্রণা, সব দাসত্ব যেন তাকে তৈরি করছে এই লড়াইয়ের জন্য।

শহরের বাতাসে তখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ। মানুষ আর চুপ করে নেই। তাদের চোখে জ্বলছে ক্রোধ, তাদের কণ্ঠে উঠছে প্রতিরোধের ডাক।

আর সেই স্ফুলিঙ্গের ভেতর দাঁড়িয়ে মায়ারী টের পাচ্ছিল—তার যাত্রা এখন আর শুধু নিজের জন্য নয়, এক বৃহৎ ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠছে।

পর্ব : আগুনে হুগলি

শহরের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল। প্রতিটি সকাল যেন শুরু হত আতঙ্কের গন্ধ নিয়ে। ঘাটে দাঁড়িয়ে দেখা যেত মুঘল সৈন্যদের টহল, পর্তুগিজদের বন্দুক হাতে দম্ভভরা পদচারণা, আর সাধারণ মানুষের চোখে ভয় ও ক্ষোভের অদ্ভুত মিশেল। ক’দিন আগেও যে হুগলি শুধু বাণিজ্যের ব্যস্ততায় মুখর ছিল, এখন সেটাই যুদ্ধক্ষেত্রের মতো হয়ে উঠেছে।

মায়ারীর দিনগুলো তখন একেবারেই অন্যরকম হয়ে গেছে। বাইরে যেমন অশান্তি, ভেতরেও তেমনি ষড়যন্ত্রের ঘনঘটা। গোপাল দত্ত প্রতি রাতে পর্তুগিজ ক্যাপ্টেনদের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন। দাসীরা জানত, এ বৈঠকে মানুষের জীবনের দাম নির্ধারণ হচ্ছে। মায়ারী চেষ্টা করত যতটা সম্ভব খবর জোগাড় করতে। তারপর ফাঁক পেলেই কুমুর হাতে পৌঁছে দিত, আর কুমু গোপনে রহিমের কাছে পাঠিয়ে দিত।

একদিন গভীর রাতে মায়ারী রান্নাঘরের পেছনের করিডোরে শুনে ফেলল ভয়ঙ্কর এক খবর। গোপাল দত্ত এক পর্তুগিজ অফিসারকে বলছে—“কাল ভোরে দুর্গে পাঠানো হবে অস্ত্র। সেগুলো মুঘলদের চোখে পড়ার আগেই পৌঁছে দিতে হবে।” মায়ারীর বুক কেঁপে উঠল। এ খবর তো বিদ্রোহীদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। সে সঙ্গে সঙ্গে কুমুকে জানাল। কুমু ভয়ে কাঁপছিল, তবুও বলল, “আমি ব্যবস্থা করব।”

পরদিনই শহরে আগুন জ্বলে উঠল। ভোরে যখন অস্ত্র বোঝাই গাড়ি দুর্গের দিকে যাচ্ছিল, বিদ্রোহীরা হঠাৎ আক্রমণ করল। বন্দুকের গর্জন, তলোয়ারের ঝলক আর মানুষের চিৎকারে কেঁপে উঠল হুগলির আকাশ। পর্তুগিজরা রক্তক্ষয়ী প্রতিরোধ করল, কিন্তু মুঘল সেনারা পিছন থেকে এসে বিদ্রোহীদের সাহায্য করল। মুহূর্তে শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হল।

প্রাসাদের ভেতর থেকে মায়ারী সব দেখছিল। উঠোনে দাঁড়িয়ে তার চোখে ভেসে উঠছিল রক্তের ধারা, ধোঁয়ার কুণ্ডলী, জ্বলন্ত ঘরবাড়ি। মানুষ দৌড়ে পালাচ্ছে, কেউ লুকোচ্ছে, কেউ প্রতিরোধ করছে। শহরের কোলাহল এক মুহূর্তে পরিণত হল হাহাকারে।

গোপাল দত্ত তখন ভয়ে পাগল। তিনি অদিতি দেবীকে বললেন, “পর্তুগিজদের সঙ্গে থাকতে হবে, নইলে মুঘলরা আমাদের শেষ করে দেবে।” কিন্তু অদিতি দেবীর মুখেও আতঙ্ক। তিনি বুঝতে পারছিলেন, যেদিকেই দাঁড়ান না কেন, মৃত্যু অনিবার্য।

মায়ারীর বুক তখন জ্বলছিল অদ্ভুত আগুনে। সে জানত, রহিম আর বিদ্রোহীরা বাইরে লড়ছে। সে চাইছিল তাদের পাশে থাকতে। কিন্তু দাসী হয়ে প্রাসাদের ভেতর থেকে সে শুধু প্রার্থনা করছিল—“বেঁচে থাকো, রহিম।”

বিকেলের মধ্যেই শহর জ্বলতে শুরু করল। মুঘল সেনারা প্রবল আক্রমণ চালাল। দুর্গের দেয়াল ভেঙে পড়ল, নদীর ধারে পর্তুগিজদের গুদাম আগুনে ভস্মীভূত হল। বন্দুকের গর্জনে কেঁপে উঠল চারদিক। দাসীরা প্রাসাদের ভেতরে কাঁদছিল আতঙ্কে। কুমু মায়ারীর হাত ধরে বলল, “আমরা কি মরে যাব?” মায়ারী তাকে বুকে টেনে নিয়ে ফিসফিস করল, “না, আমরা বাঁচব।” কিন্তু তার নিজের কণ্ঠেও তখন কাঁপুনি।

সন্ধ্যার পর পর্তুগিজরা বুঝল, তারা টিকতে পারবে না। তারা পাগলের মতো শহরে আগুন ধরিয়ে দিল। ঘরবাড়ি, বাজার, এমনকি গির্জাও রক্ষা পেল না। আগুনের লেলিহান শিখা আকাশ ছুঁল। মানুষের চিৎকার, পশুপাখির ছুটোছুটি, নদীর ঘাটে ভিড়—সব মিলে হুগলি পরিণত হল নরকে।

প্রাসাদের ফটকও তখন টার্গেট হয়ে গেল। মুঘল সৈন্যরা দরজা ভেঙে ঢুকল। গোপাল দত্ত পালাতে চাইছিলেন, কিন্তু সৈন্যরা তাকে ধরে ফেলল। অদিতি দেবী মূর্ছা গেলেন। দাসীরা এদিক-ওদিক ছুটছিল। মায়ারী কুমুকে আঁকড়ে ধরে ছিল।

ঠিক সেই সময়ে, অগ্নিকুণ্ডের ভেতর দিয়ে রহিম ছুটে এল। তার শরীর রক্তে ভেজা, হাতে তলোয়ার। সে মায়ারীর হাত ধরে চিৎকার করল, “চলো! এখনই বেরোতে হবে!” মায়ারী হতভম্ব হয়ে তার চোখের দিকে তাকাল। এতদিন পরে, মৃত্যুর মধ্যেই আবার দেখা।

কিন্তু বেরোনোর আগেই এক প্রহরী তলোয়ার উঁচিয়ে তাদের পথ রোধ করল। মুহূর্তের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হল। রহিম তার তলোয়ার দিয়ে আঘাত করল, কিন্তু নিজেও গুরুতর জখম হল। মায়ারী আতঙ্কে চিৎকার করল, “না!” তবুও রহিম তাকে ঠেলে বাইরে পাঠিয়ে দিল। “তুমি বাঁচো… তোমার বেঁচে থাকাই আমার জয়।”

মায়ারী কুমুকে নিয়ে দৌড়ে বেরোল। চারদিকে আগুন, মানুষের হাহাকার। শহর তখন রক্ত আর ধ্বংসস্তূপে ভরা। সে আর কিছু বুঝল না—শুধু দৌড়াল। কুমুর ছোট্ট হাত আঁকড়ে ধরে নদীর ঘাটে পৌঁছে গেল।

সেখানে দৃশ্য ছিল ভয়াবহ। নদীতে জাহাজ জ্বলছে, ভাসছে মৃতদেহ। মানুষ পানিতে ঝাঁপ দিচ্ছে বাঁচার জন্য। মায়ারী কুমুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখে তখন শুধু ধোঁয়া আর আগুন।

রাত গভীর হল। আগুন ধীরে ধীরে নিভল, কিন্তু হুগলি তখন ভস্মীভূত। প্রাসাদ, বাজার, ঘাট—সব ধ্বংসস্তূপ। বিদ্রোহ সফল হয়েছিল ঠিকই, পর্তুগিজরা পরাজিত, কিন্তু তার বিনিময়ে শহর রক্তে ভিজে গেল।

মায়ারী ধীরে ধীরে হাঁটল নদীর ধারে। তার চোখ খুঁজছিল রহিমকে, কিন্তু সে কোথাও নেই। বুকের ভেতর হাহাকার জমে উঠল। তার মনে হচ্ছিল, অগ্নিকুণ্ডে রহিম হারিয়ে গেছে। তবুও সে নিজের ভেতরে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা অনুভব করল।

সে টের পেল, এ ধ্বংস কেবল শুরু। এই আগুনের ভেতর দিয়েই জন্ম নেবে নতুন জীবন। আর সে—মায়ারী—সেই জীবনের অংশ হবে।

পর্ব ১০: সুবর্ণযাত্রার সমাপ্তি

ভোরের প্রথম আলো ফুটতেই হুগলির ওপর ভেসে উঠল ধোঁয়ার চাদর। আগের রাতের অগ্নিকাণ্ড শহরটাকে ভস্মস্তূপে পরিণত করেছিল। রাস্তার দু’পাশে ছাই, নদীর ঘাটে ভেসে আসা দগ্ধ কাঠ, আর বাতাসে এখনও পুড়ে যাওয়া মানুষের দুঃসহ গন্ধ। যারা বেঁচে ছিল, তারা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল ধ্বংসের দিকে। কেউ কাঁদছিল, কেউ প্রার্থনা করছিল, কেউ আবার শুধু নির্বাক হয়ে বসে ছিল।

মায়ারী নদীর ধারে দাঁড়িয়ে ছিল কুমুকে আঁকড়ে ধরে। সারারাত তারা লুকিয়ে ছিল ভাঙা গুদামের আড়ালে, এখন আবার বেরিয়ে এসেছে আলোয়। তার চোখ ছিল লাল, কিন্তু কান্না আর বেরোচ্ছিল না। এত মৃত্যু, এত আগুন দেখার পর তার অশ্রু যেন শুকিয়ে গিয়েছিল।

তার চোখ খুঁজছিল রহিমকে। আগুনের ভেতর থেকে যে তাকে ঠেলে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিল, সে কি বেঁচে আছে? সে কি এখনও লড়াই করছে? নাকি সেই ধোঁয়ার স্রোতে হারিয়ে গেছে? মায়ারীর বুকের ভেতর একটা শূন্যতা জেগে উঠেছিল।

মুঘল সৈন্যরা তখন শহরের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছিল। পর্তুগিজদের দুর্গ দখল হয়ে গেছে, বন্দুক আর বারুদ বাজেয়াপ্ত হয়েছে। শহরের মানুষরা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সৈন্যদের দিকে তাকাচ্ছিল। তারা জানত, পর্তুগিজদের অত্যাচার শেষ হলেও মুঘল শাসন শুরু হবে আবার। কারও জন্য মুক্তি, কারও জন্য আবার নতুন শৃঙ্খল।

মায়ারীর ভাগ্যও তখন অস্থির হয়ে ছিল। সে দাসী হিসেবে এসেছিল হুগলিতে, প্রাসাদে শিকলবন্দি দিন কাটিয়েছে। কিন্তু আগুনে সেই প্রাসাদ ভস্মীভূত হয়েছে। গোপাল দত্ত বন্দী হয়েছে, অদিতি দেবী নির্বাক হয়ে বসে আছেন। প্রাসাদের চাকর-দাসীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। এখন আর কেউ নেই, যে তাকে মালিক বলবে, কেউ নেই যে তার জীবনকে বেঁধে রাখবে।

সে বুঝতে পারল, এটাই তার সুযোগ। এই ধ্বংসস্তূপের ভেতরেই তার মুক্তি লুকিয়ে আছে।

কিন্তু মুক্তি মানে কী? শুধু প্রাসাদ থেকে পালানো নয়, শুধু শিকল ভাঙা নয়। মুক্তি মানে নিজের জীবনকে নিজের হাতে নেওয়া। আর তার ভেতরে জন্ম নিচ্ছিল সেই শক্তি।

কুমু তখন তার পাশে বসে ছিল, ভয় আর ক্লান্তিতে চোখ আধখোলা। মায়ারী তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। “ভয় পেও না, কুমু। এখন থেকে আমরা নিজেরাই নিজের জীবন গড়ব।” কুমু ক্লান্ত গলায় বলল, “কোথায় যাব আমরা?” মায়ারী আকাশের দিকে তাকাল—ধোঁয়ার আড়াল ভেদ করে সূর্যের আলো ফুটছে। সে ফিসফিস করে বলল, “যেখানে আলো আছে।”

কয়েকদিন পর হুগলির ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবন ফিরতে শুরু করল। বাজারে আবার দোকান বসতে লাগল, ঘাটে মাঝিরা নৌকা নামাতে লাগল। কিন্তু আগের মতো আর কখনও হবে না, কারণ শহরের বুক এখনো আগুনের দাগ বয়ে বেড়াচ্ছিল।

মায়ারী তখন নদীর ধারের এক বিধবার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল কুমুকে নিয়ে। বিধবা তাকে কাজ দিয়েছিল, বিনিময়ে অন্ন-আশ্রয়। মায়ারী খেটে খাওয়া হাত দিয়ে ঘর পরিষ্কার করত, খাবার রান্না করত। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে জানত—এ জীবনও অস্থায়ী। একদিন তাকে নিজের পথ বের করতে হবে।

এক সন্ধ্যায় ঘাটে দাঁড়িয়ে ছিল সে। নদীর জলে তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে, আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। সেই মুহূর্তে হঠাৎ সে শুনল পরিচিত গলা—“মায়ারী।” বুক কেঁপে উঠল। সে ঘুরে তাকাল। ভিড়ের ভেতর দাঁড়িয়ে রহিম। তার শরীরে এখনও ক্ষতের দাগ, চোখে ক্লান্তি, কিন্তু মুখে সেই পুরনো দীপ্তি।

মায়ারী ছুটে গিয়ে দাঁড়াল তার সামনে। “তুমি বেঁচে আছো!”—তার গলা কেঁপে উঠল। রহিম মৃদু হাসল, “মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেছি। অনেকেই ফেরেনি, কিন্তু আমি ফিরেছি শুধু তোমাকে দেখার জন্য।”

দু’জনেই তখন নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। চারপাশে নদীর ঢেউ, মানুষের কোলাহল, ধ্বংসস্তূপের গন্ধ—সব মিলিয়ে মুহূর্তটা ছিল অবাস্তব। কিন্তু তাদের চোখে তখন একটাই কথা—জীবন এখনও বাকি।

রহিম বলল, “আমি মুঘল সেনাদের সঙ্গে থাকতে পারব না আর। আমি চাই মানুষের জন্য কিছু করতে। যারা দাস হয়ে আসে, যারা নিপীড়িত হয়, তাদের জন্য।” মায়ারী তার দিকে তাকাল। “আমিও চাই মুক্তি। কেবল নিজের জন্য নয়, সবার জন্য।”

সেদিন রাতেই তারা সিদ্ধান্ত নিল। শহরের বাইরে, নদীর ওপারের গ্রামে গিয়ে নতুন জীবন শুরু করবে। সেখানে জমি চাষ করবে, মানুষকে সাহায্য করবে। হয়তো তাদের শক্তি কম, হয়তো পথ কঠিন, কিন্তু অন্তত সে জীবন হবে নিজের।

ভোরের আলোয় মায়ারী শেষবারের মতো তাকাল হুগলির দিকে। আগুনে দগ্ধ শহর, ধোঁয়ার দাগ, ছাইয়ে ভরা রাস্তা—সব যেন তার অতীতের প্রতীক। সে ফিসফিস করে বলল, “আমি আর দাসী নই। আমি মুক্ত।”

কুমুকে নিয়ে, রহিমকে পাশে পেয়ে, সে ছোট নৌকায় পা রাখল। নদীর জলে তখন নতুন সূর্যের প্রতিফলন ঝলমল করছিল। নৌকা ধীরে ধীরে গা ভাসিয়ে চলল দূরের দিকে।

মায়ারীর যাত্রা শুরু হয়েছিল বন্দী হিসেবে, আরাকানের ছোট্ট গ্রাম থেকে শিকলে বাঁধা দাসী হয়ে। তারপর সমুদ্রের ঝড়, জলদস্যুর আক্রমণ, প্রাসাদের শাসন, ষড়যন্ত্র আর আগুনে ভরা হুগলি—সব পেরিয়ে অবশেষে সে দাঁড়াল মুক্তির পথে।

এ যাত্রা কেবল তার নয়। এ যাত্রা ছিল ইতিহাসেরও—মানুষের বেঁচে থাকার, লড়াই করার, মুক্তির জন্য জেদ ধরে রাখার ইতিহাস।

নৌকা যখন দূর দিগন্তের দিকে ভেসে চলছিল, তখন মায়ারী চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলল—
“আমার যাত্রা শেষ হয়নি। এ তো কেবল শুরু।”

***

9e30fc97-c90b-48c8-bafd-7ab48cc539f1.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *