পল্লব দাস
এক
রোদ ফোটার আগেই ঘুম ভেঙে যায় বেণীমাধবের। দোকানের পাশেই তার ছোট্ট এক কামরা, সেখানেই শুয়ে শুয়ে ভোরের পাখির ডাক শোনেন তিনি। প্রতিদিনের মতো আজও সকালটা এক অদ্ভুত মায়ায় মোড়া—মৃদু কুয়াশা, রোদ উঠবার মুখে, আর দূরের ফুলের গাছগুলো থেকে ভেসে আসা একরাশ সুবাস।
দোকানটা খুব বড় নয়। বাঁশ আর টিনের চালের ছোট্ট ঘর। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় যেন কোনো মেলার অস্থায়ী দোকান। কিন্তু বেণীমাধবের কাছে এটা তার জীবনের চেয়ে বেশি। “ফুলের দোকান”—নামটা সেভাবে কেউ দেয়নি, শুধু একটা ছোট কাগজের বোর্ডে হাতে আঁকা ‘ফুলের দোকান’ লেখা। দোকানজুড়ে সারি সারি ফুলের ঝুড়ি—রজনীগন্ধা, বেলি, জুঁই, গাঁদা, গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, অর্কিড—যেন রঙের মিছিল।
তিনি দোকান খুলে বসতেই প্রথমেই একবার চোখ বুলিয়ে নেন প্রতিটি ফুলের দিকে। সযত্নে সিঁচিয়ে রাখা ফুলগুলোর পাঁপড়ির ফাঁকে শিশির জমে আছে। তার কাছে প্রতিটি ফুলই যেন একটা করে গল্প—কারও ভালোবাসা, কারও প্রতীক্ষা, কারও কান্না, কারও অমোঘ অভিমান।
সকালবেলা সবচেয়ে ভালো লাগে তার রজনীগন্ধার গন্ধটা। মায়াবী, মিষ্টি আর একরাশ স্মৃতিভেজা। প্রতিবার ফুলের গন্ধে সেই পুরনো গল্পগুলো মনে পড়ে যায়। সেই গল্প, যা তিনি কাউকে বলেননি।
এই দোকানটা তার বাঁচার অবলম্বন। খুব বেশি রোজগার হয় না, কিন্তু এ দোকানেই তার দুঃখ, সুখ, সব কিছু। পাশের চায়ের দোকানের মালিক হরিপদ তাকে বলে—“বেণীমাধবদা, তুমার দোকানডা আর ফুলের দোকান না, যেন গল্পের দোকান।” কথাটা শুনে বেণীমাধব মুচকি হেসেছিলেন। সত্যিই তো, প্রতিটি ফুলেই কত শত অজানা গল্প লুকিয়ে থাকে!
আজ সকালটায় কিন্তু অন্যরকম কিছু একটা আছে—হাওয়ায় যেন অন্যরকম একটা সুবাস। কেমন যেন অজানা অদ্ভুত।
হঠাৎ, এক অচেনা পায়ের আওয়াজ। দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল একজন মেয়ে—মাথায় হালকা ওড়না, হাতে লাল পার্স। তার চোখে কেমন অদ্ভুত আলো। বেণীমাধব খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন মেয়েটির দিকে।
মেয়েটি চোখ তুলে সোজা তাকায় তার দিকে। হালকা মৃদু হাসি ফুটে ওঠে ঠোঁটে।
“এই যে, আপনার কাছে এমন কোনো ফুল আছে, যা একবার ফোটে, তারপর মিলিয়ে যায়?”
বেণীমাধব থমকে গেলেন। এমন প্রশ্ন তো কেউ করে না। তিনি বললেন—“মেয়ে, প্রতিটি ফুলেরই একটা জীবন থাকে। কেউ কয়েক ঘণ্টা, কেউ কয়েকদিন বাঁচে। তবে এমনও কিছু ফুল আছে, যা মানুষের মনের গল্পের মতো—একবার ফোটে, তারপর হারিয়ে যায়।”
মেয়েটির ঠোঁটের কোণে হাসি। তার হাতে ধরা লাল পার্সটা মৃদু কেঁপে উঠল যেন। “এই রজনীগন্ধা…একটা নিঃশ্বাসের মতো।”
বেণীমাধব কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। বুকের ভেতরটা ধকধক করছে। কেমন যেন অজানা আতঙ্ক আর কৌতূহল একসাথে ভর করেছে মনে।
মেয়েটি তখন রজনীগন্ধা হাতে তুলে নিল। সে যেন হাওয়ার সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল—অদ্ভুত এক আলোয় ভিজে থাকা সকালবেলা।
বেণীমাধবের মনে হল, এই মেয়েটা শুধু ফুল কিনতে আসেনি—সে যেন কোনো গল্পের খোঁজ করছে, যা বহুদিন ধরে তার বুকের ভেতর লুকিয়ে আছে।
সেদিনের সকালটা অন্যরকম ছিল। দোকানের প্রতিটি ফুল যেন নতুন করে সুবাস ছড়াচ্ছিল।
দুই
পরের দিন বিকেলের আলোটা ঠিক সোনালি রঙের ছিল। বেণীমাধবের দোকানের সামনে রাস্তার ধুলো, ফুলের সুবাস, আর মানুষের কোলাহলের ভেতরেও একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা যেন জমে ছিল। দোকানটা তেমনই সাজানো—ঝুড়িতে ঝুড়িতে ফুল, আর প্রতিটি ফুলেই তার অমোঘ গল্প।
বেণীমাধব ফুলের পাঁপড়িগুলো সরিয়ে ধুলো ঝাড়ছিলেন, আর ভেতরে ভেতরে ভাবছিলেন—সকালের সেই মেয়েটির কথা। এত বছর দোকান চালাচ্ছেন, তবু এমন প্রশ্ন কেউ করেনি।
“এই যে, আপনার কাছে এমন কোনো ফুল আছে, যা একবার ফোটে, তারপর মিলিয়ে যায়?”
তারপর মেয়েটির সেই অদ্ভুত হাসি। কী যেন অদ্ভুত! সে যেন শুধু ফুল কিনতে আসেনি, সে যেন কোনো গল্প খুঁজতে এসেছে।
হঠাৎ দোকানের ঘরোয়া ঘণ্টির মতো শব্দ। তিনি তাকিয়ে দেখেন—সেই মেয়েটি আবার এসেছে।
আজ তার পরনে সাদা-নীল সালোয়ার কামিজ। তার হাতে আবার সেই লাল পার্সটা। চোখে অদ্ভুত আলো—যেন কোনো গল্পের মধ্যে হারিয়ে গেছে।
বেণীমাধবের বুকের ভেতরটা ধুকপুক করে ওঠে। মেয়েটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে দোকানের ভেতরে।
“দাদা, কাল আপনার দোকানের রজনীগন্ধা খুব সুন্দর ছিল,” সে বলে।
বেণীমাধব হাসলেন। “তাই নাকি? তুমি কই গিয়েছিলে? তোমাকে তো আর দেখা গেল না।”
মেয়েটি চোখ নামিয়ে মৃদু হাসল। “তখন চলে যেতে হয়েছিল।”
তারপর সে ধীরে ধীরে দোকানের এক কোণায় রাখা সাদা রজনীগন্ধার দিকে তাকিয়ে থাকল।
“এই ফুলটা…একটা গল্পের মতো,” মেয়েটি বলল।
বেণীমাধব অবাক হয়ে তাকালেন। “গল্পের মতো? কেমন করে?”
মেয়েটি এবার চোখ তুলে তাকাল। “আমাদের জীবনের গল্পের মতো। কখনও ফোটে, কখনও ঝরে যায়। কিছু গল্প থেকে যায় সুবাস হয়ে, কিছু গল্প অদৃশ্য হয়ে যায়।”
বেণীমাধব চুপ করে গেলেন। মেয়েটার কণ্ঠে কেমন যেন চেনা সুর। যেন অনেক বছর আগে এই কথাগুলো শুনেছেন, কোথায় যেন…।
মেয়েটি তখন দোকানের কোণায় রাখা পিতলের গ্লাসে জল ঢেলে রজনীগন্ধার গোড়ায় ঢালছিল। প্রতিটি ফুলের পাঁপড়িতে জলের ফোঁটা ঝরছিল, ঠিক বেণীমাধবের চোখের কোণের অশ্রুর মতো।
“আপনার দোকানটা খুব সুন্দর,” মেয়েটি বলল। “এখানে আসলে মন ভালো হয়ে যায়। মনে হয়, সব গল্পকে আবার ছুঁয়ে ফেলা যায়।”
বেণীমাধবের গলায় কাঁপন ধরে গেল। “তুমি কে মা? কী চাও?”
মেয়েটি হেসে ফেলল। “আমি? আমি তো কেবল গল্পের সুবাস নিতে এসেছি।”
তারপর ধীরে ধীরে পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করল। রোদ তখন আর দোকানের ভেতর নেই। সোনালি আলো মিলিয়ে যাচ্ছে গোধূলির ছায়ায়।
বেণীমাধব তাকিয়ে থাকলেন মেয়েটির পেছনে। মনে হচ্ছিল, এই মেয়েটি সত্যিই রক্তমাংসের মানুষ নয়—সে যেন কোনো গল্পের পাতার চরিত্র, যাকে ফুলের সুবাসে মিশিয়ে রেখেছেন কেউ।
দোকানের কোণে রাখা রজনীগন্ধাগুলো তখন ভিজে উঠছিল জলে, আর বেণীমাধবের বুকের ভেতর অদ্ভুতভাবে কেঁপে উঠছিল সেই না-বলা গল্পগুলো।
তিন
বিকেলটা কিছুটা হালকা হয়ে এসেছে। দোকানের বাইরে বৃষ্টি থেমে, বাতাসে রজনীগন্ধার গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। বেণীমাধব হাতের কাজ শেষ করে একটু বসতে গিয়েই সেই মেয়েটির কথা মনে পড়ল।
দুটো দিন ধরে সে আসছে, প্রতিবারই কিছু না কিছু অদ্ভুত কথা বলছে। দোকানের এই ছোট্ট দুনিয়ায় কত লোক আসে-যায়, কিন্তু এমনভাবে কেউ কখনো গল্প চায়নি।
আজও বেণীমাধব দোকান খুলেই প্রতিটি ফুলকে জলে সিঁচে রাখলেন, যেন সেগুলো প্রাণ ফিরে পায়। রজনীগন্ধার পাঁপড়িগুলোকে আলাদা করে রাখলেন। মেয়েটির জন্যই।
ঠিক তখনই ঘণ্টির শব্দ।
—“দাদা, আজ গল্প হবে তো?”
সেই মেয়েটি। চোখের কোণে দুষ্টু হাসি।
বেণীমাধব মৃদু হেসে বললেন, “তুমি যে গল্প চাও, তা তো কেবল ফুলের গন্ধে লুকিয়ে থাকে।”
মেয়েটি ধীরে ধীরে দোকানের ভেতর ঢুকে একের পর এক ফুলের গন্ধ নিচ্ছিল। কখনও বেলি, কখনও গাঁদা, কখনও গোলাপ।
—“এই গন্ধগুলো…একেকটা গল্পের মতো, তাই না দাদা?”
বেণীমাধব চমকে গেলেন। এ মেয়েটি যেন তার ভেতরের কথা জেনে যাচ্ছে।
মেয়েটি এবার রজনীগন্ধার পাঁপড়ি হাতে তুলে নিল।
—“আপনার প্রথম প্রেমের গল্প এই ফুলের গন্ধে লুকিয়ে আছে, তাই তো?”
বেণীমাধবের শরীর শিউরে উঠল। কিভাবে জানে ও এইসব? কার কাছে শুনেছে?
—“তুমি…কী করে জানলে?”
মেয়েটি মৃদু হাসল। তার চোখে ভাসছিল কেমন এক অমোঘ আলো।
—“ফুলের গন্ধের মধ্যেই তো মানুষের গল্প লুকিয়ে থাকে, দাদা। আপনার চোখে যত না কথা, এই ফুলগুলোর সুবাসে তার চেয়েও বেশি। সেই গল্প আমি শুনতে চাই।”
বেণীমাধব আর কোনো কথা খুঁজে পেলেন না। বুকের ভেতর জমে থাকা পুরনো কষ্টগুলো যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে।
মেয়েটি এবার ধীরে ধীরে দোকানের এক কোণায় রাখা গোলাপের তোড়াটা তুলে নিল।
—“এই গোলাপটা—যেটা আপনি প্রতিদিন জল দেন। এটাতেও কি কোনো গল্প লুকিয়ে আছে?”
বেণীমাধবের চোখে জল চলে এল।
—“এই গোলাপ…ওটা আমার মায়ের প্রিয় ফুল ছিল। ছোটবেলায় মা যখন মারা গেলেন, ওর গন্ধে মায়ের শাড়ির গন্ধ খুঁজতাম। তখন বুঝিনি, ফুলের সুবাসও মানুষের মতোই গল্প বলে যায়।”
মেয়েটি চুপ করে গেল। তার চোখে মুগ্ধতা।
—“আপনি জানেন, এই গল্পগুলোই আমাকে এখানে বারবার টেনে আনে।”
বেণীমাধব বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন। এই মেয়েটা কি সত্যিই মানুষ, না কোনো অদৃশ্য আত্মা? চোখের সামনে ধোঁয়াটে হয়ে উঠছে দোকানের বাতাস।
—“তুমি কে? কেন এলে?”
মেয়েটি ধীরে ধীরে দোকান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। পেছন ফিরে বলল—
—“আমি সেই গন্ধ, যা আপনার গল্পগুলোকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চাই।”
দোকানের বাতাসে তখনো রজনীগন্ধার সুবাস ভাসছিল, আর বেণীমাধব চুপ করে তাকিয়ে ছিলেন। বুকের ভেতর অজানা কষ্ট আর গল্পের গন্ধ মিলেমিশে এক অদ্ভুত আবেশ তৈরি করছিল।
চার
রাতে বেণীমাধবের ঘুম হচ্ছিল না। সেই মেয়েটি—যে গল্প শোনে, যে গন্ধে গল্প খুঁজে পায়—তার কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল মনে। কে এই মেয়ে? কী করে সে বেণীমাধবের জীবনের না বলা কথাগুলোও জেনে গেল?
চোখের সামনে ভেসে উঠছিল সেই গোলাপের গন্ধ, সেই মায়ের শাড়ি, সেই ছোট্ট দোকান—সব মিলিয়ে একরাশ আবেগ।
সকালে দোকান খুলেই দেখলেন, মেয়েটি দোকানের সামনের বেঞ্চে বসে আছে। চোখে যেন রাতের জাগরণ।
—“দাদা, গল্প শোনাবেন না?”
বেণীমাধব ধীরে ধীরে দোকানে ঢুকে রজনীগন্ধার তোড়াটা মেয়েটির হাতে দিলেন।
—“এই রজনীগন্ধা—তুমি জানো, এই ফুলের সুবাসে লুকিয়ে আছে এমন কিছু কথা, যা কাউকে বলা যায় না। কিন্তু তবু, সেই কথা ঝরাপাতার মতো মাটিতে পড়ে থাকে। কখনো কেউ তুলে নেয়, কখনো কেউ পায় না।”
মেয়েটি মুগ্ধ হয়ে শুনছিল। চোখের কোণে কৌতূহল।
—“কী কথা, দাদা?”
বেণীমাধবের বুকটা ধক করে উঠল।
—“অনেকদিন আগে, এই দোকান যখন নতুন, তখন এক মেয়ে প্রায়ই আসত। তার চোখে ছিল দুঃখের ছায়া। প্রতিবার রজনীগন্ধা কিনে যেত। একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, এত রজনীগন্ধা দিয়ে কী করে? মেয়েটি বলেছিল—‘এই গন্ধে আমি আমার ভালোবাসাকে খুঁজে পাই।’ তারপর আর আসেনি সে।”
মেয়েটি বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল।
—“তাহলে এই দোকানটা শুধু দোকান নয়, এটা একেকটা মানুষের গল্পের ঘরও বটে।”
বেণীমাধব হেসে ফেললেন।
—“তাই তো। এখানে কত রকমের মানুষ আসে—কারো বিয়ে, কারো প্রিয়জনের মৃত্যু, কারো জীবনের প্রথম প্রেম…এই দোকানটা সব গল্পের সাক্ষী।”
মেয়েটি এবার দোকানের কোণায় রাখা ছোট্ট বেলির তোড়াটা হাতে নিল।
—“এই বেলি—এত সাদা কেন? এর গল্প কী?”
বেণীমাধব চোখ বন্ধ করলেন। তার কণ্ঠে কাঁপন।
—“বেলি ফুল সাদা, কারণ ভালোবাসার মতো পবিত্র। কিন্তু এই ফুল দিয়ে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় বিয়ের অনুষ্ঠানে, আবার শবযাত্রাতেও। তাই এই ফুলে লুকিয়ে আছে শুরু আর শেষ—দুটো গল্পই।”
মেয়েটি অবাক হয়ে তাকাল।
—“আপনি অনেক জানেন, দাদা। আপনার গল্পগুলো আমায় টানে।”
বেণীমাধব এবার গভীর নিশ্বাস ফেললেন।
—“তুমি শুধু গল্প শুনতে আসো, নাকি অন্য কিছু খুঁজছো?”
মেয়েটি চুপ করে গেল। তারপর হেসে বলল—
—“আমি আসলে সেই গল্প খুঁজছি, যা কেউ আর মনে রাখেনি, সেই গল্প যা ঝরাপাতার মতো মাটিতে পড়ে থেকেছে।”
বেণীমাধব মেয়েটির চোখে তাকালেন। এক অদ্ভুত আলো ছিল সেখানে।
—“তুমি তাহলে সেই ঝরাপাতার কন্ঠস্বর, তাই তো?”
মেয়েটি মৃদু হাসল।
—“হয়তো। গল্পগুলো হারিয়ে গেলে গন্ধ হয়, আর সেই গন্ধই আমাকে টানে।”
দোকানের বাতাসে তখন একরাশ গল্পের গন্ধ ভাসছিল। রজনীগন্ধা, বেলি, গোলাপ—সব মিলে এক অদ্ভুত মায়া তৈরি করেছিল।
বেণীমাধব আর কোনো প্রশ্ন করতে পারলেন না। শুধু বসে রইলেন। বুকের ভেতর যেন ঝরাপাতার মতো কথা পড়ে রইল—যা কখনো কাগজে লেখা হবে না, শুধু গন্ধে মিশে যাবে।
পাঁচ
রাতের অন্ধকারে দোকানের পেছনের ঘরে বসে বেণীমাধব একা একা ভাবছিলেন। দোকানের সামনের বাতি নিভিয়ে দিয়েছেন, কেবল ছোট্ট প্রদীপের আলো জ্বলছে। সেই আলোতে তার মুখটা যেন অজানা গল্পের ছায়ায় ঢাকা পড়ে গেছে।
মেয়েটির কথাগুলো তাকে ঘুমোতে দিচ্ছিল না। “আমি সেই গল্প খুঁজছি, যা কেউ আর মনে রাখেনি।”
কোনো মানুষ এত অদ্ভুতভাবে গল্প খুঁজে বেড়ায়? নাকি সে সত্যিই কোনো অদৃশ্য আত্মা?
হঠাৎ হাওয়ায় রজনীগন্ধার সুবাস ভেসে এল। সেই সুবাস বেণীমাধবকে অনেক বছর আগের এক বিকেলে ফিরিয়ে নিয়ে গেল।
তখন দোকান নতুন। একদিন এক তরুণী এসেছিল—অদ্ভুত এক হাসি নিয়ে। সে প্রতিদিন রজনীগন্ধা কিনে যেত, আর বেণীমাধবের সঙ্গে গল্প করত। তার হাসিতে লুকিয়ে থাকত একরাশ ব্যথা, চোখে এক অদ্ভুত আলোর ঝিলিক।
একদিন, সেই মেয়েটি বলেছিল—“দাদা, এই ফুলের সুবাসে আমি হারিয়ে যাওয়া কারো গল্প খুঁজে পাই। সে আমাকে ছেড়ে গেছে, কিন্তু এই গন্ধ আমাকে ওর কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।”
বেণীমাধব প্রশ্ন করেছিল—“তোমার সেই গল্পটা কেমন?”
মেয়েটি বলেছিল—“গল্পটা অসমাপ্ত। সে চলে গেছে। সেই গল্পের শেষ আমি এখনো খুঁজে বেড়াচ্ছি।”
তারপর আর আসেনি মেয়েটি। কেবল প্রতিদিন রজনীগন্ধার সুবাস দোকানজুড়ে ভাসত, আর বেণীমাধব ভেবে যেতেন—সেই মেয়েটি হয়তো আজও কোনো গল্পের শেষ খুঁজছে।
বেণীমাধব ধীরে ধীরে প্রদীপটা নিভিয়ে দোকানের ভেতর এলেন। সেই গল্পগুলো—যা আজও তার বুকের ভেতর জ্বলছে—কেউ জানে না। কেবল এই ফুলের সুবাস জানে।
হঠাৎ শুনতে পেলেন দোকানের ঘণ্টির মৃদু শব্দ। তিনি চমকে উঠে দরজার দিকে তাকালেন।
মেয়েটি দাঁড়িয়ে। সেই মায়াময় হাসি, সেই চোখের আলো।
—“দাদা, গল্প শেষ হলো?”
বেণীমাধব ঠোঁট কেঁপে উঠল। “না মা, গল্প শেষ হয়নি। এই গল্পের শেষ কে খুঁজে পায়? কিছু গল্পের শেষ হয় না।”
মেয়েটি দোকানের ভেতরে ঢুকে এল। চারপাশে ফুলের সুবাসে বাতাস ভারী।
—“তাহলে আপনার গল্পের শেষটুকু আমায় শোনাবেন না?”
বেণীমাধব এবার উঠে দাঁড়ালেন। ধীরে ধীরে বললেন—
—“আমার গল্পের শেষ নেই। এই ফুলগুলোই আমার গল্পের শেষ। প্রতিটি ফুল একেকটা গল্প বয়ে আনে, আবার তারাই হারিয়ে যায়। তাই এই দোকানটা আসলে এক গল্পের পাতা।”
মেয়েটি চুপ করে শুনছিল। তারপর ধীরে ধীরে রজনীগন্ধার একটা তোড়া তুলে নিল।
—“আপনার গল্পের শেষ আমি খুঁজে আনব।”
বেণীমাধব এবার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। “তুমি পারবে?”
মেয়েটি তার চোখে চোখ রাখল।
—“আমি সেই গল্পের সুবাস খুঁজতে এসেছি, যা ঝরাপাতার মতো মাটিতে লুকিয়ে থাকে। আমি সেই শেষটুকু খুঁজে আনব, দাদা।”
বেণীমাধব এবার আর কথা বলতে পারলেন না। দোকানের বাতাসে তখনো রজনীগন্ধার সুবাস ভাসছিল, আর সেই সুবাসের ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল গল্পের শেষের অদৃশ্য সুর।
ছয়
রাতের অন্ধকারটা যেন আরেকটু গাঢ় হয়ে এসেছে। দোকানের বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। বেণীমাধব দোকানের টেবিলটায় বসে হাতের তালুতে মুখ গুঁজে ছিলেন। হঠাৎই যেন কিছু একটা হারিয়ে ফেলার বেদনা বুকের ভেতর দলা পাকিয়ে উঠল।
সেই মেয়েটি—যে গল্প খুঁজে বেড়ায়, যার চোখে অদ্ভুত আলো—তার কথা আজ আরও বেশি করে মনে পড়ছে।
আজ সারাদিন দোকানে কেউ আসেনি। বেণীমাধব রজনীগন্ধার তোড়াগুলো জলে ভিজিয়ে রেখেছেন, যেন গল্পের সুবাস হারিয়ে না যায়।
হঠাৎ দোকানের দরজায় ঘণ্টি বেজে উঠল। সেই মেয়েটি।
—“দাদা, আজ গল্প শেষ হবে?”
বেণীমাধব ধীরে ধীরে মাথা তুলে তাকালেন। মেয়েটির চোখে আলো, মুখে মায়া।
—“শেষ? কিছু গল্পের কি শেষ হয় মা?”
মেয়েটি দোকানের ভেতরে এসে চারপাশে তাকিয়ে দেখল। গোলাপ, বেলি, গাঁদা, রজনীগন্ধা—সব ফুলেই যেন অদ্ভুত আলো ঝিলিক দিচ্ছে।
—“আপনি বলেছিলেন, এই ফুলগুলোতে গল্প লুকিয়ে থাকে। আজ আমি সেই গল্পের শেষ শুনতে এসেছি।”
বেণীমাধব চুপ করে রইলেন। বুকের ভেতর জমে থাকা কথাগুলো যেন আর আটকানো যাচ্ছে না।
—“অনেক বছর আগে, এক মেয়ে এই দোকানে আসত। সে রজনীগন্ধা কিনত, গল্প বলত, গল্প শুনত। তারপর একদিন সে হারিয়ে গেল। আমি খুঁজে পাইনি তাকে। তার গল্পের শেষটুকু না শুনিয়ে সে চলে গেল।”
মেয়েটি মৃদু হেসে বলল—“তারপর?”
বেণীমাধবের গলা কাঁপছিল।
—“তারপর আমি প্রতিদিন রজনীগন্ধা ভিজিয়ে রাখি। যেন কোনোদিন সে ফিরে আসে। যেন গল্পের শেষটা বলে যায়।”
মেয়েটির চোখে অদ্ভুত এক আলো জ্বলে উঠল।
—“আপনি জানেন, সেই মেয়েটি আমি?”
বেণীমাধব চমকে উঠলেন। তার চোখে জল চলে এল।
—“তুমি…! তুমি সেই মেয়ে?”
মেয়েটি এবার রজনীগন্ধার তোড়াটা হাতে তুলে নিল।
—“হ্যাঁ, দাদা। আমি সেই গল্পেরই শেষাংশ। আমি সেই গল্পের সুবাস হয়ে ফিরে এসেছি। আজ আমি আপনার গল্পের শেষ শুনতে চাই।”
বেণীমাধব কেঁপে উঠলেন। দোকানের বাতাসে তখন কেবল রজনীগন্ধার সুবাস নয়, যেন অজানা কষ্ট, না বলা গল্প আর অশ্রুজলে মিশে এক অদ্ভুত সুর বেজে উঠল।
—“তুমি ফিরে এলে…কিন্তু গল্পের শেষ আমি আর খুঁজে পাইনি মা। তুমিই যদি সেই গল্পের শেষ হও, তবে আমাকে সেই শেষটা শোনাও।”
মেয়েটির চোখে জল।
—“দাদা, গল্পের শেষটা আমাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। কখনো সেটা খুঁজে পাই, কখনো পাই না। এই ফুলগুলোই আমাদের সেই গল্প শোনায়—তাদের সুবাসেই আমরা বেঁচে থাকি, আবার হারিয়ে যাই।”
দোকানের বাতাসে সেই মুহূর্তে রজনীগন্ধা, গোলাপ, বেলি—সব ফুলের সুবাস মিলে এক অদ্ভুত মাদকতা ছড়িয়ে পড়ল।
বেণীমাধব মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তার চোখে জল, মুখে ম্লান হাসি।
—“তাহলে এই দোকানটাই আমাদের গল্পের শেষরাতের আলো, তাই না মা?”
মেয়েটি মৃদু হাসল।
—“হ্যাঁ দাদা, এই দোকানই আমাদের গল্পের শেষরাতের আলো।”
সাত
রাত গভীর হয়েছে। দোকানের সামনে কুয়াশার আস্তরণ জমেছে। চারপাশে নিস্তব্ধতা। বেণীমাধব চুপ করে বসে আছেন, তার চোখে ক্লান্তি আর আশ্চর্যের মিশেল। আজ যেন সমস্ত গল্পের গন্ধ এসে মিলে গেছে তার এই ছোট্ট দোকানে।
হঠাৎ মেয়েটি আবার এসে দাঁড়াল। তার চোখে সেই অদ্ভুত আলো।
—“দাদা, গল্প শেষ হয়েছে?”
বেণীমাধব দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। “শেষ? শেষরেখা টানতে কে পারে মা? কিছু গল্পের শেষ নেই, কিছু গল্পের শেষ আমরা টানতে পারি না।”
মেয়েটি এবার দোকানের কোণ থেকে একটা গোলাপের তোড়া হাতে নিল। গোলাপের লালচে রঙ যেন রাতে অদ্ভুতভাবে জ্বলজ্বল করছে।
—“এই গোলাপে কি গল্প লুকিয়ে আছে, দাদা?”
বেণীমাধব তার দিকে তাকিয়ে বললেন—
—“গোলাপ ভালোবাসার প্রতীক। কিন্তু প্রতিটি গোলাপের কাঁটায় লুকিয়ে থাকে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা। তাই এই ফুলে ভালোবাসা আর বেদনা—দুটোই মিশে থাকে।”
মেয়েটির চোখ চিকচিক করে উঠল।
—“তাহলে গল্পের শেষরেখা কি এই কাঁটা?”
বেণীমাধব চমকে উঠলেন। “তুমি ঠিকই বলেছ মা, প্রতিটি গল্পের শেষের আগে কাঁটা থাকে—ব্যথা থাকে—তারপরই আসে সুবাস। তাই শেষরেখা মানেই যন্ত্রণা, আবার মুক্তিও।”
মেয়েটি ধীরে ধীরে দোকানের ভেতরটা দেখছিল। সব ফুলের সুবাস যেন একসঙ্গে মিশে গেছে বাতাসে।
—“দাদা, গল্পগুলো কি কেবল আপনার?”
বেণীমাধব হেসে বললেন—
—“না মা, এই দোকানে প্রতিটি মানুষ তার গল্প ফেলে যায়। কেউ বিয়ের রাতে, কেউ প্রিয়জনকে হারিয়ে, কেউ নতুন জীবনের শুরুতে। সেইসব গল্পের শেষরেখা আমি খুঁজে পাই এই ফুলগুলোর সুবাসে।”
মেয়েটির চোখে অশ্রু ঝরল।
—“দাদা, আমি সেই গল্পের শেষরেখা দেখতে চাই।”
বেণীমাধব এবার ধীরে ধীরে দোকানের ছোট্ট আলমারিটা খুললেন। ভিতরে কিছু পুরোনো চিঠি, শুকিয়ে যাওয়া ফুল আর একজোড়া কাঁচের চুরি।
—“এগুলো সেইসব গল্পের শেষরেখা মা। এই চিঠি লিখে কেউ ফিরতে পারেনি, এই ফুল কেউ শুকিয়ে যেতে দেয়নি, এই চুরি পড়ে থেকেছে, অথচ কেউ পরে নেয়নি।”
মেয়েটি কাঁচের চুরি হাতে নিয়ে তাকাল।
—“দাদা, তাহলে এই দোকানটাই গল্পের শেষরেখা।”
বেণীমাধব ম্লান হেসে বললেন—
—“হ্যাঁ মা, এই দোকানটাই গল্পের শেষরেখা। এখানে শেষ হয়, আবার এখানেই শুরু হয়।”
বাইরে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। দোকানের সামনে কুয়াশা ধীরে ধীরে সরছে।
মেয়েটি চুরি হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল। তার পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল কুয়াশার ভেতরে।
বেণীমাধব চুপ করে বসে রইলেন। দোকানের বাতাসে তখনো রজনীগন্ধা, গোলাপ, বেলি—সব ফুলের সুবাসে মিশে আছে হাজারো গল্পের শেষরেখা।