Bangla - সামাজিক গল্প

সীমানার এপারে

Spread the love

রবীন মণ্ডল


পর্ব ১: ভাঙনের দিন

বুকের ভেতর কেমন একটা ধকধক করছিল। যেন কিছু একটা ভেঙে পড়বে যে কোনো মুহূর্তে। তবে বাড়ির বাঁশের বেড়া বা খড়ের চাল ভেঙে পড়া নয়—এই ধকধক আসলে একটা দেশ ভেঙে পড়ার শব্দ। সেই শব্দ রুখে দাঁড়াতে পারে না কোনো কিশোরী মেয়ে, যেমন পারছিল না আমিও।

আমার নাম নাজমা। বয়স পনেরো। ঠিক পনেরোও নয়—চৌদ্দ পেরিয়ে আরও ছয় মাস। তবু বাবা বলে, “তুই তো আর ছোট মাইয়া না, হেই জন্যই তো কইছি হেরা আইলে পিছনের দরজা দিয়া পলাইয়া যাইবা।”
“হেরা” মানে কারা সেটা আমি জানি।
ওরা যখন আসে, তখন বাড়িগুলো পোড়ে। খড়ের চালের গন্ধ পুড়ে ওঠে আকাশে। ওদের ছায়াও ভয়ানক।
কিন্তু আমি পালাতে পারিনি। কারণ যেদিন ওরা এল, সেদিন মা বিছানায় পড়ে ছিলেন। জ্বর আর কাঁশিতে কাবু। এক হাতে মা, এক হাতে ভাই সাদিক—দুই বছরের ছোট ভাই। আর আমি কি ফেলে পালাই?

ঘটনাটা রাত দুটো নাগাদ। হঠাৎ বাইরে কুকুরের কান্নার মতো শব্দে ঘুম ভাঙে। জানালার ফাঁক দিয়ে দেখি, দূরের গাঁওয়ে আগুন জ্বলছে। সবার চোখ তখন আগুনে আটকে।
বাবা চুপচাপ উঠে দরজা বন্ধ করে দেয়। মা ঘরের কোণে চুপ করে বসে, আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “সাদিকরে বুকের কাছে রাখ।”
আমি বুঝে যাই, ভয়টা এবার আমাদের গায়ে লেগেছে।

সেই রাতে ঘুম আসে না। জানালার ফাঁকে দেখি, আলোর রেখা নেমে আসছে আমাদের গ্রামের দিকে। হাওয়ায় পোড়া চুল, পোড়া চালের গন্ধ।
তখনই বাবার কণ্ঠ শোনা যায়, “চলতে হবে।”
“কোথায় যাব, বাবা?”
“পারে। সীমানা পেরোতে হইব। নইলে মরতে হইব।”

সীমানা! সেই শব্দটা যেন সারা শরীরকে জমিয়ে দিল। ছোটবেলা থেকে শুনেছি, সীমান্তে গুলি চলে। মানুষ মরার খবর আসে, কিন্তু কেউ দেখাতে পারে না মরদেহ।
আমি জিজ্ঞেস করি না, মা যাবে তো?
বাবা বলে, “মারে কোলে নিছি। চল।”

সেই রাতেই আমাদের গ্রাম ফেলে রওনা হই। সাদিক ঘুমিয়ে ছিল আমার কোলে, মা ছিল বাবার পিঠে বাঁধা একটা মশারির ভাঁজের মতো। বাবার কাঁধের উপর মাথা রেখে নিঃশব্দে হেঁটেছিলেন, যেন জানতেন, আর কোনোদিন এই পথ ফেরত আসা হবে না।

আমরা হেঁটেছিলাম কাদায়, জলে, পা-ফাঁটা জমিতে। চারদিকে শোঁ শোঁ হাওয়া। মাঝে মাঝে কুকুরের ডাক। বাবার সঙ্গে আরও দশ বারো জন ছিল—সবাই আমাদের মতো উদ্বাস্তু। কেউ এক হাঁটু জলে হাঁটছে, কেউ সন্তানের হাত ধরে কাঁদছে। কেউ নিজের মাকে পেছনে ফেলে আসার যন্ত্রণায় গম্ভীর মুখে চলেছে।

সকাল হতেই হঠাৎ সবাই থেমে যায়। সামনে নদী। ব্রহ্মপুত্র। সীমান্তের কাছাকাছি জায়গা। ওপার মানে, নতুন দেশ।
কিন্তু সেই নদীও যেন আমাদের মতো গুমরে কাঁদছিল। জলের তোড় অসম্ভব। একটা পাটাতন ভাঙা, নৌকাও নেই।

বাবা একটু দূরে গিয়ে এক লোকের সঙ্গে কথা বলে। লোকটা নৌকা চালায়, কিন্তু টাকার বদলে চায় সোনার কানের দুল। মা কিছু বলে না, নিজের কানে হাত দেয়। কিন্তু কান খালি।
বাবা তার পাঞ্জাবির ভিতর থেকে একটা ছোট কাপড়ের থলি বার করে দেয়—মায়ের বিয়ের সময়ের নাকছাবি ছিল তাতে।

আমরা সেই নৌকায় উঠি। আমি, মা, সাদিক আর বাবা।
নৌকা যখন নদীর মাঝখানে, তখন হঠাৎ একটা আওয়াজ—“থেমে যা! গুলি চলবে!”
তীরের দিক থেকে আলো এসে পড়ে আমাদের মুখে। আমি বাবার হাত শক্ত করে ধরি। মা তখন নিঃশব্দে কাঁদছিলেন। সাদিকও ভয় পেয়ে চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল।

নৌকার মাঝি শুধু একবার বলল, “ওপারে যদি যেতে না দেন, তবে এপারে মরতে দিন।”
আলোটা সরিয়ে নেয় কেউ, আর গুলির শব্দ হয় না। নৌকা ধীরে ধীরে এগোয়, আমরা পেরিয়ে আসি সীমানা।

ওপারে উঠে প্রথম যে শব্দটা কানে আসে, সেটা বাংলায়—“আরে আরেকটা পরিবার এলো। নাম লিখো।”
কিন্তু সেটা কোনো স্বাগত নয়। কাঁটাতারের ওপারেও আমাদের জন্য শীতলতা ছাড়া আর কিছু নেই।
আমাদের রাখা হয় এক ছাপড়া ঘরের নিচে। মাটির বিছানা, দুটো পুরোনো কম্বল।
একটা ছিন্ন পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে আমি ভাবি, এটা কি তবে আমার নতুন দেশ?

মা সেই রাতেই আরও খারাপ হয়ে পড়ে। কাশি আর জ্বরে কাঁপতে থাকে। বাবা চিকিৎসা জোগাড় করতে বের হয়।
সেই রাতে আমি প্রথমবার শুনি অন্য উদ্বাস্তুদের কথা—যারা আরও অনেক দিন ধরে এই ক্যাম্পে আছে।
তারা বলে, “এইখানে কেউ বাঁচে না, কেউ মরেও না—শুধু অপেক্ষা করে। কারও কাগজ আসে না, কারও স্বপ্ন।”

আমি তখন জানি না, আমাদের সেই নতুন জীবনের শুরু মানেই সব কিছু ফেলে রেখে শুধু বেঁচে থাকার চেষ্টা।
আমার দেশের নাম তখনো আমি জানি না, জানি শুধু একটা দেশ আরেকটা দেশের পেছনে পড়ে থাকে, যেখানে কেউ ফিরতে পারে না।

পর্ব ২: ক্যাম্পের ভোর

পূর্বের দিনগুলোর তুলনায় এই নতুন ভোরটা নিঃসন্দেহে আলাদা। তবে ভালো নয়—কেবল অন্যরকম। কাঁথার নিচে জেগে থাকা শরীরগুলো জমে যায় শিশিরে ভেজা বাতাসে। চারদিকে ঘরের মতো কিছু নেই—বাঁশ, পলিথিন আর ছেঁড়া কাপড় দিয়ে তৈরি অস্থায়ী আশ্রয়। তবে আশ্রয় বললেই হবে না—এইটা একটা অদ্ভুত অনিশ্চয়তার খাঁচা।

আমি চোখ খুলেই মা’র দিকে তাকাই। সাদিক এখনো তার পাশে ঘুমিয়ে। কিন্তু মায়ের চোখ খুলছে না। তার ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। রাতে অনেক কাশছিলেন, আর সকালে পুরো শরীরটা গরম।
আমি বাবাকে খুঁজি। তিনি ক্যাম্পের এক কোণায় দাঁড়িয়ে অন্য পুরুষদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। বাবার মুখটা যেন আরও শুকনো, আরও বিধ্বস্ত।

আমি ছুটে গিয়ে বলি, “মা’র জ্বর আরও বেড়েছে।”
বাবা তাড়াতাড়ি ফিরে আসেন, মায়ের কপালে হাত রাখেন। তারপর কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে থাকেন।
মা কিছু বলছেন না, শুধু ফিসফিস করে কিছু একটা বলতে চাইছেন—তবে শব্দ বেরোয় না।

“ডাক্তার?” আমি জিজ্ঞেস করি।
বাবা শুধু মাথা নেড়ে বলেন, “এখানে ডাক্তার নাই। যারা আসে, তারা শুধু তালিকা করে আর ছবি তোলে। চিকিৎসা করতে আসে না।”

সেদিন দুপুরের দিকে ক্যাম্পে একটা ট্রাক আসে। তাতে দুটো এনজিওর কর্মী নেমে আসে—দুজন মেয়ে, মুখে মাস্ক, গায়ে জ্যাকেট। তারা খাবার বিতরণ করে—একটা ছোট প্যাকেট: সামান্য চাল, ডাল, আলু।
আমি দৌড়ে গিয়ে ওদের বলি, “আমার মা অনেক অসুস্থ। আপনি একটু দেখে যেতে পারেন?”
তাদের একজন প্রথমে থামে, তারপর হালকা বিরক্তির সুরে বলে, “আমরা ডাক্তার নই। মেডিকেল টিম কাল আসবে। ওষুধ তো এখন কিছু নেই।”
আমি কেবল দাঁড়িয়ে থাকি। মেয়েটি কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাঁটতে থাকে।

মাকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি যেন হারিয়ে যাচ্ছেন। সাদিক বুঝতে পারছিল না কিছুই। সে কেবল মায়ের বুকে মুখ রেখে থাকছিল। আর আমার মনে হচ্ছিল, যদি আমি জোরে কাঁদি, তাহলে এই দেশ আমার কান্না শুনবে।

সন্ধ্যা নেমে এলে বাবার সঙ্গে আগুনের পাশে বসে থাকা শুরু করি। অন্য উদ্বাস্তুদের মুখে কেবল দুঃখ আর ক্লান্তির ছায়া। কেউ একজন বলল, “গত সপ্তাহে এক বুড়ি মরছিল। কাঁথার নিচে ওর লাশ পড়ে ছিল পুরো একদিন।”
আরেকজন বলল, “ওদের কোনো নাম নেই। সরকার শুধু সংখ্যা ধরে রাখে। ‘৬৮৪৭ নারী, ৭০২৫ পুরুষ, ৩০৯৪ শিশু’। কেউ নাম ধরে ডাকে না।”

আমি জিজ্ঞেস করি, “আমাদের এখানে কতদিন থাকতে হবে?”
বাবা বলেন, “যতদিন না কেউ কাগজ দেয়। না হলে ফেরত পাঠাবে।”
“ফেরত মানে?”
বাবা চুপ করে যান। তারপর একটুখানি বলেন, “সীমান্তের পেছনে।”

সেই রাতেও ঘুম আসে না। সাদিক আমার পাশে কাঁপছে, ঘন ঘন কাশি দিচ্ছে। আমি তাকে নিজের গায়ের কাপড় দিয়ে জড়িয়ে নিই।
মায়ের শ্বাস ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছে। মাঝে মাঝে তিনি হালকা জ্ঞান ফেরার মতো করেন, কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারেন না।

ভোরের দিকে, যখন চারপাশ একটু আলো পেতে শুরু করেছে, মা একবার চোখ খুলে আমার দিকে তাকালেন। খুব অস্পষ্ট স্বরে বললেন, “তুই… তুই সাদিকরে… নিয়ে… বাঁচিস…”
তারপর আর কোনো শব্দ নেই।
আমি প্রথমে ভাবলাম, মা ঘুমিয়ে পড়েছেন। কিন্তু সাদিক তার গায়ে মাথা রেখে উঠে বসে কাঁদতে শুরু করে।
আমি ঠাণ্ডা হয়ে যাই। মা চলে গেছেন। একেবারে চলে গেছেন।

আমি বাবাকে ডাকি না, শুধু চুপচাপ বসে থাকি। আমার ভেতরে কোথাও যেন বালির বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে, কিন্তু বাইরে কোনো কান্না নেই।

ঘণ্টাখানেক পরে বাবা এসে বুঝতে পারেন। তিনি কিছু বলেন না। শুধু একটানা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপর হঠাৎ উঠে যান।
আমরা একটা পলিথিনের মোড়কে মা’কে জড়িয়ে রাখি।
ক্যাম্পের পেছনের কবরস্থানে নিয়ে যাই।
খুব ছোট একটা গর্ত খুঁড়ে, মাকে মাটির নিচে শুইয়ে দেওয়া হয়।
কেউ দোয়া করে না, কেউ নাম লেখে না।
শুধু আমি কাঁধে একটা ছোট পাথর রাখি। মা ভালোবাসতেন নদীর ধারে পাথর কুড়াতে। আমি ভেবেছিলাম সেই পাথর দিয়ে একদিন বড় হয়ে ওনার জন্য বালা বানাবো।

মায়ের মৃত্যুর পরে আমার ভিতরে সব কিছু থেমে যায়। মনে হচ্ছিল, আর কিছুই গুরুত্ব পায় না—নতুন দেশ, কাগজ, স্বীকৃতি, নাগরিকত্ব—সব কিছু এক অদৃশ্য অন্ধকার।
কিন্তু সাদিক ছিল।
তার ডাকে আমি আবার জেগে উঠি। তাকে বাঁচাতেই হবে। মা তো বলে গেছেন।

সেদিনই এক বৃদ্ধা এসে বলেন, “তুই সাহসী মাইয়া। অনেকেই তো ওরকম দুঃখে পাগল হইয়া যায়।”
আমি মাথা নাড়ি না। শুধু বলি, “আমি মায়ের কথা রাখবো।”

বাবা কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে যান মা’র পরে। চুপচাপ বসে থাকেন আগুনের পাশে। সাদিককে কোলে নেন না, খেতেও চান না।
তখন থেকেই আমি নিজেকে ঠিক করি—আমার পরিবার এখন আমিই।

পর্ব ৩: পরিচয়ের অনুপস্থিতি

ক্যাম্পের তৃতীয় সপ্তাহে পৌঁছে যখন দিনের সাথে সাথে রাতও একঘেয়ে হয়ে ওঠে, তখন মানুষ শিখে যায় কীভাবে হাহাকারকে নীরবতার মধ্যে রেখে দিতে হয়। কেউ আর জোরে কাঁদে না। কেউ মুখ তুলে আকাশ দেখে না। সবাই ব্যস্ত থাকে বেঁচে থাকার কায়দা আয়ত্ত করতে—খাবারের জন্য লাইন দেওয়া, শিশুকে লুকিয়ে রাখা, অথবা কোনোভাবে এনজিও কর্মীদের নজরে পড়া। কেউ একজন বলেছিল, “যদি ভালো মুখ করিস, তো তোর নামটা রেজিস্টারে উঠে যাবে। সেখান থেকে হয়তো কোনো শহরে পাঠাবে।”

আমিও অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু আমার চেহারায় কোনো “ভালো মুখ” ছিল না। চোখের নিচে কালচে দাগ, চুল ধুলোয় ঢেকে গেছে, জামায় মাটির ছোপ। সাদিক আমার কাঁধে বসে থাকে সারাক্ষণ, মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়ে, কখনও হঠাৎ কেঁদে ওঠে। বাবাও প্রায় নিঃশব্দ। মাঝেমধ্যে মাথা নাড়েন, কাঁধে হাত রাখেন আমার, কিন্তু খুব একটা কথা বলেন না। মনে হয়, মায়ের মৃত্যুর পর তার ভিতরটা কোনো বন্ধ ঘরের মতো হয়ে গেছে—বাইরের আলো সেখানে ঢোকে না।

চতুর্থ দিনে, ক্যাম্পে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। এক তরুণী, বয়স বড়জোর বাইশ, রাত্রিবেলা হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। পরদিন সকালে তার ছোট বোন চিৎকার করে কাঁদতে থাকে, “তাকে কে নিয়ে গেল?”
সবাই বলতে থাকে—“তাকেও তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।”
কিন্তু কে নিচ্ছে? কেন? কেউ জানে না।

আমি প্রথমবার চিন্তায় পড়ে যাই—এই ক্যাম্পটা আমাদের আশ্রয় নয়, বরং এক অদৃশ্য শিকারীর মাঠ।
তখনই আমি বুঝতে পারি, আমাকে শুধু সাদিকের দায়িত্ব নিতে হবে না, আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
তাই আমি ক্যাম্পের খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রের পাশে বসে থাকা এক বৃদ্ধাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, “আপনি তো এখানে অনেক দিন আছেন, কেউ কীভাবে এই জায়গা থেকে বেরিয়ে যেতে পারে?”

বৃদ্ধা আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, “নাম দরকার। পরিচয় দরকার। কাগজ ছাড়া তুই কেউ না। এইখানে আমরা সবাই নামহীন। সরকার কেবল নম্বর জানে। তোর নাম লিখতে হইলে প্রমাণ লাগবে।”
আমি বলি, “আমার স্কুলের পরিচয়পত্র ছিল।”
তিনি মাথা নাড়িয়ে বলেন, “সেটা তো সীমান্তের ওপারে রইছে। এই দেশে তোর কোনো অতীত নাই।”

এই কথাটা আমাকে ভীষণভাবে কাঁপিয়ে দেয়—“এই দেশে তোর কোনো অতীত নাই।”
তাহলে কি আমার মা ছিলেন না? আমি জন্মাইনি কোনো দেশে? আমার স্কুল নেই? আমার বন্ধুরা নেই? আমি তো প্রতিদিন নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে কুড়ানো পাথর দিয়ে ছবি আঁকতাম—সে সব কী মুছে গেল?

আমি ঘরের কোণায় বসে সাদিককে জড়িয়ে ধরি। তার নিঃশ্বাস গাঢ় হয়ে এসেছে। বুঝি, জ্বর তার শরীরেও ছড়িয়েছে।
কিন্তু এবার আর বসে থাকা চলে না। আমি খাবারের প্যাকেট থেকে অর্ধেক চাল রেখে, অর্ধেক নিয়ে যাই ক্যাম্পের পশ্চিম প্রান্তে, যেখানে একটা ছোট হাট বসে সপ্তাহে একদিন—পথে আসা কিছু স্থানীয় লোকজন পুরোনো কাপড়, লবণ বা ওষুধ বিক্রি করে।

এক লোকের সঙ্গে কথা বলি, তার একটা মোটা ব্যাগে কিছু স্যাচে ওষুধ ছিল। আমি জিজ্ঞেস করি, “এইটা জ্বরের?”
সে বলে, “তোর কাছে কী আছে?”
আমি বলি, “চাল।”
সে মাথা নাড়ায়, “চাল তো সবাই দেয়। কানের দুল আছে?”
আমি মাথা নাড়ি। আমার তো কানই ফাঁকা।
তবু সে দয়া করে একটা প্যারাসিটামলের পাতায় তিনটে ট্যাবলেট দেয়।

ফিরে এসে সাদিককে একটুকরো ভাঙা কাপে পানি দিয়ে ওষুধ খাওয়াই। মনে হয়, অন্তত কিছু একটা করতে পারছি।

সেই রাতে সাদিক একটু শান্ত ঘুমোয়। বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, “তুই অনেক বড় হইয়া গেছিস।”
আমি কিছু বলি না। শুধু জানি, বড় হওয়া মানে এখন বুক চেপে ভয় গিলতে শেখা।

একদিন ক্যাম্পে সরকারি লোকজন আসে—গাড়ি, জ্যাকেট, ক্যামেরা নিয়ে। তারা কিছু পরিবারকে আলাদা করে নিয়ে যায়, ছবি তোলে, নাম জিজ্ঞেস করে।
তখনই আমি ভাবি, আমাদেরও নাম লিখে ফেলবো।
আমি বাবাকে নিয়ে যাই সেই ভ্যানের কাছে।
তারা জিজ্ঞেস করে, “তোমাদের নাগরিকতা প্রমাণের কিছু আছে?”
বাবা মাথা নেড়ে বলেন, “নাই। সব ফেলে আসছি।”
তারা বলে, “তাহলে তোমাদের নাম এখনই তোলা যাচ্ছে না। পরে আসুন।”
পরে—এই কথাটা এতোবার শুনেছি, যেন সময়টা আমাদের জন্য থেমে আছে।

তবে পরদিন এক বয়স্ক স্বেচ্ছাসেবী মহিলা ক্যাম্পে আসেন। তিনি বলেন, “আমরা কিছু শিশুদের জন্য পড়ানোর ব্যবস্থা করছি—পড়ার চেষ্টাটা চালু থাকুক।”
আমি সাদিকের হাত ধরে দাঁড়িয়ে পড়ি। বলি, “আমাকে পড়াতে হবে না, আমি সাহায্য করবো।”
তিনি অবাক হয়ে বলেন, “তুমি কি পড়াতে পারো?”
আমি বলি, “আমি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি। বাংলা, অঙ্ক, সমাজবিজ্ঞান পারি।”

তিনি হাসেন, সেই হাসিটা খুব আলাদা ছিল—যেন অনেকদিন পরে কেউ আমাকে একজন মানুষ হিসেবে দেখছে।
তিনি বলেন, “তোমার নাম কী?”
আমি বলি, “নাজমা খাতুন।”
তিনি টুকে নেন।
এই প্রথম এই নতুন দেশে আমার নাম লেখা হলো কোথাও।

পর্ব ৪: নামেরও হয় জন্ম

নাম লিখে ফেলার পর বুঝলাম, এই ক্যাম্পে নাম একটা অস্তিত্ব। যাদের নাম আছে, তারা কেউ নয় তবু কিছু; যাদের নাম নেই, তারা বাতাসের মতো—দেখা যায়, ছোঁয়া যায়, কিন্তু ধরা যায় না।
আমার নাম “নাজমা খাতুন” এখন একটা রেজিস্টারে লেখা আছে। ছোট কালো হরফে, তবু সত্যি।
আমার জন্মদিন নেই, জন্মসনদ নেই, কিন্তু এখন একটা তালিকার তলায় আমার জায়গা আছে।

পরদিন সেই স্বেচ্ছাসেবী দিদি—আমরা ওনাকে “সুমিত্রা দিদি” বলি—আমাকে একটা স্লেট আর চক দেন। সঙ্গে বলেন, “আজ থেকে তুমি পাঁচজন ছোট ছেলেমেয়েকে অক্ষর শেখাবে। যেমন করে জানো, তেমন করে বোঝাও। ওদের শুধু ভয়টা কমানো দরকার।”
আমি মাথা নাড়ি। আমার নিজের ভয় তো কমেনি, কিন্তু কাউকে শেখানোর দায়িত্ব পেলে মানুষের ভিতরে একটা আশ্চর্য আলো জ্বলে ওঠে।

সেই আলো নিয়েই শুরু হয় আমার নতুন কাজ—পড়ানো।
প্রথমদিন পাঁচজন শিশু আসে, তাদের মধ্যে একজন শুধু আমার ভাই সাদিক। বাকিরা অন্য তাঁবু থেকে এসেছে। কেউ বাবা-মাকে হারিয়েছে, কেউ এখনো জানে না মা বেঁচে আছেন কি না।
তাদের চেহারায় আমার নিজের প্রতিচ্ছবি দেখি—কান্না আটকে রাখা চোখ, ক্ষুধায় শুকনো মুখ, আর একরাশ না-বলা প্রশ্ন।

আমি বোঝাতে শুরু করি “আ” থেকে “ঔ”।
আমি বলি, “এই ‘আ’ যেমন আমার ‘আম্মু’র আ।”
একটা মেয়ে বলে, “আমার আম্মু নেই।”
আমি বলি, “তবু শব্দটা মনে রাখো। আম্মু না থাকলেও ভাষা থাকে।”

দিন পেরোতে থাকে। প্রতি বিকেলে আমি সাদিকসহ ওদের পাঁচজনকে নিয়ে পড়ে থাকি বাঁশের খুঁটির নিচে, মাটির ওপর স্লেট রেখে শব্দ শেখাই।
তখনই টের পাই, এই পড়ানো শুধু শেখানো নয়—এই পড়ানো আসলে একটা নতুন দেশ তৈরি করা।
শব্দ দিয়ে আমরা বানাচ্ছি ঘর, ছাপড়া, গাছ, নদী।
আর এই নতুন দেশের নাগরিক হতে গেলে ভাষা জানতেই হবে।

একদিন সুমিত্রা দিদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কবে স্কুল ছাড়ো?”
আমি বলি, “গত বৈশাখে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। তারপর আর যাওয়ার সুযোগ হয়নি। তারপর…”
আমি থেমে যাই।
তিনি বলেন, “তুমি যদি লেখাপড়াটা চালিয়ে যেতে চাও, আমরা চেষ্টা করতে পারি একটা সুযোগ জোগাড় করার।”
এই কথা শুনে আমি প্রথমবার নিজের ভবিষ্যৎ কল্পনা করি—পড়ছি, লিখছি, এমনকি স্কুলের ইউনিফর্ম পরেছি।

তবে সেদিন সন্ধেয় আমি যখন বাবাকে এই কথাটা বলি, তিনি শুধু বলেন, “লেখাপড়ায় পেট চলে না।”
আমি বলি, “পেট না চলুক, মন তো চলে।”
তিনি চুপ করে যান।
আমরা দুজনেই জানি, লেখাপড়ার পেছনে ছুটতে গেলে এই ক্যাম্পের জীবনে কোনো নিশ্চয়তা নেই।

পরদিন ক্যাম্পে একটা বড় ঘটনা ঘটে।
সীমান্ত পুলিশ একদল উদ্বাস্তুকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যায়। বলা হয়—“তারা অবৈধ প্রবেশ করেছে, তাদের ফেরত পাঠানো হতে পারে।”
এই খবর পেয়ে গোটা ক্যাম্পে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
সবাই ফিসফিস করে বলে, “আমাদের সবার ফিরিয়ে দেওয়া হবে না তো?”
আমার বুক কেঁপে ওঠে। এই ‘ফিরিয়ে’ দেওয়ার মানে আমি জানি। মা আরেকবার কবর থেকে উঠে আসবেন না।

সেদিন রাতে আমি চুপিচুপি সুমিত্রা দিদির তাঁবুতে যাই।
বললাম, “আমার একটা অনুরোধ আছে।”
তিনি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন, “কী?”
আমি বলি, “আপনি যদি পারেন, আমাকে আর সাদিককে কোথাও পাঠিয়ে দিন। যেখানেই হোক—যেখানে আমাদের নাম থাকবে।”
তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন, তারপর বলেন, “তুমি কি জানো, সেসব জায়গাতেও জীবন সহজ নয়?”
আমি মাথা নাড়ি, “এইখানে জীবনই নেই।”

সুমিত্রা দিদি বলেন, “ঠিক আছে। আমি চেষ্টা করব। তবে কাগজ লাগবে।”
আমি হতাশ হয়ে বলি, “আমার তো কিছুই নেই।”
তিনি বলেন, “তাহলে তৈরি করতে হবে।”
আমি প্রথমবার বুঝি—পরিচয়ও বানানো যায়।

পরদিন সকালে দিদি একটা ফর্ম এনে দেন—নাম, বয়স, ঠিকানা, অভিভাবকের নাম—সবকিছু লিখতে হবে।
আমি মাথা ঘামিয়ে লিখি:
নাম: নাজমা খাতুন
জন্ম: ২০০৮ সালের ৫ই জুন
পিতার নাম: মজিবুর রহমান
মাতার নাম: হাসিনা খাতুন
বর্তমান ঠিকানা: ক্যাম্প-৭, তৃতীয় ব্লক, সীমান্তগ্রাম

আমার কাগজ তৈরি হয়। সাদিকের জন্যও একইভাবে কাগজ তৈরি হয়।
যদিও এটা সরকার অনুমোদিত নয়, কিন্তু এটা আমাদের ছোট্ট অস্তিত্বের প্রথম দলিল।

সেই রাতে আমি কাগজটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকি।
এই কাগজে লেখা নামটা যেন আমার নিজের নয়, যেন আমার আশ্চর্য একটা প্রতিকৃতি—যা আমি হতে চাই।

সাদিক ঘুমিয়ে পড়েছে। বাবার মাথা তার হাঁটুর উপর নুয়ে আছে। আগুন নিভে এসেছে অনেকক্ষণ আগে।
আমি প্রথমবার মনে মনে বলি, “আমরা যদি ফিরে যাই, তখন যেন এই কাগজটাও সঙ্গে থাকে।”

পর্ব ৫: ট্রানজিট লিস্টে নাম

ভোর হতে না হতেই ক্যাম্পে অদ্ভুত এক উত্তেজনার আমেজ। যেন কুয়াশার চাদর ভেদ করে আলো আসার আগেই মানুষের চোখ জ্বলে উঠেছে। সবাই ফিসফিস করে একটা কথা বলছে—“আজ ট্রানজিট লিস্ট আসবে।”

ট্রানজিট লিস্ট—এই শব্দটা অনেকদিন শুনেছি। বলা হয়, যাদের নাম সেই তালিকায় ওঠে, তারা চলে যেতে পারে কোনও শহরের শেল্টার হোমে, কখনও কোনও পুনর্বাসন কেন্দ্রে, কখনও বা সরকারি আবাসনে।
কিন্তু সেই তালিকায় নাম ওঠে কাদের? কেউ জানে না।
শুধু একটা কথা চালু আছে—“যারা নিজেকে বোঝাতে পেরেছে, তারা রক্ষা পেয়েছে।”
সে বোঝানো হতে পারে নামের মাধ্যমে, শিক্ষার মাধ্যমে, কারও সুপারিশে—অথবা নিছক ভাগ্যে।

সুমিত্রা দিদি সেই সকালেই আমাকে ডেকে নিলেন। তাঁর চোখে গভীর কিছু।
তিনি বললেন, “আজ তোমার নামটা গিয়েছে লিস্টে। তোমার আর সাদিকের।”
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।
আমি বলি, “বাবার?”
তিনি একটু দম নিয়ে বলেন, “দুঃখিত, তাঁর নাম ওঠেনি। কারণ উনি এখনও কনফার্মড রেজিস্ট্রেশন করেননি।”
আমার বুকটা ধক করে ওঠে।
আমি জিজ্ঞেস করি, “তবে কি আমি আর ভাই… ওঁকে ফেলে…?”
তিনি বলেন, “তোমার বাবাকে বললে হয়ত তিনি নিজেই তোমাদের যেতে বলবেন। এখানে থাকলে ভবিষ্যত নেই।”

আমি থমথমে মুখে তাঁবুতে ফিরে এলাম। বাবা আগুনের ধারে বসে, ছোট কাঁঠালের পাতায় ফুঁ দিয়ে আগুন জ্বালাচ্ছিলেন।
আমি শান্তভাবে বললাম, “বাবা, আমাদের নাম উঠেছে লিস্টে। শহরে পাঠানো হবে। সেখানে স্কুল আছে, বাড়ি আছে, ওষুধ, পড়ার সুযোগ… সব।”
তিনি একটু চমকে তাকালেন।
সাদিক তার কোলে বসে মুখ ঘষছিল, বাবার চোয়ালে একটা হালকা কাঁপুনি।

“তুই যাস,” তিনি বললেন শান্ত গলায়।
“তুমি?”
তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “আমি এখন এখানে থাকি। পরে যদি সুযোগ আসে, আমি আসবো। কিন্তু তুই যদি এখন না যাস, তো আবার এই জায়গার বালিতে ডুবে যাবি।”

আমি কিছু বলতে পারছিলাম না। কেমন একটা দমবন্ধ কষ্ট বুকের মধ্যে গেঁথে বসেছিল।
আমি শুধু বললাম, “মা চলে গেলেন। তুমি যদি না থাকো…”
তিনি আমার কাঁধে হাত রাখলেন, “মা তো চাইতো তুই বাঁচিস। তুই যদি লেখাপড়া করিস, যদি ভাইটাকে মানুষ করিস, তাহলে ওর আত্মা শান্তি পাবে।”

আমার চোখ ভিজে আসে। সাদিকও কেমন করে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে।
সেই মুহূর্তটা আমি কোনোদিন ভুলতে পারবো না—আমার সমস্ত শৈশব যেন বাবার গলায় একটা নিঃশ্বাসে জড়িয়ে রইলো।

দুপুর নাগাদ ক্যাম্পে গেটের পাশে একটা সরকারি বাস এসে দাঁড়ায়। তাতে লেখা—পুনর্বাসন যানবাহন: সীমান্ত পুনর্বাসন প্রোগ্রাম।
এক একজন করে ডাকা হচ্ছে নাম ধরে। অনেকের চোখে কান্না, অনেকের মুখে হাসি। কেউ কেউ চিৎকার করে বোনকে খুঁজছে, কেউ কোলে শিশু জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

আমার নাম যখন ডাকা হয়—“নাজমা খাতুন, নম্বর ৭৯”—আমি সাদিককে কোলে তুলে নিই।
সঙ্গে একটা ছোট পুঁটলি, যেখানে তিনটে কাপড়, দুটো খাতা আর স্লেট রেখেছি।
বাবা এগিয়ে এসে বলেন, “চিঠি লেখার মতো কিছু পেলে আমার জন্য লিখিস। আমি শুনে রাখব হাওয়ার শব্দে।”

আমি হেসে ফেলি, কান্নার মধ্যেই।
তখনই আমার মনে পড়ে, একবার বাবা বলেছিলেন—“হাওয়া সব খবর নিয়ে যায়। শুধু মন দিয়ে শুনতে হয়।”

আমরা বাসে উঠি।
সুমিত্রা দিদি বলেন, “শহরে পৌঁছলে একটা ‘ছায়া হোম’-এ রাখা হবে। মেয়েদের জন্য নিরাপদ জায়গা। সেখান থেকে স্কুল শুরু হবে। আমি চেষ্টা করব পরেও তোমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার।”
আমি তাঁকে জড়িয়ে ধরি।
এই মানুষটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পথ খুলে দিয়েছেন।

বাস চলতে শুরু করে।
সাদিক জানালার পাশে বসে প্রথমে ভয় পায়, তারপর ধীরে ধীরে রাস্তার দৃশ্য দেখতে থাকে। গাছ, ধানক্ষেত, ছোট ছোট মাটির ঘর পেছনে চলে যায়।
আমি ভাবতে থাকি—এই পথটা কি সত্যিই আমাদের নিয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যতের দিকে, না কি এটা আরেকটা অনিশ্চয়তার শুরু?

ঘণ্টা দুই পর বাস শহরের দিকে ঢোকে। রাস্তার দু’ধারে আলো, পিচঢালা রাস্তা, বিলবোর্ড, হর্ন—সব কিছু যেন এক নতুন দুনিয়া।
আমার কখনো শহরে আসা হয়নি। এত বড় বাড়ি, এত গাড়ি—সব কিছুই অচেনা।

শেষে বাস একটা পুরোনো তিনতলা বাড়ির সামনে দাঁড়ায়। লোহার গেট, ভেতরে খোলা উঠোন। লেখা—ছায়া হোম: আশ্রয় ও আলোর ঠিকানা।
আমরা একে একে নামি। একটা মহিলা এসে আমাদের অভ্যর্থনা করেন। তিনি বলেন, “ভয় পেও না। তোমাদের জন্য নতুন জীবন শুরু হচ্ছে। এখানে সবাই তোমাদের মতোই। কেউ কিছু ফেলে এসেছে, কেউ কিছু খুঁজছে।”

আমি মাথা নাড়িয়ে সাদিকের হাত শক্ত করে ধরি।
আমাদের একটা ছোট্ট ঘর দেওয়া হয়—দুটো খাট, একটা কাঠের আলমারি, জানালার পাশে পোঁতা একটা তুলসী গাছ।
এই ঘরে কোনও স্মৃতি নেই, তবু কোনও অজানা বিশ্বাস মাথা তোলে—এখানে কিছু শুরু হতে পারে।

সেদিন রাতে, আমি আর সাদিক একসঙ্গে শুয়ে পড়ি।
সাদিক ঘুমিয়ে পড়লেও আমি জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকি। শহরের আলো দেখে মনে হয়—এই আলোতে মায়ের মুখ লুকিয়ে আছে।
হয়তো মা-ই আজ আমাকে এই আলোতে নিয়ে এলেন।
আমি চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলি,
“মা, আমি লিখতে শিখবো। আমি তোমার জন্য গল্প লিখব। এমন গল্প, যেখানে কেউ উদ্বাস্তু নয়।”

 

পর্ব ৬: আলোর গন্ধে ঘেরা ঘর

নতুন ঘরটা প্রথমে অচেনা লাগলেও ধীরে ধীরে একটা নির্ভরতার গন্ধ মিশে যেতে লাগল দেওয়ালের ভিতর, জানালার ফাঁকে, খাটের চাদরে। ছায়া হোম—এই নামটা শুনলেই মনে হতো হয়তো এটা একটুখানি ছায়া দেবে, সাময়িক আশ্রয়। কিন্তু এখানে এসে বুঝলাম, কখনো কখনো সেই ছায়াতেই জন্ম নেয় আলো।

আমাদের ঘরের পাশেই ছিল একটা ছোট্ট লাইব্রেরি। এক কোণে পুরনো বইয়ের তাক, মাঝখানে চার-পাঁচটা বেঞ্চ, আর জানালার পাশে একটা বড় টেবিল যেখানে সুমনা দিদি বসতেন—ছায়া হোমের ‘এডুকেশন কোঅর্ডিনেটর’।
প্রথম দিনেই তিনি আমার কাছে এসে বলেন, “তোমার রেজিস্ট্রেশন সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। পরের মাস থেকে তুমি পাশের মিউনিসিপ্যাল স্কুলে ভর্তি হবে ক্লাস এইটে।”
আমি থমকে যাই।
“এইট?”
তিনি বলেন, “তুমি তো অষ্টম পর্যন্ত পড়েছো। তবে ক্লাস আবার শুরু হবে নিয়মিত। স্কুল ইউনিফর্ম, বই সব ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।”

আমি সেই মুহূর্তে ভেতরে একটা স্পর্শ পাই—যেন আমার শরীরের ভেতর দিয়ে হাওয়া বয়ে যায়, যা একেবারে জন্ম থেকে আটকে ছিল।
সাদিক তখন খেলছিল উঠোনে। সে বুঝতে পারেনি তার দিদি ঠিক কতটা বদলে যেতে চলেছে।

স্কুলে যাওয়ার আগে প্রতিদিন সকালবেলা ছায়া হোমে পড়ানো হতো। আমি বই খুলে আবার অঙ্ক করতে শুরু করলাম। একসময় যা মুখস্থ ছিল, এখন তা কুয়োর অতল থেকে টেনে তুলতে হচ্ছে।
তবু আমি ছাড়ি না। আমি জানি, এই অক্ষরগুলোই আমার ভবিষ্যতের সিঁড়ি।

সাদিকের জন্যও একটা ‘ডে-কেয়ার’ ঘর আছে এখানে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করে, গানের ক্লাস হয়, মাঝেমাঝে ছবি আঁকার প্রতিযোগিতাও।
সাদিক নতুন বন্ধু পেয়েছে—একটা ছয় বছরের ছেলে যার নাম রাজু, আর এক মেয়ে যার নাম ঝিলিক।
সে এখন আর মাঝরাতে ঘুম ভেঙে কান্না করে না।
সে এখন ঘুম থেকে উঠে দিদিকে চুমু খায় আর বলে, “আজ তুমি স্কুলে যাবে?”
আমি হাসি। আর সারা শরীর জুড়ে আলোর গন্ধ পাই।

স্কুল শুরু হওয়ার দিন, ছায়া হোম থেকে চারজন মেয়ে আর দুইজন ছেলে গেল নতুন স্কুলে। আমাদের গায়ে নতুন ইউনিফর্ম—সাদা-নীল শাড়ি বা প্যান্ট-শার্ট। স্কুলের প্রধান ফটক দিয়ে ঢোকার সময় মনে হচ্ছিল, পৃথিবীটা আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
কিন্তু ঢোকার পর টের পেলাম, পৃথিবীটা কেবল দেখেই না, বিচারও করে।

প্রথম দিনেই এক ছাত্র ফিসফিস করে বলল, “ওরা ক্যাম্প থেকে এসেছে। এইসব উদ্বাস্তুদের আমাদের স্কুলে ভর্তি করানো ঠিক না।”
অন্য একজন বলল, “ওদের তো নাগরিকত্বই নেই। পড়ার কী দরকার?”
এই কথা শুনে মাথা নিচু করলাম না। শুধু মনে মনে বললাম, “আমি যতদিন না নিজে প্রমাণ করতে পারি, ততদিন আমি কিছুই না।”

কিন্তু শিক্ষকরা অনেক সহযোগিতা করলেন। বিশেষ করে মণিমালা ম্যাডাম—বাংলা পড়ান। তিনি একদিন আমাকে ডেকে বললেন, “তুমি কি কবিতা লেখো?”
আমি বললাম, “না। তবে আমি কবিতা পড়তে ভালোবাসি।”
তিনি বললেন, “তবে শুরু করো। কবিতা হলো সেই জায়গা, যেখানে মানুষ নিজের দেশ নিজেই গড়ে নিতে পারে।”

সেই রাতে আমি ছায়া হোমে এসে একটা খাতায় লিখি:

“আমি ছিলাম সীমান্তের মাটি,
পায়ের তলায় ধুলো,
আমি এখন পাতার মতো বইয়ে,
আলোর দিকে চলি অনুক্ষণ।”

সুমনা দিদি সেটা পড়ে চোখ মুছলেন। বললেন, “এইখানেই শুরু হয় স্বীকৃতি।”

কিছুদিন পরে ছায়া হোমে সাংবাদিকেরা আসে—একটি জাতীয় পত্রিকা একটি প্রতিবেদন করতে এসেছে “উদ্বাস্তু শিশুদের শিক্ষা ও পুনর্বাসন” নিয়ে।
তারা আমার সঙ্গে কথা বলে।
জিজ্ঞেস করে, “তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও?”
আমি এক মুহূর্ত ভাবি না। বলি, “শিক্ষক। আমি চাই, যাদের কোনো দেশ নেই, তাদের একটা ভাষা দিতে।”

এই কথাটা ছাপা হয়। আমার নাম, ছবি, ছোট্ট কবিতা—সবই পত্রিকায় আসে।
সেদিন ছায়া হোমের সব মেয়েরা আমার ঘরে আসে। কেউ বলে, “তুই এখন আমাদের তারকা।”
কেউ বলে, “তোর নাম এখন পত্রিকায় ছাপা।”
আমি মাথা নিচু করে বলি, “আমার নাম আগেও ছিল। শুধু কেউ পড়ত না।”

সুমনা দিদি সেদিন রাতে আমার হাতে একটা খাম দেন।
চিঠি।
বাবার লেখা।

আমি থমকে যাই।
চিঠিতে লেখা—

“নাজমা,
হাওয়ার কথা সত্যি। আমি শুনেছি তোর গল্প। তোকে নিয়ে পত্রিকায় ছবি দেখেছি। আমি গর্বিত।
আমি এখনও ক্যাম্পেই আছি। তবে তোর পথ যেন বন্ধ না হয়, সেটাই চাই।
সাদিককে চুমু দিস।
মা থাকলে আজ হাসতো।
ভালোবাসা রইল,
—তোর বাবা।”

চোখের জল থামাতে পারছিলাম না।

আমি জানতাম না হাওয়ার এতখানি শক্তি থাকে।
আমি জানতাম না, চিঠি না এলেও কথারা পৌঁছে যায় ঠিক জায়গায়।

সেই রাতে আমি আবার কবিতা লিখি।
এইবার শিরোনাম—
“দেশ বললে মনে পড়ে”

তাতে লিখি:

“দেশ মানে মায়ের কণ্ঠ,
ভাইয়ের কান্না থামানো হাত।
দেশ মানে কাগজের তালিকায় নাম নয়,
দেশ মানে একটা ঘর—
যেখানে আলো পেলে ছায়াও ঘুমিয়ে পড়ে।”

পর্ব ৭: সীমানার ওপারে স্বপ্ন

শহরের হাওয়া ধীরে ধীরে আমাদের শরীরের সঙ্গে মানিয়ে নিতে শিখেছে। ছায়া হোমে কাটানো কয়েক মাসে আমরা বুঝে গেছি—একটা জায়গা ঘর হয়ে উঠতে সময় লাগে, কিন্তু যদি মাটি উর্বর হয়, তবে বীজ অঙ্কুরিত হতেই হয়।
সাদিক এখন রঙ চেনে, গান গায়, বন্ধুদের সঙ্গে খেলে। মাঝেমাঝে সে জিজ্ঞেস করে, “আমরা আবার গ্রামে যাব?”
আমি বলি না যে, সেই গ্রামটা আর নেই। শুধু বলি, “তুমি চাইলে একদিন যাব, তবে দুঃখগুলোকে না জাগিয়ে।”

আমার স্কুল এখন আমার দ্বিতীয় বাড়ি। শিক্ষকরা উৎসাহ দেন, ক্লাসের বন্ধুরাও কিছুটা বদলে গিয়েছে।
একদিন রচনা লেখার ক্লাসে সবাইকে বলা হলো—‘আমার দেশ’ বিষয়ে লিখতে।
অনেকেই লিখল জাতীয় পতাকা, ক্রিকেট দল, স্বাধীনতা দিবস নিয়ে।
আমি লিখলাম এমন একটা দেশের কথা, যেখানে সবাইকে তার নাম বলার অধিকার দেওয়া হয়। যেখানে নাগরিকত্ব একটা জন্মসনদের চেয়ে বড় কিছু নয়—ভাষা, ভালোবাসা আর লড়াইয়ের স্বীকৃতি।

আমার রচনাটি পড়ার সময় ক্লাসে নিস্তব্ধতা নেমে আসে।
শেষে মণিমালা ম্যাডাম বলেন, “এইটা শুধু রচনা নয়, এইটা এক মেয়ের ইতিহাস।”

সেদিন আমি বুঝলাম, গল্প বলা মানেই কেবল কল্পনা নয়, সেটাও প্রতিবাদ।
আমার কবিতা, আমার কথা, আমার দাগ—it all matters.
আমি সত্যিই একজন মানুষ, কেবল একটি নম্বর নয়।

একদিন ছায়া হোমে সরকারি আধিকারিকরা আসে।
বলা হয়, কিছু কিশোরীকে একটি স্কলারশিপ পরীক্ষায় বসতে হবে—রাজ্য সরকার তাদের পড়াশোনা এবং পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিতে আগ্রহী।
আমি নাম লিখিয়ে দিই।
পরীক্ষা দিতে যাবার আগের রাতে আমি বাবার চিঠিটা খুলে পড়ে নিই।
তাঁর শব্দগুলো আমার ভেতরে ঢুকে একটা পাথরের মতো ভর দেয়, যার উপর দাঁড়িয়ে আমি নিজের আকাশ ছুঁতে চাই।

পরীক্ষার হলে ঢুকতে গিয়ে হাত কাঁপছিল। সামনে বসে থাকা এক ছাত্রীর গলায় ঝুলছিল আধার কার্ড।
আমার কাছে কেবল একখানা সাময়িক শংসাপত্র—নাম লেখা, বয়স অনুমান করে দেওয়া।
তবু আমি জানি, আমার লেখার শক্তি যদি সত্যি হয়, তবে কোথাও গিয়ে সেটা ভাঙবে না।
আমি অঙ্ক করি, ইংরেজিতে গল্প লিখি, বাংলায় একটি অনুচ্ছেদে নিজের জীবনের গল্প সাজিয়ে ফেলি।

দু’সপ্তাহ পর ফলাফল আসে—
আমার নাম তালিকায় প্রথম পাঁচে।
আমাকে বৃত্তি দেওয়া হবে—পুরো মাধ্যমিক পর্যায়ের লেখাপড়া, থাকার জায়গা, শহরের এক স্বনামধন্য স্কুলে ভর্তি।

আমি ছায়া হোমের উঠোনে বসে থাকি। সন্ধ্যার আলোয় তালিকাটার দিকে চেয়ে দেখি, এই নামটা আমার।
এই ‘নাজমা খাতুন’—সে আর কেবল উদ্বাস্তু নয়, সে এখন স্বীকৃত এক শিক্ষার্থী, একজন কবি, এক নতুন জীবনের প্রতিনিধি।

সুমনা দিদি বলেন, “তুমি শুধু নিজের জীবন বদলাওনি, অনেকের আশার মুখ হয়ে উঠেছো।”
আমি হেসে বলি, “আমি শুধু মায়ের কথা রেখেছি। তিনি বলেছিলেন—বাঁচিস।”

পরের সপ্তাহে যখন নতুন স্কুলে ভর্তি হই, তখন ছায়া হোমে একটা ছোট বিদায় অনুষ্ঠান হয়।
সাদিক হাত ধরে বলে, “তুমি গেলে আমি কার সঙ্গে থাকব?”
আমি তাকে জড়িয়ে ধরে বলি, “আমি যেখানেই থাকি, তুই আমার সঙ্গে থাকিস। তোকে নিয়ে একদিন আমাদের নতুন ঘর হবে, যেখানে কেউ বলবে না, ‘তুই কে?’”

সেদিন রাতে আমি লিখি আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কবিতাটি:

“দেশহীন নয়”

“আমার কোনো দেশ নেই—
বলা হয়েছিল একদিন।
তারপর আমি মাটির তলায় শব্দ বুনেছিলাম,
তুমি দেখলে—
সেই শব্দে জন্ম নিচ্ছে ঘর,
নাগরিক, পতাকা নয়—
শুধু এক দিদি ও ভাইয়ের হাসি।”

সেই কবিতা আমি পাঠাই এক পত্রিকার কবিতা প্রতিযোগিতায়।
কয়েক সপ্তাহ পরে উত্তর আসে—
আমার কবিতা মনোনীত হয়েছে। ছাপা হবে, সঙ্গে থাকবে সংক্ষিপ্ত জীবনকথা।

ছাপা হওয়ার দিন, আমি সাদিকের হাতে কাগজটা তুলে দিই।
সে ছবি দেখে চিনতে পারে না।
আমি বলি, “এই মেয়েটা আমি।”
সে বলে, “তুমি এত সুন্দর দেখাচ্ছ!”

আমি হেসে বলি, “কারণ আমি এখন আলোয় আছি। তুইও আসবি। আমরা একসাথে আলোর দেশ বানাবো।”

তখনই জানালার বাইরে দেখি কুয়াশা জমছে।
সীমানার ওপারে যে মেয়েটা একদিন কাঁপতে কাঁপতে নৌকোয় উঠেছিল, সে আজ বইয়ের পাতায় জায়গা পেয়েছে।
সীমানা পার হয়েছি শুধু শরীরে নয়, মনের ভিতরেও।

পর্ব ৮: ফিরে দেখা নদী

পত্রিকায় নাম ছাপা হওয়ার পরদিনই বাবার দ্বিতীয় চিঠিটা এল।
খামে কোনো স্ট্যাম্প নেই—সুমনা দিদির এক সহকর্মী হাতে তুলে দিয়ে গিয়েছেন।
খামটা খুলে দেখি কাগজের ওপর পরিচিত সেই হাতের লেখা।
ছেঁড়া, কিন্তু স্পষ্ট।

“নাজমা,

তোর লেখা পড়েছি। বারবার পড়েছি। একজন মানুষ কীভাবে নিজের সব হারিয়েও অন্যদের বাঁচিয়ে তোলে, তুই আমাকে শিখিয়েছিস।

আমি এখনো ক্যাম্পে, কিন্তু ভয় নেই। আমারও একটা নাম উঠেছে এবার। তোর লেখা পড়ে স্থানীয় কিছু লোক বলেছে আমাকে সাহায্য করবে।

সাদিক ভালো তো? ওকে বলিস, বাবা খুব ভালোবাসে।

আমি জানি, তুই একদিন একটা স্কুল তৈরি করবি, যেখানে নাম, ধর্ম, কাগজ, সীমান্ত—এই সব শব্দের কোনো দরকার হবে না।

ভালো থাকিস মা,

—তোর বাবা”

আমি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম তখন। হাতে বাবার চিঠি, চোখের সামনে শহরের কুয়াশা।

তবে সেই কুয়াশার ভিতর এবার কোনো ভীতির গন্ধ নেই।
এই কুয়াশা যেন আলোর পর্দা, যার ওপারে অপেক্ষা করে একটা নতুন সকাল।

সেদিন বিকেলে, ছায়া হোমে একটা ছোট্ট সাহিত্যসভা হয়।
আমাকে বলা হয় নিজের লেখা কবিতা পড়তে।
আমি প্রথমে সংকোচে থাকলেও পরে উঠে দাঁড়াই।

বললাম, “আমি উদ্বাস্তু নই। আমি এক গল্পকার। যে দেশের গল্প বলে, যেখান থেকে সে চলে এসেছে, এবং যেটা সে গড়তে চায়।”

তারপর পড়লাম সেই কবিতাটা—“দেশহীন নয়”।

সবাই হাততালি দিল না, কেউ স্লোগান তুলল না।
শুধু নিস্তব্ধতার ভিতর একরাশ গর্ব ঘনিয়ে উঠল—যেন নিজের নামের জন্য লড়াই করে জিতে আসা মানুষরা চুপ করে চেয়ে থাকে নিজেদের ভবিষ্যতের দিকে।

সেই রাতে, আমি সাদিককে পাশে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুমের মধ্যে দেখলাম, সেই পুরোনো গ্রাম, নদীটা, নৌকো…
আর মা বসে আছেন পাড়ে, একটা পাথর কুড়িয়ে নিচ্ছেন, মুখে হালকা হাসি।

আমি স্বপ্নে হাঁটি গিয়ে বসি মায়ের পাশে।
তিনি বলেন, “তুই ঠিক পথেই চলেছিস, মা। এবার নিজের দেশ তৈরি কর।”

পরদিন সকালে সুমনা দিদি বলেন, “তোমার কবিতা এখন অনলাইনেও ভাইরাল হয়েছে। একটা শিশু অধিকার সংগঠন তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়।”
আমি অবাক হই।
তারা চায়, আমি এক অনুষ্ঠানে গিয়ে নিজের গল্প বলি। স্কুলে, শহরের লোকেদের সামনে।

আমি রাজি হয়ে যাই।
কারণ জানি—আমার কণ্ঠ কেবল আমার না, আমার মতো আরও হাজারো নাজমার।

অনুষ্ঠানে গিয়ে আমি দেখি, সামনে অসংখ্য চেনা-অচেনা মুখ। কিছু শিক্ষক, কিছু স্বেচ্ছাসেবী, কিছু সাংবাদিক, কিছু ছাত্রছাত্রী।
আমি বলতে শুরু করি—
আমার নাম, আমার মা, নদী পার হওয়া, মাটির ঘর পোড়া গন্ধ, বাবার চোখে খালি দৃষ্টির গল্প…
আর বলি, “সীমানা মানে শুধু মানচিত্রে টানা দাগ নয়, সীমানা মানে যন্ত্রণা—যেটা শুধু কাগজে মুছে ফেলা যায় না। সেটা শুধু ভালোবাসা দিয়ে ভাঙা যায়।”

অনুষ্ঠান শেষে একজন ছাত্রী এসে বলে, “তুমি তো আমার মতো। আমিও উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা অভিবাসী। আমরা তো প্রায়-ই নিজেদের অচেনা মনে করি। তোমার কথা শুনে মনে হলো—আসল পরিচয় জন্মের নয়, সাহসের।”

আমি বুঝলাম, আমার গল্প একটা দেশ গড়ছে। ধীরে ধীরে। পাথর দিয়ে, শব্দ দিয়ে।

কয়েক মাস পরে, ছায়া হোম ছেড়ে আমাকে শহরের একটি আবাসিক স্কুলে পাঠানো হয়। নতুন ঘর, নতুন সহপাঠী, নতুন শিক্ষক।
সাদিক এখন একটা বাচ্চা স্কুলে ভর্তি হয়েছে, তার নামের পাশে এখন আর ‘উদ্বাস্তু’ লেখা হয় না—সেখানে শুধু লেখা: সাদিক রহমান।

আমি মাঝে মাঝে জানালার দিকে তাকিয়ে সেই নদীটাকে খুঁজি।
যেটা আমাদের দুই দেশ ভাগ করেছে।
আবার যেটার ঢেউ আমাকে জীবনের দিকে ঠেলে দিয়েছিল।

আমি জানি, মা সেই নদীর ওপারেই আছেন, নীল মেঘের দেশে।
বাবা এখন পাশের শহরে, একটা ছোট NGO-তে কাজ পান। চিঠি আসে মাসে একবার।
তিনি লিখেছিলেন—

“তুই যেখানে আছিস, সেটাই এখন আমার দেশ। তোর মুখের হাসি দেখলেই আমি বুঝি—আমি আর উদ্বাস্তু নই।”

আমারও সেই বিশ্বাস তৈরি হয়েছে—

আমার শরীরে এখন আর কোনো কাঁটা তার নেই।
আমার ছায়ার নিচে এখন একটুকরো আলো থাকে, যেটা অন্যদের আশ্রয় দেয়।

সেদিন রাতে, নতুন স্কুলের ডায়েরিতে শেষ পাতায় আমি লিখি—

“সীমানার এপারে”
এক গল্প,
যেটা শুরু হয়েছিল নদী পেরোনোর দিন।
শেষ হয় না কোনো শিবিরে,
শেষ হয় আশার ভিতর—
যেখানে মেয়েরা নিজেদের নাম নিজেই লেখে।

—সমাপ্ত—

1000025094.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *