Bangla - ভ্রমণ - রহস্য গল্প

সিমলিপালের সাতরঙা ধোঁয়া

Spread the love

ঊর্মি রায়চৌধুরী


সকালটা ছিল শান্ত, যেন প্রকৃতির বুক জুড়ে এক অদ্ভুত শূন্যতা ছড়িয়ে আছে। অর্ণব চৌধুরী ও মৃণালিনী সেন সিমলিপাল টাইগার রিজার্ভে পৌঁছেই সে শূন্যতাকে অনুভব করেছিল, যেন এ জঙ্গল কেবল সবুজ আর বন্য প্রাণে নয়—গভীর কোনো গোপন স্মৃতিতে পূর্ণ। ওডিশার মায়াবী ঘন বনপথ পেরিয়ে যখন তাদের জিপ গাড়িটা বন বিভাগের অনুমতিপত্রসহ রেঞ্জ অফিসে পৌঁছায়, তখন চারপাশের নিস্তব্ধতা একদিকে শান্তিদায়ক, আর অন্যদিকে অজানা কিছুর পূর্বাভাসের মতো ঠেকছিল। রেঞ্জার রুদ্র বেহেরা, মাঝবয়সী এক চৌকস বন আধিকারিক, সংক্ষিপ্ত হাসি আর কাঠখোট্টা চোখে তাদের অভ্যর্থনা জানালেন। পরিচয়পর্বের পর তিনি তাদের জানালেন, “তোমরা যে জায়গায় যেতে চাইছো সেটা একটু গভীর অঞ্চল, কম লোক পাড়ি দেয়। তবে সাহস থাকলে যেতে দোষ নেই।” অর্ণবের চাহনিতে আনন্দের ঝলক ফুটে উঠল, ঠিক যেমনটা হয় যখন কেউ নতুন কোনো দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করার সুযোগ পায়। মৃণালিনী, যিনি প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেন এবং প্রাচীন লোককথা নিয়ে লেখেন, খেয়াল করলেন রেঞ্জার কথা বলার সময় তার চোখে একটা দোটানা। যেন অনুমতি দিলেও, কিছু একটা গোপন রাখছেন।

যতক্ষণে তারা নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছাল, সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। জায়গাটি ছিল এক উপত্যকা ও পাহাড়ের সংযোগস্থলে, ঘন স্যাল গাছে ঘেরা—সন্ধ্যার আলোয় ছায়া আর অন্ধকারে একাকার হয়ে আছে। অর্ণবের ড্রোন ব্যাগ, লেন্স ও ট্রাইপড গোছানোই শেষ হয়নি, মৃণালিনী ততক্ষণে ক্যাম্পের তাবু খাটাতে শুরু করেছে। পাহাড়ের পেছনে সূর্য ডোবার আগের মুহূর্তে বন যেন একবার নিঃশ্বাস ফেলল—সব পাখি চুপ, পাতার ফাঁকে বাতাসের ধাক্কায় হঠাৎ ঝাঁকুনি, আর সেই মুহূর্তেই তারা দেখল। দূরে পাহাড়ের এক ঢালের ঠিক মাঝখান থেকে ধোঁয়া উঠছে—কিন্তু ধোঁয়াটা সাদামাটা নয়। প্রথমে ছিল নীলচে, তারপর ধীরে ধীরে রং পাল্টে সবুজ, তারপর লাল, বেগুনি, কমলা হয়ে এক আশ্চর্য রঙধনুর মতো আকাশে মিশে গেল। “ওটা কি আগুনের ধোঁয়া?” মৃণালিনী প্রশ্ন করল অবাক হয়ে। অর্ণব তখন ড্রোন উড়াতে ব্যস্ত, ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল ঠিক করে রঙিন ধোঁয়া ধরার চেষ্টা করছে। ড্রোন ধীরে ধীরে ধোঁয়ার উৎসের দিকে এগোতে থাকল, কিন্তু হঠাৎ স্ক্রিন কালো হয়ে গেল। সংযোগ বিচ্ছিন্ন। অর্ণব বিরক্ত হয়ে ফিসফিস করে বলল, “সিগন্যাল গেছে! না জানি কিসে আটকে গেল। এভাবে ড্রোন হারানো একদমই ভালো নয়।”

সন্ধ্যা দ্রুত নেমে এলো, চারদিক কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে গেল, আর ধোঁয়া ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। মৃণালিনী মনে মনে ভাবছিল, এ কেবল আগুনের ধোঁয়া নয়—এ যেন কোনো ভাষা, কোনো চিহ্ন, অথবা কোনো প্রাচীন সংকেত যা কেউ পাঠাচ্ছে। সেদিন রাতে ক্যাম্পের আগুন জ্বেলে তারা বসেছিল নীরবে, কিন্তু সেই ধোঁয়া যেন তাদের দুজনের মধ্যেও এক অজানা সংলাপ তৈরি করেছিল। অর্ণব ফোনে জিপিএস লোকেশন দেখে বোঝার চেষ্টা করল ড্রোন কোথায় নামতে পারে। অথচ তার নিজের অভ্যন্তরেও যেন ধোঁয়ার মতো অস্বস্তি ভর করছিল—এটা কি শুধুই কৌতূহল? না কি ভয়ের ছায়া? মৃণালিনী তখন তার নোটবুকে পাহাড়, রং এবং ধোঁয়ার বিন্যাস লিখে রাখছিল। “এটা যেন একটা সংকেত,” সে ফিসফিস করে বলল। জঙ্গলের ভেতর থেকে রাতজাগা পাখির আওয়াজ ভেসে আসছিল, দূরে কোথাও হঠাৎ গর্জে উঠল কোনো অজানা জন্তু। সিমলিপাল যেন তাদের দিকে তাকিয়ে বলছিল—“সবকিছু চোখে দেখা যায় না, কিছু অনুভব করাই যথেষ্ট।”

সকালবেলাটা ছিল অন্যরকম চুপচাপ—গতরাতের সেই রঙিন ধোঁয়া যেন ঘুম ভেঙেই ছায়া ফেলে রেখেছিল অর্ণব আর মৃণালিনীর মনের ভেতর। বনভূমির আলো-ছায়া মাখা সেই ছোট্ট উপত্যকায় তাদের ক্যাম্পের চারপাশটা তখনো সজীব, কিন্তু কোথাও একটা যেন গুমোট ভাব। রেঞ্জার রুদ্র বেহেরা খুব ভোরে এসে খবর দিলেন, কাছেই এক গ্রামে জল আনার কাজ চলছে, চাইলে সেখানকার মানুষজনের সঙ্গে দেখা করা যেতে পারে। “তবে এক্ষুনি ওই ধোঁয়ার কথা না বলাই ভালো,” তিনি সতর্ক করলেন। অর্ণব যদিও ড্রোন হারানোর কারণে মন খারাপ করে বসে ছিল, মৃণালিনী却 ছিল উৎফুল্ল—রঙিন ধোঁয়া তার ভেতরে পুরনো কাহিনিগুলোর কথা জাগিয়ে তুলেছিল, যেন শত শত বছর ধরে যা বেঁচে আছে লোকজনের মুখে, গানে, রূপকথায়। তারা গ্রামের দিকে হাঁটতে হাঁটতে দেখল, বনজ গন্ধ আর শিশির ভেজা মাটির মধ্যে দিয়ে ছড়িয়ে আছে এক অদ্ভুত স্নিগ্ধতা। পথের দু’ধারে বাঁশের বেড়া ঘেরা বাড়ি, ধোঁয়া উঠছে চুলার মুখ থেকে, আর কিছু বয়স্ক মানুষ বসে আছে গাছতলায়, তামাক খাচ্ছে কিংবা ঝুড়ি বুনছে। তাদের দৃষ্টি প্রথমে কৌতূহলী, তারপরে সতর্ক।

যখন অর্ণব মৃদু কণ্ঠে আগের রাতের ধোঁয়ার কথা তুলল, তখন একজন মধ্যবয়সী গাইড, যার নাম ছিল গণেশ, চোখ কুঁচকে তাকাল। “ধোঁয়া দেখেছেন? কোন রঙের ছিল বলুন তো?” মৃণালিনী রঙের বিবরণ দিতে দিতেই আরেক বৃদ্ধ ধীরে ধীরে সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর মুখে বয়সের ভাঁজ, চোখে একধরনের গভীর বিষণ্নতা। তিনি পরিচয় দিলেন—“আমি খেমচি সর্দার। এই পাহাড়ের নীচে আমাদের বংশের জন্ম, আর ওখানেই অনেকে মরে গেছে।” বাক্যটা শুনে অর্ণব চমকে উঠল, আর মৃণালিনী নিজের খাতাটা খুলে খেমচির কথাগুলো টুকে রাখতে লাগল। খেমচি ধীরে ধীরে বললেন, “ছায়াচূড়া পাহাড়ের ওই ঢাল থেকেই ওঠে ধোঁয়া। ওটা আমাদের কাছে ভাষা। পাহাড়ের আত্মারা আমাদের সঙ্গে কথা বলে রঙ দিয়ে। সব রঙ মানে কিছু। লাল মানে রক্ত, নীল মানে কান্না, সাদা মানে ক্ষমা। ও ধোঁয়া কারো জন্য উঠে। ডাক দেয়। কেউ যদি সেই ডাকে যায়…” তাঁর কণ্ঠস্বর ঝিমিয়ে এলো, “সে আর ফেরে না।”

এই কথাগুলো শুনে মৃণালিনী যেন এক অদ্ভুত টানে জড়িয়ে গেল সেই পুরনো বিশ্বাসের ভেতর। সে খেমচিকে অনুরোধ করল আরও জানাতে—লোকগাথা, ঘটনার বিবরণ, বাল্যকালের স্মৃতি। খেমচি মাথা নাড়লেন, “সব গল্প বলা যায় না মা। কিছু গল্প বাঁচে শুধু বাতাসে আর ধোঁয়ার ভেতরে।” মৃণালিনী বুঝতে পারল, এই মানুষজনের কাছে ধোঁয়া কেবল বাতাসের প্রতিক্রিয়া নয়—এ এক চেতনার রূপ, প্রাচীন আত্মাদের ভাষা, যা কেবল অনুভব করে বোঝা যায়। অর্ণব এদিকে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তার ড্রোনের ট্র্যাকিং রিপোর্ট নিয়ে, কিন্তু সে লক্ষ করল—গ্রামের মানুষ তার ক্যামেরা ও প্রযুক্তির দিকে বেশ সন্দেহভরে তাকাচ্ছে। এমন সময় গণেশ বলল, “ভাইসাব, ও পাহাড়ে যাবেন না। আপনি যা দেখেছেন, সেটা আরেকবার দেখলে আপনি কাকে ডেকে আনছেন, সেটা বুঝতেও পারবেন না।” কথাটার মধ্যে ভয় ছিল, সতর্কবার্তাও ছিল। কিন্তু ঠিক সেই ভয়টাই যেন অর্ণব আর মৃণালিনীর কৌতূহল আরও বাড়িয়ে দিল। সেদিন দুপুরে ফিরে এসে, তারা তাবুতে বসে নোটপত্র ঘাঁটছিল, ছবি তুলছিল আগের রাতের ধোঁয়ার কিছু অবশিষ্ট রেখা। মৃণালিনী তার ল্যাপটপে প্রাচীন উপজাতীয় চিত্রকলা ও রঙের ব্যবহার সম্পর্কে কিছু তথ্য খুঁজতে শুরু করল—কোথাও কি এমন ধোঁয়া ও রঙের ব্যবহার সংস্কার বা ধর্মীয় অভিব্যক্তি হিসেবে দেখা গিয়েছে? সন্ধ্যা নামার আগে সে বলল, “খেমচির কথা আর বিজ্ঞান একসঙ্গে মিলছে না, কিন্তু তার কথায় কিছু একটা আছে। কোনো সংকেত নিশ্চয়ই প্রাচীন কাহিনির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। আমাদের ও পাহাড়ে যেতেই হবে।” আর দূরে, ছায়ার পেছনে পাহাড়টা তখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে, যেন তার বুকের গভীর থেকে ধোঁয়ার ভাষা তৈরি হতে শুরু করেছে—একটি নতুন রাতের আহ্বানে।

সকালটা অদ্ভুতভাবে স্নিগ্ধ ছিল, যেন জঙ্গল নিজেই নিঃশব্দে কিছু বলে যেতে চাইছিল। রাতের ঘুম ভেঙেই মৃণালিনী যেন বুঝে গেল, আজ কোনো বড় কিছু আবিষ্কারের দিন। আগের দিনের খেমচি সর্দারের মুখে শোনা ছায়াচূড়া পাহাড়ের গল্পটা তার মনে গভীরভাবে গেঁথে গেছে। ধোঁয়া, রঙ, আত্মা আর ভাষার সেই উপমাগুলো কেবল লোককথা হিসেবে না দেখে, সে তা বুঝতে চাইছিল প্রত্নতত্ত্বের দৃষ্টিভঙ্গিতে। তাই সে সকালে উঠে বন বিভাগের অফিস থেকে প্রাচীন উপজাতীয় চিহ্ন সম্পর্কিত তথ্য খুঁজে বের করার চেষ্টা করে, যদিও অল্প কিছু রিপোর্টই সে পায়—সেগুলোর অধিকাংশই অসম্পূর্ণ, প্রায় অবহেলিত। ঠিক তখনই গণেশ, সেই স্থানীয় গাইড, এসে জানায় পাহাড়ের পেছনে একটা জায়গা আছে যেখানে ‘পুরনো গাছের নিচে’ নাকি কিছু পাথরের গায়ে রঙিন দাগ রয়েছে, যেটা গ্রামবাসীরা এড়িয়ে চলে। মৃণালিনীর চোখ চকচক করে ওঠে। সে সাথে সাথেই অর্ণবকে ডাকে, আর দু’জনে মিলে ক্যাম্পের কিছু সরঞ্জাম নিয়ে পাহাড়ের ঢালু পথ ধরে রওনা দেয়। রুদ্র বেহেরা একবার জিজ্ঞেস করেও কিছু বলেন না—শুধু তাকিয়ে থাকেন, চোখে এক ধরনের শঙ্কার ছায়া।

যে জায়গাটায় তারা পৌঁছায়, সেটা প্রায় ঘন জঙ্গলের ভেতর। ছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটা পাথরের গায়ে অদ্ভুত রঙের ছোপ, যেমনটা প্রাকৃতিক ভাবে হওয়ার কথা নয়। একটায় লাল, অন্যটায় বেগুনি, আরেকটায় সবুজ—এই রঙের ছত্রাক নয়, বরং যেন ইচ্ছাকৃতভাবে আঁকা চিহ্ন। মৃণালিনী হাঁটু গেড়ে বসে, হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখে, তারপর নোটবুকে আঁকতে থাকে। একটা চিহ্ন তাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে—এক বৃত্ত, যার মাঝে উঠে আসা রেখা, যেন ধোঁয়ার ওঠার রূপ। এবং তার নিচে খোদাই করা আছে কিছু শব্দ, পুরনো মুন্ডা বা হো উপজাতির ভাষায়, যার একটি রূপান্তর সে আগেই পড়ে রেখেছিল—“বালিমা।” সে উচ্চারণ করতেই গায়ে কাঁটা দেয় ওঠে—এই নামটাই খেমচি বলেছিল গতকাল, সেই পাহাড়ের কন্যার নাম, যে ধোঁয়ার মাধ্যমে আত্মা পাঠাতো। মৃণালিনীর মনে হচ্ছিল যেন এই পাথরগুলো কেবল প্রতীক নয়, বরং এক ধরনের আদিম ভাষা। ঠিক তখনই অর্ণব তার ক্যামেরা নিয়ে পজিশন সেট করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, এমন একটা দৃশ্য তার জন্য বিরল, প্রায় স্বপ্নের মতো—প্রকৃতি, লোককাহিনী আর বাস্তবতা একসঙ্গে ধরা দিচ্ছে। সে ড্রোন ক্যামেরাও চালাতে চায়, যেন ওপর থেকে এই জায়গার পুরো দৃশ্য ধারণ করতে পারে।

কিন্তু ঠিক সেই সময়েই ঝোপের ফাঁক দিয়ে এসে উপস্থিত হন রেঞ্জার রুদ্র বেহেরা। তাঁর মুখ থমথমে, গলায় দৃঢ়তা—“আমি আপনাদের ওদিকে যেতে নিষেধ করেছিলাম, মৃণালিনী মিস, আপনি তো অন্তত বুঝবেন।” অর্ণব বিরক্ত হয়ে বলে, “আমরা শুধু ছবি তুলছি, ক্ষতি তো কিছু করছি না।” কিন্তু রুদ্র মাথা নেড়ে বলেন, “ক্ষতি হয় সবসময় না বুঝেই। এই জায়গাটা সাধারণের জন্য নয়। এখানে বহু বছর আগে দুর্ঘটনা ঘটেছে, কয়েকজন গবেষক নিখোঁজ হয়েছিলেন। তারপর থেকে আমরা জায়গাটা এড়িয়ে চলি।” অর্ণব প্রতিবাদ করে বলে, “কিন্তু আপনি তো কিছু বলেননি এসব!” রুদ্র শুধু বলেন, “সব কথা বলা যায় না। কিছু কথা ধোঁয়ার মতোই—বুঝতে হয় দূর থেকে।” তবুও মৃণালিনী অনুরোধ করে বলে, “আমরা চাই শুধু ছবিটা আর খোদাইটা নথিভুক্ত করতে। আমি বিশ্বাস করি এই প্রতীকগুলো কোনো সংকেত বহন করে, যেটা প্রাচীন মানুষ ভাষা হিসেবে ব্যবহার করত।” রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, “এই নামটা—‘বালিমা’—আপনারা জানেন ওর মানে কী? ও মানে হল সেই কন্যা, যাকে হত্যা করা হয়েছিল পাহাড়ের চূড়ায়, কারণ সে অন্য ভাষা জানত, অন্যদের সঙ্গে ‘ধোঁয়ার ভাষায়’ কথা বলত। ওর কান্না থেকেই প্রথম ধোঁয়া ওঠে।”

এই কথাগুলো শুনে মৃণালিনীর গায়ে কাঁটা দেয় ওঠে। তার সামনে পাথরের গায়ে আঁকা চিহ্নগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠতে থাকে। অর্ণব ছবি তোলা বন্ধ করে দেয়, আর তিনজন তখন নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, চারদিকে জঙ্গলের পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো ছায়া ফেলে দিচ্ছে। পাহাড়টা যেন দূর থেকে চুপচাপ তাকিয়ে আছে, তার বুকে চাপা পড়ে থাকা স্মৃতিগুলোর মধ্যে দিয়ে ধোঁয়ার মতো কিছু ওঠার অপেক্ষা করছে। সেদিন সন্ধ্যায় ক্যাম্পে ফিরে এসে মৃণালিনী সেই চিহ্নগুলো তুলনা করে পুরনো উপজাতীয় সংকেতের তালিকার সঙ্গে। ধোঁয়ার প্রতিটি রং, প্রতিটি দাগ—সে বুঝতে পারছিল, পাহাড় কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু কার উদ্দেশ্যে? আর কেন এতদিন পর? সেই রাতেও তারা পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে ছিল—আর পাহাড় যেন নিঃশব্দে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিল, আরও কিছু দেখাবে। শুধু তার ভাষা বুঝতে জানতে হবে।

সন্ধ্যা নামার পর জঙ্গলের নিস্তব্ধতা যেন আরও ঘন হয়ে উঠেছিল, যেন ছায়াচূড়া পাহাড় তার নিঃশ্বাস আটকে রাখছে। ক্যাম্পফায়ারের আলো নেভানোর আগে অর্ণব শেষবারের মতো স্কাই ম্যাপ অ্যাপে দেখে নিল আকাশের অবস্থান, যেন বুঝতে পারে রাত কেমন থাকবে—নির্বিঘ্ন নাকি ঝোড়ো। মৃণালিনী তখন একটা পুরনো মানচিত্রে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল, যেখানে পাহাড়ের পেছনে কিছু অজ্ঞাত চিহ্ন দেওয়া ছিল—যার কোনও ব্যাখ্যা সরকারিভাবে ছিল না। তারা দুজনেই জানত, আজ রাতটা স্বাভাবিক থাকবে না। আগের রাতে রুদ্রের কড়া নিষেধাজ্ঞা, খেমচির অর্ধেক বলা কাহিনি, আর সেই পাথরের গায়ে খোদাই করা “বালিমা” নাম—সব মিলিয়ে যেন একটা অদৃশ্য টান তাদের পাহাড়ের দিকে টেনে নিচ্ছিল। তাই সিদ্ধান্তটা একেবারে নিঃশব্দে নেওয়া হল—রাত গভীর হলে, কেউ কিছু না জানার আগেই, তারা পাহাড়ের দিকে হাঁটবে। ক্যাম্পের চারপাশে জিপিএস লোকেশন সেট করে, ছোট ব্যাগে টর্চ, নোটবুক, আর অর্ণবের ইনফ্রারেড ক্যামেরা নিয়ে তারা নির্ভরযোগ্য বনপথ ছাড়িয়ে অন্ধকারে মিশে গেল। রাত তখন প্রায় নিস্তব্ধ, কেবল মাঝে মাঝে পাতার ফাঁক দিয়ে পতঙ্গের ডানার শব্দ, আর দূরে কোথাও কোন পাখির আকস্মিক আর্তনাদ।

পাহাড়ের দিকে যেতে যেতে ঘন গাছপালা যেন অস্বাভাবিক ঘন হয়ে উঠছিল, আর হঠাৎই বাতাসের মধ্যে একধরনের ঘ্রাণ টের পেল তারা—না সেটা আগুন, না ফুল, না পচন, বরং যেন গন্ধের মধ্যেও রঙ আছে। অর্ণব প্রথমে ভাবল, হয়তো কোনো নির্দিষ্ট গাছের ফুল ফুঁটেছে, তবে মৃণালিনী বলল, “এই গন্ধটা একই সঙ্গে মিষ্টি আর তীব্র। যেন কিছু জ্বলছে, আবার কিছু শ্বাস নিচ্ছে।” হঠাৎ করেই একটি খোলা জায়গায় তারা পৌঁছাল—চারপাশে উঁচু উঁচু গাছ, কিন্তু মাঝখানে কয়েকটি গাছ দাঁড়িয়ে রয়েছে অদ্ভুত ভঙ্গিমায়, যেন তারা কেবল গাছ নয়—নিরীক্ষক, বা পাহাড়ের দেহরক্ষী। সেই গাছগুলোর গায়ে ফাটল ধরা, আর সেই ফাটল থেকেই ধোঁয়া উঠছে—সপ্তরঙা, ধীরে ধীরে বদলাতে থাকা। রং গুলোর মধ্যে কোনও দৃশ্যমান নিয়ম নেই, কিন্তু একটা প্রবাহ আছে, যেন শব্দ ছাড়া কথা বলা হচ্ছে। মৃণালিনী কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে রইল, তারপর ফিসফিস করে বলল, “তুই বুঝতে পারছিস না, অর্ণব—এই ধোঁয়া যেন প্রশ্ন করছে। কিছু বলতে চাইছে, আমাদেরকে… পরীক্ষা নিচ্ছে।” অর্ণব ক্যামেরা অন করে ইনফ্রারেড মোডে ধরার চেষ্টা করল, কিন্তু ছবি অস্পষ্ট—ধোঁয়ার রং ধরা পড়ছে না, বরং একধরনের ইন্টারফেরেন্স তৈরি হচ্ছে স্ক্রিনে। যেন প্রযুক্তি এখানে প্রবেশ করতে পারছে না। ঠিক সেই মুহূর্তে, গাছের ছায়ার পেছনে কিছু একটা নড়ল।

এক ছায়ামূর্তি, প্রথমে ধোঁয়ার মধ্যে ঢেকে থাকা, পরে ধীরে ধীরে উন্মোচিত, যেন মানুষের চেহারায় কোনও কুয়াশা তৈরি হচ্ছে। অর্ণব প্রথমে দৌড়ে পালাতে চাইল, কিন্তু পা যেন আটকে গেল। মৃণালিনী চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল—মূর্তিটি নারী আকৃতির, মাথা নিচু, চুল খুলে পড়া, আর কাঁধের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ধোঁয়া তার মতোই রঙিন। মুহূর্তখানেক তারা তাকিয়ে রইল সেই ছায়ার দিকে, তারপর হঠাৎ গাছের পেছনে মিলিয়ে গেল সে, যেন ছিলই না কখনও। অর্ণব হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “দেখেছিস? দেখেছিস ওটা?” মৃণালিনী নিশ্চুপ। তারা কাঁপা কাঁপা পায়ে ফিরে এল ক্যাম্পে, কোনোমতে আগুন জ্বালিয়ে নিজেদের গুছিয়ে নিতে নিতে কেউ কারও দিকে তাকাল না। গভীর রাতে মৃণালিনী এক দুঃস্বপ্নে ভেসে গেল—এক মেয়ের কান্না, অজস্র রঙের ধোঁয়া আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়, যার উপর একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো—“আমাকে ফিরিয়ে আনো।” ঘুম ভাঙতেই সে বুঝতে পারল, স্বপ্নে কেউ তার নাম ধরে ডাকছিল না, বরং বলছিল—“বালিমা।” আর জঙ্গলের অন্ধকার যেন তখনো সেই স্বপ্নের কথাটুকু সত্যি করে তুলছিল, কারণ পাহাড় তখনো নিঃশব্দে ধোঁয়া পাঠাচ্ছিল, রঙিন, রহস্যময়, এবং নিঃশব্দ ভাষায় কাঁপতে থাকা।

খেমচির কণ্ঠস্বর ছিল যেন অনেক দূরের এক পাহাড়ি নদীর মত—সেই কাহিনি বলতে বলতে তার চোখ ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল, আর ঠোঁট কাঁপছিল ভীত-সম্মোহনের মিশ্রণে। ক্যাম্পফায়ারের চারপাশে তখন সবাই নিঃশব্দে বসে ছিল, মৃণালিনীর চোখ একটানা খেমচির মুখে, আর অর্ণবের হাত কাঁপছিল রেকর্ডার ধরতে গিয়ে। খেমচি বলল, “বহু বছর আগে, এই পাহাড়ে বাস করত এক যাযাবর গোষ্ঠী, যারা বন আর গুহার ভাষা জানত। তাদের মধ্যে ছিল এক কিশোরী—বালিমা। কেউ বলে সে ভবিষ্যৎ দেখতে পারত, কেউ বলে সে পাহাড়ের নাভি চিনত, যেখানে পাতাল আর আকাশ একসঙ্গে নিঃশ্বাস নেয়। সে ছিল শব্দহীন ভাষার ধারক—গুহার দেয়ালে আঁকা সংকেতের মানে বুঝত সে। তবে এই ক্ষমতাই তার অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়।” আগুনের আলোয় খেমচির কপালে ঘাম চিকচিক করছিল, সে থেমে একটু জল খেল, তারপর আবার বলল, “একদিন কিছু শিকারি পাহাড়ে আসে, বাইরের লোক, যারা শুধু লোভ চেনে। তারা গুজব শুনেছিল বালিমা পাহাড়ের মধ্যে এক গুপ্তসন্ধান জানে—সোনা, হিরে, বা অমৃত। তারা তাকে জোর করে ধরে, প্রশ্ন করে, নির্যাতন করে। কিন্তু বালিমা কিছু বলে না—শুধু তাকিয়ে থাকে, সেই নির্জন গুহার দিকে। শেষমেশ, তারা তাকে হত্যা করে, সেই গুহার মুখেই।” খেমচির গলা রুদ্ধ হয়ে আসে এখানে। “তবে তার মৃত্যুতে কিছু শেষ হয়নি। বরং সেখান থেকেই শুরু।”

“বালিমার দেহ যেখানে ফেলা হয়, সেখান থেকেই প্রথম ধোঁয়া উঠেছিল। প্রথমে সেটা ছিল ধুসর, তারপর ধীরে ধীরে আগুনের মতো লাল, রক্তের মতো ঘন। যাযাবর গোষ্ঠীর লোকেরা বুঝতে পারে, বালিমার আত্মা শান্ত হয়নি—বরং সে পাহাড়ের সঙ্গে একীভূত হয়ে গেছে। তারা পাহাড়কে কাঁদতে শুনেছে, রাত্রি বেলায় ধোঁয়ার মধ্যে বালিমার চোখ দেখতে পেয়েছে। প্রতি পূর্ণিমায় ধোঁয়া উঠে আসে পাহাড় থেকে, যেন সেই মুহূর্তটাকে বারবার পুনরুজ্জীবিত করছে—তার মৃত্যু, তার যন্ত্রণা, আর তার অভিশাপ। সময়ের সাথে সেই গোষ্ঠী হারিয়ে গেছে, কেউ ঘাসে মিশে গেছে, কেউ পাথরে। কিন্তু পাহাড় মনে রেখেছে। পাহাড় কিছু ভুলে না। সেই ধোঁয়া এখন শুধু আকারহীন বাষ্প নয়, সেটা হল স্মৃতির ভাষা। বালিমা সেই ধোঁয়ার মধ্যেই কথা বলে, শুধু তারা শুনতে পারে, যারা তার যন্ত্রণা বুঝতে পারে।” খেমচির চোখে তখন একধরনের স্থিরতা, যেন সে এই সব নিজে দেখেছে, বা হয়তো বংশপরম্পরায় বহন করছে এই ইতিহাস। ক্যাম্পের পেছনে গাঢ় নীল অন্ধকারে তখন নিঃশব্দে চলছিল বনের নিঃশ্বাস। অর্ণব কিছু বলার চেষ্টা করল, কিন্তু শব্দ বেরোল না। মৃণালিনী ধীরে ধীরে বলল, “তাহলে… আমরা যেটা দেখেছি, সেটা শুধু অলৌকিক নয়। সেটা এক স্মৃতি। বালিমার স্মৃতি।”

সে রাতটা ছিল স্তব্ধতায় মোড়ানো। কারও ঘুম এলো না ঠিকভাবে। মৃণালিনী তার নোটবুকে কিছু আঁকতে লাগল—গাছের ফাঁক দিয়ে যে ধোঁয়া উঠছিল, সেই রংবদল, সেই ছায়া, সেই অদৃশ্য ভাষা। ধোঁয়ার প্যাটার্নগুলো যেন গুহাচিত্রের মত লাগছিল তার চোখে—সঙ্গে সঙ্গে সে খেমচির বলা কাহিনির সঙ্গে মিলিয়ে নিচ্ছিল, যেন ধোঁয়া আর সেই কাহিনি একে অন্যকে প্রতিফলিত করছে। অর্ণব তার ক্যামেরার ভিডিও বারবার দেখে—তবে ধোঁয়ার জায়গায় শুধু নীরবতা। ডেটা আছে, কিন্তু ধোঁয়া নেই। যেন প্রযুক্তি তা ধারণ করতে অক্ষম। তারা বুঝে যায়, এই রহস্য কোনও বিজ্ঞান দিয়ে বোঝানো যাবে না। এটা একটি নৃ-সাংস্কৃতিক বার্তা, সময়ের গর্ভ থেকে উঠে আসা স্মৃতির ধোঁয়া, যা প্রতি পূর্ণিমার রাতে নিজের অস্তিত্বের দাবি জানায়। “আমরা যদি বালিমার মৃত্যুর জায়গাটা খুঁজে পাই,” বলল মৃণালিনী পরদিন সকালে, “তাহলে হয়তো ধোঁয়ার উৎস বুঝতে পারব। হয়তো তাকে শান্তি দেওয়া যাবে। অথবা আরও গভীর যন্ত্রণার সম্মুখীন হতে হবে।” খেমচি তখন শুধু বলল, “গুহাটাকে অনেক বছর কেউ খুঁজে পায়নি। কেউ সাহস করেনি। কিন্তু তুমি যদি ডাক শুনে থাকো, তাহলে সে তোমাকে পথ দেখাবে।” পাহাড় তখন দূরে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ছিল, আর গাছের ফাঁক দিয়ে ধোঁয়া উঠছিল, আগুন আর রক্তের রঙে, বালিমার আর্তনাদের মতো এক দীর্ঘশ্বাসে।

অর্ণবের হাত কাঁপছিল, কিন্তু চোখ ছিল পাথরের মতো স্থির। ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারে সে দেখতে পাচ্ছিল সেই ধোঁয়ার জাদু—যেটা কেবল বাতাসে মিশে যায় না, বরং আকার নেয়, কথা বলে। সে বারবার জুম করে, ফ্রেমের স্পিড কমিয়ে দেয়, কিন্তু ধোঁয়াটাকে স্থির ধরা যায় না। কিন্তু ধোঁয়ার গতিপথ, তার রং বদল, তার দিকচিহ্ন—সব মিলিয়ে যেন একটা ছন্দ, একটা সংকেত। প্রথমে সে ভাবছিল এটা হাওয়ার খেলা, বা কোনও অপটিক্যাল ইলিউশন। কিন্তু ধোঁয়ার প্রতিটা রং, প্রতিটা বাঁক যেন অর্থ বহন করছে। ঠিক তখনই তার মনে পড়ে যায়, ছোটবেলায় সে একটা পুরোনো বইতে “মোর্স কোড” শিখেছিল—ডট আর ড্যাশ, লম্বা আর ছোট সংকেত দিয়ে বার্তা পাঠানো যেত। চোখ ধাঁধানো বিস্ময়ের মধ্যে, সে ক্যামেরার স্ক্রিনে এক মুহূর্তে দেখে ধোঁয়ার ফর্ম যেন সেইরকম কিছুই বোঝাচ্ছে। একবার সরল রেখা, তারপর হঠাৎ বাঁক, তারপর থেমে যাওয়া। বারবার এই প্যাটার্ন—যেন ধোঁয়ার মধ্যে কেউ টাইপ করে চলেছে পাহাড়ের গোপন স্মৃতিগুলি। অর্ণব তখনই ফোন বের করে পুরোনো মোর্স কোড চার্ট খুলে বসে যায়। পাশে বসে থাকা মৃণালিনী তার আঁকা আর রঙ বিশ্লেষণে ডুবে। সে ধোঁয়ার ভিন্ন ভিন্ন রঙ নোট করছে—লাল, নীল, সাদা, মাঝে মাঝে ধূসর। প্রতিটা রঙের আগমন ঘটছে ধোঁয়ার গতি ও ছন্দের পরিবর্তনের সঙ্গে।

মৃণালিনীর চোখে তখন যেন ধোঁয়াটাই একটি ভাষার রূপ পেয়েছে—এক ভাষা যা উচ্চারিত হয় না, শুধু দেখা যায়, অনুভব করা যায়। “লাল,” সে ধীরে ধীরে বলে, “আছে যখন ধোঁয়ার তীব্রতা বাড়ে, দিশাহীনভাবে পাক খায়, এবং সঙ্গে একধরনের গুমোট গন্ধ আসে—যেন পুড়ে যাওয়া মাংসের মত। এটা ক্ষোভ, দহন, হয়তো বালিমার মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া।” সে প্যাডে আঁকতে আঁকতে বলে, “নীল ধোঁয়া আসে সবকিছু থেমে গেলে—যখন হাওয়া থামে, বন স্তব্ধ হয়ে যায়, আর কেবল একটা দীর্ঘ হাহাকার শুনি, যেন কেউ গভীর গুহার মধ্যে কাঁদছে। এটা বেদনা, কান্না, সেই হারিয়ে যাওয়া সময়ের দীর্ঘশ্বাস। আর সাদা ধোঁয়া… সেটা আসে খুব অল্প সময়ের জন্য, কিন্তু যখন আসে, পাহাড় যেন নিঃশ্বাস নেয়। গাছেরা দুলে ওঠে, বাতাস হালকা হয়। সেটা শান্তি। হয়তো কোনো মুহূর্তে বালিমার আত্মা আশ্রয় খুঁজে পায়।” এই রঙ বিশ্লেষণ আর অর্ণবের মোর্স কোড মিলিয়ে তারা বুঝতে শুরু করে—ধোঁয়া শুধু আবেগের বহিঃপ্রকাশ নয়, এক সচেতন বার্তা। ধোঁয়া কোনও এক দূর অতীতের সাক্ষী, পাহাড়ের বুকে পোতা যন্ত্রণার বিবৃতি, যা শব্দহীন ভাষায় জানাতে চায় নিজের সত্য। ক্যাম্পের আশেপাশে তখন বাতাস ভারী, যেন সময় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্ণবের হাত থেমে গেছে, সে মোবাইলের স্ক্রিনে সেই সংকেতগুলো টাইপ করে রেখে দেয়—লাল-নীল-লাল-সাদা-নীল-ধূসর। “যদি আমরা এটা ভাঙতে পারি,” সে বলে, “তাহলে হয়তো পাহাড়ের কথা শুনতে পারব।”

তাদের সেই রাতটা কাটে ছায়া আর ছন্দের তত্ত্বে। ধোঁয়ার প্রতিটা গতিপথ, প্রতিটা রঙের পরিবর্তন, বাতাসের সঙ্গে তার নাচ—সব যেন এক অদ্ভুত ব্যাকরণের অনুসারী। মৃণালিনী তার আঁকায় নতুন এক নকশা তৈরি করে, যেখানে রঙ আর রেখার মিলনে এক গোপন স্ক্রিপ্ট ফুটে ওঠে। “এই ধোঁয়া একটা জীবন্ত মেমোরি,” সে বলে, “যেটা শব্দহীন ভাষায় কথা বলছে। এটা বোঝার জন্য আমাদের কানে নয়, চোখে আর মনে শুনতে হবে।” খেমচি তাদের দেখে যায় দূর থেকে—নীরব, কিন্তু আশ্চর্যভাবে শান্ত। যেন সেই গল্প যেটা সে বলেছিল, এখন তাদের চোখে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। পাহাড়ের বুক তখন ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন, একেক সময় তা হালকা নৃত্য করে, একেক সময় বিষণ্ন অশ্রু ঝরায়। এবং সেই সব সংকেত একসঙ্গে মিলে বলে দেয়—“আমি এখনও এখানে আছি। আমি এখনও কথা বলছি।” শব্দহীন ভাষা তখন হয়ে দাঁড়ায় একমাত্র সত্য, আর সেই ভাষার পাঠক হতে হতে মৃণালিনী আর অর্ণব বুঝতে পারে—তারা কেবল পর্যবেক্ষক নয়, তারা এখন অংশ হয়ে গেছে সেই যন্ত্রণার, সেই পাহাড়ের, সেই অতীতের যা ধোঁয়ার মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করতে চায়। পাহাড় আর মানুষ তখন এক সূত্রে বাঁধা, এক নীরব অথচ স্পষ্ট ভাষায়।

অরণ্যের স্তব্ধতা যেন আরও ভারী হয়ে এসেছিল সেই সকালে, যখন অর্ণব, মৃণালিনী এবং রেঞ্জার রুদ্র বেহেরা ছায়াচূড়া পাহাড়ের উদ্দেশে রওনা দেয়। সূর্য তখন গাছপালার ফাঁকে ধীরে আলো ফেলছে, কিন্তু জঙ্গলের ভিতরটা ছিল ঘন ছায়ায় ঢাকা। খেমচি সর্দার আগের দিন যেভাবে জায়গাটা সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, তার প্রতিটা শব্দ যেন মৃণালিনীর কানে বাজছিল—“ওটা প্রেতপাহাড়, ওখানে স্মৃতির ধোঁয়া ঘোরে।” তবে এই বারে অর্ণব আর মৃণ পিছু হটার মানুষ ছিল না। রুদ্র প্রথমে রাজি না হলেও, অর্ণবের কনভিন্সিং যুক্তি ও মৃণালিনীর আবেগময় আকুতি তাকে বাধ্য করে। হাঁটতে হাঁটতে তারা এক সময় পৌঁছে যায় পাহাড়ের এক গোপন মুখে, যেটা স্থানীয়রা “অরণ্যগুহা” বলে জানে। গাছের শিকড় ঝুলে আছে, পাথরে সবুজ শ্যাওলা, আর মুখে গাঢ় অন্ধকার। রুদ্র বলল, “এইখানে কেউ আসে না। আমি নিজেও প্রথমবার যাচ্ছি।” তারা টর্চ জ্বালিয়ে ভিতরে ঢোকে। গুহার ভিতর ঠাণ্ডা, স্যাঁতসেঁতে, আর আশ্চর্য এক গন্ধ। পথটা সরু, কিন্তু হঠাৎই সেটা প্রশস্ত হয়ে যায়, যেন কেউ কেটে তৈরি করেছে। ভিতরের কক্ষে পাথরের দেয়ালে আঁকা কিছু রহস্যময় গুহাচিত্র ধরা পড়ে তাদের চোখে—যেখানে এক নারীমূর্তিকে ধোঁয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে দেখা যাচ্ছে, পাশে আগুন, শিকারি, রক্ত, আর পাহাড়ি বৃক্ষের চিত্র।

মৃণালিনী ছবিগুলোকে আলতো হাতে স্পর্শ করে বলে উঠল, “এই তো, এইটাই বালিমা।” ছবির একটিতে দেখা যাচ্ছে, বালিমা ধোঁয়ার মধ্যে কিছু সংকেত পাঠাচ্ছে আকাশের দিকে—সেই ধোঁয়ার রং স্পষ্টভাবে লাল, বেগুনি, আর সাদা। অন্য একটি গুহাচিত্রে তাকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে, চারপাশে ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে, কারও মুখ নেই—শুধু চোখের স্থানে লাল বিন্দু। রুদ্র তাকিয়ে থাকে স্তব্ধ হয়ে। অর্ণব নিজের ক্যামেরা বের করে সবকিছু রেকর্ড করতে শুরু করে। হঠাৎ গুহার ভিতর এক ঠাণ্ডা বাতাস প্রবাহিত হয়, তার সঙ্গে আসে এক অদ্ভুত শব্দ—কান পাতলে যেন কেউ নিঃশব্দে কাঁদছে। মাটির নিচে সামান্য কাঁপন অনুভূত হয়। তিনজনেই থেমে যায়। গুহার ভেতরকার দেওয়ালে আলো পড়ে টর্চের, আর সেই আলোর নড়াচড়ায় হঠাৎ যেন দেখা যায় এক ছায়ামূর্তি। গায়ের উপর ধোঁয়ার মতো ঘন রং লেপ্টে আছে, মুখ অস্পষ্ট, চোখে দহন। মৃণালিনী চিৎকার করে ওঠে, কিন্তু সেই মুহূর্তেই একটি শক্তিশালী কম্পনে মাটি ফেটে যেতে থাকে গুহার এক কোণ থেকে। তিনজনেই পড়ে যায়, ধুলো আর ধোঁয়ায় চারপাশ অন্ধকার।

ধোঁয়ার মধ্যে তখন অদ্ভুত আলো জ্বলে ওঠে—রক্তরঙা, আগুনের মতো নড়াচড়া করে। সেই আলোয় দেখা যায়, এক নারীমূর্তি ধীরে ধীরে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তার পোশাক যেন ধোঁয়া দিয়ে গড়া, চোখ দুটো জলময়, কিন্তু গায়ে এক রহস্যময় ক্ষমতা। তার শরীর আধা বাস্তব, যেন সময় আর স্মৃতির মাঝখানে আটকে আছে। অর্ণবের ক্যামেরা বন্ধ হয়ে গেছে, চার্জ নেই, কিন্তু তার চোখে তখন ইতিহাসের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। মৃণালিনী নিঃশব্দে বলে ওঠে, “বালিমা।” ছায়ামূর্তিটি একবার মৃণালিনীর চোখে চোখ রাখে, তারপর গুহার দেয়ালের দিকে ফিরে তাকায়—যেখানে ছবিগুলো যেন জ্বলে উঠেছে হঠাৎ। বালিমার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে, আর সেই অশ্রু গড়িয়ে গুহার মাটিতে পড়ে এক শুষ্ক লতা থেকে সাদা ধোঁয়া উঠে আসে। রুদ্র বলল, “এই পাহাড় স্মৃতির পাহাড়। এইখানে কান্না গাছ হয়, ধোঁয়া কথা বলে।” মুহূর্তটায় যেন সময় স্থির হয়ে থাকে। তিনজনের মধ্যে তখন শব্দ নেই, শুধু বালিমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা। সেই চোখে ভয় নেই, অভিযোগ নেই—আছে এক রকম আহ্বান। যেন অতীত চাইছে—তার সত্য জানাতে, তার আঘাত বুঝতে, আর তার ভাষাকে ফিরিয়ে আনতে। পাহাড় নীরব, কিন্তু সেই নীরবতার মধ্যে একটা চিৎকার লুকিয়ে আছে—যেটা শুধু ধোঁয়ার রঙে প্রকাশ পায়।

গুহা থেকে ফিরে আসার পর মৃণালিনীর চিন্তা থামে না। তার মনে তখন একটাই প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে—এই যে ধোঁয়ার মধ্যে ভাষা, অনুভূতি, বার্তা—এগুলো কি শুধুই অলৌকিক বা আত্মিক অভিজ্ঞতা, নাকি এটার পিছনে লুকিয়ে আছে এক গভীর, পুরাতন বিজ্ঞান? সে তার বাবার পুরোনো নোটগুলো বের করে, যেখানে ‘পাহাড়ি ভাষা ও আদিবাসী সংকেত’ নিয়ে গবেষণার কিছু খসড়া পাওয়া যায়। একটা নোটে লেখা ছিল—”ধোঁয়ার রং, ঘনত্ব ও গন্ধ—এই তিনের সমন্বয়ে তৈরি হয় এক ধরণের অর্থবাহী সংকেত, যাকে ‘চিত্রধোঁয়া’ বলা হয়।” মৃণালিনী বুঝতে পারে, বালিমা হয়তো এই যোগাযোগ পদ্ধতির শেষ অভিভাবক ছিল, এবং তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সেই ভাষাও হারিয়ে গেছে। কিন্তু তখনই সে আরেকটি চিন্তায় থমকে যায়—তাহলে পাহাড় এখন কেন বার বার ধোঁয়া পাঠাচ্ছে? সেই রাতে সে আবার অর্ণবকে নিয়ে ছায়াচূড়া পাহাড়ে ফিরে যায়, রুদ্র বেহেরা সঙ্গে থাকলেও এবার সে বেশ ভীত। তারা আগের গুহার পাশেই আরেকটি সরু পথ খুঁজে পায়, যার চারপাশে ছাই, ভাঙা পাথর ও জ্বলা কাঠ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। হঠাৎ মাটি থেকে বেরিয়ে আসা এক কালো ধোঁয়া তাদের পথ আটকায়। সেই ধোঁয়ার রঙ ছিল গাঢ় বেগুনি, গন্ধে পোড়া কাঠের সঙ্গে মিশে থাকা কাঁদন।

মৃণালিনী নিজেকে শান্ত রেখে সেই ধোঁয়ার ধরণ পর্যবেক্ষণ করে। সে দেখে, ধোঁয়া একবার সরু হয়ে উঁচুতে উঠছে, আবার হঠাৎ বিস্তৃত হয়ে মাটিতে ছড়িয়ে পড়ছে। যেন সেটা কিছু বোঝাতে চাইছে—একটা নিরব বার্তা, যা ভাষায় নয়, অনুভূতিতে প্রকাশ পায়। সে নিজেই নিজের মুখে বলল, “এটা শুধু আত্নার সঙ্কেত না, এ এক পুরাতন সংকেত—যেটা জায়গা হারিয়েছে, সময় হারিয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।” এরপর তারা পাহাড়ের আরেক পাশে কিছু খোঁড়াখুঁড়ির চিহ্ন দেখতে পায়—মাটির গভীরে ড্রিল মেশিন চালানো হয়েছে, বড় বড় পাথর ভাঙা, আর সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আধুনিক যন্ত্রপাতির ভাঙা অংশ। রুদ্র বিস্ময়ে বলে ওঠে, “এখানে তো সরকারি খনি প্রকল্প চলছে কিছুদিন ধরে! কিন্তু তারপর বন্ধ হয়ে গেছিল। স্থানীয়রা তীব্র প্রতিবাদ করেছিল, বিশেষ করে খেমচি সর্দার।” অর্ণব ক্যামেরায় সব রেকর্ড করতে থাকে। পাহাড়ের বুক ফুঁড়ে উঠে আসা ধোঁয়ার সঙ্গে সেই খনির অবশেষ মিলে যেন এক ভয়ানক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে—যেখানে অতীতের কান্না আধুনিক লোভের সামনে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।

এই ধোঁয়া কোনও অলৌকিকতা নয়—এ ছিল এক অস্পষ্ট ভাষার পুনরাগমন, যা সংকটের মুখে নিজেকে দৃশ্যমান করছে। বালিমা হয়তো শেষ পর্যন্ত একটা সিগন্যাল রেখে গেছে, যার পরিণতিতে এই ধোঁয়ার ভাষা আবার মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। পাহাড়ের প্রতিটি পাথর, প্রতিটি ভাঙা শিকড় যেন একেকটা বাক্য, যেগুলো বুঝতে পারলে প্রকৃত ইতিহাস ফিরে আসবে। মৃণালিনী সিদ্ধান্ত নেয়, তাকে এই ধোঁয়ার ভাষা ডিকোড করতেই হবে। সে পাহাড়ের ওপর ধোঁয়ার ওঠার গতি, রং, ও ঘ্রাণের ভিত্তিতে একটা টেবিল তৈরি করতে শুরু করে—লাল মানে ক্ষয়, সাদা মানে শান্তি, বেগুনি মানে বিপদ, আর কালো মানে ক্ষোভ। এই ভাষা বুঝলে হয়তো বোঝা যাবে পাহাড় আসলে কী বলতে চাইছে। সে হঠাৎ বলে ওঠে, “এই পাহাড় আমাদের কিছু বলতে চাইছে, হয়তো আমাদের থামাতে চাইছে—না হলে এত বছরে এই ধোঁয়া কেন আবার জেগে উঠত?” অর্ণব সম্মত হয়, রুদ্রও নীরব হয়ে পাহাড়ের দিকে তাকায়। দূরে কোথাও আবার এক নিঃশব্দ বিস্ফোরণের মতো শব্দ শোনা যায়—হয়তো পাহাড়ের গর্ভে আরেকটা ক্ষত তৈরি হল, যার প্রতিধ্বনি ধোঁয়ার ভাষায় আমাদের কাছে পৌঁছচ্ছে, ধীর, কিন্তু নিশ্চিত বার্তায়।

রুদ্র যখন সত্য স্বীকার করল, পাহাড় যেন হঠাৎ আরও ভারী হয়ে উঠল। একটি অন্ধকার সত্য এতদিন তার বুকের মধ্যে গুমড়ে কেঁদে যাচ্ছিল, আজ সেই কান্না ভাষা পেল রুদ্রের কণ্ঠে। “হ্যাঁ,” সে ধীরে বলল, “কিছু প্রাইভেট কোম্পানি সরকার থেকে গোপনে অনুমতি নিয়েছে এখানে খনিজ খোঁজার জন্য। আমি তখন বাধা দিতে পারিনি… আমাদের গ্রামের কিছু নেতারাও এতে যুক্ত ছিল। আমার কণ্ঠ থেমে গিয়েছিল, কিন্তু এই পাহাড়ের থামেনি। যেদিন প্রথম গুহার ধোঁয়া উঠতে দেখি, বুঝেছিলাম—পাহাড় রাগে জ্বলছে।” মৃণালিনী স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তার চোখে জল এসে গিয়েছিল, যেন সে বুঝে গেছে এই পাহাড়ও মানুষ—যার শরীর ভাঙলে রক্ত নয়, ধোঁয়া বেরোয়। আর সেই ধোঁয়াতেই চাপা থাকে শতাব্দীর কান্না, অশ্রুত ইতিহাস। রুদ্র আরও জানায়, এই কোম্পানিগুলো পাহাড়ের ভিতর ‘রেয়ার আর্থ মিনারেলস’ খুঁজছিল, যেগুলো বৈদ্যুতিক প্রযুক্তির জন্য খুব মূল্যবান। এই লোভই পাহাড়ের শরীর ছিঁড়ে ফেলছিল—দিনের বেলা ড্রিল, রাতের বেলা বিস্ফোরণ, আর প্রতি ভোরে পাহাড়ের নিঃশ্বাস হয়ে বের হতো ধোঁয়ার ভাষা।

এই সত্য সামনে আসতেই অর্ণব ও মৃণালিনী আর দেরি করেন না। তারা সব তথ্য, ছবি, ভিডিও একসঙ্গে জড়ো করে—ছায়াচূড়া পাহাড়ের ধোঁয়ার ভাষা, খননের প্রমাণ, রুদ্রের সাক্ষ্য, এবং বালিমার গুহাচিত্র—সব মিশিয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তৈরি করে। অর্ণব তার চ্যানেলের মাধ্যমে খবর ছড়িয়ে দেয়, আর মৃণ সোশ্যাল মিডিয়াতে #VoiceOfTheMountain ক্যাম্পেইন শুরু করে। প্রথমদিকে মানুষ কৌতূহলী হয়, তারপর আস্তে আস্তে বিষয়টি আলোড়ন তোলে। বিশেষ করে একদিন, তারা পাহাড়ের গায়ে উঠা সাত রঙের ধোঁয়ার একটি স্পষ্ট ছবি পোস্ট করে—ধোঁয়ার ধারা এমনভাবে মিলেমিশে গেছে যে মনে হচ্ছে রংধনু পাহাড়ের মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে, কিন্তু সেই সৌন্দর্যের মধ্যেই আছে আতঙ্ক, এক অব্যক্ত কান্না। ছবিটি রাতারাতি ভাইরাল হয়ে যায়। হাজার হাজার শেয়ার, কমেন্ট, প্রতিবাদ। কেউ লেখে—”পাহাড়ও কাঁদতে পারে?” কেউ লেখে—”মানুষ যখন কান্না থামিয়ে দেয়, প্রকৃতি কথা বলে।” মৃণালিনী একবার পোস্ট করে—”এই সাতরঙা ধোঁয়া কোনও জাদু নয়, কোনও মিরাকল নয়, এটা আমাদের অপরাধের প্রতিফলন।” আর সেটাই হয় সবচেয়ে শেয়ার হওয়া বার্তা। পাহাড়ের ধোঁয়া এবার শুধু অরণ্যে না, ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মোবাইল স্ক্রিনে, অন্তরে।

সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদ যত বাড়তে থাকে, প্রশাসনের উপর চাপ বাড়তে থাকে। সংবাদ চ্যানেলগুলো ছায়াচূড়ার গল্প কভার করতে আসে, আর তখনই খেমচি সর্দার এগিয়ে এসে তার গ্রামের হয়ে কথা বলে—”এই পাহাড় আমাদের পূর্বপুরুষ। ওর কান্না শুনলে আমরা চুপ করে থাকতে পারি না।” সরকার বাধ্য হয় তদন্ত শুরু করতে। সেই সময় বালিমার নামও উঠে আসে বারবার—এক নারী, যিনি পাহাড়ের ভাষা জানতেন, অথচ যাকে পাগল বলেছিল দুনিয়া। কিন্তু এখন বোঝা যায়, তিনি ছিলেন এক ‘স্মৃতির বাহক’। অর্ণব ও মৃণালিনী তখন একসঙ্গে একটি ডকুমেন্টারি বানাতে শুরু করে—Aguner Bhitor Kanna—যেখানে ধোঁয়া, আগুন, ইতিহাস, লোভ, আত্মা আর প্রতিবাদ সব একসঙ্গে মিশে যায়। তারা বারবার বলে, “এই পাহাড় বাঁচানো মানে শুধু একখণ্ড প্রকৃতি রক্ষা নয়, এটা এক ভাষার, এক স্মৃতির, এক আত্মার বাঁচন।” শেষ দৃশ্যের জন্য তারা গুহার সেই গুহাচিত্র তুলে ধরে, যেখানে বালিমা এক হাতে আগুন, এক হাতে জল নিয়ে পাহাড়ের বুকের উপর দাঁড়িয়ে আছে। আগুন যেন কান্না আর প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে ওঠে। আর সেই আগুন আজ শুধু পাহাড়ে নয়, জেগে উঠেছে লাখো মানুষের মনে।

১০

শেষ রাতের অন্ধকারে ছায়াচূড়া পাহাড় এক আশ্চর্য শান্তিতে মোড়া ছিল, যেন বহুযুগের ঝড়ের পর এক মুহূর্তের নিঃশব্দতা। বাতাস ছিল নিঃস্তব্ধ, পাতারাও কাঁপছিল না, কেবল ধোঁয়া উঠছিল পাহাড়ের চূড়া থেকে—সেই চেনা গুহা থেকে, যেখান থেকে এতদিন উঠেছে রক্তরঙা, কালো, কখনো নীল কিংবা হলদে ধোঁয়া। কিন্তু আজকের ধোঁয়া একেবারে ভিন্ন। এটা নিঃশব্দ সাদা, যেন ভোরের প্রথম আলো, যেন চাঁদের পাড় ছুঁয়ে নামা কুয়াশা। অর্ণব ক্যামেরার লেন্স ফোকাস করে বলে ওঠে, “মৃণ, এই প্রথম ধোঁয়াটা দেখে ভয় লাগছে না। এটা যেন… শান্তির মতো।” খেমচি সর্দার ধীরে এগিয়ে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়ে। তার চোখে জল, কণ্ঠে স্মৃতি, “বালিমা আজ শান্ত, কারণ কেউ তার কথা শেষমেশ শুনেছে। অনেক বছর ধরে পাহাড় তার কান্না পাঠিয়েছে, কিন্তু এখন হয়তো সে বুঝেছে, পাহাড় একা নয়।” সেই মুহূর্তে, যেন প্রকৃতিও বুঝে নিয়েছে যে তার ভাষা অবশেষে বোঝা গেছে—না কোনও যন্ত্র দিয়ে, না কোনও গবেষণার মাধ্যমে, বরং মন দিয়ে, আত্মা দিয়ে। সেই ধোঁয়ার নিচে দাঁড়িয়ে পাহাড় আর মানুষ একসঙ্গে নীরব ছিল, কেউ কিছু বলেনি, কারণ তাদের হৃদয়ের মধ্যেই চলছিল উচ্চারণহীন এক সংলাপ।

এই ঘটনার মাত্র দুদিন পর সরকার এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে জানায়—ছায়াচূড়া অঞ্চলে সব খনিজ অনুসন্ধান বন্ধ করা হচ্ছে, এবং এলাকাকে ‘প্রাকৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা অঞ্চল’ হিসেবে ঘোষণা করা হবে। অর্ণব ও মৃণালিনীর রিপোর্ট, ছবি, সাক্ষাৎকার, বালিমার ইতিহাস, এমনকি ধোঁয়ার প্রতিটি রঙের ব্যাখ্যা—সবই উঠে আসে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়। পাহাড় আর একটি স্থান নয়, হয়ে ওঠে একটি চেতনা, একটি স্মৃতি, একটি আত্মার প্রতীক। অর্ণব ও মৃণ অনুভব করে, তাদের কাজ এখানে শেষ নয়, কিন্তু তারা জানে, এই মুহূর্তে তাদের পদক্ষেপ শেষ। তারা পাহাড় ছেড়ে ফেরার সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু বিদায়ের আগের রাতে অর্ণব তার ক্যামেরা দিয়ে শেষবারের মতো সেই ধোঁয়ার উৎসের দিকে তাকিয়ে রেকর্ড করতে থাকে। তার চোখ ধাঁধিয়ে যায় হঠাৎই—ধোঁয়ার মধ্যে একটা মুখ… যেন এক নারীর চোখ, কপালের তিলক, খোলা চুলে বাতাস খেলা করছে। ক্যামেরার লেন্স ধোঁয়ার মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে স্থির হয় সেই মুখের উপর, অর্ণব ধীরে ফিসফিস করে, “মৃণ, দেখো… ওই মুখটা… এটা কি সত্যিই?” মৃণালিনী ক্যামেরার স্ক্রিনে তাকিয়ে নিঃশব্দে বলে, “বালিমা।” আর কিছুই বলা হয় না, কেউ কিছু বোঝে না—না তারা, না পাহাড়, না সেই মুখ।

পাহাড়কে বিদায় জানিয়ে যখন তারা নিচে নেমে আসে, তখন আর ভয় নেই, নেই প্রশ্নের ভার—শুধু এক অজানা উত্তর, যা হয়তো কোনোদিন জানা যাবে না। বালিমা কি সত্যিই এক প্রেতাত্মা ছিলেন? নাকি তিনি পাহাড়েরই আত্মা, যে ধোঁয়ার ভাষায় কথা বলেন? নাকি তিনি সেই ইতিহাসের অবশেষ, যে ইতিহাসকে যুগ যুগ ধরে ভুলে গেছে মানুষ? অর্ণব ক্যামেরাটি বুকের কাছে ধরে রাখে, যেন কোনও অমূল্য রত্ন। কারণ তার মধ্যে আছে সেই মুখ, যে মুখ হয়তো কোনওদিন কোনো বইতে লেখা থাকবে না, কিন্তু যারা হৃদয় দিয়ে পাহাড় বোঝে, তাদের কাছে থেকে যাবে চিরজাগরূক। ছায়াচূড়া এখন পাহাড়ের নাম নয়—এটা হয়ে উঠেছে পাহাড় রক্ষার প্রতীক, এক নীরব বার্তা, যা বলে—“যদি মন দিয়ে শোনা যায়, তবে প্রকৃতিও কথা বলে।”

সমাপ্ত

1000050378.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *