নীলাভ্র মল্লিক
অধ্যায় ১: অদৃশ্য পুরোহিত
পুরীর আকাশটা সেইদিন অস্বাভাবিক শান্ত ছিল। জুন মাসের শেষ সপ্তাহ, কিন্তু বৃষ্টির দেখা নেই, কেবল একটা অচেনা গুমোট ভাব জমে ছিল বাতাসে। ভোর সাড়ে চারটায় সিংহদ্বারের ঘণ্টাধ্বনি যখন ধ্বনিত হচ্ছিল, তখনও কেউ টের পায়নি যে জগন্নাথ মন্দিরের প্রবীণ পুরোহিত আচার্য বিভূতিভূষণ পাঠক আর কখনো সাড়ে চারটার পূজায় উপস্থিত হবেন না। তিনি ছিলেন এই মন্দিরের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও সম্মানিত সেবায়েতদের একজন—মূর্তি সাজানো থেকে শুরু করে সপ্তপ্রহরের রীতি পর্যন্ত যাঁর জ্ঞান ও শুদ্ধাচার ছিল ঈর্ষণীয়। সেইদিন ঠিক যেমনটি রীতি, তেমন করেই তাকে সকাল চারটায় ঘুম থেকে উঠে স্নান করে পূজা শুরুর প্রস্তুতিতে থাকবার কথা, কিন্তু সেবায়েত গগনদাস যখন বারবার তার দরজায় টোকা দিয়েও কোনো সাড়া পেলেন না, তখন প্রথমবারের মতো আশঙ্কা জাগে। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, কিন্তু ভিতরে কোনো শব্দ নেই। শেষে মন্দিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ কনস্টেবল গোপাল রায় এসে তালা ভাঙার নির্দেশ দেয়। দরজা খুলতেই ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে ধূপ-ধুনো আর পুরোনো বইয়ের গন্ধে মেশা এক ভারী নিস্তব্ধতা—যেন কোনও প্রাচীন অভিশাপ ঠিক তখনই জেগে উঠল।
ঘরটা ছিল সাজানো-গোছানো, ঠিক যেমন আচার্য পাঠকের স্বভাব। তবে বিছানা খালি, আলমারি খোলা, একটা তামার ঘটির মধ্যে শুকিয়ে যাওয়া তিল-তেল আর কোণের তাকের উপর রাখা ছিল একটি লাল কাপড়ে মোড়ানো পুঁথি—যার উপর তালা লাগানো ছিল সোনালি রঙের একটি পুরাতন লোহার ফিতেয়। সেটি দেখে গগনদাস ও কনস্টেবল দু’জনেই থমকে যায়, কারণ মন্দিরের ঘরের ভিতর কোনও তালাবদ্ধ পুঁথি রাখা নিষিদ্ধ। আরও অদ্ভুত ব্যাপার ছিল, ঘরের দেয়ালে আঁকা রাধাকৃষ্ণের ছবির নিচে পেনসিলে লেখা কিছু শব্দ — “প্রহর এসে গেছে, আমি তাকে খুলে ফেলব না, যদি না…” বাক্যটি অসম্পূর্ণ, শেষ শব্দ ছিল ঘষা। ঠিক তখনই খবরটা পৌঁছে যায় মন্দির প্রশাসনে, আর আসে মহাপাত্র করুণাকান্ত, যিনি দীর্ঘদিন আচার্য পাঠকের সহকর্মী ছিলেন। তিনি এসে ঘর দেখে মুখ শক্ত করে বলেন, “এটা তার নিজের ইচ্ছায় গমন নয়। কিছু… কিছু জাগ্রত হয়েছে।” এর মধ্যেই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের চোখ পড়ে ঘটনাটিতে, আর কলকাতা থেকে আসা ইতিহাস গবেষক শ্রীমন্তী মুখার্জি, যিনি পুরীর মন্দির-শিল্প ও রীতিনীতির উপর গবেষণা করতে এসেছিলেন, প্রথমবারের মতো এক নিখোঁজের ঘটনায় জড়িয়ে পড়েন—অবচেতনে তিনি বুঝতেও পারেননি, এই ঘটনা তার নিজের ইতিহাসটাকেই বদলে দেবে।
শ্রীমন্তী সকালবেলায় যখন মন্দির চত্বরে পৌঁছান, তখন আকাশে ঝুলে থাকা মেঘের ছায়া সিঁড়িগুলির গায়ে ছোপ ফেলছিল। তিনি এসেছিলেন কয়েকদিন আগেই, পুরনো রেকর্ড, শিলালিপি আর মন্দির-সংলগ্ন সাহিত্য নিয়ে কাজ করতে। আচার্য বিভূতিভূষণের সাথেও তার একবার দেখা হয়েছিল – এক ধৈর্যশীল, নিঃশব্দ মানুষ, যিনি চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতেন এবং সব প্রশ্নের উত্তরে ‘আগে জানো, তারপর বোঝো’ বলেই প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতেন। কিন্তু সেই মানুষ হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে যাবেন, তা ভাবেননি শ্রীমন্তী। ঘরে ঢুকে তিনি প্রথমে লক্ষ্য করেন পুঁথিটি – সেটির কাপড় লাল হলেও তার গাঢ় রং প্রায় কালো হয়ে গেছে ধুলোর স্তরে। তাঁর সন্দেহ হয়, এটি কোনও সনাতন ধর্মশাস্ত্র নয় – বরং কোনও ‘তন্ত্র’সংক্রান্ত গ্রন্থ। তিনি গোপনে কিছু ছবি তুলে রাখেন। করুণাকান্ত ততক্ষণে মন্দির সেবায়েতদের ডেকে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু গগনদাস এসে জানায়—“মা, কাল রাত্তিরে মন্দিরের পিছনের দিকে সিংহদ্বারের সিঁড়িতে কেউ যেন নামছিল… আমি ভেবেছিলাম বিভূতিজী হবেন, কিন্তু আবার উপরের দিকে আলোটা নিভে যায়। খালি পায়ে সিঁড়িতে হাঁটার আওয়াজ ছিল। এখন ভাবছি… হয়তো তিনি নিজেই নামেননি… কেউ হয়তো নামিয়ে এনেছে।”
অধ্যায় ২: শ্লোকের ছায়া
পুরীর সন্ধ্যা কখনো কখনো এমন এক রঙ ছড়ায়, যা চোখে নয়, মনে গেঁথে থাকে। শ্রীমন্তী সেই সন্ধ্যাবেলাতেই নিজের হোটেল ঘরে ফিরে আসেন, কাঁধে তার ক্যামেরা আর খামে মোড়া কিছু কাগজপত্র। আজ সারাদিন মন্দিরের ভিতরের পরিবেশ, মানুষের চাউনি, আর করুণাকান্তর রহস্যজড়ানো ইঙ্গিত সব মিলিয়ে তার ভিতরে একটা অদ্ভুত অস্বস্তি জমে উঠেছে। সে জানে না কেন, কিন্তু আচার্য পাঠকের ঘরে পড়ে থাকা সেই পুঁথিটা যেন অচেনা এক আকর্ষণে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সেই লাল কাপড়ে মোড়া, তালা লাগানো পুরাতন পুঁথি যেন তাকিয়ে ছিল তার দিকেই, যেন বলতে চাইছিল—“তুমি জানবে, কিন্তু জানতে হলে নিজেকে হারাতে হবে।” রাত দশটার সময় শ্রীমন্তী নিজের ল্যাপটপ খুলে বসে আচার্য পাঠকের ঘরে দেখা সেই অসম্পূর্ণ বাক্য আর ছেঁড়া শ্লোকের ছবি দেখতে। সেই শ্লোকে একটা শব্দ তার চোখ আটকে দেয়—“অভয়েশ্বর”—একটি শব্দ যার প্রাচীন উড়িয়া ব্যুৎপত্তি অনুসারে মানে হতে পারে “নির্ভয় দেবতা”, কিন্তু কোনো ধর্মগ্রন্থে এর উল্লেখ সে আজ পর্যন্ত দেখেনি। আরো অবাক করার মতো বিষয় ছিল, শ্লোকটির ছন্দ ব্রাহ্মণ গ্রন্থ বা উপনিষদের নয়, বরং কোনও গূঢ় তান্ত্রিক কবচের ছায়া বহন করে।
রাত বাড়তেই ঘরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। জানালার ফাঁক গলে সমুদ্রের হাওয়া ঢুকে পড়ে ঘরে, কিন্তু শ্রীমন্তী যেন গন্ধ পায় পুরোনো ধূপের, ভিজে পাতা আর পুরাতন বইয়ের পৃষ্ঠা উলটে যাওয়ার গন্ধ। তার মাথার ভিতর ঘুরতে থাকে সেই অর্ধেক শ্লোক – “যে দেখে অর্পণ, সে শোনে অভয়েশ্বরের নাম, কিন্তু যার হৃদয় দ্বিধায়, তার…” বাক্যটা মাঝপথে থেমে গেছে। ঘড়িতে তখন সাড়ে এগারোটা। ঘরটা নিঃশব্দ, অথচ শ্রীমন্তী স্পষ্ট শুনতে পান একটা ধীরে ধীরে পায়ের শব্দ—যেন কেউ পায়ে পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে আসছে। তিনি উঠে যান জানালার ধারে, বাইরে কেউ নেই। হঠাৎ করেই তার মনে পড়ে যায় সেই পুরোহিতের ঘরের দেয়ালের নিচে লেখা পেনসিলের বাক্য: “আমি তাকে খুলে ফেলব না, যদি না…” কে ছিল সেই ‘সে’? কী এমন শক্তি ছিল পুঁথিতে? ঠিক সেই মুহূর্তে, ল্যাপটপের স্ক্রিন ঝাঁপসা হয়ে আসে, আর মাঝে ভেসে ওঠে একটা অদ্ভুত ছায়াময় মুখ—যেন কেউ জলের ভিতর থেকে তাকিয়ে আছে। কয়েক সেকেন্ড পর সেটি মিলিয়ে যায়, কিন্তু শ্রীমন্তীর গলা শুকিয়ে আসে। তিনি বুঝতে পারেন, এই তদন্ত শুধু ইতিহাসের নয়, বরং এমন কিছু খুলে ফেলতে চলেছেন যা তাকে আর স্বাভাবিক থাকতে দেবে না।
পরদিন সকালে, তিনি মন্দির সংলগ্ন একটি প্রাচীন মঠে যান, যেখানে থাকেন এক রহস্যময় সাধু—চরণানন্দ, যাঁর কথা তিনি শুনেছিলেন স্থানীয় দোকানদারদের কাছে। মঠটা ছিল জঙ্গলের ভিতর ছায়াঘেরা, আর সেখানে পৌঁছেই তিনি টের পান, এখানে ‘কোনো কিছু’ এখনও জীবিত আছে, যেটা সময়ের বাইরে। সাধুবাবা বসেছিলেন একটি পাথরের আসনে, চোখ বন্ধ, ধ্যানমগ্ন। শ্রীমন্তী চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন, ঠিক তখনই চরণানন্দ চোখ খুলে বলেন, “পুঁথি খুলেছিস না তো? না খুললেই ভালো করেছিস। কারণ তুই খুললেই ওরা দেখবে তোকে।” শ্রীমন্তী চমকে যান, কারণ তিনি নিজের মুখে পুঁথির কথা বলেননি। সাধুবাবা তার দিকে না তাকিয়েই বলেন, “তুই যে শ্লোকটা দেখেছিস, ওটা সপ্ত অভিশাপের চতুর্থ স্তর। অভয়েশ্বর হল সেই দেবতা, যাঁর মূর্তি ছিল না, কেবল এক খালি আসন। আর ওর আরাধনা যারা করেছে, তারা কেউ বেঁচে ফেরেনি।” শ্রীমন্তী জিজ্ঞেস করেন, “তাহলে আচার্য বিভূতিভূষণ? তিনি কি সেই আসনের সামনে গিয়েছিলেন?” চরণানন্দ ধীরে বলেন, “তিনি গিয়েছিলেন, কিন্তু খুঁজছিলেন বিশ্বাসঘাতককে। কিন্তু ভুল করে নিজেই একটা অভিশাপ ছুঁয়ে ফেলেন।” শ্রীমন্তীর গা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। তিনি আর কিছু জিজ্ঞেস করেন না। ফিরে আসার সময় সাধুবাবা বলেন, “যদি আর এগোতেই চাস, তবে মনে রাখিস, সিঁড়ি সবসময় উপরের দিকে যায় না… কিছু কিছু সিঁড়ি নিচে নামার জন্যই তৈরি।”
অধ্যায় ৩: নিষিদ্ধ চত্বর
পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের গা ঘেঁষে থাকা পেছনের খোলা চত্বরটা দিনের বেলা নিরীহ মনে হলেও, রাত গভীর হলেই সেখানে নাকি শোনা যায় চাপা পায়ের আওয়াজ, অলস বাতাসের মধ্যে কিছুর ফিসফাস আর মাঝে মাঝে গন্ধ আসে পোড়া কাঠ, ধূপ আর কিছু অজানা রক্তমিশ্রিত ধরণের ধূপের, যাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় “অগ্নিসূত্রী।” এই চত্বরটির অস্তিত্ব সবার জানা, কিন্তু ব্যবহারে নিষিদ্ধ—এমনকি অধিকাংশ সেবায়েতও সেখানে প্রবেশ করেন না। বলা হয়, এটি এক সময়ে রাজাদের ব্যক্তিগত যজ্ঞস্থান ছিল, পরে এক গুপ্ত তান্ত্রিক চক্র এই স্থানকে অভিশপ্ত বলে ঘোষণা করে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, আচার্য বিভূতিভূষণ পাঠক মাঝেমধ্যে এখানে যেতেন—সে খবর কেবল কয়েকজন জানত, যার মধ্যে একজন হল স্থানীয় সাংবাদিক কিশোর দাস। কিশোর, এক তরুণ মজারু মনের লোক, শ্রীমন্তীর আগ্রহ দেখে প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল, কিন্তু পুঁথির ছবি আর শ্লোকের কথা শুনে তারও কৌতূহল জেগে ওঠে। তাই রাত দশটা নাগাদ, শ্রীমন্তীর হোটেল থেকে দুজনে ছুটে যায় মন্দিরের পিছনের গলি বেয়ে সেই নিষিদ্ধ চত্বরে। দু’জনের সাথেই ছিল মোবাইল টর্চ আর পায়ে নরম স্লিপার—জোরে আওয়াজ না হয় সে ব্যবস্থা।
চত্বরটিতে প্রবেশের ছোট্ট লোহার গেটটা ছিল ঝাঁপসা ও মরিচে ধরা। ভিতরে ঢুকতেই দুজনেই বুঝতে পারে, বাতাস এখানে আলাদা—ভারি, যেন স্তব্ধ, আর গন্ধটা খুবই তীব্র। মাটি কাদামাটি নয়, বরং যেন পাথরের উপর পাতলা ছাইয়ের স্তর জমে আছে। কিশোর বলল, “এখানে তো গত শতাব্দীতেও কেউ পা রাখেনি… কিন্তু দ্যাখো, এই পায়ের ছাপগুলো নতুন!” শ্রীমন্তী নিচু হয়ে দেখে একজোড়া খালি পায়ের ছাপ, খুব গভীর নয়, কিন্তু মাটি এখনও চাপা পড়ে যায়নি বাতাসে। ছাপগুলো সোজা গিয়ে থেমে গেছে একটি অর্ধবোজা দরজার সামনে, যার উপরে খোদাই করা আছে কিছু অদ্ভুত চিহ্ন—তিনটি বৃত্ত, একটির ভিতরে ত্রিকোণ, অন্য দুটি ঘুরন্ত সর্পিল রেখায় বাঁধা। এমন চিহ্ন সে আগে কেবল তান্ত্রিক মুদ্রা বা বজ্রযান পুঁথিতে দেখেছে। দরজাটার উপর কেউ যেন কিছু লিখে রেখেছিল, কিন্তু সময়ের সঙ্গে লেখা প্রায় মুছে গেছে। কিশোর মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে ছবি তুলে রাখে। ঠিক তখনই হালকা ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে থাকে পেছন থেকে, এবং দুজনেই অনুভব করে যেন কেউ তাদের ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছে। শ্রীমন্তী পেছনে তাকায়—কেউ নেই। কিন্তু হঠাৎ তার চোখ পড়ে চত্বরের এক কোণে ছোট্ট একটি ভাঙা প্রস্তরস্তম্ভ, যার উপরে অদ্ভুতভাবে সাজানো কিছু কাঠকয়লা ছড়ানো। তার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি আধপোড়া তুলসীর গাছ।
শ্রীমন্তী নিচু হয়ে দেখতে পায়, তুলসীর গাছটির গোড়ার মাটিতে খোঁচাখুঁচি করে কেউ একটা চিহ্ন এঁকেছে—আরও বিস্ময়ের বিষয়, সেটি সেই একই “অভয়েশ্বর” শব্দের ধাঁচে, কিন্তু এবার উড়িয়া ভাষায় খোদাই করা। কিশোর তখন বলে, “এখানে কিছু একটা ঘটেছে… খুব সাম্প্রতিক সময়ে। এবং আমি বাজি রেখে বলতে পারি, বিভূতিভূষণ পাঠক এই চত্বরে এসেছিলেন অন্তত তিন দিন আগে।” শ্রীমন্তী ধীরে বলেন, “তুমি ঠিক বলেছ… এবং সম্ভবত তিনি এই চিহ্নকে বন্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন।” হঠাৎই কিশোরের ফোন কাঁপতে থাকে হাতে, স্ক্রিন সাদা হয়ে যায়—তাতে কয়েক সেকেন্ডের জন্য দেখা যায় এক পাথরের সিঁড়ি, যার গায়ে লাল দাগ আর নিচে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে এক মুখহীন অবয়ব। মুহূর্তেই স্ক্রিন স্বাভাবিক হয়ে যায়। শ্রীমন্তী কিছু না বলেই বুঝে যায়—সিংহদ্বারের সেই প্রাচীন সিঁড়ি এখন কেবল স্থাপত্য নয়, বরং এক অলৌকিক সত্তার প্রবেশপথ। আর তারা দুজন এখন সেই পথের দৃষ্টিসীমার মধ্যে প্রবেশ করে ফেলেছে।
অধ্যায় ৪: সপ্ত অভিশাপের সূত্র
কলকাতা থেকে যখন শৈলজা পাঠক পুরীতে পৌঁছালেন, তখন পুরনো পুরীর আকাশে আবারো মেঘ জমছিল। স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা তার চোখে কোনো কৌতূহল ছিল না, ছিল একধরনের জেদ আর একটা জমাট অভিমান। আচার্য বিভূতিভূষণ পাঠকের একমাত্র কন্যা হলেও বাবার সঙ্গে তার সম্পর্ক কখনোই হৃদ্য ছিল না। তিনি এক আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক, আর তার বাবা ছিলেন ধর্মাচার্য, যার বিশ্বাস ছিল শব্দে নয়, মন্ত্রে; যুক্তিতে নয়, আস্থায়। শৈলজা ছোটবেলায় দেখেছে তার বাবা কতটা নিঃসঙ্গ, নীরব এবং গম্ভীর—তাকে ঘিরে যেন একটা প্রাচীন বইয়ের ধুলো জমা পরিবেশ সবসময় বিরাজ করত। কিন্তু নিখোঁজ হওয়ার খবর শুনেই তার ভিতরের সমস্ত অভিমান পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। তিনি জানতেন, যদি কেউ জানে বিভূতিভূষণের মনোজগৎ বা তার লুকোনো ইতিহাস—তবে সেটা কেবল তিনিই। পুরীতে পৌঁছে তিনি সরাসরি যান তার বাবার ঘরে, যা তখনও পুলিশ সিল করে রাখেনি। শৈলজা ঘরের দেয়ালে চোখ বোলাতে বোলাতে একটানা নিঃশব্দে ঘোরেন, যেন বহুদিন বাদে ফিরেছেন এমন একটা স্থানে যেখানে ইতিহাস আর ব্যক্তিগত স্মৃতি একই মাটিতে মিশে আছে।
ঘরের এক কোণে রাখা পুরোনো কাঠের আলমারিটা খুলতেই তার চোখ আটকে যায় একটি ছোট্ট রুপোর বাক্সে। ভেতরে ছিল তার শৈশবের একটা ছবি, আর সেই ছবির পেছনে লেখা—”শৈল, যদি কোনোদিন আমি না ফিরি, তাহলে এটুকু জেনে নিও, আমি যা খুঁজছিলাম তা তোমারই উপহার ছিল—তুমি ছিলে আমার সপ্তম সূত্র।” বাক্যটা পড়ে শৈলজার চোখে জল এসে যায়, কিন্তু তার সাথে সাথে মনে জাগে গভীর কৌতূহল। বাক্সের নিচে আরেকটি পুরাতন খাতা পাওয়া যায়, যা ছিল হাতে লেখা—পুঁথির মতই, কিন্তু আধুনিক কাগজে। খাতার প্রথম পাতায় লেখা ছিল “সপ্ত অভিশাপ – ঐতিহাসিক নথি ও ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ”। এর ভিতরে বিভূতিভূষণ লিখেছিলেন, গত কয়েক বছরে তিনি কীভাবে মন্দির চত্বরে ও পুরীর বিভিন্ন স্থানে সাতটি অদ্ভুত ঘটনায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন—সবকটিই ছিল কোনও না কোনও পুরোহিতের মৃত্যু, মানসিক বিকারগ্রস্ততা, অথবা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ঘটনা। প্রত্যেকটি ঘটনার শেষে ছিল একটি অদ্ভুত শব্দ বা চিহ্ন, যেটি পরে মিলিয়ে যায় সেই “অভয়েশ্বর” নামক দেবতাসত্তার পূজার রীতির সঙ্গে। খাতার মধ্যভাগে এসে শৈলজা পড়ে—“আমি চতুর্থ সিঁড়িতে পৌঁছে গেছি, কিন্তু পঞ্চমে উঠতে গেলে আমি নিজেকেই হারাব। আর যদি সপ্তম সিঁড়িতে পৌঁছাতে হয়, তাহলে শৈলজার সাহায্য ছাড়া তা সম্ভব নয়। কারণ সে ইতিহাস জানে, আমি বিশ্বাস করি।”
শৈলজা সেই রাতেই শ্রীমন্তীর সাথে যোগাযোগ করেন। প্রথমে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখেই কথা বলেন, কিন্তু পরে যখন শ্রীমন্তী তার মোবাইলে সেদিনের সেই তান্ত্রিক চিহ্নের ছবি দেখান, তখন শৈলজার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। তিনি বলেন, “এই চিহ্ন আমি চেনি। এটা ১৫শ শতাব্দীর এক লুপ্ত রাজবংশের সীলমোহর, যারা অভয়েশ্বর পূজা চালু করেছিল। তারা বিশ্বাস করত, মানুষের মন ও শরীর দুই-ই শুদ্ধ করা যায় যদি ঈশ্বরের স্ফূর্তিময় অনুপস্থিতিকে আরাধনা করা হয়।” শ্রীমন্তী থমকে যান—“অনুপস্থিতিকে?” শৈলজা মাথা নাড়েন, “হ্যাঁ। অভয়েশ্বর পূজার আসনে কোনও মূর্তি থাকত না, কেবল এক ফাঁকা সিংহাসন, আর সাতটি সিঁড়ি, যার প্রতিটি ছিল মানুষের অভ্যন্তরীণ স্তর—লোভ, ক্রোধ, মোহ, দ্বিধা, ভয়, অহং ও অবিশ্বাস—এই সাতটি স্তর পার করেই পূর্ণতা লাভ সম্ভব হত। কিন্তু প্রতি স্তরে ছিল এক অভিশাপ। আর বাবার খাতায় লেখা আছে, তিনি ইতিমধ্যেই চতুর্থ স্তরে পৌঁছেছেন।”
এই কথা শুনেই শ্রীমন্তীর মনে পড়ে যায় সেই পুঁথির শ্লোকের অসম্পূর্ণ লাইন। এটা কেবল কোনও তান্ত্রিক চক্রের ইতিহাস নয়, বরং এক আত্মিক যাত্রার রূপক, যা আচার্য পাঠক নিজের জীবনের শেষ দশকে অনুসরণ করছিলেন। শৈলজা ও শ্রীমন্তী সিদ্ধান্ত নেন—এখন শুধুমাত্র বাহ্যিক তদন্ত করে কিছু হবে না, বরং পুঁথির বাকিটুকু খোলা, এবং সপ্ত অভিশাপের উৎস খুঁজে বের করাই আসল চাবিকাঠি। কিন্তু কোথায় আছে সেই সপ্তম সিঁড়ি? আর কোথা থেকে শুরু হয় এই অভিশপ্ত পথ? উত্তর লুকিয়ে আছে সম্ভবত সিংহদ্বারের নিচে—সেই সিঁড়ির নিচে, যার পাথর এখনও ছুঁয়ে আছে শতাব্দী প্রাচীন এক নিঃশব্দ অভিশাপকে।
অধ্যায় ৫: সিঁড়ির নিচে সুড়ঙ্গ
পুরীর বাতাসে সেই দিন এক অদ্ভুত গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছিল—একটা পুরনো, আর্দ্র মাটি, ভেজা ধূপ আর যেন কোথাও গলে যাওয়া পাথরের গন্ধ। শ্রীমন্তী আর কিশোর, দুজনে তখন জগন্নাথ মন্দিরের পাশের পুরাতন পাঠাগার ঘুরে ঘুরে একটি মানচিত্র খুঁজছিলেন। পাঠাগারের ভেতরে প্রাচীন তাম্রলিপি, অজস্র পুঁথি আর ছেঁড়া খাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, বেশিরভাগই ছুঁয়ে দেখার উপযোগী নয়। হঠাৎ এক পুরোনো কাঠের ড্রয়ারের ভেতরে তারা খুঁজে পায় ১৮৫৯ সালের একটি মন্দির পরিকল্পনা, যেখানে স্পষ্ট আঁকা আছে — “মূল মন্দির স্তর – অধস্তন ভান্ডার গৃহ – প্রবেশদ্বার : দক্ষিণ-পূর্ব কোণ।” মানচিত্রে যে সিঁড়ির কথা বলা হয়েছে, তা আজ আর দৃশ্যমান নয়, কিন্তু পরিকল্পনা অনুযায়ী, সেটি সিংহদ্বারের কাছেই কোথাও মাটির নিচে অবস্থিত। তারা মানচিত্রের ফটোকপি করে নিয়ে সোজা রওনা দেয় পুরনো গেটের দিকে—যেখানে সাধুবাবা চরণানন্দ একবার বলেছিলেন, “সিঁড়ি সবসময় উপরের দিকে যায় না।” শ্রীমন্তী তখনই বুঝেছিলেন, তাকে সত্যিই নিচে নামতে হবে—অর্থে ও আক্ষরিকতেও।
সন্ধ্যার কিছু আগে, দুইজন সেবায়েতকে কিশোর চেনার সুবাদে তারা সিংহদ্বারের পিছন দিকে ঢোকার সুযোগ পায়। চারদিকে তখন লোক কম, বাতি টিমটিম করছে। সিংহদ্বারের ঠিক দক্ষিণ-পূর্ব কোণে একটা পুরোনো প্রাচীরের পাশে মাটি একটু ডেবে গেছে। শ্রীমন্তী নীচু হয়ে খেয়াল করেন—মাটির নিচে যেন কিছু শক্ত কিছু আছে। কিশোর একটা লোহার রড এনে কয়েকবার খোঁচা দিতেই বোঝা যায় নিচে পাথরের স্ল্যাব। তারা মাটি সরিয়ে দেখতে পায়—একটি প্রাচীন পাথরের ফ্রেম, যার মাঝখানে লুকিয়ে ছিল সিঁড়ির মুখ। রড দিয়ে ঠেলে ফ্রেম সরাতেই ওপরে উঠে আসে শতাব্দী ধরে জমে থাকা ধুলো, ছাই, এবং এক ধাতব শব্দ—যেন কোনও তালা বা প্রতিরোধ ভাঙল। নিচে তাকাতেই দেখা যায় সরু, অন্ধকার এক সিঁড়ি, যা সরাসরি মাটির গভীরে নিয়ে যায়। নিচে কোনো আলো নেই, শুধু ঘন কালো অন্ধকার আর বাতাসে হালকা ছাঁচের গন্ধ। শ্রীমন্তী একবার থমকে যান, তারপর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, “আমরা যদি সত্যি জানতে চাই, আমাদের নামতেই হবে।” কিশোর হালকা কাঁপা গলায় বলে, “আমি তো রিপোর্টিং করতে এসেছিলাম… এখন মনে হচ্ছে ভূত নিয়ে ডকুমেন্টারি করতে চলেছি।”
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই আশ্চর্য ব্যাপার ঘটে—সেই সরু পথটা প্রায় কুড়ি ধাপ নামার পর হঠাৎ প্রশস্ত হয়ে যায়, যেন নিচে একটি প্রকাণ্ড গুহা বা ঘর রয়েছে। মাটির নিচে তারা পৌঁছায় এক বিস্ময়কর স্থানে—একটি প্রাচীন পাথরের চত্বর, যার দেয়াল জুড়ে আঁকা ছিল বিভীষিকাময় শিল্প—দেবদূত নয়, বরং বিকৃত মুখ, ছিন্ন দেহ, আর কণ্ঠহীন আরাধনার প্রতীক। এই হল সেই ‘অধস্তন স্তর’, যা মূল মন্দিরের নিচে নির্মিত হয়েছিল, এবং এখানে পূজিত হতো “অভয়েশ্বর” — এক শূন্য আসনের দেবতা, যার সামনে কেবল রাখা থাকত আগুন, রক্ত, আর স্তবপাঠ। কক্ষটির ঠিক মাঝখানে রাখা ছিল একটি প্রস্তরাসন—ফাঁকা, কিন্তু সেটার চারপাশে ঝরনা ধরে থাকা রক্তের দাগের মতো ছোপ। আশেপাশে চারটি গর্ত – যার প্রতিটিতে পড়ে আছে কিছু পোড়া তুলসী পাতা, মুদ্রা, আর কাঠের মুখোশ। কিশোর স্তম্ভিত হয়ে বলে, “এখানে যেন সময় থেমে আছে। কেউ যেন এখনও ফিরে আসেনি। কিংবা হয়তো ফিরেই এসেছে…” শ্রীমন্তী সিঁড়ির ধারে বসে পড়ে, নিঃশ্বাস গম্ভীর হয়, সে চোখ বন্ধ করে বলে, “এখানে কিছু ছিল, যা কেবল পূজা নয়—এ ছিল আত্মোৎসর্গ। এবং আমার বিশ্বাস, আমার দেখা সেই শ্লোক… আসলে এখানেই লেখা হয়েছিল।”
ঠিক তখনই তাদের মোবাইল টর্চ নিভে যায়। চারদিকে চুপচাপ নিঃস্তব্ধতা। কিন্তু হাওয়ায় একটি ছায়া যেন দুলে ওঠে, আর গুহার পাথরের দেয়ালের গায়ে হঠাৎ ভেসে ওঠে রক্তলাল অক্ষরে এক ছায়াময় লেখা—“পঞ্চম জন আসবে। সে দ্বিধা নিয়ে আসবে।” শ্রীমন্তী আর কিশোর একে অপরের দিকে তাকায়, কারণ তারা জানে—তাদের কেউ একজন ইতিমধ্যেই সেই পঞ্চম অভিশাপের দরজায় পা রেখেছে।
অধ্যায় ৬: বিভ্রম ও দর্শন
ঘটনার সেই রাত থেকে শ্রীমন্তী যেন ধীরে ধীরে বাস্তবতা থেকে বিচ্যুত হতে শুরু করলেন। বাহ্যিকভাবে তিনি ছিলেন স্বাভাবিক—চা খাচ্ছেন, খাতায় নোট নিচ্ছেন, ইতিহাস পড়ছেন, কিশোরের সাথে আলোচনা করছেন। কিন্তু ভিতরে যেন এক অস্পষ্ট কুয়াশা জমে উঠছে প্রতিদিন। মন্দিরের নিচের সেই প্রাচীন চত্বর, ফাঁকা সিংহাসন, সেই আগুনের চিহ্ন আর দেওয়ালের রক্তলাল বার্তা—সব মিলিয়ে তার মনে এক গভীর দাগ কেটে যায়। দিনভর মাথাব্যথা, মাঝে মাঝে বুকে চাপ লাগা, আর রাত্রিবেলা এক ধরনের অদ্ভুত স্বপ্নের ভেতর সে হারিয়ে যাচ্ছিল। প্রথম স্বপ্নটা সে দেখেছিল ঠিক ওই রাতের পরে—সে যেন সেই ফাঁকা সিংহাসনের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে আছে, আর চারপাশে অদৃশ্য কণ্ঠে কেউ শ্লোক পড়ছে, যার প্রতিটি ধ্বনি তার রক্তে প্রবাহিত হচ্ছে। সে দেখতে পায়, এক হাত তার কাঁধে রাখা—কিন্তু যখন সে মুখ তুলে দেখে, সেখানে কেবল ছায়া, চোখ নেই, মুখ নেই—শুধু দুটো পুড়ে যাওয়া পাঁজরের মতো ফাঁকা ফাঁকা চোয়াল।
দিন তিনেক পর তার মানসিক অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে যায়, যখন সে বাস্তবতা ও স্বপ্নের মাঝখানে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। এক বিকেলে, হোটেলের ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ তার মনে হয়, সিংহদ্বারের নিচে সেই সিঁড়ি আবার তাকে ডাকছে। সে জানে—সে পঞ্চম জন। বিভূতিভূষণ নিজেই শৈলজার খাতায় লিখেছিলেন, “যে ইতিহাস জানে, সে পঞ্চম ধাপে পৌঁছাবে, কিন্তু সে যদি দ্বিধাগ্রস্ত হয়, তবে তার চারপাশের বাস্তবতাই পাল্টে যাবে।” শ্রীমন্তী বুঝতে পারেন—এই ‘দ্বিধা’ তার মধ্যেই জন্ম নিচ্ছে, আর সেই দ্বিধা থেকেই তার চারপাশে তৈরি হচ্ছে এক অদ্ভুত বিভ্রম। শৈলজার সঙ্গে দেখা হলে তিনি সব খুলে বলেন, কিন্তু শৈলজাও তখন চিন্তিত। কারণ শ্রীমন্তী তাকে বলে, “আমি এখন বুঝতে পারছি, বিভূতিভূষণ আমাকে অনেক আগেই দেখে গিয়েছিলেন। সেই ফাঁকা সিংহাসনের সামনে আমিই বসেছিলাম, হয়তো তখন আমি বুঝিনি, কিন্তু এই অভিশাপের ভেতর আমি জড়িয়ে গিয়েছি।”
এক রাতে, হালকা বৃষ্টির পর, শ্রীমন্তী আবার ঘুমের মধ্যে সেই চত্বর দেখতে পান। এবার স্বপ্ন আরও স্পষ্ট—সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে আছেন বিভূতিভূষণ পাঠক। কিন্তু তিনি আর জীবিত মানুষ নন। শরীর নেই, কেবল ধোঁয়ায় তৈরি এক অবয়ব। তার মুখে হাসি নেই, কিন্তু চোখে ছিল একধরনের গভীর আকুতি। তিনি বলেন, “তুমি দ্বিধা নিয়েছ, এখন তোমার সামনে দুটো পথ—একদিকে পুঁথি খুলে সত্য জানতে পারো, কিন্তু নিজের বুদ্ধি হারাবে। অন্যদিকে পেছনে ফিরে যেতে পারো—তবে ইতিহাস রয়ে যাবে অসম্পূর্ণ, আর আমার আত্মাও…” বাক্যটি অসম্পূর্ণ রেখে তিনি মিলিয়ে যান। শ্রীমন্তী ঘুম থেকে জেগে ওঠেন—ঘাম drenched, নিঃশ্বাস দ্রুত। সেই মুহূর্তে হোটেলের জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখেন—দূরে, সিংহদ্বারের দিকে একটা কালো ছায়া আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার—ওই ছায়ার মাথায় ধূসর বসন মোড়ানো, এবং তার মুখের গড়ন যেন… নিজেই তার। শ্রীমন্তী জানেন না, তিনি এখন জেগে আছেন না আবার কোনও চতুর্থ স্তরের অভিশপ্ত স্বপ্নে ভাসছেন।
তারপর থেকে সে আর কাউকে কিছু না বলে ঠিক করে ফেলেন—তাকে আবার নিচে নামতেই হবে। কারণ একমাত্র নিচেই সে পাবে উত্তর। এবং সে যা দেখেছে, তার পর এই তদন্ত আর ঐতিহাসিক আগ্রহ নয়—এ এখন হয়ে উঠেছে নিজের আত্মা বাঁচানোর প্রশ্ন।
অধ্যায় ৭: সপ্তম মন্দির ও মূর্তিহীন শিব
যে রাতটিতে শ্রীমন্তী আবার সেই গোপন সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামবার সিদ্ধান্ত নেন, সেই রাতটি ছিল অমাবস্যা। চারপাশে ঘন কালো, আকাশে চাঁদের রেখা নেই, এমনকি বাতাসও যেন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কিশোর প্রথমে আপত্তি করলেও শ্রীমন্তীর দৃষ্টিতে এমন কিছু ছিল, যা দেখে সে আর কিছু বলতে পারেনি। তারা সঙ্গে করে ছোট একটি পাথরের তেল-চালিত দীপ, দুটি মোবাইল, একটুখানি গঙ্গাজল আর বিভূতিভূষণের হাতে লেখা খাতাটি নিয়ে নামে নিচে। আগের সেই প্রাচীন সিঁড়ি ধরে তারা আবার প্রবেশ করে সেই পাথরঘেরা চত্বরটিতে—যেখানে ফাঁকা সিংহাসনের সামনে এখনও জমে আছে ধূপের গন্ধ, আর সময় থেমে আছে সেই অভিশপ্ত স্তরে। কিন্তু এবার শ্রীমন্তী সরাসরি চত্বরের পূর্ব দিকের প্রাচীরের দিকে এগিয়ে যান—খাতার এক পাতায় বিভূতিভূষণ লিখেছিলেন, “সপ্তম স্তরের মূর্তি লুপ্ত নয়, মূর্তি কখনো ছিলই না। অভয়েশ্বরই ছিলেন মূর্তিহীন শিব।” সেই লাইন পড়ে শ্রীমন্তী অনুভব করেছিলেন, এই জায়গাটি কেবল এক গোপন স্তর নয়, এটি আদতে সেই লুপ্ত দেবতার সপ্তম মন্দির—যা বহুকাল আগে, সমাজের চোখ এড়িয়ে, ভূগর্ভে গড়ে উঠেছিল।
প্রাচীরের কাছে গেলে হঠাৎ বাতাসের ধরণ বদলে যায়। কিশোর লক্ষ করে, প্রাচীরের উপরের পাথরে খোদাই করা আছে উলটো মুখের একটি চিহ্ন—ত্রিনয়নের প্রতিফলন, কিন্তু তৃতীয় নয়নটি নেই। সে ছবিটি মোবাইলে তোলে। শ্রীমন্তী তখন প্রাচীরের একটা ফাঁকায় হাতে স্পর্শ করতেই পাথরটা সরে যায়—পিছনে বেরিয়ে আসে আরেকটি গোপন পথ। সেই সুড়ঙ্গটা অনেক সরু, আর ধীরে ধীরে নিয়ে যায় একটি গোলাকৃতি গৃহের দিকে, যার মধ্যে তারা প্রবেশ করে খুব ধীরে। ভিতরে ঢুকেই যেন শরীর হালকা শিরশির করে ওঠে—শূন্য, স্তব্ধ, অথচ উপস্থিত এক প্রবল শক্তি। ঘরটির মাঝখানে একটি পাথরের বেদি, যার উপর কিছু নেই। চারদিকের দেয়ালে আঁকা, অর্ধেক মুছে যাওয়া চিত্রগুলিতে দেখা যায় সাতজন তপস্বী—তারা কেউ অন্ধ, কেউ মূক, কেউ গলায় শৃঙ্খল বাঁধা, কিন্তু প্রত্যেকেই সেই খালি বেদির দিকে মাথা নিচু করে বসে আছে। কিশোর ধীরে বলে, “এটাই সেই সপ্তম স্তর, তাই তো?” শ্রীমন্তী মাথা নাড়েন, “হ্যাঁ। এবং এটাই সম্ভবত সেই পূজার কেন্দ্র, যেখানে অভয়েশ্বর পূজিত হতেন—নিঃশব্দে, নিরাকার, নিস্তব্ধতায়।”
ঠিক তখনই, গৃহের ভেতরের একটি দেয়াল থেকে ভেসে আসে এক ধরনের সুর—এক পুরাতন পুঁথির ছন্দ। কারও কণ্ঠ নয়, বরং যেন দেয়াল নিজেই গাইছে। তারা স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। গলার আওয়াজটা ছিল নিঃস্বর, ধ্বনি যেন বাতাসে কাঁপছিল। শ্রীমন্তী কান পাতেন—শ্লোকটা তার চেনা। বিভূতিভূষণের খাতার একটি পাতায়, যেখানে লেখা ছিল:
“যে দেখে না, সে জানে। যে জানে না, সে মুক্ত।”
এই শ্লোকটি আদতে ছিল ‘অভয়েশ্বর উপাসনা সূত্র’—এক লুপ্ত উপনিষদের অংশ, যেটি সনাতন ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তন্ত্রের এক গোপন শাখায় পরিণত হয়েছিল। শ্রীমন্তী বুঝে যান—এই মন্দিরটি জগন্নাথ মন্দিরের নীচে আরেকটি মূর্তিহীন, মনোবিজ্ঞানভিত্তিক, আধ্যাত্মিক গবেষণার কেন্দ্র ছিল এক কালে—যেখানে ঈশ্বর পূজিত হতেন অনুপস্থিতি আর আতঙ্কের মধ্য দিয়ে।
তবে হঠাৎই কিশোর মাটিতে কিছু যেন উঁচু অনুভব করে। পাথরের মেঝের একটি ফাঁকায় গলা ঢোকালেই তার হাতে লাগে একটি ধাতব কৌটো। সেটি খুলতেই দেখা যায় — ভেতরে একটি তাম্র শ্লেট, যাতে খোদাই করা আছে একটি শেষ বার্তা:
“যে সপ্তম দেখেছে, সে ফিরবে না। কিন্তু তাকে দেখতে হলে, সপ্তমকে ডাকতে হয় নিজের ভিতর থেকে।”
শ্রীমন্তী এবার বুঝে যান—বিভূতিভূষণ সেই শ্লেটের নির্দেশ মেনেই অদৃশ্য হয়েছিলেন। তিনি সপ্তম স্তরে পৌঁছেছিলেন, কিন্তু নিজেকে হারিয়ে দিয়ে। এখন প্রশ্ন একটাই—তারা কি ফিরে যাবে, না এই স্তরের মধ্যেই নিজেকে বিলিয়ে দেবে আরেক সত্য জানবার আশায়?
অধ্যায় ৮: সিংহদ্বারের ছায়া
পুরীর আকাশটা সেই দিন অস্বাভাবিক নীল ছিল, যেন ঝড় আসবে না জেনেও মেঘ জমে উঠছে মনে। শ্রীমন্তী জানতেন, আর সময় নেই। কিশোর তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু চোখেমুখে আতঙ্ক আর দ্বিধা। শৈলজা পাঠকও এসে পৌঁছেছেন সেই সকালে, হাতে ছিল তার বাবার পুরোনো খাতা ও শেষ চিঠি, যেটি তিনি এক পুরনো বন্ধুর মাধ্যমে পেয়েছিলেন—চিঠিটিতে লেখা ছিল: “যদি সত্যি খুঁজতে চাও, তবে পুঁথিটা খুলবে—অন্ধকারে দাঁড়িয়ে, মুখ রেখে পূর্বদিকে।” শ্রীমন্তী আর অপেক্ষা করতে চান না। সেই রাতেই, তারা তিনজন ফিরে যায় সেই প্রথম আবিষ্কৃত চত্বরের ভেতরে—সেই জায়গা যেখানে পড়ে ছিল লাল কাপড়ে মোড়া, তালা লাগানো সেই প্রাচীন পুঁথি। পুঁথির গায়ে তালা ছিল না তখন—তবে তালা যে খুলে গেছে, সেটা কে করেছে কেউ জানে না। পুঁথিটা যেন নিজের ইচ্ছায় প্রস্তুত হয়ে আছে তার অভিশপ্ত ইতিহাস জানানোর জন্য।
পুঁথি খুলতেই প্রথম পৃষ্ঠায় এক গা শিউরে ওঠা ছবি—ফাঁকা সিংহাসন, আর তার চারপাশে আগুনে জ্বলন্ত মানুষ, যাদের মুখে নেই কান্না, নেই আর্তনাদ, কেবল স্তব্ধতা। তারপর একে একে খুলতে থাকে পৃষ্ঠা—প্রতিটি পাতায় শ্লোক আর তার পাশে ছবি, যা এই যুগে আঁকা মনে হয় না। এক সময় পৌঁছে যায় সেই পাতায়, যেখানে লেখা ছিল অভয়েশ্বর পূজার মূল স্তব:
“ন মূর্তি, ন নাম, ন ধ্যান,
সুধা ছায়া শূন্য স্বরূপে সত্তা।
অন্ধের চোখে দীপ্তি, বিভ্রান্ত হৃদয়ে মোক্ষ।”
এটা ছিল এক ঈশ্বরসত্তার পূজা, যাকে কখনো দেখা যায় না, অনুভব করা যায় শুধু হারিয়ে গিয়ে। আর যেই সেই চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছেছে, সে আর নিজের অস্তিত্ব ধরে রাখতে পারেনি—কারণ ঈশ্বর এখানে ‘অভয়’ নন, বরং ‘অভিশপ্ত মুক্তি’।
ঠিক তখন, মন্দিরের নিচে সেই ঘরে হঠাৎ বাতাস ঘুরে যায়। ফাঁকা সিংহাসনের ওপরে উঠতে শুরু করে ধোঁয়া—আস্তে আস্তে সেই ধোঁয়ার মধ্যে গঠিত হয় এক মুখ—বিভূতিভূষণের মুখ। কিন্তু তার চোখ নেই, কেবল গহ্বর। তার ঠোঁট নড়ে, কিন্তু আওয়াজ হয় না। তারপর হঠাৎই তার কণ্ঠ ধ্বনিত হয় সবার কানে, যেন চারপাশের পাথর কথা বলছে:
“তোমরা সত্য চেয়েছিলে… পেয়েছ। কিন্তু মনে রেখো, সত্য শব্দ নয়, স্তব্ধতা।”
তারপর তিনি ধীরে ধীরে বলেন—“অভয়েশ্বর পূজা কোনো দেবতার আরাধনা নয়, বরং এক ভয়ঙ্কর মনস্তাত্ত্বিক বন্দনার নাম। আমি জানতাম আমি হারিয়ে যাব… কিন্তু আমি চেয়েছিলাম কেউ আমার শেষ চিহ্ন দেখে বুঝুক, ঈশ্বরের নাম নিয়ে মানুষ কতদূর যেতে পারে। আমি সেই পথে গেছিলাম—যেখানে ঈশ্বর ছিল আমার অভ্যন্তরের আতঙ্ক। আর তুমি, শ্রীমন্তী, তুমি পঞ্চম জন, কারণ তুমি জানো ইতিহাস মানে কেবল সত্য নয়, মানে ভয়ও।” তারপর তার অবয়ব মিলিয়ে যায়।
পুঁথির শেষ পাতায় লেখা ছিল—“যে পড়ল, সে জানল। যে জানল, সে হারাল।” শৈলজা খাতা বন্ধ করে ফেলেন। তিনি বলেন, “এখন এটা আমাদের কাছে রয়ে গেল এক প্রমাণ—ঈশ্বরতত্ত্ব কেবল বিশ্বাস নয়, এক অনন্ত বিভ্রান্তি।” কিশোর কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, “আমরা কি তাহলে মুক্ত?” শ্রীমন্তী মাথা নাড়েন—“আমরা মুক্ত নই, আমরা চুপ। আমরা জানি, এখন এ ইতিহাস আর বলা যাবে না। এই সত্য প্রকাশ করলেই মানুষ খুঁজবে অভয়েশ্বরকে, আর প্রতিটি অনুসন্ধান মানেই হবে একেকটি নতুন অভিশাপ।”
তারা তিনজনই সিদ্ধান্ত নেয়—পুঁথিটিকে আর কারও হাতে পড়তে দেওয়া যাবে না। সেই গভীর রাতে তারা পুঁথিটিকে আবার লাল কাপড়ে জড়িয়ে, সিংহদ্বারের ঠিক নিচে সেই প্রথম আবিষ্কৃত সিঁড়ির শুরুর পাথরের নিচে স্থাপন করে দেয়—যেখানে কেউ আর সহজে পৌঁছাতে পারবে না। শ্রীমন্তী আর কিশোর ফিরে যান কলকাতায়, শৈলজা ফিরে যান পাঠদানে, কিন্তু সকলের মনেই থেকে যায় সেই এক অভিজ্ঞতা—এক ইতিহাস, যা লেখা হয় না, বলা যায় না—শুধু বোঝা যায় সিংহদ্বারের ছায়ায় দাঁড়িয়ে, চুপচাপ।