Bangla - ভ্রমণ

সারনাথের সকাল

Spread the love

অতনু রায়চৌধুরী


অধ্যায় ১: নিঃশব্দের পথ
বারাণসীতে পৌঁছেছিলাম আগের দিন সন্ধ্যায়। শীতের কুয়াশায় ঢাকা ঘাটগুলো তখন ধূপ আর সান্ধ্য আরতির আলোয় মায়াবী হয়ে উঠেছে। কিন্তু শহরের কোলাহল, ভিড়, আর টানাটানির ভিড়ে কোথাও যেন আমার মন শান্তি খুঁজে পাচ্ছিল না। হোটেলের জানালা দিয়ে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে থেকে রাতটা কেটেছিল। ঘুম এসেছিল, কিন্তু মনটা যেন ঘোরের ভেতর দিয়ে হেঁটে চলছিল—কোন এক দূর, স্নিগ্ধ স্থানে। খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। হঠাৎ মনে হল, আজ সারনাথ যাওয়া যাক। বারাণসীর কেন্দ্র থেকে মাত্র দশ কিলোমিটার দূরে, যেখানে গৌতম বুদ্ধ প্রথম ধর্মচক্র প্রবর্তন করেছিলেন—এই জায়গাটাই যেন ডেকেছিল আমাকে। চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম, অটোতে চেপে বসি। রাস্তার পাশে শহর ছাড়িয়ে ধানক্ষেত, ছোট ছোট দোকান, টং ঘরগুলো পেরিয়ে আমরা যখন সারনাথে ঢুকলাম, তখন সূর্য মাথা তুলেছে ঠিকঠাকভাবে, কুয়াশার আড়ালে একটা মোলায়েম আলো ঝরে পড়ছে স্তূপ আর বৃক্ষদের গায়ে। গাড়ি থামতেই একটা অদ্ভুত শান্তি এসে শরীরের চারপাশ ঘিরে ধরল—যেন শব্দহীনতা এক নতুন ভাষায় কথা বলছে। দৃষ্টিতে ধরা পড়ল ধ্যানরত একাধিক ভিক্ষু—সাদা পোশাক, লাল আলখাল্লা পরা, তাদের মুখে কোনো সংলাপ নেই, কিন্তু চোখে এক অন্তর্দৃষ্টি। আমি হাঁটতে শুরু করলাম ধানকেতের গন্ধ আর সকালে-ভেজা ঘাসের মধ্যে দিয়ে। বিশাল ধামেখ স্তূপের পাশে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করলাম—বায়ুর মধ্যে যেন হাজার বছর আগের কোনো স্পর্শ ছিল। আমার মনে পড়ল বুদ্ধের কথা: “আপ্প দীপো ভব”—নিজেই হও নিজের আলোক। এই স্তব্ধতার মধ্যে দাঁড়িয়ে সেই কথাগুলো যেন বেজে উঠল নিজের থেকেই।
একটা ছোট্ট কড়ইগাছের নিচে বসে ছিল একটি ছোট্ট বালক—সে এক ভিক্ষু, বয়স বড় জোর আট-নয় হবে। মাটিতে বসে, সে পদ্মফুলগুলো সাজাচ্ছিল খুব মনোযোগ দিয়ে। তার গায়ে ছিল হলুদরঙা চাদর, চোখে বিস্ময়ের দীপ্তি। আমি তাকে দেখে এগিয়ে যেতেই সে একটু হাসল, কিছু বলল না, শুধু একটা শ্বেতপদ্ম তুলে দিল হাতে। আমি কিছু না বলেই বসে পড়লাম তার পাশে, নীরবে তাকিয়ে থাকলাম চারপাশের দিকে। তখনই দূরে, ধামের উত্তর দিকের পাথরের ছায়ায় এক ভিক্ষু ধ্যানমগ্ন অবস্থায় বসে আছেন—মাথায় অল্প চুল, গাঢ় লাল বসন, চোখ বন্ধ, শরীর স্থির, যেন এক নির্বিকার বৃক্ষ। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর আমি উঠে গেলাম তাঁর পাশে, দূরত্ব রেখে বসে পড়লাম মাটিতে। ঠিক তখনই ভোরের সূর্য কোমলভাবে তার মুখে আলো ফেলেছিল। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর হঠাৎই তাঁর চোখ খুলে গেল। চোখদুটি গভীর, শান্ত, কিন্তু মায়াবী। আমি কোনো প্রশ্ন করিনি, কিন্তু তিনিই বললেন: “শান্তির জন্য যে পথ খোঁজো, তা ভেতরেই লুকানো থাকে। বাইরের স্থান কেবল আয়না।” আমি ধীরে মাথা নাড়লাম, এবং হঠাৎ বুঝলাম এই কথাগুলোই ছিল আমার উত্তর, যদিও আমি জানতাম না আমি কী প্রশ্ন করতে চেয়েছিলাম। তাঁর নাম ছিল তেনজিন, লাদাখ থেকে এসেছেন বছর দশেক আগে, সারনাথে আছেন তখন থেকেই। তিনি জানালেন, প্রত্যেক দিন সূর্যোদয়ের সময় ধ্যান করেন এই গাছতলার নিচে। আমি আরও কিছু বলার আগেই তিনি আবার চোখ বন্ধ করে ফেললেন, যেন কথাগুলো ছিল শুধু বাতাসের মতো—বলতেই হয়, কিন্তু বেঁধে রাখার নয়।
প্রায় আধাঘণ্টা চুপচাপ বসে থাকার পর আমি উঠে দাঁড়ালাম, একটু হাঁটতে শুরু করলাম ধামের চত্বর ঘিরে। ধামেখ স্তূপ, অশোক স্তম্ভের খুঁটি, আশেপাশের ধ্বংসাবশেষ—সবকিছু যেন জীবন্ত ইতিহাসের মতো আমার সামনে দাঁড়িয়ে। তখনই দেখা হল মীরার সঙ্গে—এক তরুণী, কাঁধে ব্যাগ, হাতে ক্যামেরা, কানে ছোট হেডফোন। সে ক্যামেরা দিয়ে স্তূপের ছবি তুলছিল আর মাঝে মাঝে কিছু নোট নিচ্ছিল। আমি তাকে লক্ষ করছিলাম কিছুক্ষন, তারপর সে নিজেই এসে কথা বলল, “আপনি কি পর্যটক, নাকি পথিক?” প্রশ্নটা শুনে একটু হেসে ফেললাম, উত্তর দিতে গিয়ে থমকে গেলাম। মীরা বলল, “আমি ব্লগ লিখি। লোকজনের মধ্যে ‘শান্তি’ শব্দটা খুঁজে পাই না, তাই স্থানগুলোর মধ্যে খুঁজি।” আমরা দুজন কিছুটা হেঁটে গেলাম সিংহ-স্তম্ভের দিকটায়। সে বলল, “এই জায়গাটা যেন শব্দ ছাড়া কথা বলে, না?” আমি কিছু বলিনি, কেবল তাকিয়ে রইলাম স্তব্ধ স্তম্ভটার দিকে—যা হাজার বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে, অগণন চোখ আর প্রশ্নের সামনে। কিছুক্ষণ পরে, বিদায় নেওয়ার আগে মীরা বলল, “নিজেকে চেনা কি সত্যিই সম্ভব?” আমি তখন শুধু বলেছিলাম, “হয়তো সারনাথ জানে এর উত্তর।” সেই সকালে, সেই স্তব্ধতায়, সেই ধ্যানরত মুখগুলোর মধ্যে দিয়ে আমি যেন একটু একটু করে নিজের ভেতর ডুব দিচ্ছিলাম। কলকাতার ব্যস্ততা, পেরিয়ে আসা জীবন আর অস্থিরতা যেন দূরের কোনো স্বপ্ন হয়ে গিয়েছিল। পদ্মফুলটা তখনও ছিল আমার হাতেই—তাজা, সাদা, আর নিঃশব্দ।
অধ্যায় ২: স্তব্ধতার ভাষা
সারনাথের সেই সকালে তেনজিনের কথাগুলো মাথায় গেঁথে গিয়েছিল। “শান্তির পথ বাইরের নয়, ভেতরের”—এই কথাটা যেন দিগন্তে লুকিয়ে থাকা এক মন্দিরের পথনির্দেশ। আমি সারনাথের ধাম চত্বর থেকে বেরিয়ে এলাম ধীরে, পায়ে পায়ে হাঁটতে লাগলাম পুরনো ইট বিছানো পথ ধরে। রাস্তার পাশে দুটো বাচ্চা পিপঁড়ে ফোলা রুটির টুকরো কুড়িয়ে খেলছিল। তাদের মুখে কোনো চাহিদা ছিল না, শুধু প্রয়োজনের ভাষা। এ শহরে শব্দগুলোই যেন অদৃশ্য হয়ে যায়, রয়ে যায় শুধু চোখ, অঙ্গভঙ্গি, আর নিঃশব্দ অনুভব। আমি কিছুটা হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছলাম মূল মন্দির সংলগ্ন ‘বুদ্ধ পার্কে’। এখানে আসা বেশিরভাগ মানুষ ছবি তোলে, কেউ কেউ ধ্যান করে, কিছু পর্যটক জুতো খুলে কাঁচা ঘাসে বসে থাকে সূর্যের দিকে মুখ করে। আমি একটু দূরে গিয়ে বসে পড়লাম এক বটগাছের ছায়ায়। ঠিক আমার সামনে ছিল এক বিদেশি দম্পতি—তাদের মধ্যে কেউ কিছু বলছিল না, দুজনেই ধ্যানমগ্নভাবে বসে ছিল হাত ধরে। হঠাৎ করেই মনে হল—ভাষা যদি না থাকত, আমরা কি বুঝতে পারতাম ভালোবাসা, ব্যথা, শান্তি? আমি চোখ বন্ধ করলাম। বাতাসে ভেসে এল শালপাতার মৃদু শব্দ, দূরে কোনো মন্দিরঘণ্টার টুংটাং ধ্বনি। সেই মুহূর্তে যেন সময় থেমে গিয়েছিল। মাথার ভিতর ধীরে ধীরে সব চিন্তার শব্দ ফিকে হতে শুরু করল। নিজেকে খুব ছোট মনে হল, আবার একই সঙ্গে খুব বড়—জানিনা কেন, হয়তো এই নির্জনতায় নিজেকে স্পষ্ট করে অনুভব করা যায়।
আমার পাশে এসে বসেছিল মীরা, হঠাৎ করেই। সে কিছু বলল না, শুধু একটা ছবি দেখাল ফোনে—যেখানে ধামের সামনে বসে আছি আমি, চোখ বন্ধ, বাচ্চা ভিক্ষুর দেওয়া পদ্মফুল হাতে। সে বলল, “তুমি জানো, এই মুহূর্তটাই সবচেয়ে আসল। মুখে কিছু না বলে যে সময়টা কেটে যায়, সেটাই সবচেয়ে বেশি কথা বলে।” আমি তার কথার মধ্যে এক অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস খুঁজে পেলাম। সে জানালো, সে অনেক বছর আগে নেপালে গিয়েছিল একটি প্রজেক্টে, সেখানেই প্রথম ধ্যানের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। তারপর থেকেই সে খুঁজে চলেছে এমন জায়গা, যেখানে শব্দ নেই, কিন্তু হৃদয়ের শব্দ স্পষ্ট হয়। আমরা দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকি। হঠাৎ সে বলল, “জানো, বুদ্ধ কোথায় বাস করেন?” আমি উত্তর খুঁজে পাই না। সে বলল, “যেখানে সব প্রশ্ন থেমে যায়।” তারপর এক গাঢ় হাসি দিয়ে ক্যামেরাটা গলায় ঝুলিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। আমি তখনও বসে ছিলাম ঘাসে, মনে হচ্ছিল যেন এক তলানো জলজগতে ভেসে আছি—যেখানে শব্দ নেই, কেবল নীরব ঢেউ। মীরা চলে যাওয়ার আগে একটা ছোট্ট প্রশ্ন করে, “তুমি কি জীবনের ব্যস্ততা থেকে পালাতে এসেছো?” আমি তার দিকে তাকিয়ে বলি, “হয়তো পালাতে নয়, বরং ফিরে যেতে এসেছি—যেখানে সবকিছু একসময় শুরু হয়েছিল।” তার চোখে এক মুহূর্তের প্রশংসা ভেসে ওঠে, যেন আমিও সেই পথের যাত্রী, যেটা সে অনেক আগেই পেরিয়েছে।
দিন যত গড়াতে থাকে, ততই আমি অনুভব করি—এই স্থানটা শুধু ইতিহাস নয়, আত্মার প্রতিধ্বনি। সিংহ-স্তম্ভের ছায়ায় বসে থাকা এক বৃদ্ধ জাপানি ভিক্ষুর দিকে চোখ যায় হঠাৎ। তাঁর পাশেই রাখা ছিল একটি কাঠের থালা, তাতে কয়েকটি বালুর দানা আর কিছু পাথর। তিনি পাথরগুলো সাজাচ্ছিলেন একটি নিখুঁত বৃত্তে, তারপর আবার অঙ্গুলির আঘাতে তা ভেঙে দিচ্ছিলেন। আমি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি এটা বারবার করছেন কেন?” তিনি এক ঝলক হাসলেন, বললেন, “কারণ সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী। সুন্দরতাও। ধ্বংসও।” আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। একপাশে বসা পেমা নামের শিশুটি তখন আমার দিকে তাকিয়ে একবার হেসে আবার নিজের খেলায় মগ্ন হয়ে যায়। আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম, দুপুর প্রায়। হোটেলে ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছিল। কিন্তু মন চাইছিল না এখান থেকে সরে যেতে। মনে হচ্ছিল, এতদিন যা খুঁজছিলাম, তার একটুখানি ছায়া পেয়েছি এই ভোরবেলার স্তব্ধতায়। তেনজিন, পেমা, মীরা—তারা যেন কেউই এখানে কাকতালীয়ভাবে আসেনি। প্রত্যেকে যেন আমার গল্পে একটি দরজা খুলে দিয়েছে, একেকটি প্রশ্ন রেখে গেছে যার উত্তর হয়তো আমি নিজেই। হোটেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে পিছনে তাকালাম একবার। সারনাথ তখন সূর্যের নরম আলোয় আবৃত, ধামেখ স্তূপ যেন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থেকে বলছে—“ফিরে এসো। শুধু দেখবার জন্য নয়, বুঝবার জন্য।” আমি জানতাম, আজ সকালে আমি কিছু পেয়েছি, যা ভাষায় ধরা যায় না—কেবল অনুভবে রয়ে যায়।
অধ্যায় ৩: ধ্বনির বাইরে
হোটেলে ফিরে এলেও সারনাথের সেই নিঃশব্দ সকাল আমার শরীরের ভেতরে জেগে রইল, যেন আমি আসলে এখনও সেই স্তব্ধতার মধ্যে বসে আছি। চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ, বাইরের ব্যস্ততা, হর্ণ, মোটরসাইকেলের আওয়াজ আর পানের দোকানের কলহে সেই সকালে পাওয়া প্রশান্তি যেন আস্তে আস্তে মুছে ফেলতে চাইছিল। কিন্তু না, এবার আমি একটু বদলেছি—এই প্রথমবার মনে হল, শব্দ থেকে নিজেকে আলাদা করাও সম্ভব। চোখ বন্ধ করলেই মনে পড়ল সেই বালক ভিক্ষুর মুখ, সেই তেনজিনের শান্ত কণ্ঠ, সেই পাথরে গড়া স্তূপ, যেখান থেকে বুদ্ধের ধর্মচক্র ঘুরেছিল এই মানবসমাজে। আমি হঠাৎ করেই অনুভব করলাম—আমি এই শহরে কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে আসিনি, না কোনো চিহ্ন রেখে যাওয়ার জন্য, না কিছু পেতে। আমি শুধু চেয়েছিলাম একদিনের জন্য শব্দহীনতা, আর এখন মনে হচ্ছে, সে নিঃশব্দতা আমাকেই ছুঁয়ে গেছে। দুপুরবেলা ভাবলাম আবার বেরোই, এবার গন্তব্য ‘মুলগন্ধ কুটিভিহার’। হোটেল থেকে একটু হাঁটলেই পৌঁছানো যায়—এক আধুনিক বৌদ্ধ মন্দির, যেখানে চমৎকার প্রাচীন জাপানি প্রভাবে আঁকা চিত্রকলা আছে বুদ্ধদেবের জীবনের ওপর। মন্দিরে ঢুকতেই ধূপের গন্ধ, নরম আলো আর প্রতিটি দেয়ালে আঁকা নীরব চিত্রগাথা যেন মনটাকে স্নিগ্ধ করে দিল।
মন্দিরের ভেতরে বুদ্ধের এক সুবিশাল ব্রোঞ্জ মূর্তি—ধ্যানরত অবস্থায় বসে, চোখ বন্ধ, দুহাত পদ্মমুদ্রায়। আমি বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম ঠিক মূর্তির সামনের পাথরে পাতা মেঝেতে। আশেপাশে কেউ ছিল না, একরকম একাকীত্বে ঘেরা সেই মুহূর্তে হঠাৎ যেন আমি নিজের হৃদস্পন্দনও শুনতে পাচ্ছিলাম। মন্দিরের ছাদ থেকে ধীরে ধীরে নেমে আসা আলো ঠিক আমার সামনে পড়ছিল, আর মনে হচ্ছিল যেন এই আলো একেকটা চিন্তার ছায়াকে ধুয়ে দিচ্ছে। এক সময়ে পেছন থেকে এক পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম—মীরা। সে বলল, “তুমি কি জানো, এই মন্দিরটা তৈরি হয়েছিল যুদ্ধের সময় শান্তির প্রতীক হিসেবে?” আমি অবাক হয়ে তাকালাম। মীরা জানাল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরপর জাপানের এক বৌদ্ধ ভিক্ষু এই মন্দির নির্মাণে উদ্যোগী হন, কারণ যুদ্ধের ধ্বংসের পরে মানুষ যেন আবার শিখতে পারে—নীরবতা, সহানুভূতি আর আত্মিক চেতনার মূল্য। আমি ধীরে বললাম, “আসলে, মানুষ শুধু তখনই শব্দ খোঁজে, যখন তার চারপাশে আর কিছু শোনা যায় না।” মীরা বলল, “আর মানুষ শুধু তখনই নিজেকে খোঁজে, যখন সে নিজের কথাই আর বিশ্বাস করতে পারে না।” আমরা দু’জনেই চুপ হয়ে গেলাম। মনে হচ্ছিল, এই মুহূর্তগুলো কোনো ক্যামেরায় ধরা পড়ে না—এগুলো কেবল হৃদয়ের এক গোপন কোণে জমা থাকে, জীবনের জরুরি মুহূর্তগুলোর মধ্যে।
আমরা দু’জনে হাঁটতে শুরু করলাম আবার। এবার গন্তব্য ছিল সেই স্থান যেখানে কথিত আছে, গৌতম বুদ্ধ তাঁর প্রথম পাঁচ শিষ্যকে ‘ধর্মচক্র প্রবর্তন’ বিষয়ে প্রথম ভাষণ দিয়েছিলেন। জায়গাটা খুব ছোট, কিন্তু ইতিহাসে ভরপুর—কিছু ভগ্ন ইট, একটি প্রাচীন বেদি, আর আশেপাশে গাছপালায় ঘেরা নিঃস্তব্ধতা। এখানে এসে আমি বুঝতে পারলাম—শক্তির কোনো চিহ্ন নেই এখানে, নেই কোনো আধিপত্য, কিন্তু এত ইতিহাস, এত প্রভাব, শুধুমাত্র এক শান্ত, চিন্তানুভব-ভরা মুহূর্ত থেকে জন্ম নিয়েছে। আমি একটা পুরনো ইটের পাশে বসে পড়লাম, মীরা অন্যদিকে ছবি তুলছিল। পাশেই কিছু বিদেশি ধ্যান করছিল গোল হয়ে বসে। একজন থাই মহিলা, বয়সে পঁচিশ হবে, ধ্যান শেষে আমার কাছে এসে এক গ্লাস জল দিল। আমি অবাক হয়ে বললাম, “আমাকে কেন?” সে ইংরেজিতে বলল, “You were quiet. That means you are listening.” আমি হেসে বললাম, “হয়তো তাই।” এই সারনাথে সবাই যেন কাউকে কিছু দিতে চায়—শব্দ নয়, কোনো বস্তু নয়, শুধু অনুভব, কিংবা এক অনুচ্চারিত শান্তি। বিকেলের আলো ঢলে পড়ছিল, আকাশে একধরনের কমলা ও ছাইরঙা মিশ্র আলো। আমি আর মীরা ফিরে যাচ্ছিলাম ধামের দিকে, তখন সে হঠাৎ বলে, “তুমি ফিরে গেলে কি এই নিঃশব্দকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে?” আমি কিছুক্ষণের চুপির পর বলি, “হয়তো না পারলে আবার আসব। কারণ একবার শুনে ফেললে, এই স্তব্ধতার ডাক আর অগ্রাহ্য করা যায় না।” সে মাথা নেড়ে বলল, “ভালো কথা।” তারপর দুজনে আবার নিরবে হাঁটতে থাকি সেই পুরনো ইটবাঁধানো পথে—যেখানে প্রতিটি পা ফেলার শব্দও যেন ধ্বনি হয়ে মিশে যায় আকাশে।
অধ্যায় ৪: পদ্ম ও প্রতিফলন
পরদিন ভোরে যখন ঘুম ভাঙল, তখন ঘড়ির কাঁটা মাত্র পাঁচটা ছুঁয়েছে। বাইরে এখনও কুয়াশা ঝুলে আছে বারাণসীর আকাশে, আর দূর থেকে গঙ্গার ঘাটের ঘণ্টাধ্বনি ভেসে আসছে। সারনাথের সেই আগের দিনের অভিজ্ঞতা আমার ভেতরে এমনভাবে গেঁথে গিয়েছে, যেন আমি আর সেই পুরনো আমি নেই—যে বারাণসী এসেছিল কেবলই বিশ্রামের জন্য, বা জীবনের ক্লান্তি থেকে একটু সরে থাকার জন্য। আমি এখন নতুন এক গভীর জার্নির মধ্যে ঢুকে পড়েছি, যার গন্তব্য হয়তো আমার নিজের ভিতরেই। আজ আর কোনো পরিকল্পনা নেই, কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই। শুধু একটা তাগিদ অনুভব করছি—আবার ফিরে যেতে, সেই স্তব্ধ স্তূপের পাশে, যেখানে পেমা বসেছিল ফুল সাজিয়ে, আর তেনজিন বসেছিলেন ধ্যানমগ্ন হয়ে। আমি তাড়াহুড়ো না করেই তৈরি হলাম, পথে হাঁটতে হাঁটতে অটো না নিয়ে ধীরে ধীরে চলতে লাগলাম—সারনাথের দিকে। পথের দুই ধারে শুয়ে পড়া গাছ, নরম আলো, আর মাঝে মাঝে চোখে পড়ে গরু ঘেরা গাঁয়ের আঙিনা। মনে হচ্ছিল, এই সকালে শব্দের কোনো দরকার নেই, আমি যেন নিজেই একটি ধ্যানের মধ্যে হাঁটছি, প্রতিটি পা ফেলাই যেন একেকটি মন্ত্র। হঠাৎ করে মনে পড়ল—তিন দিন আগেও আমি ক্লান্ত ছিলাম, কিছুটা হতাশ, আর এখন? এখন আমি খালি, অথচ পরিপূর্ণ।
সারনাথের ধামে পৌঁছেই দেখি আজ অনেক বেশি মানুষ এসেছে, হয়তো ছুটির দিন বলে। বিদেশি ভ্রমণকারী, স্থানীয় পর্যটক, কিছু বয়স্ক মানুষ, আর কয়েকজন ভিক্ষু—সবার মধ্যেই যেন কোলাহলের নীরব ভারসাম্য। আমি ধামের উত্তর পাশে গিয়ে সেই পুরনো বটগাছটার নিচে বসলাম, যেখানে আগের দিন তেনজিন বসেছিলেন। তিনি আজও আছেন, চোখ বন্ধ, মুখে এক শান্ত অভিব্যক্তি। আমি একটু দূরে বসে চোখ বন্ধ করতেই যেন এক অদ্ভুত প্রশান্তি বুকের ভেতর ছড়িয়ে পড়ল। আশেপাশে অনেক শব্দ, কিন্তু আমার ভেতর ছিল নিঃশব্দ। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলতেই দেখি, পেমা এসে দাঁড়িয়ে আছে সামনে, হাতে একটি পদ্মফুল। এবারও সে কিছু বলল না, শুধু ফুলটা এগিয়ে দিল। আমি হাত বাড়িয়ে নিতেই সে মৃদু হাসল—সেই শিশুসুলভ সরলতা যার মধ্যে লুকিয়ে আছে শত শত বছরের শান্তি। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কই থাকো?” সে হাত তুলে দেখাল ধামের পেছনের একটি দিকের ছোট্ট ঘর। আমি বললাম, “তুমি এখানে ধ্যান করো?” সে মাথা নাড়ল। তারপর মাটিতে আঙুল দিয়ে বৃত্ত আঁকতে লাগল, বলল, “ধ্যান মানে শুধু চোখ বন্ধ নয়, মন খুলে রাখা।” আমি চমকে উঠলাম—এই কথাটি এত ছোট্ট একজনের মুখে এলো কীভাবে? হয়তো এই পরিবেশেই সে বড় হয়েছে, যেখানে বুদ্ধের ভাষা বইয়ে নয়, বাতাসে মিশে থাকে। সেই মুহূর্তে আমার মনে হল, এই শিশুটিই আসলে সারনাথের প্রতিচ্ছবি—স্নিগ্ধ, স্তব্ধ, অথচ জ্ঞানভারে পরিপূর্ণ।
পরে যখন আমি ধাম থেকে বেরিয়ে সামনের চা-দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম, হঠাৎ দেখি মীরা এগিয়ে আসছে। তার চোখে আজ অন্যরকম দীপ্তি, বলল, “আজ আমি রওনা দেব। অন্য এক প্রজেক্ট আছে আমার দিল্লিতে।” আমি একটু চুপ করে থাকলাম, তারপর বললাম, “তুমি যেখানেই যাও, এই জায়গাটা তোমার সঙ্গে থাকবে।” সে মাথা নাড়ল, তারপর ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট খাতা বার করল। “তোমার জন্য,” বলল সে। খাতার প্রথম পাতায় লেখা ছিল—“Words cannot reach where silence begins.” আমি একটুও কথা বলিনি, শুধু একবার তার চোখে তাকিয়ে থাকলাম। সে বলল, “তোমার ভ্রমণ এখনও শেষ হয়নি। কিন্তু একটা কিছু শুরু হয়েছে, আমি দেখেছি।” তারপর সে অটোয় উঠে পড়ল, হঠাৎ করেই যেন মিশে গেল শহরের ব্যস্ত চেহারায়। আমি খাতাটা হাতে নিয়ে ধামের দিকে একবার ফিরে তাকালাম—সেই স্তব্ধ স্তূপ, সেই গাছতলা, সেই কুয়াশার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা বুদ্ধের অবয়ব যেন চোখে ভাসছে। জীবনে কত কিছুই তো থাকে—কথা, শব্দ, অর্জন, ছুটে চলা—কিন্তু তার বাইরে এক জগৎ আছে, যেখানে পদ্মফুল নিজে থেকে ফোটে, নীরবতা নিজেই কথা বলে। সেই জগতের সন্ধানেই আমি এসেছিলাম, এবং এখন বুঝতে পারছি—প্রত্যেক মানুষের একবার অন্তত এমন এক সকালের মুখোমুখি হওয়া উচিত—যেখানে সে নিজেকেই নতুন করে দেখে, নিঃশব্দে।
অধ্যায় ৫: অন্তর্জগতের দরজা
হোটেলে ফিরে এসে প্রথম যেটা করলাম, সেটা একা বসে থাকা। জানলার পাশে রাখা ছোট্ট চেয়ারে বসে সেই খাতাটা খুলে পড়তে শুরু করলাম, যেটা মীরা দিয়ে গিয়েছিল। প্রতিটি পাতায় ছোট ছোট লাইন লেখা—কখনও পেন্সিলে, কখনও কালিতে, যেন প্রতিটি কথা নিজে থেকেই জন্ম নিয়েছে নির্জনতাকে স্পর্শ করে। “প্রতিটি নীরবতা একেকটা প্রশ্ন”, “পদ্ম কখনও শব্দ করে না, কিন্তু তার ঘ্রাণ বদলে দেয় আকাশ”—এইরকম লাইনগুলো পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল যেন আমার মনের কথাগুলো আগে থেকেই কেউ জেনে গিয়েছে। বইয়ের এক পাতায় একটা ছোট্ট পদ্ম আঁকা ছিল, নিচে লেখা—“তুমি হয়তো জানো না, কিন্তু তোমার মনও একদিন ফুটবে। সময়ের অপেক্ষায়।” হঠাৎ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস আমার ফুসফুস থেকে বেরিয়ে এল—এতদিন ধরে যে ভেতরের যন্ত্রণা, তীব্র ব্যর্থতা, শূন্যতা—সেগুলো এতটা সহজভাবে কে বোঝে? সেই প্রশ্নের উত্তর নিজেকেই দিতে হল—কেউ বোঝে না, কিন্তু কিছু স্থান বোঝে। সারনাথ যেন কোনো স্থাপত্য নয়, এটা একটা অনুভবের পরিধি, যেখানে কেউ শব্দে নয়, অনুভবে কথা বলে। আমি হঠাৎ করে অনুভব করলাম, আমার মধ্যেও একটা আলোর রেখা জন্ম নিচ্ছে—খুব সূক্ষ্ম, কিন্তু স্থায়ী।
পরদিন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম—শেষবারের মতো ধামের সেই নির্দিষ্ট স্থানে যাব, তেনজিন যেখানে বসতেন। আমার মনে হচ্ছিল, আজকের দিনটা হবে ‘বিদায়’ নয়, বরং এক নতুন সূচনার দিন। সকাল সকাল পৌঁছে দেখি আজ সেখানে কেউ নেই। কুয়াশা একটু পাতলা, সূর্যরশ্মি ধামেখ স্তূপের মাথায় ছুঁয়ে যাচ্ছে। আমি তেনজিনের জায়গায় বসে পড়লাম। চোখ বন্ধ করতেই একরকম হালকা মাথা ঘোরা অনুভব হল, যেন আমি ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছি এক আলো-আবৃত জগতে। হঠাৎ মনে হল, পাশেই কেউ বসেছে। চোখ খুলে দেখি তেনজিন বসে আছেন আমার পাশে, মুখে নরম হাসি। তিনি কিছু বলেননি, আমি নিজেও না। কিছুক্ষণ পরে তিনি বললেন, “তুমি খুঁজছিলে নিজের ছায়াকে। কিন্তু ছায়া শুধু আলোতেই দেখা যায়, অন্ধকারে নয়।” আমি বুঝতে পারলাম, তিনি বলতে চাইছেন—আত্ম-অনুসন্ধান শুধু দুঃখ থেকে নয়, আলো থেকেও জন্ম নেয়। আমি মাথা নিচু করে বললাম, “আমার ভয় হয়—এই প্রশান্তি হয়তো আমি হারিয়ে ফেলব ফিরে গিয়ে।” তিনি মৃদু হেসে বললেন, “যা সত্য, তা হারায় না। কেবল ঢেকে যায় অস্থিরতায়। ধুলো জমলে আয়না কি ভেঙে যায়?” আমি চুপ করে থাকলাম। সত্যিই তো, আমি যা খুঁজেছি, তা নিজেই তো বহন করছি এতদিন ধরে। কিন্তু তা স্পষ্ট হতে সময় লাগে—স্তব্ধতার সময়।
আমার পাশের ঘাসে তখন পেমা বসে, পাথরের টুকরো দিয়ে বৃত্ত আঁকছে। আমাকে দেখে সে বলল, “আজ তুমি আলো হয়ে এসেছো, কাল ছিলে ছায়া।” আমি একটু হেসে বললাম, “কে তোমাকে শেখায় এসব কথা?” সে মাথা নেড়ে বলল, “কেউ না, বাতাস।” আমি তার পাশে গিয়ে বসে থাকলাম, সময় যেন থেমে গেল। ঘড়ি দেখলাম না, মোবাইল তুললাম না, শুধু থাকলাম। এরপর পেমা হঠাৎ বলল, “তুমি এখন যেতে পারো। কারণ তুমি বুঝেছো।” আমার চোখে জল এসেছিল—কারণ বুঝতে পারছিলাম, এবার আমার বিদায় আসলেই সম্পূর্ণ। পেমা তার হাতটা বাড়িয়ে দিল, আমি হাত ধরলাম। সে বলল, “ফিরে এসো, যদি শব্দে ডুবে যাও।” আমি মাথা নেড়ে উঠলাম। ধামের বাইরে এসে শেষবারের মতো পেছনে তাকালাম—স্তূপ, বৃক্ষ, তেনজিন, পেমা—সবকিছু যেন এক শিল্পে পরিণত হয়েছে আমার মনে। তারা কেবল চরিত্র নয়, তারা প্রতিফলন—আমার নিজের ভেতরের। সারনাথের সকাল আর নেই—কিন্তু তার স্তব্ধতা এখন আমার সঙ্গে, এক চিরস্থায়ী আলো হয়ে।
অধ্যায় ৬: ফিরে দেখা আলো
ট্রেনে বসে যখন বারাণসী থেকে ফেরার পথ ধরলাম, তখন জানলার পাশে বসে থাকা আমি যেন আগের সেই মানুষটা ছিলাম না—যে এই শহরে এসেছিল কিছুদিন একা থাকতে, ক্লান্তি থেকে পালাতে। আমার ভেতরে যেন কিছু বদলে গিয়েছে, চোখে একটা নরম আলো, মনে একটা গভীর স্তব্ধতা। ট্রেনের জানালায় পিছিয়ে যাচ্ছে পাথরের ঘর, মাঠ, কুয়াশায় ঘেরা রেলস্টেশনগুলো—সবকিছু খুব চেনা অথচ নতুন লাগছিল। খাতাটা খুলে আবার মীরার লেখা পড়ছিলাম। “তুমি যা খোঁজো, সেটা অনেক সময় কোনো মানুষের মধ্যে নয়, বরং নির্জনতায় লুকানো থাকে”—এই লাইনটা পড়ে মনে হল, মীরা যেন আগেই জানত আমি কী খুঁজতে এসেছি। বুকপকেটে রাখা পদ্মফুলটা এখনও শুকিয়ে যায়নি পুরোপুরি, যেন তার ঘ্রাণের মধ্যেই জমে আছে সেই সকালে পাওয়া অদ্ভুত শান্তি। আমি জানালার দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবছিলাম—এই অনুভব কি সত্যিই বাস্তব? নাকি কেবল একটি প্রার্থিত ধ্যান, যা সময়ের মধ্যে ধরা পড়ে না? এই যে পেমার চোখ, তেনজিনের বাক্য, স্তূপের নীরবতা—এগুলো কি স্থায়ী থাকবে আমার স্মৃতিতে? নাকি ফিরে গিয়ে আবার অস্থির জীবনে ঢুকে যাব?
কলকাতার চেনা ভিড়ে ফিরে আসা যেন ছিল এক ধাক্কা। হাওড়ার স্টেশনের কোলাহল, রিকশার চিৎকার, গাড়ির হর্ণ—সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, সারনাথ এক অলীক স্বপ্নের মতো, যেটা বাস্তবে নয়, বরং হৃদয়ের ভিতরের এক স্তব্ধ কল্পলোক। কিন্তু তারপর মনে পড়ল তেনজিনের সেই কথাটা—“যা সত্য, তা হারায় না।” আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, প্রথম দিন অফিস না গিয়ে একটু নিজের সঙ্গে সময় কাটাব। বাড়িতে ফিরে দরজা বন্ধ করে খাতাটা সামনে রেখে বসে পড়লাম। একেকটা লাইন পড়ে মনে হচ্ছিল আমি আবার ফিরে যাচ্ছি সেই সকালে, সেই গাছের নিচে, পেমার পাথর-বৃত্ত আঁকার খেলায়। ঘরের জানালায় তখন রোদের ছায়া, আমি জানতাম—এখন থেকে আমার বেঁচে থাকাও বদলে যাবে। হ্যাঁ, আমি অফিস যাব, ক্লাস নেব, বাস ধরব, মানুষদের মুখে হাসি দেখব কিংবা ক্লান্ত চোখ দেখব, কিন্তু তার মাঝেও আমি মাঝে মাঝে থেমে যাব। চোখ বন্ধ করব, আর ফিরে যাব সেই স্তূপের ছায়ায়। নীরবতার মধ্যে শুনব নিজের মন।
এরপর থেকে আমার প্রতিদিনের জীবনে ঢুকে পড়ল সেই শিখন। ভিড় ট্রেনে বসেও আমি খাতার পাতা উল্টাতাম, চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে শুনতাম পাশের গাছের পাতার নড়াচড়া। বন্ধুরা অবাক হত—“তুই কেমন যেন হয়ে গেছিস”, কেউ কেউ বলত “ধ্যানী হয়ে গেছিস বুঝি?” আমি হেসে বলতাম, “হয়তো… বা হয়তো শুধু শুনতে শিখেছি।” একদিন স্কুলে ক্লাস নেওয়ার সময় আমি ছাত্রদের জিজ্ঞেস করলাম, “তোমরা কখনো নিজের নিঃশ্বাস শুনেছ?” তারা সবাই চুপ করে তাকিয়ে রইল, কিছু বুঝতে না পেরে। আমি বললাম, “যখন সব বন্ধ হয়ে যায়—মোবাইল, কথা, গান—তখনও একটা শব্দ থেকে যায়। সেটা তোমার জীবনের স্পন্দন।” ছাত্ররা চমকে গেল, তারপর এক ছাত্রী ধীরে বলল, “স্যার, তাহলে নিজের সঙ্গে কথা বলা মানে সেই নিঃশ্বাস শুনে ফেলা?” আমি শুধু বলেছিলাম, “তাই।” সেই দিন বুঝলাম—সারনাথ আমার মধ্যে বেঁচে আছে। শুধু আমার নয়, যারা একবার তাকে ছুঁয়ে গেছে, তাদের মধ্যেই সে গেঁথে থাকে। সময়ের আগে জন্ম নেওয়া এক আলো, যা শুধু প্রার্থনায় নয়, প্রতিদিনের জীবনেই জ্বলে। আর সেই আলোই আসলে আমার ভেতরের পথচলা।
অধ্যায় ৭: নীরবতার ডাকে ফেরার দিন
শহরের চেনা ব্যস্ততায় যখন ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছিলাম, তখনও প্রতিদিন সূর্য ওঠার সময় এক মুহূর্তের জন্য আমি মনে মনে ফিরে যেতাম সেই কুয়াশা-ঢাকা সারনাথের সকালে। ক্লাসে বোর্ডে লেখা শুরু করার আগেও আমি দাঁড়িয়ে থাকতাম এক মিনিট, চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নিতাম—সেই স্তব্ধতার খোঁজে, যেটা তেনজিনের ধ্যানস্থ চোখে দেখেছিলাম। সময় পেরিয়ে যাচ্ছিল, জীবন আবার চক্রের মতো ঘুরে আসছিল—ট্রেন, স্কুল, বাজার, ফোনকল, কাজের তালিকা। কিন্তু এর মধ্যেও আমি বুঝতে শিখেছি—চুপ থাকা মানে পলায়ন নয়, বরং গভীর উপলব্ধির অভ্যাস। সেই উপলব্ধিই আমাকে ফের একদিন টেনে নিল। এটা কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না—বরং এক স্বতঃস্ফূর্ত প্রত্যাবর্তন। একদিন সকালের দিকে স্কুল ছুটি ছিল, বাড়ির ছাদে বসে আকাশ দেখছিলাম, হঠাৎ মনে হল—আমি যদি আবার যাই? ঠিক করলাম, কিছু বলব না কাউকে, শুধু একটা ছোট ব্যাগ নেব আর রওনা দেব। ট্রেনের টিকিট কাটলাম চুপিসারে, একরাতের যাত্রা। যেন সেই আলোর দরজা আবার খুলবে, সেই স্তব্ধতা আবার একবার আমায় ডেকে নেবে। তখন ফেব্রুয়ারির শুরু, ঠান্ডা কিছুটা কমে এসেছে, কিন্তু সারনাথের সকালের কুয়াশা এখনও মুছে যায়নি।
পরদিন ভোরবেলায় যখন সারনাথের ধামে পৌঁছালাম, তখন চারদিক ঠিক আগের মতোই ছিল—নীরব, ধ্যানমগ্ন, অথচ জেগে থাকা। সেই পুরনো রাস্তা, সেই ইটের পথ, সেই গাছগুলো—সবকিছু যেন আমায় চিনে ফেলেছে, যেন আমি কোনো দূরবর্তী যাত্রী নই, বরং ফিরে আসা ঘরের মানুষ। আমি পা টিপে টিপে গিয়ে সেই বটগাছটার নিচে বসলাম। পেমা ছিল না, তেনজিনও ছিল না। মনে হল, আজ তাদের দরকার নেই—তারা তো আমার ভিতরে এখন। আমি চোখ বন্ধ করলাম, দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলাম। বাতাসের মধ্যে সেই চেনা ঘ্রাণ, সেই পাখির ডাকে মিশে থাকা নীরবতা, আর কোথাও থেকে যেন শোনা যাচ্ছে—”নিজেকেই চিনে নাও আবার, এবার আরও গভীরভাবে।” মনে পড়ে গেল সেই প্রথমদিন, যখন পদ্মফুলটা হাতে পেয়েছিলাম পেমার কাছ থেকে। এবার আর কেউ কিছু দেয়নি, কিন্তু নিজেই বুঝে গেছি—ভেতরে কী আছে। কিছুক্ষণ পর পাশের ঘাসে একজন অচেনা বৃদ্ধ এসে বসলেন, মুখে অল্প দাড়ি, চোখে গাঢ় শান্তি। তিনি কিছু না বলেই আমার পাশে বসে ধ্যান করলেন। তখনই আমি বুঝতে পারলাম—এই জায়গার আসল শিক্ষা এটুকুই: নীরবতার কোনো ভাষা নেই, কোনো নিয়ম নেই, শুধু একজন আরেকজনের পাশে বসে থাকা, আলো ভাগ করে নেওয়া।
আমি সেই সকালে ধামের চারপাশটা ধীরে ধীরে হাঁটলাম। কেউ ছবি তুলছিল, কেউ বসে ছিল, কেউ কেউ চোখ বন্ধ করে বসেছিল বেদির পাশে। আমি কারও সঙ্গে কথা বললাম না, কেউ আমাকে কিছু জিজ্ঞেসও করল না। এত ভিড়ের মধ্যেও আমি যেন একান্তে ছিলাম। শেষে আমি ধাম থেকে বেরিয়ে সেই চা-ওয়ালার দোকানে গেলাম, যেখান থেকে আগেরবার মীরা চলে যাওয়ার সময় শেষবার দেখা হয়েছিল। দোকানের মালিক আমাকে চিনতে পারল না, কিন্তু আমি চিনলাম তাকে। হাতে এক কাপ কড়া চা নিয়ে আমি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম—এই ফিরে আসাটাও একটা ধ্যান, একটা পুনর্জন্ম। ফোন খুলে দেখি মীরার একটা মেসেজ আছে—“তুমি কখনও যদি ফিরে যাও, আমার হয়ে তাকিও স্তব্ধ স্তূপটার দিকে।” আমি তাকালাম, স্তূপ তখনও সেই নীরবতার মতো দাঁড়িয়ে, নিজের মতো, কারও অনুমতির অপেক্ষা না করে। আমি মেসেজের রিপ্লাই দিলাম না—কারণ মনে হল, কিছু কিছু সংযোগ শুধু নিরবতায় রাখলেই সবচেয়ে গভীর হয়। তখন সূর্য একটু উপরে উঠেছে, আলো গাছের পাতায় নেমে এসেছে, আর আমি হাঁটছি সেই স্তব্ধ পাথরের পাশে—যেখানে একসময় গৌতম বুদ্ধ বলেছিলেন, “আত্মা নিজেই আত্মার আশ্রয়।” আজ বুঝতে পারছি, সেই আশ্রয় আমি নিজেই হয়েছি।
অধ্যায় ৮: স্তব্ধতার অতল থেকে
ট্রেন আবার ছুটছে শহরের দিকে। কিন্তু এই যাত্রা আলাদা। আগের যাত্রার মতো নয়, যেখানে আমি পালাতে চেয়েছিলাম। এবার যেন ফিরে যাচ্ছি কিছু নিয়ে—একটা দীপ্তি, একটা স্তব্ধ প্রতিফলন, একটা পদ্মের ঘ্রাণ আমার বুকপকেটে। জানালার পাশে বসে আছি, বাইরে হু হু করে ছুটে যাচ্ছে মাঠ, গাছ, গাঁওয়ের রাস্তা। কিন্তু আমার মন কোথাও থেমে গেছে, কোথাও আটকে আছে—সারনাথের সেই স্তব্ধ সকালে। মনে পড়ছে পেমার কথা, তেনজিনের মুখ, মীরার চোখ, সেই ধামের ছায়া। প্রত্যেকেই যেন ছিল একটা ভাষাহীন শিক্ষক, যারা আমায় কোনো পাঠ শেখায়নি, বরং আমায় শেখার সুযোগ দিয়েছে। এখন যখন ছুটে চলা শহর আমার সামনে অপেক্ষা করছে, তখন মনে হচ্ছে—সেই নীরবতাও আমি নিজের সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি। আমি জানি, অফিসের টেবিলে আবার কাগজ জমবে, মিটিং-এর তালিকা আসবে, ফোন বাজবে। কিন্তু আমি ঠিক করে নিয়েছি—দিনে অন্তত দশ মিনিট আমি স্তব্ধ থাকব, চোখ বন্ধ করব, আর অনুভব করব সেই ধামের বাতাস। কারণ আমি বুঝে গেছি—ধ্যান কোনো ‘জায়গা’ নয়, এটা একটা অভ্যাস। আমি সারনাথকে আর স্থান হিসেবে দেখি না, বরং এক অন্তর্জগত হিসেবে অনুভব করি।
ফেরার পরের দিনগুলোতে জীবন আবার ছন্দে ফিরল, কিন্তু সেই ছন্দে এখন নতুন কিছু সুর ঢুকে গেছে—স্তব্ধতার সুর। আমি ক্লাসে ছাত্রদের বলি, “প্রশ্ন করো, উত্তর খুঁজে নাও, কিন্তু মাঝে মাঝে চুপ থেকেও শুনো।” তারা হয়তো প্রথমে বুঝতে পারে না, কিন্তু আস্তে আস্তে ওদের মধ্যেও আমি দেখেছি—নীরবতার কৌতূহল জেগে উঠছে। আমি নিজেও বাড়ির জানালায় বসে সন্ধ্যায় পাঁচটা থেকে পাঁচটা দশ পর্যন্ত কিছু না করি না—কেবল বসে থাকি, চোখ বন্ধ করে শুনি, মন ছুঁয়ে দেখি। মীরাকে মাঝে মাঝে চিঠি লিখি—মেইলে না, হাতে লেখা, ছবি আঁকা খাতায়। উত্তর আসে ধীরে, কখনো ধ্যানশালার ছবি, কখনো তেনজিনের নতুন উক্তি, আর কখনো শুধু একটা পদ্মফুল আঁকা। আমার ড্রয়ারে সেই ছবিগুলো জমে যাচ্ছে—তারা যেন আমার জীবনের প্রতিদিনের ধ্যান। পেমা কী করছে এখন, জানি না। সে হয়তো বড় হচ্ছে, হয়তো আরও শিশুদের মতো খেলছে, কিন্তু আমি জানি—যে আলো তার চোখে ছিল, সেটা কোনওদিন মুছে যাবে না। তেনজিন কি এখনও সেই গাছের নিচে বসে থাকেন? জানি না। কিন্তু আমার প্রতিটি স্তব্ধ মুহূর্তে তিনি পাশে থাকেন, নিঃশব্দে, হাসিমুখে।
আজ এতদিন পর যখন আমি এই যাত্রাটাকে লিখে শেষ করছি, তখন মনে হচ্ছে—”শেষ” বলে কিছু নেই। সারনাথ কোনো সমাপ্তি নয়, বরং এক সূচনার বীজ। এই বীজ আমি বয়ে নিয়ে ফিরেছি, সেটাই এখন রোজ একটু একটু করে অঙ্কুরিত হচ্ছে আমার জীবনের প্রতিটা বাঁকে। আমি জানি, সময়ের বয়ে চলা এই শহরে, এই জীবনযাত্রায়, আবার কখনো অস্থিরতা আসবে, ক্লান্তি ঘনাবে, মন হাঁপিয়ে উঠবে। কিন্তু তখন আমি আবার ফিরে যাব সেই স্তব্ধতার কাছে—not physically, but inwardly—নিজের ভেতরে, সেই জায়গায় যেখানে আমি একবার বসেছিলাম পদ্ম হাতে, যেখানে পেমা বলেছিল, “আজ তুমি আলো হয়েছো।” সেই আলো আমি আর হারাব না। কারণ একবার যার চোখে সত্যিকারের স্তব্ধতা ছুঁয়ে যায়, সে আর শব্দে আটকে থাকতে পারে না। সে হয়ে ওঠে এক চলমান ধ্যান, এক নীরব দীপ্তি। আর আমি এখন জানি—আমি সেই পথের যাত্রী, যার শুরু সারনাথের সকালে, কিন্তু যার গন্তব্য… নীরবতার অতল।

1000036554.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *