Bangla - অনুপ্রেরণামূলক গল্প - প্রেমের গল্প

সাতরঙা আকাশ

Spread the love

সঙ্গীতা দাস


মেঘলার শৈশব কেটেছে পশ্চিমবঙ্গের এক প্রত্যন্ত গ্রামে, যেখানে কাঁচা রাস্তা, বিস্তীর্ণ ধানের মাঠ আর দিগন্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা আকাশ তার শৈশবের নিত্যসঙ্গী। সকালবেলা কাকডাকা ভোরে মাটির ঘরের জানালা দিয়ে ঢুকে পড়া আলোয় সে ঘুম ভাঙত, আর সবচেয়ে প্রিয় সময় ছিল সন্ধ্যা। গ্রামের খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তার বাবার একটি পুরোনো রেডিও ছিল—যার শরীর ক্ষয়ে গেছে, অনেক সময় স্ট্যাটিক আওয়াজের ভেতরেই কণ্ঠ শোনা যেত। সেই রেডিওতে কখনো হঠাৎ বিমান চলাচলের খবর, কখনো বেতারে ভেসে আসা এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের ভাঙাচোরা সিগন্যাল শোনার সময় তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠত। সে জানত না কীভাবে বা কেন, কিন্তু সেই শব্দগুলো তার হৃদয়ে ডানা মেলাত। গ্রাম্য শিশুদের অনেকেই মাঠে দৌড়াদৌড়ি করত, ঘুড়ি ওড়াত, কিন্তু মেঘলা এক অদ্ভুত টান অনুভব করত আকাশের প্রতি। যখনই সে উড়োজাহাজের সাদা রেখা টেনে নিয়ে যাওয়া ট্রেইল আকাশে দেখতে পেত, তার মনে হতো—একদিন সে-ও সেই আকাশে ভেসে বেড়াবে, গ্রাম ছেড়ে উড়ে যাবে অজানা শহরে, অচেনা দেশে। তার স্বপ্নকে গ্রামের অন্য শিশুরা কখনো মজা করে উড়িয়ে দিত, বলত—“মেঘলা পাগল, আকাশে কি কারো ঘর বাঁধা যায়?” কিন্তু মেঘলার বিশ্বাস ভাঙত না। সে প্রতিদিনের জীবনের কষ্ট, নোংরা পুকুর, কাঁচা রাস্তার ধুলো সব ভুলে এক অদ্ভুত জেদ নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত। তার কাছে আকাশ মানে ছিল মুক্তি, সীমাহীন সম্ভাবনা, এমন এক মঞ্চ যেখানে গরিব-ধনী, গ্রাম-শহর, মেয়ে-ছেলের কোনো ভেদাভেদ নেই।

মেঘলার পরিবার আর্থিকভাবে খুব সচ্ছল ছিল না। তার বাবা গোপাল দত্ত একজন সৎ চাষি, যিনি দিনরাত মাঠে খেটে পরিবারের ভরণপোষণ করতেন। সারা বছর ফসল ভালো হোক বা না হোক, সেই আয়ে সংসার চালানোই ছিল একপ্রকার যুদ্ধ। মেঘলার মা মঞ্জরী সংসারের হাল ধরতেন, আর জীবনের বাস্তবতা নিয়ে ছিলেন অনেক বেশি চিন্তিত। মেয়ের স্বপ্ন শোনার পর তিনি প্রায়ই কপালে হাত দিয়ে বলতেন—“মেঘলা, মেয়েমানুষের জন্য কত কিছু সম্ভব হয় নাকি? তোমার কপালে স্কুল মাস্টারনি বা নার্স হওয়ার চাকরিই যদি জোটে, সেটাই অনেক। বিমানে চড়া তো দূরের কথা, উড়ান চালাবে?” কিন্তু গোপাল অন্যরকম ছিলেন। বাইরে থেকে তিনি কঠিন আর গম্ভীর হলেও মেয়ের চোখে যে আগুন, তা তিনি চিনতে পারতেন। প্রায়ই চুপিচুপি মেঘলাকে বলতেন—“তুই বড় স্বপ্ন দেখ, মা। স্বপ্ন দেখতেই যদি না শিখিস, জীবন কীভাবে পাল্টাবি?” বাবার কথাগুলোই তাকে সবচেয়ে বেশি শক্তি দিত। তবু গ্রামের মানুষ হাসাহাসি করত। পাড়ার আড্ডায় লোকজন টিপ্পনি কাটত—“দত্তের মেয়ের নাকি পাইলট হওয়ার স্বপ্ন! হেসে মরতে হয়। পড়াশোনা ঠিকঠাক শেষ হোক, সেটাই তো ভরসা।” কিন্তু এসব শুনে মেঘলার চোখে জল এলেও সে ভেতরে ভেতরে আরও শক্ত হয়ে উঠত। সে বুঝত—তার লড়াই শুধু নিজের জন্য নয়, বরং এমন সব মেয়েদের জন্য যারা গ্রামে জন্মে বড় স্বপ্ন দেখার সাহস করে। প্রতিদিন রাতে খাটের পাশে বসে, খোলা জানালা দিয়ে তারা গুনতে গুনতে সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করত—“একদিন আমি এই মাটির আকাশ ছেড়ে উড়ে যাব।”

তার পড়াশোনার প্রতি আগ্রহও ছিল প্রবল। স্কুলের বইয়ের বাইরেও বিজ্ঞান, বিশেষ করে পদার্থবিদ্যা নিয়ে তার কৌতূহল ছিল অসীম। কিভাবে আকাশে এত বড় লোহার খাঁচা উড়ে যায়, কেমন করে ডানার ভেতর লুকিয়ে থাকে উত্তোলনশক্তি, এসব নিয়ে সে প্রায়ই শিক্ষককে প্রশ্ন করত। অনেক সময় শিক্ষক বিরক্ত হতেন, আবার অনেক সময় হাসতেন—“তুই তো মেয়েদের মতো নোস, যেন পাগল বিজ্ঞানী।” কিন্তু মেঘলা নিরস্ত হত না। ক্লাস শেষে সে লাইব্রেরির ছোট্ট বুকশেলফে বসে পুরোনো বিজ্ঞান পত্রিকায় খুঁজে বেড়াত বিমান ওড়ার তত্ত্ব। পাইলটদের ছবি দেখে তার চোখ চকচক করত। তার ঘরে কোনো দামি খেলনা ছিল না, ছিল না ভালো জামাকাপড়ও, কিন্তু ছোট্ট খাতার ভেতর সে নিজের হাতে আঁকত বিমান, লিখত অদ্ভুত সব ককপিটের কল্পনা। গ্রামের উঠোনে দাঁড়িয়ে হাত দুটো ডানা মেলে সে দৌড়াত, যেন একদিন সত্যিই আকাশ তাকে নিজের করে নেবে। সেই দিনগুলোতে তার জেদ আরও শক্ত হয়ে উঠছিল। সে জানত—টাকা-পয়সার অভাব, মায়ের সন্দেহ, সমাজের বিদ্রূপ—এসবই পথের কাঁটা। কিন্তু বাবার বিশ্বাস, নিজের জেদ আর আকাশের প্রতি আকর্ষণ তাকে বারবার মনে করিয়ে দিত—“মেঘলা, তোর আকাশ তোকে ডাকছে।” আর সেদিনই সে সিদ্ধান্ত নেয়—যেভাবেই হোক, সে শহরে গিয়ে ফ্লাইট স্কুলে ভর্তি হবে। তার জীবন হবে আকাশের মতোই বিস্তৃত, রঙিন আর সীমাহীন।

ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্যপট যখন দ্রুত পাল্টে যাচ্ছিল, মেঘলার বুকের ভেতর তখন কেমন অদ্ভুত কাঁপুনি হচ্ছিল। গ্রামের কাঁচা রাস্তা, খোলা মাঠ, নদীর ধারে বকুল গাছ, বাবার স্নেহমাখা চোখ আর মায়ের স্নিগ্ধ স্পর্শ—সবকিছু ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়ছিল, আর সামনে আসছিল অচেনা এক বিশাল শহর। ট্রেন যখন স্টেশনে এসে থামল, হইচই, ভিড় আর অগণিত অচেনা মুখ দেখে মুহূর্তের জন্য সে একেবারে স্থবির হয়ে গেল। মনে হলো, সে কি ঠিক করল? এই শহরের ভিড়ের ভেতরে সে কোথায় মিশে যাবে? কিন্তু মনে পড়ল বাবার কথাগুলো—“স্বপ্নের জন্য যদি ভয় পাইস, তবে সেই স্বপ্ন তোর নয়।” বুক ভরে শ্বাস নিয়ে মেঘলা ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে এল। শহরের চেহারাটা ছিল তার কাছে যেন একেবারে অন্য গ্রহের মতো। এখানে আকাশের রঙ যেন অনেকটাই ভিন্ন, এত কোলাহলের মাঝেও আকাশ কোথায় যেন আড়াল হয়ে গেছে। গাড়ির হর্ন, ট্রাফিক সিগন্যালের আলো, উঁচু বিল্ডিং, ব্যস্ত মানুষ—সবকিছু তার গ্রামীণ সত্তার ভেতরে কেমন এক অস্বস্তি ঢুকিয়ে দিচ্ছিল। তবে বুকের ভেতর স্বপ্নটা তখনো তেজি আগুনের মতো জ্বলছিল, আর সেই আগুনই তাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল ফ্লাইট স্কুলের গেটে।

ফ্লাইট স্কুলে ঢোকার মুহূর্তটা ছিল তার জীবনের এক অনন্য অভিজ্ঞতা। প্রথমেই চোখে পড়ল বিশাল এক হ্যাঙ্গারে সারি সারি বিমান দাঁড়িয়ে আছে, চকচকে, শৃঙ্খলাবদ্ধ, যেন আকাশ ছোঁয়ার জন্য প্রতিক্ষণে প্রস্তুত। মেঘলার চোখ বিস্ময়ে ভরে উঠল—এটাই তার স্বপ্নের দুনিয়া। কিন্তু সেই বিস্ময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভয়ও ঘিরে ধরল, কারণ এখানে সবাই অচেনা। সবারই শহুরে পোশাক, সবার চোখে আত্মবিশ্বাস, অনেকের মুখে বিদেশি ইংরেজি উচ্চারণ—সবকিছুতেই মেঘলা অনুভব করল, সে যেন একেবারে আলাদা। ক্লাসরুমে প্রথম দিন বসেই তার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। প্রশিক্ষক ক্যাপ্টেন রঘুবীর সিং কঠোর কণ্ঠে বললেন, “এখানে স্বপ্ন নয়, বাস্তব কাজ করে। পাইলট হতে চাইলে নিয়ম, শৃঙ্খলা, পরিশ্রম—এই তিনটিই শিখতে হবে।” প্রথম ক্লাসেই যখন এয়ারডাইনামিক্সের জটিল তত্ত্ব বোঝানো হচ্ছিল, মেঘলা একেবারে হতবাক হয়ে গেল। গ্রামের স্কুলের পড়াশোনার তুলনায় এগুলো অনেক জটিল, আর শিক্ষকরা প্রত্যাশা করছিলেন সবাই যেন আগে থেকেই জানে। সহপাঠীদের মধ্যে ইশিতা রায় ছিল সবচেয়ে আত্মবিশ্বাসী, বারবার প্রশ্ন করে এবং উত্তর দিয়ে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করছিল। মেঘলা সেই মুহূর্তে ভেতরে ভেতরে সংকোচ বোধ করল, কিন্তু আবার মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল—সে কাউকে তার গ্রামের পরিচয়কে দুর্বলতা ভাবতে দেবে না। রাতের হোস্টেলে একা বিছানায় শুয়ে সে কান্না চেপে ধরত, কারণ এ জায়গাটা তার কাছে ছিল একেবারে অচেনা, পরিচিত কেউ নেই, বাবার মতো ভরসার চোখও নেই। কিন্তু জানালার ওপরে শহরের আলোয় ঢাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে সে ভাবত—এই আকাশ তো একই, গ্রামের আকাশ আর শহরের আকাশ আলাদা নয়। আর সেই ভাবনা থেকেই সে নিজের সাহস খুঁজে পেত।

প্রথম প্রশিক্ষণ শুরু হওয়ার দিনগুলো ছিল তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন। ভোরবেলা সাড়ে চারটায় ঘুম ভাঙা, নির্দিষ্ট সময়ে ড্রেস আপ, তারপর শারীরিক ব্যায়াম, ক্লাসরুম সেশন, সিমুলেটর ট্রেনিং—সবকিছু এতটাই চাপপূর্ণ ছিল যে প্রথম কয়েকদিন সে প্রায় ভেঙে পড়েছিল। সিমুলেটরে বসে যখন প্রথমবার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করল, তার হাত কাঁপছিল, স্ক্রিনে বিমান দিক হারিয়ে ফেলছিল, আর প্রশিক্ষক কড়া গলায় ধমক দিচ্ছিলেন। মেঘলার চোখ ভিজে উঠেছিল, কিন্তু সে ভেতরে ভেতরে নিজের জেদ ধরে রেখেছিল। প্রতিদিন ব্যর্থ হলেও সে আবার চেষ্টা করত, আর প্রতিবার আগের চেয়ে একটু বেশি মনোযোগী হতো। একদিকে কঠিন শৃঙ্খলা, অন্যদিকে সহপাঠীদের ঠাট্টা-তামাশা, আর একাকিত্বের চাপ—সব মিলিয়ে তার মনে হচ্ছিল এই শহরে টিকে থাকা অসম্ভব। কিন্তু তার মনে তখনো ভেসে উঠত সেই ছোট্ট গ্রামের মাঠ, বাবার রেডিওর শব্দ, আর নিজের প্রতিজ্ঞা—“আকাশ আমারই হবে।” দিন যেতে যেতে ধীরে ধীরে সে বুঝল, ফ্লাইট স্কুলের শৃঙ্খলা ভয়ের জন্য নয়, বরং শক্তি গড়ে তোলার জন্য। প্রতিটি কঠিন অনুশীলনের ভেতর দিয়ে তার মনোবল আরও শক্ত হচ্ছিল। হয়তো শহরের ভিড়ে সে একা, হয়তো তার চারপাশে সবাই প্রতিদ্বন্দ্বী, কিন্তু আকাশের প্রতি ভালোবাসা তাকে প্রতিদিন নতুন করে জাগিয়ে তুলছিল। আর এইভাবেই মেঘলা প্রথমবার বুঝতে শুরু করল—স্বপ্ন দেখা সহজ, কিন্তু স্বপ্নকে ছুঁতে হলে অসীম ধৈর্য, পরিশ্রম আর জেদ প্রয়োজন। সে জানত সামনে আরও ঝড় আসবে, কিন্তু শহরের এই দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েই সে বুঝে গেল—এটাই সেই পথ, যেখান থেকে তার আকাশযাত্রা সত্যিই শুরু হয়েছে।

প্রশিক্ষণের প্রথম সপ্তাহ শেষ হতেই ফ্লাইট স্কুলে নতুন ধাপ শুরু হলো—সরাসরি আকাশযাত্রার প্রস্তুতি। মেঘলার মনে উত্তেজনা ও ভয়ের এক অদ্ভুত মিশ্রণ কাজ করছিল। সেদিন সকালে তারা সবাই এয়ারস্ট্রিপের ধারে জড়ো হলো, আর তখনই প্রথমবার তাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন ফ্লাইট প্রশিক্ষক ক্যাপ্টেন রঘুবীর সিং। তিনি ছিলেন লম্বা দেহী, গাঢ় রঙের পাইলট স্যুটে আবৃত, মুখে কোনো হাসি নেই, চোখে এক অদ্ভুত কড়া দৃষ্টি। একঝলক দেখলেই বোঝা যেত—তিনি এমন মানুষ, যাঁর সামনে দাঁড়িয়ে কেউ ভুল করতে সাহস পায় না। তিনি প্রথমেই বললেন, “তোমরা সবাই এখানে এসেছ বড় স্বপ্ন নিয়ে, কিন্তু মনে রেখো—এখানে স্বপ্ন নয়, কেবল শৃঙ্খলা আর পরিশ্রম টিকে থাকবে। আকাশ কোনো দয়া দেখায় না, পাইলটের এক মুহূর্তের অবহেলা মানেই দুর্ঘটনা। তাই আজ থেকেই তোমরা শিখবে, কিভাবে নিজের ভয়, দুর্বলতা আর অলসতাকে হত্যা করতে হয়।” কথাগুলো শুনে মেঘলার বুকের ভেতর ঠকঠক করে উঠল, কিন্তু তার চোখে তখনো জেদ লুকিয়ে ছিল। প্রথম দিন থেকেই ক্যাপ্টেন সিং-এর আচরণ ছিল নির্দয়। যদি কারও ড্রেস ঠিকঠাক না হয়, তিনি উচ্চস্বরে বকতেন। যদি কেউ দৌড়াতে পিছিয়ে পড়ে, তিনি দ্বিগুণ দৌড়ানোর শাস্তি দিতেন। মেঘলা প্রথম কয়েকদিন কষ্ট পেলেও ধীরে ধীরে বুঝে গেল—তার কঠোরতা আসলে তাদের দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলতে শেখানোর জন্য। রাতের বেলা বিছানায় শুয়ে সে ভেবে দেখত—এই মানুষটাই হয়তো তাকে তার স্বপ্নের কাছাকাছি নিয়ে যাবে।

ক্যাপ্টেন রঘুবীর সিং-এর ক্লাসে প্রতিটি মুহূর্ত ছিল চ্যালেঞ্জে ভরা। তিনি প্রথমে বিমান চালনার মৌলিক তত্ত্ব শেখাতেন—কীভাবে টেক-অফ হয়, ল্যান্ডিং-এর সময় শরীর আর মনের ভারসাম্য রাখতে হয়, কেমন করে জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কিন্তু সবচেয়ে বেশি কঠিন ছিল তার শৃঙ্খলার পরীক্ষা। একদিন সিমুলেটর ক্লাসে মেঘলার হাত কাঁপছিল, আর ভুল করে বিমান দিক হারিয়ে ফেলেছিল। সাথে সাথে ক্যাপ্টেন সিং ধমক দিয়ে বললেন, “তুমি যদি নিজের হাত নিয়ন্ত্রণ করতে না পারো, আকাশকে নিয়ন্ত্রণ করবে কিভাবে?” মেঘলার চোখ ভিজে উঠেছিল, কিন্তু সে হার মানেনি। ক্লাস শেষে যখন অন্যরা বিশ্রাম নিচ্ছিল, তখন সে একা বসে সিমুলেটরের সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা অনুশীলন করত। তার মনে হতো, এই তিরস্কারই তাকে আরও শক্ত করছে। কিন্তু এই সময়েই আরেকটা ব্যাপার সামনে এলো—তার সহপাঠী ইশিতা রায়। ইশিতা ছিল শহুরে, আত্মবিশ্বাসী আর প্রতিভাবান। সে সবসময় ক্লাসে সবার আগে উত্তর দিত, আর মেঘলাকে অক্ষম প্রমাণ করতে যেন ইচ্ছে করেই ব্যঙ্গ করত। একদিন লাঞ্চ ব্রেকে সে ঠাট্টা করে বলল, “গ্রামের মেয়েরা চাষবাসে ভালো, কিন্তু ককপিট সামলানো সহজ নয়।” মেঘলা ভেতরে কেঁপে উঠলেও মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। সে জানত প্রতিটি তিরস্কার, প্রতিটি অবহেলা আসলে তাকে আরও শক্ত করে তুলছে। তার চোখে তখন একটাই লক্ষ্য—কাউকে নয়, কেবল আকাশকেই জয় করা।

তবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ধীরে ধীরে তাদের সম্পর্ককে এক অদ্ভুত রূপ দিল। ইশিতা যখন সবার সামনে দক্ষতা দেখাত, মেঘলা নিঃশব্দে আরও কঠোর অনুশীলন করত। একদিন প্রশিক্ষক তাদের একটি গ্রুপ টেস্ট দিলেন—কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে বিমানকে নিরাপদে ল্যান্ড করাতে হবে। ইশিতা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সবার আগে এগিয়ে গেল, কিন্তু মাঝপথে ভুল করে ল্যান্ডিং ব্যর্থ হলো। এরপর পালা এলো মেঘলার। সবার চোখ তার দিকে, ক্যাপ্টেন সিং কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। মেঘলা গভীর শ্বাস নিল, হাত শক্ত করে নিয়ন্ত্রণ ধরল, আর চোখের সামনে যেন বাবার মুখ ভেসে উঠল। সেই শক্তিই তাকে শান্ত রাখল। ধীরে ধীরে কন্ট্রোল সামলে নিয়ে সে সঠিকভাবে ল্যান্ড করাল বিমানটিকে। মুহূর্তের জন্য সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। ক্যাপ্টেন সিং-এর ঠোঁটের কোণে হালকা একটা হাসি ফুটে উঠল, যা তিনি সচরাচর দেখাতেন না। তিনি শুধু বললেন, “ভালো। মনে রেখো, আকাশকে জয় করতে চাইলে মাটি থেকে শক্ত হতে হবে।” সেই দিন থেকে মেঘলার আত্মবিশ্বাস দ্বিগুণ হয়ে গেল। সে বুঝল, ইশিতা তার প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও আসলে তার উন্নতির পথ তৈরি করছে। প্রতিটি চ্যালেঞ্জ তাকে শাণিত করছে, আর প্রতিটি ব্যর্থতা তাকে দৃঢ় করছে। শহরের একাকিত্ব, ক্যাপ্টেন সিং-এর কঠোরতা, ইশিতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা—সবকিছু মিলিয়ে মেঘলার স্বপ্ন তখন যেন নতুন ডানা পেল। আকাশের প্রথম ছোঁয়া এখনো অনেক দূরে, কিন্তু তার ভেতরে অদম্য শক্তি জন্ম নিয়েছে। সে জানত, এ পথ যতই কঠিন হোক না কেন, একদিন সে সত্যিই ডানা মেলে উড়ে যাবে।

ফ্লাইট স্কুলের রুটিন তখন ধীরে ধীরে মেঘলার জীবনের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল। ভোরে উঠে শারীরিক অনুশীলন, তারপর ক্লাস, সিমুলেটর ট্রেনিং আর আকাশের দিকে তাকিয়ে অবিরাম স্বপ্ন দেখা—সবকিছুতেই সে নিজেকে গড়ে তুলছিল। কিন্তু এত কিছুর মাঝেই একটি বিষয় বারবার তাকে সংকটে ফেলত—বিমানের যন্ত্রাংশ আর তার প্রযুক্তিগত দিক। আকাশে ওঠার জন্য যেমন সাহস দরকার, তেমনি মাটিতে থেকে সেই বিশাল যন্ত্রকে বোঝাও সমান জরুরি। ক্লাসে যখন ইঞ্জিন, ফুয়েল সিস্টেম কিংবা ককপিটের জটিল বোতাম আর সেন্সরের ব্যাখ্যা দেওয়া হতো, মেঘলা প্রায়ই দিশেহারা হয়ে যেত। সে চাইলেও সহজে বুঝতে পারত না। একদিন হ্যাঙ্গারে প্রশিক্ষণের সময় সবাইকে একটি সাধারণ চেক-আপ করতে দেওয়া হলো। মেঘলার কাজ ছিল বিমানের ককপিটের কয়েকটি বেসিক ইনস্ট্রুমেন্ট পরীক্ষা করা। কিন্তু ভুলবশত সে একটি সুইচ ভুল জায়গায় চালু করে ফেলল, আর তাতে সিগন্যাল বেজে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে প্রশিক্ষক তীব্রভাবে তাকে ধমক দিলেন, আর সহপাঠীদের হাসাহাসিতে তার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেল। সে অনুভব করল, তার অজ্ঞতার কারণে সবাই তাকে নিয়ে ঠাট্টা করছে। ঠিক সেই মুহূর্তেই সামনে এসে দাঁড়ালেন অর্ণব সেনগুপ্ত। তিনি ছিলেন উড়োজাহাজ প্রকৌশলী, বয়সে কিছুটা বড়, শান্ত স্বভাবের এবং চোখে বুদ্ধিদীপ্ত দীপ্তি। তিনি হেসে বললেন, “ভুল করা স্বাভাবিক, কিন্তু ভুল থেকে শেখাই আসল। আসো, আমি তোমাকে দেখাই।” সেই দিন থেকেই মেঘলার জীবনে নতুন এক সঙ্গীর আগমন ঘটল।

অর্ণবের হাতে যেন ছিল যন্ত্রাংশের জাদু। তিনি ধীরে ধীরে মেঘলাকে বোঝাতে লাগলেন—কোন বোতাম কী কাজ করে, ককপিটের প্রতিটি আলো কেন জ্বলে, কেমন করে ইঞ্জিনের শব্দ শুনে সমস্যার ইঙ্গিত ধরা যায়। তিনি সবকিছুই বুঝাতেন ধৈর্য নিয়ে, যেন একজন শিক্ষক তার সবচেয়ে মনোযোগী ছাত্রীকে পড়াচ্ছেন। মেঘলার কাছে অর্ণব হয়ে উঠলেন আস্থার আরেকটি স্তম্ভ। প্রথমদিনের সংকোচ কাটিয়ে সে ধীরে ধীরে প্রশ্ন করতে শুরু করল, আর অর্ণব কখনোই বিরক্ত হলেন না। বরং তিনি আরও উৎসাহিত করতেন, বলতেন, “একজন ভালো পাইলট হতে চাইলে কেবল আকাশে নয়, মাটিতেও শক্ত হতে হয়। বিমানের প্রতিটি যন্ত্রাংশ তোমার শরীরের অঙ্গের মতো, এগুলো না জানলে তুমি কখনো নিরাপদে ওড়াতে পারবে না।” মেঘলার মনে তখন অদ্ভুত এক প্রশান্তি আসত। দিনের চাপ, প্রশিক্ষকের কঠোরতা, ইশিতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা—সবকিছুই যেন হালকা হয়ে যেত অর্ণবের সহজ ব্যাখ্যা আর আন্তরিক ব্যবহারের সামনে। তারা দু’জনে প্রায়ই হ্যাঙ্গারের কোণে দাঁড়িয়ে বিমানের খোলা অংশগুলো পরীক্ষা করত, কখনো ইঞ্জিনের ঢাকনা খুলে দেখত, কখনো আবার ককপিটে বসে আলো-সুইচগুলো নিয়ে আলোচনা করত। কথোপকথন আস্তে আস্তে কেবল প্রযুক্তিগত সীমায় আটকে থাকল না। অর্ণব মাঝে মাঝে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার কথা বলতেন, বলতেন কীভাবে তিনি ছোটবেলা থেকেই যন্ত্র নিয়ে মেতে থাকতেন, কেমন করে এই পেশা তার কাছে কেবল কাজ নয়, বরং নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মেঘলার ভেতরে অদ্ভুত এক পরিবর্তন ঘটছিল। প্রথমে যে মানুষটিকে সে কেবল একজন প্রকৌশলী হিসেবে দেখেছিল, ধীরে ধীরে তার প্রতি এক ধরনের গভীর শ্রদ্ধা আর মুগ্ধতা জন্ম নিচ্ছিল। অর্ণবের চোখে সে কোনো প্রতিযোগিতা দেখত না, দেখত না উপহাস বা ঠাট্টা, বরং সবসময় পেত নির্ভরযোগ্য সহায়তার হাত। এই শহরের ভিড়ে, যেখানে প্রতিটি দিন ছিল একেকটি পরীক্ষা, সেখানে অর্ণব যেন তার একমাত্র আশ্রয় হয়ে উঠছিল। একদিন সন্ধ্যায়, ক্লান্ত মুখে হ্যাঙ্গার থেকে বেরোচ্ছিল মেঘলা। অর্ণব তার পাশে এসে হেসে বলল, “জানো, আকাশকে জয় করা সহজ নয়। কিন্তু তুমি যে জেদ দেখিয়েছ, তা একদিন তোমাকে অনেক দূরে নিয়ে যাবে।” মেঘলা তার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারল না, শুধু অনুভব করল তার বুকের ভেতর এক অজানা উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ছে। সেই দিন থেকে তাদের কথোপকথন কেবল যন্ত্র বা প্রশিক্ষণেই সীমাবদ্ধ থাকল না, ধীরে ধীরে বই, গান, স্বপ্ন আর জীবনের গল্পেও ছড়িয়ে গেল। অর্ণবের উপস্থিতি মেঘলার একাকিত্বকে অনেকটা হালকা করে দিল, আর তার প্রতিটি দিনকে করল নতুন রঙে রাঙানো। শহরের আকাশ হঠাৎই আর অচেনা লাগছিল না, কারণ সেই আকাশে এখন তার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল অর্ণবের আন্তরিক আলো।

ফ্লাইট স্কুলের পরিবেশ যত এগোতে থাকল, মেঘলা আর ইশিতার প্রতিযোগিতা ততটাই তীব্র হয়ে উঠল। শুরুতে কেবল ঠাট্টা বা মন্তব্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে সেটা একরকম নীরব যুদ্ধে রূপ নিল। প্রশিক্ষকের সামনে কে বেশি ভালো করবে, ক্লাসে কে দ্রুত উত্তর দেবে, এমনকি ছোট ছোট কাজেও কে এগিয়ে থাকবে—এসব নিয়েই তাদের মধ্যে অদৃশ্য এক টানটান লড়াই চলত। বিশেষ করে ইশিতা ছিল আত্মবিশ্বাসী আর দ্রুত শিখতে পারা ছাত্রী, তাই তার সাফল্য সবার নজরে পড়ত। মেঘলার পরিশ্রমও কম ছিল না, কিন্তু প্রায়ই এক ধাপ পিছিয়ে থাকত। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা চরমে পৌঁছল এক বড় পরীক্ষার সময়—এটা ছিল মিড-টার্ম টেস্ট, যেখানে সিমুলেটর আর তত্ত্ব দুই দিকই সমানভাবে মূল্যায়ন করা হবে। সকলে জানত এই পরীক্ষায় ভালো ফল করলে প্রশিক্ষকদের চোখে আলাদা করে ধরা পড়া যাবে। মেঘলা দিনের পর দিন রাত জেগে অনুশীলন করল, অর্ণবের কাছ থেকে যন্ত্রাংশের প্রতিটি খুঁটিনাটি শেখার চেষ্টা করল, আর মনে মনে বাবার কথা ভেবে সাহস সঞ্চয় করল। কিন্তু পরীক্ষার দিন ভাগ্য যেন তাকে প্রতারিত করল। সিমুলেটরে বসে হঠাৎ তার হাত কাঁপল, ভুল সিদ্ধান্ত নিল, আর বিমান ভারসাম্য হারাল। প্রশিক্ষক সঙ্গে সঙ্গে নাম লিখে নিলেন ব্যর্থতার তালিকায়। অন্যদিকে ইশিতা আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে সঠিক কৌশল ব্যবহার করে সফলভাবে পরীক্ষা শেষ করল। সবার সামনে প্রশিক্ষক তাকে প্রশংসা করলেন, আর ইশিতার চোখে তখন যেন বিজয়ের দীপ্তি জ্বলছিল। মেঘলা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল, বুকের ভেতরটা জ্বলে উঠল হতাশার আগুনে।

পরীক্ষা শেষে মেঘলা একা বসেছিল হ্যাঙ্গারের বাইরে, চোখ ভিজে আসছিল। সেই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছিল, হয়তো ইশিতার কথাই ঠিক ছিল—সে গ্রামের মেয়ে, তার জন্য হয়তো এই জায়গাটা নয়। নিজের অক্ষমতার বোঝা যেন বুকের ওপর চাপ সৃষ্টি করছিল। ঠিক তখনই অর্ণব তার পাশে এসে দাঁড়াল। তিনি নীরবে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন মেঘলার দিকে, তারপর শান্ত স্বরে বললেন, “একটা ব্যর্থতাই সবকিছু নয়। তুমি কি জানো, আমি কতবার প্রথম দিকে ভুল করেছি? কিন্তু ভুল না করলে শেখা যায় না। বিমান চালানো মানে শুধু যন্ত্রপাতি নিয়ন্ত্রণ নয়, নিজের ভয় আর হতাশাকে নিয়ন্ত্রণ করা। তুমি যদি আজ হেরে যাও আর উঠে দাঁড়াও, তাহলে কালকের আকাশ তোমাকেই বেছে নেবে।” মেঘলা চুপ করে শুনছিল, আর তার চোখের জলে তখন এক অদ্ভুত আলো জ্বলে উঠছিল। অর্ণব আবার বললেন, “ইশিতা আজ এগিয়ে গেছে, ভালো। কিন্তু মনে রেখো, প্রতিযোগিতা মানেই অন্যকে হারানো নয়—নিজেকে আরও ভালো করে তোলা। আজ তুমি ব্যর্থ হয়েছ, কিন্তু যদি এটাকে শিক্ষা হিসেবে নাও, তবে কাল তোমাকেই সেরা মনে করা হবে।” অর্ণবের কথা যেন মেঘলার হৃদয়ে নতুন প্রাণ সঞ্চার করল। সে ধীরে ধীরে মাথা তুলে তাকাল, আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল—সে আর পিছিয়ে পড়বে না।

সেই রাতেই মেঘলা নিজেকে নতুনভাবে প্রস্তুত করার শপথ নিল। পরদিন থেকে সে দ্বিগুণ উদ্যমে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রতিটি ভুলকে নোট করল, অর্ণবের সঙ্গে বসে অনুশীলন করল, আর প্রশিক্ষকের কঠোরতা সহ্য করে প্রতিটি ধাপে মনোযোগ দিল। অন্যদিকে ইশিতা যেন তার সাফল্যের আনন্দে ডুবে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠল, মাঝে মাঝেই মেঘলাকে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দিত। কিন্তু এবার মেঘলা তাতে ভেঙে পড়ল না, বরং তা থেকে নতুন শক্তি নিল। তার চোখে তখন কেবল একটি লক্ষ্য—নিজেকে প্রমাণ করা। ক্লাসে সে আরও সক্রিয় হলো, সিমুলেটরে আরও নিখুঁত হলো, আর আকাশের প্রতি তার টান যেন আগের চেয়ে আরও প্রবল হয়ে উঠল। প্রশিক্ষকরাও লক্ষ্য করলেন তার ভেতরের পরিবর্তন। অর্ণব প্রায়ই বলতেন, “আগুন যদি সঠিক পথে জ্বলে, তবে সেটাই শক্তি। তোমার ভেতরের আগুনকে হারিয়ে ফেলো না, তাকে নিয়ন্ত্রণ করো।” ধীরে ধীরে মেঘলা বুঝতে পারল—প্রতিদ্বন্দ্বিতা আসলে তাকে দুর্বল করছে না, বরং তার স্বপ্নের পথে তাকে আরও দৃঢ় করে তুলছে। ইশিতা হয়তো এগিয়ে গেছে, কিন্তু মেঘলা জানত তার সময়ও আসবে। আর সে যখন আসবে, তখন সেই আকাশই সাক্ষী থাকবে তার জয়ের গল্পের।

শহরের ব্যস্ত রাস্তা আর গ্রামের শান্ত গলিপথের মধ্যে যেন একটি অদৃশ্য সেতু তৈরি হয়েছে অর্ণব ও মেঘলার মধ্যে। অর্ণবের শহুরে জীবন এবং মেঘলার গ্রামীণ পরিবেশের ভিন্নতা তাদের আলাপচারিতায় প্রায়ই প্রকাশ পায়। প্রতিদিনের ছোটখাট ঘটনা থেকে শুরু করে বড় ভাবনার বিষয়গুলোও তারা ভাগাভাগি করে। অর্ণব মেঘলাকে শহরের দৌড়ঝাপ, কাজের চাপ, প্রযুক্তির আধিপত্য এবং আধুনিক জীবনধারার নানা দিকের কথা বলে, আর মেঘলা শহরের কোলাহল শুনে বিস্ময় প্রকাশ করে। সে তার গ্রামের নদী, বটগাছের ছায়া, পুকুরে ভেসে আসা জলছায়া, হাওরের নির্জনতা এবং মৌসুমী ফল-ফুলের কথা জানায়। প্রথম দিকে এই আলাপচারিতা শুধুই বিনোদনমূলক এবং কৌতূহলজনক মনে হলেও, ধীরে ধীরে তা এক গভীর সম্পর্কের দিকে ধাবিত হয়। তাদের কথোপকথনে কখনও নীরবতা আসে, কখনও হাসি-ঠাট্টা, আবার কখনও সংবেদনশীল মুহূর্ত তৈরি হয়, যা বুঝিয়ে দেয় যে দুজনের মনের মধ্যে একটি অদৃশ্য সেতু গড়ে উঠছে। এই সেতু শুধু আলাপের নয়, বরং অনুভূতিরও।

একটা বিকেলে, অর্ণব মেঘলার সঙ্গে শহরের একটি ছোট ক্যাফেতে দেখা করতে আসে। বাইরে শহরের ভিড়, রাস্তায় যানবাহনের শব্দ, আর ভিতরে হালকা আলো আর নরম সঙ্গীত—সবকিছু যেন তাদের আলাপকে আরও ঘনিষ্ঠ করে। মেঘলা অর্ণবকে গ্রামের গল্প শোনায়, যেখানে তিনি হাওরের নীরবতা আর নদীর তীরে বেড়ানোর মুহূর্তগুলো জীবন্তভাবে তুলে ধরেন। অর্ণব শুনতে শুনতে অবাক হয়—কিভাবে ছোট ছোট গ্রামীণ দৃশ্য তার মনে এমন উষ্ণতা জাগাতে পারে। সে মেঘলার চোখের দিকে তাকায়, যা কিছুটা লাজুক আবার কিছুটা কৌতূহলবোধে ভরা। এই মুহূর্তগুলোতে দুজনেই বুঝতে পারে, তাদের সম্পর্ক শুধু আলাপ-সাক্ষাৎ বা বন্ধুত্বের সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ধীরে ধীরে হৃদয়ের গভীরে প্রেমের অনুভূতি চুপচাপ জন্ম নিচ্ছে, যদিও তারা এখনো সে কথা স্বীকার করতে সাহস পাচ্ছে না। মেঘলা অর্ণবের হাতে থাকা একটি চিঠি নরমভাবে ছুঁয়ে যায়, এবং অর্ণবের মনে হঠাৎ করেই এক অজানা আবেগ জাগে—একটি অনুভূতি যা সে জানে না কিভাবে প্রকাশ করবে।

নিশ্চিন্ত রাতের আলোয় তারা দুজনে শহরের পার্কে হাঁটতে বের হয়। বাতাসে হালকা ঠান্ডা, চাঁদের আলো পানি ও পাতায় খেলা করছে, আর তারা দুজনেই একে অপরের পাশে নীরবে হাঁটছে। এই নীরবতায় কথার চেয়ে বেশি অর্থপূর্ণ কিছু রয়েছে। মেঘলা অর্ণবকে তার গ্রামের মেলামেশা, উৎসব, পাখির ডাক, এবং মৌসুমী ফসলের আনন্দের কথা জানায়। অর্ণব ধীরে ধীরে তার শহরের জীবনের চাপ, বন্ধুদের গল্প, শহরের নানা অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেয়। তারা দুজনেই বুঝতে পারে, যদিও তারা ভিন্ন পরিবেশ থেকে এসেছে, হৃদয়ের অনুভূতি এবং ভাবনার গভীরতা একইরকম। এই অনুভূতিটি এক অদৃশ্য সেতুর মতো, যা শহর আর গ্রামের মধ্যে, দুই ভিন্ন জীবনধারার মধ্যেও তাদের একত্রিত করছে। সেতুটি দৃঢ়, দৃশ্যমান নয়, কিন্তু উপস্থিতি স্পষ্ট—যা তাদের সম্পর্ককে নতুন দিশা, নতুন আশা এবং এক অদৃশ্য বন্ধনের শক্তি দেয়।

প্রশিক্ষণের সেই সকালে আকাশে কেমন অস্থিরতা বিরাজ করছিল, ঠিক তেমনই মেঘলার মনে একটি অদৃশ্য তীব্র উত্তেজনা কাজ করছিল। দিনের শুরুটা ছিল সাধারণ, তবে মেঘলা জানত যে আজকের উড়ান পরীক্ষা তার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। সে প্রস্তুত ছিল, নিজের ক্ষমতা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী, কিন্তু হঠাৎ করেই পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। উড়ানের সময় হঠাৎ বাতাসের দিক পরিবর্তন এবং যান্ত্রিক কিছু ছোটখাটো ত্রুটি মেঘলাকে প্রায় দুর্ঘটনার মুখে পৌঁছে দেয়। হৃদয় দ্রুত বেজে উঠল, চোখে যেন সব অন্ধকার ঢুকে পড়ল, এবং মেঘলার সমস্ত আত্মবিশ্বাস ভেঙে যায়। এই মুহূর্তে, তার মন কেবল আতঙ্ক আর হতাশায় ঘেরা। তার প্রশিক্ষকরা দ্রুত হস্তক্ষেপ করে পরিস্থিতি সামলায়, কিন্তু মেঘলার মনে নিজের অক্ষমতা নিয়ে গভীর হতাশা নেমে আসে। সেই পরীক্ষার ফলাফল, যা তার ক্যারিয়ারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, এখন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে।

স্কুলে ফিরে মেঘলার অবস্থা আরও কঠিন হয়ে যায়। অন্যান্য শিক্ষার্থীরা ইতিমধ্যেই তাদের দক্ষতা প্রদর্শন করেছে, বিশেষ করে ইশিতা, যিনি এই পরীক্ষায় অসাধারণ ফলাফল অর্জন করেছে। ইশিতার সাফল্য যেন মেঘলার ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি, যা তার মনে আরও চাপ এবং হীনমন্যতা জাগায়। বন্ধুরা সহানুভূতিশীল হলেও, মেঘলার মনে নিজেকে ব্যর্থ মনে হচ্ছে। সে নিজেকে প্রশ্ন করে—কেন সে সক্ষম হল না? কেন তার সমস্ত পরিশ্রম ব্যর্থতায় শেষ হল? সেই সব ভাবনার ভারে মেঘলা একদিকে ভেঙে পড়ে, কখনও নিজেকে দোষারোপ করে, কখনও কাঁদতে বসে। এই ভাঙা মনস্তাত্ত্বিক অবস্থায়, অর্ণবের উপস্থিতি একটি আশার আলো হয়ে আসে। অর্ণব, যে মেঘলার বন্ধুত্ব এবং সম্ভাব্যতা আগে থেকেই চেনে, তাকে সমর্থন দেয়। সে শুধু শব্দের দ্বারা নয়, বরং তার আচরণ এবং দৃঢ় দৃশ্যে মেঘলাকে বোঝায় যে ব্যর্থতা মানুষের জীবনের অংশ এবং তা নতুন শেখার সুযোগও নিয়ে আসে।

ধীরে ধীরে, মেঘলা অর্ণবের সহায়তায় নিজের ভাঙা আত্মবিশ্বাসকে পুনর্গঠন করতে শুরু করে। অর্ণব তাকে ছোট ছোট ধাপ নিয়ে পুনরায় আত্মবিশ্বাসে ভরিয়ে তোলে—প্রতিদিনের ছোট অনুশীলন, মনোযোগী প্রশিক্ষণ, এবং ইতিবাচক চিন্তার মাধ্যমে। মেঘলা বুঝতে পারে যে একটি ব্যর্থ উড়ান তার সামগ্রিক ক্ষমতাকে সংজ্ঞায়িত করতে পারে না, বরং এটি তাকে আরও শক্তিশালী এবং সাবধানী হতে শিখিয়েছে। এক সন্ধ্যায় তারা দুজনে প্রশিক্ষণ মাঠে বসে আকাশের দিকে তাকায়, যেখানে সূর্যের শেষ আলো এবং কালের হালকা বাতাস মেঘলাকে নতুন উদ্যম দেয়। সে অনুভব করে, হঠাৎ ঝড়ের মধ্যেও আকাশের সুন্দরতা এবং সম্ভাবনা আছে।

যখন অর্ণবকে বিদেশে কাজের একটি সোনালি সুযোগ দেওয়া হয়, তখন দুজনের মনেই এক অদ্ভুত উত্তেজনা আর উদ্বেগের মিশ্রণ দেখা দেয়। অর্ণব জানে, এই সুযোগ তার ক্যারিয়ারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু একযোগে সে মেঘলাকে ছেড়ে যাওয়ার ভাবনায় দুশ্চিন্তায় পড়ে। মেঘলাও এই খবর শুনে মিশ্র অনুভূতির মধ্যে আটকে যায়—একদিকে সে খুশি যে অর্ণব তার স্বপ্নের পথে এগোচ্ছে, অন্যদিকে ভয় যে দূরত্ব তাদের বন্ধনকে দুর্বল করে দিতে পারে। প্রথম কয়েক দিন তারা নিয়মিত যোগাযোগ রাখে, ভিডিও কল, মেসেজ, ইমেইল—সবকিছু চেষ্টা করে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার। কিন্তু বাস্তবতার চাপ এবং সময়ের ব্যবধান ক্রমে তাদের আলাপচারিতাকে সীমিত করে দেয়। ছোট ছোট কথাবার্তাগুলোও যেন বোঝায় যে দুজনের মধ্যে দূরত্ব শুধু শারীরিক নয়, মানসিক ও অনুভূতির ক্ষেত্রেও একটি ফাঁক তৈরি করছে।

মেঘলা গভীরভাবে ভাবতে শুরু করে, নিজের স্বপ্ন এবং প্রেমের মধ্যে একটি বিভাজন অনুভব করে। সে বুঝতে পারে যে তার নিজের লক্ষ্য এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা, যেমন সফল প্রশিক্ষক হওয়া, শুধুই তার ব্যক্তিগত চেষ্টার ফল নয়, বরং সময়, ধৈর্য এবং মানসিক শক্তিরও দাবি করে। এই নতুন পরিস্থিতিতে তার মনে আসে এক প্রশ্ন—এই সম্পর্ক কি তার স্বপ্নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে, নাকি তারা একসঙ্গে এগোতে পারবে, প্রতিটি দূরত্ব এবং বাধা অতিক্রম করে? মেঘলা নিজেকে পরীক্ষার মতো মনে করে, যেখানে তার হৃদয় চায় অর্ণবকে পাশে পেতে, কিন্তু মনকে বোঝাতে হয় যে তার স্বপ্নও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই দ্বন্দ্ব তার দৈনন্দিন কাজকর্ম, প্রশিক্ষণ এবং ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে প্রভাব ফেলে। তার স্বপ্ন এবং ভালোবাসার মধ্যে ভারসাম্য খুঁজে বের করা ক্রমে তার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।

অর্ণবও এই দূরত্বের চাপে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে বসে না। সে জানে, মেঘলার জীবন এবং স্বপ্নকে সম্মান করা তার দায়িত্ব, আর একইসাথে নিজের ক্যারিয়ারও এগিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। তাদের মধ্যে যে সম্পর্কের সেতু তৈরি হয়েছে, তা সহজে ভেঙে যাবে না, তবে স্থায়ী করার জন্য আরও সচেতন প্রচেষ্টা দরকার। ভিডিও কলের সময় তারা একে অপরের চোখে চোখ রাখে, মিস করার অনুভূতি এবং গভীর ভালোবাসা প্রকাশ পায়। ধীরে ধীরে তারা বোঝে যে, দূরত্ব শুধু বাধা নয়, বরং সম্পর্কের গভীরতা ও দৃঢ়তা পরীক্ষা করার একটি সুযোগ। মেঘলা নিজের ভিতরের শক্তি এবং ধৈর্য খুঁজে পায়, আর অর্ণবও বুঝতে পারে যে ভালোবাসা শুধু শারীরিক উপস্থিতি নয়, বরং সমর্থন, বোঝাপড়া এবং বিশ্বাসের মাধ্যমেও শক্তিশালী হতে পারে।

প্রতিটি নতুন সকাল মেঘলার জন্য নতুন আশা নিয়ে আসে। এই অধ্যায়ের সকালে, সে আবার নিজের জেদ এবং দৃঢ় সংকল্প নিয়ে পরীক্ষার কক্ষে বসে। গতবারের ব্যর্থতা তার মনে গভীর ছাপ রেখেছিল, কিন্তু এখন সে জানে—ভয় এবং দ্বিধা তাকে কখনো এগোতে দেবে না। পরীক্ষা শুরুর মুহূর্তে মেঘলা এক অদৃশ্য শক্তি অনুভব করে, যা তার ভিতর থেকে উদ্ভূত হচ্ছে—একটি শক্তি যা তাকে বলছে, “তুমি পারবে।” প্রশ্নপত্র হাতে নিয়ে সে ধীর এবং মনোযোগীভাবে কাজ শুরু করে। প্রতিটি প্রশ্নে তার মনোযোগ এতোটাই কেন্দ্রীভূত যে সময় যেন থমকে যায়। তার হাতের নড়াচড়া, চোখের দৃষ্টি, এবং মনোযোগ—সবকিছুই এক অদ্ভুত একাগ্রতায় মিলিত হয়েছে। পরীক্ষা শেষে, মেঘলা অনুভব করে যে এবার তার প্রচেষ্টা শুধুই আত্মপরিপূর্ণতার জন্য নয়, বরং নিজের ক্ষমতার সর্বোচ্চ প্রকাশ। পরীক্ষার ফলাফলের মুহূর্তে, যখন তার নাম সাফল্য তালিকায় উজ্জ্বলভাবে ওঠে, তখন মেঘলার হৃদয় আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়। ব্যর্থতার স্মৃতি এখন শুধুই শক্তি এবং প্রেরণার উৎস।

অর্ণবও তার নিজস্ব জগতে অনন্য সাফল্য অর্জন করেছে। বিদেশে তার কঠোর পরিশ্রম এবং দক্ষতার স্বীকৃতি মিলেছে, যা তাকে একটি নতুন দায়িত্ব এবং স্বপ্নের পথে নিয়ে গেছে। মেঘলার মতোই, অর্ণবও বোঝে যে দূরত্ব ও প্রতিযোগিতা সম্পর্ককে কমিয়ে দিতে পারে না, বরং একটি নতুন মাত্রা যোগ করে। ভিডিও কল বা মেসেজের মাধ্যমে তারা একে অপরকে শুভেচ্ছা জানায় এবং আনন্দ ভাগ করে নেয়। প্রতিটি কথোপকথনে শুধু ভালোবাসা নয়, বরং একে অপরের স্বপ্ন ও পরিশ্রমকে সম্মান করার গভীর বোঝাপড়া প্রকাশ পায়। এই মুহূর্তে দুজনেই উপলব্ধি করে যে—দূরত্ব শুধু একটি শারীরিক বাধা, কিন্তু মনোযোগ, বিশ্বাস এবং পরস্পরের প্রতি সাপোর্ট সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করে। এই অনুভূতি তাদেরকে অনুপ্রাণিত করে, যেন তারা জানে—একসাথে থাকুক বা দূরে থাকুক, হৃদয়ের বন্ধন স্থায়ী।

অধ্যায়ের শেষ মুহূর্তে, মেঘলা এবং অর্ণব দুজনেই আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবেন। আকাশে রঙের খেলায় সূর্যের আলো, মেঘের ছায়া, এবং দূরত্বের মাঝে প্রেম ও স্বপ্নের মিলন যেন দৃশ্যমান। তারা বুঝতে পারে যে প্রতিযোগিতা, ব্যর্থতা, দূরত্ব—সবই জীবনের অংশ, কিন্তু সঠিক মনোভাব, বিশ্বাস, এবং ধৈর্য থাকলে স্বপ্ন আর ভালোবাসা একসাথে চলতে পারে। মেঘলা নিজের অর্জিত সাফল্যকে শুধু ব্যক্তিগত হিসেবে দেখেনি, বরং এটি তাকে শিখিয়েছে—সফলতা এবং ভালোবাসা একসাথে সম্ভব। অর্ণবও উপলব্ধি করেছে যে, দূরত্ব তাকে মেঘলার প্রতি আরও গভীর স্নেহ এবং শ্রদ্ধা শেখিয়েছে।

১০

মেঘলার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনটি এল। আজ তার প্রথম আনুষ্ঠানিক উড়ান, যা শুধুই একটি পরীক্ষা নয়, বরং তার স্বপ্নের যাত্রার চূড়ান্ত প্রতীক। সকালে সে স্কুলের উড়ান মাঠে পৌঁছায়, চোখে উচ্ছ্বাস আর হৃদয়ে অদৃশ্য উত্তেজনা। বাবা-মা দূর থেকে তাকিয়ে থাকেন, গর্বে চোখ ভিজে যায়। মেঘলার মন যেন এক অদৃশ্য যাত্রার পথে ধাবিত হচ্ছে—প্রশিক্ষণ, ব্যর্থতা, প্রতিযোগিতা, সকল অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণ তার হৃদয়ে এক জাগ্রত শক্তি তৈরি করেছে। সে হালকা বাতাস, আকাশের বিস্তৃতি, এবং প্রশিক্ষকের নির্দেশনায় নিজেকে পুরোপুরি একাগ্র করে। প্রতিটি পদক্ষেপে তার সাহস এবং আত্মবিশ্বাস প্রকাশ পায়। প্রথমবারের মতো সে স্বপ্নের আকাশে পাখির মতো স্বাধীনভাবে উড়ছে, আর প্রতিটি মুহূর্তে অনুভব করছে—এই উড়ান কেবল তার নয়, বরং তার সংগ্রাম, অধ্যবসায় এবং ভালোবাসার প্রতিফলন।

উড়ানের সময় আকাশ যেন তার সমস্ত অনুভূতিকে স্বীকৃতি দেয়। সূর্যের আলো, মেঘের নরম ছায়া, বাতাসের স্পর্শ—সবকিছু মিলিয়ে একটি মনোরম দৃশ্য তৈরি করছে। মেঘলা তার প্রথম আনুষ্ঠানিক উড়ান সম্পন্ন করার আনন্দে ভরে উঠেছে, কিন্তু তার মনে ধীরে ধীরে উপলব্ধি আসে—এই পথ একা সে তৈরি করেনি। প্রতিটি শিক্ষক, প্রশিক্ষক, সহপাঠী, আর বিশেষভাবে অর্ণবের সহায়তা এবং অনুপ্রেরণা তাকে আজকের এই সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। দূরে দাঁড়িয়ে অর্ণবও তার অর্জিত সাফল্য দেখে আত্মিক আনন্দে ভরে ওঠে। যদিও তারা শারীরিকভাবে দূরে, হৃদয়ে তাদের বন্ধন এতোটাই শক্তিশালী যে একে অপরের আনন্দ এবং গর্ব স্পষ্টভাবে অনুভব করতে পারছে। এই মুহূর্তে মেঘলা বুঝতে পারে, জীবনের প্রতিটি ঝড়, প্রতিযোগিতা, ব্যর্থতা এবং সংগ্রাম—সবই এক অদৃশ্য সেতুর মতো তাকে আজকের স্থানে নিয়ে এসেছে।

আকাশের রঙ আজ সাতটি—সংগ্রাম, আশা, ব্যর্থতা, সাহস, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ভালোবাসা এবং বিজয়। এই সাতটি রঙের মিলনে মেঘলার জীবন রঙিন হয়ে উঠেছে। প্রতিটি রঙ তার জীবনের একটি অধ্যায়ের প্রতিফলন—সংগ্রাম তাকে দৃঢ় করেছে, আশা তাকে এগিয়ে চলতে শেখিয়েছে, ব্যর্থতা তাকে নম্র এবং শিক্ষিত করেছে, সাহস তাকে নির্ভীক করে তুলেছে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা তাকে উৎকর্ষে পৌঁছতে অনুপ্রাণিত করেছে, ভালোবাসা তাকে সমর্থন এবং অনুপ্রেরণা দিয়েছে, এবং বিজয় তাকে আত্মবিশ্বাস এবং আনন্দের এক অভূতপূর্ব অনুভূতি দিয়েছে। এই সাত রঙ একসাথে মিলিয়ে মেঘলার জীবনের আকাশকে আলোকিত করেছে, আর সে বুঝতে পেরেছে যে জীবন কেবল গন্তব্য নয়, বরং প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি অনুভূতি, প্রতিটি সম্পর্ক—সব মিলিয়ে একটি সম্পূর্ণ রঙিন আকাশ তৈরি করে।

***

 

1000055817.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *