ইন্দ্রনীল লাহা
১
কলকাতার জানুয়ারি শীতভরা সকালে এসপ্ল্যানেড বাসস্ট্যান্ডটা যেন একটু বেশিই কোলাহলময় লাগছিল। চারপাশে ঠান্ডা কুয়াশা, পুণ্যার্থীদের গমগম আওয়াজ, ঠাকুরের প্রসাদের গন্ধ, আর চায়ের দোকানে জমে ওঠা ভিড়—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত উৎসবের আমেজ। অনির্বাণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল বাকিদের সঙ্গে, গলায় ম্যারুন রঙের একটা মাফলার পেঁচানো, চোখে একটা নিরুত্তাপ ছায়া। তার পাশে ঈশান ফোনে ব্যস্ত—বাসের টাইমিং, হোটেলের কনফার্মেশন মেল, সব কিছু একে একে দেখে নিচ্ছে। তৃণা বসে ছিল ওদের ব্যাগের পাহাড়ের পাশে, ঠান্ডায় হাত ঘষছে, আর বিক্রম তার নতুন DSLR ক্যামেরা নিয়ে একের পর এক ক্লিক করে চলেছে—কখনও ফুটপাথের বাউল, কখনও বাসের ছাদের ওপরে বাঁধা বস্তা। “এই মেলা কিন্তু মিথ্যা নয় বন্ধু,” বলল বিক্রম, “এখানে শুধু মানুষের ভিড় নেই, এখানে সময় থেমে থাকে!” অনির্বাণ হালকা হেসে তাকাল ওর দিকে—ঠিক যেন সেই হাসি, যেটা গভীরে কিছু লুকিয়ে রাখে। তার মন অন্য জায়গায় ঘুরছে। গত তিন রাত ধরে সে আবার সেই পুরনো স্বপ্নটা দেখছে—এক সন্ন্যাসী, গেরুয়া বসনে, চোখে গভীর নীল ছায়া, তাকে ডেকে বলছেন, “তুই আসবি না অনির্বাণ? এবার সময় হল।” আর তারপরেই ভোরবেলা ঘুম ভেঙে যাচ্ছে, বুক ধড়ফড় করে উঠছে, আর গলা শুকিয়ে আসছে। সে বহু বছর আগে এই স্বপ্ন দেখেছিল, ছোটবেলায়। তারপর ভুলে গেছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই আবার ফিরে এসেছে। এমনকি এই গঙ্গাসাগর ভ্রমণের পরিকল্পনাটা অন্যরকম ভাবে হয়েছিল—তৃণাই প্রথম বলেছিল, “চল না গঙ্গাসাগর মেলায়, একটা আলাদা অভিজ্ঞতা হবে।” অনির্বাণের ভিতরে যেন কিছু নড়ে উঠেছিল। যেন সে আগে থেকেই জানত—তাকে এবার যেতে হবেই।
বাস ছাড়ল সকাল সাতটা নাগাদ। জানলার পাশে বসে থাকা অনির্বাণ বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল—বাড়িগুলোর ছায়া ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসছে, রাস্তাঘাটে বদল আসছে, শহর থেকে গ্রামের দিকে যত এগোচ্ছে, তত তার বুকের ভিতরটা কেমন ধীরে ধীরে ভারী হয়ে উঠছে। বিক্রম জোরে গান ছেড়েছে—লোকগান, বাউল আর সামান্য কিছু ফিউশন। ঈশান বিরক্ত হয়ে বলল, “ভাই একটু শান্তিতে যাত্রা করবি?” তৃণা হেসে বলল, “বিক্রমের যাত্রা মানেই soundtrack সহ গল্প।” অনির্বাণ এসবের মাঝে থেকেও বিচ্ছিন্ন। তার মনে পড়ছে সেই সন্ন্যাসীর মুখ। ঠিক যেন কোথাও দেখে ফেলেছে একবার। তার চিত্রকর মন বারবার চেষ্টা করছে মুখটা আঁকতে, কিন্তু চোখ দুটি আঁকতে পারছে না। যেন সেই চোখ কোনো চেনা রঙে আঁকা যায় না—অসীম গভীরতা, যেন তার ভিতরেই হারিয়ে যেতে হয়। বাস ক্রমশ এগিয়ে চলেছে, নানা স্টপেজ পার করে। দুপুরের খাবার খাওয়া হয় হাইওয়ের ধারে এক ধাবায়। বিক্রম ছবি তুলতে ব্যস্ত, ঈশান টয়লেটের লাইন দেখে বিরক্ত, আর তৃণা চুপচাপ অনির্বাণের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই ঠিক আছিস তো?” অনির্বাণ হালকা মাথা নাড়ল। “হ্যাঁ, ঠিকই আছি। তবে মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটবে। কিছু অদ্ভুত।” তৃণা একটু থেমে বলল, “ঘটবে বইকি। গঙ্গাসাগর মেলা তো সাধারণ জায়গা নয়। এখানে অনেক কিছু ঘটে—যেটা আমরা দেখতে পাই, তার বাইরেও।” অনির্বাণের বুকের মধ্যে যেন ধুকপুক শব্দটা আরও জোরে বাজে।
গঙ্গাসাগরের কাছাকাছি পৌঁছতেই বিকালের আলো পড়েছে। হরহামেশা কুয়াশা, মাটির রাস্তা, দু’পাশে খেজুর গাছের ছায়া, আর মাথার উপর দিয়ে ওড়ে ধূপের ধোঁয়া মেশানো শঙ্খধ্বনি। হঠাৎ অনির্বাণ দেখতে পেল একটি বৃদ্ধ সন্ন্যাসী রাস্তার ধারে বসে আছে। চোখে সেই একই গভীর দৃষ্টি। সে ঝট করে বাসের জানলা থেকে উঠে দাঁড়াল। “কি হল?” তৃণা জিজ্ঞেস করল। “কিছু না,” বলল অনির্বাণ, “মনে হল কেউ চেনা।” কিন্তু সে জানে, সেটা কেবল মনে হওয়া নয়। তার স্বপ্নের সেই সন্ন্যাসীকে সে চোখের সামনে দেখেছে। বাস্তব আর স্বপ্নের সীমারেখা যেন এক মুহূর্তে ঝাপসা হয়ে গেল। সন্ধ্যেবেলা তারা মেলার কাছে একটি হোমস্টেতে পৌঁছায়। চারপাশে পূণ্যার্থীদের ভিড়, জলঘোলা আলো, চিৎকার, আর ঢাক-ঢোলের শব্দে জায়গাটা যেন অন্য জগতে পরিণত হয়েছে। অনির্বাণ ঘরটায় ঢুকে ব্যাগ রেখে জানালার কাছে দাঁড়ায়। দূর থেকে শোনা যায় শঙ্খ ধ্বনি আর কীর্তনের ছন্দ। তার মনে পড়ে যায় সেই স্বপ্নের শেষ দৃশ্যটা—সন্ন্যাসী বলছেন, “যদি না আসিস, খুঁজে পাবি না নিজেকে।” অনির্বাণ চোখ বন্ধ করে। এক অজানা যাত্রার শুরু হয়ে গেছে। একটা এমন যাত্রা, যেখান থেকে ফিরে আসা সহজ নয়।
২
পরদিন ভোরে ঘুম ভাঙার আগেই ঘরের জানালায় কুয়াশা জমে ছিল। ঠান্ডা হাওয়ার ছোঁয়ায় তৃণা একটু গায়ে মাফলার জড়িয়ে আবার ঘুমোতে চাইল, কিন্তু অনির্বাণ ঘরে ছিল না। বিক্রম আধো ঘুমে উঠে মুখ চুলকে বলল, “ও আবার কোথায় গেল রে?” ঈশান তখনও কম্বলের নিচে মুখ গুঁজে রেখেছিল। কিন্তু জানালা খুলে বাইরে তাকাতেই দেখা গেল—লক্ষ মানুষের স্রোত যেন গঙ্গার দিকে এগিয়ে চলেছে। পুণ্যস্নানের সেই মহোৎসব শুরু হয়ে গেছে। ঘাটের দিক থেকে শঙ্খ আর ঘণ্টার শব্দ মিলে এক মাদকতা তৈরি করছে। কুয়াশার চাদরে মোড়া চারপাশে সন্ন্যাসীদের সারি, কাঠের ছাউনির নিচে বসে থাকা মহিলারা, আলতার রঙে রাঙানো পা আর শীতের জড়ানো শাড়ি—সব কিছু যেন কেমন স্বপ্নের মতো লাগছিল। ঈশান ঘড়ি দেখে বলল, “অনির্বাণকে ফোন কর… কেমন করে এভাবে একা চলে গেল!” বিক্রম বলল, “আজ্ঞে, সে তো আগে থেকেই বলে আসছিল যে কোনো অদ্ভুত টান টানছে তাকে… আমি বলেছিলাম তোরা সিরিয়াসলি নিস না!” তৃণা কিছু না বলে চুপচাপ ওর ডায়েরি বের করে। ডায়েরির পাতায় লেখা—”ঘুমের মধ্যে এক সন্ন্যাসীর চোখে চোখ রাখি। সে বলে, আমি আসব, আর আমি যেন বুঝি কোথায়। মেলায়, মোহনায়, মিলনের ঠিক মাঝখানে…”
এই লিখাগুলো পড়ে তৃণার গা ঠান্ডা হয়ে এল। ও জানত, অনির্বাণ বরাবরই একটু ভিন্নরকম, কিন্তু এমন কিছু যে ঘটতে পারে, তা সে ভাবেনি। তবুও, মেলার ভিড়ের মধ্যে তারা বেরিয়ে পড়ে অনির্বাণের খোঁজে। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা এক চায়ের দোকানদারকে তারা ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে—“এই ছেলেটিকে দেখেছেন?” দোকানদার মাথা নেড়ে বলে, “সাহেব গো, এখানে তো লক্ষ লোক আসে, সবাই একরকম লাগে।” তারা এগিয়ে চলে বিশাল মেলার মাঠ পেরিয়ে ঘাটের দিকে। সেখানে পৌঁছে, তারা দেখে—অগণিত মানুষ পুণ্যস্নানে ব্যস্ত, কেউ ঢাক বাজাচ্ছে, কেউ ধ্যান করছে, কেউ আবার নদীর জলে ফুল ভাসিয়ে দিচ্ছে। ঠিক তখনই বিক্রম ক্যামেরা তোলার সময় হঠাৎ কিছু একটা দেখে চমকে ওঠে। ক্যামেরার লেন্সে ধরা পড়েছে অনির্বাণ, দূরে এক ধাতব ঘাটের ধাপে দাঁড়িয়ে আছে, আর তার পাশে এক বৃদ্ধা মহিলা। আশ্চর্যের বিষয়, সবার মধ্যে থেকেও যেন তারা দুজনকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। বিক্রম জোরে বলে ওঠে, “ঐ দেখ, অনির্বাণ!” কিন্তু যখন তারা ছুটে যায় সেই জায়গায়, সেখানে কেউ নেই—শুধু নদীর স্রোত আর ভাসমান একটা মালা।
তারা হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। তৃণা ধীরে ধীরে বলতে থাকে, “অনির্বাণ কোথাও লুকিয়ে নেই… আমি মনে করি সে এমন জায়গায় চলে গেছে যেটা ঠিক আমাদের এই জগৎ নয়।” ঈশান চটে গিয়ে বলে, “তোরা সব অলৌকিক ব্যাপারে বিশ্বাস করিস, কিন্তু সত্যি হচ্ছে—সে হয়তো হারিয়ে গেছে, বা হয়তো…” তার কথা শেষ হবার আগেই তৃণা চোখে জল নিয়ে বলে, “সে খুঁজতে গিয়েছে… নিজেকে।” বিক্রম আবার ক্যামেরা ঘাঁটতে থাকে—ভিডিও রিপ্লে করে, ছবিগুলো জুম করে দেখে। তার চোখে পড়ল, বৃদ্ধা মহিলার গলায় ঝুলছে একটি তামার রুদ্রাক্ষ, আর তার হাতে ছিল এক টুকরো তালপাতার পুঁথি। দৃশ্যটি যেন শতাব্দী পেছনে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। বিক্রম নিচু স্বরে বলে, “এই মহিলা তো আমি কোথাও আগে দেখিনি, এমনকি মেলাতেও নয়। আর কীভাবে ওরা সবাই ভিড়ের মাঝে এত স্পষ্ট ক্যামেরায় ধরা পড়ল?” সেই রাতেই তারা হোমস্টেতে ফিরে আসে। কিন্তু কারো মুখে কোনো কথা নেই। মেলা তখনও চলছে বাইরে, ঢাকের তালে চক্ররূপী সন্ধ্যার নাচ শুরু হয়েছে। অথচ ঘরের ভিতরে যেন সময় থেমে গেছে। অনির্বাণ কোথায়? সে কি সত্যিই গঙ্গাসাগরেই আছে? নাকি সে পৌঁছে গেছে সেই মোহনায়—যেখানে স্বপ্ন, স্মৃতি, আত্মা আর সময় একে অপরের সঙ্গে গুলিয়ে যায়?
৩
সকালের আলো এখনও পুরোপুরি জেগে ওঠেনি, কিন্তু তৃণার ঘুম ভেঙে যায় একটা স্বপ্ন দেখে—স্বপ্নে সে দেখে অনির্বাণ হাঁটছে একটা কুয়াশাভরা ধু-ধু বালুর মাঠের মধ্য দিয়ে, আর তার পেছনে অসংখ্য ছায়া—সন্ন্যাসী, বৃদ্ধা, ছেলেবেলার অনির্বাণ, এমনকি তার নিজের প্রতিচ্ছবিও যেন সঙ্গী হয়ে হাঁটছে। ঘুম থেকে উঠে সে বুঝতে পারে, সময় ফুরিয়ে আসছে। সেই মুহূর্তেই বিক্রম দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকে, মুখে আতঙ্কের ছাপ। “তৃণা…তুই বিশ্বাস করবি না। আমি কাল রাতে আবার ভিডিওটা প্লে করছিলাম… আর দেখলাম, অনির্বাণ আর সেই বৃদ্ধা যখন ঘাটে দাঁড়ানো, পেছনে এক মুহূর্তের জন্য একটা ধ্বংসপ্রায় মন্দির দেখা যায়। আগুনের দাগ, গম্বুজের ছায়া… ওইটা কোথায় হতে পারে?” ঈশান, এখন আর প্রতিবাদ করে না, শুধু বলে, “চল, খুঁজে দেখি।” তিনজন একসঙ্গে বেরিয়ে পড়ে, লোকাল গাইডের সাহায্যে ঘাটের পেছনের জঙ্গলের দিকে যেতে থাকে—যেখানে পর্যটকরা সচরাচর যায় না। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তারা একটি পুরোনো, পরিত্যক্ত পাথরের মন্দিরের সামনে দাঁড়ায়। মন্দিরটি আংশিক ভাঙা, ছাদের একাংশ নেই, আর সেখানে কাঁটা জঙ্গলে ঢেকে রয়েছে প্রবেশপথ। কিন্তু দরজার দুপাশে খোদাই করা দুটি সিংহমূর্তি যেন তাদের উপস্থিতি টের পেয়েই নড়েচড়ে ওঠে।
তারা ভিতরে ঢুকতেই এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরে। পাথরের মেঝে, ছাদের খণ্ড, আর মাঝখানে একটি ভাঙা শিবলিঙ্গের সামনে বসে আছে একজন—পেছন ফিরে, ধবধবে ধুতি পরা, মাথায় আলতো করে জড়ানো গেরুয়া গামছা। কেউ কথা বলছে না। হঠাৎ সেই পুরুষটি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়—এবং তৃণার বুক হঠাৎ কেঁপে ওঠে। সেটি অনির্বাণ—কিন্তু তার চোখে নেই সেই চেনা আধুনিক ক্লান্তি, বরং এক অতল শূন্যতা। সে যেন দেখে কিন্তু কিছুই দেখে না। ঈশান এগিয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে বলে, “অনির্বাণ! তুই এখানে কী করছিস?” সে কোনো উত্তর দেয় না, শুধু বলে, “আমি ফিরে যেতে পারি না। এখানে অপেক্ষা করছিল কেউ।” তৃণা ধীরে ধীরে সামনে যায়, বলে, “আমরা খুঁজছি তোকে—তুই তো হারিয়ে গেছিলি…” অনির্বাণ মৃদু হাসে, “আমি হারাইনি, আমি খুঁজছিলাম। বহু জন্ম ধরে এই জায়গাটার টান আমার ভেতরেই ছিল। সেই বৃদ্ধা… তিনি আমাকে বলেছিলেন, আমি অসম্পূর্ণ এক যাত্রার উত্তরসূরি। আমি কিছু রেখে গেছিলাম এখানে।”
তৃণা এবার লক্ষ্য করে—মন্দিরের কোণায় একটি তালপাতার পুঁথি রাখা আছে, তার উপর ঝরেপড়া পাতা জমে রয়েছে। অনির্বাণ তা তুলে নেয়, বলে, “এই পুঁথি ছিল আমার আগের জন্মের লেখা। আমি একজন সন্ন্যাসী ছিলাম, কিন্তু আমার সাধনা শেষ হওয়ার আগেই আমি সাগরের জলোচ্ছ্বাসে বিলীন হয়েছিলাম। সেই অসমাপ্তি আমায় ডাকছিল।” বিক্রম ক্যামেরা তুলতে যায়, কিন্তু তৃণা হাত টেনে ধরে, “না, এটা রেকর্ড করার নয়।” হঠাৎ, চারপাশে বাতাস ঘন হয়ে আসে, বালির গন্ধে মিশে যায় ধূপের ধোঁয়া, আর কোথা থেকে যেন শঙ্খধ্বনি ভেসে আসে। অনির্বাণ বলল, “আমি এখানেই থাকব, এখনো কিছু বাকি। আমি ফিরতে পারি না—যদি না সেই সন্ধান পূর্ণ হয়।” ঈশান চিৎকার করে বলে, “এই তোরা যা খুশি ভাবিস! এটা কি পাগলামি নয়? একটা আধুনিক মানুষ, যুক্তিবাদী অনির্বাণ… হঠাৎ কী করে এসব বিশ্বাস করতে পারে?” অনির্বাণ তাকায় না, শুধু বলে, “যে সব সত্য চোখে দেখা যায় না, তার ওজন অনেক বেশি।”
তারা ঘরে ফেরে, কিন্তু তৃণার মন ঘোলা হয়ে থাকে। সে জানে, অনির্বাণ যা বলছে তা অবাস্তব নয়—তার চোখের ভাষায় ছিল এক অদ্ভুত বাস্তবতার ছায়া। সেই রাতেই, হঠাৎ করে আকাশের রং পাল্টে যায়, আর মন্দিরের দিক থেকে এক মৃদু আলোর রেখা উঠতে দেখা যায়। যেন কোথাও কোনো দ্বার খুলছে, সময়ের ওপারে। তৃণা নিজের ডায়েরিতে লেখে—“আজ বুঝলাম, আমরা যা দেখি তা-ই শুধু সত্য নয়। কেউ কেউ হারায় না, বরং তারা নিজের হারানো অস্তিত্বকে ফিরে পেতে বেরোয়… সেই সাগরের পারে, যেখানে আত্মা একদিন থেমে গিয়েছিল।”
৪
গঙ্গাসাগরের আকাশটা সেই ভোরে কিছুটা আলাদা ছিল—রোদ ওঠেনি, অথচ চারপাশে অদ্ভুত একটা নীলচে আলো ছড়িয়ে পড়েছিল। ভেসে আসছিল ধূপ-ধুনোর গন্ধ, আর দূরে ঘাট থেকে শোনা যাচ্ছিল কিছু স্তবপাঠের শব্দ। হোমস্টের জানালা দিয়ে তাকিয়ে তৃণা বুঝতে পারছিল, আজকের দিনটা অন্যরকম। যেন সময় একটু সরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তাদের জন্য অপেক্ষা করছে কোনও উত্তর প্রকাশের। ঈশান অবশ্য ভেতরে ভেতরে রেগে ছিল। সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না অনির্বাণের এই আধ্যাত্মিক মোহগ্রস্ততা। বিক্রম কিছু বলছিল না, কিন্তু তার ক্যামেরা হাতে ছিল—যেন সে বুঝে গেছে, আজকের দিনটা কোনও না কোনওভাবে ইতিহাস হয়ে থাকবে। তারা তিনজন আবার রওনা দেয় সেই পুরনো মন্দিরের দিকে। কিন্তু এবারে রাস্তাটা কেমন যেন পাল্টে গেছে। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তারা যে পরিচিত গলি আর বাঁকগুলো চিনত, সেগুলো কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে গেছে। পাতার মধ্যে ফাঁকফোকরে সূর্যের আলো পড়লেও যেন তাতে কোনও উষ্ণতা ছিল না—শুধু আলো, ছায়া আর এক রহস্যময় নিস্তব্ধতা।
মন্দিরের কাছাকাছি পৌঁছতেই তারা শুনতে পায় অনির্বাণের গলা—একটানা কিছু স্তোত্র উচ্চারণ করছে, যেগুলোর ভাষা যেন বহু পুরোনো, এবং পরিচিত নয়। তারা ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে দেখে, মন্দিরের ভিতরে ধূপকাঠির ধোঁয়া জমে উঠেছে, আর মাঝখানে অনির্বাণ ধ্যানস্থ হয়ে বসে আছে। তার সামনে বসে আছেন সেই সন্ন্যাসী—এইবার প্রথমবারের মতো বাস্তব ও স্পষ্ট রূপে। তিনি ছিলেন গেরুয়া বসনে, মাথায় চুল জটা করে বাঁধা, চোখ দুটি গভীর ও ধ্যানী। তারা কেউই তাকে আসতে দেখেনি, কিন্তু তিনিই যেন সেই মন্দিরের অভিভাবক। ঈশান জোরে বলে উঠল, “আপনি কে? আর অনির্বাণকে কেন এমন করছেন?” কিন্তু সন্ন্যাসী কিছু বলেন না, শুধু চোখ তুলে তাকান। সেই চোখে যেন সময় থেমে যায়। বিক্রম ফ্রেম ঠিক করে ক্যামেরা তুলতেই ক্যামেরা নিস্তেজ হয়ে যায়—একটা বাষ্পধারার মতো কিছু ছড়িয়ে পড়ে তার স্ক্রিনে। তৃণা ধীরে ধীরে মন্দিরের মেঝেতে বসে পড়ে—তার মন বলছে, এখানে প্রতিরোধের নয়, গ্রহণের সময় এসেছে।
সন্ন্যাসী অবশেষে মুখ খোলেন, তাঁর কণ্ঠ ছিল গভীর ও স্নিগ্ধ, যেন বহু জল বেয়ে আসা নদীর মতো। তিনি বলেন, “অনির্বাণ আমার উত্তরসূরি। সে বহু শতাব্দী আগে এখানে এসেছিল, সে পথভ্রষ্ট হয়নি, শুধু অসম্পূর্ণ থেকে গিয়েছিল। যে সাধনার শুরু করেছিল, তা সম্পূর্ণ হওয়ার আগে মৃত্যু এসে কেড়ে নিয়েছিল তাকে। আজ সে ফিরে এসেছে—সেই অসমাপ্তির হিসেব মিলাতে।” তৃণা তখন বলে, “কিন্তু আমরা ওকে ফিরে চাই… আমরা বন্ধুরা ওকে হারাতে চাই না।” সন্ন্যাসী হালকা হাসেন, “সে হারায়নি। সে পূর্ণ হতে চায়। আর পূর্ণতা পেতে গেলে নিজেকে জানতে হয়। এই সাধনাক্ষেত্র, এই গঙ্গাসাগরের মোহনা, শুধু নদী-সাগরের মিলন নয়, আত্মা ও শূন্যতার মিলনের স্থান।”
একসময় অনির্বাণ চোখ মেলে তাকায়। সে বলে, “তোমরা বুঝবে না, কিন্তু এই মাটির গন্ধ, এই বাতাস, এই ধুলো—সব আমার চেনা। আমি যখন প্রথম এই স্বপ্নটা দেখেছিলাম, তখন ছোট ছিলাম। কিন্তু আসলে সেটা কোনো স্বপ্ন ছিল না, ছিল এক ডাক, এক অসমাপ্ত স্মৃতি। আজ বুঝতে পারছি, কেন এই মেলা, কেন এই জায়গা আমাকে এত আকর্ষণ করত। আমি চাই, শেষ করতে সেই যাত্রা।” ঈশান চুপ করে থাকে, তার মুখে কোনো যুক্তির জবাব নেই। বিক্রম আবার ক্যামেরা চালু করার চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থ হয়। সেই মুহূর্তে, সন্ন্যাসী উঠে দাঁড়ান, মন্দিরের ছায়া তাঁর গায়ে পড়ে এক বিভ্রম তৈরি করে—তাঁকে মনে হয় এক পুরাতন পাণ্ডুলিপির পাতায় আঁকা চিত্র। তিনি বলেন, “এই ঘরেই সে একদিন লিখেছিল পুঁথির প্রথম লাইন—‘যা আমি হারাই, তাই হয়ত আমি।’ আজ তাকে সেই বাক্য শেষ করতে হবে।”
তাদের চোখের সামনে ধীরে ধীরে ধূপের ধোঁয়ার মধ্যে মিশে যান সন্ন্যাসী। কোথাও কোনও শব্দ নেই। অনির্বাণ আবার চুপ করে বসে পড়ে। তৃণা কাছে গিয়ে বসে, তার কাঁধে হাত রাখে। “আমরা এখানেই আছি, যতক্ষণ না তুই ফিরে আসিস,” সে বলে। বিক্রম সেই দৃশ্যটা দেখে নেয়—কোনও ক্যামেরা ছাড়াই। ঈশান ধীরে ধীরে দূরে তাকিয়ে বলে, “হয়তো সব উত্তর পাওয়া যায় না, কিন্তু কিছু যাত্রা শুধু নিজের জন্যই হয়।” এবং সেই রাতে, গঙ্গাসাগরের আকাশে প্রথম তারা ফুটে ওঠে। নিস্তব্ধতা জানান দেয়—আত্মার গভীরতম ডাক কেউ শুনতে পেয়েছে।
৫
সকালবেলার সূর্য উঠলেও গঙ্গাসাগরের ঘাটে তখনও কুয়াশার চাদর জমে ছিল। দীপ্ত তখন একা ঘোরাঘুরি করছিল, কারণ সে রাতের সেই স্বপ্নের গভীর অর্থ খুঁজে বেড়াচ্ছিল। বাকি বন্ধুরা ঘাটে স্নান, পূজা, আর ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেও দীপ্তর মনে হচ্ছিল সময় যেন অন্যভাবে চলেছে তার জন্য। কাল রাতের সেই স্বপ্নটা—জলে দাঁড়িয়ে থাকা সেই রহস্যময় নারীর মুখ, তার চোখের গভীর ডাকা—এখনও তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। দীপ্ত ভাবছিল, এটি নিছক কোনো কল্পনা, নাকি কোনো ইঙ্গিত? তার মনের ভেতর জন্ম নিচ্ছিল এক অদ্ভুত টান, যা তাকে নিয়ে যাচ্ছিল ঘাট থেকে একটু দূরের, নির্জন এক পথে। সেই পথটা ধীরে ধীরে বালি ও ঝাউবন পেরিয়ে এগোচ্ছিল সাগরের কোণের দিকে, যেখানে খুব কম মানুষ পা রাখে। হাঁটতে হাঁটতে দীপ্ত হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়—তার মনে হয় কেউ তাকে ডেকেছে। “দীপ্ত…”—মৃদু, আবছা, কিন্তু স্পষ্টভাবে পরিচিত এক নারীকণ্ঠ যেন বাতাসে মিশে গেছে। সে পেছনে ফিরে দেখে কেউ নেই। কিন্তু বাতাসে লেগে থাকা এক অদ্ভুত গন্ধ, যেন চন্দনের, আবার যেন পুরোনো কোনো চিঠির গন্ধ, তাকে ঠেলে নিয়ে যায় সামনে, সেই ঝাউবনের দিকে।
ঝাউবনের ছায়ার মধ্যে, কুয়াশার স্তব্ধতা ভেদ করে দীপ্ত দেখে এক মেয়ের অবয়ব—ঠিক যেন তার স্বপ্নের সেই নারী। তার পরনে সাদাকাপড়, চুলগুলি ভিজে ঝুলে আছে, আর তার চোখে এক গভীর বিষাদ। সে কিছু বলে না, শুধু দীপ্তর দিকে চেয়ে থাকে। দীপ্তর পা যেন জমে যায়, কথা আটকে আসে গলায়। মেয়েটি এগিয়ে এসে হঠাৎ বলল, “তুমি ঠিক সময়ে এসেছ, কিন্তু সময় বাকি নেই।” দীপ্ত থমকে যায়। “তুমি কে?” সে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে। মেয়েটি একটা ছিন্ন পুরোনো চিঠি দীপ্তর হাতে দিয়ে মিলিয়ে যায় কুয়াশার মধ্যে। দীপ্ত চিঠিটা খুলে দেখে এক ভিজে, ধোঁয়াশা লেখা—যেখানে স্পষ্টভাবে লেখা: “সময়ের স্রোতে যদি ডুবে যাও, নিজেকে চিনে ফেরা হয় না।” তার পর কিছু শব্দ অস্পষ্ট, মুছে যাওয়া। চিঠির নিচে লেখা একটি নাম—“বিন্দু”। দীপ্তর মনে পড়ে যায়, ছেলেবেলায় তার এক কাকিমার নাম ছিল ‘বিন্দুদি’, যার কথা কেউ বাড়িতে বলত না, যেন সেই নাম ছিল এক গোপন ইতিহাসের অংশ।
চিঠিটা হাতে নিয়ে দীপ্ত ফিরে আসে বন্ধুর কাছে, কিন্তু কারোর কাছে কিছু বলে না। তার ভিতরে এক অদ্ভুত অস্থিরতা জমে উঠছে—এই মেয়েটি কি সত্যিই ছিল, নাকি তার মনই এঁকে নিচ্ছে এক কল্পনার ছবি? বন্ধুরা তাকে দেখে বলে, “তুই ঠিক আছিস তো? খুব থমথমে লাগছে তোকে।” দীপ্ত কেবল হাসে। সেই রাতে শিবিরে ফেরার পর, দীপ্ত ঘুমাতে পারে না। সে চিঠিটা আবার বার করে, এবার ভালোভাবে দেখে। আলোতে দেখা যায় চিঠির একপাশে সাগরের মতো ঢেউয়ের দাগ, যেন জলেই লেখা হয়েছে সব কথা। তার মাথার মধ্যে একের পর এক স্মৃতি ভেসে উঠতে থাকে—ছেলেবেলায় তার মা কোনো কারণে একবার বলেছিলেন, “বিন্দুদি আমাদের বাড়ি ছেড়ে গিয়েছিল গঙ্গাসাগরের দিকে, ফিরে আসেনি। কেবল বলেছিল, সময়ের পেছনে ছুটে লাভ নেই।” তখন এসব কথার মানে বুঝত না দীপ্ত, কিন্তু এখন যেন সবকিছু একসূত্রে বাঁধা পড়ছে। তার মনে হচ্ছিল, সে কি সেই অতীতের এক গোপন স্মৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করছে? নাকি এই স্থানে এসে, সময় তার সঙ্গে এক অদৃশ্য খেলা খেলছে?
রাত বাড়ে, শিবিরে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, কিন্তু দীপ্ত চুপিচুপি উঠে পড়ে। সে হাতে চিঠিটা নিয়ে আবার চলে যায় সেই ঝাউবনের দিকে। কুয়াশা আবার ঘন হয়ে উঠেছে। বাতাসে সেই একই চন্দনের গন্ধ। এবং সেই কণ্ঠস্বর—“দীপ্ত… এবার সময় হয়েছে।” সে এগিয়ে যায়, আর সামনে দেখতে পায় সেই নারীমূর্তি আবার ফিরে এসেছে। কিন্তু এবার তার মুখ আরও স্পষ্ট, চোখে জল, কপালে তিলক। দীপ্ত এবার ধীরে ধীরে বলে, “তুমি কি আমার অতীত? আমার পরিবারের গোপন দুঃখ? নাকি আমি নিজেই কিছু হারানো ইতিহাস?” নারীমূর্তি হেসে বলে, “তুই নিজেকে খুঁজে নিচ্ছিস, দীপ্ত। সাগরের মতোই সময়ের গভীরে অনেক কিছু লুকানো থাকে। যা চোখে দেখা যায় না, হৃদয়ে খোঁজ নিতে হয়।”
এই কথাগুলো যেন দীপ্তর বুকের গভীরে ঢুকে যায়। সেদিন রাতটা তার কাছে হয়ে ওঠে এক অন্তর্জগতের যাত্রা। সাগরের ঢেউয়ের মতোই তার স্মৃতি, তার পরিচয়, তার অস্তিত্ব—সব যেন নড়ে ওঠে। সে বুঝতে পারে, গঙ্গাসাগর এই মেলাটুকুর চেয়েও অনেক বড় কিছু। এটা আত্মা আর সময়ের সন্ধিক্ষণ—যেখানে কিছু হারিয়ে যায়, আবার কিছু খুঁজে পাওয়া যায়।
৬
সন্ধ্যার আবছায়া নামছিল ধীরে ধীরে, আর তার সঙ্গে সঙ্গে ঘনীভূত হচ্ছিল গঙ্গাসাগরের হিমেল বাতাস। সেই মুহূর্তে শিবু আর বোনি হেঁটে চলেছিল কেওড়াতলা শ্মশানের দিকে, যেখানে স্থানীয় লোকেরা বলেছিল, কখনও কখনও “পুরোনো আত্মা” দেখা দেয় মকর সংক্রান্তির আগের রাতে। গ্রামের এক বয়স্ক পাণ্ডা, যার চোখে ছিল প্রাচীনতার ছাপ আর কণ্ঠে ছিল অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, বলেছিল, “যদি সত্যিই বন্ধু রাহুল হারিয়ে গিয়ে থাকে সময়ের ফাঁকে, তাহলে তার উত্তর এই শ্মশানেই লুকিয়ে আছে।” বোনির মনটা কেমন জানি থমথমে হয়ে ছিল—শুধু রাহুল নয়, যেন তার নিজের অস্তিত্বও কোথাও হারিয়ে যাচ্ছিল। শিবু, যার মধ্যে দিনের পর দিন এক অদ্ভুত ভার জমছিল, মনে মনে স্বীকার করেছিল, রাহুল ছিল তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীল, হয়তো সেই কারণেই সে প্রথম দেখতে পেয়েছিল স্বপ্নের সেই ‘জলঘেরা শ্বেতপুরী’।
কেওড়াতলার পথে হাঁটতে হাঁটতে চারপাশের গাছে গাছে বাতাসে ঝিরঝির শব্দ উঠছিল। শ্মশানের প্রবেশপথের আগে ছিল এক প্রাচীন বটগাছ, যার শিকড় মাটির ওপরে উঠে এসে যেন মাটির চেতনায় ঢুকে পড়েছিল। গাছের গুঁড়িতে কেউ যেন গাঢ় লাল সিঁদুর লাগিয়ে রেখেছে, আর চারদিকে জ্বলছিল ছোট ছোট প্রদীপ। হঠাৎ বোনি দেখল, একটা কালী ঠাকুরের ভাঙা মূর্তি—তার চোখ দুটো যেন তাকিয়ে আছে সরাসরি তার হৃদয়ের গভীরে। শিবু বলল, “এই শ্মশানটা আগেও এসেছি একবার, বছর দশেক আগে বাবা মারা যাওয়ার পর। কিন্তু আজকের পরিবেশটা কেমন যেন আলাদা, অনেক বেশি জীবন্ত।” তারা ভেতরে ঢুকতেই, কুয়াশার স্তর গাঢ় হয়ে উঠল, আর সেই সঙ্গে কানে এল অচেনা এক রেওয়াজ—দূর থেকে ভেসে আসা ধুনুচির গন্ধ আর ঢাকের টুপটাপ শব্দ, অথচ আশেপাশে কোনও মানুষ নেই।
ঠিক সেই সময় বোনির চোখ আটকে গেল এক শ্মশানচরীর ওপর—সে এক বৃদ্ধা, কাঁধে চাদর জড়ানো, হাতে মাটির হাড়ি। সে বসে ছিল একটা পুরোনো চিতার পাশে, যেন বহু বছর ধরে সেখানেই বসে আছে। শিবু সাহস করে এগিয়ে গিয়ে বলল, “ঠাকুরমা, আপনি কি আমাদের কিছু সাহায্য করতে পারেন? আমাদের এক বন্ধু হারিয়ে গেছে, আর কেউ বলেছে—উনি সময়ের অন্য প্রান্তে আটকে আছেন।” বৃদ্ধা তাকিয়ে বলল, “হারিয়ে যাওয়াটা কখনও কখনও পাওয়া হয়ে দাঁড়ায়। যদি তোমরা সত্যিই খুঁজে পেতে চাও, তাহলে রাত্রি শেষ হওয়ার আগে সেই ‘জলঘেরা শ্বেতপুরী’র দরজায় পৌঁছাতে হবে। গঙ্গা যেখানে কপাল ছোঁয়ায়, সেই স্থানেই সে অপেক্ষা করছে। কিন্তু মনে রেখো, সেখানে প্রবেশ করার আগে তোমাদের নিজের ছায়া ছেড়ে যেতে হবে।”
এই কথা শুনে বোনির গা ঠান্ডা হয়ে উঠল। সে বলল, “ছায়া ছেড়ে দেওয়া মানে?” বৃদ্ধা বলল, “যা তুমি ভাবো তুমি নিজে, সেটা আসলে তোমার অভ্যাসে গড়া ছায়া। সে ছায়া না ভাঙলে সত্যর মুখোমুখি হওয়া যায় না। রাহুল সেই ছায়া ভেঙেই পৌঁছেছে শ্বেতপুরীতে। এবার তোমাদের পালা।” বৃদ্ধা আর কিছু না বলে হাড়ি থেকে একটু জল ছিটিয়ে দিল বোনির কপালে—আর মুহূর্তেই তার মনে ফিরে এল সেই পুরোনো স্বপ্ন, যেখানে রাহুল বলেছিল, “আমার জন্য আসিস না, নয়তো তোরও ফেরা হবে না।” কিন্তু বোনি এবার আর থামল না। সে জানত, যদি পিছিয়ে যায়, তবে আর কখনও নিজেকে খুঁজে পাবে না।
তারা বৃদ্ধার দেখানো পথে হাঁটতে লাগল—তিনটি বটগাছ পেরিয়ে এক পুরোনো ঘাটের ধারে। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল এক পাথরের সিংহ-মূর্তি, যার চোখে ছিল শূন্যতা। ঠিক তখনই শিবু হঠাৎ বলে উঠল, “বোনি, দেখছিস তো নদীর ওই পাড়ে আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে?” বোনি তাকিয়ে দেখল, নদীর জলে যেন কোনও দূর শহরের ছায়া ভাসছে—নানান রঙের আলো, যেন এক সোনালী দ্বীপ ভেসে বেড়াচ্ছে জলের মধ্যে। সেই আলোর মধ্যে যেন রাহুল দাঁড়িয়ে, হাত বাড়িয়ে ডাকছে—চোখে জল, মুখে এক অপার্থিব প্রশান্তি।
কিন্তু সে দ্বীপে পৌঁছতে হলে তাদের পার হতে হবে এক ‘মাঝের জগত’, যেখানে সময়, স্মৃতি, ছায়া আর আত্মচেতনার সীমা মুছে যায়। শিবু একটু থেমে বলল, “তুই জানিস তো, এই যাত্রা থেকে হয়তো আমরা আর ফিরতে পারব না?” বোনি মৃদু হাসল, “যা হারিয়েছে, তা ফেরত পেতে হলে কিছু না কিছু ফেলে আসতেই হয়। আমি প্রস্তুত।” ঠিক সেই মুহূর্তে নদীর জল সরে গিয়ে দেখা দিল এক চওড়া পাথরের পথ, যা নদীর মাঝে সেই আলো ছড়ানো শহরের দিকে এগিয়ে চলেছে। তারা দু’জনে পা রাখল সেই পথে, আর পিছনে পড়ে রইল কেওড়াতলার নিস্তব্ধতা, বৃদ্ধার চোখের করুণা, আর সেই ঘন কুয়াশা যা তাদের আর কখনও গ্রাস করতে পারবে না।
এইভাবে শুরু হল তাদের নতুন যাত্রা—ছায়া ভেঙে সত্যর মুখোমুখি হওয়ার পথে, যেখানে সময় হারিয়ে গেলেও হৃদয়ের সম্পর্ক অমর হয়ে থাকে।
৭
ভোরবেলা সাগরের ধারে এসে দাঁড়াল অনিরুদ্ধ। চারপাশে হিমশীতল বাতাস আর আবছা কুয়াশার মধ্যে গঙ্গার জলধারা আর সাগরের সীমারেখা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। জনস্রোত এখনও পুরোমাত্রায় আসেনি, তবে কিছু সাধু, সন্ন্যাসী আর পুণ্যার্থীরা গঙ্গাস্নানের অপেক্ষায় ধীরে ধীরে সাগরের দিকে এগিয়ে চলেছেন। অনিরুদ্ধ একা হাঁটতে হাঁটতে পায়ের নিচে বালির ছোঁয়া অনুভব করল। হঠাৎ, ঠিক তখনই, একটা অদ্ভুত অনুভূতি হলো তার—কেমন যেন পরিচিত গন্ধ, যেন কোথাও থেকে এক মিষ্টি ধূপের গন্ধ এসে তাকে ঘিরে ধরল। সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, কেউ নেই। কিন্তু গন্ধটা যেন তার স্বপ্নের সেই দৃশ্যকে আবার ফিরিয়ে আনল, যেখানে একজন বৃদ্ধ বলছিল, “যখন সাগর তার অতীত ফিরিয়ে দিতে চায়, তখন মানুষকে তার বর্তমান ছুঁড়ে দিতে হয়…” এই কথার মানে তখন বুঝতে না পারলেও আজ যেন কিছুটা স্পষ্ট হচ্ছিল। অনিরুদ্ধ লক্ষ্য করল, দূরের জেটির একধারে শোভন দাঁড়িয়ে, তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
সে ছুটে গেল শোভনের কাছে, গলায় অনেক প্রশ্ন জমে আছে। শোভন বলল, “অনিরুদ্ধ, তুই ভাবছিস কেন আমি এমন করে গায়েব হয়ে গেলাম? আসলে এটা ঠিক হারিয়ে যাওয়া নয়। এটা ছিল একটা ডাকে সাড়া দেওয়া।” অনিরুদ্ধ অবাক হয়ে শোনে—শোভন বলছে, সে বহুদিন ধরে অনুভব করছিল যে গঙ্গাসাগরে তার অতীত জীবনের কোনো অদ্ভুত টান আছে। এই জায়গার কোথাও তার স্মৃতির ছায়া লুকিয়ে আছে। মেলায় আসার পর, যখন সবাই রাতের ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিল, তখন সেই পুরোনো স্বপ্ন তাকে আবার ডেকে নিয়ে যায়—সেই কাঠের নৌকা, সেই বয়স্ক মস্তক থেকে ঝুলে পড়া গেরুয়া চুল, আর সেই তীব্র বিস্ময়… “শুধু গঙ্গা নয়, সাগরও জানে কে কোথা থেকে এসেছে।” শোভন বলল, “তখন আমি বুঝি, আমাকে কোথাও যেতে হবে। সেই টানেই চলে গেছিলাম আমি।”
শোভনের কথায় অনিরুদ্ধ বিভ্রান্ত। “কিন্তু তুই গেলি কোথায়?” শোভন জানায়, সে এক সাধুর আশ্রমে গিয়ে পৌঁছায়, যেখানে তাকে বলা হয়—তার এই জীবন কেবল এই জন্মের নয়। গঙ্গাসাগর সেই জায়গা যেখানে সময় গলে পড়ে নদীর মতো, আর স্মৃতি হয়ে ওঠে দিগন্তে ছড়ানো সাগরের রেখা। সে জায়গাটা কোনো ভৌগোলিক স্থান নয়, সেটা এক অভিজ্ঞতার স্তর, যেখানে মানুষ তার আত্মার অতীত খুঁজে পায়। শোভন বলে, “অনিরুদ্ধ, তুই কি জানিস—তোরও সেই টান আছে? তোর স্বপ্ন, যেগুলো তুই এতদিন উপেক্ষা করেছিস, ওগুলো নিছক স্বপ্ন নয়। ওগুলো স্মৃতি। ফিরে আসার স্মৃতি।”
হঠাৎ সাগরের দিক থেকে একটা ঢেউ উঠল, যেন কারও ডাক শোনা গেল দূর থেকে। শোভন বলল, “চল, তোকে একটা জায়গায় নিয়ে যাই।” অনিরুদ্ধ দ্বিধাগ্রস্ত হলেও তার ভিতরের কৌতূহল তাকে ঠেলে নেয় শোভনের সঙ্গে। তারা হাঁটতে থাকে এক সংকীর্ণ পথ ধরে, যা মেলার মূল ভিড় থেকে আলাদা। সেই পথের দুই পাশে পুরোনো অশ্বত্থ গাছের সারি, আর তার গায়ে সাদা রঙে আঁকা কিছু তান্ত্রিক চিহ্ন। অনিরুদ্ধ লক্ষ্য করে, বাতাস ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছে, আর শোভনের মুখ আরও গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে।
পথের শেষে এসে তারা দাঁড়ায় এক ছোট্ট কাঠের ঘরের সামনে, যার দরজায় ঝোলানো আছে একটি নকুল-ফুলের মালা। ভিতরে প্রবেশ করতেই তারা দেখে এক বৃদ্ধা বসে আছেন, চোখ বন্ধ করে ধ্যানস্থ। তিনি ধীরে ধীরে চোখ খুললেন, আর অনিরুদ্ধকে দেখে একটা প্রশান্ত হাসি দিলেন। বললেন, “এতদিনে এলি…তুই ফিরে এলি… গঙ্গাসাগর তোকে ডেকেছিল, তুই শোনেনি। কিন্তু শোভন শুনেছে। ও তোকে নিয়ে এসেছে।” অনিরুদ্ধ স্তব্ধ, বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। বৃদ্ধা আবার বলেন, “তুই জানিস, গঙ্গা ও সাগরের মাঝে যে রেখা, সেটা শুধু জলের নয়, সেটা আত্মার সীমানা। তুই সেখানেই দাঁড়িয়ে আছিস এখন।”
শোভন তখন বলে ওঠে, “তুই এখান থেকে ফিরে গেলে আবার সব ভুলে যাবি। কিন্তু এখান থেকে যদি আত্মাকে ছুঁয়ে নিতে পারিস, তাহলে তুই বুঝবি—তোর জীবনের যাত্রা কেবল এই বন্ধুত্ব, এই মেলা বা সেই শহরের চাকরি নয়। কিছু একটাই অনন্ত টান আছে, যেটা মানুষকে আবার এখানে ফিরিয়ে আনে। যেমন আমাকে এনেছে, যেমন তোকে এনেছে।”
অনিরুদ্ধ ধীরে ধীরে ঘরের এক কোণে গিয়ে বসে পড়ে। বাইরের সাগরের গর্জন, গঙ্গার প্রবাহ, আর শোভনের নিঃশব্দতা সব একসঙ্গে মিশে যায় তার অন্তরে। সে জানে, এবার তার নিজের ভিতরে ডুব দেওয়ার সময় এসেছে—যেখানে বাস্তব আর স্বপ্নের মাঝখানে লুকিয়ে আছে তার নিজস্ব সাগরসঙ্গম।
৮
ভোরের আলোর মধ্যে গঙ্গাসাগরের আকাশ রঙ পাল্টাচ্ছিল ধীরে ধীরে, যেন এক অদৃশ্য হাত দিয়ে কেউ পুরো আকাশজুড়ে জলরঙে তুলির আঁচড় টেনে দিচ্ছে। শাওন বসে ছিল বেলাভূমিতে, পেছনে কাঁপা কাঁপা পালের নিচে আর পায়ের সামনে বয়ে চলেছে গঙ্গার তরঙ্গ, যে তরঙ্গ তার বুকের গভীরে কিছু কথা বলতে চাইছে। রাতের শেষ স্বপ্নটা তাকে নড়ে দিয়েছে, স্বপ্নে সে দেখেছিল—এক বৃদ্ধ সাধু তার সামনে দাঁড়িয়ে বলছে, “সবকিছু ফিরে পাওয়া যায়, যদি মন ঠিক জায়গায় থাকে।” সেই কণ্ঠস্বর যেন আগুনের মতো হৃদয়ে ছাপ রেখে গেছে। বন্ধুরা তখনও ঘুমিয়ে ছিল আশ্রমের ভেতরে, অথচ শাওন একা, জেগে, যেন সময়ের বাইরের কোনো কক্ষে এসে পৌঁছেছে। সে উঠে দাঁড়াল, তার পা ভিজিয়ে দিল ঠান্ডা জলে, আর সেই জলের মধ্যে সে অনুভব করল—এক প্রাচীন টান, যেন কারও ডাক।
অন্যদিকে ঋদ্ধি, তৃষা আর অনিকেত খেয়াল করল শাওন নেই, প্রথমে ব্যাপারটা নিয়ে হাসি-ঠাট্টা হলেও একটু পরেই তৃষা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কাল রাতেও ও ঠিকঠাক ছিল, আর সকালে এভাবে কোথাও না বলে চলে যাওয়াটা… স্বাভাবিক নয়।” তারা বালির ওপর ওর পায়ের ছাপ অনুসরণ করে এগিয়ে গেল নদীর ধারে, যেখানে শাওনের ব্যাগ, চটি আর একটা ছোট ডায়েরি পড়ে ছিল। ডায়েরির পাতায় খসখসে হস্তাক্ষরে লেখা ছিল: “আমি যাচ্ছি… যেদিকে মন টানে, স্বপ্নের উৎস খুঁজতে। যদি না ফিরি, জানো আমি অন্তত একবার চেষ্টা করেছিলাম সত্যকে ছুঁতে।” তিনজনের মুখে এক নীরব আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল, যেন এই লেখার মাঝেই লুকিয়ে আছে এমন কিছু যা তারা কোনোদিন বোঝেনি, কোনোদিন ভাবেনি।
তাদের খোঁজ শুরু হলো, প্রথমে আশেপাশের দোকান, তারপর সন্ন্যাসীদের খোঁজে যাওয়া। একজন বৃদ্ধ সন্ন্যাসী বললেন, “সেই ছেলে? ভোরে একা একা দক্ষিণের দিকে চলে গেল, যেখানে জঙ্গল শুরু হয় মন্দির ছাড়িয়ে। তার চোখে আমি দেখেছিলাম কিছু খুঁজছে—যা চোখে দেখা যায় না, কেবল অন্তরে অনুভব হয়।” অনিকেত তখন ফিসফিস করে বলল, “ও কি তাহলে সত্যিই স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে গেছে? ওর সেই অদ্ভুত সব গল্প… হয়তো কিছু সত্যি ছিল?” এ কথা শুনে ঋদ্ধি বলল, “অথবা ওর মধ্যে এমন কিছু চলছে যা আমরা কোনোদিন বুঝিনি।” তারা তিনজন দক্ষিণ দিকে রওনা দিল, যেখানে পাইন গাছ আর ঝাউয়ের জঙ্গলের মাঝে হালকা কুয়াশা মোড়া পথ, সেই পথই হয়তো নিয়ে যাবে এক হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর কাছে, অথবা হয়তো আরও গভীর রহস্যের দিকে।
শাওনের যাত্রা তখন অন্য জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে বাস্তব আর অলীক মিলেমিশে গেছে। সে হেঁটেছিল এক তীর্থপথের ভেতর দিয়ে, যেখানে বৃদ্ধরা ভজন গাইছে, কেউ কেউ কুয়োর জল তুলছে, আর এক কিশোরী তাকে দেখে বলল, “তুমি এসেছ, তোমার অপেক্ষায় ছিলাম।” শাওন থমকে দাঁড়ায়, প্রশ্ন করে, “তুমি কে?” সে হাসে, বলে, “তোমার পুরোনো স্বপ্ন।” শাওন বুঝতে পারে, সে সেই জায়গায় পৌঁছে গেছে যেখানে তার মন দীর্ঘদিন ধরে তাকে নিয়ে যেতে চাইছিল—এক রূপকথার সীমানায়, যেখানে সে হয়তো খুঁজে পাবে নিজেকে, অথবা হারিয়ে যাবে চিরতরে। গঙ্গাসাগরের সাগর, সেই অনন্ত স্রোত যেন তার ভেতরের সব প্রশ্নকে গিলে নিচ্ছে, আর ফিরে দিচ্ছে নিঃশব্দ এক আশ্বাস—যেখানে শেষ নেই, কেবল খোঁজ আছে।
৯
সাগরসঙ্গমের পবিত্র বালুচরে দাঁড়িয়ে দীপ্তর চোখে ভেসে উঠছিল সেই পুরনো স্বপ্নের চিত্রপট—এক নারী, সাদা শাড়ি পরা, চোখে অপার বেদনা আর মুখে এক রহস্যময় হাসি। সেই স্বপ্ন তাকে টেনেই এনেছে এখানে, অথচ বাস্তবে সে স্বপ্নের নারী নেই, নেই সেই পুরাতন লোহার ঘাট কিংবা খেয়াঘাটের সেই হেমন্ত বিকেল। বন্ধুরা সবাই অস্থির হয়ে দীপ্তকে খুঁজছে, কিন্তু দীপ্ত তখন ধ্যানস্থের মতো একা বসে আছেন এক বুড়ো সাধুর পাশে, যিনি ঠিক তার স্বপ্নের সেই বুড়ো—যার চোখে ছিল অতল দৃষ্টি আর কণ্ঠে গভীর নিঃশব্দতা। সাধু বললেন, “যে স্বপ্ন তোমার পথ দেখায়, সে কখনোই মিথ্যে হয় না। তবে স্বপ্নের মানে বোঝা বড় কঠিন। অনেকেই স্বপ্ন দেখে, কিন্তু তোমার মতো কয়জনই তা অনুসরণ করে?” দীপ্ত স্তব্ধ হয়ে থাকে। তার মনে পড়ে, ছোটবেলায় গঙ্গাসাগরের কথা শোনার পর থেকেই সে যেন একটা আকর্ষণে আবদ্ধ ছিল—যেন কোনো এক অপূর্ণ স্মৃতি তাকে ফিরে যেতে বলত বারবার। আজ এত বছর পরে, এত স্মৃতির ঘূর্ণি পেরিয়ে সে দাঁড়িয়েছে এই সাগরসঙ্গমে, অথচ তার প্রশ্নগুলোর উত্তর আজও স্পষ্ট নয়।
সেই সময় সূর্য ডুবতে শুরু করে। আকাশের রং ক্রমশ গাঢ় হতে থাকে, আর দীপ্তের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সাধুটির ছায়া দীর্ঘ হয়ে পড়ে বালুর উপর। হঠাৎ সাধুটি দীপ্তের হাতে একটি ছোট কাঠের বাক্স ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “তোমার উত্তর এখানে লুকিয়ে আছে। কিন্তু খোলার আগে জানতে হবে, তুমি আসলে কী খুঁজছো।” দীপ্ত বাক্সটি হাতে নিয়ে অনুভব করে এক অদ্ভুত ঠান্ডা স্পর্শ। বন্ধুরা যখন অবশেষে দীপ্তকে খুঁজে পায়, তারা অবাক হয়ে দেখে দীপ্ত পুরোপুরি বদলে গেছে—সে যেন অনেক শান্ত, চোখে এক ধরনের জ্যোতি, এক নিঃশব্দ উপলব্ধির ছায়া। রক্তিম আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে দীপ্ত বাক্সটি না খুলেই নিজের ব্যাগে রাখে, আর বন্ধুরা কিছু না জেনেও তাকে নিয়ে ফিরতে রাজি হয়। ফেরার পথে দীপ্ত শুধু একবার বলে, “সব কিছু বুঝে নিতে হয় না। কিছু কিছু অনুভব শুধু হৃদয়ে রাখতে হয়।”
ট্রেন ধরে ফেরার সময়, জানালার ধারে বসে দীপ্ত আবার সেই স্বপ্নের মুখটি মনে করে। এবার যেন সেই মুখটি হাসে না, বরং এক আত্মপ্রকাশের শান্তি নিয়ে দীপ্তকে দেখে। ট্রেনের গতির সঙ্গে সঙ্গে তার মনেও চলতে থাকে নানা ধ্যানধারণা, নানা ব্যাখ্যা। বন্ধুরা পাশেই বসে, কেউ মোবাইলে গান শুনছে, কেউ জানালায় তাকিয়ে, কেউ ঘুমিয়ে পড়েছে। অথচ দীপ্ত যেন একা এক অনন্ত যাত্রায়—যেখানে স্বপ্ন, বাস্তব, অতীত আর বর্তমান এক সূক্ষ্ম রেখায় মিলেমিশে গেছে। পেছনে ফেলে এসেছে গঙ্গাসাগরের সেই গহীন নীল জলরাশি, সেই রহস্যময় সন্ন্যাসী, আর হাতে রয়েছে সেই কাঠের বাক্স—যার উত্তর হয়ত সে আর খুলবে না। কিংবা, ঠিক সময় এলে খুলবেও। কারণ জীবনের অনেক কিছুই ঠিক সময় এলে ধরা দেয়, তার আগে নয়।
দূরে সাগরের শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে ট্রেনের শব্দে। কিন্তু দীপ্তর মনে এখনো অনুরণিত হচ্ছে সেই সাধুর কণ্ঠস্বর—“তুমি যদি নিজেকে খুঁজতে পারো, তবেই সাগরের সন্ধান সত্যি হয়।” সাগর, যেটা শুধু জলের বিশালতা নয়, সেটা এক আত্মার বিশ্রাম, এক চেতনার বিস্তার, এক প্রাচীন প্রশ্নের নীরব উত্তর। এই সাগরসঙ্গমে সে শুধু তীর্থে গিয়ে স্নান করেনি, সে আত্মা দিয়ে উপলব্ধি করেছে নিজের অস্তিত্বের গভীরতা। বন্ধুরা হয়তো ভাবছে, এটি একটি ভ্রমণমাত্র, কিন্তু দীপ্ত জানে—সে ফিরছে না, সে আসলে নতুন করে শুরু করছে। এক সাগরের গর্জনের মধ্যে তার নিজস্ব নীরবতার জন্ম হয়েছে, আর সেই নীরবতাই আজ তার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
১০
গঙ্গাসাগরের শেষ সন্ধ্যা। সূর্যাস্তের রক্তিম আলো গঙ্গার বুক ছুঁয়ে সমুদ্রে মিশছে ধীরে ধীরে, যেন আকাশ আর জলের সীমারেখা মুছে যাচ্ছে। চারপাশে মেলার ভিড় thinning হলেও এখনো কানে আসছে ঢাক-ঢোল আর পূজার ঘণ্টার শব্দ। শোভন, অনির্বাণ, তিতির, শ্রেয়া—চারজনেই বসে রয়েছে সেই পুরনো সাধুবাবার আশ্রমের কাছের বালুকাবেলায়। শুভ্র এখনো নিখোঁজ, তবে তার উপস্থিতি যেন কোথাও খুব কাছেই ছায়ার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। অনির্বাণ চুপচাপ একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে সেই সাগরের দিকে, যার ঢেউ একদিন নিয়ে গিয়েছিল তাদের পঞ্চম বন্ধুকে সেই অজানা বাস্তবের সীমান্তে। এই কয়েকদিনে তারা প্রত্যেকে বদলে গেছে—বাইরে যেমন, ভেতরেও তেমনি। তিতিরের চোখের গভীরে এখন আর কেবল উদ্দীপনা নয়, রয়েছে কিছু অদ্ভুত বিশ্বাসের ছায়া। শ্রেয়া যাকে আগে প্রতিটি তর্কে যুক্তি দিয়ে কাবু করত, সে এখন নিঃশব্দে মান্যতা দেয় অদেখা জগতের অস্তিত্বকে। আর শোভনের ভিতরের যে যুক্তিবাদী মন একসময় প্রতিটি অলৌকিকতাকে উড়িয়ে দিত, সে এখন আত্মার যাত্রাপথে বিশ্বাস রাখতে শিখেছে।
সেই সময়, এক অচেনা কণ্ঠে আবার শোনা গেল—“সব কিছুর উত্তর না মিললেও কিছু প্রশ্ন থেকেই যেতে হয়।” তারা চমকে তাকিয়ে দেখে—পুরনো সেই সাধুবাবা, যার কথা এক সময় মনে হয়েছিল কেবলই উপকথা। কিন্তু এবার তার চোখে-মুখে যেন এক চেনা আলোর আভা। তিনি ধীরে ধীরে সামনে এসে বসলেন, বললেন, “শুভ্র হারায়নি, সে খুঁজে পেয়েছে। তোমরা তাকে খুঁজে পাওনি ঠিকই, কিন্তু তার খোঁজে তোমরা যে পথ পেরিয়েছ, তা-ই তার শেষ নির্দেশ ছিল।” তখন শোভনের চোখ ছলছল করে উঠল, সে বলল, “কিন্তু বাবাজি, আমরা তো জানিই না কোথায় গেল শুভ্র, সে কি এখনো বেঁচে আছে?” সাধুবাবা হেসে বললেন, “প্রশ্নটা বেঁচে থাকার নয়, অস্তিত্বের। কিছু আত্মা এ দেহে থেকেও হারিয়ে যায়, আবার কিছু আত্মা হারিয়েও থেকে যায়। শুভ্র সেই দ্বিতীয় পথে হেঁটেছে।”
এক মুহূর্তে সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়। এরপর সাধুবাবা বললেন, “এই সাগরের বুকে যখন পূর্ণ চন্দ্র ওঠে, কিছু আত্মা ফিরে আসে প্রাচীন বন্ধনের খোঁজে। তোমরা দেখোনি, কিন্তু অনুভব করেছো। সেটা যথেষ্ট। সত্যের চেয়ে অনুভূতির শক্তি অনেক বড়।” এরপর তিনি চলে যান ভিড়ের দিকে, আবার যেন মিলিয়ে যান জনসমুদ্রে।
রাত গড়িয়ে আসে। চারজন মিলে ফিরে যায় সেই জায়গাটায়, যেখানে তারা প্রথমবার হারিয়ে ফেলেছিল শুভ্রকে। সেখানে এখনো রয়ে গেছে সেই ছোট্ট আয়নার টুকরোটা, যেটা শুভ্র প্রথম দিন কিনেছিল এক সাধুর কাছ থেকে। তিতির সেটি তুলে নেয়, আয়নার মধ্যে তারা দেখে নিজেদের প্রতিচ্ছবি, কিন্তু তাতে মিশে আছে আরেকটি ছায়া—শুভ্রর, যিনি যেন মৃদু হেসে তাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। হঠাৎ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে কাশফুলের গন্ধ, যেমনটা শুভ্র সবসময় বলত—এই গন্ধ তার ছোটবেলার কোনও স্বপ্নের সঙ্গে জড়িয়ে।
তারা চারজন ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করে, সাগরের ধারে, সেই পথে যেটা একদিন শুভ্র ধরেছিল। এবার তারা জানে, গন্তব্য নয়, পথটাই আসল। গঙ্গাসাগরের সেই মেলায়, তারা কেউ একজনকে ফিরে পায়নি, কিন্তু নিজেরাই নিজেদের এক নতুন রূপে খুঁজে পেয়েছে।
পরদিন সকালে তারা কলকাতার পথে রওনা দেয়। ট্রেন ছাড়ার আগে শেষবারের মতো তারা পিছনে তাকায়। সূর্যোদয়ের আলোয় সাগর তখন সোনালি হয়ে উঠছে, যেন এক নবজন্মের প্রতীক। শোভন নিচু গলায় বলে ওঠে, “তুমি নেই—এটা সত্যি নয়। তুমি আছো—আমাদের মাঝখানে, প্রতিটি স্বপ্ন আর বিশ্বাসে।” অনির্বাণ, তিতির, শ্রেয়া—তিনজনেই চুপচাপ সম্মতিতে মাথা নাড়ে।
“সাগরসঙ্গমের সন্ধানে” এক বন্ধুর খোঁজে যাত্রা ছিল বটে, কিন্তু শেষে দেখা যায়—এই যাত্রা আসলে নিজ নিজ আত্মার প্রতিচ্ছবি সন্ধানের কাহিনি। সাগর, স্বপ্ন আর সত্য—সব একাকার হয়ে যায় সেই সন্ধিক্ষণে, যেখানে হারানো মানেই শেষ নয়, বরং শুরু—নতুন করে উপলব্ধি, নতুন করে বেঁচে থাকার।
****
				
	

	


