Bangla - রহস্য গল্প

সাইক্লোন ফাইলস

Spread the love

অভিজিৎ জোয়ারদার


আকাশ যেন দিনের আলো গিলতে শুরু করেছে। এক অদ্ভুত চাপা অন্ধকার পুরো উপকূলজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। আবহাওয়াবিদ নিহারিকা চৌধুরী, খুলনার উপকূল গবেষণা কেন্দ্রের কন্ট্রোল রুমে বসে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছেন রাডার স্ক্রিনের দিকে। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস তার কাছে নতুন কিছু নয়, কিন্তু এবার কিছু অস্বাভাবিক। ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্র বারবার তার গতিপথ পরিবর্তন করছে— যেন কারও নির্দেশে চলছে। সাধারণত সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বা বায়ুচাপ এসব নিয়ন্ত্রণ করে সাইক্লোনের দিক, কিন্তু এবার সে নিয়ম মানছে না। উপগ্রহচিত্রে দেখা যাচ্ছে, ঝড়টি অদ্ভুতভাবে ঘনীভূত হচ্ছে, অথচ পূর্বাভাস অনুযায়ী এটি মাত্র একটি লো প্রেসার থাকার কথা ছিল। নিহারিকা তাঁর সহকর্মী সাব্বিরকে বলেন, “এই কিছু একটা গড়বড় আছে… এটা স্বাভাবিক না। এই গতিপথের পেছনে যেন কেউ আছে।” সাব্বির খানিকটা হাসলেও নিহারিকা জানেন, তার বিশ্লেষণ ভুল নয়। কেন্দ্রীয় আবহাওয়া অধিদপ্তরে সিগনাল পাঠিয়ে দেন তিনি— সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড় ‘নরদা’র নতুন গতি ও শক্তি সম্পর্কে। কিন্তু তার নিজের মধ্যেই এক অজানা শঙ্কা কাজ করে। সবকিছু যেন আগেই ঠিকঠাক সাজানো— শুধু শুরু হওয়ার অপেক্ষায়।

এদিকে শহরের এক প্রান্তে, একটি পুরনো সরকারি ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন সায়রা মিত্র, অনুসন্ধানী সাংবাদিক। তাঁর চোখে ক্লান্তি, হাতে নোটবুক, আর পিঠে ঝোলানো ব্যাগে রয়েছে ক্যামেরা ও রেকর্ডার। কলকাতা থেকে তিনি এসেছেন খুলনায়, একটি রহস্যময় দুর্নীতির ফাইল খুঁজতে। ফাইলটির নাম— “Project Nor’da”। দশ বছর আগে প্রকল্পটি চালু হয়েছিল, কিন্তু হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়, আর এরপরই শহরে ঘটে কিছু নিখোঁজ ঘটনা, অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর, যেগুলো কখনও আলোচনায় আসেনি। সায়রা এই প্রকল্পে জড়িত একটি সাবেক সরকারি কর্মচারীর সন্ধানে এসেছেন, যার নাম জহিরুল হক। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সে লোকটি হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে গেছেন কয়েকদিন আগে, আর নিখোঁজের আগের রাতে নাকি তিনি একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে ইমেইল পাঠিয়েছিলেন— কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফাঁস করার কথা বলে। সায়রা ভাবছেন, এত পুরনো একটি ফাইল নিয়ে এখনো এত গোপনীয়তা কেন? শহরজুড়ে মানুষের মধ্যে চাপা উত্তেজনা, বাজারে মাছ নেই, নৌকা তীরে। একদিকে ঘূর্ণিঝড়ের আতঙ্ক, আর অন্যদিকে প্রকৃতপক্ষে কীসের ভয় কাজ করছে মানুষের মধ্যে— সেটা বোঝা মুশকিল।

অন্যদিকে পুলিশ সুপার আরিফ রহমান ব্যস্ত তার অফিসে একটি উচ্চপদস্থ মিটিং সেরে ফিরেছেন। বৃষ্টি নামতে শুরু করেছে হালকা করে। তিনি ডেস্কে বসেই তার ইমেইল চেক করছেন, তখনই চোখে পড়ে একটি পুরনো তারিখের ইমেইল— পাঠিয়েছেন “jahirul1971@…” থেকে, সাবজেক্ট লাইনে লেখা “It was not an accident. The files are real.” মেইলটি খোলার পর দেখা যায়, মাত্র দুটো লাইন— “আপনার যা মনে আছে, সব ভুল নয়। Project Nor’da-র সত্য এখনও বেঁচে আছে। আমি শীঘ্রই বিস্তারিত পাঠাব।” আরিফ রহমান চমকে ওঠেন। ‘Nor’da’— শব্দটা তার কাছে অচেনা নয়। এক দশক আগে, তিনি একজন সহকারী পুলিশ কমিশনার ছিলেন, আর এই প্রোজেক্টের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন কিছুদিন। হঠাৎ করেই প্রোজেক্ট বন্ধ হয়ে যায়, আর তাদের বলা হয় বিষয়টি “নিরাপত্তাজনিত কারণে গোপন রাখা হবে”। কিন্তু এরপর থেকেই কিছু কাগজপত্র, কিছু মানুষ— সব হারিয়ে যেতে থাকে। এবং এখন, এই ইমেইল যেন অতীতকে আবার সামনে এনে দাঁড় করাল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে তার ডেপুটি ফারহান কবির-কে ফোন করেন, নির্দেশ দেন লোক পাঠাতে জহিরুল হকের বাসায়— এবং সাথে সাথে জানতে চান, লোকটা কোথায়, বেঁচে আছে কি না। তার অন্তরাত্মা যেন বলে ওঠে, “এই ঝড়টা শুধু প্রকৃতির না, মানুষেরও হতে পারে।” আর তখনই দূরের আকাশ বিদ্যুতের ঝলকে জ্বলে ওঠে— যেন অদৃশ্য কোনো রক্তচক্ষু নিচে তাকিয়ে আছে। সেই মুহূর্তে তারা কেউই জানতেন না, এই ঝড় শুধু ঘর-বাড়ি নয়, পুরো সত্যবোধক কাঠামোকেও ধ্বংস করতে আসছে।

বাতাসে একধরনের ভারী গন্ধ লেগে আছে — যেন কাদা, সাগরের লোনা জল, আর কোথাও যেন গোপন কিছু পচে যাওয়ার গন্ধ। খুলনার আকাশে মেঘ জমেছে পুরোপুরি, সূর্য উঁকি দেওয়ার সাহস পাচ্ছে না। শহরের রাস্তাগুলো প্রায় ফাঁকা। কেবল মাঝে মাঝে ছুটে চলা অটো, কিছু মানুষ হুড তুলে হেঁটে যাচ্ছে ব্যস্তভাবে। এই অস্বাভাবিক পরিবেশে দাঁড়িয়ে সায়রা মিত্র চুপচাপ তাকিয়ে থাকেন শহরের পুরনো আর্কাইভ বিল্ডিংয়ের দিকে। শহরে এসে দ্বিতীয় দিন চলছে, আর আজ সকালেই তিনি পেয়ে গেছেন একটি ফাইল, যার পেছনে তিনি এতদিন ছুটছিলেন। ফাইলটি ছিল ভেজা অবস্থায়, এক অজানা সূত্র থেকে তার হোটেলের দরজার নিচ দিয়ে কেউ স্লিপ করে রেখে গেছে। খোলা কাগজে মাত্র দুটি শব্দ বড় হরফে লেখা — “Project Nor’da”। নিচে হস্তাক্ষরে সংক্ষিপ্ত কিছু নোট — যেমন “2015, Sector 7-C” এবং “Test halted after Phase II failure”। সায়রার শরীরের লোম খাড়া হয়ে যায়। এই নাম, এই প্রজেক্টের অস্তিত্ব কেউ মানতেই চায়নি এতদিন। অথচ এখন যেন শহরের বাতাসেই ঘোরাফেরা করছে এ শব্দ। মনে হচ্ছে শহরটি নিজেই কিছু বলতে চায়, কিন্তু কেউ শুনছে না। হোটেলের বারান্দা থেকে তিনি দেখেন নিচে একজন মানুষ তাকিয়ে আছেন তার জানালার দিকে। লোকটি গায়ের ওপর লম্বা বৃষ্টির জ্যাকেট, মুখটা অনেকটাই ঢাকা, শুধু চোখ দুটি খোলা— আর ওই চোখে যেন প্রশ্নও আছে, আবার হুমকিও।

এদিকে শহরের দক্ষিণে, যেখানে নদীর ধারে বসবাস স্থানীয় মৎস্যজীবীদের, সেখানে আজ সকালেই অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয় এক এনজিও কর্মী রবিন ঘোষ হঠাৎ করেই মাছ ধরার ঘাটে গিয়ে উপস্থিত হন, অথচ তিনি সাধারণত প্রশাসনের এলাকায় কাজ করতেন। এক বৃদ্ধ জেলে তাকে চিনতে পেরে জিজ্ঞেস করেন, “এইখানে আবার কী কাজে?” রবিন শুধু হাসেন, বলেন “পুরোনো জায়গায় ফিরলাম একটু।” তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, তিনি ঘাটের পেছনে পুরনো একটি গুদামঘরের দরজায় কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকেন, তারপর সেখান থেকে একটি লোহার বাক্স কাঁধে নিয়ে বের হয়ে যান। কেউ ঠিক বোঝে না বাক্সে কী ছিল। বিকেলের দিকে পুলিশ সুপার আরিফ রহমান ফোনে খবর পান যে, “রবিন ঘোষ এখন শহরের পুরনো জেনারেটর পয়েন্টের কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করছেন।” পুলিশ কন্ট্রোল রুমে আরিফ ডেকে পাঠান ডিএসপি ফারহান কবির-কে এবং বলেন, “রবিন একসময় ওই প্রোজেক্টে রিপোর্টিং করত— এখন হঠাৎ ওর এমন সক্রিয়তা কিছু তো বলছে।” ফারহান বলেন, “নিশ্চয়ই কিছু আছে— আমি লোক পাঠাই।” কিন্তু আরিফ বলেন, “না, এবার নিজেই যাব। এটা অনেক দিন আগের ঋণ, এখন সময় এসেছে তার হিসেব করার।” গাড়ি নিয়ে রওনা হওয়ার সময় তার চোখে পড়ে এক পোলের গায়ে সাঁটানো পোস্টার— “দুর্যোগ শুধু প্রকৃতি নয়, মানুষও আনে ধ্বংস।” কথাটা যেন ভেতরে কেঁপে ওঠে।

সন্ধ্যা নামার ঠিক আগে সায়রা মিত্র আবার বের হন শহরের পুরনো নথি দপ্তরের দিকে। তিনি জানেন, ‘Project Nor’da’ যদি কখনো ছিল, তবে তার ছায়া অবশ্যই থাকবে কোনো সরকারি ফাইল বা রিপোর্টে। বিল্ডিংটিতে প্রবেশ করে তিনি কাগজপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়ে একটি ছেঁড়া নথির টুকরো, যাতে অর্ধেক সীল আর তার পাশে লেখা “Nor’da – Phase I Observation: Subject C.41 shows unusual resistance…” বাকিটা ছিঁড়ে গেছে। তার হাত কাঁপে। ‘Subject C.41’— মানে কি কেউ ছিল এই প্রজেক্টে মানুষের ওপর পরীক্ষা হিসেবে? ঠিক তখনই হালকা শব্দ হয় পেছন থেকে। তিনি ঘুরে দেখেন, ছায়ামূর্তির মতো এক লোক দাঁড়িয়ে, গলায় স্বর কমিয়ে বলে, “আপনি যা খুঁজছেন, তা শহর ছাড়তে দেবে না আপনাকে।” লোকটা আর কিছু না বলে চলে যায়, আর সায়রা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। তার সামনে শুধু কাগজ নয়, অতীতের পাপ, গোপন গবেষণা আর শহরের নিরবতর ঢেউ উঠছে। আকাশ তখন বিদ্যুতের চমকে একবার জ্বলে ওঠে— যেন গোপন কিছু মুহূর্তের জন্য দৃশ্যমান হয়ে পড়ে, আবার গিলে নেয় অন্ধকার। শহরজুড়ে বাতাসের গন্ধ আরও ভারী হয়— এখন যেন শুধু বৃষ্টির না, বরং ভয়, গোপনতা আর আগাম ধ্বংসের ছাপ লেগে আছে।

রাত গভীর হতেই প্রকৃতি যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলল। দক্ষিণ দিক থেকে ধেয়ে এলো এক অজানা, অমানুষিক গর্জন। আকাশ থেকে বিদ্যুৎ চমকে উঠছে বারবার, আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে বাতাসের ঝাপটা—যা যেন থামতে চায় না, বরং ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠছে। সাইক্লোন ‘নরদা’ শহরে আছড়ে পড়ে যেন কোন এক দানবের আগমন বার্তা নিয়ে। খুলনার লোকজন সাইক্লোনে অভ্যস্ত, কিন্তু এবার কিছুর আলাদা গন্ধ রয়েছে, ঠিক যেন আগেই কেউ জেনেছিল এ ধ্বংস আসবে। বিদ্যুৎ চলে যায় প্রথম ঘণ্টাতেই, মোবাইল নেটওয়ার্ক ছিন্ন, ইন্টারনেট মৃত। ঘরবাড়ির চালা উড়ে যাচ্ছে, গাছ পড়ে রাস্তায়, শহরের চারপাশে শুধু ঝড় আর ধ্বংসের শব্দ। সায়রা মিত্র তখন তার হোটেলের বাথরুমে নিজেকে লক করে রেখেছেন, ছোট্ট একটি টর্চলাইট আর ভিজে যাওয়া নথিপত্রগুলো বুকের কাছে চেপে ধরে রেখেছেন। মেঝেতে জল ঢুকছে, এবং জানালার কাচ চিড় ধরেছে—যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। তাঁর মাথায় বারবার ভেসে আসছে সেই টুকরো কাগজের কথা—“Subject C.41…”। এটি কী শুধুই গবেষণা ছিল? নাকি এর পেছনে আরও কিছু? বাইরে প্রকৃতি চিৎকার করছে, আর ভেতরে সায়রার মনে ভয় আর কৌতূহল একসঙ্গে তাণ্ডব চালাচ্ছে।

ঝড় থামতে শুরু করে ঠিক ভোরবেলায়। সূর্যের আলো নেই, তবু হালকা আভা ছড়িয়ে পড়েছে মেঘের ফাঁক দিয়ে। শহর নিস্তব্ধ, যেন সদ্য একটা যুদ্ধ পার করেছে। কুয়াশা ও ধোঁয়ায় মোড়া চারপাশে দাঁড়িয়ে আছেন পুলিশ সুপার আরিফ রহমান। তিনি নিজে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন শহরের সবচেয়ে পুরনো একটি দালান— ‘ব্লক 9’ এর দিকে। এটি একসময় ছিল সরকার অনুমোদিত একটি পরীক্ষাগার, পরে বন্ধ হয়ে যায় এবং গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। রাতের ঝড়ে এই দালানটির একাংশ সম্পূর্ণ ধসে পড়েছে। স্থানীয় লোকজন জানায়, ধ্বংসস্তূপের ভেতরে কিছু অদ্ভুত গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে, কেউ কেউ বলছে ‘মরা ইঁদুর’— কিন্তু আরিফ জানেন, তা নয়। তার সঙ্গে থাকা অফিসাররা ধ্বংসস্তূপ খনন করতে করতে হঠাৎ থেমে যায়—একটি হাত দেখা যায় ধ্বংসের নিচে। কিছুক্ষণ খুঁড়ে তোলা হয় একটি পচাগলা মৃতদেহ— পুরুষ, বয়স আনুমানিক পঞ্চাশের কাছাকাছি। শরীর প্রায় ছিন্নভিন্ন, চেহারা বোঝা যায় না, কিন্তু পাশে পড়ে থাকা একটি পকেট ডায়েরিতে লেখা নাম—”Jahirul H.”। আরিফ এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে থাকেন। এই কি সেই জহিরুল হক? যিনি তাকে সেই রহস্যময় ইমেইল পাঠিয়েছিলেন? তার পকেটে ভেজা অবস্থায় একটি ফাইলের অংশ পাওয়া যায়—ছেঁড়া পাতায় যা লেখা, তা পড়ে আরিফের মুখ বিবর্ণ হয়ে ওঠে: “Nor’da Phase II experiment failed. Memory destabilization observed. Subject may be dangerous.” এতদিন যেটা ছিল শুধুই সন্দেহ—এখন হয়ে উঠল এক নির্মম সত্য।

দুপুর নাগাদ শহর কিছুটা স্থির হয়। তবে মানুষজন এখনও ঘর থেকে বেরোয়নি, আতঙ্কে জমে থাকা বাতাসে যেন কেউ নিঃশ্বাস নিতে ভয় পাচ্ছে। হাসপাতাল ও প্রশাসনিক ভবনগুলো বিদ্যুৎ ছাড়া চলতে পারছে না, মোবাইল টাওয়ার অচল। ডিএসপি ফারহান কবির ঘটনাস্থলে পৌঁছে আরিফ রহমানের কাছ থেকে পুরো বিবরণ নেন। “জহিরুল হক এরকম জায়গায় কেন ছিলেন?”— ফারহান প্রশ্ন করে। আরিফ চুপ করে থাকেন কিছুক্ষণ, তারপর বলেন, “সে Project Nor’da-র সাথে জড়িত ছিল একসময়, মনে হচ্ছে কিছু তথ্য গোপনে এখানে এনে রেখেছিল।” ফারহান সেই নথিপত্র হাতে নিয়ে পড়ে, চোখ কুঁচকে যায়: “মেমরি ডেস্ট্যাবিলাইজেশন… সাবজেক্ট… এগুলো তো জেনেটিক এক্সপেরিমেন্টের ভাষা!” আরিফ মাথা নাড়ে। তারা জানেন, এই গবেষণার লক্ষ্য ছিল মানুষের স্মৃতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কিছু নির্দিষ্ট আচরণ পরিবর্তন করা—অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারযোগ্য মস্তিষ্ক তৈরির চেষ্টা। Phase I হয়েছিল কিছু কয়েদির উপর, Phase II-তে নাকি সাধারণ মানুষের উপর পরীক্ষা চলেছিল, কিন্তু কোনোদিন তা স্বীকার করা হয়নি। আর এখন, সেই অতীত মাটির নিচ থেকে মাথা তোলে উঠে এসেছে। ঝড়ে মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু আসলে কি মৃত্যু না খুন? কে বা কারা জানত জহিরুল কোথায় লুকিয়ে ছিলেন? কে পাঠাল সেই ভেজা নথি সায়রার হোটেলে? আর যদি এটা সত্য হয় যে “Subject C.41” এখনো জীবিত থাকে, তবে সে কোথায়?

ঘূর্ণিঝড়ের ধ্বংসস্তূপ পেরিয়ে শহর যখন একটু একটু করে স্বাভাবিক হতে শুরু করল, তখন প্রশাসনের ব্যস্ততা যেমন বাড়তে লাগল, তেমনি গোপন চাপও জমে উঠল ভিতরে ভিতরে। শহরের পুরনো গুদামঘর থেকে উদ্ধার হওয়া মৃতদেহটির পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেল—জহিরুল হক, সাবেক সরকারী কর্মকর্তা, যিনি দশ বছর আগে “Project Nor’da” নামক একটি গোপন প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন। তবে এই মৃত্যুই একমাত্র চমক ছিল না। মৃতদেহের পাশ থেকে পাওয়া একটি সিলযুক্ত প্লাস্টিক কভার, তার ভেতরে ভিজে যাওয়া কিছু পুরনো নথি— যেগুলোর কালি অনেকটাই ঝাপসা হয়ে গেছে, কিন্তু কিছু কিছু শব্দ এখনো স্পষ্ট। সেগুলোই পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য নেওয়া হয় পুলিশ সদর দপ্তরে। ডিএসপি ফারহান কবির ও তদন্তকারী দল কাঁচের গ্লাসে বসে ধীরে ধীরে সেই ফাইলগুলো বিশ্লেষণ করতে থাকে। প্রথম পাতায় লেখা — “Disaster Control & Weather Impact Study – Phase II / Secure Protocol: NDR-9.” এরপর পাতায় পাতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অদ্ভুত কোড: “C.41,” “OBS-Mind Alpha,” “Neuro-wave correction,” এবং কিছু জায়গায় “weather manipulation trial – region beta” — এই শব্দগুলো যেন আগ্নেয়গিরির মতো শান্ত পৃষ্ঠের নিচে ফুটতে থাকা বিস্ফোরণের ইঙ্গিত দেয়। আরিফ রহমান গভীর মনোযোগে সেই ফাইলের একটি পাতার দিকে তাকিয়ে থাকেন, যেখানে লেখা — “Directive suspended following Subject instability. All records sealed by Order 317-B.” এটা শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রজেক্ট ছিল না—কিছু আরও গোপন, আরও অমানবিক গবেষণা এখানে চলছিল, যা কখনোই জনসমক্ষে আনা হয়নি।

ফারহান একটি লাল কালি দিয়ে দাগানো নোটিশের দিকে ইশারা করে বলেন, “স্যার, এই ‘Order 317-B’ কোথা থেকে জারি হয়েছিল সেটা আমরা জানলে হয়তো উপরের স্তরের অনুমোদন বা রাজনৈতিক সম্পর্ক খুঁজে পাব।” আরিফ মাথা নাড়েন, তারপর বলেন, “এটা জাতীয় নিরাপত্তা পর্যায়ের আদেশ। খুব সম্ভবত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায় থেকে এই প্রকল্পটি পরিচালিত হচ্ছিল।” সেই মুহূর্তে একজন জুনিয়র অফিসার এসে বলে, “স্যার, কিছু নথির পেছনে কালো কালিতে লেখা কিছু প্যাসকোড পেয়েছি—মনে হচ্ছে কোডেড নাম।” তারা সেই কোডগুলো ট্রান্সলেট করার চেষ্টা করে—সেগুলো সাধারণ সংখ্যার ধারাবাহিক নয়, বরং প্রতিটি কোডে একটি নাম লুকানো। উদাহরণস্বরূপ, “XBT-019” থেকে পরে উদ্ঘাটন হয় যে এটি আসলে এক মৎস্যজীবীর নামের রেফারেন্স—যিনি দশ বছর আগে হঠাৎ নিখোঁজ হয়েছিলেন। ফারহান কাগজ উল্টে দেখে আরেকটি নাম: “C.41” — যা আগেও তারা পড়েছিল। এবার আর সন্দেহ থাকে না, এটি কোনও গবেষণার বিষয় ছিল না, বরং এক জীবন্ত মানুষকে সাবজেক্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। হয়তো জহিরুল এই তথ্যই ফাঁস করতে চেয়েছিলেন, হয়তো তিনিই সেই একমাত্র ব্যক্তি যিনি সব জানতেন। কিন্তু কেউ তাকে সে সুযোগ দিল না।

অন্যদিকে, সায়রা মিত্র, যিনি পুলিশি তদারকির বাইরে কাজ করছেন, একটি কপি সংগ্রহ করতে পেরেছেন সেই নথির—অজানা এক তথ্যসূত্র তাকে সাহায্য করেছে, সম্ভবত সেই রহস্যময় লোকটি যিনি আগেও তার হোটেল কক্ষে নথি সরবরাহ করেছিলেন। সায়রা সেই নথিগুলোর প্রতিটি লাইন পড়ে যাচ্ছেন, চোখে ঘুম নেই, মাথার ভেতর শব্দগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে — “mind conditioning trial,” “emotion suppression,” “controlled anxiety waves.” এই কি তবে মানুষের ভেতরের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টা ছিল? এই প্রজেক্ট কি কেবল সাইক্লোন রুখতে চেয়েছিল, না বরং মানুষের মধ্যে কৃত্রিম ভয় তৈরি করে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার পরিকল্পনা ছিল? হঠাৎ করেই তাকে মনে পড়ে যায় একটি পুরনো প্রতিবেদন—যেখানে বলা হয়েছিল, শহরের কিছু এলাকায় বিশাল শব্দে সাইরেন বাজানো হয়েছিল, এবং সেই সময় কয়েকজন মানুষ একযোগে আতঙ্কিত হয়ে গলায় দড়ি দিয়েছিল। রিপোর্টে বলা হয়েছিল, এটি “ঘূর্ণিঝড় সংক্রান্ত মানসিক চাপের প্রভাব।” এখন বুঝতে পারছেন, সেটা প্রকৃতির চাপ ছিল না—বরং সম্ভবত ‘Nor’da’-এর Phase II ট্রায়াল। এই ভয়াবহ বাস্তবতা তাকে শিউরে তোলে। এই রিপোর্ট যদি প্রকাশ্যে আসে, সরকার কেবল বিব্রতই হবে না—বরং এক ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হবে। সায়রা জানেন, তিনি সত্যের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন—তবে তার সামনে এখন বিপদের ছায়াও দ্রুত এগিয়ে আসছে।

ঘূর্ণিঝড় ‘নরদা’ থেমে গেছে কয়েকদিন আগে, কিন্তু প্রকৃত অর্থে ঝড় থামেনি— অন্তত নিহারিকা চৌধুরীর মননে ও গবেষণার পর্দায়। খুলনার আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্রের ল্যাবে বসে তিনি উপগ্রহ চিত্র, গতিপথের হিসাব ও চাপ-তাপমাত্রার ডেটা ঘেঁটে যাচ্ছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ঝড়টির প্রাথমিক অবস্থান ছিল আন্দামান সাগরের কাছাকাছি, কিন্তু যে গতিতে এবং যেভাবে এটি উপকূলের দিকে বাঁক নিয়েছে— তা কোনোভাবেই সাধারণ নিয়ম মেনে হয়নি। সবগুলো তথ্য ঘেঁটে তিনি একটি শব্দ ব্যবহার করেন নিজের নোটে— “Artificial Steering?” এটা কি সম্ভব? তার মাথায় তখন ভেসে ওঠে এক পুরনো গবেষণার কাগজ, যেখানে লেখা ছিল “Electromagnetic pressure shifts & directional modulation for cloud mass relocation”। সেই সময় এসব ছিল গবেষণার কল্পনা, বাস্তবে কোনো প্রমাণ ছিল না। কিন্তু এবার প্রমাণ যেন নিজে থেকে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি একটি বিশেষ ডেটা ট্র্যাক করেন—ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথের ঠিক কেন্দ্রবিন্দুর আশেপাশে হঠাৎ করে একটি অস্বাভাবিক মাইক্রোওয়েভ সিগন্যাল রেকর্ড হয়েছে, যা শুধুমাত্র সামরিক রেডার বা গবেষণাগার থেকেই পাঠানো হতে পারে। তার ভেতর থেকে ভয় জন্ম নেয়—এটা যদি কৃত্রিম হয়, তাহলে এর উদ্দেশ্য কী ছিল? শহরের নির্দিষ্ট কিছু এলাকা, যেমন ব্লক 9, সেক্টর 7-C, কিংবা সেই পুরনো পরীক্ষাগার—সব জায়গা কি তবে ইচ্ছাকৃতভাবে ঝড়ের মুখে ফেলা হয়েছিল?

তাকে আরও কাঁপিয়ে তোলে আরেকটি তথ্য—এই মাইক্রোওয়েভ ট্রেইলটি শেষ হয়েছে একটি বন্ধ সেনা গবেষণাগারের সীমানায়, যা বছর পাঁচেক আগে গোপন অবস্থায় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। কেন্দ্রটির নাম এখন জনসাধারণের অজানা, তবে সরকারি নথিতে যার সংকেত নাম ছিল “C.G. 41”। এই একই নাম হঠাৎ করেই অন্য এক জায়গায় উঠে আসে—সায়রা মিত্রর হাতে থাকা নথিপত্রে। সে দিন সায়রা তার হোটেলের ঘরে বসে সেই ঝড়ে ভিজে যাওয়া কাগজগুলো একে একে পড়ছিলেন। একটা পাতায় বড় হরফে লেখা ছিল: “Phase II relocation complete. Primary Subject moved to C.G. 41 for behavioral isolation.” তার কণ্ঠ শুকিয়ে আসে—এটা কি সেই সাবজেক্ট C.41? আর এই নাম ‘C.G.’ এর মানে কি তবে Central Grid বা Containment Ground? সায়রার মাথার মধ্যে তখন একসাথে জেগে ওঠে প্রশ্ন ও সম্ভাবনা—জহিরুল যাকে সাবজেক্ট বলছিলেন, যাকে নিয়ে ভয় ছড়িয়েছিল, সে এখনো কি সেই কেন্দ্রে আছে? নাকি সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে? তার খোঁজ কে রাখে? এত গোপনভাবে কোনো মানুষকে আটকে রাখা—এটা কীভাবে সম্ভব? নাকি তাকে মানুষের মতো ভাবাই ভুল হবে? তার মাথায় তখন বেজে ওঠে সেই ভিডিও ক্লিপটির দৃশ্য, যা সে কিছুদিন আগে এক হার্ডড্রাইভে পেয়েছিল, যেখানে একজন বিজ্ঞানী বলতে শোনা গিয়েছিল—“We have to terminate Subject C.41 before emotional resurgence. The brain waves are not stable anymore.”

উভয়পক্ষ — নিহারিকা ও সায়রা — তখন আলাদা পথে হেঁটে একই জায়গায় এসে দাঁড়ান। নিহারিকা সিদ্ধান্ত নেন, এই তথ্য চেপে রাখলে ভবিষ্যতে আরও বড় বিপর্যয় আসবে। তিনি সরাসরি যোগাযোগ করেন এসপি আরিফ রহমান-এর সঙ্গে। তার হাতে সব ডেটা তুলে দেন—রাডার রেকর্ড, সিগন্যাল অ্যানালাইসিস, এবং সম্ভাব্য ট্রেস রুট যা দেখায়, ঝড়ের দিক নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে কোনো নির্দিষ্ট এলাকা ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে। আরিফ সব শুনে স্তব্ধ হয়ে যান। তারপর ধীরে বলেন, “তাহলে প্রকৃতি নয়, মানুষই নিয়ন্ত্রণ করেছে এ ঝড়। আর হয়তো সেই মানুষগুলো এখনো আমাদের চারপাশে, অথচ আমরা জানিই না।” এদিকে সায়রা তাঁর অনুসন্ধানে আরও গভীরে ঢুকে পড়ে। স্থানীয় পুরনো এক নিরাপত্তা প্রহরীর মাধ্যমে জানতে পারেন, শহরের বাইরে একটি পুরনো পরিত্যক্ত গবেষণাগারে কিছুদিন আগে রাতের বেলা লোকজন প্রবেশ করেছে, আর সেখান থেকে রহস্যজনক আলো ও শব্দ পাওয়া গেছে—লোকেরা বলেছে ভূতের কারসাজি, কিন্তু সায়রা জানেন এটা কেবল শুরু। সেই গবেষণাগারের কাঁটাতারের গায়ে এখনো ঝুলে আছে একটি সাইনবোর্ড, অর্ধেক ছিঁড়ে যাওয়া—তাতে লেখা আছে “CG-41 Research Unit – No Unauthorized Access.” ভবিষ্যতের ছায়া আসলে সামনে নেই, সে এসেছে পেছন থেকে—একটা গোপন অতীতের মধ্যে থেকে, যাকে চাপা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সে নিজেই এখন উঠে এসেছে আলোয়, আর তার পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে আরও এক ভয়াবহ সত্য।

ঝড় থেমে গেলেও শহরটা যেন এখনো ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। রাস্তায় গর্ত, পিলার ভেঙে পড়েছে, বাড়িগুলোর জানালায় শুধু খোলা ফ্রেম আর ভাঙা কাচের দাগ। ডিএসপি ফারহান কবির ব্যক্তিগতভাবে বেশ কিছু ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাতে তদারকি চালাচ্ছেন, কিন্তু তার লক্ষ্য এখন স্পষ্ট—Project Nor’da-র রহস্য ভেদ করা। শহরের পুরনো ব্লকগুলোর একটিতে, যেটি একসময় উপকূল উন্নয়ন দপ্তরের মালিকানায় ছিল, সেখানেই ধসে পড়া একটি কনক্রিট বিল্ডিংয়ের নিচে পাওয়া যায় একটি অদ্ভুত দেখতে ধাতব বাক্স। সেটি উদ্ধার করে আনা হয় পুলিশের বিশেষ ফরেনসিক ইউনিটে। বাক্সটি খোলার পর বেরিয়ে আসে একটি ধুলো মাখা পুরনো হার্ডডিস্ক—যা দেখে ফারহানের অভিজ্ঞ চোখ বুঝে নেয়, এটি সাধারণ কোনো সংরক্ষিত ডেটা নয়। দ্রুত সেটিকে সংযুক্ত করা হয় একটি অফলাইন সিস্টেমে। প্রথমে কোনো রেসপন্স আসে না, কিন্তু পরে একাধিক ত্রুটির মধ্যে থেকে ভেসে ওঠে একটি ফোল্ডার—“N-Phase II / Restricted Archive”। ভিতরে রয়েছে কয়েকটি ডকুমেন্ট, এবং একটি মাত্র ভিডিও ফাইল: “Final Directive (Private).mp4”। ভিডিওটি চালু হতেই দেখা যায়, কম আলোয় মোড়া একটি কনফারেন্স রুম, যেখানে একজন প্রৌঢ় কর্মকর্তা দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর গলায় ঘন আওয়াজ, চোখে আতঙ্ক: “আমরা যদি এটা চালাই, শহরটাই শেষ হয়ে যাবে… এটা কেবল একটি পরীক্ষা নয়, এটা একটি অস্ত্র। আমরা এর নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারি, এবং কেউ জানে না তখন কী হবে। Phase II বন্ধ না করলে, মানবিক বিপর্যয় অনিবার্য।”

ফারহান ভিডিওটি বারবার দেখেন। কর্মকর্তার মুখ তাঁর কাছে পরিচিত মনে হয়, কিন্তু ঠিক মিলাতে পারেন না। সেই মুহূর্তে ঘরের আলো হালকা ঝাপসা হয়ে ওঠে—জেনারেটরের লো-ভোল্টেজ কাজ করছে। অফিসে থাকা জুনিয়র অফিসারদের বলে দেন, এই ভিডিও যেন বাইরে না যায়, এবং নিরাপত্তা কপি তৈরি করতে। এরপর তিনি ব্যক্তিগতভাবে ভিডিওটির লোকেশন ট্রেস করার চেষ্টা করেন—ফাইল প্রোপার্টিতে কিছু এনক্রিপ্টেড লোকেশন কোড পাওয়া যায়, যা খুলতে পারেন কেবল এনালিটিক্স বিশেষজ্ঞ। তিনি একজন প্রাক্তন প্রযুক্তিবিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, যার নাম সাদমান নাবিল, যিনি আগে সরকারী সাইবার ইউনিটে কাজ করতেন কিন্তু এখন আড়ালে রয়েছেন। ফারহান তাকে শহরের বাইরে একটি নির্জন জায়গায় গিয়ে দেখা করতে বলেন। সেখানে তারা হার্ডড্রাইভ নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন। সাদমান বিশ্লেষণ করে জানান, ভিডিওটি রেকর্ড করা হয়েছিল CG-41 রিসার্চ ইউনিট-এ, এবং তার IP ম্যাপিং করে বোঝা যায়, ঐ সময় কেন্দ্রটিকে মোবাইল ও স্যাটেলাইট সিগন্যাল ব্লকার দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছিল। অর্থাৎ এই প্রকল্প ছিল সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন—কোনো তথ্য বের হওয়ার উপায় ছিল না। ফারহান বুঝতে পারেন, যে শহর আজ বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে, সেটির ধ্বংস হয়তো প্রকৃতির নয়, বরং সেই গোপন ঘর থেকে ছড়িয়ে পড়া এক নিয়ন্ত্রিত বিপর্যয়—যার ছায়া এখনো রয়ে গেছে।

তবে এই অনুসন্ধান কেবল একমুখী নয়। ফারহান লক্ষ্য করেন, গত কয়েকদিন ধরে সে যেখানে যাচ্ছে, কেউ যেন তার পেছনে রয়েছে। কখনও অটো চলতে চলতেই হঠাৎ থেমে যায়, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকেরা অতিরিক্ত কৌতূহলী হয়ে তাকায়, আর মাঝে মাঝে সে ফোনে হালকা আওয়াজ শুনতে পান—যেমন রেকর্ডিংয়ের সময় পটভূমির ফিসফিসানি। প্রথমে ভেবেছিলেন কাকতালীয়, কিন্তু সাদমানও একসময় বলে ওঠে, “তুমি ফোনে যা বলো, তা বোধহয় এখন শুধু আমি না, আরও কেউ শুনছে।” এরপরই একটা রাত আসে, যখন সত্যি কিছু ঘটে। সাদমানের বাড়ির কাছেই পার্ক করা গাড়ির জানালার কাচ ভাঙা অবস্থায় পাওয়া যায়, আর ভিতরে রেখে যাওয়া একটি সাদা কাগজে লেখা ছিল: “Curiosity kills loyalty.” ফারহান তখন বুঝে যান, তিনি একা নন, আর এখন তার অনুসন্ধান কেবল তথ্যভিত্তিক নয়—এটা জীবন-মৃত্যুর খেলা। কিন্তু যত বেশি বিপদ এগিয়ে আসে, ততই তার মধ্যে একরকম জেদ জন্ম নেয়। হার্ডড্রাইভের ভিডিও, Project Nor’da-র গোপন গবেষণা, আর সেই ‘C.41’ নামক সাবজেক্ট—সব মিলিয়ে ফারহান বুঝতে পারেন, এই শহরের বুকে এখনো লুকিয়ে আছে এমন কিছু, যা যদি প্রকাশ্যে আসে, তাহলে শুধু এই শহর নয়, গোটা দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামোও নড়ে যেতে পারে। আর তিনি এখন জানেন—সত্য চাপা থাকলেও, ভাঙা শহরের নিচে ছড়িয়ে থাকা ক্লুগুলো একে একে সবকিছু গেঁথে দিচ্ছে, রহস্যের অবয়ব স্পষ্ট করে তুলছে।

পুড়তে থাকা সন্ধ্যার শহরে অস্থির বাতাসের মাঝে এসপি আরিফ রহমান নিজের অফিসের দরজা বন্ধ করে বসেছিলেন। সবার অলক্ষ্যে, ডেস্কের নিচে লুকিয়ে রাখা একটি পুরনো লোহার ট্রাঙ্ক বের করলেন। ধুলো মুছে খুলতেই বেরিয়ে আসে কিছু পুরনো ফাইল, নোট, এবং একটা চামড়ার মোড়া ডায়েরি—এইসব কিছুই তার সেই অতীতের স্মারক, যে অতীত সে বহুদিন ধরে চাপা দিয়ে রেখেছেন, বুকের মধ্যে এক নিঃশব্দ আগুন হয়ে। Project Nor’da—এই নামটি তার কাছে নতুন নয়। বরং দশ বছর আগে যখন এই প্রকল্পের নাম প্রথমবার উচ্চারিত হয়েছিল প্রশাসনের ভেতরে, তিনি তখনই ছিলেন সেই প্রাথমিক নিরাপত্তা পর্বের দায়িত্বে। তখন পদমর্যাদা ছিল অনেক নিচে, কিন্তু নিঃশব্দে ও অনুগত্যে তিনি দায়িত্ব পালন করছিলেন, না বুঝেই এক ভয়ঙ্কর যন্ত্রের অংশ হয়ে উঠছিলেন। তার চোখের সামনে CG-41 কেন্দ্রে মানুষের চিৎকার, “পরীক্ষামূলক পরিবেশ”-এর নামে আটকে রাখা কিছু ‘সাবজেক্ট’, আর গবেষণার নামে চলতে থাকা অনিয়ম—সবই একদিন একটানা দেখে এসেছেন। কিন্তু ভয়, চাকরি হারানোর আশঙ্কা, আর সত্য লুকিয়ে রাখার গোপন অভ্যেস—এসব মিলিয়ে তিনি চুপ করে গিয়েছিলেন। আজ, এক দশক পরে, শহর বিধ্বস্ত, মৃতদেহ উঠছে, আর ধ্বংসস্তূপের নিচে লুকিয়ে থাকা সেই ফাইলগুলোর শব্দ যেন আঘাত করছে তাকে—“তুমি চুপ ছিলে, আর তাই এই শহর আজ কাঁদছে।”

ডায়েরির পাতাগুলো উল্টাতে উল্টাতে তিনি থমকে যান একটি পাতায়, যেখানে ছোট করে লেখা: “Subject C.41 has breached emotional threshold. Memory reset suggested, or total termination.” তার মনে পড়ে যায় সেই রাত্রি—ঝড়ের মতো এক বৈঠক, যেখানে সেনাবাহিনীর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছিলেন, “এই সাবজেক্ট যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়, আমাদের গবেষণাটাই কাল হয়ে দাঁড়াবে।” আরিফ তখন কেবল ফাইল পাহারা দিচ্ছিলেন, কিন্তু নিজের চোখে যা দেখেছিলেন, তা কখনো মুছে যায়নি। একজন মানুষ—না, বরং এক পরীক্ষিত মনুষ্যসদৃশ অস্তিত্ব—জ্ঞান হারানোর আগে চিৎকার করে বলেছিল, “আমরা কেউই স্বেচ্ছায় এখানে আসিনি…” এই কথাগুলো তার মন থেকে মুছে যায়নি। তিনি জানতেন, CG-41 শুধু একটি পরীক্ষাগার ছিল না, সেটি ছিল একটি গোপন মনস্তাত্ত্বিক অস্ত্র তৈরির কেন্দ্র, যেখানে প্রকৃতির দুর্যোগকে নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের আচরণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যুদ্ধ-প্রযুক্তি গড়ে তোলার চেষ্টা চলছিল। সেই সময়ও তিনি কিছু ফাইল লুকিয়ে রেখেছিলেন—হয়তো নিজের মধ্যে কিছু দায়বোধ ছিল, অথবা ভবিষ্যতের কাছে জবাবদিহির প্রস্তুতি। এখন, সেই ভবিষ্যত তার দরজায় কড়া নাড়ছে।

এই অবস্থায় হঠাৎ করে এক অপ্রত্যাশিত মুখ সামনে আসে—রবিন ঘোষ। শহরের পরিচিত এনজিও কর্মী, যাকে অনেকে সমাজসেবক বলেই জানে, কিন্তু আরিফ জানতেন, সে একজন তথ্য ব্যবসায়ী। রবিন এসে বলে, “এসপি সাহেব, পুরনো সময়ের কিছু ভিডিও আমি পেয়েছি… আপনি যদি চান না সেগুলো ভাইরাল হোক, তবে একটা পুরনো বন্ধ ফাইল আবার খোলা হোক—CG-41 নিয়ে।” আরিফ চমকে যান। তিনি জানেন, রবিন ব্লাফ করছে না। তার হাতে ভিডিও থাকার সম্ভাবনাও আছে—সেটি হয়তো CG-41-এ তার আগমন, কিংবা সেই শেষ রাতের ফাইল ট্রান্সফার, যেখানে তার চোখের সামনে কিছু তথ্য লোপাট হয়েছিল। রবিন বলল, “আমি চাই, আপনি কিছু তদন্ত থামিয়ে দেন। বিশেষ করে সাংবাদিক সায়রা মিত্রকে থামান। সে যা খুঁজছে, তা আমাদের কারও জন্যই ভালো না।” আরিফের মধ্যে তখন দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। একদিকে দায়বোধ—অতীতের পাপ মোচনের ইচ্ছা, আর অন্যদিকে নিজের সম্মান, পরিবার, পদ হারানোর ভয়। কিন্তু তিনি জানেন, এই দ্বিধা যত দীর্ঘ হবে, তত বেশি রক্ত ঝরবে। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন—রবিনের ব্ল্যাকমেইল তিনি প্রকাশ্যে আনবেন না, কিন্তু নীরবে সেই প্রমাণ খুঁজবেন, যা রবিনকে চুপ করিয়ে দিতে পারে। তিনি তার পুরনো সোর্স, এক প্রাক্তন সরকারি ক্লার্কের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, যার কাছে CG-41 কেন্দ্রের প্রশাসনিক নথির ফাঁকা কপি থাকার কথা। এদিকে তার ডায়েরি ও সেই পুরনো ফাইলগুলো ডিজিটাল করে সুরক্ষিতভাবে পাঠিয়ে দেন ডিএসপি ফারহান কবির-এর কাছে। এবং প্রথমবারের মতো, আরিফ রহমান নিজের মুখে কবুল করেন—“আমি ছিলাম সেই নীরব পাহারাদার, যে জানত সব, কিন্তু বলার সাহস করত না। এখন বলব। কারণ এই দায়, আর আমি নিতে পারি না।”

রাত গভীর হতেই শহরের এক কোণায় পুরনো আর্কাইভ ভবনের গোপন গুদামঘরে বসে সায়রা মিত্র আর ডিএসপি ফারহান কবির নির্লিপ্ত চোখে একেকটা নথি ঘেঁটে চলেছেন। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে ভেজা কাগজ আর পুরনো ধুলোর গন্ধ, যেন সময় নিজেই সেখানে আটকে আছে। সায়রা হঠাৎ একজোড়া ফাইল টেনে বের করে—তার ওপরে লাল কালিতে লেখা: “PROJECT NOR’DA — Internal Review: Phase Termination”। দুজনে চুপ করে পড়ে যান। ফাইলের ভেতরে থাকা রিপোর্টগুলো একে একে খুলতে গিয়ে তারা যা পড়েন, তা তাদের নিঃশ্বাস আটকে দেয়। প্রকল্পটি ছিল না কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ প্রোগ্রাম, বরং তার বিপরীত—এটি ছিল একটি ওয়েদার ওয়েপনাইজেশন ইনিশিয়েটিভ, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল কৃত্রিমভাবে সাইক্লোন তৈরি ও পরিচালনা করে শত্রু অঞ্চলকে ধ্বংস করা। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে তারা আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল—সুনামি, সাইক্লোন বা অতিবৃষ্টি—যা একে অপরের ওপরে প্রয়োগ করে শত্রুর ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে ফেলার অপারেশন চালানো যেত।

দুই পৃষ্ঠার একটি রিপোর্টে লেখা আছে: “CG-41 Experimental Phase-III, Initiated: March 2, 20XX. Artificial Cyclone Core successfully formed under controlled ionization dome. Containment failed after 7 hours.” ঠিক তার নিচেই আরেকটি অনুচ্ছেদ: “Casualties reported: 12 confirmed dead. Among them, 4 civilian technicians, 3 meteorological researchers, and 5 experimental subjects.” সায়রার হাত কাঁপতে থাকে। সে বুঝতে পারে, এগুলো কোনো কল্পবিজ্ঞান নয়—বাস্তব, ভয়ঙ্কর বাস্তব। পরীক্ষার সময় ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছিল, এবং CG-41 কেন্দ্রের ভেতরেই ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে। মৃত্যু ঘটে একাধিক ব্যক্তির। কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত তথ্য ছিল—এই ঘটনার পর পুরো প্রকল্পকে “বাতিল” ঘোষণা করা হলেও, প্রকৃতপক্ষে Phase IV চালু হয়েছিল অন্য নামে, ভিন্ন লোকেশনে। সেই তথ্য একবারেই ফাইলের নিচের অংশে ছোট করে লেখা ছিল, “Recommend transference of technology under code: CR-9 / F.Horizon Unit.” ফারহান বুঝতে পারেন, সরকার প্রকল্পটি বন্ধ করেনি—তারা শুধু মুখোশ বদলেছে।

কিন্তু প্রশ্ন ছিল—কেন এতো বড় একটি মৃত্যুর ঘটনা চাপা পড়ে গেল? তার জবাব মেলে আরেকটি ইন্টারনাল কমিউনিকেশন মেমোতে, যেখানে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মন্তব্য: “Losses acceptable under high-priority national defense innovation. Media blackout necessary. Survivors to be relocated or erased from record.” সেই মুহূর্তে ফারহানের চোখ পড়ে আরেকটি নামের ওপর—“R. Ghosh – Field Liaison”। রবিন ঘোষ! এতদিন যাকে এনজিও কর্মী বলে মনে করা হচ্ছিল, সে আদতে প্রকল্পের মাঠ পর্যায়ের তথ্য নিয়ন্ত্রণকারী ছিল। এখন তার ব্ল্যাকমেইল, তার হঠাৎ আগমন—সবকিছুর মানে স্পষ্ট হয়। সে জানত অনেক কিছু। ফারহান এবার নিশ্চিত হন—রবিন শুধু একটি ক্লু নয়, সে প্রকল্পের প্রহরী। অন্যদিকে, সায়রা বুঝতে পারে, এই তথ্য যদি প্রকাশ্যে আসে, তাহলে প্রশাসনিক স্তর থেকে শুরু করে সামরিক গোয়েন্দা পর্যন্ত বহু মুখোশ খুলে পড়বে। কিন্তু একই সঙ্গে থাকে ভয়—যদি কেউ এই সত্য জানার আগেই তাদের থামিয়ে দেয়? এই প্রকল্প শুধু ঘূর্ণিঝড় নয়, একটি রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তি নষ্ট করে গোপনে আবহাওয়াকে অস্ত্র বানিয়ে একটি অমানবিক যুদ্ধে পরিণত করার চেষ্টা ছিল।

চুপ করে সায়রা পকেট থেকে তার ভাঙা রেকর্ডারটি বের করে ফারহানের দিকে বাড়িয়ে দেয়। “এখানে রাখুন,” সে বলে। “সব তথ্য আমরা রেকর্ড করব। এটা শুধু রিপোর্ট নয়, ইতিহাস।” তারা দুজন জানেন, তাদের সামনে এখন দুইটি পথ—চুপ থেকে নিজেদের বাঁচানো, কিংবা সত্যের মুখোমুখি হয়ে ইতিহাসে নিজেদের নাম লেখা। তারা পরেরটিই বেছে নেয়। বাইরে বাতাস তখনো থেমে যায়নি। শহর ধীরে ধীরে জেগে উঠছে ধ্বংসস্তূপ থেকে, কিন্তু তার বুকের ভেতরে যে ভয়াবহ সত্য চাপা পড়ে ছিল, তা আর বেশি দিন গোপন থাকছে না।

শহরের আকাশ যেন আবার গাঢ় হয়ে উঠছে, প্রকৃতিও অস্বাভাবিকভাবে নিস্তব্ধ। আবহাওয়া অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণকক্ষে নিহারিকা চৌধুরী বিশাল স্যাটেলাইট স্ক্রিনে তাকিয়ে ছিলেন, চোখ স্থির ও চিন্তায় পূর্ণ। সাইক্লোন ‘Erebus’—এটি প্রাকৃতিক নয়, বরং একটি প্রযুক্তিনির্ভর ইন্ডিউসড স্টর্ম, যা আবার সক্রিয় হচ্ছে, এবং এবার লক্ষ্য শুধু উপকূলীয় শহর নয়, বরং বিস্তীর্ণ জনবসতি। বিভিন্ন মডেলিং রিপোর্ট, বায়ুমণ্ডলের আয়নিক স্তরে গতি ও চাপের অদ্ভুত ওঠানামা, আর বিদ্যুৎ প্রবাহের অনিয়মিততা—সব মিলে এটি আর কোন সাধারণ দুর্যোগ ছিল না। নিহারিকা হিসেব করে দেখেন, আগামী ১৮ ঘন্টার মধ্যে এটি শহরে আঘাত হানতে পারে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ করেন ডিএসপি ফারহান কবির-এর সঙ্গে, যিনি ইতোমধ্যে CG-41 কেন্দ্রের আসল তথ্য প্রকাশ করার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিলেন। দুজনের মধ্যে সিদ্ধান্ত হয়—এইবার শুধু তদন্ত নয়, পদক্ষেপ নিতে হবে। তারা বুঝতে পারেন, প্রকৃতিকে একবার মনুষ্য হস্তক্ষেপে মোড় ঘোরানো সম্ভব হলেও, দ্বিতীয়বার সেটিকে থামানো আরও ভয়ংকর ও জটিল হতে পারে। আর এটাই সেই ‘শেষ ঝড়’—যা হয়তো প্রকৃতির প্রতিশোধ, নয়তো মানুষের লোভের শেষ পরিণতি।

নিহারিকা দ্রুত একটি ডেটা রিকনস্ট্রাকশন পদ্ধতি ব্যবহার করে CG-41 ও CR-9 কেন্দ্রের পূর্ববর্তী নিয়ন্ত্রণ প্যাটার্ন খুঁজে বের করেন। তার মতে, যদি সঠিক তাপমাত্রা, বায়ু চাপ ও আয়ন নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তাহলে সাইক্লোনটির শক্তি ছড়িয়ে দিয়ে সেটিকে ভেঙে ফেলা সম্ভব হতে পারে। কিন্তু এ কাজ করতে হলে প্রয়োজন হবে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বৈদ্যুতিক ডিভাইস, এবং সেটি রাখতে হবে নির্দিষ্ট এক ‘পয়েন্ট অফ ইনফ্লুয়েন্স’-এ, যা শহরের বাইরে, উপকূলীয় বালুভূমির মধ্যবর্তী একটি পুরনো সাবস্টেশন। ফারহান সঙ্গে সঙ্গে সেই সাবস্টেশনের দায়িত্ব নেন, আর পুলিশের একটি বিশেষ দলকে নিয়ে পৌঁছে যান সেখানে। অন্যদিকে নিহারিকা ও তার টেকনিক্যাল টিম পুরনো CG-41 ডেটা অ্যানালাইস করে ম্যানুয়াল ইমপ্যাক্ট পয়েন্ট তৈরি করে। এই পুরো প্রক্রিয়া চলাকালে সায়রা মিত্র তার সাংবাদিক পরিচয়ে শহরের সমস্ত মিডিয়াকে জড়ো করে, একটি সরাসরি সম্প্রচারে জানান দেন—“আপনাদের শহর দ্বিতীয়বারের মতো আক্রান্ত হতে চলেছে। এবার আমরা প্রস্তুত। কিন্তু আমাদের প্রয়োজন সহযোগিতা। দয়া করে শহর খালি করুন, দুর্বলদের নিরাপদ স্থানে সরান।” পুলিশ, সাংবাদিক, বিজ্ঞানী—সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শুরু হয় “Storm Evac Protocol – Red Phase”, যা আগে কোনোদিন চালু হয়নি।

ঝড়ের আগমনের ঠিক তিন ঘণ্টা আগে সবকিছু প্রস্তুত হয়। শহরের অর্ধেক মানুষ আগেই নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছেন। কিছু মানুষ এখনো অনড়—তারা হয় বিশ্বাস করতে নারাজ, নয়তো তাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। এই মুহূর্তে ফারহান এবং তার দল ঝুঁকি নিয়ে সেই সাবস্টেশনে পৌঁছে শেষবারের মতো কন্ট্রোল ডিভাইস সক্রিয় করেন। সে সময়ের তীব্র বাতাস, ক্ষিপ্রগতির বজ্রপাত আর অন্ধকার আকাশ যেন কুয়াশার মধ্যে ভয় ছড়িয়ে দেয়। নিহারিকার নির্দেশনায় তারা ম্যানুয়ালি ডিভাইসটি সেট করেন এবং ১৮০ সেকেন্ডের একটি টাইমার চালু করেন। এদিকে শহরের মাঝামাঝি কিছু এলাকা ইতিমধ্যেই জলমগ্ন, বিদ্যুৎ চলে গেছে, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। কিন্তু হঠাৎ এক মুহূর্ত আসে, যখন আকাশ বিদীর্ণ হয়ে বিদ্যুৎ নেমে আসে ঠিক সেই সাবস্টেশন জুড়ে, আর ডিভাইস সক্রিয় হয়। কয়েক মিনিটের মধ্যে স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যায়, সাইক্লোন Erebus তার দিক পরিবর্তন করছে। তার কেন্দ্রস্থল দুর্বল হয়ে পড়ে এবং শক্তি কমতে থাকে। শহর এবার বেঁচে যায় এক চুলের জন্য।

এই মুহূর্তে নিহারিকা, ফারহান ও সায়রা একসঙ্গে বসে চুপচাপ মনিটরে তাকিয়ে থাকেন। ঝড় থেমেছে। কিন্তু সবার চোখে একটাই প্রশ্ন—এই প্রযুক্তি, যা প্রাকৃতিক দুর্যোগকে অস্ত্রে পরিণত করতে পারে, তা যদি আবার ভুল হাতে পড়ে? CG-41 এর মতো প্রকল্প হয়তো নষ্ট হয়েছে, কিন্তু তার বিজ্ঞান এখনো রয়ে গেছে পৃথিবীর কোনো কোণে। তারা তিনজন সিদ্ধান্ত নেন—এই সত্য ইতিহাসে রেখে যেতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ আবহাওয়াকে যুদ্ধের ভাষায় ব্যবহার করতে না পারে। “শেষ ঝড়” হয়তো কেটে গেছে, কিন্তু তাদের যুদ্ধ এখন শুরু।

১০

সকালের সূর্য ধীরে ধীরে শহরের বুকে আলো ফেলছিল, কিন্তু সেই আলো যেন ধূলিমলিন ছিল। সাইক্লোন ‘Erebus’ পুরো শক্তিতে আঘাত না করলেও যে ক্ষতি করেছে, তা মাপা কঠিন। রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে, বহু ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত, যোগাযোগব্যবস্থা ছিন্ন—কিন্তু সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মানুষের ভেতরের বিশ্বাস। সায়রা মিত্র হাঁটছিলেন ধ্বংসস্তূপের মাঝ দিয়ে, হাতে একটি ছোট ক্যামেরা আর মাথায় হাজারো চিন্তা। শহর জানে ঝড় ছিল, কিন্তু শহর জানে না ঝড়ের জন্ম কিভাবে হয়েছিল। যে ‘Project Nor’da’ এতদিন আবহাওয়ার একটি অংশ বলেই মানুষ ধরে নিয়েছিল, সেই প্রকল্পের পেছনে ছিল সরকারের গোপন সামরিক প্রযুক্তি, যেখানে সাইক্লোনকে অস্ত্র বানিয়ে প্রতিপক্ষ ধ্বংসের পরিকল্পনা চলছিল। সায়রা তার সমস্ত তথ্য প্রমাণ, ভিডিও ফুটেজ, রিপোর্ট, সরকারি গোপন মেমো, এবং সাক্ষীদের বক্তব্য একত্র করে একটি এক্সপোজে প্রস্তুত করেন—একটা নীরব বিদ্রোহ, একা হাতে রাষ্ট্রীয় পর্দা ছিঁড়ে ফেলার সাহস। তিনি জানতেন, এটা কোনো সাধারণ রিপোর্ট নয়, এটা ইতিহাসের বিপরীতে সাঁতার কাটা।

সেই রাতেই একযোগে দেশের সব বড় মিডিয়া হাউজে, আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থায় এবং হ্যাকিং ফোরামে “Storm Weapon Files: Project Nor’da” নামের রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়। রিপোর্টে দেখানো হয় কিভাবে CG-41 নামে একটি পরীক্ষাগারে সরকার ঘূর্ণিঝড় তৈরি করে পরিচালনার পরীক্ষা চালিয়েছিল, কিভাবে একটি ব্যর্থ কেসে ১২ জনের মৃত্যু হয়, এবং কিভাবে সেই প্রজেক্টকে Phase IV নামে পুনরায় গোপনে চালানো হয়। সায়রার রিপোর্টে ফারহান কবির, নিহারিকা চৌধুরী, এমনকি সাবেক কিছু বিজ্ঞানী ও কর্মকর্তার সাক্ষাৎকারও ছিল, যারা তাদের বিবেকের তাড়নায় তথ্য প্রকাশে রাজি হয়েছিলেন। পুলিশ সুপার আরিফ রহমান-এর নাম আসে সেখানে, যিনি একসময় সেই প্রকল্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন, আর পরে নিজের নীরবতাকে ঘৃণা করে পদত্যাগ করেন। সংবাদ প্রকাশের পর দেশজুড়ে আলোড়ন তৈরি হয়—সংসদে প্রশ্ন ওঠে, বিশেষ তদন্ত কমিশন গঠিত হয়, কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা গ্রেফতার হন। শহরের লোকেরা মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেয়—কেউ ক্ষুব্ধ, কেউ আতঙ্কিত, কেউ আবার আশান্বিত। কিন্তু সবার ভিতরে জন্ম নেয় একটি নতুন চিন্তা—সরকার কি সত্যিই আমাদের রক্ষা করে, না আমরা কেবল পরীক্ষার ইঁদুর?

এক সপ্তাহ পর। শহর একটু একটু করে স্বাভাবিক হচ্ছে। বাতাসে সেই পূর্বের ভার আর নেই, কিন্তু সম্পূর্ণ হালকা নয়। সায়রা তার ছোট্ট ফ্ল্যাটে বসে রিপোর্টের পরবর্তী পর্ব নিয়ে কাজ করছিলেন। এক কাপ চা হাতে, জানালার পাশে দাঁড়িয়ে, বাইরে তাকিয়ে থাকেন তিনি। হঠাৎ তার ল্যাপটপ বেজে ওঠে—নতুন মেইল এসেছে। সাবজেক্ট লাইন: “Project Nor’da wasn’t the only one.” কোনো প্রেরকের নাম নেই, শুধু এক অদ্ভুত আইপি অ্যাড্রেস আর সংযুক্তি হিসেবে একটি পিডিএফ। সায়রার গলা শুকিয়ে আসে। মাউস ধীরে ধীরে সেই ফাইলটির ওপরে যায়। তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক নতুন শব্দ: “Aurora-V”, এবং নিচে লেখা—“Arctic Weather Amplification Unit, Site-07, Greenland Sector. Classified: Omega Priority.” তিনি চুপ করে বসে পড়েন। এত কিছুর পরও, সব কিছু শেষ হয়নি। বরং এটি ছিল কেবল শুরু। প্রকৃতি ও প্রযুক্তির যে যুদ্ধ মানুষ শুরু করেছে, তা এখনো নীরবে, ছায়ায়, অন্য কোনো প্রান্তে চলছে। সায়রা জানতেন, সত্য একবার প্রকাশ করলে তা থেমে থাকে না। তার যুদ্ধ শেষ হয়নি—শুধু রূপ বদলেছে।

সমাপ্ত

1000050024.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *