নিশীথ চক্রবর্তী
সুন্দরবনের উপকূল সবসময়ই রহস্যে ঘেরা, অর্ধেক জল আর অর্ধেক জঙ্গলের মিলিত রূপ যেন সময়ের সীমানায় দাঁড়িয়ে থাকা এক অদ্ভুত ভূমি। ভোরবেলা আকাশ যখন ধীরে ধীরে আলোকিত হয়, তখন কাদা মাটির গন্ধ আর লবণাক্ত বাতাস জেলেদের নাকে এসে লাগে, নদীর স্রোত যেন ডাকে নতুন দিনের শিকারে নামতে। রফিকুল ইসলাম সেই দিনও স্বাভাবিক নিয়মে নিজের ছোট্ট নৌকো নিয়ে বের হয়েছিল। জীবনের প্রতিদিনের লড়াই, পরিবারকে দু’মুঠো খাবার জোগানোর চিন্তা আর সমুদ্রের অনিশ্চয়তা—সবকিছু মিলে তার দিনগুলোর রং একঘেয়ে, কিন্তু এই দিনের সকালটা যেন অন্যরকম কিছু হয়ে উঠতে চলেছে। জাল ফেলার জন্য সে যখন নৌকো থেকে ভর করে দাঁড়াল, তখন নদীর পানি ছিল অস্বাভাবিকভাবে স্থির, বাতাসও যেন থেমে গিয়েছিল। প্রথমে সে ভাবল হয়তো আবহাওয়ার খেলা, হয়তো জোয়ার-ভাটার অদ্ভুত কোনো মুহূর্ত। কিন্তু জালটা যখন ধীরে ধীরে টেনে তুলছিল, তখন তার চোখে পড়ল কিছু অস্বাভাবিক ঝিকিমিকি—মনে হলো যেন গভীরের অন্ধকারের মধ্যে এক সূক্ষ্ম আলো খেলছে, মাছের আঁশের মতো ঝলকানি নয়, বরং এক স্থায়ী, স্থির আলো, যা যেন সমুদ্রের গর্ভ থেকে আসছে।
প্রথমে রফিকুল ভাবল চোখের ভুল, হয়তো পানিতে সূর্যের প্রতিফলন, কিন্তু ভোরের সূর্য তখনো পুরোপুরি ওঠেনি, আর এই আলো ছিল অনেক বেশি গাঢ়, উজ্জ্বল, আর উষ্ণতায় ভরপুর। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে তার মনে হলো পানির নিচে যেন আরেকটি সূর্য জ্বলছে, ভীষণ স্থির অথচ অসীম শক্তি ছড়াচ্ছে। সে অদ্ভুতভাবে ভয়ে কেঁপে উঠল, হাত থেকে প্রায় জালটাই ছুটে যাচ্ছিল। তাড়াহুড়ো করে নৌকো সরাতে গিয়ে সে কয়েক মুহূর্ত দ্বিধায় পড়ল—কাছে যাবে নাকি দূরে সরে যাবে? জেলেদের জীবনে সমুদ্র মানেই ভরসা আর আতঙ্কের মিশ্রণ, কিন্তু এ রকম দৃশ্য সে আগে কখনো দেখেনি। রফিকুল ধীরে ধীরে নৌকো সরিয়ে নিল, কিন্তু চোখ ফিরিয়ে নিতে পারছিল না সেই অদ্ভুত আলোর দিক থেকে। আলো যেন তাকে টানছিল, একইসঙ্গে ভয় আর কৌতূহল ছড়িয়ে দিচ্ছিল তার শরীরের প্রতিটি শিরায়। অবশেষে যখন সে গ্রামে ফিরে এলো, তার মুখ শুকনো, চোখে আতঙ্ক, আর গলায় কাঁপন। অন্য জেলেদের সে যখন ঘটনাটা বলল, তখন প্রথমে কেউ বিশ্বাস করতে চাইল না, কিন্তু রফিকুলের চোখে এমন ভয় ছিল যে তারা তার কথা হেসে উড়িয়ে দিতে পারল না।
গ্রামজুড়ে খবর ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগল না। লোকজন দল বেঁধে নদীর ধারে এসে দাঁড়াল, ভয়ে কেউ পানির কাছে গেল না, কিন্তু প্রত্যেকের মনে জন্ম নিল আতঙ্ক আর কৌতূহলের মিশেল। গ্রাম্য পুরোহিত বলল, “এটি দেবতার অভিশাপ, হয়তো আমাদের অপরাধের জন্য সাগরের তলায় আগুন জ্বলে উঠেছে।” বৃদ্ধেরা বলল, তারা জীবনে কখনো এমন কিছু দেখেনি, কিন্তু লোককথায় শুনেছে সমুদ্রের তলায় কখনো কখনো অলৌকিক শক্তি প্রকাশ পায়। তরুণেরা প্রথমে উৎসুক হলেও পরে ভয় পেয়ে পিছিয়ে দাঁড়াল। আলোটি সূর্যের মতোই স্থির ছিল, সময় গড়ালেও তা নিভল না, বরং রাতের অন্ধকার নামতেই আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। দূর থেকে দেখলেও মনে হচ্ছিল পানির নিচে যেন কোনো অগ্নিগোলক জ্বলছে, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে আশেপাশের পানি গরম হয়ে উঠছিল না, মাছও চারপাশ থেকে সরে যাচ্ছিল না। গ্রামের মানুষের ভেতরে গুজব ছড়াতে লাগল—কেউ বলল সমুদ্রের দেবী রুষ্ট হয়েছেন, কেউ বলল এটি পরলোকের সেতু, কেউ আবার ফিসফিস করে বলল এটি মানুষ নয়, অন্য জগতের কারও কাজ। রফিকুল চুপচাপ দাঁড়িয়ে সব শুনছিল, তার মনে হচ্ছিল আলোটা যেন তাকে ডাকছে, অদ্ভুত এক সম্পর্ক গড়ে উঠছে তার আর সমুদ্রগর্ভে জ্বলতে থাকা সেই অগ্নিময় আলোর মধ্যে। কিন্তু ভয় তাকে গ্রাস করছিল—কারণ সে জানত, এই রহস্য একদিন পুরো গ্রামকেই বিপদের দিকে ঠেলে দেবে।
***
ভোরবেলা কুয়াশায় ঢাকা সুন্দরবনের নদীপথে যখন সরকারি নৌযানটি ঢুকছিল, তখন গ্রামের মানুষ দূর থেকে দাঁড়িয়ে তার আগমন লক্ষ্য করছিল। ডেকে দাঁড়িয়ে ছিলেন ড. অনিরুদ্ধ সেনগুপ্ত, মাঝবয়সী একজন অভিজ্ঞ মেরিন বায়োলজিস্ট, যার চোখে কৌতূহল আর দায়িত্বের ভার মিলেমিশে এক অদ্ভুত দীপ্তি ফুটিয়ে তুলেছিল। তার পাশে ছিলেন অধ্যাপক রাঘবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, বয়সের ভারে একটু ঝুঁকে পড়া, কিন্তু মস্তিষ্কে এখনো তরুণ, একসময়ের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি জীবনের শেষভাগে এসে কোনো চূড়ান্ত আবিষ্কারের সন্ধান করতে মরিয়া। আর ছিলেন লেফটেন্যান্ট কাবেরী রায়, সুশৃঙ্খল সামরিক পোশাকে দৃঢ়চেতা, যিনি এই অভিযানের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিযুক্ত। গ্রামের দিকে তাকিয়ে তারা সবাই বুঝতে পারছিলেন, এ জায়গা শুধু গবেষণার ক্ষেত্র নয়—এখানে মানুষের বিশ্বাস, ভয় আর পুরনো কাহিনিগুলো জড়িয়ে আছে, যা কোনো ল্যাবরেটরির টেস্ট টিউবের মতো সহজে ব্যাখ্যা করা যাবে না। নৌযানটি ঘাটে পৌঁছাতেই গ্রামবাসীরা দল বেঁধে এগিয়ে এলো, কেউ কৌতূহলী, কেউ ভীত, আবার কেউ যেন আগ্রাসী ভাব নিয়ে। পুরোহিত প্রথমেই উচ্চারণ করলেন—“এই আলো মানুষের জন্য নয়, দেবতার জন্য। তোমরা যদি ওটা না ছাড়ো, তবে সর্বনাশ নামবে।” এই কথায় জনতার মধ্যে গুঞ্জন উঠল, আর অনিরুদ্ধ বুঝলেন, এখানে কাজ শুরু করার আগে সবচেয়ে বড় বাধা হবে স্থানীয়দের বিশ্বাস ভাঙা।
গবেষণা দলের সরঞ্জামগুলো ঘাটে নামানো হচ্ছিল—ডুবুরি স্যুট, সেন্সর, মাপযন্ত্র, ক্যামেরা—সব দেখে গ্রামবাসীরা আরও আতঙ্কিত হয়ে উঠল। রফিকুল, যে প্রথম আলো দেখেছিল, ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল গম্ভীর মুখে। সে নিজের চোখে যা দেখেছে তা সত্যি, কিন্তু সে ভয় পাচ্ছিল এই শহুরে মানুষগুলো আলোটাকে নাড়াচাড়া করে কোনো বিপদ ডেকে আনে। অনিরুদ্ধ এগিয়ে এসে স্থানীয়দের বোঝাতে চাইলেন—“আমরা এসেছি শুধু খতিয়ে দেখতে, কোনো ক্ষতি করার জন্য নয়। এই আলোটা কী, সেটা জানলে হয়তো তোমাদেরই উপকার হবে।” কিন্তু তার কথায় সাড়া না দিয়ে কয়েকজন তরুণ চিৎকার করে উঠল—“তুমি যদি আলোর কাছে যাও, তবে গ্রামের সর্বনাশ হবে।” তখন কাবেরী রায় এগিয়ে এসে দৃঢ় স্বরে বললেন—“আমরা দেশের পক্ষ থেকে এসেছি, তোমাদের ক্ষতি করার জন্য নয়। তোমরা শান্ত হও।” তার সামরিক কণ্ঠস্বর মুহূর্তের জন্য ভিড়কে নীরব করল, কিন্তু আতঙ্কের আগুন পুরোপুরি নিভল না। অধ্যাপক রাঘবেন্দ্র তখন গম্ভীরভাবে চারপাশ দেখে ফিসফিস করে বললেন—“লোকজন ভয়ে আছে, অথচ হয়তো এদের গ্রামের মাটিতেই মানবজাতির ভবিষ্যৎ লুকিয়ে আছে। যদি এই আলো সত্যিই শক্তির উৎস হয়, তবে কল্পনা করো পৃথিবী কীভাবে পাল্টে যাবে।” অনিরুদ্ধ সেই কথার উত্তরে শান্তভাবে বললেন—“পৃথিবী পাল্টানোর আগে এ গ্রামকেই বাঁচাতে হবে, নাহলে গবেষণার কোনো মানে থাকবে না।”
রাত নামতেই উত্তেজনা আরও বেড়ে গেল। গ্রামবাসীরা টর্চ জ্বালিয়ে নদীর ধারে ভিড় জমাল, দূরে পানির নিচে সেই রহস্যময় আলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। গ্রাম্য মণ্ডপে বৈঠক বসল, যেখানে একদিকে গবেষক দল, অন্যদিকে গ্রামের প্রবীণেরা বসে আলোচনায় অংশ নিল। কেউ বলল, “এ আলোয় মাছ কমে গেছে, বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে পড়ছে, এটা অশুভ সংকেত।” আবার কেউ ফিসফিস করে বলল, “হয়তো এটা স্বর্গ থেকে নামা কোনো উপহার।” অনিরুদ্ধ ধৈর্য ধরে বললেন—“আমরা প্রথমে শুধু পর্যবেক্ষণ করব, কোনো কিছু স্পর্শ করব না। যদি ক্ষতির প্রমাণ পাই, আমরা নিজেরাই ফিরে যাব।” মায়া মিত্র তখনো গ্রামে পৌঁছায়নি, কিন্তু তার অনুপস্থিতিতেও যেন পুরো ঘটনাটা সাংবাদিকদের উপযোগী হয়ে উঠছিল—মানুষ আর বিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব যেন এক নাটকের মতো ফুটে উঠছিল। অবশেষে বৈঠক শেষ হলো এক অস্থায়ী সমঝোতায়—বিজ্ঞানীরা গবেষণা করতে পারবে, তবে গ্রামবাসীরা নজরদারিতে রাখবে। ঘরে ফেরার পথে কাবেরী বললেন, “আমাদের এখানে শুধু যন্ত্রপাতি দিয়েই কাজ চলবে না, মানুষের মন জয় করতে হবে।” অনিরুদ্ধ নিঃশ্বাস ফেলে উত্তর দিলেন—“হ্যাঁ, আলোটা হয়তো ভিনগ্রহের, কিন্তু আসল রহস্য এখানকার মানুষের মনেই।” আর নদীর তলায় সেই আলো তখনও স্পন্দিত হচ্ছিল, যেন অপেক্ষা করছিল মানুষ আর বিজ্ঞানের সংঘাতকে আরও গভীরে ঠেলে দেওয়ার জন্য।
***
সকালের আলোয় ভেসে আসা লঞ্চ থেকে নামল মায়া মিত্র। শহরের পরিচিত টেলিভিশন সাংবাদিক, যার হাতে সবসময়ই থাকে ক্যামেরা আর নোটবুক, আর যার চোখে থাকে তীক্ষ্ণ কৌতূহল। সুন্দরবনের নিরিবিলি নদী, কাদামাটির পথ, আর গ্রামের মানুষের ভিড় তাকে অপরিচিত লাগছিল না—বরং মনে হচ্ছিল এই জায়গার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এমন কিছু গল্প, যা একদিন বিশ্বকে কাঁপিয়ে তুলবে। সে জানত, সমুদ্রগর্ভে আলো পাওয়ার ঘটনা শুধু বৈজ্ঞানিক রহস্য নয়, এটা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ধাক্কাও। তার ক্যামেরাম্যান সরঞ্জাম নামাতে ব্যস্ত, আর মায়া দাঁড়িয়ে থেকে গ্রামের মানুষদের দেখছিল—কেউ কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে, কেউ বিরক্তি নিয়ে, আবার কারও চোখে আতঙ্ক। মায়ার মনে হলো, এই গল্পটা শুধু পানির তলায় থাকা এক রহস্যময় আলোর কাহিনি নয়, বরং এখানে মানুষ কীভাবে অজানাকে উপলব্ধি করে, তারই প্রতিফলন। কিছুক্ষণ পরেই সে অনিরুদ্ধদের গবেষণা শিবিরে গিয়ে দেখা করল। অনিরুদ্ধ তাকে দেখে সামান্য অবাক হলেও, তার আগমন অনুমান করেছিল। সাংবাদিক মানেই প্রচার, আর প্রচার মানেই চাপ। কিন্তু মায়া স্পষ্টভাবে জানাল—“আমি শুধু বৈজ্ঞানিক দিকটা তুলে ধরব না। আমি চাই মানুষ দেখুক, কীভাবে এই গ্রাম ভয়, বিশ্বাস আর বিজ্ঞানের মাঝে আটকে আছে।” রাঘবেন্দ্র এক চিলতে হাসি দিয়ে বললেন—“সত্যিই, বিজ্ঞানের বাইরেও গল্প আছে।”
এরপর মায়া গ্রামজুড়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে সে একে একে মানুষের বক্তব্য নিচ্ছিল। কারও চোখে ছিল ভয়ের ছায়া—“ওটা শয়তানের আলো, আমাদের সর্বনাশ করবে।” আবার কেউ বিশ্বাস নিয়ে বলছিল—“না, এটা দেবতার আশীর্বাদ, আমাদের রক্ষা করবে।” মায়ার ক্যামেরায় ধরা পড়ছিল ভয়, আশা আর কুসংস্কারের মিশ্র ছবি। এই ভিড়ের মধ্যে সে খুঁজে পেল রফিকুলকে, সেই জেলে যে প্রথম আলো দেখেছিল। রফিকুল প্রথমে কথা বলতে চাইছিল না, কিন্তু মায়ার আন্তরিকতা ও কৌতূহল ধীরে ধীরে তাকে নরম করে দিল। নৌকোতে বসে মায়া তাকে জিজ্ঞাসা করল—“তুমি কী দেখেছিলে সেদিন?” রফিকুল গভীর দৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকিয়ে ধীর স্বরে বলল—“মনে হয়েছিল পানির নিচে সূর্য জ্বলছে। এমন আলো আমি কখনও দেখিনি। সেটা শুধু আলো নয়, মনে হচ্ছিল আমাকে ডাকছে।” মায়া তার প্রতিটি কথা নোট করছিল, চোখে ভেসে উঠছিল সম্ভাব্য দৃশ্যপট—ডকুমেন্টারির ভেতরে এক সাধারণ জেলের কণ্ঠেই যেন অজানার সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের গল্প শোনা যাবে। ক্যামেরা চালু হওয়ার মুহূর্তে রফিকুলের কণ্ঠে যে ভয় মিশে ছিল, তা দর্শকদের শিরায় শিরায় প্রবাহিত হবে বলে মায়ার বিশ্বাস হলো।
রাতে, নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে মায়া তার ক্যামেরা আলোয় নদীগর্ভের ঝলমলে দৃশ্য ধারণ করছিল। দূরে গ্রামবাসীরা প্রার্থনা করছে, কেউ মোমবাতি জ্বালাচ্ছে, আবার কেউ ভয়ে শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অনিরুদ্ধের দল তখন বৈজ্ঞানিক যন্ত্র বসাতে ব্যস্ত, আর গ্রামবাসীরা তাদের দিকে সন্দেহের চোখে দেখছে। মায়া বুঝতে পারছিল, এই দ্বন্দ্বটাই গল্পের আসল প্রাণ। সে ঠিক করল, তার ডকুমেন্টারিতে শুধু আলো বা বিজ্ঞান নয়, মানুষের ভয় আর প্রতিরোধকেও আন্তর্জাতিক মঞ্চে তুলে ধরবে। কারণ তার চোখে বৈজ্ঞানিক সত্য অর্ধেক, বাকিটা হলো সমাজের প্রতিক্রিয়া, যা অনেক সময় সত্যের থেকেও জটিল। ল্যাপটপে বসে সে প্রথম কাট সাজাতে সাজাতে ভেবেছিল—এই কাহিনি হয়তো কেবল সুন্দরবনের গ্রাম নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির। যদি সত্যিই আলোটা ভিনগ্রহী শক্তির, তবে পৃথিবী শুধু বৈজ্ঞানিক চমকেই নয়, সাংস্কৃতিক কম্পনেও কেঁপে উঠবে। মায়া একদৃষ্টিতে নদীর অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল—“তুমি কে, আর কেন এসেছো আমাদের পৃথিবীতে?” আর তার পিছনে দূর থেকে সেই আলো তখনও সমুদ্রগর্ভে শ্বাস নিচ্ছিল, ক্রমশ গাঢ়তর হয়ে উঠছিল রহস্যের আভা।
***
সকাল থেকেই গবেষণা শিবিরে অদ্ভুত এক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল। রাতভর বৈঠক শেষে অনিরুদ্ধ ও রাঘবেন্দ্র অবশেষে ঠিক করলেন, আর দেরি করা যাবে না—আজই প্রথমবার ডুব দেওয়া হবে সেই রহস্যময় আলোর দিকে। নৌকোয় সাজানো হলো ডুবুরিদের সরঞ্জাম—অক্সিজেন ট্যাঙ্ক, হেলমেট, ওয়াটারপ্রুফ ক্যামেরা, সেন্সর আর বিশেষ আলো। লেফটেন্যান্ট কাবেরী তদারকি করছিলেন প্রতিটি যন্ত্রপাতি, যেন কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে। গ্রামবাসীরা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল, কেউ প্রার্থনা করছিল, কেউ ভয়ে কেঁপে উঠছিল, আবার কেউ গোপনে আশা করছিল এ অভিযানের মাধ্যমে হয়তো রহস্যের সমাধান মিলবে। রফিকুল দাঁড়িয়ে ছিল স্থির মুখে, তার মনে হচ্ছিল আজ কিছু অঘটন ঘটবেই। অনিরুদ্ধ যখন ডুবুরিদের ব্রিফ করছিলেন, তার গলায় দৃঢ়তা থাকলেও চোখে ভেসে উঠেছিল চাপা শঙ্কা। তিনি বললেন—“আমরা শুধু পর্যবেক্ষণ করব, কোনোভাবেই যন্ত্রের কাছে গিয়ে হাত দেব না। যা দেখব, তা রেকর্ড করব। আমাদের প্রথম কাজ হলো বোঝা—আলোর উৎস আসলে কী।” রাঘবেন্দ্র, যিনি সাধারণত উচ্ছ্বসিত থাকেন, আজ অস্বাভাবিকভাবে নীরব ছিলেন। শুধু একবার ফিসফিস করে বললেন—“জীবনভর বইয়ে পড়েছি মহাবিশ্বের রহস্য, আজ মনে হচ্ছে আমরা নিজেরাই তার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছি।” এই কথায় অনিরুদ্ধ তার দিকে তাকালেন, যেন দুজনেই বোঝাচ্ছিলেন—আজকের ডুব তাদের জীবন বদলে দেবে।
নদীর মাঝখানে গিয়ে চারজন ডুবুরি পানিতে ঝাঁপ দিল, তাদের পেছনে অনিরুদ্ধ ও রাঘবেন্দ্রও স্যুট পরে নামলেন। পানির নিচে নেমেই চারদিক ভরে গেল অন্ধকারে, কেবল দূরে ভেসে উঠছিল সেই অদ্ভুত আলো, যেটা যেন ডেকে নিচ্ছিল। যত তারা এগোতে লাগল, আলো ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, আর পানির ভেতর থেকে শোনা যাচ্ছিল অদ্ভুত কম্পন—মনে হচ্ছিল সমুদ্রের বুকে কেউ নিঃশ্বাস ফেলছে। ডুবুরিদের হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছিল, হেলমেটের ভেতর দিয়ে তাদের দ্রুত শ্বাস নেওয়ার শব্দ ভেসে আসছিল। অনিরুদ্ধ ওয়াটারপ্রুফ ক্যামেরা দিয়ে দৃশ্য ধারণ করতে লাগলেন। হঠাৎই তাদের সামনে দেখা দিল এক বিশালাকার কাঠামো—যা দেখতে ধাতবের মতো, কিন্তু জ্যান্ত কিছুর মতো নড়ছে। তার ভেতর থেকে আলো বের হচ্ছে, আর পৃষ্ঠদেশে ছোট ছোট ফোঁটা উঠানামা করছে, যেন শ্বাস নেওয়ার মতো। দৃশ্যটা এতটাই অবিশ্বাস্য ছিল যে, মুহূর্তের জন্য সবাই থমকে গেল। রাঘবেন্দ্র কাঁপা গলায় বললেন—“এটা কোনো প্রাকৃতিক বস্তু নয়… এ যেন এক জীবন্ত যন্ত্র।” অনিরুদ্ধ কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলেন, চোখ স্থির হয়ে ছিল সেই কাঠামোর দিকে। ডুবুরিদের একজন হাতের ইশারায় ফিরে আসতে বলল, কিন্তু অন্যরা এগিয়ে গিয়ে যন্ত্রের ত্বকের মতো অংশে হাত বুলিয়ে দেখতে চাইছিল। ঠিক তখনই হালকা এক কম্পন ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে, পানি ফেনিয়ে উঠল, আর মনে হলো যন্ত্রটা যেন তাদের উপস্থিতি টের পেয়েছে।
ভয়ে সবার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। অনিরুদ্ধ তৎক্ষণাৎ ইশারা করলেন—“ফিরে যাও!” সবাই দ্রুত ভেসে উঠতে লাগল, কিন্তু পেছন থেকে সেই আলোকিত কাঠামো যেন অদৃশ্য চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। উপরে উঠে আসার পর সবাই হাপিয়ে উঠেছিল, কারও হাত কাঁপছিল, কারও মুখে আতঙ্ক জমে ছিল। গ্রামবাসীরা তীরে দাঁড়িয়ে তাদের অবস্থা দেখে গুঞ্জন শুরু করল—“ওরা অশুভ শক্তিকে বিরক্ত করেছে!” রাঘবেন্দ্র চুপচাপ বসে ছিল, তার চোখে বিস্ময় আর ভয়ের মিশ্রণ। অনেকক্ষণ পর সে শুধু বলল—“এটা নিছক যন্ত্র নয়, এটা যেন প্রাণ আর প্রযুক্তির মিশ্রণ। আমি ভাবতেও পারছি না এ কিসের সৃষ্টি।” অনিরুদ্ধ মাথা নিচু করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন—“আজ আমরা প্রথমবার জানলাম, আমরা যা খুঁজছি তা শুধু রহস্য নয়, ভয়ংকর এক বাস্তবতা। এই যন্ত্রটা যেন আমাদের পর্যবেক্ষণ করছে, আমাদের উপস্থিতি অনুভব করছে।” সবাই চুপ করে বসে রইল, কেবল পানির নিচ থেকে ভেসে আসছিল মৃদু আলো, যেন বলছিল—এখনও অনেক কিছু অজানা রয়ে গেছে। সেই রাতেই শিবিরে অস্বস্তির ছায়া নেমে এল—প্রথমবার গবেষণা দলের ভেতরে জন্ম নিল ভয়, আর সবাই বুঝতে পারল, সমুদ্রের তলায় তারা যা খুঁজে পেয়েছে, তা শুধু বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।
***
ডুব থেকে ফিরে আসার পর রাতটা প্রায় নিদ্রাহীন কাটল। ভেজা কাপড়ে বসে থাকা ডুবুরিদের চোখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট, কিন্তু বিজ্ঞানীরা তখনও তাদের নোট, ভিডিও আর সংগৃহীত নমুনার দিকে ব্যস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে। সকালে ঘুম ভাঙতেই অধ্যাপক রাঘবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় অস্থির হয়ে উঠলেন। তিনি সারারাত ভিডিও রেকর্ডিং ঘেঁটে যন্ত্রটির আলোর ধরণ, কম্পন ও শক্তির প্রবাহ বিশ্লেষণ করেছেন। ক্যাম্পের ছোট্ট ল্যাবরেটরিতে বসে তিনি যন্ত্রপাতির সাহায্যে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও বিকিরণ মেপে দেখলেন—এটা কোনো পরিচিত শক্তির ধরণ নয়। আলোটা সাধারণ সৌরশক্তি বা তেজস্ক্রিয় বিকিরণ নয়, বরং এমন এক অচেনা তরঙ্গ, যা ক্রমাগত পরিবর্তনশীল এবং জীবন্ত কিছুর মতো ছন্দে স্পন্দিত হচ্ছে। রাঘবেন্দ্র তার খাতা ভরে ফেলছিলেন সমীকরণ, গ্রাফ আর পর্যবেক্ষণে। হঠাৎই উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন—“এই শক্তি পৃথিবীর কোনো পরিচিত জ্বালানি প্রযুক্তির সঙ্গে মেলে না। এটা যদি সত্যিই কাজে লাগানো যায়, তবে মানবজাতির শক্তি সংকট ইতিহাস হয়ে যাবে।” তার কণ্ঠে উত্তেজনা এতটাই স্পষ্ট ছিল যে, শিবিরে উপস্থিত সবাই মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেল। অনিরুদ্ধ চিন্তিত মুখে তাকিয়ে ছিলেন, জানতেন রাঘবেন্দ্রের আবিষ্কার যতটা আশার আলো জ্বালাচ্ছে, ততটাই ভয়ংকর এক প্রশ্নও ছুঁড়ে দিচ্ছে—এই শক্তির উৎস আসলে কী, আর কে বা কারা এটি তৈরি করেছে।
এরপর থেকে শিবিরে যেন দুইটি মতামত গড়ে উঠল। একদিকে ছিলেন রাঘবেন্দ্র, যার চোখে এই যন্ত্র মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ। তিনি মনে করছিলেন, পৃথিবীর তেল, কয়লা, গ্যাস—সব ফুরিয়ে যাচ্ছে, শক্তি সংকট ক্রমশ ভয়াবহ হয়ে উঠছে। আর এখানে, সুন্দরবনের সমুদ্রগর্ভে, হয়তো লুকিয়ে আছে সেই সমাধান, যা মানবজাতিকে নতুন যুগে প্রবেশ করাবে। তার কণ্ঠে বারবার ভেসে আসছিল আশাবাদ—“ভাবুন তো, এক অক্ষয় শক্তির ভাণ্ডার যদি আমাদের হাতে আসে! যুদ্ধ থামবে, দারিদ্র্য কমবে, মানুষ নতুন করে স্বপ্ন দেখতে পারবে।” অন্যদিকে অনিরুদ্ধ অনেক বেশি সতর্ক। তিনি জানতেন অজানা শক্তি নিয়ন্ত্রণে আনা সহজ নয়। ইতিহাসের প্রতিটি যুগে মানুষ নতুন শক্তি আবিষ্কার করেছে, কিন্তু সেই শক্তিই অনেক সময় সর্বনাশ ডেকে এনেছে। পারমাণবিক শক্তি যেমন বিদ্যুৎ দিয়েছে, তেমনি বোমাতেও রূপান্তরিত হয়েছে। অনিরুদ্ধের চোখে আলোটা ছিল এক রহস্যময় অস্ত্র, যা হয়তো সভ্যতাকে উদ্ধার করবে, অথবা ধ্বংসের দ্বার উন্মোচন করবে। কাবেরী ছিলেন মাঝামাঝি অবস্থানে—তিনি সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবছিলেন। তার মনে হচ্ছিল, যদি এই যন্ত্র কোনো ভিনগ্রহী সভ্যতার হয়, তবে সেটি হয়তো পর্যবেক্ষণ করছে, এমনকি আক্রমণের পূর্বাভাসও হতে পারে। মায়া মিত্র, তার ক্যামেরা হাতে, নীরবে সবকিছু লিপিবদ্ধ করছিল। তার কাছে ঘটনাটি শুধু বৈজ্ঞানিক গবেষণা নয়, বরং এক মানবিক নাটক—আশা, ভয়, লোভ আর দোটানার গল্প।
দিনের পর দিন পরীক্ষা চলতে লাগল। রাঘবেন্দ্র ছোট ছোট সেন্সর বসিয়ে বুঝতে পারলেন, যন্ত্র থেকে নির্গত শক্তি শুধু আলো ও তাপ নয়, বরং অজানা কণার স্রোত। এরা জীবন্ত প্রাণীর স্নায়ু তরঙ্গের মতো ছন্দে ওঠানামা করে, যেন যন্ত্রটি নিজেই জীবন্ত। তিনি একটি তুলনা টানলেন—“এটা যেন সূর্য আর হৃৎপিণ্ডের মিশ্রণ। একদিকে সূর্যের মতো সীমাহীন শক্তি, অন্যদিকে হৃৎপিণ্ডের মতো স্পন্দন।” শুনে সবার শরীর কেঁপে উঠল। প্রশ্ন উঠল—যন্ত্রটা কি কেবল শক্তির ভাণ্ডার, নাকি এক ভিনগ্রহী প্রাণীর শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতো কিছু? অনিরুদ্ধ নীরবে বললেন—“যদি এটা জীবন্ত হয়, তবে আমরা এক অচেনা জীবকে হাত দেওয়ার চেষ্টা করছি।” এই কথার পর গ্রামবাসীদের মধ্যে ভয় আরও বেড়ে গেল। তারা বলতে লাগল—“ওরা দানবকে জাগিয়ে তুলেছে!” আর বৈজ্ঞানিক দলের ভেতরেও এক অদ্ভুত টানাপোড়েন শুরু হলো—কেউ ভাবছিল শক্তির মুক্তি, কেউ আতঙ্কে পিছু হটতে চাইছিল। রাতের অন্ধকারে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ত, তখনও সমুদ্রগর্ভ থেকে আসত আলো আর নিঃশ্বাসের মতো কম্পন, যেন যন্ত্রটা জীবন্ত থেকে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আছে। মায়া তার ডায়েরিতে লিখল—“আমরা কি সত্যিই এক নতুন সূর্যের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, নাকি এমন এক রহস্যের সামনে, যা মানবজাতিকে চিরতরে বদলে দেবে?” সেই প্রশ্নের উত্তর তখনও অজানা রয়ে গেল, কিন্তু সবাই জানত—এ রহস্য একদিন ভয়ংকর সত্যে রূপ নেবে।
***
রাতটা ছিল অদ্ভুতভাবে ভারী, যেন আকাশ থেকে ঝরে পড়া অদৃশ্য কোনো বোঝা পুরো গ্রামকে চেপে ধরেছে। সুন্দরবনের উপকূলীয় ছোট্ট জেলে গ্রামটিতে হঠাৎ করেই ছড়িয়ে পড়ল ভয়ের শিহরণ। ভোরের আগে নদীর ঘাটে গিয়ে লোকজন দেখল—শত শত মাছ ভেসে উঠেছে পানির ওপর, নিথর হয়ে। যারা মাছ ধরার জন্য নদীতে নামতে গিয়েছিল, তাদের চোখে পড়ল পানির তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে, হাত ডোবালেই মনে হচ্ছে যেন গরম পুকুরে ডুব দেওয়া হয়েছে। লোকজনের মুখে মুখে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল—“সমুদ্র রেগে গেছে, আলো আমাদের অভিশাপ দিয়েছে।” সেই আতঙ্ক আরও গভীর হয়ে উঠল যখন জানা গেল—রাতে তিনজন অভিজ্ঞ জেলে, যারা জাল ফেলতে গিয়েছিল, আর ফিরে আসেনি। তাদের নৌকা ভেসে এসেছে, কিন্তু মানুষগুলো নেই। নৌকার কাঠে অদ্ভুত পোড়া দাগ, আর জালের সুতো গলে গিয়ে শক্ত হয়ে গেছে। গ্রামবাসীরা কান্নায় ভেঙে পড়ল, আবার কারও চোখে শঙ্কা জমে উঠল। রফিকুল, যিনি প্রথম আলো দেখেছিলেন, গ্রামের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বললেন—“আমি বলেছিলাম, ওটা আমাদের জন্য নয়। আমরা সূর্যকে সমুদ্রের নিচে নামিয়েছি, এখন সে আমাদের রাগ দেখাচ্ছে।” তার কথায় ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষ আরও কেঁপে উঠল। অনেকেই তখন গবেষণা দলের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে লাগল—“ওরাই সমুদ্রকে বিরক্ত করেছে, ওরাই আলো জাগিয়েছে।”
শিবিরে বৈজ্ঞানিক দলের পরিবেশও তখন উত্তপ্ত। অনিরুদ্ধ ও কাবেরী খবর শুনেই ঘটনাস্থলে গেলেন। নদীর পানিতে ডুব দিয়ে তারা কিছু নমুনা সংগ্রহ করলেন। দেখা গেল পানির তাপমাত্রা আশপাশের তুলনায় প্রায় দশ ডিগ্রি বেশি, আর তার ভেতর অজানা ধরনের বিকিরণ প্রবাহিত হচ্ছে। রাঘবেন্দ্র তথ্য বিশ্লেষণ করে বললেন—“এটা স্পষ্টতই সেই যন্ত্রের বিকিরণের প্রভাব। শক্তির প্রবাহ কোনোভাবে নদীর জলকে প্রভাবিত করছে।” তার যুক্তি ছিল বৈজ্ঞানিক, কিন্তু গ্রামবাসীরা শুনতে রাজি হলো না। তাদের চোখে এটা অশুভ আত্মার অভিশাপ। এই নিয়ে প্রথমবার গ্রামবাসী ও বৈজ্ঞানিক দলের মধ্যে প্রকাশ্যে সংঘাত দেখা দিল। মানুষজন ঢিল হাতে দলটার দিকে এগোতে চাইছিল, তখন কাবেরী গম্ভীর কণ্ঠে বললেন—“আমরা এখানে সাহায্য করতে এসেছি, ক্ষতি করতে নয়।” পরিস্থিতি সামলাতে কষ্ট হলেও, ভেতরে ভেতরে গবেষণা দলের মধ্যেও অস্থিরতা জমতে লাগল। রাঘবেন্দ্র বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা খুঁজছিলেন, অনিরুদ্ধ সন্দেহ করছিলেন যন্ত্রের ভেতরে হয়তো কোনো অজানা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় হচ্ছে। কিন্তু মায়া, যিনি নিরপেক্ষভাবে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিলেন, তার মনে হচ্ছিল কেবল বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে সব ধরা যাচ্ছে না। রাতে ক্যামেরা হাতে নদীর ধারে বসে তিনি অদ্ভুত এক ছায়ামূর্তি দেখলেন পানির ওপর ভাসছে, যেন ধোঁয়ার মতো গড়গড়িয়ে উঠে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। তিনি ভয় পেয়ে গেলেন, কিন্তু পরক্ষণেই দৃশ্যটা মিলিয়ে গেল। সে ডায়েরিতে লিখল—“আলো শুধু শক্তি ছড়াচ্ছে না, বরং ছায়াও ছড়িয়ে দিচ্ছে। হয়তো আমরা এমন কিছুর মুখোমুখি হচ্ছি, যা প্রযুক্তি আর রহস্যের মাঝামাঝি।”
দিনের পর দিন গ্রামে মৃত্যুভয় আর আতঙ্ক ঘনীভূত হতে লাগল। রাতে কারও সাহস হচ্ছিল না নদীর ধারে যাওয়ার। জাল ফেলা বন্ধ হয়ে গেল, গ্রামবাসীরা খাবারের সংকটে পড়তে শুরু করল। মানুষজন একে অপরকে দোষারোপ করছিল—কেউ বলছিল বৈজ্ঞানিকরা অভিশাপ ডেকে এনেছে, কেউ বলছিল রফিকুলই প্রথম দেখে তাদের দুর্ভাগ্য ডেকে এনেছে। অনিরুদ্ধ চেষ্টা করছিলেন তথ্য দিয়ে বোঝাতে—“এটা বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া, যন্ত্রের বিকিরণের কারণে ঘটছে।” কিন্তু তার গলায় দৃঢ়তা যতই থাকুক, চোখে অস্বস্তি ধরা পড়ছিল। তিনিও জানতেন, কিছু একটা ব্যাখ্যার বাইরে ঘটছে। রাতে গবেষণা শিবিরে ঘুম আসছিল না কারও। চারদিকে মশালের আলো, কিন্তু দূরে নদীর ওপারে হঠাৎ হঠাৎ ভেসে উঠছিল অদ্ভুত ছায়া, কখনও মানুষের মতো, কখনও অচেনা কোনো প্রাণীর মতো। বাতাসে ভেসে আসছিল এক অচেনা গন্ধ, যেন ধাতু পোড়া আর নোনা জলের মিশ্রণ। মায়া মিত্র নীরবে ক্যামেরা চালু রেখেছিলেন, আশা করছিলেন প্রমাণ ধরতে পারবেন, কিন্তু যা ধরা পড়ছিল তা ছিল অস্বচ্ছ, অস্পষ্ট ছায়া, যাকে বিজ্ঞান দিয়ে বোঝানো যায় না। সে ভয়ে কেঁপে উঠে লিখল—“আমরা হয়তো এমন কিছুর মুখোমুখি হচ্ছি, যা কেবল শক্তির উৎস নয়, বরং এক ভিনগ্রহী ছায়ার উপস্থিতি।” সেই মুহূর্তে সবাই বুঝল—আলোর আবির্ভাব যতটা আশা জাগিয়েছিল, এখন তা ততটাই ভয়ের ছায়া হয়ে পুরো গ্রামকে গ্রাস করছে।
***
রাত যত গড়াচ্ছিল, সমুদ্রগর্ভ থেকে আসা সেই রহস্যময় আলোর ছন্দও যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। অনিরুদ্ধ প্রথম বিষয়টি খেয়াল করলেন। তিনি ডুবুরিদের ক্যামেরায় ধরা যন্ত্রটির ফুটেজ বারবার ঘুরিয়ে দেখছিলেন। আলোটা নিছক একটানা উজ্জ্বল নয়, বরং এক অদ্ভুত ছন্দে স্পন্দিত হচ্ছে। কখনও তা দ্রুত, কখনও ধীর, আবার কখনও বিরতি দিচ্ছে। তার বৈজ্ঞানিক চোখে বিষয়টা পড়ল একেবারেই এলোমেলো নয়, বরং সুপরিকল্পিত কোনো ধারা। তিনি টেবিলে কাগজ-কলম রেখে আলো-স্পন্দনের সময় মেপে লিখতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণ পরই তার মাথায় এলো—এটা হয়তো সংকেত। স্পন্দনগুলো মানুষের চোখে স্রেফ ঝলকানি, কিন্তু বাস্তবে হয়তো কোনো ভাষা, কোনো বার্তা। ভেতরে ভেতরে অনিরুদ্ধ শিহরিত হচ্ছিলেন। এ যে হতে পারে মানব ইতিহাসের প্রথম ভিনগ্রহী যোগাযোগের চেষ্টা। তিনি দলের বাকিদের ডাকলেন। রাঘবেন্দ্র কৌতূহলী চোখে তথ্যগুলো দেখলেন, তার বৈজ্ঞানিক মস্তিষ্ক মুহূর্তে জেগে উঠল। তিনি বললেন—“এটা মর্স কোডের মতো… আলো দিয়ে বার্তা পাঠানো হচ্ছে।” শিবিরে তখন এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এল। চারপাশে শুধু জঙ্গলের শব্দ, দূরের নদীর ঢেউ, আর কাগজে কলমের খসখস। সবাই বুঝল, তারা এক বিশাল আবিষ্কারের কিনারায় দাঁড়িয়ে।
কাবেরী রায় ছিলেন সবচেয়ে বাস্তববাদী। সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তিনি জানতেন, কোনো সংকেত মানেই যোগাযোগের চেষ্টা, আর যোগাযোগ মানেই বার্তা—যা বন্ধুত্বপূর্ণও হতে পারে, আবার হুমকিস্বরূপও হতে পারে। তিনি তৎক্ষণাৎ তাদের যোগাযোগ যন্ত্র বের করলেন। ছোট্ট পোর্টেবল রিসিভারে তিনি আলো-স্পন্দনের ছন্দকে রূপান্তর করতে চেষ্টা করলেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর অবশেষে যন্ত্রে অদ্ভুত এক শব্দ ধরা পড়ল—একটি নিরবচ্ছিন্ন কম্পন, মাঝে মাঝে ছেদ পড়ছে, আবার মিলছে। রিসিভারের শব্দ যেন মানবকণ্ঠের ভাষা নয়, কিন্তু তাতে এমন এক তাল আছে, যা নিছক প্রাকৃতিক নয়। কাবেরী শোনার পর বললেন—“এটা বার্তা। কেউ কথা বলছে।” পুরো দল মুহূর্তেই স্নায়ু-যুদ্ধে জড়িয়ে গেল। যদি সত্যিই এটা কোনো ভিনগ্রহী সভ্যতার সংকেত হয়, তবে প্রশ্ন উঠছে—তারা কাকে ডাকছে? পৃথিবীকে? নাকি পৃথিবীর কারও জন্য অপেক্ষা করছে? মায়া মিত্র ক্যামেরা চালু করলেন, কণ্ঠ কাঁপছিল কিন্তু চোখে ছিল অদম্য দৃঢ়তা। তিনি ফিসফিস করে বললেন—“আজ ইতিহাস লেখা হচ্ছে। মানবজাতি প্রথমবার ভিনগ্রহীদের ডাক শুনছে।” অনিরুদ্ধ ও রাঘবেন্দ্র আলো-স্পন্দনকে সংখ্যায় রূপান্তর করতে লাগলেন। তারা বুঝলেন বার্তাটি নিছক এলোমেলো নয়, বরং এক পুনরাবৃত্তি—যেন কারও নাম ধরে ডাকা হচ্ছে, অথবা কোনো সিগন্যাল পৃথিবীর ভেতর কারও কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ছুটে আসছে।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিশ্লেষণ শেষে দলের ভেতরে আতঙ্ক ও বিস্ময়ের মিশ্র অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল। রাঘবেন্দ্র বললেন—“আমরা যদি বার্তাটি ভাঙতে পারি, তবে জানতে পারব যন্ত্রটি কার। হয়তো এটা সাহায্যের আবেদন, হয়তো কোনো নির্দেশ।” অনিরুদ্ধের কণ্ঠ গম্ভীর—“অথবা সতর্কবার্তা।” কাবেরীর চোখে ঝিলিক ফুটল। তিনি বললেন—“আমি সামরিক জীবনে অনেক সংকেত বিশ্লেষণ করেছি। এর ধারা দেখে মনে হচ্ছে না এটা নিছক বন্ধুত্বপূর্ণ শুভেচ্ছা। বরং এর ভেতরে এক ধরনের তাড়না আছে, যেন কেউ অধীর আগ্রহে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছে।” তাদের চারপাশে তখন গ্রামবাসীদের ভয় আরও গভীর হয়ে উঠছে। মাছ মারা যাচ্ছে, নিখোঁজের ঘটনা বাড়ছে, আর মানুষজন বিশ্বাস করছে “আলো দানব” তাদের অভিশাপ দিচ্ছে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক দলের চোখে বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা জানে এই আলো শুধু এক যন্ত্র নয়, বরং এক বার্তাবাহক। মায়া তার ডায়েরিতে লিখল—“এটা কেবল সমুদ্রগর্ভের রহস্য নয়, এটা এক ভিনগ্রহের ডাক। হয়তো তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছে, অথবা আমাদের অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দিতে চাইছে। তবে ভয়টা অন্য জায়গায়—যদি এই ডাকটা আসলে পৃথিবীর কারও জন্য হয়, আর আমরা কেবল অনিচ্ছাকৃত সাক্ষী?” সেই রাতে শিবিরে আর কারও ঘুম এল না। রিসিভার থেকে আসা কম্পন, আলো থেকে আসা স্পন্দন আর চারপাশে ছায়ার ভুতুড়ে উপস্থিতি মিশে গিয়ে এক ভীতিকর অথচ ইতিহাসগড়ার মুহূর্ত তৈরি করেছিল। তারা জানত, এই আবিষ্কার আর তাদের জীবনে ফিরে যাওয়ার পথ রাখবে না—মানবসভ্যতা এখন ভিনগ্রহের সঙ্গে এক অদ্ভুত সেতুবন্ধনের শুরুতে দাঁড়িয়ে।
***
সুন্দরবনের নিস্তব্ধ প্রকৃতিতে খবর পৌঁছাতে দেরি হলো না। যন্ত্রের অস্তিত্ব, আলোয়ের স্পন্দন, আর ভিনগ্রহী বার্তার গুঞ্জন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল সরকারি মহল থেকে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে। প্রথমে গোপন রাখার চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু একবার ফাঁস হয়ে গেলে তা আর থামানো গেল না। গবেষণা শিবিরের চারপাশে তখন সামরিক তৎপরতা বেড়ে গেল। হেলিকপ্টারের গর্জন, ভারী অস্ত্র হাতে সেনাদের চলাফেরা—পুরো গ্রাম যেন এক অদৃশ্য যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হলো। আন্তর্জাতিক কর্পোরেশনগুলোও ছায়ার মতো সক্রিয় হলো। তারা দূত পাঠাচ্ছিল, গোপনে প্রস্তাব দিচ্ছিল, বিপুল অর্থ আর সুবিধার বিনিময়ে যন্ত্রটির গবেষণা দখল করতে চাইছিল। অনিরুদ্ধ সেই দৃশ্য দেখে শিউরে উঠলেন। তিনি জানতেন, মানবজাতির ইতিহাসে যত বড় আবিষ্কারই হোক না কেন, লোভই তার সর্বনাশ ডেকে এনেছে। তিনি ঠান্ডা গলায় বললেন—“এই যন্ত্র যদি ভুল হাতে পড়ে, পৃথিবীকে রক্ষা করার বদলে ধ্বংস ডেকে আনবে।” মায়া একমত হলো। তার চোখে যন্ত্রটা শুধু বিজ্ঞান নয়, বরং এক মহাজাগতিক রহস্য, যা অপরিণত মানবলোভের জন্য উন্মুক্ত হওয়া বিপজ্জনক। কিন্তু রাঘবেন্দ্র তখন অন্য সুরে কথা বলছিলেন। তাঁর চোখে যন্ত্রটা ছিল মুক্তির প্রতীক। তিনি বলছিলেন—“এটা শক্তির ভবিষ্যৎ। মানুষ আর অন্ধকারে থাকবে না, যুদ্ধ করবে না জ্বালানির জন্য। আমাদের দায়িত্ব এই প্রযুক্তি মানবজাতির হাতে তুলে দেওয়া।” তাঁর যুক্তি ছিল দৃঢ়, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার কণ্ঠে এক অদ্ভুত তাড়না জমে উঠছিল—যেন তিনি নিজেকেও বোঝাচ্ছেন, আবার নিজের মধ্যে চাপা লোভকেও আড়াল করছেন।
এই ভিন্নমত ধীরে ধীরে দ্বন্দ্বে রূপ নিল। দলের ভেতরেই বিভাজন তৈরি হলো। কাবেরী, যিনি সবসময় শৃঙ্খলা বজায় রাখতে চাইতেন, বুঝলেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে। তিনি স্পষ্ট করে বললেন—“আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যন্ত্রটা আমরা কার হাতে তুলে দেব।” অনিরুদ্ধ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন—“কাউকেই না। এখনই না। আমরা প্রস্তুত নই।” কিন্তু রাঘবেন্দ্র তার কথার মাঝেই বাধা দিয়ে উঠলেন—“তুমি ভুল করছ। ইতিহাস কাউকে অপেক্ষা করে না। এটা আমাদের সুযোগ।” মায়া তাঁর দিকে তাকিয়ে বলল—“আপনি নিশ্চিত তো, আপনি ইতিহাসের কথা ভাবছেন, নিজের নয়?” রাঘবেন্দ্রের চোখ চকচক করল, কিন্তু তিনি চুপ রইলেন। দলের ভেতরের উত্তেজনা আরও বাড়ল যখন আন্তর্জাতিক কর্পোরেশনের এক দূত গোপনে রাঘবেন্দ্রকে প্রস্তাব দিল। বিশাল অঙ্কের অর্থ, খ্যাতি, গবেষণাগারের অবারিত সুযোগ—সবকিছু তার জন্য প্রস্তুত ছিল, যদি সে যন্ত্রটির গোপন তথ্য তাদের হাতে তুলে দেয়। রাঘবেন্দ্র দ্বিধাগ্রস্ত হলেও তাঁর ভেতরের লোভ মাথা তুলল। তিনি ভাবতে লাগলেন, এটাই তাঁর জীবনের মোড় ঘোরানোর মুহূর্ত। হয়তো তিনি হয়ে উঠবেন সেই বিজ্ঞানী, যিনি মানবজাতিকে ভিনগ্রহী প্রযুক্তি উপহার দিলেন। কিন্তু একইসঙ্গে তাঁর মাথায় প্রশ্ন জাগল—এই প্রযুক্তি সত্যিই মুক্তি বয়ে আনবে, নাকি মানবজাতিকে অচেনা অন্ধকারে ঠেলে দেবে?
অন্যদিকে অনিরুদ্ধ ও মায়া বুঝতে পারছিলেন, তাদের সময় ফুরিয়ে আসছে। সরকারের চাপ বাড়ছে, সেনাদের সংখ্যা বাড়ছে, আর আন্তর্জাতিক কর্পোরেশনগুলো ক্রমেই ভয়ংকর হয়ে উঠছে। তারা জানত, যদি দ্রুত কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়া হয়, তবে যন্ত্রটি আর তাঁদের হাতে থাকবে না। অনিরুদ্ধ রাতে মায়ার সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনায় বললেন—“এটা শুধু বিজ্ঞান নয়, এটা শক্তি। মানুষ এখনো এই শক্তি সামলাতে পারবে না। তারা এটাকে অস্ত্র বানাবে।” মায়া গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিল—“তাহলে আমাদের কি করতে হবে? ধ্বংস করে দেব?” দুজনেই জানত, ধ্বংস করা মানেই মানবজাতিকে হয়তো এক মহাজাগতিক সত্য থেকে বঞ্চিত করা। আবার এটিকে দখলে রাখতে গেলে নিশ্চিতভাবেই লোভ, রাজনীতি আর যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়বে। কাবেরী নীরবে তাদের কথা শুনছিলেন। সামরিক মানসিকতায় তিনি জানতেন, যন্ত্রটা যে কারও হাতে পড়ুক না কেন, সেটা শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠবে শক্তির প্রতীক। আর শক্তি মানেই দ্বন্দ্ব। সেই রাতে শিবিরে কেউ ঘুমোতে পারল না। ভেতরে ভেতরে প্রতিটি মানুষ দ্বন্দ্বে ভুগছিল—এটা কি মুক্তির আলো, নাকি সর্বনাশের আগুন? রাঘবেন্দ্রের চোখে তখন ভবিষ্যতের স্বপ্ন—মানবজাতি শক্তিশালী হয়ে উঠছে তাঁর হাত ধরে। অনিরুদ্ধের চোখে তখন ভয়—মানবজাতি ধ্বংস হচ্ছে নিজের হাতে। আর মায়ার চোখে ছিল প্রশ্ন—ভিনগ্রহীরা আসলে কী চেয়েছিল? তারা কি সত্যিই পৃথিবীকে সাহায্য করতে চেয়েছিল, নাকি এক অদৃশ্য ফাঁদ পেতেছিল, যেখানে মানুষ নিজের লোভেই জড়িয়ে যাবে?
***
সুন্দরবনের নিস্তব্ধ রাত হঠাৎ করেই যেন বিদীর্ণ হয়ে গেল। সমুদ্রগর্ভ থেকে আসা আলোটি হঠাৎ এতটাই তীব্র হয়ে উঠল যে চারপাশের জলে এক অস্বাভাবিক উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে পড়ল। দূর থেকে মনে হচ্ছিল, সমুদ্রের তলদেশে যেন একটি দ্বিতীয় সূর্য জন্ম নিয়েছে। আলো শুধু বাড়ছিল না, তার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছিল এক অদ্ভুত গর্জন, যা মাটির ভেতর দিয়ে গ্রামে পর্যন্ত কাঁপন তুলে দিচ্ছিল। রাঘবেন্দ্র বিস্মিত কণ্ঠে ফিসফিস করে বললেন—“এটা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় হয়েছে।” অনিরুদ্ধের কণ্ঠ কাঁপছিল—“না, হয়তো এটা নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে।” হঠাৎ করেই জোয়ার অস্বাভাবিকভাবে ফুলে উঠতে শুরু করল। নদীর পানি স্রোতের বেগে গ্রাম অভিমুখে ছুটে এল। গাছপালা ভেঙে পড়তে লাগল, ঘরবাড়ি ভেসে যেতে লাগল, মানুষ আতঙ্কে চিৎকার করতে করতে পালাচ্ছিল। গ্রামবাসীরা বিশ্বাস করল, সমুদ্রই অভিশাপ নেমে এনেছে, আর এই যন্ত্রই তার কারণ। মায়া ক্যামেরা চালু রাখতে চেষ্টা করল, কিন্তু পানির প্রবল স্রোত আর বাতাসের গর্জন তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দিচ্ছিল না। তার মনে হচ্ছিল, হয়তো এই যন্ত্রের ভেতরে এমন শক্তি রয়েছে যা সমুদ্রের স্বাভাবিক ভারসাম্যকে ভেঙে দিচ্ছে। সমুদ্র যেন ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে, আর তার প্রতিক্রিয়ায় প্রকৃতি মানবজাতিকে আঘাত করছে।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে কাবেরী রায় দায়িত্ব নিলেন নেতৃত্বের। তাঁর সঙ্গে থাকা নেভির দল মুহূর্তের মধ্যে উদ্ধারকাজে নেমে পড়ল। তারা নৌকা নামাল, দড়ি ছুঁড়ল, মানুষজনকে পানির স্রোত থেকে টেনে তুলে আনতে লাগল। তবুও অনেককে বাঁচানো যাচ্ছিল না—স্রোতের বেগ এতটাই প্রবল ছিল যে শক্তপোক্ত নৌকাগুলোও টাল খেয়ে উল্টে যাচ্ছিল। কাবেরী নিজে বুক সমান পানিতে নেমে কয়েকজন শিশুকে টেনে তুলে আনলেন। তাঁর চোখে তখন শুধু একটাই উদ্দেশ্য—প্রাণ বাঁচানো। একই সময়ে বৈজ্ঞানিক দলের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ল। রাঘবেন্দ্র উন্মত্তের মতো চিৎকার করে বলছিলেন—“এটা থামাতে হবে, নাহলে পুরো অঞ্চল ধ্বংস হয়ে যাবে।” কিন্তু অনিরুদ্ধ জোর দিয়ে বললেন—“আমরা থামাতে পারব না, এটা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এখন শুধু মানুষ বাঁচাও।” উত্তাল সমুদ্রের গর্জন, বজ্রপাতের মতো আলোর ঝলকানি আর মানুষের আর্তনাদ মিশে এক ভয়াবহ দৃশ্য তৈরি করেছিল। মায়া সেসবই ক্যামেরায় ধরে রাখছিল—তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল, কিন্তু সেটি চোখের জল না ঝড়ো জলের ফোঁটা, সে বুঝতে পারছিল না।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা এই দুর্যোগ চলতে লাগল। গ্রামগুলো পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছিল, সুন্দরবনের অগণিত পশুপাখি ভেসে যাচ্ছিল, গাছের শেকড় উপড়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল সমুদ্র এক অদম্য ক্রোধ নিয়ে সবকিছু ধ্বংস করে দেবে। শিবিরের যন্ত্রপাতি ভেসে যাচ্ছিল, টেন্টগুলো ছিঁড়ে উড়ে যাচ্ছিল। অনিরুদ্ধ দাঁতে দাঁত চেপে ভাবছিলেন—“এটাই কি ভিনগ্রহীদের উদ্দেশ্য ছিল? এই শক্তি আসলে ধ্বংসের জন্যই তৈরি?” রাঘবেন্দ্র হাহাকার করে বলছিলেন—“না, এটা প্রযুক্তি, এটা মুক্তি! আমরা নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছি, ওরা চায়নি এমনটা।” কিন্তু কারও যুক্তি, কারও হাহাকার কিছুই থামাতে পারছিল না সমুদ্রের এই উন্মত্ত রূপ। কাবেরী একবার তাকিয়ে দেখলেন, আলোটা যেন আরও গভীরে ডুবে যাচ্ছে, কিন্তু সেই সঙ্গে তার স্পন্দন দ্রুততর হচ্ছে—যেন সে কারও সঙ্গে যোগাযোগের শেষ চেষ্টা করছে। কাবেরী তখন নিজের মনেই বললেন—“এটা লড়ছে। হয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চালু করছে, নয়তো আমাদের সবাইকে শেষ করে দিয়ে যাবে।” উদ্ধারকাজ চলতে লাগল প্রাণপণ লড়াইয়ের মতো। মানুষের চোখে ভয়ের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছিল এক প্রশ্ন—এটা কি প্রকৃতির ক্রোধ, নাকি ভিনগ্রহের কোনো যন্ত্রের ব্যর্থতা? রাত শেষে, যখন সমুদ্র কিছুটা শান্ত হলো, তখন সুন্দরবনের চেহারা বদলে গিয়েছিল। ভাঙা ঘরবাড়ি, মৃত মাছ আর ভেসে আসা মৃতদেহের স্তূপ যেন সাক্ষ্য দিচ্ছিল—যন্ত্রটির শক্তি শুধু আশীর্বাদ নয়, মহা অভিশাপও হতে পারে। আর যারা সেই রাত বেঁচে গেল, তাদের চোখে ভাসছিল শুধু এক চিত্র—এক অদ্ভুত আলোর উৎস, যা সমুদ্রের গহীনে অজানা ক্রোধে এখনও স্পন্দিত হচ্ছে।
***
রাতের ভয়াবহ সমুদ্রের ক্রোধ থেমে যাওয়ার পর সকালবেলায় সুন্দরবন যেন এক শ্মশানভূমির মতো নিস্তব্ধ হয়ে ছিল। গাছপালা উপড়ে গেছে, নদীর ধার মুছে গেছে, গ্রামবাসীর কান্না আর হাহাকার বাতাসে ভেসে আসছে। নেভি উদ্ধারকাজ চালাচ্ছে, কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি এতটাই ব্যাপক যে মনে হচ্ছিল গোটা অঞ্চলটিই যেন মুছে গেছে। এই বিপর্যয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল সেই আলো—যা এখনো সমুদ্রগর্ভে জ্বলজ্বল করছে, আগের চেয়ে হয়তো কিছুটা ম্লান হলেও তার মধ্যে ছিল অদ্ভুত এক স্পন্দন। সবাই বুঝতে পারছিল, এই আলোই ছিল সর্বনাশের কারণ, আর সেটিই আবার মানুষের ভবিষ্যতের সবচেয়ে বড় সম্ভাবনাও। বৈজ্ঞানিক দলের শিবিরে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে, কিন্তু সেই নিস্তব্ধতার ভেতরেও উত্তপ্ত তর্ক চলছিল। রাঘবেন্দ্র অগ্নিদীপ্ত চোখে বললেন—“তোমরা কি বোঝ না, এটাই ভবিষ্যৎ! এ শক্তি যদি আমরা কাজে লাগাতে পারি তবে মানবসভ্যতা আর কখনো শক্তির জন্য কাঁদবে না। আমরা আমাদের সীমাবদ্ধতা ভেঙে মহাবিশ্ব জয় করব!” অনিরুদ্ধ ক্রুদ্ধ স্বরে উত্তর দিলেন—“এই শক্তিই তোমার চোখের সামনে শত শত মানুষকে মেরে ফেলেছে। তুমি কি সেটা দেখনি?” মায়া তখন ঠান্ডা গলায় বলল—“শুধু শক্তি থাকলেই তো হয় না, নিয়ন্ত্রণও লাগে। আর আমরা জানি না, এর পেছনে কারা আছে। হয়তো ভিনগ্রহীরা এটা আমাদের পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছে, আর আমরা ব্যর্থ হয়েছি।” মুহূর্তে দলের ভেতর দ্বন্দ্ব আরও ঘনীভূত হলো, আর প্রত্যেকের চোখে দেখা যাচ্ছিল যে সামনে এক কঠিন সিদ্ধান্তই তাদের নিতে হবে।
এই সময়ে গ্রামবাসীরা আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে শিবিরে এসে জড়ো হলো। কারও সন্তান নিখোঁজ, কারও ঘর ভেসে গেছে, কারও প্রিয়জনের মৃতদেহ ভেসে উঠেছে। তারা চিৎকার করে দাবি জানাল—“ওটাকে ধ্বংস করো! সমুদ্রকে শান্ত করো!” মায়া ক্যামেরায় সেই মুহূর্তগুলো ধারণ করছিল, আর তার চোখে স্পষ্ট হচ্ছিল মানুষের যন্ত্রণা। কিন্তু রাঘবেন্দ্র অনড় থাকলেন—“না, আমরা এটা ধ্বংস করতে পারি না। এটা মানুষের নয়, মহাজগতের দান। আমরা যদি এটাকে চিরতরে চাপা দিই, তবে আমাদের ভবিষ্যৎও চাপা পড়ে যাবে।” কথার তীব্রতা বেড়ে উঠতে লাগল। কাবেরী ঠান্ডা মাথায় বললেন—“আমরা যদি এটাকে অক্ষত রাখি, তবে হয়তো আবার সমুদ্র উন্মত্ত হয়ে উঠবে, হাজারো মানুষ মরবে। সেনা হিসাবে আমার প্রথম দায়িত্ব মানুষের জীবন বাঁচানো।” অনিরুদ্ধ মুষ্টিবদ্ধ হাত শক্ত করে বললেন—“আমারও তাই মনে হয়। আমাদের জ্ঞানের বাইরে কিছু যদি থাকে, তবে সেটা থেকে দূরে থাকাই নিরাপদ।” কিন্তু কেউই এই যন্ত্র ধ্বংস করার ঝুঁকি নিতে চাইছিল না—কারণ কেউ জানত না, ধ্বংসের চেষ্টা করলে যন্ত্রটি আরও ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। তাই প্রশ্ন থেকে গেল, কীভাবে এটিকে চিরতরে শান্ত করা যায়। এই টানাপোড়েনের মধ্যেই এগিয়ে এল রফিকুল। সরল মুখ, চোখে অদ্ভুত এক দৃঢ়তা। সে ধীর স্বরে বলল—“ওটা আমি প্রথম দেখেছিলাম, হয়তো আমাকেই শেষ করতে হবে। সমুদ্র আমাদের ঘর, আর আমি সমুদ্রের সন্তান। যদি সমুদ্রকে শান্ত করতে হয়, তবে আমাকেই তার তলায় নামতে হবে।” সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল।
শেষ মুহূর্তে কোনো দ্বিধা ছাড়াই রফিকুল তার পুরনো নৌকোতে যন্ত্রপাতি বেঁধে নেমে পড়ল সমুদ্রের ঢেউয়ে। কাবেরী চিৎকার করছিলেন—“না, একা যেও না!” অনিরুদ্ধ তাকে থামানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু রফিকুল শুধু একবার পেছনে তাকিয়ে হেসে বলল—“আমাদের জন্য কেউ না কেউ তো বলি দিতেই হবে।” তার চোখে কোনো ভয় ছিল না, বরং ছিল অদ্ভুত এক প্রশান্তি। সে অদৃশ্য হয়ে গেল গাঢ় অন্ধকার পানির গভীরে। সবাই শ্বাস আটকে তাকিয়ে রইল সমুদ্রের দিকে। মিনিটের পর মিনিট কেটে যাচ্ছিল, আর সবার চোখ তখনও নিবদ্ধ ছিল সেই জ্বলজ্বলে আলোর ওপর। হঠাৎ আলোটা ধীরে ধীরে ম্লান হতে শুরু করল। প্রথমে স্পন্দন থেমে গেল, তারপর ঝলকানি থেমে গিয়ে নিভে গেল সম্পূর্ণ। সমুদ্র শান্ত হলো, ঢেউ থেমে এল, বাতাসের গর্জন স্তব্ধ হলো। মনে হচ্ছিল প্রকৃতি আবার স্বাভাবিকতায় ফিরছে। কিন্তু রফিকুল আর ভেসে উঠল না। তার জীবন সমুদ্রের তলদেশে চিরতরে মিশে গেল, আর তার সঙ্গে চাপা পড়ল সেই রহস্যময় যন্ত্রও। গ্রামবাসীরা হাঁটু গেড়ে বসে প্রার্থনা করল, যেন সমুদ্র আর কখনো রাগ না করে। অনিরুদ্ধ আর মায়া চোখ মুছে একে অপরের দিকে তাকালেন, হৃদয়ে বেদনা আর অদ্ভুত স্বস্তি মিলেমিশে ছিল। রাঘবেন্দ্র দূরে দাঁড়িয়ে নির্বাক হয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তার চোখে তখনও জ্বলছিল হাহাকার আর অপূর্ণতার আগুন। মায়ার ক্যামেরা সেই শেষ দৃশ্য ধরে রাখছিল—অন্ধকার সমুদ্র, শান্ত ঢেউ, আর আকাশের ওপরে ভোরের আলো। আলো নিভে গেল, কিন্তু মানুষের মনে প্রশ্ন রয়ে গেল—এটা কি সত্যিই চিরতরে নিভে গেল, নাকি একদিন আবার কোনো অজানা মুহূর্তে জেগে উঠবে?
____




