Bangla - কল্পবিজ্ঞান

সমান্তরাল কলকাতা

Spread the love

দেবজিত ঘোষ


এক

অর্ণবের ঘুম ভাঙল ভোরবেলার প্রথম আলোয় নয়, বরং এক অদ্ভুত অস্বস্তিতে। সাধারণত জানলার বাইরের ট্রামের টুংটাং শব্দ, কিংবা রাস্তার ভাঁপাও বিক্রেতার হাঁক তাকে জাগিয়ে তোলে। কিন্তু আজ যেন চারদিকে সম্পূর্ণ নীরবতা। এত নীরবতা কলকাতায় কোনোদিন শোনা যায়নি। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াতেই মনে হলো যেন বাতাস ভারী হয়ে আছে, যেন প্রতিটি শ্বাস নিতে তাকে দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হচ্ছে। ঘরটাও কেমন অচেনা মনে হলো—একই বইয়ের তাক, একই ডেস্ক, তবুও যেন সবকিছু নতুনভাবে সাজানো। জানলার বাইরে তাকিয়ে অর্ণব স্তব্ধ হয়ে গেল। যেখানে প্রতিদিন অগোছালো গলি, চায়ের দোকান, ভিখারির ভিড়, সেখানে আজ দেখা যাচ্ছে অদ্ভুত খালি রাস্তা। কোনো মানুষ নেই, কোনো গাড়ির শব্দ নেই, এমনকি কুকুরের ঘেউ ঘেউও নেই। চারদিকের এই নিস্তব্ধতা তার বুকের ভেতর চাপ তৈরি করছিল।

সে চোখ ঘষে আবার তাকাল বাইরে। হয়তো ঘুমঘোরের বিভ্রম—এমনটাই ভাবল প্রথমে। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে টের পেল, এটি কোনো বিভ্রম নয়। অদ্ভুতভাবে পরিচিত রাস্তা হারিয়ে গেছে, তার জায়গায় তৈরি হয়েছে কংক্রিটের ফাঁকা পথ, যেন নতুন করে শহরটা কেউ বানিয়ে দিয়েছে। অথচ বাড়িগুলো আগের মতোই—কিন্তু তাদের চারপাশে যেন জীবনের সব চিহ্ন মুছে গেছে। হঠাৎ তার কানে এলো এক অচেনা আওয়াজ—টেলিফোনের ঘণ্টাধ্বনি। অর্ণবের বুকের ভেতর কাঁপন ধরল। বহুদিন হলো বাড়ির ল্যান্ডলাইনের ব্যবহার নেই, ফোনটি তো নষ্ট হয়ে আছে। তাহলে বাজছে কীভাবে? গলা শুকিয়ে গেলেও সে ধীরে ধীরে এগোল টেবিলের দিকে। কালো রঙের পুরোনো ফোন সেটটি সত্যিই বাজছে, ঘণ্টাধ্বনির প্রতিটি সুর যেন তাকে আরো গভীর আতঙ্কে ডুবিয়ে দিচ্ছে।

কাঁপতে থাকা আঙুল দিয়ে সে রিসিভার তুলতেই ওপাশে এক অদ্ভুত ফিসফিসানি শোনা গেল। স্পষ্ট কোনো ভাষা নয়, বরং হালকা সাঁইসাঁই শব্দ, যেন কাগজ ছিঁড়ছে বাতাসে। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পর সেই শব্দ স্পষ্ট হয়ে এল কানে—“পরীক্ষা শুরু হয়েছে।” শব্দটা শুনেই অর্ণবের শরীরের লোম খাড়া হয়ে গেল। কে বলল? কোন পরীক্ষার কথা? তার বুকের ভেতর অস্বস্তির ঢেউ উঠল, মনে হলো ফোনের তার বেয়ে কোনো অদৃশ্য শক্তি তার শরীরে ঢুকে যাচ্ছে। সে রিসিভার নামিয়ে রাখতে চাইল, কিন্তু যেন হাত আটকে গেছে। ফিসফিসানি আবারও কানে ভেসে এলো—একই বাক্য, বারবার, অবিরাম—“পরীক্ষা শুরু হয়েছে… পরীক্ষা শুরু হয়েছে…”। অর্ণব জোর করে রিসিভার ছুড়ে ফেলে দিল মেঝেতে। শব্দ বন্ধ হয়ে গেল, কিন্তু ঘরে একটা অদ্ভুত প্রতিধ্বনি বাজতে লাগল, যেন দেয়ালগুলোও সেই বাক্য ফিরিয়ে দিচ্ছে।

অর্ণব আতঙ্কিত হয়ে জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। এই শহর কি আর তার সেই চেনা কলকাতা? সে ভাবছিল, হয়তো কোনো স্বপ্নে আটকে গেছে, কিংবা মানসিক বিভ্রম চলছে। কিন্তু জানলার কাঁচে তার নিজের প্রতিবিম্বও অদ্ভুত লাগছিল—চোখদুটো কেমন অচেনা, যেন আরেকজন মানুষ তাকিয়ে আছে। অর্ণব ঠোঁট কামড়ে ভাবল, এ সব কি তার কল্পনা, নাকি সত্যিই কোনো অজানা শক্তি তাকে টেনে নিয়েছে অন্য কোথাও? সে আবার বাইরে তাকাল, আর ঠিক তখনই দূরে এক ছায়া দেখতে পেল। মানুষ নয়, আবার সম্পূর্ণ অমানবিকও নয়—একটা চলন্ত অবয়ব, ধীরে ধীরে রাস্তার মোড়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে অর্ণবের মেরুদণ্ডে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। বুক ধড়ফড় করতে লাগল, কিন্তু ভেতরে কোথাও একটা কৌতূহলও জন্ম নিল। কে এই ছায়ামূর্তি? আর কেন ফোনে তাকে বলা হলো—“পরীক্ষা শুরু হয়েছে”? অর্ণব জানত, তার জীবনের প্রতিটি সকাল আর আগের মতো হবে না। এই শহর, এই নীরবতা, এই অচেনা সকাল—সবকিছুর পেছনে লুকিয়ে আছে এক রহস্য, যা তাকে ধীরে ধীরে টেনে নিয়ে যাবে সমান্তরাল কলকাতার অন্তহীন পথে।

দুই

অর্ণবের চোখ খুলতেই যেন হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলকানি ভেসে এলো। প্রথমে সে ভেবেছিল হয়তো সকালের সূর্যের আলো জানলার কাঁচে প্রতিফলিত হয়েছে, কিন্তু যখন সম্পূর্ণ জেগে উঠল, তখন বুঝল—এ কোনো সাধারণ সকাল নয়। গতকালের অদ্ভুত নিস্তব্ধতা আজ বদলে গেছে এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতায়। জানলার বাইরে তাকাতেই চোখ ঝলসে গেল তার—কলকাতা আর সেই পরিচিত ধূসর শহর নয়, বরং রঙিন আলোকসজ্জায় ভরা এক বিশাল ভবিষ্যতের নগরী। আকাশ জুড়ে ভাসছে অসংখ্য যানবাহন, যাদের ডানায় নীলচে আলোর রেখা। উঁচু উঁচু দালান, আকাশ ছুঁয়ে যাওয়া কাঁচের টাওয়ার, আর প্রতিটি দেয়ালে নীয়ন আলোয় ঝলমল করে ওঠা বিজ্ঞাপন—সব মিলিয়ে শহর যেন এক বিশাল সাইবার-চিত্রকল্প। অর্ণব অবাক হয়ে গেল। গতকাল যে রাস্তা ফাঁকা ও নিস্তব্ধ ছিল, আজ সেখানে মানুষের ভিড়, তবে এই মানুষগুলো দেখতে আলাদা—তাদের পোশাক ঝলমলে, শরীরে জ্বলজ্বলে ট্যাটুর মতো সার্কিট আঁকা, আর কানে, চোখে অদ্ভুত যন্ত্র। সে জানালার কাঁচে ঠেস দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল, মনে হচ্ছিল সে একেবারে অন্য কোনো গ্রহে এসে পড়েছে।

ভয় আর কৌতূহল মিশ্রিত অবস্থায় সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। গলি পেরোতেই বুঝল, তার পায়ের নিচের মাটি আর সিমেন্টের রাস্তা নয়, বরং কোনো ধাতব প্ল্যাটফর্ম, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপে নীল আলো জ্বলে ওঠে। রাস্তায় উড়ে যাচ্ছে স্বয়ংক্রিয় গাড়ি, যেগুলোর কোনো চালক নেই। আকাশে বিশাল স্ক্রিন ভেসে উঠছে, যেখানে খবর সম্প্রচার হচ্ছে এমন ভাষায়, যা অর্ণবের বোধগম্য নয়, অথচ আশ্চর্যজনকভাবে সে শব্দগুলোর অর্থ বুঝতে পারছে। “ভবিষ্যতের মেট্রোপলিস—নিও-কলকাতা আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে,” এক গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এল। অর্ণব নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। এ কি সত্যিই কলকাতা? ট্রামের লাইন, হাওড়া ব্রিজ, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল কোথায় গেল? না কি এগুলো সবকিছু কোনো অদ্ভুত মায়া? মানুষের ভিড়ের মধ্যে হেঁটে যেতে যেতে তার মনে হচ্ছিল, সে যেন এক পরীক্ষাগারের ইঁদুর, আর চারপাশে যন্ত্র দিয়ে সাজানো এক কৃত্রিম মহাবিশ্ব। কিন্তু তারপরেই তার দৃষ্টি পড়ল এক নারীর দিকে, যিনি ভিড়ের মধ্যেও একেবারে আলাদা।

সে নারী ছিল সাদা রঙের পোশাকে, পোশাকটা দেখতে সাধারণ হলেও তার গায়ে ঝলমল করছিল অদ্ভুত প্রতীক। তার চোখে ছিল গভীর দৃষ্টি, আর তার ঠোঁটে হালকা হাসি। অর্ণব অনুভব করল, এই মানুষটিই যেন তাকে লক্ষ্য করছে অনেকক্ষণ ধরে। সে কাছে আসতেই নারীর কণ্ঠ শুনতে পেল—“তুমি অর্ণব সেন, তাই না?” অর্ণব অবাক হয়ে তাকাল। এই অপরিচিতা তার নাম জানে কীভাবে? সে তো কারো সঙ্গে কোনো কথা বলেনি! নারী শান্তভাবে হাত বাড়িয়ে দিলেন—“আমি রোহিনী মুখার্জী। আমি জানি তুমি কী পার করছো।” অর্ণব কাঁপা গলায় বলল, “আপনি কে? এ জায়গাটা কী? আমি কেন বারবার অন্য রকম শহরে ঘুম থেকে উঠছি?” রোহিনী তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “কারণ তুমি আর দশজনের মতো নও। তোমাকে বেছে নেওয়া হয়েছে এক বিশেষ পরীক্ষার জন্য। সমান্তরাল মহাবিশ্বের সব বাস্তবতাকে একজন মানুষের চোখ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে—আর সেই মানুষটি তুমি।”

অর্ণব যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে লাগল অগণিত প্রশ্ন। সমান্তরাল মহাবিশ্ব—এ তো সে শুধু বইয়ে পড়েছে বা কল্পনায় লিখেছে! কিন্তু রোহিনী এমনভাবে বলছে যেন সে সব জানে, যেন কোনো গোপন রহস্যের দ্বার খুলে দিচ্ছে। চারপাশের মানুষজন ব্যস্ত নিজেদের কাজে, কেউ ভাসমান গাড়িতে উঠে যাচ্ছে, কেউ রোবটের সঙ্গে বাজার করছে, কেউ বা চোখে লাগানো কাচের ভেতর দিয়ে অন্য বাস্তব দেখছে। এই ভিড়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে অর্ণব বুঝতে পারল, রোহিনীই একমাত্র ব্যক্তি যে তাকে সত্যিটা জানাতে পারছে। রোহিনী বলল, “তুমি লেখক, অর্ণব। তোমার চোখে এই শহরগুলো শুধু শহর নয়, একেকটি কাহিনি। পরীক্ষকেরা বিশ্বাস করে, লেখকের কল্পনাই সবচেয়ে শক্তিশালী যন্ত্র, যা সমান্তরাল বাস্তবকে ধরতে পারে। তোমার ভয়, তোমার বিস্ময়, তোমার কৌতূহল—সবকিছুই তাদের তথ্য হিসেবে নথিভুক্ত হচ্ছে।” অর্ণব শিহরিত হয়ে গেল। তবে কি তার জীবন তার নিজের হাতে নেই? তবে কি সে শুধু এক পরীক্ষার বিষয়বস্তু? রোহিনী মৃদুস্বরে বলল, “তুমি যা দেখছো, তা সবই বাস্তব। কিন্তু একই সঙ্গে, এগুলো সবই এক নির্মাণ—যেমন তোমার লেখা গল্প।” অর্ণব আকাশের দিকে তাকাল—ভাসমান গাড়ি, নীয়ন আলো, অচেনা বিজ্ঞাপন—সবকিছু যেন এক ভয়ংকর বাস্তব কল্পনা। আর তার ভেতর থেকে শুধু একটি প্রশ্ন ভেসে উঠল—এই পরীক্ষার শেষ কোথায়?

তিন

অর্ণবের ঘুম ভাঙল এক অদ্ভুত গন্ধে—ধুলো, পাথর আর শ্যাওলার মিশ্র গন্ধ। চোখ খুলেই সে অনুভব করল, বিছানাটা নেই, চারপাশে নেই কোনো আধুনিক কক্ষের সুরক্ষিত দেয়াল। বরং তার গা ঘেঁষে পড়ে আছে ভাঙা ইট, ভগ্নস্তূপ, আর মাথার ওপরে ঝুলছে আধখানা ছাদের মতো কিছু। সে তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়াল, বুক ধড়ফড় করতে লাগল। কোথায় এল সে? জানলার বাইরে তাকাতেই দেখা গেল—যেখানে গতকাল নীয়ন আলোয় ভরা ভবিষ্যতের নগরী ছিল, আজ সেখানে অদ্ভুত শূন্যতা। চোখ যতদূর যায়, কেবল ভাঙাচোরা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ, ভগ্নপ্রায় প্রাসাদের ধাতব দরজা, আর গাছের শিকড়ে জড়িয়ে থাকা প্রাচীন ইটপাথর। বাতাসে অদ্ভুত নীরবতা, শুধু মাঝে মাঝে ভেসে আসে কাকের ডাক আর দূরের ঝড়ো হাওয়ার শোঁ শোঁ শব্দ। অর্ণবের মনে হলো, যেন সে এক অচেনা সময়ের মধ্যে এসে পড়েছে—যেখানে এক সভ্যতা একদিন জেগে উঠেছিল, আবার হঠাৎ ধ্বংস হয়ে গেছে। তার বুকের ভেতর প্রশ্ন জেগে উঠল—এই ধ্বংসস্তূপের কলকাতা কি সত্যিই তার নিজের শহর, নাকি এক সমান্তরাল বাস্তবের নিদর্শন?

সে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল। মন্দিরের ভাঙা গায়ে খোদাই করা প্রতীকগুলো দেখে তার মনে হলো, এগুলো সে আগে কোথাও দেখেছে—কোনো পুরোনো বইয়ের পাতায় হয়তো। একটা বিশাল প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপের সামনে এসে দাঁড়াতেই তার বুকের ভেতর কাঁপন ধরল। ভাঙা দরজার ভেতর থেকে আসছিল অদ্ভুত গুঞ্জন, যেন কেউ ফিসফিস করছে ভেতরে। অর্ণব সাহস করে ঢুকতেই দেখা গেল এক বৃদ্ধ বসে আছেন ভগ্নস্তম্ভের ওপর। ধবধবে সাদা দাড়ি, কাঁধে জীর্ণ চাদর, হাতে পুরোনো এক খাতা। তার চোখদুটি অদ্ভুত শান্ত, যেন এই ধ্বংসস্তূপের নীরবতাকেও ছাড়িয়ে গেছে। অর্ণব অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়তেই বৃদ্ধ হাসলেন—“তুমি এসেছ, অর্ণব সেন।” অর্ণব চমকে উঠল। এই অচেনা বৃদ্ধ তার নাম জানে কীভাবে? বৃদ্ধ শান্ত গলায় বললেন, “আমার নাম অধ্যাপক দত্ত। আমি দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করছিলাম তোমার জন্য।”

অর্ণব হকচকিয়ে প্রশ্ন করল, “আপনি আমার নাম জানলেন কীভাবে? আর এই জায়গাটা কী? গতকালও তো আমি একেবারে ভিন্ন শহরে ছিলাম।” অধ্যাপক দত্ত মৃদু হাসলেন, তাঁর কণ্ঠে ছিল এক অদ্ভুত নিশ্চিন্ততা—“কারণ এই শহর কোনো একক রূপে নেই। কখনো এটি প্রযুক্তির নগরী, কখনো প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ। এই সবকিছুই আসলে একটিই গল্প, যা সমান্তরাল মহাবিশ্বের বুননে লেখা হচ্ছে। তুমি সেই গল্পের পাঠকও, আবার লেখকও।” অর্ণব স্তম্ভিত হয়ে গেল। অধ্যাপক দত্ত ধীরে ধীরে খাতাটা খুললেন। ভেতরে লেখা আছে অসংখ্য অক্ষর, কিন্তু সেগুলো কোনো ভাষায় নয়—তবু অর্ণব পড়তে পারল প্রতিটি শব্দ। সেখানে লেখা—“মহাবিশ্ব কোনো পদার্থের সমষ্টি নয়, বরং অনন্ত সংখ্যক কাহিনির বিন্যাস।” অর্ণব কেঁপে উঠল। এতদিন সে ভেবেছে গল্প লেখা মানে মানুষের কল্পনা, অথচ এখানে দাঁড়িয়ে বুঝল—গল্পই আসল বাস্তবতা, আর মহাবিশ্ব সেই গল্পের ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণ।

চারপাশের ভগ্নাবশেষের দিকে তাকিয়ে অধ্যাপক দত্ত আবার বললেন, “একদিন এই সভ্যতাও ভেবেছিল তারা চিরকাল টিকে থাকবে। তারা গড়েছিল প্রাসাদ, মন্দির, গ্রন্থাগার। কিন্তু সময় তাদের গল্পকে নতুন পথে নিয়ে গেল, আর তারা ইতিহাস হয়ে গেল। আজ তুমি সেই ইতিহাসের ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে আছো। বুঝতে হবে, অর্ণব, বাস্তব কোনো স্থির বস্তু নয়। বাস্তব হচ্ছে গল্পের মতো, প্রতিদিন বদলাতে থাকে। তুমি একজন লেখক, তাই তোমাকে বেছে নেওয়া হয়েছে। তুমি-ই দেখবে প্রতিটি রূপ, প্রতিটি মহাবিশ্ব, আর বুঝবে—সবকিছু আসলে একই কাহিনির ভিন্ন ভিন্ন অধ্যায়।” অর্ণব চুপ করে শুনছিল। তার ভেতরে কাঁপন ধরেছিল, কিন্তু একই সঙ্গে মনে হচ্ছিল এই মানুষটি সত্য বলছেন। ভাঙা প্রাসাদের শীর্ষে দাঁড়িয়ে থাকা ভগ্ন মূর্তির ছায়া ধীরে ধীরে মাটিতে লম্বা হয়ে যাচ্ছিল, আর সেই ছায়ার ভেতর অর্ণব নিজেকে দেখতে পেল—একজন লেখক, যাকে টেনে আনা হয়েছে অনন্ত মহাবিশ্বের ভ্রমণে। তার কানে এখনও বাজছিল অধ্যাপক দত্তের সেই গভীর উচ্চারণ—“সমস্ত মহাবিশ্ব আসলে এক গল্প।”

চার

অর্ণবের ঘুম ভাঙল এক আশ্চর্য নিশ্চিন্ততার অনুভূতিতে। গত কয়েকদিন ধরে প্রতিটি সকালই তাকে নতুন কোনো দুঃস্বপ্নের মতো চমকে দিয়েছে—কখনো ভবিষ্যতের অচেনা প্রযুক্তির শহর, কখনো আবার ধ্বংসস্তূপে ভরা প্রাচীন সভ্যতার ভগ্ন চিহ্ন। কিন্তু আজ সকালে চোখ খোলার পর সে অবাক হয়ে দেখল, সবকিছু যেন আবার আগের মতো হয়ে গেছে। বিছানার পাশে পরিচিত টেবিল, জানলার কাঁচ দিয়ে ভেসে আসা গলির শব্দ, আর তার পাশেই শুয়ে আছে অনন্যা—তার স্ত্রী। অর্ণবের বুক ভরে উঠল স্বস্তিতে। সে ভেবেছিল হয়তো অবশেষে দুঃস্বপ্নের অবসান হলো, হয়তো আবার ফিরে এসেছে তার বাস্তব জীবনে। একটু ঝুঁকে অনন্যার মুখের দিকে তাকাতেই তার বুক কেঁপে উঠল। অনন্যার মুখ একেবারে আগের মতো হলেও, তাতে যেন কোনো অচেনা ছায়া লেগে আছে। চোখ দুটো ফাঁকা, গভীর শূন্যতায় ভরা, আর ঠোঁটে যেন এক অদ্ভুত শক্তির ছাপ। অর্ণব ধীরে ধীরে তাকে ডাকল, “অনন্যা…” কিন্তু সাড়া এলো এক অচেনা শব্দে।

অনন্যার ঠোঁট নড়ল, কিন্তু বেরিয়ে এলো এমন এক ভাষা, যা অর্ণব আগে কখনো শোনেনি। অদ্ভুত গড়নের শব্দ, তীক্ষ্ণ অথচ সুরেলা, যেন একসঙ্গে হাজারো আওয়াজ মিলিত হয়ে কথা বলছে। অর্ণবের শরীর কেঁপে উঠল। সে বুঝতে পারল, তার পাশে যে নারী শুয়ে আছে, সে তার স্ত্রী অনন্যা নয়, বরং অন্য কোনো বাস্তবতার অনন্যা। চোখের দৃষ্টি এতটাই শূন্য যে, সেখানে কোনো আবেগ, কোনো সম্পর্কের ছায়া নেই। অথচ একই মুখ, একই চেহারা, একই গন্ধ—সবকিছু তাকে দোটানায় ফেলে দিল। তার মনে হচ্ছিল, যেন এই নারী তাকে চিনলেও চিনছে না, ভালোবাসলেও ভালোবাসছে না। অর্ণব ভয় আর কৌতূহলের মিশ্র অনুভূতিতে আবার ডাকল, “তুমি কে? তুমি কি আমার অনন্যা?” নারী কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল তার দিকে, তারপর আবার সেই অচেনা ভাষায় কিছু বলল, যেটা হঠাৎ করেই অর্ণবের কাছে বোধগম্য হয়ে গেল। শব্দগুলো যেন তার কানে নয়, সরাসরি মস্তিষ্কে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল—“তুমি ভুল জায়গায় জেগেছো, অর্ণব। তুমি আমার নয়।”

অর্ণব হতবাক হয়ে গেল। তার মেরুদণ্ডে ঠান্ডা স্রোত বইতে লাগল। এতদিন সে যা দেখেছে তা কোনোভাবে হয়তো বোঝা যেত—ভবিষ্যতের শহর, প্রাচীন সভ্যতা, ধ্বংসস্তূপ—সবকিছু ছিল বাইরের পরিবর্তন। কিন্তু আজ পরিবর্তন ঢুকেছে তার ঘরের ভেতরে, তার বিছানায়, তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটির মধ্যে। অনন্যা, যে তার জীবনের সবচেয়ে আপনজন, যে তার সঙ্গে অসংখ্য স্মৃতি ভাগ করে নিয়েছে, আজ সে সম্পূর্ণ অপরিচিত। অর্ণব মনে মনে ভাবতে লাগল—এ কি তাহলে আরেক সমান্তরাল মহাবিশ্ব, যেখানে অনন্যা একই রকম দেখতে হলেও তার স্ত্রী নয়? তার গলা শুকিয়ে এলো। সে হাত বাড়িয়ে অনন্যার কাঁধ ছুঁতে গেল, কিন্তু ছোঁয়া মাত্রই মনে হলো যেন ঠান্ডা পাথরের ওপর হাত রেখেছে। সেই মুহূর্তে অনন্যা—অথবা যে নারী তার রূপে শুয়ে আছে—হঠাৎ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল অর্ণবের দিকে। চোখের ভেতর কোনো মানুষের উষ্ণতা নেই, শুধু অদ্ভুত শূন্যতা আর এক অচেনা শক্তির ইঙ্গিত। অর্ণব দ্রুত হাত সরিয়ে নিল।

হঠাৎ জানলার বাইরে থেকে ভেসে এলো অদ্ভুত শব্দ। অর্ণব ছুটে গিয়ে তাকাল, আর স্তম্ভিত হয়ে গেল। তার পরিচিত গলি, চায়ের দোকান, খেলতে থাকা বাচ্চারা—কিছুই নেই। তার বদলে চারদিকে ঘন কুয়াশা, অদ্ভুত লালচে আলো, আর দূরে দূরে দাঁড়িয়ে আছে ছায়ামূর্তি। যেন অচেনা মানুষ, অথচ তাদের মুখ সব অনন্যার মতো। একের পর এক অনন্যা-চেহারার মানুষ দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার মোড়ে, জানলার ঠিক বাইরে, সবাই একসঙ্গে তাকিয়ে আছে তার দিকে। অর্ণবের বুক ধড়ফড় করতে লাগল। সে ঘুরে তাকাল বিছানার দিকে, সেখানে বসে থাকা নারী মৃদুস্বরে সেই অচেনা ভাষায় আবার বলল—“তুমি যে অনন্যাকে খুঁজছো, সে অন্য বাস্তবতায় আটকে আছে। তোমাকে বেছে নেওয়া হয়েছে কারণ তুমি তাকে চিনতে পারবে, এমনকি সে বদলে গেলেও।” অর্ণব বুঝতে পারল, এ শুধু সমান্তরাল মহাবিশ্বের পরীক্ষা নয়, বরং তার নিজের ভালোবাসা, তার নিজের বিশ্বাসেরও পরীক্ষা। সে ঠোঁট কামড়ে ভেতরে ভেতরে ভাবল—যদি প্রতিটি মহাবিশ্বে অনন্যা আলাদা হয়, তবে সে কোন অনন্যাকে সত্যি ভালোবাসে? আর কোন অনন্যাই বা তার?

পাঁচ

অর্ণব ঘুম ভাঙতেই প্রথমে মনে হলো পুরো শহর যেন নিস্তব্ধতার গহ্বরে ডুবে আছে। জানলার বাইরে তাকাতেই সে দেখল, রাস্তা-ঘাটে একটিও মানুষ নেই। গতকাল যে গলি ভরে ছিল অনন্যার মতো মুখওয়ালা অচেনা ছায়ায়, আজ সেখানে শুধু ফাঁকা পথ, ভাঙাচোরা বৈদ্যুতিক খুঁটি আর অদ্ভুত নীলচে আলোয় ঢাকা আকাশ। সে চমকে বুঝতে পারল—এই নিস্তব্ধতা আসলে ভয়ংকর। মানুষের স্বাভাবিক কথাবার্তা, গাড়ির হর্ন, দোকানের আড্ডা, বাচ্চাদের খেলা—সব কিছু যেন হঠাৎ করে মুছে গেছে। তবুও সে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না, কারণ বাতাসে ভেসে আসছিল এক অদ্ভুত যান্ত্রিক শব্দ। প্রথমে মনে হলো দূরে কোথাও কোনো পুরোনো মেশিন কাজ করছে, তারপর শব্দটা যেন চারদিক ঘিরে ধরল। মেশিনের ধাতব ঘষাটে আওয়াজ, কোথাও যেন বিশাল গিয়ার ঘুরছে, আবার কোথাও যেন অচেনা কোনো যন্ত্র স্লো গতিতে চালু হচ্ছে। শহরটা ফাঁকা হলেও সেই শব্দে মনে হচ্ছিল, কোথাও না কোথাও তাকে অদৃশ্য চোখে দেখা হচ্ছে, পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

সে রাস্তায় নামতেই খেয়াল করল, প্রতিটি বাড়ির জানলা খোলা, কিন্তু ভেতরে কেউ নেই। খালি বারান্দা, পরিত্যক্ত সিঁড়ি, অথচ মেঝেতে পড়ে আছে মানুষের ব্যবহার করা জিনিস—খোলা বই, অর্ধেক খাওয়া থালা, টেবিলে রাখা কফির কাপ—যেন মুহূর্ত কয়েক আগে মানুষগুলো হঠাৎ করেই অদৃশ্য হয়ে গেছে। অর্ণবের মনে প্রশ্ন জাগল—তাহলে কি এই শহরটিও আরেকটি সমান্তরাল কলকাতা? নাকি এটি কেবল একটি পরীক্ষাগার, যেখানে তার চারপাশের প্রতিটি জিনিস নিছক এক প্রক্ষেপণ? এই ভাবনার মাঝেই হঠাৎ আকাশ কেঁপে উঠল। অদ্ভুত কম্পন নামল চারদিকে, যেন বিশাল লাউডস্পিকার থেকে কেউ কথা বলছে। কিন্তু শব্দটা কোনো মানুষের নয়, অচেনা ধাতব স্বরে ভেসে এলো—“তুমি ভালোই করছো, পরীক্ষার অর্ধেক শেষ।” অর্ণব স্তব্ধ হয়ে গেল। সেই কণ্ঠস্বর অদৃশ্য, কিন্তু চারপাশের প্রতিটি প্রাচীর, প্রতিটি জানলা কেঁপে উঠছিল সেই কথার প্রতিধ্বনিতে। গলার স্বর যান্ত্রিক হলেও তার ভেতরে ছিল অদ্ভুত তৃপ্তি, যেন সে একটি পরীক্ষার ফলাফল লিখে রাখছে। অর্ণবের শরীরে শীতল স্রোত বইতে লাগল—কোন পরীক্ষা? কে করছে এই পরীক্ষা? আর কেন তাকে বেছে নেওয়া হয়েছে?

সে চিৎকার করে উঠল, “কে তুমি? কোথায় আছো? কেন আমার সঙ্গে এই খেলা খেলছো?” কিন্তু কোনো উত্তর এল না। শুধু সেই যান্ত্রিক গুঞ্জন তার চারপাশে বেজে চলল, যেন শত শত যন্ত্র একসঙ্গে চালু আছে। হঠাৎ করেই রাস্তার মাঝখানে একটি ধাতব স্তম্ভ মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো। স্তম্ভটি অদ্ভুত—তার গায়ে যেন অসংখ্য চোখ খোদাই করা, আর প্রতিটি চোখে অর্ণবের প্রতিবিম্ব ভেসে উঠছে। সে ভয়ে পিছিয়ে গেল। সেই স্তম্ভ থেকেই এবার আবার ভেসে এলো কণ্ঠস্বর—“তুমি যত দূরই পালাও, আমরা তোমাকে দেখতে পাই। আমরা সর্বদা পর্যবেক্ষণ করি।” অর্ণবের মনে হলো সে যেন একটা ল্যাবরেটরির ইঁদুর, চারদিক থেকে অদৃশ্য বিজ্ঞানীরা তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার বুকের ভেতর শ্বাসরোধী আতঙ্ক জমে উঠল। সে বুঝতে পারল, শুধু শহর নয়, তার প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি দৃষ্টি, এমনকি তার ভয়ও কারও কাছে তথ্য হিসেবে পৌঁছে যাচ্ছে। সে যেন পরীক্ষার উপাদান, আর এই পরীক্ষার লক্ষ্য সে নিজেই জানে না।

অর্ণব মাথা ঘুরে হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে পড়ল। মাথার ভেতর প্রতিধ্বনি হয়ে বাজছিল সেই যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর—“অর্ধেক শেষ।” মানে কি আরও অর্ধেক বাকি আছে? মানে কি আরও ভয়ঙ্কর বাস্তবতার মুখোমুখি তাকে হতে হবে? সে ভাবছিল, এতদিন সে ভেবেছে কেবল অদ্ভুত কোনো দুঃস্বপ্নে আটকে গেছে, অথবা সমান্তরাল মহাবিশ্বের রহস্যে জড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু আজ সে নিশ্চিত হলো—এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটা পরিকল্পিত। কেউ বা কিছু ইচ্ছে করে তাকে এই সব জগতের ভেতর টেনে নিচ্ছে। হয়তো তারা দেখতে চাইছে, মানুষের মস্তিষ্ক কতটা ভেঙে পড়তে পারে, ভালোবাসা আর ভয় কতটা টিকে থাকে অপরিচিত বাস্তবতার মধ্যে। অর্ণব দাঁড়িয়ে উঠে আকাশের দিকে তাকাল। কুয়াশার ভেতর অস্পষ্ট নীলচে রেখা ভেসে উঠছিল, যেন কোনো অদৃশ্য চোখ উপরের দিক থেকে তাকে ঘিরে রেখেছে। সে ঠোঁট কামড়ে মৃদুস্বরে বলল—“যদি আমার পরীক্ষা হয়ে থাকে, তবে আমি লড়াই করব। কিন্তু মনে রেখো, আমি কেবল পর্যবেক্ষিত নই, আমিও তোমাদের খুঁজে বের করব।” শহর তখনো ফাঁকা, কেবল যান্ত্রিক শব্দে ধুকপুক করছিল, আর অর্ণব বুঝতে পারছিল—তার পরীক্ষা এখনো অনেক বাকি।

ছয়

অর্ণবের চোখ খুলতেই প্রথমে মনে হলো সে যেন কোনো পুরোনো সিনেমার সেটে এসে পড়েছে। চারদিকে ধোঁয়ার গন্ধ, মাটির রাস্তার ওপর ঘোড়ার খুরের টকটক শব্দ, আর দূরে হালকা কুয়াশার মধ্যে দিয়ে ভেসে আসছে হুইসেলের আওয়াজ। চারপাশে অচেনা অথচ পরিচিত এক কলকাতা—যেন সে হঠাৎ করেই ব্রিটিশ আমলে পৌঁছে গেছে। আকাশে নেই কোনো উড়ন্ত যান বা নীয়ন আলো; তার বদলে আছে মশালের ঝলমলে আলোর সারি, রাস্তার পাশে গ্যাসল্যাম্প। লোকজন ধুতি-পাঞ্জাবি পরে হেঁটে যাচ্ছে, মাথায় টুপি, হাতে লণ্ঠন। আর চারদিকে ছড়িয়ে আছে ঘোড়ার গাড়ি, দুধওয়ালা, হকারের ডাক। অর্ণব বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। এটা কি সত্যিই সেই কলকাতা, যা সে বইয়ে পড়েছে? কিন্তু প্রশ্নের চেয়েও অদ্ভুত ছিল মানুষের দৃষ্টি। যেখানেই সে যাচ্ছিল, সবার চোখে ছিল অচেনা আতঙ্ক মিশ্রিত বিস্ময়। কেউ থমকে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলছে, কেউবা সোজাসুজি তার দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে প্রণাম করছে। এক বৃদ্ধ কাঁপা গলায় বলে উঠল—“ওই যে! এ তো সেইজন, যে আমাদের ভবিষ্যৎ দেখেছে।”

অর্ণবের বুক ধক করে উঠল। এরা তাকে চেনে? কিভাবে সম্ভব? সে কি ইতিহাসের ভেতর ঢুকে পড়েছে, নাকি কোনো অন্য বাস্তবতার খেলায় এখানে এসেছে? সে ধীরে ধীরে হেঁটে চলল, অথচ লোকজন তার দিকে ঝুঁকে আসছিল। কেউ হাত ছুঁতে চাইছে, কেউ তার দিকে তাকিয়ে কাঁদছে। এক তরুণী এগিয়ে এসে বলল—“আপনি আমাদের মুক্তির দিন দেখেছেন, তাই না? আমাদের বলুন, কবে আসবে সেই সময়?” অর্ণব হতভম্ব হয়ে গেল। সে বুঝতে পারল না, এরা তাকে কার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছে। হয়তো এই বাস্তবতায় তার আরেক রূপ আছে, একজন ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা, যে মুক্তি, স্বাধীনতা কিংবা বিপ্লবের ভবিষ্যৎ দেখেছে। চারদিকে যে ভাষা, যে সুরে লোকেরা তার সঙ্গে কথা বলছে, তাতে ছিল অদ্ভুত বিশ্বাস আর ভয়ের মিশেল। মনে হচ্ছিল তারা তার কাছে ভবিষ্যতের সত্য শুনতে মরিয়া। অথচ অর্ণব নিজেই জানে না সে আসলে কী দেখেছে। হঠাৎ করেই একদল তরুণ তাকে ঘিরে ধরল—তাদের চোখে অগ্নি, হাতে লাঠি। তারা ফিসফিস করে বলল—“আপনি আমাদের পথ দেখাবেন। বলুন, ব্রিটিশরা কবে যাবে?”

অর্ণবের মাথার ভেতর তখন ঝড় বইছিল। সে ইতিহাস জানে, স্বাধীনতা এসেছে বহু পরে, রক্ত আর সংগ্রামের বিনিময়ে। কিন্তু এখন এই সময়ে দাঁড়িয়ে যদি সে সত্যিটা বলে দেয়, তবে কী হবে? মানুষের মনোবল ভেঙে যাবে, নাকি ইতিহাসই বদলে যাবে? তার বুকের ভেতর দোটানা জমে উঠল। সে কি পরীক্ষার অংশ হিসেবে এখানে এসেছে, যেখানে তার প্রতিটি উত্তর ভবিষ্যতের চিত্র পাল্টে দিতে পারে? চারপাশের লোকজন তখনো তাকিয়ে আছে তার দিকে, তাদের দৃষ্টিতে এক ধরনের অদ্ভুত বিশ্বাস—যেন সে না বললে তারা বাঁচবে না। হঠাৎ ভিড় থেকে একজন বৃদ্ধ স্বাধীনতা সংগ্রামী বেরিয়ে এসে অর্ণবের কাঁধে হাত রাখলেন। তার চোখে অদ্ভুত জ্যোতি, তিনি বললেন—“তুমি যা দেখেছো, তা আমাদের বাঁচাবে। আমরা তোমার কথা শুনব। ভবিষ্যৎ জানার বোঝা এখন তোমার কাঁধে।” অর্ণব গলা শুকিয়ে গেল। এ কী পরীক্ষা? শুধু নিজের মানসিক শক্তির নয়, সময়েরও?

হঠাৎ আকাশে মশালের আলো নিভে গেল, আর চারদিক থেকে ভেসে এলো সেই পরিচিত যান্ত্রিক গুঞ্জন। মাটির রাস্তা, ধুতি-পাঞ্জাবি পরা মানুষ, ঘোড়ার গাড়ি—সব কেঁপে উঠল। আকাশ থেকে আবার শোনা গেল সেই অদৃশ্য কণ্ঠস্বর—“ভালো করছো, অর্ণব। সময়ের উলটপালটও তুমি অতিক্রম করেছো।” চারপাশের লোকেরা কণ্ঠস্বর শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল, তাদের চোখে আতঙ্ক আর ভক্তি মিশ্রিত ছায়া। অর্ণব মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকাল, কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। কেবল অনুভব করল, অদৃশ্য চোখগুলো তাকে পরীক্ষা করছে, তার প্রতিটি সিদ্ধান্তকে মাপছে। সে জানত না ইতিহাসের ধারা বদলে গেছে কিনা, বা তার একটুখানি কথা হাজারো মানুষের বিশ্বাসকে নতুন রূপ দিয়েছে কিনা। কিন্তু তার ভেতরে দৃঢ় হয়ে উঠল এক সত্য—এই পরীক্ষা কেবল জায়গা বা সময়ের নয়, বরং তার আত্মার। হয়তো আগামীতে তাকে আরও ভয়ঙ্কর বাস্তবতার ভেতর দিয়ে যেতে হবে। আর এই উপলব্ধি নিয়েই অর্ণব অনুভব করল, তার যাত্রা এখনো শেষ হয়নি, বরং আসল পরীক্ষা কেবল শুরু হলো।

সাত

অর্ণব হঠাৎ অনুভব করল যেন চারপাশের পরিবেশ থেমে গেছে। ঘোড়ার গাড়ি, মানুষ, গ্যাসল্যাম্পের আলো সব যেন এক অদৃশ্য ফ্রেমে আটকে দাঁড়িয়ে আছে। সে হঠাৎ দেখতে পেল—আলো থেকে বেরিয়ে আসছে রোহিনী। কিন্তু এবার সে আগের মতো রহস্যময় ছায়া নয়, বরং একেবারে স্পষ্ট রূপে, যেন বাস্তবের মাংস-রক্তের মানুষ। তার চোখে গভীর তীক্ষ্ণতা, মুখে এক অদ্ভুত শান্তি, আর গলায় এমন দৃঢ়তা যা অর্ণব আগে শোনেনি। রোহিনী সরাসরি অর্ণবের দিকে তাকাল, বলল—“এবার সময় এসেছে সত্যটা জানার। তুমি এখনো ভাবছো তুমি কেবল এক অদ্ভুত স্বপ্নের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছো। কিন্তু না, এটা কোনো স্বপ্ন নয়। তুমি একটি বিশাল পরীক্ষার অংশ।” অর্ণব হতচকিত হয়ে গেল। তার বুক কেঁপে উঠল, প্রশ্ন জমা হলো ঠোঁটে—“কোন পরীক্ষা? কে করছে এইসব?” রোহিনী তার কথার মাঝেই শান্ত ভঙ্গিতে হাত তুলল, বলল—“এটা শুধু এক শহর, এক সময়, বা এক বাস্তবতার পরীক্ষা নয়। তোমাকে ব্যবহার করা হচ্ছে সমান্তরাল মহাবিশ্বের প্রতিটি সংস্করণে মানুষের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করার জন্য।”

অর্ণব যেন বজ্রাহত হলো। মাথার ভেতর দ্রুত শব্দের ঝড় বয়ে গেল—“সমান্তরাল মহাবিশ্ব!” সে বইয়ে পড়েছে, তত্ত্বে জেনেছে, কিন্তু সেটা যে তার জীবনের বাস্তব হয়ে দাঁড়াবে তা কল্পনাও করেনি। রোহিনী ধীরে ধীরে তার ব্যাখ্যা শুরু করল। সে বলল—“এই মহাবিশ্ব একা নয়। প্রতিটি সিদ্ধান্ত, প্রতিটি সম্ভাবনা থেকে নতুন এক মহাবিশ্ব জন্ম নেয়। আর প্রতিটি মহাবিশ্বে মানুষ আলাদা পথে এগোয়, ভিন্ন ভিন্ন পরিণতি বেছে নেয়। বিজ্ঞানীরা বহুদিন ধরে চেষ্টা করছে এই শাখাগুলিকে বোঝার, তাদের প্রতিক্রিয়া নিরীক্ষণের। আর তুমি, অর্ণব, সেই পরীক্ষার কেন্দ্রবিন্দু। তোমার ভেতর দিয়ে তারা যাচাই করছে—কোনো মানুষ কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়, যখন তাকে ক্রমাগত অচেনা বাস্তবতার ভেতর ফেলে দেওয়া হয়।” অর্ণব স্তব্ধ হয়ে গেল। তার বুকের ভেতর ভয় ও বিস্ময়ের স্রোত বইতে লাগল। সে তো ভেবেছিল সে কেবল হারিয়ে যাচ্ছে অচেনা এক দুনিয়া থেকে আরেক দুনিয়ায়। কিন্তু আসলে তাকে নিয়ে খেলা চলছে, এমন এক খেলা যার খেলোয়াড়ই হয়তো দেবতার মতো শক্তিশালী কোনো বিজ্ঞানী বা অদৃশ্য শক্তি।

রোহিনীর চোখে তীব্র আলো ঝলসে উঠল। সে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল—“তুমি এখনো বুঝছো না, অর্ণব। তুমি কেবল পর্যবেক্ষিত নও, তুমি নিজেই এক পরীক্ষাগার। প্রতিটি বাস্তবতায় তুমি ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিচ্ছো, আর সেই সিদ্ধান্তের ফলাফল মাপা হচ্ছে। যখন তুমি অতীতের মানুষদের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলে, তখন দেখা হচ্ছিল—একজন মানুষ যদি ভবিষ্যতের জ্ঞান বহন করে, তবে সমাজ কিভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়। যখন তুমি দেখেছিলে নিঃসঙ্গ শহর, তখন দেখা হচ্ছিল—মানুষ একাকীত্বে কীভাবে টিকে থাকে। আর এখন… এখন সময় এসেছে বোঝার, তুমি নিজে এই পরীক্ষার সঙ্গে কতটা মানিয়ে নিতে পারো।” অর্ণব শ্বাস নিতে কষ্ট বোধ করল। মনে হচ্ছিল সে একটা কাচের খাঁচায় বন্দি, আর অগণিত অদৃশ্য চোখ তার প্রতিটি পদক্ষেপ রেকর্ড করছে। তার মনের গভীরে প্রশ্ন গর্জে উঠল—কে করছে এই পরীক্ষা? আর তাদের উদ্দেশ্য কী? সে কি কেবল এক পুতুল, নাকি সত্যিই কোনো মহাজাগতিক রহস্যের অংশ হয়ে উঠেছে? রোহিনী যেন তার মনের ভেতরটা পড়ে ফেলল। ঠাণ্ডা গলায় বলল—“এরা শুধু বিজ্ঞানী নয়, এরা পর্যবেক্ষক। মানুষ যাদের ঈশ্বর বলে ভেবেছে, হয়তো তারা এরাই। তারা সৃষ্টি করেছে সম্ভাবনার খেলা, আর তুমি সেই খেলায় নির্বাচিত।”

অর্ণবের শরীর কেঁপে উঠল। হঠাৎ মনে হলো মাটির নিচ থেকে ধীরে ধীরে উঠছে কম্পন, যেন পুরো শহরটি দুলে উঠছে। কিন্তু চারপাশের মানুষ এখনো অচল, যেন সময় থেমে গেছে। কেবল রোহিনী আর সে নড়ছে, কথা বলছে। অর্ণব বুঝতে পারল—এটাই আসল পরীক্ষা, যেখানে কেবল তাকে টেনে আনা হয়েছে সত্যের মুখোমুখি। তার কণ্ঠ কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে এলো—“তাহলে আমি কে? আমি কি কেবল পরীক্ষার বস্তু, না কি আমার কোনো স্বাধীনতা আছে?” রোহিনীর ঠোঁটে এক অদ্ভুত হাসি ফুটল। সে ধীরে ধীরে বলল—“এই প্রশ্নই তোমার আসল শক্তি। যে নিজেকে প্রশ্ন করতে জানে, সে-ই শেষ পর্যন্ত নিজের ভাগ্য লেখে। কিন্তু মনে রেখো, অর্ণব, প্রতিটি মহাবিশ্বে তুমি আলাদা সিদ্ধান্ত নিচ্ছো। আর তোমার প্রতিটি সিদ্ধান্তই তাদের পরীক্ষার অংশ।” হঠাৎ করে আকাশের দিক থেকে আবার সেই অদৃশ্য কণ্ঠ ভেসে এলো—“পরীক্ষা চলতে থাকবে। অর্ধেক পথ অতিক্রান্ত হয়েছে।” কণ্ঠস্বরের সঙ্গে সঙ্গে থেমে থাকা দৃশ্যপট আবার চলতে শুরু করল। ঘোড়ার গাড়ি এগিয়ে গেল, বাতাসে ভেসে এলো মানুষের কণ্ঠ, আর গ্যাসল্যাম্প আবার টিমটিম করে জ্বলে উঠল। অর্ণব চারপাশে তাকাল, কিন্তু রোহিনী কোথাও নেই। কেবল তার কানে বাজতে থাকল সেই কথাগুলো—“তুমি শুধু পর্যবেক্ষিত নও, তুমি নিজেই এক পরীক্ষাগার।”

আট

অর্ণব প্রথমে টের পেল মাটির ভেতর থেকে আসা এক অদ্ভুত কম্পন। চারপাশের দৃশ্যপট যেন হালকা কাঁপছে, কুয়াশার মতো দুলছে। হঠাৎ দেখল, দূরের আকাশচুম্বী কাঁচের টাওয়ারের ভেতর দিয়ে উঁকি মারছে এক ভগ্ন মন্দিরের গম্বুজ, আর মন্দিরের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা লোকজন। ট্রামের লাইনের ওপর দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে এক ঘোড়ার গাড়ি, আর তার ছায়ার মধ্যে মিলেমিশে আছে স্বয়ংক্রিয় উড়ন্ত যানের ভাসমান আলো। অর্ণব চোখ ঘষে দেখতে চেষ্টা করল—এ কি কেবল তার দৃষ্টির বিভ্রম, নাকি আসলেই চারটি আলাদা যুগ, আলাদা বাস্তব এখন একসঙ্গে ধসে পড়ছে এক বিন্দুতে? সে দেখল, একদিকে হাঁটছে উপনিবেশিক আমলের ভদ্রলোক, কাঁধে লণ্ঠন নিয়ে; তাদের পাশেই ছুটে যাচ্ছে নিওন আলোয় সাজানো ভবিষ্যতের কৃত্রিম মানুষ, আর তাদের মাঝখান দিয়ে হাঁটছে বর্তমানের সাধারণ অফিসগামী ভিড়। যেন সব সময়কাল, সব বাস্তব একসঙ্গে এক রঙিন অথচ বিভীষিকাময় চিত্রপটে আটকে গেছে। অর্ণবের গলা শুকিয়ে গেল। তার মনে হলো, বাস্তবতার ভিত্তিই ভেঙে পড়ছে।

চারপাশে মানুষের চিৎকার শোনা গেল, কিন্তু প্রত্যেকের ভাষা যেন আলাদা, একে অপরের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা। কেউ প্রাচীন সংস্কৃতে প্রার্থনা করছে, কেউ ইংরেজ শাসকের আদেশ দিচ্ছে, কেউ আবার ভবিষ্যতের কোনো যান্ত্রিক ভাষায় নির্দেশ ছুড়ছে। এই ভিন্ন ভিন্ন সুর যেন মিশে গিয়ে এক অদ্ভুত শব্দতরঙ্গ তৈরি করছে, যা অর্ণবের মাথার ভেতর আছড়ে পড়ছে। সে অনুভব করল, তার মস্তিষ্ক যেন ভেঙে যাচ্ছে—যেন তাকে একইসঙ্গে চারটি ভিন্ন জীবন, চারটি ভিন্ন বাস্তবতার স্মৃতি বহন করতে বাধ্য করা হচ্ছে। সে রাস্তার একপাশে দেখতে পেল ভগ্নপ্রায় প্রাসাদের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে অধ্যাপক দত্ত, যার ঠোঁটে সেই রহস্যময় বাক্য—“সমস্ত মহাবিশ্ব আসলে এক গল্প।” অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে রোহিনী, ভবিষ্যতের পোশাকে, তাকে সতর্ক করছে—“এই ভাঙন স্থায়ী নয়, অর্ণব। তুমি যদি নিজেকে সামলাতে না পারো, তবে তুমি নিজেই হারিয়ে যাবে অনন্ত ভাঙনের মধ্যে।” কিন্তু এই সতর্কবাণীর মাঝেও অর্ণব অনুভব করল, চারপাশের প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি মানুষ ক্রমশ গলে গিয়ে মিশে যাচ্ছে একে অপরের ভেতর।

অর্ণব বুঝতে পারল—এটা কেবল দৃশ্যের অদলবদল নয়, বরং বাস্তবতার স্তরগুলো ভেঙে গিয়ে একে অপরকে গ্রাস করছে। যে ট্রামলাইন ধরে সে কখনো অনন্যার সঙ্গে হাঁটত, এখন সেই লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে ভগ্ন মন্দিরের স্তম্ভ। গম্বুজ ভেদ করে উঠে আসছে কাঁচের টাওয়ার, আর টাওয়ারের ভেতর শোনা যাচ্ছে ঘোড়ার টগবগ শব্দ। যেন ইতিহাস, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ একই ছাঁচে ঢুকে পড়েছে, কিন্তু জায়গা না পেয়ে একে অপরকে ধ্বংস করছে। তার চোখের সামনে এক নারী দাঁড়িয়ে, দেখতে অনন্যার মতো, কিন্তু তার মুখে প্রাচীন ভাষা, অন্যদিকে একই মুখ আরেক জায়গায় রোবোটিক কণ্ঠে বলছে অচেনা শব্দ। অর্ণব হঠাৎ বুঝতে পারল—যে সমস্ত বাস্তবতায় সে এতদিন ঘুরে বেড়াচ্ছিল, সেগুলো আলাদা নয়, বরং সমান্তরাল স্রোতের মতো পাশাপাশি বয়ে চলছিল। এখন সেই স্রোতগুলো একসঙ্গে মিশে গিয়ে বিশাল বন্যার মতো সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সে অনুভব করল, তার নিজের সত্তাও যেন টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে—একটি অংশ প্রাচীন সভ্যতায় বন্দি, একটি অংশ উপনিবেশিক কলকাতায়, একটি অংশ ভবিষ্যতের যান্ত্রিক নগরে, আর আরেকটি অংশ তার চেনা বর্তমানের মাঝখানে।

আকাশে হঠাৎ সেই অদৃশ্য কণ্ঠ ভেসে এলো—কিন্তু এবার তা ছিল না শান্ত বা আশ্বস্ত করা। কণ্ঠস্বর যেন গর্জে উঠল, চারদিক কাঁপিয়ে দিয়ে বলল—“সমস্ত বাস্তবের ভারসাম্য ভেঙে পড়ছে। পর্যবেক্ষণ প্রায় শেষের পথে।” শব্দের সঙ্গে সঙ্গে আকাশ ফেটে বেরোল আলোর ঝলকানি। আলোয় দেখা গেল চারটি ভিন্ন দৃশ্যপট একসঙ্গে ভেসে উঠেছে—নীয়ন আলোয় ভরা ভবিষ্যতের দালান, ধ্বংসস্তূপ হয়ে যাওয়া প্রাচীন শহর, ব্রিটিশ আমলের মশালের রাস্তা, আর আধুনিক ট্রামের ট্র্যাক। প্রতিটি দৃশ্য যেন তাকে টানছে আলাদা দিকে। অর্ণব কেঁপে উঠল। সে জানল, তাকে এখনই কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হবে, নইলে এই ভাঙনের মধ্যে সে নিজেই হারিয়ে যাবে, এক চিরন্তন বিভ্রমের বন্দি হয়ে। তার মাথায় প্রতিধ্বনিত হলো রোহিনীর সেই কথা—“তুমি শুধু পর্যবেক্ষিত নও, তুমি নিজেই এক পরীক্ষাগার।” অর্ণব দাঁড়িয়ে রইল সেই ভাঙনের মাঝখানে, তার চোখে ভয়ের সঙ্গে মিশে উঠল এক অদ্ভুত দৃঢ়তা। হয়তো এটাই মুহূর্ত, যখন তাকে নিজের বাস্তব বেছে নিতে হবে।

নয়

অর্ণব অনুভব করল, চারপাশের শব্দ, আলো আর ভাঙা বাস্তবের তীব্র চাপ হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। যেন হাহাকার, চিৎকার, ধ্বংসস্তূপ, মশালের ছায়া আর নিওন আলো একসঙ্গে গলে গিয়ে নেমে এলো গভীর নীরবতায়। সে দেখল, চারপাশ শূন্যতায় ভেসে যাচ্ছে—না মাটি, না আকাশ, শুধু এক অসীম অন্ধকার, যার ভেতর থেকে ভেসে আসছে আলোর বিন্দু। সেই বিন্দুগুলো একে একে রূপ নিচ্ছে গ্রহ, নক্ষত্র, নগর, মন্দির, প্রাসাদ আর যান্ত্রিক শহরের। অর্ণব বুঝতে পারল, সে দাঁড়িয়ে আছে এমন এক জায়গায়, যেখানে সমস্ত বাস্তবতার মূল জন্ম নেয়। এই অসীমতার ভেতর হঠাৎ ভেসে উঠল এক ছায়ামূর্তি—অদৃশ্য অথচ স্পষ্ট। মূর্তির মুখ নেই, শরীর নেই, কেবল এক পরিবর্তনশীল আলোকরেখা, যেন প্রতি মুহূর্তে নতুন আকার নিচ্ছে। আর সেই অদ্ভুত আলোকসত্তা থেকেই বেরিয়ে এলো পরিচিত কণ্ঠ—যে কণ্ঠ এতদিন অদৃশ্য পর্যবেক্ষক হিসেবে তাকে পথ দেখাচ্ছিল। কণ্ঠ এবার বলল, “অর্ণব, তুমি এসেছো অবশেষে। তোমার যাত্রা প্রায় শেষের পথে। আমি সেই পরীক্ষক, যে এতদিন তোমাকে দেখছিল।”

অর্ণবের বুক ধকধক করতে লাগল। সে জিজ্ঞেস করল, “কেন আমি? কেন আমাকে এই সব বিভ্রমের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হলো?” আলোকসত্তা যেন তার প্রশ্নের ভেতর দিয়ে ভেসে গিয়ে উত্তর দিল, “কারণ তুমি একজন গল্পকার। পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ আছে, কিন্তু সবাই পারে না বাস্তবতার ভেতরে থাকা অসংখ্য স্তর একসঙ্গে দেখতে। গল্পকারের চোখ ভিন্ন—তারা কেবল দৃশ্য দেখে না, তারা অনুভব করে, কল্পনা করে, আর সেই কল্পনাকে বাস্তবের সঙ্গে মিলিয়ে নতুন অর্থ খুঁজে পায়। তুমি যখন লেখ, তখন তোমার প্রতিটি শব্দই সম্ভাব্য বাস্তবতার এক দরজা। আর সেই দরজা দিয়েই আমরা প্রবেশ করি।” অর্ণবের শরীর কেঁপে উঠল। এতদিন যা সে ভেবেছিল কেবল এক দুঃস্বপ্ন, তা আসলে এক মহাজাগতিক পরীক্ষা। পরীক্ষক আরও বলল, “আমরা সমান্তরাল মহাবিশ্বগুলো পর্যবেক্ষণ করি। কিন্তু সেই মহাবিশ্বকে একত্রে উপলব্ধি করতে আমাদের প্রয়োজন একজন গল্পকার—কারণ গল্পই হলো সেই একমাত্র ভাষা, যা সব বাস্তবতাকে বেঁধে রাখতে পারে।”

অর্ণব ধীরে ধীরে বুঝতে পারল, এই পরীক্ষার প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি অদ্ভুত পরিবর্তন আসলে তার সৃষ্টিশীলতা যাচাই করার একেকটি ধাপ ছিল। প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসস্তূপ, ব্রিটিশ আমলের কলকাতা, ভবিষ্যতের যান্ত্রিক শহর—সবই ছিল তার কল্পনার ভেতর বপন করা বীজ, যেগুলো পরীক্ষক বাস্তবে রূপ দিয়েছিল। তার মনে পড়ল, সে ছোটবেলায় শুনত নানা পুরাণ, ইতিহাস আর বিজ্ঞানকল্প কাহিনি, আর সেসব কাহিনি তার ভেতরে তৈরি করেছিল অসংখ্য জগৎ। আজ সেই জগতগুলোই একে একে খুলে গিয়েছে তার সামনে। পরীক্ষক বলল, “তুমি ভাবছো, তোমাকে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু না, অর্ণব। তুমি নিজেই বেছে নিয়েছো এই পথ। তুমি যে প্রতিটি গল্প লিখেছো, প্রতিটি চরিত্র কল্পনা করেছো, তার ভেতর দিয়েই তুমি আমাদের আহ্বান জানিয়েছো। আর আজ আমরা তোমাকে জানাচ্ছি—তুমি এখন কেবল এক লেখক নও, তুমি এক সেতু, যে সেতু দিয়ে এক বাস্তব থেকে অন্য বাস্তবে যাওয়া সম্ভব।” অর্ণব অনুভব করল, তার বুকের ভেতর ভয় আর বিস্ময়ের পাশাপাশি জেগে উঠছে এক অদ্ভুত গর্ব।

কিন্তু সেই গর্বের মাঝেও প্রশ্ন রয়ে গেল। সে ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করল, “তাহলে এর মানে কি আমি আমার জীবন আর বাস্তব হারিয়ে ফেলব? আমি কি আর কখনো অনন্যার কাছে ফিরতে পারব না?” পরীক্ষকের আলোকদেহ এক মুহূর্ত থমকে রইল, তারপর উত্তর দিল, “বাস্তব বলে আলাদা কিছু নেই, অর্ণব। বাস্তব হলো গল্পের মতো—যতক্ষণ তুমি তাকে বিশ্বাস করো, ততক্ষণ সে বেঁচে থাকে। অনন্যা তোমার জীবনের গল্পের অংশ, তাই সে থাকবে। কিন্তু তোমাকে শিখতে হবে তাকে দেখতে নতুন চোখে—কারণ সে হয়তো আর কেবল এক পৃথিবীর অনন্যা নয়, বরং বহু বাস্তবের অনন্যা। তুমি যদি গল্পকার হিসেবে তোমার ক্ষমতাকে গ্রহণ করো, তবে তুমি পারবে তাকে সব মহাবিশ্বে খুঁজে নিতে। তোমার কলমই হবে তোমার দিশারী।” এই উত্তর শুনে অর্ণবের মনে হলো, তার অস্তিত্বই বদলে যাচ্ছে। সে যেন একসঙ্গে ভয় পাচ্ছে আর বিস্ময়ে ভরে উঠছে। সে বুঝল, তার পরীক্ষা শেষ হয়নি, বরং এখনই শুরু হলো আসল যাত্রা। সামনে অপেক্ষা করছে এক শেষ দরজা, যেটি তাকে পার হতে হবে নিজের ইচ্ছাশক্তি আর গল্পকারের দৃষ্টি নিয়ে।

দশ

অর্ণব যখন পরীক্ষকের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, চারপাশে সেই অসীম শূন্যতা এক নতুন রূপ নিতে শুরু করল। অন্ধকারের ভেতর থেকে ভেসে উঠতে লাগল অগণিত দরজা—কেউ কাঠের, কেউ ইস্পাতের, কেউবা অদ্ভুত আলোয় ঝলমল করছে। প্রতিটি দরজা যেন কোনো এক ভিন্ন বাস্তবের প্রতীক। পরীক্ষক বলল, “অর্ণব, এটাই তোমার শেষ পরীক্ষা। তোমার হাতে আছে দুটি পথ—তুমি চাইলে এই সমস্ত দরজা বন্ধ করে নিজের জীবনে ফিরে যেতে পারো। সেখানে তোমার অনন্যা, তোমার অসমাপ্ত গল্প আর তোমার সাধারণ জীবন অপেক্ষা করছে। অথবা তুমি চাইলে এই অসীম বাস্তবতাগুলোর অভিভাবক হয়ে থেকে যাবে। তখন আর তুমি কেবল একজন মানুষ নও, বরং এক সেতু, এক রক্ষক, যে গল্পের ভেতর দিয়ে বহু মহাবিশ্বকে রক্ষা করবে।” অর্ণব শুনতে পেল তার বুকের ভেতর হৃদস্পন্দন তীব্র হয়ে উঠছে। তার চোখের সামনে একদিকে ভেসে উঠছে পরিচিত ঘর, অনন্যার হাসি, কলকাতার রাস্তায় ট্রামের ঝংকার; আর অন্যদিকে ভেসে উঠছে অজানা সব জগত—প্রাচীন সভ্যতার প্রত্নস্তূপ, ভবিষ্যতের অন্ধকার নগরী, উপনিবেশিক পথের শীতল ছায়া। সে জানল, এই মুহূর্তেই তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

অর্ণবের হাত ধীরে ধীরে কাঁপতে লাগল। তার মনে পড়ল সেই দিনগুলোর কথা, যখন সে শুধু একজন লেখক ছিল—কলম আর খাতার ভেতর গড়ে তুলত কল্পনার জগত। তার গল্পগুলো হয়তো কেউ কেউ পড়ত, আবার কেউ কেউ অবহেলা করত। তবুও সে লিখত, কারণ লেখা ছাড়া তার বেঁচে থাকা সম্ভব ছিল না। আজ বুঝতে পারল, সেই গল্পগুলোই তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। পরীক্ষক তাকে বলল, “স্মরণ রেখো, ফিরে গেলে তোমার স্মৃতির অনেকটা ঝাপসা হয়ে যাবে। তুমি হয়তো আর মনে করতে পারবে না এই অসীম ভ্রমণের কথা। তুমি কেবল টের পাবে, কিছু অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিলে। আর যদি থাকতে চাও, তবে তুমি আর কেবল অর্ণব নও—তুমি তখন হয়ে যাবে কাহিনির রক্ষক, যে প্রতিটি মহাবিশ্বকে গল্পের সুতোয় বেঁধে রাখবে।” অর্ণব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। অনন্যার চোখ তার সামনে ভেসে উঠল। কিন্তু সেই চোখ যেন এক নয়, একাধিক রূপ—ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবের অনন্যা, একবার মন্দিরের ছায়ায় দাঁড়িয়ে, একবার ভবিষ্যতের অচেনা পোশাকে, আবার কখনো ব্রিটিশ আমলের গৃহিণীর রূপে। সে বুঝল, যাকে ভালোবাসা যায়, তাকে হারানো যায় না—বাস্তবের দেয়াল যতই বদলাক না কেন।

হঠাৎ অর্ণবের হাতের মুঠোয় ভেসে উঠল এক কলম। সে বুঝতে পারল, তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আর মুখে উচ্চারণ করতে হবে না, বরং লিখতে হবে। ধীরে ধীরে সে সাদা পৃষ্ঠার ওপর লিখতে শুরু করল—“আমি শুধু লেখক নই, আমি সমস্ত কলকাতার ইতিহাস, ভবিষ্যৎ আর স্বপ্নের সাক্ষী। আমি সেই সেতু, যে মানুষকে ভিন্ন বাস্তবের দরজায় পৌঁছে দেবে। আমি সেই চোখ, যে অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের ভেতর লুকিয়ে থাকা কাহিনি খুঁজে পাবে।” শব্দগুলো লিখতে লিখতে তার চারপাশে আলো বিস্ফোরিত হলো। সেই আলোয় একসঙ্গে দেখা দিল অসংখ্য কলকাতা—হাওড়া ব্রিজে গাড়ির ভিড়, বিদ্যাসাগরের সময়কার অশ্বত্থগাছের তলায় জমায়েত, স্বাধীনতার আন্দোলনের মিছিল, ভবিষ্যতের আকাশছোঁয়া টাওয়ার। প্রতিটি কলকাতা যেন আলাদা, আবার প্রতিটি একই সঙ্গে বাঁধা এক সুতোয়। পরীক্ষক সন্তুষ্টির কণ্ঠে বলল, “তুমি তোমার পথ বেছে নিয়েছো, অর্ণব। তুমি এখন থেকে কেবল এক ব্যক্তি নও, বরং এক কাহিনির রক্ষক।”

আলো ধীরে ধীরে থিতিয়ে এলো। অর্ণব অনুভব করল, সে দাঁড়িয়ে আছে তার নিজের শহরে—কলকাতার রাস্তায়। ট্রামের ঘণ্টা বাজছে, আড্ডার আসর জমেছে কফি হাউসে, গঙ্গার বাতাসে ভেসে আসছে সন্ধ্যার আরতি। অনন্যা তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, একেবারে বাস্তব আর স্পর্শযোগ্য। কিন্তু অর্ণবের চোখে ভেসে উঠছে তার আরও অনেক রূপ—যেন সে একসঙ্গে অনেক বাস্তবের অনন্যা। অর্ণব বুঝতে পারল, সে আর কেবল নিজের জীবনে ফিরে আসেনি, বরং নতুন জীবন শুরু করেছে। এখন থেকে তার প্রতিটি লেখা, প্রতিটি গল্প, হবে একেকটি বাস্তবতার দরজা। হয়তো মানুষ ভাববে, ওগুলো কেবল সাহিত্য, কেবল কল্পনা। কিন্তু সে জানে—প্রতিটি গল্পের ভেতরই লুকিয়ে আছে অন্য কোনো মহাবিশ্বের সত্য। আর সেই সত্যকে ধরে রাখাই তার দায়িত্ব। অর্ণব আকাশের দিকে তাকাল, মনে হলো শূন্যের ভেতর থেকে পরীক্ষকের কণ্ঠ ভেসে আসছে—“গল্প কখনো শেষ হয় না, অর্ণব। গল্পই হলো আসল বাস্তব।” আর সেই মুহূর্তে অর্ণব নিশ্চিত হলো, সে তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।

শেষ

1000059752.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *