Bangla - কল্পবিজ্ঞান

সময়ের সেতু

Spread the love

অনিত চক্রবর্তী


এক

অর্ণব সেনের চোখে তখন ঘুমের ছায়া নেই, কেবল জেগে আছে অদম্য স্বপ্নের আলো। ল্যাবরেটরির অন্ধকার ঘরখানায় টেবিলজোড়া ছড়ানো যন্ত্রপাতি, নীল আলোতে ঝলমল করা মনিটরের গ্রাফ, আর চারদিকে ছড়ানো অজস্র খসখসে কাগজ। কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে তার গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মীদের কাছে পাগলামি ছাড়া কিছু নয়, কিন্তু অর্ণব বিশ্বাস করে—সময় কোনো স্থির জিনিস নয়, বরং এক অদৃশ্য নদী, যেখানে স্রোতের বিপরীতে হাঁটার মতোই অতীতে বা ভবিষ্যতে যাওয়া সম্ভব। সে নিজেকে বারবার বোঝায়, এই আবিষ্কার শুধু বিজ্ঞানের ইতিহাস নয়, মানবজাতিরও নতুন ভোর নিয়ে আসবে। শৈশব থেকেই সে ভবিষ্যৎ দেখার স্বপ্নে বিভোর ছিল—যেখানে প্রযুক্তি সীমাহীন, রোগমুক্ত এক সমাজ, আর মানুষ মহাশূন্যে নিজের বাসস্থান তৈরি করেছে। বহু রাতের নির্ঘুম পরিশ্রম শেষে, অবশেষে এক ঝড়ো রাতের নিস্তব্ধতায় সে দাঁড়িয়ে আছে নিজের তৈরি টাইম-মেশিনের সামনে। চৌম্বক তরঙ্গের শব্দ কানে বেজে উঠছে, ধাতব বৃত্তের ভেতরে জমছে অজানা আলোর ঘূর্ণি। তার ভেতরটা কেঁপে ওঠে ভয় আর উল্লাসে, কিন্তু বৈজ্ঞানিক মনে ভয়ের কোনো জায়গা নেই—শুধু পরীক্ষার ফলাফল। “এবার,” নিজের ঠোঁটে চাপা স্বর শোনা যায়, “ইতিহাসে আমার নাম লেখা থাকবে।”

যন্ত্র চালু করার মুহূর্তে চারপাশে যেন বজ্রপাতের ঝলকানি ছড়িয়ে পড়ে। অর্ণব অনুভব করে মাটির নিচ থেকে প্রবল কম্পন উঠছে, যেন পৃথিবীর গোপন ভাঁজ থেকে সময়ের স্তরগুলো খুলে যাচ্ছে। বাতাস ঘূর্ণির মতো বয়ে যায়, চোখে-মুখে লেগে যায় বিদ্যুৎঝলকানো হাওয়া। সে নিজের শরীরকে হালকা হতে দেখে, যেন মাধ্যাকর্ষণ তার ওপর থেকে ক্ষমতা হারিয়েছে। চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে যায় মনিটর, দেয়াল, ল্যাব—সবকিছু মিলিয়ে গিয়ে রূপ নেয় এক অজানা অন্ধকারে। তার বুক ধড়ফড় করে ওঠে, কিন্তু তার যুক্তিবাদী মন আশা করে—কিছু মুহূর্ত পরেই সে দাঁড়িয়ে থাকবে ভবিষ্যতের প্রযুক্তি-সমৃদ্ধ পৃথিবীতে। হয়তো সে দেখবে ভাসমান শহর, মঙ্গল গ্রহে মানুষের বসতি, কিংবা এমন কোনো সভ্যতা যেখানে মৃত্যুকেও জয় করা গেছে। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরই আলো-ঝড় থেমে গেলে সে বুঝতে পারে, তার প্রত্যাশা বাস্তবের সঙ্গে মেলে না। পায়ের নিচে কাদায় ভেজা মাটি, বাতাসে বারুদ আর ঘামের গন্ধ, দূরে ভেসে আসে ঢোলের তীব্র আওয়াজ আর তলোয়ারের ঝনঝনানি। মাথা ঘুরে দাঁড়িয়ে যখন চারপাশে তাকায়, তখন সে দেখে—অজস্র সৈনিকের ভিড়, কেউ ঘোড়ায় সওয়ার, কেউ হাতে বর্শা, কেউ কামানের পাশে দাঁড়িয়ে। আকাশে ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাক খাচ্ছে, আর সেই ধোঁয়ার আড়াল দিয়ে উঁকি দিচ্ছে জুন মাসের স্যাঁতসেঁতে আকাশ।

অর্ণব প্রথমে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। এ কি কোনো ভার্চুয়াল ইলিউশন? নাকি টাইম-মেশিন তাকে ভুল সময়ে ছুড়ে ফেলেছে? ধীরে ধীরে উপলব্ধি হয়—সে এসে পড়েছে ১৭৫৭ সালের প্লাসির যুদ্ধক্ষেত্রে, সেই মুহূর্তে যা ভারতের ইতিহাসে এক বিরাট মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে, কারণ সে জানে এই যুদ্ধের ফলাফল মানেই এক দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসনের সূচনা, যার ছায়া কয়েক শতাব্দী জুড়ে তার দেশকে বেঁধে রেখেছিল। চারদিকে ছুটোছুটি করছে সৈন্য, কেউ তাকে সন্দেহের চোখে দেখছে, কারণ তার পোশাক অচেনা, চশমা চোখে একেবারেই অদ্ভুত। একদল বর্শাধারী তাকে প্রায় ধরে ফেলতে যাচ্ছিল, এমন সময় সে আড়ালে সরে গিয়ে শ্বাস নিল। মাথার ভেতরে তখনও ঝড় বইছে—সে কি সত্যিই ইতিহাসের মাটিতে পা রেখেছে? ল্যাবের একাকী রাত থেকে হঠাৎ করে সে এখন ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত যুদ্ধক্ষেত্রে। ভয়, বিস্ময় আর অদম্য কৌতূহল একসঙ্গে তার হৃদয়ে তোলপাড় করে। আর তখনই তার মনে উদয় হয় এক অনিবার্য প্রশ্ন—সে কি কেবল দর্শক হয়ে থাকবে, নাকি নিজের আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়ে ইতিহাস পাল্টে দেওয়ার দায়িত্ব নেবে? এই প্রশ্নের উত্তর তখনো তার অজানা, কিন্তু সে বুঝে যায়—সময় আর বাস্তবতার সেতুতে পা রেখেই তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে।

দুই

অর্ণব প্রথমে চারদিকে তাকিয়ে কিছুই বুঝতে পারছিল না। চারদিক থেকে ভেসে আসছিল ঢোলের ঘনঘটা, শিঙ্গার তীব্র আওয়াজ আর মানুষের হুঙ্কার—যেন পৃথিবী এক অচেনা যুদ্ধে ফেটে পড়েছে। কাদায় ভেজা মাটির গন্ধ, বাতাসে বারুদের তীব্রতা আর ঘোড়ার খুরের শব্দে তার বুক কেঁপে উঠছিল। আধুনিক শহরের নিঃশব্দ ল্যাবরেটরি থেকে এমন এক পরিবেশে পড়ে সে যেন দিশেহারা হয়ে গেল। চোখের সামনে দিয়ে ছুটে যাচ্ছে অশ্বারোহী সৈন্যরা, কারও হাতে বর্শা, কারও হাতে তলোয়ার, আবার কেউ কামানের কাছে দাঁড়িয়ে ব্যস্তভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে। মাথার ওপর ঝুলছে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী, আর মাঝে মাঝে বজ্রপাতের মতো ভেসে আসছে কামানের গর্জন। সে নিজের দিকে তাকিয়ে হকচকিয়ে গেল—চশমা পরা, আধুনিক শার্ট, জ্যাকেট আর প্যান্ট তার চেহারাকে এখানে একেবারেই অদ্ভুত করে তুলেছে। সৈন্যদের চোখে সে বিদেশি গুপ্তচরের মতোই মনে হলো। দু’জন বর্শাধারী তাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে এলো, তাদের মুখে সন্দেহের রেখা স্পষ্ট। অর্ণবের বুক ধড়ফড় করে উঠল—কীভাবে বোঝাবে সে কে, অথবা কেন এখানে? ইতিহাসের বইয়ে পড়া যুদ্ধক্ষেত্র এখন তার চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠেছে, অথচ সেই ইতিহাসের ভেতর তার উপস্থিতি এক অনাহুত রহস্য।

ঠিক তখনই এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। দুই সৈন্য যখন তাকে জাপটে ধরতে যাচ্ছিল, তখন আরেকদিক থেকে এক তরুণ সৈনিক এসে চিৎকার করে বলল, “থামো! এ লোকটা গুপ্তচর হলে এত বেমানান পোশাকে আসত না। আমার সঙ্গে চল।” সেই তরুণের নাম রহিমুদ্দিন, বয়স মাত্র কুড়ি-পঁচিশ, মুখে ঘামের ফোঁটা, চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। সে অর্ণবকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল এক আড়াল করা তাঁবুর দিকে। সেখানে বসেছিল আরেক সৈনিক, গায়ের রং শ্যামলা, চেহারায় সহজ সরলতা, নাম গোপাল দাস। গোপাল দাস অবাক হয়ে অর্ণবের দিকে তাকাল—“তুমি এভাবে কোথা থেকে এলে? পোশাক-আশাক তো একেবারেই অচেনা।” অর্ণব জবাব খুঁজে পেল না, কেবল মৃদু স্বরে বলল, “আমি… আমি এখানে ভুল করে চলে এসেছি।” সৈনিকেরা হাসল, ভেবেছিল হয়তো সে ভীত কোনো সাধারণ পথচারী। কিন্তু অর্ণবের চোখের ভেতর লুকানো আতঙ্ক আর রহস্য তারা বুঝে গেল। গোপাল দাস বলল, “শোনো, তোমার পোশাক দেখে এরা তোমাকে ইংরেজদের গুপ্তচর ভেবে ফেলবে। আমাদের ক্যাম্পে যদি ধরা পড়, তাহলে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবে না। আপাতত তুমি আমাদের সঙ্গে থাকো। আমরা তোমাকে আড়াল করে রাখব।” অর্ণব বুঝতে পারল, ভাগ্যের অদ্ভুত খেলায় এ দুই সাধারণ সৈনিকই তার প্রথম রক্ষক হয়ে উঠল।

সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্র আরও ভয়াল হয়ে উঠছিল। দূরে শিবিরে মশালের আলো জ্বলছে, সৈন্যরা গান গাইছে, কেউ কেউ তলোয়ার ঘষে প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেই ভয়ংকর পরিবেশে বসে অর্ণবের মনে হলো—সে যেন কোনো স্বপ্নের মধ্যে আছে। অচেনা এই পৃথিবী তার সামনে উন্মুক্ত হয়েছে এক রহস্যের দরজা হয়ে। রহিমুদ্দিন মাটিতে বসে বলল, “আমরা তো আর রাজা-নবাব নই, ভাই। আমরা গরিব ঘরের সন্তান। লড়তে আসি শুধু দু’মুঠো ভাতের আশায়।” গোপাল দাস মৃদু হেসে যোগ করল, “আমাদের বুকে দেশপ্রেম আছে, কিন্তু তা দিয়ে পরিবার চলে না। তবু যুদ্ধ আমাদের ডাকলে আসতেই হয়।” অর্ণব তাদের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। ইতিহাসের পাতা থেকে যে সৈনিকদের সে কেবল সংখ্যার মতো জেনেছিল, আজ তারা তার সামনে রক্ত-মাংসের মানুষ হয়ে দাঁড়াল। তাদের দুঃখ, আশা আর ভয়—সবকিছু তার চোখের সামনে বাস্তব হয়ে ফুটে উঠল। সে বুঝল, ইতিহাস শুধু রাজা, নবাব বা ইংরেজ অফিসারদের কাহিনি নয়—বরং সেই হাজারো সাধারণ মানুষের জীবনকথা, যাদের রক্তে একেকটি যুদ্ধের ফলাফল লেখা হয়। আর এই মুহূর্তে, সেই ইতিহাসের ভেতরে সে নিজেই এক অবাঞ্ছিত চরিত্র, যার হাতে হয়তো ভবিষ্যৎ বদলে দেওয়ার চাবিকাঠি লুকানো আছে। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়—সে কি দর্শক হয়ে থাকবে, নাকি এই অচেনা পৃথিবীর নিয়ম ভেঙে কিছু করতে এগিয়ে আসবে?

তিন

রাতের গভীর নীরবতায় অর্ণব বসেছিল রহিমুদ্দিন ও গোপাল দাসের সঙ্গে। আগুনের আলোতে সৈনিকেরা গান গাইছিল, কেউ কেউ আবার নীরবে নিজের অস্ত্র ধার দিচ্ছিল। বাতাসে ভেসে আসছিল ভাত আর মাংস রান্নার গন্ধ, তবু সেই গন্ধে শান্তি ছিল না—ছিল অদ্ভুত এক উৎকণ্ঠা। অর্ণবের বুকের ভেতরেও তখন তীব্র অস্থিরতা। সে ইতিহাস জানে, জানে আগামীকালের সূর্য উঠলেই ঘটবে এক ভয়ংকর অধ্যায়, যা ভারতের ভবিষ্যৎকে শতাব্দীর জন্য দাসত্বে বেঁধে দেবে। ইতিহাসের পাতায় যতবার সে পড়েছে, ততবার বুকের ভেতর কেঁপে উঠেছে মীর জাফরের নাম—নবাবের সেনাপতি, যিনি লোভে পড়ে ব্রিটিশদের সঙ্গে গোপন চুক্তি করেছিলেন। অর্ণব ধীরে ধীরে বুঝতে পারল, সময় তাকে এনেছে সেই ভয়াল রাতের ঠিক আগে, যখন সবকিছু নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে। তার বৈজ্ঞানিক মন বারবার বলছিল, “তুমি কেবল একজন দর্শক, ইতিহাসের স্রোতে হস্তক্ষেপ করা তোমার কাজ নয়।” কিন্তু মানুষের মন তাকে অন্য প্রশ্ন করছিল—”যদি তোমার হাতে ভবিষ্যৎ বদলানোর ক্ষমতা থাকে, তবে তুমি কি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে?” এই দ্বন্দ্বে তার নিশ্বাস ভারী হয়ে উঠল।

শিবিরে গোপনে ঘুরতে ঘুরতে অর্ণব একসময় শুনল ফিসফিস কণ্ঠে কয়েকজন উচ্চপদস্থ সৈনিকের আলাপ। সেখানে বারবার উচ্চারিত হচ্ছিল মীর জাফরের নাম। এক বৃদ্ধ সৈনিক বলছিল, “আমাদের নবাব তরুণ, হঠকারী। সেনাপতি যদি অন্তর থেকে তাকে সমর্থন না দেয়, তবে যুদ্ধ জেতা অসম্ভব।” অন্যজন ধীরে ধীরে বলল, “তুমি কি শোনোনি? মীর জাফর নাকি ইংরেজদের সঙ্গে গোপন কথাবার্তা চালাচ্ছে। আমাদের চোখের সামনে ইতিহাস পাল্টে যাবে।” এই কথা শুনে অর্ণবের বুক কেঁপে উঠল। সে জানত ইতিহাসে এ-ই ঘটেছিল—কিন্তু এখন সে সবকিছু নিজের কানে শুনছে। চোখের সামনে যেন বিশ্বাসঘাতকতার ছায়া ঘনিয়ে আসছে। আকাশে তখন কালো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছিল, দূরে শোনা যাচ্ছিল বজ্রপাতের শব্দ, যেন প্রকৃতিও বুঝে গেছে—অদ্ভুত কোনো অস্থিরতা নামতে চলেছে। অর্ণব ভাবল, যদি সে মীর জাফরকে থামাতে পারে, যদি তাকে বোঝাতে পারে যে বিশ্বাসঘাতকতার ফল ভয়াবহ হবে, তবে কি ভারতের ইতিহাস বদলানো সম্ভব হবে না? এই চিন্তা তার মস্তিষ্কে ঝড় তুলল। সে অনুভব করল, বিজ্ঞানী হিসেবে সে যতটা ঠান্ডা মাথায় থাকার চেষ্টা করছে, মানুষ হিসেবে তার হৃদয় ততটাই বিদ্রোহ করছে।

সেই রাতে অর্ণব আর ঘুমোতে পারল না। বারবার মনে পড়ছিল তার ল্যাবরেটরির রাতগুলো, যেখানে সে স্বপ্ন দেখত ভবিষ্যতের। অথচ ভবিষ্যৎ দেখার আগেই সে এসে পড়েছে অতীতে—যেখানে প্রতিটি সিদ্ধান্তের ওজন কোটি কোটি মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করবে। তার মনে প্রশ্ন জাগল, “আমি কি তাহলে কেবল ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকব? নাকি আমি হব পরিবর্তনের সেতু?” সে জানত, যদি সে মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতা ঠেকাতে পারে, তবে হয়তো ইংরেজদের জয় আটকানো সম্ভব হবে। কিন্তু সেই সঙ্গে এই ভয়ও কাজ করছিল—ইতিহাস পাল্টে দিলে ভবিষ্যতের পৃথিবীই হয়তো ভেঙে পড়বে। হয়তো সে নিজেই মুছে যাবে অস্তিত্ব থেকে। এই দ্বন্দ্ব তাকে তাড়া করতে লাগল এক অদৃশ্য দানবের মতো। রহিমুদ্দিন ও গোপাল দাস ঘুমিয়ে পড়লেও অর্ণব নীরব চোখে তাকিয়ে রইল মশালের আলোয় কাঁপতে থাকা শিবিরের তাঁবুগুলোর দিকে। সে জানত, এই তাঁবুর একটিতে বসে আছেন মীর জাফর, যিনি কালকের ভোরে ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেবেন। অর্ণবের বুক ধড়ফড় করে উঠল—সে কি সাহস করে তার মুখোমুখি দাঁড়াতে পারবে? নাকি ইতিহাসের মতোই সবকিছু চুপচাপ ঘটতে দেবে? আকাশে চাঁদ ডুবে যাচ্ছিল, দূরে ঢোলের শব্দ ক্ষীণ হচ্ছিল, আর তার ভেতরে কেবল স্পষ্ট হচ্ছিল একটি প্রশ্ন—বিশ্বাসঘাতকতার ছায়া সে কি মুছে দিতে পারবে? নাকি এই ছায়াই তার নিয়তি হয়ে থাকবে?

চার

অর্ণব যখন রহিমুদ্দিন ও গোপাল দাসের সহায়তায় শত্রুপক্ষের চোখ এড়িয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলার শিবিরে পৌঁছায়, তখন আকাশে রাতের অন্ধকার নেমে এসেছে। মশালের আলোয় ঝলমল করছে তাঁবুগুলো, যেখানে সশস্ত্র প্রহরীরা সতর্ক দৃষ্টি রেখে হাঁটাহাঁটি করছে। বাতাসে বারুদের গন্ধ, ঘোড়ার পায়ের শব্দ আর যুদ্ধের আগমনী উত্তেজনা মিশে এক অদ্ভুত আবহ তৈরি করেছে। অর্ণবের বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দ ক্রমশ বেড়ে চলেছে। সে জানে, ইতিহাসে বর্ণিত এই রাতের পরের দিনেই ঘটে যাবে সেই মর্মান্তিক যুদ্ধ, যা ভারতের ভাগ্য চিরদিনের মতো পাল্টে দেবে। সে যদি সত্যিই কিছু করতে চায়, তবে এই রাতটাই তার সুযোগ। ধীরে ধীরে সাহস সঞ্চয় করে অর্ণব গোপনে ঢুকে পড়ে নবাবের প্রধান তাঁবুর দিকে। ভেতরে প্রবেশ করতেই সে দেখতে পায়—মধ্যাহ্নভোজ শেষে, তরুণ নবাব ক্লান্ত হয়ে একপাশে বসে আছেন। তার চোখে লুকানো দুশ্চিন্তার ছাপ, কপালে ভাঁজ, চারপাশে বিশ্বস্ত দরবারিদের উপস্থিতি। অথচ অর্ণবের মনে হয়, এই বিশ্বস্ততা আসলে শুধু মুখোশ, কারণ ইতিহাসের পাতায় সে জানে—নবাবকে একা ফেলে দেবে তারই প্রিয়জনেরা।

অর্ণব দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর এক অদ্ভুত দৃঢ়তা নিয়ে নবাবের সামনে উপস্থিত হয়। প্রথমে প্রহরীরা তেড়ে আসে, কিন্তু অর্ণবের কণ্ঠে এক অস্বাভাবিক দৃঢ়তা ভেসে ওঠে—“আমাকে নবাবের সঙ্গে কথা বলতে হবে। এটা তার জীবনের জন্য জরুরি।” নবাব বিস্ময়ে তাকান তার দিকে। অদ্ভুত পোশাক, অদ্ভুত ভাষার টান, যেন এই যুবক কোনো ভিনদেশ থেকে এসেছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সিরাজ তাকে কথা বলতে দেন। অর্ণব গভীর শ্বাস নিয়ে বলে ওঠে, “হুজুর, আপনার সেনাপতি মীর জাফর বিশ্বাসঘাতকতা করবে। যুদ্ধের ময়দানে আপনাকে একা ফেলে দেবে।” এক মুহূর্তের জন্য যেন শিবিরের ভেতর হিম শীতল নীরবতা নেমে আসে। নবাবের চোখ বড় হয়ে যায়, কিন্তু তারপরই তিনি তিক্ত হাসি হেসে বলেন, “তুমি কে, যে আমাকে ভবিষ্যতের কথা বলছ? বিশ্বাসঘাতকতা আর আনুগত্য—এসব খেলার নিয়ম আমি ভালো করেই জানি। যুদ্ধক্ষেত্রে কেবল ঈশ্বর আর সাহসীরাই সিদ্ধান্ত নেন, ভবিষ্যদ্বক্তারা নয়।” অর্ণবের বুক হুহু করে ওঠে। তার মাথার ভেতর ঘুরতে থাকে ইতিহাসের ভয়ংকর সব স্মৃতি—প্লাসির বিশ্বাসঘাতকতা, ইংরেজ শাসনের সূচনা, পরাধীনতার দীর্ঘ শৃঙ্খল। অথচ তরুণ নবাব তার সতর্কবাণীকে কেবলই রূপকথা ভেবে উড়িয়ে দিচ্ছেন।

অর্ণবের চোখ জ্বালা করে ওঠে অশ্রুতে। সে শেষবার চেষ্টা করে—“হুজুর, যদি আমার কথা ভুলও হয়, তবু আপনার অন্তরাত্মা আপনাকে সতর্ক করছে না? কেন আপনার ঘনিষ্ঠদের চোখে এত দ্বিধা? কেন আপনার চারপাশে এত সন্দেহ?” কিন্তু সিরাজ হাত তুলে থামিয়ে দেন। তার কণ্ঠে ক্লান্তি, যেন জীবনের ভারে নুয়ে পড়েছেন। “যুবক, তুমি অচেনা, অদ্ভুত পোশাক পরা, আর অদ্ভুত সব কথা বলছ। আমি যদি প্রতিটি ফিসফিসানি আর ভয়কে সত্যি বলে মেনে নিই, তবে যুদ্ধের আগেই ভেঙে পড়ব। আমি নবাব, আমাকে ভয়ের কাছে হার মানা মানায় না।” সেই মুহূর্তে অর্ণব বুঝে যায়, ইতিহাসের গতিপথ এত সহজে পাল্টানো যায় না। সময়ের স্রোত যেন এক অদম্য শক্তি, যা ব্যক্তিগত চেষ্টাকে উপহাস করে। তবু তার মনে এক টুকরো আশা রয়ে যায়—হয়তো কোনোভাবে, কোনো অদ্ভুত মোড়ে, সে কিছু করতে পারবে। তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে আসতেই রাতের আকাশে মেঘ জমেছে, মশালের আলো দুলছে বাতাসে। অর্ণব হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে থাকে—সে কি সত্যিই ব্যর্থ হয়ে ফিরবে, নাকি সময়ের সেতু পার হয়ে ইতিহাসকে একটুও হলেও বদলাতে পারবে? এই প্রশ্নের উত্তর তখনও অন্ধকারের আড়ালে লুকানো।

পাঁচ

অর্ণব অনেকক্ষণ দ্বিধায় ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কৌতূহল তাকে টেনে নিয়ে যায় ইংরেজদের শিবিরে। প্লাসির যুদ্ধের আগের রাত, গঙ্গার ধারে গাঢ় অন্ধকারে শুধু টিমটিমে প্রদীপ আর অগ্নিশিখার আলোয় ইংরেজদের তাঁবুগুলো ভেসে উঠছিল। অশ্বারোহীদের ঘোড়ার খুরের শব্দ, সৈন্যদের গম্ভীর হাঁকডাক, কামানের ধাতব ঝঙ্কার—সবকিছু যেন অর্ণবের কাছে অবাস্তব মনে হচ্ছিল, যেন সে কোনো নাটকের মঞ্চে এসে পড়েছে। কিন্তু এ নাটক বাস্তব, আর এর ফলাফল বদলে দেবে ভারতের ইতিহাস। সাবধানে শিবিরের ভেতরে ঢুকতেই তার চোখে পড়ে ইংরেজ সেনাপতির টেবিলে ছড়ানো যুদ্ধের মানচিত্র, দাগানো পথ, গোপন সংকেতের নোট। রবার্ট ক্লাইভ বসে আছে ঠাণ্ডা মাথায়, কিন্তু তার চোখে এক শিকারির নিষ্ঠুর দৃষ্টি। অর্ণবের শরীরে শিহরণ জাগে—এই মানুষটার হাতে যে আগামী দিনের ভারত ধ্বংস হবে, তা সে জানে। অথচ ক্লাইভের চারপাশে জমে থাকা আত্মবিশ্বাস, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আর শৃঙ্খলাবদ্ধ সৈন্যবাহিনী দেখে অর্ণব বুঝতে পারে কেন নবাবের সেনাদল, যাদের মধ্যে ছলচাতুরি ও ভীরুতার ছাপ স্পষ্ট, এদের কাছে হেরে যাবে। তার বুকের ভেতর অজানা এক ভয়ের সাথে লড়াই চলতে থাকে—সে কি নিজের চোখে ইতিহাসের এই নিষ্ঠুর মোড় ঘুরে যেতে দেখবে, নাকি চেষ্টা করবে তা পাল্টাতে?

হঠাৎ অর্ণব লক্ষ্য করল, ক্লাইভ এক দোভাষীর মাধ্যমে এক অচেনা দাড়িওয়ালা ব্যক্তির সঙ্গে গোপন আলাপ করছে। ফিসফিসানি আর ইঙ্গিত বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু অর্ণব স্পষ্ট বুঝতে পারল যে এটা মীর জাফরের দূত, যে চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। ইংরেজ সেনাপতির ঠোঁটে এক হালকা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল—একদম শীতল, যেন ভারতের স্বাধীনতা নয়, শুধু কোনো দাবার বোর্ডে ঘুঁটি সরানোর খেলা। সেই হাসি অর্ণবের মনে তীব্র ঘৃণা ও আতঙ্ক ছড়িয়ে দিল। সে জানে ইতিহাসে এই মুহূর্ত এক বিশাল মোড় এনে দিয়েছে। তবু তাকে দেখে কেউ যেন টের পেল। একজন ইংরেজ প্রহরী দূর থেকে তার অচেনা চেহারার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। অর্ণব দ্রুত সরে গিয়ে লুকোতে চাইলেও, মনের মধ্যে ভয়াবহ এক শঙ্কা কাজ করছিল—যদি ধরা পড়ে যায়? তার আধুনিক পোশাক, মুখের ভাষা, আচরণ—সবকিছুই যে অন্যকিছুর গন্ধ বহন করছে, তা কি ইংরেজরা টের পাবে না?

কিছুক্ষণ পর হঠাৎ রবার্ট ক্লাইভের দৃষ্টি পড়ল অর্ণবের ওপর। সে যেন অর্ণবের উপস্থিতি অনুভব করেছে। ক্লাইভের চোখে সেই মুহূর্তে এক অদ্ভুত তীক্ষ্ণতা ঝলসে উঠল, যেন সে অর্ণবের আত্মার ভেতর তাকিয়ে দেখছে। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে সে কাছে এগিয়ে এল, তার চারপাশে আলো যেন আরও ঘন হয়ে উঠল। ক্লাইভ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “তুমি কে? কোন দেশ থেকে এসেছ? তোমার চোখে আমি এক অদ্ভুত অচেনা আলো দেখতে পাচ্ছি, যা আমার কোনো সৈন্যের চোখে নেই।” অর্ণবের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। সে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করল—কিন্তু কী বলবে? সত্য বললে তাকে উন্মাদ ভাববে, মিথ্যে বললে ধরা পড়ে যাবে। ক্লাইভের চোখে গভীর সন্দেহ, তবে সেই সঙ্গে কৌতূহলের শীতল আগুনও। অর্ণবের মনে হল—এই মানুষটা শুধু সেনাপতি নয়, এক ধূর্ত মনস্তাত্ত্বিক খেলোয়াড়ও। ক্লাইভ যেন বোঝার চেষ্টা করছে—অর্ণব অন্য সময় থেকে এসেছে কিনা। সেই মুহূর্তে অর্ণব অনুভব করল, তার উপস্থিতি হয়তো ইতিহাসের এই খেলায় নতুন এক অপ্রত্যাশিত ছায়া ফেলেছে। যুদ্ধের আগে রাতটা তার কাছে হয়ে উঠল অস্থির ও আতঙ্কে ভরা—কিন্তু সেই আতঙ্কের আড়ালেই হয়তো লুকিয়ে আছে ভবিষ্যত পাল্টানোর এক সুযোগ।

ছয়

অর্ণব দীর্ঘ প্রস্তুতির পর অবশেষে এক অন্ধকার রাতের আড়ালে মীর জাফরের তাঁবুর সামনে পৌঁছায়। গোপনে প্রবেশ করা তার জন্য সহজ ছিল না—চারদিকে প্রহরীদের চোখ, সন্দেহভাজন হয়ে ওঠার ভয়, আর সেই সময়ের কঠোর সামরিক শৃঙ্খলা। কিন্তু তার ভেতরে এক অদম্য তাগিদ ছিল; ইতিহাসের সেই মুহূর্তে পৌঁছে যদি কিছু পরিবর্তন করা যায়, তবে হয়তো ভারতের ভবিষ্যৎ অন্যরকম হতে পারে। তাঁবুর ভেতরে ঢুকতেই সে দেখতে পেল এক উচ্চাঙ্গ সামরিক নেতাকে, যার চোখে জ্বলজ্বল করছে দ্বিধা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা। মীর জাফর তখনও সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যে ভুগছিল—সে কি সত্যিই ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলাবে, নাকি নবাবের প্রতি আনুগত্য দেখাবে? অর্ণব দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলতে শুরু করল, “আপনি জানেন না আপনার এই সিদ্ধান্তের কী ভয়াবহ পরিণতি হবে। আগামী শতাব্দী আপনাকে শুধু বিশ্বাসঘাতক বলেই মনে রাখবে।” অচেনা এই যুবকের কণ্ঠে ইতিহাসের সত্যি যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। মুহূর্তের জন্য মীর জাফরের চোখে এক ঝলক অনিশ্চয়তা ফুটে উঠল, কিন্তু সেই দৃষ্টি দ্রুত মিলিয়ে গেল উচ্চাকাঙ্ক্ষার অন্ধকারে।

মীর জাফরের মন যেন দুটি পথে ছিন্নভিন্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একদিকে ছিল তার আনুগত্যের শপথ, নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রতি তার সামরিক দায়িত্ব; অন্যদিকে ছিল ইংরেজদের লোভনীয় প্রতিশ্রুতি—সিংহাসনের লালসা, অবাধ ক্ষমতা, আর ব্যক্তিগত প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ। অর্ণব বারবার তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল, “আপনার নাম ইতিহাসে শুধু একবারই লেখা হবে। সেই লেখাই নির্ধারণ করবে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আপনাকে নায়ক হিসেবে স্মরণ করবে নাকি অভিশপ্ত বিশ্বাসঘাতক হিসেবে ঘৃণা করবে।” কিন্তু জাফরের মুখে ধীরে ধীরে এক তিক্ত হাসি ফুটে উঠল। সে বলল, “আমি কি ভবিষ্যতের মানুষ যে ইতিহাসের বিচার নিয়ে ভাবব? আমি বাঁচি আজকের দিনে, আমার ক্ষুধা আজকের ক্ষমতা, আমার লালসা আজকের সিংহাসন। কে কী বলবে ভবিষ্যতে—সে বোঝার দায় আমার নয়।” তার ঠাণ্ডা কণ্ঠে উচ্চারিত সেই শব্দগুলো অর্ণবকে শিহরিত করল। যেন সময়ের প্রতিটি পাতা তাকে এই কথাগুলোর সাক্ষী বানাচ্ছে। সে বুঝল—কখনও কখনও মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এত প্রবল হয় যে ইতিহাসের ভয়ানক সতর্কবার্তাও তাকে টলাতে পারে না।

অর্ণব গভীর অসহায়তায় কেঁপে উঠল। তার মনে হচ্ছিল—সে যদি মীর জাফরের চোখে ভবিষ্যতের রক্তাক্ত পরিণতি দেখাতে পারত! কিন্তু সে কেবল শব্দ দিয়েই বোঝাতে পারছিল, আর শব্দ ক্ষমতার অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছিল। মীর জাফরের চোখে তখন শুধু সিংহাসনের প্রতিচ্ছবি, নিজের নাম নবাব হিসেবে ঘোষণার স্বপ্ন। অর্ণব জানত, এই বিশ্বাসঘাতকতার কারণে শুধু সিরাজ নয়, সমগ্র ভারতবর্ষ একটি নতুন শৃঙ্খলের বাঁধনে আবদ্ধ হবে। মীর জাফরের সিদ্ধান্তের কারণে প্রথমবারের মতো বিদেশী শক্তি ভারতের মাটিতে শাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ পাবে, আর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সেই শৃঙ্খল ভাঙতে হবে রক্ত আর বিদ্রোহের মাধ্যমে। কিন্তু এই কথাগুলো বলার পরও কোনো প্রভাব পড়ল না। জাফর দাঁড়িয়ে বলল, “যাও, অচেনা মানুষ। আমার পথ আমি নিজেই বেছে নিয়েছি।” তাঁবু থেকে বেরিয়ে আসার সময় অর্ণবের মনে হচ্ছিল, ইতিহাসের গতি সে জানে, অথচ তা বদলানোর ক্ষমতা নেই তার হাতে। আকাশের দিকে তাকিয়ে সে বুঝল—কখনও কখনও মানুষ ভাগ্যের হাতে বন্দি হয়ে পড়ে, আর লোভের মায়াজাল ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারণ করে দেয়। সেই মুহূর্তে অর্ণব অনুভব করল—সে শুধু একজন দর্শক, যাকে নিয়তির খেলা ঠেলে দিয়েছে এক ভয়ংকর ইতিহাসের কেন্দ্রে।

সাত

অর্ণব যখন মীর জাফরের চোখে সেই অসহ্য ক্ষমতালিপ্সার আগুন দেখে ফিরে আসে, তখন তার ভেতরে এক অদ্ভুত অস্থিরতা জমতে থাকে। চারপাশের যুদ্ধের প্রস্তুতির শব্দ, সৈন্যদের গর্জন, ঘোড়ার টগবগ আওয়াজ—সব মিলিয়ে যেন সময়ের চাকা দ্রুত ঘুরছে, আর সে তার ভেতরে আটকে পড়েছে। এই মুহূর্তেই অর্ণব অনুভব করে—কেউ যেন তার মাথার ভেতরে কথা বলছে। কণ্ঠস্বরটা কারও নয়, অথচ খুব পরিচিত। ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারে, এটা তারই অন্তরাত্মার কণ্ঠস্বর, যে তাকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়: “তুমি কি সত্যিই ভাবছো, একজন মানুষ ইতিহাস বদলাতে পারে? যদি পারোও, তবে কোন নিশ্চয়তা আছে যে তার পরিণতি ভালো হবে?” অর্ণব থমকে যায়। এতদিন সে নিজের জ্ঞান, ইতিহাসের তথ্য আর যুক্তি দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চাইছিল, কিন্তু এই প্রশ্ন যেন তার ভেতরের শূন্যতায় আঘাত করে। ইতিহাস এক বিশাল স্রোত, যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষের স্বপ্ন, বিশ্বাস, লোভ আর ভয়ের ঢেউ মিলে তৈরি হয় ভবিষ্যৎ। সেখানে তার মতো এক ভ্রমণকারীর ভূমিকা কী? সে কি সত্যিই পারবে সেই স্রোতের গতিপথ ঘুরিয়ে দিতে, নাকি সে কেবল দর্শক, এক অস্থায়ী ছায়া?

কণ্ঠস্বর থেমে থাকে না। আবারও সে শুনতে পায়, এবার আরও তীক্ষ্ণ সুরে: “তুমি বিজ্ঞানী। তোমার কাছে সময় মানে গণিত, পদার্থবিদ্যা, পরীক্ষাগার। কিন্তু তুমি কি ভাবছো—সময়কে কেবল সূত্র দিয়ে বেঁধে রাখা যায়? ইতিহাসেরও কি কোনো নিজস্ব পথ নেই, যা মানবীয় যুক্তিকে অতিক্রম করে চলে?” অর্ণবের মস্তিষ্কের ভেতরে যেন বজ্রপাত হয়। সে মনে করতে থাকে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সূত্র, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অজানা সম্ভাবনা, সময়রেখার জটিল শাখাপ্রশাখা। হ্যাঁ, হয়তো সে জানে সময় ভ্রমণের প্রযুক্তি, জানে কিভাবে ইতিহাসের ঘটনাকে আগে থেকে পড়া যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এগুলো জানলেই কি সে ইতিহাসের প্রকৃত পরিণতি পাল্টাতে সক্ষম? নাকি সে যতোই চেষ্টা করুক, ঘটনাগুলো অন্যভাবে গড়ালেও শেষ ফলাফল একই জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবে? যেমন, হয়তো প্লাসির যুদ্ধ না-ও হতে পারে, কিন্তু ইংরেজরা অন্য কোনো পথে ভারত দখল করবেই। কণ্ঠস্বর যেন তার প্রতিটি ভাবনায় সাড়া দেয়: “তাহলে বলো, তুমি কী করবে? মানুষ হিসেবে তুমি কি আবেগ দিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে, নাকি বিজ্ঞানী হয়ে শীতল যুক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করবে?” অর্ণবের বুকের ভেতর ধকধক করে ওঠে। যুক্তি তাকে বলে—ঘটনাপ্রবাহকে যেমন আছে তেমন থাকতে দাও। কিন্তু তার ভেতরের আবেগ ফিসফিস করে—যদি সত্যিই একবার চেষ্টা করা যায়?

এই দ্বন্দ্বে অর্ণবের মন ভেঙে দুই টুকরো হয়ে যায়। একদিকে সে নিজেকে দেখে একজন ঠাণ্ডা বিজ্ঞানী, যে বুঝে গেছে ইতিহাসের অপরিবর্তনীয় স্রোতকে পাল্টানো যায় না। অন্যদিকে, সে একজন মানুষ, যার চোখের সামনে তরুণ সিরাজউদ্দৌলা ধ্বংস হতে যাচ্ছে, যার কানে বাজছে সৈন্যদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের হাঁকডাক, আর সে জানে, এই যুদ্ধ শুধু একজন নবাবের পতন নয়—পুরো উপমহাদেশের ভবিষ্যৎকে বদলে দেবে। তার অন্তরের কণ্ঠ তাকে নিরন্তর টেনে নিয়ে যায় এক অমোঘ প্রশ্নের দিকে: “তুমি কি দর্শক হয়ে থাকবে, নাকি অংশগ্রহণ করবে?” হঠাৎ তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই সব শিশুদের মুখ, যারা ভবিষ্যতের পাঠ্যবইতে পড়বে—মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনি, সিরাজের পতনের বেদনা, আর ইংরেজদের উত্থান। কণ্ঠস্বর তখন কোমল হয়ে যায়, যেন এক অদৃশ্য শিক্ষক ফিসফিস করছে: “তোমার সিদ্ধান্তই তোমার পরিচয় গড়ে তুলবে। ইতিহাস হয়তো তার নিজের পথ নেবে, কিন্তু তুমি ঠিক করবে—তুমি কোন পথে হাঁটলে মানুষ হিসেবে বাঁচতে পারবে।” অর্ণব চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নেয়। বিজ্ঞান আর আবেগের যুদ্ধ তখনও থামেনি, কিন্তু সে বুঝতে পারে, এই যুদ্ধ আসলে তার নিজের সঙ্গে—তার সত্তার ভেতরকার এক অনন্ত দ্বন্দ্ব।

আট

প্রভাতের আলো ফোটার আগেই প্লাসির প্রান্তরে এক অদ্ভুত উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। কুয়াশায় ঢাকা মাঠ, মাটির গন্ধ আর ভিজে ঘাসের ওপর দাঁড়িয়ে অর্ণব অনুভব করছিল ইতিহাসের হৃদস্পন্দন যেন তার চারপাশে ধ্বনিত হচ্ছে। ইংরেজ ও বাংলার সৈন্যরা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, উভয় পক্ষেই উত্তেজনা আর ভয় মিশ্রিত এক অস্থিরতা। অর্ণব বুঝতে পারছিল, আজকের এই সকালেই ভারতের ভাগ্য নির্ধারিত হতে চলেছে। সে চারদিকে তাকিয়ে দেখল—কেউ ঢাল-তলোয়ার হাতে, কেউ বাঁশের লাঠি, কেউ আবার শুধু ভাঙা জুতো পরে এসেছে যুদ্ধক্ষেত্রে। তাদের চোখে ছিল ভিন্ন ভিন্ন স্বপ্ন—কেউ দেশের সম্মান রক্ষায় প্রাণ দিতে প্রস্তুত, কেউ আবার শুধু দুটো রুটির আশায় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। আকাশে পাখিদের কিচিরমিচির থেমে গেছে, প্রকৃতিও যেন অপেক্ষা করছে ইতিহাসের রক্তমাখা রূপ দেখতে। অর্ণবের বুক ধকধক করছিল—সে তো জানে সামনে কী ঘটবে, তবু সামনে দাঁড়িয়ে বাস্তব রূপ দেখা এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা।

যুদ্ধ শুরু হতেই তলোয়ারের ঝলকানি, কামানের গর্জন আর মানুষের চিৎকারে প্রান্তর ভরে গেল। কামানের ধোঁয়া চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল, সূর্যের আলো যেন ম্লান হয়ে গেল তার তলায়। অর্ণব সৈনিকদের মাঝে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করছিল সেই ভয়ংকর বাস্তবতা—কেউ বুক চিতিয়ে লড়ছে, কেউ আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে, কেউ আবার পিছু হটে পালানোর পথ খুঁজছে। নবাবের সেনাদের মধ্যে ভয়ের ছায়া ক্রমশ ঘন হচ্ছিল, অনেকেই বুঝতে পারছিল—ভেতরে ভেতরে বিশ্বাসঘাতকতার আগুন জ্বলছে। ইংরেজ সৈন্যরা কিন্তু ঠাণ্ডা মাথায়, শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে কৌশল চালাচ্ছিল। অর্ণবের মনে হচ্ছিল, বিজ্ঞানী হিসেবে সে যতবার ইতিহাস পড়েছে, তার একটিও লাইনে এই ভয়ঙ্কর বাস্তবতার গন্ধ ছিল না—মাটিতে ছড়িয়ে থাকা রক্তের ধারা, মৃতদেহের উষ্ণতা, আর বেঁচে থাকার জন্য মানুষের করুণ আর্তনাদ কোনো বইয়ে ধরা পড়ে না। তার চোখের সামনে একেকটি মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে, অথচ সময় যেন তাকে বলছে—“দেখো, এটাই ইতিহাসের নির্মম সত্য।”

অর্ণব ভেতরে ভেতরে দ্বিধায় ভুগছিল—সে কি কিছু করবে, নাকি শুধু নিরব দর্শক হয়ে থাকবে? তার মনে হচ্ছিল, যদি সে এই যুদ্ধের পরিণতি বদলাতে পারে, হয়তো ভবিষ্যতের ভারত ভিন্ন রকম হতো। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ‘সময়ের কণ্ঠস্বর’ তার মনে ভেসে উঠল—“ইতিহাসেরও তো নিজস্ব পথ আছে। তুমি কি তা পাল্টাতে পারবে?” সে চারপাশে তাকিয়ে দেখল, সাধারণ সৈনিকরা আসলে কোনো রাজনীতি বোঝে না; তারা শুধু পরিবার, ক্ষুধা আর বেঁচে থাকার সংগ্রাম বোঝে। একজন যুবক সৈনিক রক্তাক্ত হাতে তার মায়ের নাম ডাকছিল, অন্য এক বৃদ্ধ যোদ্ধা চোখ বন্ধ করে আল্লাহর নাম জপছিল। অর্ণব বুঝতে পারল, এই যুদ্ধ শুধু রাজাদের নয়, মানুষেরও। সময়ের স্রোতে হয়তো বিজয়ী হবে ইংরেজ, কিন্তু হারবে সেইসব সাধারণ মানুষ, যাদের স্বপ্ন আজ মাটিতে মিশে যাবে। কামানের শব্দে আকাশ কেঁপে উঠল, আর অর্ণব অনুভব করল—সে ইতিহাসের বুকে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তার হাত বাঁধা, কারণ ইতিহাসের সকাল কখনও একজন মানুষের ইচ্ছায় বদলায় না।

নয়

অর্ণব দাঁড়িয়ে আছে যুদ্ধক্ষেত্রের ধোঁয়া, রক্ত আর চিৎকারে ভরা এক ভয়ংকর প্রান্তরে। চারপাশে গুলির শব্দ, কামানের গর্জন, তলোয়ারের ঝনঝনানি—সব মিলিয়ে এক অরাজকতা। কিন্তু সেই অরাজকতার মাঝেই সে লক্ষ্য করে এক ভয়ংকর সুযোগ—ইংরেজদের বন্দুকখানার পাশেই একটি জায়গা প্রায় অরক্ষিত, যদি সে চুপিসারে আগুন ধরিয়ে দেয়, তবে হয়তো রবার্ট ক্লাইভের সমগ্র শক্তিই ভেঙে পড়বে। নবাব সিরাজউদ্দৌলা হয়তো হেরে যাবে না, ইতিহাস হয়তো ভিন্ন মোড় নেবে। তার শিরায় শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে সেই ভাবনার উত্তেজনা। “একটিমাত্র কাজ,” অর্ণব নিজেকে বলে, “একটিমাত্র স্ফুলিঙ্গেই ইতিহাস বদলে যেতে পারে।” তার বুক ধকধক করছে, হাত কাঁপছে, অথচ তার চোখে এক ধরনের অদ্ভুত দৃঢ়তা ফুটে উঠছে। কিন্তু ঠিক তখনই তার মস্তিষ্কে বাজের মতো শব্দ হয়ে ভেসে ওঠে এক অন্তর্গত কণ্ঠ—সময়ের কণ্ঠ—যা সে আগেই শুনেছিল। কণ্ঠস্বর তাকে প্রশ্ন করে, “তুমি কি নিশ্চিত? তুমি কি ইতিহাসের নিয়ম ভাঙতে প্রস্তুত? নাকি এই প্রবাহ এমনিতেই ঘটবে, তোমার উপস্থিতি কেবল এক দর্শকের মতো?” মুহূর্তের জন্য অর্ণবের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়, আর তার মনে প্রশ্নের ঝড় বয়ে যেতে থাকে।

তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে দ্বন্দ্বের গভীরতম রূপ—বিজ্ঞানী অর্ণবের যুক্তিবাদী মন একদিকে টানছে, বলছে, “যদি আগুন দাও, তবে উপনিবেশবাদ অনেকটাই দেরিতে আসবে, হয়তো ভারত স্বাধীনতার পথে আরও আগে হাঁটবে।” কিন্তু তার মানবিক মন বলছে, “তুমি কি নিশ্চিত জানো, বদলালে ভবিষ্যৎ ভালো হবে? তুমি কি নিজের অস্তিত্ব ঝুঁকিতে ফেলতে প্রস্তুত?” অর্ণব চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে সৈন্যদের রক্তাক্ত দেহ, নবাবের ভয়ে কাঁপা মুখ, আর ইংরেজদের ঠাণ্ডা মাথার ষড়যন্ত্র—সবকিছু যেন তাকে প্রলুব্ধ করছে পদক্ষেপ নিতে। অথচ একইসঙ্গে মনে পড়ে যায় তার নিজের সময়, তার পরিবার, তার গবেষণাগার, তার জন্ম নেওয়ারই যে ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই ইতিহাসের ওপর। “যদি আমি বদলাই,” সে ভাবে, “তাহলে হয়তো আমি জন্মই নেব না। হয়তো আমার অস্তিত্বই মুছে যাবে। আমি কি সেই ঝুঁকি নেব?” তার দেহে যেন এক অদৃশ্য ভার চাপতে থাকে, হৃদয় আর মস্তিষ্কের মধ্যে যুদ্ধ চলতে থাকে। দূরে বন্দুকখানার কাঠের দেওয়াল স্পষ্ট দেখা যায়, কেবল একটা মশালই যথেষ্ট। অথচ সেই মশাল জ্বালানোর আগেই তার ভেতরে আরেকটা যুদ্ধ শুরু হয়—নিজের সত্তা রক্ষা করবে, নাকি পুরো জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করবে।

শেষমেশ অর্ণবের হাত থমকে যায়। তার চোখে জল এসে যায়, বুক ভরে ওঠে অদ্ভুত এক যন্ত্রণায়। সে অনুভব করে, সে যদি এক স্ফুলিঙ্গ জ্বালায়, তবে শুধু বন্দুকখানা নয়, সময়ের পুরো কাঠামো জ্বলে উঠবে। আর সে নিজেই হয়তো সেই আগুনে ভস্মীভূত হবে। ইতিহাসকে সে জানে—এমনিই যন্ত্রণাদায়ক, অগণিত রক্তে রঞ্জিত, কিন্তু তবুও ইতিহাসের মধ্য দিয়েই মানবসভ্যতা বিকশিত হয়। সে ভাবে, “আমার কাজ ইতিহাস পাল্টানো নয়, আমার কাজ ইতিহাস বোঝা।” সে ধীরে ধীরে বন্দুকখানা থেকে দূরে সরে যায়, চোখে অশ্রুর কুয়াশা, হৃদয়ে অমোঘ বেদনা। যুদ্ধক্ষেত্রে রক্ত আর ধোঁয়ার মধ্যেও তার মনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে—সে দর্শক, সে ইতিহাসের অনাহূত অতিথি, যার উপস্থিতি মাত্রই অস্থায়ী। তার গা শিউরে ওঠে যখন সে অনুভব করে, এই সিদ্ধান্ত তাকে বাঁচিয়ে রাখল, কিন্তু একইসঙ্গে পুরো জাতিকে এমন এক ভাগ্যের দিকে ঠেলে দিল, যেটা সে জানে ভীষণ কঠিন। ইতিহাসের পাতা তার চোখের সামনে আবারও রক্তে ভিজে ওঠে, আর সে মনে মনে ফিসফিস করে—“আমি বাঁচলাম, কিন্তু ভারত হারাল।” এই উপলব্ধির ভার যেন তাকে চিরতরে পাল্টে দেয়। সে দাঁড়িয়ে থাকে, যেন সময়ের সাক্ষী হয়ে, যুদ্ধের গর্জন আর মানুষের কান্নার মাঝে।

দশ

অর্ণব বন্দুকখানার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় যেন নিজের ভেতরের সমস্ত দ্বন্দ্বকে ছিঁড়ে ফেলতে পারছিল না। হাতে ধরা অগ্নিসংযোগের মশালটুকু বারবার জ্বলে উঠছিল, আবার নিভে যাচ্ছিল তার দোটানার মতো। একদিকে চোখের সামনে মৃতপ্রায় সৈনিকরা, যাদের শরীরের রক্ত মিশে যাচ্ছে প্লাসির মাটির সঙ্গে, আরেকদিকে মাথার ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই প্রশ্ন—“ইতিহাস কি তুমি বদলাতে পারো?” তার বিজ্ঞানী মন তাকে বলছিল—“সবকিছু পরিবর্তন সম্ভব, যদি যথাযথ প্রক্রিয়া জানা থাকে।” কিন্তু সেই একই মুহূর্তে তার ভেতরে অন্য এক কণ্ঠস্বর ফিসফিস করে উঠল—“যদি তুমি বদলাও, তবে তার ঢেউ ছড়িয়ে পড়বে শত শত বছর জুড়ে, ভেঙে ফেলবে সেই কাঠামো যেটির ওপর দাঁড়িয়ে তোমার আজকের অস্তিত্ব।” সে দেখতে পেল—মীর জাফর এখনো নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে, কেবল সুযোগের অপেক্ষায়, আর ব্রিটিশ সেনারা আত্মবিশ্বাসে পূর্ণ হয়ে ক্রমশ ভারতীয় বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করছে। মুহূর্তটাকে আটকানোর ইচ্ছে তার হাত কাঁপিয়ে তুলল, কিন্তু সেই কাঁপুনি যেন তার হৃদয় থেকে উঠে আসা ভয়ের সঙ্গে মিলেমিশে এক অনিবার্য সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দিল।

মহাবজ্রপাতের মতো তীব্র গর্জনে হঠাৎ আকাশ ছিঁড়ে পড়ল বজ্রের আলো। ঠিক তখনই অর্ণব অনুভব করল, তার পায়ের তলায় মাটি যেন কেঁপে উঠেছে। টাইম-মেশিনের লুকানো যন্ত্রপাতি, যা সে ঝড়ের ভেতরে রেখে এসেছিল, হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠল সেই বজ্রশক্তির টানে। তার চোখে ভেসে উঠল জ্বলজ্বলে আলোর এক সেতু—যেন অতীত থেকে বর্তমানকে যুক্ত করছে। চারপাশের যুদ্ধের হাহাকার, কামানের গর্জন, সৈন্যদের চিৎকার—সবকিছু মিলেমিশে এক ভয়াবহ কোলাহল তৈরি করছিল, কিন্তু সেই কোলাহলের ভেতর দিয়েই সে দেখতে পেল আরেকটি পথ। মশালটা তার হাত থেকে পড়ে গেল, মাটিতে গড়িয়ে নিভে গেল আগুনের শেষ শিখাটুকু। সেই নিভে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন তার ভেতরের দ্বন্দ্বও মুছে গেল। ইতিহাস তার নিজের পথেই এগোবে—সে হবে কেবল একজন প্রত্যক্ষদর্শী, অংশগ্রহণকারী নয়। যুদ্ধ চলতেই থাকল, বিশ্বাসঘাতকতা ঘটল, আর সেই বিশ্বাসঘাতকতার পরিণতি ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎকে চিরদিনের মতো বদলে দিল। অর্ণব দাঁড়িয়ে রইল নিথর, তার চারপাশে ভেঙে পড়া সৈন্যদের আর্তনাদ আর দূরে জ্বলে ওঠা কামানের আগুন যেন তাকে বিদায় জানাচ্ছিল এক অনিবার্য অতীতের থেকে।

পরের মুহূর্তেই বজ্রের আলো তাকে গ্রাস করে নিল। অর্ণব হঠাৎ টের পেল, তার শরীর টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এক অদৃশ্য স্রোতে, আর হঠাৎ করেই চারপাশের যুদ্ধক্ষেত্র মিলিয়ে গিয়ে ভেসে উঠল তার পরিচিত ল্যাবরেটরির দেওয়াল। টাইম-মেশিন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, কাঁপছে, ধোঁয়া ছড়াচ্ছে, কিন্তু সক্রিয়। সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, নিঃশ্বাস নিতে নিতে তাকাল টেবিলের ওপর রাখা সেই ইতিহাসের বইটির দিকে—যেখানে লেখা আছে প্লাসির যুদ্ধের কাহিনি, মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার গল্প, আর তার পরিণতি। সবকিছুই সেই বইয়ের মতো ঘটেছে, কোনো পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু এবার বইয়ের পাতার অক্ষরগুলোর দিকে তাকাতে তাকাতে অর্ণব বুঝল—এখন সে ইতিহাসকে অন্য চোখে দেখছে। ইতিহাস মানে কেবল অতীতের রেকর্ড নয়; ইতিহাস হলো শিক্ষার উৎস, সতর্কবার্তা, আর মানুষের জন্য প্রতিবার নতুন করে দিশা খোঁজার দর্পণ। অর্ণবের চোখে জল এসে গেল, তবে সেই জল ছিল না ব্যর্থতার—বরং ছিল উপলব্ধির। সে জানল, মানুষ ইতিহাসকে পাল্টাতে পারে না, তবে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে পারে, আর সেই শিক্ষাই ভবিষ্যৎকে পাল্টে দিতে সক্ষম। টাইম-মেশিন নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, কিন্তু অর্ণবের চোখে এবার এক নতুন দৃষ্টি জন্ম নিল—এক দৃষ্টি, যেখানে বিজ্ঞান আর মানবতার হাত একসঙ্গে ধরে ভবিষ্যতের জন্য আলোর সেতু তৈরি করছে।

___

1000060003.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *