Bangla - কল্পবিজ্ঞান

সময়ের ডাকঘর

Spread the love

ঈশানী ভট্টাচার্য


কলকাতার সিঁথি অঞ্চলের ভেতরে, মরা একটি গলির শেষে দাঁড়িয়ে আছে এক পুরনো লালবাতিওয়ালা দালান—সাইনবোর্ডে লেখা বেলঘর ডাকঘরস্থাপিত ১৮৯৩। দরজার কপাটে জং ধরেছে, জানালায় জালার ফাঁকে ঘুমিয়ে আছে ধুলো। কেউ আর এখানে আসে না। কেউ বলে, ডাকঘর উঠে গেছে। কেউ বলে, ওটা ভূতের জায়গা।

তবে অভীক বিশ্বাস করে না ভূতের গল্প। ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, প্রেসিডেন্সিতে পড়ে। পুরনো জিনিসের গন্ধ তাকে ডাকে—জীর্ণ কাগজ, ঝাপসা চিঠি, পুরনো ম্যাপ, ধুলোমাখা বই।

সে প্রথম বেলঘর ডাকঘরের কথা শুনেছিল তার দাদুর মুখে—“ওখানে একসময় একটা মিরাকল ঘটত রে। একটা চিঠি পেয়েছিলাম যা কদিন পর লেখা হয়েছিল।”

সেই কথা মাথায় রেখেই একদিন বিকেলে সে পৌঁছায় সেই ডাকঘরের সামনে। সন্ধ্যা নামছে, চারপাশ নিঃস্তব্ধ। কিন্তু দরজাটা খানিকটা খোলা। ভিতরে ঢুকে দেখে—ঘরের মাঝখানে একটা পুরনো কাঠের টেবিল, তার পাশে একটা লোহার চিঠির বাক্স, যার মুখে লেখা “ডাকবাক্স—চিঠি ফেলার সময়: সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা”।

অভীক চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর আকস্মিকভাবে দেখে—চিঠির বাক্সের নিচে জমে আছে ধুলোর ভেতর একটা একেবারে নতুন খাম। চকচকে। হালকা নীল।

সে তাড়াতাড়ি তুলে নেয় খামটা। নামধাম লেখা নেই, কিন্তু ঠিকানাটা স্পষ্ট—

অভীক রায়
১৩/, মল্লিকবাড়ি লেন, সিঁথি, কলকাতা৭০০০০৪
তারিখ: ২৭ জানুয়ারি ২০৯৯

অভীক স্তব্ধ হয়ে যায়।

তারিখ দেখে গা শিরশির করে ওঠে। ২০৯৯? সেটা তো একশো বছরের বেশি ভবিষ্যতের তারিখ! সে আবার খামের ওপরে স্পর্শ করে—কোন ফাঁদ নয় তো? কিন্তু খামের সিল পুরোপুরি বন্ধ।

সে খামটা ব্যাগে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। মোবাইলে সিগনাল নেই। একধরনের ছায়া যেন ঝুলে আছে পুরো বেলঘর গলির ওপর।

ফিরে এসে নিজের ঘরে বসে, ধীরে ধীরে খামটা খোলে। ভিতরে আছে একটা সাদা কাগজ। মোটা মোটা হরফে লেখা—

তুমি যখন এটা পড়ছো, সময় ইতিমধ্যেই বদলাচ্ছে। বিশ্বাস কোরো না কাউকে। চিঠি ফেলার আগে ভাবোকারা পড়ে সেটা, আর কখন।
বেলঘর থেকে ফের চিঠি পাবে, ঠিক দশ দিন পর।
আর মনে রেখো, তোমার অতীতটা অতীত নয়।
সময়

অভীক কাঁপতে কাঁপতে কাগজটা পাশে রাখে। কৌতূহল, ভয়, উত্তেজনা—সব মিশে এক অদ্ভুত অনুভূতি। কে পাঠাল এই চিঠি? কী উদ্দেশ্যে?

পরদিন সকাল থেকে সে বেলঘর ডাকঘরের ইতিহাস খুঁজতে থাকে। লাইব্রেরিতে খোঁজ করে, পুরনো নথি পড়ে। জানতে পারে—এই ডাকঘর একসময় ‘বিশেষ শ্রেণির চিঠি’ চালাত, যেগুলিকে ‘স্বপ্ন-বার্তা’ বলা হতো। ব্রিটিশ আমলে বহু বিজ্ঞানী এখানে গবেষণার কাজে চিঠি আদান-প্রদান করতেন।

আর এক অদ্ভুত তথ্য—১৯৪৩ সালে এই ডাকঘরের এক কর্মচারী হারিয়ে গিয়েছিলেন, চিরতরে। তাঁর নাম ছিল সুরেশ পাল। তাঁর শেষ চিঠি লেখা হয়েছিল ভবিষ্যতের একজনের নামে।

অভীক মাথা চুলকে ভাবতে থাকে—তবে কি এই পুরো ব্যাপারটাই একধরনের টাইম-লুপ? কে এই ‘সময়’? কেন লিখছে ওকে?

ঠিক দশ দিন পর, অভীক আবার যায় সেই ডাকঘরে। এবার সে নিজেই একটা চিঠি লিখে ফেলে চিঠির বাক্সে—
আপনি কে? কেন আমি?”

বাক্সে ফেলার পর বেরিয়ে আসে, কিন্তু সে জানে—তার জীবন এখন আর আগের মতো থাকবে না।

সেই রাতে অভীক ঘুমোতে পারে না। জানলার পাশে বসে, সে ভাবে—
যদি সময় চিঠি পাঠাতে পারে, আমি কেন পারব না? যদি ভবিষ্যৎ আমার কথা জানে, আমি কি পারব নিজের অতীত বদলাতে?”

অভীক জানে না, তার জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত সময়টা এখন শুরু হতে চলেছে।

 

ঘুম ভেঙে গেলে প্রথম যে জিনিসটা অভীক লক্ষ্য করল, সেটা চিঠির খাম। জানালার রোদ এসে পড়েছে বিছানায়, আর তার ঠিক ওপরে রাখা খামের গায়ে জ্বলজ্বল করছে একই পরিচিত অক্ষর—
অভীক রায়, ১৩/ মল্লিকবাড়ি লেন…”

খামের ওপরে আবারও সেই তারিখ—
ফেব্রুয়ারি, ২০৯৯

এবার সে আর অবাক হয় না। বরং খানিকটা ঠান্ডা মাথায় ধীরে ধীরে খামটা খোলে। ভেতরে একটা কালচে ছবি—দেখেই বুক কেঁপে ওঠে। ছবিটা ধুলোছাওয়া, কিন্তু স্পষ্ট দেখা যায়—একজন মৃতদেহ পড়ে আছে রাস্তায়, মাথার পাশে জমাট রক্ত। আর তার মুখ…

অভীক নিজেই।

সে চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু গলা শুকিয়ে আসে। তখনই খেয়াল করে—ছবির উল্টো পাশে লেখা একটা ছোট্ট নোট। কালি ধুয়ে গেছে অনেকটা, কিন্তু লেখাটা ঠিক পড়া যায়—

ওই সন্ধ্যেবেলা ওই গলিটা বেছে নিও না। তোমার বিশ্বাসঘাতকতা শুরু হবে আজ। আর তুমি নিজেই নিজের সর্বনাশ করো না।
সময়

এইবার সে ঠান্ডা মাথায় বসে ছবিটার কাগজ পরীক্ষা করে। এটা আধুনিক থার্মাল প্রিন্ট। কিন্তু কিভাবে এলো? কে এনেছে?

তবে সবথেকে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, ছবিটার নিচে একটা হস্তাক্ষর। খুব পরিচিত। নিজেরই। নিজের হাতের লেখা।
আমি জানি, আমি মরব। কিন্তু কেন আমি নিজেই সেটা লিখে রাখলাম?”

অভীক নিজের ডায়েরি টেনে নেয়। আগের পাতাগুলো উল্টে দেখে, হুবহু সেই হাতের লেখা। তাহলে কি ভবিষ্যতের কোনো অভীকই এই বার্তাগুলো পাঠাচ্ছে? কিংবা…

সে সোজা চলে যায় প্রেসিডেন্সির আর্কাইভ রুমে। প্রাচীন ডাকঘরের নথি, ব্রিটিশ আমলের সংবাদপত্র, আর কয়েকটা পুরনো গেজেট ঘেঁটে জানতে পারে—সুরেশ পাল নামে যিনি ১৯৪৩ সালে বেলঘর ডাকঘরে নিখোঁজ হয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যু রহস্যজনকভাবে হয়েছিল। তাঁর লাশ পাওয়া গিয়েছিল ভবানীপুরের এক ভাঙা গ্যারেজে, এক মাস পর।

কিন্তু সেদিনের পত্রিকা এক অদ্ভুত তথ্য দেয়—
মৃতদেহের পাশে পড়ে থাকা একটি চিঠি উদ্ধৃত হয়েছে, যাতে লেখা ছিল: ‘আমি মরেছি ভবিষ্যতের দোষে।‘”

অভীক এবার আর চুপ করে থাকতে পারে না। সে সিদ্ধান্ত নেয়—নিজেই একখানা চিঠি লিখবে, নিজের মতো করে। কোনো প্রশ্ন নয়, বরং একটি নির্দেশ।

সে লেখে:
যদি তুমি আমার ভবিষ্যৎ, তাহলে বলে দাওকারা আছে আমার বিরুদ্ধে? কে আমাকে মেরে ফেলবে? আর কেন আমি নিজের মৃত্যুর সাক্ষী?”
তারিখ দেয়, সময় দেয়, নিজের সই করে।

চিঠি ফেলার জন্য ফের বেলঘর যায়। এবার চিঠি ফেলতেই এক অদ্ভুত শব্দ শোনা যায় চিঠির বাক্সের ভেতর থেকে—মৃদু গড়গড়, যেন ভেতরে ঘুরছে সময়ের কাঁটা।

হঠাৎ তার পেছনে একটা ছায়া পড়ে। সে ঘুরে তাকায়—
এক বৃদ্ধ, ধবধবে দাড়ি, পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। মুখে অদ্ভুত প্রশান্তি। তিনি সোজা এসে বলেন,
সব প্রশ্নের উত্তর চাইলে, একটা কাজ করো। ১৯৪৩ সালের সুরেশ পালএর ফাইলটা খুঁজে বার করো। উত্তর লুকিয়ে আছে সেখানে।

অভীক জিজ্ঞেস করার আগেই তিনি চলে যান পাশের গলির ভেতর। কিন্তু তার হেঁটে যাওয়ার ভঙ্গিটা কেমন যেন পরিচিত। খুবই…

সে মোবাইল টেনে গুগলে সার্চ দেয়:
“Suresh Pal – Belghar Post Office – 1943 – photograph”

একটি সাদা-কালো ছবি খোলে। সুরেশ পাল দাঁড়িয়ে আছেন ডাকঘরের সামনে, হাতে লাল টিনের চিঠির বাক্স।

অভীক হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।

ছবিতে থাকা সেই লোকটা…

তার মুখটা হুবহু অভীকের নিজের মতো।

অভীক ছাদে উঠে বসে থাকে সারারাত। বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত যন্ত্রণা—আশ্চর্য, ভয়ানক, তবুও মগ্ন করে দেওয়া কৌতূহল। একটা পুরনো ডাকঘর তাকে নিজের মৃত্যুর ছবি পাঠাচ্ছে, আর সেই সঙ্গে এমন একজন মানুষকে দেখিয়েছে, যার মুখ অবিকল তার মতো—১৯৪৩ সালের সুরেশ পাল।

ঘড়ির কাঁটা রাত তিনটে ছুঁলে সে উঠে আসে ঘরে, চুপচাপ নিজের লেখার ডেস্কে বসে। সামনে রাখে সেই ছবিটা, তার পাশে প্রথম চিঠি, আর নিজের হাতে লেখা সেই নতুন চিঠির কপি।

তার মাথায় একটা বুনট গাঁথা শুরু হয়—যদি সুরেশ পাল সময়ের মধ্য দিয়ে কোনোভাবে চলে গিয়েছিলেন ভবিষ্যতে, যদি তিনিই ডাকঘরকে বানিয়েছিলেন একটা টাইম-চ্যানেল, তাহলে অভীক কি সেই লুপের পরবর্তী কাহিনি?

সকাল হতেই সে সোজা চলে যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগের সহকারী প্রফেসর অনিরুদ্ধ চক্রবর্তীর কাছে—তার মেন্টর, যিনি নানা সময়ে তাকে পুরনো ম্যাপ ও দলিল জোগাড় করে দিয়েছেন।

“স্যার, আপনি কি কখনো শুনেছেন, এমন কোনো জিনিস, যা সময়ের মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করতে পারে? টাইম ক্যাপসুল নয়, টাইম কানেক্টর?”

অনিরুদ্ধবাবু প্রথমে হেসে উড়িয়ে দেন। তারপর অভীক চিঠিটা দেখায়। সেই প্রিন্টেড ছবি। তারপর সুরেশ পালের নথি।

গম্ভীর হয়ে যান অনিরুদ্ধ। “তুমি বলছ, সুরেশ পাল হয়তো সময় পেরিয়ে গিয়েছিলেন?”

“তিনি যদি পারেন, তাহলে হয়তো আমিও পারি, স্যার। কিন্তু কিভাবে?”

অনিরুদ্ধ চশমা খুলে বলেন, “একটা মাত্র উপায় আছে। কলকাতার নিকো পার্কের পেছনে একটা বেসরকারি সংরক্ষিত আর্কাইভ আছে—‘প্যাটার্নস অব টাইম’। সেটা আসলে একটা অবৈধ গবেষণাগার ছিল আশির দশকে। এখন অচল। কিন্তু শোনা যায়, সেখানে একসময় এক ‘Temporal Tunnel’–এর মডেল তৈরি হয়েছিল। ওটাই হয়তো বেলঘর ডাকঘরের সঙ্গে যুক্ত।”

অভীক কিছু না বলে বেরিয়ে পড়ে। বিকেলে ছেঁড়া ব্যাগে শুধু কয়েকটা চিঠি নিয়ে চলে আসে নিকো পার্কের পাশে ফাঁকা এলাকায়। একটা বন্ধ ফ্যাক্টরি, যার চারপাশে ঘাসে ঢাকা। সাইনবোর্ড পড়ে আছে মাটিতে—
“P.O.T LABS: Patterns of Time”

টিনের দরজা ধাক্কা দিতেই খুলে যায়। ভিতরে গা ছমছমে অন্ধকার। সিলিং থেকে ঝুলে আছে তারের গোছা, ইলেকট্রিক বক্স, পুরনো কম্পিউটার। এক কোণায় একটা বুলেটিন বোর্ডে আটকানো কাগজে লেখা—
“Do not attempt entry to door-07 unless synchronised.”

অভীক ঘুরতে ঘুরতে পায় সেই দরজাটা—ডোর০৭
দরজায় আবারও লেখা—“Belghar Transmission Port – EST: 1987”

হাতটা কাঁপতে থাকে। ধীরে ধীরে সে সেই দরজার হ্যান্ডল ঘোরায়।

ভিতরে অদ্ভুত ছোট্ট এক রুম। মাঝখানে একটা পিতলের বাক্স। তার গায়ে খোদাই—চিঠি ফেলুন
এখানে? এত বছর ধরে?

সে টেনে নেয় নিজের সেই প্রশ্ন করা চিঠিটা—যেটা গতকাল বেলঘর ডাকঘরে ফেলেছিল।

চমকে ওঠে—চিঠিটার কাগজ ভেতরে নেই। তার বদলে নতুন আরেকটা চিঠি সেখানে পড়ে।

সে তুলে নেয় চিঠিটা। খুলে দেখে, পরিচিত হস্তাক্ষর—

তুমি জানতে চেয়েছিলে কারা আছে তোমার বিরুদ্ধে। উত্তরটা সহজতুমি নিজেই। তুমি জানো না, তোমার হাত দিয়ে সময় বদলে যাবে, কিন্তু কে জানেসেটা ভালো হবে না খারাপ।
এই চিঠির সঙ্গে দিই সুরেশ পালএর শেষ বার্তা। পড়ো।
সময়

চিঠির ভাঁজের ভেতরে আরেকটি সাদা কাগজ। ছেঁড়া। ঘামে-ভেজা দাগ।
লেখা:

আমি বুঝেছিলাম দেরি হয়ে গেছে। সময় খেলছে আমার সঙ্গে। যদি কেউ পড়ে এই চিঠি, তবে জেনে রেখোবেলঘর শুধু ডাকঘর নয়, এটা এক প্রাচীন প্রহেলিকা। সেখানে চিঠি যায় না, চিঠি ফেরে।
যত বেশি জানবে, তত বেশি বদলাবে ভবিষ্যৎ।
আর যত বদলাবে ভবিষ্যৎ, ততই তুমি হারাবে নিজের সত্য।
সুরেশ পাল
১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৩

অভীক এখন নিশ্চিন্ত নয় কিছুতেই। একদিকে রহস্য, অন্যদিকে ভবিষ্যতের মৃত্যু। সে জানে, আরও চিঠি আসবে। আরও দরজা খুলবে।

কিন্তু এই খেলায় তার প্রতিপক্ষ কে? ভবিষ্যৎ? নাকি সময়ের মধ্যেই বাস করা এক রহস্যময় সত্তা?

সে আর একবার দরজা-০৭ বন্ধ করে পেছনে তাকায়। দেয়ালের একটা কোণে আঁকা—

একটা চিঠি বদলে দিতে পারে একটা সময়। আর একটা সময় বদলে দিতে পারে এক জীবন।

বেরোতে বেরোতেই আকাশটা কালো হয়ে আসে। নিকো পার্কের পরিত্যক্ত ল্যাবের ধুলোবালিতে চলার পথে অভীক টের পায়—পায়ের শব্দ যেন শুধু তার একার নয়। চারপাশটা নিঃস্তব্ধ, অথচ কেমন যেন মনে হয়, সময় তার পেছনে হাঁটছে।

চিঠিগুলো তার ব্যাগে গুছিয়ে রেখেছে—প্রথম অজ্ঞাত চিঠি, নিজের হাতে লেখা প্রশ্নপত্র, মৃতদেহের ছবি, সুরেশ পালের বিদায়বার্তা—প্রত্যেকটা যেন এক একটা ক্লু। তবে কার খেলার?

রাত্তিরে ঘরে ফিরে আলো নিভিয়ে জানালার পাশে বসে পড়ে থাকে অভীক। মাথায় ঘুরপাক খায় বারবার একটাই প্রশ্ন—যদি আমি নিজেই নিজের মৃত্যুর চিঠি লিখি, তাহলে কি আমি নিজের ভবিষ্যতের খুনি?

সেই মুহূর্তে দরজার তলায় একটা সাদা খাম ঠেলে ঢুকে পড়ে ঘরের মধ্যে।

সে উঠে যায় তাড়াতাড়ি। বাইরে কেউ নেই। পুরো বাড়ি নিঃশব্দ। তবু চিঠিটা পরিষ্কারভাবে সেই অদ্ভুত সাদা খাম—যার কোনো স্ট্যাম্প নেই, ঠিকানা নেই, কিন্তু সময়ের গন্ধ রয়েছে।

এইবার খাম খুলে দেখে সে অবাক হয়।

ভেতরে কোনো লেখা নেই।

একটা ফাঁকা সাদা কাগজ। অথচ, তার ঠান্ডা হাতের তালুতে যেন কাগজটা ধীরে ধীরে গরম হয়ে উঠছে। তাপ ছড়াচ্ছে।

সে ব্যাগ থেকে আগের সব চিঠিগুলো এনে পাশাপাশি রাখে। এবার খেয়াল করে—এই ফাঁকা কাগজের আকৃতি, রং, এমনকি কাগজের টেক্সচার—একদম আলাদা। অনেক বেশি মসৃণ, অনেক বেশি গাঢ় সাদা। যেন কোনো সাধারণ কাগজ নয়, বরং কোনো প্রযুক্তিগত ফর্ম।

হঠাৎ তার ঘরের দেওয়ালে ঝুলে থাকা আয়নার উপর একটা রেখা ফুটে ওঠে। মনে হচ্ছে কেউ কাচের ওপর কিছু লিখছে অদৃশ্য কালি দিয়ে। ধীরে ধীরে ভেসে ওঠে কয়েকটা শব্দ—

চোখে যা নেই, তা ছুঁয়ে বোঝো। কাগজের লেখাগুলো আলোতে আসে। সময়ের আলোয়।

অভীক কাগজটা নিয়ে আসে ডেস্ক ল্যাম্পের নিচে। সোজা আলোয় কিছুই দেখা যায় না। তারপর মোবাইলের UV ফিল্টার অ্যাপ চালিয়ে দেখে—
ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে এক অদ্ভুত অক্ষরে লেখা পঙক্তি—

ভবিষ্যতের যে শহরে আলো নেই, সেখানে তোমার নামেই শুরু হয় বিদ্রোহ। তুমি যদি না পালাও, সেই শহর আর কখনও সকাল দেখবে না।
ফিরে যাও। অতীতই তোমার ভবিষ্যৎ।

অভীক স্তব্ধ হয়ে পড়ে।
কোন শহরের কথা বলা হচ্ছে? আর ভবিষ্যতের সেই ‘বিদ্রোহ’ যদি তার নামেই হয়, তবে কি সে কোন অপরাধের জন্মদাতা?

সে মোবাইলে টাইম-লুপ, টাইম-কার্গো, প্যারাডক্স নিয়ে সার্চ করে। ইউটিউব ঘেঁটে ঘেঁটে এক গবেষককে খুঁজে পায়—ডঃ অদ্বৈত বসু—যিনি বছর দশেক আগে টাইম-কমিউনিকেশন নিয়ে একটা ভিডিও দিয়েছিলেন, যেখানে বলেছিলেন:
যদি কখনো তুমি নিজের নাম দেখে ফেলো ভবিষ্যতের কোন বিপ্লবে, তবে বুঝে নিওতোমার ভবিষ্যৎ তোমার হাতেই নেই।

ডঃ বসু এখন নিখোঁজ।

অভীক ঠিক করে, সে বেরোবে পরদিন। খুঁজে বের করবে প্যাটার্নস অব টাইম-এর আরো নথি।

সেই রাতে ঘুমের মধ্যে অভীক দেখে, সে হাঁটছে এক গাঢ় ধোঁয়ায় ঢাকা শহরের রাস্তায়। চারদিক শূন্য। হঠাৎই একদল মানুষ ছুটে আসে তার দিকে। সবার চোখে এক ভয়, এক কুয়াশা। একজন তার সামনে এসে দাঁড়ায়, কাঁপতে কাঁপতে বলে—
তোমাকে ফিরে যেতে হবে। তুমি যদি এখানেই থাকো, আমরা কেউই বাঁচব না। তোমার চিঠি দিয়েই সব শুরু হয়েছিল।

অভীক জেগে ওঠে হঠাৎ। বুক ঢিপঢিপ করছে। পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিয়ে খেয়াল করে, কে যেন একখানা খাম সেখানে গুঁজে দিয়েছে।

খাম খুলে দেখে, ভেতরে একটিই বাক্য—

কাল তুমি দেখবে একটা মেয়েকে, যে চিঠি দেয় নাচিঠি খায়।

অভীক সকালবেলা বেরোনোর আগেই তার মা এসে বলে, “রাতে আবার ঘুমোনি, না?”
সে মুচকি হাসে। এখন আর ঘুম আসে না। সময় যেন প্রতিটি মুহূর্তে তার পায়ের নিচে সরে যাচ্ছে।

সে পৌঁছে যায় বেলঘর ডাকঘরের সামনে। হালকা রোদ পড়েছে গলির মধ্যে, কিন্তু ডাকঘরের দরজা আজ একটু বেশি খুলে। যেন কেউ ভেতরে ঢুকেছে।

সে ধীরে ধীরে এগোয়, হালকা পা ফেলে ভিতরে প্রবেশ করে। ডাকঘরের ভেতরটা আজ অন্যরকম ঠান্ডা—একটা অচেনা গন্ধ ছড়িয়ে আছে চারদিকে, যেন পুড়ে যাওয়া কাগজের ধোঁয়া।

আর তখনই সে দেখতে পায় মেয়েটিকে।

ডাকঘরের এক কোণে বসে আছে এক মেয়ে, মাথা নিচু করে। তার সামনে কয়েকটা খোলা খাম, ছেঁড়া কাগজ ছড়িয়ে আছে। মেয়েটির পরনে মলিন নীল শাড়ি, চুল খুলে পড়েছে কাঁধে। সে একটা চিঠি তুলে নেয় ধীরে, চুপচাপ দেখে, তারপর ঠোঁটে নিয়ে যায়…

চিঠিটা সে খাচ্ছে। এক কামড়ে কাগজটা গিলে নিচ্ছে।

অভীক থমকে দাঁড়ায়। শব্দ করে না, কেবল তাকিয়ে থাকে। মেয়েটা হঠাৎ মাথা তোলে, ধীরে বলে—
তুমি অভীক রায়?”

সে চমকে ওঠে।
“তুমি আমাকে চেনো?”

মেয়েটি উঠে দাঁড়ায়। চোখদুটো লাল, কান্নায় ধোয়া। বলে, “আমি সব চিঠি পড়ি। যেগুলো তুমি পাওনি, সেগুলোও।”

অভীক এগিয়ে গিয়ে বলে, “তুমি কে?”

“আমি? আমি সেই, যার নাম কোনো চিঠিতে লেখা থাকে না। অথচ আমি সব জানি। আমি ‘মেঘনা’। একদিন ছিলাম ডাকঘরের পাঠিকা, এখন আমি সময়ের অভিশাপ।”

অভীক নিঃশব্দে বলে, “তুমি কি ভবিষ্যৎ থেকে এসেছো?”

মেঘনা হাসে, খুব ধীরে। “না। আমি ছিলাম অতীতে। ১৯৪৩ সালে। সুরেশ পাল ছিল আমার প্রেমিক। আমি তার জন্য চিঠি লিখতাম প্রতিদিন, কিন্তু কোনো চিঠি পৌঁছাত না। শেষে সে একদিন নিজেই হারিয়ে গেল সময়ের মধ্যে। তখন থেকেই আমি এইখানে—চিঠিগুলো খাই, যাতে কেউ আর না হারায়।”

অভীক ধীরে বলে, “কিন্তু তবু হারাচ্ছে। আমি তো হারাচ্ছি।”

মেঘনা তার দিকে তাকায়। “তুমি যদি জানতে সময় কিভাবে কাজ করে, তাহলে বুঝতে… সব চিঠিই কোথাও না কোথাও পৌঁছায়। কেবল পাঠক বদলে যায়।”

অভীক পকেট থেকে ফাঁকা চিঠিটা বার করে দেয়। মেঘনা কাগজটা নেয় হাতে, চোখ বুজে বলে, “এই চিঠির অক্ষরগুলো তোমার নিজের ভেতরেই লেখা। তুমি কেবল ভুলে গেছো কী লিখেছিলে। সময় তোমাকে মনে করিয়ে দেবে, ধীরে ধীরে।”

সে এরপর তার ব্যাগ থেকে মৃতদেহের ছবিটা বের করে দেয়। “এই ছবি কি সত্যি? আমি কি মরব?”

মেঘনা দেখে, তারপর বলে, “এই ছবির ভবিষ্যৎটা নিশ্চিত নয়। তুমি চাইলে পালাতে পারো, কিন্তু পালালে সময় থেমে যাবে। তুমি আর কেউ নও, তুমি সেই ‘ভবিষ্যৎ-চালক’ যাকে সময় বেছে নিয়েছে।”

“ভবিষ্যৎ-চালক?”

“হ্যাঁ। প্রতি একশো বছরে একটা মানুষ জন্মায়, যার হাতে সময়ের চিঠি খোলে। তুমি সেই লোক। কিন্তু তুমি এখনও জানো না, তোমার ভিতরে লুকিয়ে আছে কী।”

অভীক ততক্ষণে অনুভব করে, তার কাঁধ ভারী হয়ে এসেছে। যেন কোনো চিঠির ওজন চেপে বসেছে তার শরীরের ভেতরেই।

মেঘনা তখন ধীরে বলে, “একবার আমার সঙ্গে এসো। আমি তোমাকে দেখাবো সেই চিঠি—যেটা কেউ কোনোদিন পায়নি। কিন্তু সেটার উত্তর দিলে সময় বদলাবে।”

অভীক চুপচাপ তার পিছু নেয়।

বেলঘর ডাকঘরের পেছনে একটা ছোট্ট চেম্বার। দরজায় ধুলো জমে থাকলেও, ভেতরে ঢুকতেই টের পাওয়া যায়—কেউ যেন রোজ এখানে আসে। একটি ছোট কাঁচের বাক্সে রাখা আছে চিঠি। কিন্তু সেটা কোনো কাগজ নয়।

একটা ধাতব পাত। তামার মতো। তার গায়ে খোদাই করা অদ্ভুত লিপি।

মেঘনা ফিসফিসিয়ে বলে, “এটা সুরেশ পাল লিখেছিল। সময় পেরিয়ে। কিন্তু ভাষাটা কোনো মানুষের নয়। আমরা বলি, এটা ‘সিঙ্ক-লিপি’—যে ভাষা শুধুই অনুভব করা যায়, পড়া যায় না।”

অভীক কাছে গিয়ে তাকায়। তার চোখের সামনে সেই অক্ষরগুলো ধীরে ধীরে চলতে থাকে, নড়ে, মিশে যায়। আর হঠাৎই তার মাথায় ঘুরে ওঠে একটা বাক্য—

তুমি যদি নিজেকে চিনতে পারো, তাহলে সময় তোমার হয়ে যাবে। না হলে, সময় তোমাকে খেয়ে ফেলবে।

অভীক ধাতব চিঠির অক্ষরগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল একটানা, কিন্তু চোখ দিয়ে নয়—মনের ভেতর দিয়ে। অক্ষরগুলো বদলে যাচ্ছিল, মিশে যাচ্ছিল যেন তার মস্তিষ্কের ভাঁজে ভাঁজে, আর সেখানে তৈরি হচ্ছিল এক সুর—কোনো ভাষাহীন বার্তা, যা কেবল অনুভব করা যায়।

একটা নাম ভেসে ওঠে মনের গভীরে। খুবই পরিচিত, অথচ বহুদিনের বিস্মৃত।
অভিকরণ…”

সে কেঁপে ওঠে। “করণ”—এই নাম সে বহু বছর আগে শুনেছিল। তার বাবার মুখে, একবার স্বপ্নে। এমনকি, এক পুরনো বংশানুক্রমিক গৃহদেবতার মূর্তির পেছনেও খোদাই করা ছিল সেই নাম—”অভিকরণ”।

সে ফিসফিস করে মেঘনাকে জিজ্ঞেস করে, “এই নামটা… আমার ভেতরেই ছিল। এটা কি আমার আসল নাম?”

মেঘনা ধীরে বলে, “তুমি অভীক, কিন্তু সময়ের বর্ণমালায় তুমি ‘অভিকরণ’। এই নামে লিপিবদ্ধ আছে তোমার ভবিষ্যতের সমস্ত চিঠি। সেই নাম দিয়েই তুমি তৈরি করো সময়ের প্রতিবিপ্লব।”

“প্রতিবিপ্লব?”

মেঘনা তাকায় কপালের দিকে। “তুমি এখনো জানো না তুমি কী করেছো। তুমি একটা চিঠি লিখেছিলে… যা কেবল তুমি নিজেই পেতে পারো। সেই চিঠির মধ্যে ছিল এমন এক নির্দেশ, যা ভবিষ্যতের এক শহরের নিয়তি বদলে দেয়। তারা তোমার নামেই একটা আইন জারি করেছিল—‘অভিকরণ ডিক্রি’। সেই আইনেই শুরু হয় ধ্বংস।”

অভীক পেছনে সরে আসে। “আমি তো কিছুই লিখিনি! আমি কেবল প্রশ্ন করেছি। উত্তর চেয়েছি!”

“তোমার প্রশ্নই ছিল এক আদেশ,” মেঘনা ফিসফিস করে বলে, “কারণ সময় সবকিছুকে উল্টে পড়ে।”

অভীক এবার বুঝতে পারে, এই খেলা কেবল অতীত-ভবিষ্যতের নয়—এটা স্মৃতি আর অবচেতনের খেলা। সময়কে বুঝতে হলে, তাকে নিজের মধ্যেই খুঁজতে হবে সেই ফাঁকা জায়গা—যেখানে কোনো চিঠি লেখা হয়নি, অথচ লেখা হয়ে গেছে।

সে চোখ বন্ধ করে। মনে মনে বলে,
আমি কোথা থেকে এসেছি? কেন আমাকে এই চিঠিগুলোর পথ দেখানো হচ্ছে?”

এক মুহূর্তে, তার মাথার ভিতর ঝাঁকুনি লাগে। একটা কন্ঠস্বর শোনা যায়—গভীর, কেমন যেন রোবটিক, অথচ মানবিক।
কারণ তুমি সময়ের শেষ পাঠক। তুমি যে গল্প শুরু করবে, সেই গল্পই হবে শেষ চিঠি।

সে আবার চোখ মেলে দেখে—মেঘনা চোখ বন্ধ করে আছে। মুখে এক চাপা দুঃখ।

“তুমি জানো না,” সে বলে, “আমি কত বছর ধরে অপেক্ষা করছি তোমার জন্য। আমি জানতাম, তুমি আসবে। কারণ আমি দেখেছি সেই ভবিষ্যৎ, যেখানে আমি… তোমার জন্য মরি।”

অভীক কেঁপে ওঠে। “তুমি মরবে আমার জন্য?”

মেঘনা হেসে ওঠে—একটা ক্লান্ত, বিষণ্ণ হাসি। “আমি তো মরেই আছি, অভীক। আমি এক মৃত চিঠি। শুধু আমার শরীরটা বেঁচে আছে এই ডাকঘরের গন্ধে।”

একটা হঠাৎ শব্দ হয়। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে।

মেঘনা উঠে দাঁড়ায়, টেবিলের নিচ থেকে বের করে আরেকটা বাক্স। তার মধ্যে রয়েছে ডজন ডজন খাম।

সে বলে, “এই চিঠিগুলো তুমি লেখনি, কিন্তু লেখার কথা ছিল। তুমি একেকটা খুললে, তোমার ভেতরের বিভিন্ন ভবিষ্যৎ সামনে আসবে। কিন্তু সাবধান—সব ভবিষ্যৎ গ্রহণ করা যায় না।”

অভীক হাত বাড়ায়, একটা খাম তোলে। ওপরে লেখা—

লিখিত: ২১ জুন, ২০৯২ | প্রাপক: অভীক রায় | বিষয়: তোমার জন্মের রহস্য

সে খামটা খোলে। ভিতরে কাগজ নেই।

বরং এক ফ্ল্যাশ-ড্রাইভ।

মেঘনা বলে, “তোমার জন্ম সরকারি নথিতে যেভাবে লেখা আছে, সেটা ঠিক নয়। তুমি সাধারণ কোনো শিশু ছিলে না। তুমি সময়ের পরীক্ষাগারে তৈরি—প্রথম এবং শেষ ‘মেমোরি-হোস্ট’। যাকে দিয়ে ভবিষ্যৎ এবং অতীত সংরক্ষণ করা যায়।”

অভীক পেছনে এক ধাক্কা খায়। “আমি কি তাহলে মানুষই না?”

মেঘনা বলে, “তুমি মানুষ, কিন্তু অতিমানুষও। তোমার মাথায় যে স্মৃতিগুলো আছে, তা সব তোমার নয়। কিছু তোমার ভবিষ্যতের, কিছু তোমার পূর্বপুরুষের। আর কিছু এমন সময়ের, যা ঘটেনি—তবু ঘটবে। এই ‘সময়ের ডাকঘর’ কেবল তোমার জন্যই চালু থাকে। কারণ, তুমিই পারো একটা ভুল চিঠিকে সঠিক ইতিহাস বানাতে।”

অভীক চুপ হয়ে যায়। সে জানে, আর পালানোর রাস্তা নেই।

সে এখন বুঝে গিয়েছে—প্রতিটি চিঠিই এক যুদ্ধ। আর প্রতিটি বাক্য, এক অস্ত্র।

বাড়ি ফিরে অভীক দরজা বন্ধ করে দেয় নিঃশব্দে। ঘরের ভেতরে নিস্তব্ধতা, একদম পিন পড়লেও শোনা যায়। ব্যাগ থেকে বের করে টেবিলের ওপর রাখে সেই সোনালি রঙের ফ্ল্যাশ-ড্রাইভ, যার গায়ে খোদাই করা একটা সংখ্যা:
“1120-BX”

সে জানে, এটা কোনো সাধারণ ভিডিও নয়। এটা তার জন্মের সত্য। তার অস্তিত্বের রহস্য।

ল্যাপটপ খুলে সে ফ্ল্যাশ-ড্রাইভটা প্লাগ-ইন করে। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে একটা সিকিউরিটি স্ক্রীন—“Enter Identity Key”

সে খানিকক্ষণ ভাবে, তারপর টাইপ করে—AVIKARAN

দু’সেকেন্ড পরেই স্ক্রিনে ঝলকে ওঠে এক বিকট শব্দ, তারপর ধীরে ধীরে খুলে যায় একটা ফুটেজ।

ভিডিও শুরু হয় এক সাদা ঘর দিয়ে। হাসপাতালের মতো নয়—বরং একটা পরীক্ষাগারের মতো। দেয়ালে গ্রাফ, অদ্ভুত লাইট, অ্যালগরিদম ঘুরছে স্ক্রিনে।

একজন মানুষ, মুখে মাস্ক, চোখে সুরক্ষা চশমা পরে ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ায় ক্যামেরার সামনে। তার হাতে একটা ফোল্ডার, তার গায়ে গাউন লেখা—“ChronoLab Kolkata — Head Memory Technician”

তার মুখ খুলে—“আজ ১৪ অগস্ট, ২০৬৩। আমরা তৈরি করছি ‘মেমোরি-হোস্ট’ সিরিজের প্রথম সফল প্রোটোটাইপ। কোডনেম: Avikaran-1”

অভীক গা-ছমছমে চোখে দেখে—একটা তরল ভর্তি ক্যাপসুল। ভিতরে একটা শিশুর অবয়ব, ভ্রূণের মতো ভেসে আছে। এবং সেই মুখটা…

অভীক নিজের মুখ চিনে ফেলে।

ক্যামেরার মানুষটি আবার বলে,
“এই ভ্রূণকে আমরা সৃষ্ট করেছি পঞ্চাশটি স্মৃতির কোড থেকে—যার মধ্যে রয়েছে মহাত্মা গান্ধির চিঠি, রামানুজমের গণিত ব্লট, এক্সটিংক্ট কালচারাল ট্রাইবসের মুখে মুখে বলা ইতিহাস, এমনকি ভবিষ্যতের এলগরিদম। এই শিশু কোনো একটিমাত্র সময়ের নয়। এ জন্মের নয়, এ চিঠির। Avikaran is not born. He is written.”

ভিডিও চলতেই থাকে। শিশুটি জন্ম নিচ্ছে, এক স্বচ্ছ পাত্রের ভিতর থেকে ধীরে ধীরে তুলে আনা হচ্ছে মানুষের জগতে।

অভীক চেয়ারে হেলান দিয়ে পড়ে। বুকের ভিতর এমন এক কাঁপুনি শুরু হয়, যা কোনো ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।

সে ফিসফিস করে বলে, “তাহলে… আমার মা-বাবা?”

ভিডিওতে দেখা যায়, এক মহিলা দাঁড়িয়ে, হাত ধরে শিশুকে। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু ক্যামেরার পাশে দাঁড়ানো আরেকজন বলে, “এনকোডেড ন্যানো-মেমোরি ইনজেকশন সম্পন্ন। ফিজিক্যাল প্যারেন্টিং শুরুর জন্য প্রস্তুত।”

স্ক্রিনে ঝাঁকুনি হয়। একটা ক্লিপ ঝাঁপিয়ে আসে—

“SUBJECT AVIKARAN-1 LEAKED FROM CHRONOLAB – SUSPECTED ESCAPE FROM TIME GATE 3 | STATUS: MISSING | ACTIVATION LIKELY BETWEEN 2090–2099”

ভিডিও হঠাৎই বন্ধ হয়ে যায়।

অভীক বোঝে, তার জন্ম প্রকৃত জন্ম নয়। সে সময়ের মধ্যে বানানো এক মেমোরি-ধারক। তার সমস্ত অনুভূতি, স্মৃতি, এমনকি স্বপ্ন—সবই আসলে একটি লেখা ইতিহাসের অংশ।

তখনই দরজায় কড়া নড়ে।

একবার। তারপর দুবার। তারপর তিনটে কড়া একসাথে।

অভীক এগিয়ে দরজায় কাঁধ রাখতেই শুনতে পায় নিচু গলায় কেউ বলছে—
“Open, Avikaran. We are from Time Order Unit. You are unauthorized. You need to come with us.”

সে পেছনে তাকায়। জানালার বাইরে কে যেন দাঁড়িয়ে। ছায়ার মতো।

মেঘনা।

সে ফিসফিস করে—
তুমি পালাও। এবার সময় পেছনে পড়ছে। কিন্তু যদি ধরাও, চিঠিগুলো পুড়ে যাবে। আর একটাও লেখা যাবে না।

অভীক জানে, এবার তাকে পালাতেই হবে।

সে ব্যাগে গুঁজে নেয় সমস্ত চিঠি, ফ্ল্যাশ-ড্রাইভ, মৃতদেহের ছবি, মেঘনার নাম লেখা চিঠি, ধাতব প্লেট।
একবার ফিরে তাকায় নিজের ল্যাপটপের স্ক্রিনে—শেষে লেখা:

“Avikaran Protocol Activated. Future Rewrite Possible.”

দরজার বাইরে ধাপের শব্দ।

সে জানালার কাঁচ ঠেলে নিচে ঝাঁপ দেয়।

সময় এখন তার পেছনে ধাওয়া করছে। আর তার সামনে একটাই রাস্তা—নিজের ভবিষ্যতের ইতিহাসকে নতুন করে লেখা।

রাতের শহর ঝাঁঝালো নিঃশ্বাস ফেলছে।

অভীক জানালা দিয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে গিয়েছিল এক পরিত্যক্ত বাসিন্দাবিহীন পাথরের আঙিনায়। শরীর থেঁতলে যায়নি, বরং সময় যেন তাকে নিজের শরীর থেকে আলাদা করে ফেলেছে।

তাকে খুঁজতে খুঁজতে টাইম অর্ডার ইউনিটের লোকেরা এসে পৌঁছেছে সেই ঘরে, কিন্তু ততক্ষণে সে সরে গেছে অন্যপথে—গলির পর গলি পেরিয়ে, এক অন্ধকার অটোয় উঠে, শহর ছাড়িয়ে, চলে গেছে দক্ষিণ ২৪ পরগণার এক গ্রামে—নোনাডাঙা

কেউ বলে সেখানে জল মাটির নিচে কথা বলে। কেউ বলে, একটা পুরনো ব্রিটিশ ডাকঘর ছিল ওখানে, যা রাতের বেলায় জ্বলে ওঠে—চিঠি ছাড়াই।

অভীক ট্রেন, রিকশা, তারপর হেঁটে এসে দাঁড়ায় সেই বাড়িটার সামনে। ধ্বস্ত, ছাউনি ভাঙা, কিন্তু সিঁড়ির মুখে এখনও বোর্ড ঝুলে আছে—
নোনাডাঙা পোস্টাল স্টেশন, স্থাপিত ১৮৫১

চুপ করে ভিতরে ঢোকে সে। দরজায় কেউ নেই। ভেতরে একটা ছোট কাঠের টেবিল।
আর তার ওপরে একটা খাম।

খামের ওপরে লেখা:
অভিকরণ (পুনরাবৃত্ত)”
তারিখ: অজানা
স্থল: ডাকঘরসংলগ্ন টাইমগেট

সে কাঁপা হাতে খাম খুলে দেখে। ভেতরে সাদা কাগজ, কিন্তু এবারও সেই অদ্ভুত অক্ষর—আলোয় পড়ে না, ছায়ায় ঝলসে ওঠে। সে এক কোণে বসে, ঘরের জানলা দিয়ে ঢোকা চাঁদের আলোয় তাকায়।

ধীরে ধীরে অক্ষরগুলো ফুটে ওঠে—

তোমার মৃত্যু এখানে নয়। তোমার জন্মও নয়। শুরু করো এখান থেকে।
এখানে চিঠি পাঠাবে না। বরং নিজেরই চিঠি খুঁজে পাবে।
এই ঘরের নিচে আছে চেম্বার১২।
সেখানে সময় এখন দাঁড়িয়ে। তোমার অপেক্ষায়।

অভীক মাথা নিচু করে জানালার ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়ে কিছুক্ষণ।

তার ঘুম ভাঙে এক নরম শব্দে—ঘরের মেঝের কাঠের একটা পাটাতন আলগা হয়ে খুলে যাচ্ছে নিজে থেকেই।

সে নেমে পড়ে, সেই গর্তের মধ্যে দিয়ে ঢোকে নিচে।

একটা সরু সিঁড়ি, যা যেন কোনো বাইনারি কোডের মতো ঘুরে ঘুরে চলে গেছে অনেক নিচে।

অবশেষে সে পৌঁছায় একটা ছোট্ট পাথরের চেম্বারে। ভেতরে একটাই জিনিস—একটা চিঠির দেয়াল।

সেই দেয়ালে সারি সারি খাম সাঁটানো। প্রত্যেকটির উপরে তার নাম—অভীক রায়, অভিকরণ, অভি, এমনকি “Unknown Host #1” পর্যন্ত।

সে এগিয়ে গিয়ে একটা চিঠি তোলে। খামে লেখা—

প্রেরক: ভবিষ্যতের তুমি
প্রাপক: বর্তমানের তুমি
বিষয়: সময়ের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ

সে চিঠিটা খুলে দেখে ভিতরে একটিই লাইন—

তুমি যাকে ভয় পাচ্ছো, সে তোমারই সৃষ্টি। তার নামনিরুপায় অভি তুমি নিজেই।

সে পেছনে ফিরে তাকায়। দেয়ালে এবার আরেকটি খাম নিজে থেকে খুলে পড়ে নিচে।

তাতে লেখা—

যদি সত্যি জানতে চাও তুমি কে, তবে তোমাকে ফিরতে হবে ১৯৪৩এ। সেখানেই প্রথম চিঠি লেখা হয়েছিল। সময় তোমার অপেক্ষায়।

সাথে এক ছোট্ট মুদ্রা পড়ে। ব্রিটিশ আমলের। আর খামটিতে সেঁটে আছে একটা ছোট্ট ম্যাপ—বেলঘর ডাকঘরের ঠিক নিচে একটা চোরাগলি দেখানো।

অভীক মুদ্রাটা হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করে। এক ঝটকায় যেন শরীর জেগে ওঠে অন্য কিছুর জন্য।

সময় এবার পেছনে নয়—সমান্তরালে চলছে তার সঙ্গে।

সে জানে, এবার তাকে ফিরে যেতে হবে।

নোনাডাঙার সেই গোপন চেম্বার থেকে বেরিয়ে অভীক ফিরে আসে কলকাতায়, বেলঘর ডাকঘরের দিকে। কিন্তু এবার সে জানে, তাকে মূল ঘরে নয়—ঘরের নিচে যেতে হবে, সেই অদৃশ্য চোরাগলি দিয়ে, যেটা এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে লুকিয়ে ছিল।

গভীর রাতে সে সেই ধুলো-ঢাকা ঘরে ঢোকে। বাইরের রাস্তায় হালকা কুয়াশা। ভিতরের অন্ধকারে যেন কিছুর অপেক্ষা দীর্ঘ হয়ে আছে।

টেবিলটা একটুখানি সরালেই কাঠের মেঝেতে দেখা যায় দাগ। চাবির মতো একটা ফাঁক।
সে নোনাডাঙা থেকে আনা সেই ব্রিটিশ মুদ্রাটা ফাঁকে গুঁজে দেয়।

টিক।

মেঝে একটু কেঁপে ওঠে। একটা কাঠের ফ্রেম সরে যায়, খুলে পড়ে নিচের সিঁড়ির পথ।

অভীক নামতে থাকে ধীরে ধীরে। নিচে নামার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের বাতাস ঠান্ডা হয়ে আসে। দেয়ালের গায়ে এখনো পুরনো পোস্টাল কোড, কিছু অদ্ভুত লিপি, কিছু তারিখ—সব মুছে যাওয়া ইতিহাসের ছেঁড়া খাতা।

তিন মিনিটের মতো সিঁড়ি পেরিয়ে শেষে সে পৌঁছে একটা ঘরে।
ঘরটা গোলাকার, দেয়ালে নানা রঙের খাম সাঁটা, মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু ছেঁড়া কাগজ। মাঝখানে বসে আছে একজন।

অভীক থেমে যায়।

লোকটা দেখতে হুবহু তার মতো।

একটুও না কম, না বেশি। যেন আয়নার প্রতিবিম্ব—কিন্তু কেবল চেহারায় নয়, চোখের গভীর দৃষ্টিতেও।

লোকটা মাথা তোলে।

তুমি দেরি করে ফেলেছো।
তার কণ্ঠে সময়ের ক্লান্তি, বিষণ্ণতা আর একধরনের অভিমান।

অভীক কাঁপা গলায় বলে, “তুমি কে?”

লোকটা বলে, “আমি সেই তুমি, যে পালাতে পারেনি। যে থেকে গিয়েছিল সময়ের ফাঁদে। আমার নাম ছিল ‘অভিকরণ-১’। তুমি, অভিকরণ-২।”

“তাহলে… আমি কি প্রতিস্থাপন?”

লোকটা হেসে ওঠে। “তুমি আশা ছিলে। আমি ব্যর্থতা। ২০৬৩ সালে আমাকে তৈরি করা হয়েছিল, সময়কে শোষণ করার জন্য। কিন্তু আমি প্রেমে পড়ে যাই। এক মেয়ের সঙ্গে—মেঘনা।”

অভীক পিছিয়ে আসে।

লোকটা মাথা নিচু করে বলে, “আমার এই ভালবাসা অ্যালগরিদমের বাইরে ছিল। তাই টাইম ইউনিট আমাকে তাড়া করে। আমি পালাতে পারিনি। মেঘনাকেও হারাই। তখন আমি নিজেই লিখে যাই একের পর এক চিঠি—যাতে ভবিষ্যতের আমি তোমাকে সাবধান করতে পারি। কিন্তু তুমি এসেছো অনেক দেরিতে।”

“তুমি কি… সময়ের বন্দি?”

“না,” লোকটা বলে, “আমি এখন নিজেই সময়ের রক্ষক। এই কক্ষে যত চিঠি আছে, সব লেখা ভবিষ্যতের। সবই তোমার জন্য। কিন্তু প্রতিটা চিঠি খুললে এক একটা ভবিষ্যৎ বদলে যাবে।”

অভীক কাছে গিয়ে বলে, “আমি জানি না আমি কী চাই, কিন্তু আমি পালাতে চাই না। আমি লিখতে চাই। যদি সময় আমাকে তৈরি করে, তবে সময়কেই আমি নতুন করে লিখব।”

অভিকরণ-১ তাকিয়ে বলে, “তবে তোমাকে করতে হবে সর্বশেষ কাজ।
এখানে আছে ‘মাস্টার চিঠি’। একটিই মাত্র। সেটি লিখলেই সব ভবিষ্যৎ স্থির হবে।
তুমি যদি লেখো—‘আমি নিজেই আমার ভবিষ্যৎ’—তবে সময় নিজেকে খুলে দেবে।
না হলে সব চিঠি বাতিল হবে। এই কক্ষ পুড়ে যাবে। মেঘনা হারিয়ে যাবে, আর তুমি জন্মাবেই না।”

একটা ধাতব কালি-কলম তুলে দেয় সে।

অভীক চুপচাপ কাগজ নেয়।

আর লিখে ফেলে একটিমাত্র লাইন—

আমি নিজেই আমার ভবিষ্যৎ।

–––

হঠাৎ ঘর কাঁপে। সময়ের ঢেউ বয়ে যায় মাথার ভিতর দিয়ে। অভীক দেখতে পায় সব চিঠি নিজের নিজের খামে ফিরে যাচ্ছে, যেন বাতাসে উড়ে গিয়ে ঠিক জায়গায় বসছে।

অভিকরণ-১ আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে যায়। তার শেষ কথা—“তুমি পেরেছো।”

আর শেষ শব্দের ঠিক আগে, মেঘনার কণ্ঠ ভেসে আসে কোথাও থেকে—

আমরা আবার দেখা করব। অন্য সময়, অন্য চিঠিতে।

সময় তার পথ বদলেছে।

চক্র শেষ হয়েছে, আবার শুরু হয়েছে নতুন এক লুপে। অভীক আর পালিয়ে বেড়ানো একটি নাম নয়—এবার সে সময়ের নিজস্ব ইতিহাস।

বেলঘর ডাকঘরের সেই গোপন চেম্বার এখন ফাঁকা। সব চিঠি, সব ভবিষ্যৎ, সব ভুল এবং সম্ভাবনা তার জায়গায় ফিরে গেছে।

অভীক ঘুরে ফিরে আবার নিজের বাড়িতে। ঘরটা বদলায়নি, কিন্তু তার ভেতরের সে বদলে গেছে।

সে জানে, এখন সব শেষ—কিন্তু সব শুরুও।

বইয়ের তাকের ওপর একটা নতুন খাম পড়ে আছে। আগের মতোই অদ্ভুত সাদা, পরিচিত গন্ধ। কিন্তু এবার তার ওপরে লেখা নেই কোনো ঠিকানা, তারিখ বা নাম।

শুধু একটিমাত্র শব্দ—

অভী

সে চমকে যায়।

দরজার দিকে তাকাতেই দেখে—একটা ছোট ছেলেকে, হয়তো আট-নয় বছর বয়স, হাতে আরেকটা খাম। ছেলেটা কিছু না বলে খামটা বাড়িয়ে দেয় তার দিকে।

অভীক নিচু হয়ে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কে?”

ছেলেটা চোখ মেলে চায়। বলে, “আমি সেই, যে একদিন তোমার মতো হবে। আর তুমি যাকে লেখো, আমি তার উত্তর।”

অভীক থমকে যায়।

ছেলেটা চলে যায় দরজা দিয়ে। কিন্তু তার মুখে হালকা হাসি ছিল—যেমন হয় চিঠি পড়ার সময় কারো মুখে থাকে।

অভীক খামটা খোলে। ভিতরে একটা সাদা কাগজ। পরিষ্কার হস্তাক্ষরে লেখা—

তুমি সময়কে লিখলে, আমি সময়কে পড়েছি।
তুমি যা ভাবলে, আমি তা হই।
আমি সেই ভবিষ্যৎ, যার জন্ম তোমার চিঠির ভেতরেই।
তুমি যদি আবার কখনও লিখতে চাও, আমি অপেক্ষা করব
বেলঘর ডাকঘরের পিছনে, সময়ের ওই চুপচাপ দরজাটার সামনে।

নিচে সই নেই। কোনো নাম নেই।

শুধু এক কোণে ছোট করে লেখা—
পুনরাবৃত্ত শেষ | পুনরাবৃত্ত অপেক্ষায়

অভীক জানে—এটা কেবল একটা গল্প নয়। এ এক বেঁচে থাকা।

চিঠি লিখে গেলে, সময় থামে না।

কিন্তু যখন চিঠির মধ্যেই সময় লুকিয়ে থাকে, তখন সেই চিঠিই হয়ে ওঠে সবচেয়ে জীবন্ত সত্য।

সে ডেস্কে বসে। কাগজ নেয়। কলম তোলে।

লিখতে শুরু করে
প্রিয় অচেনা,
আমি আবার শুরু করছি…”

শেষ

WhatsApp-Image-2025-07-14-at-6.39.02-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *