Bangla - সামাজিক গল্প

সবুজের জন্য স্বপ্ন

Spread the love

ঐশী চৌধুরী


জঙ্গলের ডাক

মেঘমালা বসাকের বয়স পনেরো। কিন্তু তার চোখে যেন হাজার বছরের পুরোনো বৃক্ষের জ্ঞান আর ভবিষ্যতের বাতাসের গন্ধ। সবুজডাঙা গ্রামের এই দশম শ্রেণির ছাত্রী বরাবরই একটু অন্যরকম। পুতুল খেলায় তার মন ছিল না, বরং মাঠে ঘুরে ঘাসের গন্ধ নিতে, পাখিদের ডাক শুনতে আর গাছের ছায়ায় বসে গল্পের বই পড়তে ভালোবাসত। গ্রামের পাশেই একটুকরো জঙ্গল, যেখানে ছোট্ট খালটা বয়ে গেছে বাঁক নিয়ে। সেই খালের পাড়ে বসে মেঘমালা ভাবত, পৃথিবী যদি সবসময় এমন সবুজ থাকত!

কিন্তু সবুজডাঙার সবুজ আর আগের মতো নেই। নতুন রাস্তা তৈরির নাম করে পঞ্চায়েত কয়েক মাস আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, জঙ্গলের একাংশ কেটে ফেলা হবে। গাছগুলোতে সাদা দাগ কেটে দেওয়া হয়েছে, যেগুলো কাটা হবে। দিনের পর দিন মেশিন আসে, মানুষ আসে, মেপে দেখে যায় গাছের মাটি কতটা শক্ত। মেঘমালার বুক ধকধক করে ওঠে, যখন দেখে সে বটগাছটাতেও দাগ কাটা—যার নিচে বসে সে জীবনের সবচেয়ে দুঃখের দিনে কেঁদেছিল, প্রথম প্রেমের চিঠি লিখেছিল।

স্কুলে সেদিন পরিবেশ বিজ্ঞান ক্লাসে শিক্ষক বললেন, “গাছ কাটা মানে শুধু অক্সিজেনের ঘাটতি নয়, গাছ কাটা মানে হাজার প্রাণের বাসস্থান ধ্বংস, মানে জলবায়ুর ভারসাম্য ভেঙে যাওয়া, মানে একটা প্রজন্মের শ্বাসরোধ।” মেঘমালার মনে হল এই কথাগুলো যেন কেবল তথ্য নয়, নিজের হৃদয়ের ভাষা। সে স্থির করল, কিছু একটা করতেই হবে।

বাড়ি ফিরে খাতায় বড় করে লিখল—“সবুজ রক্ষা কমিটি।” তারপর লাইন টেনে নীচে লিখল, “লক্ষ্য—জঙ্গল বাঁচানো।” পরিকল্পনা খুব বড় নয়—প্রথমে বন্ধুদের নিয়ে এক দল গড়ে তোলা, তারপর পোস্টার তৈরি, মানুষকে বোঝানো, গ্রামের মিটিংয়ে কথা বলা। কিন্তু মনে বিশ্বাস অগাধ—এই কাজ সে করবেই।

প্রথমে যায় নয়নের কাছে। নয়ন ওর সহপাঠী, ভালো বন্ধু আর সবসময়ের হাসির সঙ্গী। নয়ন শুনে হেসে ফেলে, “তুই একটা স্কুলছাত্রী, সরকার যেখানে রাস্তা বানাতে চাইছে, সেখানে তোর পোস্টার কাজ করবে?” মেঘমালা জবাব দেয়, “সরকারও মানুষ, আর আমরা যে জঙ্গল বাঁচাতে চাই, সেটা মানুষের ভবিষ্যতের জন্যই। যদি কিছু না করি, তাহলে তো গাছগুলো কাটা হবেই। অন্তত চেষ্টা তো করা যায়।”

নয়ন খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর বলে, “ঠিক আছে, চল তবে—তোর স্বপ্নে আমি সঙ্গী।” এরপর ধীরে ধীরে আরও পাঁচ-ছয়জন বন্ধু যোগ দেয়—মুন্নি, বাদল, সুজাতা, তানিশা আর শুভ। তারা মিলে তৈরি করে কিছু পোস্টার—“গাছ কাটা মানে জীবন কাটা,” “সবুজ গেলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার,” “জল, বায়ু আর গাছ—এই তিনে জীবন।” তারা এই পোস্টার দেয়ালজুড়ে লাগায়, গ্রামের বাজারে লিফলেট বিলি করে, স্কুলে পরিবেশ বিষয়ক নাটক করে।

গ্রামের অনেকেই হাসে। কেউ বলে, “বাচ্চাদের এইসব খেলা!” কেউ বলে, “কাজকর্ম ফেলে এসব করছো? সরকার যেখানে উন্নয়ন করতে চাইছে, সেখানে বাধা দেওয়া ভালো নয়।” তবে কয়েকজন প্রবীণ মানুষ—যেমন হরিমোহন কাকু, যিনি চাষবাস করেন খালের জল দিয়ে—চুপচাপ এসে বলে, “তোমরা চালিয়ে যাও, মেয়ে। এই গাছগুলো না থাকলে আমরা টিকতে পারব না।”

একদিন খুব সকালে নয়ন দৌড়ে এসে বলে, “মেঘমালা, তাড়াতাড়ি চল! বুলডোজার এসেছে, দক্ষিণ পাশে কাজ শুরু হয়ে গেছে।” মেঘমালা কোনও কিছু না ভেবেই দৌড়ে যায় জঙ্গলের দিকে। তার পেছনে নয়ন, মুন্নি আর বাদল। তারা গিয়ে দেখে, এক বিশাল যন্ত্র দাঁড়িয়ে আছে, পাশে লোকজন গাছ কেটে ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মেঘমালা চিৎকার করে বলে, “আপনারা থামুন! এটা আমাদের জঙ্গল। এখানে কাজ চলতে পারে না।”

লোকজন প্রথমে হেসে ফেলে। “তুই কে রে? ছোট্ট একটা মেয়ে এসে আমাদের কাজ থামাবে?” মেঘমালা বুক সোজা করে দাঁড়ায়, “আমি এই গ্রামের মানুষ, আর এই গাছগুলোও আমাদের মতোই জীবন্ত। আপনারা চাইলে আমাদের ওপর দিয়েই বুলডোজার চালান, কিন্তু আমরা সরে দাঁড়াব না।”

ততক্ষণে নয়ন ভিডিও করতে শুরু করেছে। কয়েকজন গ্রামবাসীও জড়ো হয়েছে। কেউ কেউ উৎসাহ দেয়, কেউ ভয় পায়। ঠিক সেই সময় এক স্থানীয় সাংবাদিক এসে পড়ে। তার ক্যামেরার ফ্ল্যাশ মেঘমালার চোখে পড়ে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেই ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে—“এক কিশোরীর লড়াই সবুজ রক্ষার জন্য।”

সন্ধ্যায় যখন তারা ফিরে আসে, তখন গাছ কাটা বন্ধ হয়েছে। সরকার পক্ষ থেকে জানানো হয়, আপাতত কাজ স্থগিত রাখা হবে, বিষয়টি নিয়ে আলোচনার দরকার আছে। মেঘমালা জানে, এটা পুরো জেতা নয়, কিন্তু প্রথম ধাপ তো পেরিয়ে গেছে। সে ভাবে, “সবুজকে বাঁচানো সহজ নয়, কিন্তু অসম্ভবও নয়।”

সে রাতে সে খালের পাড়ে বসে, বটগাছটার দিকে তাকিয়ে বলে, “আমি আছি তো। তোমাকে সহজে মরতে দেব না।” আকাশে তখন ধীরে ধীরে উঠছে পূর্ণিমার আলো, আর খালের জলে পড়ে ঝিলিক খেলে যাচ্ছে এক নতুন আশার।

নদীর নীচে আগুন

ঘুম ভাঙল হাঁসের ডাক আর মায়ের ব্যস্ত হাঁকডাকের শব্দে। কিন্তু আজ মেঘমালার মনে অন্যরকম উত্তেজনা। কালকের ঘটনাটা যেন এখনো তার রক্তে ঢেউ তোলে। পত্রিকায় ছবি এসেছে, যেখানে সে আর নয়ন হাতে হাত ধরে গাছের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। উপরে শিরোনাম—“এক কিশোরীর সবুজ যুদ্ধ।” ফোনে ফোনে খবর ছড়িয়ে পড়েছে—একটা কিশোরী গাছ বাঁচাতে বুলডোজারের সামনে দাঁড়িয়েছে।

স্কুলে ঢুকতেই সবাই তাকাচ্ছে মেঘমালার দিকে। কেউ প্রশংসা করছে, কেউ কটাক্ষ করছে। কেউ কেউ বলছে, “নেতাগিরি করতে এসেছে!” ক্লাসে ঢোকার সময় মাস্টারমশাই হাসতে হাসতে বলে, “তুমি তো এখন বিখ্যাত!” মেঘমালা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে, কিন্তু নয়নের কানে কানে বলে, “তুই দেখিস, এই বিখ্যাত হবার মানে আমি বদলাব।”

বিকেলে তারা আবার খালের ধারে মিলিত হয়—মুন্নি, বাদল, সুজাতা, তানিশা, শুভ। সবাই খুব উত্তেজিত, কিন্তু একটু দিশেহারা। মুন্নি বলে, “সরকার তো কেবল ‘স্থগিত’ বলেছে। কাল আবার শুরু করে দিলে?” শুভ বলে, “আমরা চেঁচিয়ে আর কতদিন থামাতে পারব?” মেঘমালা চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, “আমাদের পরিকল্পনা বদলাতে হবে। শুধু প্রতিবাদ নয়, প্রস্তাবও দিতে হবে।”

সে রাতে মেঘমালা তার বাবার পুরোনো ভূগোল বই আর খবরের কাগজ ঘেঁটে একটা প্রস্তাব তৈরি করে—একটা বিকল্প রাস্তার পরিকল্পনা। যাতে জঙ্গল বাঁচে, আবার রাস্তাও তৈরি হয়। পরদিন সকালে স্কুলে সে এই খসড়া নিয়ে যায় প্রধান শিক্ষকের কাছে। স্যার খুব অবাক হয়ে বলেন, “তুমি কী করে এসব জানলে?” মেঘমালা হাসে, “জানা না থাকলে চেষ্টা করি। আর চেষ্টা করতে করতেই তো পথ তৈরি হয়।”

স্যার তার খসড়াটা পড়ে খুশি হন। তিনি বলেন, “আমি তোমাদের পঞ্চায়েতে সুপারিশ করব, যাতে এই পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়।” সেইদিন বিকেলে স্কুলে একটা বিশেষ সভা হয়—গ্রামের প্রধান, পঞ্চায়েত সদস্য, শিক্ষক আর ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে। মেঘমালা দাঁড়িয়ে তার প্রস্তাব পেশ করে। তার কণ্ঠ কাঁপছে, কিন্তু চোখে ভয় নেই। সবাই মন দিয়ে শোনে। প্রধান মশাই একটু গম্ভীর মুখ করে বলেন, “তোমার পরিকল্পনাটা যৌক্তিক। কিন্তু সরকারি প্রকৌশলীদের সাথে আলোচনা করতে হবে।”

পরদিন, সরকারি প্রকৌশল দপ্তরের দু’জন আধিকারিক এসে জায়গাটা পরিদর্শন করেন। মেঘমালা তাদের সামনে পুরো বিষয়টা ব্যাখ্যা করে। নয়ন তখন পাশে দাঁড়িয়ে, সাহস জোগায়। মুন্নি খালপাড় দেখায়, যেখানে নতুন রাস্তা বাঁক নিলে গাছগুলো বেঁচে যেতে পারে। আধিকারিকরা মাথা নাড়েন, কেউ কেউ ছবিও তোলে।

সন্ধ্যায় মেঘমালা বাড়ি ফিরে দেখে বাড়ির উঠোনে অনেক লোক জড়ো হয়েছে। কেউ এসেছে ছবি তুলতে, কেউ সাক্ষাৎকার নিতে, কেউ শুধু দেখে যেতে। মেঘমালার মা প্রথমে ভীত, বলে, “এত কিছুর মধ্যে তুই কোথায় গিয়ে দাঁড়াবি মা?” কিন্তু বাবা পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, “এই বয়সেই যদি কেউ স্বপ্ন দেখে, তাকে থামানো যায় না।”

ঠিক তখনই ফোন আসে, যশোদা মাসিমার। তিনি গ্রামের প্রাক্তন প্রধান, বয়স পঁচাত্তর, কিন্তু আজও সাইকেলে চড়েন। বললেন, “তোর বাবাকে নিয়ে কাল আমার বাড়ি আয়। কথা আছে।” পরদিন তারা যায় যশোদা মাসিমার কাছে। তিনি বলেন, “তুই যেটা করছিস, সেটা শুধু গাছ বাঁচানো নয়—এটা ভবিষ্যৎ তৈরি করার কাজ। তোকে সাহায্য করতে চাই। গ্রামের প্রবীণদের নিয়ে আমি এক বৈঠক ডাকব।”

পরের তিন দিন ধরে সেই বৈঠক হয়—চা, মুড়ি, কথা আর আলোচনার মধ্য দিয়ে। মেঘমালা দেখে, যাদের সে ভাবত কিছুই বোঝে না, তারাও কত কথা জানে। কেউ বলেন, “আমার ছোটবেলায় এই জঙ্গলে হাতির পাল এসেছিল।” কেউ বলেন, “এই গাছের ছায়ায় আমার ছেলের জন্ম হয়েছিল।” এই স্মৃতিগুলোকে একত্র করে মেঘমালা তৈরি করে আরেকটা পরিকল্পনা—গ্রামের নিজস্ব ‘সবুজ ইতিহাস’ সংরক্ষণের উদ্যোগ।

এদিকে আবার এক অশনি সঙ্কেত আসে। এক রাতে নয়ন ফোন করে জানায়, “কেউ একজন গাছের গোড়ায় আগুন ধরিয়েছে।” মেঘমালা দৌড়ে যায়। দেখে, দক্ষিণ দিকের একটা গাছের নিচে আগুন লেগে গিয়েছিল, তবে গ্রামবাসীরা মিলে নিভিয়ে দিয়েছে। তবুও, ভয় ঢুকে পড়ে সবার মনে। কে এমন কাজ করল?

শুভ বলে, “সবাই চায় না আমরা সফল হই।” মেঘমালা দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “তবে আমাদের ভয় পেতে হবে না। বরং আরও শক্ত হতে হবে।” সে সিদ্ধান্ত নেয়, প্রতি রাতে পাহারা দেবে ওর দল। প্রত্যেক রাতে দু’জন করে গিয়ে পাহারা দেবে, যাতে কেউ আর কিছু করতে না পারে।

মেঘমালার চোখে এখন ঘুম নেই, ক্লান্তি নেই। সে জানে, লড়াইটা দীর্ঘ, কিন্তু যদি হাতে হাত রেখে, পায়ের নিচে মাটি রেখে এগোতে পারে, তবে সবুজ রক্ষা শুধু স্বপ্ন নয়, বাস্তবও হতে পারে।

নামহীন যুদ্ধে

রাতের অন্ধকারে নদীর ধারে বসে নয়ন আর মেঘমালা চুপচাপ। মাথার উপর তারারা জ্বলছে, খালের জল শান্ত, কিন্তু তাদের মনে ঝড়। আগুনের ঘটনার পর থেকে এক অদ্ভুত অস্থিরতা জমে আছে সবার ভিতর। মেঘমালা ফিসফিস করে বলে, “যারা জঙ্গল পুড়িয়ে দিতে চায়, তারা মানুষ নয়, তারা ভয়। আর ভয়কে রুখতে হলে ভয়কে চোখে চোখ রেখে দেখতে হয়।”

নয়ন বলে, “আমরা ছোট, মেঘমালা। যদি কেউ সত্যিই ক্ষতি করতে চায়?”
মেঘমালা ওর দিকে তাকায়, “তাই তো আমরা একসাথে আছি। একা হলে ভাঙা যেত, দল হলে লড়াই হয়।”

পরদিন সকালে তারা আরও কিছু বন্ধু জোগাড় করে। এবার শুধু স্কুলের বন্ধু নয়, গ্রামের চায়ের দোকানের ছেলে, মুদির দোকানের রাজু, এমনকি তানিশার দাদা—সকলেই হাত মেলায় ‘সবুজ রক্ষা কমিটি’র নতুন অভিযানে। তারা তিন ভাগে ভাগ হয়—একটা দল পোস্টার বানাবে, একটা দল পাহারা দেবে, আর একটা দল গ্রামের প্রবীণদের কাছ থেকে জঙ্গলের গল্প সংগ্রহ করবে।

শুরু হয় এক নামহীন যুদ্ধ। দপ্তরে দপ্তরে ছুটোছুটি, পঞ্চায়েত অফিসে আবেদন, স্কুলে আলোচনা সভা, আর প্রতিদিন বিকেলে গ্রামের হাটে একটি করে পরিবেশ সচেতনতার কর্মসূচি। তারা একটা ছোট্ট ব্যানার বানায়—‘জঙ্গল আমাদের প্রাণ’। প্রতিদিন সন্ধ্যায় তারা জঙ্গলের ধারে বসে গাছের নিচে গান গায়, কবিতা পড়ে, গল্প শোনায়—একটা সংস্কৃতির আবহ তৈরি করে।

তখনি শুরু হয় প্রতিবন্ধকতা। একদিন পোস্টার ছেঁড়া অবস্থায় পড়ে থাকে স্কুলের পাঁচিলের গায়ে। মুন্নি কাঁদতে কাঁদতে বলে, “এত কষ্ট করে বানিয়েছিলাম!” মেঘমালা তার হাত চেপে ধরে, “এটাই প্রমাণ আমরা কিছু একটা করছি। কেউ বিরোধিতা করছে মানে আমাদের পথটা ঠিক।”

তারপর একদিন পঞ্চায়েতের একজন সদস্য ডেকে বলে, “তুমি এইসব আন্দোলন থামাও। শহর থেকে এক বড় কোম্পানি এসে রাস্তার জন্য টাকা দিয়েছে। এখানে যত দেরি হবে, তত সমস্যা। ছোট মেয়ে হয়ে এসব জটিল ব্যাপারে ঢোকো না।”

মেঘমালা চুপ করে শোনে, কিন্তু বেরিয়ে এসে ভাবে—“যারা আমাকে থামাতে চায়, তারা জানে না আমি কার হয়ে লড়ছি। আমি লড়ছি গাছের জন্য, খালের জন্য, পাখিদের জন্য। আর ওরা কেবল টাকার জন্য।”

সে রাতে বাবার খাতায় মেঘমালা একটা চিঠি লিখে রাখে—“বাবা, যদি আমাকে কাল স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেয়, যদি কেউ ভয় দেখায়, তুমি পাশে থেকো। আমি থামব না।” বাবা সকালে পড়ে বলেন, “তুই থামলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। আমি তোর পিঠে হাত রাখব, যতক্ষণ তুই সামনে হাঁটবি।”

দু’দিন পর, জেলা থেকে এক পরিবেশ বিশেষজ্ঞ আসেন খবরে দেখে। তিনি স্কুলে আসেন, মেঘমালার সঙ্গে কথা বলেন, পুরো প্রক্রিয়াটা শোনেন। তারপর বলেন, “তোমাদের সাহস আমাকে বিস্মিত করেছে। কিন্তু শুধু প্রতিবাদ নয়, প্রমাণ দরকার। তুমি কি জঙ্গলের জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে কিছু সংগ্রহ করেছ?”

এই প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে মেঘমালা ঘাবড়ে যায়। কিন্তু ততক্ষণে নয়ন বলে বসে, “আমরা শুরু করেছিলাম ছবি তোলা, ভিডিও করা। আমাদের কাছে কিছু ফুটেজ আছে—পাখি, গাছ, ব্যাঙ, ঝোপ।” বিশেষজ্ঞ সেগুলো দেখে বলেন, “তোমরা যদি পরের এক সপ্তাহের মধ্যে একটা প্রতিবেদন তৈরি করতে পারো, আমি সেটা সরকারি পর্যায়ে পাঠাব। প্রকৃতির গুরুত্ব বুঝিয়ে উন্নয়নের বিকল্প ভাবনা সম্ভব।”

এবার শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়। সবাই মিলে দল গঠন করে তথ্য সংগ্রহে নামে—কে কোথায় কোন পাখি দেখে, কোন গাছে কী ফুল ফোটে, খালে কোন মাছের চিহ্ন পাওয়া যায়। কেউ লিখে, কেউ তোলে ছবি, কেউ বানায় ভিডিও। তারা স্কুলের লাইব্রেরি থেকে বই এনে পড়ে, গুগল ঘেঁটে গাছের বৈজ্ঞানিক নাম জানে।

মুন্নি খালের কচুরিপানার পাশে এক ধরণের সাদা বক দেখে, তার নাম হয়তো ‘স্নো ইগরেট’। শুভ বলে, “ওই যে পাথরের ফাঁকে একটা সবুজ ব্যাঙ আছে, ওর চোখে লাল রঙ, এটা দুর্লভ প্রজাতি হতে পারে।” তানিশা পুরোনো নোটবুকে লেখে, “এই জঙ্গলে ৩৫ প্রজাতির গাছ, ১৪ প্রজাতির পাখি, ৬ রকম ব্যাঙ দেখা গেছে। আমাদের কাছে এই জঙ্গল শুধু গাছ নয়, একটা বাসস্থান, একটা ইতিহাস।”

মেঘমালা পুরো ডেটা গুছিয়ে একটা হাতেখড়ি প্রতিবেদন তৈরি করে—‘সবুজডাঙা জঙ্গলের প্রাণভাণ্ডার’। সেই প্রতিবেদন তিন কপি করে প্রিন্ট করে বিশেষজ্ঞের হাতে দেয়। তিনি হাসেন, বলেন, “তোমরা শুধু লড়াকু নও, বুদ্ধিমানও।”

মেঘমালার হাতে তখন আর স্লোগান নেই, আছে তথ্য, প্রমাণ আর ভালবাসা। তার চোখে ভয়ের চিহ্ন নেই, শুধু প্রতিজ্ঞা—এই নামহীন যুদ্ধ সে চালিয়ে যাবে, যতক্ষণ না শেষ গাছটিও নিরাপদ হয়।

প্রতিবাদের পাঠশালা

সবুজডাঙার সকালগুলো বদলে গেছে। আগে যেখানে মুরগির ডাক, বাজারের হাঁকডাক, আর খালের পাশের কুয়াশা ছাওয়া নিস্তব্ধতা ছিল—এখন সেখানে ছোট ছোট জটলা, কিশোরদের আলোচনা, আর নতুন নতুন পোস্টার লেখার ব্যস্ততা। মেঘমালাদের সেই ছোট্ট দল এখন স্কুলে এক নবীন শক্তি। শিক্ষকরা ক্লাসে পরিবেশ বিষয়ক প্রশ্ন করলে, প্রায় সবাই মেঘমালার দিকে তাকায়।

আজ স্কুলে বিশেষ পরিবেশ সভা ডাকা হয়েছে। জেলা শিক্ষা আধিকারিক এসেছেন মেঘমালার প্রতিবেদন দেখে। তিনি মেঘমালাকে দাঁড়াতে বলেন। মেঘমালা একটু অপ্রস্তুত, কিন্তু নয়নের চোখের ইশারায় ভরসা পায়।

সে বলে, “আমরা গাছ ভালোবাসি কারণ ওরা আমাদের কথা না বলেও বোঝে। আমরা এই জঙ্গলকে শুধুই গাছের দল বলে ভাবি না, এ আমাদের বন্ধু, আশ্রয়, জীবন। আমরা রাস্তাও চাই, কিন্তু এমন রাস্তা যা গাছ কেটে নয়, গাছ বাঁচিয়ে চলে।”
সভায় সবাই চুপ। এক ধরনের গর্ব আর বিস্ময়ের মিশ্রণ ছড়িয়ে পড়ে। জেলা আধিকারিক বলেন, “তোমাদের মতো ছাত্ররা যদি দেশের হাল ধরে, তাহলে ভবিষ্যৎ এখনও উজ্জ্বল।”

সেই সভার পর, স্কুলে ‘প্রকৃতি ক্লাব’ তৈরি হয়। মেঘমালাকে করে দেওয়া হয় ক্লাব ক্যাপ্টেন। তার দায়িত্ব—পরিবেশ রক্ষা নিয়ে স্কুলজুড়ে সচেতনতা ছড়ানো, প্রজেক্ট তৈরি, বার্ষিক বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পরিচালনা করা। নয়ন সহকারী হয়, আর মুন্নির দায়িত্ব পোস্টার ডিজাইন।

কিন্তু যতই তাদের স্বপ্ন মজবুত হয়, ততই ছায়ার মতো এসে পড়ে কিছু অচেনা প্রতিবন্ধকতা। একদিন ক্লাব ঘরের বাইরে একটা পিচ্ছিল চিরকুট পড়ে থাকে—“সবুজ দিয়ে জীবন চলে না। সরে দাঁড়াও।” কেউ জানে না কে দিয়েছে, কেউ কিছু দেখেনি। তানিশা ভয় পায়। বলে, “আমরা যদি বিপদে পড়ি?” মেঘমালা ভাবে না। তার চোখে এখন থেমে যাওয়ার জায়গা নেই।

পরদিন তারা নতুন একটি পরিকল্পনা নেয়—‘প্রতিবাদের পাঠশালা’। স্কুল শেষে খালের ধারে বসে, তারা পরিবেশ রক্ষার ছোট ছোট পাঠ তৈরি করে—ছড়া, গান, ছোট নাটক। মুন্নি লেখে, “এক গাছ কাটলে, তিনটে লাগাও / প্রকৃতিকে বন্ধু বানাও।” নয়ন বাঁশি বাজায়, তানিশা নাটকের কল্পনা করে।

এই সবকিছু শুধু ছাত্রদের নয়, গ্রামবাসীদের মধ্যেও আলোড়ন তোলে। সন্ধ্যায় হাটে, কেউ বলে, “ওই মেঘমালার দলের ছেলেমেয়েরা নাটক করছে আজ।” ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এসে বসে যায় খালের ধারে। কেউ হাততালি দেয়, কেউ বলে, “আবার হবে তো কাল?”

মেঘমালার বাবা বলেন, “তুই শুধু গাছ বাঁচাচ্ছিস না, তুই মানুষের ভিতরের স্বর বাঁচাচ্ছিস।” মা চুপ করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে মেয়ের কপালে চুমু খায়—এই প্রথম, নির্দ্বিধায়।

তখন একদিন এল সেই চিঠি। জেলা পরিষদ থেকে সরকারি অনুমোদন—“সবুজডাঙা রাস্তা পুনরায় পরিকল্পিত হবে, জঙ্গল বাঁচিয়ে নতুন রুটের চিন্তা চলছে।” স্কুলে ঘোষণা করা হয়, “মেঘমালা বসাক ও তার সহপাঠীরা জেলাভিত্তিক পরিবেশ সম্মাননা পাচ্ছে।”

সেদিন সবাই মেঘমালাকে ঘিরে ধরে। কিন্তু সে হেসে বলে, “আমি একা কিছুই করিনি। আমরা একসাথে ছিলাম বলেই পেরেছি।”
নয়ন বলে, “আমরা যদি এতদূর আসতে পারি, তাহলে আরও কত কিছু করা যায়!”

তখন থেকেই তারা ‘প্রতিবাদের পাঠশালা’ বড় করতে শুরু করে। শুধু সবুজডাঙা নয়, আশপাশের পাঁচটা স্কুলে তারা পরিবেশ শিক্ষা নিয়ে যায়। ‘সবুজ রক্ষা ক্লাব’ নামে এক ছোট ম্যাগাজিন ছাপে, যেখানে শিশুদের লেখা, ছবি, গবেষণা ছাপা হয়। এক শিক্ষক বলেন, “এ যেন নতুন এক মুক্তিযুদ্ধ। কলম আর পাতা দিয়ে চলে যেই যুদ্ধ।”

কিন্তু লড়াই এখনও শেষ হয়নি। যেসব কোম্পানি রাস্তায় টাকা দিতে চেয়েছিল, তারা এখন অন্যভাবে প্রবেশের চেষ্টা করছে। একদিন এক চেনা সাংবাদিক বলে যায়, “বেশ কিছু লোক চায় তোমার মুখ বন্ধ হোক। সাবধানে থেকো।”

মেঘমালা ভাবে, “আমার মুখ বন্ধ হলেও, এখন আর কণ্ঠ থামবে না। কারণ এই লড়াই কেবল মেঘমালার নয়, এখন এ এক সমবেত কণ্ঠের সুর।”

সেদিন সন্ধ্যায় তারা আবার বসে খালের ধারে। বাতাসে পেঁপে গাছের গন্ধ, দূরে একটা শালিক ডেকে উঠছে। নয়ন বলে, “আজ আর ভয় করে না, জানিস?” মেঘমালা তাকায়, বলে, “কারণ আমরা জানি, এই খাল, এই গাছ, এই মাটি আমাদের পাশে আছে।”

আকাশে চাঁদ উঠেছে। জলের প্রতিফলনে তা যেন একটা আশীর্বাদ হয়ে নামে। আর মেঘমালা জানে, এখন যে যুদ্ধটা শুরু হয়েছে, তার জেতা শুধু সময়ের অপেক্ষা।

শালগাছের নিচে শপথ

জেলার সম্মাননা পাওয়ার পর সবুজডাঙা যেন নতুন পরিচয়ে জেগে ওঠে। পত্রিকায় আসে ছবি—“সবুজ রক্ষা ক্লাবের নেতৃত্বে নতুন রাস্তার পরিকল্পনা।” টেলিভিশনেও এক ঝলক ফুটে ওঠে মেঘমালার মুখ। কেউ কেউ বলে, “এই মেয়েটা হয়তো একদিন বড় কিছু করবে।” কিন্তু মেঘমালা জানে, এই সম্মান যুদ্ধের একটা খণ্ড মাত্র, গন্তব্য নয়।

যেদিন সম্মাননা দেওয়া হয়, সেদিন সন্ধ্যায় তারা সবাই মিলে খালের ধারে সেই পুরোনো শালগাছটার নিচে দাঁড়ায়। বাতাসে শালপাতার খসখসে শব্দ, চারপাশে নিস্তব্ধতা। মেঘমালা হাতে ধরে একটা নতুন পোস্টার, যেখানে লেখা—“শুধু প্রতিবাদ নয়, প্রতিশ্রুতি।” সে বলে, “আজ আমরা সবাই একসাথে শপথ নিই—যে যেখানেই থাকি, যেখানেই যাই, প্রকৃতির বন্ধু হয়ে থাকব।”

সেই রাতে তারা হাতে হাতে মোমবাতি জ্বালে। প্রত্যেকের চোখে জ্বলজ্বলে আলো, যেন অন্ধকার আর ভয়—দুটোই দূরে সরে যায়। নয়ন বলে, “তোর কথায় প্রথমে হাসি পেয়েছিল, এখন মনে হয়—এই আলো শুধু এই মোমের নয়, এই আলোর নাম সাহস।”

পরের দিন থেকে শুরু হয় প্রকৃতি পাঠশালার নতুন রূপ। তারা শুধু জঙ্গল রক্ষার গল্প নয়, জৈবচাষ শেখায়, জল সংরক্ষণের পদ্ধতি শেখায়, খালের ধারে আবর্জনা পরিষ্কারের অভিযান চালায়। তারা গ্রামবাসীদের বোঝায়, রাস্তা আর প্রকৃতি একে অপরের শত্রু নয়—যদি আমরা পরিকল্পনা করি সম্মানের সঙ্গে।

একদিন এক মজার ঘটনা ঘটে। স্কুলের খেলার মাঠে সবুজ রক্ষা ক্লাব এক নতুন সদস্য পায়—একটা কচ্ছপ। কেউ জানে না ও কোথা থেকে এসেছে, কিন্তু ওদের নাটকের রিহার্সালের মাঝেই হেঁটে এসে বসে পড়ে স্টেজের সামনে। মেঘমালা হেসে বলে, “এই তো আমাদের প্রকৃতি পাঠশালার প্রথম অতিথি!” তারা কচ্ছপটার নাম দেয়—‘সবুজু’। ওরা তাকে খালের কাছে একটা ছোট্ট জায়গায় রাখে, খাবার দেয়, পানি দেয়। সেই কচ্ছপ হয়ে ওঠে তাদের প্রতীক।

এদিকে সরকারি প্রকৌশলীরা মেঘমালাদের প্রস্তাব মেনে নতুন রুট চূড়ান্ত করে। বড় কোম্পানিটি কিছুটা বিরক্ত হলেও জেলা প্রশাসনের সমর্থনে আর কিছুর চেষ্টা করে না। গ্রামবাসীরা ধীরে ধীরে বিশ্বাস করতে শেখে—ছোটরাও অনেক কিছু বদলে দিতে পারে।

তখনই আসে আরেক প্রস্তাব—শহরের এক পরিবেশ বিষয়ক কনফারেন্সে মেঘমালাকে বক্তা হিসেবে ডাক দেওয়া হয়। প্রথমে সে রাজি হয় না। বলে, “আমি তো শুধু আমার গ্রামের কথা বলেছি।” কিন্তু নয়ন বলে, “তুই যা করেছিস, সেটা অনেক বড়। তোর গল্প শুনলে অন্যরাও সাহস পাবে।”

বাবা নতুন পাঞ্জাবি এনে দেয়, মা চুলে খোঁপা করে দেয়, মুন্নি আর তানিশা মিলে একটা প্রেজেন্টেশন বানায়। সেই অনুষ্ঠানে যখন মেঘমালা মাইক হাতে নেয়, তখন তার গলা একটু কাঁপে। কিন্তু প্রথম বাক্যেই সে বলে, “আমি কোন বিশেষজ্ঞ নই। আমি শুধু একজন মেয়ে, যে নিজের জঙ্গলটাকে ভালোবেসেছিল।” তারপর সে পুরো গল্পটা বলে—কীভাবে তারা লড়েছে, কীভাবে ভয় এসেছে, আবার সেই ভয়কেই সাহসে রূপ দিয়েছে।

মঞ্চের সামনে বসা শহরের বড় বড় মানুষরা অবাক হয়ে শোনে। কেউ চুপচাপ মাথা নাড়ে, কেউ চোখ মুছে। শেষে সবাই দাঁড়িয়ে উঠে হাততালি দেয়। একজন পরিবেশবিদ এগিয়ে এসে বলে, “তোমার নাম মনে রাখবে মানুষ। কিন্তু তোমার সাহস—ওটা একেকটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ুক, এটাই চাই।”

ফিরে এসে মেঘমালা চুপ করে খালের পাশে বসে থাকে। নয়ন পাশে এসে বসে বলে, “কি হলো, চুপ করে আছিস কেন?”
মেঘমালা বলে, “মনে হচ্ছে যেন একটা বড় ঢেউ পেরিয়ে এলাম। কিন্তু জানি, সামনে আরও স্রোত আছে।”

তখনই, হঠাৎ খালের পাড় দিয়ে হেঁটে আসে এক অচেনা লোক। লম্বা দাড়ি, কাঁধে একটা থলি। সে হাসে, বলে, “তুমি কি মেঘমালা? তোমাদের গল্প শুনে এলাম। আমি পাহাড় থেকে এসেছি। আমাদের গ্রামেও একটা ছোট জঙ্গল আছে, যেটা রক্ষা করতে চাইছি। তোমার সাহায্য লাগবে।”

মেঘমালা তাকিয়ে থাকে তার চোখে। দেখে সেখানে সেই একই আগুন, যা তার নিজের চোখেও ছিল কিছুদিন আগে। সে বলে, “তোমাদের জন্যও একটা শালগাছের নিচে শপথ তৈরি করতে হবে। আমি সাহায্য করব।”

নয়ন বলে, “তোর গল্প তো শুধু সবুজডাঙায় থেমে থাকল না, রে। এখন তো শুরু হল প্রকৃতির এক নতুন বাঁচার গল্প।”
আর মেঘমালা মনে মনে ভাবে—শালপাতা যেমন মাটি ছুঁয়ে নতুন পাতা হয়, তেমনি হয়তো তার কথাও ছড়িয়ে যাবে অন্য অন্য সবুজের ভিতর।

পায়ের নিচে পথ

জুন মাসের ভ্যাপসা গরমেও সবুজডাঙার খালে যেন একটা শীতল বাতাস বইছে। রাস্তার নতুন পরিকল্পনার কাজ শুরু হয়েছে, জঙ্গল বেঁচে গেছে, আর গ্রামজুড়ে মেঘমালাদের কথা এখন শুধু গর্ব নয়—অনুপ্রেরণাও। স্কুলের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বলে, “আমরাও মেঘদিদির মতো হব!” মুন্নি হেসে বলে, “তাদের জন্য তোকে আরও কিছু করে দেখাতে হবে।”

মেঘমালা জানে, একটা জঙ্গল বাঁচানো মানেই পরিবেশ রক্ষা শেষ নয়। সে চায়, গাছ শুধু খালপাড়ে নয়, উঠোনে উঠোনে জন্মাক। সে চায়, যে শিশুরা আজ মাঠে ছুটছে, তাদের মনেও রোপিত হোক সবুজের বীজ। তাই তারা এবার নতুন উদ্যোগ নেয়—‘আমার গাছ, আমার বন্ধু’। প্রতিটি বাড়ির শিশুদের একটা করে চারাগাছ দেওয়া হবে, তারা সেই গাছের নাম দেবে, জল দেবে, যত্ন নেবে, আর গাছ বড় হলে তাদের নিজস্ব ছোট্ট উদ্যান গড়ে উঠবে।

তানিশা আর বাদল এক সপ্তাহ ধরে নার্সারি ঘুরে চারা সংগ্রহ করে। মেঘমালার বাবা নিজের জমিতে জায়গা করে দেন যেখানে গাছগুলো রাখা হয়, আর মুন্নি নিজের খরচের পয়সা বাঁচিয়ে চারার জন্য নতুন পাত্র কেনে। স্কুলে একদিন উৎসবের মতো অনুষ্ঠান হয়—গাছ বিতরণ উৎসব। প্রধান অতিথি হিসাবে আসেন সেই জেলা পরিবেশ আধিকারিক।

মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, “মেঘমালা আর ওর বন্ধুরা শুধু গাছ বাঁচায়নি, ওরা শিক্ষা দিয়েছে কীভাবে গাছ ভালোবাসতে হয়।”
নয়ন তার ডায়েরিতে লেখে, “আজ আমাদের ক্লাব শুধু ক্লাব নয়, এটা একটা আন্দোলন—নীরব, শান্ত, কিন্তু দৃঢ়।”

একদিন সন্ধ্যায় মেঘমালা খালের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দেখে, সবুজু কচ্ছপটা হাঁটছে, ধীরে ধীরে, কিন্তু নির্ভুল পথে। হঠাৎ তার মনে হয়, সবুজুর হাঁটাতেই হয়তো প্রকৃতির আসল পাঠ আছে—তাড়াহুড়ো নয়, বরং প্রতিটি পদক্ষেপে স্থিরতা আর নির্ভরতা। সে ভাবে, “তাই তো আমাদেরও পায়ের নিচে পথ তৈরি হচ্ছে। যত হাঁটি, তত পথ জন্মায়।”

তাদের উদ্যোগ এবার আশেপাশের গ্রামের নজর কাড়ে। একদিন কল্যাণপুর গ্রাম থেকে একদল ছাত্রছাত্রী আসে সবুজডাঙায়, মেঘমালার সঙ্গে দেখা করতে। তাদের সঙ্গেও একটি জঙ্গলের গল্প আছে, যা তারা বাঁচাতে চায়। মেঘমালা তাদের খালের ধারে বসিয়ে বলে, “তোমরা যদি সত্যি ভালোবাসো সেই জায়গাটাকে, তবে তার জন্য লড়তে ভয় পাবে না।”

তারা খাতায় কল্যাণপুর জঙ্গলের মানচিত্র আঁকে, গাছের ধরন লিখে, প্রাণীর নাম তালিকাভুক্ত করে। তানিশা তাদের শেখায় কীভাবে ভিডিও করতে হয়, মুন্নি তাদের দেয়াল লিখন শেখায়। সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই মেঘমালার ক্লাব হয়ে ওঠে এক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, এক ধরনের চলন্ত পাঠশালা।

কিন্তু এই ছড়িয়ে পড়া আলো দেখতে পায় কেউ কেউ, যারা অন্ধকারেই থাকতে চায়। এক রাতে, খালের ধারে লাগানো নতুন চারাগাছগুলোর কয়েকটা উপড়ে ফেলা হয়। নয়ন খবর দেয় ভোরবেলায়, মেঘমালা ছুটে যায়। দাঁড়িয়ে দেখে, কয়েকটা ছোট নিম আর আমগাছ মাটির বাইরে পড়ে আছে, শেকড় ছেঁড়া। মুন্নির চোখে জল, বলে, “ওরা আবার কেন?”
মেঘমালা ধীরে ধীরে গাছগুলো কুড়িয়ে তোলে। বলে, “কারণ আলো ছড়ালে অন্ধকার ভয় পায়। আর ভয় পেলে হামলা করে। কিন্তু আলো থামে না, থামতে নেই।”

সেইদিনই তারা নতুন করে গাছগুলো লাগায়। চারপাশে বেড়া দেয়, নামের সাইনবোর্ড দেয়। আর পাশে একটা নতুন বোর্ড বসানো হয়—“একটা গাছ উপড়ে ফেললে, আমরা দুটো গাছ লাগাব।”
গ্রামের মানুষ এসে দেখে, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ মাথা নাড়ে, কেউ পাশে এসে মাটি খুঁড়ে সাহায্য করে।

সেদিন রাতে নয়ন বলে, “তুই জানিস? তোর এই জেদটাই আমাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র।”
মেঘমালা হেসে বলে, “না রে, জেদ না। এটা ভালোবাসা। যে ভালোবাসে, সে সহজে ছাড়ে না।”

পরের সপ্তাহে, জেলা প্রশাসন নতুন এক সার্কুলার দেয়—প্রত্যেক স্কুলে ‘সবুজ রক্ষা ক্লাব’ গঠনের পরামর্শ। শিক্ষকেরা প্রশিক্ষণ নিতে আসে সবুজডাঙা স্কুলে। মেঘমালা তাদের হাতে তুলে দেয় ‘প্রকৃতি পাঠ’—তাদের ক্লাবের নিজস্ব লিফলেট, যেখানে গাছ চেনার নিয়ম, প্রাকৃতিক সংকেত বোঝার উপায়, আর পরিবেশ আন্দোলনের কৌশল লেখা।

নয়ন বলে, “তোর লেখা এখন সরকারি নথি হয়ে যাচ্ছে, ভাবতে পারিস?”
মেঘমালা জানে, গাছ বাঁচানো মানেই শুধু প্রকৃতি রক্ষা নয়—এটা আত্মরক্ষা, ভবিষ্যতের পক্ষে দাঁড়ানো। তাই সে চায়, প্রতিটি পদক্ষেপে জন্ম নিক একটা নতুন পথ।

খালের পাড়ে দাঁড়িয়ে সে ভাবে, “আমরা তো শুধু গাছ রক্ষা করিনি। আমরা আমাদের জীবনের ভিতরে একটা বিশ্বাস গড়ে তুলেছি—যেখানে পথ নেই, সেখানে হাঁটলে পথ তৈরি হয়।”
আর সেই পথ, সে জানে, কখনোই থেমে যাবে না।

মাটির গন্ধে লেখা চিঠি

শীতকাল এসে গেছে সবুজডাঙায়। খালের কুয়াশা ঘেরা সকাল, মাঠে শিশিরে ভেজা ঘাস, আর বাতাসে একটা নরম নিস্তব্ধতা। অথচ মেঘমালার মন আজ বেশ অস্থির। কিছু একটা যেন ঘুরপাক খাচ্ছে তার ভেতরে।
সকালবেলা স্কুলে যেতেই সে দেখে, একটা বড় সাদা খাম পড়ে আছে তার ডেস্কে। খামের ওপরে লেখা: “শুধু তোমার জন্য, প্রকৃতির পক্ষ থেকে।” সে ভাবতে পারে না কে পাঠিয়েছে। খুলে দেখে, ভিতরে একটা ছোট কবিতা—

“যে গাছ তুমি বাঁচালে, সে একদিন ছায়া দেবে
যে মাটি তুমি আগলে রাখো, সে একদিন গল্প বলবে
আমরা শুনি তোমার পায়ের শব্দ,
আর বুঝি—মানুষ এখনও মানুষ আছে।”

নয়ন এসে দেখে বলে, “কে লিখেছে বল তো?”
মেঘমালা মাথা নাড়ায়। “জানি না, কিন্তু মনে হচ্ছে, এ চিঠি শুধু কাগজে নয়, মাটির গন্ধে লেখা।”

সেইদিন বিকেলে তারা গিয়ে বসে সেই পুরোনো বটগাছের নিচে। মুন্নি, তানিশা, বাদল—সবাই চুপচাপ। কারণ আজ তারা একটা নতুন খবর পেয়েছে। পঞ্চায়েত থেকে জানানো হয়েছে, পাশের গ্রাম বারান্দি পাথর কাটার জন্য তাদের ছোট পাহাড় ভাঙার অনুমতি পেয়েছে। আর সেই পাথরের রাস্তা যাবে খালপাড় ঘেঁষে।

মেঘমালার গলা শুকিয়ে যায়। “মানে আবার খালের ধারে কাজ হবে?” নয়ন বলে, “হ্যাঁ, আর সেটা যদি হয়, তাহলে খালের ঢালে থাকা পলাশগাছের দলটা যাবে আগে।”

তারা সিদ্ধান্ত নেয়—কালই বারান্দি যাবে, সেখানে গিয়ে গ্রামের সঙ্গে কথা বলবে। তারা ভাবে, হয়তো সেই গ্রামের মানুষ জানেই না এই প্রকল্পের প্রকৃতি-ধ্বংসের দিকটা।
পরদিন সকালে তারা সাতজন মিলে হেঁটে যায় বারান্দি। গ্রামটা সবুজডাঙার চেয়ে একটু বেশি শুষ্ক, মাটির রঙ ফ্যাকাসে। কিন্তু মানুষের চোখে আগ্রহ, অচেনা মুখ দেখে অনেকেই বেরিয়ে আসে। তারা স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলে গিয়ে প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে। তিনিই তাঁদের গ্রামের প্রবীণদের সামনে নিয়ে যান।

মেঘমালা দাঁড়িয়ে বলে, “আপনারা যে পাহাড় ভাঙার কথা শুনেছেন, সেটা শুধু রাস্তা নয়, সেটা মাটির শরীর চিরে ফেলার মতো। আমরা রাস্তা চাই, কিন্তু সেই রাস্তা যদি আমাদের জীবন কেড়ে নেয়, তবে সেটা উন্নয়ন নয়, ধ্বংস।”
একজন বয়স্ক কৃষক জিজ্ঞেস করেন, “তাহলে উপায়?”
মুন্নি এগিয়ে এসে বলে, “আপনারা পাহাড়ের পাশ দিয়ে নয়, গ্রামের চারপাশ দিয়ে বাঁকা পথ নিলে পাহাড়ও থাকবে, রাস্তাও হবে।”

তারা একটা ছোট মানচিত্র আঁকে মাটিতে। নয়ন সেখানে কাঠি দিয়ে দেখায় বিকল্প রুট, যেখানে পাথর ভাঙা লাগবে না। প্রবীণ কৃষকটি মাথা চুলকে বলেন, “বলো তো বাছা, এত কিছু তুমি শিখলে কোথায়?”
মেঘমালা হেসে বলে, “শিখিনি, ভালোবেসেছি। আর যে ভালোবাসে, সে পথ খুঁজে নেয়।”

সেই রাতেই পঞ্চায়েতের এক সদস্য আসে সবুজডাঙায়। তিনি বলেন, “তোমাদের প্রস্তাব শুনে বারান্দির মানুষ নিজেরাই চাইছে বিকল্প পথ। তারা আবেদন করছে আবার জরিপ করতে।”
মেঘমালার মুখে হাসি, কিন্তু চোখে চিন্তা। কারণ সে জানে, এসব উদ্যোগে অনেকের লাভ বন্ধ হয়ে যায়, আর তখনই আসে আসল বাধা।

তবে এবার তারা প্রস্তুত। তারা আর কেবল প্রতিবাদ করে না, তারা প্রমাণ দেয়, তারা প্রস্তাব দেয়, তারা বিকল্প গড়ে তোলে। তারা জানে—লড়াই মানে শুধু বাঁধা দেওয়া নয়, লড়াই মানে পথ দেখানো।

সেই রাতে আবার একটা চিঠি পায় মেঘমালা। এবার খামে শুধু একটা বাক্য—“তোমার কাছে মাটি কেবল জমি নয়, এ তো মা। ধন্যবাদ।”
নয়ন খামটা হাতে নিয়ে বলে, “তুই জানিস, কে পাঠাচ্ছে এসব?”
মেঘমালা চোখ বন্ধ করে বলে, “হয়তো জানি, হয়তো জানি না। কিন্তু যেই পাঠাক, তার মনেও সবুজের জন্য ভালোবাসা আছে। সেটাই বড় কথা।”

মেঘমালারা এরপর থেকে ঠিক করে, প্রতি মাসে একদিন তারা জঙ্গল, খাল, পাড়, রাস্তা—সব মিলিয়ে একটা ‘সবুজ পরিদর্শন দিবস’ পালন করবে। সেইদিন তারা কেবল দেখে না, শোনে—পাতার শব্দ, পাখির ডাকে জলস্রোতের আভাস, আর মাটির নরম নিঃশ্বাস।

মেঘমালার মনে হয়, তারা যেন প্রকৃতির ভাষা শিখে ফেলছে ধীরে ধীরে। আর সেই ভাষায় লেখা চিঠিগুলোর প্রতিটি অক্ষর হয়ে উঠছে তাদের পথের দিশা।

ঝড়ের রাত, বটগাছের ছায়া

গ্রীষ্ম শেষ হয়ে বর্ষা এসে গেছে সবুজডাঙায়। খাল উপচে জল উঠে এসেছে ধানখেত পর্যন্ত, বাতাসে কাঁচা মাটির গন্ধ। আকাশে প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় মেঘ জমে, আর হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি নামে। এই সময়টায় প্রকৃতি যেমন রূপবতী, তেমনই অস্থির।
সন্ধ্যায় মেঘমালা যখন পড়তে বসে, নয়ন ফোন করে। “খালের ওদিকে একটা গাছ পড়ে গেছে ঝড়ে। আমাদের লাগানো আমগাছটা, মনে আছে?” মেঘমালা আর কিছু না ভেবেই ছাতা হাতে বেরিয়ে পড়ে।

বৃষ্টি পড়ে টিপটিপ, কিন্তু পায়ের তলায় কাদা জমে সপাৎ শব্দ। খালের ধারায় গিয়ে দেখে, আমগাছটা সত্যিই উপড়ে গেছে। পাশেই পড়ে আছে ভাঙা বেড়া, কিছু কাদা লেগে যাওয়া চারাগাছ। মুন্নি বলে, “সব নষ্ট হয়ে গেল!”
মেঘমালা চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে, আমগাছটার গোড়া ছুঁয়ে বলে, “তুই পড়ে গেছিস, ঠিক আছে। কিন্তু তোর শিকড় এখনো আছে। আর যতদিন শিকড় থাকবে, নতুন চারা উঠবেই।”

ওর কণ্ঠে এমন এক স্থিরতা যে মুন্নি আর কিছু বলে না। সবাই মিলে গাছটা আবার তুলে মাটিতে বসিয়ে দেয়। বেড়াগুলো ঠিক করা হয়, পাশ থেকে পাতা কুড়িয়ে গাছের গোড়ায় বিছিয়ে দেওয়া হয় যাতে মাটি নরম থাকে।
নয়ন বলে, “এটা তো শুধু গাছ তোলা নয়। এটা যেন আমাদের নিজের একটা কিছু ফিরিয়ে আনা।”
মেঘমালা মাথা নাড়ে, “সবচেয়ে বড় যুদ্ধটাই হয় নীরবে, মাটির নিচে।”

সেই রাতেই বৃষ্টি আরও বেড়ে যায়। বিদ্যুৎ চলে যায়, বাড়ির বাইরে হাওয়ার তীব্র শব্দ। জানলার ফাঁক দিয়ে মেঘমালা দেখে, বটগাছটা যেন দুলছে—কিন্তু সে দাঁড়িয়ে আছে, দৃঢ়, গম্ভীর, মাথা উঁচু করে।
সে ভাবে, এই বটগাছটাকেই তো কেন্দ্র করে তাদের পুরো আন্দোলন শুরু। এখানেই প্রথম তারা দাঁড়িয়েছিল, প্রথমবার ‘সবুজ রক্ষা কমিটি’র নাম উচ্চারণ করেছিল।

পরদিন স্কুল বন্ধ হয়ে যায় অতিবৃষ্টির কারণে। কিন্তু দুপুর গড়িয়ে বিকেলে বৃষ্টি কিছুটা থেমে গেলে, তারা সবাই মিলে আবার খালের ধারে যায়। গাছগুলো পরীক্ষা করে, চারাগুলো দেখে। হঠাৎ বাদল বলে, “মেঘদিদি, ওই দেখো—সবুজু নেই!”

সবাই চমকে ওঠে। ছোট কচ্ছপটা, যাকে তারা মাসখানেক ধরে খালপাড়ে রেখেছিল, নেই কোথাও। আশেপাশে খোঁজ শুরু হয়। নয়ন বলে, “জলের তোড়ে চলে গেছে হয়তো!” মুন্নির গলা কেঁপে ওঠে, “সবুজুও চলে গেল?”

মেঘমালা একবার চুপ করে থাকে। তারপর খালের ধারায় বসে পড়ে, জলের দিকে চেয়ে বলে, “সবুজু কোথাও হারায়নি। সে এখন হয়তো নতুন কোথাও যাচ্ছে, নতুন খালের সন্ধানে। প্রকৃতিও তো একই কাজ করে—বয়ে চলে, থেমে থাকে না।”

তারা একমত হয়, সবুজুর জন্য একটা ছোট স্মৃতিফলক তৈরি করবে—একটা পাথরের টুকরোতে লেখা থাকবে, “একটি কচ্ছপ, যে আমাদের শিখিয়েছে ধৈর্য কাকে বলে।”

সেই সন্ধ্যায় তারা বটগাছের নিচে বসে। নয়ন বলে, “তুই জানিস, আগে আমি ভাবতাম গাছ তো চুপ করে থাকে। এখন মনে হয়, ওরাই সবচেয়ে বেশি কথা বলে।”
মেঘমালা বলে, “কারণ আমরা এখন ওদের ভাষা বুঝতে শিখেছি। ঝড় এলে মানুষ পালায়, গাছ থাকে। পাতা ঝরে, ডাল ভাঙে, কিন্তু গাছ দাঁড়িয়ে থাকে। আমি তাই গাছ হতে চাই।”

তখনই বাদল বলে, “আমরাও গাছ। আমাদের ডালও কেটেছে—কখনও কটূ কথা, কখনও ভয়, কখনও অভিমান। তাও তো আমরা দাঁড়িয়ে আছি, তাই না?”
মুন্নি মুচকি হেসে বলে, “আমরা ‘মানুষ-গাছ’।”

সেই রাতে আবার আসে একটা অচেনা চিঠি। diesmal সেটা রাখা খালপাড়ের সেই ছোট কুঁড়েঘরের জানালায়। মেঘমালা খুলে দেখে, ভিতরে শুধু একটি বাক্য—
“যে গাছ ঝড়ে পড়ে না, সে ঝড়ে শিখে দাঁড়াতে। তুমিও ঠিক তাই। চলতে থাকো।”

মেঘমালা জানে না কে এই চিঠির প্রেরক। হতে পারে কোনও স্থানীয় কেউ, হতে পারে দূরের কোনও মানুষ যিনি নাম রাখেননি, কণ্ঠ দেননি—শুধু লেখেন। কিন্তু প্রতিটি শব্দ যেন শক্তি জোগায়।

আর সেই রাতেই সে সিদ্ধান্ত নেয়—আগামী বর্ষায় শুধু সবুজডাঙা নয়, আশেপাশের দশটা গ্রামে তারা মিলিয়ে দশ হাজার চারা রোপণ করবে।
নয়ন বলে, “তুই পাগল হয়ে যাচ্ছিস?”
মেঘমালা হেসে বলে, “না, আমি শুধু গাছ হতে চাই। আর গাছের স্বপ্ন তো কখনোই ছোট হয় না।”

সবুজ যখন প্রতিজ্ঞা হয়

বর্ষা কাটিয়ে শীত ফিরে এসেছে সবুজডাঙায়, কিন্তু এবার শীতের সঙ্গে এসেছে এক অন্য উষ্ণতা। মেঘমালারা এখন গ্রামে শুধু কিশোর নয়, একেকটা পরিবর্তনের চিহ্ন। তারা যখন পুকুরপাড়ে দাঁড়ায়, মানুষ বলে, “ওরা তো গাছ লাগানোর দল।” কেউ খোঁজ নেয়, “তোমরা এবার কী করছো?” মেঘমালা হাসে, “সবুজে নতুন প্রতিজ্ঞা লিখছি।”

পরিকল্পনা শুরু হয় আগেই—দশটা গ্রামে দশ হাজার চারা। নয়ন পুরো লিস্ট তৈরি করেছে—কোথায় কোন প্রজাতির গাছ লাগানো যাবে, কোন এলাকায় কিসের চাহিদা বেশি। বাদল আর তানিশা সঙ্গে করে ছোট একটা মানচিত্র বানিয়েছে, যাতে স্পষ্ট বোঝা যায়—কোথায় কেমন মাটি, জল কতটা ধরে রাখে।

তাদের কাজটা আর শুধু শখের নয়, এখন এটা প্রক্রিয়া। তাদের সঙ্গী এখন শুধু স্কুলের বন্ধুরা নয়, এসেছে কৃষকের দল, গ্রামের আয়া, ক্লাবের সদস্য, এমনকি বৃদ্ধাশ্রমের কিছু প্রবীণরাও। তারা বলে, “এই গাছ যদি আমায় না ছায়া দেয়, তবুও লাগাব। কারণ এই ছায়া হয়তো কাউকে বাঁচাবে একদিন।”

বছরের শুরুতেই জেলা প্রশাসনের সহায়তা চাওয়া হয়। তারা মুগ্ধ হয়ে পুরো পরিকল্পনা দেখে ও কিছু চারা, শ্রমিক সহায়তা আর পরিবহন ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দেয়। জেলা অফিসার বলেন, “এই বয়সেই তোমরা একটা আন্দোলনকে প্রতিষ্ঠান করে তুলছো। এটা একদিন ইতিহাসে জায়গা পাবে।”

মেঘমালার বাবা রাতে খাতায় লেখেন, “আমার মেয়ে শুধু গাছ লাগায় না, সে গড়ে তোলে ভবিষ্যৎ।” মা চুপচাপ ওর গায়ে চাদর দিয়ে দিয়ে বলে, “গাছের ছায়া যেন তোকে কোনোদিন না ফেলে।”

এদিকে, মেঘমালার চিঠিও আর একতরফা নেই। এবার সে উত্তরও পায়। সেই অচেনা চিঠির মানুষটি অবশেষে একদিন নিজের নাম লেখে—“অরণ্য, এক যাযাবর শিক্ষক।” সে লিখে, “তোমার গল্প শুনে আমি আমার স্কুলে বনভোজনের বদলে গাছরোপণের উৎসব চালু করেছি। এবার তোমাদের দেখা করতে চাই।”
মেঘমালা উত্তরে লেখে, “আমরা কারো ছাত্র নই, আবার কারো শিক্ষকও। আমরা শুধু শিখি গাছের কাছে, আর শেখাই যারা শোনে।” তারা ঠিক করে, চিঠি চালাচালির জন্য এক ছোট্ট প্রকৃতি পত্রিকা তৈরি করবে—নাম রাখবে “পাতার পত্র”।

গাছরোপণের দিন এসে যায়। মেঘমালারা পাঁচটা দলে ভাগ হয়। প্রতিটি দলে একজন শিক্ষক, একজন স্থানীয় প্রবীণ, আর পাঁচজন কিশোরকিশোরী। হাতে চারাগাছ, সাথে খুঁড়ি, জল, ও একরাশ উদ্দীপনা। সেইদিন আকাশ পরিষ্কার, যেন প্রকৃতিও চায় এই কাজ সফল হোক।

তারা চারা লাগায় কবরস্থানের পাশে, স্কুলের দেয়ালের গা ঘেঁষে, মাঠের কিনারায়, নদীর ধারে, এমনকি মন্দিরের পেছন দিকটায় যেখানে আগে কেউ খেয়ালই করত না।
মুন্নি বলে, “এই গাছগুলো বড় হলে হয়তো আমার মেয়ে একদিন এর নিচে দাঁড়াবে।”
নয়ন বলে, “তোর মেয়ের জন্য তো লাগাচ্ছিস, আমার ছেলের জন্যও একটা লাগা উচিত।” সবাই হেসে ওঠে, কিন্তু সেই হাসির ভেতরে এক গভীর প্রতিজ্ঞা মিশে থাকে।

দিনশেষে তারা যখন ফিরছে, পায়ে কাদা, হাতে ক্লান্তি, কিন্তু চোখে বিজয়ের জ্যোতি। পেছনে ফেলে আসা গাছগুলোর দিকে ফিরে তাকিয়ে মেঘমালা ভাবে, “এই তো আসল চিহ্ন। আমরা চলে যাব, কিন্তু গাছগুলো থাকবে। আর এটাই আমাদের পথচলার প্রকৃত প্রমাণ।”

সেই রাতেই অরণ্য নামের সেই অচেনা চিঠির মানুষটি আসে সবুজডাঙায়। লম্বা চুল, চোখে চশমা, কাঁধে ব্যাগ। সে বলে, “তোমাদের সঙ্গে একটু হাঁটতে চাই।”
মেঘমালা, নয়ন, মুন্নি আর তানিশা তাকে নিয়ে যায় বটগাছের নিচে। সেখানে সে বসে পড়ে, বলে, “আজ আমি শিখলাম—পরিবর্তন বয়স দেখে হয় না, চোখ দেখে হয়। আর তোমাদের চোখে আগুন আছে, কিন্তু সেই আগুন পোড়ায় না, আলো দেয়।”

তারা গল্প করে রাত অবধি। অরণ্য বলে, “তোমাদের এই গল্প যদি একদিন বই হয়, আমি চাই সেই বইয়ে কোনো নাম না থাকুক। শুধু লেখা থাকুক—‘গাছেরা জানে কারা ওদের বাঁচিয়েছিল।’”

মেঘমালা চুপচাপ আকাশের দিকে তাকায়। তার চোখে তখন আর কোনও সংশয় নেই। শুধুই প্রতিজ্ঞা।
সবুজের প্রতিজ্ঞা।

যেখানেই গাছ, সেখানেই গল্প

এক বছর পেরিয়ে গেছে। সবুজডাঙা এখন আর শুধুই একটা গ্রাম নয়—এ যেন একটা পথ, একটা আন্দোলনের নাম। খালের ধারে লাগানো গাছগুলো বড় হয়ে ছায়া দিয়েছে, স্কুলের পাশের বটগাছের নিচে নতুন বেঞ্চ বসেছে, আর পুকুরপাড়ে ‘প্রকৃতি পাঠশালা’র ছোট ঘরটা আজ ফুলে ফুলে ভরে আছে।

মেঘমালা আজ ক্লাস ইলেভেনে পড়ে। পড়াশোনার চাপ বেড়েছে, কিন্তু তার চোখে সেই একই দৃঢ়তা। সকালবেলায় স্কুলে যাবার আগে এখনও সে খালপাড় ঘুরে দেখে, গাছগুলো ঠিকঠাক আছে কি না। মুন্নি এখন শহরের কলেজে পড়লেও প্রতিমাসে একবার আসে ক্লাবের বৈঠকে। নয়ন, তানিশা আর বাদল মিলে এখন নতুন কিশোরদের হাতে দায়িত্ব তুলে দিয়েছে—“সবুজ রক্ষা কমিটি” যেন শুধু একটি সময়ের সংগঠন না হয়ে, এক চলমান উত্তরাধিকার হয়।

সেইদিন বিকেলে স্কুলে আয়োজন হয় এক বিশেষ অনুষ্ঠানের—‘এক বছর পূর্তি’ সবুজ আন্দোলনের। মেঘমালার হাতে দেওয়া হয় একটি পদক আর একটি ফলক, যেখানে খোদাই করা—“একটি মেয়ে, যে গাছকে মানুষ ভাবতে শিখিয়েছে।”
সে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলে, “এই পদক শুধু আমার নয়। এটা সেই বটগাছের, যে দাঁড়িয়ে থেকেছে সব ঝড়ের রাতে। এটা সেই খালের, যে শোনে আমাদের প্রতিদিনের কান্না, হাসি আর গান। এটা সেই সব মানুষের, যারা থেমে যায়নি।”

সবাই দাঁড়িয়ে উঠে হাততালি দেয়। নয়ন পাশ থেকে বলে, “তুই একটা ইতিহাস লিখেছিস, জানিস?”
মেঘমালা হেসে বলে, “না রে। আমি কেবল একটা গল্প লিখেছি, যেটা গাছেরা চুপচাপ বলে।”

কিন্তু সে জানে, গল্প এখানেই থেমে যায় না।
কয়েকদিন পর এক খবরে চমকে ওঠে তারা—অরণ্য, সেই যাযাবর শিক্ষক, পাহাড়ি এক গ্রামে গাছ লাগাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছেন। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তিনি নাকি একটাই কথা বলছিলেন, “মেঘমালাকে বলো, গাছ যেন থামে না।”

মেঘমালা কাঁপতে কাঁপতে লেখে এক চিঠি—
“প্রিয় অরণ্যদা,
আপনি যদি না উঠতে পারেন, আমি দাঁড়াব। যদি না হাঁটতে পারেন, আমি এগোব। আপনার লাগানো চারা যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন আমরা আপনাকে মনে রাখব পাতায় পাতায়।”

এরপর সে সিদ্ধান্ত নেয়, “পাতার পত্র” নামের সেই পত্রিকাটাকে এখন সত্যিকারের ছাপার বই হিসেবে ছড়িয়ে দেবে। প্রথম সংস্করণে থাকবে অরণ্যদার স্মরণে লেখা কবিতা, মেঘমালার ডায়েরির পৃষ্ঠা, আর নতুন কিশোরদের চিঠি—যারা সবুজকে বন্ধু হিসেবে দেখেছে।

মুন্নি ডিজাইন করে কভার—একটা হাত, যার তালুতে শিকড় গজাচ্ছে। নয়ন লেখে সম্পাদকীয়—“এই কাগজের কালি সবুজ।”

পত্রিকাটি ছড়িয়ে পড়ে রাজ্যজুড়ে। কলকাতার এক পরিবেশমঞ্চ থেকে ফোন আসে—তারা ‘পাতার পত্র’-কে পুরস্কার দিতে চায়। মেঘমালা বলে, “পুরস্কার চাই না, চাই পঞ্চাশটা নতুন চারা, যা আমরা নতুন গ্রামে রোপণ করব।”
ওরা মুগ্ধ হয়ে চারা পাঠায়। আর সেই চারা নিয়ে শুরু হয় নতুন যাত্রা—এইবার লক্ষ্যমাত্রা: ‘একশো গ্রাম, এক লাখ গাছ’।

শেষ দৃশ্য—মেঘমালা খালের ধারে দাঁড়িয়ে, হাতে একটুকরো বীজ। পাশে নয়ন, তানিশা, বাদল, আর একটা নতুন প্রজন্ম—হাতে খুঁড়ি, পিঠে ব্যাগ, মুখে জেদ।
সে বীজটা মাটিতে পুঁতে বলে, “আজ না হয় আরেকটা গল্প শুরু হোক।”
আর সেই মাটির নিচে, চুপচাপ, একটা নতুন সবুজ ডাল উঁকি দেয়—যার নাম ইতিহাস নয়, আশা।

শেষ

1000024509.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *