ঋদ্ধিমা বসুরায়
পর্ব ১: সোমবার – দর্শন প্রেম
ইরা সেনের ঘড়িটা তখন সকাল আটটা বাজাচ্ছে। দক্ষিণ কলকাতার সেই পুরোনো বাড়ির ছাদে নীল রোদ, আর রেলিং জুড়ে বসে আছে কয়েকটা কাক। সে সিলিং ফ্যানের নিচে বসে হাতের কাপে শেষ চুমুকটা নিচ্ছিল, আর মনে মনে ভাবছিল, আজকের চরিত্রটা কে হবে?
সে জানে, প্রতিটা সোমবার তার হৃদয়ের দরজায় কড়া নাড়ে একজন—অর্ক।
অর্ক কোনো সাধারণ মানুষ নয়। অন্তত ইরার চোখে সে দর্শনের প্রতিমূর্তি।
তাঁর চোখে নিরাসক্তির ছায়া, ঠোঁটে আধা হাসি। সে ধূসর পাঞ্জাবি পরে ধীরে ধীরে হাঁটে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলে,
“জানো ইরা, অস্তিত্ব একটা চেনা ভুল। আমরা শুধু কল্পনায় আছি।”
ইরা চুপ করে শুনে। উত্তর দেয় না। সে জানে, অর্ক বাস্তবে নেই।
কিন্তু তবুও, সোমবার এলেই, এই মানুষটা তার সামনে এসে দাঁড়ায়।
অর্কের সাথে সে যায় গড়িয়াহাটের ফুটপাত ধরে হেঁটে—যেখানে বইওলা ছেলেটা কবিতা আর দর্শনের বই মিশিয়ে রাখে।
“তোমার মতো কেউ কি কোনোদিন ছিল?” ইরা জিজ্ঞেস করে।
অর্ক উত্তর দেয় না, শুধু বলে—“যে প্রেমকে প্রশ্ন করতে হয়, সে প্রেম নয়। সে এক আত্ম-সংলাপ।”
তারা দুপুর অবধি হাঁটে। কথা কম হয়, অনুভব বেশি।
কখনো অর্ক তার কাঁধে হাত রাখে, খুব স্বাভাবিকভাবে।
ইরা ভিজে যায় সেই স্পর্শে, যদিও জানে, সেই হাতটা ছুঁলে হয়তো কিছুই ছোঁয়া যাবে না।
রাতে সে লিখতে বসে। তার খাতা খুলে দেখে—সোমবার, অর্ক, দর্শন, ভালোবাসা, নিরাসক্তি—এই শব্দগুলোতে ভরে গেছে পাতা।
সে একটানা লিখে যায়—
“তোমার ভেতর একটা শূন্যতা আছে, যেটায় আমি ডুবে যেতে চাই। কিন্তু জানি, তুমি শুধুই কাগজের মানুষ।”
এতটুকু লিখেই হঠাৎ কলিং বেল বেজে ওঠে।
ইরা ঘড়ি দেখে—সন্ধ্যে সাতটা।
দরজা খুলে দেখে কেউ নেই। শুধু একটা চিরকুট পড়ে আছে দরজার সামনে।
সাদা কাগজে অর্কের হাতের লেখা:
“আমি আছি, কারণ তুমি লিখে ফেলেছো।”
ইরা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
তার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি।
সে জানে, কাল মঙ্গলবার। আর কাল আসবে নীল—ছবির প্রেমিক।
তবুও আজ সে অর্ককে ধরে রাখতে চায় আরও কিছুক্ষণ।
কিন্তু জানে, এই প্রেমগুলো প্রতিদিনের মতোই—আসে, থাকে, এবং মিলিয়ে যায় ঠিক সূর্যাস্তের মতো।
পর্ব ২: মঙ্গলবার – ক্যামেরার ফ্রেম
ইরা সেন ঘুম থেকে উঠে প্রথমে তাকায় দেয়ালে টাঙানো একটা ফটোফ্রেমের দিকে—পুরোনো সাদা-কালো ছবি, ছাদে দাঁড়িয়ে একজন যুবক ছবি তুলছে। ছেলেটার মুখ ঝাপসা, শুধু ক্যামেরাটা স্পষ্ট।
সে জানে, আজ মঙ্গলবার।
আজ নীল আসবে।
নীল—একজন ফটোগ্রাফার।
তাঁর চোখে আলো খেলা করে, আর ঠোঁটে থাকে একরাশ গোপন বিষণ্ণতা।
প্রতিদিন যারা ছবি তোলে, তারা কি নিজের ছবিটা তুলতে পারে?
এই প্রশ্নটা ইরা প্রথম দিনই করেছিল।
নীল শুধু হেসেছিল, “নিজেকে তো কেউ কখনো পুরোটা দেখতে পায় না, ইরা।”
আজ তারা দেখা করল বালিগঞ্জ লেকের ধারে।
নীলের কাঁধে ঝুলছে পুরোনো মিনোল্টা ক্যামেরা। ইরা একঘেয়েমি ভাঙতে একটা মেরুন শাড়ি পরে এসেছে, খোলা চুল, চোখে হালকা কাজল।
নীল ক্যামেরা তোলে, কিছু না বলেই ক্লিক করে।
“কি ছবি তুললে?”
“তোমার মুখে হালকা বিরক্তি। আর চোখে শূন্যতা।”
ইরা হাসে না। সে বুঝতে পারে, এই লোকটা চোখ দিয়ে ভেঙে ভেঙে ভালোবাসে। মুখে বলে না কিছুই।
চা খেতে খেতে নীল বলে, “ছবিগুলো নেগেটিভে ওঠে। তখন কালো-সাদা। কিন্তু প্রিন্ট করলে তবেই রঙ ধরা পড়ে।
তোমার ভেতরেও অনেক রঙ আছে, ইরা। তুমি শুধু নিজেকে প্রিন্ট করোনি।”
এই কথায় ইরার গলা শুকিয়ে আসে।
সে জানে, নীল একজন চরিত্র—তার নিজের কল্পনার গড়া।
কিন্তু এই চরিত্রটাই তার মনকে এত গভীরে ছুঁয়ে যায়, যেন সে বাস্তব।
তারা হাঁটে—নীল মাঝে মাঝে ছবি তোলে, কখনও পাখির, কখনও ইরার মুখের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া হাওয়ার।
হঠাৎ একটা ছবি তুলেই নীল চুপ করে যায়।
“কি হলে?”
“তোমার পাশে আজ আমি ছাড়া আর কেউ নেই। এটা অদ্ভুত। যেন এই জগতেই তুমি কল্পনা।”
ইরা হাসে—“তাহলে আমরা উলটো দিকে আছি, নীল। তুমি কল্পনায় বাস্তব, আমি বাস্তবে কল্পনা।”
রাতে ইরা খাতায় লিখে—
“তুমি যখন আমার ক্যামেরার সামনে দাঁড়াও, আমি চাই না তুমি স্পষ্ট হও। তোমার ঝাপসাতাই আমার প্রেম।”
কিন্তু লেখা শেষ করার আগেই সে দেখে, খাতার মধ্যে একটা প্রিন্টেড ছবি।
তার মুখ, চোখ বন্ধ, হাওয়ায় চুল উড়ছে।
কিন্তু ছবি তুলেছে কে?
নীল তো ছিল না।
নীল তো কোনোদিনই থাকে না।
পর্ব ৩: বুধবার – অর্থ ও অভাব
বুধবার মানেই বাস্তবতার দিন।
আজ আর রোমান্টিকতা নয়, আজ ইরার জীবনে আসবে রজত—একজন সফল ব্যাংকার।
রজতের মুখে সবসময় চাপা ক্লান্তি, চোখে কিছু হিসেবের রেখা।
সে বলে—“ভালোবাসা একটা ইনভেস্টমেন্ট, ইরা। রিটার্ন নিশ্চয় নয়, কিন্তু রিস্ক সবসময় থাকে।”
ইরা হাসে।
“তোমার চোখেও কি ইন্টারেস্ট রেট বসে থাকে?”
রজত তার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর উত্তর দেয়, “তোমার প্রেমে আমার রিটার্ন কম, কিন্তু রিস্ক অনেক বেশি। তবুও আমি বসেছি।”
আজ তারা দেখা করল ক্যাফে পাড়ায়—একটা কফিশপের কর্নারে।
রজতের পরনে নীল শার্ট, ধূসর টাই। খুব হিসেবী সাজ।
সে তার ল্যাপটপ খুলে দেখায় ইরাকে, “দেখো, স্টক মার্কেট আজ কী রকম খেল দেখাচ্ছে।”
ইরা চুপ করে চায়ে চুমুক দেয়।
সে বোঝে, এই প্রেম হিসেব বোঝে না, টাকার ভাষায় কথা বলে।
রজতের প্রতিটি কথা যেন কোনো ব্যালান্স শীটের মতো।
তবুও, সে যখন বলে,
“তুমি আসলে এক ‘ডেফিসিট’ রোমান্স, ইরা। যত ভালোবাসি, ততই খালি লাগে।”
ইরার বুক ধুকপুক করে ওঠে।
রজত একসময় বলে, “তুমি যদি আসল হতে, আমি তোমার জন্য একটা ফিক্সড ডিপোজিট খুলে রাখতাম।”
ইরা হেসে বলে, “তুমি যদি আসল হতে, আমি আমার সমস্ত শূন্যতা তোমার কাছে ঋণ রাখতাম।”
বিকেল গড়ায়। তারা আলাদা হয়ে যায়।
রজত যায় অফিস মিটিং-এ, আর ইরা ফিরে আসে তার ফাঁকা ঘরে।
রাতে খাতায় লিখে—
“তোমার মতো প্রেমিকদের নিয়ে লেখা কঠিন। কারণ তারা চায় নিরাপত্তা, আর আমি দিই অনিশ্চয়তা।”
কিন্তু লেখার মাঝখানে সে দেখে, খাতার ভাঁজে রাখা একটা পে স্লিপ।
Bank of Fiction – Employee ID: R2024, Name: Rajat Sen, Salary Credited: ₹ 0
ইরা স্তব্ধ।
সে জানে, রজত কেবলই তার কল্পনা।
তবুও সে এত নিখুঁতভাবে থেকে যায় তার জীবনে, যেন তাকে প্রতিদিন অফিস যেতে হয়।
সে জানে কাল বৃহস্পতিবার।
কাল আসবে রোহন—তার ফ্যান্টাসি ও উন্মাদনার প্রতিনিধি।
পর্ব ৪: বৃহস্পতিবার – কল্পনার রাজা
বৃহস্পতিবারের সকাল মানেই ইরার এক অন্যরকম উন্মাদনা।
কারণ আজ আসবে রোহন—কমিক বুক পাগল, সুপারহিরোর মতো কথা বলা, কিছুটা ছেলেমানুষ, কিছুটা দার্শনিক, আর পুরোপুরি কল্পনার সন্তান।
রোহনের প্রথম কথা ছিল,
“তুমি জানো, আমরা যারা ছোটবেলায় সুপারম্যান হতে চেয়েছিলাম, তারা বড় হয়ে খুব সাধারণ মানুষ হয়ে যাই। কিন্তু মনটা থেকে যায় লাল চাদরে মোড়া।”
আজ তারা দেখা করল কলেজ স্ট্রিটে—বুক গলির এক পুরোনো কমিক বিক্রেতার দোকানে।
রোহনের চোখ চকচক করছে, হাতে তুলে নেয় একটা পুরোনো Bengali Phantom কমিক্স।
“দেখো ইরা, এই ছবিটার মতো তোমার চোখ। একটু রহস্য, একটু শিকারি।”
ইরা হাসে, চুপচাপ রোহনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।
সে জানে, রোহনের সাথে সময় কাটানো মানেই বাস্তব ভুলে যাওয়া।
সে যখন বলে,
“তুমি জানো, প্রতিটা সুপারহিরোর একটা ট্র্যাজিক ব্যাকস্টোরি থাকে?”
ইরা ভাবে—তার নিজের ব্যাকস্টোরি কি রোহন জানে?
দু’জনে মিলে চা খেতে বসে। রোহন বলে,
“তুমি লেখো, আর আমি আঁকি। আমি চাই, একদিন তুমি আমার কমিক্সের নায়িকা হও। একটা পাতায় শুধু তোমার হাসি থাকুক, আর পাশে আমি—উল্টোদিকে তাকিয়ে।”
ইরা বলে, “তোমার চরিত্ররা সব ভেসে যায় রঙের ভেতর, রোহন। আমার কি জায়গা আছে তাদের মধ্যে?”
রোহন থামে না।
“তুমি এমন একটা নায়িকা, যাকে কেউ ছুঁতে পারে না। শুধু পেছন থেকে দেখে যায়।”
চা শেষ হয়। বিকেল নামে।
রোহন হঠাৎ ইরার হাত ধরে বলে,
“তুমি যদি কখনো হারিয়ে যাও, আমি তোমাকে একটা কমিক্স বানিয়ে খুঁজে নেব।”
রাতে ফিরে ইরা খাতায় লিখে—
“তুমি এক পেনসিল স্কেচ, আমি জলরঙে ধুয়ে যাচ্ছি। আমরা মিলি না—কারণ আমরা দুজনেই গল্প।”
তখনই সে খেয়াল করে, টেবিলের কোণে পড়ে আছে একটা স্কেচ।
তাতে ইরার মুখ—বুক গলির বইয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে, পেছনে ছায়ার মতো এক নায়ক।
রোহন কি রেখে গেছে এটা?
না কি ইরারই হাত থেকে বেরিয়েছে অজান্তেই?
সে জানে না।
তবে জানে—কাল শুক্রবার।
আর শুক্রবার মানেই তীর্থ—একটা পুরোনো প্রেমের ঠাণ্ডা শ্বাস।
পর্ব ৫: শুক্রবার – পুরোনো প্রতিধ্বনি
ইরার জীবনে শুক্রবারটা একটু ভারী।
এই দিনটাতে সে সাবধান থাকে, মনের ভেতরে একটা চাপা ব্যথা নিয়ে জেগে ওঠে।
কারণ আজ আসবে তীর্থ—একটা অসমাপ্ত প্রেম, একটা কখনো-না-বলা কথা, একটা অতীত যাকে সে নিজের থেকে মুছে ফেলতে পারেনি।
তীর্থ একসময় সত্যিই ছিল।
কলেজে তারা একসাথে ইংরেজি সাহিত্য পড়ত।
তীর্থর চোখে ছিল রবীন্দ্রনাথ, আর ঠোঁটে ছিল বিপ্লব।
সে বলত, “তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে ‘underlined’ বাক্য, ইরা। কিন্তু আমি কখনো তোমার পুরো অধ্যায় পড়া শেষ করতে পারিনি।”
তাদের মধ্যে একটা গভীর টান ছিল, কিন্তু সময়টা তাদের পক্ষে ছিল না।
তীর্থ চলে গিয়েছিল, দেশের বাইরে।
ইরা অনেক চিঠি লিখেছিল—কোনোটারই উত্তর আসেনি।
আজ, এত বছর পর, সে ফিরে আসে প্রতি শুক্রবার।
একইরকম গলায় বলে, “এই চায়ের দোকানটা এখনো আছে?”
ইরা বলে, “তুমি না থাকলেও, দোকানটা আছে। আমার অপেক্ষাটাও আছে।”
তারা বসে কিশোর কুমারের গান শুনে, অতীত নিয়ে কথা বলে।
তীর্থ হঠাৎ বলে,
“জানো, আমি আজও সেই শেষ চিঠিটার উত্তর লিখিনি। লেখা হয়ে গেছে, কিন্তু পাঠানো হয়নি। তুমি কি পড়তে চাও?”
ইরা মাথা নাড়ে।
“না তীর্থ। চিঠি যতদিন না আসে, ততদিন আশা থাকে। তুমি চিঠি এনেছো, মানে তুমি ফেরার মতো কিছু নিয়ে এসেছো। আমি সেটা নিতে পারবো না।”
তীর্থ চুপ করে যায়।
তার চোখে ভেসে ওঠে সেই কালের অপরাধবোধ, সেই মুহূর্তগুলো যা ইরা বয়ে নিয়ে বেড়ায়।
বিকেলে তারা একসাথে হাঁটে, যেমন কলেজের দিনগুলোতে হেঁটেছিল—কিন্তু তখন দু’জনের মাঝখানে ছিল স্পর্শ, আজ আছে দূরত্ব।
তীর্থ বলল, “তুমি কি এখনো লেখো?”
ইরা মৃদু হেসে বলল, “হ্যাঁ। তবে এখন আর উত্তর আশা করে লিখি না। শুধু ভুলে যাওয়ার জন্য লিখি।”
রাতে ইরা তার খাতায় লেখে—
“তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে ভারী চরিত্র। এতটাই ভারী যে, প্রতিবার লেখার সময় আমার হাত কাঁপে।”
ঠিক তখনই টেবিলের উপর পড়ে থাকা একটা পুরোনো খাম চোখে পড়ে তার।
ভেতরে তীর্থর হাতের লেখা—
“ইরা, হয়তো তোমার কোনো চিঠির উত্তর আমি দিতে পারিনি। তাই শেষবার লিখলাম—তোমাকে ভালোবাসি বলে, আজও।”
ইরা চুপ করে থাকে। জানে, এই চিঠি বাস্তব নয়।
তীর্থ এখনো দূরে, হয়তো অন্য কারও পাশে।
কিন্তু তার স্মৃতিটা প্রতিটি শুক্রবারে ফিরে আসে—গভীর, ঠান্ডা, আর শোকের মতো।
সে জানে, আগামীকাল শনিবার।
আর শনিবার মানেই কবির—সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রেমিক।
পর্ব ৬: শনিবার – অচেনা উত্তাপ
শনিবারের সকালটা একটু অন্যরকম। ইরা সেন নিজের আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে দেখে—চুলগুলো একটু খুলে রেখেছে আজ, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক, চোখে হালকা রূপালি কাজল। সে জানে, আজ কবির আসবে।
কবিরকে নিয়ে সে কখনো কারও সঙ্গে আলোচনা করেনি।
কারণ কবির ঠিক প্রেমিক নয়—সে এক আকর্ষণ, এক উত্তেজনা, এক বিপদ।
কবির কখনো ফোন করে না, মেসেজ পাঠায় না।
সে শুধু হাজির হয়ে যায়—অপ্রত্যাশিতভাবে, নিঃশব্দে।
আজ দুপুরে ইরা বসে ছিল তার জানালার ধারে।
হঠাৎ এক ছায়া পড়ে বারান্দায়।
কবির, হাতে একটা সিগারেট, চোখে রোদচশমা, গলায় গা-ছাড়া হাসি।
সে বলে, “আজ বাইরে নয়। তোমার ঘরেই আমার ঘর।”
ইরা চুপ করে থাকে। সে জানে কবির বাস্তব নয়, কিন্তু তার শরীর যেন তা মানতে চায় না।
কবির ঘরে ঢোকে, বেজে ওঠে কোনো পুরোনো আরবী গানের সুর, তার সঙ্গে তার শরীরের গন্ধ—এক ধরনের আদিমতা, যা যুক্তি ভুলিয়ে দেয়।
“তুমি জানো, তুমি আমাকে বানাও,” কবির বলে, “তবু আমি তোমায় নিয়ন্ত্রণ করি। এটা প্রেম নয়, এটা আগুন।”
ইরা চোখ বন্ধ করে, তার বুক ধড়ফড় করে ওঠে।
সে জানে, কবির স্পর্শ কখনো হয়নি, কিন্তু প্রতিবার কবির উপস্থিতি তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।
তারা বসে কিছু না বলে, নিঃশব্দে চোখে চোখ রাখে।
কবির হঠাৎ খুব কাছে এসে বলে,
“তুমি কি কখনো তোমার গল্পের কোনো চরিত্রের প্রেমে পড়েছো?”
ইরা ফিসফিস করে, “হ্যাঁ। কিন্তু সে বাস্তবে ছিল না। আর তুমিও তো না।”
কবির হেসে ওঠে, তার হাসিতে বিদ্যুৎ কাঁপে।
“তাহলে আমরা দুইটা ছায়া—একটা মেঘের নিচে, একটা খিদের ভেতর।”
বিকেলে কবির চলে যায়, কোনো শব্দ না করে।
তারপর ইরা আয়নায় দেখে নিজের ঠোঁটের কোণে লিপস্টিক লেগে গেছে—তবু স্পর্শের কোনো চিহ্ন নেই।
রাতে সে খাতায় লিখে—
“তোমার নাম আমি মুছে ফেলি প্রতিদিন, তবু তুমি প্রতিবার আরও গাঢ় হয়ে ফিরে আসো।”
ঠিক তখনই বাতাসে একটা গন্ধ ভেসে আসে—সিগারেটের।
ইরা উঠে দেখে বারান্দায় কেউ নেই।
তবে ছাইদানি ভরে গেছে।
সে জানে, কাল রবিবার।
কাল আসবে সাগ্নিক—সবচেয়ে নিঃশব্দ প্রেমিক, যাকে সে কোনোদিন ভালোবাসা বলতে পারেনি।
পর্ব ৭: রবিবার – নিঃশব্দ কবিতা
রবিবার সকালে ঘুম থেকে উঠে ইরা বুঝতে পারে—আজ তার শরীর খুব হালকা। মাথায় কোনো কথা নেই, চারপাশে একধরনের শান্তি।
আজ আর কেউ আসবে না বলে মনে হয়।
কিন্তু তখনই জানলার কাঁচে ধাক্কা দেয় হাওয়া, আর সেই হাওয়ার সঙ্গে চলে আসে এক অতিপরিচিত নিঃশব্দতা।
সাগ্নিক—প্রেমিক নয়, কবিতা।
সাগ্নিক কথা বলে না।
তাকে ইরা কোনোদিন তার লেখায় স্পষ্ট করে লেখেনি।
সে আসে শুধু রবিবারে, যখন শহর থেমে থাকে, যখন শব্দের দরকার পড়ে না।
সে এসে জানালার ধারে বসে থাকে, আর কাগজে শব্দ না লিখে শুধু দাগ কাটে।
ইরা আজ লিখতে বসে না।
সে চুপচাপ চা খায়, আর সাগ্নিকের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সাগ্নিক বলে না কিছুই, শুধু একটা খাতা এগিয়ে দেয়।
খাতাটা খুলে দেখে—সাদা পাতায় কিছুই লেখা নেই, শুধু ছায়ার মতো কালি ছড়িয়ে আছে।
তবু ইরার মনে হয়, সে সব পড়ে ফেলেছে।
“তোমার চুপ থাকা এত জোরে বাজে,” সে বলে, “যে আমি শুনতে পাই সব না বলা কথা।”
সাগ্নিক তার দিকে তাকায়।
তাঁর চোখে এমন এক দৃষ্টি—যেন সে চিরকাল ইরাকে চিনত, এমনকি তার জন্মের আগেই।
তারা কিছুক্ষণ একসাথে বসে থাকে।
কোনো গান নেই, কোনো ছোঁয়া নেই, কোনো রঙ নেই।
শুধু দুইটি নিঃশব্দ অস্তিত্ব—একটা কবিতা হয়ে ওঠার যাত্রায়।
সন্ধের আগে সাগ্নিক চলে যায়, কোনো বিদায় জানায় না।
ইরা জানে, সে প্রতি রবিবার ফিরে আসবে, যতদিন তার লেখা চলবে।
কিন্তু আজ তার ভেতরে একটা অদ্ভুত খালি জায়গা তৈরি হয়েছে।
রাতে খাতায় সে শুধু একটি লাইন লেখে—
“তুমি যে কথাগুলো বলো না, সেগুলোর মাঝেই আমি ভালোবাসি।”
তারপর সে চুপ করে থাকে অনেকক্ষণ।
তিন পাতার ওপর কিছুই লেখে না।
শুধু উপরে লিখে—
“শেষ পর্ব – লেখকের মৃত্যু, প্রেমের জন্ম”
কাল সোমবার।
আবার অর্ক আসবে।
কিন্তু কি হবে যখন এই চক্র বন্ধ হবে?
কখনও কি ইরার কল্পনার চরিত্ররা তার হাত ছেড়ে বেরিয়ে আসবে?
পর্ব ৮: লেখকের মৃত্যু, প্রেমের জন্ম
সোমবার সকালে ইরা সেন ঘুম ভেঙে চমকে ওঠে।
ঘড়ি আটটা পঁচিশ বাজে।
আজও সকালটা সেইরকমই, কাকের ডাক, ছাদের উপর রোদ, কাপে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চা।
কিন্তু আজ তার মনে হয় কিছু নেই।
আজ অর্ক আসবে না।
আজ কারো পায়ের শব্দ আসবে না সিঁড়ি বেয়ে।
সে খাতার দিকে তাকিয়ে থাকে।
সাদা পাতা।
আর সেই পাতার এক কোণায় ছায়া পড়ে থাকে, তার নিজের ছায়া নয়।
ইরা খাতা খুলে দেখে, গত সাতদিনে লেখা প্রতিটি চরিত্র—অর্ক, নীল, রজত, রোহন, তীর্থ, কবির, সাগ্নিক—সবাই একেকটা পরিচ্ছেদে বেঁচে আছে।
কিন্তু আজ তার কলম বন্ধ।
সে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজের চোখে চোখ রাখে।
“তুই কি প্রেমিকদের ভালোবাসিস, না শুধু কল্পনার মধ্যেই প্রেম খুঁজিস?”
নিজেকেই প্রশ্ন করে।
তারপর হঠাৎ কিছু মনে পড়ে।
টেবিলের এক কোনায় পড়ে থাকা ডায়েরিটা খুলে—যেটা সে এক বছর ধরে নাড়েনি।
ভেতরে একটা নাম লেখা—রুদ্র।
বাস্তবের রুদ্র।
যাকে সে সত্যিই ভালোবেসেছিল।
যে সত্যিই তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল।
তারপরের সব প্রেমিক—সাতজন—রুদ্রের একেকটা ছায়া হয়ে উঠেছিল।
অর্ক ছিল রুদ্রের স্থিরতা।
নীল তার শিল্পবোধ।
রজত বাস্তবতা।
রোহন কল্পনা।
তীর্থ অতীত।
কবির দেহ।
সাগ্নিক আত্মা।
সব মিলিয়ে গড়া হয়েছিল সেই একক পুরুষ, যাকে সে কল্পনায় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল।
তাকে ভুলে যেতে নয়, বরং লেখার মধ্যে ধরে রাখতে।
ইরা জানে, এবার সময় হয়েছে কলম থামানোর।
সে একটানা লিখে ফেলে শেষ লাইনটা—
“এই গল্প শেষ নয়। কারণ ভালোবাসা যদি কল্পনায় বাঁচে, তবে মৃত্যু নেই কোনো লেখকের—শুধু চরিত্র বদলায়।”
ঠিক তখন কলিং বেল বেজে ওঠে।
ইরা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
দরজা খুলে।
একজন লোক দাঁড়িয়ে। অচেনা নয়।
সাদা শার্ট, গলায় হালকা দাড়ি, চোখে একটা গভীরতা।
সে বলে, “আমি নিচের ফ্ল্যাটে উঠেছি কাল। শুনলাম আপনি লেখেন? আমি কিছু পড়তে চাই… যদি অনুমতি দেন।”
ইরার ঠোঁটে একচিলতে হাসি।
সে জানে না লোকটা কার ছায়া।
রুদ্র? অর্ক? না একেবারে নতুন কেউ?
তবে এটুকু বোঝে—এই প্রেম কল্পনা নয়।
এই গল্প নতুন।
সমাপ্ত