ঋজু ভট্টাচার্য
১
কলকাতার আকাশটা সকাল থেকেই মেঘলা ছিল। শহরের কনস্ট্যান্ট কোলাহলের মাঝেও যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল কোর্ট স্ট্রিটের চত্বর জুড়ে। আইনজীবীদের মধ্যে চাপা উত্তেজনা, কিছুটা উদ্বেগও, কারণ শহরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্রিমিনাল ল’ এক্সপার্ট বরণ ঘোষাল আজও কোর্টে আসেননি। এই নিয়ে সাত দিন হয়ে গেল তিনি নিখোঁজ। প্রথম দু’দিন ভেবেছিল সবাই হয়তো কোনো প্রফেশনাল ট্রিপে গেছেন, তৃতীয় দিনে একাধিক কেসের শুনানি বাতিল হওয়ায় শুরু হয়েছিল গুঞ্জন, এবং সপ্তম দিনে এসে পুরো শহরটা যেন চঞ্চল হয়ে উঠল। মিডিয়া জ্বলজ্বল করছে ‘সেলিব্রিটি লইয়ার নিখোঁজ’ শিরোনামে। পুলিশ অফিশিয়ালি এখনও “মিসিং পারসন” কেস ফাইল করলেও, তদন্তে নামানো হয়েছে দুই কনস্টেবল, একটি গোয়েন্দা ইউনিট এবং একজন প্রাক্তন ক্লায়েন্টকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই ঘটে গেল এমন কিছু, যা শহরটাকে আরও গভীর অন্ধকারে ঠেলে দিল। এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার — বিধায়ক গৌতম বাগচীর — মরদেহ পাওয়া গেল তার দক্ষিণ কলকাতার বাড়ির স্টাডি রুমে। খুনের পদ্ধতি ছিল নিখুঁত: গলায় টানানো পিয়ানো তার, ছুরির একটিও দাগ নেই, রক্ত একবিন্দুও মেঝেতে নেই। কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত ছিল টেবিলের উপর রাখা একটি ছোট্ট সাদা কাগজ, হাতে লেখা—“আমাকে চেনো?” এবং তার নিচে একটি চেনা সই—যা হুবহু বরণ ঘোষালের সইয়ের মতো।
কমিশনার সঞ্জয় ধর যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছালেন, তখন সন্ধ্যে সাতটা। চারপাশে মিডিয়ার ক্যামেরা, ফ্ল্যাশ, রিপোর্টারদের চিৎকারে জায়গাটা যেন একটা লাইভ নাট্যমঞ্চে রূপ নিয়েছে। ঘরের ভেতরে মরদেহ দেখে তিনি প্রথমে কিছু বললেন না, শুধু পিয়ানো তার দিয়ে বাঁধা গলাটা দেখে মুখ শক্ত করে ফেললেন। তার অভিজ্ঞতা বলে দিল এটা কোনো অপেশাদার খুনি নয়। প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি সাজানো উপাদান ছিল সম্পূর্ণ প্রফেশনাল। তিনি টেবিলের সাদা কাগজটা হাতে নিলেন, লেখাটা বেশ পরিচ্ছন্ন—‘আমাকে চেনো?’—এর মধ্যে একরকম ব্যক্তিগত আহ্বান লুকিয়ে আছে, যেন খুনি চায় তাকে খুঁজে বার করা হোক। কিন্তু সইটা? কমিশনার কাগজটা সহকারে সঙ্গে সঙ্গে ফরেনসিক ল্যাবে পাঠালেন এবং অফিসে ফেরার সময় গাড়ির ভিতরে বসে ভাবলেন, “বরণ ঘোষাল কোথায়? উনি কি সত্যিই নিখোঁজ, না কি এই পুরো দৃশ্যপটেরই পরিচালক?” এর মধ্যে প্রেস কনফারেন্সের চাপ, উচ্চমহলের টেলিফোন, এবং মন্ত্রীর হুঁশিয়ারিতে তার মাথার মধ্যে যেন একসঙ্গে হাজারটা প্রশ্ন ঘুরতে লাগল। শহর তো বোধহয় এমন নাটক আগেও দেখেছে, কিন্তু এই কেসে কোথাও একটা ভয়ঙ্কর ভুলচুক লুকিয়ে আছে—এটা তার অভিজ্ঞতা বলে দিচ্ছে। তিনি জানতেন, একমাত্র ব্যক্তি যে এই গোটা বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখতে পারে, সে হল ঋতব্রত ভৌমিক—একজন প্রাক্তন পুলিশ, এখন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর।
ঋতব্রত ভৌমিক তখন উত্তর কলকাতার এক পুরনো বাড়িতে বসে পুরনো ফাইল ঘাঁটছিলেন—কোনো ক্লায়েন্টের পার্সোনাল ইনভেস্টিগেশন নয়, বরং বরণ ঘোষালের কিছু পুরনো কেস হিস্ট্রি। তিনি এই মানুষটাকে একসময় শ্রদ্ধা করতেন, কিন্তু সেই শ্রদ্ধার ভিত কেঁপে উঠেছিল যেদিন তাঁর নিজস্ব তদন্ত ব্যাহত হয়েছিল বরণ ঘোষালের আদালতে নিখুঁত যুক্তির জন্য। তারপর থেকে তিনি আর পুলিশের হয়ে কাজ করেননি। এবার তিনি নিজেই নিজের তদন্তে নামলেন—এটা কোনো চাকরি নয়, এটা যেন ব্যক্তিগত। খুনের খবরে, তাতে আবার সেই “চেনা” সই দেখে তাঁর শিরদাঁড়া ঠান্ডা হয়ে গেল। এত নিখুঁত নকল সম্ভব? না কি সত্যিই এই বুদ্ধিমান আইনজীবী কোনো অন্ধকার পরিকল্পনার পিছনে রয়েছেন? তিনি জানতেন, সইটা হুবহু নকল করলেও হাতের চাপ, কালি প্রবাহ, হস্তাক্ষরের ভারসাম্য থেকে অনেক কিছু বোঝা যায়। কিন্তু একমাত্র একজন মানুষই পারত এত নিখুঁত ভাবে সেটা তৈরি করতে—যদি সে বরণ ঘোষালের খুব কাছের কেউ হয়। অথবা… খুনের পিছনে নিজেই তিনি থাকেন। তদন্তের সূত্র কোথা থেকে শুরু হবে? সই, নাকি প্রশ্নবোধক সেই সংলাপ—“আমাকে চেনো?” তার মাঝে খেলা করছে এক অসমাপ্ত পরিচয়। আর এই খেলা যেন আজ শুরু হল শুধুই শহরের বুকে নয়, ঋতব্রতের নিজের ভেতরেও।
২
বিধায়ক গৌতম বাগচীর অন্ত্যেষ্টির দিন সকাল থেকেই কলকাতা থমথমে। মিডিয়ার ভিড়, পুলিশের পাহারা আর রাজনীতিকদের শোকপ্রকাশের আড়ালে সাধারণ মানুষ যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না—এটা শুধুই এক রাজনৈতিক খুন, নাকি শহরের বুকে কোন গভীর ছায়া নেমে এসেছে। এদিকে তদন্তে নেমে পড়েছে বিশেষ অপরাধ দমন শাখা, এবং ফরেনসিক রিপোর্ট এসে পৌঁছেছে কমিশনার সঞ্জয় ধরের হাতে। কাগজে যে সই পাওয়া গিয়েছিল, তা হুবহু মিলে গেছে বরণ ঘোষালের আগের আইনি কাগজপত্রের সঙ্গে—লুপ, প্রেশার, অ্যাঙ্গেল সব এক। এই মুহূর্তে দুটো প্রশ্ন সবার মনে—যদি বরণ ঘোষাল খুনি হয়, তাহলে সে কোথায়? আর যদি সে না হয়, তাহলে কারা তার সই নকল করছে এত নিখুঁতভাবে? সাংবাদিক স্নিগ্ধা চক্রবর্তী এক সপ্তাহ ধরে এই কেসের প্রতিটি তথ্য নিজের মতো করে জড়ো করছেন। তাঁর সংবেদনশীলতা আর প্যাশন অনেক রিপোর্টারের থেকে আলাদা—সে শুধুমাত্র হেডলাইন খোঁজে না, সে খোঁজে গল্পের ‘ভেতরের গল্প’। বিধায়কের খুনের ঠিক আগের রাতে কে কে এসেছিলেন তাঁর বাড়ি, তা জানতে সে বাগচীর ব্যক্তিগত সিকিউরিটি রক্ষী, রান্নার লোক, এমনকি বাড়ির পুরনো কাজের লোকদের সঙ্গেও কথা বলেছে। সেখানে সে পায় একটি অদ্ভুত তথ্য—একজন ব্যক্তি কালো কোট আর সানগ্লাস পরে রাত দশটার সময় দেখা করতে এসেছিলেন, যিনি ‘কোর্ট থেকে এসেছেন’ বলে দাবি করেন। নাম জানাতে চাননি, মুখ ঢাকা ছিল। সে কি বরণ ঘোষাল নিজে? নাকি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে সেই সিগন্যাল রেখেছে?
ঋতব্রত ভৌমিক ইতিমধ্যেই নিজের তদন্তে গতি বাড়িয়েছেন। তিনি গিয়েছিলেন বরণ ঘোষালের বাড়িতে, যেখানে এক বৃদ্ধ দারোয়ান ছাড়া কেউ নেই। দারোয়ান জানায়, বাবু সাত দিন আগে রাতের বেলায় গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যান, তার পর আর ফেরেননি। কোথাও যাওয়ার কথা বলেননি, ফোনও বন্ধ। বাড়ির অন্দরে ঢুকে ঋতব্রত একটি জিনিস লক্ষ্য করেন—ঘরের মধ্যে চেম্বার টেবিল অদ্ভুতভাবে পরিষ্কার করা, যেন কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে সব সরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু টেবিলের ডানদিকে রাখা একটি ছোট্ট খামে তিনি পান একটি ছেঁড়া চিঠির টুকরো—তাতে লেখা ছিল, “…আমরা সবাই একই খাঁচার পাখি… যদি একটাও উড়ে যায়, বাকিরা নীরব থাকে না।” নিচে কোনো নাম নেই। এই লাইনটা তাঁর মাথায় গেঁথে যায়। ঠিক সেই সময়ে ফোন আসে স্নিগ্ধার—আরেকটি খুন হয়েছে, এবার একটি নামী রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীর। মৃতদেহ পাওয়া গেছে তার সল্ট লেকের ফ্ল্যাটে, এবং একই ধরনের চিঠি রেখে গেছে খুনি—“আমাকে চেনো?” আর সেই একই সই। তদন্ত এখন সরাসরি সিরিয়াল কিলিংয়ের দিকে মোড় নিচ্ছে। দুই মৃত ব্যক্তির পেশা আলাদা হলেও একটা জায়গায় তারা মিলছে—দুজনেই একসময় বরণ ঘোষালের মাধ্যমে বড় আইনি সুবিধা পেয়েছিলেন। যেন খুনি নিজেই বলছে—“আমি জানি, কে কার শাস্তি পায়নি, আর আমি সেই বিচার করব।”
স্নিগ্ধা ও ঋতব্রতের পথে প্রথমবারের মতো যোগাযোগ ঘটে। সল্ট লেকের খুনের ঘটনার পর, মিডিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে পুলিশ মুখ গুঁজে থাকে, আর স্নিগ্ধা সরাসরি প্রশ্ন তোলে—“একই ধরনের সই, একই বার্তা—তবে কি একজন আইনজীবী খুনি হয়ে উঠেছেন, নাকি তিনি নিজেরই শিকার?” এই প্রশ্ন ঋতব্রতকে আরও গভীর করে ভাবায়। স্নিগ্ধা তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে ফোন করে দেখা করতে বলে, এবং তারা বসে একটি ক্যাফেতে, যেখানে আলোচনায় উঠে আসে একটি নাম—তপন সেন, সেই যুবক যার কেসে বরণ ঘোষাল একজন যৌন অপরাধীকে আদালতে রেহাই পাইয়ে দিয়েছিলেন। সেই ঘটনার পর তপন আত্মহত্যা করে। হয়তো এটাই সেই “খাঁচার পাখি”র ইঙ্গিত। এদিকে কমিশনার সঞ্জয় ধর গণমাধ্যমের চাপ সামাল দিতে ব্যস্ত, কিন্তু তার নিজের বিশ্বাস শক্তিশালী হচ্ছে যে, বরণ ঘোষাল হয়তো কোনো গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। এই মুহূর্তে তিনি খুঁজছেন একমাত্র মানুষ, যে শহরের আইন আর অপরাধ দুই দিকই চেনে—ঋতব্রত ভৌমিক। আর ঋতব্রত বুঝে গেছেন, এই কেস কেবল সই নয়, বরং প্রতিটি হত্যার পেছনে লুকিয়ে আছে এক অব্যক্ত বিচার—যা সম্ভবত সমাজের আদালতে হয়নি, কিন্তু কারও ব্যক্তিগত আদালতে রায় ইতিমধ্যে হয়ে গেছে।
৩
কলকাতার পুলিশ হেডকোয়ার্টারের কনফারেন্স রুমে গভীর রাত পর্যন্ত আলো জ্বলছিল। কমিশনার সঞ্জয় ধর সামনে পেতেছেন দুটি খুনের রিপোর্ট, ফরেনসিক অ্যানালাইসিস, এবং সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভ্রান্তিকর তথ্যের সারসংক্ষেপ। সবার সামনে এখন একটাই প্রশ্ন—এই খুনের পেছনে কে, আর বরণ ঘোষালের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক? দুই খুনের ভিক্টিমই একসময় বরণ ঘোষালের কেসে রেহাই পেয়েছিলেন, এবং সে রেহাই নিয়ে সংবাদপত্রে বিতর্কও হয়েছিল। কমিশনার নিজের চুলে আঙুল চালিয়ে ভাবলেন, “কেউ কি পুরনো রায়ের পুনঃবিচার করছে, তবে আদালতের বাইরে?” এর মাঝেই আসে তৃতীয় খুনের খবর—এইবার এক প্রাক্তন পুলিশ অফিসার, হেমন্ত দত্ত, যিনি পাঁচ বছর আগে একটি ধর্ষণ মামলায় তদন্তকারী অফিসার ছিলেন, যেখানে সন্দেহভাজন এক ধনী ব্যবসায়ী আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হন। বিচারপতিরা তখন বলেছিলেন—”তথ্য যথেষ্ট নয়।” কিন্তু সেই কেসেই বরণ ঘোষাল ছিলেন অভিযুক্তের আইনজীবী। এবার সেই হেমন্ত দত্তকে পাওয়া গেল তার লেক টাউনের ফ্ল্যাটে, বিছানায় মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা অবস্থায়, পিঠে রক্ত দিয়ে লেখা তিনটি শব্দ: “ন্যায় কোথায় বলো?” পাশে একই কাগজ, একই সই, আর সেই ভৌতিক প্রশ্ন—“আমাকে চেনো?” এবার পুলিশের ভিতর থেকেই চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে। কেউ একজন পুলিশকে টার্গেট করছে। সঞ্জয় ধর জানতেন, এখন কেস আর আইনজীবী বনাম খুনি নয়, এটা সমাজের এক অদৃশ্য আইনের বিরুদ্ধে খোলা চ্যালেঞ্জ।
ঋতব্রত ভৌমিক এই খুনের খবর শুনেই বুঝে ফেলেন—এটা কেবল প্রতিহিংসা নয়, এটা বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক জৈবিক ক্ষোভ। আর এই ক্ষোভ কেবল তথ্য দিয়ে নয়, অনুভূতি দিয়ে জন্ম নিয়েছে। তিনি আবারও ফিরে যান সেই পুরনো কেসগুলির দিকে, যেখানে বরণ ঘোষাল এমন কিছু অপরাধীর হয়ে লড়েছিলেন যাদের সামাজিক অবস্থান, পয়সা আর প্রভাব ছিল অপরাধ ঢেকে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। তার ডেস্কে এখন ছয়টি ফাইল খোলা, প্রতিটি ফাইলে এক একটি অপরাধের ইতিহাস, যেখানে ক্ষতিগ্রস্তরা কোনোদিন ন্যায় পায়নি। এবং প্রতিটি কেসেই একটিই নাম বারবার উঠে এসেছে—বরণ ঘোষাল। ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি দেখেন, চতুর্থ কেসে—এক কলেজ ছাত্রী আত্মহত্যার মামলা—আসামী মুক্তি পেয়েছিল কারণ মুল সাক্ষী চুপ করে গিয়েছিল। সাক্ষীর নাম ছিল অর্ক ঘোষাল, বরণ ঘোষালের ভাইপো। তার চোখ কুঁচকে যায়। এর আগেও অর্ক সম্পর্কে সে শুনেছে—চুপচাপ, লেখালেখিতে আগ্রহী, কিছুটা বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করে। সে সিদ্ধান্ত নেয়, এবার সময় হয়েছে অর্ককে সামনে এনে কথা বলার। কিন্তু অর্ক তো মিডিয়ার সামনে আসে না, এমনকি পুলিশও তাকে কখনও জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। তখন সে সিদ্ধান্ত নেয়, সরাসরি তার বাড়িতে গিয়ে কথা বলবে।
স্নিগ্ধা চক্রবর্তী এদিকে আলাদাভাবে খোঁজ শুরু করেছে সেই আত্মহত্যার ঘটনার ভিক্টিমের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। মেয়েটির নাম ছিল সুহানী ব্যানার্জী। সে কলেজে খুব মেধাবী ছিল, কিন্তু এক কনস্ট্রাকশন সংস্থার উচ্চপদস্থ ব্যক্তির দ্বারা যৌন হেনস্থার শিকার হয়। কেস হয়েছিল, মিডিয়াতেও এসেছিল খবর, কিন্তু পরে হঠাৎ করেই সাক্ষীরা কথা বলতে অস্বীকার করে, এবং কেস খারিজ হয়ে যায়। সুহানী আত্মহত্যা করে, আর তার বাবা হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান কয়েক মাসের মধ্যে। সেই কেসে বরণ ঘোষাল ছিলেন অভিযুক্তের উকিল। স্নিগ্ধা যখন ঘটনাস্থলে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে, তখন এক প্রৌঢ়া তাকে বলেন—“সেই ছেলেটা, যাকে জোর করে আদালতে দাঁড় করানো হয়েছিল, ও চুপ ছিল, ভয় পায়নি—সে কাঁদছিল।” প্রশ্ন করতেই স্নিগ্ধা জানতে পারে, ছেলেটি ছিল অর্ক। সেই রাতেই ঋতব্রত ও স্নিগ্ধা দেখা করে, নিজেদের খোঁজ মিলিয়ে ফেলে, এবং সিদ্ধান্ত নেয়—অর্ক ঘোষাল এখন শুধু সাক্ষী নয়, হয়তো গোটা কেসের চাবিকাঠি। অতীতের ছায়া যেন এখন জীবন্ত হয়ে ফিরে এসেছে, এবং এই খুনগুলো কেবল অপরাধ নয়, এক লুকোনো অভিশাপের প্রতিফলন। তারা জানে না, সামনে কী অপেক্ষা করছে—কিন্তু এটুকু বোঝে, এবার আর খুনিকে খোঁজা হচ্ছে না, বরং খুনি হয়তো তাদেরই খুঁজছে।
৪
কলকাতার বুকে একের পর এক খুনের ঘটনার ফলে পুলিশের পাশাপাশি সংবাদমাধ্যম, আইনজীবী মহল ও জনসাধারণের মনেও ছড়িয়ে পড়েছে ভয়, ধোঁয়াশা এবং গভীর অনিশ্চয়তা। কিন্তু চতুর্থ খুনটা যেন সমস্ত আগের নিয়ম ভেঙে দিল। এবার খুনের শিকার একজন সাধারণ মানুষ—এক প্রাক্তন প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক, নাম বিশ্বজিত দে, বয়স প্রায় সত্তর। দক্ষিণ শহরতলির এক ছোট্ট ফ্ল্যাটে একা থাকতেন তিনি। প্রথমে পুলিশ ভেবেছিল এই হত্যাকাণ্ড পূর্ববর্তী ঘটনার সঙ্গে যুক্ত নয়, কারণ বিশ্বজিত দে-র কোনো রাজনৈতিক প্রভাব নেই, আইন বা অপরাধ জগতের সঙ্গে যোগসূত্র নেই। কিন্তু ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসার পর চমকে উঠল সবাই। তার কণ্ঠনালী ছিন্ন হয়েছিল পিয়ানো তার দিয়ে, এবং বুকের পাশে রাখা ছিল সেই একই সাদা কাগজ—“আমাকে চেনো?”—নিচে সেই অদ্ভুত পরিচিত সই। তদন্ত ঘুরে যায় অন্য খাতে, যখন জানা যায় এই শিক্ষক ছিলেন সেই মামলার মূল সাক্ষী, যেখানে বরণ ঘোষাল একজন ধনী জমিদারপুত্রকে বেকসুর খালাস করিয়েছিলেন একটি শিশু নির্যাতনের কেসে। বিশ্বজিত তখন ক্লাস ফাইভে পড়ানো এক ছাত্রীর অভিভাবকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে ভয় পেয়ে আদালতে নিরপেক্ষ সাক্ষ্য দেন। এরপর স্কুল থেকে অবসর নেন এবং নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করতেন। কমিশনার সঞ্জয় ধর এবার আর ধৈর্য ধরতে পারলেন না—এত খুন, এত নিখুঁত ‘প্রতিশোধমূলক বার্তা’—এটা আর কাকতালীয় নয়। তাঁর ধারণা স্পষ্ট হয়: খুনি একে একে তাদের খুঁজে মারছে, যারা আইনকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত করেছে, এবং প্রত্যেক খুনের নেপথ্যে রয়েছে একটি পুরনো মামলা, যার প্রতিটি ইঞ্চিতে ছিল বরণ ঘোষালের ছায়া।
ঋতব্রত ভৌমিক বুঝে যান, খুনি তার নিজের আদর্শে ‘বিচারক’, সে নিজেই আদালত, বিচারক এবং শাস্তিদাতা। প্রতিটি খুনের পেছনে রয়েছে এক অস্পষ্ট নৈতিক বার্তা, যে বার্তা সমাজ ভুলে গেছে। তাঁর হাতে থাকা কেসফাইলগুলোর ফাঁকে যেন শব্দ উঠে আসে—‘ন্যায়’, ‘সাক্ষ্য’, ‘ভয়’, ‘মুখ বন্ধ’, ‘সই’। এর মধ্যেই এক রাতে হঠাৎ করে একটি ফোন আসে। অপরিচিত কণ্ঠ, কাঁপা গলা, কিন্তু বক্তব্য স্পষ্ট—”আপনি যদি সত্যি জানতে চান, কাদের শাস্তি হওয়া উচিত ছিল, তাহলে শ্যামবাজারের পুরনো সাইকেল দোকানটার পিছনের গলিটায় আসুন, রাত বারোটায়। একা আসবেন।” ফোন কেটে যায়। ঋতব্রত দ্বিধায় পড়ে যান, ফাঁদ হতে পারে, আবার হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যাবেন, কিন্তু দূর থেকে নজর রাখার জন্য স্নিগ্ধাক ফোন করেন। বারোটা ঠিক পাঁচ মিনিট আগে তিনি পৌঁছে যান নির্ধারিত জায়গায়। গলি সুনসান, আলো নেই, রাস্তার ধারে একটা ভাঙাচোরা বেঞ্চে একটা ছায়ামূর্তি বসে আছে। কাছে যেতেই ছায়াটি বলে—“আপনার বারণ ঘোষালকে চিনলেও, তাঁর ছায়ার বিচার এখনও কেউ করতে পারেনি।” মুখটা ছায়ায় ঢাকা, শুধু একটি কাগজ তার হাতে তুলে দিয়ে সে দ্রুত অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। কাগজে লেখা ছয়টি নাম—সবাই কোনো না কোনো মামলায় বরণ ঘোষালের মাধ্যমে রক্ষা পেয়েছিল। ইতিমধ্যে তিনজন খুন হয়ে গেছে। বাকিদের মধ্যে একটির নাম পড়ে স্নিগ্ধা চক্রবর্তীর চোখ কুঁচকে যায়—“রিমা পাল”। এই নাম সে কোথাও শুনেছে।
স্নিগ্ধা এরপর খোঁজ নিয়ে জানতে পারে—রিমা পাল একসময় একটি শিশু পাচার মামলার মূল সাক্ষী ছিল। কিন্তু পরে সে হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে যায়। সন্দেহ হয় যে সে হয়তো অন্য নামে জীবনযাপন করছে। তদন্ত করতে করতে সে পৌঁছে যায় গড়িয়াহাটের এক নার্সিং হোমে, যেখানে এক নার্সের নাম উঠে আসে—“রূপসা দে”, যিনি দেখতে অনেকটা রিমা পালের মতো। স্নিগ্ধা সেখানে গিয়ে জানতে পারে, রূপসা কয়েক বছর আগে এসে কাজ শুরু করেছেন, কিন্তু তাঁর ফর্মে দেওয়া তথ্য ও আসল নথির মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। সে বুঝতে পারে, কেউ হয়তো তাঁকে নতুন পরিচয় দিয়েছে, পুরনো পরিচয় মুছে দিয়ে। এদিকে ঋতব্রত সেই তালিকা নিয়ে বিশ্লেষণ করতে করতে হঠাৎ আবিষ্কার করেন, এই ছয়টি নামের প্রতিটি কেসে শুধু বরণ ঘোষালই ছিলেন না—ছিল আরেকজন… একজন সাক্ষী… নাম: অর্ক ঘোষাল। বরণ ঘোষালের ভাইপো। কিন্তু সে কেবল একটি কেসে সাক্ষী ছিল না, পাঁচটি কেসেই কোনো না কোনোভাবে উপস্থিত ছিল, আদালতে, চেম্বারে বা বাড়ির আলাপচারিতায়। এবার ধোঁয়াশার মেঘ ধীরে ধীরে সরে যেতে থাকে। খুনি কি তাহলে অর্ক? তার মানসিক অবস্থার পেছনে কি লুকিয়ে আছে সেসব কেসের চাপা ব্যথা? ঋতব্রত ও স্নিগ্ধা ঠিক করেন, আর দেরি নয়—এবার মুখোমুখি হতে হবে অর্ক ঘোষালের সঙ্গে। কারণ প্রতিটি খুনের পরে থাকা সেই সইয়ের পেছনে হয়তো লুকিয়ে আছে শৈশবের এক অভিশাপ, এক অসমাপ্ত বিচার, কিংবা এক ভয়াবহ সত্যের জন্ম।
৫
বিকেলটা যেন কেমন অদ্ভুত হয়ে উঠেছিল। কলকাতার আকাশটা হঠাৎ করে কালচে হয়ে এল, মেঘ জমেছে, কিন্তু বৃষ্টি পড়ছে না—শুধু একটা বিদ্যুতের মতো আলো, মাঝে মাঝে ঝলক দিচ্ছে। ঠিক সেই সময়েই অরিত্র বসুর ফ্ল্যাটে প্রবেশ করলেন দীক্ষিত। রায়দিঘির এই বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে যখন তিনি পৌঁছোলেন, তখন অরিত্রর স্ত্রী বন্যা একা ছিলেন। ভদ্রমহিলা শুরুতে বেশ কিছুটা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু শুনে যখন বুঝলেন পুলিশ এসেছে তার নিখোঁজ স্বামীর খোঁজে, তখন শান্ত হয়ে ড্রইংরুমে বসালেন। দীক্ষিত চারপাশটা পর্যবেক্ষণ করলেন। ড্রইংরুম সাজানো, পরিষ্কার, ঘরে বইয়ের তাক ভর্তি আইন ও অপরাধ সংক্রান্ত গ্রন্থ, একটা ম্যাকবুক খোলা রাখা, জানলার ধারে রাখা একটা চায়ের কাপ—হয়ত অরিত্রর শেষ চা খাওয়া ওই দিনটিতেই, যেদিন সে নিখোঁজ হয়েছিল। বন্যা মুখে চাপা বিষণ্ণতা নিয়ে জানালেন, “আপনারা যা খুঁজে পেয়েছেন, সেটা শুনে আমি শকড… আমার স্বামী কখনও কাউকে মারতে পারেন, সেটা ভাবাই যায় না!” দীক্ষিত সাবধানে বললেন, “আমরা নিশ্চিত নই এখনও, কিন্তু যেভাবে খুনের পরে সই পাওয়া যাচ্ছে, আর সেই সই আপনার স্বামীর সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে, সেটা উপেক্ষা করা যাচ্ছে না।” বন্যা চোখ নামিয়ে ফেললেন। তারপর চুপচাপ উঠে বইয়ের তাক থেকে একটা পুরোনো নোটবুক বের করলেন। “এইটা ওর হাতের লেখা। আপনি মিলিয়ে দেখতে পারেন। তবে একটা কথা বলতে পারি, অরিত্রর যেমন একটা মস্তিষ্ক ছিল, সে যদি খুনি হতোও, তবে তার নিজের সই রেখে যেত না।”
দীক্ষিত অফিসে ফিরে একরাশ চিন্তায় ডুবে গেলেন। একদিকে অরিত্রর সই প্রতিটি খুনে পাওয়া যাচ্ছে, আরেকদিকে সে নিজেই নিখোঁজ। কি এমন ঘটল যে একজন খ্যাতনামা আইনজীবী হঠাৎ উধাও হয়ে গেলেন, আর সেই সময়েই শহরে শুরু হল সিরিয়াল কিলিংয়ের মহোৎসব? ঠিক তখনই অফিসের এক জুনিয়র সুভাষ একটা নতুন ইনপুট দিল—যে তিনটি খুন হয়েছে, তাদের তিনজনের সাথেই অরিত্র বসুর আইনি যোগাযোগ ছিল। প্রথম জন—সব্যসাচী পাল, একজন প্রাক্তন রাজনীতিবিদ, একসময় দুর্নীতির মামলায় অরিত্র তাকে বাঁচিয়েছিলেন। দ্বিতীয় জন—নিত্যানন্দ সাহা, রিয়েল এস্টেট মাফিয়া, যার বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও জমি দখলের অভিযোগ থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন অরিত্রর জোর আইনি চালচালিতে। তৃতীয় জন—মঞ্জু শর্মা, এক শিশু পাচার চক্রের সদস্যা, যার পক্ষে দাঁড়িয়ে মামলা জিতে নিয়েছিলেন অরিত্র। এমনকি সুভাষ আরও জানাল, “স্যার, শহরে একটা কিস্সা চালু আছে—‘অপরাধ করো, অরিত্রর কাছে যাও, এবং বাঁচো।’” দীক্ষিত এবার ভাবলেন, তাহলে কি এটা কেউ একরকম বিচারকার্য চালাচ্ছে? শহরের অপরাধীদের, যারা আইনজীবীর চাতুর্যে বাঁচে, তাদের খতম করছে? আর প্রতিবারই সেই আইনজীবীর সই দিয়ে একটা ‘নির্বোধ বার্তা’ রেখে দিচ্ছে—“আমাকে চেনো?” তাহলে কি অরিত্র নিজেই আত্মগোপন করে এই সব অপরাধীদের শাস্তি দিচ্ছে? কিন্তু তাহলে সই রেখে যাবে কেন? কিংবা… কেউ কি তাকে ফাঁসাচ্ছে?
ঠিক তখনই রাতের ফোনটা এল। বিশাল রায়ের গলা ঘামা, উত্তেজিত, “দীক্ষিত, একটা ব্রেকিং নিউজ। আমরা চতুর্থ খুনটা পেয়েছি। এইমাত্র শরৎ বোস রোডে একটা পরিত্যক্ত ফ্ল্যাটে, এক যুবককে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। তার মুখে টেপ লাগানো ছিল, বুকে ছুরির আঘাত। আর সব থেকে বড় কথা, এইবারও একটা সাদা কাগজ পড়ে আছে, তার গায়ে লেখা—‘আমাকে চেনো?’ এবং… সেই একই সই!” দীক্ষিত মুহূর্তে জায়গা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে দলবল নিয়ে ছুটে গেলেন ঘটনাস্থলে। রাত্রি প্রায় সাড়ে এগারোটা। জায়গাটা শুনশান, চারপাশে ভাঙা পাঁজা, হঠাৎ একটা বিড়াল ডেকে উঠল—সেই শব্দে যেন মৃতদেহও কেঁপে উঠল। কিন্তু এবার কিছু নতুন পাওয়া গেল। ফ্ল্যাটের এক কোণে একটা পুরোনো, ছেঁড়া ফাইল খুঁজে পেল দীক্ষিত। সেই ফাইলের ভেতর ছিল চারজনের ছবি—সব্যসাচী, নিত্যানন্দ, মঞ্জু, আর সদ্য খুন হওয়া যুবক—নাম সজল ধাড়া। এবং নিচে একটা স্ক্রিপ্ট লেখা—“এই চারজনের বিচার হয়েছিল, কিন্তু সত্যিকারের শাস্তি হয়নি। আমি ফিরেছি, তাদের বিচার করতে।” দীক্ষিতের বুক কেঁপে উঠল—“আমি ফিরেছি”—মানে কি সত্যিই অরিত্র ফিরে এসেছে নিজের তৈরি আইনি ফাঁকফোকরের ন্যায়হীনতা সংশোধন করতে? নাকি এটা কারও গভীর ষড়যন্ত্র, একটা আইনজীবীর সুনাম ধ্বংস করতে? প্রশ্ন গুলো কুয়াশার মতো ঘুরপাক খাচ্ছিল তার মনে, আর সেই কুয়াশার ভিতর থেকে ধীরে ধীরে ভেসে উঠছিল এক মুখ—চেনা মুখ, সই করা এক খুনের ছায়া।
৬
বিকেলটা থমথমে। কফির কাপে ঠোঁট ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে দীপ আর শুভায়ন বসে আছে বালিগঞ্জের একটি নিরিবিলি ক্যাফেতে। ঘড়িতে তখন পাঁচটা বেজে দশ। আকাশে মেঘ, কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে না। সকাল থেকে দু’জনে অনেক জায়গায় ছুটে বেরিয়েছে—আদালতের পুরনো দলিল, আদালতের কেরানি হরিপদর বয়ান, এমনকি নিখোঁজ আইনজীবী ঋত্বিক গুহর ছেলের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টাও হয়েছে। কিন্তু সবকিছু যেন শূন্যতায় শেষ হচ্ছে। শুভায়নের চোখে ক্লান্তির ছায়া, কিন্তু দীপের চোখে আজ এক অন্য রকম দৃঢ়তা। ওদের সামনে রাখা ল্যাপটপে দেখা যাচ্ছে কয়েকটি ছবির কোলাজ—সবগুলো মৃতদেহের পাশে একটি করে সাদা কাগজ, একই প্রশ্ন: “আমাকে চেনো?” এবং একইরকম একটি সই। অথচ forensic বলছে এই সই পুরোপুরি মেলে ঋত্বিক গুহর কোর্ট ফাইলের সিগনেচারের সঙ্গে। দীপ ধীরে ধীরে বলে উঠল, “তিনজন খুন, তিনটে আলাদা এলাকা—একটা রাজারহাট, একটা টালিগঞ্জ, আর একটা চিৎপুর। অথচ তিনটেতেই ঋত্বিক গুহর স্বাক্ষর। এটা যদি সে-ই করত, তাহলে নিখোঁজ থাকত না। কিন্তু কে তাহলে ওর সই নকল করছে? আর এত নিখুঁতভাবে?”
সন্ধে গড়াতে না গড়াতেই ওরা পৌঁছে যায় চিৎপুর থানায়। সেখানে এসআই পার্থসারথি মিত্র ওদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। চিৎপুরের মৃতদেহটি ছিল একজন স্থানীয় মুদির দোকানদার, নাম গোপাল সাহা। তাকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে—চোখ বন্ধ করে ন্যাপকিনে মুখ চাপা দিয়ে, গলায় চাপ দিয়ে শ্বাসরোধ। পার্থসারথি জানান, ঘটনার আগের দিন এক অচেনা লোক দোকানে আসে, খুব সাধারণ পোশাকে, কিন্তু তার চোখ দুটো ছিল অদ্ভুত ফাঁকা। সিসিটিভি-তে চেহারা স্পষ্ট বোঝা যায় না, কারণ লোকটি মুখে একটা সাদা মাস্ক পরে ছিল। শুভায়ন বলে ওঠে, “সাদা মাস্ক? তিনটে ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজেও একইরকম একটা মুখোশ দেখা গেছে!” দীপ মাথা নাড়ে। তিনটি খুন, তিনজন সাধারণ মানুষ, কারো সঙ্গেই ঋত্বিক গুহর সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। তবে একটা অদ্ভুত মিল—তিনজনকেই কিছু না কিছু আইনি সহায়তা একসময় দিয়েছিলেন ঋত্বিক, বিনামূল্যে। পুরনো কেস ফাইলে সেই রেকর্ডও আছে। দীপ গভীরভাবে বলে, “যদি কেউ এই তিনটে কেস খুব ভালোভাবে জানত, যদি সে চাইত ঋত্বিককে ফাঁসাতে, তাহলে কী হতো? একটা করে খুন করে তার সই বসিয়ে যেত।” শুভায়ন জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু কেন ঋত্বিক গুহকে টার্গেট করবে কেউ?” দীপের চোখে তখন নতুন আলো, ও শুধু বলল, “কারণ, মানুষটা নিখোঁজ আছে—এটাই তাকে দোষী প্রমাণ করার সবচেয়ে সহজ রাস্তা।”
রাতে ওরা ফিরে আসে দীপের সল্ট লেকের ফ্ল্যাটে। কেসের খুঁটিনাটি একে একে সাজিয়ে বসে ওরা। কফির কাপ খালি হয়, ছাইভর্তি অ্যাশট্রে সাক্ষ্য দেয় ঘুমহীন চিন্তার। দীপ হঠাৎ বলে ওঠে, “শুভ, যদি আমি বলি খুনি খুব কাছেই আছে?” শুভায়ন বিস্ময়ে তাকায়, “মানে?” দীপ ধীরে ধীরে বলে, “এই খুনগুলো একটা emotional revenge—যে কেউ করতে পারে না। খুনি, ঋত্বিক গুহকে খুব ভালো করত, বা ঘৃণা করত—এমন কেউ যার ব্যক্তিগত ক্ষোভ রয়েছে। আর তার মধ্যে আইনি বিষয় জানার স্পষ্ট ধারণা আছে।” শুভায়ন চুপ করে। দীপ উঠে আসে জানালার ধারে, বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, হালকা ঝিরঝিরে। ও জানালার কাঁচে হাত রেখে বলে, “কেউ আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, যার ভিতরে দাউ দাউ করে জ্বলছে প্রতিশোধের আগুন। এবং সে এখনো থামেনি।” হঠাৎই ফোন বেজে ওঠে। অপরিচিত নম্বর। দীপ ফোন তোলে। ওপার থেকে একটা ঠান্ডা, তীক্ষ্ণ গলা শোনা যায়—“চতুর্থটা কাল সকালে… দক্ষিণেশ্বর ঘাটে। একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখো আমার সইটা। এবার একটু ভিন্নতা থাকবে।” ফোন কেটে যায়। ঘরে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। দীপ ধীরে ধীরে বলে ওঠে, “ও আমাদের সঙ্গে খেলছে। আর আমরা বুঝেও পেরে উঠছি না।”
৭
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে শহরের গায়ে, আর ঠিক সেই মুহূর্তে এক নিঃশব্দ আগুন জ্বলে ওঠে বালিগঞ্জের এক ফাঁকা বাড়িতে। পুলিশের কাছে খবর আসে প্রতিবেশীদের ফোনে—ধোঁয়া উঠছে পুরনো সিংহভিলা থেকে, বাড়ি যেটি একসময় নামজাদা আইনজীবী অরিন্দম সিংহর পৈত্রিক সম্পত্তি ছিল, এবং এখন সম্পূর্ণ তালাবদ্ধ। দীপ্ত দাঁড়িয়ে ছিল জানালার পাশে, হাতে একটি পুরনো কফির কাপ আর চোখে স্পষ্ট ক্লান্তি, কিন্তু আগুনের খবর শুনে মুহূর্তে সক্রিয় হয়ে ওঠে। শুভায়নকে সঙ্গে নিয়ে সে ছোটে ঘটনাস্থলে, যেখানে ইতিমধ্যেই পৌঁছে গেছে ফায়ার ব্রিগেড ও স্থানীয় পুলিশ। আগুন নিভে গেলে বাড়ির ভেতরে পাওয়া যায় এক পোড়া নোটবই, যেটির পৃষ্ঠাগুলি আধপোড়া, কিন্তু একটিতে লেখা স্পষ্ট—”শেষ অঙ্কটা এখনো বাকি, দীপ্ত। আমাকে চেনো?” সইটা যেন এবার আর শুধু চ্যালেঞ্জ নয়, বরং ব্যক্তিগত আঘাতও। দীপ্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, চোখে বিদ্যুতের রেখা, ঠোঁটে চাপা রাগ।
নোটবইটি বিশ্লেষণ করে বোঝা যায়, এটা অরিন্দম সিংহর ব্যক্তিগত ডায়েরি, যেখানে শেষ কয়েকটি পাতায় রহস্যময় কিছু নাম, সময় ও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে ভবিষ্যৎ খুনের। এই মুহূর্তে দীপ্ত বুঝে যায়, খুনির পরবর্তী টার্গেট সে নিজে, কারণ ডায়েরির এক পাতায় লেখা: “সে ভাবে সত্যি খুঁজে ফিরছে, অথচ জানেই না যে তার পেছনে কেউ হাঁটে…” ডায়েরির শেষ পাতায় একটি ছবির টুকরো জোড়া লাগানো ছিল—সেই ছবিতে দীপ্ত, অরিন্দম, এবং একটি অচেনা মুখ—হয়তো তাদের পুরনো কোনো কেসের সূত্র ধরে। শুভায়নের মাথায় তখনও ঘুরছে আগুন লাগানোর উদ্দেশ্য—কেন খুনি এত চুপচাপভাবে বাড়িটা পুড়াতে চেয়েছিল? প্রমাণ লোপাট, না কি শুধু একটা ইঙ্গিত? সেদিন রাতে ফেরার সময় তারা খেয়াল করে বাড়ির পেছনের বাগানে কেউ যেন সদ্য হেঁটে গেছে—কাদার উপরে তাজা পায়ের ছাপ, একজোড়া পায়ে জুতো ছিল না, এবং ছাপগুলো গিয়ে মিলিয়ে গেছে পাশের শ্মশানঘাটে। দীপ্ত জানে, রাত বড় রহস্যময় হতে চলেছে।
পরদিন সকালেই দীপ্ত অফিসে গিয়ে প্রফেশনাল ক্রাইম প্রোফাইলার মীনাক্ষীর সঙ্গে দেখা করে। মীনাক্ষী ডায়েরির কভার ও লেখার ধরন বিশ্লেষণ করে বলে, খুনি নিছক সাইকোপ্যাথ নয়, সে একজন থিয়েট্রিকাল কিলার—যে প্রতিটি খুনকে একটি নাটকের দৃশ্য হিসেবে মঞ্চস্থ করছে। “আমাকে চেনো?” এই প্রশ্ন তার কাছে শুধুই স্লোগান নয়, বরং নিজের অস্তিত্বের প্রমাণ, প্রতিটি খুন যেন সে তার উপস্থিতির ছায়া ফেলে যায়। মীনাক্ষী এটাও জানায়, খুনি যে নকল সই ব্যবহার করছে, তা অরিন্দম সিংহর ছাত্রজীবনের সময়কার রেজিস্ট্রেশন কাগজ থেকে নেওয়া, যার একমাত্র কপি ছিল এক জায়গায়—কলকাতা ল’ কলেজের আর্কাইভ। দীপ্ত ও শুভায়ন সেই রাতেই পৌঁছে যায় কলেজে, কিন্তু আর্কাইভ রুমে ঢুকতেই তাদের সামনে আসে এক বিস্ময়—সেখানে আগেই কেউ ঢুকে ভাঙচুর করেছে সব ফাইল, কাচ ছড়িয়ে ছিটিয়ে, আর দেওয়ালে লাল রঙে আঁকা: “সময় কম, দীপ্ত… এবার তোমার পালা।” শুভায়নের কাঁধে হাত রাখে দীপ্ত, নিঃশব্দে বলে ওঠে, “খেলা শুরু হয়েছে। শেষ দৃশ্য লেখার সময় এবার আমার।”
৮
অভিজিৎ বসুর মৃত্যুর পর শহরের চেহারা যেন আরও ভারী হয়ে উঠেছে। গোটা বারাসত যেন এক অদৃশ্য আতঙ্কের ঘেরাটোপে বন্দি। সংবাদপত্র, টেলিভিশন—সব জায়গায় শুধুই একটাই শিরোনাম: “নিখোঁজ আইনজীবীর নামে আবার খুন!” এই নিয়ে চতুর্থ খুন, আর প্রতিবারই মৃতদেহের পাশে পাওয়া যাচ্ছে সেই একরকম নোট—“আমাকে চেনো?” এবং সেই একই সই, যা হুবহু মেলে নিখোঁজ আইনজীবী চঞ্চল মিত্রর স্বাক্ষরের সঙ্গে। পুলিশ প্রাথমিকভাবে অনুমান করছিল, হয়তো কেউ তার নাম ব্যবহার করে খুন করছে, কিন্তু forensic রিপোর্ট বলছে, সইটি আসল। সেই কালি, সেই পেন, সেই চাপ। আর এইসব ঘটনার মধ্যেই আজ হঠাৎ করেই থানায় এসে হাজির হল এক রহস্যময় নারী—ঈশিতা। চোখে সানগ্লাস, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, আর হাতে একটা ছোট্ট নীল খাম। সে ডান হাতের কনুইয়ে ভর দিয়ে ইন্সপেক্টর সৌগতর দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার খুনি কোথায় সেটা আমি জানি। কিন্তু সত্যটা জানলে আপনি ঘুমোতে পারবেন তো?” সৌগত মুখ তুলে তাকিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ঈশিতা তাকে থামিয়ে দিয়ে খামের ভেতর থেকে একটা পাতা বের করল। সেখানে একটা পুরনো ছেঁড়া নোটবুকের পাতায় কিছু লেখা—আর সেই লেখার নিচে আবার সেই একই সই। ঈশিতা বলল, “এই পাতাটা আমি পেয়েছি চঞ্চল মিত্রর পুরনো চেম্বার থেকে, যেটা এখন বন্ধ। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার হলো—এই লেখাটা চঞ্চল নিজেই লিখেছে, এক বছর আগে… এই লেখার তারিখও দেওয়া আছে।”
ইন্সপেক্টর সৌগত আর কিছু না বলে ডেকে পাঠাল তার অফিসার স্নেহাশীষকে, এবং দু’জন মিলে ঈশিতার দেওয়া পাতাটা পাঠালেন ফরেন্সিক টিমে। রাত তখন দশটা গড়িয়ে এগারোটা ছুঁই ছুঁই। থানার ভিতরে টানটান উত্তেজনা। ঈশিতাকে আলাদা একটা কক্ষে বসানো হয়েছে, আর সৌগত একমনে তার অতীত খুঁজে বার করতে ব্যস্ত। হঠাৎ স্নেহাশীষ এসে জানাল, “স্যার, ফরেন্সিক রিপোর্ট আসছে। দুই লেখাই মিলে গেছে। কিন্তু সইয়ের নিচে থাকা লেখাটাই বেশি পুরনো, মানে সেটা আগেই লেখা।” এই শুনে সৌগত ধাক্কা খেল। তাহলে কি চঞ্চল আগে থেকেই খুনের প্ল্যান করে রেখেছিল? কিন্তু কেন? সে তো একজন নামজাদা আইনজীবী, তার এমন কোনো মানসিক সমস্যা ছিল না। ঈশিতার দিকে তাকিয়ে সে বলল, “তুমি কে? চঞ্চলের সঙ্গে তোমার সম্পর্কটা কী?” ঈশিতা নিঃশব্দে হাসল, চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে বলল, “আমি চঞ্চলের সাবেকা স্ত্রী। এবং এই খুনের ছায়া অনেক আগেই আমাদের জীবনে নেমে এসেছিল। আপনি জানেন না, চঞ্চল কারা কারা রোজ রাতে নিজের ডায়েরিতে তাদের নাম লিখত, যাদের সে আইনের ফাঁক গলে ছাড়িয়ে এনেছিল। এবং তার মধ্যে একদিন সে নিজেই একটা তালিকা তৈরি করেছিল—‘বিচারের নতুন পথ’ নামে।” সৌগত হতবাক। চঞ্চলের অতীতের এমন এক ভয়ানক অধ্যায় সে কল্পনাও করতে পারেনি। ঈশিতা আরও বলল, “চঞ্চল নিজেই একদিন বলেছিল—একদিন যদি আমি হারিয়ে যাই, তাহলে খুঁজো না। কারণ আমি যা করতে চলেছি, তা হয়তো আইন স্বীকার করবে না, কিন্তু বিবেক করবে।”
এই বিস্ময়ের মাঝেই হঠাৎ থানার ফোন বেজে উঠল। ডিউটি অফিসার জানাল, বারাসতের এক পুরনো বাড়িতে পাওয়া গেছে আরেকটা মৃতদেহ। পুলিশ পৌঁছেই দেখে—মৃত, বছর পঁঁচিশের এক যুবক, যার গায়ে ফর্মাল পোশাক, পাশে পড়ে আছে সেই চিরপরিচিত চিরকুট, “আমাকে চেনো?”, আর নিচে সেই সই। কিন্তু এবার তার পাশে আরেকটা বস্তু, যা আগেরবার পাওয়া যায়নি—একটা ছোট্ট ক্যাসেট টেপ। টেপটি বাজানো হলে, শোনা যায় এক পুরুষ কণ্ঠের কথাঃ “তাদের আমি একে একে সাজা দিচ্ছি, যাদের জন্য বিচার নামক শব্দটা একটা তামাশায় পরিণত হয়েছিল। আইন দিয়ে তারা পার পেয়ে গেছে, কিন্তু বিবেকের আদালত তো আর বন্ধ হয় না। আমি শুধু একজনে রইলাম। তারপর আমি থেমে যাবো।” সৌগত ক্যাসেটটি শোনার পর চুপ করে বসে থাকল। ঈশিতা একপলক চেয়ে বলল, “এটাই চঞ্চলের কণ্ঠ।” সৌগত জিজ্ঞেস করল, “তাহলে চঞ্চল বেঁচে আছে?” ঈশিতা বলল, “হয়তো, হয়তো না। কিন্তু সে কোথাও লুকিয়ে আছে, এবং শেষ খুনটা যে কাকে নিয়ে সে করেছে, তা সে-ই জানে।” থানার ঘড়িতে তখন রাত বারোটা বাজে। শহরের নিস্তব্ধতা ফাটিয়ে যেন হাওয়ায় ভেসে আসে সেই প্রশ্ন—“আমাকে চেনো?”
৯
রাত তখন দু’টো। কলকাতার বাতাসে হালকা ঠান্ডা, রাস্তা প্রায় ফাঁকা। লালবাজারে আলো জ্বলছে, এবং ইন্সপেক্টর অনিরুদ্ধ বসে আছেন তার অফিসে, চোখে ক্লান্তি, কপালে ভাঁজ। ফাইলের পাহাড়ে চোখ রাখলেও তার মন স্থির নয়—কারণ প্রতিটি খুন, প্রতিটি নোট, প্রতিটি সই—সবই যেন একটা অদৃশ্য ছায়ার ইশারা করছে। আইনজীবী অনিরুদ্ধ সেনের নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে শহরে ছড়িয়ে পড়েছে গুজব—কেউ বলছে সে-ই খুনি, কেউ বলছে সে হয়তো খুনের শিকার। কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয়, প্রতিটি হত্যার স্থানে রেখে যাওয়া সেই সই—যা ফরেনসিক পরীক্ষায় হুবহু অনিরুদ্ধ সেনের সই হিসেবে প্রমাণিত। আর এখন, আজ সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া ষষ্ঠ খুনটিতে নোটে লেখা ছিল নতুন এক লাইন—“তোমার ছায়া তো আমিই, এবার চেনো নিজেকে!” কাগজটা ঠাণ্ডা বাতাসে থরথর করছিল, আর তার ঠিক নিচেই পড়ে ছিল এক যুবকের মৃতদেহ—যে ছিল অনিরুদ্ধ সেনের জুনিয়র সহকারী।
অন্যদিকে, গোয়েন্দা রুদ্র চ্যাটার্জী তখন বসে রয়েছেন একটি পরিত্যক্ত বাড়ির সিঁড়ির উপর। মুখে চিরচেনা সিগারেট, চোখে গভীর ভাবনা। তার সামনে ছড়িয়ে রয়েছে নানা ছবি, পেপার কাটিং, ও নিহতদের ব্যক্তিগত তথ্য। তার একটানা বিশ্লেষণে ফুটে উঠেছে একটি রহস্যময় প্যাটার্ন—খুন হওয়া প্রতিটি ব্যক্তি কোনও না কোনওভাবে জড়িত অনিরুদ্ধ সেনের পুরোনো একটি মামলা সংক্রান্ত। প্রথম নিহত ব্যক্তি ছিলেন এক সাক্ষী, দ্বিতীয় জন এক অব্যাহতি পাওয়া আসামি, তৃতীয়জন ছিল একজন সরকারি কৌঁসুলি, এবং আজকের খুনের শিকার ছিল সেনের জুনিয়র। অথচ সেন নিজেই নিখোঁজ! রুদ্রের মাথায় ঘুরছে একটি কথা—“এই সই করা খুনগুলো কি শুধুই প্রতিশোধ, নাকি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে চিত্রনাট্য সাজিয়ে চলেছে অনিরুদ্ধ সেনকে কেন্দ্র করে?” তখনই তার ফোন বেজে ওঠে—কলটি এসেছে সাংবাদিক ঋতা সেনগুপ্তার কাছ থেকে। সে জানায়, অনিরুদ্ধ সেনের বাল্যবন্ধু সমীর রায়কে দেখা গেছে কলকাতা শহরের এক সস্তা হোটেলে, এবং তার গতিবিধি বেশ সন্দেহজনক।
রুদ্র সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে। শহরের অলিগলি পেরিয়ে সে পৌঁছয় সেই হোটেলে। সামান্য ঘুষে রিসেপশনিস্ট জানিয়ে দেয়, সমীর রায় দু’দিন ধরেই এখানে আছেন, তবে ঘর ছাড়েন না। রুদ্র তার ঘরের দরজার সামনে গিয়ে ধাক্কা দেয়। দরজা খুলে যায় অদ্ভুত নিস্তব্ধতায়। ঘরের ভেতর আলো নেই, কেবল একটা হ্যারিকেন জ্বলছে। আর তার আলোয় দেখা যায়, দেয়ালে টাঙানো রয়েছে অনিরুদ্ধ সেনের পুরোনো ফটো, পাশেই ম্যাপ, খুন হওয়া লোকদের ছবি, ও একটি কাঁচের বাক্সে রাখা একজোড়া চশমা—ঠিক যেটা অনিরুদ্ধ সেন পরতেন! রুদ্র বুঝতে পারে, সে একটি বড় জালের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে—যেখানে ছায়া আর সত্য মিশে গেছে এক হয়ে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, অনিরুদ্ধ সেন কোথায়? সে কি নিজেই নিজের ছায়া হয়ে খেলা খেলছে? নাকি এই পুরো ঘটনা কারও সাজানো এক মারাত্মক মানসিক খেলা? রুদ্র জানে, সময় কম—কারণ খুনি এবার স্পষ্ট করে দিয়েছে, পরবর্তী লক্ষ্য রুদ্র নিজেই!
১০
কলকাতার বর্ষার শেষ ভাগে চারদিকে একটা ধূসর ধোঁয়াটে আলো। লালবাজারের কনফারেন্স রুমে তখন রাত আটটা পেরিয়ে গেছে, কিন্তু আলো নিভছে না। অতনু বসু একা বসে আছেন, সামনে সাদা বোর্ডে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সব খুনের ছবি, সময়, স্থান, এবং সেই চিরচেনা বাক্য—‘আমাকে চেনো?’ আর পাশে সেই রহস্যময় সই। প্রতিটি খুন যেন একেকটা চিৎকার করে বলে উঠছে, “এই শহরের মাঝেই আছে সে, যে খেলছে আমাদের সবার সঙ্গে!” অতনু জানেন, আজ রাতেই তিনি শেষ খেলা খেলবেন। মোবাইল হাতে নিয়ে সে কল করেন শুধিরঞ্জন মুখার্জীর ছেলেকে—অভিষেককে। তাঁর চোখে অভিষেক এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে সম্ভাব্য ব্যক্তি যিনি এই কেসের মূল চরিত্র হতে পারেন। তাঁর আইনজীবী বাবার সই নকল করা, নিখোঁজ থাকা এবং খুনের ঘটনাগুলোর সময়ের সঙ্গে অভিষেকের গতিবিধির অদ্ভুত মিলে যাওয়ার প্যাটার্ন, সবই অতনুর মনে প্রশ্ন তুলেছে।
অভিষেক মুখার্জীকে অতনু যখন পৌঁছান হাজরার এক পুরনো বাড়ির সামনে, রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা। হালকা বৃষ্টির ফোঁটাগুলো বাড়ির ঝুঁকে পড়া কার্নিশ থেকে টুপটাপ করে পড়ছে। দরজা খুললেন একজন বৃদ্ধা—অভিষেকের মা। তিনি জানালেন, অভিষেক তিনদিন ধরেই ঘরবন্দি, মানসিক অবসাদে ভুগছেন। অতনু ধীরে ধীরে ঘরে প্রবেশ করেন। ঘরের ভিতরে বইয়ে ভরা একটি কক্ষের এক কোণে অভিষেক চুপচাপ বসে আছেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে, কোনো এক গভীর মানসিক দ্বন্দ্বে তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। অতনু প্রশ্ন করেন, “তোমার বাবার সই কীভাবে খুনের জায়গাগুলিতে পাওয়া যাচ্ছে? তুমি কি জানো কে এটা করছে?” অভিষেক হঠাৎ মুখ তুলে তাকিয়ে বলেন, “আপনি তো সব জানেন, আপনি এসেছেন বলেই বুঝেছি—শেষ সময় ঘনিয়ে এসেছে।” এরপর তিনি ধীরে ধীরে একটি খাম বাড়িয়ে দেন অতনুর হাতে। খামের ভিতরে একটি স্বীকারোক্তির চিঠি—যেখানে লেখা, কিভাবে অভিষেক তার বাবার অনুপস্থিতিতে আইনজীবী বাবার অফিসের স্ট্যাম্প, সইপ্যাড, এবং কিছু ক্লায়েন্ট তথ্য ব্যবহার করে তার ‘নৈতিক বিচার’-এর ধারায় একে একে কিছু মানুষের বিচার করেছে। তারা কেউই ‘আইন’-এর চোখে অপরাধী ছিল না, কিন্তু অভিষেকের চোখে তারা ছিল অপরাধী—যারা অর্থ, ক্ষমতা, প্রভাব খাটিয়ে আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে গিয়েছিল।
অভিষেককে গ্রেপ্তার করার মুহূর্তে অতনুর চোখে অদ্ভুত এক যন্ত্রণার ছাপ। একজন সুস্থ মনের মানুষ, শিক্ষিত আইনজীবীর সন্তান, কিভাবে এমন অন্ধ প্রতিশোধের পথে এগিয়ে গেল! অতনু জানতেন, অভিষেক একজন খুনি, কিন্তু তবু এই কেস তাঁকে একধরনের শূন্যতায় ভরে দিয়েছে। সাংবাদিকেরা ভিড় জমিয়েছিল লালবাজারের সামনে, কিন্তু অতনু তাড়াহুড়ো করেননি সংবাদ দিতে। সেদিন রাতে নিজের ডেস্কে বসে তিনি চুপচাপ হাতে এক কাপ চা নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন সেই সাদা বোর্ডের দিকে। প্রতিটি নোট এখন নিষ্প্রাণ কাগজমাত্র। ‘আমাকে চেনো?’—হ্যাঁ, এখন অতনু তাঁকে চেনেন, খুব ভাল করেই। সমস্যা হলো, তিনি চাননি এভাবে চিনতে। শহর নিঃশব্দে আবার নিজের ছন্দে ফিরছে, কিন্তু অতনুর মনে প্রশ্ন রয়ে গেল—কত অভিষেক এমন ঘুরে বেড়ায় আমাদের চারপাশে, বিচার না পেয়ে বিচারক হয়ে ওঠে? এবং আমরা কি সত্যিই চিনি আমাদের চেনা মানুষদের?
সমাপ্ত




