সৌম্যজিত লাহিড়ী
১
অক্টোবরের সূর্য তখন রক্তিম হয়ে অস্ত যাচ্ছে, বিষ্ণুপুর শহরের উপর ধীরে ধীরে নেমে আসছে পুজোর সন্ধ্যা। বাঁকুড়ার ধুলোমাখা পথ পেরিয়ে ঋষভ সেনগুপ্ত তার DSLR-টা কাঁধে ঝুলিয়ে নামল লোকাল বাস থেকে। বেশ কিছুদিন ধরেই সে পরিকল্পনা করছিল দুর্গাপুজোর এক বিশেষ সিরিজ করবে — শহর থেকে দূরে, লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা এমন পুজো, যেগুলো এখন কেবল ইতিহাসের পাতায় টিকে আছে। বিষ্ণুপুরের এক স্থানীয় গাইড তাকে বলেছিল, শহরের প্রান্তে একটা পোড়া রাজবাড়ি আছে যেখানে কোনো এক সময় দুর্গাপুজো হত, আজ আর কেউ যায় না, কিন্তু একটা প্রতিমা নাকি এখনও প্রতি বছর বানানো হয় এবং অল্প কিছু মানুষ সেখানে পুজো করে। কৌতূহলবশত সে সেই পোড়া রাজবাড়ির ঠিকানাটা খুঁজে বের করে, আর সেখানেই পা ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় — জানত না, এই ছবিগুলোই তাকে এমন এক দৃষ্টির ফাঁদে ফেলে দেবে, যেখান থেকে মুক্তি নেই।
রাজবাড়িটা ছিল প্রায় ধ্বংসস্তূপ, এককালে সম্ভ্রান্ত পরিবারের বসতবাড়ি, এখন কেবল ইট-বালির ছাইচাপা স্মৃতি। লাল পোড়া ইটের গায়ে জং ধরেছে, উঠোনে আগাছা গজিয়ে উঠেছে, আর ভাঙা দালানগুলোতে কাক আর বাদুড়ের বাসা। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, বাড়ির মধ্যবর্তী অংশে একটা ছাদের নিচে রাখা আছে মাটির তৈরি এক শ্যামল দুর্গাপ্রতিমা — পঞ্চপ্রদীপের আলোয় সামান্য দৃশ্যমান, অথচ থমথমে। প্রতিমার গঠন ঠিক তেমনই — দশভুজা, মহিষাসুরমর্দিনী, কিন্তু তার চোখের কাজ দেখে ঋষভ প্রথমেই থমকে যায়। প্রতিমার ডান চোখ খোলা, বাঁ চোখ আংশিক বন্ধ — যেন এক চাহনি আটকে আছে, আর সেটা ঠিক যেন তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে ভাবল, মৃৎশিল্পীর কারিগরি বৈচিত্র্য হতে পারে, কিন্তু যখন সে ক্যামেরা তোলার জন্য সামনে দাঁড়ায়, হঠাৎ একটা অনুভব হয় — এই চোখ কি সত্যিই তাকিয়ে আছে আমার দিকেই?
ছবি তোলার সময় ঋষভ বেশ কিছু কোণ থেকে শট নেয় — সামনে থেকে, পাশে থেকে, নিচু অ্যাঙ্গেল থেকে। প্রতিমার আলোর সাথে প্লে করতে সে ফ্ল্যাশ অফ করে, কেবল ন্যাচারাল লাইটে কাজ করে। কিন্তু প্রতিবারই ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারে তাকিয়ে দেখে, প্রতিমার সেই এক চোখ যেন একই জায়গায় ঠিক তার চোখে চোখ রাখছে। প্রথমে এটা তার কল্পনা ভেবেছিল — আলোর প্রতিফলন, অথবা অ্যাঙ্গেলের বিভ্রান্তি। কিন্তু তোলা ছবিগুলো ডিএসএলআরের স্ক্রিনে ফিরে ফিরে দেখতে গিয়ে তার গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে। যত কোণেই ছবি তুলুক না কেন, প্রতিমার চোখ তার দিকেই। চমকটা তখনও শেষ হয়নি — হঠাৎ একটা শটের ব্যাকগ্রাউন্ডে সে দেখে, কোনো অচেনা মুখ প্রতিমার পায়ের কাছে বসে আছে — অথচ সে শটটা তুলেছিল একেবারে একা!
ঘাম জমে যায় ঋষভের কপালে, কিন্তু সে নিজের যুক্তিবোধকে আঁকড়ে ধরে। হয়তো ভুল দেখছে, হয়তো ত্রুটি এসেছে ক্যামেরায়। সে আবার তাকায় — এবার নেই কিছু। হয়তো ধুলোর প্রতিফলন, হয়তো নিজের ক্লান্তি। কিন্তু তার পরেও, সে ছবিগুলো একে একে দেখে — প্রতিমার চোখের চাহনি যেন স্থির, অথচ জীবন্ত। ঠিক যেন ক্যামেরা ফ্রেম ভেদ করে সে নিজে তাকিয়ে আছে একজন মানুষের চোখে চোখ রেখে। প্রতিমার এক চোখই শুধু খোলা — আর সেই চোখটা যেন তার সঙ্গে কথা বলছে। “তুই এসেছিস… তোকে চিনি।” এমন অনুভব বারবার মাথায় ফিরে ফিরে আসে। দিনের আলো কমে গেলে সে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু যাওয়ার সময় বারান্দা দিয়ে নামতে গিয়ে পিছন ফিরে একবার দেখে — প্রতিমার সেই চোখে এবার কেমন যেন বিদ্রূপের ঝিলিক! ঠিক যেন চোখের ভাষায় বলে উঠল, “তুই ফিরবি। এই খেলাটা এখনও শেষ হয়নি।”
২
পরদিন সকালে হালকা কুয়াশার চাদরে মোড়ানো বিষ্ণুপুর যেন ঘুমচোখে তাকিয়ে ছিল ঋষভের দিকে। মাথা কিছুটা ভার হয়ে ছিল আগের রাতের সেই প্রতিমার চোখের স্মৃতিতে। তবুও পেশাদার মনোভাব নিয়ে সে আবার ফিরে গেল রাজবাড়িতে — এই বার ক্যামেরা নয়, শুধু একটি নোটবুক আর টর্চ নিয়ে। বাড়ির মূল অংশ থেকে একটু দূরে থাকা উত্তর-পূর্ব কোণার একটি ভাঙাচোরা করিডোরে তার চোখ আটকে যায়। ইটবাঁধানো দেওয়ালে একটা চওড়া ফাটল, যার মাঝখান থেকে আগাছা গজিয়ে উঠেছে। সে এগিয়ে গিয়ে হাত দিয়ে ধুলো সরাতে বোঝে, ওটা আসলে একটা পুরনো খোলা সিঁড়ির মুখ — তবে ধ্বংসস্তূপে ঢেকে পড়েছে। ধীরে ধীরে মাটি ও পাথরের টুকরো সরিয়ে বেরিয়ে আসে এক ধাতব রেলিং, আর নিচে নামা একটি সংকীর্ণ সিঁড়ি — যার প্রথম কয়েকটা ধাপ ভাঙা হলেও বাকি অংশ অনেক নিচে নেমে গেছে। নিচে থেকে আসছে ঠান্ডা হাওয়া, আর কোথাও কোথাও যেন হালকা ধূপের মত গন্ধ। এটা কি শুধু কৌতূহল, না কি কারও ইচ্ছার ডাক — ঋষভ বুঝতে পারে না।
সেদিন সন্ধ্যেয় শহরের এক পুরনো লাইব্রেরির বাইরে অপেক্ষা করতে করতে ঋষভের দেখা হয় অমৃতা পালের সঙ্গে। অমৃতা বিষ্ণুপুর মিউজিয়ামে কাজ করে, লোকগাথা ও স্থানীয় স্থাপত্য বিষয়ে তার বিশেষ আগ্রহ। ঋষভ প্রথমেই বলে বসে — “তুমি কি জানো পোড়া রাজবাড়ির নিচে একটা গোপন সিঁড়ি আছে?” অমৃতা প্রথমে একটু চমকে ওঠে, তারপর নিচু গলায় বলে — “তুমি কি নিচে নেমেছিলে?” ঋষভ মাথা নাড়ে। “এখনও না। শুধু মুখটা খুঁজে পেয়েছি।” অমৃতার চোখে ভয় আর উত্তেজনা একসঙ্গে ফুটে ওঠে। সে জানায়, বহু বছর আগে সেই রাজবাড়িতে দুর্গাপুজোর পাশাপাশি চলত এক নিষিদ্ধ শ্যামা পূজা — যার উৎসর্গ ছিল রক্ত। সেই পুজোর প্রধান পুরোহিত এক রাতে খুন হন গর্ভগৃহের ভেতরে, যেখানে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হতো না। ঘটনাটিকে পর্দার আড়ালে রেখে দেওয়া হয়, আর এরপর থেকেই পুজো বন্ধ হয়ে যায় — কেবল কিছু ঘরোয়া নিয়মে টিকে থাকে প্রতিমা বানানোর রীতি। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কথা ছিল এই যে, গ্রামের প্রবীণেরা বলে থাকেন, সেই গর্ভগৃহ এখনও রক্ত চাই — আর যেই সেখানে যায়, ফিরে আসে পাল্টে যাওয়া একজন হয়ে।
ঋষভ আর অমৃতা একসাথে সিদ্ধান্ত নেয়, পুরনো দলিল, খাতা আর ফাইল ঘেঁটে দেখবে, যদি এই ইতিহাসের পেছনের সত্য কিছু জানা যায়। অমৃতা তাদের মিউজিয়ামের পুরাতন সংগ্রহশালায় নিয়ে যায় — যেখানে ধুলোমাখা কাঠের আলমারিতে বহু পুরনো জমির দলিল, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র, পুজোর রেজিস্টার ও স্থাপত্য পরিকল্পনার কপি সযত্নে সংরক্ষিত। তাদের চোখ আটকে যায় ১৮৭৩ সালের একটি অতি পুরাতন নথিতে — রাজপুরোহিত শিবদাস মুখার্জির হাতে লেখা একটি চিঠি, যেখানে তিনি বলেন, “গর্ভগৃহে প্রবেশ রুদ্ধ করা হোক, কারণ দেবী এখন চেতনার অতীত স্তরে প্রবেশ করেছেন। উনি রক্ত চান — কিন্তু তা হতে হবে বংশধরের, যিনি জন্মের রেখা দিয়ে বাঁধা।” এই লাইন পড়েই ঋষভ হঠাৎ স্থির হয়ে যায়। কীভাবে সম্ভব? এই ‘রক্তের রেখা’ কথাটা সে আগে শুনেছে, কিন্তু কোথায় মনে করতে পারে না। এর পরের পাতায় ছিল একটা প্রাথমিক মানচিত্র, যেখানে দেখানো ছিল রাজবাড়ির নিচে একটি ‘আন্তর্গৃহ’ বা অভ্যন্তরীণ স্তর — সিঁড়ির অবস্থান প্রায় হুবহু সেই জায়গাতেই, যেখানটায় সে ফাটলটা পেয়েছিল।
ফাইল বন্ধ করে যখন তারা বাইরে আসে, তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে। আকাশে ধূসর মেঘ, হালকা বাতাসে ধুপধুপ শব্দে নড়ে উঠছে পাতাঝরা গাছের ডাল। ঋষভের বুকের ভিতর একটা অদ্ভুত আলোড়ন চলছে — যেন তার শরীরের রক্ত সাড়া দিচ্ছে সেই গর্ভগৃহের ডাককে। সে নিজেকে বোঝায়, এ কেবল ইতিহাস নয় — তার নিজের মধ্যেও আছে কিছু প্রশ্ন, যা এই রাজবাড়ির সঙ্গে বাঁধা। অমৃতা একটু ইতস্তত করে বলে, “যদি কাল সকালে নামার চেষ্টা করি, সেভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। সেখানকার বাতাস বিষাক্তও হতে পারে।” কিন্তু ঋষভ এর মধ্যেই স্থির করে ফেলেছে — পরদিন সে একবার অন্তত নিচে নামবে। প্রতিমার চোখের সেই নির্লজ্জ দৃষ্টি যেন তাকে ঠেলে দিচ্ছে অজানার মুখোমুখি হওয়ার জন্য। আর কোথাও যেন একটা চেতনা কানে কানে বলে যাচ্ছে — “তুই নিজেকে দেখবি, কিন্তু আয়নার ভেতর নয়… মাটির নিচে।”
৩
রাত গভীর হলে বিষ্ণুপুরের বাতাসে কেমন যেন একটা ঘন নিস্তব্ধতা জমে ওঠে — যে নীরবতা শহরের নয়, বরং মাটির নিচ থেকে উঠে আসা অতীতের। সেই রাতে, হোটেল ঘরে বিছানায় শুয়ে থেকেও ঋষভ ঘুমোতে পারছিল না। চোখ বন্ধ করলেই প্রতিমার সেই ডান চোখ যেন তার মস্তিষ্কের ভিতর দিয়ে চিরে চিরে ঢুকে যাচ্ছিল — চোখ নয়, যেন অভিশাপ। হঠাৎ এক সময় অদ্ভুতভাবে তার শরীর ভারী হয়ে এল, যেন কারও উপস্থিতি ঘরের কোণে ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঘুম আর জাগরণের মাঝখানে সে দেখতে পেল এক বৃদ্ধা মহিলা ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছেন — মুখে শান্ত এক ভয়ানক হাসি, গায়ে মলিন সাদা শাড়ি, চোখে অনন্তের খোঁজ। তিনি কেবল একবার বললেন, “রক্তের রেখা এখনও শুকায়নি… তোকে ফিরতেই হবে।” কথাটা উচ্চারণ করেই যেন পুরো ঘরটা ধ্বনিত হয়ে উঠল সেই বাক্যে। ভয়ে ঋষভ ঘামাঘামি অবস্থায় জেগে ওঠে, তার বুক ধুকপুক করছে, ঘরের আলো জ্বালিয়ে দেখে, কেউ নেই — কিন্তু বাতাসে এখনও সেই গন্ধ, ধূপ আর পুরোনো কড়ির মতো কিছু যেন ভেসে বেড়াচ্ছে।
পরদিন সকালে হোটেলের রিসেপশন থেকে বেরিয়ে আসতেই সে দেখে, গলির মোড়ের এক বৃদ্ধা দোকানদার শান্তভাবে বোধহয় সব কিছু জানেন এমনভাবে তাকিয়ে আছেন। ঋষভ একটু কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “রাজবাড়ির রাণী মন্দাকিনী দেবী কি এখনও বেঁচে আছেন?” বৃদ্ধা চমকে ওঠেন না, শুধু নিচু স্বরে বলেন, “বেঁচে তো আছেন… কিন্তু মানুষ না ছায়া, ঠিক বলতে পারব না। কতো বছর কেউ দেখেনি ওঁকে, কিন্তু রাত গভীরে কারা যেন বলেন, জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। কথা বলেন না, শুধু তাকিয়ে থাকেন।” ঋষভের শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। তার স্বপ্নের সেই মুখ কি বাস্তবেই এই মন্দাকিনী? কেমন করে তার সামনে এলেন তিনি? কিছুতেই মিল পাচ্ছিল না — নাকি বাস্তব ও স্বপ্নের সীমা পেরিয়ে কিছু এগোতে শুরু করেছে?
রাজবাড়িতে সেইদিন বিকেলবেলা সে আবার ফিরে যায়, এইবার সিঁড়ির নিচে নামার প্রস্তুতি নিয়ে। একটি হেড টর্চ, মাস্ক, দড়ি আর ছোট একটা কাঠের মুগুর সঙ্গে নেয় — যদি নিচে কিছু পড়ে থাকে। সিঁড়ি নামতে নামতে সে টের পায়, ধুলো আর স্যাঁতসেঁতে গন্ধ ছাড়াও একটা অদ্ভুত কাঁপুনি জেগে উঠছে ভিতরে — যেন মাটির নিচ থেকে কেউ নিঃশ্বাস ফেলছে তার গলায়। নীচে নেমে আসে এক সেমি-সার্কুলার ঘরে — ঘরের গা ঘেঁষে পাথরের অলংকরণ, ভাঙা মূর্তি আর দেয়ালে কিছু প্রাচীন লেখা। কিন্তু তার দৃষ্টি আটকে যায় মাঝখানে রাখা এক ক্ষুদ্র মূর্তিতে — প্রায় আধফুট লম্বা, কিন্তু কী ভয়ানক দৃঢ়তায় স্থাপন করা! সেটা ছিল কালীমূর্তি — কিন্তু সাধারণ কালী নয়, এক অদ্ভুত রূপ, যাঁর গলায় ছিল না খুলি, ছিল রক্তপাতের ছাপ, জিভ বেরোনো নয়, বরং মুখে নিঃসাড় এক মৃদু হাসি, আর সবচেয়ে আশ্চর্য — তাঁর ডান চোখ খোলা আর বাঁ চোখ বন্ধ।
মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে মনে হল, যেন সেটা একধরনের প্রতিবিম্ব — বড় প্রতিমার, বা হয়তো দেবীর অন্য এক রূপ। ঋষভ ওটা তুলতে যায়, কিন্তু ছুঁতেই গায়ে বিদ্যুৎ খেলে যায় — যেন কিছুর সাথে সংযোগ তৈরি হয়ে গেল হঠাৎই। একটা দৃশ্য চোখে ভেসে ওঠে — এক গর্ভগৃহ, রক্তস্রোত, কালীঘোরে নাচছে মুখ ঢাকা সন্ন্যাসীরা, আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে সেই বৃদ্ধা — চোখ তুলে তাকিয়ে বলছেন, “শ্যামার আহ্বান একবার এলে ফেরানো যায় না।” ঋষভ হঠাৎই ধপ করে মাটিতে পড়ে যায়। মাথা ঘুরছে, শ্বাস নিতে পারছে না ঠিকমতো, কিন্তু মূর্তিটার চোখে তাকিয়ে একটা কথা মনে পড়ছে — “রক্তের রেখা শুকোলে পুজো থামে। না শুকোলে ফেরে উৎসর্গ।” ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, মাটির কোণে কি একটা নড়ছে। টর্চ মারতেই সে বোঝে — অন্ধকারের ভিতর কোথাও, একজোড়া চোখ তাকিয়ে আছে — আবার সেই একই দৃষ্টি। প্রতিমার চোখ? না মূর্তির? নাকি মন্দাকিনীর?
৪
চতুর্থ দিনে ঋষভ আরও অস্থির বোধ করছিল — রাজবাড়ির সিঁড়ির নিচে পাওয়া সেই কালীমূর্তির ডান চোখের চাহনি যেন তার ভিতরের আলো-আঁধারির সীমা ঘেঁটে দিচ্ছিল। সে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, এই চোখের রহস্যটা কী — কেন বারবার ডান চোখই খোলা থাকে, এবং বাঁ চোখ থাকে আধা বন্ধ। এই প্রতিকৃতি কি নিছক কোনো রীতির ব্যতিক্রম, নাকি এর পেছনে আছে এক নিষিদ্ধ তন্ত্রচর্চার ইতিহাস? ঠিক সেই সন্ধ্যায়, যখন ঋষভ বিষ্ণুপুরের এক চায়ের দোকানে বসে খাতা নেড়েচেড়ে কিছু আঁচ করতে চাইছে, তার সঙ্গে পরিচয় হয় এক মধ্যবয়স্ক মানুষ — যিনি নিজেকে পরিচয় দেন রুদ্রনাথ চক্রবর্তী বলে। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, গলায় নানারকম পুঁতির মালা, চোখে কাচের ফ্রেমের চশমা, আর কথার মধ্যে যেন ইতিহাসের ধুলো জমে থাকে। রুদ্রনাথ বলেন, তিনি একজন লোক-ইতিহাসবিদ এবং বহু বছর ধরেই বিষ্ণুপুরের রাজবাড়ি নিয়ে গবেষণা করছেন। ঋষভ অবাক হলেও তার দিকে মনোযোগ দেয়, কারণ এই মানুষটা জানেন অনেক কিছু, যেগুলো কেউ প্রকাশ্যে বলে না।
রুদ্রনাথ এক কাপ চায়ের বদলে বলে বসেন, “তুমি যদি সত্যিই জানতে চাও কেন এক চোখ, তবে তোমাকে সেই পুঁথি পড়তে হবে যা রাজপুরোহিত শিবদাস নিজে লিখে রেখে গিয়েছিলেন। এই পুঁথি আজও সরকারি আর্কাইভে নেই — আমি নিজেই খুঁজে পেয়েছি এক পুরোনো দাতব্য লাইব্রেরির গুদামে।” তিনি ব্যাগ থেকে বের করেন এক বাদামি কাপড়ের মোড়া ধূলিধুসরিত খাতা — হাতের লেখা পটচিত্রের মত আঁকা, প্রতিটি শব্দে লুকিয়ে আছে শ্লোক আর ছায়া। ঋষভ মোহগ্রস্তের মতো পড়ে যেতে থাকে সেই লেখার দিকে। শুরুতেই লেখা — “এই পুজো দেবী দুর্গার নয়, তিনি শ্যামা — যিনি কালীর আদিরূপ, রক্তস্বরূপ, যিনি শুদ্ধ রক্তে জাগেন, কিন্তু অসম্পূর্ণ আহ্বানে তিনি অসন্তুষ্ট হন। আহ্বান করার পর পেছনে ফিরে দেখা নিষেধ, এবং তাঁর এক চোখই খোলা রাখা হয়, যাতে তাঁর জাগরণ পূর্ণ না হয়।” এই অংশ পড়ে ঋষভের হৃদপিণ্ড কাঁপতে থাকে। সে যেন এক নতুন দেবীর মুখোমুখি হয়েছে — যে আরাধ্য নন, বরং ভয়ানক, নিয়ন্ত্রিত নয় বরং দাবিদার।
পুঁথির ভিতর আরও লেখা ছিল — রাজবাড়ির প্রাচীন তান্ত্রিক শাখার সদস্যরা প্রতি অষ্টমীর রাতে গর্ভগৃহে রক্তপূর্ণ উৎসর্গ করতেন — তা পশু নয়, মানব রক্ত, যা রাজপরিবারের বংশধরদের মধ্য থেকে নির্বাচিত হত। কিন্তু এক বছর সেই রীতিতে বাধা পড়ে — যখন এক পুরোহিত উৎসর্গের বদলে নিজের পুত্রকে বাঁচিয়ে দেন এবং গোপনে মূর্তির চোখ দুটোই বন্ধ করে দেন। ফলস্বরূপ দেবী চঞ্চল হয়ে ওঠেন, এবং ওই রাতেই গর্ভগৃহের দরজা ভেঙে পড়ে এক রক্তস্নাত ঝড় — যেটিকে লোকমুখে ‘শ্যামার রক্তরাত্রি’ নামে ডাকা হয়। এরপর থেকে নিয়ম করা হয়, শুধু এক চোখ খোলা থাকবে, যাতে জাগরণ অসম্পূর্ণ হয় এবং পূর্ণ আহ্বান না ঘটে। কিন্তু সেই পুরোহিত শিবদাস নিজেই লেখেন — “জন্মরেখায় বাঁধা রক্ত একদিন ফিরে আসবেই। দেবী যা চান, তা পায়। এ বন্ধন সময়ের নয়, আত্মার।” এই বাক্যটা পড়ে ঋষভ যেন নিজের শরীরে কাঁটা দিয়ে অনুভব করে — এক অদৃশ্য বাঁধনে সে নিজেই জড়িয়ে যাচ্ছে।
রুদ্রনাথ এরপর গভীর গলায় বলে ওঠেন, “এই পুজোর কাহিনি শুধু ইতিহাস নয়, এটা অভিশাপের উত্তরাধিকার। তুমি যখন ওই মূর্তির দিকে তাকিয়েছিলে, সে তখন তোমাকে চিনে নিয়েছে। প্রতিমার চোখ শুধু ছবি তোলার জন্য খোলা নয়, সেটা ডাকে। আর তুমি এসে গেছো — এখন আর ফিরতে পারবে না।” ঋষভ স্তব্ধ হয়ে যায়। সে জানে না, রুদ্রনাথ ভয় দেখাচ্ছেন নাকি সতর্ক করছেন। কিন্তু তার ভিতরে কোথাও যেন কিছু দুলে ওঠে — সেই স্বপ্নের বৃদ্ধা, মাটির নিচে পাওয়া মূর্তি, এক চোখ খোলা দৃষ্টি — সব যেন এক রহস্যময় ছকে বাঁধা। সে মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করে — এই শ্যামা কি কালী? না কি কালী নামে আমরা যাকে জানি, তার আগে এক রক্তলোলুপ ছায়া ছিল? যদি সত্যি হয় এই দেবী এখনও জেগে আছেন, তবে কেন অপেক্ষা করছেন কারও রক্তের জন্য? আর সেই কারো মধ্যে কি সত্যিই সে নিজেই পড়ে যায়? উত্তর অজানা, কিন্তু তেমনই অস্বস্তিকর। আর এই প্রশ্ন নিয়েই সে ফিরে যায় হোটেলে, আর জানালার বাইরের আঁধারে মনে হয় — কেউ তাকিয়ে আছে এক চোখে… শুধু তার দিকেই।
৫
ঋষভের মন তখন ঘুরপাক খাচ্ছে পুরোহিত শিবদাসের পুঁথির প্রতিটি লাইনের অর্থ নিয়ে। সেই রাতে, সে তার ল্যাপটপ খুলে বসে এবং রাজবাড়ির ভিতরে তোলা ছবিগুলি আবার খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করে — কিন্তু এবার অন্যরকম দৃষ্টিতে। আগেই সে জানত, কিছু ছবিতে লেন্সের গ্লিচ বা লাইট রিফ্লেকশনের কারণে অদ্ভুত ছায়া বা দাগ দেখা যেতে পারে। কিন্তু এইবার, যেসব ছবি আগে কেবল ধুলোবালির ছায়া মনে হয়েছিল, সেগুলির মধ্যে অনেক স্পষ্টতা চোখে পড়ে। একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটি ছোট বালিকার মতো অবয়ব — মাথা নিচু করে মাটিতে বসে আছে প্রতিমার ডান পায়ের কাছেই, তার গা থেকে যেন রক্তের দাগ মাটির দিকে গড়িয়ে পড়ছে। আরেকটায় দেখা যায়, গর্ভগৃহের গা ঘেঁষে শুয়ে আছে মানুষের মতো একটি ছায়ামূর্তি — মুখ ঢাকা, চোখ বন্ধ, আর শরীর যেন রক্তে রাঙা। ঋষভ বারবার জুম করে, চোখ কচলে দেখে, কিন্তু তবুও ওই ছবির ছায়াগুলি মুছে যায় না। এমনকি সে চেষ্টা করে ফটো এডিটিং সফটওয়্যারে চেক করতে — কোনো ওভারলে বা এক্সপোজারের কারচুপি আছে কিনা — কিন্তু না, সবই বাস্তব ফ্রেমে ধরা পড়েছে।
তারপরে ঘটে আরেকটি অস্বাভাবিক ঘটনা। রাত প্রায় দুটো নাগাদ, হোটেলের বাথরুমে পানি নিতে গিয়ে সে দেখে কল থেকে পানি নয়, অদ্ভুত লালচে তরল পড়ছে — যা প্রথমে সে ‘জংধরা’ জল ভেবেছিল, কিন্তু তার গন্ধে ছিল একধরনের ধাতব আচ্ছাদিত গন্ধ — যা রক্তের মতো। সে অবাক হয়ে কল বন্ধ করে, আলো জ্বালিয়ে ভালো করে দেখে — কিন্তু এখন জল স্বাভাবিক। কিছুক্ষণ পর, আবার সে পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে আয়নার কাচে জলের ফোঁটা পড়ে লেখা — “তোকে ডেকেছে…”। মুহূর্তের মধ্যে ঋষভ পেছনে ঘুরে দাঁড়ায় — কেউ নেই। আতঙ্ক ও অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বে সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর আয়নার সামনে হাত বুলিয়ে দেখে — জল ফোটার মতো কিছুই নেই। নিজেকে বোঝায়, হয়তো ক্লান্তি থেকে এই সব ভ্রম। কিন্তু তারপর যখন সে ল্যাপটপ বন্ধ করে বিছানায় বসে, তখন আবার তার ফোনে অটো ওপেন হয় সেই ছবি — যেখানে শিশুটির চোখ এখন ক্যামেরার দিকে তাকানো।
পরদিন সকালে, অমৃতার মুখ দেখে ঋষভ আঁচ করে — কিছু একটা ঘটেছে। অমৃতা ধীরে ধীরে বলে, “কাল রাতে ঘুম ভাঙে… মনে হচ্ছিল যেন আমার নাম ধরে কেউ ডাকছে। প্রথমে মা ভেবেছিলাম, কিন্তু তখন মনে পড়ল আমি একা ঘরে। তারপর দরজার কাছে কান পাততেই একটা চাপা আওয়াজ শুনতে পেলাম — একটা ঘষা ঘষার শব্দ আর ফিসফিসানি — ‘তোর রক্ত চায়…’” অমৃতার গলা কাঁপছিল, চোখে একরাশ অবিশ্বাস। “কিন্তু দরজা খুলে কিছু দেখলাম না… শুধু বাইরে মেঝেতে একটা ছোট হাতের ছাপ, লাল রঙে আঁকা — ঠিক যেন কোনো শিশু মাটি ছুঁয়ে হেঁটেছে।” ঋষভ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর তার ল্যাপটপ থেকে শিশুটির সেই ছবিটা অমৃতাকে দেখায়। সে আঁতকে ওঠে, “ঋষভ! এটা তো… আমি ঠিক এমনটাই দেখেছি!” তাদের দুজনের চোখে তখন আর কোনো সংশয় নেই — এই রাজবাড়িতে কেবল ইতিহাস নেই, আছে এক আশরীর আত্মা — যাকে কেউ থামাতে পারেনি, এবং এখন সেই ছায়া যেন তাদের পিছু নিচ্ছে।
ঋষভ এরপর সিদ্ধান্ত নেয় — তাকে আরও গভীরে যেতে হবে। শুধুমাত্র ছবি নয়, তার মনেও সেই বিভ্রম ঢুকছে। রাজবাড়ির মন্দির চত্বরেই হয়তো রয়েছে সেই সত্য যা চোখে ধরা দেয় না, কিন্তু কোনওভাবে ক্যামেরা বা অন্তরাত্মা বুঝে ফেলছে। সে জানতে চায়, কে এই শিশু? কেন সে কাঁদছে? আর কীভাবে তার রক্ত চাওয়া হচ্ছে? ছবির একটিতে গর্ভগৃহের ছায়ার সামনে ছোট হাত দিয়ে কিছু আঁকা ছিল — যেন কারও নাম, কিন্তু অসম্পূর্ণ। সে ছবি জুম করে একটি শব্দ বের করতে পারে — “ভূমি”। এই নাম যেন কোথাও শুনেছে সে — কিন্তু ঠিক মনে করতে পারে না। এদিকে অমৃতা বলেও ফেলে, “আমাদের এখানে একটা ছায়ার মতো মেয়ে ঘোরে বলেই অনেক পুরোনো লোকেরা বলে — নাম নাকি ভূমি, কিন্তু রাজপরিবারে এমন কেউ ছিল না বলেই কথাটা গুজব ভাবা হত। তবে বৃদ্ধা মহারানী মাঝে মাঝে ঘোরের মধ্যে ‘ভূমি, আমার মেয়ে’ বলে কান্নাকাটি করতেন বলে শোনা যায়…” এই কথায় ঋষভ হঠাৎ বুঝতে পারে — বিষয়টা কেবল পূজার ইতিহাস নয়, এটা একটা চেপে রাখা অপরাধ, হয়তো রাজপরিবারেরই কোনো নিষিদ্ধ সন্তান — যাকে দেবী শ্যামার কাছে উৎসর্গ করা হয়েছিল, এবং সেই আত্মা এখনও মুক্তি পায়নি।
৬
ঝড়জলের রাত। মন্দিরচত্বর যেন কোনও অদৃশ্য শাস্তির ভারে থমকে আছে। সেই অন্ধকারে ঋষভ ধীরে ধীরে পা ফেলে পৌঁছায় মূল গর্ভগৃহের দ্বারে — যেখানে বাতাস ভারী, আর প্রতিটি শ্বাসে যেন ধূপ, চন্দনের সাথে মিশে আছে রক্তের পুরনো গন্ধ। তার পেছনে অমৃতার পায়ের শব্দ, কিন্তু এই মুহূর্তে সে একা অনুভব করে নিজেকে। সে হাত বাড়িয়ে দরজায় চাপ দেয়, আর তখনই এক অদ্ভুত শীতলতা ছড়িয়ে পড়ে সারা গায়ে। দরজা খুলে গেলে যে দৃশ্য সে দেখতে পায়, তাতে দম বন্ধ হয়ে আসে — প্রতিমার সামনে বসে আছেন এক বৃদ্ধা, সাদা ধুতি আর অলংকারে মোড়া, যেন কালো ছায়া আর আলো একসাথে তাঁর চারপাশে কুণ্ডলী পাকিয়েছে। তিনি ধীরে ধীরে মুখ তুলে বলেন, “তুই ফিরে এসেছিস… ক’বার মরবি এবার?” সেই কণ্ঠে কোনও রাগ নেই, ছিল একটা করুণ অথচ শীতল শাসনের স্পর্শ। ঋষভ স্তব্ধ হয়ে যায় — এই মহিলাই কি মন্দাকিনী দেবী? যার নাম শুনে গ্রামের লোকেরা ভয় পায়? যার মুখ নাকি কখনো কেউ আজ পর্যন্ত পরিষ্কার দেখেনি?
মন্দাকিনী ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ান, তাঁর গলায় ঝোলানো তাম্র লকেটটি ঝনঝন শব্দ তোলে — যেন পুরনো কোনও ঘন্টা বাজল। “তুই জানিস না, তোর চোখ যে চোখ না, সেটা জন্মে থেকেই তোর অন্তরে লেখা ছিল। তুই ছবি তোলে, কারণ তোর ক্যামেরা সত্যি দেখে। কিন্তু তোর আত্মা — সেটা তো সেই চোখই, যা একদিন আমার কোল থেকে ভূমিকে কেড়ে নিয়েছিল।” ঋষভ অবাক হয়ে পিছিয়ে যায়। ভূমি… সেই নাম আবার ফিরে এল! সে জানতে চায়, কে এই ভূমি? আর কেন বারবার তার সামনে এই নাম, এই মুখ, এই বিভ্রম? মন্দাকিনী বলেন, “ভূমি ছিল নিষিদ্ধ, কিন্তু সে রক্ত ছিল রাজবংশেরই। তাকে উৎসর্গ করা হয়েছিল মহাশক্তির আরাধনায় — পিতার আসনে বসে ছিল তোরই পূর্বপুরুষ, রাজপুরোহিত অনন্ত রুদ্রশর্মা। সে-ই প্রথম এই নিষিদ্ধ পুজোর সূচনা করে, এবং ভূমিকে বলি দিয়ে দেবীর কৃপা আনতে চায়। দেবী কিছুই বলেননি তখন — কিন্তু তার প্রতিমার চোখ… তোর মত করেই তাকিয়ে ছিল। সেই চোখ ভুলে গেছিস তুই? ভুলে গেছিস, কিভাবে তোর আত্মা পুড়েছে জন্ম থেকে জন্মান্তরে?” ঋষভ স্তব্ধ, কিন্তু মনে পড়ে তার ছোটবেলায় দেখা বিভ্রম — রক্তাক্ত সিঁড়ি, শিকল বাঁধা শিশু, ঘুমের মধ্যে পায়ের ধ্বনি — সব যেন এখন যুক্ত হতে শুরু করেছে।
মন্দাকিনী তখন তার দিকে এগিয়ে এসে চোখের দিকে তাকান। “তোর মধ্যে সেই চোখ এখনো আছে। তুই দেখতে পাস, কারণ তুই দণ্ডভোগ করছিস। জন্মে জন্মে ফিরে এসে — ছবি তোলে, আর আবার হারিয়ে যায়। ভূমি তোকে ডাকছে — তার রক্ত, তার কান্না, তার অভিশাপ। তুই যদি এ জন্মে শেষ করতে না পারিস, তবে আবার ফিরতে হবে। প্রতিমার চোখ তো শুধু পাথরের নয় — সেটাই তো সাক্ষী, সাক্ষ্য আর দণ্ডের উৎস। শ্যামা এখানে কৃপাময়ী নন, তিনি রক্তের স্মৃতির ধারক।” মন্দাকিনীর কথায় যেন চারপাশের বাতাস ঘন হয়ে ওঠে। হঠাৎ প্রতিমার চোখের দিকে তাকাতেই ঋষভের মাথায় ঘুরতে থাকে দৃশ্য — লাল কাপড় জড়ানো শিশু কাঁদছে, এক রাজপুরোহিত বেদীতে মন্ত্রপাঠ করছে, আর ছুরির নিচে জমে আছে ভূমির চোখের জল। সে হাঁপাতে থাকে, ঘামতে থাকে — সব যেন এক সেকেন্ডে ভেসে উঠছে তার দৃষ্টিতে। প্রতিমার চোখে প্রতিফলিত সে নিজেকে দেখে — কিন্তু পরনে রাজপুরোহিতের পোশাক, হাতে রক্তমাখা কুড়ুল। সে যেন ফিরে গেছে সেই অভিশপ্ত জন্মে, যেখানে ভূমি তার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “তুমি কেন?”
হঠাৎ সে চিৎকার করে ওঠে, অমৃতা তাকে ধরে ফেলে। মন্দাকিনী তখন ধীরে ধীরে ফিরে যান ছায়ার মধ্যে, আর পেছনে রেখে যান একটি বাক্য — “তোর চোখই তো শাস্তি, এখন দেখ… সবকিছু।” তারপরেই মন্দিরের আলো নিভে যায়, অন্ধকারে কেবল প্রতিমার চোখ জ্বলজ্বল করে — যেন পাথরের ভিতর থেকেও সবকিছু দেখছে, বিচার করছে, আর মনে রাখছে কার কী শাস্তি বাকি। ঋষভের মনে হয়, হয়তো এবার সত্যি তাকে মুক্তি পেতে হলে সেই পাপের মূল অবশেষটুকু প্রকাশ করতেই হবে — ভূমির রক্তের ইতিহাসকে সামনে আনতে হবে, তার প্রতিচ্ছবি নয়, পুরো সত্যের মুখ। কারণ যদি না আনে, তবে হয়তো সে আবার ফিরে আসবে — আবার ক্যামেরা হাতে, আবার প্রতিমার চোখে নিজেকে দেখতে দেখতে। জন্মান্তরের এই ফাঁদ থেকে মুক্তি নেই, যতক্ষণ না শেষ সত্যটি সামনে আসে — এবং সে দণ্ড গ্রহণ করে তার দৃষ্টির শক্তির জন্য।
৭
ঋষভের রাত কাটছিল আতঙ্ক আর প্রশ্নে। ক্যামেরার লেন্সের ভেতর যে ছবি ধরা পড়ে, আর বাস্তবের চোখে যা সে দেখছিল — তার মিল ছিল না, অথচ অমিলও ছিল না। এমন সময়েই মিউজিয়ামের গবেষক অমৃতা তাকে জানায় রুদ্রনাথ চক্রবর্তীর অদ্ভুত আচরণের কথা — সে প্রায়ই অদৃশ্য হয়ে যায়, তার সংগ্রহে থাকা কিছু প্রাচীন তান্ত্রিক পুঁথি রক্ষা করার নামে সে রাজবাড়ির গোপন প্রকোষ্ঠে ঘুরে বেড়ায়। সন্দেহ গাঢ় হয়, যখন তারা আবিষ্কার করে, শিবদাস পুরোহিতের শেষ পুঁথির একটি পাতায় লেখা আছে — “যার রক্তে কলঙ্ক জন্মেছে, সেই রক্তেই শুদ্ধি আসবে। একবার চক্র সম্পূর্ণ হলে, শ্যামা স্বয়ং রক্ত গ্রহণ করবেন উৎসর্গ থেকে।” অমৃতা আর ঋষভ তখনই স্থির করে, সত্য উন্মোচন না হওয়া পর্যন্ত এই শহর তারা ছাড়বে না — যদিও তারা জানত না, সেই সত্য তাদের ঠিক কতটা গভীর অন্ধকারে টেনে নিয়ে যাবে।
ঋষভ এক রাতে চুপিচুপি রাজবাড়ির নিচের গোপন পথ ধরে পৌঁছে যায় সেই পুরনো কালীমন্দিরে, যেখানে আগের রাতেও তার ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল একটি রক্তাক্ত শিশুর কান্না। সেখানে সে দেখে রুদ্রনাথ চক্রবর্তী, সম্পূর্ণ এক তান্ত্রিক বেশে, এক বৃত্ত আঁকছে রক্ত দিয়ে। তার সামনে জ্বলছে আগুন, বাতাস ভারী কপালজুড়ে তেল ও ছাইয়ের গন্ধে। সে কিছু মন্ত্র পড়ছিল, যেগুলো যেন বাতাসে কাঁপন তুলছিল। ঋষভ পেছনে সরে গিয়ে দেখতে পায়, একটি মাটির প্রদীপের পাশে রাখা একটি কাঠের বাক্সে আছে তারই তোলা প্রতিমার ছবি, আর তার পাশে — এক কালচে লাল কাপড়ে মোড়া একটি কাটা আঙুল! তার নিজের! সে আঁতকে উঠে পড়ে, বুঝতে পারে, কেউ বা কিছু তার শরীর থেকে রক্ত নিয়েছে তার অজান্তে। হঠাৎ রুদ্রনাথ বলে ওঠে, “শেষ পর্যায় শুরু হয়েছে, শ্যামার কাছে উৎসর্গ পৌঁছে গেছে, এখন শুধু পূর্ণিমার রাত।”
অমৃতা তখন দ্বিধায়। তার মনে হয়, যেন দুই সত্তা তার মধ্যে যুদ্ধ করছে। একদিকে ঋষভের জন্য একটা অদ্ভুত টান, ভালোবাসা, অন্যদিকে তান্ত্রিক মণ্ডলের প্রতি এক গভীর আকর্ষণ — যেন তার আত্মায় কোথাও আগেও এই পূজোর অনুষঙ্গে সে ছিল। সেই রাতে অমৃতার ঘুম ভেঙে যায়, কারও গলা শোনে সে — “তুই জানিস, কোন দিক থেকে আলো এলে ছায়া পড়ে না?” সেই ভয়ঙ্কর প্রশ্ন তাকে ঠেলে দেয় রাজবাড়ির সেই ঘরে, যেখানে এক আয়না ঝুলছে ছাদের নিচে। সেখানে সে দেখে, নিজের প্রতিচ্ছবির পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা শ্যামার রক্তাক্ত প্রতিমা। আয়নার ওপাশ থেকে শোনা যায় একটাই উচ্চারণ — “সে ফিরেছে, এবার বন্ধ হবে চক্র।” এরপরই অমৃতা দেখতে পায়, তার কপালে শ্যামার চিহ্ন আঁকা — কিন্তু কবে? কে করেছে? সে জানে না। তার ভেতর জন্ম নেয় সন্দেহ — সে কি শুধুই প্রেমিকা, নাকি তন্ত্রে বাঁধা উৎসর্গদাত্রী?
ঋষভ তখন নিজেকে দেখে অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে। তার স্বপ্নে আসে এক অতীত জন্ম — যেখানে সে পুরোহিত শিবদাস, রক্তচক্র আর শ্যামার পুজোর পরিচালনাকারী। আর তার ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে এক নারী — অমৃতার প্রতিচ্ছবি — সেই সময়ের প্রধান উৎসর্গ। এক ঝড়ের রাতে পুজোর মাঝেই সে নারী আত্মঘাতী হয়ে পুজো বিঘ্ন করে। তখনই শ্যামা অভিশাপ দেয় — “তোমরা বারবার ফিরে আসবে, পাপপুণ্যের ফাঁদে, যতক্ষণ না উৎসর্গ সম্পূর্ণ হয়।” ঘুম ভেঙে ঋষভ বুঝে যায়, বর্তমান, অতীত সব জড়িয়ে গেছে এক অমোঘ পাপচক্রে। সে সিদ্ধান্ত নেয় রুদ্রনাথকে থামাতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন জেগে থাকে — সত্যিই কি রুদ্রনাথকে ঠেকানো যাবে? নাকি ঋষভ, অমৃতা — উভয়েই সেই রক্তরেখার পূর্বনির্ধারিত চরিত্রমাত্র? বাইরে তখন পূর্ণিমার আলো পড়ছে পোড়া রাজবাড়ির গায়ে — আর এক দণ্ড পড়ে সেই রাতে শুরু হবে চক্রের শেষ উৎসর্গ।
৮
অষ্টমীর রাতের ঘন অন্ধকার নেমে এসেছিল পোড়ো রাজবাড়ির চারদিকে, যেন রাত নিজেই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে উঠেছে। শ্যামার পুজোর জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল রাজবাড়ির নিচের গর্ভগৃহ, যার দরজা যুগের পর যুগ ধরে বন্ধ ছিল। সেই গর্ভগৃহকে আজ খোলা হয়েছে রুদ্রনাথ চক্রবর্তীর নির্দেশে — চারদিকে ছড়িয়ে আছে ধুনোর ধোঁয়া, শ্মশানচূর্ণ, কর্পূরের গন্ধে ভারী বাতাস। পাথরের মেঝেতে আঁকা হয়েছে একটি জটিল রক্তচক্র — যার প্রতিটি বিন্দুতে পুঁতেছে শ্মশানের ফুল। পুরাতন তামার ঘন্টা বাজছে ক্রমাগত, যেন সময়কে জাগিয়ে তোলা হচ্ছে ঘুম থেকে। গৃহদেবতার আসনের পরিবর্তে প্রতিমা স্থাপন করা হয়েছে — কাঠে গড়া এক কালো দেবীমূর্তি, যার ডান চোখ ছিল এতদিন খোলা, আজ তা পূর্ণ হয়েছে এক আশ্চর্য কায়ায়, যেন অন্ধকারের শিরায় ছুটে এসেছে কোনো অতিপ্রাকৃত স্রোত। রুদ্রনাথ তান্ত্রিক বেশে, হাতে গরুড়চর্ম, কপালে রক্ততিলক, গলায় অষ্টধাতুর মালা পরে দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে রয়েছে অমৃতা — দেহে রক্তবর্ণ শাড়ি, কপালে অদ্ভুত এক চিহ্ন — যেন সেও হয়ে উঠেছে সেই চক্রেরই একটি ছায়া।
দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ:
ঋষভ তখন গর্ভগৃহের পেছনের পিলারে বাঁধা, চোখে ক্লান্তি আর রক্তে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া শরীর। তার দু’হাত শক্ত করে বাঁধা হয়েছে অশ্বত্থের দড়িতে, আর গলার কাছ থেকে রক্ত ধীরে ধীরে চুঁইয়ে পড়ছে সেই রক্তচক্রের কেন্দ্রে। শীতল পাথরের মেঝে যেন গিলে নিচ্ছে তার অস্তিত্ব — সে ঘুমিয়ে পড়ার মতো ঘোরের মধ্যে যাচ্ছিল, কিন্তু চোখ খোলার পর যে দৃশ্য সে দেখে, তা তার সারা শরীরের কাঁপুনি জাগিয়ে দেয়। দেবীমূর্তির বাম চোখও হঠাৎ খুলে গেছে! সেই চোখে কোনো দয়া নেই, নেই আশীর্বাদ, শুধু কুয়াশার মতো ঘোলা দৃষ্টি, যেন হাজার বছরের প্রতীক্ষার ক্ষুধা এক মুহূর্তে জেগে উঠেছে। তখন গর্ভগৃহে একটি প্রবল বাতাস ঢুকে পড়ে — দরজার ওপাশে থাকা ধুনো, প্রদীপ, তামার কলসি সব পড়ে যেতে থাকে। রাজবাড়ির দেওয়ালে আঁকা প্রতিমূর্তিগুলো এক এক করে ফাটতে থাকে, যেন কোন প্রাচীন অভিশাপ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। রুদ্রনাথ তবু থেমে যায় না — মন্ত্র পড়তে থাকে দ্রুত, গলায় কাঁপুনি, তবু ভয় নেই — কারণ তার বিশ্বাস, আজ শ্যামা তার কথা শুনবেন, আজ উৎসর্গ হবে পূর্ণ, আর এই শহর আবার পুরোনো শক্তির অধীনে ফিরে যাবে।
তৃতীয় অনুচ্ছেদ:
অমৃতা তখন আর শুধু এক মানুষী নারী নয় — তার চেতনায় ভেসে আসছিল এমন সব দৃশ্য, যা তার নয়, কোনো অজানা সময়ের, অজানা জন্মের। সে দেখতে পায় — আগুনঘেরা পীঠস্থলে দাঁড়িয়ে আছে সে, তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে রক্তাক্ত পুরোহিত — সেই মুখ ঋষভের। সে বুঝতে পারে, এই মুহূর্ত, এই পুজো, এই উৎসর্গ — সবই পূর্বনির্ধারিত, আবারও ফিরে এসেছে ইতিহাস। কিন্তু প্রশ্ন একটাই — সে কি আবার সেই পথেই যাবে? না কি সে নিজেই চক্র ভেঙে দেবে? সেই সময়, রুদ্রনাথ উচ্চারণ করে শেষ মন্ত্র — “কালিকার বেদনা পূর্ণ কর, রক্তে শুদ্ধ কর আত্মা!” সাথে সাথে প্রতিমার ঠোঁট হালকা নড়ে ওঠে, যেন সে নিঃশ্বাস নিচ্ছে! তারপর এক অন্ধকার ধোঁয়ার ঘূর্ণি ঘিরে ফেলে সমস্ত গর্ভগৃহ — ধ্বনি ওঠে শঙ্খনিনাদের মতো — আর সেই ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে আসে এক ছায়ামূর্তি, বিশাল, কালো, দৃষ্টিহীন চোখ, গলায় নরমুণ্ডের মালা, পায়ে বাঘছাল। সেই অস্তিত্ব যেন ঠেকিয়ে রাখা যেত না কোনো শক্তিতেই — সে এগিয়ে আসছিল উৎসর্গের দিকে, সে এসেছিল রক্ত নিতে।
চতুর্থ অনুচ্ছেদ:
ঋষভ ধীরে ধীরে অচেতন হয়ে যাচ্ছিল, তার রক্ত গর্ভগৃহের ছাঁচ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে চক্রের কেন্দ্রস্থলে। আর ঠিক সেই সময়, অমৃতা চিৎকার করে ওঠে — “এই চক্র আমি ভাঙছি!” সে ছুটে গিয়ে নিজের হাতের শিরা কাটে, রক্তে ছিটিয়ে দেয় দেবীমূর্তির সামনে, আর বলে — “আমার রক্তই যদি চাও, তবে নাও, কিন্তু আমি কাউকে উৎসর্গ হতে দেব না!” সেই মুহূর্তে গর্জে ওঠে গর্ভগৃহ — প্রতিমার চোখ দুটি অন্ধকারে ফিরে যায়, চারদিকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে, রুদ্রনাথ পেছনে ছিটকে পড়ে চক্রের বাইরে। তার মুখে বিভ্রান্তি আর আতঙ্ক — সে চিৎকার করে ওঠে, “তুই করলি কী! ইতিহাস থেমে গেল!” কিন্তু অমৃতার চোখ তখন জ্বলছিল অন্য আলোয় — যেন তার ভেতরে সত্যিকারের শ্যামার এক অংশ জেগে উঠেছে, যে রক্তের বদলে চেতনা চায়, ভালোবাসা চায়, অবসান চায় পুনরাবৃত্তির। গর্ভগৃহে বাতাস স্তব্ধ হয়ে যায়। প্রতিমা আর নিশ্বাস নেয় না, চোখ বুজে আসে ধীরে ধীরে, ছায়ামূর্তিটিও মিলিয়ে যায় ধোঁয়ার মধ্যে। ঋষভের বন্ধ হয়ে আসা চোখ খুলে যায় — সে দেখে, অমৃতা তার সামনে দাঁড়িয়ে, কপাল থেকে রক্ত ঝরছে, অথচ এক অপার্থিব আলোয় সে ঘেরা। সেই রাতের শেষে গর্ভগৃহের দরজা বন্ধ হয়, আর রাজবাড়ির অন্ধকারে পড়ে থাকে কেবল এক গন্ধ — কর্পূর, রক্ত আর শুদ্ধির।
৯
রাজবাড়ির গর্ভগৃহ তখন অন্ধকার ও আলোয় এক বিভীষিকাময় মিশ্রণে ডুবে রয়েছে। শ্যামার প্রতিমার চোখ দুটোই তখন বিস্ফারিত, যেন অতল অন্ধকারের গহ্বর থেকে তাকিয়ে রয়েছে ঋষভের আত্মার গভীরে। রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে গর্ভগৃহের প্রাচীন পাথরে, প্রতিমার পায়ের কাছে আঁকা তান্ত্রিক মণ্ডলের প্রতিটি রেখা যেন জ্বলজ্বল করে উঠছে। ঠিক সেই মুহূর্তেই, বয়স্ক, কাঁপা পায়ে এগিয়ে আসে মন্দাকিনী দেবী। তাঁর গলা এখন আর নিস্তেজ নয় — বরং যেন কোনও এক বিস্মৃত কালের প্রাচীন মন্ত্র জেগে উঠেছে তাঁর কণ্ঠস্বরে। তিনি বলেন, “আমি যা শুরু করেছিলাম, তা আমিই শেষ করব। শ্যামার পিপাসা এবার ঘুমিয়ে পড়বে।” তাঁর শরীর দুর্বল, তবুও এক অলৌকিক ঔজ্বল্যে দীপ্ত।
রুদ্রনাথ চক্রবর্তী সেই দৃশ্য দেখে হিংস্র কুকুরের মতো গর্জে ওঠে, “না! এত বছরের সাধনা ভেসে যেতে দেব না আমি! শ্যামা জাগবেন! এবার রক্ত চাই! পুরোপুরি!” সে পাগলের মতো ছুটে আসে ঋষভের দিকে, হাতে ধারালো একটা ছুরি। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে অমৃতা সামনে এসে দাঁড়ায়। তার হাতে নিজের রক্তাক্ত আঙুল — সে নিজের আঙুল কেটে মণ্ডলের কেন্দ্রে ছুঁড়ে দেয় রক্তবিন্দু। “এই রক্ত, কিন্তু উৎসর্গ নয়। আমি রক্ত দিচ্ছি মায়ের ঘুমের জন্য, জাগরণের জন্য নয়।” মুহূর্তেই মণ্ডলের রেখাগুলি ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে শুরু করে, যেন সেই তন্ত্রমণ্ডলের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
আলো নিভে আসে। শ্যামার চোখ দুটো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়, প্রতিমার মুখাবয়বে যেন আবার ফিরে আসে স্থিরতা। রাজবাড়ির ভিত গর্জে ওঠে একবার — তারপর থেমে যায়। রুদ্রনাথ ছুরি হাতে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর পাগলের মতো দৌড়ায় অন্ধকার গর্ভগৃহের বাইরে — যেন সে কিছু হারিয়েছে যা আর কখনো ফেরত পাওয়া যাবে না। গর্ভগৃহ নিঃশব্দ হয়ে আসে, রক্ত শুকিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, কালীমূর্তির পায়ের কাছে যেন এক চিলতে আলো এসে পড়ে — সূর্যোদয়ের নয়, বরং অন্তিম চেতনার। অমৃতা জড়িয়ে ধরে ঋষভকে, যে রক্তাক্ত, ক্লান্ত, কিন্তু বেঁচে আছে।
মন্দাকিনী দেবী ধীরে ধীরে বসে পড়েন প্রতিমার সামনের পাথরের চৌকাঠে। “যে পাপ আমি সৃষ্টি করেছিলাম, তা আবার কালের গর্ভেই ফিরে গেল,” তিনি ফিসফিস করে বলেন। “শ্যামা আসলে আমাদের প্রতিফলন, আমরা তাকে যেমন দেখি, তিনিও তেমন হয়ে ওঠেন। আমরা রক্ত চাই বলেই তিনি রক্ত পান করেন, নয়তো তিনি শুধু মা।” তাঁর চোখে জল — শুধু আত্মদহনের নয়, এক গোপন আত্মমুক্তির। ঋষভের মনে হয়, সে যেন বহু জন্মের এক বৃত্তে ঘুরে ঘুরে অবশেষে এই রাজবাড়িতেই থেমে এসেছে, যেখানে শেষের মধ্যে হয়তো এক শুরুও লুকিয়ে আছে। তার চোখ বন্ধ হয়ে আসে, নিঃশব্দে, কেবল অনুভব করে — এক নিঃশ্বাসে প্রবাহিত হয়ে গেল প্রতিরোধ, প্রতিচ্ছবি, আর প্রতিশোধের কালো জোয়ার।
১০
ঋষভ ধীরে ধীরে চোখ মেলে। চোখের পাতার নিচে তখনও যেন আগুনের আঁচ লেগে আছে। সে প্রথমে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না—চারপাশে শুধু ছাইয়ের গন্ধ, পোড়া মাটি, আর বাতাসে এক ধরনের নিস্তব্ধ ভয়। মাথার নিচে কাঁচা মাটি, গায়ে জমে থাকা ধুলোর স্তর, শরীরে জখমের যন্ত্রণা। সে উঠে বসে। সামনে এক বিশাল খোলা মাঠ, যেন কোনো সময় এখানে কিছু ছিল, এখন কিছুই নেই। রাজবাড়ির চিহ্নমাত্রও নেই—না সেই গর্ভগৃহ, না সেই অলিন্দ, না সেই ছাদের কার্নিশ, না সেই জরাজীর্ণ বারান্দা। সব যেন নিঃশব্দ বিস্ফোরণে মিশে গেছে শূন্যতায়। একমাত্র যা থেকে গেছে তা হল পোড়ার দাগ—পৃথিবীর বুকে আঁচড় কেটে যাওয়া রক্তমণ্ডলের স্মৃতি। অমৃতার কোনো চিহ্ন নেই, নেই মন্দাকিনী দেবী। যেন তারা কেউই কোনোদিন ছিল না—ঋষভ একা, নিঃসঙ্গ, আর এক বিস্মৃত ভয়াবহতার মধ্যে হারিয়ে থাকা।
সে ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে পড়ে। শরীর ভারী, মন আরও ভারী। পকেটের ভিতর হাত দিতে গিয়ে পায় তার পুরনো ক্যামেরাটা—আশ্চর্যভাবে এটা এখনো আছে। কাচ ভাঙা, স্ক্র্যাচ পড়েছে লেন্সে, কিন্তু সে চালু হয়। কাঁপা হাতে সে ফ্রেম ঘোরায়। কিছুই তো নেই। তবে সে শেষ ছবি দেখতে চায়—শেষ ক্লিক, শেষ মুহূর্ত, যখন সবকিছু থেমে যাওয়ার আগে ক্যামেরাটা চোখে তুলেছিল। সে স্ক্রিনে স্ক্রল করে… এবং তখনই স্তব্ধ হয়ে যায়। শেষ ছবিটা—শ্যামার মূর্তি। কিন্তু অন্ধ নয়। প্রতিমার দুটি চোখ সম্পূর্ণ খোলা, আর ঠিক তার ক্যামেরার লেন্সের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটি যেন জীবন্ত, যেন যাকে একবার দেখে ফেলে, সে তাকে ছেড়ে দেয় না। ছবি নয়, যেন সে চোখের ভিতর আটকে যায়—ঋষভ টের পায় এক অদ্ভুত দৃষ্টি তার স্নায়ুতে ঘুরে বেড়াচ্ছে, শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ছে অজানা সঞ্চার।
ঋষভ থমকে যায়। ক্যামেরা নামিয়ে নেয়, আবার তাকায় মাঠের দিকে। যেন মাঠের রঙ একটু গাঢ় হয়ে উঠছে, বাতাসে মৃদু মন্ত্রের ধ্বনি ভেসে আসে—কান ভুল শুনছে না তো? “জাগো, রক্ত এখনও শুকায়নি…” সে কেঁপে ওঠে। এই শব্দ সে শুনেছে আগেও—গর্ভগৃহের অন্ধকারে, মণ্ডলের ভিতরে, শ্যামার চোখে ডুবে যেতে যেতে। সে পেছনে তাকায়, যেন কেউ আছে। কিন্তু কেউ নেই। শুধু নিজের নিঃশ্বাস। তখনি ক্যামেরার স্ক্রিনটা হঠাৎ ঝিলিক মারে। আবার সেই ছবি। আবার সেই চোখ। এবং এবার ছবি বদলায় না, স্ক্রিন বন্ধ করলেও না, ব্যাটারি খুললেও না। সেই চোখ, সব জায়গায়। মনে হয় যেন সে চোখ দুটো এখন তার নিজের চক্ষু হয়ে গেছে। সে যতদূর যেতে চায়, সেই দৃষ্টি ছায়ার মতো তার সঙ্গে সঙ্গে চলে—অদৃশ্য, অথচ স্পষ্ট।
অমৃতা কোথায়? মন্দাকিনী? তারা কি প্রকৃতিই ছিল, না সে নিজেই তন্ত্রমণ্ডলের অংশ হয়ে গিয়েছিল সেই রাতে? সে জানে না। শুধু জানে, কিছু একটার শেষ হয়নি। রাজবাড়ি ধ্বংস হলেও, রক্তরেখা এখনও ভাঙেনি। তার শরীর থেকে বয়ে যাওয়া সেই একফোঁটা রক্তই কি তাকে চিহ্নিত করে দিয়েছে চিরতরে? যে চোখ একবার তাকায়, সে চোখ ফিরিয়ে নিতে পারে না। ঋষভ জানে, সে ফিরে যাবে শহরে, ক্যামেরা নিয়ে আবার কাজ করবে। কিন্তু ওই চোখ? তারা তার ভেতরে থাকবে, প্রতিটি শাটারে, প্রতিটি লেন্সে, প্রতিটি প্রতিচ্ছবিতে। শ্যামা ঘুমিয়ে আছেন হয়তো, কিন্তু দৃষ্টি তো রয়ে গেছে—চোখে চোখ রেখে যার শুরু, তার শেষ হয় না। সে আবার হাঁটতে শুরু করে পোড়া মাঠের ধারে—পেছনে রেখে যায় এক অনন্ত চোখের নিঃশব্দ জাগরণ।
সমাপ্ত




