Bangla - রহস্য গল্প

শ্যামবাজারের ছায়ামূর্তি

Spread the love

এক

শ্যামবাজারের রাস্তাগুলো দিনের আলোয় যতটা সরগরম থাকে, রাত নামলেই যেন ততটাই অচেনা হয়ে যায়। বিশেষ করে শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড় থেকে একটু ভেতরের সরু গলিটা যেন আরও রহস্যে ভরা। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে এক পুরনো থিয়েটার হল, যার নাম আজ আর কেউ মনে রাখে না। একসময় এখানে জমজমাট নাটকের আসর বসত, শহরের বড় বড় অভিনেতারা মঞ্চে আসতেন, তুমুল হাততালিতে ভরে উঠত আসনভর্তি দর্শক। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব থেমে যায়—একটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে থিয়েটারটি বন্ধ হয়ে পড়ে। তারপর কেটে গেছে দুই দশকেরও বেশি সময়, ধুলো জমে গেছে ভেতরে, মাকড়সার জালে জড়িয়ে গেছে সোনালি আসন, কাঠের মঞ্চ কেবল পচতে পচতে দাঁড়িয়ে আছে। স্থানীয়রা এড়িয়ে চলেন সেই গলিটা, কারণ গুজব আছে, মাঝরাতে ভেতর থেকে আলো জ্বলে ওঠে, শোনা যায় সংলাপ, আর দেখা যায় ছায়ার মত কারও অভিনয় চলছে। অনেকে বলেছেন, তারা নাকি পরিষ্কার দেখেছেন সাদা আলোয় ভেসে থাকা মূর্তি, কখনও একা, কখনও একাধিক জন। আবার কেউ কেউ দাবি করেছেন, এ সবই নাকি ভূতের খেলা—যারা অগ্নিকাণ্ডে মারা গিয়েছিল, তারা আজও অসমাপ্ত নাটক শেষ করার চেষ্টা করে চলেছে।

এই গুজবই সাংবাদিক রণদীপ সেনের কানে আসে। বয়স তার মাত্র বত্রিশ, কিন্তু ইতিমধ্যেই বেশ নাম করেছে কলকাতার সাংবাদিক জগতে। মূলত রাজনৈতিক দুর্নীতি ও অপরাধ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে সে বিখ্যাত, তবে সবসময় এক অদ্ভুত কৌতূহল তাকে টেনে নিয়ে যায় ভৌতিক বা অলৌকিক গুজবের খোঁজে। তার যুক্তিবাদী মন বলে এগুলো কেবল মানুষের তৈরি গল্প, কিন্তু ভেতরের সাহসী অনুসন্ধানী চেতনা তাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়—“প্রমাণ করো, সত্যিই ভূত নেই।” তাই এক সন্ধ্যায় সে শ্যামবাজারের পুরনো থিয়েটারের সামনে এসে দাঁড়ায়। চারপাশ ফাঁকা, দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে, রাস্তার কুকুরেরা কেবল মৃদু ডাকছে। থিয়েটারের বিশাল লোহার গেট মরিচা পড়ে লালচে হয়ে গেছে, তালা ঝুলছে, কিন্তু তালার ওপরেও ধুলো জমে। রণদীপ দাঁড়িয়ে গেটের ফাঁক দিয়ে ভেতরে তাকায়। অন্ধকারে কিছুই বোঝা যায় না, কেবল ভাঙা পোস্টারের ছেঁড়া কাগজ হাওয়ায় উড়ছে। গলায় ঝোলানো ক্যামেরা ঠিক করে নেয় সে, নোটবুক বের করে লিখে রাখে কয়েকটি কথা—‘প্রথম দর্শন: ভাঙাচোরা গেট, নিস্তব্ধতা, হাওয়ায় এক অদ্ভুত শীতলতা।’

এরপর রাত নামতেই সে ঠিক করে, গুজবের সত্যতা যাচাই করতেই হবে। চারপাশে কেউ না থাকায় গেট টপকে ভেতরে ঢোকে। চারদিক নিস্তব্ধ, কেবল পায়ের নিচে কড়কড় শব্দ। বাতাসে এক অদ্ভুত পুরোনো গন্ধ—মিশ্রণ ধুলো, কাঠ পচা, আর পোড়া কিছুর। ভেতরে ঢুকে সে দেখতে পায় থিয়েটারের আসনগুলো সব ছেঁড়া, ছড়ানো কাগজ, আর ভাঙা কাচের টুকরো। দূরে মঞ্চ অন্ধকারে ঢাকা, কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়ে যেন কেউ তাকিয়ে আছে। রণদীপ টর্চ জ্বালাতেই ছায়া মিলিয়ে যায়। বুকের ভেতর ধক করে ওঠে, তবে সাংবাদিকসুলভ জেদ তাকে ঠেকায় না। আসন পেরিয়ে ধীরে ধীরে এগোয় মঞ্চের দিকে। মনে হতে থাকে, কারও ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছে, যেন নাটকের সংলাপ উচ্চারণ করছে কেউ। “এই পৃথিবী মঞ্চ—আমরা কেবল চরিত্র।” রণদীপ থমকে দাঁড়ায়। শব্দটা কোথা থেকে এল? টর্চের আলো চারদিকে ঘুরিয়ে কিছু খুঁজে পায় না। গলা শুকিয়ে আসে, কিন্তু নোটবুকে লিখে নেয়—‘শব্দ—স্পষ্ট সংলাপ, অথচ উৎস অজানা।’

মঞ্চের একেবারে সামনে গিয়ে হঠাৎ সে দেখতে পায়—উপরে এক ঝলক আলো জ্বলে উঠল। যেন অদৃশ্য কোনো বাতি জ্বলে মঞ্চের মাঝখান আলোকিত করেছে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে এক ছায়ামূর্তি—উচ্চতায় মানুষের মতো, হাত দুটো ছড়িয়ে যেন অভিনয়ের ভঙ্গি করছে। রণদীপের নিঃশ্বাস আটকে আসে। ক্যামেরা তুলে ছবি তুলতে যায়, কিন্তু শাটার চাপতেই আলো নিভে যায়, মূর্তি মিলিয়ে যায়। থিয়েটার আবার অন্ধকারে ঢেকে যায়। মুহূর্তে তার বুকের ভেতর কাঁপুনি শুরু হয়, তবুও সাহস করে মঞ্চে উঠে পড়ে। কাঠের মঞ্চ কর্কশ শব্দ তোলে, তবে চারপাশে আবার নীরবতা। এক কোণে ছড়ানো কাগজে লেখা কিছু সংলাপ চোখে পড়ে, যেন অসমাপ্ত নাটকের পাণ্ডুলিপি। তাতে বড় হরফে লেখা—“শেষ দৃশ্য শুরু হয়নি।” রণদীপের শরীর কেঁপে ওঠে। সে বুঝতে পারে, গুজব যতটা শুনেছে, তার থেকেও অনেক গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে এই থিয়েটারের পরিত্যক্ত মঞ্চে।

দুই

সন্ধ্যার পর থেকেই আকাশে কালো মেঘ জমতে শুরু করেছিল। শ্যামবাজারের সরু রাস্তাগুলো তখনও মানুষের কোলাহলে সরগরম, কিন্তু রাত গড়াতেই চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে যায়। ঝড়ের হাওয়া বাড়তে থাকে, দোকানপাট একে একে বন্ধ হয়, কেবল ছিন্নবস্ত্র কুকুরেরা আশ্রয় খুঁজে বেড়ায়। সেই অশান্ত রাতে রণদীপ আবার হাজির হয় সেই পরিত্যক্ত থিয়েটারের সামনে। হাতে তার ছোট্ট ব্যাগ, ভেতরে ক্যামেরা, টেপ রেকর্ডার আর টর্চলাইট। গেট টপকানোর আগে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে—বজ্রপাতের আলোয় ভেসে ওঠে থিয়েটারের মরিচাধরা দেওয়াল, খসে পড়া পলেস্তারা, আর উপরে ছেঁড়া পোস্টার, যেগুলো এখন আর চেনা যায় না। ঝড়ো হাওয়ায় পোস্টারের কাগজ কাঁপতে কাঁপতে ভৌতিক শব্দ তোলে। বুকের ভেতর চাপা উত্তেজনা, আবার অজানা ভয়ের শীতলতা। পেশাদার সাংবাদিকের মতো সে নিজেকে বোঝায়, “সব গুজব, সত্যি কিছু নেই। আজ প্রমাণ করতে হবে।” এবং সাহস জুগিয়ে গেট টপকে ভেতরে ঢোকে।

ভেতরে পা রাখতেই অন্য জগতে প্রবেশ করার মতো অনুভূতি হয়। ঝড়ের হাওয়া ভাঙা জানালা দিয়ে শিস দিয়ে ঢুকছে, কোথাও কোথাও পানি চুঁইয়ে পড়ছে। আসনভর্তি হল ঘরটি এখন ভাঙাচোরা, মেঝেতে ধুলো জমে পাহাড়ের মতো, স্যাঁতসেঁতে গন্ধে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। তবু অদ্ভুতভাবে মনে হয়, চারপাশে কেউ আছে। রণদীপ টর্চ জ্বালিয়ে আসনগুলোর মাঝে আলো ফেলে দেখে—কোথাও ভাঙা চেয়ার, কোথাও ছেঁড়া পর্দা, কোথাও আবার ছড়ানো নাটকের কাগজ। সবই যেন অতীতের সাক্ষ্য। মঞ্চের দিকে চোখ পড়তেই থমকে যায় সে। নিস্তব্ধতার মাঝে হঠাৎ ভেসে আসে এক ক্ষীণ কণ্ঠস্বর, যা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে—“চরিত্রের মৃত্যু নেই, মৃত্যু কেবল দেহের।” রণদীপের হাত ঠান্ডা হয়ে আসে। শব্দটা আসছে মঞ্চ থেকেই, অথচ আলো ফেলতেই ফাঁকা মঞ্চ ছাড়া আর কিছু নেই। সে কানে রেকর্ডার লাগিয়ে শব্দ ধরতে চায়, কিন্তু পরক্ষণেই সব মিলিয়ে যায়। কেবল ঝড়ের হাওয়া আর বৃষ্টির শব্দে ভরে ওঠে চারদিক।

রণদীপ ধীরে ধীরে মঞ্চের দিকে এগোয়। কাঠের মেঝে কড়কড় শব্দ করে ওঠে, যেন বহু বছর ঘুমন্ত মঞ্চ জেগে উঠছে। মঞ্চের মাঝখানে পৌঁছেই সে হঠাৎ বুঝতে পারে—কেউ যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে। টর্চের আলো ঘোরাতে গিয়ে দেখে, দেয়ালে লম্বা ছায়া নড়ে উঠল। কিন্তু সেখানে তো কেউ দাঁড়িয়ে নেই! আবার আলো ঘোরানো মাত্র ছায়া মিলিয়ে যায়। বুক ধড়ফড় করতে থাকে, তবু জেদ চেপে বসে—সে জানে, ভয়ের কাছে হার মানলে সাংবাদিকতার আসল উদ্দেশ্য নষ্ট হবে। নোটবুক বের করে লিখে নেয়—‘মঞ্চে উপস্থিতির অনুভূতি—কণ্ঠস্বর পরিষ্কার, তবে দৃশ্যমান নয়।’ ঠিক সেই মুহূর্তে মাথার ওপর থেকে ভাঙা ফ্যান ঘুরতে ঘুরতে মাটিতে পড়ে যায়, বজ্রপাতের আলোয় চারপাশ ঝলসে ওঠে, আর রণদীপ অনুভব করে, যেন অদৃশ্য কেউ তাকে মঞ্চ থেকে সরিয়ে দিতে চাইছে।

ঝড় আরও তীব্র হয়ে ওঠে, বাইরে বৃষ্টি আছড়ে পড়ে। কিন্তু থিয়েটারের ভেতরে এক ভিন্ন আবহ তৈরি হয়। মঞ্চের কোণে হঠাৎ আলো জ্বলে ওঠে—যেন পুরনো স্পটলাইট আবার জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সেই আলোয় ভেসে ওঠে এক মানবসদৃশ ছায়া, হাত দুটো প্রসারিত, ঠোঁট নড়ছে সংলাপ বলার ভঙ্গিতে, কিন্তু শব্দ বেরোয় না। রণদীপ মুহূর্তের জন্য থমকে যায়, টর্চ ফেলে ক্যামেরা তুলে নেয়। শাটার চাপতেই আলো নিভে যায়, ছায়ামূর্তি মিলিয়ে যায়, হলঘর আবার অন্ধকারে ডুবে যায়। কেবল বৃষ্টির শব্দ আর বজ্রপাতের ঝলকানি। রণদীপ ক্যামেরার ডিসপ্লে খুলে ছবি দেখতে চায়, কিন্তু স্ক্রিন অদ্ভুতভাবে কালো হয়ে যায়, যেন কিছুই ধরা পড়েনি। হঠাৎই তার মনে হয়, ছায়াটি যেন ফিসফিস করে বলল—“এখনও শেষ হয়নি।” শরীর শিউরে ওঠে, কিন্তু মন ঠিক করে নেয়—এ রহস্য তাকে আরও গভীরে টেনে নিয়ে যাবে। প্রথম প্রবেশেই সে বুঝে যায়, থিয়েটারের অন্ধকারে লুকিয়ে আছে এক অসমাপ্ত নাটক, এক রহস্য যার জাল থেকে বেরোনো সহজ হবে না।

তিন

রণদীপের প্রথম রাতের অভিজ্ঞতা তাকে ভেতরে ভেতরে নাড়া দিয়ে দিয়েছিল। যুক্তিবাদী মানসিকতা তাকে সবসময় অদ্ভুত ঘটনা যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে শেখালেও, থিয়েটারের ভেতরে শোনা সংলাপ আর দেখা ছায়ার উপস্থিতি সে সহজে ভুলতে পারছিল না। অফিসে ফিরে খবরের কাগজের পুরনো ফাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে তার চোখে পড়ে যায় এক ভগ্নপ্রায় থিয়েটারের বিজ্ঞাপন—প্রায় বিশ বছর আগের। পোস্টারে স্পষ্ট লেখা—‘নতুন নাটক: শেষ দৃশ্য—নাট্যকার রোহন বসু।’ নামটা পড়তেই রণদীপের কৌতূহল বাড়ে। খানিক খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারে, এই নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার আগেই অগ্নিকাণ্ড ঘটে, আর সেই ঘটনার পর থেকেই রোহন বসু হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যান। কেউ বলে তিনি মারা গেছেন, কেউ বলে তিনি আত্মগোপন করেছিলেন, কিন্তু কোনও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। ঠিক তখনই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যগবেষণা বিভাগের এক লাইব্রেরিতে তার সঙ্গে দেখা হয় এক তরুণীর—অর্পিতা মুখার্জি। বয়স আনুমানিক আঠাশ, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, হাতে পুরনো নাট্যপত্রিকার ফাইল। সে রণদীপের দিকে একবার তাকিয়েই জিজ্ঞেস করল—“আপনিও কি শ্যামবাজার থিয়েটারের ইতিহাস খুঁজছেন?”

প্রথম আলাপেই রণদীপ অবাক হয়ে যায়, কারণ এতদিন যাদের কাছেই সে থিয়েটারের কথা তুলেছিল, তারা ভয় পেয়ে চুপ করে গিয়েছিল। অথচ এই তরুণী স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বলল, “ওই জায়গাটা অভিশপ্ত নয়, বরং ইতিহাসের এক অসমাপ্ত অধ্যায়।” অর্পিতা জানায়, সে নাট্যগবেষক, এবং বহু বছর ধরে কলকাতার পুরনো থিয়েটারগুলোর ওপর কাজ করছে। শ্যামবাজারের থিয়েটার নিয়ে তার বিশেষ আগ্রহ, কারণ এখানেই ঘটেছিল শহরের সবচেয়ে রহস্যময় ঘটনা—রোহন বসুর অন্তর্ধান। অর্পিতা দৃঢ় কণ্ঠে বলে, “যদি ওই নাটকটা মঞ্চস্থ হতো, হয়তো বাংলার থিয়েটার অন্য উচ্চতায় পৌঁছত। কিন্তু তার আগেই সব শেষ হয়ে গেল।” রণদীপ অবাক হয়ে শোনে, এবং তাকে নিজের দেখা অভিজ্ঞতার কথা বলতে দ্বিধা করে না। সে জানায় কিভাবে মঞ্চে ছায়ামূর্তি দেখেছে, কিভাবে সংলাপ শুনেছে। অর্পিতা চুপচাপ শুনে যায়, তারপর ধীরে বলে, “আপনি যা দেখেছেন, সেটা হয়তো রোহনের অসমাপ্ত নাটকের প্রতিধ্বনি।”

অর্পিতা তার ব্যাগ থেকে একটি পুরনো ডায়েরি বের করে রণদীপকে দেখায়। সেখানে রোহন বসুর কিছু লেখা পাওয়া গেছে—অসমাপ্ত নাটকের টুকরো, সংলাপ, আর ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনা। এক জায়গায় লেখা—“সত্য যদি মঞ্চে আনা না যায়, তবে নাটক অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।” অর্পিতা ব্যাখ্যা করে যে রোহনের নাটক শেষ দৃশ্য আসলে তীব্র সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যঙ্গ ছিল, যেখানে দুর্নীতি, ক্ষমতার দৌরাত্ম্য আর সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল। অনেক প্রভাবশালী মানুষ এই নাটকের বিরোধিতা করেছিলেন। রণদীপ ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করে, হয়তো রোহনের অন্তর্ধান কেবল দুর্ঘটনা ছিল না, বরং এর পেছনে লুকিয়ে আছে গভীর ষড়যন্ত্র। অর্পিতা তার দিকে তাকিয়ে বলে, “আপনি যদি সত্যিই এই রহস্য খুঁজতে চান, তবে আমাকে সঙ্গে নিতে হবে। কারণ একা এই ইতিহাস টেনে তোলা সম্ভব নয়।” রণদীপ প্রথমে একটু ইতস্তত করলেও, তার চোখের দৃঢ়তা দেখে রাজি হয়ে যায়।

তাদের কথোপকথনের শেষে দু’জনেই বুঝতে পারে, তারা একই পথে হাঁটছে। রণদীপ যেখানে সাংবাদিকতার তীক্ষ্ণ চোখ নিয়ে রহস্য উন্মোচনে নেমেছে, অর্পিতা সেখানে ইতিহাসের হারিয়ে যাওয়া অধ্যায় উদ্ধার করতে চায়। দুজনের উদ্দেশ্য আলাদা হলেও গন্তব্য একই। সেই দিন থেকে তারা একসঙ্গে অনুসন্ধান শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়। রণদীপ মনে মনে ভাবে, প্রথম রাতে দেখা ছায়ামূর্তি হয়তো তাকে এখানে টেনে এনেছে, আর অর্পিতার আবির্ভাব সেই ইঙ্গিতেরই পরবর্তী ধাপ। বাইরে তখন বৃষ্টি থেমে গেছে, শহরের বাতাসে ঠান্ডা শীতলতা। জানলার বাইরে তাকিয়ে রণদীপ মনে মনে উচ্চারণ করে—“রোহন বসু, আমরা তোমার শেষ দৃশ্য দেখতে চাই।” আর অর্পিতা নিঃশব্দে মাথা নাড়ে। তাদের দুজনের পথচলা শুরু হয় এক নতুন রহস্যের দিকে, যার শেষ কোথায় তা কেউ জানে না।

চার

ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে, এক বিকেলের অন্ধকার গলিপথে রণদীপ পৌঁছে গেল হরিপদের ছোট্ট ভাঙাচোরা ঘরে। বৃদ্ধ মানুষটি আর আগের মতো শক্তসমর্থ নেই, কুঁজো হয়ে হেঁটে বেড়ায়, চোখে মোটা চশমা। চা-এর পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে সে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল—“তুই খবরের কাগজের ছেলে, তাই সবটা জানিস না। এই থিয়েটারের অন্দরমহল একসময় কী জাঁকজমক ছিল তা কল্পনাও করতে পারবি না। রাতে ট্রামে কিংবা হাতে করে গাড়ি চেপে শহরের ধনী-গরিব সকলে ছুটে আসত নাটক দেখতে। মঞ্চ আলোকিত হত, সুরে আর সংলাপে মাতত জনতা। কিন্তু এক রাত, সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেল।” রণদীপ মনোযোগ দিয়ে শুনছিল, আর হরিপদের কণ্ঠস্বর যেন সময়কে ভেদ করে অতীতে ফিরে যাচ্ছিল। সে বলল, সেই রাতে মঞ্চে চলছিল বিখ্যাত নাট্যকার রোহন বসুর নতুন নাটক “অগ্নিশিখা”। হলভর্তি দর্শক, বাইরে সারি সারি গাড়ি। হঠাৎ কোথা থেকে যেন আগুনের শিখা ছড়িয়ে পড়ে মঞ্চের এক পাশে। দর্শকের চিৎকারে শোরগোল, সবাই বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছিল। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, আগুন যেন কেবল অভিনেতাদের চারপাশেই ঘিরে ছিল। কয়েকজন বেরোতে পারেনি—তাদের দগ্ধ দেহ পরদিন সকালেই উদ্ধার হয়।

হরিপদ থেমে গেল কিছুক্ষণের জন্য, যেন অতীতের সেই ভয়াবহ দৃশ্য এখনও তার চোখের সামনে। তার কণ্ঠ কেঁপে উঠল—“আমি তখন দারোয়ান। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছিলাম, লোকজনকে বাইরে আনছিলাম। কিন্তু শপথ করে বলছি, আগুনটা স্বাভাবিক ছিল না। কারা যেন মঞ্চে সংলাপ বলছিল শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। আমি স্পষ্ট শুনেছি, এক পুরুষ কণ্ঠ হাসতে হাসতে বলছিল—‘এ নাটক শেষ হয়নি, আগুনেও তা শেষ হবে না।’ এরপর থেকে ওই থিয়েটারটা আর আগের মতো হয়নি।” রণদীপ কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করল, “কিন্তু আপনি আগুন লাগার কারণ জানলেন না?” বৃদ্ধ দারোয়ান চশমার আড়াল থেকে কটমট করে তাকাল—“কেউ বলে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট, কেউ বলে ষড়যন্ত্র। আমি বলি, ওটা অভিশাপ। রোহন বসুর নাটক শেষ হতে দেয়নি আগুন। আর তার পর থেকেই রাতের বেলা ওই মঞ্চে ছায়া দেখা যায়। লোকজন বলে, যারা মরেছিল, তাদের আত্মা এখনও অভিনয় করছে।”

বাতাসে অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে গেল। রণদীপের মনে হল যেন ঘরের অন্ধকার কোনায় কেউ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে শুনছে। বাইরে বজ্রপাতের শব্দে জানলার কাচ কেঁপে উঠল। হরিপদ আরও কাছে ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে বলল—“তোকে সাবধান করে দিচ্ছি। ওই ছায়া মানুষ নয়। আমি বহুবার দেখেছি। রাত্তিরে দেরি করে বেরোলে, থিয়েটারের ভেতরে আলো জ্বলে ওঠে, আর মঞ্চে কুয়াশার মতো এক দল দাঁড়িয়ে থাকে। তারা কথা বলে, হাঁটে, হাসে—কিন্তু মানুষ নয়। আমি বারবার চিৎকার করেছি, ভেবেছি হয়তো কিশোর ছেলেপিলে দুষ্টুমি করছে। কিন্তু কাছে যেতেই সব মিলিয়ে গেছে।” তার চোখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট, গলায় এক ধরনের অনিশ্চয়তা। রণদীপ নীরব হয়ে গেল। একজন বাস্তববাদী সাংবাদিক হিসেবে সে ভূতের গল্পে বিশ্বাস করে না, কিন্তু হরিপদের বয়ান এত বিস্তারিত আর ভয়াবহ যে যুক্তি খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছিল।

চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে হরিপদ হাত কাঁপতে কাঁপতে সিগারেট ধরাল। ধোঁয়ার কুণ্ডলীর ফাঁক দিয়ে সে তাকাল দূরের দিকে—“এই বয়সে আমার লাভক্ষতি কিছু নেই, তাই তোকে বলছি। এই গল্প বাইরে ছড়ালে কেউ বিশ্বাস করবে না, আবার তুইও হয়তো উপহাস করবি। কিন্তু মনে রাখিস, রোহন বসুর নাটক শেষ হয়নি। ওর অর্ধেক সংলাপ এখনও হলঘরের দেওয়ালে আটকে আছে। যতক্ষণ না নাটকটা শেষ হয়, ততক্ষণ ওই আত্মারা শান্তি পাবে না।” হঠাৎ সে হাত বাড়িয়ে রণদীপের কব্জি চেপে ধরল—“সাবধানে থাকিস। তুই যদি সত্যিই থিয়েটারে যাস, মনে রাখিস—ওই ছায়া মানুষ নয়।” রণদীপের মেরুদণ্ডে ঠান্ডা শীতল স্রোত বয়ে গেল। বাইরে ঝড়ের আওয়াজের সঙ্গে তার মনের ভেতরেও যেন অস্থিরতা বাজতে লাগল।

পাঁচ

রাত তখন অনেক গভীর। কলকাতার শ্যামবাজারের রাস্তায় ভরসন্ধ্যার ভিড় নেই, চারদিকে নিস্তব্ধতা। থিয়েটারের ফটকের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল রণদীপ আর তার বন্ধু সায়ন্তন। সায়ন্তন পেশায় আলোকচিত্রী, শহরের বিভিন্ন অচেনা কোণ ক্যামেরায় ধরে রাখাই তার নেশা। রণদীপ তার সমস্ত অভিজ্ঞতা খুলে বলেছিল—অদ্ভুত আলো, সংলাপ, আর হরিপদের কাহিনি। প্রথমে সায়ন্তন হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিল, বলেছিল—“ভূতপ্রেত বলে কিছু নেই বন্ধু, সবই মানুষের ভ্রম। তবে ছবি ক্যামেরা কিন্তু মিথ্যে বলে না। যদি কিছু সত্যিই থাকে, তবে লেন্স সেটা ধরবেই।” রণদীপ জানত সায়ন্তনের কথা সত্য, তাই আজকের পরিকল্পনা করা হয়েছিল—দু’জনে একসঙ্গে ভেতরে যাবে, আর সায়ন্তনের ক্যামেরায় রেকর্ড হবে সবকিছু। ভারী ফটক ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই ধুলোমাখা অন্ধকার তাদের স্বাগত জানাল। চারপাশে যেন অতীতের ধ্বংসস্তূপ, আসনের চামড়া ছিঁড়ে গিয়েছে, ছাদ থেকে ঝুলছে জাল, আর মঞ্চ শূন্যতার মতো দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সেই নীরবতার মাঝেই তারা দু’জন একইসঙ্গে অনুভব করল, কারও নিঃশ্বাস যেন কোথাও লুকিয়ে আছে।

রণদীপ টর্চ জ্বেলে মঞ্চের দিকে এগোতেই সায়ন্তন ক্যামেরা সেট করল। ক্যামেরার ফ্ল্যাশে ক্ষণিকের জন্য থিয়েটারের ভেতর আলোর ঝলকানি ছড়িয়ে পড়ল। প্রথমে কিছুই ধরা পড়ল না—কেবল ফাঁকা চেয়ার আর খালি মঞ্চ। কিন্তু হঠাৎ রণদীপ থেমে গেল। তার কানে আসছিল মৃদু সংলাপের আওয়াজ। যেন কেউ অন্ধকারে বসে কোনো নাটক আবৃত্তি করছে। সায়ন্তন কান পেতে কিছুই শুনতে পেল না, সে বরং ক্যামেরা তাক করল মঞ্চের মাঝখানে। আবার ফ্ল্যাশ জ্বলে উঠল, আর সেই মুহূর্তে ক্যামেরার স্ক্রিনে এক শিহরণ জাগানো ছবি ধরা পড়ল। মঞ্চের ঠিক কেন্দ্রে, অর্ধেক আলো-অর্ধেক অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে এক ছায়ামূর্তি। পোশাক-আশাকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু মুখাবয়ব স্পষ্ট। সায়ন্তন ছবিটা জুম করে দেখল, বুকের ভেতর যেন থেমে গেল তার হৃদস্পন্দন—এটা তো সেই বিখ্যাত নাট্যকার রোহন বসুর মুখ! রণদীপ ক্যামেরার স্ক্রিনে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল, চোখের সামনে ফাঁকা মঞ্চ, অথচ ছবিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এক মানুষ।

মুহূর্তেই পরিবেশ আরও ভারী হয়ে উঠল। বাতাসে এক অজানা ঠান্ডা শীতলতা নেমে এল, কুয়াশার মতো ধোঁয়া গড়িয়ে আসছিল মঞ্চের দিকে। রণদীপ বুঝতে পারছিল, এ আর কেবল গুজব নয়। সে ফিসফিস করে বলল, “তুই দেখছিস সায়ন্তন? ওটা সত্যিই রোহন বসুর মুখ।” সায়ন্তন গম্ভীর গলায় উত্তর দিল, “হ্যাঁ, আমি জীবনে এত ছবি তুলেছি, কিন্তু এমন কখনো দেখিনি। এটা ফটোশপ বা কাকতালীয় আলো হতে পারে না।” সেই মুহূর্তে আবার ভেসে এল সংলাপের ধ্বনি—“নাটক অসমাপ্ত রইল, আর তাই আমি শান্তি পাইনি।” রণদীপের শরীর কেঁপে উঠল। চারদিকে কেউ নেই, তবু কণ্ঠস্বর যেন মঞ্চের দেওয়াল থেকে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসছে। সায়ন্তন কাঁপা হাতে আবার শাটার চাপল, এবার লেন্সের ভেতর ধরা পড়ল যেন অর্ধেক পোড়া পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু ছায়া-মানুষ, যারা নীরব দর্শকের মতো চেয়ে আছে।

দু’জনের মনেই একসঙ্গে ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে কৌতূহল কাজ করছিল। রণদীপ ভাবল, হয়তো এই রহস্যের সূত্র এখানেই লুকোনো—রোহন বসুর নিখোঁজ হওয়া, থিয়েটারের অগ্নিকাণ্ড আর আত্মাদের অশান্ত উপস্থিতি। সায়ন্তন ঠোঁট কামড়ে বলল, “বন্ধু, আমি যত ছবি তুলছি, প্রতিটাই আরও ভয়ঙ্কর হচ্ছে। যদি এগুলো বাইরে প্রকাশ পায়, শহর কেঁপে উঠবে।” রণদীপ ধীরে মাথা নাড়ল—“কিন্তু এখানেই লুকিয়ে আছে সত্যি। আমাদের খুঁজে বের করতে হবে কেন এই নাটক অসমাপ্ত রইল, কেন আত্মারা শান্তি পাচ্ছে না।” সেই মুহূর্তে তাদের দু’জনের টর্চ হঠাৎ নিভে গেল। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে তারা অনুভব করল, চারদিক থেকে অদৃশ্য দৃষ্টি তাদের দিকে চেয়ে আছে। অজানা এক চাপা আওয়াজ শোনা গেল মঞ্চ থেকে—“শেষ করো, নাটকটা শেষ করো…”। সায়ন্তন কাঁপতে কাঁপতে ক্যামেরা বুকে জড়িয়ে ধরল, আর রণদীপ বুঝল, এখন আর পিছু হটার উপায় নেই। সত্যিটা যত ভয়ঙ্করই হোক, তা উদঘাটন করতেই হবে।

ছয়

রণদীপ থিয়েটারের ভেতরের আড়ালে লুকিয়ে থাকা তথ্যগুলো একে একে জুড়ে যাচ্ছিল। তার কৌতূহল এতটাই তীব্র হয়ে উঠেছিল যে, সে আর পেছনে তাকাতে পারছিল না। শহরের বিভিন্ন মহলে ব্যবসায়ী কমলেশ মিত্রের নামটি ক্রমশই প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। জানা গেল যে, তিনি থিয়েটারের জমি দখল করার চেষ্টা করছেন এবং সেখানে একটি বহুতল ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা করছেন। রণদীপের মনে একটি প্রশ্ন জাগছিল—কেন এই থিয়েটারের জমি এত গুরুত্বপূর্ণ? সাধারণ মানুষের চোখে এটি তো কেবল একটি পুরনো, বেহাল অবস্থা থিয়েটার। কিন্তু মিত্রের জন্য এটি ছিল একটি সোনার খনির মতো সুযোগ। জমির বাজার মূল্যের সাথে সম্পর্কিত যে হিসাবগুলো রণদীপ খুঁজে পেয়েছে, তা তাকে অবাক করেছে।

থিয়েটারের জমি নিয়ে যে গুজব ছড়ানো হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হল ছায়ামূর্তির উপস্থিতি। শহরের মানুষদের মধ্যে এই ছায়ামূর্তি এমন এক রহস্যময় চরিত্র, যা কেউ দেখেছে, কেউ দেখেনি, কিন্তু সকলেই বিশ্বাস করে। রণদীপের পর্যবেক্ষণ বলছে যে, এই গুজব কার্যত একটি সামাজিক চাপ তৈরি করছে। জমির দাম কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ীর পক্ষে এটি দখল করা সহজ হয়ে যাচ্ছে। রণদীপ ভাবতে শুরু করে—এটি কি আসলেই একটি স্বতঃস্ফূর্ত বিশ্বাস, নাকি কোনো পরিকল্পিত কৌশল? আর যদি এটি পরিকল্পিত হয়, তাহলে কারা এই নাটক সাজাচ্ছে? তার মনে সন্দেহ জাগে যে, মিত্র হয়তো শুধুই চুপচাপ আর্থিক সুবিধা নিতে চায় না, বরং তিনি লোকেদের ভয় দেখিয়ে তাদের দমন করতেও চায়।

রণদীপ থিয়েটারের আশেপাশের লোকদের সঙ্গে কথা বলার সময় আরও কিছু তথ্য জেনে ফেলে। কর্মচারীরা চুপচাপ এবং আতঙ্কিত, কেউ কোনোরকম বিস্তারিত বলতে চায় না। এমনকি যে কয়েকজন প্রায়ই রাতে থিয়েটারের আশেপাশে ঘোরাফেরা করে, তারা বলে যে তারা অদ্ভুত ছায়ামূর্তি দেখেছে, কিন্তু ঠিক কখন বা কোথায় তা মনে করতে পারছে না। রণদীপ বুঝতে পারে যে, এই থিয়েটারের চারপাশে একটি মানসিক পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে—যেখানে মানুষের মন শঙ্কায় ও ভয়ে আবদ্ধ। এটি স্পষ্ট যে, এই ভয়ের হাত ধরে জমি দখলের পরিকল্পনাকে কার্যকর করা হচ্ছে। রণদীপ ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে থাকে যে, এই জটিল পরিস্থিতি কোনো সাধারণ ব্যবসায়িক লড়াই নয়, বরং এক বড় ষড়যন্ত্রের অংশ।

শেষপর্যন্ত রণদীপের চিন্তায় আসে যে, এটি শুধু আর্থিক লোভের বিষয় নয়। এখানে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ, ভয় এবং মানুষের বিশ্বাসের উপর কৌশলগত প্রভাব প্রয়োগের চেষ্টাও রয়েছে। ছায়ামূর্তি হয়তো কেবল একটি প্রতীক, যা মানুষের মনকে নিয়ন্ত্রণ করছে। রণদীপ এই কূটকৌশলের গভীরে ঢুকতে চায় এবং সিদ্ধান্ত নেয় যে, সে শুধুই তথ্য সংগ্রহ করবে না, বরং এই ষড়যন্ত্রের খোলস উন্মোচন করবে। সে বুঝতে পারে যে, যদি সত্যটি প্রকাশ পায়, তাহলে শুধুই জমি রক্ষা হবে না, বরং শহরের মানুষের মধ্যে যে অযথা ভয় আর কল্পনার সৃষ্টি হয়েছে, তা ও দূর হবে। এই অধ্যায়ের শেষে রণদীপের মনে দৃঢ় সংকল্প জন্মায়—ছায়ামূর্তির রহস্য এবং ব্যবসায়ী মিত্রের প্রকৃত পরিকল্পনা উভয়ই সে উন্মোচন করবে, এবং যেকোনো ষড়যন্ত্রই তার সামনে লুপ্ত হয়ে যাবে।

সাত

রাতের গভীরে থিয়েটারের পুরনো দরজা চিরকালের মতো খিঁচ খিঁচ করে খোলার শব্দে থরথর করে ওঠে। রণদীপ আর অর্পিতা সেই নিঃসঙ্গ স্থানে আবার প্রবেশ করল, যেখানে দিনের আলোও থিয়েটারের ভেতরকার গোপন অন্ধকারকে ভেদ করতে পারত না। থিয়েটারের মেঝে চিলতে কাঠের তালে তালে নড়ছিল, যেন প্রতিটি পদক্ষেপ তাদের উপস্থিতি অনুভব করছে। বাতাসে অদ্ভুত গন্ধ—একধরনের পুরনো ধুলো আর ভেজা কাঠের মিলন—মনে করিয়ে দিচ্ছিল যে, তারা কোনো সাধারণ স্থানে নেই। অন্ধকারের মাঝে এক অদ্ভুত নিঃশব্দ চাপ তাদের ওপর নেমে এসেছে, যা কেবল শারীরিক নয়, মানসিকভাবেও ভীত করছিল। রণদীপের মন প্রায় অবচেতনভাবে সতর্ক করতে থাকে, যেন সে জানে, আজকের রাতের ঘটনা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়।

হঠাৎ মঞ্চের মধ্য দিয়ে একটি ছায়ামূর্তির গা ছোঁয়া উপস্থিতি তাদের নজরে আসে। সেই মুহূর্তে মঞ্চের পর্দার আড়াল থেকে যেন নাটকের দৃশ্য নিজেই জীবন্ত হয়ে উঠল। অর্পিতা তাকিয়ে রইল, চোখ ভয়ঙ্কর উত্তেজনায় বড় হয়ে গেছে। থিয়েটারের বাতাসে হঠাৎ এক অচেনা কণ্ঠ তাদের উদ্দেশ্যে সংলাপ বলতে শুরু করে। শব্দগুলো ছিল অর্ধেক মানব, অর্ধেক অস্পষ্ট, কিন্তু স্পষ্টভাবে তাদের কানে ভয় আর বিস্ময়ের স্রোত সৃষ্টি করে। রণদীপ চেষ্টা করল কণ্ঠের উৎস চিহ্নিত করতে, কিন্তু ঘন অন্ধকার এবং থিয়েটারের ভাঙাচোরা কাঠের ছায়া তাকে বিভ্রান্ত করে। প্রতিটি শব্দ যেন ধীরে ধীরে তাদের মনস্তত্ত্বের উপর আক্রমণ চালাচ্ছিল।

এই অচেনা কণ্ঠে সায়ন্তন সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত হয়। সে একেবারে ভেঙে পড়তে বসে, হাতে থাকা ক্যামেরার লেন্সও যেন থেমে যায়। রণদীপ দ্রুত তার পাশে গিয়ে তাকে শান্ত করতে চেষ্টা করে, কিন্তু সায়ন্তনের দেহে ছাপা আতঙ্ক স্পষ্ট। কণ্ঠটি বারবার থিয়েটারের ভেতরকার স্থানগুলো ঘেঁষে ঘেঁষে আসছিল, যেন এটি মঞ্চের দৃশ্যের সাথে মিলিয়ে তাদের প্রতি ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ চালাচ্ছিল। অর্পিতা রণদীপকে ধরে বলল, “আমরা কি সত্যিই এখানে একা?”—মনে হচ্ছিল, অন্ধকার আর কণ্ঠ দুজনেই তাদের চারপাশে বেড়ে উঠছে, নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে।

রণদীপ মনে করল যে, এটি শুধু ছায়ামূর্তির কার্যকলাপ নয়; এখানে কোনো এক শক্তি বা পরিকল্পনা তাদের পরীক্ষা করছে। সে দ্রুত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে—থিয়েটারের প্রতিটি কোণ, মঞ্চের আড়াল, ভাঙাচোরা আসবাবপত্র—সব কিছু যেন জীবন্ত। অন্ধকারের আক্রমণ একরকম মানসিক যুদ্ধের রূপ নিয়েছে, যেখানে রণদীপ, অর্পিতা এবং সায়ন্তন একসঙ্গে নিজেকে রক্ষা করতে চেষ্টা করছে। সেই রাতের অন্ধকার তাদের সাহস এবং ধৈর্যের সীমা পরীক্ষা করে, এবং রণদীপ স্থিরভাবে সিদ্ধান্ত নেয় যে, শুধু মুখোমুখি হয়ে এগোলে এই রহস্য উন্মোচিত হবে। এই অধ্যায়ের শেষে পাঠক বোঝে, থিয়েটারের অন্ধকার কেবল শারীরিক নয়, বরং একটি গভীর, জটিল ষড়যন্ত্রের আঙ্গিক, যা তাদের সাহস, বুদ্ধি এবং মানসিক দৃঢ়তা যাচাই করছে।

আট

অর্পিতা তার গবেষণার জটিল নেটওয়ার্কে ডুব দিয়ে অবশেষে থিয়েটারের অজানা ইতিহাসের গভীরে পৌঁছায়। সে খুঁজে পায়, রোহন বসুর শেষ নাটকটি কেবল একটি বিনোদনের অংশ ছিল না, বরং সমাজের কুখ্যাত দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি তীব্র প্রতিবাদের আকার নেয়। নাটকের প্রতিটি সংলাপ এবং চরিত্রের আঙ্গিক বাস্তব জীবনের ঘটনা ও মানুষদের প্রতিফলিত করছিল। রোহন সাহসীভাবে এমন বিষয়গুলো তুলে ধরেছিল যা অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির সুবিধার সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল। অর্পিতা দেখল, নাটকের মধ্যে এমন কিছু দৃশ্য ছিল যা শহরের রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অসহায় অবস্থা প্রকাশ করেছিল। এই তথ্য অর্পিতাকে বোঝায় যে, রোহন শুধু একটি সাধারণ নাট্যকার ছিলেন না; তিনি একটি সমাজ সংস্কারক হিসেবে নিজের অবস্থান রাখার চেষ্টা করছিলেন।

গবেষণার পাশাপাশি অর্পিতা খুঁজে পায়, রোহনের নিখোঁজ হওয়ার সময়কালে থিয়েটারের আশেপাশে অস্বাভাবিক কিছু ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয়দের মধ্যে অনেকেই চুপচাপ থাকে, কেউ সরাসরি কিছু বলতে চায় না। কিন্তু কয়েকজন বিশ্বাসযোগ্য সূত্র থেকে অর্পিতা জানতে পারে যে, রোহনের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটি একেবারেই স্বাভাবিক ছিল না। থিয়েটারের আড়ালে থাকা কক্ষগুলোর নথি, পুরনো চিঠিপত্র এবং শহরের কিছু গোপন আর্কাইভ তাকে জানায়, যে রোহনের ওপর পরিকল্পিতভাবে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। নাটকে তুলে ধরা সামাজিক দুর্নীতি এমন এক তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল, যা কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির রোষ দারুণভাবে জাগিয়ে তুলেছিল। আর সেই রোষই রোহনের নিখোঁজ হওয়ার মূল কারণ হতে পারে—শুধু এটিই নিখোঁজ নয়, বরং খুনের আড়াল হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে।

অর্পিতা ধীরে ধীরে সব তথ্য একত্রিত করতে থাকে। সে বুঝতে পারে যে, রোহনের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় শুধুমাত্র আর্থিক লোভ বা ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব নয়, বরং রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতার সংঘাতও জড়িত। নাটকটি এমন একটি আঘাত সৃষ্টি করেছিল, যা সরাসরি প্রভাবশালী মহলকে হুমকি হিসেবে দেখিয়েছিল। রোহন হয়তো জানত যে, নাটকের বিষয়বস্তু তাকে বিপদে ফেলতে পারে, কিন্তু তিনি চুপ করে বসে থাকেননি। তার সাহসিকতা এবং সত্যের প্রতি নিষ্ঠা তাকে এই বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে নিয়ে গেছে। থিয়েটারের অদ্ভুত ছায়ামূর্তি, অর্পিতা ও রণদীপের সামনে আবির্ভূত ঘটনাগুলো—সবকিছু যেন সেই সময়ের রোহনের সাহসিকতার প্রতিফলন।

অধ্যায়ের শেষে অর্পিতার উপলব্ধি গভীর হয়। রোহনের নিখোঁজ কেবল একটি রহস্য নয়, এটি সমাজের গভীর অন্ধকার এবং ক্ষমতার কৌশলগত খেলা নিয়ে তৈরি এক জটিল চিত্র। সে বুঝতে পারে যে, থিয়েটারের ইতিহাস এবং রোহনের নাটক একে অপরের সাথে জড়িত এবং এই জটিল সম্পর্কই তার সামনে রহস্য উন্মোচনের চাবিকাঠি। অর্পিতা সিদ্ধান্ত নেয় যে, শুধুমাত্র রোহনের নিখোঁজ রহস্য উদঘাটন করলেই তার সত্য উন্মোচিত হবে না, বরং সমাজের সেই অন্ধকার দিকগুলোর মুখোমুখি হতে হবে। এই অধ্যায় রণদীপ, অর্পিতা এবং সায়ন্তনকে আরও গভীরভাবে থিয়েটারের মায়াজালে যুক্ত করে এবং পাঠককে রোহনের নিখোঁজ রহস্যের প্রকৃত কারণের দিকে নিয়ে যায়।

নয়

রাতের গভীরে থিয়েটারের মঞ্চে একা দাঁড়িয়ে রণদীপ অনুভব করল যে, এখন আর পেছনে ফেরার কোনো উপায় নেই। চারপাশে অন্ধকার ও ভাঙাচোরা আসবাবের মধ্যে যেন সময় স্থির হয়ে গেছে। তার হৃদস্পন্দন দ্রুত বেড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু মন অব্যাহতভাবে সতর্ক ছিল। মঞ্চের নরম কাঠের তলে প্রতিটি পদক্ষেপ যেন বাতাসের সাথে মিলিত হয়ে এক অদ্ভুত প্রতিধ্বনি তৈরি করছিল। অর্পিতা এবং সায়ন্তন পাশে দাঁড়িয়েছিল, তবে তারা নিজেও এক ধরনের শীতল ভয় অনুভব করছিল। রণদীপ জানত যে, এই মুহূর্তে তার সাহসই সবচেয়ে বড় অস্ত্র। মঞ্চের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে অন্ধকারের দিকে গভীরভাবে নজর রাখল এবং মনে করল, ছায়ামূর্তির মুখোমুখি হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।

হঠাৎ মঞ্চের অন্ধকার থেকে একটি পরিচিত, কিন্তু দীর্ঘদিন নিখোঁজ কণ্ঠ শোনা গেল। রোহন বসুর কণ্ঠে সংলাপের শব্দগুলো স্পষ্টভাবে রণদীপের কানে পৌঁছল—“সত্যকে মঞ্চ থেকে মুছে ফেলা যায় না।” শব্দগুলো যেন কেবল শুনানোর জন্য নয়, বরং মঞ্চের স্থিরতা এবং রহস্যময় অন্ধকারের মধ্যে শক্তি ছড়াচ্ছিল। রণদীপ বুঝতে পারল, এই কণ্ঠ শুধু অতীতের স্মৃতি নয়, বরং একটি সংকেত—যে সত্য লুকানো নয়, প্রকাশের জন্য অপেক্ষা করছে। তিনি ধীরে ধীরে কণ্ঠের উৎস খুঁজতে লাগল, মঞ্চের প্রতিটি আড়াল ও কক্ষ মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করল। তখন তার মনে হলো, ছায়ামূর্তির উপস্থিতি এবং রোহনের কণ্ঠ মিলিত হয়ে একটি নতুন পথ দেখাচ্ছে, যা তাকে অপরাধীদের ফাঁস করার সুযোগ দিতে পারে।

রণদীপের মনোযোগ সবদিকে ছড়িয়ে থাকা নথি, পুরনো চিঠিপত্র এবং মঞ্চের দৃশ্যের সঙ্গে মিলিত হলো। মনে হল, সবকিছু এক জটিল কৌশল হিসেবে সাজানো হয়েছে—রোহন নাটকের মাধ্যমে সমাজের দুর্নীতি ও অপরাধীদের মুখোমুখি হওয়ার বার্তা রেখেছিলেন। এই সত্যটি বুঝতে পেরে রণদীপ ধীরে ধীরে সাহস নিয়ে নিজেকে মঞ্চের কেন্দ্রে স্থাপন করল। তার চোখে ঝলমল করছিল প্রত্যাশা এবং সংকল্প। অর্পিতা ও সায়ন্তনের দিকে তাকিয়ে সে জানাল যে, তাদের কেবল নজর রাখতে হবে, কারণ মঞ্চের প্রতিটি দৃশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করছে। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ছায়া যেন রহস্যের চাবিকাঠি।

অধ্যায়ের শেষ অংশে রণদীপ উপলব্ধি করল যে, ছায়ামূর্তির সাথে মুখোমুখি হওয়া মানে শুধু ভয়ের মুখোমুখি হওয়া নয়, বরং সত্যকে প্রকাশের জন্য নিজের ভয় জয় করা। সে বুঝল, অপরাধীদের ফাঁস করার উপায় এই মঞ্চের মধ্যে লুকানো—রোহনের সংলাপ, ছায়ামূর্তি এবং নাটকের ভেতরের ইঙ্গিতগুলো সব মিলিয়ে একটি পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করছে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে রণদীপের মনে দৃঢ় সিদ্ধান্ত জন্ম নিল, যে সে এই রহস্য উদঘাটন করবে এবং সমাজের অন্ধকার ও লুকানো অপরাধকে সামনে নিয়ে আসবে। এই অধ্যায় পাঠককে সরাসরি রহস্যের মূলের কাছে নিয়ে আসে, যেখানে সাহস, সত্য এবং ন্যায়ের মিলিত শক্তি ছায়ামূর্তির আড়ালকে ভেদ করতে পারে।

দশ

রাতের অন্ধকারে থিয়েটারের ভিতরে সব কিছুর অবস্থা একেবারে শান্ত মনে হলেও, রণদীপ ও অর্পিতার মনে উত্তেজনা এবং কৌতূহল উভয়ই তীব্র ছিল। শেষ রাতের জন্য তারা সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিল—প্রমাণ, নথি এবং মঞ্চের প্রতিটি কোণ পর্যবেক্ষণ করার জন্য। আগের রাতের অন্ধকার এবং ছায়ামূর্তির উপস্থিতি তাদের ভয় দেখিয়েছিল, তবে এবার তারা আরও দৃঢ় সংকল্প নিয়ে এসেছে। রণদীপ জানত যে, ষড়যন্ত্রের মূল রহস্য উন্মোচন না করলে থিয়েটার ও রোহনের স্মৃতি নষ্ট হয়ে যাবে। মঞ্চে ধীরে ধীরে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে তিনি দেখতে পেলেন, সাধারণ দিনের মতো নয়, এই রাতে কোনো অদ্ভুত প্রযুক্তি বা আলো ব্যবহার করে থিয়েটারের ভেতরেকার আবহ মনের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি শব্দ যেন একটি নাট্যকারের পরিকল্পনা নয়, বরং মানুষের কৌশল ও চক্রান্তের ফল।

তারা শিগগিরই বুঝতে পারে যে, কমলেশ মিত্রের লোকজনই এই সমস্ত ভয়ঙ্কর দৃশ্য তৈরি করেছে। বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা ছায়া এবং অদ্ভুত আলো তৈরি করছিল, যেন থিয়েটারের পরিবেশ অভিশপ্ত মনে হয়। মানুষের মনে ভয় জন্মানোই ছিল মূল উদ্দেশ্য—যাতে জমি দখল সহজ হয়। রণদীপ ও অর্পিতা সব প্রমাণ সংগ্রহ করে দেখল, কিভাবে প্রযুক্তি ব্যবহার করে কল্পনার ভয়কে বাস্তবে পরিণত করা যায়। প্রায় প্রতিটি ধাপ ছিল সুচিন্তিত, যাতে কেউ সহজে বুঝতে না পারে যে, সবকিছু মানবসৃষ্ট। তাদের চোখে ধীরে ধীরে ষড়যন্ত্রের খোলস উন্মোচিত হতে থাকে, এবং তারা অনুভব করে যে, অনেকের বিশ্বাস, ভয় এবং প্রতিক্রিয়া কেবল এক নাটকীয় কৌশলেই তৈরি হয়েছে।

তবে, এই বাস্তবতা প্রকাশের পরেও একটি রহস্য রয়ে গেল—শেষ রাতে, যখন সমস্ত প্রযুক্তি বন্ধ করা হলো এবং মঞ্চ সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ, হঠাৎ এক অদৃশ্য কণ্ঠ আবার সংলাপ উচ্চারণ করল। শব্দগুলো স্পষ্ট, গভীর এবং মানবসাধ্য নয়—যেমন সত্যিই কোনো অদৃশ্য আত্মা মঞ্চে অভিনয় করছে। রণদীপ ও অর্পিতা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে অবাক হলো। তারা বুঝতে পারল, শুধু মানুষের ষড়যন্ত্রই নয়, সম্ভবত কিছু সত্যিই এমন আছে যা মানববুদ্ধি পর্যবেক্ষণ করতে পারে না। এই মুহূর্তে তাদের মনে প্রশ্ন জাগল—সবই কি কেবল মানুষের কৌশল, নাকি থিয়েটারে সত্যিই একটি অসমাপ্ত নাটকের আত্মা আজও অভিনয় করছে?

অধ্যায়ের শেষে রণদীপ ও অর্পিতা সিদ্ধান্ত নিল যে, তারা এই রহস্যকে কেবল বিজ্ঞান বা প্রমাণের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবে না, বরং অনুভূতি ও সম্ভাবনার দিক থেকেও মূল্যায়ন করবে। থিয়েটারের ইতিহাস, রোহনের নাটক, ছায়ামূর্তি এবং মানুষের ষড়যন্ত্র—সব মিলিয়ে একটি গভীর জটিলতা তৈরি করেছে। সত্যের আলো এখন উন্মোচিত হয়েছে—ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়েছে, কমলেশ মিত্রের খেলা ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু সেই অদৃশ্য কণ্ঠের উপস্থিতি তাদের মনে একটি অনিশ্চয়তা রেখেছে, যা থিয়েটারের অতীত ও বর্তমানকে জড়িয়ে রাখে। এই অধ্যায় পাঠককে শেখায় যে, কখনো কখনো সত্য শুধুমাত্র প্রকাশ পায় না, তা অনুভূতিও হয়, এবং রহস্যের শেষ চুম্বকটি সবসময় মানবজ্ঞানকে পুরোপুরি বোঝাতে পারে না।

শেষ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *