শৌর্য সেনগুপ্ত
অধ্যায় ১
অরিন্দম সেন কলকাতার এক নামী দৈনিকের অনুসন্ধানী সাংবাদিক, যার জীবনের মূল নীতি হলো—কোনো খবরের সত্যতা যাচাই না করে তা প্রকাশ করা নয়। এক বর্ষার বিকেলে অফিসের কাজ শেষ করে সে যখন চা খেতে রাস্তার ধারের ছোট্ট দোকানে দাঁড়িয়েছিল, তখনই পরিচিত এক বৃদ্ধ লোক, হরিদাসবাবু, এসে বসে পড়েন তার পাশে। হরিদাসবাবু একসময় পত্রিকার ফ্রিল্যান্স রিপোর্টার ছিলেন, তবে গত কয়েক বছর ধরে তিনি গ্রামের নানা রহস্যময় কাহিনি ও লোকগাথা নিয়ে গবেষণা করছিলেন। সেদিন কথায় কথায় তিনি এক অদ্ভুত ঘটনার উল্লেখ করেন—তারাপীঠের কাছের এক পুরোনো শ্মশানে, প্রতি পূর্ণিমার রাতে, নাকি কিছু তান্ত্রিক গুরুদের গোপন সভা বসে। লোকমুখে শোনা যায়, সেই সভায় তারা “মহাকাল” নামে এক ভয়ঙ্কর শক্তিকে আহ্বান করে, যে নাকি সময় ও মৃত্যুর ওপর অধিকার রাখে। অরিন্দম প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিলেও, হরিদাসবাবুর চোখের গভীরে দেখা গোপন আতঙ্ক তাকে কৌতূহলী করে তোলে। বৃদ্ধ আরও বলেন, “বাবু, এ শুধু কুসংস্কার নয়, আমি নিজে সেই জায়গার পাশ দিয়ে গেছি, আর মনে হয়েছিল—কেউ আমাকে নজর রাখছে। বাতাসে তখন এক অদ্ভুত গন্ধ, আর দূরে ধোঁয়ার মতো কালো ছায়া।” যুক্তিবাদী অরিন্দম যদিও ভূত-প্রেত বা তান্ত্রিক বিদ্যায় বিশ্বাস করে না, তবুও তার ভেতরের অনুসন্ধানী মন হঠাৎই চ্যালেঞ্জ অনুভব করে। সে ভাবে—যদি এই গুজব আসলেই মানুষের ভয়কে কাজে লাগিয়ে কিছু অসাধু ব্যক্তি অপরাধ ঢাকতে ব্যবহার করে, তাহলে তার তদন্তের মাধ্যমে সত্য প্রকাশ পাবে।
পরদিন অফিসে গিয়ে অরিন্দম তার সম্পাদককে পুরো ঘটনা শোনায় এবং সেখানে যাওয়ার অনুমতি চায়। সম্পাদক প্রথমে কিছুটা অনিচ্ছুক ছিলেন, কারণ তারাপীঠের আশপাশে এ ধরনের “অপঘটন” নিয়ে আগেও কিছু সাংবাদিক হারিয়ে গিয়েছিলেন বা মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিলেন। কিন্তু অরিন্দমের আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গি দেখে সম্পাদক শেষমেশ রাজি হন এবং তাকে একটি হালকা কিন্তু কার্যকর ক্যামেরা, সাউন্ড রেকর্ডার এবং একটি শক্তিশালী টর্চলাইট সঙ্গে নিতে বলেন। সেই রাতেই অরিন্দম মানচিত্র দেখে শ্মশানের অবস্থান নির্ধারণ করে, স্থানীয় সূত্রের খোঁজে ফোনে যোগাযোগ করে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়—কারও মুখেই সেই শ্মশানের সঠিক ঠিকানা নেই। সবাই শুধু বলে, “তারাপীঠের দক্ষিণে পুরোনো মহাশ্মশান… ওদিকে কেউ যায় না।” এমনকি স্থানীয় এক হোটেল মালিক তাকে সাবধান করে দেন, “সাহেব, পূর্ণিমার রাতে ওই পথ একদম এড়িয়ে চলুন, ওখানে গেলে আর ফেরার রাস্তা থাকে না।” এইসব সতর্কবার্তা অরিন্দমকে ভয় না দেখিয়ে বরং আরও দৃঢ় করে তোলে। তার মন ঠিক করে—গুজব হোক বা সত্য, পূর্ণিমার রাতে সে শ্মশানে যাবে এবং যা দেখবে, ক্যামেরায় ধরে আনবে।
পূর্ণিমার আগের দিন সন্ধ্যায় অরিন্দম নিজের ব্যাগ গোছাতে শুরু করে—ক্যামেরা, লেন্স, অতিরিক্ত ব্যাটারি, সাউন্ড রেকর্ডার, নোটবুক, একটি ছোট ফার্স্ট এইড কিট, বোতলজাত জল আর টর্চলাইট। মন যতই দৃঢ় থাকুক, তার ভেতরে এক ধরনের অদ্ভুত টান এবং অল্প শঙ্কা তৈরি হচ্ছিল, যা সে স্বীকার করতে চাইছিল না। রওনা দেওয়ার আগে হরিদাসবাবু আবার এসে তাকে বলেন, “যদি যেতেই হয়, মনে রেখো, যা দেখবে তা বিশ্বাস করো—কিন্তু কারও চোখের দিকে তাকিয়ো না।” এই অদ্ভুত উপদেশে অরিন্দম খানিক হেসে জবাব দিলেও, কোথাও যেন মনে হচ্ছিল এই কথার পেছনে গভীর অর্থ আছে। রাতে সে ঘুমোতে গেলেও অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে—চাঁদের আলোয় ভাসমান ধোঁয়ার মধ্যে এক বিশাল সিংহাসন, তাতে বসে আছে এক ছায়ামূর্তি, যার চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলছে। ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর তার বুক ধড়ফড় করছিল, কিন্তু সে নিজেকে বোঝাল—এ সবই তার উত্তেজনা আর কৌতূহলের ফল। পূর্ণিমার রাত ঘনিয়ে আসছে, আর সে প্রস্তুত, শ্মশানের অন্ধকারে পা রাখতে।
অধ্যায় ২
সকালবেলায় কলকাতার আকাশ ছিল মেঘলা, কিন্তু বেলা বাড়তেই হালকা রোদে ভিজে উঠল শহর। অরিন্দম সেন তার ব্যাগ গুছিয়ে নিল—ক্যামেরা, নোটবুক, অডিও রেকর্ডার, অতিরিক্ত ব্যাটারি, টর্চলাইট, কিছু শুকনো খাবার, আর বোতলজাত জল। হোটেল ও রেলস্টেশনের বুকিং আগেই করে রেখেছিল, তাই কোনো তাড়াহুড়ো ছিল না। তবুও মনে হচ্ছিল আজকের যাত্রা যেন সাধারণ কোনো অ্যাসাইনমেন্ট নয়—এ যেন অদৃশ্য এক শক্তির দিকে এগিয়ে যাওয়া। বাসে ওঠার আগে সে আবার হরিদাসবাবুর কথাগুলো মনে করল—“যদি যেতেই হয়, কারও চোখের দিকে তাকিয়ো না।” এই সতর্কবার্তার অর্থ তখনও তার কাছে পরিষ্কার নয়, কিন্তু অন্তরে একটা অদ্ভুত অস্বস্তি রেখে গিয়েছিল। কলকাতা থেকে তারাপীঠের পথ দীর্ঘ হলেও অরিন্দম জানত, প্রতিটি মাইল তাকে কাছে নিয়ে যাচ্ছে সেই শ্মশানের, যেটি নিয়ে এত গুজব ছড়ানো। বাসের জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্যপট বদলাচ্ছিল—পিচঢালা রাস্তার দুই পাশে ধানক্ষেত, মাঝেমধ্যে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো মন্দির, আর রাস্তার ধারে চা-বিক্রেতারা হুঁশিয়ারি দিচ্ছে অপরিচিত পথিকদের। বাস থামলে অরিন্দম নেমে চা খেতে যায়, আর সেই সময়ই স্থানীয় এক বৃদ্ধ দোকানি, তার চুল পাকা, গায়ে ধুতি, কাঁপা গলায় বলে ওঠে—“আপনি কি তারাপীঠ যাচ্ছেন? ওখানকার দক্ষিণ দিকের পথটা এড়িয়ে চলবেন, বিশেষত আজ রাতে। পূর্ণিমায় ওই দিকে গেলে আর ফেরার রাস্তা নাও পেতে পারেন।” অরিন্দম হেসে জবাব দিলেও বৃদ্ধের চোখে যে আতঙ্ক সে দেখল, তা বাসে উঠে যাওয়ার পরও তার মনে ঘুরপাক খেতে থাকল।
পথ যত এগোচ্ছিল, ততই বাতাসে এক ধরনের গুমোট ভাব এসে পড়ছিল। ছোট ছোট জনপদ পেরিয়ে বাস যখন তারাপীঠের কাছাকাছি পৌঁছল, তখন আকাশে চাঁদ উঠতে শুরু করেছে—যদিও এখনো পূর্ণিমা আসেনি, তবু তার উজ্জ্বলতা গাছের ফাঁক দিয়ে পথের ওপর ছিটকে পড়ছিল। রাস্তার ধারে কিছু দোকান বন্ধ হয়ে গেছে, বাকিগুলোর সামনে প্রদীপ জ্বলছে, আর সেগুলোর আলোয় ছায়ারা লম্বা হয়ে মাটিতে পড়ছে। বাস থেকে নেমে অরিন্দম একটি ভাড়ার গাড়ি নিল, যাতে তাকে স্থানীয় লজে পৌঁছে দেবে। গাড়ির চালক, মাঝবয়সী এক ব্যক্তি, সিগারেট খেতে খেতে বলল, “আপনি কি মন্দির দর্শন করতে এসেছেন, না অন্য কোনো কাজে?” অরিন্দম সত্য গোপন করে বলল, “শুধু দর্শন।” কিন্তু চালক তার দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসি হেসে যোগ করল, “দক্ষিণের দিকে যাবেন না, বাবু। পূর্ণিমার আগে-পরে ওদিকে খুব খারাপ কিছু ঘটে।” চালকের কণ্ঠে এমন নিশ্চিত ভয় ছিল, যেন সে নিজেই সেই অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছে। লজে পৌঁছে ব্যাগ রাখার পরও অরিন্দমের মনে হচ্ছিল, যেন সে চারদিক থেকে এক অদৃশ্য সতর্কবার্তার জালে জড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু সাংবাদিক হিসেবে এতবার হুমকি, গুজব ও লোককথা শুনে সে শিখেছে—ভয় পাওয়া মানে গল্পের আসল সত্য কখনোই ধরা পড়বে না। তাই সে ঠিক করল, যত সতর্কবার্তাই আসুক না কেন, কাল রাতে সে শ্মশানে যাবে।
রাত নামার সাথে সাথে লজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে অরিন্দম চারপাশ পর্যবেক্ষণ করল। পূর্ণিমার আলো ক্রমে বেড়ে উঠছে, আর সেই আলোয় দূরের গাছপালা সাদা কুয়াশায় মোড়া মনে হচ্ছিল। বাতাসে ধূপ ও ফুলের গন্ধ ভেসে আসছিল, কিন্তু তার মধ্যে কোথাও যেন এক অদ্ভুত ধাতব গন্ধ মিশে ছিল, যা তাকে অস্বস্তি দিচ্ছিল। লজের মালিক, সদ্যোজাত গোঁফওলা এক তরুণ, বিনা প্রশ্নে তাকে চাবি দিলেও চলে যাওয়ার সময় ধীরে বলল, “যদি রাতে বাইরে বেরোন, রাস্তার বাম দিকটা ধরে হাঁটবেন—ডান দিকে যাবেন না।” অরিন্দম এই নিয়ে তৃতীয়বার একই ধরণের সতর্কবার্তা পেল, কিন্তু সে জানত তার গন্তব্যই সেই ডান দিকের রাস্তা। রাতের খাবার শেষে সে সরঞ্জাম পরীক্ষা করল—ক্যামেরা ঠিক আছে, ব্যাটারি ফুল চার্জ, নোটবুকে প্রাথমিক নোট লেখা হয়ে গেছে। তবুও ভেতরে কোথাও এক অনিশ্চিত কাঁপুনি রয়ে গেল। জানালার বাইরে তাকিয়ে সে দূরে শ্মশানের দিকের আকাশ দেখতে পেল—সেখানে যেন চাঁদের আলো একটু গাঢ়, আর বাতাসও অন্যরকম। মনে হচ্ছিল, অদৃশ্য কোনো চোখ ইতিমধ্যেই তার আগমনের খবর পেয়ে গেছে। পূর্ণিমার রাত প্রায় এসে গেছে, আর অরিন্দম জানে, সে যে পথে পা রাখতে চলেছে, তা হয়তো একমুখী যাত্রা।
অধ্যায় ৩
অন্ধকার রাতকে ছেদ করে পূর্ণিমার আলো যেন অরিন্দমের পথ দেখাচ্ছিল, কিন্তু যতই সে শ্মশানের দিকে এগোচ্ছিল, ততই সেই আলো অদ্ভুতভাবে ফিকে হয়ে আসছিল। শহরের কোলাহল অনেক পেছনে পড়ে গেছে, চারপাশে শুধু ঝোপঝাড়, শুকনো বাঁশবন আর রাতের নীরবতা ভেঙে মাঝে মাঝে শেয়ালের ডাক। অরিন্দম পায়ের শব্দ যতটা সম্ভব নিঃশব্দে রাখার চেষ্টা করছিল, কিন্তু শুকনো পাতার মচমচ শব্দ তাকে নিজের উপস্থিতির কথা বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিল। হঠাৎই বাতাসে ভেসে এল এক অদ্ভুত গন্ধ—পোড়া কাঠ, চন্দন, আর কিছু যেন আরও তীব্র, যা সে প্রথমে চিনতে পারল না। সেই গন্ধের সঙ্গে মিলেমিশে দূরে ভেসে আসছিল গভীর স্বরের মন্ত্রোচ্চারণ, যেন অনেকগুলো গলা একসঙ্গে তাল মিলিয়ে কিছু আহ্বান করছে। গাছের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে সে দেখতে পেল—দূরে কয়েকটি চিতা জ্বলছে, আগুনের লেলিহান শিখা মাঝে মাঝে ছাই উড়িয়ে আকাশে তুলে দিচ্ছে। সেই ছাই চাঁদের আলোয় সাদা ধোঁয়ার মতো ভেসে বেড়াচ্ছিল, যা দেখে মনে হচ্ছিল মৃতদের আত্মারা যেন বাতাসে নাচছে। অরিন্দমের হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে উঠল, কিন্তু সাংবাদিকের স্বভাবসিদ্ধ কৌতূহল তাকে থামতে দিল না। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে সে এমন এক জায়গায় দাঁড়াল, যেখান থেকে পুরো দৃশ্য কিছুটা আড়াল নিয়ে দেখা যায়।
সেখানে তার চোখে ধরা পড়ল লাল পোশাক পরা কয়েকজন মানুষের দল, যারা চিতার আগুন ঘিরে বৃত্তাকারে নড়াচড়া করছে। তাদের হাতে ত্রিশূল, কাঁধে ঝোলানো রুদ্রাক্ষমালা, আর কপালে ছাইয়ের তিলক। আগুনের আলোয় তাদের ছায়া মাটিতে দীর্ঘ ও বিকৃত আকারে পড়ছিল, যা দেখে মনে হচ্ছিল তারা মানুষ নয়, বরং অদ্ভুত কোনো ছায়াপ্রাণী। তারা প্রত্যেকে ধীর, কিন্তু হিসেবি ভঙ্গিতে একে অপরের সঙ্গে সুর মেলাচ্ছিল, যেন এই নাচের প্রতিটি পদক্ষেপের গভীরে রয়েছে কোনো গোপন উদ্দেশ্য। ঠিক তখনই অরিন্দমের চোখে প্রথমবার ধরা পড়ল গুরু অগ্নিবীর। লাল পোশাকের ভিড়ের মধ্যে তার উপস্থিতি যেন আলাদা এক মহিমা ছড়াচ্ছিল। তিনি ছিলেন লম্বা, গাঢ় তামাটে রঙের, কপালে বড় করে আঁকা ছাইয়ের তিলক, আর চোখে অদ্ভুত লালচে আভা। গলায় মোটা রুদ্রাক্ষের মালা, হাতে এক লম্বা লাঠি, যার মাথায় বাঁধানো ছিল রূপালি খুলি। অগ্নিবীরের চারপাশে থাকা মানুষগুলো যেন তার প্রতিটি ইশারায় সাড়া দিচ্ছিল, আর তিনি গভীর, গম্ভীর স্বরে মন্ত্র পাঠ করছিলেন, যা শুনে অরিন্দমের বুকের ভেতর দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল।
অরিন্দম চোখ সরাতে পারছিল না, যেন গুরু অগ্নিবীরের উপস্থিতি তাকে স্থির করে রেখেছে। হঠাৎ সে লক্ষ্য করল, অগ্নিবীরের মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের তীব্রতা বদলাচ্ছে। আগুনের শিখা একবারে উঁচু হয়ে উঠছে, আবার হঠাৎ থমকে যাচ্ছে, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তার সঙ্গে খেলছে। মাঝে মাঝে সেই আগুনের আলোয় চারপাশের অন্ধকারে কিছু ছায়া নড়ে উঠতে দেখা যাচ্ছিল, যা লাল পোশাকধারী তান্ত্রিকদের মধ্যে কাউকে নয়। অরিন্দম বুঝতে পারছিল না, এগুলো কি তার চোখের ভুল, নাকি সত্যিই কিছু আছে, যা মানুষের বাইরের জগৎ থেকে এসেছে। দূরের চিতাগুলোর ভস্ম বাতাসে উড়ে এসে তার মুখে লাগছিল, আর তার সঙ্গে ভেসে আসছিল গরম ধাতব গন্ধ—যেটি সে হাড়গোড় পোড়ার গন্ধ হিসেবে চিনতে পারল। সেই মুহূর্তে তার মনে হল, সে যেন মৃতদের এক নগরীতে এসে পড়েছে, যেখানে প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি গন্ধ জীবিতদের জন্য নয়, বরং অন্য জগতের বাসিন্দাদের জন্য তৈরি। তবুও সে নিজের অবস্থান ধরে রাখল, কারণ জানত—এই দৃশ্যই হতে পারে তার প্রতিবেদনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ।
অধ্যায় ৪
শ্মশানের বাতাস যেন অন্যরকম গা ছমছমে হয়ে উঠেছিল সেই রাতটিতে। চাঁদের ম্লান আলো, দূরের শ্মশানঘাটের চিতাভস্মের গন্ধ, আর মাঝেমধ্যে শকুনের ডানা ঝাপটানোর শব্দ মিলেমিশে এক অদ্ভুত ভয়ের আবহ তৈরি করেছিল। অরিন্দম আগে কখনো এই ধরণের অনুভূতির মুখোমুখি হয়নি। হঠাৎ দূরে মৃদু ঢোলের আওয়াজ শোনা গেল, ধীরে ধীরে তা কাছে আসতে থাকল। তারপর সেই অদ্ভুত মূর্তির আবির্ভাব—গুরু অগ্নিবীর। গায়ের গাঢ় লাল রঙের কাপড়, খালি বুক, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, হাতে কঙ্কালের আকারের দণ্ড, চোখে যেন জ্বলন্ত আগুনের দৃষ্টি। তার আগমন যেন শ্মশানের নীরবতায় এক অদৃশ্য ঝড় তুলল। ধুলোর কুন্ডলী উড়তে লাগল, বাতাস আরও শীতল হয়ে উঠল। শিষ্যদের মধ্যে নীরবতা নেমে এলো, কেউ শ্বাস নেওয়ার সাহস করল না। গুরু ধীরে ধীরে মাটিতে বসে পড়লেন, তাঁর চোখ অরিন্দমের দিকে স্থির হয়ে রইল—সেই দৃষ্টিতে ছিল এমন এক শক্তি, যা মানুষকে ভিতর থেকে কাঁপিয়ে দিতে পারে।
গুরু অগ্নিবীর মাটিতে ছাই ছড়িয়ে দিতে শুরু করলেন—তা ছিল না কোনো সাধারণ ছাই, বরং বহু বছরের সাধনা ও মৃত্যুর সান্নিধ্যে অর্জিত এক গূঢ় বস্তু। ধীরে ধীরে তিনি ছাই দিয়ে একটি বৃত্ত আঁকলেন, তারপর তার ভিতরে সাপের মতো বেঁকে যাওয়া কিছু চিহ্ন তৈরি করলেন, যা অরিন্দম আগে কখনো দেখেনি। সেই ছাইয়ের গন্ধে ছিল আগুন, ধূপ, আর মৃত্যুর ছোঁয়া মেশানো এক অদ্ভুত সুবাস। তারপর গুরু তাঁর দণ্ডটি বৃত্তের কেন্দ্রে স্থাপন করে গভীর কণ্ঠে মন্ত্র উচ্চারণ শুরু করলেন। তাঁর কণ্ঠের ধ্বনি যেন আকাশে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, মাটির নিচে কেঁপে উঠছিল অদৃশ্য কোনো শক্তি। অরিন্দম অনুভব করল, তার চারপাশে হঠাৎ হাওয়া থেমে গেছে, যেন সময়ও থমকে গেছে। শিষ্যরা গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা নত করে বসে আছে, আর গুরু অগ্নিবীরের গলা থেকে বের হওয়া প্রতিটি মন্ত্রধ্বনি যেন শ্মশানের রাতকে আরও ঘন ও ভয়ার্ত করে তুলছে। “শ্মশানের সিংহাসন”—এটাই সেই আসন, যেখানে বসে গুরু মৃত্যুর সাথে কথা বলেন বলে কথিত আছে।
অরিন্দম হঠাৎ অনুভব করল, এক শীতল স্রোত তার মেরুদণ্ড বেয়ে ধীরে ধীরে শিরায় ছড়িয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছিল, এই ঠান্ডা কেবল বাতাসের নয়—এ যেন তার আত্মার গভীরে ঢুকে পড়ছে। গুরু অগ্নিবীরের চোখের অগ্নি, তাঁর মন্ত্রের কম্পন, ছাইয়ের গন্ধ, আর চারপাশের নিস্তব্ধতা মিলেমিশে অরিন্দমকে এমন এক অবস্থায় নিয়ে গেল যেখানে ভয়, কৌতূহল আর সম্মোহন একসাথে কাজ করছিল। তার শ্বাস ভারী হয়ে এল, হৃদস্পন্দন যেন ধীরে ধীরে গুরু অগ্নিবীরের মন্ত্রপাঠের তাল মিলিয়ে চলতে লাগল। এক মুহূর্তে মনে হল, সে যেন নিজের অস্তিত্ব হারাচ্ছে, নিজের শরীর থেকে আলাদা হয়ে অদৃশ্য কোনো শক্তির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। গুরু ধীরে ধীরে তাঁর চোখ বন্ধ করলেন, আর মন্ত্রের সুর আরও গভীর হল—যেন শ্মশানের প্রতিটি ছাই, প্রতিটি কঙ্কাল, প্রতিটি মৃত আত্মা সেই ধ্বনির সাথে একাত্ম হয়ে উঠেছে। অরিন্দম বুঝতে পারল, সে এমন এক দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে, যেখান থেকে ফিরে আসা বা এগিয়ে যাওয়া—দুটোই তার জীবনের জন্য চরম মোড় হয়ে উঠতে পারে।
অধ্যায় ৫
অরণ্যের ভেতরকার গম্ভীর নিস্তব্ধতা ভেদ করে মাধব নাথের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি চারপাশে ঘুরছিল। গুরু অগ্নিবীরের সঙ্গে শিষ্যত্বে থাকার বছরগুলোতে সে শিখেছে কিভাবে শব্দের ফাঁক, বাতাসের দিক, আর পাতা নড়ার তাল দেখে অদৃশ্য শত্রুর উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। সেইদিন সন্ধ্যার আকাশে লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে, ঘন গাছের ডালপালার ফাঁক দিয়ে সূর্যের শেষ রশ্মি পড়ছে মাটিতে। গুরুর ধ্যানের সময় হঠাৎ মাধবের কানে আসে হালকা পায়ের শব্দ—এমন শব্দ যা কেবল একজন সতর্ক মানুষই করবে, কিন্তু অভিজ্ঞ শিকারির কানে তা এড়ানো যায় না। ধীরে ধীরে সে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে দূরের একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে একজন মানুষ, মুখ আংশিক ছায়ায় ঢাকা, কিন্তু চোখের মধ্যে কৌতূহল আর অস্থিরতা। মাধবের বুকের মধ্যে স্রোতের মতো ছুটে আসে তীব্র সন্দেহ—এই লোকটি এখানে কী করছে? তার আঙুলের গাঁট শক্ত হয়ে আসে, চোখে এক ঝলক খুনের আগুন জ্বলে ওঠে। সে বুঝে গেছে, এই অপরিচিত লোক হঠাৎ করে এখানে আসে নি, তার উপস্থিতির মধ্যে লুকিয়ে আছে কোনো গোপন উদ্দেশ্য, আর সে উদ্দেশ্য গুরু অগ্নিবীরের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
কিন্তু মাধবের পরবর্তী পদক্ষেপের আগেই গুরু অগ্নিবীর ধ্যানভঙ্গ না করেই যেন চারপাশের সমস্ত কম্পন অনুভব করে ফেলেন। তাঁর হাতের সূক্ষ্ম ইশারা মাধবের দিকে পৌঁছে যায়—এমন এক ইশারা, যা বলে “থামো।” সেই ইশারার মধ্যে ছিল কঠোর সতর্কতা, যেন মাধবের চোখের আগুনও মুহূর্তে নিভে যায়। মাধব হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, কারণ গুরুর এই থামানোর মধ্যে কোনো দ্বিধা নেই, বরং আছে এক অদ্ভুত নিশ্চয়তা। অগ্নিবীর জানেন, এই অচেনা ব্যক্তিকে এখনই আক্রমণ করা ঠিক হবে না। মাধব অনুভব করে, গুরুর দৃষ্টি হয়তো ইতিমধ্যেই ওই ব্যক্তিকে ভেদ করে তার অন্তরের গোপনতম রহস্য স্পর্শ করেছে। বাতাসের মধ্যে এক ধরণের অদৃশ্য টান তৈরি হয়, যেখানে দুইজন শিকারি একে অপরের উপস্থিতি টের পাচ্ছে, কিন্তু কেউই প্রথম আঘাত হানতে চাইছে না। মাধবের বুকের ভেতর ধকধক শব্দ বাড়তে থাকে, আর তার মুঠো শক্ত হলেও, সে বাধ্য হয়ে পিছিয়ে দাঁড়ায়, গুরুর সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস তার নেই।
অন্যদিকে গাছের আড়াল থেকে দাঁড়িয়ে থাকা অরিন্দম এই মুহূর্তের তীব্রতা নিজের চামড়ায় অনুভব করছিল। সে জানে, তার আড়াল ফাঁস হয়ে গেছে—মাধবের চোখে সে শিকার নয়, বরং অনধিকারপ্রবেশকারী, যার জন্য মুহূর্তের মধ্যেই বিপদ নেমে আসতে পারে। তবুও গুরু অগ্নিবীরের সেই থামিয়ে দেওয়া ইশারা তাকে অবাক করে। এর মানে একটাই—গুরু জানেন সে এসেছে, এবং হয়তো তাঁরা চাইছেন তাকে সরাসরি মুখোমুখি হতে দেওয়া হোক। অরিন্দমের মন অস্থির হয়ে ওঠে, কারণ এই নীরব সম্মতির মধ্যে লুকিয়ে আছে একটি অদ্ভুত খেলা—যেখানে সে হয়তো একজন পর্যবেক্ষক নয়, বরং অদূর ভবিষ্যতের খেলোয়াড়। তার পায়ের নিচে শুকনো পাতা মচমচ করে ওঠে, আর সেই শব্দ যেন এই নিস্তব্ধ অরণ্যে অঘোষিত যুদ্ধের ঢাক বেজে ওঠার মতো। অরিন্দম ধীরে ধীরে পিছিয়ে আসে, কিন্তু জানে, এই সাক্ষাৎ শুধু শুরু, এবং এর পর যা ঘটবে, তা আর শুধুই তার নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। এই অদৃশ্য দড়ি-টানাটানির মধ্যে অরণ্যের হাওয়া আরও ঠান্ডা, আর ছায়া আরও ঘন হয়ে আসে।
অধ্যায় ৬
চাঁদের আলোয় ভেসে থাকা সেই রাতের মঞ্চ যেন এক অদৃশ্য মায়াবৃতের আবরণে ঢেকে ছিল। চারদিকে ধূপের গন্ধে ঘন হয়ে উঠেছিল বাতাস, আর ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন ঢোলের ধ্বনি তুলছিল ধীরে ধীরে—যেন কোনও অদ্ভুত আচার শুরু হতে চলেছে। হঠাৎই ভিড়ের ফাঁক দিয়ে আবির্ভূত হলেন তিনি—প্রণতি দেবী। পরনে কেবল সাদা শাড়ি, কিন্তু সেই সরল রঙের মধ্যে লুকিয়ে ছিল এক অজানা জ্যোতি, যেন আকাশের পূর্ণিমা তার গায়ে নেমে এসেছে। চুলের বাঁধনে গুঁজে রাখা কপালের গাঢ় লাল সিঁদুর দূর থেকেও চোখে পড়ছিল, যেন লাল রক্তের বিন্দু চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে। তাঁর চোখদুটি গভীর, যেন সেখানে গোপন রয়েছে বহু জন্মের গল্প, বহু অদেখা রহস্য। মঞ্চে পা রেখেই তিনি এমন এক দৃঢ়তা আর শান্তি ছড়ালেন যে, সামনের ভিড় নিঃশব্দ হয়ে পড়ল। তাঁর ঠোঁট খুলতেই শোনা গেল এক অনন্য তান্ত্রিক স্তোত্র, যা এই জনপদের ভাষায় নয়, বরং প্রাচীন কোনও অজানা মন্ত্রে বাঁধা। সেই সুর যেন একসঙ্গে স্নিগ্ধ আর ভয়াল—যা শুনে অরিন্দমের শরীরের প্রতিটি লোম খাড়া হয়ে উঠল। তার মনে হল, এ কোনও সাধারণ গানের সুর নয়; বরং কোনও গোপন শক্তিকে আহ্বান করা হচ্ছে এই স্বরলিপির মাধ্যমে, যেন বাতাসও থেমে গেছে শুনতে।
স্তোত্রের ধ্বনি যতই গভীর হতে লাগল, চারপাশে যেন আলো-ছায়ার খেলা শুরু হল। মঞ্চের ওপরে রাখা প্রদীপের শিখা একবার লম্বা হয়ে উঠছে, আবার হঠাৎ দপ করে নিভে যাচ্ছে, আর সেই মুহূর্তে প্রণতি দেবীর মুখ চাঁদের আলোয় আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছে। দর্শকদের মধ্যে ফিসফিসানি শুরু হয়েছে, কেউ কেউ চোখ নামিয়ে নিচ্ছে, কেউ আবার অভিভূত হয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। কিন্তু অরিন্দমের অনুভূতি আলাদা—তার মনে হচ্ছে এই দৃষ্টি, এই কণ্ঠ, এই উপস্থিতি, সবই যেন আগে কোথাও সে পেয়েছিল। স্মৃতির অন্ধকার থেকে ভেসে আসছে কিছু অস্পষ্ট ছবি—এক পুরনো বাড়ি, জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক নারী, আর সেই একই গভীর দৃষ্টি। স্তোত্রের মাঝে এক মুহূর্তের জন্য প্রণতি দেবী হঠাৎ চুপ করলেন, আর সরাসরি অরিন্দমের দিকে তাকালেন। সেই দৃষ্টি এমন ছিল, যেন তিনি শুধু দেখছেন না, বরং তার আত্মার গভীরে প্রবেশ করছেন। অরিন্দম অনুভব করল, এই চোখ তাকে চিনে ফেলেছে—তার অতীতের অদেখা কোনও অধ্যায় খুলে ফেলছে, যা সে নিজেও ভুলে গিয়েছিল বা ভুলতে চেয়েছিল। তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠল, হাতের তালু ঘেমে গেল, অথচ চোখ সরাতে পারল না।
প্রণতি দেবীর চোখে সেই মুহূর্তে এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি ছিল—চেনা, বিস্ময়, আর এক অনির্বচনীয় আহ্বান। তিনি আবার স্তোত্র শুরু করলেন, তবে এবার তার গলায় যেন ব্যক্তিগত কোনও আবেদন মিশে গেল, যা শুধু অরিন্দমের কানে পৌঁছল। বাকিরা হয়তো শুনল মন্ত্রের ধ্বনি, কিন্তু অরিন্দম যেন শব্দের আড়ালে স্পষ্ট শুনতে পেল—“তুমি ফিরেছ।” সেই কথার সাথে সাথেই তার মনে পড়ল, বহু বছর আগে গ্রাম্য মেলার রাতে এমনই এক সাদা শাড়ি পরা নারী তার দিকে তাকিয়ে ছিল, যার চোখে ছিল এক অব্যক্ত প্রতিজ্ঞা। চারপাশে তখন ধোঁয়া আর আলোর খেলা চলছিল, যেমন এখন চলছে। সে মুহূর্তে অরিন্দম বুঝে গেল, এই সাক্ষাৎ কেবল কাকতালীয় নয়; এর মধ্যে রয়েছে কোনও গভীর নিয়তি। প্রণতি দেবীর কণ্ঠে শেষ স্তোত্র ভেসে উঠতেই মঞ্চের প্রদীপগুলি একসাথে প্রজ্বলিত হল, আর চারপাশে ভিড় হাততালি দিয়ে উঠল। কিন্তু অরিন্দম সেই শব্দ শুনতে পেল না—সে তখনও প্রণতি দেবীর চোখে বন্দি, সেই দৃষ্টি যেন তাকে একটি অনিবার্য পথে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে, যেখান থেকে আর ফিরে আসা সম্ভব নয়।
অধ্যায় ৭
গভীর রাতের নির্জনতায়, গ্রামের শেষ প্রান্তের প্রাচীন শ্মশানের দিকে পা বাড়িয়ে যায় গুরু অগ্নিবীর। তার হাতে ধরা একটি কালো লোহার থালা, যার উপর রাখা চিতা ভস্ম, রক্তে ভেজা পুরোনো কাপড়, আর তিনটি কালো ধূপকাঠি। শ্মশানের চারপাশের শিউলি গাছগুলো যেন হঠাৎ অকারণে কেঁপে উঠছে, পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে ভাঙা সমাধি আর পুড়ে যাওয়া কাঠের উপর। চাঁদের আলো যেন আজ ভিন্ন—ম্লান, ধূসর, আর ভয়াবহ এক ছায়ায় মোড়া। অগ্নিবীর নিঃশব্দে একটি বৃত্ত এঁকে তার ভেতরে থালাটি রাখে, তারপর মাটির উপর চিতা ভস্ম দিয়ে এক প্রাচীন তন্ত্রচিহ্ন আঁকে, যা শুধু গুরুদের কাছে অর্থবহ। বাতাসে ধূপের গন্ধ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু সেই গন্ধে যেন অদ্ভুত এক ধাতব স্বাদ মিশে গেছে—মৃত্যুর গন্ধ। মন্ত্রপাঠ শুরু হতেই তার কণ্ঠ গম্ভীর, গভীর, আর যেন অন্য এক জগতের সুরে বাঁধা। প্রতিটি শব্দ যেন বাতাসকে কেটে যাচ্ছে, চারপাশের নীরবতা ছিঁড়ে ফেলে এক অদৃশ্য কম্পন ছড়াচ্ছে। চারদিক থেকে ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করে, এত তীব্র যে ধূপের ধোঁয়া সোজা আকাশে না উঠে কুণ্ডলির মতো ঘুরতে ঘুরতে বৃত্তের ভেতরে থেমে যায়। দূরে কোথাও এক কুকুর হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে, তারপর থেমে গিয়ে কান্নার মতো দীর্ঘ হাহাকার করে, যেন সে-ও বুঝতে পেরেছে কিছু ভয়ংকর জেগে উঠছে।
অগ্নিবীরের চোখ লালচে, মুখের শিরাগুলো টানটান হয়ে উঠেছে, তার ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বের হওয়া মন্ত্রের শব্দ ক্রমে তীব্রতর হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন প্রতিটি শব্দ চারপাশের শূন্যতাকে চিরে সেই অদৃশ্য শক্তির কাছে পৌঁছাচ্ছে, যাকে সে আহ্বান করছে। তার সামনে রাখা রক্তে ভেজা কাপড়টি ধীরে ধীরে ভিজে গিয়ে কালো আঠালো তরল ছাড়তে শুরু করেছে, যা চিতা ভস্মের সাথে মিশে গিয়ে বৃত্তের প্রান্তে গাঢ় রঙের রেখা তৈরি করছে। বাতাস আরও ঠান্ডা হয়ে যায়, এমন ঠান্ডা যেন শীতল হিমবাহ থেকে সরাসরি এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে হাড় পর্যন্ত। দূরে শেয়ালের ডাক শোনা যায়, আর সাথে সাথে গাছের পাতাগুলো থরথর করে কাঁপে—কিন্তু আশেপাশে কোনো ঝড় নেই। চাঁদের আলো আরও ম্লান হয়ে এসে যেন ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে যায়, কেবল ধূপের আগুন আর বৃত্তের ভেতরের অদ্ভুত আলো দৃশ্যমান থাকে। সেই আলো কোনো প্রাকৃতিক আলো নয়—এটি লাল, অস্থির, আর মাঝে মাঝে কালো রঙের ছায়া এর মধ্যে ভেসে ওঠে। এই ছায়াগুলো বৃত্তের কিনারা ছুঁয়ে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে, যেন তারা বাইরে আসার পথ খুঁজছে কিন্তু কোনো শক্তি তাদের আটকে রেখেছে।
মন্ত্রপাঠের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে অগ্নিবীর হঠাৎ তার কণ্ঠ আরও নিচু করে ফেলে, কিন্তু শব্দগুলো এত ভারী যে মনে হয় মাটির নিচে গিয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। চিতা ভস্মের গন্ধ, রক্তের ধাতব গন্ধ, আর ধূপের কটু গন্ধ মিলেমিশে বাতাসকে ভারী করে তুলেছে, শ্বাস নেওয়াও কষ্টকর। বৃত্তের মাঝখানে থাকা ছায়াগুলো এবার আকার নিতে শুরু করে—প্রথমে অস্পষ্ট, তারপর ধীরে ধীরে যেন মানুষের মতো অবয়ব দেখা যায়, কিন্তু তাদের মুখ নেই, শুধু ফাঁপা কালো গহ্বর। দূরে আবার কুকুরের হাহাকার শোনা যায়, এবার আরও করুণ, যেন সে অদৃশ্য শৃঙ্খলে বন্দী। হঠাৎ এক তীব্র ঝোড়ো বাতাস এসে ধূপগুলোকে নাড়িয়ে দেয়, কিন্তু আগুন নিভে যায় না—বরং আরও বড় হয়, লাল থেকে গাঢ় বেগুনি হয়ে ওঠে। অগ্নিবীর চোখ বন্ধ করে শেষ মন্ত্র উচ্চারণ করে, আর তার হাত দুটো আকাশের দিকে তুলে ধরে। মুহূর্তের মধ্যে, বৃত্তের ভেতরের অবয়বগুলো একসাথে মাথা তুলে যেন অগ্নিবীরকে চেয়ে থাকে—মুখহীন সেই দৃষ্টি এত শীতল, এত গভীর, যেন তা মানুষের আত্মা ছিঁড়ে নিতে পারে। ঠিক তখনই, দূরের অন্ধকারে কেউ বা কিছু নড়েচড়ে ওঠার শব্দ আসে, এবং বোঝা যায় আহ্বান সম্পূর্ণ হয়েছে—যা আসার, তা এসে গেছে।
অধ্যায় ৮
মন্দিরের আঙিনায় তখন নিস্তব্ধতা এমন গভীর যে বাতাসের শব্দও যেন কোথাও হারিয়ে গেছে। হঠাৎই চারপাশের ধূপের ধোঁয়া আর প্রদীপের জ্বলা-নিভে যাওয়া আলোর মধ্যে এক অদ্ভুত পরিবর্তন আসতে থাকে। ধোঁয়াগুলো যেন কোনো অদৃশ্য শক্তির নিয়ন্ত্রণে ঘূর্ণি খেয়ে খেয়ে এক বিন্দুতে জমাট বাঁধতে থাকে। সেই বিন্দুটি ধীরে ধীরে আকার নিচ্ছে—প্রথমে অস্পষ্ট ছায়া, তারপর ধীরে ধীরে এক কালো অবয়ব। অবয়বটির দেহ গঠিত যেন ধোঁয়া আর ছাইয়ের মিশ্রণে, কিন্তু তবুও তার ভেতর থেকে বেরোচ্ছে এমন এক তাপ ও গন্ধ যা মানুষের বুক ধকধক করিয়ে দেয়। অবয়বের মুখের জায়গায় কিছুই দেখা যাচ্ছিল না—শুধু শূন্যতা, আর সেই শূন্যতার ভেতর থেকে যেন দম বন্ধ করা অন্ধকার বেরোচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত পর, সেই অন্ধকারে দুইটি ক্ষীণ আলো ফুটে উঠল, যা ধীরে ধীরে রক্তিম হয়ে প্রবল জ্যোতি ছড়াতে লাগল। দুটি লাল চোখ ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে—এমন তীক্ষ্ণ, অমানবীয় দৃষ্টি যে মনে হয় তা সরাসরি আত্মার গভীরে গিয়ে আঘাত করছে। উপস্থিত সবাই যেন একসাথে নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে আছে, আর পরের মুহূর্তে, যেন কোনো অদৃশ্য আদেশে, তারা মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতে শুরু করল। প্রণামের ভঙ্গি এত গভীর আর একাগ্র যে মনে হচ্ছিল তারা এই অবয়বের কাছে নিজেদের সমস্ত অস্তিত্ব সমর্পণ করে দিচ্ছে। কারও মুখে কোনো কথা নেই, শুধু নিস্তব্ধতার ভেতর ভয় আর ভক্তির অদ্ভুত মিশ্রণ ছড়িয়ে আছে।
অরিন্দম দূর থেকে এই দৃশ্য দেখছিল, তার মনে হচ্ছিল সময় থমকে গেছে। শরীরের প্রতিটি স্নায়ু যেন শিথিল হয়ে আসছে, শ্বাস ধীর হয়ে যাচ্ছে, এমনকি দাঁড়িয়ে থাকা পর্যন্ত কঠিন হয়ে উঠেছে। তার মাথার ভেতরে এক অজানা চাপ অনুভূত হচ্ছে, যেন কেউ তার চিন্তা আর ইচ্ছাশক্তি ধীরে ধীরে শুষে নিচ্ছে। সে বোঝার চেষ্টা করছে—এটা কি স্বপ্ন? কিন্তু বাতাসের গন্ধ, মাটির শীতলতা, ধোঁয়ার কটু স্বাদ—সবই এত বাস্তব যে স্বপ্ন বলে মানা যায় না। তার চোখ অবয়বটির দিকে স্থির হয়ে আছে, আর সেই চোখের লাল জ্যোতি যেন তাকে ভেতর থেকে শূন্য করে দিচ্ছে। অরিন্দম বুঝতে পারছিল না সে ভয় পাচ্ছে, না কি এক অদ্ভুত মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। অবয়বটির দৃষ্টি যেন তার অস্তিত্বের সব গোপন কোণে ঢুকে পড়েছে—তার অতীত, তার পাপ, তার লুকানো ব্যথা সবকিছু খুলে দেখছে। এই দৃষ্টি থেকে পালানো অসম্ভব, যেন মহাকালের শীতল হাত তার কাঁধে এসে পড়েছে। মন্দিরের বাইরে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে, আর দূরে কোথাও বজ্রের মতো গভীর গর্জন শোনা যাচ্ছে—যেন এই কালো অবয়ব শুধু এই স্থানেই নয়, সময়ের সীমানা পেরিয়েও তার উপস্থিতি ছড়িয়ে দিচ্ছে।
মুহূর্তগুলো আরও অদ্ভুত হয়ে উঠল যখন অরিন্দম অনুভব করল, তার আশেপাশের মানুষজন ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে—তাদের দেহ যেন ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসে, কিন্তু তাদের প্রণামের অবস্থান অটল রয়ে গেছে। অবয়বটির লাল চোখ হঠাৎই তার দিকে স্থির হলো, আর অরিন্দমের শরীর সম্পূর্ণ অবশ হয়ে গেল। সে অনুভব করল যেন সময়ের এক বিশাল ঘূর্ণিপাকে সে টেনে নেওয়া হচ্ছে, যেখানে অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ একসাথে মিশে যাচ্ছে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল অজানা দৃশ্য—প্রাচীন যুদ্ধক্ষেত্র, ভাঙা মন্দির, অসংখ্য মানুষের কান্না, আর রক্তে ভিজে যাওয়া নদী। সেই সমস্ত দৃশ্যের ভেতর দিয়ে এক অদৃশ্য কণ্ঠ বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে—“সবই সময়ের, কিছুই তোমার নয়।” অরিন্দম চেষ্টা করল চিৎকার করতে, কিন্তু কোনো শব্দ বেরোল না। তার মন শুধু বুঝতে পারল—সে আর নিজের হাতে নেই, সে এক অজানা শক্তির খেলায় বন্দি। আর তখনই অবয়বটির ছায়া তার দিকে বাড়িয়ে এল, যেন তাকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে নেবে। এই শেষ মুহূর্তে, অরিন্দমের মনে শুধু একটাই প্রশ্ন বাজল—সে কি এই দৃশ্য থেকে জেগে উঠবে, নাকি এই কালো অবয়বের সঙ্গে মিলিয়ে যাবে মহাকালের ছায়ায় চিরকালের জন্য।
অধ্যায় ৯
গুহার গভীরে তখন মশালের হলুদ-লাল আলো নাচছে, দেয়ালের ছায়াগুলো যেন প্রাচীন কোনো অশুভ নৃত্য করছে। গুরু অগ্নবীরের মুখে এক অদ্ভুত তৃপ্তি ও ক্রোধ মিশ্রিত অভিব্যক্তি—যেন তিনি বহু প্রতীক্ষিত এক আচার শুরু করতে চলেছেন। তার চারপাশে সাজানো আছে বলির সামগ্রী—প্রাচীন ধাতুর পাত্রে ভরা কালচে তেল, শুকনো ভেষজগাছ, পশুর হাড়, কিছু তামার মুদ্রা, আর একখানা কুটিল আকারের মুখোশ। ধীরে ধীরে তিনি সেই সামগ্রীগুলো মহাকালের দিকে ঠেলে দেন, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তিকে আহ্বান জানাচ্ছেন। গুহার ভিতর হালকা কাঁপুনি ছড়িয়ে পড়ে, বাতাস ঘন হয়ে ওঠে, আর এক অচেনা গন্ধ নাকে এসে লাগে—পচা কাঠের মতো, কিন্তু তাতে আবার অদ্ভুতভাবে লোভনীয় কোনো সুবাস মিশে আছে। অগ্নবীরের ঠোঁট নড়ছে, কিন্তু শব্দ শোনা যায় না—শুধু তার চোখে প্রতিফলিত হচ্ছে মশালের আলো, যেন চোখদুটো আলাদা কোনো জীবন্ত সত্তা হয়ে উঠেছে।
প্রণতি দেবী তখন এগিয়ে এসে হাতে ধরা অদ্ভুত ছুরিটি তুলে নিলেন। ছুরির ধারটি চন্দ্রালোকে দেখা পড়লে বোঝা যেত, তাতে খোদাই করা আছে অসংখ্য গোপন চিহ্ন—কিছু প্রাচীন দেবতার প্রতীক, কিছু আবার এতটাই অপরিচিত যে অরিন্দম সেগুলো আগে কখনও দেখেনি। ধীরে ধীরে তিনি নিজের তালুর ওপর ধারটি রাখলেন, এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে যেন মন্ত্রপাঠ করলেন, তারপর হালকা চাপ দিলেন—এবং ছুরিটি চামড়া ভেদ করে গেল। রক্ত ফোঁটা ফোঁটা ঝরে পড়তে লাগল, আর সেই রক্ত যেন মাটিতে পড়েই শুষে নিচ্ছে অদৃশ্য কোনো শক্তি। মাটির ওপরের নকশাগুলো, যা আগে নিছক আঁকিবুঁকি মনে হয়েছিল, রক্ত পড়তেই যেন জীবন্ত হয়ে উঠল—হালকা লালচে আভা ছড়াতে শুরু করল, আর গুহার ভিতর এক অদ্ভুত কম্পন বাড়তে লাগল। প্রণতির মুখে ব্যথা বা ভয় নেই, বরং এক ধরণের শান্তি—যেন এই আচার তার কাছে ভক্তির সমান।
ঠিক তখনই, পেছন থেকে মাধব নাথের শক্ত হাত অরিন্দমের কাঁধে পড়ল। “চল, এখন তোর পালা,” তার গলা গভীর ও শীতল, তাতে কোনো মানবিক উষ্ণতা নেই। অরিন্দম প্রতিরোধ করার চেষ্টা করল, কিন্তু মাধবের আঁকড়ে ধরা হাত লোহার বেড়ির মতো। তাকে টেনে আনা হলো সেই লাল আভাময় বৃত্তের মাঝখানে, যেখানে গরম বাতাস যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে। অগ্নবীর মশাল উঁচিয়ে কিছু উচ্চারণ করলেন, আর প্রণতি দেবী সেই রক্তমাখা ছুরি অরিন্দমের দিকে এগিয়ে দিলেন। মুহূর্তটিতে অরিন্দমের মনে হলো—এই গুহা, এই মানুষগুলো, আর এই আচার—সব মিলিয়ে সময় যেন অন্য কোথাও আটকে গেছে, এমন এক জায়গায় যেখানে জীবনের বিনিময়ে কেবল অন্ধকারই লাভ করা যায়। তার হৃদপিণ্ড দ্রুত স্পন্দিত হতে লাগল, শ্বাস ভারী হয়ে উঠল, আর চোখের সামনে মশালের আলো ঝাপসা হয়ে গেল—কিন্তু তিনি জানতেন, পরের কয়েক সেকেন্ডই হয়তো তার জীবনের শেষ অধ্যায় লিখে দেবে।
অধ্যায় ১০
শেষ দৃশ্যের এই মুহূর্তে আকাশ যেন তার সমস্ত আলো ফিরিয়ে নিয়েছে, যেন রাত নিজেই এক গভীর কূপে ডুবে গেছে যেখানে চাঁদের আভা এক বিন্দুও বাকি নেই। শ্মশানের বাতাসে তখন শুধু মৃত কাঠ পোড়ার গন্ধ নয়, আরও কিছু ঘন ও অদৃশ্য উপস্থিতি ছিল, যা অরিন্দমের শ্বাসকেও ভারী করে তুলছিল। মহাকালের চোখ—দুটি দীপ্ত, অতল গভীরতায় ভরা গোলক—দূরের চিতা-ছাইয়ের ওপারে যেন ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছিল, কিন্তু অদ্ভুতভাবে এই গতি ছিল সময়ের বাইরে, একদিকে শ্লথ, আবার অন্যদিকে তীব্র। তার চারপাশে পুরনো শ্মশানের ভাঙা ঘাট, পোড়া কাষ্ঠের উপর জমে থাকা ছাই, আর কুয়াশায় আচ্ছন্ন গাছের ডালপালা যেন ধীরে ধীরে বাঁক নিয়ে এক গোপন অঙ্গভঙ্গিতে তাকে ঘিরে ফেলছিল। সে বুঝতে পারছিল, এই মুহূর্তে তার প্রতিটি অনুভূতি যেন আর নিজের নয়—হৃদয়ের ধুকপুকানি, ঠান্ডায় শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে আসা শিহরণ, এমনকি চোখের পলকও যেন মহাকালের ইশারায় চলছে। তার কানে তখন দূর থেকে বাজছিল করুণ এক বাঁশির সুর, যা ক্রমশ গভীর শোকের স্রোতে ডুবিয়ে দিচ্ছিল, আর সেই সুরের তালে তালে যেন মহাকালের চোখ আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল।
এই অদ্ভুত আলোতে দাঁড়িয়ে অরিন্দম শেষবারের মতো চারপাশের সবকিছু দেখতে চেষ্টা করল, যেন প্রতিটি ইঞ্চি নিজের চোখে বন্দি করে নিয়ে যাবে—যদি যাওয়া সম্ভব হয়। সে দেখল, এক কোনায় আধপোড়া খয়েরি রঙের ডায়েরি মাটির উপর পড়ে আছে, যা সম্ভবত সেই নিখোঁজ পণ্ডিতের, যার গল্পে শ্মশানের সিংহাসনের অভিশাপের কথা শোনা গিয়েছিল। একটু দূরে, পুড়ে যাওয়া কাঠের ফাঁকে সে যেন দেখতে পেল অদৃশ্য হাতের আকার, যা মুহূর্তের জন্য ছাই সরিয়ে কিছু লুকোনো প্রতীক দেখিয়ে দিল। কিন্তু চোখের পলকে সেই প্রতীক ঢেকে গেল, যেন তাকে জানিয়ে দিল—সবকিছু জানার অনুমতি তার নেই। হঠাৎই বাতাস থমকে গেল, আর শূন্য থেকে ভেসে এল এমন এক শীতলতা যা তাকে ভেতর থেকে বরফে রূপান্তরিত করে দিল। মহাকালের চোখ তখন তার একদম কাছে, এতটাই কাছে যে অরিন্দম মনে করল, সে যদি হাত বাড়ায় তবে ছুঁয়ে ফেলতে পারবে, কিন্তু কোনও অদ্ভুত ভয়ের বাঁধন তাকে স্থির করে রেখেছিল। এই মুহূর্তে সে যেন বুঝল, এই আলো মানে কেবল দৃষ্টি নয়, বরং সময়ের ভিতর ঢুকে যাওয়ার এক দ্বার—যেখান থেকে একবার প্রবেশ করলে আর ফিরে আসা যায় না।
তারপর হঠাৎই যেন চারপাশের সব শব্দ—বাঁশির সুর, কাঠের টুকরো পোড়ার শব্দ, এমনকি নিজের হৃদয়ের স্পন্দন—সব নিঃশব্দ হয়ে গেল, আর তার উপর নেমে এল এক অন্ধকার ঢেউ। অরিন্দম অনুভব করল, এই অন্ধকার কোনও সাধারণ রাতের মতো নয়—এ যেন তরল, জীবন্ত, এক মহাশূন্যের গহ্বর যা তাকে টেনে নিচ্ছে। চারদিকের দৃশ্য মুছে যেতে লাগল, হাত-পা অসাড় হয়ে এল, আর শেষ মুহূর্তে তার চোখে ভেসে উঠল সেই সিংহাসন—কালো পাথরের তৈরি, চারপাশে অগ্নিশিখা ঘেরা, যার উপরে কোনও রাজা নয়, বরং এক ছায়ামূর্তি বসে আছে। সেই ছায়া যেন তাকে হাত তুলে ইঙ্গিত করল—এসো, চিরতরে এখানে থাকো। গল্প শেষ হয় এই অমীমাংসিত প্রশ্নে—অরিন্দম কি আসলেই বেঁচে ফিরতে পেরেছিল, নাকি শ্মশানের সিংহাসন তাকে সময়ের বাইরে, মহাকালের রাজ্যে চিরকালের জন্য বন্দি করে ফেলেছে? এই শেষ দৃশ্যের পর পাঠকের মনেও সেই চোখের জ্যোতি রয়ে যায়, যা বন্ধ করলে অন্ধকার, আর খুললে এক অসীম রহস্যের গহ্বর।
সমাপ্ত