Bangla - ভূতের গল্প

শ্মশানের শাঁখ

Spread the love

মৈনাক গাঙ্গুলী


এক

সেদিন সন্ধ্যার পর থেকে আকাশে এক অদ্ভুত গুমোট ভাব নেমে এসেছে। বৃষ্টি হবে কিনা বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু বাতাসে যেন স্যাঁতসেঁতে এক শীতলতা ভেসে বেড়াচ্ছে। তরুণ পুরোহিত অরিন্দম চক্রবর্তী মন্দিরের ছোট ঘরে বসে সেদিনের সন্ধ্যারতি সেরে নিজের থালাবাসন ধুচ্ছিল, এমন সময় মন্দিরের দ্বারপাল গুরুচরণ কাঁপা গলায় এসে বলল—”অরিন্দম, তোমাকে রাতেই শ্মশানে যেতে হবে।” অরিন্দম প্রথমে ভ্রূ কুঁচকে তাকাল, কারণ এত রাতে শ্মশানে যাওয়ার কোনো কারণ থাকে না। কিন্তু গুরুচরণ জানাল, আজ অমাবস্যার রাত, আর গ্রামের ‘শ্মশান পূজা’র দিন। পুরোনো বিশ্বাস—এ রাতে শ্মশান দেবতার কাছে বলি ও ধূপ-দীপ না দিলে, গ্রামে অশুভ শক্তি নেমে আসে। এই কাজটা বহুদিন ধরে গ্রামের প্রধান পুরোহিত করতেন, কিন্তু তিনি গত মাসে অসুস্থ হয়ে পড়ায় দায়িত্ব পড়েছে অরিন্দমের কাঁধে। হঠাৎ দায়িত্ব এসে পড়ায় অরিন্দম কিছুটা দ্বিধায় ছিল, তবুও গ্রামের বিশ্বাস আর নিজের পুরোহিত-ধর্ম মানতে সে রাজি হয়ে গেল। বাইরে তখন ঘন কুয়াশা নামতে শুরু করেছে, গাছের ডালগুলোতে স্যাঁতসেঁতে শিশির জমে আছে, আর দূরে কোথাও শেয়ালের দীর্ঘ আর্তনাদ রাতের নিস্তব্ধতাকে আরও ভারী করে তুলছে।

শ্মশানটি গ্রামের একেবারে প্রান্তে, নদীর ধারে, যেখানে শীতল বাতাসে নদীর কুয়াশা মিশে থাকে সারাবছর। অরিন্দম পূজার সামগ্রী গুছিয়ে নিয়ে বেরোতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই গোপাল মাঝি মন্দিরের বাইরে এসে দাঁড়াল। গোপাল এই গ্রামের প্রাচীনতম মাঝি, বয়স পঁয়ষট্টি ছাড়িয়েছে, গায়ের রঙ রোদে পোড়া, চোখে এক অদ্ভুত মলিনতা। সে ধীরে ধীরে কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল—”বাবা, আজ তুমি যেও না নদীর ধার দিয়ে, উজানের দিক ঘুরে শ্মশানে যেও।” অরিন্দম অবাক হয়ে কারণ জানতে চাইলে গোপাল গাঢ় গলায় বলল—”আজ অমাবস্যা, নদীর ধারে পুরোনো শাঁখওয়ালা আসে। ও মানুষ নয়, ওর চোখ নেই। ও শাঁখ বাজায়, আর যে শোনে, তার সর্বনাশ হয়।” গোপালের কথা শুনে অরিন্দম হেসে উঠল—”গোপাল কাকা, এসব তো শুধু গল্প। আমি ছোটবেলা থেকেই এসব শুনে আসছি।” কিন্তু গোপাল মাথা নেড়ে বলল—”গল্প নয় বাবা, আমি নিজের চোখে দেখেছি।” অরিন্দমের কৌতূহল বেড়ে গেল, কিন্তু সে আর কিছু না বলে নিজের পথে রওনা দিল, গোপালের দৃষ্টি তখনও তার পেছনে লেগে রইল—এক ধরনের অব্যক্ত আতঙ্কে ভরা।

গ্রামের ভেতর দিয়ে অরিন্দম যখন শ্মশানের পথে হাঁটছিল, চারদিক ফাঁকা, কেবল বাতাসে বাঁশঝাড়ের পাতার সড়সড় শব্দ শোনা যাচ্ছিল। অমাবস্যার কালো আকাশে একফোঁটা চাঁদ নেই, শুধু দূরের মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি আর কুকুরের ঘেউ-ঘেউ মিলেমিশে ভয়ানক পরিবেশ তৈরি করেছিল। পা যত নদীর দিকে পড়ছে, তত যেন ঠান্ডা বাড়ছে। শ্মশানের প্রবেশদ্বারের কাছে পৌঁছেই অরিন্দম থমকে দাঁড়াল—দূরে নদীর দিকে তাকিয়ে সে স্পষ্ট শুনতে পেল একটানা শাঁখের শব্দ। শব্দটা অদ্ভুত, যেন খুব কাছে থেকেও দূর থেকে আসছে, আর শাঁখের ধ্বনির ভেতরে এক ধরনের অচেনা সুর মিশে আছে, যা বুকের ভেতর হিম এনে দেয়। গোপালের সতর্কবাণী হঠাৎ করে মনে পড়ল, কিন্তু অরিন্দমের মনে হল—এটা নিশ্চয়ই গ্রামের কেউ পূজার জন্য শাঁখ বাজাচ্ছে। তবু তার অজান্তে শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। হাতে ধরা পূজার ঝাঁপি আঁকড়ে ধরে সে ধীরে ধীরে শ্মশানের ভেতরে পা রাখল, যেখানে কালো ধোঁয়া, ভিজে কাঠের গন্ধ আর অচেনা শীতলতা তাকে যেন অন্য এক জগতে টেনে নিচ্ছিল। অজান্তেই আজ তার জীবন বদলে যেতে চলেছে।

দুই

শ্মশানের পাথরের গেট পার হতেই অরিন্দমের মনে হল, সে যেন পরিচিত পৃথিবী ছেড়ে অন্য এক জগতে পা রাখল। কুয়াশা এত ঘন যে সামনের তিন হাত দূরও স্পষ্ট দেখা যায় না। বাতাসে ভিজে কাঠের আর পোড়া দেহের গন্ধ মিশে আছে, আর কোথাও কোথাও সাদা ধোঁয়ার সরু রেখা কুয়াশার সঙ্গে মিলেমিশে আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে। ভিজে মাটি পিচ্ছিল, পায়ের চাপা শব্দ মাটিতে থেমে থেমে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। শ্মশানের এক পাশে পোড়ানো চিতার ছাই এখনও গরম, তার ধোঁয়ার গন্ধক আর ধূপের গন্ধ মিলেমিশে এক অদ্ভুত মাতাল করা ঘ্রাণ তৈরি করেছে। অরিন্দম চোখ সরু করে দেখতে চেষ্টা করল, নদীর ধারে কুয়াশার আড়ালে কি নড়ছে—মনে হল, যেন কারও অবয়ব হেলে দুলে হাঁটছে। বাতাসে হালকা শিরশিরে ঠান্ডা, কাঁধে ঝোলা থাকা পূজার সামগ্রীর ওজন যেন দ্বিগুণ হয়ে গেছে। মন্দিরে থাকাকালীন সে অমাবস্যার এই শ্মশান পূজার অনেক গল্প শুনেছে, কিন্তু এভাবে প্রত্যক্ষ করে দেখার অভিজ্ঞতা তার ছিল না। প্রতিটি শ্বাস যেন ফুসফুসে শীতল কুয়াশা ঢুকিয়ে দিচ্ছে, আর প্রতিটি নিঃশ্বাসে মনে হচ্ছে কিছু অজানা ভয় বুকের মধ্যে জমে উঠছে।

তারপর হঠাৎই অরিন্দমের কানে এলো সেই শব্দ—দূরের কোথাও থেকে ভেসে আসছে একটানা শাঁখের ধ্বনি। প্রথমে মনে হল, কারও বাড়ির পূজায় বাজানো শাঁখ, কিন্তু মন দিয়ে শুনতেই বোঝা গেল, এই শাঁখের সুরে যেন একটা ধীর, গভীর শূন্যতা আছে। সাধারণ শাঁখের মতো এতে পবিত্রতার সুর নেই, বরং এক ধরণের ভারী, ঠান্ডা কম্পন আছে যা বুকের ভেতর ঢুকে হাড় পর্যন্ত ঠান্ডা করে দেয়। শব্দটা কখনও কাছে আসে, কখনও দূরে সরে যায়, যেন কুয়াশার মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে। অরিন্দম স্থির দাঁড়িয়ে শুনতে লাগল, অনুভব করল, শব্দটার মধ্যে এক অদ্ভুত ছন্দ আছে—তিনবার লম্বা সুর, তারপর একটা হঠাৎ থেমে যাওয়া, আবার লম্বা সুর। সেই বিরতির ফাঁকে, কুয়াশা আর ধোঁয়ার ভেতরে, তার মনে হল যেন কেউ ফিসফিস করে ডাকল, কিন্তু কথাগুলো এত ধীরে আর দূরে যে বোঝা গেল না। অরিন্দম নিজের বুকের ভেতর ধুপধুপ শব্দ টের পেল, কিন্তু কৌতূহল তাকে পেছনে টানতে পারল না। সে জানত, নদীর ধারে গেলে গোপালের সতর্কবাণী সত্যি হতে পারে, তবুও সেই অদ্ভুত শাঁখের ডাক যেন তাকে নিজের দিকে টেনে নিচ্ছে।

পথ ধরে এগোতে এগোতে অরিন্দম শ্মশানের পুরোনো অংশে পৌঁছাল, যেখানে ভাঙাচোরা চিতার কাঠ, কালো হয়ে যাওয়া পাথরের শিলালিপি আর শ্যাওলায় ঢাকা অর্ধেক ভাঙা শিবলিঙ্গ পড়ে আছে। সেখানকার নিস্তব্ধতা এত ঘন যে নিজের নিঃশ্বাসের শব্দও অস্বস্তিকর লাগছে। দূরে নদীর ওপর ঘন কুয়াশা এমনভাবে নেমে এসেছে, যেন সাদা চাদর পেতে ঢেকে দিয়েছে সব কিছু। কুয়াশার আড়ালে মাঝে মাঝে মনে হয়, কেউ যেন ধীরে ধীরে চলেছে—কিন্তু চোখ সরু করে তাকালেই সেটা মিলিয়ে যায়। শাঁখের সুর তখনও চলছে, কিন্তু তাতে এখন এক ধরনের তীব্রতা এসেছে, যেন বাজনেওয়ালা জানে, কেউ তাকে শুনছে এবং ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছে। কুয়াশার ভেতরে নদীর কালো জলের উপর আলো প্রতিফলিত হয়ে অদ্ভুত কমলা-সাদা ছোপ তৈরি করেছে, যা অরিন্দমের চোখে পড়তেই তার মনে হল—এ দৃশ্য সে কোনোদিন ভুলবে না। ঠিক তখনই বাতাসের এক ঝাপটা কুয়াশা সরিয়ে দিল, আর অরিন্দম দেখতে পেল—নদীর ধারে, অর্ধেক পানিতে দাঁড়িয়ে আছে এক লম্বা অবয়ব, হাতে ধরা শাঁখ ঠোঁটে তুলে বাজাচ্ছে। তার শরীর স্থির, কিন্তু মাথা ধীরে ধীরে অরিন্দমের দিকে ঘুরছে। অরিন্দমের গা দিয়ে ঠান্ডা ঘাম গড়িয়ে পড়ল, আর তার মনে হল—এখান থেকে এখনই ফিরতে না পারলে, হয়তো আর ফিরেই আসতে পারবে না।

তিন

অরিন্দম যত নদীর দিকে এগোচ্ছিল, শাঁখের শব্দ তত পরিষ্কার হতে লাগল, আর তাতে যেন অদ্ভুত এক ভারী সুর যুক্ত হচ্ছিল—যেন বাতাসে শুধু শব্দ নয়, সঙ্গে জমাটবাঁধা ঠান্ডা ছড়িয়ে পড়ছে। পায়ের নিচের ভিজে বালি নরম হয়ে গেছে, হাঁটলেই মনে হচ্ছে কেউ পায়ের গোড়ালি টেনে নিচ্ছে। নদীর ধারের শেষ বাঁশঝাড় পেরোতেই কুয়াশার আড়াল থেকে উদ্ভাসিত হল সেই অবয়ব—লম্বা, শীর্ণকায়, প্রায় সাড়ে ছ’ফুট উচ্চতা। সাদা ধুতি ভিজে গায়ে লেপ্টে আছে, বুক খালি, আর চামড়ার রঙে যেন মৃত্যুর ধূসরতা লেগে আছে। সবচেয়ে ভয়ংকর তার মুখ—দুটি চোখ থাকার জায়গায় আছে গভীর কালো গহ্বর, যেন কেউ খুঁড়ে নিয়েছে, আর সেই শূন্যতা থেকে ছড়িয়ে পড়ছে এক অবর্ণনীয় অন্ধকার। ঠোঁটের কাছে ধরা রক্তমাখা পুরনো শাঁখে অরিন্দমের দৃষ্টি আটকে গেল—শাঁখের গায়ে শুকনো রক্তের দাগ কুয়াশার আর্দ্রতায় নতুনের মতো টাটকা হয়ে উঠেছে। অবয়বটি স্থির দাঁড়িয়ে বাজাচ্ছে শাঁখ, কিন্তু অরিন্দম স্পষ্ট বুঝতে পারছিল—শাঁখের ভেতরের শব্দ মানুষের নিঃশ্বাসের নয়, বরং এক অচেনা গভীর কণ্ঠস্বর, যেন শাঁখের ভেতরে কেউ বন্দি আছে।

অরিন্দমের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, তবুও কৌতূহল তাকে পিছু হটতে দিল না। সে ধীরে ধীরে কয়েক পা সামনে এগোল। হঠাৎ শাঁখের ধ্বনি থেমে গেল, আর সেই মুহূর্তে চারপাশের সব শব্দও নিঃশেষ হয়ে গেল—নদীর ঢেউয়ের শব্দ নেই, পাতার সড়সড়ানি নেই, এমনকি নিজের হৃদস্পন্দনের আওয়াজও যেন স্তব্ধ। নীরবতার ভেতরে সেই অবয়বটি ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে সরাসরি অরিন্দমের দিকে তাকাল—অথবা বলা ভালো, চোখহীন গহ্বরগুলো তার দিকে স্থির হল। পরের মুহূর্তে শাঁখ থেকে বেরিয়ে এল শীতল, গভীর এক কণ্ঠ—”তুমি… আমার জায়গায়… বসেছো।” শব্দগুলো যেন শুধু কানে নয়, মনের ভেতর, হাড়ের গভীরে গিয়ে আঘাত করল। গলায় এক অদ্ভুত চাপ অনুভব করল অরিন্দম, যেন কেউ অদৃশ্য হাত দিয়ে তার নিশ্বাস চেপে ধরেছে। কণ্ঠের ভেতরে ছিল ক্ষোভ, অভিমান, আর এক অদ্ভুত শূন্যতা—যা মানুষ নয়, মৃতদের স্বর।

অরিন্দম ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে পিছিয়ে যেতে চাইছিল, কিন্তু তার পা যেন বালিতে গেঁথে গেছে। সেই অবয়ব এক পা এগোল, আর প্রতিটি পায়ের ধাপের সঙ্গে বালির উপর জলের ফোঁটা পড়ার শব্দ হল, যদিও তার পা পানিতে ছিল না। কুয়াশা ধীরে ধীরে তাদের চারপাশে ঘিরে এল, যেন দুজনকে এক অদৃশ্য বৃত্তের মধ্যে বন্দি করে ফেলেছে। অরিন্দমের হাতে থাকা পূজার ঝাঁপি থেকে ধূপের গন্ধ আরও তীব্র হয়ে উঠল, কিন্তু সে বুঝতে পারল—এই গন্ধও শাঁখওয়ালার উপস্থিতি মুছে দিতে পারবে না। অবয়বটি আবার শাঁখ ঠোঁটে তুলল, আর এবার বাজল এক ভিন্ন সুর—তীব্র, ছেঁড়া, বুকের মধ্যে শীতল শূন্যতা ঢুকিয়ে দেওয়া এক সুর। কণ্ঠ এবার আর শাঁখের ভেতর নয়, সরাসরি তার কানে ফিসফিস করে বলল—”যা আমার, তা কেউ নিতে পারে না… ফিরিয়ে দাও…” পরের মুহূর্তেই বাতাসের এক শীতল ঝাপটা এসে তার কপালে ঠেকল, আর সে বুঝতে পারল—এখান থেকে যদি আজ না ফেরে, তাহলে হয়তো চিরকাল আর ফিরেই আসবে না।

চার

পরদিন সকালটা ছিল অদ্ভুতভাবে ভারী। অরিন্দম খুব ভোরে মন্দিরের আঙিনায় এসে বসেছিল, চোখে গভীর ক্লান্তি আর গলায় হালকা কর্কশতা। রাতের ঘটনার কথা কারও সঙ্গে শেয়ার করার সাহস হয়নি, কিন্তু মনে হচ্ছিল, কেউ যেন তার পেছনে হাঁটছে—এমনকি সূর্যের আলোতেও সেই শীতলতার অনুভূতি মিলিয়ে যায়নি। ঠিক তখনই গোপাল মাঝি তার নৌকা বেঁধে মন্দিরের দিকে এগিয়ে এল। সারা মুখে বয়সের রেখা, চোখে অন্যমনস্ক দৃষ্টি, কিন্তু অরিন্দমকে দেখে সে থমকে দাঁড়াল। একদম চুপচাপ কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে গোপাল বলল—“তুমি গেছো তো নদীর ধারে!” অরিন্দম চমকে উঠল—গোপালকে কিছু বলেনি তো সে, তবে কীভাবে জানল? গোপাল ধীরে ধীরে মন্দিরের সিঁড়িতে উঠে তার পাশে বসল, তারপর কণ্ঠে এক ধরনের নিস্তব্ধ গম্ভীরতা এনে বলল—“শোনো, অনেকদিন ধরে আমি এটা কাউকে বলিনি, কিন্তু তোমার শোনা দরকার।”

গোপাল জানাল, প্রায় ত্রিশ বছর আগে এই শ্মশানে ছিলেন হরিদাস চক্রবর্তী নামে এক বিখ্যাত পুরোহিত। বয়সে তখন মাত্র চল্লিশের কোঠায়, শক্তপোক্ত শরীর, শাস্ত্রজ্ঞান সমৃদ্ধ মানুষ। অমাবস্যার রাতে তিনি শ্মশানে এক বিশেষ পূজা করতেন, যেখানে শাঁখ বাজিয়ে মৃত আত্মাদের শান্তি দেওয়া হতো। কিন্তু একদিন হঠাৎ গ্রামের লোকজন শুনতে পেল, পূজা চলাকালীন নদীর ধারে এক অস্বাভাবিক উচ্চস্বরে শাঁখ বাজছে, আর সেই সুরে এমন এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা যে মানুষের শরীর কাঁপছিল। গোপাল তখন তরুণ মাঝি, সেদিন নৌকা নিয়ে কাছাকাছি ছিল। কৌতূহল তাকে নদীর ধারে টেনে নিয়ে যায়, কিন্তু কুয়াশার আড়াল থেকে যা দেখেছিল, তা জীবনে আর ভুলতে পারেনি—হরিদাস পুরোহিত দাঁড়িয়ে আছেন জলে হাঁটু ডুবিয়ে, চোখ দুটো নেই, হাতে শাঁখ, আর চারপাশে নদীর জল যেন লাল হয়ে উঠছে। সেই দৃশ্যের কিছুক্ষণ পরেই হরিদাস নিথর হয়ে ভেসে ওঠেন নদীর ধারে, কিন্তু শাঁখ তখনও তার ঠোঁটের কাছে, আর তাতে হালকা কম্পন। গ্রামের লোকেরা বলেছিল, সেই দিন থেকে হরিদাসের আত্মা শান্তি পায়নি, আর তার বাজানো শাঁখ আজও শোনা যায় অমাবস্যার রাতে।

গোপাল থেমে একটু নিঃশ্বাস নিল, তারপর আরও নিচু স্বরে বলল—“তুমি জানো, কেন সে এখনও শাঁখ বাজায়? কারণ তার বিশ্বাস, এই পূজার জায়গা তারই। যে-ই পুরোহিত তার জায়গা নিতে আসে, সে মারা যায়। আমি নিজের চোখে দেখেছি দু’জন পুরোহিতকে, যারা তার পর এই পূজা করতে গিয়েছিল—একজন নদীতে ডুবে মারা গেলেন, আরেকজনের দেহ পাওয়া গেল শ্মশানের ভেতর, শাঁখের পাশে।” গোপালের কণ্ঠ কেঁপে উঠল, চোখে ভয়ের ছায়া ফুটে উঠল। “অরিন্দম, তুমি আজ বেঁচে ফিরেছ, কিন্তু যদি আবার ওর সামনে পড়, তবে হয়তো ফিরতে পারবে না।” অরিন্দম চুপচাপ শুনছিল, তার মাথার মধ্যে রাতের সেই চোখহীন অবয়ব আর শীতল কণ্ঠের কথা ঘুরছিল। গোপালের গল্প শুনে মনে হল, এটা শুধু পুরনো কুসংস্কার নয়, বরং বাস্তবের গভীরে লুকিয়ে থাকা এক ভয়ঙ্কর সত্য। সে বুঝতে পারল, এই শ্মশানের অমাবস্যা শুধু পূজার রাত নয়, বরং মৃত্যুর সঙ্গে খেলা করার এক নিষ্ঠুর আহ্বান।

পাঁচ

রাতটা ছিল অদ্ভুতভাবে নীরব, যেন আশেপাশের সব শব্দ কেউ চেপে রেখেছে। শ্মশানের পাশে ভাড়া করা ছোট কুঁড়েঘরে অরিন্দম ঘুমিয়ে পড়েছিল, কিন্তু ঘুমের ভেতরও এক অস্বস্তি তাকে গ্রাস করছিল। হঠাৎই যেন অদৃশ্য কোনো পর্দা সরিয়ে দিল—তার স্বপ্নে দেখা গেল, ধোঁয়াশায় ঢাকা নদীর ধারে সে দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশে সাদা কুয়াশার ফাঁকে ফাঁকে মৃদু ঢেউয়ের শব্দ আসছে, কিন্তু তার থেকেও বেশি স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে এক নারীকণ্ঠ—স্নিগ্ধ, কোমল, কিন্তু অদ্ভুতভাবে ঠান্ডা। কণ্ঠটা যেন গলা দিয়ে নয়, বাতাসের ভেতর দিয়ে বয়ে আসছে—“অরিন্দম… এসো… আমাকে মুক্ত করো…”। সে চমকে চারপাশে তাকায়, কিন্তু কিছুই দেখা যায় না। কেবল নদীর জলে মাঝে মাঝে আলো প্রতিফলিত হচ্ছে, যেন জ্যোৎস্না জলে ভেসে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ সে লক্ষ্য করল, সেই আলো আসলে এক নারীর অবয়ব—লম্বা চুল ভাসছে জলের উপর, চোখদুটো যেন গভীর শূন্যতার মধ্যে হারিয়ে গেছে। অরিন্দম এগোতে চাইলো, কিন্তু পা যেন জমাট বরফে আটকে গেল। নারীর ঠোঁট নড়ে উঠল—“আমার শঙ্খ ফিরিয়ে দাও…”। কণ্ঠের প্রতিটি শব্দ তার বুকের ভেতর বরফের মতো বিঁধে যাচ্ছিল, আর ঘুমের মধ্যেও সে অনুভব করছিল কপাল দিয়ে ঠান্ডা ঘাম ঝরছে।

হঠাৎ স্বপ্নের ভেতরেই যেন পরিবেশ বদলে গেল—নদীর শান্ত জল উথালপাথাল হতে শুরু করল, ঢেউয়ের শব্দের সঙ্গে মিশে গেল দূরের শাঁখ বাজানোর কর্কশ আওয়াজ। সেই শাঁখের শব্দ ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠছিল, আর তার সঙ্গে যেন মিশে যাচ্ছিল এক অদৃশ্য যন্ত্রণার হাহাকার। অরিন্দম দেখল, সেই নারী ধীরে ধীরে জলের তলা থেকে উঠে আসছে, কিন্তু তার মুখে তীব্র যন্ত্রণার ছাপ। চোখদুটো লালচে হয়ে উঠেছে, ঠোঁটে যেন রক্তের আভা। সে হাত বাড়িয়ে অরিন্দমের দিকে এগিয়ে আসছে, কিন্তু হাতগুলো স্বাভাবিক নয়—দীর্ঘ, কঙ্কালসার, আর আঙুলের ডগায় লম্বা নখ। এক মুহূর্তের জন্য অরিন্দমের মনে হল, যদি সে হাত বাড়িয়ে দেয়, নারীটি তার হাত ধরে তাকে নদীর গভীরে টেনে নিয়ে যাবে। কিন্তু সেই ভয়কে ছাপিয়ে গেল কণ্ঠের অনুনয়—“আমাকে মুক্ত করো… মুক্তি দাও…”। এই অনুরোধে ছিল এক অদ্ভুত টান, যা ভয় আর সহানুভূতির সীমারেখা মুছে দিচ্ছিল। হঠাৎ নারীর পেছনে দেখা গেল সেই লম্বা মানুষটিকে—চোখহীন, হাতে রক্তমাখা শাঁখ, মুখে বিকৃত হাসি। সে যেন নদীর জলকেও জমিয়ে দিচ্ছে।

ঠিক তখনই স্বপ্নের জগতে এক অদৃশ্য ঝড় বয়ে গেল। নদীর ঢেউ উঁচু হয়ে উঠল, কুয়াশা ছিন্নভিন্ন হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল, আর নারী ও চোখহীন মানুষ দুজনেই মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিন্তু তাদের কণ্ঠ যেন বাতাসে রয়ে গেল—নারীর অনুনয়, আর পুরুষের তাচ্ছিল্য—দুটো মিলেমিশে এক ভয়ঙ্কর প্রতিধ্বনি তৈরি করছিল। সেই প্রতিধ্বনি মাথার ভেতর বারবার বাজতে থাকল, যতক্ষণ না অরিন্দম হঠাৎ চমকে জেগে উঠল। বুক ধড়ফড় করছে, শরীর ঘামে ভিজে গেছে। বাইরে তাকিয়ে সে দেখল, গভীর রাত, চারদিকে অন্ধকার, কিন্তু দূরে নদীর দিক থেকে সত্যিই যেন কারও ফিসফিসানি ভেসে আসছে—“আমাকে মুক্ত করো…”। অরিন্দমের গলা শুকিয়ে গেল, সে বুঝল না এটা স্বপ্নের প্রভাব, নাকি সত্যিই কোনো অদৃশ্য উপস্থিতি তাকে ডাকছে। এক অদ্ভুত শীতলতা তার মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে এলো, আর তার মনে হল—যাই হোক না কেন, সেই নারীর রহস্য এখন তার জীবনের অংশ হয়ে গেছে।

ছয়

পরবর্তী কয়েকদিনে অরিন্দমের মাথায় এক অদ্ভুত গুঞ্জন চলতে থাকে। রাতে বারবার সেই নারী কণ্ঠ তার কানে ভেসে আসে—”আমাকে মুক্ত করো…”। সে জানত, কিছুই ঘটছে না, তবে অনুভব করছিল, কোনো রহস্য তাকে ঘিরে ধরেছে। তবে এসব ভাবনা জোর করে মনের মধ্যে ঠেলে দিয়ে, সে একদিন গ্রাম থেকে বেশ কিছুটা দূরে পুরোনো মন্দিরের দিকে রওনা দিল। মন্দিরটি একসময় খুবই পরিচিত ছিল, তবে এখন প্রায় ভগ্ন অবস্থায়, চারপাশে গাছপালা আগলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মন্দিরের ভেতর প্রাচীন পুঁথির পাণ্ডুলিপি ছিল, যার মধ্যে শ্মশান পূজার বিভিন্ন নিয়মকানুন, তন্ত্রমন্ত্র, এবং রহস্যময় ঘটনার বর্ণনা ছিল। সেই পুরোনো পুঁথি খোঁজার উদ্দেশ্যেই অরিন্দম সেখানে গিয়েছিল। মন্দিরের পাথুরে মেঝেতে গাঢ় ধূলোর স্তূপ জমেছে, আর বাতাসে গন্ধের মতো পচা দুর্গন্ধ এসে প্রবাহিত হচ্ছিল। সে মন্দিরের কোণে একটি পুরনো চৌকি দেখে, যেখানে অনেক পুরনো গ্রন্থ আর পুঁথি স্তূপীকৃত ছিল। ধীরে ধীরে সেগুলি সরিয়ে একটি কনিষ্ঠ পুঁথি খুঁজে পেল, যার বাইরের কাঠের মলাটে সাফ সাফ লেখা ছিল—”শাঁখওয়ালা পুরোহিতের পুঁথি”। সেদিকে হাত বাড়িয়ে অরিন্দম খুঁজে পেল তার কাঙ্ক্ষিত তথ্য।

পুঁথি খুলতেই সে অবাক হয়ে গেল। ভিতরের পাতায় অদ্ভুত লেখা ছিল—এমন কিছু শব্দ, যা তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল কিছু পুরোনো তন্ত্রমন্ত্রের পদ্ধতি। সেখানে লেখা ছিল, “শাঁখওয়ালা পুরোহিত মৃত্যুর আগে শঙ্খিনী নামে এক আত্মাকে বেঁধেছিল। সে মুক্তি চায়, আর মুক্তি পেতে হলে একজন জীবিত পুরোহিতকে বলি দিতে হয়।” অরিন্দমের হাত থেকে পুঁথি পড়েই মেঝে টানতে থাকল, যেন সে কোনো বিভীষিকায় পড়েছে। সেই শব্দগুলো তার চেতনাকে অবশ করে ফেলেছিল। শঙ্খিনী—এ নাম কখনো শোনা ছিল, তবে এইভাবে মৃত্যুর আগমুহূর্তে এক আত্মার সাথে বাঁধার কথা কল্পনা করাই যায় না। প্রাচীন পুঁথিতে বলা হয়েছিল, এক পুরোহিত—যার নাম হরিদাস চক্রবর্তী, এই শঙ্খিনী নামক আত্মাকে বেঁধে রেখে মৃত্যুর আগে সেই আত্মার মুক্তির জন্য পরবর্তী পুরোহিতকে বলি দিতে হবে। এটি একটি পাপী চক্র ছিল—মৃত্যু এবং পুনর্জন্মের মাঝে এক অমিত শক্তি, যা শঙ্খের বাজনা আর মন্ত্রের মাধ্যমে সক্রিয় হয়ে ওঠে। অরিন্দম জানত, হরিদাস চক্রবর্তীর মৃত্যুর পর এই শক্তি ঘিরে নানা গুজব ছিল, কিন্তু এর থেকে গভীর কোনো সত্যের সঙ্গে সে প্রথমবারের মতো মোকাবিলা করছিল।

পুঁথির বাক্যগুলোর মধ্যে গাঢ় শঙ্কা ছিল—এখানে এমন কিছু ছিল, যা কেবল অরিন্দমকে নয়, পুরো গ্রামের অস্তিত্বকেই বিপদে ফেলতে পারে। শঙ্খিনী—যে আত্মা মৃত্যুর আগেও আটকে ছিল, আর এখন সে মুক্তির জন্য এক জীবিত পুরোহিতকে দাবি করছে—এ ধরনের অলৌকিক ধারণা তাকে ভীষণ অস্বস্তিতে ফেলছিল। পুঁথি অনুযায়ী, শঙ্খিনীর মুক্তির জন্য যে তন্ত্রের পথ অনুসরণ করা হতো, তা এক জীবিত পুরোহিতকে নিজ ইচ্ছায় বলি দিয়ে শঙ্খকে বাজিয়ে ভাঙতে হতো। কিন্তু প্রশ্ন উঠছিল, যদি কেউ এই পথ বেছে নিত, তবে পরিণতি কী হবে? আর শঙ্খওয়ালা পুরোহিতের পদ্ধতির অনুসরণ না করলে, যে আত্মা তার মুক্তি দাবি করছিল, সে আবার নতুন কোনো পুরোহিতকে খুঁজে বের করতে সক্ষম হত—এমনকি তাদের জীবন কেড়ে নিত। অরিন্দম তার মনের মধ্যে ছুটে চলা এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে ছটফট করতে লাগল। এখন তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—এই পুরোনো পুঁথির বর্ণনা অনুসরণ করা কি উচিত, নাকি সমস্ত কিছু উপেক্ষা করে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করা?

সাত

অরিন্দম সেই রাতে মন্দিরের ভেতরে বসে পূজার আসনে মন দিয়ে মন্ত্র জপ করছিল। বাতাস থমথমে, বাইরে কেবল দূরে শেয়ালের ডাক ভেসে আসছে। হঠাৎ, যেন অদৃশ্য কেউ নিঃশ্বাস ফেলে গেল তার ঘাড়ের কাছে—এক শীতল, ভেজা হাওয়া গা বেয়ে নামল, মেরুদণ্ডের ওপর দিয়ে কাঁপুনি নামিয়ে দিল। তার কানে ক্ষীণ অথচ অদ্ভুত এক ফিসফিসানি—শব্দ যেন এক মুহূর্তে জন্ম নিয়ে মিলিয়ে গেল। অরিন্দম গায়ের শিরশির ভাব সামলে মন্ত্র জপ চালিয়ে যেতে চাইল, কিন্তু বুকের ভেতরে এক অকারণ অস্থিরতা কাজ করছিল। তার মনে হচ্ছিল কেউ যেন তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে আছে, এক অদৃশ্য দৃষ্টি তার প্রতিটি নড়াচড়া লক্ষ্য করছে। ধূপের গন্ধের সঙ্গে মিশে আসছিল কাদাজলের সোঁদা গন্ধ, যা ধীরে ধীরে আরও তীব্র হতে থাকল।

এরপরেই অরিন্দম হঠাৎ অনুভব করল, পিছন থেকে কেউ আলতো কিন্তু দৃঢ়ভাবে হাত রাখল তার কাঁধে। সেই স্পর্শ হিমশীতল, অথচ অদ্ভুতভাবে স্নিগ্ধ, যেন কোনো দীর্ঘদিনের দুঃখভরা মানুষ চুপচাপ সান্ত্বনা দিচ্ছে। মুহূর্তের জন্য তার শরীর অবশ হয়ে গেল—সে ঘাড় ঘুরিয়ে ধীরে ধীরে পিছনে তাকাল, কিন্তু বাতাস ছাড়া কিছুই নেই। মন্দিরের ভেতরে প্রদীপের আলো দুলে উঠছে, কিন্তু তাতে আর কোনো চেহারা ধরা পড়ল না। কেবলই মনে হচ্ছিল, অদৃশ্য কারও উপস্থিতি ঠিক তার শ্বাসের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎই মাটির দিকে তাকিয়ে অরিন্দমের চোখ স্থির হয়ে গেল—যেখানে সে বসে ছিল, সেখানকার পাথরের মেঝেতে এক দীর্ঘ, আঁকাবাঁকা ভিজে লাল দাগ ছড়িয়ে আছে, যেন কেউ সদ্য রক্ত ঝরিয়ে গেছে। সেই দাগ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছিল, আর তার গন্ধ ছড়িয়ে দিচ্ছিল এক ধরনের ধাতব স্বাদ, যা তার জিভে এসে লাগছিল।

অরিন্দমের বুক ধড়ফড় করতে লাগল। সে ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে মেঝের দিকে এগোল, কিন্তু তার আঙুল ছোঁয়ামাত্র দাগগুলো হঠাৎ মিলিয়ে গেল, যেন তারা কখনো ছিলই না। তবুও সেই ঠান্ডা স্পর্শের অনুভূতি কাঁধে রয়ে গেল, আর শিরদাঁড়া বেয়ে নামতে লাগল ভয়ের ঘাম। বাইরে তখন হঠাৎ জোরে বাতাস বয়ে এল, মন্দিরের ঘণ্টা নিজের থেকেই বাজতে লাগল—একটা টানা, করুণ ধ্বনি, যা অরিন্দমের বুকের ভেতরকে কাঁপিয়ে তুলল। সে বুঝতে পারল, এই জায়গায় তার উপস্থিতি এখন কেবল একজন মানুষের নয়—এখানে আরেকজন আছে, যে তাকে স্পর্শ করেছে, তার উপস্থিতি জানান দিয়েছে, আর হয়তো শিগগিরই আরও ভয়ংকর কিছু ঘটতে চলেছে।

আট

অরিন্দমের পা কাঁপছিল, কিন্তু সে তবু শ্মশানের নির্জনতার দিকে এগিয়ে চলল। চারপাশে শুকনো পাতার উপর পায়ের শব্দ অদ্ভুতভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, যেন কারও শ্বাস তার পেছনে লাগাতার লেগে আছে। চাঁদের আলোয় সাদা ধোঁয়ার কুণ্ডলী শ্মশানের চুল্লির দিক থেকে উঠছিল, আর তার মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল সেই রহস্যময় শাঁখওয়ালা পুরোহিত—দেহ যেন অর্ধেক দৃশ্যমান, অর্ধেক অন্ধকারে ডুবে। অরিন্দম গলার স্বর স্থির রাখার চেষ্টা করল, কিন্তু গলা শুকনো—“তুমি এই জায়গা ছাড়তে চাও না কেন?” মুহূর্তের জন্য নীরবতা ভর করল চারপাশে, এমনকি কুকুরের হুক্কা ধ্বনিও থেমে গেল। তারপর শাঁখওয়ালার গলা ভেসে এল, কর্কশ অথচ বেদনামিশ্রিত—“আমি এখানে বেঁধে আছি… মৃত্যুর পরও আমার মুক্তি হয়নি।” তার চোখে ক্ষীণ নীল আলো জ্বলে উঠল, আর ঠান্ডার শিহরণ অরিন্দমের মেরুদণ্ড বেয়ে নামল। পুরোহিতের মুখের ভাঁজে লুকিয়ে ছিল শতাব্দীর অভিশাপের ভার, যা বোঝা যাচ্ছিল প্রতিটি শব্দের ভেতর দিয়ে।

অরিন্দম গভীর নিশ্বাস নিয়ে আবার প্রশ্ন করল—“তোমার মুক্তি আটকাচ্ছে কী?” শাঁখওয়ালার চোখের সেই নীল আভা মুহূর্তে তীব্র হল, আর চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে উঠল, যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি তাদের দুজনকে ঘিরে ফেলেছে। “আমি শঙ্খিনীকে বন্দি করেছিলাম—সে এক অভিশপ্ত আত্মা, যার দুঃখের সীমা নেই। মৃত্যুর আগে আমি তার উপর মন্ত্রবলে শঙ্খবন্ধন দিয়েছিলাম, যাতে সে আর কাউকে ক্ষতি করতে না পারে। কিন্তু শঙ্খিনী প্রতিজ্ঞা করেছিল—যে দিন কোনো জীবিত পুরোহিতের প্রাণ সে পাবে, সে দিন সে মুক্তি পাবে আর আমি… আমি-ও মুক্তি পাব।” শাঁখওয়ালার ঠোঁটে এক অদ্ভুত হাসি ফুটল, যা ভয়ের থেকেও গভীর কিছু—কোনো প্রাচীন দুঃখ আর ক্লান্তি মিশে থাকা হাসি। অরিন্দমের মনে ভেসে উঠল মন্দিরের সেই প্রাচীন পুঁথির লেখা, যেখানে এই অভিশাপের ইঙ্গিত ছিল। কিন্তু বাস্তবের মুখে শুনে তার বুক ভারী হয়ে এল—এ যেন শুধু শঙ্খিনীর নয়, শাঁখওয়ালারও মুক্তির লড়াই।

শ্মশানের বাতাস হঠাৎ আরও শীতল হয়ে উঠল, যেন অদৃশ্য বরফের হাত তার গলা চেপে ধরছে। অরিন্দম বুঝতে পারল, সে আর কেবল কোনো মৃত আত্মার সঙ্গে কথা বলছে না, বরং শত বছরের এক চুক্তির সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। “তাহলে কি আমাকে বলি চাইছ?”—তার কণ্ঠ কেঁপে উঠল, কিন্তু চোখ শাঁখওয়ালার চোখ ছাড়ল না। শাঁখওয়ালা ধীরে ধীরে এগিয়ে এল, আর তার প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে জমি যেন কেঁপে উঠছিল। “আমি চাই না,”—সে ফিসফিস করল, “কিন্তু শঙ্খিনী চাইছে… আর তার শক্তি আমার থেকেও পুরোনো। আমি চাই না তুমি মরো, কিন্তু তোমার রক্ত ছাড়া এই অভিশাপ ভাঙবে না।” এই কথা শেষ হতেই দূরে শ্মশানের চুল্লি থেকে আগুনের ফুলকি আকাশে ছিটকে উঠল, আর এক মুহূর্তের জন্য অরিন্দমের মনে হল—কেউ অদৃশ্যভাবে তার কানে ফিসফিস করছে, “এসো… আমার মুক্তি দাও…”—সে জানত, এখন সিদ্ধান্ত তার হাতে, আর ভুল পদক্ষেপ মানে হয়তো মৃত্যু, নয়তো আরও গভীর কোনো অন্ধকারে ডুবে যাওয়া।

নয়

অরিন্দম অগ্নিকুণ্ডের সামনে বসে, হাতে পুরনো তাম্রপাতের মন্ত্রলিপি। চারদিকের অন্ধকার যেন আরও ঘন হয়ে এসেছে, বাতাসে শঙ্খের করুণ গর্জন মিশে আছে। মন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে অরিন্দমের চারপাশে অদৃশ্য এক বলয় তৈরি হতে থাকে—যেন প্রাচীন দেবশক্তি তাকে রক্ষা করছে। কিন্তু সেই সঙ্গে চারপাশের বাতাসে এক ভয়ানক চাপা আওয়াজ, কুয়াশার ভেতর থেকে ধীরে ধীরে উদ্ভাসিত হয় শাঁখওয়ালার কালো ছায়া, আর তার পাশে শঙ্খিনীর অপার্থিব রূপ। দুজনের চোখে অদ্ভুত আগুনের আভা, মুখে বিকৃত হাসি। শাঁখওয়ালার হাতে রক্তমাখা শাঁখ, যা থেকে অদ্ভুত কাঁপন ছড়িয়ে পড়ছে। শঙ্খিনী তার লম্বা চুল বাতাসে উড়িয়ে মন্ত্রের শব্দ ঢেকে দিতে চাইছে, যাতে অরিন্দমের সাধনা ভেঙে যায়। কিন্তু অরিন্দম এক বিন্দু নড়ে না—তার চোখ বন্ধ, ঠোঁট নড়ে চলেছে, মন্ত্রের প্রতিটি ধ্বনি আরও গভীর হয়ে ওঠে। ঠিক তখনই মাটির তলা থেকে যেন কিছুর গর্জন শোনা যায়, আগুনের শিখা কয়েক গুণ উঁচু হয়ে ওঠে, আর হঠাৎ করে শাঁখওয়ালা বিকট চিৎকার দিয়ে সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

শঙ্খিনী অরিন্দমের কাঁধে হাত রাখতেই, তীব্র ঠান্ডা তার শরীরে ঢুকে যায়—যেন এক মুহূর্তে রক্ত জমে আসছে। তার শ্বাস ভারী হয়ে ওঠে, কিন্তু হাতের মুদ্রা বদলাতে সে ভোলে না। শাঁখওয়ালা তখন চারপাশে এক অদ্ভুত শব্দ তৈরি করছে, যা শুনে মনে হচ্ছে হাজারো শাঁখ একসঙ্গে বাজছে, আর তাতে মন্ত্রের ধ্বনি মিলিয়ে যাচ্ছে। শঙ্খিনী তখন অরিন্দমের চারপাশে ঘুরে ঘুরে তার মন ভাঙতে চাইছে, কানে ফিসফিস করে বলছে—”ছাড়ো… ছাড়ো মন্ত্র… আমার হয়ে যাও…”। অরিন্দম জানে, এ কেবল ভয় দেখানোর কৌশল নয়—এ এক অপার্থিব প্রলোভন, যা মেনে নিলেই তার আত্মা চিরদিনের জন্য ওদের হাতে বন্দি হবে। সে দাঁতে দাঁত চেপে মন্ত্র চালিয়ে যায়, এবং তাম্রপাতের উপরে রাখা ধূপদানি থেকে এক অদ্ভুত নীল ধোঁয়া বের হতে শুরু করে, যা ধীরে ধীরে শাঁখওয়ালা ও শঙ্খিনীর দিকে এগিয়ে যায়। দুজনেই হঠাৎ থেমে যায়, যেন সেই ধোঁয়ার গন্ধ তাদের জন্য বিষের মতো। কিন্তু পরের মুহূর্তেই তারা একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে অরিন্দমের উপর।

ধাক্কায় অরিন্দমের হাত থেকে তাম্রপাত ছিটকে পড়ে যায়, মন্ত্র থেমে যায়, আর মুহূর্তের মধ্যে আগুনের শিখা মিইয়ে আসে। শাঁখওয়ালা তার শাঁখ ঠোঁটে তুলতেই, শঙ্খিনী অরিন্দমের গলা চেপে ধরে। শ্বাসরোধের সঙ্গে সঙ্গে অরিন্দমের চোখে জল এসে যায়, কিন্তু সে শেষ শক্তি দিয়ে পাশের পাত্র থেকে গঙ্গাজল তুলে শাঁখওয়ালার মুখের দিকে ছুঁড়ে মারে। গঙ্গাজল ছোঁয়ামাত্র শাঁখওয়ালা ও শঙ্খিনী বিকট চিৎকারে পিছু হটে, আর অরিন্দম সেই সুযোগে তাম্রপাত আবার হাতে নিয়ে মন্ত্র পড়া শুরু করে দেয়। এবার তার কণ্ঠে যেন স্বর্গীয় বজ্রের মতো দৃঢ়তা—মন্ত্রের ধ্বনি চারদিকে প্রতিধ্বনিত হয়। শাঁখওয়ালার শাঁখ ফেটে গিয়ে মাটিতে পড়ে যায়, আর শঙ্খিনীর রূপ ভেঙে কুয়াশার মতো মিলিয়ে যায়। তীব্র ঝড় বইতে শুরু করে, আর অরিন্দম মাটিতে লুটিয়ে পড়ে—ক্লান্ত, কিন্তু জানে যে শাঁখের অভিশাপ শেষ হয়েছে। দূরে শ্মশানের চিতা থেকে ধীরে ধীরে আগুনের আলো মুছে যেতে থাকে, যেন বহু বছরের অশুভ ছায়া অবশেষে দূর হয়েছে।

দশ

অন্ধকারে ভেজা রাত তখন ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে। পূর্ব দিগন্তে হালকা কমলা আভা ফুটে উঠলেও শ্মশানের ভিতরে বাতাসের ঠাণ্ডা স্রোত এখনো মৃত্যুর মতোই স্থির। অরিন্দম, ঘামে ভিজে ও কাঁপতে থাকা হাতে, শেষবারের মতো শাঁখের উপর হাত রাখল। তার চোখ বন্ধ, ঠোঁটে গোপন মন্ত্রের ধ্বনি—যে মন্ত্র বহু শতাব্দী ধরে কেবলমাত্র কয়েকজন পুরোহিতের জানা ছিল। প্রতিটি শব্দের সঙ্গে যেন অদৃশ্য কাঁপুনি ছড়িয়ে পড়ছিল বাতাসে। হঠাৎ চারদিক থেকে শাঁখওয়ালা ও শঙ্খিনীর তীক্ষ্ণ আর্তনাদ ভেসে এল—অর্ধেক মানব, অর্ধেক দানবের মতো সেই চিৎকার যেন কানে ছুরি চালাল। মন্ত্র যত গাঢ় হচ্ছিল, তারা তত হিংস্র হয়ে উঠছিল। শাঁখওয়ালা ভাঙা দাঁতের মতো সাদা নখ উঁচিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল, আর শঙ্খিনী নদীর দিক থেকে ছুটে এসে কালো কেশে আচ্ছন্ন করল চারদিক। অরিন্দমকে ঘিরে ধুলো, ছাই, নদীর জল ও শ্মশানের আগুন একসাথে মিশে এক অদ্ভুত ঘূর্ণি তৈরি করল, যার ভিতরে দাঁড়িয়ে সে শেষ নিঃশ্বাসের মতো উচ্চারণ করল মন্ত্রের শেষ শব্দ।

মন্ত্রের শেষ ধ্বনি মাটিতে পড়তেই এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল—শাঁখটি হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, যেন তার ভিতরে বন্দি কোনো আত্মা মুক্তি চাইছে। শাঁখের গায়ে সাদা বিদ্যুৎ খেলে গেল, আর পরের মুহূর্তে ভয়ানক বিস্ফোরণের মতো শব্দে তা ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। শাঁখওয়ালা ও শঙ্খিনীর বিকট আর্তনাদ শূন্যে ছড়িয়ে গেল, তারপর ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল ভোরের কুয়াশায়। তাদের শরীর ধোঁয়ার মতো বিলীন হয়ে গেল, যেন কখনো ছিলই না। শ্মশানের চারপাশে যে ভয়ার্ত নীরবতা এতদিন ছিল, তা ভেঙে হালকা হাওয়া বইতে লাগল। চিতা ভস্ম হয়ে গিয়েছিল, নদীর জল শান্ত, আর আকাশে প্রথম সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। তবে অরিন্দমের চোখে সেই শান্তি ধরা পড়ল না। তার বুক ধীরে ধীরে ওঠানামা করছিল, যেন লড়াইয়ের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। তার হাতে শাঁখের ভাঙা টুকরো পড়ে ছিল, কিন্তু সেটিও ঠাণ্ডা হয়ে গেছে—যে শক্তি এতদিন ভয় ছড়িয়েছে, তা এখন কেবল একখণ্ড মৃত বস্তু।

ভোর পুরোপুরি নেমে এলে নদীর ধারে নিস্তব্ধতা নেমে আসে, কিন্তু তখনই দেখা যায় এক ভয়ংকর দৃশ্য—অরিন্দম নদীর ঘাটে বসে আছে, তার ধুতি ভিজে লাল হয়ে আছে রক্তে। কারো পা ফসকে আসা শব্দে সে তাকায় না, শুধু স্থির চোখে নদীর দিকে চেয়ে থাকে। জল ধীরে ধীরে ভেসে যাচ্ছে, তার মাঝে ভেসে আছে কিছু ভাঙা শাঁখের টুকরো, যেগুলো সূর্যের আলোয় অদ্ভুত ঝিলিক দিচ্ছে। দূর থেকে মনে হয়, অরিন্দম বেঁচে আছে—তার বুকের ওঠানামা যেন শ্বাসের প্রমাণ। কিন্তু কেউ কাছে গিয়ে দেখল না, কেউ জানল না তার রক্ত নিজের, নাকি সেই অভিশপ্ত লড়াইয়ের শেষ চিহ্ন। গ্রামের লোকেরা শুধু পরে বলেছিল, ভোরের পর থেকে সেই শ্মশানের কাছে আর কোনো ছায়ামূর্তি দেখা যায়নি। তবে নদীর ধারে দাঁড়ালে, ভেজা বাতাসে এখনো মাঝে মাঝে মন্ত্রের ফিসফিসানি শোনা যায়—যেন শাঁখের নীরবতা কেবল একটি নতুন গল্পের শুরু।

_____

 

1000051262.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *