সুমন্ত বসাক
অধ্যায় ১: নতুন চাকরি
অনির্বাণের বয়স মাত্র চব্বিশ। স্নাতক পাশ করার পর থেকেই কাজের খোঁজে এখানে-ওখানে ছুটছে, কিন্তু ভাগ্য যেন তাকে বারবার ঠকাচ্ছে। শহরে একসময় অনেক চেষ্টা করেছিল, কল সেন্টারের চাকরি থেকে শুরু করে প্রাইভেট স্কুলে শিক্ষকতার জন্য সাক্ষাৎকার দিয়েছে, কিন্তু কোথাও ঠিকমতো জায়গা হয়নি। গ্রামে ফিরে আসতে হয়েছে খালি হাতে। বাবার মৃত্যুর পর সংসারের দায়িত্ব কাঁধে এসে পড়েছে, আর মায়ের অসুখে ওষুধের খরচ মেটানোই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ অবস্থায় গ্রামের মুন্সি হঠাৎ একদিন খবর দিল—পঞ্চায়েতের তরফ থেকে প্রহরীর একটা পদ খালি আছে। তবে জায়গাটা হলো গ্রামসংলগ্ন পুরনো শ্মশান। শুনে অনির্বাণের শরীর শিউরে উঠেছিল। শ্মশান পাহারা দেওয়া মানে একেবারেই নির্জন জায়গায় রাত কাটানো, তার উপর ভৌতিক গল্পগুলো গ্রামে বহুদিন ধরে প্রচলিত। কিন্তু বিকল্প নেই। টাকা দরকার, এবং মুন্সি সোজা বলল—“চাকরিটা তুই নে, আর কেউ রাজি হবে না।”
গ্রামের প্রান্তে সেই শ্মশানটা বহু পুরোনো। বিশাল বটগাছের ছায়ায় ঢাকা, চারদিকে ভাঙাচোরা সমাধি আর অর্ধেক ভেঙে পড়া চিতা ঘিরে রেখেছে জায়গাটা। শ্মশানের এক পাশে ছোট্ট ঘর, সেখানেই প্রহরীদের বসবাস। এর আগে যিনি ছিলেন, তিনি রাতারাতি চাকরি ছেড়ে পালিয়েছিলেন। গুজব আছে, রাতে তিনি অদ্ভুত ছায়া দেখেছিলেন, আগুন নিভে যাওয়ার পরও কুণ্ড থেকে অঙ্গারের মতো আলো জ্বলছিল, আর হাওয়ার শব্দে কানে ভেসে এসেছিল ফিসফিসানি। গ্রামের মানুষ এ নিয়ে অনেক কাহিনি বানিয়েছে—কেউ বলে আত্মারা সেখানে ঘোরাফেরা করে, কেউ বলে এটি অভিশপ্ত ভূমি। এসব ভেবে অনির্বাণের বুক ধড়ফড় করতে লাগল। কিন্তু সে নিজেকে বুঝিয়ে নিল—এ সবই গাঁয়ের গল্প, মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য ছড়ানো। কাজের বেতন যেমনই হোক, অন্তত ঘরে টাকা আনতে পারবে। মায়ের মুখ মনে করে দৃঢ় হলো—চাকরি যেভাবেই হোক তাকে সামলাতেই হবে।
চাকরির প্রথম দিন বিকেলেই সে পৌঁছল শ্মশানে। হাতে কেরোসিনের লণ্ঠন, সঙ্গে মুন্সির দেওয়া লাঠি। সন্ধ্যার আকাশ লালচে অন্ধকারে ঢেকে গেছে, বটগাছের পাতা দিয়ে হাওয়ার সোঁ সোঁ শব্দ আসছে। শ্মশানের মধ্যে ঢুকতেই অনির্বাণের মনে হলো জায়গাটা যেন অন্য জগৎ। চারদিকে অদ্ভুত নীরবতা, মাঝে মাঝে শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। দূরে একটা অর্ধেক জ্বলা চিতা তখনও ধিকিধিকি করে জ্বলছিল, ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে আকাশের দিকে উঠছিল। অনির্বাণ মনে মনে নিজেকে শক্ত করল, লণ্ঠনটা পাশে রেখে ছোট্ট ঘরে বসে পড়ল। কাজের নিয়ম সহজ—রাতভর টহল দিতে হবে, ভোর হলে বাড়ি ফেরা। সে ভাবল, এটা তেমন কিছু নয়, একরকম পাহারা দেওয়া। কিন্তু মন তার মানতে চাইছিল না। বুকের মধ্যে হালকা আতঙ্ক জমে উঠেছিল, মনে হচ্ছিল কেউ হয়তো তাকে অন্ধকার থেকে নিরবে দেখছে। শ্মশানের গন্ধ, বাতাসের ভারী নিস্তব্ধতা আর দূরের আগুনের আলো—সব মিলিয়ে প্রথম রাতটা অনির্বাণের জীবনের সবচেয়ে অস্বস্তিকর রাতের সূচনা হয়ে দাঁড়াল।
অধ্যায় ২: প্রথম রাত
অন্ধকার নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গেই শ্মশানের নীরবতা যেন আরও ভারী হয়ে উঠল। সূর্য অস্ত যাওয়ার পর আকাশে উঠেছিল অর্ধচন্দ্র, কিন্তু তার ম্লান আলো এতদূর পৌঁছায়নি। চারপাশে শুধু কুয়াশার মতো ধোঁয়া, যা আসলে দাহকুণ্ড থেকে বেরিয়ে আসা কালচে ধোঁয়ার সঙ্গে মিশে গেছে। অনির্বাণের হাতে থাকা লণ্ঠনের হলুদ আলো যেন অন্ধকারকে ভেদ করার জন্য মরিয়া চেষ্টা করছে, কিন্তু প্রতিবারই সেই আলোকে গিলে ফেলছে অদৃশ্য কোনো শক্তি। দূরে শেয়ালের হুক্কাহুয়া ডাক শোনা গেল, সাথে সাথেই ভয়ার্ত কুকুরের ঘেউ ঘেউ। এসব শব্দ তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল, সে এখানে একা—একেবারেই একা। বুকের ভেতর ধুকপুকানি বাড়তে লাগল, কিন্তু তবুও সে নিজেকে সামলাল। কাজ মানে কাজ, ভয়কে যদি এত সহজে জয় করতে না পারে, তবে এখানে টিকে থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই।
রাত যত গভীর হলো, শ্মশানের অন্ধকার যেন আরও গাঢ় রূপ নিল। বাতাসে পোড়া কাঠ আর মাংসের কটু গন্ধ ভেসে আসছিল, যা অনির্বাণকে বারবার বমি এনে দেওয়ার মতো অবস্থায় ফেলছিল। সে কেরোসিনের লণ্ঠনটা নিয়ে শ্মশানের একপাশ থেকে আরেকপাশে ঘুরে বেড়াতে লাগল, যেন টহল দেওয়ার ভান করছে। কিন্তু প্রতিবারই যখন দাহকুণ্ডের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, অদ্ভুত এক শীতল স্রোত তার শরীরের ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কেউ তার কাঁধ ছুঁয়ে যাচ্ছে, কিংবা ছায়ার আড়াল থেকে তাকিয়ে আছে। হাওয়ার দমকে বটগাছের শেকড় নড়ছিল, আর সেই শব্দে তার মনে হচ্ছিল কেউ হাঁটছে। হঠাৎ সে থমকে দাঁড়াল—দূরে যেন কারো ছায়া নড়ল। চোখ কচলাল, আবার তাকাল, কিন্তু সেখানে কিছু নেই। অনির্বাণ নিজেকে বোঝাল, “সবই চোখের ভুল। ভয় পেলে কাজ করা যাবে না।”
কিন্তু যত রাত বাড়ল, তার ভয় তত বাড়তে লাগল। শ্মশানের নিস্তব্ধতা মাঝে মাঝে এমন ভাঙছিল যেন কেউ ফিসফিস করে কথা বলছে, অথচ চারদিকে মানুষ নেই। হঠাৎ একটা শব্দ কানে এলো—মাটিতে শুকনো পাতার ওপর কারো পায়ের শব্দ, ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। অনির্বাণ লণ্ঠন উঁচিয়ে চারদিকে তাকাল, কিন্তু শূন্য অন্ধকার ছাড়া আর কিছু নেই। তার বুক ধড়ফড় করতে লাগল, হাতের লাঠি শক্ত করে ধরল। ঠিক সেই মুহূর্তে দূরে দাহকুণ্ড থেকে উঠল এক টুকরো লালচে আলো, যেন আগুন আবার জ্বলে উঠল। অথচ সন্ধ্যার সময় সেই চিতা সম্পূর্ণ নিভে গিয়েছিল। আগুনের আলোয় ছাইয়ের ভেতর দিয়ে যেন কোনো অদ্ভুত নড়াচড়া দেখা গেল, কারো মতো, অথচ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। অনির্বাণের কপাল দিয়ে ঠান্ডা ঘাম গড়িয়ে পড়ল—এটা কি তার কল্পনা, নাকি সত্যিই কেউ আছে? সে অনুভব করল, তার প্রথম রাত মাত্র শুরু হয়েছে, আর এর ভেতরেই লুকিয়ে আছে এমন এক অদৃশ্য রহস্য, যা হয়তো তার জীবনকেই বদলে দেবে।
অধ্যায় ৩: চোখে ধরা বিভ্রম
মধ্যরাত পেরোতেই শ্মশানের পরিবেশ যেন হঠাৎ বদলে গেল। আকাশে তখন মেঘ জমে উঠেছে, চাঁদের ক্ষীণ আলো পুরোপুরি হারিয়ে গিয়ে চারপাশ আরও গাঢ় অন্ধকারে ডুবে গেল। বাতাস এক অদ্ভুত শীতলতা নিয়ে বইতে শুরু করল, যেন শীতকাল নয় অথচ হাড় পর্যন্ত ঠান্ডা পৌঁছে যাচ্ছে। অনির্বাণ শ্মশানের প্রহরীর ঘরে বসে লণ্ঠনের আলোয় চারপাশের অন্ধকার লক্ষ্য করছিল, তখনই তার চোখ আটকে গেল দাহকুণ্ডের দিকে। অদ্ভুতভাবে মনে হলো, ছাইয়ের স্তূপটা যেন নড়ছে। প্রথমে সে ভাবল হয়তো বাতাসে উড়ে যাচ্ছে, কিন্তু না—এবার স্পষ্টভাবে দেখল ছাইয়ের ভেতর থেকে একটা হাত ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে। শিরদাঁড়া দিয়ে যেন বিদ্যুৎ বয়ে গেল, তার শরীর একেবারে অবশ হয়ে গেল, চিৎকার করার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলল।
তারপর ধীরে ধীরে সেই হাতের সঙ্গে কাঁধ, তারপর মুখও ভেসে উঠল। পোড়া, দগ্ধ চামড়ার গায়ে কালচে ছাই লেগে আছে, চোখদুটো শূন্য, অথচ ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চারপাশে তাকাচ্ছে। অনির্বাণ মনে করল, এ যেন কোনো দুঃস্বপ্ন, এ বাস্তব হতে পারে না। সে লণ্ঠনটা উঁচু করে ধরল—আরও স্পষ্ট দেখতে পেল সেই দেহটা আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াচ্ছে। চিতার আগুনের শেষ অঙ্গারের মতো লালচে আলোয় পুরো দৃশ্যটা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল। ছাইয়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসা সেই দেহ কোনো শব্দ করছিল না, শুধু নিঃশব্দে দাহকুণ্ডের পাশে দাঁড়িয়ে রইল, যেন কিছু অপেক্ষা করছে। অনির্বাণের বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়ে চলল, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল, কিন্তু তার চোখ সরাতে পারছিল না।
একটু পরেই সে আরেকটা নড়াচড়া টের পেল। আরেকটি দাহকুণ্ড, যা আগেই নিভে গিয়েছিল, সেখান থেকেও ভেসে উঠল এক জীর্ণ দেহ। এভাবে একের পর এক কুণ্ড থেকে ছাই ভেঙে দাঁড়িয়ে গেল মানুষ—না, মৃত মানুষ, যাদের পোড়া শরীর অঙ্গারের মতো ঝলসে উঠছে। তারা কেউ একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে না, কারো সঙ্গে কথা বলছে না—শুধু নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে। অনির্বাণ বুঝতে পারল, তারা যেন এক অদ্ভুত ধৈর্যের সঙ্গে কোনো অজানা মুহূর্তের অপেক্ষা করছে। তার শরীর কাঁপতে লাগল, মনে হচ্ছিল এখনই পা চালিয়ে পালিয়ে যাবে, কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তাকে আটকে রাখল। হয়তো কৌতূহল, হয়তো ভেতরের ভয়কে জয় করার অদ্ভুত চেষ্টা—যা-ই হোক, অনির্বাণ নিশ্চিত বুঝল যে আজকের রাত তার জীবনে কোনো সাধারণ রাত নয়, বরং এক রহস্যময় আতঙ্কের দরজা খুলে দিয়েছে।
অধ্যায় ৪: অপেক্ষমাণ আত্মারা
রাত তখন গভীর, যেন সময়ও থমকে গেছে। অনির্বাণের চোখের সামনে সেই সব পোড়া দেহগুলো নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে, কেউ বটগাছের ছায়ায়, কেউবা অর্ধভাঙা চিতার ধারে। তাদের মধ্যে একটিও শব্দ নেই, কোনো গতি নেই, শুধু স্থিরতা আর এক অদ্ভুত শূন্য দৃষ্টি। অনির্বাণ প্রথমে ভেবেছিল হয়তো এরা তার দিকে আসবে, তাকে আক্রমণ করবে, কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে দেখল তারা যেন তার অস্তিত্বকেই উপেক্ষা করছে। সে যতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, তার উপস্থিতি যেন বাতাসের মতো, অদৃশ্য। এই অদ্ভুত দৃশ্য আরও ভয়ানক হয়ে উঠছিল কারণ প্রতিটি দেহের ভেতর থেকে ছাই আর দগ্ধ মাংসের গন্ধ ধীরে ধীরে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছিল। বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল, কেরোসিনের লণ্ঠনের আলো কাঁপতে কাঁপতে নিভে যাওয়ার মতো হচ্ছিল, অথচ মৃতেরা এক অচঞ্চল ধৈর্যের সঙ্গে শূন্য দৃষ্টিতে চারদিকে তাকিয়ে রইল।
এক সময় অনির্বাণ লক্ষ্য করল, তাদের ভঙ্গিতে যেন এক ধরনের অপেক্ষার ছাপ আছে। তারা একে অপরের সঙ্গে কথা বলছে না, না কোনো অঙ্গভঙ্গি করছে, তবুও বোঝা যাচ্ছিল যে তারা সবাই একই উদ্দেশ্যে এখানে দাঁড়িয়ে। কিছু মৃত দেহ দাহকুণ্ডের ছাইয়ের পাশে মাটিতে বসে পড়েছে, যেন ধৈর্য ধরে সময় কাটাচ্ছে। একজন পোড়া মুখ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, আরেকজন মাটিতে শুয়ে পড়েছে, তবে চোখ দুটি স্থিরভাবে খোলা। এই দৃশ্য দেখে অনির্বাণের বুকের ভেতর শীতল কাঁপুনি জেগে উঠল—মনে হলো তারা যেন কোনো সংকেতের অপেক্ষা করছে, যেন মৃত্যুর পরও তাদের মুক্তি আসেনি। হঠাৎ করেই তার মনে পড়ল গ্রামের বুড়োদের গল্প—“এই শ্মশানে যারা দাহ হয়, তাদের আত্মা আগুনে পুরোপুরি মুক্তি পায় না, তাই তারা ফিরে আসে।” এতদিন সে এসব গল্পকে নিছক গুজব ভেবেছিল, অথচ আজ চোখের সামনে সবকিছু ঘটতে দেখে আর অস্বীকার করতে পারল না।
অনির্বাণ ধীরে ধীরে পিছিয়ে এসে প্রহরীর ঘরের সামনে দাঁড়াল, কিন্তু ভেতরে যাওয়ার সাহস হলো না। মনে হচ্ছিল, একবার চোখ সরালেই হয়তো তারা নড়বে, হয়তো তার দিকে আসবে। হঠাৎ করেই এক মৃত দেহ ধীরে ধীরে দাহকুণ্ড থেকে উঠে এসে ছাইয়ের ওপর বসে পড়ল, তার চোখ শূন্যভাবে জ্বলজ্বল করছে। সেই দৃষ্টিতে কোনো ক্রোধ নেই, আবার শান্তিও নেই—শুধু এক অদ্ভুত প্রত্যাশা। অনির্বাণ শিউরে উঠল, কারণ সে নিশ্চিত হলো যে এই সব আত্মারা শুধু হাঁটাহাঁটি করছে না, তারা কিছু একটা চায়। কিন্তু কী চায়, তা অনির্বাণের জানা নেই। হয়তো আরও এক দাহ, হয়তো কোনো অজানা মন্ত্র, হয়তো মুক্তি। আর এই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে অনির্বাণ বুঝল, তার চাকরির আসল দায়িত্ব শুধু পাহারা দেওয়া নয়—বরং এক অজানা, অদৃশ্য সত্যের মুখোমুখি হওয়া।
অধ্যায় ৫: ভয় আর কর্তব্য
অনির্বাণের পা যেন জমে গিয়েছিল মাটিতে, দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছা হচ্ছিল, কিন্তু বুকের ভেতর ভয় আর দায়িত্বের মধ্যে এক অদ্ভুত টানাপোড়েন শুরু হলো। সে জানে, এখন যদি পালিয়ে যায় তবে আর কখনো এই চাকরিতে ফিরে আসতে পারবে না, তাতে সংসারের ভরণপোষণ বন্ধ হয়ে যাবে। মায়ের মুখ ভেসে উঠল চোখের সামনে, অসহায় আর কাতর চাহনি মনে করিয়ে দিল—যতই ভয়ংকর হোক, এই কাজ ছেড়ে দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া অদ্ভুতভাবে মনে হচ্ছিল, এ অভিজ্ঞতার মাঝেই যেন লুকিয়ে আছে এক রহস্য, যার সমাধান করতে পারলে সে নিজেকে প্রমাণ করতে পারবে। ভেতরের আতঙ্ককে দমিয়ে রেখে সে দাঁড়িয়ে রইল, দূরে দাঁড়ানো আত্মাদের দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে।
কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে সে বুঝল, এরা আসলে তাকে আক্রমণ করার কোনো চেষ্টা করছে না। তারা শুধু দাঁড়িয়ে আছে, কেউ বসে, কেউ শুয়ে, কেউবা দূরে তাকিয়ে, যেন প্রত্যেকে নিজের ভেতর কোনো অদৃশ্য যন্ত্রণার সঙ্গে লড়ছে। অনির্বাণ প্রথমে স্বস্তি পেল, কারণ অন্তত সরাসরি বিপদে সে পড়েনি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই এক অদ্ভুত অস্বস্তি গ্রাস করল—এমন সব পোড়া দেহ, খোলা চোখ, ছাইয়ের গন্ধে ভরা বাতাস—এসবের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মানুষ আস্তে আস্তে নিজের স্নায়ুর ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে বাধ্য। সে চেষ্টা করল লণ্ঠনের আলোয় আশেপাশে ঘুরে দেখতে, আত্মারা কি তাকে অনুসরণ করছে কিনা। অবাক হয়ে দেখল, তারা যেন তার অস্তিত্বকেই অস্বীকার করছে, যেন সে এখানে নেই। তাদের দৃষ্টি ভেদ করে গেলেও অনির্বাণ বুঝল, এরা অপেক্ষা করছে অন্য কারো জন্য, অন্য কোনো ঘটনার জন্য, যা তার সাধ্যের বাইরে।
অবশেষে সে নিজেকে বুঝিয়ে নিল—তার কাজ হলো পাহারা দেওয়া, আর সেটা করতেই হবে। সে ছোট্ট ঘরে ঢুকে বসে পড়ল, কিন্তু ঘরের ভেতরেও অস্বস্তি কমল না। প্রতিটি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল কেউ বাইরে হাঁটছে, হয়তো জানালার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। লণ্ঠনের আলো টিমটিম করতে থাকলে তার বুকের ভেতর দমবন্ধ হয়ে আসছিল, অথচ আলো নিভিয়ে রাখার সাহসও পাচ্ছিল না। সে লাঠি হাতে শক্ত হয়ে বসে রইল, আর কান পাতল বাইরের প্রতিটি শব্দে। তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছিল প্রতিবার যখন বাতাসে শোঁ শোঁ শব্দ উঠছিল বা শুকনো পাতায় হালকা খসখসানি হচ্ছিল। তবুও ভেতরে ভেতরে একটা দৃঢ়তা তৈরি হলো—যত ভয়ই আসুক, তাকে দায়িত্বে টিকে থাকতে হবে। রাত এখনো অনেক বাকি, আর অনির্বাণ বুঝল, এই প্রথম রাতের পরীক্ষাই হয়তো তার ভাগ্য নির্ধারণ করবে।
অধ্যায় ৬: প্রথম সংলাপ
রাত তখন নিস্তব্ধতার চরমে, বাতাস থেমে গেছে যেন, কেবল দূরে কোথাও পেঁচার ডাক শোনা যাচ্ছে। অনির্বাণ লণ্ঠনের ক্ষীণ আলোয় বসে চোখের পাতা নামিয়ে আনছিল, হঠাৎ মনে হলো বাইরে পায়ের শব্দ ভেসে এলো। আতঙ্কে দম বন্ধ হয়ে এলেও সাহস করে উঠে দাঁড়াল, লাঠি হাতে বেরিয়ে এলো ঘরের সামনে। চোখ মেলে তাকাতেই বুক কেঁপে উঠল—অন্যদের মতো স্থির হয়ে না দাঁড়িয়ে, এক পোড়া দেহ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তার দিকে। অর্ধেক মুখ ছাইয়ে ঢাকা, চুল পুড়ে খাটো হয়ে গেছে, কিন্তু চোখ দুটি অদ্ভুতভাবে উজ্জ্বল। অনির্বাণের শরীর ঠান্ডা ঘামে ভিজে গেল, পা কাঁপতে শুরু করল, তবুও দৌড়ে পালাতে পারল না। যেন অদৃশ্য শেকলে বাঁধা, তাকে দাঁড়িয়ে থেকেই দেখতে হলো সেই মৃতদেহের আসা।
কিছু দূরে এসে সেই দেহ থেমে দাঁড়াল। আগুনে দগ্ধ ঠোঁট নড়ল ধীরে ধীরে, অথচ অদ্ভুতভাবে অনির্বাণ স্পষ্ট শুনতে পেল কণ্ঠস্বর—নিচু, কর্কশ অথচ ব্যথাভরা এক ফিসফিসানি: “আমরা অপেক্ষায় আছি।” অনির্বাণ স্তম্ভিত হয়ে গেল, এ কেমন অলৌকিক ঘটনা! সে কিছু বলার চেষ্টা করল, কিন্তু মুখ থেকে শব্দ বেরোল না। আবার শোনা গেল—“আগুন নিভে গেলে, আলো শেষ হলে… মুক্তি আসে না। তাই দাঁড়িয়ে আছি।” এই কথাগুলো যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল, অথচ তার কানে কাঁপতে কাঁপতে বাজতে থাকল। অনির্বাণের শরীরে ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত এক সহানুভূতি জন্ম নিল—এরা কি তবে সত্যিই অশান্ত আত্মা, যারা কোনো কারণে মুক্তি পায়নি?
সেই মুহূর্তে আত্মাটা আর এগোল না, শুধু নিঃশব্দে ঘুরে দাহকুণ্ডের পাশে গিয়ে দাঁড়াল, যেন আবার অপেক্ষার শৃঙ্খলে ফিরে গেল। অনির্বাণ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল অবশ হয়ে, তারপর আস্তে আস্তে ঘরে ফিরে এল। বুকের ভেতর প্রচণ্ড ধুকপুক করছিল, কিন্তু মনে হচ্ছিল এখন সে আগের চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক এক সত্যের মুখোমুখি। মৃতেরা তাকে আক্রমণ করছে না, বরং তার সামনে তাদের যন্ত্রণার ইঙ্গিত দিচ্ছে। কিন্তু কেন? তারা কি চায় সে তাদের মুক্তি দিক? নাকি কেবল তাদের কষ্টের সাক্ষী হয়ে থাকুক? অনির্বাণ বুঝতে পারল না, শুধু জানল তার ভয় আর কৌতূহলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আজ এক নতুন দরজা খুলে গেল—যে দরজা হয়তো তাকে টেনে নিয়ে যাবে আরও গভীর এক রহস্যের দিকে।
অধ্যায় ৭: অশান্ত আত্মারা
রাতের নিস্তব্ধতা হঠাৎ ভেঙে গেল এক বিকট শব্দে। অনির্বাণ চমকে উঠল, লণ্ঠন হাতে দৌড়ে বেরোল বাইরে। দূরের এক দাহকুণ্ড থেকে কালো ধোঁয়া হু হু করে উঠছে, আগুনের লালচে অঙ্গার আবার জ্বলে উঠেছে। কিন্তু এবার দৃশ্যটা আলাদা—ছাইয়ের ভেতর থেকে এক দগ্ধ দেহ উঠে আসছে প্রবল তাড়াহুড়োয়, অন্যদের মতো স্থির নয়। মুখটা বিকৃত, চোখ দুটো রাগে জ্বলছে, হাত-পা এলোমেলোভাবে ছটফট করছে, যেন কোনো অদম্য ক্রোধে জ্বলছে। অনির্বাণ শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যেতে অনুভব করল—এ সেই শান্ত অপেক্ষমাণ আত্মাদের মতো নয়, এ ভিন্ন। এটা অস্থির, অশান্ত, যেন প্রতিশোধ নিতে ফিরে এসেছে।
দেহটা মাটিতে পা রেখেই চারদিকে ছুটতে শুরু করল। ভাঙাচোরা সমাধির ওপর আছড়ে পড়ছে, শুকনো গাছের ডাল ভেঙে ফেলছে, আর তার চিৎকার যেন আকাশ কাঁপিয়ে দিচ্ছে। অন্য আত্মারা দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চুপে, কিন্তু কারো দৃষ্টি তোলা নেই, যেন তারা অশান্ত আত্মাটিকে এড়িয়ে চলতে চাচ্ছে। অনির্বাণ ভয়ে লাঠি আঁকড়ে ধরে একপাশে সরে গেল। সে অনুভব করল, এই আত্মাটা অসম্পূর্ণ মৃত্যুর শিকার—যার দাহ সঠিকভাবে হয়নি, যার শরীর পুরোপুরি আগুনে ভস্ম হয়নি। তাই তার ক্রোধ নিভে যায়নি, মুক্তিও আসেনি। অনির্বাণের মনে হলো, এ যেন জীবন্ত দুঃস্বপ্ন। অশান্ত দেহটা হঠাৎ তার দিকে ঘুরে তাকাল—শূন্য অথচ জ্বলন্ত চোখদুটি সরাসরি তার দৃষ্টিকে বিদ্ধ করল। মুহূর্তে শরীর অবশ হয়ে গেল, পালানোর শক্তি হারিয়ে ফেলল সে।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, আত্মাটা তার দিকে এগোলো না। বরং বটগাছের শিকড় আঁকড়ে ধরে বিকটভাবে চিৎকার করল, তারপর আবার ছুটে গিয়ে ছাইয়ের স্তূপে আছড়ে পড়ল। অনির্বাণ কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে রইল, বুকের ভেতর শ্বাসের শব্দ প্রচণ্ড জোরে কানে বাজছিল। এই দৃশ্য তাকে বুঝিয়ে দিল—সব আত্মা একরকম নয়। কেউ শান্ত অপেক্ষমাণ, কেউ অশান্ত ক্রোধে জ্বলা। আর সেই অশান্ত আত্মাদের উপস্থিতি শুধু ভয়ঙ্কর নয়, বিপজ্জনকও। অনির্বাণ বুঝতে পারল, তার চাকরির আসল পরীক্ষা এখনই শুরু হলো, কারণ এই শ্মশান পাহারা দেওয়া মানে কেবল নিঃশব্দ ছায়াদের দেখা নয়, বরং এক অস্থির, রুদ্ধশ্বাস যন্ত্রণার সঙ্গে প্রতিরাতে মুখোমুখি হওয়া।
অধ্যায় ৮: অতীতের গোপন কথা
অশান্ত আত্মার সেই উন্মত্ত আচরণের পর পুরো শ্মশান যেন আবার স্তব্ধ হয়ে গেল। তবে নিস্তব্ধতার আড়ালে এক অদ্ভুত চাপা অশান্তি টের পাচ্ছিল অনির্বাণ। ঘরে ফিরে এলেও তার বুকের ভেতর ধুকপুকানি থামছিল না। বিছানার মতো করে বাঁশের খাটে বসে সে গভীর নিশ্বাস নিল, লণ্ঠনের আলোয় দেয়ালে ছায়ারা নড়ছিল, আর প্রতিটি ছায়াকেই মনে হচ্ছিল ভিন্ন কোনো রূপ। সে ভাবল—গ্রামের মানুষ এতদিন যে গল্প করত, তা কি তবে সত্যিই ছিল? মৃতেরা ফিরে আসে, তারা অপেক্ষা করে মুক্তির জন্য, আর যাদের দাহ অসম্পূর্ণ হয় তারা অশান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু কেন এই শ্মশানেই সব ঘটে? অন্য শ্মশানগুলোতে তো এমন শোনা যায় না।
ভোর হওয়ার আগে সেই প্রশ্নের উত্তর যেন হঠাৎই তার সামনে উন্মোচিত হতে শুরু করল। অর্ধনিদ্রার ঘোরে সে স্বপ্ন দেখল, কিংবা হয়তো কোনো দৃষ্টিভ্রম—এক বৃদ্ধ মানুষ সাদা পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছে দাহকুণ্ডের পাশে। মুখে তীব্র ক্রোধ, চোখে অদ্ভুত দীপ্তি। বৃদ্ধ বলল, “এই ভূমি অভিশপ্ত। এখানে কারো আত্মা আগুনের পূর্ণ আলো পায় না, কারণ আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম—যতদিন না সত্য প্রকাশ পাবে, ততদিন কেউ মুক্তি পাবে না।” অনির্বাণ চমকে উঠল, কিন্তু তার ঠোঁট থেকে প্রশ্ন বেরিয়ে এল, “আপনি কে?” বৃদ্ধ ধীরে ধীরে উত্তর দিলেন, “আমি ছিলাম এই গ্রামের পণ্ডিত। মৃত্যুর আগে দেখেছিলাম, কতজনকে ভুল নিয়মে দাহ করা হয়েছে, কত আত্মা কষ্ট পেয়েছে। তাই আমি আগুনকে বেঁধে রেখেছি, মুক্তি আটকে রেখেছি। কেউ সঠিক পথ দেখালে তবেই এই অভিশাপ ভাঙবে।”
চোখ খুলতেই অনির্বাণ দেখল, চারপাশ ফিকে আলোয় ভরে উঠেছে, ভোর হয়ে গেছে। তবে ঘাম ভেজা শরীর তাকে বুঝিয়ে দিল, এ কেবল স্বপ্ন ছিল না। এর ভেতর কোনো না কোনো সত্যি লুকিয়ে আছে। সে জানল, এ শ্মশানের অদ্ভুত রহস্য বহু পুরোনো অভিশাপের সঙ্গে যুক্ত, আর সেই অভিশাপের কারণেই আত্মারা ঘুরে বেড়ায়, কেউ শান্ত, কেউ অশান্ত। অনির্বাণ হঠাৎই অনুভব করল, তার সামনে এক ভারী দায়িত্ব এসে দাঁড়িয়েছে। সে আর শুধু একজন প্রহরী নয়—তার ওপর বর্তেছে এমন এক শপথের বোঝা, যা হয়তো তাকে নিয়ে যাবে মুক্তির দরজা পর্যন্ত, নাহয় টেনে নিয়ে যাবে আরও গভীর অন্ধকারে।
অধ্যায় ৯: প্রহরীর দায়িত্ব
অনির্বাণের ভেতর এক অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটল। প্রথম রাতে যে আতঙ্ক তাকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করতে চাইছিল, এখন সেই ভয় ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছিল দৃঢ়তায়। সে বুঝল, এখানে তার কাজ শুধু পাহারা দেওয়া নয়। এই শ্মশান পাহারা দেওয়ার মানে হলো মৃত আত্মাদের যন্ত্রণা সহ্য করা, তাদের অপেক্ষা আর অশান্তির কারণ খুঁজে বের করা। ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়তেই সে গ্রামে ফিরে গেল, কিন্তু সারাটা দিন অস্বস্তি তাকে ছেড়ে গেল না। মাথায় বারবার ঘুরে বেড়াল সেই বৃদ্ধ পণ্ডিতের কণ্ঠস্বর, সেই অভিশাপের প্রতিজ্ঞা। গ্রামবাসীরা তাকে জিজ্ঞেস করল কেমন ছিল রাত, কিন্তু সে কিছু বলল না। শুধু চুপচাপ শুনল, কারও মুখ থেকে বেরোল পুরনো গল্প—কেউ কেউ জানে এই শ্মশান অশান্ত, কিন্তু কেন অশান্ত তার উত্তর কেউ দিতে পারল না।
পরের রাতে সে আর শুধু ভয়ে কুঁকড়ে বসে থাকল না। বরং লণ্ঠন হাতে ধীরে ধীরে পুরো শ্মশান ঘুরে দেখল। প্রতিটি ভাঙা চিতা, প্রতিটি অর্ধদগ্ধ ছাইয়ের স্তূপ যেন তাকে ফিসফিস করে বলছিল—“আমরা এখনো মুক্তি পাইনি।” সে টের পেল, আত্মারা তাকে দেখে না, অথচ অনুভব করে তার উপস্থিতি। আর সে নিজেই উপলব্ধি করল, হয়তো এই ভূমি তাকে বেছে নিয়েছে। সে লাঠি মুঠোয় ধরে দাঁড়িয়ে রইল, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল—সে এই রহস্য ভেদ করবে, অভিশাপ ভাঙার উপায় খুঁজবে। ভেতরে ভেতরে ভয় থাকলেও, সেই ভয়কে ছাপিয়ে উঠল এক অদ্ভুত দায়িত্ববোধ। যেন অচেনা কণ্ঠ তাকে পথ দেখাচ্ছে—“তুমি প্রহরী, তোমাকেই মুক্তি দিতে হবে।”
সময় যত গড়াল, অনির্বাণ মন্ত্র-তন্ত্র, আগুনের নিয়ম, শ্মশানের প্রাচীন আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে জানতে শুরু করল। গ্রামে বৃদ্ধ ব্রাহ্মণদের সঙ্গে আলাপ করল, পুরনো বইয়ের পাতা উল্টে ইতিহাস জানল। আস্তে আস্তে সে খুঁজে পেল আগুনের প্রকৃত তাৎপর্য, কীভাবে মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে আত্মাদের শান্তি দেওয়া যায়। প্রতিটি রাত সে আরও সতর্কভাবে পাহারা দিল, আর প্রতিটি সকাল নতুন সংকল্প নিয়ে গ্রামে ফিরল। সে বুঝল, প্রহরী মানে শুধু চোর-ডাকাত ঠেকানো নয়, বরং এক অদৃশ্য যন্ত্রণার পাহারা দেওয়া। তার দায়িত্ব হলো সেই যন্ত্রণাকে শেষ করা। অনির্বাণ এখন আর কেবল একজন চাকুরে নয়—সে হয়ে উঠছে এক সেতু, জীবিত আর মৃতের মাঝের একমাত্র প্রহরী।
অধ্যায় ১০: চূড়ান্ত রাত
অবশেষে সেই রাত এলো, যেটা যেন দিনের পর দিন অনির্বাণকে সামনে টেনে আনছিল। আকাশে তখন কালো মেঘে ঢেকে গেছে চাঁদ, হাওয়ায় ভেসে আসছিল পোড়া কাঠ আর ভেজা মাটির তীব্র গন্ধ। অনির্বাণ জানত, এ রাতই তার পরীক্ষা—হয় সে প্রহরীর সত্যিকার দায়িত্ব পালন করবে, নয়তো এই অভিশপ্ত শ্মশানের মতো সেও অন্ধকারে গ্রাস হয়ে যাবে। লণ্ঠন হাতে সে দাঁড়িয়ে থাকল দাহকুণ্ডের সামনে। রাত যত গভীর হলো, একে একে মৃতেরা উঠে দাঁড়াল। কিন্তু এবার সংখ্যা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। পুরো শ্মশান ভরে উঠল শত শত পোড়া দেহে, যারা নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল অনির্বাণের দিকে। বুকের ভেতর তার হৃদস্পন্দন যেন গর্জন তুলছিল, তবুও সে দমে গেল না।
হঠাৎই বাতাস ভারী হয়ে উঠল, চারদিকে কুয়াশার মতো ধোঁয়া ঘনিয়ে এল। আগের রাতগুলোর শান্ত অপেক্ষমাণ আত্মারা এবার যেন একসাথে এগিয়ে এল দাহকুণ্ডের দিকে, আর অশান্ত আত্মাদের চিৎকার শ্মশানের দেয়াল কাঁপিয়ে তুলল। অনির্বাণ বুঝল, এ রাতই সিদ্ধান্তের মুহূর্ত। সে কাঁপতে থাকা হাত মুঠো করে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করল, যা সে শিখেছিল দিনের পর দিন গবেষণা করে। লণ্ঠনের আলোয় মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, আর তার কণ্ঠে যেন এক অদ্ভুত দৃঢ়তা জন্ম নিল। হাতে লাঠি গেঁথে আগুন জ্বালাল, শিখা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল ছাইয়ের ওপর, আর সেই সঙ্গে ভেসে এল আত্মাদের ভারী নিঃশ্বাসের মতো শব্দ। প্রতিটি মন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে একেকটি আত্মা যেন হালকা হয়ে যাচ্ছিল, ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল কুয়াশায়।
অবশেষে ভোরের প্রথম আলো ফুটতেই শ্মশান নিস্তব্ধ হয়ে গেল। শত শত দেহ, সেই অশান্ত আর শান্ত আত্মারা, সব অদৃশ্য হয়ে গেল ধীরে ধীরে। শুধু পড়ে রইল ভাঙা চিতা আর পোড়া কাঠের স্তূপ। অনির্বাণ ক্লান্ত শরীরে মাটিতে বসে পড়ল, কিন্তু তার চোখে তখন এক অন্য রকম শান্তি। সে জানত, অন্তত কিছুটা মুক্তি সে দিতে পেরেছে। গ্রামবাসীরা সকালে এসে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুই বোঝেনি, তারা ভেবেছে রাতটা হয়তো সাধারণ ছিল। কিন্তু অনির্বাণ জানল, সে আর শুধু প্রহরী নয়—সে এখন মৃতদের মুক্তিদাতা, অভিশপ্ত শ্মশানের একমাত্র রক্ষক। আর সেই দায়িত্বের ভার নিয়ে তার জীবনের প্রতিটি রাত নতুন এক অভিযানের সূচনা করবে।
শেষ