Bangla - ভূতের গল্প

শ্মশানের ডাকঘর

Spread the love

অমল ছিল এক সাধারণ গ্রামীণ ডাকপিয়ন, যার জীবন প্রতিদিনের রুটিন আর নির্দিষ্ট পথেই আবদ্ধ ছিল। সকালবেলায় সে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ত, চিঠির ব্যাগ কাঁধে নিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি যেত, আর বিকেলের মধ্যেই সব বিলি শেষ করে বাড়ি ফিরত। কিন্তু সেদিনটা অদ্ভুতভাবে ভিন্ন হয়ে দাঁড়াল। অফিসে কিছু অতিরিক্ত কাজের জন্য তাকে দেরি হয়ে গেল, আর সন্ধ্যার আলো যখন ম্লান হতে শুরু করল, তখনও অমল চিঠির ব্যাগ নিয়ে রওনা দেয়নি। সে জানত, গ্রামের মানুষরা চিঠির অপেক্ষায় থাকে, আর দেরি করলে তাদের মুখে বিরক্তি ফুটে ওঠে। তাই অমল নিজের ক্লান্তি উপেক্ষা করে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। পথে হাঁটতে হাঁটতে সে লক্ষ্য করল, অন্ধকার যেন অস্বাভাবিক দ্রুত নেমে এসেছে। চারদিক ফাঁকা, শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ আর দূরে কোথাও কুকুরের হাহাকার শোনা যাচ্ছিল। গাঁয়ের সরু মাটির রাস্তা ধরে যেতে যেতে সে অনুভব করছিল, যেন সেই নির্জনতা তার বুকের ভেতর চাপ সৃষ্টি করছে। তবুও সে নিজের কর্তব্য মনে করে এগিয়ে চলল। কিন্তু যখন গ্রাম প্রায় শেষ হয়ে এল আর শ্মশানের ধারে পৌঁছল, তখন তার চোখে এক অচেনা দৃশ্য ধরা দিল—একটা বাড়ি, যা সে আগে কখনও দেখেনি।

বাড়িটা দেখতে ছিল অদ্ভুত। গাঢ় কালো অন্ধকারের ভেতরেও বাড়িটার চেহারা যেন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল, যেন কোনো অদৃশ্য আলো তাকে আলাদা করে তুলেছে। দেয়ালের রঙ ছিল মলিন ধূসর, জানালার কাঠামো বেঁকে গেছে, আর বারান্দায় ঝুলে ছিল শুকনো লতার মতো কিছু অচেনা গাছপালা। অমল থমকে দাঁড়াল, কারণ তার মনে পড়ল—সে এই রাস্তায় বহুবার এসেছে, শ্মশানের পাশ দিয়ে গিয়েছে অগণিতবার, কিন্তু এরকম কোনো বাড়ি সে কোনোদিন দেখেনি। “হয়তো চোখ এড়িয়ে গেছে আগে,” নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করল সে, যদিও ভেতরে এক অস্বস্তি ক্রমে ঘনিয়ে আসছিল। ঠিক তখনই তার মনে পড়ল—ব্যাগে একটা চিঠি আছে, যার ঠিকানায় লেখা ছিল গ্রামের শেষপ্রান্তে অবস্থিত ‘চন্দ্রভবন’। অমল ভেবেছিল, হয়তো ওই চিঠির ঠিকানাটাই এই বাড়ি। ধীরে ধীরে সাইকেল নামিয়ে সে বাড়িটার দিকে এগোল। শ্মশানের হাওয়া তখন ঠান্ডা হয়ে উঠেছে, বাতাসে ভেসে আসছিল পুড়োনো কাঠ আর ছাইয়ের গন্ধ। অমলের গা শিরশির করছিল, তবুও তার পা যেন অজান্তেই বাড়িটির দিকে চলতে লাগল।

বারান্দায় উঠে সে খটখট করে দরজায় কড়া নাড়ল। ভেতর থেকে কোনো সাড়া আসেনি। এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হল, হয়তো বাড়িটা আসলেই পরিত্যক্ত। কিন্তু ঠিক তখনই দরজাটা কিঞ্চিৎ শব্দ করে খুলে গেল, যেন ভেতর থেকে কেউ ঠেলে দিয়েছে। অমলের বুক ধকধক করে উঠল, তবুও সে ভিতরে ঢুকে পড়ল। ঘরের ভেতরে আলো নেই, শুধু এক কোণে ধোঁয়াটে প্রদীপ জ্বলছে। দেওয়ালে ধুলো জমে আছে, আসবাবপত্রে মাকড়সার জাল। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো—ঘরটা যেন ফাঁকা নয়, অমল অনুভব করছিল কারও উপস্থিতি, কারও শ্বাসের শব্দ। “চিঠি এসেছে,” সে আস্তে করে বলে উঠল, ব্যাগ থেকে খামটা বের করে টেবিলে রাখল। তখনই হাওয়ার ঝাপটা এসে প্রদীপটা নিভিয়ে দিল, আর অমল যেন বুকের ভেতর ঠান্ডা একটা হাতের স্পর্শ পেল। ভয়ে কেঁপে উঠে সে বাইরে দৌড়ে এল, সাইকেল টেনে ধরে দ্রুত রাস্তার দিকে ছুটল। শ্মশানের নিস্তব্ধতা তখন আরো গভীর হয়ে উঠেছে, পেছন ফিরে তাকাতে তার সাহস হচ্ছিল না। শুধু মনে হচ্ছিল, বাড়িটার জানালা থেকে কেউ তাকে লক্ষ্য করছে। অমল দৌড়াতে দৌড়াতে বুঝতে পারল, এই রাতের পোস্টম্যানের কাজ তাকে এক অচেনা অন্ধকার রহস্যের মুখোমুখি এনে ফেলেছে, যার উত্তর হয়তো আগামী দিনগুলোতেই উন্মোচিত হবে।

অমল সেদিন রাতের ঘটনার পর মনকে শান্ত করার চেষ্টা করলেও কিছুতেই তা সম্ভব হলো না। শ্মশানের ধারে সেই অচেনা বাড়ি আর ভেতরের অদ্ভুত অনুভূতি তাকে সারারাত তাড়া করে ফিরল। পরদিন সকালে ডাকঘরে পৌঁছে সে যখন নতুন চিঠির ব্যাগ পেল, তখন হঠাৎ নজরে এল—আবারও সেই ‘চন্দ্রভবন’ নামটি লেখা একটি খাম। কাঁপা হাতে সে খামটি ব্যাগে রাখল। ভেতরে ভেতরে সে ভাবছিল, গত রাতে যে বাড়িতে সে চিঠি দিয়ে এসেছে, সেটা কি সত্যিই আছে? নাকি তার চোখ তাকে ধোঁকা দিয়েছিল? কিন্তু ঠিকানাটা এত স্পষ্ট লেখা যে কোনো ভুল হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তাই দুপুরে যখন আবার সে সেই পথে বেরোল, তার মন দ্বিধা আর আতঙ্কে ভরে উঠল। গ্রামের মানুষের কাছে জিজ্ঞেস করেও কিছু জানা গেল না। সবাই বলল, শ্মশানের ধারে কোনো বাড়ি নেই। কেউ কেউ হেসে বলল, অমল বোধহয় রাতের অন্ধকারে ভ্রম দেখেছে। কিন্তু অমল জানত সে যা দেখেছে, তা মিথ্যে নয়। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামার পর যখন সে আবার শ্মশানের কাছে পৌঁছল, তার বুক ধুকপুক করতে লাগল। এবং অবাক হয়ে দেখল—সেই বাড়ি আবার দাঁড়িয়ে আছে, যেন কখনোই হারিয়ে যায়নি। এবার সে বারান্দার দিকে এগোতে গিয়ে চোখে পড়ল—দরজার পাশে একটি পুরোনো লোহার ডাকবাক্স ঝুলছে, কালচে রঙে মরচে ধরা, কিন্তু এখনও যেন ব্যবহারযোগ্য।

অমল থমকে দাঁড়াল। ডাকবাক্সটি এতদিন তার চোখে পড়েনি, অথচ এবার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মনে হলো যেন ডাকবাক্সটা ইচ্ছে করে তার জন্য অপেক্ষা করছে। ধীরে ধীরে খাম থেকে সেই চিঠি বের করে অমল বাক্সের ঢাকনা তুলে ভেতরে রাখল। ঠিক তখনই যেন চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে উঠল। পেছন দিক থেকে হালকা ফিসফিসানি শোনা গেল, যেন একসাথে কয়েকজন মানুষ কথা বলছে, কিন্তু শব্দ এত মৃদু যে বোঝা যায় না কি বলা হচ্ছে। অমল ভয়ে সাইকেল ধরে সরে আসতে চাইছিল, কিন্তু কৌতূহল তাকে আটকে রাখল। সে কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করল, ফিসফিসানির সঙ্গে যেন কারও হালকা হাসির আওয়াজও মিশে ছিল। তার চোখ বারান্দার দিকে গিয়ে পড়ল—দরজার ফাঁক দিয়ে অস্পষ্ট আলো বেরোচ্ছে, যেন ভেতরে প্রদীপ জ্বলছে বা কোনো ঘরে আলো জ্বালানো হয়েছে। অথচ বাড়ির বাইরের অবস্থা দেখে মনে হয় ভেতরে বহু বছর কেউ পা রাখেনি। বুকের ভেতর ধকধক করছিল, তবুও অমল সাহস করে কয়েক কদম এগোল। সে দরজার কাছে যেতেই হঠাৎ সবকিছু নিস্তব্ধ হয়ে গেল। আলো নিভে গেল, ফিসফিসানি মিলিয়ে গেল, আর চারপাশে নেমে এল এমন এক গভীর নীরবতা, যেন বাতাসও থেমে গেছে।

অমল ঘামতে শুরু করল। তার মনে হচ্ছিল, বাড়ির ভেতরে অদৃশ্য চোখ তাকে লক্ষ্য করছে। ডাকবাক্সের ভেতরে রাখা চিঠিটা হঠাৎ ঠকঠক শব্দ করে নড়ে উঠল, যেন ভেতর থেকে কেউ সেটা টেনে নিল। অমল আতঙ্কে পিছিয়ে গেল, তার সাইকেলের হ্যান্ডেল শক্ত করে ধরে দাঁড়াল। এক মুহূর্তের জন্য সে পেছন ফিরে পালিয়ে যেতে চাইল, কিন্তু কৌতূহল তাকে আবারও আচ্ছন্ন করল। “আসলেই যদি কেউ এই চিঠিগুলো নিচ্ছে?” সে মনে মনে ভাবল। “তাহলে সেই কেউ তো এখানে থাকে, কিংবা… কোনো অচেনা শক্তি এই বাড়ির ভেতরে বসবাস করে।” তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল, হাত কাঁপছিল, কিন্তু তারপরও চোখ সরাতে পারছিল না সেই অন্ধকার দরজার ফাঁক থেকে। কিছুক্ষণ পর যখন কোনো সাড়া মিলল না, অমল ভয়ে ভয়ে সাইকেল চালিয়ে সরে গেল। শ্মশানের হাওয়া আবার বুকের ভেতর কাঁপুনি ধরাচ্ছিল। গ্রামের রাস্তা ধরে ফিরতে ফিরতে তার মনে হচ্ছিল, পিছন থেকে যেন কেউ অনুসরণ করছে। সে যতবারই পেছনে তাকাল, শুধু শূন্য রাস্তা আর কালো গাছের ছায়া ছাড়া কিছু দেখতে পেল না। তবুও তার মনে হচ্ছিল, চিঠি দেওয়ার মুহূর্ত থেকে এই অচেনা বাড়ির সঙ্গে তার এক অদৃশ্য সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, যেখান থেকে আর সহজে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।

পরদিন সকালে অমল তার সাধারণ রুটিন অনুযায়ী গ্রামের চায়ের দোকানে চলে এল। দোকানটি ছোট, কিন্তু তার প্রতিটি কোণে গ্রামীণ জীবনের গল্প লুকিয়ে আছে—দরজার পাশে ঝুলছে ধূসর রঙের পুরোনো ফ্যান, টেবিলগুলোতে চকচকে ধুলো, আর কোণের চুলার পাশে আগুনের গন্ধ এখনও খোঁচাচ্ছে। অমল কৌতূহল ও অস্থিরতার সঙ্গে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বসে রইল। চায়ের দোকানে তখন কয়েকজন লোক ছোটখাটো খবরের আদান-প্রদান করছিল। গ্রামের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো, ফসলের অবস্থা, বাজারের দাম—সবই সাধারণ আলোচনার বিষয়। অমলের মন অন্যদিকে মনোযোগী ছিল; সে গতকাল রাতের ঘটনা ভাবছিল, সেই অচেনা বাড়ি, ডাকবাক্সে চিঠি রাখা এবং ভেতরের অদ্ভুত ফিসফিসানি। ঠিক তখনই একজন বৃদ্ধ গ্রামবাসী, যিনি চায়ের দোকানে নিয়মিত আড্ডা দিতেন, হঠাৎ এক গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “তোমরা জানো না সেই চন্দ্রভবনের বাড়িটা? অনেক বছর আগেই আগুনে পুড়ে গেছে। সেখানে কেউ বেঁচে নেই।”

অমলের কানে এই শব্দগুলো ঢুকতেই তার চায়ের কাপে থাকা চা যেন ঠান্ডা হয়ে গেল। প্রথমে সে বিশ্বাস করতে পারল না। তার চোখ বড় হয়ে গেল, এবং মনে মনে বারবার সেই বাড়ির ছবি তার চোখের সামনে ভেসে উঠল—গতকাল রাতের অন্ধকার, ফিসফিসানি, এবং ভেতরের আলো। “কিন্তু আমি তো নিজে দেখেছি… সেখানে তো আলো জ্বলছিল, ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছিল,” সে ভেতরে ভেতরে ভাবতে লাগল। চায়ের দোকানের অন্য গ্রামবাসীরাও তখন আগ্রহ নিয়ে কথায় যোগ দিল। কেউ বলল, “হ্যাঁ, সে বাড়িটা দশ-পনেরো বছর আগে আগুনে পুড়ে যায়। তখন সব পরিবার মারা যায়। এরপর কেউ সেখানে বাস করেনি। কেউ সেখানে যাওয়ার সাহসও পায়নি।” অমলের হাত কেঁপে উঠল। তার মনে হলো, অদ্ভুত কিছু ঘটে গেছে—কিছু এমন যা তার যৌক্তিক বোধের বাইরে। তার মন ঘুরপাক খাচ্ছিল, কিন্তু একই সঙ্গে কৌতূহল আরও বাড়ছিল। সে ভাবতে লাগল, “যদি বাড়ি আগুনে পুড়ে গেছে, তাহলে昨 রাতের আলো, ফিসফিসানি, এবং ডাকবাক্সের আন্দোলন… এটা কি কেবল তার কল্পনা ছিল?”

অমল স্তব্ধ হয়ে চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে এল। গ্রামবরাবর হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হয়েছিল, যেন চারপাশের বাতাসও পরিবর্তিত হয়েছে। শ্মশানের পথে ফিরে গিয়ে, সেই অচেনা বাড়িটি তার চোখে ভেসে উঠল—কিন্তু এবার আর তা নিঃসঙ্গ বা অচেনা মনে হল না। ভেতরের আলো, ফিসফিসানি, সব যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। অমল বুঝতে পারল, যে বাড়ি বহু বছর আগেই ধ্বংস হয়েছে, তার সঙ্গে তিনি যে এক অদ্ভুত জগতে সংযুক্ত হয়েছেন, তা সত্য। প্রতিটি পদক্ষেপে তার মনে হচ্ছিল, বাড়ির অদৃশ্য উপস্থিতি তার সঙ্গে যোগাযোগ করছে। ডাকবাক্সে চিঠি রাখা, ফিসফিসানি শোনা, আলো দেখা—সবই যেন তাকে কিছু জানাতে চাচ্ছিল। অমল হঠাৎ নিজেকে ছোট খুঁজল, একদম একা, এবং বুঝল যে তিনি এমন কিছু দেখেছেন যা সাধারণ মানুষের বোঝার বাইরে। তিনি বুঝতে পারছিলেন, তার জীবনের নিয়মিত রুটিন আর নিরাপত্তা এখন আর অচেনা বাড়ির রহস্যের কাছে কোনো মানে রাখে না। সেই সকালে গ্রামবাসীর কথাগুলো অমলের মনে একটি গভীর শিহরণ বয়ে দিল, এবং তার মনে হলো, এই রাতের পোস্টম্যানের যাত্রা এখন শুধু একটি ডেলিভারির কাজ নয়—এটি শুরু হয়েছে এক অদ্ভুত রহস্যের যাত্রা, যার কোনো শেষ নেই।

অমল তার মনের বিভ্রান্তি দূর করতে গ্রামের এক বৃদ্ধের খোঁজ করল, যিনি সময়ের গভীরতার সঙ্গে বহু গ্রামীণ গল্পে অবহিত ছিলেন। বৃদ্ধের নাম ছিল রঘুনাথ, যিনি প্রায় শতবর্ষ বয়সী হলেও স্মৃতিশক্তি এতটাই তীক্ষ্ণ যে প্রায় সব গ্রামের ইতিহাস তার কাছে জীবন্ত মনে হতো। অমল যখন সেই বাড়ি, ‘চন্দ্রভবন’, এবং আগুনের ঘটনা সম্পর্কে প্রশ্ন করতে শুরু করল, রঘুনাথ তার চোখে গভীর দৃষ্টির আভাস দিয়ে গল্প শুরু করলেন। তিনি বললেন, “চন্দ্রভবনের মানুষরা সাধারণ পরিবার ছিল না। তারা ডাকঘরের কাজের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিল, বিশেষ করে রাতে লেখা চিঠি ও গোপন বার্তা পৌঁছানোর কাজে। গ্রামে কেউ জানত না ঠিক কি লেখা হতো, কিন্তু তাদের নাম সবসময়ই গোপনীয়তার সঙ্গে জড়িত ছিল।” অমল চোখ বড় করে শুনছিল, মনে হচ্ছিল যেন ইতিহাসের কোনো অদৃশ্য ছায়া তার সামনে ধীরে ধীরে উঠে আসছে। বৃদ্ধের কথায় বোঝা গেল, ওই পরিবার শুধুমাত্র চিঠি দেওয়ার কাজে নয়, বরং এক ধরনের গুপ্ত বার্তা পরিবহণের কাজ করত, যা গ্রামের অন্যান্য মানুষদের জানা ছিল না। আগুনে বাড়ি পুড়ে যাওয়ার পর থেকে তাদের অস্তিত্বকে যেন ভুলে যাওয়া হয়েছে; গ্রামে কেউ আর তাদের নাম উচ্চারণ করতে সাহস পায় না।

রঘুনাথ আরও বললেন, “তাদের জীবন ছিল গোপন ও রহস্যময়। মানুষ যাঁদের কাছে কোনো চিঠি পৌঁছাত, তাঁরা জানত না কোথা থেকে এসেছে, এবং কখন। রাতে ঘরের ভেতরে তারা লেখা চিঠি, সেগুলো ছদ্মনামে পাঠানো হতো। কেউ জানত না, এই কাজের জন্য কেউ মর্যাদা পেত কিনা, বা তাদের প্রাপকেরা কি অনুভব করত। কিন্তু সেই আগুন… তা সবকিছু শেষ করে দিয়েছে। আগুনে তারা মারা গেলেন, আর গ্রামবাসী সেই ঘটনার পর থেকে তাদের নাম উচ্চারণ করা শুরু করল না। এটি যেন একটি অভিশপ্ত নাম হয়ে গেছে। কেউ তাদের স্মরণ করতে চায় না। আর তাই, আজও সেই বাড়ি শ্মশানের ধারে দাঁড়িয়ে থাকলেও কেউ সেখানে প্রবেশ করতে সাহস পায় না।” অমলের মনে হলো, গতকাল রাতের অদ্ভুত ঘটনা—ফিসফিসানি, আলো, ডাকবাক্সের নড়াচড়া—সবই এই পরিবারের অতিপ্রাকৃত উপস্থিতি হতে পারে, যা তাদের জীবনের গোপন রহস্য ও অকাল মৃত্যুকে তুলে ধরছে।

এই কথাগুলো শুনে অমল আরও আগ্রহী হয়ে উঠল। তিনি বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন, কেন কেউ তাদের সম্পর্কে কথা বলে না। রঘুনাথের চোখে গভীর দৃষ্টি আসে, এবং তিনি বললেন, “কারণ তারা মরে যাওয়ার পর, তাদের জীবন আর গ্রামবাসীর বাস্তবতার সঙ্গে মিশে যায়নি। চন্দ্রভবনের নাম উচ্চারণ করলেই যেন অতীত ফিরে আসে, সেই অদৃশ্য আগুনের স্মৃতি, যেটি কেউ ভুলতে চায়। গ্রামে এমন লোকও ছিল যারা চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কেউ সঠিকভাবে বলতে পারত না কী ঘটেছিল। যাঁরা রাতের পোস্টম্যানের মতো সাহসী ছিল, তাঁদেরও শিরা কেঁপে উঠত। তাই সবাই চুপ হয়ে গিয়েছে।” অমল তখন বুঝতে পারল, যে তিনি কেবল একটি পরিত্যক্ত বাড়ি বা একটি চিঠি বিতরণের কাজ দেখেননি। তিনি একটি পরিবারের নিঃশেষিত ইতিহাসের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছেন, যাদের জীবনের রহস্য এখনও এই গ্রামের মধ্যে ভেসে বেড়ায়। তিনি নিজেকে এই গভীর রহস্যের মধ্যে আবদ্ধ অনুভব করলেন, আর মনে হলো, তাঁর সামনে অপেক্ষা করছে একটি জটিল গল্প—যার শুরু হয়েছে আগুন, গোপন চিঠি, এবং মানুষের ভুলে যাওয়া অতীত থেকে।

রাত নামতেই অমল তার সাইকেল নিয়ে আবার ডিউটিতে বের হল। দিনের আলোতে যে অচেনা বাড়ির রহস্য কিছুটা দূরে থাকল, রাতের অন্ধকারে তা যেন আরও জীবন্ত হয়ে উঠল। গ্রামের পথে ঘুরতে ঘুরতে অমলের মনে হচ্ছিল, গতকাল যা শোনা হলো—চন্দ্রভবনের পরিবার এবং তাদের আগুনে ধ্বংস—সেটা শুধু গল্প নয়, তার চোখের সামনে জীবন্ত অভিজ্ঞতা হতে চলেছে। ব্যাগটি কাঁধে ঝুলানো চিঠি যেমন সাধারণ রুটিনের অংশ, তেমনই আজ তার মনে অদ্ভুত এক আশঙ্কা তৈরি করছিল। গতকালের রাতের ঘটনা, ফিসফিসানি, এবং আলো—সবই যেন বারবার তার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছিল। কিন্তু যখন অমল পথ চলতে চলতে ব্যাগটি খুলল, তার চোখ বিশ্বাস করতে পারল না। ব্যাগের ভেতর অদ্ভুতভাবে কিছু নতুন চিঠি হাজির হয়েছে। পুরনো চিঠিগুলো নয়, এগুলো দেখতে সম্পূর্ণ নতুন—তবে ঠিকানায় লেখা নাম ছিল সেই আগুনে পুড়ে যাওয়া ‘চন্দ্রভবন’। অমল হতবাক হয়ে দেখল, এতো রাতের বেলা এই চিঠিগুলো তার কাছে কিভাবে এসেছে, তা তার কাছে এক রহস্যের মতো মনে হলো।

চিঠিগুলো ধরে অমল ভাবতে লাগল। সে কি স্বপ্ন দেখছে, নাকি বাস্তবেই এমন কিছু ঘটছে? চিঠির কাগজ জীর্ণ, প্রায় কাগজের রঙই ধূসর হয়ে গেছে, কিন্তু কালি এখনও স্পষ্ট। ঠিকানা ঠিক সেই পুরনো বাড়ির নাম—চন্দ্রভবন। ব্যাগের ভেতরে হঠাৎ এগুলো হাজির হওয়ার ঘটনা তাকে এক অদ্ভুত আতঙ্কে ফেলে দিল। তার মনে হলো, কেউ বা কিছু তাকে চিঠি পৌঁছে দিতে নির্দেশ দিচ্ছে। মনে হচ্ছিল, বাড়ির অদৃশ্য প্রাপকেরা তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছে। অমল চারপাশে তাকাল—গ্রামের রাস্তাগুলো শুনশান, বাতাসে হালকা কাঁপুনি, আর দূরে শ্মশানের কোলাহল, যেন প্রতিটি শব্দ তার ভেতরের আতঙ্ক বাড়াচ্ছে। তার হাতে চিঠি, তার চোখে অচেনা বাড়ি—সব মিলিয়ে যেন বাস্তবতার সঙ্গে অতিপ্রাকৃত ঘটনার সীমানা ধূসর হয়ে যাচ্ছে।

অমল ভাবল, এই চিঠিগুলো কি আগের রাতের মতো ভেতরের ফিসফিসানি ও আলোকে প্ররোচিত করছে? সে সাইকেল চালাতে চালাতে মনে মনে চেষ্টা করল—কোনো যুক্তি খুঁজে বের করার, কিন্তু যুক্তি যেন এ রাতের ঘটনা থেকে পালাচ্ছে। ব্যাগের ভেতর চিঠি থাকা, ঠিক ঠিকানায় আগুনে পুড়ে যাওয়া বাড়ির নাম লেখা, এবং গ্রামের নীরবতা—সবই এক অদ্ভুত মেলবন্ধন তৈরি করেছিল। অমল বুঝতে পারল, সে আর সাধারণ ডাকপিয়ন নয়; তার হাতে এসেছে এমন কিছু, যা অতীত ও বর্তমানের সীমানা মিলিয়ে রেখেছে। তার মন কৌতূহল আর ভয়ের মধ্যে দ্বিধায় বিভক্ত, এবং মনে হলো, এই রাতের যাত্রা শুধুই একটি ডেলিভারি নয়, এটি এক রহস্যময় অভিযানের শুরু—যা তাকে নিয়ে যাবে অচেনা শক্তির, অদৃশ্য প্রাপকেরা এবং অতীতের জ্বলন্ত স্মৃতির মধ্যে।

রাত গভীর হয়ে আসছিল, আর অমল তার ছোট ঘরে বসে চিঠিগুলো নিয়ে ভাবছিল। দিনের আলোতে যা ঘটেছে, রাতে তা যেন আরও জীবন্ত হয়ে উঠছে। ঘরের কোণে রাখা প্রদীপের আলো তার ছায়াকে বড় করে দেখাচ্ছিল, আর বাতাস হালকা ভিজিয়ে আনে একটি অদ্ভুত ঠান্ডা স্পর্শ। ক্লান্তি থাকা সত্ত্বেও অমল গভীর ঘুমে পড়ে গেল, কিন্তু স্বপ্নে সে যেন অন্য এক জগতে প্রবেশ করল। স্বপ্নে সেই চন্দ্রভবনের বাড়ি দেখা গেল, আগুনে জ্বলছে। অদ্ভুতভাবে সে নিজেকে ঘরের ভেতরে দেখতে পেল—দেয়ালগুলো ছাই হয়ে পড়েছে, কক্ষগুলো ধোঁয়ায় ঢাকা। মানুষের চিৎকার, আতঙ্ক, এবং ব্যস্ততায় ভরে উঠল ঘর। অমল দেখল, ভেতরের মানুষরা ছটফট করছে, কেউ জানালা দিয়ে পালানোর চেষ্টা করছে, কেউ দরজা খুলতে ব্যর্থ। তার চোখে দেখা গেল—ডাকঘরের সীলমোহর দেওয়া চিঠিগুলো ভেতরে ছড়িয়ে আছে, আগুনে জ্বলছে। কাগজ জ্বলে কালো ছাইতে রূপান্তরিত হচ্ছে, আর অমলের হৃদয় দম বন্ধ করে দিচ্ছে। সে যেন স্বপ্নের ভেতরে আটকে গেছে, আর সেই আগুনের শিখা যেন তার মস্তিষ্কে দগ্ধ হয়ে যায়।

স্বপ্নের দৃশ্যগুলি অমলের মনে এক অদ্ভুত আবেগ জাগাল। সে বুঝতে পারল, এই পরিবার শুধুমাত্র মারা যায়নি; তারা চেষ্টা করছিল কিছু বার্তা পৌঁছে দিতে—যে বার্তাগুলো অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আগুনে পুড়ে যাওয়া চিঠিগুলো যেন তাদের অসমাপ্ত কাজের প্রতীক। অমল অনুভব করল, সেই অদৃশ্য প্রাপকেরা তার মাধ্যমে এই বার্তাগুলো শেষ করতে চাচ্ছে। স্বপ্নে সে অনুভব করল, কক্ষের এক কোণে একজন বৃদ্ধ ডাকঘরের সীলমোহর ধরে চিঠিগুলো হাতে ধরছেন, আর অন্যরা তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করছে। চোখে পড়ল, তাদের চোখে আতঙ্কের সঙ্গে এক ধরনের অনুরোধ—একটি অসমাপ্ত কাজ সম্পূর্ণ করতে হবে। অমলের বুকটা যেন ভেঙে যায়, ভয় ও সহানুভূতির এক অদ্ভুত মিশ্রণে। সে স্বপ্নে চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু কোনো শব্দ বের হলো না। শুধু অনুভূতিই বয়ে গেল—যে বার্তাগুলো কখনো পূর্ণ হয়নি, তা হয়তো এবার তার হাতেই পৌঁছাবে।

সকাল হলে অমল ঘুম থেকে জেগে উঠল। ঘরের বাতাসে এখনও সেই স্বপ্নের অচেনা গন্ধ মিশে আছে—ধোঁয়া, আগুন, এবং কাগজের পোড়ার গন্ধ। সে চিঠিগুলো হাতে নিয়ে দেখল, আগের রাতের মতো ব্যাগের ভেতর আবার কিছু অদ্ভুত চিঠি হাজির। অমল বুঝতে পারল, মৃতরা যেন তাকে দিয়ে তাদের অসমাপ্ত বার্তা পৌঁছাতে চাইছে। তাঁর মনে হলো, চন্দ্রভবনের আগুনে মারা যাওয়া মানুষরা এখনও কোনোভাবে সংযুক্ত—অদৃশ্য, কিন্তু অত্যন্ত দৃঢ়। স্বপ্ন ও বাস্তবের মধ্যে যে সেতুবন্ধন তৈরি হয়েছে, তা তাকে আতঙ্কিত করার পাশাপাশি এক অদ্ভুত দায়িত্বও প্রদান করেছে। এই রাতের অভিজ্ঞতা তাকে স্পষ্ট করে জানাল যে, তার ডাকপিয়নের কাজ কেবল চিঠি বিতরণ নয়; এটি একটি বৃহৎ রহস্যের অংশ, যেখানে অতীত, মৃত্যুর ছায়া, এবং অসমাপ্ত বার্তার মিলন ঘটছে। অমল বুঝতে পারল, তার সামনে দীর্ঘ রাতের অভিযান অপেক্ষা করছে—যেখানে তাকে কেবল দৃষ্টি খোলা রাখতে হবে, সাহস রাখতেই হবে, আর সম্ভব হলে চন্দ্রভবনের মৃতদের বার্তাগুলো জীবিতদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।

রাত গভীর হয়ে আসল, আর অমল তার ছোট ঘরে বসে ব্যাগ থেকে চিঠিগুলো এক এক করে বের করতে লাগল। প্রতিটি চিঠি পুরনো, কুঁচকানো কাগজে লেখা, কিন্তু কালি এখনও চিহ্ন স্পষ্ট করে রেখেছে। চোখে পড়ল যে এগুলো সীলমোহরযুক্ত, আর সীলমোহরের আঘাত স্থানীয় আগুনের কারণে কিছুটা ক্ষয়প্রাপ্ত। অমল প্রথমে মনে করল, হয়তো এগুলো শুধু পুরনো নথি, কিন্তু পড়তে শুরু করার সাথে সাথে তার হৃদয় জড়িয়ে উঠল। প্রতিটি লাইন যেন অতীতের কণ্ঠস্বর, যা তাকে সরাসরি বাড়ির ভেতরের অদৃশ্য মানুষদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করছে। লেখা ছিল অসন্তোষের, অসমাপ্ত প্রতিশ্রুতির, এবং এমন গোপন সত্যের যা আজকের দিনে কেউ জানে না। অমল বুঝতে পারল, এটি কোনো সাধারণ চিঠি নয়; বরং এগুলো সেই পরিবারের আত্মার প্রেরিত বার্তা, যারা আগুনে মারা গিয়েছিল। একে একে চিঠিগুলো পড়তে পড়তে অমল অনুভব করল, প্রতিটি শব্দ তার ভেতরে অদ্ভুত শিহরণ তৈরি করছে।

চিঠিগুলোর মধ্যে একটি চিঠি বিশেষভাবে তাকে থমকে দিল। চিঠির লেখক ছিলেন বাড়ির এক মহিলা, যিনি আগুনে মারা যাওয়ার আগে গোপন বার্তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। চিঠিতে লেখা ছিল, “আমরা মরেও অপেক্ষা করছি, আমাদের কথা যেন পৌঁছায়। আমরা চাই যে আমাদের সত্য, আমাদের অসন্তোষ, এবং আমাদের অসমাপ্ত প্রতিশ্রুতি কেউ শুনুক। যদি কেউ এই বার্তাগুলো পায়, তবে আমাদের গল্প শেষ হতে পারে।” অমল চোখ বড় করে পড়ছিল, মনে হচ্ছিল যেন শব্দগুলো তার কানে এক অদ্ভুত সুরে বাজছে। চিঠিতে এমন কিছু লেখা ছিল যা গ্রামের কেউ জানত না, এমনকি রঘুনাথও। অমল বুঝতে পারল, এই চিঠিগুলো কেবল ব্যক্তিগত নয়; এগুলো ইতিহাস, যা জীবিতদের কাছে পৌঁছানো বাকি। সে অনুভব করল, এই বার্তাগুলো এখন তার হাতে এসেছে, এবং কোনোভাবে সে যেন অচেনা প্রাপকের ভূমিকা পালন করতে যাচ্ছে।

অমল গভীরভাবে চিন্তিত হয়ে পড়ল। তিনি বুঝতে পারলেন, চিঠিগুলো শুধু লেখা নয়, একটি আধ্যাত্মিক দায়িত্ব। মৃতরা তাকে দিয়ে তাদের বার্তা পৌঁছে দিতে চাইছে—যা তাদের জীবদ্দশায় অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। প্রতিটি চিঠি পড়ার সাথে সাথে তিনি অনুভব করলেন, বাড়ির মানুষরা শুধুমাত্র আগুনে মারা যায়নি; তারা এখনও এই গ্রামের মধ্যে এক অদৃশ্য উপস্থিতি হিসেবে বেঁচে আছে। অমল বুঝতে পারল যে, তার ডাকপিয়নের কাজ কেবল চিঠি পৌঁছে দেওয়া নয়—এটি একটি রহস্যময় যাত্রা, যেখানে অতীত, অদৃশ্য আত্মা, এবং অসমাপ্ত প্রতিশ্রুতির মিলন ঘটছে। সে মনে মনে ঠিক করল, যতই ভয়ঙ্কর হোক না কেন, এই বার্তাগুলো পৌঁছানোই তার কর্তব্য। রাতের নিস্তব্ধতা, চিঠির শব্দ, এবং অদৃশ্য আত্মাদের উপস্থিতি—সব মিলিয়ে অমলের জন্য এক গভীর, মনোমুগ্ধকর অভিজ্ঞতা হয়ে উঠল, যা তাকে ধীরে ধীরে সেই অচেনা বাড়ি এবং তার মৃত প্রাপকদের সঙ্গে সংযুক্ত করে দিল।

রাত গভীর হয়ে গেছে, আর অমল ব্যাগে রাখা চিঠিগুলো হাতে নিয়ে শ্মশানের দিকে এগিয়ে চলল। গ্রামের রাস্তা নিস্তব্ধ, বাতাসে অদ্ভুত এক শীতলতা ভাসছে, আর তার হৃদয় ধুকপুক করছে, মনে হচ্ছে প্রতিটি পদক্ষেপে অদৃশ্য কেউ তাকে অনুসরণ করছে। শ্মশানের কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে অমলকে মনে হচ্ছিল, প্রতিটি ছাইয়ের স্তর, প্রতিটি ধূসর ধুলো, যেন তার জন্য অপেক্ষা করছে। সে জানত, আজকে যা ঘটবে তা গত রাতের স্বপ্ন এবং গতকালের চিঠির ঘটনার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। যখন সে শ্মশানের প্রবেশদ্বারে দাঁড়ালো, তখন চারপাশে বাতাসের সঙ্গে ফিসফিসানি শোনা গেল—এক ধরনের নিঃশব্দ ডাক, যা শুধু তার কানে বেজে উঠছিল। অমল ব্যাগ খুলে চিঠিগুলো বের করল, মনে মনে দৃঢ় সংকল্প করল যে, আজকে সে এই চিঠিগুলো সেই পরিবারের মৃত প্রাপকদের উদ্দেশ্যে পৌঁছে দেবে।

শ্মশানের ভেতরে ঢুকতেই অমলের চোখে এক অদ্ভুত দৃশ্য ধরা দিল। এক কোণে ছাইয়ের স্তরের ভেতর থেকে যেন হালকা আগুন ঝলসে উঠছে, আর বাতাসে ধোঁয়ার সঙ্গে এক ধরনের অদৃশ্য আলো ফুটছে। চিঠিগুলো তার হাতে থাকলেও, যেন তারা নিজেরাই ছাইয়ের দিকে এগোচ্ছে। অমল দেখল, চিঠিগুলো অদ্ভুতভাবে জ্বলতে জ্বলতে ধীরে ধীরে ছাইয়ে মিশে যাচ্ছে, যেন আগুন এবং ছাই তাদের মধ্যস্থ করে এক ধরনের মধ্যযুগীয় বার্তালাপ সৃষ্টি করছে। তার চোখের সামনে সেই অদৃশ্য উপস্থিতি স্পষ্ট হয়ে উঠল—যেন মৃতরা নিজেরাই চিঠিগুলো গ্রহণ করছে। অমলের বুক কাঁপছে, আর মনে হচ্ছে, এই জায়গা শুধু শ্মশান নয়; এটি তাদের জন্য এক ধরণের ডাকঘর, যেখানে চিঠি পৌঁছানোই তাদের অসমাপ্ত কাজের সমাধান।

ভয় এবং বিস্ময় মিশ্রিত একটি অনুভূতি অমলের ভেতরে ভেসে উঠল। সে বুঝতে পারল, এই শ্মশান আর সাধারণ শ্মশান নয়; এটি মৃতদের ডাকঘর, যেখানে আগুনের স্মৃতি, ছাইয়ের স্তর, এবং অদৃশ্য উপস্থিতি একত্রিত হয়ে একটি বার্তা পরিবহণের অনন্য স্থান তৈরি করেছে। চিঠিগুলো জ্বলতে জ্বলতে ধূসর হয়ে যাওয়া, আগুনের ছাইয়ে মিশে যাওয়া—সবই যেন মৃত্যুর পরেও বার্তা পৌঁছানোর এক ধরনের আধ্যাত্মিক পদ্ধতি। অমল ধীরে ধীরে ব্যাগ থেকে এক একটি চিঠি তুলে সেই অদৃশ্য আগুনের দিকে এগিয়ে দিল, মনে মনে বঝে, প্রতিটি চিঠি পৌঁছানো মানে মৃতদের অসমাপ্ত কথাগুলো জীবিতদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। শ্মশানের নিস্তব্ধতা, ছাইয়ের ভেতর জ্বলন্ত আগুন, এবং অদৃশ্য ডাকপ্রণালীর সংমিশ্রণ—সব মিলিয়ে অমলের জন্য এক অভিজ্ঞতার সীমাহীন গভীরতা খুলে দিল, যা তাকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিল, রাতের পোস্টম্যান কেবল চিঠি পৌঁছানোর কাজই নয়, বরং অতীত ও বর্তমানের মধ্য দিয়ে অদৃশ্য আত্মাদের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার মধ্যবর্তী সংযোগের অংশ।

রাতের অন্ধকার যখন পুরো গ্রাম ঢেকে দিল, অমল আবার তার সাইকেল নিয়ে রুটিন অনুযায়ী চিঠি বিলি করতে বের হল। তবে আজকের রাতটি আগের রাতগুলোর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মনে হচ্ছিল। বাতাসে অদ্ভুত এক স্থিরতা, এবং প্রতিটি পদক্ষেপে যেন অদৃশ্য কোনো দৃষ্টি তার প্রতি নিবদ্ধ। গ্রামের রাস্তাগুলো নীরব, শুধু দূরে কোথাও কুকুরের ভয়ঙ্কর ভোঁকার আওয়াজ এবং পেছন দিক থেকে হালকা ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছিল। অমল ব্যাগে রাখা চিঠিগুলো নিয়ে ধীরে ধীরে অচেনা বাড়ির দিকে এগোল। মনে হচ্ছিল, রাতের অন্ধকার যেন তার জন্য বিশেষভাবে তৈরি হয়েছে, আর প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি বাতাসের কণাও যেন তাকে সতর্ক করার চেষ্টা করছে। সে কল্পনাও করতে পারছিল না, যা ঘটতে চলেছে—যে বার্তা পৌঁছানোর কাজ এতদিন কল্পনাতীত, আজ তার সামনে জীবন্ত হয়ে উঠছে।

যখন অমল বাড়ির দিক এগোল, তার চোখে এক অদ্ভুত দৃশ্য ধরা দিল। বাড়ির অদৃশ্য ভেতরের ঘরে মৃতদের ছায়া সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিটি ছায়ার হাতে চিঠি রয়েছে, আর তাদের মুখে যেন এক অদৃশ্য অনুরোধ, যা অমলকেই লক্ষ্য করছে। প্রতিটি ছায়া নিরিবিলি, কিন্তু উপস্থিতি স্পষ্ট। অমল প্রথমে ভয় পেয়েছিল, কিন্তু শীঘ্রই সে বুঝতে পারল, তারা তাকে ক্ষতি করতে চাচ্ছে না। বরং, তার চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠল, তারা চায় যে অমল হোক সেই একমাত্র জীবিত ডাকপিয়ন, যিনি তাদের বার্তা পৌঁছে দিতে পারবে। অমলের হৃদয় কাঁপছিল—এমনকি তার শরীরও কাঁপছিল, তবে মনে হচ্ছিল, এটি কেবল ভয় নয়; এক ধরনের দায়িত্ব, এক ধরনের বিশ্বাস, যা তাকে মৃতদের এবং জীবিতদের মধ্যবর্তী সংযোগস্থল হিসেবে দাঁড় করাচ্ছে।

অমল ধীরে ধীরে তাদের কাছাকাছি গিয়ে চিঠিগুলো গ্রহণ করল। ছায়াগুলো কোনো শব্দ করছে না, শুধু তার দিকে তাকিয়ে আছে, যেন এই কাজের প্রতি তাদের সম্পূর্ণ বিশ্বাস প্রকাশ করছে। অমল বুঝতে পারল, প্রতিটি চিঠি কেবল তথ্য বা বার্তা নয়; এগুলো হলো মৃতদের অসমাপ্ত প্রতিশ্রুতি, তাদের অসন্তোষ, এবং জীবিতদের কাছে পৌঁছানো উচিত এমন গোপন সত্য। প্রতিটি চিঠি হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অমল অনুভব করল, যে সে এখন শুধুমাত্র ডাকপিয়ন নয়, বরং এক রহস্যময় যাত্রার অংশ, যেখানে জীবিত এবং মৃতের মধ্যবর্তী সেতুবন্ধন তার দায়িত্বে রয়েছে। রাতের নীরবতা, ছায়াগুলোর উপস্থিতি, এবং চিঠির শক্তি—সব মিলিয়ে অমলকে নতুন এক দায়িত্বের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেল, যা তাকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে প্রলুব্ধ করল, তবে এক অদ্ভুত সাহসও প্রদান করল, যেন সে জানে, এই বার্তাগুলো পৌঁছানোই তার জীবন ও মৃতদের গল্পের সংযোগ।

১০

রাতের নিস্তব্ধতা পুরো গ্রামকে ঢেকে রেখেছিল, আর অমল ব্যাগ হাতে চিঠি বিলি করতে বেরিয়েছিল, ঠিক যেমন আগের রাতে করেছে। কিন্তু আজকের রাতটি আগের সব রাতের থেকে ভিন্ন এবং আরও ঘনভাবে রহস্যময় মনে হচ্ছিল। বাতাসে অদ্ভুত শীতলতা, এবং প্রতিটি পদক্ষেপে যেন অদৃশ্য চোখ তার প্রতি নজর রাখছে। অমল চাঁদের হালকা আলোয় গ্রামের রাস্তায় এগোচ্ছিল, কিন্তু তার মন ছিল অস্থির। ব্যাগে থাকা চিঠিগুলো এবার বিশেষভাবে ভারী মনে হচ্ছিল—যেমন প্রতিটি চিঠি নিজেই এক অদৃশ্য শক্তি বহন করছে। অমল ইতিমধ্যেই বুঝে গিয়েছিল, শ্মশানের সেই অচেনা বাড়ি এবং মৃতদের উপস্থিতি কেবল অতীতের স্মৃতি নয়; বরং এটি একটি জীবন্ত, অদৃশ্য ডাকঘর, যেখানে মৃত্যু এবং জীবন একসাথে মিলিত হয়। প্রতিটি চিঠি হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হচ্ছিল, সে যেন ধীরে ধীরে এই অদৃশ্য শক্তির অংশ হয়ে উঠছে।

যখন অমল শ্মশানের দিকে এগোল, তার চোখে আবার সেই অদ্ভুত দৃশ্য ধরা দিল—মৃতদের ছায়া সারিবদ্ধ, প্রতিটি হাতে চিঠি, এবং তাদের চোখে এক অনুরূপ অনুরোধ, যা তাকে একমাত্র জীবিত ডাকপিয়ন হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছিল। অমল আতঙ্কিত হলেও, সে জানত যে এই বার্তাগুলো পৌঁছানো তার দায়িত্ব। সে ধীরে ধীরে এক এক করে চিঠিগুলো ছাইয়ের আগুনের মধ্যে রাখল, এবং প্রতিটি চিঠি জ্বলতে জ্বলতে ধূসর হয়ে ছাইয়ে মিলিত হল। ঠিক তখনই তার চোখ একটি চিঠিতে পড়ল, যা অদ্ভুতভাবে অন্য চিঠিগুলোর থেকে আলাদা—সাদা কাগজ, প্রায় অক্ষত, এবং সীলমোহরের ওপর লেখা ছিল তার নাম। অমল অবাক হয়ে চিঠি খুলল, এবং পড়তে পড়তে রক্ত জমাট বাঁধল। চিঠিতে লেখা ছিল—“একদিন তুমিও এই শ্মশানের ডাকঘরের পোস্টম্যান হবে।”

চিঠি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অমলের শরীরে এক অদ্ভুত শীতলতা ছড়িয়ে পড়ল। সে বুঝতে পারল, এই যাত্রা কেবল শেষ চিঠি পৌঁছে দেওয়ার নয়; বরং এটি তার জীবনের এবং মৃত্যুর সীমানার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। তার চোখ বড় হয়ে গেল, বুক কাঁপতে লাগল, আর সে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু কোনো পদক্ষেপ সহজ মনে হচ্ছিল না। চারপাশে বাতাসে হালকা ফিসফিসানি, ছায়াগুলোর নীরব উপস্থিতি, আর আগুনের ছাই—সব মিলিয়ে তাকে এক অদৃশ্য জগতে টানতে শুরু করল। গল্প শেষ হয় অমলের আতঙ্কিত মুখের ওপর দৃষ্টি রেখে, আর পাঠককে রেখে যায় এক প্রশ্নের মাঝে—সে কি এখন জীবিত, নাকি ধীরে ধীরে মৃতদের জগতে টেনে নেওয়া হচ্ছে? রাতের অন্ধকারে, ছাইয়ের হালকা ঝলক, এবং অদৃশ্য ডাকঘরের উপস্থিতি যেন প্রতিটি পাঠককে মনে করিয়ে দেয়, যে অমলের মতো একজন সাধারণ ডাকপিয়নও কখনো কখনো অতীত, মৃত্যু, এবং অসমাপ্ত বার্তার মধ্যে এক রহস্যময় যাত্রার অংশ হয়ে যেতে পারে।

শেষ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *