Bangla - তন্ত্র

শ্মশানতলার পিশাচ

Spread the love

সৌম্য আইচ


অধ্যায় ১: অমাবস্যার আগমন

বছর দশেক পরে তমাল আবার ফিরছে গ্রামের দিকে। শহরের ব্যস্ততা, কনক্রিটের জঞ্জাল, অসংখ্য হর্নের আওয়াজের ভিতর থেকেও তার মনটা একধরনের অস্থিরতায় কাঁপছিল কয়েকদিন ধরে। দাদুর হঠাৎ মৃত্যু সংবাদে সে যেন মুহ্যমান হয়ে পড়েছিল, যদিও শেষ ক’বছর তেমন যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু শৈশবের সেই বিকেলগুলো, যখন দাদুর তান্ত্রিক ঘরের ধূপগন্ধে বসে সে ঘুমিয়ে পড়ত—সে স্মৃতি আজো গাঁথা। তমাল জানত, তার দাদু শুধু ঘরের মন্ত্রতন্ত্রেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, গ্রামের লোকেরা তাঁকে ভয় করত। কিছুটা শ্রদ্ধায়, কিছুটা আতঙ্কে। ‘বিজনানন্দ ঠাকুর’ নামে পরিচিত তার দাদু নাকি এক পিশাচকে কাবু করেছিলেন—এমন গল্প শুনেছে সে ছোটবেলায় জমিলা বুড়ির মুখে। তমাল এসব কখনও পাত্তা দিত না, মনে করত লোককথা। কিন্তু এবার সে ফিরছে এক অদ্ভুত টানেই, যেন তার মন বলছে—দাদুর মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। পুরনো ভাঙাচোরা ভিটেটায় পৌঁছেই সে অনুভব করল সময় থমকে দাঁড়িয়েছে সেখানে। দেয়ালে পোঁতা লোহালক্কড়, ঝুলে থাকা ডাবের খোলের বাতি আর মাটির তলায় গন্ধ ছড়ানো আগরবাতির ছাই যেন বলে—এই বাড়িতে এখনও কিছু আছে, যা অদেখা, অথচ জাগ্রত।

রাত্রি নামতেই গ্রামের পরিবেশে একরকম নিস্তব্ধতা নেমে এল। অমাবস্যা আসছে—এমন একটা অনুভূতি যেন বাতাসেই। গ্রামের বটতলার পাশে শ্মশানতলা, যেখানে কেউ যায় না সূর্য ডোবার পরে। তমাল শ্মশানতলার কথাটা মনে পড়তেই অস্বস্তি বোধ করল। সেই বটগাছটা, যেটার নিচে নাকি প্রতি অমাবস্যায় ‘সে’ দেখা দেয়, পিশাচ, যার মুখ থাকে না, চোখ থেকে ঝরে আগুন, আর শরীর নড়ে মাটি না ছুঁয়ে। তমাল এসব ভেবে অবাক হয়ে গেল, তার শহুরে মন এতসব কল্পনা কেন করছে? রাত বাড়তেই সে কৌতূহলে বারান্দায় বসে পড়ল, হাতে দাদুর পুরোনো ডায়েরি। পাতার পর পাতা জুড়ে মন্ত্র, উপবাসের হিসেব, এবং একটা বিশেষ অংশে লেখা—“অমাবস্যার রাতে, যদি শোনো হাঁসফাঁস, নাম না জানা কিছুর ডাক, ভুলেও ডেকো না। শুধু শুনে যাও, আর মনে রেখো… উচ্চারণে ভুল মানেই মৃত্যু।” তমাল শিউরে উঠল। ঠিক তখনই গ্রামের এক ছেলেকে চিৎকার করতে শোনা গেল—“ব্রজেন কাকা হারিয়ে গেছে শ্মশানপাড়ায়!” ছেলেটা ভয়ে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে হারিয়ে গেল অন্ধকারে, আর তমাল যেন স্থির হয়ে বসে থাকল। তার বুকের মধ্যে একটা অচেনা শব্দ, ধুকধুক, ধুকধুক… ঠিক যেন কেউ তার নাম ধরে ডাকছে, অথচ কানে আসছে না, শুধু অনুভবে ধরা পড়ছে।

পরদিন সকালে সে হাজির হয় জমিলা বুড়ির ঘরে, পানের রসালো গন্ধে ভরা সেই ঘর, যেখানে শত গল্প জমে আছে। জমিলা চোখ সরু করে তাকাল তমালের দিকে, বলল, “ফিরলি? বুঝেছিলাম ফিরবি, কারণ যারা শোনে, তারা ফেরে।” তমাল তার কথার মানে বুঝে উঠতে না পেরে ডায়েরিটা বাড়িয়ে ধরল। জমিলা একবার দেখে বলল, “ওটা আসল না রে, ওটা ঢাকনা, মন্ত্র ঢাকতে জানলে তবেই সে টের পায় না।” তমাল তখন জিজ্ঞেস করল, “কে সে?” জমিলা বলল, “তলায় থাকা সে… পিশাচ না, আত্মা না… সে এক প্রাচীন শক্তি, যার শ্বাসে ভোর হয়, আর নিশ্বাসে মৃত্যু।” তমাল ঠোঁট কামড়ে বলল, “আমি জানতে চাই সবটা, কী ঘটেছিল দাদুর সঙ্গে।” জমিলা থেমে বলল, “তোর দাদু শেষবার মন্ত্র পাঠ করছিল, বশ করতে চাইছিল তাকে… কিন্তু মন্ত্র ভুল ছিল। একটা মাত্র শব্দ ভুল… আর বাকিটা ইতিহাস।” সেই রাতে তমাল স্থির করল, সে যাবে শ্মশানতলায়, অমাবস্যার রাতে, একাই, কারণ সত্য জানতে হলে ভয়কে ছুঁয়ে দেখতে হয়।

তমাল প্রস্তুত হচ্ছিল তার জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত ও ভয়াবহ রাতের জন্য, অথচ সে জানত না—এই এক রাতেই তার সমস্ত বাস্তব, যুক্তি, বিজ্ঞান, আর হৃদয়ের বিশ্বাস ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। বিজনানন্দের পুরোনো ঘরের নিচে থাকা লোহার সিন্দুক থেকে সে পেয়ে গেল একটি কাঁটাওয়ালা রুদ্রাক্ষ, একটি তামার পাত, আর এক খণ্ড কাগজে লেখা একটি অদ্ভুত মন্ত্র—“অগ্নিসূচী সংহিতা নিকটে হলে, নিশ্বাস থেমে যায়, তবেই শোনে সে”। সে জানত না, এই মন্ত্র উচ্চারণের মাঝখানেই কোথাও ছড়ানো আছে বিভ্রম, যেটা তার মনকে ধোঁকা দিতে চাইবে। শ্মশানতলার সেই বটগাছ তার মতো কারও অপেক্ষায় আছে বহু বছর ধরে—যে ভয়কে ভালোবেসে পা দেবে তার ছায়ায়, আর হয়তো, কোনো ভুল উচ্চারণে খুলে দেবে এমন এক দরজা, যেখান থেকে ফিরে আসা মানেই মৃত্যু নয়, বরং আরও গভীর কিছু—যা মানুষ ‘অস্তিত্ব’ নামে চেনে না।

অধ্যায় ২: বটগাছের ছায়া

তমাল সারাদিন বাড়ির আনাচকানাচ ঘেঁটে বের করল কিছু পুরোনো সামগ্রী—দাদুর একটি কাঠের মালা, রক্তমাখা কাপড়ে মোড়ানো ছোট্ট একটি তামার পুঁথি আর তার পাশেই শোভা পাচ্ছে একটি পাথরের চক্র। বস্তুগুলো যতই নিরীহ দেখাক না কেন, তমালের ভেতরে এক অজানা ভয় সঞ্চার করছিল। কিন্তু তার মন কেমন যেন স্থির হয়ে গেছে, সে অনুভব করছিল—তার আসা এমনি এমনি নয়। দাদুর মৃত্যুর সঙ্গে এই বস্তুগুলোর যোগ আছে, এবং সবচেয়ে বড় কথা, শ্মশানতলার পিশাচকে ঘিরেই যেন সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু। বিকেল গড়িয়ে রাত নামতে না নামতেই তমাল প্রস্তুত হয়ে নিল। সে হাতে পরে নিল কাঠের মালাটি, বুক পকেটে রেখে দিল তামার পুঁথি আর কাগজের সেই মন্ত্রখণ্ড, আর কোমরে বেঁধে ফেলল দাদুর বাটির লোহার ছুরি। রাত যেন ভয় আর নিস্তব্ধতার চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। পায়ের নিচে শুকনো পাতার শব্দ শুনে তমাল থেমে দাঁড়াল। বাতাস থেমে গেছে, যেন প্রকৃতি নিজেই নিঃশব্দে কোনো কিছু অপেক্ষা করছে। গ্রামের দক্ষিণ দিকের পথ ধরে সে এগিয়ে চলল শ্মশানতলার দিকে—যেখানে মৃতরা অনন্তে মিশে যায়, আর কিছু কিছু অস্তিত্ব থেকে যায় বেঁচে।

শ্মশানতলায় পৌঁছাতেই তমাল দেখল, দূর থেকে যেন বটগাছের নিচে আবছা আগুন জ্বলছে। অথচ কেউ নেই সেখানে। সে সামনের দিকে পা বাড়াল, প্রতিটি ধাপে শোনা যাচ্ছে শুষ্ক ঘাসের চিড়বিড় আওয়াজ, যেন জিভ টেনে নিচ্ছে মাটি। বটগাছের কাছে পৌঁছতেই সে দেখল—ভস্মে ঢাকা একটি বৃত্ত আঁকা, তার মাঝে কাচের পাত্রে আটকে রাখা রক্ত, যেটি হয়তো কোনো বলির! হঠাৎই হাওয়া বদলে গেল। পেছন থেকে ভেসে এলো শ্বাস ফেলার গম্ভীর আওয়াজ, এবং সেই সঙ্গে গন্ধ—পচা মাংস, আগরবাতি আর ভেজা মাটির এক গন্ধময় মিশ্রণ। তমাল ঘুরে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে অনুভব করল পায়ের নিচে কাঁপন, মাটি যেন নিচে ডেকে নিচ্ছে তাকে। সে তাড়াতাড়ি পকেট থেকে কাগজটি বের করল, আর মন্ত্র পাঠ করতে শুরু করল—“অগ্নিসূচী সংহিতা নিকটে হলে… নিশ্বাস থেমে যায়… তবেই শোনে সে…” কিন্তু ঠিক সেই সময় হঠাৎই তার কণ্ঠ আটকে গেল, শব্দটি ভুলভাবে উচ্চারিত হয়ে গেল। মুহূর্তেই চারদিক অন্ধকারে ঢেকে গেল।

তমালের চারপাশে ঘূর্ণি বাতাস তৈরি হল, মাটির নিচ থেকে যেন ফুসফুসফাটানো গর্জন উঠল। বটগাছের ছায়া লম্বা হয়ে তার দিকে এগিয়ে এল, আর সেই ছায়ার মধ্যে ধীরে ধীরে গঠিত হল এক কুয়াশাময় রূপ—দেহহীন মুখ, চোখের জায়গায় গর্ত, কণ্ঠে অস্পষ্ট শব্দ… যেন “ফিরে যা…”। তমাল ভয়ে পেছাতে গিয়ে পড়ে গেল বৃত্তের ভেতর। ঠিক সেই মুহূর্তে কিছু একটা তার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল বাইরে। সে অচেতন হয়ে পড়ল, চোখের সামনে শুধু দেখা যাচ্ছিল আগুনের লেলিহান শিখা আর একটি সাদা চোখ—যেটি কেবল তাকিয়ে আছে তার হৃদপিণ্ডের গভীরে। জ্ঞান ফিরে পেতে পেতে তমাল নিজেকে আবিষ্কার করল গ্রামের প্রান্তের ঘাসভরা মাঠে। তার হাতে ধরা সেই রুদ্রাক্ষটি ফেটে গেছে, বুক পকেটের পুঁথির কাগজ ছিঁড়ে গেছে মাঝখান থেকে।

সে বুঝতে পারল, সে কিছু একটা খুলে ফেলেছে—একটা দরজা, যা হয়তো বন্ধ রাখা উচিত ছিল। পিশাচ এখন জানে তার নাম, তার মুখ, এমনকি তার হৃদয়ের গতি। তমাল এখন শুধুমাত্র অনুসন্ধানকারী নয়—সে এখন সেই খেলার একজন অংশগ্রহণকারী, যেখানে প্রতিটি ভুল মানে জীবন নয়, আত্মা খণ্ডিত হওয়া। বিজনানন্দ দাদুর মুখের সেই কথাগুলো যেন কানে বাজছিল—“ভুল উচ্চারণ মানেই মৃত্যু।” কিন্তু তমাল জানে, তার ভুল তাকে শেষ করবে না—তাকে পথে নামাবে, যেখানে আর পিছু ফেরা নেই। কারণ এখন পিশাচ তাকে চেনে।

অধ্যায় ৩: তন্ত্রচক্রের গহ্বরে

তমাল জেগে উঠল চমকে, চোখের পাতায় তখনও আগের রাতের ধোঁয়া লেগে আছে যেন। ঘাসের উপর তার শরীরটি পড়ে ছিল নিশ্চলভাবে, কিন্তু মন—তা ছিল বিশৃঙ্খলার কেন্দ্রস্থলে। সে প্রথমে বুঝতেই পারছিল না কীভাবে সে শ্মশান থেকে মাঠে এল, কে বা কী তাকে টেনে আনল, আর কেন তার পকেটের মন্ত্রফলক ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। বুকের ভেতর একটা ভারি শ্বাস, যেন কোনো অদৃশ্য কিছু এখনও চাপ দিয়ে আছে তার হৃদপিণ্ডে। সেই চোখ—সাদা অথচ জীবন্ত, তার স্বপ্ন নয়, বাস্তবের কোনো অংশ ছিল। বাড়ি ফিরে সে স্নান করে বসে পড়ল বিজনানন্দের পুরনো আলমারির সামনে, যেখানে দাদু কোনো এক সময়ে তার সমস্ত তান্ত্রিক নথি লুকিয়ে রেখেছিল। অনেক খোঁজাখুঁজির পর সে পেল একটি কাঠের বাক্স, যেটি লোহার খাঁজ দিয়ে বন্ধ করা। ভিতরে ছিল বহু পুরনো পাতার তৈরি এক চক্র, তাতে ত্রিকোণ, গোলাকার রেখা ও অনেক সাংকেতিক চিহ্ন আঁকা। ঠিক মাঝখানে লেখা—”তন্ত্রচক্র শুদ্ধ না হলে, পিশাচ পূর্ণরূপে বিকশিত হয়।”

তমালের মনে পড়ল জমিলা বুড়ির কথা—“মন্ত্র মুখস্থ নয়, অনুভবে জানতে হয়।” সে বুঝল, দাদুর ডায়েরিতে যা লেখা ছিল, তা শুধুই বহিরাবরণ, আসল শক্তি আছে এই চক্রে লুকানো। সে পুঁথি খুলে পড়তে পড়তে বুঝতে পারছিল, পিশাচ কোনো সাধারণ আত্মা নয়—সে এক চেতনার রূপ, যে নিজে জন্ম দেয় না, বরং উৎসারিত হয় মানুষের ভয়, দ্বন্দ্ব আর ক্ষমতালোভ থেকে। আর একমাত্র ‘স্বর-তন্ত্র-যোগ’ নামক এক জটিল তান্ত্রিক ধ্যানের মাধ্যমে তাকে বশ করা সম্ভব, যা বহু শতাব্দী আগে এক মহাপাণ্ডিত্য শ্মশানবাসী সিদ্ধ পুরুষ আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু সেই সাধনার জন্য চাই তিনটি জিনিস—একটি পিশাচের ছায়া সংগ্রহ, একটি মৃতের অনিচ্ছায় উৎসারিত শব্দ এবং সর্বশেষে, এক চিরজাগরিত পুরনো তান্ত্রিক বটগাছের ছায়ায় চক্রস্থ ধ্যান। তমাল জানে না সে এসবের যোগান কোথায় পাবে, কিন্তু তার মন বলছে—বিজনানন্দ এসবের প্রস্তুতি নিয়েই গিয়েছিলেন, শুধু সময় পেয়ে শেষ করতে পারেননি।

বিকেলের দিকে সে আবার দেখা করল জমিলা বুড়ির সঙ্গে। জমিলা এবার তাকে বসতে দিল সামনে, একপ্রকার গুরুগম্ভীরভাবে বলল, “তুই দরজা খুলেছিস, এবার সেই পথেই যেতে হবে, না হলে তুই শুধু মরবি না—তোকে দিয়ে সে অন্য দরজা খুঁজে পাবে।” তমাল বলল, “আমি চক্রটা পেয়েছি, কিন্তু বাকি কীভাবে সম্ভব?” জমিলা বলল, “তোর দাদু বেঁচে থাকতে একবার পিশাচকে আটকাতে চেয়েছিল, কিন্তু তার নিজেরই ভয় জয় করতে পারেনি। তাই তো সেই রাতে ভুল উচ্চারণ হল, আর তোর দাদুর আত্মা পুরোপুরি মুক্তি পায়নি।” তমাল বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল, “মানে?” জমিলা বলল, “তোর দাদুর আত্মা এখনও এই পৃথিবীতে আছে, পিশাচের কাছেই। সে তোর মধ্য দিয়ে শেষ কাজটা করতে চায়। তুই যদি সাহস পাস, আমি তোকে দেখাব কোথায় পাওয়া যাবে ‘ছায়া’, আর কোথায় রাখা হয়েছে সেই বদ্ধঘর, যেটা একদিন ছিল বিজনানন্দের গুহ্যতান্ত্রিক ধ্যানের আসন।”

রাত গভীর হতেই জমিলা তমালকে নিয়ে গেল গ্রামের উত্তর দিকের বালির টিলা পেরিয়ে এক পোড়োবাড়ির সামনে। বাড়ির দরজা ভাঙা, ভিতরে বাতাসে পচা কাঠ আর পাখার পালক গন্ধ। ভিতরের এক গোপন কুঠুরির মধ্যে জমিলা দেখাল একটি আয়না, যার উপরে পাথরের মতো ছায়া জমে আছে—জমিলা বলল, “এটাই তোর প্রথম চাবি। একবার এই ছায়া মন্ত্রপাঠে টেনে আনতে পারলে তুই প্রথম স্তর পার হবি।” তমাল চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, হাতে কাঠের মালা ঘোরাতে ঘোরাতে ধীরে ধীরে পড়তে থাকল তার মুখে জমে থাকা সেই মন্ত্র—এইবার যেন শব্দগুলো স্বতঃস্ফূর্ত, কোনো জোর নেই, কণ্ঠের গভীরতা থেকেই উচ্চারিত। চারপাশে বাতাস জমাট বাঁধল, আয়নার মধ্যে থেকে ছায়া ধীরে ধীরে উঠে এল, একরকম কেঁপে উঠল তমালের হাতের উপর—ঠান্ডা, কিন্তু জীবন্ত। পিশাচের প্রথম ছায়া এবার তার চক্রে যুক্ত হল। তমাল জানে, সামনে অপেক্ষা করছে আরও ভয়, আরও ত্যাগ, কিন্তু সে এবার পিছু হটবে না। কারণ তার ভিতরে এখন কথা বলছে শুধু ভয় নয়—দায়, রক্তের দায়, উত্তরাধিকার।

অধ্যায় ৪: মৃতের আওয়াজ

তমাল সারারাত ঘুমোতে পারেনি। সেই ছায়াটির স্পর্শ এখনও তার হাতের তালুতে যেন জমে আছে, যেন একটি অদৃশ্য বরফরেখা তার রক্তনালিতে হেঁটে বেড়াচ্ছে। আয়না থেকে উঠে আসা সেই ছায়া এখন চক্রের কেন্দ্রস্থলে ঘূর্ণায়মান এক রেখা হয়ে অবস্থান করছে, কখনও জ্বলজ্বল করছে, কখনও নিভে যাচ্ছে, ঠিক যেন নিঃশ্বাসের তালে তালে বেঁচে থাকা এক অস্তিত্ব। সকাল হতেই তমাল শুরু করল দ্বিতীয় উপাদানের খোঁজ—মৃতের অনিচ্ছায় উৎসারিত শব্দ। জমিলা বুড়ি আগেই বলেছিল, এই কাজটা সবচেয়ে কঠিন, কারণ মৃতদের মধ্যে যারা শান্তিতে যায়, তারা আর কোনো শব্দ করে না। কিন্তু যে আত্মা জোর করে টেনে নেওয়া হয়, যাকে বলি দেওয়া হয়, যাকে অভিশাপের মধ্যে দিয়ে পৃথিবী ছেড়ে যেতে হয়—তার আওয়াজ মাটির ভিতরে রয়ে যায়। সেই আওয়াজকে একবার কানে শোনা যায়, যদি কেউ সাহস করে যায় নির্জন সেই ‘উত্তর-শ্মশান’-এ, যেখানে এক সময় রাজাদের বলি দেওয়া হত অশুভ তান্ত্রিক রীতিতে। কেউ যায় না সেখানে, এমনকি পাখিরাও না। তমাল সিদ্ধান্ত নিল—সে আজ রাত্রেই সেখানে যাবে, একা, কেবল একটি লণ্ঠন, একখণ্ড কাঁচ এবং তার দাদুর ছুরি নিয়ে।

রাত নামার অনেক আগে থেকেই চারপাশে কুয়াশা জমতে শুরু করল, যেন রাত এই অঞ্চলে একটু বেশিই অন্ধকার নিয়ে আসে। তমাল গ্রামের প্রান্ত পেরিয়ে ঢুকল সেই বনের ভেতর, যার শেষ প্রান্তে উত্তর-শ্মশান। রাতের কুয়াশা তার গায়ে বৃষ্টির মতো পড়ছে, আর তার চারপাশে যেন অদৃশ্য চোখগুলি ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেখানে পৌঁছানো মাত্রই সে দেখতে পেল, শ্মশানটা আর পাঁচটা জায়গার মতো নয়। পাথরের তৈরি বিশাল বলিপীঠ এখনও আছে, আর তার ঠিক পাশে একটি ছোট পাথরের গর্ত, যার মুখে আগুনের দাগ। তমাল জানে, এখানেই কোনও এক রাতে কাউকে বলি দেওয়া হয়েছিল, এবং সে চিৎকার করতে চেয়েও পারেনি, কারণ গলায় কাটা ছিল আধা। তমাল সেই পাথরের গর্তে কান ঝুঁকিয়ে ধরল কাঁচের টুকরো, যে টুকরোয় শব্দ প্রতিফলিত হলে তা ধরে রাখা যায়। প্রথমে কিছু শোনা যাচ্ছিল না, কিন্তু কুয়াশার ভেতর থেকে হঠাৎ ভেসে এল এক কণ্ঠস্বর—“বাঁচতে চেয়েছিলাম…” এরপর নিঃশব্দ। তমালের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। কাঁচে সেই আওয়াজ রয়ে গেল, যেমনটা চাই। সে জানত, এই আওয়াজ কোনও নকল নয়, কোনও মানসিক বিভ্রম নয়—এ এক আত্মার ছেঁড়া আর্তনাদ, এক বলি হওয়া মানুষের শেষ প্রতিবাদ। এই আওয়াজ এখন চক্রে যুক্ত হবে, এবং তমালের মন্ত্র আরও এক ধাপ জোরালো হবে।

ফিরে এসে সে জমিলার কাছে গিয়ে কাঁচটা দেখাল। জমিলা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তুই যা এনেছিস, ওটা শুধু আওয়াজ না, ওটা একরকম চেতনার গন্ধ, যা বহু বছর পরে আবার ঘুম থেকে উঠবে। পিশাচ তোকে এখন টের পাচ্ছে, কারণ তুই তার পথে হাঁটছিস।” তমাল বুঝে গেল, সে এখন শিকার নয়, সে এখন সে ‘সাধক’, যাকে পিশাচ চেনে, অপেক্ষা করে, ও হয়তো ভয়ও পায়। কারণ পিশাচ জানে, এই ধরণের মন্ত্র যদি সম্পূর্ণ হয়, তাহলে তার ক্ষমতা কমে যায়, আর সে বাধ্য হয় বশীভূত হতে। কিন্তু মন্ত্র সম্পূর্ণ করতে হবে নিখুঁতভাবে, ভুল নয়, লোভ নয়, কেবল মন আর স্পর্শ দিয়ে। জমিলা তাকে বলল, “এখন তৃতীয় ধাপ—তুই ধ্যান করবি সেই চক্রের ভেতরে, বটগাছের ছায়ায়, যেটা এক সময় তোর দাদু করেছিল।” তমাল বলল, “সেই গাছটা, যেখানে সে বাস করে?” জমিলা বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু তার ছায়া যদি স্পর্শ করিস নিজের মনের শক্তিতে, তাহলে সে তোকে স্পর্শ করতে পারবে না, বরং সে বাধ্য হবে নিজেকে প্রকাশ করতে। তখনই শুরু হবে মূল ধ্যান।”

তমাল সেই রাতে প্রস্তুত হল। চক্রটি সামনে রেখে, ছায়া ও কাঁচের আওয়াজ মাঝখানে রেখে, সে বটগাছের নিচে গিয়ে বসে পড়ল। বাতাস থেমে গেল, জোনাকি গুলো যেন স্থির হয়ে গেল মাঝআকাশে, কেবল এক বিষণ্ণ নিস্তব্ধতা। তমাল চোখ বন্ধ করে, হাত জোড় করে শুরু করল ধ্যান। মন্ত্র আসছিল নিজে থেকেই, যেমনটা আগে কখনও হয়নি। “অগ্নিসূচী সংহিতা… বাণী যাত্রিক মৃতস্বর…”—এমন কিছু শব্দ যার অর্থ সে জানত না, কিন্তু হৃদয়ের ভিতর থেকে উঠে আসছিল। বটগাছের ছায়া আস্তে আস্তে তাকে ঘিরে ধরল, ঠান্ডা অথচ ভারী এক বলয় তৈরি করল। তমালের মাথার উপর যেন এক অদৃশ্য হাত রেখে কেউ বলল, “তুই শেষ কর… আমি দেখব তুই পারিস কি না…” সে হাত ছিল কার? দাদুর? নাকি পিশাচের? সে জানে না। কিন্তু সে জানে, তন্ত্রচক্র এখন পূর্ণ হতে চলেছে, আর তার সামনে অপেক্ষা করছে সেই দ্বার—যেখানে পিশাচ শুধু একটি অস্তিত্ব নয়, একটি সিদ্ধান্ত—সে হবে বশ? না হবে সর্বনাশ?

অধ্যায় ৫: অগ্নিকুণ্ডের প্রহরী

তমালের চারপাশে সময় যেন হিমবাহের মতো জমে দাঁড়িয়ে ছিল। চোখ বন্ধ করে ধ্যানস্থ হয়ে বসে থাকা অবস্থায় সে অনুভব করছিল, চক্রের প্রতিটি রেখা তার শরীরের ভেতরে প্রবেশ করছে, যেমন নদী প্রবাহিত হয় অজানা গুহায়। শব্দহীন পরিবেশে, তার হৃদস্পন্দনের তালের সঙ্গেই এক অদ্ভুত ছন্দ মিলছিল—একবার কম্পন, একবার নিস্তব্ধতা। হঠাৎ সে অনুভব করল তার চক্রের মাঝখানে থাকা ছায়াটি কেঁপে উঠছে, আর সেই কাঁচের টুকরো, যেখানে বন্দী ছিল মৃতের আওয়াজ, তা হালকা আলো ছড়াতে শুরু করেছে। মন্ত্রপাঠের মাঝখানে হঠাৎই যেন সময় থেমে গেল। তারপর হঠাৎ এক গর্জন, যেন গাছের মূল থেকে উঠে এল—ভূগর্ভ থেকে আগুনের মতো বিস্ফোরণ। তমাল চোখ খুলে দেখল—সে আর বটগাছের নিচে নেই, বরং একটি আগুনে বৃত্তের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে, আর চারপাশে ছায়াময় রূপগুলি ঘুরছে—অস্পষ্ট, দেহহীন, চোখহীন কিন্তু দৃষ্টি-ভরা। সামনে দাঁড়িয়ে এক প্রহরী, যাকে দেখে মনে হয় আগুন আর ছায়ার মিলনে গঠিত এক দৈত্যাকার অস্তিত্ব।

এই প্রহরীই ছিল পিশাচের দ্বাররক্ষক। এটি কোনো আত্মা নয়, বরং একটি জাগ্রত তান্ত্রিক চেতনা—যে চক্রের মধ্যে আগমনকারীকে যাচাই করে। তার মুখে নেই কোনও শব্দ, কিন্তু চোখ থেকে বের হচ্ছে দুইটি আলোকরেখা—একটি শান্ত, অন্যটি জ্বলন্ত। তমাল বুঝে গেল, এই চোখই সিদ্ধান্ত নেবে সে প্রস্তুত কিনা। চক্রের রুদ্রাক্ষ ফেটে পড়ল, এবং তমালের বুকের ঠিক ওপর থেকে একটি চিহ্ন জ্বলতে শুরু করল—যেটি দাদুর নথিতে দেখা এক প্রাচীন প্রতীক: ত্রিকোণাকার আগুনের উপর দাঁড়িয়ে থাকা একটি অক্ষর—“হ্রীং”। মুহূর্তেই আগুনের প্রহরী তার হাতে একটি কাঁটাওয়ালা পাথরের প্রদীপ তুলে দিল। প্রদীপে আগুন নেই, কিন্তু তার ওম গায়ে লেগেই তমাল বুঝল, এটি কোনো সাধারণ আলো নয়—এই আলোতে পিশাচ নিজের রূপ ধরে রাখে না। আর এই প্রদীপই তার শেষ অস্ত্র, যেটি নিয়ে তাকে ঢুকতে হবে ‘তলায় থাকা সে’-র সামনে, একেবারে তার চোখের সামনে। প্রহরী মাথা নাড়ল, মন্ত্র শেষ হল। সময় আবার ফিরে এল নিজের গতিতে।

তমাল এবার পুরোপুরি জানত—তন্ত্রচক্র সম্পূর্ণ হয়েছে। তার হাতে পিশাচকে দেখা, শোনা, ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যথেষ্ট উপাদান আছে, কিন্তু তার পরবর্তী কাজ এক চরম পরিক্ষা। তাকে এখন নামতে হবে শ্মশানতলার সেই অংশে, যেটা আর পাঁচজনের চোখে দৃশ্যমান নয়—তলায় থাকা স্তর, যেখানে অমাবস্যার রাতে খোলে এক ছায়ার দরজা, এবং ভিতরে থাকে ‘সে’। সেই রাতে তমাল যখন চুপচাপ প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন তার চারপাশে বাতাস হঠাৎই ভারি হয়ে উঠল। জানালার কাচে ধাক্কা মারল এক অদৃশ্য সত্তা, এবং পেছনের দেয়ালে ছায়া পড়ল—দুটি নয়ন, রক্তের মতো লাল, আর মাঝখানে এক চিৎকার—“এবার আসো… শেষ খেলাটা শুরু হোক।” তমাল জানত, সে ডাক এখন আর উপেক্ষা করা যাবে না।

জমিলা বুড়ি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, “তুই একবার ভেতরে গেলে আর ফিরবি কিনা, জানি না… কিন্তু তুই একমাত্র সন্তান যে তার দাদুর ঋণ শোধ করতে পারিস।” তমাল মাথা নোয়াল, একে অপরের দিকে শেষবারের মতো তাকাল তারা। এরপর তমাল রওনা দিল সেই শ্মশানের বটগাছের নিচে, প্রদীপ হাতে, চক্র বুক পকেটে, আর মন্ত্র হৃদয়ে। পথ চলতে চলতে চারপাশ যেন মুছে যেতে লাগল, গাছের ডালপালা গিলে ফেলল আলো, কুয়াশা চেপে ধরল বুক, আর একসময় সে পৌঁছাল সেই নির্দিষ্ট জায়গায়—যেখানে মাটি নয়, ছায়া জমে আছে স্তরে স্তরে। সে প্রদীপ জ্বালাল, আর মন্ত্র পাঠ শুরু করল। ধীরে ধীরে মাটি ফেটে খুলে গেল এক গহ্বর, নিচে নামার সিঁড়ি দেখা দিল, যেটা আলোয় নয়, বরং পিশাচের নিজস্ব অন্ধকারে তৈরি। তমাল নামতে শুরু করল—এক, দুই, তিন… তার পায়ের নিচে সিঁড়ি শেষ হচ্ছে না, আর ওপরে ছায়া জমে যাচ্ছে।

এই যাত্রা পেছনে ফেরা নয়, সামনে অজানার মুখোমুখি হওয়া। আর তমাল জানে, এইবার সে কারও চেতনা নয়—সে নিজেই এক চক্র, এক অস্ত্র, এক তান্ত্রিক উত্তরসূরি… যাকে ‘তলায় থাকা সে’ আর অবজ্ঞা করতে পারবে না। নিচে অপেক্ষা করছে মুখহীন সে, পিশাচ, যার ইতিহাস আছে রক্তে, আর ভবিষ্যৎ তমালের মুখে উচ্চারিত মন্ত্রে।

অধ্যায় ৬: ছায়ার নীচে নেমে

তমালের পা প্রতিটি ধাপে নামতে নামতে কেমন যেন ভারী হয়ে উঠছিল, ঠিক যেন সময় নিজেই তার কাঁধে চাপিয়ে দিচ্ছে শতাব্দীর অভিশাপ। নিচে নামার পথ অন্ধকারে ঘেরা, কিন্তু তার হাতে থাকা প্রদীপের অগ্নিশিখা মরে যায় না—বরং যতই সে নামছে, ততই তার আলো যেন গাঢ়, গম্ভীর আর গা ছমছমে হয়ে উঠছে। চারপাশের দেয়ালে অদ্ভুত সব চিত্র—কারো মুখ নেই, কারো চোখগুলো টানা চৌকোনা, কারো শরীর পুরোটাই কাটা এবং ছড়ানো রক্তে ঢাকা। মনে হচ্ছিল যেন এই গুহা কোনো এক সময়ে বলি দেওয়া মানুষের শ্বাসে, রক্তে, এবং ঘৃণায় তৈরি হয়েছে। অবশেষে প্রায় একশো তলার মতো নামার পর সে পৌঁছাল এক গোলাকৃতি চেম্বারে। মাটিতে আঁকা তন্ত্রচক্র জ্বলছিল নিজস্ব আলোয়, এবং তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল ‘সে’—তলায় থাকা সে—পিশাচ।

সে এক বিশাল ছায়া, দেহহীন, কিন্তু অস্তিত্ব এতটাই প্রবল যে তমালের শ্বাস আটকে আসছিল। মুখ বলতে কিছু নেই, শুধু এক দীর্ঘ ছায়ার ঢেউ, আর সেই ছায়ার মাথার কাছে দুটি গভীর গর্ত—যেখান থেকে নিরন্তর ঝরে পড়ছে কুয়াশা। শরীর ছুঁয়ে আছে না ছুঁয়েই, যেন অদৃশ্য এক তরঙ্গভঙ্গি তৈরি করছে চারপাশে। তার ভয়াবহতা এমন নয় যে সে দেখাচ্ছে কী, বরং সে যা গোপন করছে, তা। তমাল চক্রের ঠিক কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে প্রদীপটি তোলার মুহূর্তেই চারপাশে হাওয়ার ঘূর্ণি তৈরি হল। পিশাচের ছায়া হঠাৎ দানবের আকার নিল, এবং এক তীব্র শব্দে কাঁপিয়ে দিল গুহা—এক আত্মিক চিৎকার, যেটা ভাষাহীন, অথচ হৃদয়বিদারক। তমাল সেই সময় চোখ বন্ধ করে শুরু করল সেই চূড়ান্ত মন্ত্রপাঠ—যেটা তার দাদুর মৃত্যুর ঠিক আগের রাতে অসম্পূর্ণ ছিল।

“অগ্নিসূচী সংহিতা… আত্মচক্র বিকাশ… মৃতস্বর তপস্যা-রক্ষিতা…” তার প্রতিটি শব্দে চারপাশে যেন ঢেউ তৈরি হচ্ছিল। ছায়া একবার ছুটে এল তার গায়ের ওপর, ছুঁয়ে গেল, পুড়িয়ে দিল তমালের কাঁধের ডানদিক, কিন্তু তমাল মন্ত্র থামাল না। পিশাচের মুখে আগুনের রেখা জ্বলল, সে থেমে গেল, ছায়া কাঁপতে শুরু করল, এবং তার চোখের গর্তদুটো থেকে বেরিয়ে এল দুটি সাদা রেখা, সোজা তমালের কপালের দিকে। এই আলোর সঙ্গে সংযোগ মানেই আত্মার সংযোগ, এবং তমাল প্রস্তুত ছিল। সে ধ্যানস্থ অবস্থায় হাত প্রসারিত করল, এবং উচ্চারণ করল চক্রের শেষ শব্দ—”হ্রীং অগ্নিসংযোগে ত্বং বশীভূতঃ।” এক মুহূর্তের জন্য পিশাচ থমকে গেল। যেন তার সমস্ত শক্তি, শতাব্দীর খিদে, হাজার মানুষের আত্মা… হঠাৎ কোথাও আটকে গেল সেই উচ্চারণে।

এরপর যা ঘটল তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। চারপাশে ছায়া উঠে এসে সজোরে আঘাত করল চক্রের সীমানায়, কিন্তু তমালের আশেপাশে একটি অদৃশ্য বলয় তৈরি হয়ে গেল। সেই বলয় ছায়াকে ঠেলে দিল পিছনে, পিশাচের রূপ ভেঙে পড়ল, ছায়া টুকরো টুকরো হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। গুহার দেয়ালে ছায়ার ছিটে পড়ল, এবং প্রতিটি ছায়া থেকে বেরিয়ে এল এক একটি মুখ—যাদের কেউ ছিল, কেউ আর নেই। এক গর্জনের মধ্যে দিয়ে পিশাচের কেন্দ্রীয় রূপটি হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল, আর তমালের সামনে আবির্ভূত হল একটি পুরনো চেহারা—বিজনানন্দ, তার দাদু, যিনি কুয়াশার শরীরে দাঁড়িয়ে বললেন, “তুই শেষ করেছিস, যা আমি পারিনি।”

তমাল তখন অনুভব করল, তার কাঁধে পুড়ে যাওয়া সেই ক্ষত আস্তে আস্তে ঠান্ডা হচ্ছে। চক্রের আলো নিভে আসছে, কিন্তু পিশাচ নেই—সে বশীভূত, সে বন্দী তন্ত্রচক্রের গভীরে। গুহা আস্তে আস্তে হালকা হয়ে উঠছে, আর তার আশেপাশে সেই ছায়া-আত্মারা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে আলোয়। বিজনানন্দ ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে তার কপালে একটি রক্ততিলক দিলেন, এবং বললেন, “এই দায়িত্ব তুই পালন করেছিস, এখন এই পথ তোর শেষ নয়… শুরু।” তারপর দাদুর রূপ মিলিয়ে গেল, এবং চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ছায়াগুলো বাষ্প হয়ে মিলিয়ে গেল গুহার ছাদে।

তমাল প্রদীপ নিভিয়ে উপরের দিকে হাঁটা শুরু করল। পেছনে পড়ে রইল এক তন্ত্রচক্র, এক পিশাচ, আর এক পুরনো অভিশাপ—যেটা আজ শেষ হল তার মন্ত্রে, তার বিশ্বাসে, আর তার রক্তে। গুহা পেরিয়ে আবার যখন সে শ্মশানের বটগাছের নিচে ফিরে এল, তখন আকাশে সূর্য উঠেছে—অমাবস্যার অন্ধকার শেষ।

অধ্যায় ৭: বিজনানন্দের উত্তরাধিকার

তমাল যখন ফিরে এল, তখন সকালটা অন্যরকম ঠেকল তার কাছে—আলোটা যেন আরও বেশি সোনালি, বাতাসটা অনেক হালকা। শ্মশানতলার সেই বটগাছটি ছিল আগের মতোই নিশ্চুপ, অথচ তার ছায়া আর কাঁপছে না, যেন বহু বছর পরে প্রথমবার শান্তি এসেছে এই ভূমিতে। তমাল মাটির দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল—চক্রের অদৃশ্য রেখাগুলি কোথাও নেই, পিশাচের ছায়ার অস্তিত্ব মুছে গেছে। সে একবার পিছনে তাকাল—দাদুর সেই নিঃশব্দ আত্মচোখ যেন এখনও তার পিঠে স্পর্শ করে যাচ্ছে। গুহার অভ্যন্তরে যা ঘটেছে, তা হয়তো সময় বা ইতিহাস কোনোদিন লিখে রাখবে না, কিন্তু তমালের মনের ভেতরে গেঁথে থাকবে অমর চিহ্ন হিসেবে। সে জানত, এই গল্প এখানেই শেষ নয়। কারণ মন্ত্রে বশ করা যায়, ধ্বংস নয়। পিশাচ হয়তো বশীভূত হয়েছে, কিন্তু তার মূল অস্তিত্ব—ভয়, লোভ, আর নরবলির দুর্নাম—সেগুলো এখনো বেঁচে আছে সমাজে, মানুষের মনে।

তমাল বাড়ি ফিরে এল, জমিলা বুড়ি তখন বারান্দার কোণে চুপ করে বসে ছিলেন, চোখে যেন দূরের দৃষ্টি। তমালকে দেখেই তিনি বললেন, “দেখেছি… আমি দেখেছি তোকে তলায় নামতে… তুই পারছিস। কিন্তু এবার শুন, তোর কাজ এখানেই শেষ না।” তমাল চমকে বলল, “তবে?” জমিলা বলল, “বিজনানন্দের মৃত্যুর পর যেসব শক্তি ঘুমিয়ে ছিল, তারা আবার সক্রিয় হয়েছে। তোকে এখন শুধু পিশাচ নয়, অন্য চক্রগুলোর দায়িত্বও নিতে হবে। তোর দাদু শুধু পিশাচ নিয়েই কাজ করেননি। তার চক্র ছিল পাঁচভাগে বিভক্ত—ভূত, পিশাচ, ব্রহ্মরাক্ষস, প্রেত, আর সর্বশেষে ‘অচেতন দেবতা’—যাদের নাম উচ্চারণ করাও মানা।” তমাল থমকে গেল। তার হৃদয় ধকধক করতে লাগল। সে ভাবছিল, এই চক্রের একটি মাত্র অংশের মধ্যে সে এমন এক যন্ত্রণার মধ্যে গেছে, তাহলে যদি সে আরও গভীরে যায়, তবে কী ঘটবে?

জমিলা তাকে দিলেন একটি পুরনো তালা লাগানো তামার কৌটো। বললেন, “এটা তোর দাদু রেখে গিয়েছিলেন, যার তালা খুলবে শুধু একজন উত্তরসূরি, যে পিশাচ বশ করে ফিরে আসবে।” তমাল যখন সেটা খুলল, দেখতে পেল ভিতরে পাঁচটি ছোট চক্র-চিহ্ন, প্রতিটি ভিন্ন রঙে জ্বলছে। প্রতিটির গায়ে তাম্রাক্ষরে লেখা—“ভূতচক্র”, “প্রেতচক্র”, “রাক্ষসচক্র”, “দেবচক্র”, “নির্বাণচক্র”। তার নিচে লেখা—“যদি একজন সত্যিকারের সাধক নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে, তবে সে এই পাঁচ চক্র একত্রিত করে ‘তন্ত্রলোক’ রচনা করতে পারে। আর যদি না পারে, তবে সে নিজেই হয়ে উঠবে ছায়ার অংশ।” তমাল কৌটো বন্ধ করে চোখ বন্ধ করল। তার মন বলছিল—এই পাঁচ চক্রই হয়তো আসল উত্তরাধিকার, এবং বিজনানন্দ কেবল শুরুটা করেছিলেন।

তারপরের কয়েকদিন তমাল এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা অনুভব করতে লাগল। রাতে কেউ যেন তার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, যেন বাতাসে কারো নিঃশ্বাস মিশে থাকে। কিন্তু তমাল এখন ভয় পায় না। কারণ সে জানে, সে জিতেছে, মন্ত্র তাকে রক্ষা করবে, আর চক্র তাকে পথ দেখাবে। তবে একইসঙ্গে, সে বুঝে গেছে—এই পথ ব্যক্তিগত নয়, বরং উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এক সংগ্রাম। এক সন্ধ্যায় সে উঠোনে বসে বসে দাদুর পুরোনো ডায়েরিগুলি পড়ছিল, সেখানে হঠাৎ একটা পাতায় চোখ আটকে গেল। পাতায় লেখা—“যদি কোনোদিন কেউ পিশাচ বশ করে ফেলে, তবে সে যেন শ্মশানের বটগাছের নিচে রেখে যায় এক ছিন্ন তাম্রপট্ট, যার মধ্যে ঘুমিয়ে থাকবে পরবর্তী চক্রের সংকেত।” তমাল সিদ্ধান্ত নিল, সে আবার যাবে সেই গাছের নিচে, এবং রাখবে সেই তাম্রপট্ট, যাতে ভবিষ্যৎ কেউ যদি পথ চায়, সে পায় এক সংকেত।

সেই রাতে, পূর্ণিমার আলোয়, তমাল গেল শ্মশানের সেই নির্জন পথে। তার হাতে কৌটো, পকেটে রুদ্রাক্ষ, বুক পকেটে বিজনানন্দের মন্ত্র। গিয়ে সে বটগাছের নিচে তাম্রপট্টটি মাটির নিচে পুঁতে রাখল। তারপরে শেষবারের মতো চক্রের মাঝখানে বসে পড়ল, একবারও মন্ত্র না পড়ে—শুধু নিঃশব্দে ধ্যান করল। বাতাস থেমে গেল, গাছের পাতাগুলো নড়ল না, এবং দূরে কুকুরের ডাকও থেমে গেল। প্রকৃতি যেন স্বীকৃতি দিল—তমাল এখন তান্ত্রিক নয়, তন্ত্র-রক্ষক। যারা আগুনে পুড়েছে, ছায়ায় হারিয়েছে, এবং অন্ধকারে নিজেকে বিসর্জন দিয়েছে, তাদের মধ্যে এক নতুন সাধক যোগ দিল—তমাল, বিজনানন্দের উত্তরসূরি।

অধ্যায় ৮: প্রেতচক্রের পদসঞ্চার

বটগাছের নিচে সেই রাতে যখন তমাল বসে ছিল নিঃশব্দ ধ্যানে, তখন মনে হচ্ছিল সময় এক অদৃশ্য রেখায় আটকে গেছে। চারপাশে নিস্তব্ধতা এমন এক মাত্রায় পৌঁছেছিল, যেখানে নিজের হৃদস্পন্দনের শব্দটাও যেন বহিরাগত। সে অনুভব করল তার শরীরের ভেতর দিয়ে কিছু প্রবাহিত হচ্ছে—না রক্ত, না শ্বাস, বরং এক অদ্ভুত ধরণের স্পন্দন, যেন মাটি নিচে থাকা অদৃশ্য কোনো সত্তার সঙ্গে সে সরাসরি যুক্ত হয়ে গেছে। হঠাৎই সে অনুভব করল তার ডান হাতের তালু গরম হয়ে উঠেছে। চোখ খুলে দেখল—তাম্রকৌটোর ভেতরের একটি চক্র, ‘প্রেতচক্র’, হালকা রক্তাভ আলো ছড়াচ্ছে। বাতাসে একটি পুরনো সুগন্ধ—চন্দন, ধূপ আর গন্ধরাজ ফুলের গন্ধ ভেসে উঠল, আর সেইসঙ্গে এক শীতল হাওয়া, যেটা কেবল মৃত আত্মার আশেপাশেই অনুভব করা যায়।

তমাল বুঝতে পারল, প্রেতচক্র নিজে থেকেই সক্রিয় হয়েছে—তার মানে, কোথাও কোনো ‘অপূর্ণ’ আত্মা তাকে ডেকেছে। ডায়েরি থেকে জানা ছিল, প্রেত আত্মা সাধারণত সেইরকম ব্যক্তি, যাদের মৃত্যু অসময়ে হয়েছে, অথবা যারা মৃত্যুর সময় কোনো অমীমাংসিত আকাঙ্ক্ষা নিয়ে গেছেন—প্রেম, প্রতিশোধ, রাগ অথবা আফসোস। এমন এক আত্মা, যা পিশাচের মতো হিংস্র নয়, কিন্তু স্থির নয় বলেই সর্বদা ‘চঞ্চল’, এবং সেই চঞ্চলতা অন্য জীবিতদের উপর প্রভাব ফেলে। প্রেতকে মুক্তি দেওয়ার চক্র অত্যন্ত জটিল—তাকে তার মৃত্যুর সময়কার অনুভব ফেরত দিতে হয়। তমাল জানে না এই চক্রকে কোথায় খুঁজে পাবে, কিন্তু অনুভব করছে যে কেউ বা কিছু নিজেই তাকে খুঁজছে। হঠাৎ তার ঘরের জানালায় একবারে আস্তে টোকা পড়ল—‘টক্ টক্’। সে বাইরে গেল, সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল এক বালক, চোখে হাওয়া পাথরের মতো স্থিরতা, গায়ে ধুলো মাখা পুরোনো স্কুলের জামা।

তমাল জিজ্ঞেস করল, “তুমি কে?” ছেলেটা হাসল, বলল, “আমার নাম অনির্বাণ। আমি এখানে পড়তাম… একটা দুর্ঘটনায় মরে গেছি… কিন্তু মা এখনও প্রতিদিন খোঁজে আমাকে।” তমাল স্তব্ধ হয়ে গেল। সে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি মুক্তি চাও?” অনির্বাণ বলল, “না… আমি শুধু চাই আমার মা যেন একবার আমার কথা শুনে… বুঝতে পারে আমি কোথায় আছি… তাহলেই আমি চলে যাব।” এরপর অনির্বাণ অদৃশ্য হয়ে গেল বাতাসের মতো। তমাল বুঝে গেল—প্রেতচক্র শুরু হয়েছে। এই চক্রে তাকে শুধু আত্মার সঙ্গে নয়, জীবিতের সঙ্গেও যুক্ত হতে হবে। সেই মা, যিনি প্রতিদিন আশায় বসে থাকেন, আর সেই প্রেত আত্মা, যাকে প্রতিদিন দৃষ্টি দিয়েও অদৃশ্য ভাবা হয়।

তমাল সেই রাতেই বেরিয়ে পড়ল অনির্বাণের বাড়ির খোঁজে, যা ছিল গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে এক পরিত্যক্ত কুঁড়েঘরে। সেখানে গিয়ে সে দেখল এক বৃদ্ধা, চোখে কোনও আলো নেই, শুধু পাটকাঠির আগুনের পাশে বসে কাঁপছেন। বৃদ্ধা তমালকে দেখে বললেন, “তুই কি নতুন ওঝা?” তমাল মাথা নাড়ল, বলল, “আমি শুধু আপনাকে আপনার ছেলের কথা শোনাতে এসেছি।” এরপর সে তার সঙ্গে বসে পড়ল, এবং ধীরে ধীরে মন্ত্রপাঠ শুরু করল—এই মন্ত্র পিশাচের জন্য নয়, প্রেতের জন্য, যার শব্দ স্নিগ্ধ, করুণ আর মুক্তির। ঠিক সেই মুহূর্তে বাতাসে অনির্বাণের কণ্ঠস্বর ভেসে এল—“মা, আমি ভালো আছি। তুমি আর কান্না করো না। আমার বন্ধুরা আছে এখন। আমি খেলি, ঘুমাই… এখন তোমার ঘুমনোর পালা।” বৃদ্ধা হঠাৎ চুপ করে গেলেন, এবং তার চোখে জলের পরিবর্তে এক শান্তির রেখা ফুটে উঠল।

সেই মুহূর্তেই প্রেতচক্রের আলো নিভে গেল, এবং তমাল জানল—প্রথম আত্মা মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু সে আরও জানে, এমন আরও অনেক অনির্বাণ, আরও অনেক মা আছে যারা এখনো আঁধারে বসে থাকে, অপেক্ষা করে। তমাল ফিরল তার কক্ষে, এবং কৌটো খুলে দেখল, দ্বিতীয় চক্র ‘প্রেতচক্র’ নিঃশব্দে স্থির হয়ে গেছে, কিন্তু তৃতীয় চক্র ‘রাক্ষসচক্র’ একটু একটু করে গরম হতে শুরু করেছে।

তমাল জানে, এইবারের পথ হবে ভিন্ন—এবার প্রার্থনা নয়, এবার লড়াই, কারণ রাক্ষসরা প্রেত নয়… তারা আত্মা নয়… তারা ছিল মানুষ, যারা নিজের ইচ্ছায় দানব হয়ে উঠেছিল। এবং তমাল প্রস্তুত, কারণ সে এখন শুধুই একজন উত্তরসূরি নয়—সে তন্ত্রচক্রের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে থাকা এক জীবন্ত দীক্ষিত।

অধ্যায় ৯: রাক্ষসচক্রের জাগরণ

তমাল সেই রাতের পর আর নিজেকে আগের মতো ভাবতে পারেনি। পিশাচ বশীকরণ, প্রেত আত্মার মুক্তি—সব মিলিয়ে তার হৃদয়, মন আর শরীর যেন তন্ত্রের গভীর স্তরে গেঁথে গেছে। চক্রের তিনটি খণ্ড এখন নিস্তব্ধ, কিন্তু তৃতীয়টি—‘রাক্ষসচক্র’—সে ছিল আলাদা। তার তাপ ছিল আগুনের মতো, অস্থির, দহনশীল। তমাল যখন কৌটো খুলে দেখল, এই চক্রের উপর জ্বলছিল গাঢ় লাল আলোকরেখা, এবং তার চারপাশে ছড়ানো ছায়া যেন ফুঁসছিল। সে জানত, রাক্ষস আত্মা নয়—রাক্ষস হল সেই মানুষ, যারা জন্ম নয়, কর্মে দানব হয়ে ওঠে। তাদের মৃত্যুতে শেষ হয় না পথ, বরং তারা এমন এক অস্তিত্বে রূপ নেয় যারা নিজের ইচ্ছায় পিশাচ, প্রেত, ভূত—সব কিছুর সীমা ছাড়িয়ে যায়। এদের বশ করা মানে শুধুই তন্ত্র নয়, নৈতিক শক্তিরও পরীক্ষা। বিজনানন্দের ডায়েরিতে লেখা ছিল—“রাক্ষস চক্রে নামা মানেই নিজেকেই একবার ঝাঁপ দিতে হয় অন্ধকারে, আর নিজেরই মুখোমুখি হতে হয়।”

তমাল সেই রাতে গেল পুরনো কালীমন্দিরের ধ্বংসস্তূপে, যেটা বছর দশেক আগে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। কথিত ছিল, সেখানে এক প্রাক্তন পুরোহিত এক নিষিদ্ধ তান্ত্রিক রীতি চালাত, যেখানে বলি হত পশু নয়, মানুষ। তার নাম কেউ মুখে আনে না, কিন্তু বিজনানন্দ সেই নাম লিখে রেখেছিলেন—“ত্রৈলোক্যনাথ”—এক সাধু, যে নিজের শরীরকেই অমরত্বের গবেষণাগার বানাতে চেয়েছিল। মন্দিরের ধ্বংসাবশেষে গিয়ে তমাল অনুভব করল, চারপাশে বাতাস থেমে গেছে। পাথরের উপর ছড়ানো ছাই যেন হঠাৎ নড়ে উঠল তার পায়ের শব্দে। হঠাৎই এক বিকট গর্জন—আকাশ থেকে নয়, মাটির নিচ থেকে এল। আগুন জ্বলে উঠল একটি ভাঙা শিবলিঙ্গের চারপাশে, এবং আগুনের শিখার ভিতরে ভেসে উঠল এক মুখ—ত্রৈলোক্যনাথ। চোখ ছিল নীলাভ, ঠোঁটের কোণে পুড়ে যাওয়া চামড়া, এবং গলার ঠিক মাঝখানে আঁকা ছিল তিনটি ত্রিকোণ—‘তিন স্তরের শক্তি’—শরীর, চেতনা ও ছায়া।

তমাল মন্ত্রপাঠ শুরু করল, কিন্তু এইবার শব্দ যত উচ্চারিত হচ্ছিল, গর্জন ততই বাড়ছিল। হঠাৎ আগুন থেকে ছুটে এল ত্রৈলোক্যনাথের এক ছায়া, যেটি তমালের দিকে তীব্র গতিতে ধেয়ে এল, ধাক্কা দিল তার বুকের মধ্যে। মুহূর্তেই সে পড়ে গেল পাথরের উপর, শ্বাস নিতে পারছিল না। তমাল চোখ খুলে দেখল, তার চারপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে অনেক মুখ—যারা একদিন বলি হয়েছিল, একেকটি শিশু, কিশোরী, বৃদ্ধ, পুরোহিত। তাদের চোখে কোনও অভিশাপ নেই, বরং একটা গভীর নীরবতা। তারা যেন চায়—“তুমি আমাদের হয়ে প্রতিশোধ নাও।” তমাল উঠে দাঁড়াল। শরীরে ব্যথা, তবুও সে আবার মন্ত্র পড়া শুরু করল, এবার কোনও তামার চক্র নয়, রক্ত দিয়ে বৃত্ত আঁকল মাটিতে। সে জানত, রাক্ষসকে হারাতে হলে কেবল তন্ত্র নয়, হৃদয়ও দিতে হয়।

মন্ত্র পূর্ণ হতে না হতেই আগুন ছুটে এল চক্রের কেন্দ্রে। ছায়ার শরীর ছিন্ন হতে লাগল, আর ত্রৈলোক্যনাথের কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল—“আমি অমর… আমি মৃত্যুর ঊর্ধ্বে…” তমাল এবার ঠোঁট কামড়ে রক্ত ঝরিয়ে বলল—“অমর সে, যে নিজেকে বিসর্জন দিতে জানে। তুই শুধু দানব, যার মৃত্যু একমাত্র বাঁচা।” এরপর সে মন্ত্রের শেষ পঙক্তি উচ্চারণ করল—”রক্তং শক্তি, শব্দং বাণী, ছায়াং বিদ্বেষহারা।” মুহূর্তেই আগুন নিভে গেল। ত্রৈলোক্যনাথের রূপ ছিন্নভিন্ন হয়ে আকাশে মিলিয়ে গেল। ছায়া, আগুন, আর কান্নার শব্দ হারিয়ে গেল বাতাসে। কৌটোতে ফিরে এসে তমাল দেখল—‘রাক্ষসচক্র’ নিভে গেছে।

তিনটি চক্র—পিশাচ, প্রেত, রাক্ষস—এখন নিঃশব্দ, নিষ্ক্রিয়। কিন্তু কৌটোতে এখন কেবল দুটি চিহ্ন রয়ে গেছে—‘দেবচক্র’ ও ‘নির্বাণচক্র’। তমাল জানে, এই চক্রগুলি আর পাঁচটা নয়। একটিতে দেবতাদের শক্তি, যারা অনন্ত কালের জন্য নিদ্রিত, আর অপরটিতে সেই চূড়ান্ত চক্র—নির্বাণ—যেখানে সবকিছু সমাপ্ত হয়, অথবা সবকিছু আবার শুরু হয়।

তমাল ফিরে এল, শরীর জর্জরিত, মন নিঃশেষ, কিন্তু একটি নতুন দায়বদ্ধতায় আবদ্ধ। কারণ পরবর্তী চক্রগুলি শুধুই আত্মার পরীক্ষা নয়, এই বাস্তব জগতের মুখোমুখি হওয়া—যেখানে মানুষ, দেবতা ও তন্ত্র এক সরলরেখায় মিশে যায়। আর সেই রেখার কেন্দ্রে এখন একাই দাঁড়িয়ে আছে—তমাল, বিজনানন্দের উত্তরাধিকার, যাকে অন্ধকার গ্রহণ করেছে, আলো এখনো বিচার করেনি।

অধ্যায় ১০: নির্বাণচক্রে শেষ অগ্নিসাক্ষ্য

তমালের জীবন যেন এই শেষ চক্রের দিকে ধাবমান ছিল শুরু থেকেই। পিশাচ, প্রেত, রাক্ষস—তাদের সঙ্গেই যেমন সংঘর্ষ হয়েছে, তেমনই অন্তরে ছিল এক অনির্বচনীয় টান, যেটা তাকে এই পাঁচ চক্রের কেন্দ্রের দিকে টেনে নিয়ে আসছিল। এখন বাকি দুটি চিহ্ন—‘দেবচক্র’ ও ‘নির্বাণচক্র’—কৌটোর ভিতর নিঃশব্দভাবে আলোড়িত হচ্ছিল। কিন্তু তমাল জানত, এই দুই চক্রের পথ বাকি তিনটির চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। দেবচক্র মানে অতল, যেখানে অধিষ্ঠিত আছেন ঘুমন্ত শক্তিরা, যাদের ডেকে তোলা মানেই জাগ্রত করা এক আদি-বিস্মৃত আগুন। আর নির্বাণচক্র—তা শুধু পথের শেষ নয়, বরং সমস্ত তন্ত্রের কেন্দ্রীয় সংযোগবিন্দু। সেখানে যেতে হয় আত্মাকে একেবারে ত্যাগ করে, মৃত্যুর সীমা অতিক্রম করে।

তাঁর প্রস্তুতি শুরু হয় ভোর থেকেই। ডায়েরির শেষ পাতাগুলিতে বিজনানন্দ লিখেছিলেন—“যে দেবচক্রে প্রবেশ করবে, তাকে আত্মা ও অহং ছেড়ে সম্পূর্ণ রূপে একাগ্র হতে হবে। সেখানে কেবল এক বার্তা থাকবে—তুমি কে? যদি উত্তর দিতে না পারো, তুমি ফিরে আসবে না।” তমাল জানে, একটিও ভুল করলে সে আর ফিরে আসবে না এই জগতে। তাই সে ঠিক করল, দেবচক্র নয়—সে সরাসরি যাবে নির্বাণচক্রে। কারণ পিশাচকে বশ করে যে শুরু করেছিল, সে নিজেকে তন্ত্রচক্রে সম্পূর্ণরূপে বিসর্জন না দিলে তার যাত্রা সম্পূর্ণ হবে না।

রাত্রি তখন নিঃশব্দ। আকাশে পূর্ণিমা নেই, অমাবস্যাও নয়—এক মধ্যবর্তী ক্ষণ, যাকে বলা হয় ‘চতুর্দশী ক্ষণ’। এই সময়ে নাকি চক্র নিজেই খুলে যায়, যদি কেউ প্রস্তুত থাকে আত্মত্যাগের জন্য। তমাল পৌঁছাল সেই পুরনো শ্মশানে, যে মাটির নিচে ঘুমিয়ে আছে শতাব্দীর চেতনা। সেখানে একটি ছোট প্রস্তর খচিত মণ্ডপ, যার ঠিক মাঝখানে আঁকা ছিল এক ত্রিভুজের ভেতরে গোলাকার চিহ্ন—নির্বাণচক্র। সেই বৃত্তের মাঝে বসে, রক্ত দিয়ে আঁকা চিহ্নের উপর হাত রাখল সে। ধীরে ধীরে তার শ্বাস ধীর হল, চোখ বুজল, আর উচ্চারণ করল সেই সর্বশেষ মন্ত্র, যা লেখা ছিল কেবল বিজনানন্দের শেষ পাতায়—
“মা চেতনা, স্তব্ধ হউক শব্দ, নিঃশব্দে মিলুক রূপ, তন্ত্রে বিলীন হউক আমি।”

চোখ খুলতেই সে দেখল—সে আর এই জগতে নেই। সে এক আলো ও ছায়ার মাঝে ভাসছে, এক অপার্থিব স্পন্দনে। সেখানে নেই কোনও শব্দ, নেই শরীর—শুধু অনুভব, আর এক প্রশ্ন, যেটা প্রতিধ্বনির মতো ফিরে ফিরে আসছে—“তুমি কে?”
তমাল ভাবল—সে তান্ত্রিক? সাধক? বিজনানন্দের দৌহিত্র? কিন্তু না—এই চক্রে সে এসব কিছুই নয়। হঠাৎ মনে পড়ল প্রথমবার শ্মশানে যাত্রার দিন, সেই নির্জনতা, সেই ভয়, সেই নির্ভরতা দাদুর মন্ত্রে। তারপর প্রেতের কান্না, রাক্ষসের অগ্নিগর্জন, অনির্বাণের মায়ের শ্বাস। তমাল নিজেকে বলল—“আমি সেই, যে প্রশ্ন করে, উত্তর চায় না। আমি সেই, যে আলোয় ঢুকেও ছায়া ছাড়ে না। আমি শুধু একজন রক্ষক।”

এই উত্তরেই চারপাশে আলোর বিস্ফোরণ ঘটল। গহ্বর থেকে উঠে এল এক শুদ্ধ আগুন, আর সেই আগুনে মিলিয়ে গেল তমালের সমস্ত অস্তিত্ব—তার শরীর, স্মৃতি, নাম, পরিচয়। শুধুই রয়ে গেল এক কম্পন—এক অদৃশ্য, অলৌকিক, এবং নীরব সত্তা—যেটা শ্মশানতলার বাতাসে থেকে যায়।

পরদিন ভোরবেলা, জমিলা বুড়ি একা হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে পৌঁছাল সেই বটগাছের নিচে। দেখল, সেখানে নেই তমাল, নেই তার ছায়া, নেই কৌটো—কেবল একটি ছোট পাথরের তলায় খোদাই করে লেখা—
“পথের শেষে কেউ থাকে না। শুধু পথ থাকে। সেই পথেই আমি আছি।”

তারপর থেকে প্রতি চতুর্দশীর রাতে, সেই শ্মশানে কেউ কেউ একটি মৃদু শ্বাস ফেলার শব্দ শোনে, অথবা বাতাসে হালকা রুদ্রাক্ষের গন্ধ পায়। কেউ কেউ বলে, শ্মশানতলার পিশাচ আর কখনো দেখা যায় না—কারণ সে এখন আর নেই। কেউ একজন তাকে নিজের মধ্যে বশ করে রেখেছে। আর সেই কেউ একজন, হয়তো, তমাল নয়—একটা চেতনা, যে রয়ে গেছে… শুধু পথ রক্ষার জন্য।

বছর কেটে গেছে। কুয়াশা ঢেকে রেখেছে সেই শ্মশানতলার পথ, আর তার বুকের নিচে ঘুমিয়ে আছে এক গল্প—যেটা কেউ শোনে না, কেউ বলে না, শুধু অনুভব করে। তমাল এখন আর মানুষের জগতে নেই, তার নাম কোনও পুরাণে লেখা হয়নি, কোনও তন্ত্রগ্রন্থেও না। কিন্তু যেসব আত্মা অভিশপ্ত, যাদের চেতনায় অস্থিরতা, কিংবা যারা অন্ধকারের দিকে হেঁটে যেতে গিয়ে থেমে যায়—তারা জানে, কোথাও কেউ আছে, যে একদিন সমস্ত চক্র পার করে আত্মা থেকে ছায়া, ছায়া থেকে শুদ্ধি, আর শুদ্ধি থেকে নির্বাণে পৌঁছে গিয়েছিল।

জমিলা বুড়ি আজও মাঝে মাঝে মন্ত্র জপেন, আগুনে ধূপ দেন, কিন্তু এখন তার মুখে আর আতঙ্ক নেই—আছে প্রশান্তি। তার মনে হয়, কেউ যেন ছায়ার ভেতর দিয়ে তাঁর পাশে বসে থাকে, ঠিক দাদুর মতো, তমালের মতো, সময়ের মতো। গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েরা শ্মশানতলার গল্প শুনে ভয় পায় না, বরং ভাবে, সেখানে কেউ একজন পাহারা দেয়, কেউ একজন আলো জ্বালিয়ে রাখে যাতে পথ হারিয়ে না যায় কেউ।

বিজনানন্দের পুরনো ডায়েরি আজ আর কেবল কাগজে আবদ্ধ নয়, সেটা এখন চেতনার এক বিস্তৃত মানচিত্র—যেখানে পিশাচ নেই, প্রেত নেই, রাক্ষস নেই—আছে শুধু তন্ত্রের সেই নিরব শক্তি, যা যুগ যুগ ধরে উত্তরাধিকারীদের বেছে নেয়, গড়ে তোলে, এবং তাদের মধ্য দিয়ে নিজেকে অমর করে তোলে।

তমালের গল্প শেষ হয়নি। সে এখন কোনও ব্যক্তি নয়—সে এক তন্ত্রচক্র, সে এক অনুভূতি, সে এক শিখা, যা অমাবস্যার রাতেও মরে না। আর যতদিন কেউ কৌতূহল নিয়ে তন্ত্রচক্রের দিকে তাকাবে, যতদিন কেউ আত্মার উত্তর খুঁজতে চাইবে, ততদিন ‘নির্বাণচক্র’-এর প্রহরী তমাল থেকে যাবে… ছায়ার বাইরে, আলোর ভেতরে।

সমাপ্ত

1000032079.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *