এক
মাঘ মাসের শেষে মুর্শিদাবাদ শহরের ভেজা শীত এখনও হাড়ে হাড়ে কাঁপায়। গঙ্গার পাড় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা রাজবাড়ির ছায়ায়, ড. সায়ন্তনী মুখোপাধ্যায় একটি পুরাতন প্রত্নতাত্ত্বিক ফাইল হাতে নিয়ে চুপ করে বসেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি অনুদানের ভিত্তিতে তিনি এসেছেন মুর্শিদাবাদের হারিয়ে যাওয়া ফোক-কালচার আর মুঘল-পরবর্তী ইসলামি নির্মাণকলা নিয়ে গবেষণার জন্য। কিন্তু আসল আগ্রহ তাঁর ছিল এক রহস্যময় বস্তু নিয়ে—যার নাম কেবলমাত্র একটি ডকুমেন্টে পাওয়া গিয়েছিল: “শ্বেতপাথরের বালিশ।” নথিতে লেখা ছিল, এটি এক সময় একটি প্রাচীন মসজিদের গোপন কামরায় রাখা হত এবং বলা হত যেই এই বালিশে একবার মাথা রাখে, সে মৃতদের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে—তাদের যন্ত্রণার স্মৃতি, তাঁদের না-বলা ইতিহাস যেন বালিশের ভিতর চিরকাল জমে আছে। অন্য কেউ হয়তো এই লেখাকে গালগল্প বলে উড়িয়ে দিত, কিন্তু সায়ন্তনীর গবেষণার অভিমুখই এমন কিংবদন্তিকে বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড় করানো। লোককথা, ফোকলোর, উপকথা—এই তিনের সংমিশ্রণে তিনি সত্যকে খুঁজে বের করতেন।
স্থানীয় মসজিদগুলোর রেকর্ড ঘেঁটে তিনি জানতে পারেন, শহরের প্রান্তে গাছপালা ঘেরা একটা পরিত্যক্ত মসজিদ আছে—‘মসজিদে ফিরোজা’। নামটা আজ আর কারও মুখে শোনা যায় না, অথচ একসময় নবাব কাশিম আলীর আমলে সেই মসজিদে নাকি রাতের বেলায় রীতিমতো লোক জমত। মুর্শিদাবাদের ইতিহাসবিদদের অনেকেই একে কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিয়েছেন, কিন্তু সায়ন্তনী এর গভীরে প্রবেশ করতে চাইলেন। স্থানীয় পরিচিত গাইড রফিক শেখ তাঁকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতেই যেন কিছুটা ঘাবড়ে যায়। “আপনি ওই জায়গায় যাবেন ম্যাডাম? ওটা তো কেউ যায় না আজকাল,”—রফিক বলেছিল, চোখ নামিয়ে। সায়ন্তনী থেমে থাকেননি। পরদিন সকালে, দুজন মিলে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছালেন সেই গাছপালা-জঙ্গলে ঢাকা স্থানে। দূর থেকে দেখতে পাওয়া গেল ধ্বংসপ্রাপ্ত এক মিনার, যার চূড়ায় এখনও কিছু অংশ রূপালি রঙের ইটের মতো ঝলমল করছিল রোদে। চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু কাকের ডাক আর শুকনো পাতার মচমচ শব্দ। ভেতরে ঢুকতেই ধুলো, বাদুড়ের গন্ধ, আর এক অদ্ভুত ঠান্ডা ঘরের ভিতর প্রবেশের অনুভূতি তাঁকে গ্রাস করে। একটা কোণ ঘেঁষে বসে ছিলেন এক বৃদ্ধ—চোখে সাদা ছানি, কাঁপা গলায় বললেন, “আপনি এখানে গবেষণা করতে এসেছেন? তবে সাবধানে থাকবেন মা।” তিনি ছিলেন মাওলানা সিদ্দিক হাসান, এই মসজিদের শেষ জীবিত খাদিম। তাঁর হাতের ছুঁয়ে সায়ন্তনী যেন শীতল একটা কম্পন অনুভব করেন।
সেদিন বিকেলের আলো মসজিদের দেয়ালে এক লম্বা ছায়া ফেলে রেখেছিল। সায়ন্তনী ধীরে ধীরে ঘুরে দেখছিলেন প্রতিটি কক্ষ, প্রতিটি খাঁজ। হঠাৎ মেঝেতে চোখ পড়ে এক প্রাচীন পাথরের স্তম্ভে, যেখানে ছোট করে আরবিতে কিছু খোদাই করা। পাশেই একটা ছোট কক্ষের দরজা বন্ধ—দরজার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় এক ধুলোয় ঢাকা বস্তু, ঠিক যেন একটা বালিশের আকার। রফিক এক পা পিছিয়ে এসে বলল, “এই ঘরেই নাকি সেই বালিশটা আছে ম্যাডাম, যেটা আপনি খুঁজছিলেন। কেউ এ ঘরে ঢোকে না। বলে, কেউ মাথা রাখলে সে আর স্বাভাবিক থাকে না।” সায়ন্তনী তবু এগিয়ে যান। দরজা ঠেলে তিনি ঘরের ভেতরে ঢোকেন। ঘরে ঢুকতেই ঠান্ডা হাওয়া যেন গায়ে জড়িয়ে ধরে। সামনে সেই বালিশ—ধূসর পাথরের, কিন্তু তার ওপর সূক্ষ্ম সাদা রেশমের মতো জমে থাকা ধুলো, আর তাতে যেন এখনো কারও মাথার ছাপ রয়ে গেছে। তিনি হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করতেই যেন একটা অদৃশ্য কম্পন শরীরের ভিতর দিয়ে সরে গেল। বালিশটার গায়ে লেখা আছে “মাকতাল”—যার মানে মৃত্যুস্থান। সায়ন্তনীর বুক ধড়ফড় করতে থাকে, কিন্তু হাত সরান না। তাঁর চোখ দুটো বুজে আসে এক মুহূর্তে—ঘরের নিস্তব্ধতায় মিশে যায় এক অদৃশ্য শ্বাসপ্রশ্বাস। আর ঠিক তখনই তিনি দেখতে পান, চোখ বুঁজতেই এক মুখ ভেসে ওঠে—চোখে ভয়, ঠোঁটে কষ্টের কান্না, চারপাশে আগুন। তিনি আর জ্ঞান রাখতে পারেন না, অজ্ঞান হয়ে পড়েন ঘরের মেঝেতে। বাইরে সূর্য অস্ত যাচ্ছে, আর পাথরের বালিশ যেন শান্ত মুখে সব স্মৃতি চেপে রাখছে—পরবর্তী অধ্যায়ের জন্য অপেক্ষায়।
দুই
রাতের অন্ধকার যখন ধীরে ধীরে মুর্শিদাবাদের আকাশকে আচ্ছন্ন করে ফেলছিল, তখন রফিক শেখ মসজিদের ছোট কাঠের বারান্দায় হাঁটছিল বারবার। ভিতরের ঘরে পড়ে থাকা সায়ন্তনীকে বাইরে টেনে আনতে তার বুকের মধ্যে ধুকপুক ধ্বনি উঠেছিল, কিন্তু সেই বালিশের কাছ থেকে সে কখনো বেশি কাছে যায়নি। অগত্যা সে মাওলানা সিদ্দিক হাসানকে ডেকে আনে। অন্ধ চোখে মাওলানা ভিতরে ঢুকে খুব ধীরে সায়ন্তনীর কপালে হাত রাখেন, কুরআনের আয়াত ফিসফিস করে পড়তে থাকেন, যেন ঘরের ঠান্ডা হাওয়ার মধ্যে থেকে কোনও অতৃপ্ত আত্মা ছিন্ন করার চেষ্টা করছেন। কিছুক্ষণ পর সায়ন্তনী জ্ঞান ফিরে পান। চোখ খুলে প্রথমেই বলেন, “আমি এক নারীকে দেখলাম… আগুনে… চিৎকার করছে।” তাঁর কণ্ঠস্বর কাঁপছিল। রফিক চুপচাপ তাঁকে জল এনে দিলেও ভেতরে তার চোখে ভয় জমে আছে। মাওলানা সিদ্দিক ধীরে ধীরে বললেন, “আপনি যা দেখলেন, তা স্বপ্ন নয় মা। ওই পাথরের বালিশে অনেক স্মৃতি আটকে আছে। সব শুনতে পারবেন না, বুঝতে পারবেন না… কিন্তু তারাও চায় তাদের কথা কেউ জানুক।” কথাগুলো শোনার পরও সায়ন্তনীর মনে কোনও ভয় নেই—বরং ছিল প্রবল কৌতূহল, যে ইতিহাস শুধু বইয়ে নেই, তার প্রকৃত রূপটা জানার পিপাসা।
পরদিন সকালে তিনি পুনরায় সেই ঘরে প্রবেশ করেন, সঙ্গে রফিক এবং মাওলানা। এবার তিনি ঘরের প্রতিটি দেওয়ালে খোদাই লক্ষ্য করেন—আরবি, ফারসি আর কিছু বাঙলা ভাষায় ছাপা নাম, তারিখ, দু’একটি বাক্য, যেমন—”সে এসেছিল সন্ধ্যায়, আর ফিরে যায়নি”, “আগুনে চোখ দেখেছিলাম, আগুনেই নীরবতা”, ইত্যাদি। ঘরের এক কোণে ছিল একটি ছোট কাঠের বাক্স, তাতে ধূলোমলিন একটি রেকর্ড বই। মাওলানার অনুমতি নিয়ে তিনি বইটি খোলেন। ভেতরে লেখা কয়েকটি নাম—নুরজাহান বিবি, ফাতেমা খাতুন, হুরুন নিশা। প্রতিটির পাশে লেখা মৃত্যু তারিখ এবং একটি চিহ্ন, যেন পাথরের আকৃতির ছাপ। একেকটি নাম মানে একেকটি জীবনের যন্ত্রণার ইতিহাস। সায়ন্তনী বুঝতে পারছিলেন, এই মসজিদ কেবল প্রার্থনার স্থান ছিল না—এ ছিল এক নিঃশব্দ কারাগার, যেখানে কিছু নারীর কণ্ঠ চিরদিনের জন্য স্তব্ধ করা হয়েছিল। তিনি রফিককে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কখনও শুনেছ এদের কথা?” রফিক মাথা নাড়িয়ে বলে, “আমার ঠাকুরদা বলতেন, নবাব কাশিম আলীর হারেমে যারা থাকত, তাদের মধ্যে অনেকেই হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে যেত। কেউ জিজ্ঞেস করত না। কিন্তু আমাদের পাড়ার একজন বৃদ্ধা একবার বলেছিলেন, ওদের কবর হয় না… ওরা ঘুমায় পাথরের ভিতরে।” সায়ন্তনীর শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়, কারণ সেই কথাগুলোর সাথে তাঁর দেখা স্বপ্নের অদ্ভুত মিল খুঁজে পান।
সন্ধ্যে নামার আগে তিনি সিদ্ধান্ত নেন—এই বালিশে আবার মাথা রাখতে হবে। এই স্বপ্নের জগৎ থেকে পিছিয়ে এলে গবেষণা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। মাওলানা তাঁকে খুব সাবধানে বলেন, “আপনি যা খুঁজছেন, তা সত্যি, কিন্তু তার জন্য আপনি নিজের ঘুম হারাতে পারেন মা। আবার যদি প্রবেশ করেন, ফিরে আসা কঠিন হতে পারে।” কিন্তু এই সতর্কবাণীও সায়ন্তনীকে থামাতে পারে না। তিনি শুয়ে পড়েন পাথরের মেঝেতে, বালিশে মাথা রাখতেই যেন অদ্ভুত কাঁপুনি পায়ের নিচে বয়ে যায়। চোখ বন্ধ করতেই চারপাশে অন্ধকার, তারপর ধীরে ধীরে আলো ফুটতে শুরু করে—সে আলো কোনও দিনমানের নয়, বরং আগুনের আলো। চারপাশে ছুটে বেড়াচ্ছে নারীরা, চিৎকার করছে কেউ, আর ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে একজন রক্তমুখী নবাব, যিনি ঠাণ্ডা চোখে সেই দৃশ্য দেখছেন। বালিশ যেন কথা বলে ওঠে মনে—“এবার তোমার শোনা প্রয়োজন… এবার তুমি দেখবে সব।” বাইরে মসজিদের বাতাস থমকে গেছে, রাত গভীর হয়, আর শ্বেতপাথরের বালিশ আবার খুলে দেয় অতীতের আরেকটি দরজা।
তিন
সায়ন্তনী এক অদ্ভুত শ্বাস টেনে নিলেন, বালিশে মাথা রাখার মুহূর্তে এক ঝাঁক শীতল বাতাস তাঁর গা বেয়ে বয়ে গেল, যেন অতীতের অন্ধকার স্নায়ু দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। চোখ বন্ধ করতেই সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল এক অদ্ভুত অনুভূতি, একটি অন্য জগতের স্পর্শ। প্রথমে অন্ধকার, তারপর ধীরে ধীরে সেই অন্ধকারে আবছা রঙের ছায়া ভেসে ওঠে—একটুকু আলো, একটুকু ধোঁয়া, আর দূর থেকে আসা এক শিহরণ। সায়ন্তনী অনুভব করেন, তিনি আর শুয়ে নেই, তিনি কোথাও অন্য একটি স্থানে আছেন। এক মুহূর্তের মধ্যে তিনি বুঝতে পারেন, এটা কোনও স্বপ্ন নয়—এটা বাস্তবতারই এক ভিন্ন স্তর।
অদ্ভুত সুরে বেজে উঠেছিল কড়া আর ঘন্টা, হালকা আলোর মধ্যে বেশ কিছু মানুষ ঘোরাফেরা করছিলেন। সায়ন্তনী নিজেকে দেখতে পান, এক বিরাট প্রাসাদে দাঁড়িয়ে, তার চারপাশে সাদা রঙের পরিধান পরিহিত নারীপুরুষ। সেখানকার বাতাস ভারী, সঙ্গীতের মৃদু সুরে রেশমের মতো মেঝে থেকে ঝরে পড়ছে, যেন মহল একটি ঐতিহাসিক অনুষ্ঠান পালন করছে। কিন্তু অদ্ভুত একটি ছায়া ঢেকে দিয়েছে সেই স্থান। সায়ন্তনী অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন, সেখানে একটি মহল, ঘন তামাটে রঙে ঢেকে রয়েছে, আর সেই প্রাসাদের এক প্রান্তে একটি বিশাল হালকা দহন ঝলসে উঠছে। ঠিক তখনই তাঁর চোখে পড়ে একটি মেয়ের মুখ, তার চোখ দুটি ভীষণভাবে ভীত—চিৎকার করছে, তবে তার কণ্ঠস্বর পৌঁছাচ্ছিল না। মেয়েটি সায়ন্তনীর দিকে তাকিয়ে ছিল, তার মুখে যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট, আর শরীর কাঁপছিল। সায়ন্তনী কিছুটা এগিয়ে যান, তার শরীর ছুঁতে চান, কিন্তু সে তার দিকে এক পা পেছনে সরে গিয়ে অসহায়ের মতো চিৎকার করে ওঠে, “এখানে এসো না!”
তার চিৎকার সায়ন্তনীর মনের মধ্যে যেন বাজ পড়ে। মেয়েটির সঙ্গে সায়ন্তনীর চোখের যোগাযোগ ছিল, তবে কোনও শব্দ আসছিল না। মেয়েটির চোখে যে যন্ত্রণার চিত্র ফুটে উঠছিল, তা সায়ন্তনীর হৃদয়ে এক গভীর ক্ষত তৈরি করেছিল। সে কিছু বুঝতে না পারলেও, তার মনের অজানা অস্থিরতা শূন্যতার মধ্যে মিলিয়ে গিয়েছিল। সায়ন্তনী ঘুরে দাঁড়িয়ে, অবচেতনভাবে একটি দরজা খোলেন, এবং সেখানে এক বিস্ময়কর দৃশ্য ধরা দেয়—এক পুরনো ঘরের ভিতরে কিছু পুরনো নথিপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সেগুলো ধুলোতে ঢাকা, এবং কিছু লেখা পড়তে পারছিল না সায়ন্তনী, শুধু জানালার কাঁচের মধ্যে লাল আভা পড়ে এক দৃষ্টিকোণ থেকে ছায়া দেখাচ্ছিল। সেই মুহূর্তে পেছন থেকে এক চিৎকার উঠল—মেয়েটি তার শরীরের মধ্যে আগুনের মতো কিছু অনুভব করছিল, তার মুখ থেকে গড়িয়ে পড়ছিল অবর্ণনীয় কান্না। সায়ন্তনী দ্রুত ঘুরে যায়, কিন্তু সে মেয়ে যেন মাটির মধ্যে ডুবে যাচ্ছিল।
এটি সায়ন্তনীর কাছে একটি আতঙ্কের স্বপ্ন হয়ে উঠেছিল। তবে যখন সে আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে, নিজের মনের মধ্যে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তে থাকেন, তখন কিছু অতৃপ্ত আত্মা এসে তার চারপাশে ঘুরতে থাকে। তাদের চোখের মধ্যে ছিল এক তীব্র ব্যথা, যা সায়ন্তনীর মধ্যে যেন প্রবাহিত হচ্ছিল, গহীন অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার মতো। তিনি শুনতে পান সেই মেয়েটির ভয়ঙ্কর শব্দ—“তুমি যদি আমাকে উদ্ধার না করো, তবে তুমি এই পৃথিবীতে অশান্তি নিয়ে আসবে।” তার কথা ভেঙে দিয়ে, অন্ধকার কেটে যেতে থাকে, যেন কিছু একটা ভেঙে গেছে—একটি প্রতিজ্ঞা, একটি অশান্তি, একটি রাক্ষসী মনের বার্তা।
অচিরেই সায়ন্তনীর চোখ খুলে যায়, কিন্তু অনুভব করেন, ঘরটা অপরিচিত। মসজিদ, আর তার চারপাশে কেবল নিঃশব্দ স্থিতি। তার শরীর পুরোপুরি অবশ হয়ে পড়েছে, যেন ঘুমের মধ্যে তিনি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন। বুকের মধ্যে একটা চাপ অনুভব করেন—মাথার মধ্যে সেই মেয়েটির চোখ, তার শীর্ণ মুখ, কান্নার শব্দ—এগুলি যেন এক অদৃশ্য হালকা ঝুঁকির মতো তাঁকে ঘিরে রেখেছে। তাঁর চোখের কোণ থেকে এক বিন্দু অশ্রু গড়িয়ে পড়ে, কিন্তু তিনি জানেন—এটা শুধু স্বপ্ন নয়। এটা একটি অভিশাপ, একটি চক্র, যা তাঁর জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। তিনি বুঝতে পারেন, এই এক রাতের মধ্যে যে ইতিহাস তিনি দেখেছেন, তার জন্য প্রস্তুত হওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার।
চার
ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর সায়ন্তনী কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন মসজিদের ভেতরে, যেন তাঁর শরীর সচল থাকলেও মন এখনও সেই অন্য জগতে ঘোরাঘুরি করছে। মাথার ভিতর টান টান চাপ, বুকের মাঝে সেই মেয়েটির চিৎকার এখনো অনুরণিত হচ্ছে। “তুমি যদি আমাকে উদ্ধার না করো…”—এই একটি বাক্য যেন শিকড় বিস্তার করেছে তাঁর চেতনায়। সায়ন্তনী জানতেন, প্রত্নতত্ত্ব শুধুমাত্র স্থাপত্য বিশ্লেষণের কাজ নয়, এটা অতীতের কান্না, আড়াল করে রাখা গল্পগুলোকে জাগিয়ে তোলার কাজ। সেই বিকেলে, পুরনো নথির খোঁজে তিনি রফিককে নিয়ে মুর্শিদাবাদের জেলা রেকর্ড অফিসে যান। বহু পুরনো ফারসি ও বাংলা মিলিয়ে লেখা দলিলের মধ্যে এক পাতায় চোখ আটকে যায়—নবাব কাশিম আলীর শাসনকালে নির্মিত ‘মসজিদে ফিরোজা’র পাশে থাকা হারেম সম্পর্কে একটি রিপোর্ট। সেখানে উল্লেখ ছিল কিছু হারেমকর্মীর হঠাৎ নিখোঁজ হওয়ার কথা, আর তাতে একটি মেয়ের নাম—নুরজাহান বিবি। সায়ন্তনীর রক্ত হিম হয়ে গেল। এটাই সেই নাম, যেটা তিনি ঘুমের মধ্যে শুনেছিলেন আগুনের চিৎকারের ফাঁকে। দলিলের পাশে লেখা ছিল, “নবাবের আদেশে তদন্ত বন্ধ করা হয়।”
এরপরের কয়েক ঘণ্টা সায়ন্তনী কাটান হারেম সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে। তিনি জানতে পারেন, নবাব কাশিম আলী ছিলেন একাধারে বিদ্বান ও অত্যাচারী। ইতিহাস তাঁকে শিল্পরসিক বললেও প্রজাদের মুখে তাঁর নাম উচ্চারণ করা হত কাঁপা কণ্ঠে। হারেমে প্রায় চল্লিশজন নারী থাকতেন, যাঁদের মধ্যে অনেকে ছিলেন রাজপুতানা, পারস্য, কিংবা বাংলা অঞ্চলের। অথচ সেই নারীদের ইতিহাস নেই, তাঁদের নামও নেই—শুধু ছিল সৌন্দর্য আর নীরবতা। হারেম ছিল বাইরের দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, আর এই বিচ্ছিন্নতা অনেক সময়েই হয়ে উঠত অদৃশ্য নির্যাতনের আড়াল। স্থানীয় একটি লোককথা পাওয়া যায়—“হারেমের সন্ধ্যায় কেউ যদি কানের কাছে শুনে, নারীরা এখনো কান্না করে”—এই বাক্যটা সায়ন্তনীর মনে গেঁথে যায়। তিনি বুঝে যান, এই ‘শ্বেতপাথরের বালিশ’ কেবল একজন নয়, বরং অনেকের যন্ত্রণার সংগ্রহশালা। প্রতিটি মাথা যেটা ওই বালিশে রাখা হয়েছিল, হয়তো নিজের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছিল অপমান, কষ্ট, মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত। তিনি নিশ্চিত হয়ে যান, এই বালিশ এক অভিশপ্ত বস্তু, কিন্তু এর মধ্যে রয়েছে এমন এক গল্প, যা ইতিহাসের বইয়ে লেখা হয়নি।
রাত বাড়লে, মসজিদের সেই ঘরে ফিরে গিয়ে সায়ন্তনী আবার দাঁড়ান বালিশের সামনে। এবার তাঁর ভিতরে এক ভয় নয়, বরং এক তীব্র জেদ জমেছে—এই মেয়েদের জন্য, যাঁদের কথা কেউ শোনেনি। তিনি বালিশে মাথা রাখার আগে একটানা চোখ বন্ধ করে শুধু বলেন, “নুরজাহান, আমি এসেছি। এবার আমাকে সব বলো।” ঠিক তখনই, ঘরটা যেন এক অদ্ভুত নীলাভ আলোয় ভরে ওঠে। আর সায়ন্তনী অনুভব করেন, তিনি আবার প্রবেশ করছেন সেই জায়গায়, যেখানে আলোর চেয়ে ছায়া বেশি, গন্ধ ছড়ানো আতর, আর মাঝে মাঝে বিষণ্ণ সুর ভেসে আসে। এবার হারেমের ভিতরে নিজেকে দেখতে পান তিনি—চারপাশে পর্দা, রেশমের চাদর, আর আবছা মুখগুলো। এক এক করে নারীরা তাঁকে দেখে ফিরে যাচ্ছে, কেউ কেউ মুখ ঢেকে কাঁদছে, আর সবার শেষে দাঁড়িয়ে সেই মেয়ে—নুরজাহান। তার গলায় নেই গয়না, চুল খুলে গেছে, কিন্তু চোখে অদ্ভুত স্থিরতা। সে বলে, “তুমি যদি সত্য জানতে চাও, তবে ফিরে যেও না।” এবং তার হাত বাড়িয়ে দেয় সায়ন্তনীর দিকে। স্পর্শ হতেই এক আগুনের ঝলকানি, আর অতীত খুলে যায়—সেখানে দেখা যায় নবাবের পায়ের নিচে কাঁপতে থাকা নুরজাহান, প্রতিরোধহীন এক অভিশপ্ত জীবন, যাকে চিরতরে চেপে দেওয়া হয়েছিল ইতিহাসের বালুতে। সায়ন্তনী চমকে ঘুম থেকে উঠে বসেন। ঘরের মধ্যে বাতাস থেমে গেছে, বালিশ এখনও আগের জায়গায়, অথচ ঘরের কোণে যেন হালকা একটি আতরের গন্ধ—যা হারেমের সুর তুলে ধরে। এবার তিনি জানেন, গল্পটা তাঁর হাতেই উঠেছে, এবং তিনি আর থামবেন না।
পাঁচ
তিনদিন ধরে সাহিল আর অনিমেষ মসজিদের ভেতর পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে। দিনের বেলায় সব শান্ত, নিস্তব্ধ, পাথরের গায়ে কেবল ধুলোর স্তর জমেছে। কিন্তু রাত নামলেই অদ্ভুত স্বপ্ন ঘিরে ধরে সাহিলকে—কখনও একজন ঘোড়সওয়ার তুর্কি সেনাপতি পাথরের বালিশে মাথা রেখে রক্তাক্ত চোখে তাকিয়ে থাকে, কখনও দেখা যায় জনপদের মেয়েরা অশ্রুজলে প্রার্থনা করছে, যেন বাঁচার শেষ আর্তি জানাচ্ছে এক নিষ্ঠুর যন্ত্রণা থেকে। সাহিল সেইসব স্বপ্নে বন্দি হয়ে পড়ে যায়, যেন তার আত্মা সেখানেই আটকে আছে। সে দেখে যে প্রতিটি মৃত ব্যক্তি একে একে এসে পাথরের বালিশে শুয়ে পড়ে, আর তার ঠিক পরেই তাদের জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ মুহূর্তগুলো পুনরায় জীবন্ত হয়ে ওঠে। সাহিল বুঝতে পারে এই পাথর কোনো সাধারণ শিলাখণ্ড নয়—এটি এক অভিশপ্ত যন্ত্রণা-সংগ্রাহক, যেন কোনো পৌরাণিক অস্তিত্ব তার পেটে সব স্বপ্ন আর মৃত্যুবেদনার ইতিহাস ধরে রেখেছে।
অনিমেষ এক রাতে সাহিলকে ডেকে বলে—”তুই যেভাবে বালিশটার স্বপ্নে ডুবে যাচ্ছিস, সেটা খুব বিপজ্জনক। আমি পুরনো তুর্কি রেকর্ডে কিছু পাণ্ডুলিপি পেয়েছি, সেখানে বলা আছে—‘নতুন আত্মা যখন প্রাচীন যন্ত্রণার ধারক হয়, তখন সে হয়ে ওঠে প্রহরী।’ হয়ত বালিশটা একটা দরজা, আর তুই সেই দরজার নতুন চাবি।’ সাহিল চমকে ওঠে—প্রহরী? সে কি তাহলে নিজের অজান্তেই হয়ে উঠছে সেই অতীত আর বর্তমানের মাঝের এক সেতু, যার কাজ হবে পুরনো মৃতদের যন্ত্রণার সাক্ষী হয়ে বেঁচে থাকা? সেই রাতে সে আর ঘুমাতে পারে না। ঘরের জানালা দিয়ে দেখা যায় দূরের মসজিদটা যেন নিঃশব্দে ডেকে চলেছে তাকে। মাথায় এক অদ্ভুত যন্ত্রণা নিয়ে সে বালিশের দিকে তাকায়—যেন সেটা তাকে বলছে, ‘আরো দেখ, আরও জান, তোমার দায়িত্ব এখানেই শেষ নয়।’
পরদিন সকালে সাহিল মসজিদের পুরনো গম্বুজের নিচে খুঁজে পায় একটা অদ্ভুত খোদাই—তাতে লেখা, ‘ইলমে কুহনা ইদ্রাক পাথর হ্যায়’—জ্ঞান আর বোধ যেখানে থেমে যায়, সেই পাথরই সাক্ষী থাকে। অনিমেষও বোঝে, স্বপ্নগুলো শুধু সাহিলের কল্পনা নয়, এগুলো এক বিশাল ঐতিহাসিক ব্যথার বহিঃপ্রকাশ। পাথরের বালিশটি যেন একটা পোর্টাল, যেখানে নেমে গেলে আর ফেরা যায় না আগের জীবনে। সাহিল তার রেকর্ডারে রাতের স্বপ্নগুলো রেকর্ড করতে শুরু করে—কিন্তু ভয়াবহ ব্যাপার ঘটে, পরদিন সেই রেকর্ডার চালু করতেই শোনা যায় অসংখ্য আর্তনাদ আর নামহীনদের দীর্ঘশ্বাস। সে বুঝতে পারে, সে শুধু স্বপ্ন দেখছে না, সে তাদের আত্মিক অবশিষ্টাংশও নিজের ভেতর ধারণ করছে। আর সেই মুহূর্তে সাহিল নিশ্চিত হয়—পাথরের বালিশ তাকে বেছে নিয়েছে, চিরকালীন যন্ত্রণার ইতিহাস বাঁচিয়ে রাখার জন্য একজন জীবন্ত প্রহরী হিসেবে।
ছয়
মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা যখন যেন আরও ঘনিয়ে এল, মসজিদের দেওয়ালের বাইরে শেয়ালের হাহাকার আর বটগাছের পাতায় পাতায় বাতাসের কান্না মিলেমিশে এক অদ্ভুত সুর তুলেছিল। রাবেয়া নিজের চোখে দেখা স্বপ্নের বিভীষিকা ভুলতে পারেনি—আলাউদ্দিনের চোখে যে মৃত্যু, যন্ত্রণা, আর বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস ঝরে পড়েছিল, তা যেন বাস্তবের চেয়েও বাস্তব ছিল। তবে আজ রাতে তিনি আর একটা ধাপে এগোতে চেয়েছিলেন। সেই বালিশে মাথা দিয়ে, পূর্বপুরুষদের বেদনার আরও গভীরে যেতে। তিনি বালিশটা আবার নিজের মাথার নিচে রাখলেন, নিঃশ্বাস আটকে রেখে চোখ বুজলেন। মুহূর্তেই চারপাশের শীতলতা আরও বেড়ে উঠল, আর তার চেতনার ধারে ধারে ঢুকে পড়ল আরেকটা কাহিনী, আরেকটা সময়।
রাবেয়া দেখলেন, তিনি এক গুহার ভেতরে দাঁড়িয়ে আছেন—নির্জন, অন্ধকার, আর দেয়ালজোড়া ফিসফিস শব্দে পূর্ণ। সামনের এক দরজা খোলা, তার ওপারে আলো ঝলমল করছে। সেই আলোতে হেঁটে এল এক বৃদ্ধা, তার চোখ দুটি যেন সময়েরও প্রাচীনতর। বৃদ্ধা বলল, “তুমি অনেকের স্বপ্ন ভেদ করে এসেছো, এবার পেছনের সত্যি জেনো। বালিশটা কেবল শুয়ে দেখার বস্তু নয়, এটা এক শাস্তি, এক শুদ্ধির দরজা।” তারপর দরজার ওপাশে নিয়ে গেল তাঁকে—এক পুরাতন মাদ্রাসার আঙিনায়। সেখানে একদল শিশু কোরআন পড়ছে, কিন্তু তাদের মুখে হাসি নেই, চোখে কেবল ভয়। হঠাৎ করেই এক মোল্লা প্রবেশ করলেন, হাতে চাবুক, আর তার প্রবেশেই শিশুরা স্তব্ধ। রাবেয়া ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এই কি সেই ইতিহাস যা লুকোনো? শিশুদের ওপর ধর্মের নামে চালানো নির্যাতন? কিন্তু বৃদ্ধা বলল, “না, এ কেবল প্রেক্ষাপট। সত্যি আরও গভীরে।”
চোখ খুলতেই ঘেমে উঠলেন রাবেয়া, তার শ্বাস যেন ফুসফুস ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু তার পাশেই, দেয়ালের একটা অংশে অদ্ভুতভাবে সাদা হয়ে উঠেছে। তিনি এগিয়ে গিয়ে দেখলেন, প্রাচীন আরবি ভাষায় খোদাই করা কিছু শব্দ—”আল্লাহর ঘরে সত্যের মুখ লুকানো নেই।” তিনি জানতেন, এটা অলৌকিক নয়। শ্বেতপাথরের বালিশ কেবল স্বপ্নের দরজা নয়, এটা সময়ের এক ফাটল। প্রতিবার যখন তিনি মাথা রাখছেন, তখন সেই অতীতের ভূতেরা কেবল স্বপ্ন দেখাচ্ছে না, বরং তাকে নির্দেশ দিচ্ছে, আহ্বান জানাচ্ছে সত্যকে সামনে আনার। আর সেই সত্যের পথ বাধা দিয়ে রেখেছে কেউ—কোনো সংগঠন, কোনো অভিশাপ, কিংবা কিছু হারিয়ে যাওয়া মৃত আত্মা, যারা এখনও শান্তি পায়নি।
সাত
অন্ধকার আকাশের নিচে মুর্শিদাবাদের সেই প্রাচীন মসজিদের চারপাশটা যেন ক্রমশ ঘন হয়ে উঠছে। আরমান এখন নিছক একজন প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক নয়, বরং এক জীবন্ত সেতু—অতীত ও বর্তমানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক জিজ্ঞাসু আত্মা, যে নিজের চেতনার সীমা ছাড়িয়ে গিয়ে অন্য মৃত আত্মাদের যন্ত্রণায় ভাগীদার হয়ে উঠেছে। প্রতিটি রাত যেন তাকে আরও গাঢ়, আরও জটিল অন্ধকারে ডুবিয়ে নিয়ে যাচ্ছে—যেখানে কেবল মৃতদের আর্তনাদ, পোড়া শরীরের গন্ধ, আর রক্তরঙা অলীক ছায়া ভেসে বেড়ায়। সপ্তম রাতে, যখন আরমান পুনরায় শ্বেতপাথরের বালিশে মাথা রাখল, ঘুমের ঠিক আগের মুহূর্তে তার মনে হল যেন মসজিদের দক্ষিণ দিকের দেয়ালে খোদাই করা কিছু অক্ষর নড়ে উঠছে, যেন সে নিজেই ডেকে বলছে—“এইখানেই শেষ হয়নি সব।” সে চোখ বন্ধ করতেই শুরু হল আরেকটি স্বপ্ন—এইবার আর কোন ফকির, সেপাহী কিংবা জল্লাদের কাহিনী নয়, বরং এক নিষিদ্ধ প্রেমের অনলস্পর্শা স্মৃতি।
স্বপ্নের পর্দায় ধীরে ধীরে ভেসে উঠল এক কিশোরী, যার পরনে ছিল সাদা জামদানি, পায়ের নুপুরে যেন বাতাসের শব্দ থমকে থাকে। সে একা দাঁড়িয়ে আছে মসজিদের পাশের পুরনো পুকুর ঘাটে, তার চোখে জল, অথচ মুখে এক নির্লিপ্ত প্রতিজ্ঞা। আরমান দেখল—এই কিশোরী ইমাম সাহেবের মেয়ে, যার মন দিয়েছিল এক হিন্দু শিল্পীকে, যে মসজিদের দেয়ালে আরবি কলিমা খোদাই করার কাজে নিযুক্ত ছিল। প্রেম দুজনের মাঝখানে জাত-ধর্মের কাঁটাতার হয়ে দাঁড়ায়, আর সেই তারেই বিদ্যুৎ খেলে দেয় এক ভয়ানক পরিণতি। ইমাম সাহেবের সম্মান রক্ষায় সেই কিশোরীকে শাস্তি দেওয়া হয়—প্রথমে শিকলবন্দী, তারপর পাথর ছুঁড়ে মৃত্যুদণ্ড। আরমান তাকিয়ে দেখল, স্বপ্নে সে যেন স্বয়ং সেই বিচারসভায় উপস্থিত, কিশোরীর আর্তনাদ তার কানে নয়, আত্মায় বাজে। তার মৃত্যু যেন শুধু এক প্রাণের অবসান নয়, বরং সেই মসজিদের পবিত্রতার আড়ালে ঢেকে রাখা এক নিষ্ঠুর ইতিহাসের কালিমা।
ঘুম ভাঙার পর আরমানের শরীর ঠান্ডা ঘামে ভিজে থাকে। তার কাঁধ ভারী, চোখে যেন এখনো কিশোরীর অভিশপ্ত চাহনি লেগে আছে। পাথরের বালিশটি এখন আর নিছক একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন নয়, বরং প্রতিটি স্বপ্নের সঙ্গে তার চেতনার ভিতরকার আবরণ ছিন্ন করে দিচ্ছে। সে বুঝতে পারে, এই বালিশে কেবল অতীত দেখা যায় না—এর মধ্যে রয়েছে অপ্রকাশিত পাপের দলিল, চেপে রাখা কান্নার ইতিহাস। আরমান সিদ্ধান্ত নেয়—এবার সে শুধু দর্শক থাকবে না। তাকে খুঁজে বের করতেই হবে সত্যের সমস্ত পরত। এই অভিশপ্ত প্রেম, ধর্মান্ধতা আর হিংসার ইতিহাসের গভীরে ডুবে গিয়ে তাকে জাগিয়ে তুলতে হবে সত্যকে—আর তাতেই হয়তো মুক্তি পাবে সেই মেয়েটির আত্মা, কিংবা… তার নিজের?
আট
সপ্তম রাতের আতঙ্ক এখনও আরমানের মনের গভীরে বাজছিল, কিন্তু আজ যেন সেই ভয় মিশে গেছে এক অদ্ভুত কৌতূহলে। সেই কিশোরীর কান্না, তার পোড়া মুখ, তার ভালোবাসা এবং বিশ্বাসঘাতকতার যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি যেন এখন আরমানের শরীরে জমে থাকা রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে। এ রাতের মেঘ ছিল ভারী, তবে বৃষ্টি হয়নি। নিঃশব্দে আরমান আবারও মাথা রাখল সেই শ্বেতপাথরের বালিশে। চোখ বন্ধ হতেই চারপাশের দৃশ্য পাল্টে যেতে লাগল, যেন সময়ের গভীরে ডুব দিল সে, আর উঠে এল মসজিদের আরও গভীরতর ইতিহাসের এক রহস্যময় স্তরে। এবার আর সাদাকালো নয়, দৃশ্য রঙিন—তবে সেই রঙ যেন পুড়ে যাওয়া তামার মত গাঢ় আর দগ্ধ। সে নিজেকে দেখতে পেল এক মুঘল আমলের বিচার সভার সামনে, যেখানে একজন বৃদ্ধ সন্ন্যাসী দণ্ডপ্রাপ্ত অবস্থায় মাটিতে বসে আছে। তার চোখে কোনো ভয় নেই, কিন্তু গভীর দৃষ্টিতে অনড়ভাবে চেয়ে আছে ইমাম সাহেবের দিকে, যার চেহারাটা এবার সম্পূর্ণ আলাদা। সে যেন আর ধার্মিক পুরোহিত নয়, বরং এক পাষাণের প্রতীক—তার কণ্ঠস্বর ভরে উঠেছে ঘৃণায়, কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ধর্মীয় শুদ্ধতার নামে রক্তচাপাতির সিদ্ধান্ত। চারপাশে থাকা জনতা “অপবিত্র” বলে চিৎকার করছে, আর সেই বৃদ্ধ মৃদু হাসছে। “আমি এখানে শুধু তীর্থ করতে এসেছিলাম,” তার কণ্ঠে উচ্চারিত হল, “তোমরা আমার দেহ পুড়িয়ে দেবে, কিন্তু আমার প্রার্থনা রয়ে যাবে এই স্থানে। যতদিন না কেউ শুনবে তা, ততদিন শান্তি পাবে না এই জায়গা।”
আরমান বুঝতে পারল, এই শ্বেতপাথরের বালিশ কোনও মসজিদের অংশ ছিল না, বরং এই সন্ন্যাসীর ধ্যানের আসন ছিল, যেখানে সে একান্তে ঈশ্বরের সাথে কথোপকথনে লিপ্ত থাকত। ধর্মান্ধ সমাজের অত্যাচারে সে এই জায়গাতেই প্রাণ হারিয়েছিল, আর তার আত্মা আটকে গেছে এই পাথরে, কারণ তার শেষ প্রার্থনা কেউ শোনেনি। মসজিদের নির্মাণ হয়েছিল বহু পরে, কিন্তু সেই পাথর থেকেই ছড়াতে থাকে অদ্ভুত এক শক্তি, যা ধীরে ধীরে এই স্থানকে আত্মাহুতির কেন্দ্রে পরিণত করে। মসজিদের ইতিহাস বারবার পাল্টেছে, বিভিন্ন শাসকের নাম জড়িয়ে গেছে এর সঙ্গে, কিন্তু প্রতি শতাব্দীতে কেউ না কেউ এই পাথরের কাছে মাথা রেখে সেই সন্ন্যাসীর প্রার্থনার ভার বহন করতে বাধ্য হয়েছে। এবার আরমানও সেই চক্রের অংশ হয়ে গেছে। সে অনুভব করে তার নিজের শরীর ক্রমাগত ভারী হয়ে উঠছে, তার শ্বাস টেনে নিচ্ছে সেই প্রাচীন বাতাস, চোখের সামনে দৃশ্য গুলো যেন আর স্বপ্ন নয়—এগুলো বাস্তব, অস্বাভাবিক হলেও সত্য। পাথরের ওপর ছায়া নাচছে, এক ঝলক আলোয় সে দেখে এক শিশু, এক নারী, এক সৈনিক—তিনটি মৃত আত্মা যাদের শেষ আশ্রয় হয়েছে এই শ্বেতপাথরের অভিশাপে। তারা কারা? কেন তাদের কষ্ট এত গভীর?
রাত গভীর হতে হতে পাথরের গায়ে ফাটল দেখা দিতে থাকে। আরমান আতঙ্কিত হয়—এই কি তাহলে শেষ পর্যায়? পাথরের ফাটলের ফাঁক দিয়ে যেন বেরিয়ে আসে অসংখ্য চাপা আওয়াজ—একটি নারীর দীর্ঘশ্বাস, একটি শিশুর কান্না, আর একটি কণ্ঠস্বর যা শুধু বলে, “আমার প্রার্থনা কেউ শোনে না।” আরমান অনুভব করে তার নিজের বুকের ভিতরেই সেই আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সে শুয়ে আছে, কিন্তু মনে হয় যেন সে এক শূন্য জায়গায় দুলছে, যেখানে আলো নেই, মাটি নেই, কেবল গলা টিপে ধরা কান্নার শব্দ। হঠাৎ, সবকিছু থেমে যায়। পাথরের মধ্যে থেকে এক কণ্ঠস্বর বলে ওঠে—”তুই যদি সত্যিই গবেষক হিসেবে সত্য খুঁজিস, তবে আমার শেষ প্রার্থনা লেখ। অন্যথায় তুইও আটকে যাবি।” আতঙ্ক আর দায়িত্বের দ্বন্দ্বে জর্জরিত আরমান উঠে বসে। ঘামে ভেজা শরীর, কিন্তু চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। এইবার সে জানে, গবেষণা নয়—এটা এক প্রেতাত্মার মুক্তির যাত্রা, এবং তার নিজের আত্মারও। এখন সে যা দেখেছে, তা শুধু কাগজে লেখার নয়—তা বলার, ছড়িয়ে দেওয়ার, আর এই মসজিদ থেকে সমস্ত যন্ত্রণার ইতিহাসকে মুক্ত করার। কিন্তু ঠিক কতটুকু সত্যি বলা যাবে এই যুগে? আর কোথায় শুরু করবে সেই লেখা? এই প্রশ্ন গুলো তাকে যেন আর ঘুমাতে দিচ্ছে না, আবারো সে তাকায় পাথরের দিকে—এই পাথর তো শুধু ইতিহাস নয়, এটা নিজেই এক প্রাণ।
নয়
অষ্টম রাতের বিভীষিকা কাটিয়ে উঠে আরমান আবারও সেই বালিশে মাথা রাখে, তবে এবার ভেতরে এক অদ্ভুত স্থিরতা কাজ করছিল—যেন সে জানে, আর মাত্র কিছু বাকি, আর একটু হলেই সে পৌঁছে যাবে সেই গূঢ় রহস্যের কেন্দ্রে। চোখ বন্ধ হতেই সে উঠে পড়ে এক ভিন্ন পরিবেশে—এক বিরাট সভা, যেন মুঘল আমলের কোনো বিচারসভা, যেখানে পাথরের সিংহাসনে বসে আছেন এক বিশাল আকৃতির কাজি, আর সামনে দাঁড়িয়ে শত শত মানুষ। শৃঙ্খলাবদ্ধ এক যুবককে টেনে আনা হচ্ছে, যার মুখে ক্ষোভ আর চোখে এক শূন্য দৃষ্টি। কেউ চিৎকার করছে, কেউ কাঁদছে, আর কেউ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে বিচার দেখছে। সেই কাজি ঘোষণা করছেন—“এই যুবক ‘আদম’, মসজিদের শুদ্ধতা নষ্ট করেছে, হিন্দু রমণীর সঙ্গে মিলিত হয়ে শত্রুতা এনেছে ধর্মের ভিতর।” তারপর তীব্র শব্দে ঘোষিত হয় মৃত্যুদণ্ড। অথচ পুরোটা সময়ে আদমের চোখ ছিল একটাই জায়গায়—সভায় দাঁড়িয়ে থাকা সেই রমণীর দিকে, যার চোখে কেবল নীরব বিদ্রোহ। মঞ্চের এক পাশে ছিল সেই শ্বেতপাথরের বালিশ, সিংহাসনের নিচে রাখা, যেন তার সামনে দিয়ে অতীত, বর্তমান, সব বিচার চলছে। আরমান বুঝতে পারে—এই বালিশ শুধু ঘুমের গহ্বরে ইতিহাস দেখায় না, এটি নিজেই ইতিহাসের অংশ, এই সব বিচারের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে।
স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার পরে আরমান আর চুপ করে থাকতে পারে না। এইবার সে সিদ্ধান্ত নেয় মসজিদের নথিপত্র, আর্কাইভ, স্থানীয় ইতিহাস ঘেঁটে এই ‘আদম’-এর সত্যতা খুঁজে বের করবে। সাদা জামদানি পরা কিশোরীর পরিচয় আর মৃত্যুর রেকর্ড খুঁজে বেড়াতে সে শহরের পুরাতন লাইব্রেরিতে যায়, কথা বলে মুর্শিদাবাদের ইতিহাসবিদ ড. সাইফুল্লাহর সঙ্গে। সেখানে সে জানতে পারে, মুঘল আমলে মুর্শিদাবাদে অনেক বিচারসভা বসত মসজিদ চত্বরে, যেখানে ধর্মীয় শাসনের বাইরে কেউ গেলেই কঠোর শাস্তি হত। ‘আদম’ নামের একজন শিল্পী সত্যিই ছিলেন, যিনি আকবরের সময়কাল থেকে শুরু করে আওরঙ্গজেবের আমল পর্যন্ত বহু মসজিদে পাথরের কাজ করতেন। কিন্তু তার হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, কোনো রেকর্ড না থাকা, আজও এক অমীমাংসিত প্রশ্ন হয়ে আছে। আর সেই কিশোরী? তার নামের জায়গায় শুধু লেখা আছে—“মৃত্যু, আগুনে, সমাজের ইচ্ছায়”। এই সব তথ্য দেখে আরমান ভিতরে ভিতরে কেঁপে ওঠে। তাহলে তার স্বপ্ন কি নিছক কল্পনা নয়? এই বালিশ, এই মসজিদ, এই ইতিহাস—সবই এক ভয়ঙ্কর চক্র, যেখানে অতীত এখনো বেঁচে আছে।
ঘরে ফিরে এসে আরমান সেই বালিশের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবে—এই পাথর হয়ত কেবল মৃতদের কান্না ধারণ করে না, বরং সে নিজেই এক ‘জীবন্ত দলিল’, যার শরীরে জমে আছে শতাব্দীর রক্ত, ভালোবাসা, বিশ্বাসঘাতকতা আর অভিশাপের গল্প। সে ঠিক করে, এই ইতিহাস সে লুকাবে না। লেখালেখির মাধ্যমে সবার সামনে আনবে, সত্যকে জানাবে। কিন্তু ঠিক তখনই ঘরের দরজায় এক অদ্ভুত শব্দ হয়—টুপটাপ টুপটাপ, যেন কেউ ভেজা পায়ে ঘরে ঢুকছে। সে ঘুরে তাকাতেই দেখে, জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সেই কিশোরী, চোখে যেন আগুন, কণ্ঠে কাঁপা কাঁপা স্বর—“আর কেউ যেন আমাদের যন্ত্রণা নিজের মতো করে না লেখে, এই গল্প কারো একার নয়, এটা রক্তের।” কথা বলার আগেই তার শরীর অদৃশ্য হয়ে যায় বাতাসে, আর শুধু বালিশের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে এক গভীর ঠান্ডা, আরমানের শিরায় শিরায় কাঁপন তোলে। এটা কেবল ইতিহাস নয়, এটা এখন এক জীবন্ত অভিশাপ।
দশ
আকাশে পূর্ণিমার আলো, মসজিদের চারপাশে অস্পষ্ট কুয়াশা, আর তীব্র নিস্তব্ধতা—মুর্শিদাবাদের সেই রাত যেন এক অভিশপ্ত মঞ্চের পরিণতির অপেক্ষায় ছিল। আরমান নিজের রুমে শুয়ে থাকলেও মনে হচ্ছিল যেন তার শরীর পড়ে আছে, কিন্তু আত্মা ইতিমধ্যেই পাড়ি দিয়েছে সেই শ্বেতপাথরের বালিশের গভীর অভিসারে। আজ ছিল দশম রাত—প্রথম স্বপ্ন দেখার পর থেকে শুরু হওয়া অভিশপ্ত যাত্রার শেষ অধ্যায়। তার মাথা যখন সেই শীতল পাথরের ওপর স্পর্শ করল, মুহূর্তেই সে প্রবেশ করল এক অদ্ভুত সময়চক্রে—মসজিদ ছিল ধ্বংসস্তূপে পরিণত, বাতাসে পুড়ে যাওয়া শরীরের গন্ধ, আর কানে বাজছিল হাজারো কণ্ঠে আর্তনাদ। সে দেখতে পেল একদল পুরোহিত আর মৌলবী মিলে আগুনের চারপাশে নাচছে, তাদের চোখ উন্মাদ, মুখ বিকৃত, আর তারা বলছে—“যে জানবে, সে পোড়াবে, যে দেখবে, সে হারাবে।” এরপর একে একে সেই সব আত্মারা সামনে এল—সাধু, জল্লাদ, প্রেমিক কিশোরী, নির্যাতিত ভৃত্য, চুন-সুরকি করা বন্দি ইমাম—সবাই যেন আরমানকে কিছু বলার চেষ্টা করছে, কিন্তু শব্দগুলো বাতাসে গলে যাচ্ছে। এমন সময় তার সামনে এসে দাঁড়াল সেই কিশোরী—চোখে জল, হাতে শ্বেতপাথরের বালিশ। সে বলল, “তুমি জেগে উঠলে সব ভুলে যাবে, কিন্তু যদি এইবারও সাহস করো জানতে, তাহলে চিরকাল আমাদের মাঝেই থেকে যাবে।”
ভোরের আলো ফোটার আগেই আরমান হঠাৎ চিৎকার দিয়ে উঠে বসে—গলা শুকনো, দেহ ঘামে ভেজা, কিন্তু চারপাশ নিস্তব্ধ। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে, মসজিদের আকাশপানে ধোঁয়ার মতো ছায়া উঠছে, যেন কেউ বিদায় নিচ্ছে। তার মন অদ্ভুত ভারে ভারাক্রান্ত—কী সত্যি, কী স্বপ্ন, সে বুঝে উঠতে পারে না। সে দেয়ালের ঘড়ির দিকে তাকায়—সময়ে ঠিক ভোর পাঁচটা। পাথরের বালিশ তখনও তার বিছানায় পড়ে আছে, শীতল, নির্লিপ্ত। আরমান সেটাকে হাতে তুলে নেয়, চোখে দেখে কোনো চিহ্ন আছে কিনা, কিন্তু কিছুই নেই—তবে সে অনুভব করে তার মনে গেঁথে আছে প্রতিটি মৃত আত্মার আর্তনাদ, প্রতিটি পুড়ে যাওয়া গল্পের ছায়া। সে ভাবে, এই অভিশাপ কি কেবল স্বপ্নে দেখা ইতিহাস, নাকি বাস্তবের চেয়ে বেশি বাস্তব এক অভিজ্ঞতা? সে ঠিক করে, সে কলকাতায় ফিরে গিয়ে এগুলো লিখে ফেলবে, হয়তো ইতিহাসের নামে, হয়তো গোপনে কোনো উপন্যাসে—কিন্তু তার কাছে এগুলো নিছক গল্প নয়, বরং আত্মায় গেঁথে যাওয়া সত্য।
সপ্তাহখানেক পর, কলকাতার ফ্ল্যাটে বসে আরমান শুরু করল লিখতে—‘শ্বেতপাথরের বালিশ: এক ইতিহাসের অভিশাপ’। কাগজে কলমে সেসব স্বপ্ন-দৃশ্য ফুটে উঠছে, কিন্তু প্রতিটি শব্দ লিখতে গিয়ে তার মাথা ভার হয়ে আসে, বুকের মধ্যে চাপ পড়ে, আর মাঝে মাঝেই শোনে ফিসফিসে আওয়াজ—“লিখে ফেলো, নয়তো আমরা হারিয়ে যাবো।” প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে গেলে সে ভাবে, আবার বালিশটা ব্যবহার করবে কিনা। কিন্তু সে জানে, আর একবার মাথা রাখলেই সে হয়তো চিরতরে আর জাগতে পারবে না। একদিন সকালে সে আবিষ্কার করে, বালিশটা বিছানায় নেই। অনেক খুঁজেও পায় না, এবং আশ্চর্যের ব্যাপার, সে বুঝতে পারে সেই বালিশকে সে কোনোদিন বাইরে থেকে আনার কথাই মনে করতে পারছে না। তাহলে কি এই সবটাই ছিল মনের সৃষ্টি? না কি সে নিজেই এখন এক ইতিহাসের বাহক, যার কাহিনি কেউ বিশ্বাস করবে না, আবার কেউ হয়তো পাগল বলেই উড়িয়ে দেবে। কিন্তু সে জানে, তার ভিতরে যা রয়েছে, তা মুছে যাবে না। সেই বালিশ যেমন অজস্র মুখের অভিশাপ বহন করে, তেমনি আরমানও হয়ে উঠল এক নতুন অভিশপ্ত কাহিনির নীরব লেখক—চোখে ঘুম নেই, কলমে আগুন, আর আত্মায় সেই পুরনো মসজিদের ছায়া।
সমাপ্ত
				
	
	


