Bangla - প্রেমের গল্প

শেষ লোকাল ট্রেন

Spread the love

নন্দিতা রায়


কলকাতার রাত নেমে এসেছে। অফিস পাড়া ফাঁকা হতে শুরু করেছে, কিন্তু হাওড়া বা শিয়ালদহমুখী লোকালের প্ল্যাটফর্ম তখনও গমগম করছে। ব্যস্ত দিন শেষে ট্রেন ধরে ফেরা এই শহরের মানুষের কাছে শেষ লোকাল মানে যেন জীবনের অবশিষ্ট কয়েক ফোঁটা শক্তি খরচের জায়গা। প্রতিদিনের মতোই অয়ন মুখার্জী হাঁটছে ক্লান্ত পায়ে। তার চোখে লাল আভা, কাঁধে ব্যাগের ভার, মুখে একরকম নিরাসক্তি। যেন পুরো দিনটা তাকে চেপে রেখেছে, আর ট্রেন ছাড়া তার কোনো আশ্রয় নেই। অয়ন এই সময়ের লোকাল ধরতে অভ্যস্ত—শহরের কোলাহল পেছনে ফেলে বাড়ি ফেরার একমাত্র উপায় এই শেষ যাত্রা। ট্রেনে ওঠার সময় সে জানে—এখানে গাদাগাদি, ঘাম, ঠেলাঠেলি থাকবে, কেউ হয়তো ঝগড়া করবে সিট নিয়ে, কেউ আবার ঘুমিয়ে পড়বে হেলেদুলে। তবুও এই ভিড়ের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে এক শান্তি, এক প্রত্যাশা। কারণ প্রতিদিন একই কামরায়, প্রায় একই সিটে বসা এক মেয়ে তাকে অদ্ভুতভাবে আকর্ষণ করে। প্রথমদিন হয়তো হঠাৎ নজরে এসেছিল, তারপর থেকে প্রতিদিনই অয়ন অনায়াসে খুঁজে নেয় তাকে। মেয়েটি জানালার ধারে বসে থাকে, হাতে বই কিংবা খালি দৃষ্টি বাইরে ছড়িয়ে। তার চুল খোলা থাকে বেশিরভাগ সময়, আলো-আঁধারের ভেতরেও চোখে স্পষ্ট দীপ্তি। আশ্চর্যের বিষয়, কোনোদিন দু’জনের মধ্যে কোনো কথা হয়নি, অথচ চোখের দৃষ্টি যেন প্রতিদিন তাদের মধ্যে নীরব আলাপ ঘটায়। অয়ন জানে না মেয়েটির নাম, জানে না কোথায় নামে, এমনকি তার জীবনের কিছুই জানে না। কিন্তু তবুও, প্রতিদিনের এই এক মুহূর্ত যেন অয়নের দিন শেষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

অয়নের জন্য প্রতিদিনের লোকাল মানেই একঘেয়ে ছন্দ। টিকিট কাটার লাইনে দাঁড়ানো থেকে শুরু করে, প্ল্যাটফর্মে অগণিত পায়ের শব্দ, ট্রেন ঢোকার কর্কশ শব্দ, সবার হুড়োহুড়ি—সবই প্রতিদিনের অভ্যস্ত ছবি। কিন্তু এই এক মেয়ের উপস্থিতি সেই অভ্যস্ত ছবিকে ভেঙে দেয়। ক্লান্তি, বিরক্তি সবকিছু সরে গিয়ে তার চোখ খুঁজে বেড়ায় কেবল এক চেনা মুখকে। মেহের—যদিও অয়ন তখনও তার নাম জানে না—তার চারপাশের মানুষদের থেকে আলাদা। অন্যরা যেখানে হইচই করছে, সিট নিয়ে ঝগড়া করছে, কিংবা ঘুমের ঘোরে দুলছে, সেখানে মেয়েটির মধ্যে এক অদ্ভুত শান্তি। সে হয়তো বইয়ের পাতায় ডুবে আছে, অথচ মাঝেমাঝে চোখ তুলে তাকায় জানালার বাইরের অন্ধকার শহরে, যেন কোথাও নিজেকে খুঁজছে। আর সেই মুহূর্তে, অনিচ্ছাকৃতভাবে, তার চোখ পড়ে অয়নের দিকে। দু’জনের চোখ মিললে এক অদ্ভুত কাঁপন জন্ম নেয়—না বলা কথার মতো, যেটা কেবল অনুভব করা যায়, বলা যায় না। কেউ হাসে না, কেউ মাথা নোয়ায় না, তবুও বোঝা যায়—এই নীরবতা কোনো সাধারণ নীরবতা নয়। অয়ন ভাবে, “এমন কেন হয়? একজন সম্পূর্ণ অচেনা মানুষকে কেন প্রতিদিন খুঁজে নিতে ইচ্ছে করে?” প্রশ্নের উত্তর সে জানে না, তবে প্রতিদিনই সে সেই উত্তরের খোঁজে লোকালে ওঠে। যেন মেয়েটি শুধু একজন যাত্রী নয়, বরং তার ক্লান্ত দিনের শেষ আলো।

মেহেরও হয়তো অয়নকে চিনে নিয়েছে, যদিও কোনো প্রকাশ নেই। প্রতিদিনের একই ভিড়ে, একই সিটে বসা সেই যুবকের চোখে এক অদ্ভুত দৃষ্টি সে টের পায়। ভিড়ের মধ্যে এই একমাত্র মুখটি যেন আলাদা হয়ে ওঠে তার কাছে। সে জানে না ছেলেটি কী করে, কোথায় নামে, তার জীবনে কী আছে—কিন্তু প্রতিদিন দেখা হওয়ার এই নীরব অভ্যাস তাকে এক অচেনা নিরাপত্তা দেয়। হয়তো তার জীবনের ক্লান্ত দিনগুলোর মাঝে এই ছোট্ট মুহূর্তই তাকে নতুন করে ভাবতে শেখায়। বইয়ের পাতা পড়লেও, মনের কোণে সে টের পায়—কেউ আছে যে তাকে খুঁজে নেয়, শুধু চোখের ভাষায়। কিন্তু কোনোদিনই সে এগিয়ে গিয়ে কথা বলে না, কোনোদিনই সে নাম জিজ্ঞাসা করে না। কারণ হয়তো কথার প্রয়োজন নেই। অয়ন আর মেহের—দু’জন দুই জগতের মানুষ, অথচ লোকালের ভিড়ের ভেতর তারা তৈরি করেছে নিজেদের এক গোপন জগৎ, যেখানে শব্দের কোনো অস্তিত্ব নেই, আছে কেবল চোখের ইশারা। আর প্রতিদিনের শেষ লোকাল ট্রেন হয়ে ওঠে সেই জগতের সেতু। এভাবেই শুরু হয় এক নীরব, অথচ গভীর সম্পর্ক—যার কোনো নাম নেই, কোনো সংজ্ঞা নেই, তবুও যা প্রতিদিন দু’জনের জীবনকে অদ্ভুতভাবে ছুঁয়ে যায়।

দিনগুলি চলতে থাকে নিজেদের মতো। সময়ের চাকায় বাঁধা মানুষজন ভোরে ওঠে, কাজের জাঁতাকলে ঘোরে, সন্ধ্যায় ক্লান্ত শরীর টেনে ফেরে, আর রাত নামলে আবার ঘরে পৌঁছনোর জন্য শেষ লোকালে ভিড় জমায়। এই ভিড়ের ভেতরে অয়ন আর মেহের একে অপরের সঙ্গী হয়ে ওঠে, যদিও একে অপরের নামটুকুও জানে না। প্রথম কয়েকদিন অয়ন ভেবেছিল—হয়তো মেয়েটি কেবলই এক অচেনা মুখ, আজ আছে কাল থাকবে না। কিন্তু সপ্তাহ পেরোতেই সে বুঝল, এ তো নিত্য অভ্যাসে ঢুকে গেছে। তার চোখ স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুঁজে নেয় জানালার ধারে সেই সিটটিকে, যেখানে মেয়েটি বসে থাকে বই হাতে বা চুপচাপ জানালার বাইরের অন্ধকারে তাকিয়ে। আশ্চর্যের বিষয়, তার উপস্থিতি ভিড়ের একঘেয়েমিকে ভেঙে দেয়, আর এক অদ্ভুত স্থিরতা এনে দেয় অয়নের ভেতরে। আগে অয়ন হয়তো ভিড়ে বিরক্ত হতো, ঠেলাঠেলি দেখে রেগে যেত, কিন্তু এখন যেন সেই সবকিছু ছাপিয়ে আছে এক জোড়া চোখ। মাঝেমাঝে দু’জনের দৃষ্টি মিলে যায়, কখনো দীর্ঘক্ষণ, কখনো হঠাৎ এক ঝলক। একে অপরকে চেনার কোনো আনুষ্ঠানিকতা নেই, তবুও অয়ন অনুভব করে—এই নীরব দৃষ্টির ভেতরেই এক অদ্ভুত বন্ধন তৈরি হচ্ছে।

মেহেরও সেই নীরবতার ভাষা বুঝতে শুরু করেছে। সে ভিড়ের মধ্যে নিজেকে আলাদা রাখতে ভালোবাসে—বই তার সঙ্গী, কখনো গান শোনে, কখনো শুধু জানালার বাইরে ঝাপসা আলো দেখার ভান করে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে জানে, কামরার এক কোণে বসে থাকা ছেলেটি প্রতিদিন তার দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রথম প্রথম বিষয়টা তাকে কৌতূহলী করে তুলেছিল, পরে অদ্ভুতভাবে স্বস্তিও দিতে শুরু করল। লোকাল ট্রেনে প্রতিদিন কতজন আসে, কতজন যায়—কেউ কারো দিকে তাকায় না, সবাই ব্যস্ত নিজের দুনিয়ায়। অথচ সেই ভিড়ের মাঝেও কারো চোখ তাকে খুঁজে নেয়। অচেনা ছেলেটির মুখে কোনো কৌতুক নেই, কোনো অশালীন দৃষ্টি নেই—শুধু একরকম নিঃশব্দ শান্তি। মাঝেমাঝে যখন তাদের দৃষ্টি এক হয়, মেহেরের মনে হয়—কোনো কথা না বলেও কি বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে? এমন বন্ধুত্ব যা না বলেই বোঝা যায়? একদিন হঠাৎ সে খেয়াল করল, ছেলেটি একটু ক্লান্ত দেখাচ্ছে। অজান্তেই তার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। আশ্চর্যভাবে ছেলেটিও তাকিয়ে হালকা হাসল। সেই হাসি ছিল নিঃশব্দে বিনিময় করা এক গোপন স্বীকৃতি—হ্যাঁ, তারা একে অপরকে চেনে, যদিও কোনো নাম বা ঠিকানা জানে না।

এভাবেই সময় বয়ে যায়, দিনগুলো একে অপরের গায়ে মিশে যেতে থাকে। কখনো সেদিন ভিড় কম হলে তারা অনেকক্ষণ চোখে চোখ রাখে, কখনো ভিড় বেশি হলে কেবল পাশ কাটিয়ে যাওয়া দৃষ্টিই যথেষ্ট। অথচ সেই সামান্য মুহূর্তগুলোই হয়ে ওঠে পুরো দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি। অয়ন অফিসের চাপ, সহকর্মীদের কোলাহল, বা বাড়ির একাকিত্ব সবকিছু ভুলে যায় শুধু এই নীরব বন্ধুত্বের জন্য। মেহেরও নিজের জীবনের নীরস দিনগুলোর মাঝে এই অচেনা বন্ধুর উপস্থিতি অনুভব করে। কোনো ফোন নম্বর নেই, কোনো বার্তা নেই, কিন্তু প্রতিদিনের লোকাল ট্রেন হয়ে ওঠে তাদের দেখা করার একমাত্র মাধ্যম। ধীরে ধীরে তারা বুঝতে শেখে—কথা বলার দরকার নেই সবসময়, সম্পর্ক অনেক সময় শুধু নীরবতা দিয়েও তৈরি হয়। চোখের ভাষাই হয়ে ওঠে তাদের মেলবন্ধনের সেতু। এই নীরব বন্ধুত্বই একদিন নতুন যাত্রার পথে নিয়ে যাবে দু’জনকে, যদিও তখনও কেউ জানে না সে যাত্রা কেমন হবে।

অয়ন একদিন বাড়ি ফেরার পথে অদ্ভুতভাবে নিজের ভেতরের প্রশ্নগুলোর সঙ্গে মুখোমুখি হল। লোকালের কামরার কোলাহল, চিৎকার, হকারদের ডাক—সবকিছুই প্রতিদিনের মতোই ছিল, কিন্তু তার ভেতরে যেন অন্য এক তরঙ্গ বইছিল। কেন সে প্রতিদিন মেয়েটির জন্য অপেক্ষা করে? কেন ভিড়ের শত শত মুখের মধ্যে কেবল ওই এক জোড়া চোখকে খুঁজে নেয়? অয়ন আগে কখনো কাউকে নিয়ে এতটা ভাবেনি। কলেজজীবনে কিছু বন্ধুত্ব হয়েছিল, হালকা প্রেম-প্রেম খেলা হয়েছিল, কিন্তু তা গভীরে পৌঁছয়নি। আর চাকরি শুরু হওয়ার পর থেকে তো জীবনই হয়ে গেছে নিঃশব্দে টানা একরকম ছন্দ—অফিস, ফাইল, মিটিং, ম্যানেজারের ধমক, তারপর ক্লান্ত দেহ নিয়ে ট্রেন ধরে বাড়ি ফেরা। মাঝে মাঝে মনে হয়—সে যেন এক যন্ত্রে পরিণত হয়েছে, যেখানে আবেগ বা কৌতূহলের কোনো জায়গা নেই। অথচ এই মেয়ে—যার নামও সে জানে না—তার ভেতরে এমন এক আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে, যা সে বোঝাতে পারে না। প্রতিদিন সেই আলোই তাকে ক্লান্তি থেকে উদ্ধার করে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্ন জেগে ওঠে—এ কি শুধুই অস্থায়ী এক বিভ্রম, নাকি সত্যিই কোনো সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে? সে ভাবতে থাকে, “অচেনা একজনের সঙ্গে কি সত্যিই কোনো সম্পর্ক তৈরি হতে পারে? নাকি এটা কেবল আমার মনঘটিত কল্পনা?” এই দ্বন্দ্ব তাকে প্রতিদিন ভোগায়, তবুও প্রতিদিন আবার লোকালে ওঠে মেয়েটির দেখা পাওয়ার আশায়।

অয়নের মনের ভেতর চলতে থাকে একরকম টানাপোড়েন। একদিকে সে ভেবেই পায় না, কেন এমন অনুভূতি হচ্ছে; অন্যদিকে এক অদ্ভুত ভয় কাজ করে তার ভেতরে। যদি একদিন মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে চায়, আর সে বিরক্ত হয়ে যায়? যদি সে ভাবে—এই ছেলেটি হয়তো তাকে অযথা অনুসরণ করছে? আবার কখনো মনে হয়, হয়তো মেহের (যদিও নাম তখনও জানে না) তাকেও খেয়াল করে। মাঝে মাঝে তাদের চোখে চোখ পড়ার সেই ক্ষণিক মুহূর্তে সে একধরনের আশ্বাস টের পায়, যা অন্য কোথাও পায়নি। কিন্তু আবার সেই সাহস জোগাড় করতে পারে না। ছোটবেলায় তার বাবা একবার বলেছিলেন—“জীবনের সবকিছু ঝুঁকি নিয়ে পাওয়া যায় না, কিছু কিছু জিনিস নিজের সময়েই ঘটে।” হয়তো তাই, হয়তো সময় আসলে কথা বলার সাহস আসবে। কিন্তু তবুও প্রতিদিন ট্রেনে ওঠার আগে তার বুকের ভেতর একরকম অস্থিরতা তৈরি হয়। সেদিন যদি মেয়েটিকে না পায়? সেদিন যদি ভিড়ের মধ্যে চোখ মেলে না তাকায়? সেই অস্থিরতাই যেন প্রমাণ করে দেয়—এই নীরব সম্পর্ক কেবল কল্পনা নয়, বরং অয়নের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠছে।

অয়ন অনেক রাতে বিছানায় শুয়ে নিজের দিনটিকে মনে করে। অফিসের চাপ, ম্যানেজারের বকুনি, সহকর্মীদের ফাঁকা আড্ডা—সবকিছুর মধ্যে কোনো আনন্দ খুঁজে পায় না। কিন্তু ট্রেনের সেই অল্প কয়েক মিনিট, যখন মেয়েটিকে দেখে, তখন যেন মনে হয় জীবনে সত্যিই কিছু বাকি আছে। অয়ন ভাবে, যদি কোনোদিন মেয়েটি ট্রেনে না ওঠে? সেই ভয়েই সে কেঁপে ওঠে। মনে হয় যেন পুরো পৃথিবী হঠাৎ শূন্য হয়ে যাবে। অথচ সে কোনোদিনই চেষ্টা করেনি কথা বলার। নিজের অস্থিরতা সে বোঝে, কিন্তু আবার নিজেকে থামায়—“না, এভাবে হুট করে এগোনো ঠিক নয়। এ নীরবতা হয়তো একধরনের সৌন্দর্য, যেটা কথার ভিড়ে ভেঙে যাবে।” আবার কখনো মনে হয়—কথা না বললে কিভাবে জানবে, এই সম্পর্কের কোনো মানে আছে কি না? অয়ন দ্বন্দ্বে ভোগে—এগিয়ে যাবে, নাকি এই নীরব বন্ধুত্বকেই আঁকড়ে ধরবে। তার জীবন এতটাই একঘেয়ে, এতটাই ক্লান্তিকর যে, এই ক্ষণিকের দৃষ্টিই হয়ে উঠেছে মুক্তির জানালা। ভেতরে ভেতরে সে বুঝে যায়—এই মেয়েটিই তার নিঃশব্দ যাত্রার একমাত্র আলোর রেখা। আর সেই আলোকে আঁকড়ে ধরেই শুরু হচ্ছে তার ভেতরের সত্যিকারের যাত্রা।

মেহেরের ভেতরের জগৎটা বাইরে থেকে যেরকম শান্ত, ভদ্র, আর অতি সাধারণ বলে মনে হয়, ভেতরে তার চিত্র একেবারেই অন্যরকম। বহুদিন ধরেই সে একরকম নিজের চারপাশে এক অদৃশ্য প্রাচীর তৈরি করেছে—যেন মানুষজন, পরিস্থিতি বা কোনো অনুভূতি আর তাকে স্পর্শ না করতে পারে। শহরের একঘেয়ে শব্দ, হোটেলের বার কাউন্টারে রাতভর দাঁড়িয়ে অতিথিদের হাসিমুখে পরিবেশন করা, ম্লান আলো আর ভিড়ভাট্টার ভেতরও সে সবসময় ভেতরে ভেতরে আলাদা থেকেছে। বাইরে থেকে সবাই ভাবে, মেহের হয়তো বেশ দৃঢ়চেতা, মজবুত একজন মেয়ে—যে নিজের দায়িত্ব চুপচাপ সামলে নিতে জানে। কিন্তু বাস্তবে তার ভিতর জুড়ে আছে এক অদ্ভুত শূন্যতা। তার কাছে জীবনটা যেন একটানা ক্লান্তি—প্রতিদিনের পুনরাবৃত্তি, যেখানে না আছে আনন্দ, না আছে আশা। এই শূন্যতার পেছনে লুকিয়ে আছে অতীতের এক ইতিহাস, এমন এক বেদনা যা সে কারো সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারে না। কখনো সে মনে করে, হয়তো জীবনে কোনো অপূর্ণ প্রেম থেকে গেছে, হয়তো কোনো স্বপ্নপূরণ হয়নি, অথবা হয়তো পরিবার কিংবা সমাজের বাঁধনে তার ভেতরের অনেককিছুই চেপে গেছে। সে জানে না কবে থেকে শুরু হলো এই নীরব বেঁচে থাকা, কিন্তু এতদিনে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে—হাসি দিয়ে কথা বলা, কিন্তু অন্তরে প্রতিটি হাসির আড়ালে গভীর ক্লান্তি লুকিয়ে রাখা।

এই মানসিক অবসাদ আর নীরবতার ভেতরেই একদিন হঠাৎ তার চোখে পড়ে ছেলেটিকে—সাহিত্যপ্রেমী, নির্লিপ্ত অথচ ভেতরে ভেতরে কেমন অস্থির এক মানুষ। প্রথমবার দেখা হওয়ার সময় থেকেই তার চোখের ভেতর যেন কোনো এক অদ্ভুত সত্য মেহেরকে টেনে নেয়। ছেলেটির দৃষ্টিতে সে খুঁজে পায় এমন এক নিঃশব্দ আশ্বাস, যেটা এতদিন ধরে সে কারো কাছ থেকে পায়নি। কিন্তু আশ্বাস পেলেও মেহের যেন দ্বিধায় ভোগে। এতদিন ধরে সে যে প্রাচীর তৈরি করে রেখেছে, সেটা কি এত সহজে ভাঙা যায়? সমাজ, দায়িত্ব, অতীতের অভিজ্ঞতা—সব মিলে সে যেন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে, সামনে এগোতে চায় অথচ সাহস পায় না। নিজের মনের এই দোটানা সে কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারে না। বার কাউন্টারে দাঁড়িয়ে থাকলেও যখন চোখে পড়ে ছেলেটিকে, মনে হয় কিছু একটা তার ভিতরে নড়ে উঠছে—কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই সে আবার নিজের মুখোশ পরে নেয়। মেহের জানে, কারো সামনে দুর্বল হয়ে পড়লে হয়তো তাকে আবার আঘাত পেতে হবে, হয়তো আবার হারাতে হবে কাউকে। তাই সে সবসময় দূরত্ব বজায় রাখে, ভেতরে যতই টান অনুভব করুক না কেন। এই টানাপোড়েনেই তার ভেতরের চরিত্র গড়ে ওঠে—একদিকে আকর্ষণ আর অন্যদিকে ভয়, একদিকে নতুন সম্ভাবনা আর অন্যদিকে পুরনো ক্ষতের তীব্র স্মৃতি।

তবে এই টানাপোড়েনই মেহেরকে ভেতরে ভেতরে নতুন করে চিনতে শেখায়। ছেলেটির চোখে প্রতিদিন একটু একটু করে সে নিজের অন্যরকম এক রূপ খুঁজে পেতে শুরু করে—একটা রূপ যেখানে সে আর শুধু একঘেয়ে জীবনের যান্ত্রিক চরিত্র নয়, বরং একজন নারী যার নিজের অনুভূতি আছে, স্বপ্ন আছে, আকাঙ্ক্ষা আছে। অথচ তার ভেতরের দ্বিধা তাকে বারবার আটকে দেয়। মেহের বোঝে, যদি একদিন সে সাহস করে এই প্রাচীর ভেঙে বাইরে আসে, তাহলে হয়তো জীবনটা আবার নতুন করে শুরু হতে পারে। কিন্তু সেই সাহসের জায়গাটা সে এখনও খুঁজে পায়নি। ছেলেটি তার সামনে দাঁড়িয়ে থেকেও তার কাছে ধাঁধা হয়ে থাকে—এমন এক ধাঁধা, যার সমাধান করতে হলে আগে নিজেকেই উন্মুক্ত করতে হবে। কিন্তু নিজের অন্তর্জগৎ খুলে দেখানোর মানে, নিজের ক্ষত, নিজের দুঃখ, নিজের অতীত—সবকিছু সামনে আনা। আর সেটাই মেহেরের সবচেয়ে বড় ভয়। তাই সে নীরব থেকে যায়, নিজেকে আড়ালেই রাখে। অথচ ভেতরে ভেতরে প্রতিদিন সে বুঝতে পারে—এই নিরস জীবনের ভেতরে ছেলেটি যেন একরকম আলো, যাকে সে যতই এড়িয়ে যেতে চায়, ততই সে তার ভেতরে প্রবেশ করে যাচ্ছে। এই আলো একদিন হয়তো মেহেরের সমস্ত অন্ধকারকে সরিয়ে দিতে পারবে, কিন্তু সেই মুহূর্ত আসা পর্যন্ত মেহের শুধু নিজের ভেতরের নিঃসঙ্গতার সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যায়, আর প্রতিদিন নতুন করে প্রশ্ন করে—সে কি কখনো নিজের এই প্রাচীর ভেঙে বাইরে আসতে পারবে?

প্রথম কয়েকদিন অয়ন ভেবেছিল হয়তো কাকতালীয় ঘটনা—কোনো কারণে মেহের আসতে পারেনি। সকালবেলা ট্রেনের ধোঁয়ায় মিশে যাওয়া প্ল্যাটফর্মের কোলাহলের মধ্যে তার চোখ বারবার সেই একই জায়গায় খুঁজত, যেখানে নীরবে বসে মেহের বই পড়ত বা বাইরে তাকিয়ে জানলার ফাঁক দিয়ে ভেসে যাওয়া পৃথিবীকে দেখত। সেদিনও ভিড় ঠেলাঠেলির মধ্যেই অয়ন উঠে বসে, কিন্তু পাশে যে সিটটি গত কয়েক মাস ধরে প্রতিদিন তার জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল, তা খালি পড়ে রইল। প্রথমে সে অস্বস্তি চাপা দিয়ে নিজের মতো বই পড়তে চেয়েছিল, কিন্তু পাতা উল্টানো চলছিল অথচ তার মনের ভেতরে অদ্ভুত এক শূন্যতা জমতে থাকল। এ যেন কোনো প্রিয় গান মাঝপথে থেমে যাওয়ার মতো, কোনো আড্ডায় প্রিয়জন হঠাৎ উঠে চলে যাওয়ার মতো। কারও সঙ্গে একটিও কথা না বলে যে সম্পর্ক তৈরি হতে পারে, যে সম্পর্ক চোখের দৃষ্টি বা আড়ালে ছোঁয়া হাসিতে প্রতিদিন নতুন মাত্রা পায়—তার অনুপস্থিতিই তাকে প্রথমবার বুঝতে দিল সেই নীরব বন্ধনের ওজন কতটা গভীর। প্রথম দুই-তিন দিন অয়ন এই শূন্যতাকে কাকতালীয় ভাবেই দেখেছিল, কিন্তু দিন যত গড়াল, তার মন ততই অস্থির হয়ে উঠল।

পাঁচদিন পরে অয়নের ভেতরে একরকম অস্বীকার করার মতো অনুভূতি জন্মাল। কেন সে মেহেরকে এতটা খুঁজছে? কেন মনে হচ্ছে যে সে এক অচেনা মেয়েকে হারিয়েছে, যে কিনা তার নামও জানে না? প্রতিদিনের ভিড়ভাট্টার সেই ট্রেন এখন তার কাছে এক অদ্ভুত নির্জন জায়গা হয়ে উঠেছে। কোলাহলের ভেতরেও তার মনে হচ্ছিল—কিছু নেই, কিছু কম। প্রতিটি সকাল মানেই যেন অদ্ভুত এক প্রতীক্ষা আর প্রতিদিনের সেই খালি সিট তাকে নির্লিপ্তভাবে মনে করিয়ে দিচ্ছিল যে তার জীবন থেকে অজান্তেই একটা রঙ মুছে গেছে। হঠাৎ সে খেয়াল করল, ট্রেন থেকে নামার পর অফিসের কাজেও মন বসছে না, সহকর্মীদের সঙ্গে কথোপকথনও অন্যমনস্কভাবে করছে। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আড্ডা কিংবা টেলিভিশন সবকিছুই একরকম শূন্য শূন্য লাগছে। তখন সে উপলব্ধি করল—মেহেরের উপস্থিতি নিছক একটি অভ্যাস ছিল না, বরং তার দিনযাপনের এক নীরব অংশ হয়ে গিয়েছিল। মানুষের জীবনে কিছু সম্পর্ক কথাবার্তা বা সামাজিক স্বীকৃতি ছাড়াই জন্ম নেয়, আর সেটাই যখন হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যায় তখন ভিতরে ভিতরে অসহ্য শূন্যতা তৈরি করে।

অয়ন চেষ্টা করেছিল নিজেকে বোঝাতে—হয়তো মেহের অন্য রুটে ট্রেনে উঠছে, হয়তো অফিস বদলেছে, হয়তো অসুস্থ। কিন্তু মন তার সেসব যুক্তি মানতে চাইছিল না। বরং যতই সে যুক্তি খাড়া করছিল, ততই তার হৃদয়ের অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছিল। সে ভাবতে শুরু করল—এমন কি সম্ভব, যে মেহের আর কোনোদিন ফিরবে না? এই চিন্তাই তাকে ভীষণ ব্যথিত করে তুলল। ট্রেনের ভিড়ভাট্টার মাঝে হঠাৎ শূন্য হয়ে থাকা একটি সিট এতটা অস্থিরতা আনতে পারে—এটা আগে সে কখনও কল্পনাও করেনি। নীরব সম্পর্কও কতটা প্রগাঢ়, তা সে প্রথমবার উপলব্ধি করল। প্রতিটি সকালের যাত্রা তার কাছে একেকটা অনিশ্চয়তার খেলা হয়ে দাঁড়াল—আজ কি আবার দেখা হবে, না কি চিরদিনের মতো অদৃশ্য হয়ে গেল? প্রতিদিন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে অয়ন চোখ মেলে তাকাত, আশায় বুক বাঁধত যে হয়তো হঠাৎ একদিন ভিড়ের মধ্যে পরিচিত মুখটা দেখা যাবে, জানলার পাশে বসে আবার সেই নীরব সংযোগ ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু প্রতিদিনই সে ফিরে আসত শূন্যতার হাতে বন্দি হয়ে, আর প্রতিদিনই সে একটু একটু করে বুঝতে থাকল—জীবন কত সহজেই এক অচেনা মানুষকেও প্রয়োজনীয় করে তোলে। সেই অভাব, সেই নিঃশব্দ বেদনা অয়নের ভেতরে এক নতুন অস্থিরতার জন্ম দিল, যা তাকে নিজের সঙ্গে নতুন এক যুদ্ধে নামিয়ে দিল—এই সম্পর্ক আসলে কী, আর তার জীবনে মেহেরের মানে কী।

অয়ন যখন প্রথমবার উপলব্ধি করল যে মেয়েটির হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাওয়া কেবলমাত্র তার কৌতূহলের সীমাবদ্ধ প্রশ্ন নয়, বরং তার নিজের ভেতরের এক অস্থিরতার প্রতিধ্বনি, তখন থেকেই সে আর চুপ করে বসে থাকতে পারল না। অফিসে বসে প্রতিদিনকার নিরস ফাইলের স্তূপ আর কম্পিউটারের আলোতে চোখ আটকে থাকলেও তার ভেতরে অন্য এক আলো জ্বলে উঠছিল—অস্থির, অধরা, কিন্তু প্রাণবন্ত। কাজের ফাঁকে সে স্কুলে ফোন করে জানতে চায়, মেয়েটির সম্পর্কে কোনো খোঁজ পাওয়া যায় কি না। ফোনের ওপাশে কেবল অব্যক্ত নীরবতা আর নিয়মমাফিক উত্তরের কাঠিন্য—“এখানে নতুন ভর্তি হয়েছে অনেক, আপনি কার কথা বলছেন ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।” কিন্তু অয়ন থেমে যায় না। অফিস থেকে বেরিয়ে সে কয়েকবার স্কুলের সামনের রাস্তায় দাঁড়ায়, যেখানে প্রথম তাকে দেখেছিল, সেই হাসির ভেতরকার রহস্য এখন যেন তার কাছে কোনো অদৃশ্য ডাক হয়ে ওঠে। রিকশাওয়ালাদের, চায়ের দোকানের আড্ডাখোরদের জিজ্ঞেস করতে শুরু করে সে—“এখানে কি কোনো নতুন মেয়েকে দেখেছেন?”—কেউ হাসে, কেউ অবজ্ঞা করে বলে, “দাদা, কতজন আসে-যায়, কে কাকে মনে রাখে?” তবুও অয়ন বুঝতে পারে, সে যে খুঁজছে, তা আর কেবল একজন অচেনা মেয়েকে খোঁজা নয়—সে খুঁজছে নিজের নতুন এক রূপকে, যাকে আগে কখনো চিনত না।

এই খোঁজের ভেতরে ঢুকে যেতে যেতে অয়ন উপলব্ধি করতে শুরু করল, তার জীবনের এতদিনকার একঘেয়েমি আসলে তাকে কতটা নিস্তেজ করে রেখেছিল। অফিস, মেট্রো, ফ্ল্যাটের চার দেওয়াল—এই ছিল তার দুনিয়া। এখন প্রথমবারের মতো সে বেরিয়ে এসে মানুষের চোখে চোখ রাখছে, প্রশ্ন করছে, তাদের গল্প শুনছে। ট্রামের ভেতরে হঠাৎই সে এক বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করে বসে—“আপনি কি কখনো এমন কাউকে খুঁজেছেন, যাকে আগে এক ঝলক দেখেছিলেন, আর তারপর হারিয়ে ফেলেছিলেন?” বৃদ্ধ প্রথমে হেসে ওঠে, তারপর নিঃশব্দে জানালার বাইরে তাকিয়ে বলে, “হ্যাঁ, খুঁজেছি। হয়তো সবাই খোঁজে।” এই কথাটাই অয়নের মধ্যে নতুন এক উপলব্ধি জাগিয়ে তোলে—সে একা নয়, তার খোঁজ আসলে মানবজীবনেরই চিরন্তন আকাঙ্ক্ষার অংশ। আর এই আকাঙ্ক্ষাই তাকে টেনে নিয়ে যায় শহরের অলিগলিতে, বইয়ের দোকানে, এমনকি পুরোনো সিনেমা হলের সামনে, যেখানে সে ভাবে হয়তো সেই মেয়েটি কোনোদিন হেঁটে গেছে। তার খোঁজ আর শুধুমাত্র তথ্যসংগ্রহ নয়, হয়ে উঠছে এক ধরণের অনুসন্ধান—যেন সে নিজের অজান্তেই শিখছে কীভাবে মানুষকে চেনা যায়, কীভাবে নিজের অনুভূতিকে শব্দে বাঁধা যায়।

অবশেষে অয়ন বুঝতে পারে, তার খোঁজ শুধু বাইরের নয়, ভেতরেরও। যে অয়ন এতদিন কোনো কিছু নিয়েই উত্তেজিত হয়নি, নিজের ইচ্ছাকে সবসময় শৃঙ্খলার বেড়াজালে বেঁধে রেখেছে, সেই অয়ন এবার ভিন্ন। অফিসের সহকর্মীরা খেয়াল করে, সে আগের মতো নির্লিপ্ত নেই; চোখে একটা অদ্ভুত আলো, কথাবার্তায় একটা অস্থিরতা। রাতে ঘরে ফিরে সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবে—“আমি কি আসলেই তাকে খুঁজছি, নাকি আমি খুঁজছি আমাকে?” উত্তর মেলে না, কিন্তু সেই অস্থিরতাই তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় সামনে এগোতে। মেয়েটি কে, কোথায় গেল, আদৌ কি আবার দেখা হবে—এসবের কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু খোঁজার এই যাত্রাপথই তার জীবনের প্রথম সক্রিয় পদক্ষেপ, যা তাকে বাইরে নয়, ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে। নিজের ভেতরের নিস্তেজতা থেকে জেগে ওঠা, নিজের অনুভূতির সঙ্গে সত্যিকার অর্থে পরিচয় হওয়া—এই নতুন যাত্রা শুরু হয়েছে, যার প্রথম পদক্ষেপই হল সেই এক ঝলক দেখা অচেনা মেয়েটির রহস্যময় ছায়া।

ট্রেনের কামরার জানালা দিয়ে ভেসে আসা হাওয়ার শব্দের মধ্যে সেদিনের আলোটা যেন ভিন্ন ছিল। শেষ লোকালটা ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল, কিন্তু অয়ন আর মেহেরের সময় যেন থেমে গিয়েছিল কোথাও। এতদিন ধরে প্রতিদিন এই ট্রেনের কামরায় দেখা হতো, হয়তো কোনোদিন কথাবার্তা বেশি হতো, কোনোদিন শুধু চোখাচোখি। তবুও অজান্তে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, যা এই রাত্রিবেলা, হেডলাইটের হলদে ঝলক আর চাকার ঠকঠক শব্দের ভিতর জন্ম নিয়েছিল। অয়ন ভেবেছিল হয়তো এই গল্প এখানেই শেষ হয়ে যাবে—শেষ লোকালই শেষের প্রতীক হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু সেদিন মেহেরের কণ্ঠে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা ছিল, সে বলেছিল—“আমি প্রতিদিন নাও আসতে পারি, কিন্তু চাইলে আমরা ট্রেনের বাইরেও দেখা করতে পারি।” কথাটা শুনে অয়নের বুকের ভেতর যেন হঠাৎ আলো জ্বলে উঠল। এতদিন ধরে সে যে দ্বিধা, অনিশ্চয়তা, নিঃশব্দ ভালোবাসা লুকিয়ে রেখেছিল, তার সবটা যেন মুছে গেল মুহূর্তেই। সে হাসল—একটা খোলা, উজ্জ্বল, স্বতঃস্ফূর্ত হাসি, যেখানে ছিল স্বপ্নের আভা, ভবিষ্যতের ইঙ্গিত আর অদৃশ্য এক প্রতিশ্রুতির ছাপ। মেহেরও যেন বুঝতে পারল, এই লোকাল ট্রেনটা আর শুধু যাত্রার মাধ্যম নয়, হয়ে উঠেছে তাদের জীবনের প্রথম অধ্যায়ের প্রতীক। কামরার জানালা দিয়ে রাতের অন্ধকার এগিয়ে আসছিল, কিন্তু তাদের চোখে জ্বলছিল আলো—যেন শুরু হলো কোনো নতুন ভোর।

সেদিনের যাত্রা শেষ হওয়ার পরেও অয়ন আর মেহেরের মনে হলো, যেন তাদের গল্প শুরু হলো কেবলমাত্র। প্ল্যাটফর্মে নেমে দু’জন পাশাপাশি হাঁটছিল, লোকজনের ভিড়, ঘোষণার আওয়াজ, ট্রেন ছাড়ার সিটি—সব মিলিয়ে এক বিশৃঙ্খলার মাঝেও তাদের মনে হচ্ছিল যেন চারপাশে গভীর নীরবতা। একে অপরের উপস্থিতি সেই ভিড়কে অতিক্রম করে এক অদ্ভুত শান্তি এনে দিয়েছিল। মেহের বলছিলো, “জীবন তো সবসময় নিয়মে চলে না, সবসময় ঠিক সময়ে সব কিছু পাওয়া যায় না। তবে যদি ইচ্ছে থাকে, তবে দেখা করার অজুহাত খুঁজে নেওয়া যায়।” অয়ন মন দিয়ে শুনছিল, আর বুঝছিল—এমন একজন মানুষের হাত ধরা মানে কেবল সম্পর্ক নয়, জীবনের এক নতুন আশ্বাস পাওয়া। এই সহজ অথচ শক্তিশালী কথাগুলো তার মনে অনুরণন তুলছিল। এতদিন ধরে যে ভয়, যে সংকোচ তাকে আটকে রেখেছিল, সেগুলো যেন ট্রেনের শব্দের মতোই মিলিয়ে যাচ্ছিল দূরে। মেহেরের চোখে এক অদ্ভুত নিশ্চিন্ততা ছিল, যেন সে জানে—জীবন যত ব্যস্ততাই দিক না কেন, দু’জন মানুষের ইচ্ছা যদি সত্যি হয়, তবে দূরত্ব কখনো আলাদা করতে পারে না। অয়ন এই নিশ্চিন্ততার মধ্যে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করছিল—একটা বন্ধন, একটা সহযাত্রা, যা কোনো ট্রেনের সময়সূচির ওপর নির্ভরশীল নয়, বরং হৃদয়ের সংযোগে তৈরি।

শেষ লোকাল ট্রেনের প্রতীক হয়ে ওঠা এই মুহূর্তটা ছিল এক অসাধারণ উপলব্ধির। অয়ন বুঝল, প্রতিটি যাত্রারই একটা গন্তব্য থাকে, কিন্তু কিছু যাত্রা গন্তব্যে পৌঁছে শেষ হয় না—বরং নতুন পথের শুরু হয়। শেষ লোকাল তাদের কাছে শুধু একটা ট্রেন নয়, হয়ে উঠল এক প্রতীক—সময়কে ছাড়িয়ে যাওয়া সম্পর্কের প্রতীক। রাতের আকাশে তারা ভরে উঠছিল, যেন সাক্ষী দিচ্ছিল এই নতুন সূচনার। অয়ন যখন মেহেরের দিকে তাকাল, তখন দেখল তার চোখে কোনো দ্বিধা নেই, শুধু এক অসীম আস্থা। সেই চোখে যেন এক ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি লুকিয়ে আছে। মেহেরের কথাগুলো তার মনে গেঁথে রইল—“আমি প্রতিদিন নাও আসতে পারি, কিন্তু চাইলে আমরা দেখা করব, কথা বলব, একসাথে থাকব।” এ এক অদ্ভুত অনুভূতি—যেন শেষ লোকাল তাদের জীবনের দরজা খুলে দিয়েছে নতুন ভোরের দিকে। কামরার ভেতরকার ঠকঠক শব্দ, প্ল্যাটফর্মের কোলাহল, রাতের আকাশ—সব মিলিয়ে তৈরি করল এক স্মৃতি, যা থেকে যাবে সারাজীবন। অয়ন হাসল, আর সেই হাসিতে ছিল না কোনো দ্বিধা, না কোনো ভয়—ছিল শুধু বিশ্বাস আর ভালোবাসার আলো। শেষ লোকাল এবার আর শুধু গন্তব্য নয়, হয়ে উঠল সত্যিকারের সম্পর্কের শুরু, এক অনন্ত যাত্রার প্রতীক।

***

1000058874.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *