অরিত্রা মৈত্র
ভোরের প্রথম কুয়াশা যখন মাঠের উপর ধোঁয়ার মতো বসে থাকে, তখন কাঁসার ঘরে একটা ঝমঝম শব্দ শোনা যায়। যেন ভোর নিজেই ধাতুর গায়ে হাত বুলিয়ে তাকে জাগিয়ে দিচ্ছে। সেই শব্দের উৎস—হরিপদ কর্মকার, দক্ষিণ ভাদুরিয়া গ্রামের প্রাচীনতম কাঁসারু। তার হাতের চেটো আর আঙুলে শক্তি কমে এলেও, যন্ত্রণা বা ক্লান্তি তাকে থামাতে পারেনি। তার ঘরে আলো জ্বলে মাটির প্রদীপে, আর চোখে জ্বলে এক অবিনশ্বর দীপ্তি—সংগ্রামের, টিকে থাকার, আর আত্মসম্মানের।
তার ছেলে অনিমেষ তখনো বিছানায়, কিন্তু সেই ঝমঝম শব্দ তার ঘুমের অংশ হয়ে গেছে। এ শব্দ তার শৈশবের লোরি, আর ভবিষ্যতের দিশা। প্রতিদিন এই শব্দেই সে জাগে। কখনো কখনো স্বপ্নেও সে দেখে, যেন কাঁসার ভেতরে তার নিজের কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হচ্ছে, “তুই পারবি, অনিমেষ!”
অনিমেষের বয়স তখন তেরো। মধ্যবিত্ত নয়, গরিবও নয়—তাদের অবস্থান এক অনির্দিষ্ট রেখায় দাঁড়ানো। স্কুলের পোশাক তার মামার দেওয়া পুরনো হাফ-প্যান্ট, আর জুতোয় ফুটো। স্কুলব্যাগ বলতে মায়ের হাতে সেলাই করা একটা কাপড়ের থলে। কিন্তু চোখে, চোখে তার ছিল অন্য কিছু। এমন কিছু যা এই গ্রামের আর দশটা ছেলের চোখে নেই—প্রশ্ন।
সে প্রায়ই বাবাকে জিজ্ঞেস করত, “বাবা, কাঁসার কাজটা তুমি কেন করো? এত কষ্ট করে গড়ো, কিন্তু দাম তো ঠিকমতো পাও না।”
হরিপদ হাসতেন, সেই হাসিতে মাটির গন্ধ থাকত। বলতেন, “আমরা ধাতু গড়ি না রে, ইতিহাস গড়ি। এই শব্দ, এই ঝমঝম ধ্বনি, এটাই আমাদের পরিচয়।”
তখন অনিমেষ বুঝত না, কিন্তু তার কিশোর হৃদয়ে ঢুকে যেত সেই গর্বের রেণু। প্রতিদিন স্কুল যাওয়ার আগে সে একবার কারখানার খুপরি ঘরটায় ঢুকে বাবার কাজ দেখত। পিতলের পাত, হাতুড়ির শব্দ, আগুনের আঁচ—সব যেন এক অলিখিত পাঠশালা।
স্কুলে অনিমেষ ছিল অদ্ভুত। লেখাপড়ায় ভালো, কিন্তু খেলাধুলোতে পিছিয়ে। তার সবচেয়ে প্রিয় ছিল গণিত। ‘সমস্যা’ শব্দটা শুনলেই তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত। শিক্ষক অরুণবাবু প্রায় বলতেন, “এই ছেলেটার মাথায় জ্যামিতি নেই, জাদু আছে।”
একদিন স্কুলে এক টেস্টে সে পুরো ক্লাসে একমাত্র ফুল-মার্কস পায়। প্রধান শিক্ষক তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“অনিমেষ, তোর চোখে আমি আগুন দেখতে পাচ্ছি। এই আগুনটা জ্বালিয়ে রাখিস। একদিন এই আগুন দিয়ে তুই নিজের ভাগ্য লিখবি।”
সেই রাতে বাড়ি ফিরে সে মাকে বলল, “মা, আমি বড় হয়ে কিছু একটা করব, এমন কিছু, যাতে এই গ্রামের কেউ না বলে, ‘আমরা গরিব বলেই পিছিয়ে পড়েছি।’”
মা তার মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে ছিল। তার চোখে জলের ছোঁয়া ছিল, কিন্তু হাসিটা ছিল ঠিক গঙ্গার মত—নীরব অথচ গভীর।
রাতে খাবার খেতে বসে হরিপদ বলল, “আজ একটু বেশি ভাত খাও, শুনলাম তুই আবার পুরো নম্বর পেয়েছিস। আচ্ছা, তুই বড় হয়ে কি হতে চাস, বলতো?”
অনিমেষ বলল, “আমি এমন কিছু করতে চাই, যাতে সবাই আমায় মনে রাখে। শুধু কাঁসা গড়ে নয়, আমি চাই মস্তিষ্ক দিয়ে দেশ গড়তে।”
হরিপদ এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “তোর মা চায় তুই শিক্ষক হ, আমি চাই তুই বড় অফিসার হ, কিন্তু তুই যা হতে চাস, তোর পথ তুই-ই তৈরি কর।”
কিন্তু সেই পথ এত সোজা ছিল না। শীতের এক সকালে খবর এল, হরিপদ গুরুতর অসুস্থ। তার হাতে একটা পুরনো কাঁসার গামলা তৈরি করতে গিয়ে গভীর ক্ষত হয়েছিল, আর তাতে ইনফেকশন।
অনিমেষ সেই প্রথম বুঝল, জীবন কেবল স্কুলের পাঠ্যবই নয়, বরং জীবনের পরীক্ষার কালি লেখা হয় রক্ত আর ঘামের মিশ্রণে। তিন দিন পরে বাবার হাতের অস্ত্রোপচার হয়। কিছু টাকা সরকারি হাসপাতালে খরচ হয়, কিছু ধার দিতে হয়।
মা এখন দিনমজুরের কাজ নিচ্ছেন, মাঠে ধান কাটছেন। কিন্তু কোনোদিন অনিমেষকে পড়াশোনা বন্ধ করতে বলেননি। উল্টে সন্ধ্যাবেলায় বাতির তেল ফুরিয়ে গেলেও মাটি ঘষে জ্বালানো প্রদীপে আলোর ব্যবস্থা করেছেন।
স্কুলে এখন সবাই জানে অনিমেষের বাড়ির অবস্থা। সহপাঠীরা অনেকেই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। “দেখো, কাঁসারু ছেলের ইংরেজি উচ্চারণ! ম্যালকম ফোর্বস হবে বুঝি!” কেউ কেউ বইয়ে কালি ঢেলে দেয়, কেউ জুতো লুকিয়ে ফেলে।
কিন্তু অরুণ স্যার একদিন ক্লাসে দাঁড়িয়ে বললেন,
“কোনও পাথরেই যত বেশি আঘাত লাগে, সে তত বেশি মসৃণ হয়। অনিমেষই আমাদের ভবিষ্যৎ। সে নিজেই একদিন আমাদের গর্ব হবে।”
এই কথাটা যেন আগুনের শিখায় ঘি ঢেলে দিল। সেই রাতেই অনিমেষ একটা ডায়েরি খুলল। তার প্রথম পাতায় লিখল—
“যে দিন এই গ্রামে কাঁসার শব্দ নয়, কণ্ঠে সম্মানের ধ্বনি উঠবে—সেদিনই আমি সফল হব।”
দিন যায়, রাত যায়। মাধ্যমিক এসে পড়ে সামনে। অনিমেষ জানে, এই একটাই সুযোগ—এই একটাই কাঁসার ঘা, যা তাকে ইতিহাসে উঠিয়ে আনতে পারে। পড়াশোনায় এমন ডুবে যায় যে কাঁসার শব্দ শোনেও সে খাতা থেকে চোখ সরায় না।
পরীক্ষা শেষ হয়। অপেক্ষার দিন। ফলাফল প্রকাশের দিন সকালে সাইকেল নিয়ে সে বাজারে যায়—পত্রিকা আনতে। ঠাণ্ডা হাত, শুকনো ঠোঁট, কিন্তু চোখে আগুন।
হরিপদ তখন উঠোনে বসে, পাশে মাটি কাটা প্রদীপ জ্বলছে। মা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে, মুখে ঠাকুরের নাম।
অনিমেষ পত্রিকা খুলে কাঁপা হাতে দেখে—”জেলায় প্রথম স্থান—অনিমেষ কর্মকার, দক্ষিণ ভাদুরিয়া হাই স্কুল”
সে চুপ করে থাকে। তার চোখ বন্ধ হয়, কিন্তু কান খোঁজে বাবার সেই চেনা শব্দ—কাঁসার ঝমঝম।
আজ হরিপদ নিজেই একখানা কাঁসার থালা নিয়ে বাজাতে থাকে। তার চোখে জল, ঠোঁটে হাসি।
তিনি বললেন, “আজ তোর কাঁসার ধ্বনি আমাদের পরিবারের নয়, গোটা গ্রামের গর্ব।”
আর অনিমেষ, সে বসে থাকে উঠোনে, একমুঠো আলোয় ভিজে, আর মনে মনে ভাবে—এই তো শুরু। শেষ বিকেলের আলো তো এখনই ফুটেছে, সকাল এখনও অনেক দূরে…
***
পত্রিকায় নামটা দেখে অনিমেষ চুপ করে বসে ছিল, যেন শব্দের আঘাতে ওর ভেতরের পৃথিবী হঠাৎ থমকে গেছে। নিজের নাম, নিজের ছবি—কালো কালো অক্ষরে ছাপা হয়ে উঠেছে কাগজের পাতায়, যেন কিশোর বয়সের লুকানো স্বপ্নগুলোকে কেউ টেনে তুলে এনেছে দিনের আলোয়। মাটি থেকে চোখ তুলতে পারছিল না সে, বুকের মধ্যে হাতুড়ির মতো বাজছিল একটা কথা, “এটাই কি শুরু?”
মা তখন দরজার পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে। তার মুখে না ছিল বিস্ময়, না ছিল উল্লাস—ছিল শুধুই একরাশ নিরব প্রশান্তি। যেন এতদিন ধরে মাটির পাত্রে সযত্নে রাখা বীজের অঙ্কুরোদ্গম সে দেখেছে প্রতিদিন, শুধু বাকিরা এখন দেখতে পেল। তিনি শুধু এগিয়ে এসে মাথায় হাত রাখলেন অনিমেষের, আর বললেন, “তুই যেন নিজেকে ভুলে না যাস বাবা, তোর নিজের ছায়াটাকেও চিনে রাখিস।”
সেই সন্ধ্যায় গ্রামে আলো ছিল অন্যরকম। কুয়াশার চাদর সরিয়ে যেন একটা সূর্য হাসছিল দক্ষিণ ভাদুরিয়ার উঠোনে। পঞ্চায়েত প্রধান থেকে শুরু করে মুদির দোকানের মন্টু, সকলেই এসে পড়ল কর্মকারদের বাড়ি। কেউ হাতে লজেন্স, কেউ টিনের কৌটায় সন্দেশ। পরের দিন স্কুলে আনন্দ মিছিল হলো, ব্যানারে বড় অক্ষরে লেখা—“আমাদের অনিমেষ, জেলার গর্ব।”
কিন্তু অনিমেষ জানত, এই স্বীকৃতি শুধু গন্তব্য নয়, এটা একটাই প্রমাণ—সে পারলে পারে, তার মতো হাজারজন পারবে, যদি আগুনটা চোখে জ্বলে থাকে।
পরীক্ষার পরে কয়েক সপ্তাহ ছিল মিশ্র অনুভূতির সময়। বাবার হাতের ক্ষত ধীরে ধীরে সেরে উঠছে, মায়ের মুখে ক্লান্তি কমলেও, শরীরের ভার কিছুটা বেড়েছে। অনিমেষ বুঝে গিয়েছিল, এখন আর শুধু পড়াশোনাই তার কাজ নয়—এখন সংসারের হিসেবেও তাকে জুড়ে যেতে হবে।
সে প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে সন্ধ্যাবেলায় গ্রামের বাচ্চাদের পড়াতে বসে যেত। নাম ছিল “আলো ক্লাস”—কারণ সে বলত, “এটা আলো ছড়ানোর স্কুল, নম্বরের নয়, স্বপ্নের।” কারো মেয়ে পড়তে পারত না, কেউ স্কুল ছেড়ে দিয়েছিল টাকার অভাবে, কারো মা-বাবা বলত, “বেয়াদপ মাইয়া বেশি পড়লে বর মিলবে না”—তাদের সবার জন্য দরজা খুলে রেখেছিল অনিমেষ।
এক সন্ধ্যায়, পড়ানো শেষে সে উঠোনে বসে গাঁয়ের বাতাসে ভিজে থাকা ধানচালের গন্ধ নিচ্ছিল। তখন অরুণ স্যার এলেন। পাশে বসে বললেন, “এই গ্রামে একটা আগুন জ্বালিয়ে দিস তোকে দেখে। এটা নিভতে দিস না।”
অনিমেষ জিজ্ঞেস করল, “স্যার, আমি কি সত্যিই কিছু পারি?”
অরুণ স্যার মাথা নাড়লেন। বললেন, “তুই কাঁসার ঘরের ছেলে, অনিমেষ। তোর মধ্যে শব্দ আছে, ধ্বনি আছে, ধাতুর মতো স্থায়িত্ব আছে। তুই পারবি। তবে মনে রাখিস—তোর চোখের আগুন যদি অন্তর থেকে আসে, তবেই তা জ্বলে থাকবে। কৃতিত্বের জ্বালা একদিন নিঃশেষ হয়, কিন্তু দায়িত্বের আলো নিভে না।”
সেই রাতে অনিমেষ আর ঘুমোতে পারেনি। সে ডায়েরি খুলে লিখল,
“আজ থেকে আমি শুধু অনিমেষ নই। আমি সেই আলো, যা শুধু নিজেকে নয়, চারপাশকে দেখাবে পথ।”
এরপর সময় এসে দাঁড়াল উচ্চ মাধ্যমিকের দরজায়। বড় ক্লাস, কঠিন বই, আর বেশি প্রতিযোগিতা। কিন্তু অনিমেষ জানত, তার সময় নষ্ট করার অধিকার নেই। পড়াশোনার ফাঁকে সে ছেঁড়া জুতোর তলা নিজে সেলাই করত, পুরনো বই নিজেই বাঁধিয়ে নিত। কলকাতার এক দাদার পাঠানো পুরনো ল্যাপটপে YouTube দেখে গণিতের নতুন ফর্মুলা শিখত।
এর মধ্যেই নতুন এক চরিত্র এল অনিমেষের জীবনে—মীরা। সে ছিল পাশের গ্রামের এক মেয়ের দূর সম্পর্কের বোন, যিনি শহর থেকে গ্রামে ফিরে এসেছিলেন শিক্ষিকার চাকরি ছেড়ে, কিছু করতে। মীরা অনিমেষের “আলো ক্লাস”-এর পাশে বসে পড়াত। দু’জনের মধ্যে কথাবার্তা খুব কম, কিন্তু এক অদ্ভুত বোঝাপড়া গড়ে উঠল—চোখে চোখে কথা বলা, নীরবে স্বপ্ন ভাগ করে নেওয়া।
এক বিকেলে, রঙিন আকাশের তলায় তারা বসেছিল বটতলায়। মীরা বলল, “তুমি জানো, আমি শহর ছেড়েছি কারণ আমি নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না সেখানে। তুমি জানো তুমি কে, আর এটা অনেক বড় বিষয়।”
অনিমেষ হেসে বলেছিল, “আমি জানি না আমি কে, শুধু জানি আমি কী হতে চাই।”
এরপর এলো উচ্চ মাধ্যমিক। দিনের পর দিন, অনিমেষ পড়ে চলল একনাগাড়ে। স্কুলের বাচ্চাদের পড়ানো, মায়ের ওষুধ আনা, খুপরি ঘরের বাতি জ্বালানো—সব সেরে, মধ্যরাতে কুপির আলোয় সে পড়ত। একদিন মা উঠে দেখলেন সে ঘুমোয়নি, হাওয়ার মধ্যে ডায়েরির পাতাগুলো উল্টে যাচ্ছে, আর তার চোখের নিচে কালির ছাপ। মা শুধু বলেছিলেন, “তুই যদি ক্লান্তও থাকিস, হার মানিস না।”
পাঠ্যপুস্তকের বাইরে তখন অনিমেষ শেখা শুরু করেছে অন্য জিনিস—সমাজ, অর্থনীতি, প্রযুক্তি। সে বুঝতে শিখেছে, কেবল চাকরি পেতে পড়াশোনা করলেই চলবে না, জানতে হবে সমাজ কীভাবে চলে, কেন এক ঘরের মেয়ের মুখে দুধ থাকে, আর আরেক ঘরের মেয়ে সারাদিন খালি পেটে কাটায়।
তাই সে শুধু বই মুখস্থ না করে, প্রশ্ন করত। শিক্ষকরা বলতেন, “এই ছেলে শুধু পড়ে না, বুঝে।”
ফলাফল প্রকাশের দিন এলো। গ্রীষ্মের প্রখর দুপুরে, সে ফলাফল দেখতে গেল নিজে হাতে। স্কুলের নোটিস বোর্ডে নাম খুঁজতে খুঁজতে এক সময় তার চোখ আটকে গেল—
“উচ্চ মাধ্যমিকে রাজ্যে সপ্তম স্থান—অনিমেষ কর্মকার।”
আকাশে চিল ডাকছিল, পেছনে বাজছিল রিকশার ঘণ্টা, সামনে কাগজে লেখা ছিল তার ভবিষ্যৎ। স্কুল প্রাঙ্গণে তখন হুলস্থুল। সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল, পঞ্চায়েত প্রধান—সবাই হাজির। কেউ মাইকে বলল, “এই ছেলেটা আমাদের স্বপ্নের প্রতিনিধি।”
কিন্তু সে হাসল না। তার চোখে তখন ছিল অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা। বাড়ি ফিরে সে মাকে জড়িয়ে ধরল। বলল, “মা, আমি রাজ্যে সেভেনথ হয়েছি, কিন্তু আমার কাজ এখনো শেষ হয়নি।”
মা বলল, “তোর চোখে আগুন আমি অনেকদিন আগেই দেখেছি, এখন তুই শুধু তোর আলো অন্যদের গায়ে ছড়িয়ে দে।”
সেই রাতে আকাশে চাঁদ ছিল পরিপূর্ণ। অনিমেষ উঠোনে বসে ছিল, মাটিতে পা রেখে, মাথায় আকাশের খোলা নীল। তার পাশে মীরা এসে বলল, “তুমি জানো, আগুন খুব শক্তিশালী, কিন্তু আলো তার চেয়েও বেশি দীর্ঘস্থায়ী। তুমি শুধু আগুন হয়ে নয়, আলো হয়েও থেকো।”
অনিমেষ ধীরে মাথা নাড়ল। আর ডায়েরির একপাশে লিখল—
“আমি আর কাঁসারু হরিপদের ছেলে নই শুধু, আমি সেই ধাতু—যার শব্দ আগামীকাল লিখবে।”
***
পাঁচ কিলোমিটার—একটা সংখ্যা মাত্র, ছোট একটা দূরত্ব। কিন্তু অনিমেষের কাছে এই পাঁচ কিলোমিটার ছিল তার পরিচিত পৃথিবী আর এক অপরিচিত স্বপ্নের মাঝখানে টানা একটা রেখা। গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত বাসস্ট্যান্ড অবধি সেই রাস্তা, যার এক প্রান্তে ছিল ধুলো লাগা ধানের গোলা, পুকুরে কচুরিপানার ভেলা, মাটির কুয়োর জল; আর অন্য প্রান্তে ছিল কলকাতার চওড়া রাস্তায় ভাসমান ভবিষ্যতের বাসনাময় আয়না—যেখানে মানুষ নেমে আসে শুধু নিজেকে ছাপিয়ে উঠতে।
পরীক্ষার ফলাফলের পর সরকারি একটা স্কলারশিপ পেয়েছে অনিমেষ। কলকাতার এক নামী কলেজে ভর্তির অনুমতি এসেছে চিঠিতে। কিন্তু সেখানে পৌঁছানো মানে শুধু গন্তব্যে যাত্রা নয়, এক সম্পূর্ণ নতুন যুদ্ধের ডাক।
“কিন্তু তোকে একা পাঠাতে মন চায় না,” মা বলেছিলেন রাতে, চুলে তেল দিতে দিতে।
অনিমেষ হেসে বলেছিল, “একাই তো এসেছি এতটা, মা। ওই পাঁচ কিলোমিটার তো কিছুই না।”
মা চুপ করে ছিলেন। হঠাৎ মাটির মগ থেকে জল নিয়ে মুখে ছুঁড়ে দিলেন, মজা করে বললেন, “চালাক ছেলে আমার, ঢাক বাজাতে শিখেছে। কিন্তু মনে রাখিস, শহরের আলো খুব মোহময়ী, তুই যেন নিজের ছায়া হারিয়ে না ফেলিস।”
সকালবেলা, ট্রাংকে গুঁজে দেওয়া হল কয়েকটা জামা, পুরনো বই, ডায়েরি, মা’র সুতো জড়ানো এক থলে—যার ভেতরে ছিল দুটো গুঁড়ো চিঁড়ে, এক বয়ামে তেল মাখানো চচ্চড়ি, আর একটা হাতের চিঠি—যেখানে লেখা ছিল:
“তুই যত দূরেই যা, আমি এখানেই আছি, তোকে নিয়ে।”
বাসস্ট্যান্ড অবধি হাঁটতে হাঁটতে অনিমেষ তাকাচ্ছিল চারপাশে—যে পুকুরের জলে সে ছোটবেলায় ডুব দিয়েছিল, যে বটগাছের ছায়ায় পড়াশোনা করত, যে পথ ধরে সে স্কুলে যেত। প্রত্যেকটা জায়গা যেন বিদায় নিচ্ছিল। ধীরে ধীরে বাসটা এল, ধুলো উড়িয়ে। সে উঠে বসলো, পিছনের সিটে। বাস চলা শুরু করল—পেছনে পড়ে রইল গ্রামের সবুজ, সামনে আসতে লাগল কংক্রিট আর গাড়ির শিস।
কলকাতা—শব্দটা উচ্চারণের মধ্যেই যেন একটা গম্ভীরতা থাকে। এক অদ্ভুত খরস্রোতা নদীর মতো শহর, যার ভিতরে ঢুকলে মানুষ আর আগের মতো থাকে না। বড় রাস্তা, হোর্ডিং, ট্র্যাফিকের হর্ন—অনিমেষ তাকিয়ে ছিল স্তব্ধ হয়ে। এত আলো, এত মানুষ, এত মুখ—কিন্তু এত নিঃসঙ্গতা। তার বুকের ভেতরটা ধীরে ধীরে ভারি হতে লাগল। চোখ বুজে সে কল্পনা করল সেই ছোট ঘরটা, যেখানে মা সন্ধ্যায় ধূপ জ্বালাতেন।
কলেজে প্রথম দিন পরিচয়পর্ব ছিল। সবাই ইংরেজিতে বলছিল নিজেদের কথা—“Hi, I am from Xaviers… I love computers and books…” আর অনিমেষ দাঁড়িয়ে ছিল ঘেমে ওঠা কপালে, বুকের ভেতরে শব্দ জমে ছিল, কিন্তু ঠোঁট দিয়ে কিছু বেরোচ্ছিল না। তারপর ধীরে ধীরে সে বলল, “My name is Animesh Karmakar. I come from Bhaduriya village. I want to be a change.”
রুমে কারো মুখ নড়ল না, কিন্তু স্যার হেসে বললেন, “That’s the boldest thing I’ve heard today.”
কলকাতার দিনগুলো ছিল যুদ্ধের মতো। সে ভোর পাঁচটায় উঠে পড়ত, রুটি খেয়ে ক্লাসে যেত, ল্যাব শেষে লাইব্রেরিতে বসত, রাত দশটায় ফিরে এসে কেরোসিনের আলোয় পড়ত। একদিন রুমমেট অবাক হয়ে বলল, “তুই মানুষ না কি রোবট?”
অনিমেষ শুধু হেসে বলেছিল, “আমি গ্রাম থেকে এসেছি ভাই, পিছিয়ে থাকলে চলবে না।”
কিন্তু এই শহরে আসার পর সে বুঝতে শিখল অন্য এক যন্ত্রণা—অসাম্য। পাশের ক্লাসের এক বন্ধু, যার বাবা কর্পোরেট কোম্পানির ম্যানেজার, সে একদিন বলল, “তুই এত পরিশ্রম করিস কেন? স্কলারশিপ আছে না?”
অনিমেষ তাকিয়ে বলেছিল, “তুই স্কুলে টিফিন নিয়ে যাস, আমি একদিন শুধু জল খেয়ে ক্লাস করেছি—তাই।”
কিন্তু সে দমে যায়নি। প্রতি সপ্তাহে সে ভিডিও বানিয়ে ইউটিউবে আপলোড করত—“Science for Rural Minds” নামে এক সিরিজ শুরু করেছিল। সে বোঝাত সহজ বাংলায়—অণু কী, বিদ্যুৎ কীভাবে কাজ করে, গ্রামে টিউবওয়েল কিভাবে চলতে পারে কম খরচে। তার ভিডিও হঠাৎ জনপ্রিয় হয়ে উঠল, গ্রামের লোকজন থেকে কলেজের প্রফেসর পর্যন্ত বললেন, “তুই একটা বিপ্লব চালাচ্ছিস অনলাইনে।”
একদিন এক বিশেষ সন্ধ্যায়, ক্লাস শেষে কলেজের ক্যাফেটেরিয়ায় বসে সে চা খাচ্ছিল। হঠাৎ একজন প্রফেসর এসে বসলেন পাশে। বললেন, “তোমার গল্পটা শুনেছি। তুমি জানো, অনেক বড় বড় শহরের ছেলে-মেয়েরা শুধু নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবে। তুমি প্রথম, যে নিজের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামকে সঙ্গে নিয়ে চলেছ। একদিন কেউ তোমার গল্প লিখবে। আজ আমি সেটা বলছি, কাল তুমি নিজেই বলবে।”
সে রাতে, কোলাব্যাগানের ভাড়া ঘরে বসে অনিমেষ ডায়েরি খুলে লিখল—
“পাঁচ কিলোমিটার পার হওয়া মানে শুধু দূরত্ব নয়, এটা নিজের ভিতরের পাঁচ হাজার বাধা পার হওয়া। আমি এখনও পথের মানুষ। গন্তব্য অনেক দূরে। কিন্তু হাঁটা আমি ছাড়িনি।”
***
স্টেশন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে অনিমেষ তাকিয়ে ছিল রেললাইন বরাবর সোজা এগিয়ে যাওয়া রাস্তাটার দিকে। শহর থেকে গ্রামে ফেরার ট্রেন তখনো আসেনি, কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ছিল তার সারা শরীরে। কলকাতার সজীব হট্টগোল আর ধোঁয়াটে হাওয়া পেরিয়ে এই প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়ানো মানে শুধু একটা ভৌগোলিক স্থান পরিবর্তন নয়—এ যেন মনের এক গভীর জায়গা থেকে উঠে আসা আর এক নিজস্বতার দিকে ফিরে যাওয়া।
দুই হাতে ট্রলি ব্যাগের হাতল চেপে ধরে সে অনুভব করছিল নিজের আঙুলের রক্ত চলাচল। ব্যাগে গোঁজা বইগুলো যেন ফিসফিস করে বলছিল, “ফিরে যাচ্ছিস, কিন্তু কি জানিস, তুই আর সেই আগের অনিমেষ নস।”
রেললাইন পার হতে থাকা বাতাসে ভেসে আসছিল কচুরিপানার গন্ধ, বাঁশপাতা পোড়ানোর ধোঁয়া, আর কোথাও থেকে কাঁচা আমের ঝাঁঝালো টক। ট্রেনটা আসতে দেরি হচ্ছিল। পাশে এক বৃদ্ধ বসে ছিলেন মাটি বিছানো চাদরে, গায়ে একটা মোটা চাদর জড়ানো। তিনি বললেন, “তুমি ছাত্র? গ্রামে যাচ্ছ?”
অনিমেষ হেসে বলল, “হ্যাঁ কাকু, অনেকদিন পর যাচ্ছি। কলকাতা থেকে।”
বৃদ্ধ হেসে বললেন, “গ্রাম মানেই একটানা বাঁচা। শহর তো গতি, আর গ্রাম হলো ধ্বনি—যে শব্দ মন ছুঁয়ে যায়।”
ঘন্টাখানেক পর যখন প্ল্যাটফর্মে ধোঁয়ামাখা শব্দে ট্রেন ঢুকল, তখন অনিমেষর চোখে জল জমে উঠছিল। এতটা সময়ে কত কিছু বদলে গেছে—কিন্তু এই ট্রেন, এই চেনা শব্দ, আর এই ভাঙা বেঞ্চটা ঠিক আগের মতোই রয়ে গেছে।
ট্রেন থেকে নামার পর, সেই পাঁচ কিলোমিটার মাটির রাস্তা সে পায়ে হেঁটেই ফিরল। কাঁধে ব্যাগ, পায়ে পুরনো চপ্পল, মুখে একরাশ নিঃশব্দ আনন্দ। কদমগাছ, বটতলা, বাঁশঝাড়—সব যেন বলে উঠছিল, “ফিরে এসেছিস অনিমেষ, তোকে দেখে শান্তি পেলাম।”
বাড়ির উঠোনে পা দিতেই মা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন। চোখে জল, মুখে হাসি। বললেন, “তোর গায়ের গন্ধ এতদিন পরে পেলাম, বুকের ভিতরটা যেন শান্ত হয়ে গেল।”
অনিমেষ মায়ের কাঁধে মাথা রেখে বলল, “মা, আমি শুধু সফল হতে যাইনি, তোর কাছে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি রাখতে গিয়েছিলাম।”
সন্ধ্যায় গ্রামে এক উৎসবের আবহ। পাড়া-প্রতিবেশীরা, স্কুলের বাচ্চারা, হরিপদ কাকু, এমনকি পঞ্চায়েত প্রধান পর্যন্ত এসে পড়ল। মাটির চুলোর ধোঁয়া, চালচুলোহীন ছেলেপুলের হাসি, আর অনিমেষের হাতে পোঁড়া গরম দুধের গ্লাস—এই ছোট্ট গ্রামটা যেন তার জন্য অপেক্ষা করছিল।
সে বলল, “আমি এসেছি একটু সময় কাটাতে, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা—আমি এসেছি শুনতে, বুঝতে, শিখতে।”
গ্রামের পুরনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সে একটা সেমিনার করল—“তরুণের চোখে ভবিষ্যৎ” নামে। বাঁশ দিয়ে তৈরি স্টেজ, মাথার ওপর ত্রিপল, আর সামনে বসে থাকা মাটি মেখে থাকা পা-ওয়ালা ছোট ছোট শিশু থেকে শুরু করে, পরিশ্রমী কৃষক, মেঘে ভেজা চুলের মা-বোনেরা—সবাই শুনছিল।
সে বলল, “শহর আমায় অনেক কিছু দিয়েছে, কিন্তু শেকড় টেনে ধরেছে এই মাটি। আমি ফিরেছি, কারণ এই মাটি আমায় মানুষ করেছে। এখন আমার পালা, এই মাটিকে ফিরিয়ে দেওয়ার।”
পরের দিন সে হাঁটতে হাঁটতে পুরনো স্কুলে গেল। যে বেঞ্চে সে বসত, সেখানে এখন একটা বাচ্চা ছেলে বসে—হাতের খাতা রোদে চকচক করছে। অনিমেষ জিজ্ঞেস করল, “তুই পড়ছিস?”
ছেলেটা বলল, “হ্যাঁ দাদা, আপনাকে দেখে পড়ার আগ্রহ হয়।”
এই কথাটা তার বুকে গিয়ে বিধল। এত দিন ধরে সে ভেবেছিল, শুধু নিজের জীবনের গল্পই বদলেছে। আজ বুঝল, সে অন্য অনেক জীবনের গল্পের প্রথম লাইন হয়ে গেছে।
বিকেলে সে বটগাছের তলায় বসেছিল একা। মীরা এসে পাশে বসলো। অনেক দিন পর দেখা। মীরার চোখে ক্লান্তি, কিন্তু মুখে সেই শান্তি, যেটা ছিল প্রথম দিনের মতো।
সে বলল, “অনিমেষ, তুমি বদলাওনি। শুধু গভীর হয়েছো। শহর তোমার পোশাক বদলাতে পেরেছে, মেরুদণ্ড নয়।”
অনিমেষ কিছু বলল না। শুধু ডায়েরিটা বের করে লিখল—
“ফিরে এসে বুঝলাম, আমি আসলে কোথাও যাইনি। আমি বরাবর এখানে ছিলাম—এই মাটিতে, এই রোদের ভেতরে, এই স্কুলের বেঞ্চে।”
চাঁদের আলোয়, পুকুরের পাড়ে বসে মীরা বলল, “তুমি কি ফিরে আসবে চিরকাল?”
অনিমেষ বলল, “না, কিন্তু আমি রেখে যাব এমন কিছু, যাতে আমি না থাকলেও মানুষ মনে রাখে—একজন এসেছিল, আগুন চোখে, আলো হাতে।”
***
শহরে ফেরার ট্রেনটা ছিল ভোরবেলার, যখন কুয়াশায় আচ্ছন্ন মাঠগুলো ধীরে ধীরে সূর্যের কিরণে উন্মোচিত হতে থাকে। অনিমেষ জানালার পাশে বসে ছিল, মুখটা বাইরের দিকে ঘোরানো। সে জানত, এই ফিরে যাওয়া আগের মতো নয়। এবার সে ফিরছে না শুধু নিজের স্বপ্ন নিয়ে, বরং এক বহমান লক্ষ্যের ভার কাঁধে নিয়ে—যেটা গ্রাম তাকে দিয়ে গেছে বিশ্বাস করে।
কলকাতার বুকে ফের পা রাখতেই অনিমেষ যেন নিজেকে আর একা অনুভব করল না। আগের মতো সে কুন্ঠিত নয়, এখন তার ভিতরে এক অদ্ভুত বল শক্তি তৈরি হয়েছে—যা আত্মবিশ্বাস থেকে নয়, বরং দায়িত্ববোধ থেকে জন্ম নিয়েছে। তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায় যেন ধীরে ধীরে মিলে যাচ্ছে এক বৃহৎ কাহিনীতে, যেখানে সে নায়ক নয়, বরং সেই বার্তাবাহক—যে আলো নিয়ে ফেরে।
কলেজে ফিরেই সে ডিন-এর সঙ্গে দেখা করল। বলল, “স্যার, আমি একটা উদ্যোগ নিতে চাই—একটা মডেল, যার মাধ্যমে ভারতের প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলগুলোতে সহজ পদ্ধতিতে বিজ্ঞান শেখানো যাবে।”
ডিন প্রশ্ন করলেন, “তোমার কাছে আছে কী?”
অনিমেষ বলল, “আমার কাছে আছে অভিজ্ঞতা, লক্ষ্য, আর বিশ্বাস। আমি নিজে একটা পরীক্ষিত মডেল।”
ডিন মুগ্ধ হয়ে বললেন, “তুমি সাহসী। এই শহর সাহসীদেরই জায়গা দেয়। শুরু করো।”
সেই রাতেই অনিমেষ নিজের ছোট ঘরটায় বসে একটা সাদা কাগজে লিখে ফেলল পরিকল্পনার খসড়া। নাম দিল—“Project Jyoti”। ‘জ্যোতি’—মানে আলো। সে চেয়েছিল এমন একটা পাঠ্যপদ্ধতি তৈরি করতে, যেটা শহরের বিজ্ঞান নয়, গ্রামের বাস্তবতাকে ধরবে। যেমন—একটা ল্যাম্প কিভাবে মাটি দিয়ে তৈরি করা যায়, জল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা যায়, কিংবা কীভাবে গ্রামের পরিবেশেই সোলার এনার্জি কাজে লাগানো যায়।
সে ভেবেছিল, “শিক্ষা মানে শুধু পৃষ্ঠা নয়, সেটা হওয়া উচিত পথ। এমন এক পথ, যা অন্ধকারে আলো জ্বালাতে পারে।”
প্রথমে প্রজেক্টে কেউ আগ্রহ দেখাচ্ছিল না। সহপাঠীরা বলত, “এই সব সমাজসেবা করে ভবিষ্যৎ বানানো যায়?”
অনিমেষ বলত, “ভবিষ্যৎ বানানো না গেলে অন্তত ভবিষ্যতের মানুষকে আলো দেখানো যায়।”
সে রাত্রির পর রাত্রি জেগে প্রেজেন্টেশন বানাল, ভিডিও বানাল, ইউটিউব চ্যানেলে টিউটোরিয়াল দিল। ধীরে ধীরে কলেজের অন্য ছাত্রছাত্রীরা জড়ো হতে লাগল, কেউ অঙ্ক বুঝত, কেউ ডিজাইন করত, কেউ স্ক্রিপ্ট লিখত। প্রজেক্ট জ্যোতি যেন এক আন্দোলনে পরিণত হল।
একদিন রাষ্ট্রপতির দপ্তর থেকে একটা আমন্ত্রণপত্র এল—“জাতীয় যুব উদ্যোগ সম্মেলনে ‘প্রজেক্ট জ্যোতি’ উপস্থাপন করতে হবে।”
ডিন বললেন, “অনিমেষ, তুমি শুধু নিজের সম্মান নয়, আমাদের প্রতিষ্ঠানের সম্মানও বাড়ালে।”
সম্মেলনের মঞ্চে উঠে, লাখো মানুষের সামনে অনিমেষ মাইক ধরে দাঁড়িয়ে বলল—
“আমার নাম অনিমেষ কর্মকার। আমি এক অজ পাড়াগাঁর ছেলে। আমার মা এখনও কুয়োর জল দিয়ে রান্না করেন, আমার স্কুলে একটাও পাখা ছিল না। কিন্তু আজ আমি এখানে দাঁড়িয়ে, কারণ একটা আলো আমার ভিতর জ্বলেছিল—একটা ইচ্ছে, আমি শুধু নিজেকে নয়, নিজের মতো আরও হাজারটা ছেলেকে এগিয়ে নিতে চাই।”
তার বক্তব্য শুনে উপস্থিত সকলে উঠে দাঁড়াল। করতালির ধ্বনি যেন বিস্ফোরণের মতো আছড়ে পড়ল মঞ্চে। এক সংবাদপত্রে লেখা হল—“একজন তরুণ শুধু নিজের জন্য স্বপ্ন দেখে না, সে স্বপ্ন দেখায়।”
এরপর শুরু হল এক নতুন অধ্যায়—‘Project Jyoti’ একটি অলাভজনক সংস্থা হিসেবে স্বীকৃতি পেল। সরকার থেকেও অনুদান এল। তার নেতৃত্বে একটি টিম তৈরি হল যারা বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল—পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম, নদীয়া, রায়গঞ্জ—ঘুরে ঘুরে বিজ্ঞান শিবির করত, প্রজেক্টর ছাড়া, বড় মেশিন ছাড়া, শুধু দেশজ পদ্ধতিতে।
একদিন তার পুরনো স্কুলের হেডস্যার ফোন করে বললেন, “তুই তো একদিন এখানে চক ছুঁয়ে সি.ও.ভি পড়তিস। আজ তোকে দেখে বাকি ছাত্রদের চোখে আলোর রেখা পড়ছে।”
অনিমেষ জবাব দিল, “স্যার, তখন আমি বোঝার চেষ্টা করতাম আলো কীভাবে কাজ করে, আজ বুঝি আলো কাদের জন্য কাজ করে।”
কিন্তু পথ সহজ ছিল না। মিডিয়া আসতে লাগল, সোশ্যাল মিডিয়ায় হঠাৎ ভাইরাল হয়ে উঠল তার ভিডিও, লোক বলল—“তুমি নেতা হয়ে যাও”, কেউ বলল, “বিজনেস খোলো”—কিন্তু অনিমেষ জানত, এই পথ নামকরা হওয়ার জন্য নয়, প্রাসঙ্গিক হওয়ার জন্য।
একদিন সে লিখল—
“আমি আলো জ্বালাতে চেয়েছিলাম, আলোয় পুড়ে যাওয়া নয়।”
এক সন্ধ্যায় কলকাতার এক বিখ্যাত হলরুমে TED Talk-এ বক্তৃতা দিতে গিয়ে সে বলল,
“যখন কেউ বলেন—‘তুমি আলোর মানুষ’, তখন আমি মাথা নিচু করে শুধু বলি—আমি একটা বাতি, যার ভিতরে জ্বলছে হাজার গ্রাম শিশুর চোখের জ্যোতি।”
সেদিন অনিমেষ বুঝেছিল—সে আর একটা মানুষ নয়, একটা অনুপ্রেরণা। একটা আলোকস্তম্ভ, যার দিকে তাকিয়ে আরও অনেক অনিমেষ, আরও অনেক মীরা, আরও অনেক স্কুলের বেঞ্চ থেকে উঠে আসা স্বপ্ন দেখতে শিখছে।
রাত্রে বাড়ি ফিরে সে ডায়েরিতে লিখল—
“যারা আলো জ্বালায়, তারা কখনওই অন্ধকারে হারিয়ে যায় না। কারণ তারা নিজের আলো দিয়ে অন্যের রাস্তাও দেখাতে পারে।”
***
একটি কুয়াশা ঢাকা সকালে অনিমেষ ট্রেন থেকে নামল ফের নিজের গ্রামে। তবে এবার সেই আগের অনিমেষ নয়। এবার সে এসেছে হাতে শুধু একটি ব্যাগ নয়—সাথে এক পূর্ণ পরিকল্পনা, এক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দায়িত্ব, এবং এক অটুট অঙ্গীকার নিয়ে।
তাঁর আগমনে যেন গ্রামটা বদলে গিয়েছে। বাঁশের ঝোপের ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছেলেরা দৌড়ে বলছিল, “আলোর দাদা এসেছে! আলোর দাদা!”
কেউ বলছিল, “জ্যোতির স্যার এসেছে!”
পেছন থেকে এসে তার মা বললেন, “তুই তোর দাদার মতো দেখতে হয়েছিস—সে-ও স্বপ্ন নিয়ে বাঁচত। এখন তুই বাঁচাস অন্যদের স্বপ্ন দিয়ে।”
অনিমেষ হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের এক কোণে এসে দাঁড়াল—যেখানে এক পুরনো ভাঙা পাঠশালার খোলামেলা উঠোন আর মাটির দেয়াল ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে। এটাই ছিল তার প্রাথমিক বিদ্যালয়, তার শিকড়।
সেখানে দাঁড়িয়ে সে বলল, “এইখান থেকেই শুরু হবে নতুন আলো। এবার এই পাঠশালা হবে ডিজিটাল স্কুল—গ্রামের প্রথম।”
সেই রাতে, উঠোনে খোলা আকাশের নিচে বসে সে গ্রামের প্রবীণ শিক্ষক, পঞ্চায়েত সদস্য ও কয়েকজন তরুণকে নিয়ে বৈঠক করল। আলোচনার বিষয়—“গ্রামে ডিজিটাল পাঠশালা চালু করা ও পরিচালনা পদ্ধতি”।
এক বৃদ্ধ শিক্ষক বললেন, “বাবা, বিদ্যুৎ থাকে না, ইন্টারনেট তো অনেক দূরের কথা।”
অনিমেষ বলল, “আমরা সোলার প্যানেল বসাবো, অফলাইন পাঠ্যপাঠ তৈরি করব, যা মোবাইল না থাকলেও টিভি বা প্রজেক্টর দিয়ে শেখানো যাবে।”
পাঁচদিনের মধ্যেই কাজ শুরু হল। একটি NGO ও শহরের কিছু স্বেচ্ছাসেবকের সহায়তায় পুরনো স্কুল ঘর মেরামত হল। দেয়ালে রং করা হল—‘শিক্ষাই শক্তি’, ‘জ্ঞানই আলো’, ‘তোমরাই ভবিষ্যৎ’। গ্রামীণ কারিগররা বানালেন বেঞ্চ, টেবিল, আর কাঠের তৈরি প্রোজেক্টর স্ট্যান্ড। ছেলেমেয়েরা রোজ সন্ধ্যায় এসে গান, কবিতা, আর ছবি আঁকা শিখতে লাগল।
এক সন্ধ্যায়, যখন প্রথম পাঠ শুরুর দিন, তখন অনিমেষ বলল,
“এই স্কুল শুধুমাত্র একটি ভবন নয়—এটা একটি শুরু, একটা আন্দোলনের। যেখান থেকে একটা নতুন সকাল জন্ম নেবে।”
প্রথম পাঠে সে পড়াল—‘আলো কাকে বলে’। ব্যাখ্যা করল কীভাবে একটা দীপ শুধু চারপাশকে আলোকিত করে না, মানুষকেও বদলাতে পারে। একটি ছাত্রী বলল, “স্যার, আমি বড় হয়ে আপনাদের মতো হতে চাই।”
অনিমেষের চোখ ছলছল করে উঠল। সে বলল, “আমি চাই, তুই আমার থেকেও বড় হ, আলোয় ভরে দিস অন্যদের জীবন।”
গ্রামের একটি বয়স্ক মহিলা—যিনি কখনও স্কুলে পড়েননি—প্রতিদিন আসতেন ক্লাসের দরজায় দাঁড়িয়ে শোনার জন্য। একদিন তিনি বললেন, “বাবা, আমি কিছু পড়তে পারি না, কিন্তু তোর মুখে আলো দেখি। এই আলোয় আমি দিন পার করি।”
অনিমেষ জানত, শিক্ষা শুধু সার্টিফিকেট নয়, সেটা অনুভব, উপলব্ধি—যা ছুঁয়ে যায়।
দুই মাসের মধ্যেই স্কুলটি হয়ে উঠল ‘আলোক বিদ্যালয়’। আশেপাশের গ্রামের ছেলেমেয়েরা ছুটে এল ক্লাসে বসার জন্য। কেউ ট্রেনে চেপে আসত, কেউ সাইকেলে, কেউ হেঁটে।
একটি মিডিয়া হাউজ রিপোর্ট করল—
“যেখানে শহর ব্যর্থ, সেখানে আলোর মানুষ সৃষ্টি করছে গ্রামীণ জ্ঞানভিত্তিক বিপ্লব।”
শহরের বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আইআইটি এবং কিছু বিদেশি এনজিও সহায়তা দিতে চাইল। কিন্তু অনিমেষ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল—গ্রাম নিজের পায়ে দাঁড়াবে, বাইরের ভরসা ছাড়া।
মাঝেমধ্যে সন্ধ্যায় সে বসত মাঠে, কাঁধে শাল চাপিয়ে, একা। চোখে থাকত জোনাকি পোকার আলো। মনে পড়ত বাবার কথা—যিনি বলতেন, “তুই আলাদা হবিই, কারণ তোর ভিতরে আগুন আছে, তবে সেই আগুন যেন কাউকে পোড়ায় না—আলো দেয়।”
মা এসে বসতেন পাশে। বলতেন, “অনিমেষ, তুই যদি শহরে থাকতিস, হয়তো নাম হত বড়। কিন্তু এখানে তুই বড় হচিস নিজের চোখে।”
একদিন সকালবেলা, স্কুলের মঞ্চে দাঁড়িয়ে অনিমেষ বলল,
“আজ এই স্কুলে আমার মা ক্লাস নেবেন—তিনি পড়বেন না, তিনি শোনাবেন। তাঁর জীবনটাই শিক্ষার গল্প।”
মা বললেন, “আমার ছেলেকে আমি বই পড়াতে পারিনি, কিন্তু শিখিয়েছি মানুষ হতে। আজ সেই ছেলেই আমাকে শেখায়—আলো কীভাবে ছড়াতে হয়।”
সেইদিন থেকেই স্কুলে শুরু হল নতুন পাঠক্রম—‘জীবনশিক্ষা’। যেখানে জীবনের গল্প, সংগ্রাম আর সাফল্যই শিক্ষার আসল উপাদান।
রাতের আকাশে চাঁদ ঝলমল করছিল। দূরে মাঠে ছেলেমেয়েরা নাচত, গান গাইত—“আমরা আলোর মানুষ, আমরা অন্ধকার ভাঙি।”
অনিমেষ জানালার পাশে বসে ডায়েরিতে লিখল—
“আজ ফিরে পেলাম আমার সকাল—যেটা হারিয়ে গিয়েছিল শহরের কংক্রিটে। এবার আমি জানি, একটা সকাল ফিরে পাওয়া মানে একটা ভবিষ্যৎ ফিরে পাওয়া।”
***
বিকেলটা একটু অন্যরকম ছিল। সোনালি আলো ধীরে ধীরে মাঠ ছুঁয়ে চলে যাচ্ছিল বনদিকের দিকে, যেন সূর্য জানে—আরেকটা দিন শেষ হয়ে আসছে। অনিমেষ সেই আলোয় চুপ করে বসে ছিল নিজের স্কুলঘরের ছাদে, যেখানে কিছুদিন আগেও শুধু ধুলা ছিল, এখন সেখানে বই, বেঞ্চ, হাসি আর স্বপ্নের শব্দ।
কিন্তু আজ তার ভেতরে এক অদ্ভুত স্রোত বইছিল। সেই আলো, যেটা এতদিন ধরে সে ছড়িয়ে এসেছে, এখন যেন নিজেকেই প্রশ্ন করছে—“তুই কেমন আলো?”
কারণ এখন সে অনুভব করছে, আলো জ্বালানো সহজ, কিন্তু সেই আলোকে ধরে রাখা কঠিন।
গত কয়েক সপ্তাহে তার কাজ বেড়েছে অনেক বেশি। নানা জায়গা থেকে ডাক আসছে—কনফারেন্স, সাক্ষাৎকার, অ্যাওয়ার্ড প্রোগ্রাম, সরকারিভাবে প্রজেক্টের জন্য ফান্ডিং—এই সব ব্যস্ততায় যেন কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে তার নিজস্ব নির্জনতা, তার সেই ‘চুপচাপ থেকে কাজ করে যাওয়া’ মন।
সে বুঝল, তার চারপাশে এখন অনেক চোখ, প্রত্যাশা, বিচার—যারা তার প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি দেরিতে ফেরা সন্ধ্যার ওপর প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে পারে।
একদিন তার এক বন্ধু বলল, “তুই এখন শুধু অনিমেষ না, তুই এখন প্রতীক।”
সে হাসল, কিন্তু ভিতরে যেন কিছু ধসে পড়ল—একটানা আলোতে জ্বলে জ্বলে কখনও কখনও দেয়ালও ভেঙে যায়।
সেই রাতে, ঘরে ফিরে মা বললেন,
“তোকে আজকাল ক্লান্ত দেখায়, মনটা কোথায় রে?”
অনিমেষ চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর বলল,
“মা, আমি তো আলো দিতে চেয়েছিলাম, এখন মনে হয় আমি নিজেই আর আলো দেখতে পাচ্ছি না।”
মা একটা বাতি জ্বালিয়ে বললেন,
“এই দেখ, বাতিটাও জ্বলে উঠতে একটু থেমেছিল। কিন্তু তার মানে কি সে আর আলো দিতে পারবে না? মাঝে মাঝে আলোকেরও বিশ্রাম দরকার।”
তারপর থেকে অনিমেষ নিজেকে একটু দূরে সরিয়ে রাখল কিছুদিন। না, কাজ থামল না, কিন্তু সে স্কুলে ফিরে এল পূর্ণসময়ে, শিশুগুলোর সঙ্গে বসে আঁকল, খেলল, বই পড়ল। সে বুঝল, যত বড় হোক দায়িত্ব, মানুষের নিজের ভেতরের শিশুটাকেও বাঁচিয়ে রাখতে হয়।
একদিন সে তার ছোটবেলার একটা খাতার মধ্যে একটা কবিতা পেল—
“আমি আলো হতে চাই,
আমি বাতি হতে চাই,
আমি জোনাকি হতে চাই,
কিন্তু আগে আমি নিজে হতে চাই।”
পড়ে তার চোখে জল এল।
সে নিজেকে বলল, “আলো জ্বালানোর আগে নিজেকেই জ্বালতে হবে—ভালোবাসায়, নির্ভরতায়, নিঃস্বার্থতায়।”
এরপর শুরু হল তার সবচেয়ে গভীর প্রয়াস—“আত্মআলো” নামের একটি উদ্যোগ। এই প্রকল্পে শিশুদের শুধু পড়ানো নয়, শেখানো হল—নিজেদের আবিষ্কার করা। প্রতিদিন সন্ধ্যায় স্কুলে বসত ‘নীরবতা ক্লাস’—যেখানে কেউ কিছু বলত না, শুধু বসে থাকত নিজের সঙ্গে।
শুরুতে সবাই অবাক হয়েছিল—শিক্ষা না দিয়ে এই কী শুরু হল!
কিন্তু কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দেখা গেল ছেলেমেয়েরা আগের তুলনায় আরও সংবেদনশীল, আরও মনোযোগী, আরও সহানুভূতিশীল হয়ে উঠছে।
এক শিক্ষক বললেন,
“এটা তো আলাদা শিক্ষা! এ তো মানুষ বানানোর ক্লাস!”
এক সন্ধ্যায়, মাটির উঠোনে বসে, কয়েকজন বৃদ্ধ এসে বললেন,
“আমরা তো ভাবতাম পড়াশোনা মানেই পাস করা। এখন দেখি, এটা তো মন খোলা শেখা।”
একটা বাচ্চা মেয়ে বলল, “স্যার, আমি জানতাম না, চুপ করে বসেও অনেক কিছু শোনা যায়—নিজের মনটা।”
এই ছিল সেই দিন, যেদিন অনিমেষ বুঝেছিল—সে শুধু শিক্ষাদাতা নয়, সে এক শ্রোতা, এক সঙ্গী, এক পথপ্রদর্শক।
সে আর আগের মতো বক্তৃতা দিত না—সে ছেলেমেয়েদের বলত, “তোমরা যা দেখো, তা আঁকো। তোমরা যা ভাবো, তা লেখো। আমি শুনতে এসেছি, শেখাতে নয়।”
তাদের আঁকা দেয়ালে টানানো হতো—একটি ছেলে এঁকেছিল, একটি হাতে লণ্ঠন, অন্য হাতে মাটির বীজ, তার নিচে লেখা—“আমি আলো বুনছি”।
এক সন্ধ্যায়, গ্রামের মাঠে বসে, চোখে শেষ বিকেলের আলো পড়লে, এক ছেলেমেয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,
“দাদা, তুমি আমাদের গল্প বলো না? সেই যে তুমি কেমন করে এমন হলে?”
অনিমেষ হেসে বলল,
“আমি কেমন হলাম জানো? একদিন আমি হাঁটছিলাম খুব অন্ধকার রাস্তায়। কেউ ছিল না। তখন একটা চাঁদের আলো পড়েছিল আমার মুখে। আমি তখন বুঝেছিলাম, আলো কাউকে চেনে না, কিন্তু সে পথ দেখায়। সেইদিন থেকে আমি ঠিক করেছিলাম, আমিও আলো হব।”
ছেলেরা বলল, “তুমি তো শেষ বিকেলের মতো—হালকা, গা ছুঁয়ে যাওয়া, চোখে জল এনে দেওয়া আলো।”
সে বলল, “হ্যাঁ, আমি শেষ বিকেলের মানুষ—যে জানে সূর্য অস্ত যায়, কিন্তু তার আলো থেকে যায়।”
রাতে সে ডায়েরিতে লিখল—
“আমি এখন জানি, আলো ছড়ানো মানে শুধু আলো জ্বালানো নয়, আলোকে রক্ষা করাও এক সাধনা। আলোকে ভালোবাসতে শেখাও, তাকে অন্যের হাতে তুলে দাও—ধরে রাখো না।”
***
বছরের শেষদিকে হেমন্তের সন্ধ্যা যেন আকাশকে আরও বেশি নীল করে তোলে, আর মাটির ধুলোয় ছড়িয়ে পড়ে সোনালি বিষণ্নতা। এমন একদিনেই খবরটা এল—পাহাড়ি গ্রামের একটি স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে শিক্ষকের অভাবে। খবরটা পাঠিয়েছিল অনিমেষের পুরনো বন্ধু বিক্রম, যে বহুদিন আগে শহরের চাকরি ছেড়ে চলে গিয়েছিল উত্তর বাংলার এক প্রত্যন্ত এলাকায়, অজানা এক সাধনার খোঁজে।
চিঠিতে লেখা ছিল—
> “অনিমেষ, জানি তুই আলোর পথিক হয়েছিস। জানিস, এখানেও অনেক জোনাকি আছে, কিন্তু কেউ দেখতে পায় না। এই পাহাড়ি শিশুদের চোখে একরাশ স্বপ্ন জমেছে, কিন্তু সেগুলো ফোটার আগেই স্কুলটা বন্ধ হয়ে গেল। আমি আর পারছি না, চলতি মাসেই সব গুটিয়ে ফেলছি। যদি পারিস, একবার আয়—তোর আলোর একটা ঝলক হয়তো এখানেও পড়ে।”
চিঠির প্রতিটি অক্ষরে যেন ক্লান্তি, অপারগতা আর হাল ছেড়ে দেওয়ার গন্ধ ছিল। অনিমেষ কিছু না ভেবেই পরদিন রওনা দিল—তিনটা ট্রেন, একটানা বাসের ধুলো মাখা রাস্তা পেরিয়ে পৌঁছল পাহাড়ের কোলে, সেই ছোট্ট গ্রামে—নাম মেঘতলি।
গ্রামে পা রেখেই যেন একটা অন্য পৃথিবীতে এসে পড়ল সে। ঠান্ডা হাওয়া, আকাশভরা মেঘ, আর চারপাশে বুনো ফুলের গন্ধে একধরনের নির্মলতা মিশে আছে।
তবে গ্রামের শেষ প্রান্তে সেই বন্ধ স্কুলঘরটা যেন এক শোকস্তব্ধ মুখ। জানালাগুলো খুলে আছে, অথচ ভেতরে আলো নেই। বেঞ্চগুলো ভাঙা, বোর্ডে শেষ লেখা কিছু অক্ষর আধখানা মুছে গেছে—“আলো মানেই…” বাকিটা নেই।
বিক্রম তাকে দেখে চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল,
“তুই তো শহর-গ্রাম ঘুরে আলো বিলাসিস। এখানে দেখ, আলো নেই বলেই কেউ কান্নাও করে না।”
অনিমেষ বলল,
“তাই তো এসেছি, হয়তো কিছু কান্নার জায়গা ফিরিয়ে দিতে পারব।”
সেই সন্ধ্যায় দুই বন্ধু উঠল পাহাড়ের ঢালে, যেখানে শিশুরা আগেও খেলত, এখন কেবল ঘুরে বেড়ায় নিঃসঙ্গতায়। একটা ছোট মেয়ে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি কি নতুন স্যার?”
অনিমেষ হাঁটুগেড়ে বসে বলল,
“তুমি যদি আমাকে শিখাও, তবে হ্যাঁ। আমি শেখার জন্য এসেছি।”
সেই রাতে, ছোট একটি কুঁড়েঘরে বিক্রমের তক্তায় বসে অনিমেষ জানতে পারল, কিভাবে স্কুলে মাসখানেক হল পঠনপাঠন বন্ধ। সরকারী শিক্ষক আর আসেন না। বিক্রম নিজেই চেষ্টা করছিল কিছুদিন, কিন্তু গ্রামের লোকজন অভ্যস্ত হয়ে গেছে নিরাশায়। ছেলেমেয়েরা বই ছাড়িয়ে এখন আগুনের কাঠ খোঁজে, কিংবা জ্বালানি নিয়ে দৌড়োয়।
পরদিন ভোরে অনিমেষ শুরু করল তার যাত্রা। সে গিয়ে বসে রইল স্কুলঘরের উঠোনে, হাতে একটা খাতা আর পেন্সিল। যখন এক শিশু কৌতূহলে এগিয়ে এলো, তখন সে তাকে একটা ছবি আঁকতে দিল। এরপর আরেকজন এলো, তারপর তিনজন, ছয়জন। বিকালের মধ্যে ছোট ঘরটা আবার যেন প্রাণ ফিরে পেল।
তারপর দিনগুলো কেটে গেলো এক ঘূর্ণিপাকে।
অনিমেষ কোনও ঘোষণা দেয় না, কোনও বক্তৃতা করে না—সে শুধু প্রতিদিন সকালে এসে বসে পড়ে, রঙিন খাতা, মাটি দিয়ে বানানো বল আর কিছু পাতা নিয়ে।
সে শিশুদের শেখায়—নদীর শব্দ শোনা, পাতার কাঁপুনি বোঝা, আর নিজেদের ইচ্ছেগুলোকে বিশ্বাস করা।
তাদের কেউ বলে, সে বড় হয়ে বাইসন রক্ষাকারী হবে, কেউ বলে সে আকাশে চিঠি লিখবে পাখিদের নামে।
এক সন্ধ্যায় বিক্রম বলল,
“তুই কি স্কুল খুলতে এসেছিস, না মনের দরজা?”
অনিমেষ হেসে বলল,
“দুটোই। তবে দ্বিতীয়টাই আগে।”
তারপর একরাতে, পুরো গ্রামের শিশুদের নিয়ে এক ছোট নাটক করল সে—নাম ছিল “জোনাকির জ্যোতি”।
নাটকে দেখানো হয়, কীভাবে এক জোনাকি অন্য জোনাকিকে খুঁজে বেড়ায়, একা একা আলো জ্বালাতে জ্বালাতে। শেষে তারা একত্র হলে, একসাথে অন্ধকার ছাপিয়ে ফেলে এক নতুন সকাল।
গ্রামের বয়স্ক মহিলারা প্রথমে বিরক্ত ছিলেন, কিন্তু নাটকের শেষে তাঁরা কেঁদে ফেললেন। একজন বললেন,
“আমরা তো ভাবতাম এই পাহাড়ে কেউ আসে না, আলো শুধু শহরের জন্য। আজ বুঝলাম, জোনাকি নিজের আলো নিয়ে এসেছ।”
অবশেষে এক মাসের মধ্যেই স্কুলখানা ফের খোলার প্রস্তাব পাঠানো হল জেলা অফিসে। সরকারি তরফে সহায়তা এল। তবে তার চেয়ে বড় কথা, গ্রামেরই কিছু তরুণ-তরুণী এবার স্বেচ্ছায় স্কুল চালানোর দায়িত্ব নিতে চাইল।
তারা বলল,
“আপনাদের অপেক্ষা করতে করতে আমরা নিজেরা সব ভুলে গেছিলাম। অনিমেষদা আমাদের মনে করিয়ে দিলেন—আমরাও আলো হতে পারি।”
বিদায়ের আগে, অনিমেষ সেই পুরনো বোর্ডে চক দিয়ে লেখে—
“আলো মানেই—নিজের ভেতরে জোনাকি খুঁজে পাওয়া।”
রাতের অন্ধকারে ফেরার ট্রেনে বসে বিক্রম বলল,
“তুই জানিস, তোর আসার আগে আমি ভাবছিলাম সব ছেড়ে চলে যাব। আজ দেখ, আমি এখানে থাকবো—কারণ জানি, তুই জোনাকি ধরতে শিখিয়ে গেছিস।”
অনিমেষ জানালার বাইরে তাকাল—বনে বনে জ্বলে উঠছে অজস্র জোনাকি, যেন জানে, তাদের দেখা দিয়েই কোনো গল্প আবার শুরু হবে।
***
একের পর এক দিন কেটে যাচ্ছিল। অনিমেষের জীবন এখন এক আশ্চর্য সমান্তরালে চলে যাচ্ছিল। একদিকে ছিল তার শিক্ষকতা—বাড়তে থাকা একটি ছোট্ট বিদ্যালয়, যেখানে প্রতিদিন শিশুরা আনন্দে আসে, তাদের আকাশে হারানো স্বপ্নগুলো ফের ভরে যায়। অন্যদিকে, ছিল তার নিজের ভেতর খুঁজে পাওয়া সেই অদৃশ্য প্রাপ্তি—আলো ছড়ানো, মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা, এবং একে অপরের অন্তরে আলোর স্পর্শ পৌঁছে দেওয়ার সেই অমলিন আনন্দ।
তবে, সেসব সত্ত্বেও, অনিমেষ জানত, তার জীবনে একটা ফাঁক ছিল, একটা গতি, একটা অভাব ছিল। বিশেষ কোনো মুহূর্ত বা সম্পর্কের অভাব, যা তাকে পূর্ণতা দেবে, এক অস্থির খোঁজের মতো।
একদিন বিকেলে, তার ফোনে একটি ফোনকল এল। কলারটি ছিল তার পুরনো বন্ধু সায়ন্তনী, যাকে অনিমেষ বহুদিন আগে হারিয়েছিল। সায়ন্তনী ছিল তার প্রাক্তন সহকর্মী—একজন অসাধারণ মহিলা, যার সঙ্গে এক সময় তার বন্ধুত্ব ছিল গভীর। কিন্তু এক বিচিত্র কারণে তারা একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।
ফোনে সায়ন্তনী বলেছিল,
“অনিমেষ, আমি জানি তুমি আজকাল পাহাড়ে কাজ করছো, কিন্তু আমি তো সব সময় জানতাম, তুমি কখনোই এক জায়গায় স্থির থাকতে পারো না। তবে, একটা বিষয় আছে যা আমি বলব। তোমার কাছে একটা বার্তা আছে। আমি ফিরে আসছি।”
তার কণ্ঠে কিছুটা দুঃখ ছিল, তবে শান্তি ছিল, যেন বহু সময় পর পূর্ণতা পেতে চলেছে কিছু।
এবার অনিমেষ জানত, একটি পুরনো প্রজেক্ট, একটি পুরনো সম্পর্ক আবার সামনে আসছে। সায়ন্তনী—যে তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল, সেই সম্পর্কের জন্য সে কীভাবে প্রস্তুত ছিল? এই প্রশ্নটাই তাকে ঘিরে রেখেছিল।
এক সপ্তাহ পর, অনিমেষ তার পুরনো শহরে ফিরে এলো। সেখানে সায়ন্তনী অপেক্ষা করছিল। যদিও সময় বদলেছে, তবে সায়ন্তনীর সেই পরিচিত হাসি, সেই চেনা গন্ধ, সেই অদ্ভুত শান্তি, যা সে বহুদিন আগে হারিয়েছিল, এখনও ঠিক সেভাবেই ছিল।
সায়ন্তনী বলল,
“অনিমেষ, জানো, এতদিন পরে তোমার সঙ্গে দেখা হল, কিন্তু আমি জানতাম একদিন ফিরে আসব। আমি শুধু এটুকু বলতে চাই, আমি জানি, তুমি যখন একা ছিলে, তুমি আলোর সন্ধানে ছিলে, কিন্তু তুমি জানো, মাঝে মাঝে তুমি সেই আলোকে নিজের মাঝে খুঁজতে পারো না।”
অনিমেষ চুপ করে শুনছিল। সায়ন্তনী বলল,
“তুমি জানো, আমরা দুজন একে অপরকে কীভাবে ভুলে গিয়েছিলাম? তখন কি মনে হয়েছিল, যদি আমরা একে অপরকে ছেড়ে চলে যাই, তো কিছু আর আগের মতো থাকবে না। কিন্তু আসলে, আমাদের পুরনো সম্পর্কটা একটা ছবি ছিল, যার মধ্যে প্রতিটি রঙের ব্যাখ্যা ছিল। তুমি যখন আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে, আমি তখন কিছু বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু এখন, আমার অনুভব হয়েছে, সম্পর্কের যে অর্থ, তা কখনোই হারায় না—সেটা শুধু সময়ের সাথে বেড়ে যায়।”
অনিমেষ সেই মুহূর্তে অনুভব করল, তার জীবনে যে গোধূলির গান এতদিন শুনে আসছিল, সেটি এখন শুরু হচ্ছে নতুন রূপে। এর মধ্যে মাধুর্য, বেদনা, উচ্ছ্বাস—সব কিছু ছিল।
সে বলল,
“তুমি চলে গেলে, সায়ন্তনী, আর আমি জানতাম, আমার আলোর পথের মাঝে তুমি ছিলে, কিন্তু আমি সেই পথে একাই হাঁটছিলাম। এখন, তোমার কথায়, বুঝতে পারছি, সেই আলো যখন নিজের মধ্যে থাকে, তখন তা নতুনভাবে ছড়িয়ে যায়, কারণ তখন তুমি জানো—তোমার জন্য অপেক্ষা করছে একটা মানে।”
সায়ন্তনী একটু ধীরগতিতে বলল,
“তোমার আলোটা নিজের মতো করে খুঁজে পেয়েছ, অনিমেষ। এবার, তুমি যখন বাইরে তাকাবে, তুমি সেই আলোকে ফের দেখতে পাবে—যেটি অন্যের সঙ্গে শেয়ার করা যাবে। আমরা দুজন সেই আলো একসাথে ভাগ করতে পারি।”
পরদিন, অনিমেষ ও সায়ন্তনী পাহাড়ের এক প্রান্তে হাঁটছিল, যেখানে গোধূলির রোদ হালকা তামাটে আভা তৈরি করেছে। পাহাড়ের এক কোণে ছিল একটি ছোট্ট অশ্বত্থ গাছ, যেটির তলায় তারা বসে কথা বলছিল। সেই সময়, অনিমেষের মধ্যে অনুভূতি জাগল—এটা শুধু সম্পর্কের পুনঃস্থাপন নয়, এটি একটি নতুন জীবনের সূচনা।
এভাবে, অনিমেষ ও সায়ন্তনী একসাথে ফিরে এলো, গোধূলির আলোর নিচে। তারা একে অপরের কাছে ফিরে আসার সাথে সাথে, তাদের জীবনে অনেক কিছু নতুনভাবে শুরু হয়েছিল। সম্পর্কের শক্তি আর আলো একে অপরের মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছিল—তাদের মনে ও জীবনে একটা নতুন ধারা তৈরি হচ্ছিল।
“তুমি জানো,” সায়ন্তনী বলল, “আলোর একমাত্র কাজ হল অন্ধকার কাটানো। আর যদি আমরা একে অপরকে সাহায্য করি, তবে অন্ধকার আসবেই না।”
অনিমেষ বলল,
“ঠিক তাই, সায়ন্তনী। তাই তো—আমরা একসাথে আছি, গোধূলির মধ্যে, আর নতুন একটি পথের দিকে হাঁটছি।”
***
পাহাড়ি রাস্তাগুলোতে যখন শেষ বিকেলের আলো পড়ে, তখন মনে হয় যেন আকাশ মাটি ছুঁয়ে ফেলেছে। চারপাশে লালচে আভা, বাতাসে হালকা শীতের গন্ধ, আর পাখিরা ফিরছে আপন নীড়ে—এইসব দৃশ্যের মাঝে অনিমেষ ও সায়ন্তনী হাঁটছিল নিরবে, কিন্তু মনের ভেতরে চলছিল এক অদ্ভুত শব্দমালা।
তারা ফিরছিল মেঘতলি গ্রামের সেই ছোট্ট স্কুলের দিকে। অনিমেষের শিষ্য, ছোট্ট গিরিশা দৌড়ে এসে বলল,
“স্যার! আপনি ফিরে এসেছেন? আর সাথের দিদিও থাকবেন?”
সায়ন্তনী হেসে বলল,
“হ্যাঁ রে, থাকবো। তুমি আমাকে তোমার নতুন কবিতা শুনাবে তো?”
গিরিশা মৃদু হেসে মাথা নাড়ল। এই ছোট্ট হাসিতেই ছিল একরাশ শান্তি—যেটা শহরের বড় বড় বক্তৃতায় মেলে না, মেলে না কোনো সভায়, কেবল মেলে এমন সোনালি সন্ধ্যায়।
স্কুলঘরটাকে নতুন করে সাজানো হয়েছিল। স্থানীয় মানুষজন নিজেরাই কিছু রং, কিছু চুন কিনে এনেছিলেন। জানালার পর্দা নতুন, মাটির দেয়ালে কয়েকটি ছবি—সবই স্থানীয় শিশুদের আঁকা।
সায়ন্তনী, এই স্কুলঘর দেখে কাঁপা কণ্ঠে বলল,
“তুমি তো বলেছিলে এটা একটা বন্ধ স্কুল। এখন দেখছি, এটা একটা স্বপ্নের ঘর।”
অনিমেষ বলল,
“স্বপ্ন কখনো ইট আর ছাদের ওপর দাঁড়ায় না, দাঁড়ায় বিশ্বাসের ওপর। আমরা শুধু সেই বিশ্বাসটা ফিরিয়ে দিয়েছি।”
পরদিন সকাল থেকেই তারা দু’জনে মিলে ক্লাস নেওয়া শুরু করল। কিন্তু এবার বিষয় শুধুই ভাষা বা অঙ্ক নয়—সায়ন্তনী পড়াচ্ছিল কল্পনা, গল্প বলা, আত্মপরিচয়; আর অনিমেষ শেখাচ্ছিল শব্দের ভেতর কান পাততে, পাতার নড়াচড়া শুনতে।
একদিন একটি মেয়ে এসে সায়ন্তনীকে বলল,
“দিদি, আমি বড় হয়ে আপনার মতো হতে চাই। এমন করে কথা বলতে চাই, যেন সবাই মন দিয়ে শোনে।”
সায়ন্তনী সেই মেয়েটির মাথায় হাত রেখে বলল,
“তা হলে এখনই শুরু করো। নিজের ভেতরের আওয়াজটাকে ভালবাসো। কারণ ওটাই তোমার সবচেয়ে বড় শিক্ষক।”
দিন কেটে যেতে লাগল। বিকেলে স্কুল শেষে তারা মাঠে বসত, মাঝে মাঝে ছোট্ট একটি খোলা চায়ের দোকানে যেত—সেখানে গ্রামের বৃদ্ধা শিবানী দিদা বলতেন,
“তোমাদের দু’জনকে দেখলে আমার নিজের যৌবন মনে পড়ে যায়। তখনও ভাবতাম, পৃথিবীটা শুধুই কাজ আর পরিশ্রম দিয়ে চলে না, একটু ভালবাসা লাগেই।”
সন্ধ্যায়, তারা হেঁটে ফিরত সেই অশ্বত্থ গাছের নিচে। প্রতিদিন তারা কিছু না কিছু শিখত একে অপরের কাছ থেকে—না কোনও পাঠ্যপুস্তক ছিল, না পাঠ্যক্রম।
একদিন সায়ন্তনী অনিমেষকে বলল,
“তুমি কি জানো, আমি এতদিন আলোর সংজ্ঞা খুঁজেছি। শহরে, কর্পোরেট সভায়, বইয়ের লাইনে। অথচ এখানে এসে বুঝলাম, আলো মানে কারও হাত ধরা, কারও পাশে চুপ করে বসা, কারও নীরব কান্না শুনতে পারা।”
অনিমেষ বলল,
“আমরা দুজনই হয়তো আলোর খোঁজ করেছিলাম, কিন্তু আলোর গানে হারিয়ে গেছিলাম। এবার আমরা সেই গানটা গাইতে শিখছি—একসাথে।”
এরপর একদিন, মেঘতলির লোকেরা জানাল, তারা একটি ছোট ‘আলো উৎসব’ করতে চায়—শিশুদের আঁকা, গাওয়া, বলা সবকিছু মিলিয়ে এক ছোট্ট অনুষ্ঠান। অনিমেষ ও সায়ন্তনী এতে সম্মতি দিল। তারা নিজেদের মত করে অনুষ্ঠান সাজাতে লাগল।
উৎসবের দিন এলো—গ্রামের মানুষরা ছোট ছোট আলপনা করল, শিশুদের পায়ে ঘুঙুর বাঁধা হল, মাটির প্রদীপে আগুন জ্বলল। সায়ন্তনী বলল,
“আজ কেউ বক্তৃতা দেবে না। আজ শিশুরা বলবে—তাদের চোখে আলো মানে কী।”
ছোট্ট নীলু বলল,
“আমার আলো মানে, মা যখন ঘুমের আগে গল্প বলে।”
গিরিশা বলল,
“আমার আলো মানে, দিদি যখন বলে—‘তুমি পারবে’।”
অনুষ্ঠান শেষে, সায়ন্তনী ও অনিমেষ দু’জন একসাথে সেই অশ্বত্থ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। বাতাসে ফুলের গন্ধ, মাটিতে ছড়িয়ে থাকা মোমবাতির আলো, আর আকাশের তারা যেন জানাল—সব কিছু ঠিক হয়ে গেছে।
সায়ন্তনী বলল,
“অনিমেষ, এবার তোমাকে একটা প্রশ্ন করব।”
“বলো।”
“তুমি কি আর কখনো একা চলবে না? তুমি কি এবার হাত ধরে হাঁটবে?”
অনিমেষ মৃদু হাসল।
“আমার তো মনে হয়, আমি সেই পথেই চলেছি আজকাল—যেখানে তুমি আছো। সেটা আলোর পথ, আর তাতে ছায়া থাকলেও, ভয় নেই।”
সেদিন মেঘতলির রাত ছিল সোনালি সন্ধ্যার মতোই উজ্জ্বল। প্রদীপ নিভে এলেও, কারও চোখে আঁধার ছিল না। অনিমেষ ও সায়ন্তনী প্রথমবারের মতো পাশাপাশি দাঁড়িয়ে শুধু ভাবছিল—এই পৃথিবীতে যেটুকু আলো তারা ছড়িয়ে দিল, সেটুকুই হয়তো যথেষ্ট।
***
পাহাড়ের মাথায় তখন শেষ সূর্যের আলো থমকে দাঁড়িয়েছে, যেন নিজেই ভাবছে—এটাই কি শেষ আলো? নাকি এক নতুন শুরুর বার্তা? মেঘতলির আকাশে যেন সোনালি রঙ মিশে গেছে নীলাভ অস্তগামী বাতাসে। অনিমেষ ধীরে পায়ে হেঁটে উঠছিল অশ্বত্থ গাছের দিকে, পাশে সায়ন্তনী—চুপচাপ, কিন্তু ভেতরে চলছিল আলোড়নের ঝড়।
তারা দু’জন বসে ছিল সেই পুরনো চেনা পাথরের বেঞ্চে—যেটা একদিন অনিমেষ নিজ হাতে বানিয়েছিল বাচ্চাদের অপেক্ষা করতে করতে বসার জন্য। আজ যেন সেই পাথরও কথা বলছিল। চারপাশে ছিল নিরবতা, আর সেই নীরবতার মাঝখানে ছিল এক অপার্থিব আশ্বাস।
সায়ন্তনী হঠাৎই বলল,
“অনিমেষ, তুমি কি জানো, এতদিন ধরে যেটা খুঁজছিলাম, সেটা এত কাছে ছিল?”
“তুমি নিজেকে বলছো?”
“হ্যাঁ। আগে ভাবতাম, সাফল্য মানেই পদবী, মানেই শহরের উঁচু মঞ্চ। এখন বুঝি, সফলতা মানে কাউকে সকালবেলা দেখে মনে হওয়া—আজও সব ঠিক আছে।”
অনিমেষ তাকাল আকাশের দিকে। মেঘেরা তখনও গা ছুঁয়ে বয়ে যাচ্ছিল। পাহাড়ে সূর্য ডোবার দৃশ্য কখনোই একইরকম হয় না—প্রতিদিনের অস্তযাত্রা এক নতুন কাব্য।
সে বলল,
“জীবনটা যদি একটা সুর হয়, তবে তুমি তার সেই অংশ, যেটা ছাড়া বাকি সব নিঃশব্দ হয়ে যায়।”
সায়ন্তনী মৃদু হেসে বলল,
“তাহলে আমি কি তোমার সুরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা নীরবতা?”
“না, তুমি সেই নীরবতার আলো—যেটা না বলেই বুঝিয়ে দেয় সব কিছু।”
সেদিন সন্ধ্যার পর, তারা হাঁটতে হাঁটতে গেল সেই ছোট্ট খোলা মাঠে। সেখানেই হবে মেঘতলির এক বিশেষ রাত—‘আলো-বিচরণ’ নামক ছোট্ট উৎসবের সমাপ্তি। প্রত্যেক বাচ্চার হাতে মাটির প্রদীপ, আর মুখে একটা করে নিজের লেখা পঙ্ক্তি—আলো নিয়ে, স্বপ্ন নিয়ে।
গিরিশা বলল,
“আমার আলো মানে সেই শিক্ষক, যিনি আমার চুপ করে থাকা চোখ পড়তে পারেন।”
নীলু বলল,
“আমার আলো মানে, সেই পেটখালি দুপুরেও একটা হাসি।”
প্রদীপগুলো ধীরে ধীরে জ্বলতে লাগল। সায়ন্তনী দাঁড়িয়ে সেই সব কণ্ঠ শুনছিল, যেন সুরের এক সমবেত বৃষ্টি ঝরছে তার চারপাশে।
অনিমেষ তাকে বলল,
“তুমি কি জানো, এই প্রদীপগুলো শুধু আলো নয়—এগুলো বিশ্বাস। এই ছেলেমেয়েগুলো যখন হাসে, তারা জানে তারা একা নয়।”
সায়ন্তনী চুপ করে তাঁর হাত ধরল। বলল,
“অনিমেষ, আমি এখানে থাকতে চাই। শুধু শিক্ষক হয়ে নয়, তোমার সঙ্গে এক জীবন শিখতে।”
অনিমেষ চোখে জল নিয়ে বলল,
“তুমি যদি থাকো, তবে প্রতিটা সন্ধ্যা শেষ বিকেলের আলোয় ভরে উঠবে। আর প্রতিটা সকাল হবে নতুন করে জন্ম নেওয়ার মতো।”
সেই রাতে তারা দু’জনে মেঘতলির সবচেয়ে উঁচু ঢিপির মাথায় গিয়ে বসে রইল। তারা কিছু বলল না—শুধু চাঁদের আলোয় একে অপরের চোখে তাকাল। সেই চোখে ছিল অতীতের সমস্ত দূরত্ব, ভুল বোঝাবুঝি, মুছে যাওয়া প্রতিশ্রুতি—সব কিছুকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সাহস।
সায়ন্তনী হঠাৎ বলল,
“আমরা কি এবার স্কুলটাকে একটা ‘আলো পাঠশালা’ হিসেবে তৈরি করব? যেখানে শুধু অঙ্ক বা বাংলা নয়, শেখানো হবে—কীভাবে কান্না থামানো যায়, কীভাবে নীরব মানুষকে বোঝা যায়?”
অনিমেষ বলল,
“তা হলে চল শুরু করি আগামীকাল থেকেই। আমরা একটা গল্প দিয়েই শুরু করব—‘শেষ বিকেলের আলো’ দিয়ে।”
সেদিন থেকেই, মেঘতলির সেই ছোট্ট স্কুলে চালু হলো ‘আলো পাঠশালা’। সপ্তাহে একদিন—শুধু গল্প বলা, চিঠি লেখা, বর্ণনা করা—নিজের স্বপ্ন, ভয় আর ভালোবাসার। প্রতিটি শিশু নিজেকে খুঁজে পেল একটু একটু করে, আর অনিমেষ ও সায়ন্তনী জানল, মানুষের জীবনে আলোর উৎস একটাই—ভালোবাসা।
শেষ বিকেলের আলো ক্রমে গাঢ় হয়ে এলো। মেঘেরা নিচু হয়ে এসে আকাশ ঢেকে দিল, কিন্তু অশ্বত্থ গাছের নিচে তখনও বসে ছিল দু’টি মানুষ, যাদের জীবনে আলো মুছে যায় না, কারণ তারা নিজেরাই সেই আলো হয়ে উঠেছে।
***