Bangla - প্রেমের গল্প

শেষ বাঁশির আগে

Spread the love

আরিন মজুমদার


পর্ব ১ : প্রথম বাঁশি

বৃষ্টি ভিজে মাঠে সেই বিকেলটা যেন কলকাতার অন্য সব বিকেলের থেকে আলাদা। সল্টলেক স্টেডিয়ামের প্র্যাকটিস গ্রাউন্ডে সবুজ ঘাসের উপর ছোট ছোট জলকণা জমে উঠেছিল, যেন প্রত্যেকটা ঘাসের ডগায় একেকটা গল্প আটকে আছে। ঈশা চক্রবর্তী হাতে মেডিকেল কিট নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল মাঠের এক কোণে। নতুন দায়িত্বে এসেছে—দলের অফিশিয়াল ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে। খেলোয়াড়দের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা তার থাকলেও, পেশাদার ফুটবল দলের সঙ্গে এটাই প্রথম।

ঈশার চোখে বারবার চলে যাচ্ছিল নির্ভয় গাঙ্গুলির দিকে। দলের স্ট্রাইকার, এক সময়ের জাতীয় দলের প্রতিশ্রুতিমান নাম। কিন্তু গত মরশুমে হাঁটুর গুরুতর ইনজুরির পর সবকিছু পাল্টে গেছে। স্পোর্টস পেজের শিরোনামে সে আজ আর তেমন আসে না, বরং প্রশ্ন ওঠে—নির্ভয়ের কেরিয়ার কি শেষের পথে?

নির্ভয় আজ মাঠে আবার নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ঘামের সঙ্গে মিশে বৃষ্টির ফোঁটা তার শরীরকে চকচকে করে তুলছিল, যেন যুদ্ধক্ষেত্রে নামার আগে কোনো সৈনিকের দেহ। কিন্তু ঈশা লক্ষ্য করছিল, ওয়ার্ম আপের সময়ও তার বাঁ পা একটু টেনে হাঁটছে। ফিজিও হিসেবে এড়ানো যায় না এমন সূক্ষ্ম ইঙ্গিত।

“তুমি দেখছো ওর গেইট?” পেছন থেকে কোচ মেহেদি জিজ্ঞেস করল ঈশাকে।
ঈশা মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, এখনো পুরোপুরি ওকে হয়নি। ও নিজেকে চাপ দিচ্ছে।”
কোচের চোখে দ্বন্দ্ব স্পষ্ট—টিমের সবচেয়ে বড় ম্যাচ সামনে, কিন্তু সেরা খেলোয়াড় ফিট নয়।

ম্যাচ শুরুর আগে নির্ভয় এসে ঈশার পাশে দাঁড়াল। চোখেমুখে সেই চেনা দৃঢ়তা, কিন্তু ভিতরে কোথাও একটা ভাঙাচোরা গোপন আড়াল আছে।
“তুমি কি মনে করো আমি খেলতে পারব?”—নির্ভয়ের প্রশ্নে ঈশা এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল।
“আমার কাজ হচ্ছে সত্যি বলা। তুমি ঝুঁকি নিলে হয়তো ম্যাচ খেলতে পারবে, কিন্তু ভবিষ্যতে কেরিয়ারটাই শেষ হয়ে যেতে পারে।”
নির্ভয় হেসে উঠল। “কেরিয়ার তো এমনিই শেষের পথে। অন্তত শেষ বাঁশি বাজা পর্যন্ত লড়াই করে যেতে চাই।”

ঈশার ভেতরে হঠাৎ একটা অদ্ভুত টান তৈরি হল। এই মানুষটাকে সে চেনে কেবল ফাইলের রিপোর্টে, খেলোয়াড় হিসেবে পরিসংখ্যানে, আর মাঠে দৌড়নো শরীরের ছায়ায়। কিন্তু চোখের ভেতরের আগুন তাকে অন্য এক জায়গায় টেনে নিয়ে গেল।

খেলা শুরু হল। গ্যালারিতে অল্প দর্শক, কিন্তু বৃষ্টির শব্দ যেন করতালির মতো মাঠে ছড়িয়ে পড়েছে। নির্ভয় প্রথম কয়েক মিনিট স্বাভাবিক খেলার চেষ্টা করল। তার স্পর্শে এখনও সেই পুরনো ছোঁয়া আছে, বল পায়ে পেলে টিমমেটরা ভরসা পায়। কিন্তু তৃতীয় মিনিটে হঠাৎ ট্যাকল এড়াতে গিয়ে মাটিতে পড়ে গেল সে। পুরো মাঠ নিস্তব্ধ।

ঈশা দৌড়ে গেল মাঠে। মেডিকেল কিট খুলে হাঁটুতে হাত রাখতেই বুঝল, লিগামেন্টে বাড়তি চাপ পড়েছে। নির্ভয় কষে দাঁত চেপে বলল, “আমি ঠিক আছি। খেলাটা থামিও না।”
“তুমি খেলতে পারছ না, নির্ভয়। এটা পাগলামি।”
“পাগলামিই তো আমাকে এখানে এনেছে। তুমি শুধু বলো, আমি দাঁড়াতে পারব তো?”

ঈশা বুঝল, পেশার নিয়ম আর হৃদয়ের নিয়ম আলাদা। সে জানে এভাবে খেলানো উচিত নয়, কিন্তু নির্ভয়ের চোখে ভেসে উঠেছে সেই অসহায় দৃঢ়তা, যা শুধু একজন হার না মানা খেলোয়াড়ের নয়, বরং এক মানুষের—যে হয়তো জীবনের শেষ সুযোগ আঁকড়ে ধরে আছে।

শেষ পর্যন্ত কোচ সিদ্ধান্ত নিল তাকে নামানো যাবে না। দর্শকের গুঞ্জন শুরু হল। নির্ভয় রাগে-অভিমানে সাইডলাইনে বসে রইল। ঈশা পাশে এসে চুপ করে বসে পড়ল।
“তুমি আমাকে থামালে,” নির্ভয় ফিসফিস করে বলল।
“আমি তোমার ভবিষ্যত বাঁচালাম,” ঈশা জবাব দিল, কিন্তু কথাগুলো তার নিজের ভেতরেও কেমন যেন দোলা দিল।

সেদিন ম্যাচ হেরে গেল দল। কিন্তু ঈশার মনে হল, নির্ভয়ের সঙ্গে তার নতুন এক খেলা শুরু হয়ে গেছে—যার নাম সে এখনও জানে না।

পর্ব ২ : ইনজুরির ছায়া

স্টেডিয়ামের ভেতর সেদিনের হারের পর অদ্ভুত নীরবতা নেমে এসেছিল। খেলোয়াড়রা ধীরে ধীরে ড্রেসিংরুমের দিকে ফিরছিল, আর বাইরে বৃষ্টির জল গড়িয়ে নামছিল গ্যালারির খালি সিট বেয়ে। ঈশা মেডিকেল কিট কাঁধে নিয়ে হাঁটছিল ধীরে, কিন্তু চোখ তার বারবার চলে যাচ্ছিল নির্ভয়ের দিকে। সে এক কোণে বসে আছে, মাথা নিচু, চোয়াল শক্ত করে চেপে রাখা। পুরো শরীরটা ভিজে কাদামাখা হলেও সেই নিঃশব্দ যন্ত্রণা যেন চারপাশের বাতাসকেও ভারী করে তুলেছে।

ড্রেসিংরুমে ঢুকতেই টিম ম্যানেজার বলল, “আজকেই আবার রিপোর্ট বানাতে হবে। কাল প্র্যাকটিস সেশন নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
ঈশা মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। পেশাদার দায়িত্ব তার কাছে সবচেয়ে আগে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে নির্ভয়ের চোখের সেই ভাঙা আগুন যেন তাকে শান্ত থাকতে দিচ্ছিল না।

নির্ভয় সবার থেকে আলাদা হয়ে বসেছিল। ওর হাঁটুতে সাদা ব্যান্ডেজ পেঁচানো, কিন্তু মুখে স্পষ্ট রাগ আর অভিমান। ঈশা এগিয়ে গিয়ে বলল,
“তুমি কি এখন কিছুক্ষণ বরফের সেঁক নেবে?”
নির্ভয় তাকাল না। কেবল বলল, “তুমি চাইছ আমি মাঠেই না নামি।”
ঈশা ধীরে উত্তর দিল, “আমি চাই তুমি ভেঙে না পড়ো। একটা ম্যাচ হারলে আবার খেলা যাবে, কিন্তু তোমার হাঁটু একবার শেষ হয়ে গেলে আর ফিরবে না।”

কথাগুলো শুনে নির্ভয় প্রথমবার তার দিকে তাকাল। সেই চোখে একসঙ্গে জেদ, অভিমান, আর কোথাও যেন ভরসার ক্ষীণ আলো। “তুমি জানো? আমি যখন ছোট ছিলাম, বাবার কাছে শুনতাম ফুটবল মানেই যুদ্ধ। মাঠ মানে কেবল খেলা না, মানে মর্যাদা, মানে নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ। আজ আমি যদি বসে থাকি, মানুষ বলবে—নির্ভয় শেষ। আমি কি সেটা সহ্য করতে পারব?”

ঈশা জানত, খেলোয়াড়রা কেবল শরীর দিয়ে খেলে না—মনের ভেতরে যুদ্ধ করে প্রতিদিন। কিন্তু একজন ফিজিও হিসেবে তার কর্তব্য সত্যি কথা বলা। সে মৃদু স্বরে বলল, “তুমি যতই যুদ্ধের কথা বলো, একজন আহত সৈনিক যদি নিজের শরীরের কথা না ভাবে, তবে সেই সেনাদলও হারে। তুমি কেবল নিজের জন্য না, পুরো দলের জন্যও দরকার।”

কথার পর আবার নীরবতা নেমে এলো। বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে, জানলার কাঁচে জমা জলের ফোঁটায় ভাঙা আলো ঢুকছে ভেতরে।

পরের দিন সকালে ঈশা খুব ভোরে উঠে টিম ফিজিওর কক্ষে বসেছিল। রিপোর্ট লিখছিল। নির্ভয়ের নামের পাশে বড় করে লিখল—Partial ligament strain, left knee. Risk of recurrence if pressure continues. হাতে কলম থেমে গেল কিছুক্ষণ। রিপোর্টের অক্ষরগুলো হঠাৎ তার কাছে ঠাণ্ডা আর নিষ্ঠুর মনে হল। এই কাগজের কয়েকটা শব্দই নির্ভয়ের কেরিয়ার ঠিক করে দেবে।

ঠিক তখন দরজায় টোকা। নির্ভয় দাঁড়িয়ে। পরনে ট্র্যাকস্যুট, চোখে সারারাত জাগার ক্লান্তি।
“তুমি খুব সকালে ওঠো মনে হচ্ছে।”
ঈশা কিছু না বলে রিপোর্টটা উল্টে রাখল। “তুমি এসেছো?”
“হ্যাঁ, একটু কথা ছিল। তুমি কি আজ সন্ধ্যায় কিছু সময় পাবে?”

ঈশা অবাক হল। টিমের কোনো খেলোয়াড় সাধারণত ফিজিওকে মাঠের বাইরে ডাকতে সাহস করে না। কিন্তু নির্ভয়ের গলায় ছিল না কোনো অনুরোধ, ছিল নিঃশব্দ দৃঢ়তা।
“কেন?”
“আমার কিছু উত্তর দরকার। মাঠে নয়, বাইরে।”

সন্ধ্যায় তারা দুজন মেরিন ড্রাইভ ধরে হাঁটছিল। হাওয়া আসছিল নদীর দিক থেকে, আকাশে তখনও মেঘের রঙ মুছে যায়নি। রাস্তার আলো এক এক করে জ্বলছিল, আর সেই আলোর নিচে নির্ভয়ের ছায়া দীর্ঘ হয়ে পড়ছিল।

“তুমি কি সত্যি মনে করো আমার খেলা শেষ হয়ে যাবে?”—নির্ভয়ের কণ্ঠস্বর ভাঙা ছিল, কিন্তু চোখে লুকোনো তীব্র অস্থিরতা।
ঈশা উত্তর দিল, “শেষ হয়ে যাবে কি না সেটা নির্ভর করছে তোমার সিদ্ধান্তের উপর। যদি তুমি এখন বিশ্রাম নাও, যদি নিজেকে সময় দাও, তবে হয়তো আবার মাঠে ফিরতে পারবে। কিন্তু তুমি যদি তাড়াহুড়ো করো, তবে হ্যাঁ, শেষ।”

নির্ভয় থেমে দাঁড়াল। সাগরের ঢেউয়ের গর্জন তার কথাগুলোকে আরো ভারী করে তুলল। “আমি যদি খেলতে না পারি, তবে আমি কে? আমি তো শুধু বল নিয়ে দৌড়নো একটা শরীর না, আমি তার থেকেও বেশি কিছু হতে চাই। আমি চাই মানুষ আমাকে মনে রাখুক।”

ঈশা অনুভব করল তার বুকের ভেতর কেমন যেন চাপ তৈরি হচ্ছে। সে ধীরে বলল, “মানুষ তোমাকে মনে রাখবে তোমার লড়াইয়ের জন্য, তোমার সততার জন্য। কেরিয়ার শেষ হলেও জীবন শেষ হয় না।”

এক মুহূর্তের জন্য নির্ভয়ের চোখে জল চকচক করে উঠল, কিন্তু সে মুখ ফিরিয়ে ফেলল।
“তুমি জানো, আমি কখনো এত খোলাখুলি কাউকে কিছু বলিনি। মাঠে আমি সবসময় হিরো, সবাই ভাবে নির্ভয় কিছুতে ভয় পায় না। কিন্তু সত্যিটা হলো, আমি ভীষণ ভয় পাই—হারিয়ে যাওয়ার ভয়, অচেনা হয়ে যাওয়ার ভয়।”

ঈশা তার দিকে তাকিয়ে রইল। এই নির্ভয়কে সে আগে কখনো দেখেনি। ভেতরের ভাঙা মানুষটাকে হঠাৎ সে খুব কাছে অনুভব করল।
“তাহলে ভয়টা ভাগ করে নাও। একা বয়ে বেড়িও না।”

নির্ভয় তার দিকে চেয়ে রইল অনেকক্ষণ। বাতাসে চুল উড়ে যাচ্ছিল ঈশার মুখে, সে হাত দিয়ে চুল সরাতেই নির্ভয় মৃদু হেসে উঠল। “তুমি অদ্ভুত, ঈশা। তুমি আমাকে থামাচ্ছো, অথচ আমি মনে করি তুমি-ই একমাত্র আমার ভেতরের আগুনটা বুঝতে পারছো।”

সেদিন তারা দুজন অনেকক্ষণ কথা বলল। খেলা, জীবন, হারানো সুযোগ—সবকিছু নিয়ে। আর সেই রাতেই প্রথমবার ঈশার মনে হল, এই সম্পর্কটা হয়তো কেবল ফিজিও আর খেলোয়াড়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না।

রাত বারোটার পর ঈশা হোস্টেলের ঘরে ফিরে এসে ডায়েরি খুলল। লিখল—
নির্ভয়ের চোখে আজ আমি এক নতুন মানুষকে দেখলাম। শক্তির আড়ালে ভাঙন, হাসির আড়ালে ভয়। আমি কি প্রস্তুত আছি এই মানুষের পাশে দাঁড়াবার জন্য?”

ডায়েরির পাতায় কালির দাগ ছড়িয়ে গেল হঠাৎ। তার আঙুল কাঁপছিল। হয়তো সে নিজেই বুঝতে পারছিল না—এটা কি কেবল দায়িত্বের টান, না কি ধীরে ধীরে অন্য কোনো গল্প বোনা শুরু হয়েছে?

সেই প্রশ্নের উত্তর তখনও আসেনি। কিন্তু কোথাও একটা বাঁশির শব্দ যেন শোনা যাচ্ছিল—যেন নতুন খেলার শুরু হতে চলেছে।

পর্ব ৩ : নতুন খেলার শুরু

পরের সপ্তাহে দল আবার প্র্যাকটিসে ফিরল। মাঠের চারপাশে শিস, বাঁশি, আর কোচ মেহেদির তীক্ষ্ণ নির্দেশে ভরে উঠল বিকেলটা। খেলোয়াড়রা বল পায়ে ছুটছিল, কেউ কেউ ফ্রি কিক প্র্যাকটিসে মগ্ন। কিন্তু নির্ভয় ছিল আলাদা ট্রেনিং জোনে, ফিজিওর নির্দেশে লাইট রানিং আর স্ট্রেচিং করছিল। ঈশা সাইডলাইনে দাঁড়িয়ে খেয়াল করছিল প্রতিটি ভঙ্গি, প্রতিটি পায়ের মুভমেন্ট।

হঠাৎ নির্ভয় বলেই উঠল, “আমাকে খেলার সুযোগ দাও। আমি পারব।”
ঈশা শান্ত গলায় বলল, “তুমি এখনো পুরোপুরি ফিট নও। ঝুঁকি নিলে আবার ভেঙে পড়বে।”
নির্ভয় ঠোঁট চেপে বলল, “ঝুঁকি না নিলে খেলোয়াড়ের নাম হয় না।”

এই টানাপোড়েনের ভেতরেই কোচ মেহেদি এসে হাজির। “ঈশা, নির্ভয়কে নিয়ে তোমার রিপোর্ট আমি দেখেছি। কিন্তু ম্যানেজমেন্ট চাপ দিচ্ছে, পরের ম্যাচে ওকে নামাতে হবে।”
ঈশা বিস্মিত হয়ে তাকাল। “আপনি জানেন এটা ঝুঁকিপূর্ণ।”
“জানি,” কোচ দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “কিন্তু স্পন্সর, দর্শক, মিডিয়া—সবাই চাইছে নির্ভয়কে দেখতে। ও নামলে টিকিট বিক্রি হবে, আলোচনায় আসবে দল। কখনো কখনো খেলার বাইরের খেলা বড় হয়ে ওঠে।”

ঈশার ভেতরে ক্ষোভ জমে উঠল। একজন মানুষের শরীর আর স্বপ্নকে কেবল ব্যবসার হিসেবে মাপা যায়? কিন্তু সে কিছু বলল না। শুধু চোখে চোখ রেখে নির্ভয়কে বোঝাতে চাইলো—এই খেলাটা অন্যরকম।

প্র্যাকটিসের পর সন্ধ্যায় ঈশা একা বসেছিল স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে। মাঠ তখন খালি, শুধু বাতিগুলো নরম আলো ছড়াচ্ছে। এমন সময় নির্ভয় এসে বসল তার পাশে। হাতে পানির বোতল, মুখে ক্লান্ত হাসি।

“তুমি জানো, আমি ভেবেছিলাম তুমি আমার বিপক্ষে থাকবে সবসময়।”
ঈশা অবাক হয়ে তাকাল। “কেন এমনটা ভাবলে?”
“কারণ তুমি চাইছো আমি খেলাটা ছেড়ে দিই। অথচ আমি চাই প্রমাণ করতে, আমি এখনো শেষ হইনি।”

ঈশা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ধীরে বলল, “আমি তোমার বিপক্ষে নই, নির্ভয়। আমি তোমার শরীরের পক্ষে। তুমি যদি আজ নিজের শরীরকে ধ্বংস করো, তবে আগামীকাল তোমার স্বপ্নও শেষ হবে।”

নির্ভয় গভীরভাবে তাকাল তার দিকে। সেই দৃষ্টিতে ছিল না কোনো অহংকার, বরং এক ধরনের স্বীকারোক্তি।
“তুমি কি জানো, আমি আসলে কেন এত লড়ছি? শুধু নিজের নাম বাঁচানোর জন্য নয়। আমার মা এখনো প্রতিদিন সকালে আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করে—‘তুই আবার মাঠে নামবি তো?’ আমি চাই না ওর চোখে হতাশা দেখতে। ও একসময় নিজের স্বপ্ন মাটিচাপা দিয়েছে আমার জন্য। এখন আমি যদি হেরে যাই, তবে ওর স্বপ্নও মরে যাবে।”

ঈশার বুক কেঁপে উঠল। নির্ভয়কে সে প্রথমবার অন্য আলোয় দেখতে পেল—একজন ছেলের মতো, যে নিজের পরিবারের জন্য যুদ্ধ করছে। সেই মুহূর্তে তার পেশাগত দূরত্ব ভেঙে গেল খানিকটা।

“তুমি যদি সত্যিই আবার মাঠে ফিরতে চাও,” ঈশা বলল, “তবে আমাকে ভরসা করো। আমার নির্দেশ মেনে চল। আমি তোমাকে প্রস্তুত করব, কিন্তু তাড়াহুড়ো করলে আমি পাশে থাকব না।”

নির্ভয় হেসে উঠল। “ঠিক আছে। তবে শর্ত আছে—তুমি প্রতিদিন আমার সঙ্গে প্র্যাকটিসে থাকবে। শুধু ফিজিও হিসেবে নয়, আমার সহযোদ্ধা হিসেবে।”

ঈশা একটু ইতস্তত করল, তারপর মাথা নেড়ে রাজি হয়ে গেল। হয়তো এটাই তাদের গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দেবে।

এরপর শুরু হল নতুন অধ্যায়। ভোরবেলা, যখন মাঠে এখনো রোদ ওঠেনি, নির্ভয় আর ঈশা একসঙ্গে হাজির হতো ট্রেনিং সেশনে। নির্ভয় ট্রেডমিলে দৌড়াত, ঈশা স্টপওয়াচ হাতে সময় মাপত। ফিজিওথেরাপির প্রতিটি স্টেপ সে মনোযোগ দিয়ে করত, আর ঈশা তার হাঁটুর অবস্থা পরীক্ষা করত বারবার।

কিছুদিনের মধ্যেই তাদের মধ্যে অদ্ভুত এক ছন্দ তৈরি হয়ে গেল। ব্যায়ামের মাঝেই নির্ভয় হঠাৎ মজা করে বলত,
“তুমি কি সবসময় এত সিরিয়াস থাকো?”
ঈশা হেসে উত্তর দিত, “ফিজিওদের কাজই সিরিয়াস। নাহলে খেলোয়াড়রা মাঠেই ভেঙে পড়বে।”
“তাহলে আমাকেও বাঁচানোর জন্যই এত সিরিয়াস?”
ঈশা চোখ সরিয়ে বলত, “হয়তো।”

কথাগুলো হালকা হলেও, ভেতরে কোথাও টান স্পষ্ট হচ্ছিল।

কিন্তু বাইরের দুনিয়া এত সহজ ছিল না। মিডিয়া প্রতিদিন শিরোনাম করছিল—নির্ভয়ের প্রত্যাবর্তন কবে?” আর সোশ্যাল মিডিয়ায় সমর্থকেরা দাবি জানাচ্ছিল তাকে আবার মাঠে দেখতে। দলের মালিকও কোচকে ফোন করে বলছিল, “ওকে মাঠে না নামালে স্পন্সরের চুক্তি ভেস্তে যাবে।”

এই চাপের ভেতর একদিন মিটিং ডাকল ম্যানেজমেন্ট। বড় টেবিলের চারপাশে বসে সবাই নির্ভয়ের ফিটনেস নিয়ে আলোচনা করছিল। টিম ডাক্তার বলল, “ও এখনো ৭০% ফিট।”
কোচ মেহেদি মাথা চুলকাচ্ছিলেন। “কিন্তু আমাদের হাতে সময় নেই।”
তখন ঈশা দৃঢ় গলায় বলল, “আমি স্পষ্ট জানাচ্ছি—নির্ভয় এখন খেলতে নামলে বড় ঝুঁকি আছে।”

ঘরে মুহূর্তে নীরবতা নেমে এল। মালিক ঠান্ডা গলায় বললেন, “ম্যাচ হারলে দায় কে নেবে? স্পন্সর হারালে দায় কে নেবে?”

ঈশা জানত, এই খেলাটা শুধু মাঠে নয়, বোর্ডরুমেও লড়া হয়। কিন্তু নির্ভয়ের দিকে তাকিয়ে সে সিদ্ধান্ত নিল—যা-ই হোক, সত্যি কথা না বললে চলবে না।

রাতের দিকে নির্ভয় এসে ঈশার দরজায় দাঁড়াল।
“আজ তুমি আমাকে বাঁচালে।”
ঈশা অবাক হল। “আমি তো শুধু সত্যি বলেছি।”
“না, তুমি আমাকে চাপ থেকে বাঁচালে। সবাই চাইছে আমি ঝুঁকি নেই। শুধু তুমি বললে—না। বিশ্বাস করো, এটা আমার জন্য অনেক।”

ঈশা মৃদু হেসে বলল, “আমি যদি তোমার পাশে না দাঁড়াই, তবে আমার কাজটাই ব্যর্থ।”
নির্ভয় এগিয়ে এসে ধীরে ফিসফিস করে বলল, “তুমি শুধু আমার ফিজিও নও, ঈশা। তুমি আমার আশ্বাস।”

সেই মুহূর্তে বাতাসে অদ্ভুত নীরবতা তৈরি হল। দুজনেই কথা হারাল। হয়তো খেলার মাঠের বাইরেও আরেকটা খেলা শুরু হয়ে গেছে—যেটার নিয়ম কেউ জানে না।

পর্ব ৪ : মিডিয়ার চোখে

সকালটা অস্বাভাবিকভাবে কোলাহলপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। ক্লাবের গেটে ঢুকতেই ঈশা দেখল, সাংবাদিকদের ভিড়। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ, মাইক্রোফোনের বন্যা, আর একটার পর একটা প্রশ্ন—
“নির্ভয় কি খেলবে আগামী ম্যাচে?”
“ওর হাঁটু কতটা ফিট?”
“কোচ কি ঝুঁকি নিতে চাইছেন?”

ঈশা চেষ্টা করল ভিড় সরিয়ে ভেতরে ঢুকতে, কিন্তু একজন রিপোর্টার তার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল।
“ম্যাম, আপনি দলের ফিজিও, সোজাসুজি বলুন—নির্ভয় কি ফিরছে?”
ঈশা ঠান্ডা গলায় জবাব দিল, “আমার কাজ খেলোয়াড়দের সুস্থ রাখা, অনুমান দেওয়া নয়। আপনি অফিসিয়াল রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করুন।”

কিন্তু ততক্ষণে ক্যামেরায় তার কথাগুলো রেকর্ড হয়ে গেছে। রাতের নিউজে শিরোনাম হল—ফিজিওর ইঙ্গিত, নির্ভয় এখনও প্রস্তুত নয়!”

ড্রেসিংরুমে ঢুকতেই নির্ভয় খবরটা জানল। হাতে মোবাইল নিয়ে গম্ভীর মুখে বসেছিল।
“তুমি কি সত্যিই এটা বলেছো?” তার কণ্ঠে ক্ষীণ রাগের সুর।
ঈশা ব্যাখ্যা করল, “না, আমি শুধু বলেছি অনুমান দেব না। বাকিটা ওরা বানিয়েছে।”
নির্ভয় চোখ সরিয়ে ফিসফিস করে বলল, “মানুষ এখন ভাববে আমি দুর্বল। আমি চাই না কেউ আমাকে করুণা করুক।”

ঈশা এক মুহূর্ত থেমে শান্ত গলায় বলল, “দুর্বলতা মানে করুণা নয়। এটা মানে তুমি মানুষ, মেশিন নও। সবাই ভুলে যায় সেটা।”
নির্ভয় আর কিছু বলল না। শুধু চোখে এক ধরনের হতাশা ছড়িয়ে পড়ল।

দুপুরের মিটিংয়ে কোচ মেহেদি চাপে ভরা কণ্ঠে জানালেন, “ম্যানেজমেন্ট চাইছে নির্ভয়কে মাঠে নামাতে। কিন্তু যদি ও ফিট না থাকে, আমরা ঝুঁকিতে পড়ব।”
ঈশা সোজা হয়ে বলল, “আমি মেডিকেল রিপোর্টে সই করে দায়িত্ব নিতে পারব না। আমার পেশার শপথ এর বিরুদ্ধে।”

ঘরটা জমে উঠল গরম তর্কে। অবশেষে সিদ্ধান্ত হল—পরের ম্যাচের আগে একটা ফিটনেস টেস্ট হবে, সাংবাদিকদের সামনেই। নির্ভয়কে প্রমাণ করতে হবে সে খেলতে সক্ষম।

পরদিন সকালে মিডিয়ার সামনে নির্ভয়ের ফিটনেস টেস্ট শুরু হল। চারপাশে ক্যামেরা, দর্শক, ক্লাব অফিশিয়াল—সবাই তাকিয়ে। নির্ভয় দৌড় শুরু করল, স্ট্রেচ করল, জাম্প করল। প্রথমে সব স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ স্প্রিন্টের সময় সে থেমে গেল, মুখে ব্যথার ছাপ।

ঈশা ছুটে গেল কাছে। “কি হলো?”
নির্ভয় দাঁত চেপে বলল, “আমি ঠিক আছি। আমাকে থামিও না।”
ক্যামেরাগুলো সেই দৃশ্য ধরে ফেলল। কিছু সাংবাদিক হাসাহাসি শুরু করল—দেখো, আসলেই ভাঙা।

ঈশা ব্যথিত দৃষ্টিতে তাকাল। তার মনে হচ্ছিল, নির্ভয় যেন শুধু নিজের হাঁটুর সঙ্গে নয়, পুরো পৃথিবীর অবিশ্বাসের সঙ্গে যুদ্ধ করছে।

সেই সন্ধ্যায় নির্ভয় একা বসেছিল প্র্যাকটিস গ্রাউন্ডে। আলো নিভে আসছিল, গ্যালারি ফাঁকা। ঈশা চুপচাপ এসে বসে পড়ল তার পাশে।
“আজ তুমি কেন এত জেদ করলে?”
নির্ভয় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “কারণ আমি জানি—যদি আমি হেরে যাই, আগামীকাল আর কেউ আমাকে মনে রাখবে না। খেলোয়াড়রা স্মৃতির থেকেও দ্রুত মুছে যায়।”

ঈশা ধীরে উত্তর দিল, “মানুষ শুধু জয়কেই মনে রাখে না। তারা মনে রাখে লড়াই, তারা মনে রাখে সত্যিকারের আবেগ। আজ তুমি ভাঙা শরীর নিয়ে দাঁড়িয়েও লড়েছো—এটা ছোট ব্যাপার নয়।”

নির্ভয় তার দিকে তাকাল। সেই দৃষ্টিতে ছিল অবাক কৃতজ্ঞতা। “তুমি কি সত্যিই মনে করো মানুষ এটা মনে রাখবে?”
ঈশা মৃদু হেসে বলল, “আমি তো তোমাকে মনে রেখেছি। এতেই প্রমাণ হয়।”

ওদের চোখ দুটো একে অপরের দিকে স্থির হয়ে গেল। চারপাশে শুধু রাতের বাতাস, দূরে শহরের আলো। মুহূর্তটা নীরব, অথচ ভেতরে ভেতরে জটিল।

এদিকে মিডিয়ার চাপে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে উঠল। সোশ্যাল মিডিয়ায় হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ড করছে—#BringBackNirbhoy। দর্শকরা ক্ষোভ দেখাচ্ছে, কেন তাকে মাঠে নামানো হচ্ছে না। ম্যানেজমেন্ট বারবার কোচকে ফোন করছে।

কোচ এক রাতে নির্ভয়কে ডেকে বললেন, “দেখো, তোমাকে খেলতেই হবে। না খেললে টিম ভেঙে পড়বে। কিন্তু আমি চাই না তুমি ভেঙে যাও।”
নির্ভয় উত্তর দিল, “আমি ভাঙলেও লড়ব। এটা আমার শেষ সুযোগ।”

ঈশা এ কথা শুনে রাগে ফেটে পড়ল। “তুমি বুঝছো না, এটা কেবল তোমার খেলা নয়, তোমার জীবন। যদি আজকেই হাঁটু নষ্ট হয়, তবে তুমি হয়তো আর হাঁটতেই পারবে না।”
নির্ভয় চুপ করে তার দিকে তাকাল। তারপর হঠাৎ বলল, “তাহলে তুমি বলো, আমি কী করব?”

ঈশা থমকে গেল। এতদিন ধরে সে কেবল ডাক্তারি যুক্তি দিয়ে উত্তর দিয়েছে। কিন্তু আজ নির্ভয়ের প্রশ্নে তার নিজের ভেতরেও দ্বন্দ্ব তৈরি হল। সে কি চাইছে নির্ভয়কে বাঁচাতে, নাকি চাইছে তাকে থামিয়ে নিজের হৃদয়ের কথা শোনাতে?

সেই রাতে ঈশা আবার ডায়েরি খুলল। লিখল—
আমার পেশা আমাকে বলে নির্ভয়কে থামাতে হবে। কিন্তু আমার হৃদয় চায় তাকে লড়তে দেখতে। আমি কি নিজেও খেলোয়াড় হয়ে গেছি, যে মাঠে না নামলে শান্তি পায় না?”

শব্দগুলো কাঁপছিল, যেমন কাঁপছিল তার ভেতরের দ্বন্দ্ব।

পরদিন সকালে নির্ভয় প্র্যাকটিসে এল আগের চেয়ে দৃঢ় মুখ নিয়ে। ঈশাকে দেখে বলল, “আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি খেলব। ঝুঁকি থাকলেও। কিন্তু একটা শর্ত আছে।”
ঈশা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী শর্ত?”
“তুমি আমার পাশে থাকবে। মাঠে, মাঠের বাইরে—সব জায়গায়। তুমি যদি থাকো, আমি ভয় পাব না।”

ঈশা হতবাক হয়ে গেল। এ কি শুধু এক খেলোয়াড়ের অনুরোধ, নাকি এর ভেতরে অন্য কোনো স্বীকারোক্তি লুকোনো? তার বুকের ভেতরে অদ্ভুত উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ল।

সে শুধু মাথা নেড়ে বলল, “আমি থাকব।”

 

পর্ব ৫ : ম্যাচের দিন

গ্যালারির বাইরে মানুষের ঢল নেমেছে। শহরজুড়ে পোস্টার—নির্ভয় আবার ফিরছে। টিকিট সব বিক্রি হয়ে গেছে আগেভাগেই, কালোবাজারে দ্বিগুণ দামে চলছে লেনদেন। টেলিভিশনের ক্যামেরা সাজানো হয়েছে প্রতিটি কোণায়। যেন এ ম্যাচ শুধু একটা খেলা নয়, নির্ভয়ের ভাগ্যের রায়।

ড্রেসিংরুমে খেলোয়াড়দের মুখে চাপা উত্তেজনা। কোচ মেহেদি শেষবারের মতো কৌশল বোঝাচ্ছিলেন। কিন্তু সব চোখই বারবার চলে যাচ্ছিল নির্ভয়ের দিকে। হাঁটুতে শক্ত ব্যান্ডেজ, গায়ে জার্সি, চোখে সেই পুরনো আগুন।

ঈশা সাইডলাইনে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। তার ভেতরে এক অদ্ভুত অশান্তি। পেশাগত দায়িত্ব তাকে বারবার বলছে—তাকে নামিও না। কিন্তু হৃদয় তাকে চুপ করিয়ে দিচ্ছে। নির্ভয়ের মুখের দৃঢ়তা দেখে তার মনে হচ্ছিল, এই মানুষটাকে আটকানো অসম্ভব।

ম্যাচ শুরুর আগে কোচ আলাদা করে ঈশাকে ডেকে বললেন, “তুমি মাঠের সাইডে থাকো। ও যদি পড়ে যায়, প্রথমেই তোমাকে দৌড়াতে হবে।”
ঈশা মাথা নেড়ে সম্মতি দিল, কিন্তু মনে মনে প্রার্থনা করল—ঈশ্বর, যেন পড়ে না যায়।

হুইসেলের শব্দে খেলা শুরু হল। স্টেডিয়াম গর্জে উঠল। নির্ভয় প্রথম কয়েক মিনিটেই বল পায়ে পেয়ে পুরনো ছন্দ ফিরিয়ে আনল। দর্শকরা উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিল। ধারাভাষ্যকার চিৎকার করে বলল—নির্ভয় আবার মাঠে জাদু দেখাচ্ছে!”

কিন্তু ঈশা খেয়াল করল, দৌড়ের মাঝে মাঝেই সে অল্প খুঁড়িয়ে যাচ্ছে। তার চোখ বারবার হাঁটুর দিকে চলে যাচ্ছিল।
“কতক্ষণ টিকবে?”—মনে মনে প্রশ্ন করছিল সে।

২০ মিনিটের মাথায় প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডার শক্ত ট্যাকল করল। নির্ভয় বল বাঁচালেও মাটিতে পড়ে গেল। পুরো গ্যালারি নিস্তব্ধ। ঈশা কিট নিয়ে দৌড় দিল।
“কেমন লাগছে?”—সে হাঁটু ধরে পরীক্ষা করল।
নির্ভয় দাঁত চেপে বলল, “আমি পারব। আমাকে উঠতে দাও।”
“তুমি ঝুঁকি নিচ্ছো।”
“আমার জীবনটাই ঝুঁকি, ঈশা। তুমি আমাকে থামিও না।”

দর্শকরা তখন স্লোগান তুলেছে—“নির্ভয়! নির্ভয়!”। চাপটা এমন, যে ঈশা আর না বলতে পারল না। সে শুধু ব্যান্ডেজ টাইট করে দিল আর ফিসফিস করে বলল, “নিজেকে শুনো, দর্শকদের নয়।”

খেলা আবার শুরু হল। এবার নির্ভয় যেন আগুন হয়ে উঠল। প্রতিপক্ষকে ফাঁকি দিয়ে একের পর এক দৌড়, বল কন্ট্রোল, শট। ৩৫ মিনিটে সে দুর্দান্ত গোল করল। স্টেডিয়াম বিস্ফোরিত হল চিৎকারে। গ্যালারি থেকে স্লোগান ছড়িয়ে পড়ল—“নির্ভয় ফিরে এসেছে!”

ঈশার চোখে জল চলে এল অজান্তেই। সে বুঝতে পারছিল, এ দৃশ্য শুধু ফুটবলের নয়, এক মানুষের পুনর্জন্ম।

কিন্তু আনন্দ বেশিক্ষণ টিকল না। দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি নির্ভয় আবার পড়ে গেল মাটিতে। এবার মুখে তীব্র ব্যথার ছাপ। ঈশা ছুটে গিয়ে হাঁটু পরীক্ষা করল। পেশিতে টান ধরা পড়েছে।
“তুমি আর পারছো না।”
নির্ভয় ফিসফিস করে বলল, “আমি শেষ বাঁশি শুনব দাঁড়িয়ে।”

ঈশার ভেতরে যুদ্ধ শুরু হল। একদিকে ডাক্তারি দায়িত্ব, অন্যদিকে তার হৃদয়ের টান। অবশেষে সে কোচকে বলল, “আরেকটু খেলতে দিন। যদি এখন নামিয়ে দিই, ওর আত্মবিশ্বাস ভেঙে যাবে।”

কোচ অবাক হয়ে তাকাল, কিন্তু সম্মতি দিলেন।

শেষ দশ মিনিট। নির্ভয় বল পেল কর্নার থেকে। ভিড়ের ভেতর মাথা তুলে শট করল—আরেকটা গোল! গ্যালারি উন্মাদ। ধারাভাষ্যকার চিৎকার করছে—নির্ভয় ইতিহাস লিখছে!”

কিন্তু গোলের পরেই নির্ভয় মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। হাঁটু শক্ত হয়ে গেছে। এবার সত্যিই আর উঠতে পারছে না। ঈশা দৌড়ে গিয়ে হাঁটু ধরে ফিসফিস করল, “তুমি তোমার প্রতিশ্রুতি রাখলে। এবার আমাকে দায়িত্ব নিতে দাও।”

খেলার শেষ বাঁশি বাজল। দল জিতল। দর্শকরা মাঠে ঢুকে পড়ল নির্ভয়কে কাঁধে তুলে নিতে। কিন্তু ঈশার চোখে অদ্ভুত ভয় জমল। সে জানত—এই জয় হয়তো নির্ভয়ের কেরিয়ার শেষ করে দিল।

রাতের পর টিম বাসে ফিরছিল সবাই। জয়োল্লাস, গানের সুর, করতালি—সবকিছুতে ভরে উঠেছিল পরিবেশ। কিন্তু নির্ভয় চুপ করে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল। ঈশা তার পাশে বসে কেবল হাঁটুর উপর বরফের প্যাক চাপিয়ে রেখেছিল।

“তুমি জিতেছো।” ঈশা বলল।
“কিন্তু কি হারালাম জানো?” নির্ভয় ধীরে উত্তর দিল।
“তুমি কিছু হারাওনি। তুমি প্রমাণ করেছো তুমি লড়াকু।”
নির্ভয় তার দিকে ঘুরে তাকাল। “আর তুমি? তুমি কি প্রমাণ করোনি যে তুমি কেবল ফিজিও নও, আমার সবচেয়ে বড় সহযোদ্ধা?”

ঈশার বুক কেঁপে উঠল। এই মানুষটার জেদ, ব্যথা, আর অদ্ভুত আকর্ষণ তাকে পুরোপুরি টেনে নিচ্ছিল।

সেই রাতে হোটেলে ঈশা ঘুমোতে পারছিল না। বারবার ভেসে উঠছিল নির্ভয়ের মুখ, তার কণ্ঠ, তার জেদ। ডায়েরির পাতায় লিখল—
আজ মাঠে আমি কেবল চিকিৎসক ছিলাম না। আমি ছিলাম এক সহযোদ্ধা, যে হৃদয়ের খেলায় হেরে যাচ্ছে প্রতিদিন।

বাইরে তখন শহরের আলো, দূরে বাজির শব্দ। কিন্তু ঈশার মনে হচ্ছিল আসল বাজি বাজছে তার ভেতরে।

পরের দিন সকালে পত্রিকার শিরোনাম—অসাধারণ প্রত্যাবর্তন! নির্ভয়ের জোড়া গোল।
কিন্তু ছোট্ট এক কলামে লেখা—ডাক্তারদের আশঙ্কা, চোট বাড়তে পারে।

ঈশা পত্রিকাটা ভাঁজ করে রাখল। তার চোখে ভয়ের রেখা। জয় আসলেও, সামনে আসছে এক ভয়ঙ্কর পরীক্ষা—নির্ভয়ের ভবিষ্যতের।

পর্ব ৬ : ইনজুরির বোঝা

জয়ের উল্লাসে শহর যেন ঘুমোতেই ভুলে গিয়েছিল। সব সংবাদপত্র, সব নিউজচ্যানেল শুধু এক নামের জয়গান গাইছিল—নির্ভয়। তার ছবি বিলবোর্ডে, টিভি স্ক্রিনে, সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতিটি পোস্টে। অলৌকিক প্রত্যাবর্তন!”—এমন শিরোনাম সবাইকে মাতিয়ে তুলেছিল।

কিন্তু নির্ভয়ের ঘরে নেমে এসেছিল অন্য এক নীরবতা। খেলার পরে তার হাঁটু ফুলে উঠেছিল ভয়ঙ্করভাবে। প্রতি পদক্ষেপে ব্যথা ছড়িয়ে যাচ্ছিল পায়ের গোড়ালি থেকে কোমর পর্যন্ত। ঈশা বরফের সেঁক দিচ্ছিল ধীরে ধীরে।

“তুমি জানো,” ঈশা ফিসফিস করে বলল, “এটা কোনো সাধারণ ইনজুরি নয়। তুমি আবার খেললে, হয়তো আর কখনো স্বাভাবিকভাবে হাঁটতেই পারবে না।”

নির্ভয় চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল। “আমি জয় এনেছি। আমি আমার কথা রেখেছি। এখন যদি শেষ হয়ে যাই, তাও মানুষ আমাকে মনে রাখবে।”

ঈশার বুকটা হঠাৎ ভেঙে গেল। “মানুষ মনে রাখবে, কিন্তু তুমি? তোমার জীবনটা তখন কীভাবে চলবে? মাঠ ছাড়া তুমি কীভাবে বাঁচবে?”

নির্ভয় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “জীবনটা তো আমি কখনো মাঠ ছাড়া কল্পনাই করিনি।”

পরদিন সকালে ক্লাব ডাক্তাররা নির্ভয়ের এমআরআই রিপোর্ট হাতে পেল। ফলাফল ভয়ঙ্কর—লিগামেন্টে গভীর ছিঁড় ধরেছে। অপারেশন ছাড়া উপায় নেই। অন্তত ছয় মাস মাঠের বাইরে থাকতে হবে।

রিপোর্ট শোনার পর নির্ভয় প্রথমে চুপ করে রইল। তারপর হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে রাগে চিৎকার করল, “ছয় মাস? মানে আমার কেরিয়ার শেষ! আমি ফিরে আসতে পারব না।”

ঈশা শান্ত কণ্ঠে বলল, “ফিরতে পারবে, যদি তুমি ধৈর্য ধরো।”
নির্ভয় চোখ রাঙাল। “তুমি বোঝো না। আমার হাতে সময় নেই। মিডিয়া, দর্শক—সবাই অপেক্ষা করছে। ছয় মাস পর আর কেউ আমাকে মনে রাখবে না।”

ঈশা দৃঢ় গলায় বলল, “যদি তুমি এখন মাঠে নামো, তুমি শুধু দর্শকের নয়, নিজের কাছেও শেষ হয়ে যাবে।”

নীরবতা ছড়িয়ে পড়ল। নির্ভয়ের চোখে জল চিকচিক করে উঠল, কিন্তু সে মাথা ঘুরিয়ে নিল।

এদিকে মিডিয়া চাপে ফেটে পড়ছিল। কেউ বলছিল—নির্ভয়কে এখনই আবার নামাও, কেউ বলছিল—ইনজুরি লুকোনো হচ্ছে। সমর্থকরা ক্লাবের গেটে মিছিল করছিল, ব্যানার হাতে—“আমাদের হিরোকে ফিরিয়ে দাও।”

কোচ মেহেদি ভেতরে ভেতরে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। ম্যানেজমেন্ট প্রতিদিন ফোন করে বলছিল—“নির্ভয় ছাড়া স্পন্সরের চুক্তি বাতিল হয়ে যাবে।”

এক রাতে মেহেদি ঈশাকে ডেকে বললেন, “তুমি কি নিশ্চিত অপারেশন ছাড়া উপায় নেই?”
ঈশা জোর গলায় উত্তর দিল, “হ্যাঁ। অপারেশন ছাড়া ওর হাঁটু ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি রিপোর্টে মিথ্যা লিখব না।”

কোচ তার দিকে তাকালেন ক্লান্ত চোখে। “তুমি জানো, তুমি কত বড় ঝুঁকি নিচ্ছো? সবাই তোমার বিরুদ্ধেই যাবে।”
ঈশা শান্তভাবে বলল, “আমি চিকিৎসক। আমার কাজ সত্যি বলা। এর বাইরে আমি কিছু করব না।”

কিন্তু নির্ভয় অন্যরকম যুদ্ধ চালাচ্ছিল নিজের ভেতরে। রাতে একা হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে ঈশাকে বলল, “তুমি জানো, আমি ছোটবেলায় একটা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। আমি দেশকে গর্বিত করব। আমি মাঠে মরব, তবু হেরে যাব না। আজ যদি অপারেশনের জন্য বসে যাই, তবে সেই প্রতিজ্ঞার মানে কী থাকবে?”

ঈশা এগিয়ে এসে তার পাশে দাঁড়াল। “প্রতিজ্ঞা মানে শুধু জয় নয়। প্রতিজ্ঞা মানে নিজের সীমার সন্মানও রাখা। তুমি যদি নিজের শরীর ভেঙে দাও, তবে প্রতিজ্ঞাই ভেঙে যাবে।”

নির্ভয় তার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কি সত্যিই বিশ্বাস করো আমি আবার ফিরতে পারব?”
ঈশা তার হাত স্পর্শ করল। “হ্যাঁ। যদি তুমি আমাকে বিশ্বাস করো।”

মুহূর্তটা অদ্ভুত হয়ে উঠল। বাতাস থমকে গেল, শহরের আলো ঝাপসা হয়ে গেল। তাদের চোখে চোখ আটকে গেল। হয়তো সেখানে জন্ম নিচ্ছিল এক সম্পর্ক, যা খেলার বাইরের, কিন্তু খেলার মতোই তীব্র।

কিছুদিন পরে অপারেশনের দিন ঠিক হল। মিডিয়া পাগলের মতো নিউজ করছিল। নির্ভয়ের শেষ ম্যাচ হয়ে গেল?”—এই শিরোনাম ছড়িয়ে পড়েছিল প্রতিটি চ্যানেলে।

অপারেশনের আগে নির্ভয় ঈশাকে বলল, “যদি আমি ফিরতে না পারি?”
ঈশা দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দিল, “তুমি ফিরবে। কারণ আমি তোমাকে ফিরিয়ে আনব।”

অপারেশন সফল হল, কিন্তু সামনে অপেক্ষা দীর্ঘ রিহ্যাবিলিটেশন। প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা থেরাপি, ব্যথার সঙ্গে যুদ্ধ, ধৈর্যের পরীক্ষা।

ঈশা ছিল তার ছায়ার মতো। প্রতিটি এক্সারসাইজ, প্রতিটি সেশনে পাশে বসে থাকত। নির্ভয় রাগে চিৎকার করলে, হতাশায় ভেঙে পড়লে, ঈশাই তাকে আবার তুলে দাঁড় করাত।

কখনো কখনো নির্ভয় ফিসফিস করে বলত, “আমি যদি তোমাকে না পেতাম, তবে হাল ছেড়ে দিতাম।”
ঈশা মৃদু হেসে বলত, “আমি শুধু তোমার ফিজিও নই, নির্ভয়। আমি তোমার বিশ্বাস।”

কিন্তু বাইরের দুনিয়া থামেনি। মিডিয়া প্রতিদিন নতুন হিরো খুঁজে নিচ্ছিল। এক তরুণ খেলোয়াড় এখন শিরোনামে—নতুন নির্ভয়?” প্রশ্ন তুলছিল তারা।

নির্ভয় এটা দেখলে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠত। “আমার জায়গা নিতে চাইছে সবাই।”
ঈশা তাকে শান্ত করত। “তুমি নিজেকে খুঁজে পাওয়ার লড়াই করো। বাকিদের নিয়ে ভাবো না।”

ধীরে ধীরে নির্ভয় বুঝতে শুরু করল—এই লড়াই কেবল মাঠে নয়, নিজের ভেতরেও।

এক সন্ধ্যায় ঈশা হাসপাতালের রুমে বসে তাকে হাঁটুর এক্সারসাইজ করাচ্ছিল। নির্ভয় হঠাৎ বলল, “তুমি কেন এত পরিশ্রম করছো আমার জন্য?”
ঈশা থমকে গেল। তারপর ধীরে উত্তর দিল, “কারণ আমি বিশ্বাস করি তুমি পারবে। আর হয়তো… কারণ আমি চাই তুমি পারো।”

নির্ভয় দীর্ঘ সময় তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর মৃদু স্বরে বলল, “তুমি জানো, আমি মাঠে যত লড়াই করি, তার চেয়েও বেশি লড়াই করি তোমাকে না ভালোবাসার জন্য।”

ঈশার বুক কেঁপে উঠল। সে কিছু বলল না, শুধু চোখ সরিয়ে নিল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে স্বীকার করল—এই লড়াই থেকে সে নিজেও পালাতে পারছে না।

পর্ব ৭ : নতুন নায়ক

শীতের সকালে হাসপাতালের ফিজিও রুমে আবারও যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। নির্ভয় ধীরে ধীরে পায়ের ওজন তুলছিল, মুখে ঘামের ফোঁটা ঝরছিল অবিরাম। ঈশা সামনে দাঁড়িয়ে টাইমার ধরেছিল।
“আরো পাঁচ সেকেন্ড, নির্ভয়। তুমি পারবে।”
“আমি পারব না… ব্যথা হচ্ছে।”
“পারবে। লড়াইটা এখানেই।”

নির্ভয় দাঁত চেপে শেষ করল এক্সারসাইজ। তারপর ক্লান্ত হয়ে চেয়ারে বসে পড়ল। ঈশা তোয়ালে দিয়ে তার কপালের ঘাম মুছে দিল। মুহূর্তটা অদ্ভুতভাবে নরম হয়ে উঠল।

নির্ভয় ফিসফিস করে বলল, “তুমি জানো, তোমাকে ছাড়া আমি এতোটা এগোতে পারতাম না।”
ঈশা চোখ নামিয়ে নিল। সে বুঝতে পারছিল, পেশাদার দায়িত্বের বাইরে একটা অন্য স্রোত তাকে টেনে নিচ্ছে।

এদিকে বাইরের দুনিয়ায় গল্প পাল্টে যাচ্ছিল। মিডিয়া এখন নতুন নামের জয়গান গাইছিল—অরিন্দম সেন, মাত্র ২০ বছরের তরুণ স্ট্রাইকার। মাঠে তার দ্রুততা, শক্তিশালী শট, আর ধারাবাহিক গোল সমর্থকদের মাতিয়ে তুলেছিল। পত্রিকার শিরোনাম—অরিন্দম কি নতুন নির্ভয়?”

নির্ভয় এই খবর পড়ল, মুখ শক্ত হয়ে গেল।
“তাহলে এত দ্রুতই আমাকে ভুলে গেল সবাই?”
ঈশা তার পাশে বসে শান্ত কণ্ঠে বলল, “এটা খেলার নিয়ম। মানুষ নতুন হিরো খুঁজে নেয়। কিন্তু তুমি কি ভেবেছো, একদিন তোমাকেও আবার ফিরতে হবে? তখন মানুষ আবার তোমাকেই চাইবে।”

নির্ভয় তিক্ত হাসি দিল। “তখন কি দেরি হয়ে যাবে?”

ঈশা নরম গলায় বলল, “দেরি বলে কিছু হয় না। খেলোয়াড় শুধু মাঠে নয়, মানুষের মনে বেঁচে থাকে। তুমি যদি নিজের লড়াই শেষ না করো, তবে কেউ তোমাকে মুছে ফেলতে পারবে না।”

 

অরিন্দমের নাম প্রতিদিন খবরের কাগজে আসতে শুরু করল। টিভি চ্যানেলগুলো বলছিল—অরিন্দমই ভবিষ্যৎ। ক্লাব ম্যানেজমেন্টও নতুন স্পন্সরশিপে তার মুখ ব্যবহার করছিল। নির্ভয়ের পোস্টারগুলো নামতে শুরু করল শহরের দেওয়াল থেকে।

এক রাতে নির্ভয় হঠাৎ ঈশাকে বলল, “তুমি কি ভাবো, আমি সত্যিই শেষ হয়ে গেছি?”
ঈশা দৃঢ়ভাবে উত্তর দিল, “না। তুমি শেষ হওনি। কিন্তু তুমি যদি ভেতর থেকে হেরে যাও, তবে সত্যিই শেষ হয়ে যাবে।”

নির্ভয় দীর্ঘক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর মৃদু স্বরে বলল, “তাহলে আমাকে জিততে সাহায্য করো।”

রিহ্যাবিলিটেশনের দিনগুলো সহজ ছিল না। প্রতিটি মুভমেন্টে ব্যথা, প্রতিটি ব্যায়ামে হতাশা। কখনো নির্ভয় রাগে তোয়ালে ছুড়ে ফেলত, কখনো কাঁপা গলায় বলত, “আমি পারছি না।”
তখন ঈশা তার হাত ধরে বলত, “তুমি পারবে। আমি আছি।”

ঈশার ধৈর্য, মমতা আর কঠোরতা মিশে একটা অদ্ভুত শক্তি তৈরি করছিল। ধীরে ধীরে নির্ভয় হাঁটুর ভর বাড়াতে লাগল, দৌড়ের গতি ফিরে পেতে লাগল।

একদিন সন্ধ্যায়, প্র্যাকটিস গ্রাউন্ডে প্রথমবার বল পায়ে দৌড়াল নির্ভয়। ঈশা দূর থেকে তাকিয়ে ছিল। সেই দৌড়টা অসম্পূর্ণ হলেও তার চোখে জল এসে গেল।
নির্ভয় দৌড় থামিয়ে হেসে উঠল। “দেখলে? আমি আবার ফিরছি।”

ঈশা হাসল, কিন্তু তার বুকের ভেতর অদ্ভুত কষ্ট। কারণ সে জানত, এই প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আসবে আরও বড় লড়াই—মিডিয়ার চোখ, অরিন্দমের জনপ্রিয়তা, আর ভেতরের সম্পর্কের দ্বন্দ্ব।

একদিন প্র্যাকটিস শেষে নির্ভয় ঈশাকে বলল, “তুমি জানো, আমি শুধু মাঠেই নয়, তোমার জন্যও লড়ছি।”
ঈশা চমকে উঠল। “তুমি কি বলছো?”
“হ্যাঁ, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি জানি হয়তো বলা উচিত নয়, কিন্তু আমি আর থামাতে পারছি না।”

ঈশার চোখ ছলছল করে উঠল। সে অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তুমি আহত অবস্থায় আছো, আবেগে ভেসে যাচ্ছো। আমার কাজ তোমাকে সুস্থ করা, অনুভূতি ভাগ করে নেওয়া নয়।”

নির্ভয় দৃঢ় গলায় বলল, “না, এটা আবেগ নয়। এটা সত্যি।”

ঈশা মুখ ফিরিয়ে নিল। তার ভেতরে ঝড় উঠেছিল। পেশাগত নিয়ম তাকে বাঁধছিল, কিন্তু হৃদয় ভেঙে যাচ্ছিল।

পরদিন সংবাদপত্রে বড় করে ছবি ছাপা হল—অরিন্দমের হ্যাটট্রিক। শিরোনাম—নতুন নায়কের জন্ম
নির্ভয় খবরটা দেখে চুপ করে বসে রইল। ঈশা তার পাশে এসে বলল, “তুমি কি হাল ছাড়বে?”
নির্ভয় ঠান্ডা গলায় বলল, “না। কিন্তু এবার আমার লড়াই শুধু মাঠে নয়, অরিন্দমের বিরুদ্ধেও।”

ঈশা অনুভব করল, আসছে ঝড়।

সেই রাতে ঈশা ডায়েরিতে লিখল—
নির্ভয় আমার রোগী, আমার দায়িত্ব। কিন্তু কেন আমি তার প্রতিটি হাসি, প্রতিটি ব্যথা নিজের মধ্যে টেনে নিচ্ছি? আমি কি পেশা ভুলে যাচ্ছি? নাকি এটাই সত্যিকারের খেলার নিয়মযেখানে হৃদয়ও খেলোয়াড় হয়ে ওঠে?”

শব্দগুলো ভিজে যাচ্ছিল চোখের জলে।

কিছুদিন পরে ক্লাব ঘোষণা করল—পরের মরশুমের প্রথম ম্যাচে অরিন্দম হবে প্রধান স্ট্রাইকার। নির্ভয় থাকবে রিজার্ভ বেঞ্চে।
মিডিয়া উচ্ছ্বাসে ভরে উঠল। সময়ের পালাবদলঅরিন্দম এগিয়ে, নির্ভয় পেছনে।

নির্ভয়ের মুখ শক্ত হয়ে গেল। সে ঈশাকে বলল, “আমি বেঞ্চে বসব না। আমি ফিরব মাঠে, সবার সামনে।”
ঈশা দৃঢ়ভাবে বলল, “তাহলে যুদ্ধটা দ্বিগুণ কঠিন হবে। তুমি কি প্রস্তুত?”
নির্ভয় তাকিয়ে উত্তর দিল, “আমি জন্ম থেকেই যুদ্ধ করছি।”

পর্ব ৮ : প্রতিদ্বন্দ্বিতা

মরশুমের প্রথম ম্যাচ ঘনিয়ে আসছে। গ্যালারির টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে আগেভাগেই। কিন্তু আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু আর নির্ভয় নয়—সবাই শুধু বলছে অরিন্দমের কথা। সোশ্যাল মিডিয়ায় হ্যাশট্যাগ চলছে #ArindamTheFuture, পোস্টারে তার হাসিমুখ। শহরের চায়ের দোকান, বাসের ভিড়, কলেজের আড্ডা—সব জায়গায় প্রশ্ন, নতুন নির্ভয় এসে গেছে, পুরনো নির্ভয়কে কি কেউ মনে রাখবে?”

ড্রেসিংরুমে বাতাস ভারী হয়ে আছে। খেলোয়াড়রা অরিন্দমকে ঘিরে প্রশংসা করছে—“ওর ফিটনেস দারুণ”, “ওর শট মারাত্মক”—এসব মন্তব্য বারবার নির্ভয়ের কানে বাজছিল। সে চুপচাপ জুতোর ফিতা বাঁধছিল, চোখে জমাট অগ্নি।

ঈশা পাশে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। তার মনে হচ্ছিল, দলটা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একদিকে অরিন্দমের নতুন ভক্তরা, অন্যদিকে কিছু অভিজ্ঞ খেলোয়াড় যারা এখনো নির্ভয়ের প্রতি বিশ্বস্ত। এই অদৃশ্য বিভাজন ম্যাচের আগেই এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি করছিল।

প্র্যাকটিসে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চরমে উঠল। একদিন ফ্রেন্ডলি গেমে অরিন্দম বল নিয়ে এগোতেই নির্ভয় হঠাৎ জোরে ট্যাকল করল। অরিন্দম মাটিতে পড়ে গিয়ে রেগে উঠল।
“তুমি কি আমাকে ইচ্ছে করে আঘাত করলে?”
নির্ভয় ঠান্ডা গলায় বলল, “ফুটবল যুদ্ধ, এখানে দয়া দেখানো হয় না।”

মুহূর্তে পুরো মাঠ থমকে গেল। কোচ মেহেদি দুজনকে আলাদা করে দিলেন।
“এটা অনুশীলন, যুদ্ধ নয়!”—কোচ চেঁচিয়ে উঠলেন।

কিন্তু ভেতরে ভেতরে সবাই বুঝল—এখন থেকে এই দলের আসল খেলা মাঠে নয়, নির্ভয় আর অরিন্দমের মাঝে।

ঈশা রাতের বেলা নির্ভয়কে বোঝাতে এল।
“তুমি কেন এভাবে করছো? প্রতিদ্বন্দ্বিতা তো স্বাভাবিক, কিন্তু তুমি যদি এভাবে রাগ দেখাও, নিজের অবস্থাই খারাপ করবে।”
নির্ভয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। “তুমি জানো, ওরা আমাকে ভুলে গেছে। আমি যদি আবার প্রমাণ না করি, তবে আমি শেষ। আমি কি হাত গুটিয়ে বসে থাকব?”
ঈশা ধীরে বলল, “প্রমাণ করার অনেক পথ আছে। নিজেকে ধ্বংস করলেই মানুষ তোমাকে মনে রাখবে না, বরং করুণা করবে।”

নির্ভয় কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর হঠাৎ প্রশ্ন করল, “তুমি কি অরিন্দমকে পছন্দ করো?”
ঈশা হতচকিত হয়ে গেল। “এই প্রশ্নের মানে কী?”
“কারণ আমি দেখি, ও যখন মাঠে নামে, তোমার চোখেও গর্ব থাকে। আমার জন্যও কি সেই চোখে গর্ব আছে?”

ঈশার বুক কেঁপে উঠল। সে উত্তর না দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল।

মিডিয়ার চাপ বাড়ছিল। সাংবাদিকরা প্রতিদিন শিরোনাম করছিল—অরিন্দম বনাম নির্ভয়: কে হবে আসল তারকা?” টিভি শোতে বিশ্লেষকরা বলছিলেন, “নির্ভয় অভিজ্ঞ, কিন্তু ইনজুরিতে ভুগছে। অরিন্দম তার জায়গা নিতে প্রস্তুত।”

ক্লাবের ভেতরও এই দ্বন্দ্ব ঢুকে পড়ল। ম্যানেজমেন্ট চাইছিল অরিন্দমকে সামনে রেখে প্রচার চালাতে। কিন্তু কিছু পুরনো অফিসিয়াল বলছিলেন, “নির্ভয় এখনো আমাদের হিরো।”

এই বিভাজন খেলোয়াড়দের মনেও প্রভাব ফেলছিল। প্র্যাকটিসে পাসের সময় কেউ ইচ্ছে করে নির্ভয়কে বল দিচ্ছিল না, কেউ আবার অরিন্দমকে এড়িয়ে যাচ্ছিল।

কোচ মেহেদি একদিন সবার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, “শুনে রাখো, মাঠে কেবল একজনই শত্রু—প্রতিপক্ষ। নিজেদের মধ্যে লড়াই করলে আমাদের দলই হেরে যাবে।”
কিন্তু তাঁর কণ্ঠে অসহায়তা স্পষ্ট ছিল।

ঈশা আরও কঠিন অবস্থায় পড়েছিল। একদিকে নির্ভয়ের ইনজুরি—সে জানত এখনো শতভাগ ফিট হয়নি। অন্যদিকে অরিন্দম প্রতিদিন দুর্দান্ত পারফর্ম করছে। ম্যানেজমেন্ট চাইছিল রিপোর্টে লিখতে, নির্ভয় পুরোপুরি প্রস্তুত। ঈশা সেটা মানতে রাজি ছিল না।

“তুমি জানো না, মিডিয়া কেমন শিরোনাম করবে?”—ম্যানেজার হুমকি দিল।
ঈশা দৃঢ় গলায় বলল, “আমি মিথ্যে লিখব না। নির্ভয় এখনও রিহ্যাবে আছে। ওকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারি না।”

এই সোজাসাপ্টা কথার জন্য ঈশা শত্রু বানিয়ে ফেলল অনেককে। কিন্তু নির্ভয় চুপচাপ এসে একদিন বলল, “তুমি একাই আমার জন্য লড়ছো। জানো, এটা আমার কাছে জয়ের থেকেও বড়।”

ঈশা তার চোখে তাকিয়ে বলল, “কিন্তু আমি চাই তুমি নিজেকেও বাঁচাও। শুধু আমার জন্য নয়, তোমার নিজের জন্য।”

মরশুমের প্রথম ম্যাচের দিন এলো। গ্যালারি উপচে পড়া ভিড়। মাঠে নামার আগে কোচ ঘোষণা করলেন—স্টার্টিং লাইন-আপে অরিন্দম থাকবে, নির্ভয় রিজার্ভ বেঞ্চে।

নির্ভয়ের মুখ শক্ত হয়ে গেল। সে কিছু বলল না, শুধু মাথা নিচু করল। ঈশা তার পাশে বসে ফিসফিস করে বলল, “এটা শেষ নয়। এটা নতুন শুরু।”

খেলা শুরু হতেই অরিন্দম দুর্দান্ত পারফর্ম করতে লাগল। দ্রুত দৌড়, ধারালো পাস, একের পর এক শট। গ্যালারি উন্মাদ হয়ে উঠল। ধারাভাষ্যকার চিৎকার করে বলল—এই তরুণই দলের ভবিষ্যৎ!”

বেঞ্চে বসে নির্ভয় চুপ করে সব দেখছিল। তার মুষ্টি শক্ত হয়ে যাচ্ছিল প্রতিটি মুহূর্তে। ঈশা তার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছিল, ভেতরে আগুন জ্বলছে।

দ্বিতীয়ার্ধে কোচ তাকে নামালেন। দর্শকরা হাততালি দিল, কিন্তু সেই হাততালিতে ছিল না আগের উন্মাদনা। মাঠে নেমে নির্ভয় প্রথমে ছন্দ খুঁজে পাচ্ছিল না। অরিন্দমের সঙ্গে সমন্বয় হচ্ছিল না একেবারেই।

একবার বল নিয়ে দৌড়াতে গিয়ে অরিন্দমকে পাস না দিয়ে নিজেই শট নিল নির্ভয়। বল বার-এর বাইরে চলে গেল। অরিন্দম ক্ষুব্ধ হয়ে চিৎকার করল, “তুমি পাস দিলে গোল হতো!”
নির্ভয় দাঁত চেপে বলল, “আমি জানি কখন শট নিতে হয়।”

পুরো দল অস্বস্তিতে পড়ল।

ম্যাচ শেষে ফলাফল ড্র হল। মিডিয়া লিখল—অরিন্দম দুর্দান্ত, নির্ভয় ছন্দহীন। সমর্থকেরা মাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিল, “অরিন্দম, আমাদের ভবিষ্যৎ।”

নির্ভয় নিঃশব্দে গাড়িতে উঠে গেল। ঈশা পাশে বসে ছিল। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর নির্ভয় বলল, “তুমি কি মনে করো, আমি সত্যিই শেষ হয়ে যাচ্ছি?”

ঈশা ধীরে উত্তর দিল, “শেষ হচ্ছে না, তবে তুমি যদি অরিন্দমকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে লড়ো, তাহলে হেরে যাবে। তোমার লড়াই অরিন্দমের সঙ্গে নয়, নিজের ভেতরের ভয় আর সন্দেহের সঙ্গে।”

নির্ভয় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “কিন্তু আমি যদি নিজের ভেতরের লড়াইয়ে হেরে যাই?”
ঈশা তার হাত স্পর্শ করল। “তাহলে আমি তোমার পাশে থাকব। আমরা একসঙ্গে লড়ব।”

মুহূর্তটা নিঃশব্দ ছিল, কিন্তু সেই নীরবতাতেই জন্ম নিচ্ছিল নতুন এক সম্পর্ক—যেখানে ভালোবাসা আর লড়াই একে অপরের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল।

পর্ব ৯ : ভেতরের ভয়

শহরের সকালটা যেন ভিন্ন রঙে রাঙা হয়েছিল। সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় অরিন্দমের ছবি—হাসিমুখে, হাত উঁচিয়ে স্যালিব্রেশন। নিচে শিরোনাম—অরিন্দম, আমাদের নতুন নায়ক। ছোট্ট এক কলামে নির্ভয়ের নাম, অভিজ্ঞ হলেও ছন্দ হারাচ্ছেন

নির্ভয় পত্রিকাটা টেবিলে ছুঁড়ে ফেলল। চোখে তীব্র হতাশা। “আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি, তাই না?”
ঈশা শান্তভাবে তার সামনে বসে বলল, “তুমি যতক্ষণ না হাল ছাড়ছো, ততক্ষণ তুমি শেষ নও।”
“কিন্তু মানুষ কি আমাকে মনে রাখবে?” নির্ভয়ের কণ্ঠ কেঁপে উঠল।
“মানুষ মনে রাখবে তোমার লড়াই। তুমি শুধু গোলের জন্য নও, তুমি প্রতিজ্ঞার প্রতীক।”

কথাগুলো নির্ভয় শুনল, কিন্তু তার ভেতরের ভয়টা তবু কাটল না।

প্র্যাকটিসে অরিন্দমের পারফরম্যান্স দিনদিন বাড়ছিল। কোচ মেহেদি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেন, এই তরুণই এখন দলের ভরসা। নির্ভয় দৌড়াত, খেলত, কিন্তু প্রতিটি মুভমেন্টে দেখা যেত সেই আগের আত্মবিশ্বাস আর নেই।

একদিন অনুশীলনের মাঝেই নির্ভয় হঠাৎ বসে পড়ল। হাঁটুতে হাত চেপে ধরে বলল, “আমি পারছি না।”
খেলোয়াড়রা থমকে দাঁড়াল। অরিন্দম এগিয়ে এসে হাত বাড়াল। “তুমি চাইলে আমি সাহায্য করতে পারি।”
নির্ভয় তার হাত সরিয়ে দিল। “আমার সাহায্যের দরকার নেই।”

এই দৃশ্য দেখে ঈশার বুক ভেঙে গেল। সে জানত, নির্ভয়ের ভেতরে জেদ আছে, কিন্তু সেই জেদের আড়ালে ভয়ও জমে আছে—হেরে যাওয়ার ভয়, মুছে যাওয়ার ভয়।

রাতে ঈশা তাকে বোঝাতে এল।
“তুমি কি জানো, ভয়কে অস্বীকার করলে ভয় আরও বড় হয়ে যায়?”
নির্ভয় ঠান্ডা গলায় বলল, “ভয়কে স্বীকার করলে মানুষ ভাবে আমি দুর্বল।”
“না,” ঈশা বলল, “ভয়কে স্বীকার করা মানে সাহসী হওয়া। তুমি যদি ভয়টা স্বীকার করো, তবে সেটার সঙ্গে লড়তেও পারবে।”

নির্ভয় তার চোখের দিকে তাকাল। অনেকক্ষণ নীরব থাকার পর বলল, “তুমি জানো, আমি তোমার সামনে দুর্বল হতে পারি। কারণ তুমি একমাত্র যে আমাকে সত্যিকারের ভাবে দেখছো।”

ঈশার বুক কেঁপে উঠল। সে অনুভব করল, সম্পর্কটা আর শুধু খেলোয়াড় আর ফিজিওর মধ্যে নেই—এর ভেতর প্রবল টান তৈরি হয়েছে।

এদিকে ক্লাব ম্যানেজমেন্ট অরিন্দমকে কেন্দ্র করে নতুন বিজ্ঞাপন ক্যাম্পেইন শুরু করল। শহরের দেওয়ালে পোস্টার—অরিন্দমের হাসিমুখে লেখা ভবিষ্যতের তারকা। নির্ভয়ের পোস্টারগুলো মুছে ফেলা হচ্ছিল।

এক সন্ধ্যায় নির্ভয় একা গ্যালারির সিঁড়িতে বসেছিল। আলো নিভে আসছিল, গ্যালারির দেওয়ালে ওর পুরনো পোস্টারের আধা ছেঁড়া অংশ ঝুলে ছিল। ঈশা পাশে গিয়ে বসে পড়ল।
“কষ্ট পাচ্ছো?”
“পাচ্ছি।” নির্ভয় গলায় হতাশার সুর নিয়ে বলল। “যে পোস্টারগুলো একসময় আমার নামে উঠেছিল, সেগুলো আজ অরিন্দমের নামে ঝুলছে। আমি কি এতটাই অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেলাম?”

ঈশা ধীরে বলল, “পোস্টার মানুষকে তৈরি করে না। মানুষ পোস্টার তৈরি করে। তুমি যদি লড়াই চালিয়ে যাও, তবে একদিন আবার তোমার পোস্টার উঠবে।”

নির্ভয় মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাল। “আর যদি না ওঠে?”
“তাহলে?” ঈশা মৃদু হেসে বলল, “তাহলে তুমি আমার হৃদয়ে থাকবে। সেখানে কোনো পোস্টারের দরকার নেই।”

নির্ভয় এক মুহূর্তের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। চোখে ভরসার ঝলক দেখা দিল।

পরবর্তী ম্যাচের দিন এল। অরিন্দম মাঠে দুর্দান্ত পারফর্ম করছিল। প্রথমার্ধেই একটি গোল করে ফেলল। দর্শকরা পাগলের মতো চিৎকার করছিল। নির্ভয় বেঞ্চে বসে কেবল তাকিয়ে রইল।

দ্বিতীয়ার্ধে কোচ তাকে নামালেন। মাঠে নামতেই দর্শকেরা হাততালি দিল, কিন্তু সেই হাততালির ভেতরে আগের উন্মাদনা ছিল না। নির্ভয় প্রথমেই বল পেয়ে দ্রুত দৌড়াল। কিন্তু প্রতিপক্ষ তাকে আটকাতেই আবার হাঁটুতে চাপ পড়ে গেল। ঈশা সাইডলাইন থেকে আতঙ্কিত চোখে সব দেখছিল।

ম্যাচ শেষে ফলাফল জিতল দল—অরিন্দমের গোলেই। মিডিয়া শিরোনাম করল, অরিন্দম বাঁচাল দল, নির্ভয় ছায়ায় ঢাকা

ম্যাচের পর সাংবাদিকরা নির্ভয়ের সামনে মাইক্রোফোন ধরল।
“আপনি কি মনে করেন, অরিন্দম আপনার জায়গা নিয়ে নিচ্ছে?”
নির্ভয় কঠিন গলায় বলল, “ও ভালো খেলোয়াড়, কিন্তু আমি এখনো লড়াই করছি। আমার জায়গা কেউ নিতে পারবে না।”

কথাটা শিরোনাম হয়ে গেল। পরদিন পত্রিকায় লেখা হল—নির্ভয়ের চ্যালেঞ্জ: আমার জায়গা কেউ নিতে পারবে না। সমর্থকেরা আবার দুই ভাগ হয়ে গেল—কেউ অরিন্দমের পক্ষে, কেউ নির্ভয়ের পক্ষে।

দল ভেতরে ভেতরে বিভক্ত হয়ে পড়ল। খেলোয়াড়রা বুঝতে পারছিল, সামনে বড় ঝড় আসছে।

ঈশা এই দ্বন্দ্বের মাঝে আটকা পড়ে গেল। একদিকে নির্ভয়ের প্রতি তার টান, অন্যদিকে পেশার দায়বদ্ধতা। সে জানত, নির্ভয়ের হাঁটু এখনো ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু তার চোখের দৃঢ়তা দেখে মনে হচ্ছিল, তাকে থামানো যাবে না।

এক রাতে নির্ভয় তার কক্ষে এসে বলল, “আমি জানি তুমি আমাকে থামাতে চাইছো। কিন্তু আমি থামব না। কারণ আমি শুধু নিজের জন্য খেলছি না, তোমার জন্যও খেলছি।”

ঈশার চোখে জল চলে এল। “তুমি আমার জন্য খেলছো মানে কী?”
“মানে তুমি আমাকে যে বিশ্বাস দাও, আমি সেটাকে সত্যি করতে চাই। তুমি বলেছো আমি ফিরতে পারব—তাহলে আমি ফিরব। যদি মাঠেই পড়ে যাই, তবু আমি চেষ্টা করব।”

ঈশা তার হাত ধরে ফেলল। “তুমি যদি পড়ো, আমি তোমাকে তুলে নেব। আমি সবসময় তোমার পাশে থাকব।”

সেই মুহূর্তে তাদের চোখে চোখ আটকে গেল। বাইরের পৃথিবী ভুলে গিয়ে যেন তারা কেবল দুজন মানুষ—একজন ভাঙা খেলোয়াড়, আর একজন যে তাকে বাঁচাতে চায়, আর ভালোবাসতে ভয় পায় না।

কিন্তু দূরে কোথাও ঝড় জমছিল। মিডিয়া আর সমর্থকদের বিভাজন দলকে অস্থির করে তুলছিল। সামনে ছিল মরশুমের সবচেয়ে বড় ম্যাচ—ডার্বি। এবং সেই ম্যাচই হয়তো ঠিক করে দেবে—নির্ভয় কি আবার মাঠের হিরো হবে, না অরিন্দমের ছায়াতেই ডুবে যাবে।

পর্ব ১০ : শেষ বাঁশি

ডার্বি ম্যাচের দিন সকাল থেকে শহরটা যেন উৎসবের মঞ্চ হয়ে উঠেছিল। দুই দলের পতাকা রঙে রঙিন গলি, দোকান থেকে শুরু করে বাসস্ট্যান্ড—সব জায়গায় স্লোগান ভেসে আসছিল। রেডিওতে ধারাভাষ্যকার গলা চড়িয়ে বলছিল—আজকের ডার্বি শুধু খেলা নয়, সম্মান, গৌরব আর ভবিষ্যতের লড়াই।

স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে ঢুকতে না ঢুকতেই বোঝা গেল, উত্তেজনা কোথায় পৌঁছেছে। অর্ধেক দর্শক অরিন্দমের নামের স্লোগান তুলছিল, অর্ধেক আবার পুরনো গৌরব ফেরানোর প্রত্যাশায় নির্ভয়ের নাম ডাকছিল। কাগজের পোস্টারে দুজনের মুখ পাশাপাশি, নিচে লেখা—কে আসল নায়ক?”

ড্রেসিংরুমে নীরবতা। খেলোয়াড়রা একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিল, চাপা উত্তেজনায় ভরা পরিবেশ। কোচ মেহেদি সামনে দাঁড়িয়ে দৃঢ় গলায় বললেন,
“শুনে রাখো, আজ মাঠে শুধু প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে খেলবে, নিজেদের মধ্যে নয়। দলে অরিন্দমও আছে, নির্ভয়ও আছে। মনে রেখো, একসঙ্গে খেললে তবেই আমরা জিততে পারব।”

কথাগুলো মাথা নেড়ে সবাই মেনে নিলেও ভেতরে ভেতরে বিভাজন রয়ে গেল।

খেলা শুরু হল বজ্রধ্বনির মতো করতালির মধ্যে। প্রথম থেকেই অরিন্দম দুর্দান্ত। দ্রুত দৌড়ে প্রতিপক্ষকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে, একের পর এক আক্রমণ তৈরি করছে। দর্শকরা পাগলের মতো তার নাম ডাকছে।

নির্ভয় শুরুতে ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছিল। কয়েকবার বল পেলেও ছন্দ খুঁজে পাচ্ছিল না। গ্যালারি থেকে ভেসে আসছিল কটূক্তি—শেষ হয়ে গেছে!”

ঈশা সাইডলাইনে দাঁড়িয়ে শ্বাস আটকে দেখছিল সব। তার বুকের ভেতর কেবল একটাই প্রার্থনা—নির্ভয় যেন ভেঙে না পড়ে।

প্রথমার্ধের শেষে অরিন্দম একটি গোল করে দলকে এগিয়ে দিল। গ্যালারি উন্মাদ হয়ে উঠল। ধারাভাষ্যকার চিৎকার করছিল—অরিন্দম, নতুন যুগের প্রতীক!”

বেঞ্চে বসা নির্ভয় মাথা নিচু করে বসেছিল। ঈশা কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,
“তুমি ভয় পাচ্ছো?”
নির্ভয় চোখ তুলে তাকাল। “হ্যাঁ, ভয় পাচ্ছি। ওর কাছে হেরে যাওয়ার ভয়।”
“ভয় স্বীকার করা মানেই সাহসী হওয়া।” ঈশা তার চোখে চোখ রেখে বলল। “এখন মাঠে গিয়ে সেই ভয়কে হারাও।”

দ্বিতীয়ার্ধ শুরু হল। কোচ নির্ভয়কে নামালেন। মাঠে নামতেই গ্যালারি আবার গর্জে উঠল, কিন্তু এবার সেই গর্জনে সমালোচনার সুরও মিশে ছিল।

প্রথম কয়েক মিনিট নির্ভয় আবার ছন্দ পাচ্ছিল না। অরিন্দম একবার বল পেয়ে তার দিকে তাকাল, কিন্তু পাস দিল না। নির্ভয় দাঁত চেপে সহ্য করল।

তারপর এল সেই মুহূর্ত। প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডার বল হারাল, নির্ভয় পেয়ে গেল ফাঁকা জায়গা। পায়ে বল নিয়ে এগোতে লাগল। গ্যালারি নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইল। হাঁটুতে চাপ পড়লেও সে থামল না। এক ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে, দ্বিতীয়জনকে পাশ কাটিয়ে নির্ভয় সরাসরি শট নিল। বল জালে ঢুকে গেল।

স্টেডিয়াম কেঁপে উঠল। স্লোগান ফের উঠল—“নির্ভয়! নির্ভয়!”

ঈশার চোখে জল ভরে উঠল। মনে হচ্ছিল, পুরনো নির্ভয় যেন আবার জন্ম নিল।

খেলা শেষের দিকে আরও রোমাঞ্চকর হয়ে উঠল। স্কোর সমান। অরিন্দম আর নির্ভয়—দুজনেই বল চাইছিল, দুজনেই সুযোগ খুঁজছিল। দলটাও বিভক্ত হয়ে পড়েছিল, কে কাকে পাস দেবে তা নিয়ে দ্বিধায় ভুগছিল সবাই।

শেষ পাঁচ মিনিট। কর্নার কিক পেল দল। কোচ সাইডলাইন থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন, “নির্ভয়, অরিন্দম—দুজনেই সামনে যাও।”

কর্নার থেকে বল এল। অরিন্দম জাম্প করল, কিন্তু বল তার মাথা ছুঁয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই নির্ভয় লাফ দিয়ে মাথা ছুঁইয়ে দিল। বল জালে ঢুকে গেল।

শেষ বাঁশি বাজল। দল জিতে গেল। গ্যালারি একসঙ্গে ফেটে পড়ল—অরিন্দমের নামও ধ্বনিত হচ্ছিল, নির্ভয়ের নামও। কিন্তু সেই রাতে শিরোনাম হল—নির্ভয় এখনো শেষ হয়নি।

ম্যাচ শেষে মাঠে দাঁড়িয়ে নির্ভয় হাঁপাচ্ছিল। হাঁটুতে ব্যথা বাড়ছিল, কিন্তু তার মুখে হাসি। ঈশা দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। চারপাশের ক্যামেরা, দর্শক—সব ভুলে গেল তারা।

“তুমি পেরেছো,” ঈশা ফিসফিস করে বলল।
“না,” নির্ভয় বলল, “আমরা পেরেছি। তুমি পাশে না থাকলে আমি ফিরতেই পারতাম না।”

ঈশার চোখে ভরসার ঝিলিক। হয়তো প্রথমবার সে নিজের মনের কথাটা স্বীকার করতে পারল।
“তাহলে শোনো—আমি শুধু তোমার ফিজিও নই। আমি তোমার সঙ্গী।”

নির্ভয় হেসে মাথা নুইয়ে বলল, “এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় জয়।”

সেই রাতে সংবাদপত্র আবার নতুন শিরোনাম করল—অরিন্দম ভবিষ্যৎ, নির্ভয় বর্তমানদল পেল দুই তারকা। সমর্থকেরা আবার গর্বে ভরে উঠল।

কিন্তু ঈশা আর নির্ভয়ের জন্য এই জয় ছিল অন্যরকম। এটা ছিল ভয়কে জেতার জয়, ভেতরের যুদ্ধ জেতার জয়, আর ভালোবাসার জয়।

কিছুদিন পর নির্ভয় হাঁটুর চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাবে ঠিক হল। বিদায়ের আগে সে ঈশাকে বলল,
“আমি জানি না মাঠে আবার ফিরতে পারব কিনা। কিন্তু আমি জানি, আমার জীবনে তোমাকে ছাড়া আর কিছু অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।”
ঈশা তার হাত শক্ত করে ধরল। “তুমি ফিরবে। শুধু মাঠেই নয়, আমার কাছেও।”

দুজনেই চুপ করে একে অপরের দিকে তাকাল। আর সেই চোখের দৃষ্টিতে লেখা ছিল এক অব্যক্ত প্রতিজ্ঞা—শেষ বাঁশি যেভাবেই বাজুক না কেন, তাদের গল্প চলতে থাকবে।

***

WhatsApp-Image-2025-09-01-at-5.22.27-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *