অনিৰ্বাণ দাস
১
সকালবেলা শহরের কাগজে প্রথম পাতার শিরোনামই ছিল—“বিখ্যাত লেখক অরিন্দম সেন আর নেই।” গত রাতেই তাঁর মৃত্যু হয়, অথচ মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই সাহিত্য মহল থেকে শুরু করে পাঠকসমাজ স্তব্ধ হয়ে যায়। জীবদ্দশায় অরিন্দম ছিলেন রহস্য ও খুনের কাহিনীর এক অনন্য কারিগর, যার প্রতিটি লেখা পাঠকের মনে গা ছমছমে আবহ তৈরি করত। তাঁর বয়স হয়েছিল পঁয়ষট্টি, তবে এখনো নিয়মিত লেখালিখি করছিলেন। এমন একজন মানুষের হঠাৎ মৃত্যুতে সবাই ধরে নেয় হয়তো হার্ট অ্যাটাক বা বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা। কিন্তু তার বাসভবন—শহরের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা পুরোনো ভিক্টোরিয়ান ঢঙের দোতলা বাড়িটি—যেন মৃত্যুর পর অদ্ভুত এক নীরবতায় ডুবে যায়। বাড়ির ভেতর ছড়ানো পুরোনো বই, কাঠের তাকের ফাঁকে জমে থাকা ধুলো, আর সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা অরিন্দমের গাঢ় উপস্থিতি যেন বলে দেয়, এই মৃত্যু নিছক একটি ব্যক্তিগত ঘটনা নয়; এর ভেতরে আছে আরও গভীর এক শূন্যতা। সাহিত্যপ্রেমীরা শোকে মুহ্যমান হলেও, কাছের কয়েকজন বুঝতে পারছিলেন—অরিন্দম তাঁর মৃত্যুরও অনেক আগে থেকেই এক অদ্ভুত ভয়ের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন। ফোন ধরতেন না, হঠাৎ সাক্ষাৎ এড়িয়ে যেতেন, আর একরাশ উদ্বেগ নিয়ে রাত জেগে লিখতেন। কী লিখছিলেন, সেটা কারও জানা ছিল না।
শেষকৃত্যের পর যখন বাড়িটি খানিকটা শান্ত হয়, তখনই অনিন্দিতা—অরিন্দমের একমাত্র মেয়ে—চুপিচুপি বাবার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে ঢোকে। ভারী কাঠের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই গন্ধ ভেসে আসে পুরোনো কাগজের, সঙ্গে হালকা চন্দনের গন্ধ, যেটা বাবার ঘরে বরাবরই লেগে থাকত। ছাদের ঝুলন্ত বাতি কম্পমান আলো ফেলছিল চারপাশে, আর একটার পর একটা তাক ভর্তি বই যেন চোখ মেলে তাকিয়ে ছিল তাঁর দিকে। এই লাইব্রেরিই ছিল বাবার সত্যিকারের রাজ্য—যেখানে তিনি দিনের পর দিন নিঃশব্দে লিখতেন, আর বাস্তব আর কল্পনার সীমানা মিলিয়ে দিতেন। তাকের এক কোণে রাখা ছিল একটি ছোট্ট লোহার আলমারি, যা বরাবরই তালাবদ্ধ থাকত। বাবার মৃত্যুর পর সেটি খোলার অনুমতি মেলে। ভেতর থেকে বের হয় একটি মোটা ডায়রি, যার উপর লেখা—“শেষ পান্ডুলিপি।” প্রথম কয়েকটি পাতা দেখেই অনিন্দিতার বুক কেঁপে ওঠে। গল্পের ভেতরে লেখা ছিল এক খুনের বিবরণ—সময়, স্থান, আর শিকার সম্পর্কে খুঁটিনাটি এমনভাবে বর্ণিত, যেন ঘটনাটি সত্যিই ঘটেছে। কিন্তু আরও ভয়ানক ব্যাপার হলো, কয়েক দিন আগে ঠিক সেইরকমই একটি খুন শহরে ঘটেছিল। পুলিশের রেকর্ডে যার তদন্ত তখনো চলছে, তার বিবরণ যেন হুবহু এই পান্ডুলিপির পাতায় আঁকা ছিল।
অনিন্দিতা স্তব্ধ হয়ে যায়। বাবার লেখা এতদিন শুধু সাহিত্য বলে মেনে এসেছে সবাই, কিন্তু এবার মনে হচ্ছিল লেখক হয়তো কোনো সত্যিকারের রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করছিলেন, কিংবা তিনি এমন কিছু জানতেন যা প্রকাশ্যে বলতে পারেননি। প্রশ্ন মাথার ভেতর ঝড় তুলতে শুরু করে—এটা কি নিছক কাকতালীয় মিল? নাকি বাবা খুন সম্পর্কে আগেই জানতেন? নাকি আরও ভয়ঙ্কর কিছু—তিনি নিজেই এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন? পান্ডুলিপির ভেতর কলম থেমে গেছে মাঝপথে, কয়েকটি বাক্য অসম্পূর্ণ। মনে হচ্ছিল মৃত্যুর আগে শেষ রাতে অরিন্দম হয়তো তাড়াহুড়ো করে লিখছিলেন, কিন্তু শেষ করতে পারেননি। বাইরে রাত গভীর, জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকে আসা আলো বইয়ের পাতায় ছায়া ফেলে খেলছিল। অনিন্দিতা ঠান্ডা কাগজ স্পর্শ করে অনুভব করছিল, বাবার মৃত্যুর নীরবতার মধ্যে এই পান্ডুলিপি যেন ফিসফিস করে বলে যাচ্ছে কোনো অমীমাংসিত সত্যের কথা। সে জানত, বাবার মৃত্যুর পর শহর সাহিত্যিক ক্ষতিতে শোক করছে, কিন্তু সে-ই প্রথম অনুভব করল—এই মৃত্যু কেবল একজন লেখকের বিদায় নয়, বরং এক ভয়ঙ্কর রহস্যের দরজা খোলার শুরু। আর সেই দরজার চাবি লুকিয়ে আছে এই অসম্পূর্ণ পান্ডুলিপির পাতায়।
২
অরিন্দম সেনের মৃত্যুর পর দিনগুলোয় বাড়িটা যেন আরও গুমোট হয়ে উঠেছিল। আত্মীয়স্বজনরা চলে গিয়েছিল, শোকবার্তার ফুল শুকিয়ে ধুলো হয়ে মেঝেতে ঝরে পড়েছিল, কিন্তু বাড়ির ভেতরে নীরবতা যেন ঘন কুয়াশার মতো জমে ছিল। অনিন্দিতা বাবার টেবিলে বসে সেই পান্ডুলিপি পড়তে শুরু করেছিল, আর প্রতিটি শব্দে তার শিরদাঁড়া ঠান্ডা হয়ে আসছিল। খুনের বিবরণ ছিল এত নিখুঁত, যেন একজন প্রত্যক্ষদর্শী লিখছে—একটি নির্দিষ্ট তারিখ, একটি পুরোনো সিনেমা হলের গলির বর্ণনা, রাত সাড়ে দশটার সময়, আর এক মাঝবয়সী পুরুষের গলা টিপে হত্যার ঘটনা। প্রতিটি বাক্যে বর্ণনার সূক্ষ্মতা দেখে মনে হচ্ছিল ঘটনাটা বাস্তবেই ঘটেছে। হঠাৎ করেই তার চোখ আটকে যায় একটি নামের উপর—“অভিজিৎ দত্ত।” অনিন্দিতার মনে পড়ে যায়, কয়েক দিন আগে খবরের কাগজে এমন একজন ব্যবসায়ীর মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে শহরের প্রান্তে, আর পুলিশ প্রাথমিকভাবে বলেছিল এটি খুন। তারিখ মিলে যাচ্ছে, জায়গা মিলে যাচ্ছে, এমনকি মৃত ব্যক্তির পেশা পর্যন্ত একই। বুক ধড়ফড় করতে থাকে, হাত কেঁপে ওঠে—এটা কি নিছক কাকতালীয় ঘটনা? নাকি বাবা সত্যিই কিছু জানতেন?
পাণ্ডুলিপির ভেতরে বর্ণনা ছিল কেবল হত্যার নয়, হত্যার আগের ঘটনাগুলোরও। সেখানে লেখা ছিল, কিভাবে ওই ব্যক্তিকে কয়েক দিন ধরে অনুসরণ করা হচ্ছিল, কিভাবে তাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছিল, আর কিভাবে শেষমেশ গলির অন্ধকারে তাকে শেষ করে দেওয়া হয়। অনিন্দিতা যত পড়ছিল, ততই মনে হচ্ছিল—এটা কেবল কল্পকাহিনী নয়, বরং কোনো বাস্তব ডায়েরির মতো। বাবার হাতের লেখার সঙ্গে পরিচিত ছিল সে; প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি দাগ তার চোখে অরিন্দমের ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তুলছিল। কিন্তু যদি বাবাই এই সব জানতেন, তবে তিনি বললেন না কেন? কারও সঙ্গে শেয়ার করেননি কেন? আর সবচেয়ে বড় কথা—যদি তিনি আগেই জানতেন, তাহলে পুলিশকে জানালেন না কেন? এর উত্তর কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না। সে আরও পড়তে পড়তে হঠাৎ থেমে যায়। মাঝপথে একটি বাক্য অসম্পূর্ণ ছিল—“যদি এই খুনটা থামানো না যায়, তবে পরের জন হবে…” তারপর কিছু নেই, শুধু ফাঁকা পাতা। মনে হচ্ছিল কলমটা হঠাৎ থেমে গেছে, যেন লেখক আর সময় পাননি বা কেউ তার হাত থামিয়ে দিয়েছে। অনিন্দিতার মাথায় এক অদ্ভুত আতঙ্কের ঢেউ বয়ে যায়—মানে কি, বাবার নিজের মৃত্যুও কি এই ধারাবাহিকতার অংশ ছিল?
গভীর রাতে জানালার কাঁচে আলো পড়ছিল, বাইরে থেকে ভেসে আসছিল বৃষ্টির শব্দ। পান্ডুলিপির পাতায় হাত রেখে অনিন্দিতা শিহরিত হচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল, এই কাগজের ভেতর লুকিয়ে আছে এমন এক অন্ধকার সত্য, যা প্রকাশ পেলে সবকিছু ওলটপালট হয়ে যাবে। বাবার চরিত্র মনে পড়ছিল—তিনি সবসময় একাকী ছিলেন, কিন্তু কাউকে আঘাত করেননি, কারও ক্ষতি করার মানুষ নন। তাহলে কি কেউ তাঁকে ব্যবহার করছিল? নাকি তিনি সত্যিই কিছু জেনেছিলেন, যা প্রকাশ করলে অনেক শক্তিশালী মানুষের মুখোশ খুলে যেত? এই ভয়ের সঙ্গে এক ধরনের দৃঢ়তাও জন্ম নিচ্ছিল অনিন্দিতার ভেতরে। সে জানত, বাবার নাম আজ শোকার্ত ভাষণে, কাগজের হেডলাইনে, আর পাঠকদের চোখে “মৃত সাহিত্যিক” হিসেবে জায়গা পাচ্ছে। কিন্তু সে-ই একমাত্র জানত, মৃত্যুর আড়ালে আরও এক ভয়ঙ্কর গল্প লুকিয়ে আছে, যার সূত্রপাত এই অসম্পূর্ণ পান্ডুলিপি। চোখে জল এসে গেলেও ঠোঁট শক্ত করে সে মনে মনে শপথ নিল—বাবার নামের সঙ্গে খুনির ছায়া জড়াতে দেওয়া যাবে না। যদি সত্যিই খুনের সঙ্গে তাঁর কোনো যোগ থাকে, তবে তা উদ্ঘাটন করতে হবে, আর যদি তিনি নির্দোষ হন, তবে প্রমাণ করতে হবে—তিনি ছিলেন একজন সত্যসন্ধানী, মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করেছেন অন্ধকারের বিরুদ্ধে। এই ভাবনায় বুক জ্বলে উঠছিল, আর ঘরের অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় অনিন্দিতা বুঝতে পারছিল—তার নিজের জীবনও এখন এই রহস্যের ভেতরে জড়িয়ে গেছে, যেখান থেকে ফিরে আসা আর সহজ নয়।
৩
অরিন্দম সেনের মৃত্যুর পর বাড়ির দোরগোড়ায় মানুষের ভিড় কিছুটা কমতেই অনিন্দিতা সিদ্ধান্ত নেয় পান্ডুলিপির ব্যাপারে কাউকে জানাতে হবে। সে জানত, এমন কাগজ হাতে নিয়ে একা এগোনো বিপজ্জনক, তবুও যাঁর কাছে প্রথমে খবর দিল, তিনি হলেন সমরেশ মুখার্জি—বাবার পুরোনো বন্ধু এবং দীর্ঘদিনের সম্পাদক। সমরেশ বহু বছর ধরে অরিন্দমের বই প্রকাশ করেছেন, তাঁর প্রতিটি উপন্যাসের সাফল্যের পিছনে সম্পাদকীয় পরিশ্রমও কম ছিল না। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে, তবে এখনো সুট-টাই পরে চকচকে গাড়িতে ঘোরেন, আর কথাবার্তায় ব্যবসার গন্ধ লুকিয়ে রাখেন। অনিন্দিতা যখন বাবার ঘরে তাঁকে নিয়ে এসে পান্ডুলিপি দেখায়, সমরেশের চোখে সঙ্গে সঙ্গেই এক ধরনের ঝিলিক খেলে যায়। তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে পাতা উল্টে উল্টে পড়তে থাকেন, মাঝে মাঝে ভ্রূ কুঁচকে ওঠে, আবার কোথাও নীচু স্বরে বিড়বিড় করে বলেন—“চমৎকার, একেবারে মাস্টারপিস হতে চলেছিল।” তবে অনিন্দিতার বুক ধড়ফড় করে ওঠে যখন সমরেশ দৃঢ় কণ্ঠে বলেন—“এটা অবশ্যই প্রকাশ করতে হবে। অসম্পূর্ণ হলেও পাঠক পাগল হয়ে যাবে, বইটা বেরোলেই বেস্টসেলার।” তাঁর চোখে-মুখে তখন এক অদ্ভুত উন্মাদনা, যেন অরিন্দমের মৃত্যুশোক নয়, বরং বাজারদরের হিসেবই তাঁর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অনিন্দিতা দ্বিধায় পড়ে যায়—এখনই কি এই পান্ডুলিপি প্রকাশ করা উচিত? এর ভেতরে যদি সত্যিই কোনো খুনের সূত্র লুকিয়ে থাকে, তবে সেটি প্রকাশ পেলে তদন্ত ব্যাহত হবে না তো?
এই দ্বিধার ভেতরেই হঠাৎ একদিন দরজায় কড়া পড়ে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল নীলয় মুখোপাধ্যায়—বাবার একসময়ের শিষ্য। বয়সে তরুণ, লেখালিখির দুনিয়ায় নাম করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তার চোখেমুখে স্পষ্ট। একসময় অরিন্দমের কাছে গল্প লেখা শিখতে যেত, তবে হঠাৎই দূরে সরে গিয়েছিল। অনিন্দিতা তাকে তেমন পছন্দ করত না; তার মধ্যে সবসময়ই এক ধরনের ঈর্ষা আর জেদ দেখা যেত। কিন্তু আজকের আগমন একেবারেই ভিন্ন ছিল। সে বসে পড়তেই প্রায় ঝড়ের মতো বলে ওঠে—“পাণ্ডুলিপির কিছু অংশ আমার লেখা।” অনিন্দিতা হতবাক হয়ে যায়। নীলয় ব্যাখ্যা দিতে থাকে—অরিন্দম নাকি তার সেরা আইডিয়াগুলো নিয়ে নিজের মতো সাজাতেন, তাকে কখনো কৃতিত্ব দিতেন না। “তুমি যে অংশে অভিজিৎ দত্তর খুনের কথা পড়েছো, সেই মূল ধারণাটা আমারই,” গলা কাঁপিয়ে বলে নীলয়, “আমিই প্রথমে বাবাকে বলেছিলাম এই চরিত্রটা ব্যবহার করতে। কিন্তু উনি পরে সেটা নিজের মতো লিখলেন।” অনিন্দিতা হতভম্ব হয়ে শুনছিল। যদি নীলয়ের কথাই সত্যি হয়, তবে প্রশ্ন থেকে যায়—খুনের তারিখ, জায়গা আর শিকার বাস্তব ঘটনার সঙ্গে মিলে গেল কিভাবে? নীলয় তখনও বলতে থাকে, “দিদি, তুমি জানো না, অরিন্দমদা অনেক কিছু লিখতেন যা আমার কাছ থেকে নিয়েছিলেন। এই অসম্পূর্ণ পান্ডুলিপি অর্ধেক আমার মস্তিষ্কপ্রসূত।” তার চোখে তখন প্রতিশোধের আগুন, আর ঠোঁটে ঈর্ষার কাঁপন।
সমরেশ আর নীলয়ের এই দুই বিপরীত অবস্থান অনিন্দিতাকে প্রবলভাবে বিভ্রান্ত করে দেয়। একদিকে সম্পাদক স্পষ্টতই চান, বইটি যেভাবেই হোক প্রকাশ করতে হবে, কারণ তিনি জানেন বাজারে এর চাহিদা হবে বিস্ফোরণ ঘটানোর মতো। অন্যদিকে নীলয় জোর দিয়ে দাবি করছে, এর অংশবিশেষ তার সৃষ্টি, তাই তার কৃতিত্ব ছাড়া বই ছাপা যাবে না। অথচ অনিন্দিতার মাথায় তখন অন্য এক ঝড়—যদি খুনের কাহিনী সত্যিই বাবার লেখা না হয়, তবে এই ভৌতিক মিলের ব্যাখ্যা কী? বাবার হাতে লেখা দেখে তো মনে হচ্ছিল নিখুঁত তাঁরই সৃষ্টি। তবে কি নীলয় মিথ্যে বলছে? নাকি সমরেশ অর্থলোভে সব আড়াল করতে চাইছেন? প্রতিটি চরিত্রই যেন সন্দেহজনক হয়ে উঠছিল। পান্ডুলিপির পাতাগুলো বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল, বিশেষ করে সেই অসম্পূর্ণ বাক্য—“যদি এই খুনটা থামানো না যায়, তবে পরের জন হবে…”। এই রহস্যময় বাক্য অনিন্দিতার কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, আর মনে হচ্ছিল পান্ডুলিপির প্রতিটি অক্ষরই যেন তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক অজানা অন্ধকারে। এখন কার উপর ভরসা করবে সে? সম্পাদক, যে কেবল ব্যবসা দেখে, নাকি শিষ্য, যে হয়তো মিথ্যা দাবি করে নিজেকে প্রমাণ করতে চাইছে? অনিন্দিতা বুঝে যায়, বাবার মৃত্যুর পর শুধু শোক নয়, তার কাঁধে এসে পড়েছে এক ভয়ঙ্কর দায়িত্ব—সত্য খুঁজে বের করা, এবং সেই সত্য যতই বিপজ্জনক হোক, তাকে এড়িয়ে যাওয়া আর সম্ভব নয়।
৪
অরিন্দম সেনের হঠাৎ মৃত্যু আর তার রেখে যাওয়া অসম্পূর্ণ পান্ডুলিপির কাহিনি চারদিকে আলোড়ন তুলতেই, তদন্তের দায়িত্ব এসে পড়ে ইন্সপেক্টর রুদ্রপ্রসাদ দত্তের উপর। রুদ্রপ্রসাদ ছিলেন তুখোড় বুদ্ধির অফিসার, কড়া শৃঙ্খলার মানুষ, যিনি প্রতিটি মামলার সূত্র ধরে নিখুঁত বিশ্লেষণ করার জন্য পরিচিত। কিন্তু এই কেস তার কাছে একেবারেই অস্বাভাবিক—এখানে কোনও সাধারণ প্রমাণ বা সাক্ষী নেই, বরং আছে এক সাহিত্যকর্ম, একটি অসম্পূর্ণ উপন্যাস, যেখানে কাল্পনিক বর্ণনা আর বাস্তব খুনের ঘটনাকে আলাদা করা যাচ্ছে না। শুরুতেই তিনি বুঝতে পারেন, এই পান্ডুলিপি কোনও সাধারণ খাতা নয়; এটি হয়তো হত্যাকারীর উদ্দেশ্যকে লুকিয়ে রেখেছে অথবা খুনের প্রকৃত ঘটনার ইঙ্গিত দিয়েছে। কিন্তু পুলিশের অফিসিয়াল মহলে এই ধারণা স্বাভাবিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়—আইন তো কেবল বাস্তব প্রমাণের উপর দাঁড়িয়ে থাকে, কল্পনার উপর নয়। তবুও রুদ্রপ্রসাদের মনে হচ্ছিল, এই রহস্যের সমাধান যদি কোথাও থাকে তবে তা লুকিয়ে আছে অরিন্দম সেনের শেষ পান্ডুলিপির পাতায়।
তদন্তের প্রথম ধাপেই রুদ্রপ্রসাদের মুখোমুখি হয় অরিন্দম সেনের মেয়ে অনিন্দিতা। বাবার প্রতি তার বিশ্বাস, ভালোবাসা, আর সাহিত্যিক মর্যাদাকে আঘাত লাগছিল পুলিশের এই দৃষ্টিভঙ্গিতে। “একজন লেখকের কল্পনা কি কখনও খুনের প্রমাণ হতে পারে?”—অনিন্দিতার প্রশ্নে রুদ্রপ্রসাদ কিছুটা বিরক্ত হলেও, এক অদ্ভুত দ্বিধায় পড়ে যান। সত্যিই, অরিন্দম সেন যদি কেবল একজন সাহিত্যিক হন, তবে তার পান্ডুলিপিকে খুনের সঙ্গে যুক্ত করা ন্যায়সংগত নয়। কিন্তু বাস্তব ঘটনা আর পান্ডুলিপির অদ্ভুত মিল যেন তাকে বারবার সেই খাতার দিকে ঠেলে দিচ্ছিল। এভাবে দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হতে থাকে—অনিন্দিতা বাবাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চায়, আর রুদ্রপ্রসাদ খুঁজতে চায় পান্ডুলিপির ভেতরে লুকোনো অপরাধের সূত্র। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুজনের পথ বারবার মিলে যায়—অনিন্দিতা নিজের অজান্তেই পুলিশকে অনেক সূত্র দেয়, আর রুদ্রপ্রসাদও কখনও কখনও স্বীকার করতে বাধ্য হন যে তার কড়া নিয়মকানুনের বাইরে এই কেস সমাধানে সাহিত্যের ব্যাখ্যার প্রয়োজন। দ্বন্দ্ব আর সহযোগিতার এই দ্বৈত সম্পর্ক গল্পকে ক্রমশ গভীর করে তোলে।
তদন্ত এগোতে থাকায় দেখা যায়, পান্ডুলিপির প্রতিটি অধ্যায় যেন একটি করে নতুন প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে। খুনের বিবরণ, খুনির মানসিকতা, এমনকি অপরাধের পরবর্তী পরিস্থিতিও অরিন্দম সেন লিখে রেখেছিলেন—যেন তিনি সব আগেভাগে জানতেন। রুদ্রপ্রসাদ পান্ডুলিপির প্রতিটি বাক্যকে বিশ্লেষণ করতে থাকেন, কিন্তু তাতে জটিলতা আরও বাড়ে। খাতার ভেতরে হয়তো কোনও কোডেড বার্তা লুকিয়ে আছে—এমনটাও তার মনে হতে থাকে। অন্যদিকে অনিন্দিতা বারবার যুক্তি দেয়, একজন সৃজনশীল লেখক চারপাশের ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লিখতেই পারেন, এর মানে এই নয় যে তিনি অপরাধে জড়িত। পুলিশি তদন্তের কঠোরতা আর সাহিত্যিক ব্যাখ্যার সূক্ষ্মতা—এই দুইয়ের টানাপোড়েনে গল্প আরও রহস্যময় হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে মনে হতে থাকে, হয়তো এই কেসের সমাধান কেবল পুলিশি যুক্তি বা সাহিত্যের ব্যাখ্যা দিয়ে সম্ভব নয়; বরং দরকার হবে দুয়ের মিশ্রণ। আর এই জায়গাতেই অনিন্দিতা আর রুদ্রপ্রসাদের সম্পর্ক নতুন মোড় নেয়—তারা শত্রুতার মাঝেও বুঝতে শুরু করে, একে অপরকে ছাড়া এই রহস্যের গিঁট খোলা যাবে না।
৫
অরিন্দম সেনের বিশাল লাইব্রেরি ও বাড়ির নিস্তব্ধতা যেন দিন দিন আরও গাঢ় হয়ে উঠছিল। অনিন্দিতা নিজের ভেতরে বাবার শূন্যতার যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে বেড়ালেও মনের এক কোণে পান্ডুলিপির রহস্য তাকে তাড়া করে ফিরছিল। প্রতিটি পৃষ্ঠা পড়তে পড়তে তার মনে হচ্ছিল—এ যেন নিছক গল্প নয়, বরং এক বাস্তবের প্রতিচ্ছবি, যা বাবার জীবনের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এই ভাবনায় সে অনেক রাত অবধি জেগে থাকত, পুরোনো বইয়ের গন্ধ মাখা লাইব্রেরির টেবিলে বসে কাগজের ওপর আঙুল চালাত। কিন্তু একদিন হঠাৎ সে লক্ষ্য করল, বাবার গৃহপরিচারিকা মায়া বসু তার সঙ্গে চোখাচোখি এড়াতে চাইছে। বহু বছর ধরে অরিন্দমের বাড়িতে কাজ করা এই নারী সবসময় ভদ্র, শান্ত ও নির্ভরযোগ্য ছিলেন। অথচ এখন তার চোখে ভাসছিল অদ্ভুত এক ভয়ের ছায়া। অনিন্দিতা বুঝতে পারল—মায়া হয়তো এমন কিছু জানে, যা বাবার মৃত্যুর আসল কারণের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু সমস্যা হলো, মায়া নীরব, এমনকি প্রশ্ন করলেও অস্বীকার বা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সেই নীরবতার ভেতরে চাপা পড়ে থাকা সত্যি যেন তাকে আরও আতঙ্কিত করছে।
অনিন্দিতা সিদ্ধান্ত নিল একান্তে মায়ার সঙ্গে কথা বলবে। এক বিকেলে, যখন বাড়ির অন্যান্য কাজকর্ম শেষ হয়ে গিয়েছে, সে মায়াকে ডেকে আনে রান্নাঘরের পাশে ছোট ঘরে। সেখানে এক কাপ চা এগিয়ে দিয়ে সে আস্তে আস্তে বাবার মৃত্যুর প্রসঙ্গ তোলে। প্রথমে মায়া নিচু চোখে, চাপা স্বরে বলে—“আমি তো কিছুই জানি না মেমসাহেব।” কিন্তু তার হাত কাঁপছিল, চোখে ভাসছিল অশ্রুর আভাস। অনিন্দিতা ধৈর্য ধরে বোঝানোর চেষ্টা করল—“তুমি যদি কিছু লুকাও, তাহলে সত্যিটা কখনো প্রকাশ পাবে না। বাবা যদি সত্যিই অন্যায়ভাবে মারা গিয়ে থাকেন, তবে তাকে ন্যায্য বিচার দিতে আমাদের সাহায্য করতেই হবে।” কথাগুলো যেন মায়ার অন্তরের দরজায় ধাক্কা দিল। ধীরে ধীরে সে কিছু কথা বলতে শুরু করল। জানাল, অরিন্দম সেনের মৃত্যুর আগের রাতে তিনি খুব অস্থির হয়ে ছিলেন। মায়া তাকে একা লাইব্রেরিতে টহল দিতে দেখেছিল—মুখে চাপা উৎকণ্ঠা, আর হাতে একটি নীল খাম। কিন্তু ভোর হওয়ার আগেই, অরিন্দমকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। পুলিশ তখন বলেছিল—হৃদরোগে মৃত্যু। কিন্তু মায়া বলল, সে নিশ্চিত—সেই রাতে কেউ একজন বাড়িতে এসেছিল, কারণ সে পায়ের শব্দ শুনেছিল করিডরে। ভয় আর সামাজিক অবস্থানের কারণে সে তখন কিছুই বলেনি।
এই স্বীকারোক্তি শুনে অনিন্দিতার বুক কেঁপে উঠল। এর মানে, বাবার মৃত্যু প্রাকৃতিক ছিল না, বরং কারও পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। কিন্তু সেই নীল খামের ভেতরে কী ছিল? কেন অরিন্দম এত অস্থির হয়ে পড়েছিলেন? আর কে এসেছিল সেই রাতে? অনিন্দিতা মায়ার হাত ধরে আশ্বাস দিল—“তুমি ভয় পেয়ো না, আমি আছি। সত্যিটা চাপা থাকবে না।” তবে একই সঙ্গে সে উপলব্ধি করল, এই নতুন তথ্য তদন্তকে আরও জটিল করে তুলবে। কারণ এর মানে দাঁড়াল—পান্ডুলিপি, বাস্তব খুন আর অরিন্দমের মৃত্যু—সবকিছুই যেন এক অদৃশ্য সুতোর মতো বাঁধা। ইন্সপেক্টর রুদ্রপ্রসাদের সঙ্গে এই নতুন তথ্য ভাগ করে নিলে হয়তো তদন্ত অন্যদিকে মোড় নেবে। কিন্তু মায়ার নিরাপত্তার কী হবে? রাতের নিস্তব্ধতায় অনিন্দিতা বাবার টেবিলে বসে নতুন করে শপথ নিল—সে যেকোনো মূল্যে এই রহস্যের সমাধান করবে। বাবার অসমাপ্ত পান্ডুলিপির পাতা যেন তাকে ফিসফিস করে বলছিল—শেষ সত্যিটা এখনো লুকিয়ে আছে, আর সেই সত্যি প্রকাশের অপেক্ষায় অস্থির হয়ে আছে সময় নিজেই।
৬
অরিন্দম সেনের ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারের অন্ধকার কোণায় বসে অনিন্দিতা আবারও সেই অসম্পূর্ণ পান্ডুলিপি খুলে পড়তে থাকে। পাতার পর পাতা এগোতেই তার মনে হচ্ছিল, যেন সে কোনও কল্পকাহিনি নয়, এক জীবন্ত দুঃস্বপ্নের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। প্রতিটি বর্ণনা, প্রতিটি সংলাপ, প্রতিটি ঘটনার সূক্ষ্মতা অবিশ্বাস্যভাবে বাস্তবের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। প্রথম খুন—যেটি পুলিশি নথিতে আজও একটি অমীমাংসিত রহস্য হিসেবে রয়ে গেছে—সেটির বর্ণনা হুবহু এখানে আছে। এমনকি খুনের রাতের হালকা বৃষ্টির উল্লেখও বাদ যায়নি। রুদ্রপ্রসাদ দত্ত যখন অনিন্দিতার হাত থেকে এই অংশ পড়ে শুনলো, তার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো। সে একজন অভিজ্ঞ অফিসার, অসংখ্য অদ্ভুত কেস সে সামলেছে, কিন্তু কোনও সাহিত্যকর্ম যেন একেবারে হুবহু পুলিশের কেস ডায়েরি হয়ে উঠবে—এমন ঘটনা সে আগে দেখেনি। অনিন্দিতার বুকের ভিতর অদ্ভুত আতঙ্ক জমে উঠলো। সে অনুভব করলো, বাবার মৃত্যুর রহস্যের আসল সূত্র এই পান্ডুলিপির অক্ষরে অক্ষরে লুকিয়ে আছে, আর কেউ যদি এটিকে সত্যিই নির্দেশিকা হিসেবে ব্যবহার করে থাকে, তবে ঘটনাটা কোনও কাকতালীয় ব্যাপার নয়।
তবে যতই সামনে এগোনো যায়, ততই দেখা দিল আরও গভীর অস্থিরতা। কারণ যেখানে পর্যন্ত লেখা সম্পূর্ণ হয়েছে, সেখানে প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে বাস্তবের ভৌতিক মিল পাওয়া গেলেও, তার পরের অংশগুলো হঠাৎ থেমে গেছে। কিন্তু অসম্পূর্ণ জায়গায় যে আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তাতে আরও একটি হত্যার ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পান্ডুলিপির বাক্যগুলো যেন রহস্যে মোড়া—“অন্ধকারে দ্বিতীয় ছায়া এগিয়ে আসে, তার নিশ্বাসে মৃত্যুর গন্ধ।” অনিন্দিতা বারবার এই বাক্য পড়তে পড়তে শিউরে উঠলো। সে মনে করলো, এই ‘দ্বিতীয় ছায়া’ আসলে পরবর্তী খুনির আভাস। কে হতে পারে সে শিকার? বাবার কোনও ঘনিষ্ঠ মানুষ? নাকি শহরের সাহিত্যজগতের কারও প্রতি বাবার পুরোনো ক্ষোভের প্রতিশোধ? রুদ্র যখন পান্ডুলিপিটি আবার পড়লো, সে স্পষ্ট বললো—“এটা শুধুই কল্পনা নয়। খুনি হয়তো এটিকে নিজের নীলনকশা হিসেবে ব্যবহার করছে।” পুলিশের অভিজ্ঞতায় সে জানতো, কোনও অদ্ভুত অপরাধী মাঝে মাঝে কল্পকাহিনি বা প্রতীক ব্যবহার করে নিজের অপরাধকে সাজিয়ে তোলে। আর এখানে অরিন্দম সেনের অসম্পূর্ণ লেখা যেন সেই অন্ধকার মানচিত্র হয়ে উঠেছে।
এই উপলব্ধি পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুললো। কারণ যদি পাণ্ডুলিপি বাস্তবের পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে, তবে অসম্পূর্ণ জায়গায় লুকিয়ে থাকা আভাস মানে সামনে আরও একটি খুন অপেক্ষা করছে। অনিন্দিতার শিরায় রক্ত জমে গেল। বাবার মৃত্যু হয়তো নিছক প্রাকৃতিক ছিল না—বরং তারও কোনও রহস্যময় যোগ থাকতে পারে। রুদ্রের চোখে ঝলসে উঠলো সন্দেহের আগুন—“তুমি বুঝতে পারছো, অনিন্দিতা, এই গল্পের মধ্যে হয়তো তোমাকেও কোনও না কোনওভাবে জড়িয়ে রাখা হয়েছে?” অনিন্দিতা স্তব্ধ হয়ে গেল। তার চারপাশে যেন অদৃশ্য জাল বিস্তার করছে, যেখানে বাবার অতীত, পান্ডুলিপির অদ্ভুত মিল, আর আসন্ন অজানা বিপদ একসঙ্গে তাকে আটকে ফেলেছে। ঘড়ির কাঁটা যেমন এগিয়ে চলে, তেমনি বাস্তব আর কল্পনার সীমারেখা মুছে যেতে থাকে, আর প্রতিটি মুহূর্তে প্রশ্নটা আরও তীব্র হয়ে ওঠে—কে আসল খুনি? আর কে সেই পরবর্তী শিকার, যার রক্তপাতের ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই পাণ্ডুলিপির অক্ষরে লেখা হয়ে গেছে?
৭
প্রথমে বিষয়টি সীমিত আকারে সাহিত্য মহলের ভেতরে ঘুরছিল—অরিন্দম সেনের রহস্যময় মৃত্যুর সঙ্গে তাঁর অসম্পূর্ণ পান্ডুলিপির যোগসূত্র। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে ঘটনা শহরের গণ্ডি পেরিয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপ, টুইটার ট্রেন্ড, ইউটিউব লাইভ—সব জায়গায় অরিন্দমকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। কেউ বলছে, তিনি একজন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ছিলেন; তাঁর লেখার ভেতরেই লুকিয়ে ছিল সমাজের গোপন সত্য। আবার কেউ কেউ প্রমাণসহ দাবি করছে—অরিন্দম নাকি নিজের মৃত্যুও লিখে গেছেন, যদিও সেটি প্রকাশিত হয়নি। সাধারণ মানুষ, যারা হয়তো আগে অরিন্দমের একটি বইও পড়েনি, তারাও হঠাৎ তাঁর ভক্ত হয়ে ওঠে। চারদিকে ‘অরিন্দমের শেষ রহস্য’ নিয়ে হইচই শুরু হয়, আর সংবাদমাধ্যম প্রতিটি ক্ষুদ্র তথ্যকে বাড়িয়ে তুলে মানুষের কৌতূহলকে আরও উস্কে দেয়। ফলে পুলিশি তদন্তের গুরুত্ব যেন জনমত আর গুজবের ঢেউয়ে ডুবে যায়।
ভক্তদের এই উন্মাদনা ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। অরিন্দমের বাড়ির সামনে প্রায় প্রতিদিন ভিড় জমতে শুরু করে—কেউ ফুল নিয়ে আসে, কেউ মোমবাতি জ্বালিয়ে তাঁর নামে প্রার্থনা করে, আবার কেউ অরিন্দমকে “আধুনিক যুগের নস্ত্রাদামুস” বলে প্রচার চালায়। অনেক ইউটিউবার বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে ‘লাইভ’ করে, ভেতরের এক ঝলক পাওয়ার আশায়। কিছু ভক্ত আবার সরাসরি অনিন্দিতার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করে, তাঁকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তোলে—“আপনার বাবা কি সত্যিই খুনের আগাম ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন?”, “শেষ পান্ডুলিপিতে আর কী লেখা ছিল?”, “তিনি কি নিজের মৃত্যুর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন?”—এইসব প্রশ্নের উত্তর না দিলে ভক্তরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, আবার উত্তর দিলেও নতুন জল্পনার জন্ম হয়। অনিন্দিতা একদিকে বাবার শোক সামলাতে পারছে না, অন্যদিকে হঠাৎ এই জনসমুদ্রের চাপ তাকে মানসিকভাবে ক্লান্ত করে তুলছে। পুলিশের জন্যও পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে, কারণ যেকোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ প্রকাশ্যে এলে তা মুহূর্তে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে গিয়ে বিভ্রান্তি বাড়িয়ে দিচ্ছে।
সবচেয়ে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে কিছু উগ্র ভক্তদের আচরণ। তারা বিশ্বাস করতে শুরু করে, অরিন্দম যেটুকু অসম্পূর্ণ রেখে গেছেন, সেটি পূর্ণ করা তাদের দায়িত্ব। কেউ কেউ ভুয়া অধ্যায় লিখে ছড়িয়ে দেয়, কেউ দাবি করে অরিন্দম তার স্বপ্নে এসেছেন আর আসল খুনির নাম জানিয়েছেন। এইসব অদ্ভুত জল্পনা পুলিশি তদন্তকে দিশাহীন করে তোলে। রুদ্রপ্রসাদ বুঝতে পারে, প্রকৃত সত্য যত না অপরাধীর ছায়ায় লুকিয়ে আছে, তারচেয়ে বেশি চাপা পড়ছে মানুষের কল্পনা আর অন্ধভক্তির কোলাহলে। অনিন্দিতা ধীরে ধীরে উপলব্ধি করে, সত্য উদঘাটন করতে হলে কেবল খুনি খুঁজলেই হবে না—বরং এই বিশাল উন্মাদনার প্রাচীর ভেদ করতেও হবে। কিন্তু কীভাবে? তার উত্তর এখনো অন্ধকারেই ঢাকা পড়ে থাকে, আর তদন্ত ক্রমশ প্রবাহিত হয় এমন এক পথে, যেখানে বাস্তব আর কল্পনার সীমারেখা ঝাপসা হয়ে যায়।
৮
নীলয়ের কথাগুলো শুনে অনিন্দিতার ভেতর অদ্ভুত এক শীতলতা নেমে আসে। এতদিন যাকে সে বাবার শিষ্য বলে ভেবেছে, যার প্রতি বাবার স্নেহ ও আস্থা ছিল, সেই মানুষই নাকি বাবার প্রতি ক্ষোভ পুষে রেখেছিল? নীলয় ঠান্ডা গলায় বলে ওঠে, “তোমার বাবা আমার লেখা কেড়ে নিয়েছিলেন, অনিন্দিতা। আমার স্বপ্ন, আমার রক্ত-মাংসের সৃষ্টিকে তিনি নিজের নামে ছাপালেন, আর আমার নামটুকুও রইল না কোথাও।” তার চোখে তীব্র ক্ষোভের আগুন, যেন বহুদিনের লুকোনো ব্যথা আচমকা বিস্ফোরিত হলো। অনিন্দিতা প্রথমে বিশ্বাস করতে চায় না—অরিন্দম সেন, যিনি সাহিত্যজগতে সততার প্রতীক ছিলেন, তিনি কি সত্যিই এমন অন্যায় করতে পারেন? কিন্তু নীলয়ের ভাঙা কণ্ঠে, চোখের জ্বলন্ত ক্ষোভে এক অস্বস্তিকর সত্য যেন ধীরে ধীরে ফুঁসে ওঠে। তার মনের ভেতর বাবার চরিত্র নিয়ে সন্দেহ জন্ম নিতে থাকে—কীসের জন্য এতদিন তিনি মানুষজনের কাছ থেকে ঈশ্বরতুল্য সম্মান পেয়েছিলেন, যদি তাঁরই শিষ্য বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে থাকে? নীলয়ের দাবি শুধু লেখার অধিকার নয়, প্রতিশোধের কথাও স্পষ্ট—“তিনি আমার জীবন নষ্ট করেছেন, আমি কেন তাঁর শান্তি রক্ষা করব?” এই স্বীকারোক্তি অনিন্দিতার মনে গভীর ঝড় তোলে—তাহলে বাবার মৃত্যু কি নিছক ভাগ্যের খেলা, নাকি কারও প্রতিশোধের শিকার?
অন্যদিকে সম্পাদক সমরেশের আচরণও ক্রমশ অদ্ভুত হয়ে উঠছে। একদিকে তিনি বারবার জোর দিচ্ছেন অসম্পূর্ণ পান্ডুলিপি প্রকাশ করার জন্য, আবার অন্যদিকে কিছু বিষয় গোপন করতে চাইছেন। অনিন্দিতা যখন সরাসরি জিজ্ঞেস করে, “আপনি বাবার মৃত্যুর আগে শেষ দিনগুলিতে কী জানতেন? কেন বারবার ফোন করেছিলেন তাঁকে?”—সমরেশ এড়িয়ে যান, অস্পষ্ট উত্তর দেন। তাঁর চোখে এক অদ্ভুত ভীতির ছায়া, যেন এমন কিছু আছে যা প্রকাশ করলে তাঁর নিজেরও সর্বনাশ হতে পারে। অনিন্দিতা বুঝতে পারে, সমরেশ শুধু একজন সম্পাদক নন—তিনি এই রহস্যের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তিনি হয়তো পান্ডুলিপি নিয়ে কিছু লুকোচ্ছেন, হয়তো জানেন কাকে ঘিরে দ্বিতীয় হত্যার ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে। কিন্তু কেন তিনি সত্যিটা প্রকাশ করছেন না? তাঁর ভেতরে কীসের এত ভয়? হয়তো অর্থনৈতিক স্বার্থ, হয়তো খ্যাতির মোহ, হয়তো আরও ভয়ঙ্কর কোনও সত্য। অনিন্দিতার সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়, বিশেষত যখন সে আবিষ্কার করে যে পান্ডুলিপির কয়েকটি পাতা সম্ভবত অদলবদল করা হয়েছে—আর এই অদলবদলের মধ্যে সমরেশের হাত থাকার সম্ভাবনা প্রবল।
সব মিলিয়ে অরিন্দম সেনের মৃত্যু আর তাঁর অসম্পূর্ণ লেখাকে ঘিরে যেন এক অদৃশ্য জাল বোনা হচ্ছে। একদিকে নীলয়ের প্রতিশোধস্পৃহা, অন্যদিকে সমরেশের অস্বচ্ছতা—সবকিছু মিলে খুনের রহস্য আরও গভীর হচ্ছে। অনিন্দিতার ভেতর দ্বন্দ্ব তীব্র হয়ে ওঠে—সে বাবাকে ভালোবাসত, তাঁকে নির্দোষ ভাবতে চাইত, কিন্তু প্রতিটি নতুন তথ্য যেন তাঁর বিশ্বাসকে ধ্বংস করছে। যদি সত্যিই বাবা কারও লেখার অধিকার কেড়ে নিয়ে থাকেন, তবে তিনি কি শুধু একজন সাহিত্যিক ছিলেন, নাকি এক নির্মম প্রতারকও? আর যদি তাই হয়, তবে তাঁর মৃত্যু কি এক প্রাপ্য শাস্তি ছিল? না কি এই পুরো সত্যের আড়ালে আরও বড় কোনও ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে? পুলিশের তদন্তও নতুন মোড় নেয়, কারণ রুদ্রপ্রসাদ এখন নীলয়কেও সন্দেহের তালিকায় রাখে। অথচ কোনও নির্দিষ্ট প্রমাণ হাতে আসে না। সেই সঙ্গে সমরেশের গোপনীয়তা তদন্তকে আরও জটিল করে তোলে। মনে হয় যেন প্রতিটি চরিত্রই অরিন্দমের মৃত্যু থেকে কিছু না কিছু লুকোচ্ছে। অনিন্দিতা বুঝতে পারে—বাবার মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটন করতে গেলে তাঁকে কেবল খুনির পরিচয় নয়, বাবার জীবন আর সাহিত্যকর্মের অন্ধকার দিকগুলোকেও সামনে আনতে হবে। বিশ্বাসঘাতকতার ছায়া ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে, আর সেই ছায়ার ভেতরেই লুকিয়ে আছে সত্য ও মিথ্যার এক অদ্ভুত খেলা, যা শিগগিরই আরও ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করবে।
৯
অনিন্দিতা এবং রুদ্রপ্রসাদ দত্ত টানা কয়েকদিন ধরে অরিন্দমের অসমাপ্ত পান্ডুলিপি নিয়ে গভীর অনুসন্ধানে ব্যস্ত ছিল। লেখার প্রতিটি লাইন, প্রতিটি শব্দ যেন একেকটা ধাঁধা—যা সমাধান করতে না পারলে মূল রহস্যের কাছে পৌঁছানো যাবে না। এক গভীর রাতে, পুরোনো কাঠের টেবিলে ছড়িয়ে রাখা পান্ডুলিপির পাতাগুলো পড়তে পড়তে অনিন্দিতা হঠাৎ খেয়াল করে, কিছু বাক্যে অদ্ভুত পুনরাবৃত্তি আছে। সাধারণ পাঠকের চোখ এড়িয়ে যাবে, কিন্তু একজন লেখকের কন্যা হিসেবে অনিন্দিতা জানত—অরিন্দম সচেতনভাবে এভাবে লিখতেন না। রুদ্র তার পর্যবেক্ষণ শুনে মনোযোগ দিয়ে পাতাগুলো পরীক্ষা করতে থাকে। কাগজের ভাঁজ, হস্তাক্ষরের ঝাপসা জায়গা, এমনকি নির্দিষ্ট কিছু শব্দের অদ্ভুত জোর—all clues pointed to a hidden code. অবশেষে তারা বুঝতে পারে, আসল সূত্র রয়েছে শেষ লাইনে। সেখানে লেখা ছিল—“যে ছায়া আলোকে গ্রাস করে, সত্যিই সে-ই হত্যার রচয়িতা।” এই বাক্যটা পড়েই অনিন্দিতার বুক কেঁপে ওঠে, কারণ এটি কেবল একটি সাহিত্যিক উক্তি নয়—এটি খুনির দিকে সরাসরি ইঙ্গিত বহন করছে।
রুদ্র ব্যাখ্যা করতে থাকে যে “ছায়া” শব্দটি হয়তো কোন ব্যক্তির নামের সঙ্গে যুক্ত, বা এমন কারো প্রতীক যিনি সবসময় অরিন্দমের জীবনে থেকেও আড়ালে ছিলেন। অনিন্দিতা ভাবতে থাকে সম্পাদক সমরেশের দিকে, যিনি অরিন্দমের লেখা গোপনে বদলাতেন, আবার নীলয়ের দিকেও সন্দেহ ঘন হয়, কারণ সে নিজেকে বাবার শিষ্য বলে দাবি করলেও মনের গভীরে প্রতিশোধের আগুন পুষে রেখেছিল। কোডটি ভাঙার জন্য তারা অক্ষরগুলোকে আলাদা করে পরীক্ষা করে, এবং আবিষ্কার করে প্রতিটি অনুচ্ছেদের প্রথম শব্দের সঙ্গে একটি রহস্যময় অক্ষরখেলা লুকিয়ে আছে। এই অক্ষরগুলো মিলিয়ে যে নামটি তৈরি হতে শুরু করে, সেটি তাদের চমকে দেয়। মনে হয় যেন অরিন্দম মৃত্যুর আগে খুনিকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন, এবং ইচ্ছে করেই লেখার মধ্যে সূত্র রেখে গেছেন। কিন্তু সবকিছু এখনও অস্পষ্ট—স্পষ্ট নাম উচ্চারণের আগে আরও কিছুটা বিশ্লেষণ দরকার ছিল।
ঠিক এই সময়, যখন অনিন্দিতা এবং রুদ্র কোডের শেষ অংশটা বিশ্লেষণ করতে বসে, তখনই শহরে আরেকটি ভয়ংকর খবর আসে। সমরেশের বাড়িতে খুন হয় এক তরুণ গবেষক, যে সম্প্রতি অরিন্দমের লেখা নিয়ে প্রবন্ধ লিখছিল। ঘটনাস্থলে পাওয়া যায় অদ্ভুত চিহ্ন—যেটি পান্ডুলিপির শেষ লাইনের সঙ্গে মিলে যায়। অর্থাৎ খুনি তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ লক্ষ্য করছে, এবং তারা সূত্রের কাছাকাছি গেলেই নতুন শিকার করছে। অনিন্দিতার বুক হিম হয়ে যায়—এখন খুনি কেবল অরিন্দমের মৃত্যুর রহস্যেই আটকে নেই, বরং যেকোনো মুহূর্তে সে নিজেকেও শিকার বানাতে পারে। রুদ্র শান্ত থাকার চেষ্টা করে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে বুঝে যায়—পাণ্ডুলিপির শেষ লাইনই হলো সেই দ্বার, যেটি খুলতে পারলেই মুখোশ সরবে খুনির, নাহলে মৃত্যু আর বিভ্রান্তির অন্ধকারই কেবল ছড়িয়ে পড়বে।
১০
চাপা অন্ধকারের মতো দীর্ঘ হয়ে ওঠা তদন্তের শেষ পর্যায়ে অনিন্দিতা আর রুদ্র যখন পান্ডুলিপির প্রতিটি লাইন ঘেঁটে দেখছিল, তখন এক অদ্ভুত অনুভূতি বারবার তাদের ঘিরে ধরছিল—অরিন্দম যেন মৃত্যুর অনেক আগে থেকেই এই মুহূর্তের আভাস রেখেছিলেন। শেষ ক’টি পাতায় পাওয়া সংকেতগুলো একত্র করলে স্পষ্ট হলো যে তিনি নিজের মৃত্যুর ঠিক আগে সত্যিটা ধরতে পেরেছিলেন। তাঁর লেখার ভেতরে লুকোনো প্রতিটি রূপক, প্রতিটি দ্ব্যর্থবোধক বাক্য যেন নতুনভাবে উন্মোচিত হলো। কিন্তু প্রশ্ন ছিল—এতদূর এসে সত্যিটা কি তাদের নাগালের বাইরে থেকে যাবে? সেই উত্তর এলো হঠাৎই, যখন আরেকটি হত্যাকাণ্ড ঘটে গেল, যা যেন একেবারে প্রমাণ করে দিল খুনির উপস্থিতি এখনও বর্তমান। শহরের সাহিত্যচক্র, সংবাদমাধ্যম আর ভক্তদের মধ্যে হইচই পড়ে গেল, আর অনিন্দিতা গভীরভাবে উপলব্ধি করল—এখন যে পথ বেছে নিতে হবে, তা শুধু একজন মেয়ের বাবার মৃত্যু-রহস্য উন্মোচনের নয়, বরং গোটা সাহিত্য-দুনিয়ার অন্ধকার মুখোশ সরানোর দায়ও তার কাঁধে এসে পড়েছে।
চূড়ান্ত সংঘর্ষের মুহূর্তটা এলো হঠাৎ করেই। রাতের অন্ধকারে, অরিন্দমের পুরনো স্টাডি রুমে, যেখানে অসংখ্য অমর সৃষ্টি জন্ম নিয়েছিল, সেখানে দাঁড়িয়ে খুনির মুখোমুখি হলো অনিন্দিতা ও রুদ্র। টেবিলের উপর ছড়িয়ে থাকা কালি-দাগা কাগজগুলো, ভাঙা কফি মগ, আর একপাশে পড়ে থাকা অরিন্দমের শেষ লেখা খাতা যেন সাক্ষী হয়ে দাঁড়াল। খুনির মুখোশ খুলে গেল—সেই মানুষটির, যাকে কেউ সন্দেহই করেনি এতদিন। প্রকাশ পেল যে তিনি অরিন্দমের সাহিত্যিক ক্ষমতাকে ভয় করতেন, তাঁর খ্যাতি আর প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ ভেবেছিলেন, এবং সেই ঈর্ষা আর প্রতিহিংসার জালেই সাজিয়েছিলেন মৃত্যুর নাটক। অথচ অরিন্দম মৃত্যুর আগেই এই সত্য উপলব্ধি করেছিলেন, কিন্তু খোলাখুলি প্রকাশ করেননি; বরং সাহিত্যের মাধ্যমেই রেখে গিয়েছিলেন সূত্র। সেই সূত্র ধরেই আজ সব ফাঁস হলো। দ্বন্দ্বটা শুধু খুনি আর তদন্তকারীর মধ্যে ছিল না, বরং লেখক বনাম ছায়ার—একজন স্রষ্টার সত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা বনাম এক প্রতিহিংসাপরায়ণ মানুষের ধ্বংসাত্মক নকশা। সংঘর্ষের শেষে ধরা পড়ল খুনি, কিন্তু তার আগে অনিন্দিতা যেন নতুন করে আবিষ্কার করল বাবাকে—একজন সত্য-সন্ধানী, যিনি শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত সাহিত্যকেই আশ্রয় করেছিলেন সত্য প্রকাশের জন্য।
তবু সমাধান যেন পুরো হয়নি। মামলার কাগজপত্র গুছিয়ে নেওয়ার সময় অনিন্দিতা লক্ষ্য করল—পাণ্ডুলিপির শেষ পাতায় একটি রহস্যময় ফাঁকা জায়গা রয়ে গেছে, যেন অরিন্দম ইচ্ছে করেই অপূর্ণ রেখেছিলেন তা। সেটি কি শুধু এক প্রতীক? নাকি এর ভেতরে আরও কোনো গোপন তথ্য চাপা আছে? পুলিশি রিপোর্ট বলল—খুনি ধরা পড়েছে, সত্য উন্মোচিত হয়েছে। কিন্তু অনিন্দিতার ভেতরে অদ্ভুত এক দ্বন্দ্ব রয়ে গেল। বাবার লেখা, বাবার চোখের ইশারা, আর অসম্পূর্ণ বাক্যের ফাঁকে ফাঁকে সে যেন শুনতে পেল এক নিঃশব্দ আহ্বান—“সত্যের অনুসন্ধান শেষ হয়নি।” গল্প শেষ হলো খুনি ধরা পড়ার মধ্য দিয়ে, কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের মনে গেঁথে গেল গভীর প্রশ্ন—সব রহস্য কি সত্যিই উন্মোচিত হলো, নাকি সাহিত্যের ভেতরেই লুকিয়ে আছে আরও এক অন্ধকার দিক, যা ভবিষ্যতে হয়তো নতুন অধ্যায়ের জন্ম দেবে? এভাবেই সমাপ্তির মুহূর্তে কাহিনী শুধু রহস্য নয়, বরং সাহিত্য, সত্য ও প্রতিশোধের বহুমাত্রিক অনুসন্ধান হয়ে উঠল—যেখানে এক লেখকের ছায়া মৃত্যুর পরও জীবিত রইল, আর খুনির হাত ধরা পড়লেও ছায়ার ভেতর লুকিয়ে থাকা প্রশ্নগুলো অমীমাংসিত থেকে গেল।
শেষ




