ঋতুপর্ণা ঘোষাল
১
পাঞ্জাবের গরম তখন তীব্র, কিন্তু আকাশজুড়ে ছড়ানো এক অপূর্ব বিকেলের আলো। চারপাশে সরষে ফুলের হলুদ ঢেউ, আর তার মাঝে একটি মাটির পথ—যেটা সোজা চলে গেছে একটি ছোট্ট গ্রামে। গ্রামটির নাম ছিল হুসেনওয়ালা, সীমান্তের অনেকটা কাছেই, কিন্তু তখনো সীমান্ত বলে কিছু নেই। এপাশ-ওপাশের মানুষ তখনো ‘একটাই দেশ’ ভাবত। সেই গ্রামে একটি পুরনো, আধাবসতি জমিদার বাড়িতে থাকতেন এক নিঃসন্তান শিক্ষক দম্পতি। তাঁদের বাড়িতে মাঝে মাঝে আসতেন তাঁদের একমাত্র ভাইঝি—অরুন্ধতী।
অরুন্ধতী তখন ষোলো কি সতেরো হবে। বড় বড় চোখ, শাড়ি পরে চুলে বেণী বাঁধে, কিন্তু চোখেমুখে শহরের পড়ুয়া মেয়ে বলেই স্পষ্ট বোঝা যেত। সে লাহোরের কুইন্স কলেজের ছাত্রী, গ্রীষ্মের ছুটিতে মামাবাড়িতে এসেছিল। সে শহরের মেয়ে হলেও প্রকৃতিকে ভালোবাসত, এবং পড়াশোনার বাইরেও গান, কবিতা, আর ছবি আঁকার প্রতি এক অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল তার।
একদিন বিকেলে, সে বাড়ির পাশে বটগাছের নিচে বসে রবীন্দ্রনাথ পড়ছিল। গাছের ছায়া তার মুখে নেমে এসেছে। সে একাই বসে ছিল, হঠাৎ কেউ তাকে ডাকল।
—“আপনি রবীন্দ্রনাথ পড়ছেন?”
অরুন্ধতী তাকিয়ে দেখল—এক যুবক দাঁড়িয়ে। বয়স বিশ কি বাইশ, কাঁধে একটি খয়েরি ব্যাগ, মাথায় পাগড়ি, চোখে গভীরতা।
—“হ্যাঁ, আপনি চেনেন?”
—“আমি জানি, উনি একজন মহান কবি। তবে আমাদের মাদ্রাসায় ওঁর লেখা শেখায় না। আমি লুকিয়ে পড়ি।”
অরুন্ধতী মুচকি হাসল।
—“তাহলে আপনাকে কবিতার চোর বলা যায়।”
—“হয়তো। তবে কবিতার চোরেরা প্রেমের জিনিস চুরি করে, ক্ষতি করে না।”
ছেলেটির নাম ছিল রফিক। গ্রামের পাশেই মাদ্রাসার ছাত্র, পাশাপাশি গ্রামের পাণ্ডিত বাড়িতে টিউশনি করত। বাবাকে ছোটবেলায় হারিয়ে সে তার মাকে নিয়ে এক ভাঙা কুঁড়ে ঘরে থাকত। চোখে ছিল বড় হওয়ার তৃষ্ণা, আর হৃদয়ে কবিতা।
প্রথম আলাপে তেমন কিছু না হলেও, কিছু একটা শুরু হয়েছিল। পরদিন, আবার দেখা। অরুন্ধতী তার পুরনো খাতায় রফিককে নিজের আঁকা কিছু ছবি দেখায়—যার মধ্যে একটি ছিল একটি হাত ধরাধরি করা যুগলের। রফিক তাতে শুধু বলেছিল—“ছবিটা কাঁদছে যেন।”
তৃতীয় দিন অরুন্ধতী তাকে গান শুনিয়েছিল—“এই কথাটি মনে রেখো, যদি যাই আমি চলে।”
আর চতুর্থ দিন, তারা একসাথে বসে সূর্যাস্ত দেখেছিল।
সমস্ত গ্রামের মধ্যে এই দুটি যুবক-যুবতীর বন্ধুত্ব এক গোপন নদীর মতো বয়ে চলেছিল—কেউ বুঝতে পারত না, কিন্তু তারা জানত, কিছু একটা বদলে যাচ্ছে।
এক সন্ধ্যায়, অরুন্ধতী রফিককে বলল, “তুমি মুসলমান, আমি হিন্দু। এ সম্পর্ক তো আমাদের সমাজ মেনে নেবে না।”
রফিক একটু থেমে বলেছিল, “তোমার চোখে যদি জাত দেখতাম, তাহলে ভালোবাসতাম না। আমি তোমার চোখে শুধু কবিতা দেখি।”
অরুন্ধতী কোনো উত্তর দেয়নি। কেবল তাকিয়ে থেকেছিল তার চোখে, আর জবাব দিয়ে দিয়েছিল নিঃশব্দে।
তাদের মধ্যে কোনোদিন কোনো অঙ্গীকার হয়নি, কোনো চিঠি চালাচালি হয়নি। ছিল না কোনো ফাঁকা প্রতিশ্রুতি। শুধু ছিল সময়কে ছুঁয়ে দেখা এক নিঃশব্দ ভালোবাসা—যেটা দু’জনেই জানত, জীবনের প্রারম্ভে একমাত্র সঙ্গী।
এরকমই চলছিল। কিন্তু একদিন, হঠাৎ গ্রামের হাটে গুজব উঠল—“বিভাজন হবে।” দেশ ভাগ হবে—হিন্দু ও মুসলিম আলাদা হবে। তখনো গ্রামের মানুষ গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু শহর থেকে খবর এলো—রেললাইন কেটে যাচ্ছে, পরিবার পালাচ্ছে, হিংসা ছড়াচ্ছে।
রফিক একদিন ছুটে এলো অরুন্ধতীর বাড়িতে।
—“আমার মা বলছে আমাদের পাকিস্তানে চলে যেতে হবে। আমি যেতে চাই না। আমি কোথাও যাব না।”
—“কিন্তু তুমি কী করবে? দাঙ্গা যদি হয়?”
—“আমি তোমার জন্য থেকে যাব। এখানে থেকে যাব।”
—“না রফিক, তোমাকে কিছু হলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।”
সেদিন তারা দু’জনের মধ্যে একমাত্র বার্তালাপ হয়, যেখানে ভবিষ্যতের জন্য কিছু ঠিক হয়েছিল। অরুন্ধতী বলেছিল, “যদি দেশ ভাগ হয়, আর যদি আমরা একে অপরকে হারিয়ে ফেলি, যদি যোগাযোগের সব পথ বন্ধ হয়ে যায়… তাহলে একদিন লিখো। যদি বেঁচে থাকো, লিখো।”
তাদের দেখা হয়েছিল শেষবারের মতো সেই রাতে। গ্রামের এক পাণ্ডে পরিবারের তত্ত্বাবধানে অরুন্ধতীকে পাঠানো হয়েছিল পূর্ব দিকে, তার মামাবাড়ির নিরাপত্তার জন্য। আর রফিক—সে পালাতে চায়নি, কিন্তু শেষমেশ মা’র হাত ধরে সে উঠে পড়েছিল সেই ‘মৃত্যুর ট্রেন’-এ, যেটা হুসেনওয়ালা থেকে চলে গিয়েছিল লাহোর।
ট্রেন ছাড়ার সময় রফিক তার ব্যাগে রেখে দিয়েছিল একটি কাগজ। তাতে লেখা ছিল—
“যদি এই ভাগের শেষে আবার দেখা হয়, তবে সেটা হবে কেবল সময়ের দয়া। কিন্তু যদি না হয়… আমি তো তোমার ওই ছবিটার ছায়া হয়েই থাকব। কাঁদা ভালোবাসা।”
সে ট্রেন আর ফিরেনি। অরুন্ধতী এক জীবনে কোনোদিন আর রফিকের দেখা পায়নি।
২
পাঞ্জাবের আকাশে তখন ধুলোর ঝড়, আর মাটির গায়ে ছড়িয়ে পড়ে রক্তের গন্ধ। ১৯৪৭ সালের জুন মাস। রাতের বেলায় শহরে হঠাৎ আগুন দেখা যায়, ভোরে শোনা যায় চিৎকার। সেই পাঞ্জাব, যেখানে একসাথে চলত ইমাম আর পুরোহিতের প্রার্থনা, যেখানে একই খেতের ধান তুলত হিন্দু, মুসলমান আর শিখ—সেই পাঞ্জাব এখন ফেটে গেছে বিভাজনের বিষে।
অরুন্ধতী তখন অস্থায়ীভাবে মামাবাড়ির সঙ্গে স্থানীয় হিন্দু পরিবারে আশ্রয়ে। তার মামা কলকাতায় ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন, কিন্তু যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। রফিকের কোনো খোঁজ নেই। গ্রামের রাস্তাগুলো বদলে গেছে। যেসব পথ তাদের দেখা করাত, আজ সেখান দিয়ে যায় লরি—ভরা অস্ত্রধারী মানুষে, চোখে ঘৃণা।
একদিন সন্ধ্যায় খবর আসে—পাশের গ্রামে দাঙ্গা লেগেছে। আগুন ধরেছে। আর সে আগুন রাতের ভেতরেই ছড়িয়ে পড়বে এই গ্রামে।
অরুন্ধতীর মামা সিদ্ধান্ত নেন—“কাল সকালে ট্রেন ধরতেই হবে। আর দেরি নয়।”
কিন্তু অরুন্ধতীর মন কিছুতেই স্থির হয় না। তার কাছে এ সিদ্ধান্ত মানে, শেষবার রফিককে না দেখা।
সে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “একবার, শুধু একবার, যদি দেখতে পারতাম তাকে!”
কেউই বলতে পারছিল না রফিক কেমন আছে, কোথায় আছে।
ওদিকে রফিক তখন লাহোরে। তার মা’র এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে তারা। যাওয়ার সময় রফিক শুধু একটি ব্যাগ নিয়েছিল, আর তার ভেতরে ছিল কিছু বই, একটি খাতা, আর অরুন্ধতীর দেওয়া ছোট একটি স্কেচ—দু’টি হাত, যেগুলি মিলতে পারছে না।
লাহোরে পৌঁছে সে শুনল, হুসেনওয়ালা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। অর্ধেক বাড়িঘর পুড়ে ছাই, বাকিরা পালিয়েছে। রফিক বুঝল, সে আর কোনোদিন অরুন্ধতীর দেখা পাবে না।
কিন্তু তার মন মানে না। সে খুঁজতে থাকে পত্রিকা, সংবাদ। একবার সে রেডিওতে শুনল “অমৃতসরে হিন্দু উদ্বাস্তুদের শিবির খোলা হয়েছে।” রফিক প্রায় উন্মাদ হয়ে উঠল। যদি সে সেখানে থাকে? যদি সে কোনোভাবে তার চিঠি পায়?
রাতের পর রাত, সে সেই খাতায় লিখতে শুরু করল। লিখতে লাগল তার মনের কথা, যন্ত্রণা, স্মৃতি। যেন সে চিঠি লিখছে অরুন্ধতীর উদ্দেশ্যে—যদিও কোনো ঠিকানা ছিল না।
চিঠিগুলোর একটি এইরকম ছিল—
“অরু, জানি না তুমি বেঁচে আছ কিনা। যদি থাকো, এই আকাশের নিচে কোথাও, তাহলে শুনো—তোমার চোখের ছবি আমি আজও আঁকি মনের ভিতর। দেশ ভাগ হয়েছে, হয়তো মনও ভাগ হবে। কিন্তু প্রেম কি বিভক্ত হয়? তুমি যদি না ফিরো, আমি লিখে যাবো… যতদিন কলম চলে।”
অপরদিকে অরুন্ধতী সেই বিশৃঙ্খলার মধ্যেও একটি পাণ্ডুলিপি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল কলকাতায়—যেখানে প্রথম লেখা কবিতা সে রফিকের সঙ্গে শেয়ার করেছিল। সে তখন কলকাতার বালিগঞ্জে বসবাস শুরু করল মামার বাড়িতে। শহরটা যেন সম্পূর্ণ অচেনা, জনসমুদ্রের মাঝে সে একা। কেবল এক সন্ধ্যায় সে ছাদে উঠে দেখল আকাশের গায়ে চাঁদ উঠেছে, যেমনটা উঠত হুসেনওয়ালার বটগাছের ওপরে। সে চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে বলেছিল—”তুমি শুনতে পাচ্ছ রফিক? তুমি কি বেঁচে আছ?”
একদিন তার মামা খবরের কাগজে পড়ে—“দাঙ্গা কবলিত এলাকা থেকে মুসলিম কবি পালিয়ে গিয়ে লিখছে বিভাজনের দিনলিপি”—আর তাতে লেখকের নাম—রফিক আনসারী।
অরুন্ধতীর হাত কেঁপে ওঠে। সে নিশ্চিত—এই নাম, এই ভঙ্গি, এ তো তারই রফিক!
কিন্তু সেই সময় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কোনো সরাসরি যোগাযোগ ছিল না। পোস্টাল সার্ভিস বন্ধ, ফোন দূরের কথা।
রফিক তখন লাহোরের এক লাইব্রেরিতে চাকরি পেয়েছে, সন্ধ্যাবেলায় বসে চিঠি লিখে, নিজের ডায়েরিতে। চিঠিগুলো কখনো পাঠানো হয়নি।
অন্যদিকে অরুন্ধতী রাতের অন্ধকারে মোমবাতি জ্বালিয়ে লিখতে শুরু করে তার নিজস্ব স্মৃতিকথা। যেন নিজের মধ্যে জীবিত রাখছে রফিককে।
এই অধ্যায় জুড়ে সময় গড়ায়।
১৯৪৮, ১৯৫0, ১৯৬৫—যুদ্ধ হয়, দু’দেশ আরও দূরে সরে।
রফিক বিয়ে করেনি। অরুন্ধতীও না।
কিন্তু কেউ জানে না এই দুই আত্মা এখনো একই সুরে বাঁধা।
১৯৭১—আরেক যুদ্ধ। এরপর কিছু কিছু চিঠি চালাচালির পথ খোলে, কিন্তু এত বছর পর কে কাকে লিখবে?
তবুও… একটি কবিতা একদিন রফিক ছাপায় একটি পাকিস্তানি সাহিত্যপত্রে—
“যদি ফিরেও না আসো, তোমার অপেক্ষায় রইবে ছায়ার মতো আমি… সীমান্তের কিনারায় দাঁড়িয়ে।”
এই কবিতা পৌঁছাবে কোথাও, কোনোদিন, কারো কাছে…
কিন্তু এখনো সেই দেখা হয়নি।
তারা একে অপরকে বাঁচিয়ে রাখে কেবল হৃদয়ের খামে, যে খাম কোনো ডাকবাক্সে ফেলা হয়নি, কোনো পোস্টম্যান ছুঁয়েও দেখেনি।
৩
সময় থেমে থাকে না। ইতিহাসের বুকে যত যুদ্ধ, রক্ত, বিভাজন আর প্রতিশোধের রেখা আঁকা হয়, তার মাঝেও কিছু সম্পর্ক থেকে যায় নিঃশব্দ, কিছু চিঠি লেখা হয় যাদের প্রাপক কোনোদিন পড়ে না। ঠিক তেমনি, রফিক আনসারী আর অরুন্ধতী রায়—দু’টি নাম, যাদের জীবন ছুঁয়েছিল একে অপরকে, কিন্তু সময় তাদের আড়ালে রেখেছিল দীর্ঘ নীরবতায়।
১৯৮০ সালের এক শরতের সকাল। কলকাতার বালিগঞ্জে একটি ছোট্ট রাস্তায় অরুন্ধতীর ছোট্ট বাড়ির বারান্দায় বসে সে প্রতিদিনের মতো এক কাপ চায়ে চুমুক দিচ্ছিল। বয়স তখন ষাট পেরিয়েছে, চুলে পাক ধরেছে, চোখে চশমা, কিন্তু মন এখনো কিশোরী। সকালে সে Statesman পত্রিকা খুলে পড়ে, পাতার কোণায় নজর পড়ে একটি ছোট্ট আন্তর্জাতিক সাহিত্য খবরে—
“Urdu poet Rafiq Ansari nominated for South Asian Peace Prize for Literature.”
তার বুকের ভেতরটা ধপ করে ওঠে। সে হাত কাঁপা হাতে খবরটি পড়ে—“তিনি দীর্ঘদিন ধরে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিরুদ্ধে লেখালেখি করে চলেছেন। তার সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থ Seema ke Us Paar (সীমার ওপারে) ভারত-পাকিস্তান পুনর্মিলনের আশা জাগিয়েছে।”
আর নিচে লেখক পরিচিতি—“বর্তমানে লাহোরে বসবাস করেন। বৈবাহিক জীবন নেননি।”
অরুন্ধতী আর স্থির থাকতে পারে না। সে উঠে দাঁড়ায়, টেবিলে চা পড়ে যায়। এতদিন পর এই নাম, এই পরিচয়! সে জানে—এ রফিক ছাড়া আর কেউ হতে পারে না।
সে নিজের পুরনো ট্রাঙ্ক খুলে, বের করে তার সেই চিরকুট খাতা—যেখানে সে লিখেছে রফিকের জন্য কবিতা, স্মৃতি, অগোছালো লাইন—সব। পাতাগুলো ছেঁড়া, হলুদ হয়ে গেছে, কিন্তু অনুভূতির কোনো ভাঁটা পড়েনি।
অরুন্ধতী ঠিক করে, এবার সে লিখবেই।
সীমান্তে চিঠি পাঠানোর নিয়ম জেনে সে লিখতে শুরু করে—
“রফিক, জানি না তুমি পড়বে কিনা, জানি না তোমার ঠিকানায় পৌঁছাবে কিনা। কিন্তু আমি আর চুপ থাকতে পারছি না। এই নীরবতা আমাকে গিলে খাচ্ছে। আমি এখনো বেঁচে আছি। এখনো, সেই সন্ধ্যাটা মনে পড়ে, সেই গানের কলি—‘যদি যাই আমি চলে’। তুমি শুনেছিলে কি সেইদিন শেষবারের মতো?”
চিঠি ছোট, কিন্তু প্রতিটি শব্দ কাঁপছিল। সে খামে ভরে ঠিকানার জায়গায় শুধু লেখে—
Rafiq Ansari, Urdu Writer, Lahore Literary Society, Pakistan
চিঠি পোস্ট হয়।
কয়েক সপ্তাহ কেটে যায়। উত্তর আসে না।
অরুন্ধতী ভাবতে থাকে, হয়তো ঠিকানায় পৌঁছেনি।
হয়তো সে ভুল করছে।
হয়তো রফিক তাকে ভুলে গেছে…
কিন্তু সেই একই সময়, লাহোরে এক বিকেলে, রফিক তার রিভারসাইড আবাসনের বারান্দায় বসে হেমন্তের আলো গায়ে মেখে বই পড়ছিল। তখনই পিওন এসে দেয় একটি চিঠি—ভারত থেকে এসেছে বলে একটু বেশি খরচ লাগিয়েছে।
খাম খুলতেই প্রথমে সে স্তব্ধ।
হাতের লেখা—চেনা।
গন্ধ—পুরনো কালির।
ভিতরে একটি পাতলা কাগজে লিখিত চিঠি।
পড়ার সময় রফিকের গলা আটকে যায়, চোখ জলে ভরে ওঠে।
তারপর সে ধীরে ধীরে চিঠিটি বুকের কাছে ধরে।
“তুমি বেঁচে আছ, অরু… তুমি সত্যিই আছ!”
পরের দিনই রফিক উত্তর লেখে—
“তোমার চিঠির জন্য আমি চল্লিশ বছর অপেক্ষা করেছি। একদিনও পেরোয়নি যখন আমি তোমার কথা ভাবিনি। আমি বিশ্বাস করিনি, তুমি আমাকে চেনাবে, মনে রাখবে। কিন্তু তুমি তো রেখেছ। এখন আর নীরবতার প্রয়োজন নেই, অরু। এখন আমরা লিখব। যতদিন কলম চলে। যতদিন মন কাঁদে। যতদিন ছায়া পড়ে দেয়ালে।”
চিঠি এবার ঠিকমতো পৌঁছায় কলকাতায়।
অরুন্ধতী সেই উত্তর পেয়ে ভেঙে পড়ে কান্নায়।
সেই নীরবতা, সেই জমে থাকা কুয়াশার মতো একাকিত্ব, হঠাৎ করেই ফেটে পড়ে বৃষ্টির মতো।
এইবার শুরু হয় দু’দেশের দুই প্রান্তে দু’টি বৃদ্ধ হৃদয়ের নতুন প্রেমের পুনর্জন্ম।
চিঠি আসে যায়—গান, কবিতা, পুরনো দিনের কথা, স্মৃতির ফাঁদে পা দিয়ে হাঁটা।
তারা লিখতে থাকে—
“আমরা হয়তো একসাথে হাটার সময় পাইনি, কিন্তু আমাদের শব্দগুলো একসাথে হাঁটতে পারে।”
“যদি জীবন আবার শুরু হতো, আমি শুধু সেই বটগাছটার নিচে অপেক্ষা করতাম।”
তাদের দেখা হয়নি—এখনো নয়।
কিন্তু এবার তারা জানে, তারা বেঁচে আছে, তারা চায় দেখা করতে, শেষ দেখা।
একবার, কেবল একবার—যত দেরি হোক না কেন।
৪
১৯৮২ সালের শীতকাল। কলকাতার চেয়ে লাহোরে ঠান্ডা কিছুটা বেশি, কিন্তু দু’জায়গার বাতাসে এখন এক রকম উত্তেজনার কাঁপুনি। দু’টি শহরের দুই কোণে, দুটি বৃদ্ধ হৃদয় চিঠি লেখে, প্রতিদিন। মুদ্রিত শব্দের চেয়ে হাতে লেখা কথাগুলো অনেক বেশি গাঢ়। চিঠির পাতাগুলোয় সময় জমে থাকে, কাগজের কোণে লেগে থাকে চোখের জল আর সযত্নে চাপা রাখা দীর্ঘশ্বাস।
রফিক প্রতিদিন সন্ধ্যার পর নিজের ঘরে আলো কমিয়ে অরুন্ধতীর চিঠি পড়ে। প্রতিটি শব্দের মাঝে সে খুঁজে নেয় সেই কিশোরী মেয়েটিকে, যে একদিন বলেছিল—“আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব, যতদিন না আকাশে বাঁশির সুর ওঠে।” সে জানে, এই বয়সে দেখা হওয়া অসম্ভব নয়, কিন্তু সহজ নয়। তাদের দেখা করতে হলে দরকার ভিসা, রাজনৈতিক অনুমতি, সীমান্ত পার হওয়ার সাহস—সব মিলিয়ে যেন আরেকটি যুদ্ধ।
কলকাতায় অরুন্ধতীও এখন আর আগের মতো নির্জন নন। প্রতিবেশীরা অবাক হয়, কেন তিনি এত চিঠি লেখেন? কেন তিনি এত হাসেন এখন? তার নাতনি রিয়া একদিন জিজ্ঞাসা করল—“ঠাম্মি, তুমি কার সঙ্গে কথা বলো?”
অরুন্ধতী মৃদু হেসে বলে, “যার সঙ্গে কথা বন্ধ হয়নি কোনোদিন। শুধু দেখা হয়নি।”
তবে এখনো তাদের দেখা হয়নি। সীমান্তের নিয়ম, পাসপোর্ট অফিসের ভিড়, ভারত-পাকিস্তান রাজনৈতিক অস্থিরতা—সব যেন এক এক করে দাঁড়িয়ে থাকে ভালোবাসার পথে। কিন্তু এতো বাধা তারা আর নিতে চায় না। রফিক একদিন সাহস করে Lahore Literary Society-এর প্রেসিডেন্টের সাহায্য চায়।
সে বলে, “আমি একজন সাহিত্যিক, এবং আমি চাই, পিস লিটারেচার প্রোগ্রামে অংশ নিতে কলকাতায় যেতে।”
সাহিত্যিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভিসার প্রস্তাব পাঠানো হয়—ভারত সরকারের অনুমতির জন্য।
অন্যদিকে, কলকাতায়ও অরুন্ধতী স্থানীয় সাহিত্য সভার সঙ্গে যোগাযোগ করে।
সে বলে, “আমার একজন বন্ধু আছে পাকিস্তানে, যাকে আমি গত ৪০ বছর ধরে লিখছি। আমি চাই, একবার অন্তত তাকে আমন্ত্রণ জানাতে।”
একসময় এই উদ্যোগ সংবাদে আসে—
“সীমান্ত পার হতে চলেছে দু’টি হৃদয়, কবিতা আর ভালোবাসার হাতে হাত রেখে”
এই খবর পৌঁছায় সমাজের নানা স্তরে—অনেকে সমর্থন করে, কেউ কেউ প্রশ্ন তোলে—“এতদিন পর কেন? কেন একজন হিন্দু নারী ও একজন মুসলিম বৃদ্ধ এত জেদ করে দেখা করতে চান?”
কিন্তু তাদের কোনো জবাব নেই, প্রয়োজনও নেই। তাদের ভালোবাসা ব্যাখ্যা চায় না, অনুমোদনও না।
১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারি। অবশেষে অনুমতি আসে—রফিক ভারত আসতে পারবেন “Literary Peace Conference”-এ অংশ নিতে, কলকাতায়।
অরুন্ধতী সেই দিন সকাল থেকে বাড়ির জানালা দিয়ে আকাশ দেখে। তার মনে হয়, আকাশটা যেন আজ শান্ত, বৃষ্টির কোনো আশঙ্কা নেই। সে তার সাদা খোঁপা খোলে, নীল পাড়ের শাড়ি পরে, কপালে টিপ আঁকে। সে জানে, আজকের দিন কোনো কবিতার পাতায় লেখা নয়—আজকের দিন বাস্তব।
দুপুরে কলকাতা বিমানবন্দরে রফিক নামে। চশমা, ধবধবে দাড়ি, ধীরে চলা। কিন্তু তার চোখের কোণে ঝিলিক। সাহিত্য সভার প্রতিনিধি তাকে স্বাগত জানায়, সাংবাদিক ছবি তোলে। কিন্তু সে কারো খোঁজে নেই। সে খোঁজে আছে সেই চোখের, যে চোখে আছে চার দশকের অপেক্ষা।
সন্ধ্যায় সাহিত্য সম্মেলনে অরুন্ধতী আসে ধীরে ধীরে, সবার চোখ এড়িয়ে। মঞ্চের কোণায় একটি চেয়ারে বসে সে।
রফিক তখন বক্তৃতা দিচ্ছে—
“আমরা ভাষা ভাগ করেছি, ধর্ম ভাগ করেছি, ভূখণ্ড ভাগ করেছি—কিন্তু প্রেম ভাগ হয় না। আমি আজ এসেছি, শুধু একবার দেখতে, যার জন্য আমি চল্লিশ বছর কলম চালিয়েছি। তার নাম বলব না, কারণ সে আমার কবিতার শেষ লাইন। যদি সে আজ এখানে থাকে, তাহলে জেনে নিক—আমার দেখা পূর্ণ হয়েছে।”
সবার দৃষ্টি ঘোরে। অরুন্ধতী উঠে দাঁড়ায়।
চোখে জল, ঠোঁটে শব্দ নেই।
দু’জনে একে অপরের দিকে এগিয়ে যায় ধীরে ধীরে।
চারপাশে ক্যামেরা ফ্ল্যাশ, হাততালি, সাংবাদিকের চিৎকার—কিন্তু তারা কিছুই শোনে না।
শুধু চোখে চোখ রেখে বলে—
“তুমি এখনো ঠিক আগের মতোই আছ।”
“আর তুমি আমার শেষ দেখার প্রথম আলো।”
সেই সন্ধ্যায় তারা কোনও কবিতা লেখেনি, কোনও চিঠি লেখেনি।
শুধু বসেছিল পাশাপাশি, বহু বছরের কথা না বলে কাটিয়ে দিয়েছিল একটি নিঃশব্দ সন্ধ্যা।
৫
ফেব্রুয়ারির সেই সন্ধ্যা যেন স্বপ্ন হয়ে নেমে এসেছিল। কলকাতার দক্ষিণে ছোট এক সাহিত্য সম্মেলনের মঞ্চে, বহু বছর পর মুখোমুখি হয়েছিল দু’টি জীবন, যাদের ভালোবাসা কখনো সময়ের কাছে মাথা নত করেনি।
রফিক আর অরুন্ধতী—একজন লাহোর থেকে, আরেকজন কলকাতা থেকে—দু’জন দু’ধরনের জীবন পেরিয়ে এসে বসেছিল একটি কফির টেবিলে। বাইরের মানুষদের কাছে তারা ছিল দু’জন প্রবীণ সাহিত্যিক, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারা ছিল দুই যুবক-যুবতী, যাদের কেবল একবার বলা বাকি ছিল—“তোমাকে আমি ভালোবাসি, কোনো সময়ের শর্তে নয়।”
সেই রাতে তারা বেশি কথা বলেনি।
হোটেলের করিডোরে রফিক বলেছিল,
“আমি বুঝতে পারিনি, এত বছর পরে এসে তোমার চোখে আবার সেই ছায়া খুঁজে পাব।”
অরুন্ধতী বলেছিল, “আর আমি আজ বুঝলাম, প্রতীক্ষার কোনো শেষ নেই, কিন্তু ভালোবাসার শুরু নতুন করে হতে পারে।”
তারা ঠিক করল—আর একবার দেখা হবে, পরদিন, শান্তিনিকেতনে। কবিগুরুর আশ্রম, সেই জায়গা যেখান থেকে ভালোবাসার ভাষা শিখেছিল তারা।
পরদিন তারা ট্রেনে রওনা দেয়—রফিক, অরুন্ধতী, সাথে দুজন স্বেচ্ছাসেবক ও সাহিত্য সংস্থার প্রতিনিধি। ট্রেনের জানালা দিয়ে আলো এসে পড়ছিল তাদের মুখে—একইভাবে যেমনটা পড়ত পঁচিশের দশকে, যখন তারা রেলগাড়ির ধোঁয়া ভেদ করে চোখে চোখ রাখত।
শান্তিনিকেতনে গিয়েই অরুন্ধতী বলল,
“এই গাছটার নিচে বসেছিলাম একবার—তুমি একটা কবিতা বলেছিলে, মনে আছে?”
রফিক মুচকি হেসে উত্তর দেয়,
“‘তোমার ছায়া যেন কেবল আমাকে ছুঁয়ে যায়, আমি না থাকলেও।’”
অরুন্ধতী বলে, “আজ সেই ছায়া আমাদের দু’জনকেই ঢেকে রাখুক।”
তারা সারাদিন নির্জনে সময় কাটায়—কোনো জনতার ভিড় নয়, কোনো সংবাদমাধ্যম নয়। কেবল গাছ, আলো, পাখির ডাক আর নিঃশব্দ কিছু কথা।
তবে জীবনের গল্পে সুখের মুহূর্তগুলো যেন খুব বেশি স্থায়ী হয় না। পরদিনই রফিকের শরীরটা খারাপ হয়। হোটেলে ফিরেই সে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। কলকাতার এক নামী নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়।
ডাক্তার বলেন—বয়সজনিত ক্লান্তি, হৃদপিণ্ডে অনিয়মিত স্পন্দন। বেশ কিছুদিন বিশ্রাম দরকার।
অরুন্ধতী তার পাশে বসে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। একসময় রফিক বলে,
“তুমি জানো, আমি জানি—আমাদের সময় খুব বেশি নেই। কিন্তু আমার অনুরোধ, আমাকে আবার চিঠি লিখো, শেষবারের মতো। এমন একটি চিঠি, যা আমি চোখ বন্ধ করে পড়ে নিতে পারি।”
অরুন্ধতী ধীরে মাথা নেড়ে চলে যায়। রাতে সে বাড়িতে ফিরে ট্রাঙ্ক থেকে সেই পুরনো খাতা বার করে, এবং লেখা শুরু করে—
“রফিক,
এই চিঠিখানি কোনো প্রশ্ন রাখে না, কোনো উত্তর খোঁজে না। শুধু জানাতে চাই, আমি বেঁচে ছিলাম, কারণ তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। আমার জীবনে তুমি একমাত্র সত্য, যাকে হারিয়েও পেয়েছি। আমার সব কবিতা, গান, নিঃশব্দ বিকেল—সব ছিল তোমাকে নিয়ে। আজ যদি তুমি চলে যাও, আমি জানব—শেষ দেখা হয়েছিল, সত্যিকারের দেখা। এই চিঠি তোমার চোখে শেষ আলো হয়ে থাকুক।
তোমার,
অরুন্ধতী”
সে খামে ভরে, পরদিন সকালে হসপিটালে গিয়ে রফিকের হাতে তুলে দেয়।
রফিক চিঠি হাতে নিয়ে বলে,
“তুমি জানো, এই চিঠি পড়ার জন্য আমি বেঁচে ছিলাম।”
তারপর ধীরে ধীরে সে চিঠিটি খুলে পড়ে—শেষ পর্যন্ত।
চোখে জল আসে না, কারণ তার চোখ পূর্ণ হয়ে যায় চিরন্তন আলোর চাপে।
রাতের দিকে সে ঘুমিয়ে পড়ে, সেই ঘুম থেকে আর ওঠে না। ডাক্তাররা বলে—“শান্ত নিঃশ্বাস, কোনো যন্ত্রণার চিহ্ন নেই।”
অরুন্ধতী জানালা দিয়ে আকাশ দেখে—নির্জন, শান্ত, নির্মল।
তারপর সে ট্রাঙ্কে পুরে ফেলে চিঠির গুচ্ছ, কেবল সেই শেষ চিঠিখানিই রাখে বুকের কাছে।
৬
রফিকের মৃত্যুর পর সময় থেমে গিয়েছিল যেন। না, ঘড়ির কাঁটা চলছিল ঠিকই, ট্রাম চলছে, খবরের কাগজে প্রতিদিন নতুন কিছু ছাপা হচ্ছে, রোদের তাপে মলিন হচ্ছে জানালার পর্দা। কিন্তু অরুন্ধতীর জীবনের ঘড়ি আটকে গেছে রফিকের চিঠির শেষ শব্দে। কলকাতার দক্ষিণের বাড়িটায় যেন হঠাৎ নেমে এসেছে নিঃশব্দ এক ঋতু—না বসন্ত, না শীত—কেবল এক নিরবতার আবরণ।
সেই দিন থেকে, যেদিন রফিক চিরঘুমে চলে গেল, অরুন্ধতী আবার শুরু করল লেখা। তবে এবার আর কারো উদ্দেশে নয়। সে লিখত নিজের কাছে, যেন একটি ব্যক্তিগত দিনলিপি, যেখানে প্রতিটি পাতায় জমে উঠছিল রফিকের স্মৃতি, তার অনুপস্থিতি, আর একরাশ ব্যথা—যা না বলা কথার চেয়ে অনেক বেশি গভীর।
দিনলিপির প্রথম পাতায় সে লিখল—
“৩ মার্চ ১৯৮৩ – আজ তুমি নেই, অথচ তুমি আছো প্রতিটি শব্দে।”
সে লিখতে শুরু করে প্রতিদিন। সকালবেলা এক কাপ চা নিয়ে জানালার পাশে বসে ছায়ার দিকে তাকিয়ে।
সে লেখে—
“আজ জানালার বাইরে একটা হলুদ পাখি বসেছিল। ঠিক যেন তোমার পাঠানো চিঠির খামে থাকা সেই হলুদ স্ট্যাম্প। পাখিটার চোখে তোমার চিঠির মতোই একটা অভিমান ছিল।”
বা,
“আজ ট্রামে উঠলাম। জানালার ধারে একটা ছেলে তার প্রেমিকাকে চিঠি দিচ্ছিল। আমার বুক হঠাৎ হাহাকার করল—তুমি কি কখনো ট্রামে চড়ে আমার ঠিকানার দিকে চিঠি পাঠাতে গিয়েছিলে?”
প্রতিটি দিন অরুন্ধতী নিজেকে চিঠি লিখত, এবং সেই চিঠিগুলো ছিপি বন্ধ কাঁচের জারে রেখে দিত—যেন কোনো একদিন, ভবিষ্যতের কেউ খুলে পড়বে, জানবে তাদের গল্প।
তার দিন কেটে যেত বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে, কফির কাপে উষ্ণতা ধরে রাখার ব্যর্থ চেষ্টায়, রফিকের চিঠিগুলোর গন্ধে ঘুমোতে গিয়ে।
একদিন তার নাতনি রিয়া এল বাড়িতে, খাতাগুলো দেখে বলল,
“ঠাম্মি, এগুলো কী?”
অরুন্ধতী মৃদু হাসল,
“তোমার ঠাম্মার প্রেমপত্র, যেগুলো সে নিজেকেই লিখেছে, কারণ যাকে লিখতে চেয়েছিল, সে তো এখন নক্ষত্র।”
রিয়া অবাক হয়, বলে,
“তুমি কি সত্যিই ভালোবেসেছিলে কাউকে, এতটা গভীরভাবে?”
অরুন্ধতী তখন জানালার বাইরে তাকিয়ে বলে,
“ভালোবাসা কোনো কাগজে মাপে না, রে। এটা সময়কে ছাড়িয়ে যায়। তুমি কি জানো, আমি এখনো অপেক্ষা করি—যদি কোনোদিন সেই ট্রেনটা ফেরে, যদি কোনো জানালার পাশে আবার সেই চোখের ছায়া দেখা যায়?”
সে তার নাতনিকে সেই পুরনো খাম দেখায়—যেখানে অর্ধেক ঝাপসা ঠিকানায় লেখা—“Rafiq Ansari, Lahore Literary Society”।
রিয়া বলে,
“আমি এগুলো একদিন বই করব। যাতে কেউ ভুলে না যায়, ভালোবাসা কেমন করে বেঁচে থাকে হারানোর পরও।”
অরুন্ধতী হাসে—তবে সেই হাসিতে ধরা পড়ে এক চিলতে বেদনার রেখা, এমন এক রেখা, যা কখনো মোছে না।
দিন যায়, মাস গড়ায়, বছর পেরোয়।
একদিন সকালে অরুন্ধতী আর উঠে আসে না বিছানা থেকে। বুকের নিচে রাখা ছিল সেই শেষ চিঠি, চোখের কোণে শুষ্ক কিন্তু শান্ত এক রেখা।
তার টেবিলের ডায়েরির শেষ পাতায় লেখা ছিল—
“রফিক, আমি আসছি। এবার তোমার পাশে বসব, সীমান্তহীন কোনো আকাশের নিচে, যেখানে চিঠি লিখতে হয় না, অপেক্ষা করতে হয় না।”
৭
অরুন্ধতীর মৃত্যুর পর রিয়া প্রথম কয়েকদিন বাড়িতে একা আসেনি। জানালার পাশে রাখা সেই বেতের চেয়ারে ঠাম্মির অনুপস্থিতি যেন পুরো ঘরটাকেই শূন্য করে দিয়েছিল। যেখানে একসময় বই, চিঠি আর নরম চায়ের কাপে দিনের শুরু হতো, এখন সেখানে শুধু নীরবতা, আর একটা ফাঁকা কাগজের মতো বিষণ্ণ বেলা।
কিছুদিন পর, রিয়া সাহস করে আবার ফিরে আসে। সে জানে, তার ঠাম্মি যে গল্প রেখে গেছে, তা শুধুই তাদের পরিবারের নয়—তা সময়ের, ইতিহাসের, আর সেই ভালোবাসার যা দেশ, ধর্ম বা মৃত্যু মানে না।
সে সেই কাঠের ট্রাঙ্কটা টেনে বার করে। খোলা মাত্র ছড়িয়ে পড়ে পুরনো কালি, স্যাঁতসেঁতে পৃষ্ঠা, আর একরাশ গন্ধ—যেটা হয়তো অরুন্ধতীর শেষ নিঃশ্বাসে মিশে গিয়েছিল। খামের পর খাম, পত্রের পর পত্র—কিছু রফিকের লেখা, কিছু অরুন্ধতীর নিজের কাছে লেখা। তারিখের ছাপ, জলছাপ কালি, অর্ধেক ভাঙা বাক্য—সব যেন কাঁপা কাঁপা হাতে লেখা এক ইতিহাস।
রিয়া দিন-রাত পড়ে যায় সেই কাগজে, কোনোটা পড়তে পড়তে কাঁদে, কোনোটা পড়তে পড়তে হাসে।
একটি চিঠির শেষ লাইনে লেখা ছিল—
“তোমার চিঠির খামে যতটা জায়গা আছে, তার চেয়েও বেশি আমার বুকের মধ্যে জমে আছে তোমাকে বলা না-বলা কথাগুলো।”
রিয়া ঠিক করে—এগুলো নষ্ট হবে না। এগুলো একটা গল্প হবে, একটি বই হবে—যাতে পরের প্রজন্ম জানে, ভালোবাসা একসময় ভাঙা দেশকেও জোড়া দিতে পারে।
সে নাম ঠিক করে—”শেষ দেখা: সীমান্তের দু’পাশে ভালোবাসার কথা”
বইয়ের কাভার হয় সাদা—কারণ ওটাই ছিল রফিকের প্রিয় খামের রঙ। অক্ষর হয় নীল, অরুন্ধতীর কলমের কালি যেটা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়েছিল।
রিয়া শহরের এক ছোট প্রকাশনীতে যায় প্রথমে।
প্রকাশক প্রথমে সন্দেহে ভরে দেখে—”আচ্ছা, আপনার ঠাম্মি এই চিঠিগুলো কবে লিখেছেন?”
রিয়া উত্তর দেয়—“যখন দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক শুধু কাঁটাতার আর গুলি নয়, চিঠির ভালোবাসাও ছিল।”
প্রকাশক একদিন পড়ে জানান—”এই বই শুধু প্রেম নয়, এ এক জীবনচর্চা। আমরা প্রকাশ করতেই চাই, সসম্মানে।”
বই প্রকাশিত হয়। শহরের বইমেলায় স্টলে ঝুলে থাকে সেই কভার—সাদা খাম, নীল অক্ষরে লেখা—শেষ দেখা।
অনেক মানুষ ভিড় করে পড়ে। কেউ বলেন—“আমার ঠাকুর্দাও দেশভাগে ছিন্ন হয়েছিল প্রেম থেকে।”
কারো চোখে জল, কারো ঠোঁটে নীরবতা।
আর রিয়া দাঁড়িয়ে থাকে, ঠাম্মির ছায়াকে মনে রেখে।
বইয়ের একটি অনুচ্ছেদ—
“আমি তোমাকে চাইনি কোনো রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে, চাইনি হিন্দু বা মুসলমান হিসাবে। আমি চাইতাম তোমাকে, শুধুই তোমাকে—যেভাবে আকাশ চায় খোলা হাওয়া, অথবা মেঘ চায় বিদ্যুৎ।”
এই অনুচ্ছেদটি পরে আন্তর্জাতিক সাহিত্যমঞ্চে আলোচিত হয়। বহু দেশ থেকে আমন্ত্রণ আসে রিয়ার কাছে—“এই চিঠির ভালোবাসা কি তুমি দেখাতে পারো আরও একবার?”
রিয়া বলে—“আমি শুধু উত্তরসূরি। ভালোবাসা লিখেছিলেন তারা, আমি কেবল সেই গল্পের বাহক।”
বইটির একটি বিশেষ সংস্করণ ছাপা হয়—দুটি দেশের পতাকার ছবি পাশে রেখে, যার নিচে একটি মাত্র বাক্য—
“Separation was geographical, not emotional.”
তবে রিয়ার কাছে এই সব সাফল্য গুরুত্বহীন। সে জানে, অরুন্ধতী যেখানে আছেন, হয়তো আকাশের কোনো নিরালায়, এখন রফিকের পাশে বসে পড়ছেন সেই বইটি।
সাদা খামে মোড়ানো বইটি একদিন সে রেখে দেয় শান্তিনিকেতনের সেই গাছের নিচে—যেখানে একদিন অরুন্ধতী বলেছিলেন,
“এই ছায়া থাকুক আমাদের জন্য।”
৮
বইটি প্রকাশের ঠিক এক বছর পর, রিয়া একটা নতুন ভাবনা নিয়ে চিঠি লেখে দিল্লির এক সাংস্কৃতিক সংস্থাকে—“আমরা কি একটা আন্তর্জাতিক ‘পত্রমেলা’ আয়োজন করতে পারি? যেখানে দুই দেশের মানুষ পুরনো প্রেমপত্র, অপেক্ষার চিঠি কিংবা স্মৃতিময় লেখা ভাগ করে নেবে?”
প্রথমে সংশয় জাগে—এ যুগে কে আর চিঠি লেখে? ইমেল, ইনবক্স, হোয়াটসঅ্যাপেই সব অনুভব এখন। কিন্তু ঠিক তখনই একটা অসাধারণ ঘটনা ঘটে। পাকিস্তানের লাহোর ইউনিভার্সিটির এক তরুণ লেখক, আশরাফ খান, ‘শেষ দেখা’ পড়ে ইনস্টাগ্রামে লেখে—
“This book made me write my first handwritten letter. Not to a lover, but to my grandfather—who still waits for someone across the border.”
এই পোস্ট ভাইরাল হয়। দুই দেশের সাহিত্যপ্রেমীরা সাড়া দেয়।
বাংলা, উর্দু, হিন্দি, ইংরেজি—চিঠির ভাষা বদলায়, কিন্তু অনুভব একটাই—অভিমানের ওপারে ভালোবাসা।
সেই বছর কলকাতায় আয়োজিত হয় প্রথম ‘পত্রমেলা’। মেলা নয়—এ যেন স্মৃতির এক প্রদর্শনী।
প্রবেশপথে ঝুলছে অসংখ্য সাদা খাম, প্রতিটিতে হাতের লেখা। কেউ লিখেছে মাকে, কেউ প্রাক্তনকে, কেউ সেই মানুষটিকে যাকে হারিয়ে ফেলেও ভুলতে পারেনি।
রিয়া সেই মেলার উদ্বোধন করে বলে—
“আমার ঠাম্মি বলতেন, চিঠি হলো মন খুলে বলা একটা নীরব ভাষা। আমরা আজ সেই ভাষাকে আবার জীবিত করব।”
মেলায় আসে পাকিস্তান থেকে এক যুবতী, লায়লা আনসারি। তার ঠাকুরদা রফিক আনসারির ভাই। লায়লা বলে—
“আমার পরিবারে রফিক ছিলেন এক নিঃশব্দ কিংবদন্তি। আজ এই মেলায় এসে যেন তার ভালোবাসার প্রতিধ্বনি শুনলাম।”
লায়লা নিজের লেখা একটি চিঠি পড়ে শোনায়, যা সে লিখেছে ‘অরুন্ধতী’কে—
“আপনি যাকে চিঠি লিখেছিলেন, তার রক্তে আমার শিরা। আমি আপনার ভালোবাসার উত্তর দিতে আসিনি, আমি শুধু আপনাকে জানাতে এসেছি—আপনার লেখা এখনো কাউকে কাঁদায়, আবার হাসায়।”
চিঠিগুলো শুধু স্টলে থেমে থাকে না। শিশুদের জন্য রাখা হয় ‘খোলা খাম’—যেখানে তারা প্রথমবার নিজের হাতে লিখে ফেলে—“মা, তুমি রোজ কাজ থেকে ফিরলে আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরতে চাই।”
বৃদ্ধেরা নিজেদের পুরনো প্রেমপত্র এনে পড়ে শোনান।
এক প্রবীণ সিকন্দর সিং বলে—
“আমি আমার স্ত্রীকে যখন প্রথম প্রেমপত্র লিখেছিলাম, সেটি এই কাগজেই ছিল। আজ তাকে নেই। কিন্তু তার লেখা উত্তর আমি এখনো বুকপকেটে রাখি।”
এই মেলায় আসেন সাংবাদিক, লেখক, কবি, এমনকি কূটনীতিকরা।
একজন ভারতীয় কূটনীতিক বলেন—
“রাজনীতি যদি হৃদয়ের কথা বুঝত, তাহলে এই চিঠিগুলোই শান্তির বার্তা হতো।”
পত্রমেলা শেষ হয় একটি প্রতীকী অনুষ্ঠানে। দুই দেশের পতাকা রঙের কাগজে দু’জন শিশু লিখে ফেলে—
“আমরা বড় হলে চিঠি পাঠাব, কাঁটাতার নয়।”
রিয়া চুপচাপ মেলার শেষ বিকেলে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। কেউ একজন এসে বলে,
“আপনার ঠাম্মি আজ থাকলে খুব খুশি হতেন।”
রিয়া চোখ বন্ধ করে বলে,
“তিনি আছেন। এই চিঠির ভিড়েই, প্রতিটি নীল অক্ষরে, প্রতিটি সাদা খামে তিনি আছেন।”
৯
পত্রমেলা শেষ হওয়ার ঠিক এক মাস পর, রিয়া ফের কলকাতার সেই পুরনো বাড়িতে ফিরে আসে। বৃষ্টির জলের শব্দ জানালায় টপটপ করে পড়ে, আর রান্নাঘরের কোণে রাখা পুরনো কুলারটা মাঝে মাঝে হেঁচকি তোলে। সবকিছু আগের মতোই—কেবল ঠাম্মি নেই। কিন্তু অদ্ভুতভাবে মনে হয়, তার অনুপস্থিতিই যেন এখন ঘরটাকে পূর্ণ করেছে।
রিয়া টেবিলের উপর ছড়িয়ে রাখে অরুন্ধতীর সমস্ত চিঠি। চুপচাপ বসে থাকে। তারপর সে ধীরে ধীরে পায়ে হেঁটে যায় দোতলার ফাঁকা ঘরটায়—যেটা আগে ব্যবহার হতো না। জানালার পাশে কিছু টিনের ট্রাংক, কাঠের পুরনো তাক, আর ধুলো ধুলো একটা আয়না। রিয়ার চোখে তখন ঠিক একটাই ভাবনা—এই ঘরটাই হবে সেই চিঠিগুলোর স্থায়ী আশ্রয়।
তিন মাস ধরে সে নিজ হাতে সাজায় এক নিঃশব্দ জাদুঘর। দেয়ালের উপর গ্লাস বক্সে রাখে রফিকের লেখা প্রথম চিঠি, যার কোণায় লেখা ছিল—”তোমাকে ফিরে পেতে চাই না, শুধু জানতে চাই তুমি কেমন আছো।”
একটা কাঁচের আলমারিতে রাখা হয় সেই চিঠি, যেটা অরুন্ধতী নিজের কাছে লিখেছিল, মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগে—
“আমি প্রতিদিন তোমার চিঠি পড়ি, রফিক। এমনকি যখন তুমি আর চিঠি লেখো না, তখনো তোমার খামের গন্ধেই ঘুমিয়ে পড়ি।”
ঘরের এক কোণায় বানানো হয় ‘বিকেলের জানালা’ নামে একটি জায়গা—যেখানে বসে যে কেউ নিজের হাতে লিখতে পারে চিঠি, ঠিক অরুন্ধতীর মতো। টেবিলের ওপর রাখা থাকে কালির পেন, সাদা খাম, আর ছাপা স্ট্যাম্প—যার নকশায় আঁকা অরুন্ধতী ও রফিকের দুটি মুখ, পাশাপাশি, অথচ মাঝখানে কাঁটাতার।
এই জাদুঘর শুধু দেখার নয়, ছুঁয়ে দেখার জায়গা।
এক প্রৌঢ় এসে বলেন—
“এই চিঠিগুলো আমার স্ত্রীর মুখ ফিরিয়ে এনেছে।”
এক তরুণী এসে লিখে রেখে যায়—
“আমি কাউকে ভালোবাসি। বলিনি কখনো। আজ এই চিঠিটা সেই প্রথম স্বীকারোক্তি।”
রিয়া জাদুঘরের নাম দেয়—“শেষ দেখা – একটি স্মৃতি চিঠির”
এই জাদুঘরটি সরকারি অনুমোদন পায়। টেলিভিশন নিউজ কাভার করে বলে—
“এটি একমাত্র জাদুঘর যেখানে কালি আর কাগজ হয়ে উঠেছে ভালোবাসার জীবন্ত দলিল।”
প্রতি বছর ১৫ অগাস্ট, দুই দেশের স্বাধীনতার দিনে, জাদুঘরে অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ অনুষ্ঠান—‘চিঠি দিয়ে সংযোগ’। একসাথে দুই দেশের ৫০টি স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা চিঠি বিনিময় করে—কোনো চিঠিতে থাকে প্রশ্ন, “তোমাদের রুটি কেমন হয়?”, আবার কোথাও লেখা থাকে—“তোমাদের বাড়িতেও কি ঠাম্মি গল্প বলেন?”
এইসব চিঠি সময়ের প্রমাণ রাখে—দু’পাশে জন্ম নেওয়া শিশুরাও একদিন জানতে পারে, ভালোবাসা এক ‘পরিচয়’ নয়, এক অনুভব।
রিয়ার চোখে জল আসে যখন এক বৃদ্ধ পাকিস্তানি নাগরিক এসে বলে—
“আমি রফিকের ছোট ভাইয়ের ছেলে। আজ এই জাদুঘরে এসে মনে হলো, যেন আমার ভাইয়ের জীবন একটা পূর্ণবৃত্ত পেল।”
জাদুঘরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘরে থাকে ‘শেষ খাম’। সেখানে রাখা অরুন্ধতীর মৃত্যুর দিন বুকের নিচে রাখা শেষ চিঠিটা। পাশে একটা ছোট কার্ডে লেখা তার শেষ লাইন—
“আমি আসছি, রফিক। এবার আর কোনো খামে নয়, সরাসরি তোমার পাশে বসব।”
এখনও বহু মানুষ এই জাদুঘরে এসে চিঠি লেখে, নিজের চোখের জল মুছে রেখে যায় ভালোবাসার অক্ষর। রিয়া প্রতিদিন পড়ে, সংরক্ষণ করে, আর নতুন খামে পুরে রাখে—ভবিষ্যতের কোনও এক অরুন্ধতীর জন্য।
১০
জাদুঘর চালু হওয়ার পর কেটে গেছে প্রায় ছয় বছর। রিয়া এখন এক প্রতিষ্ঠিত গবেষক, “ঐতিহাসিক চিঠি ও ব্যক্তিগত স্মৃতিপত্র”-এর উপর তাঁর গবেষণা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু যত বড় হয়েছে তাঁর কাজ, ততই যেন একা হয়ে পড়েছে সে। ঠাম্মির সেই নিঃশব্দ সান্নিধ্য, সেই রাত্রির অক্ষরভরা খাম—সবই এখন অতীতের দোলাচলে বাঁধা পড়ে আছে।
একদিন সন্ধ্যাবেলা, জাদুঘরের পরিচারক গোপাল এসে এক খাম হাতে দেয় রিয়াকে।
“ম্যাডাম, এটা আমাদের দক্ষিণ গ্যালারির এক পুরনো বইয়ের পেছনে ছিল। মেইল রেজিস্টারে ছিল না। কেউ জমা দেয়নি।”
খামটি হলুদ হয়ে গেছে, কিনারে ছেঁড়া। তবুও অদ্ভুত এক পরিচিত গন্ধ—সাদা চন্দনের মতো হালকা।
রিয়া ধীরে ধীরে খাম খুলে। ভেতরে মাত্র একটি চিঠি। মাথার দিকে তারিখ—“১১ জানুয়ারি, ১৯৮১”—অর্থাৎ অরুন্ধতীর বিয়ের ঠিক আগের দিন।
চিঠির উপরে কেবল লেখা ছিল—
“অরুন্ধতীর কাছে, সীমান্তের ওপার থেকে—রফিক।”
রিয়া কাঁপা হাতে পড়ে—
“আমি জানি, তোমার জীবনে আমার আর কোনো স্থান নেই। হয়তো তুমি এখন অন্য কাউকে ভালোবাসো, হয়তো শুধু বাবা-মায়ের ইচ্ছেতেই রাজি হয়েছো। তবুও আমি আজ শেষবার চিঠি লিখছি, কারণ এই অক্ষরগুলোই আমার বেঁচে থাকা।”
“যদি কোনোদিন তুমি এই চিঠি পড়ো, জেনে নিও—তোমার মুখে আরেকবার আমার নাম শুনতেই আমি বেঁচে ছিলাম। তোমার কাছে না পৌঁছানো প্রতিটি চিঠির বদলে এই একটি লিখছি, যেন অন্তত আমার অক্ষরেরা তোমার চেয়ারের পাশে বসে থাকতে পারে।”
“আমি আসব না তোমার বিয়েতে। আমি হব না কোনো প্রতিবাদকারী। আমি হব সেই অদৃশ্য অতিথি, যে শুধু বাতাসে শুনবে—তুমি কেমন, তুমি কি হাসছো, নাকি চুপ করে আছো।”
“শেষবার বলি—তুমি ছিলে, আছো, থাকবে। সময়ের পাতায় নয়, আমার রক্তে।”
রিয়া নিঃশব্দে পড়ে যায় সেই চিঠি, বহুবার। যেন কেবল তার ঠাম্মি নয়, বরং গোটা প্রেমটাকে সে আবার একবার ছুঁয়ে ফেলেছে। এতদিন ধরে লেখা যে শত শত চিঠি সংরক্ষণ করেছে সে, তার মধ্যে এই একটি চিঠি যেন সমস্ত অনুভবকে এক বিন্দুতে এনে জড়ো করেছে।
রিয়া সিদ্ধান্ত নেয়, এই চিঠিটিই হবে শেষ দেখা জাদুঘরের শেষ প্রদর্শনী।
তাকের উপর কাঁচের বাক্সে রাখা হবে খামটি। পাশে রাখা থাকবে ঠাম্মির সেই একফালি ছবি, যেখানে সে জানালার ধারে বসে আছে, কপালে সিঁদুর, মুখে নিঃশব্দ আলোকছায়া।
কিন্তু ঠিক তার পরদিন, আরও একটি চিঠি আসে। পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশ থেকে পাঠানো, হাতে লেখা।
প্রেরক: আফশান আনসারি—রফিকের নাতনি।
চিঠিতে লেখা ছিল—
“আমার দাদার মৃত্যুর পরে আমরা একটি ট্রাংক খুলেছিলাম। ভেতরে ছিল বহু না-পাঠানো চিঠি—সব অরুন্ধতীর উদ্দেশে। তিনি কখনো এগুলো পোস্ট করেননি। কিন্তু সব চিঠির শেষে শুধু একটাই বাক্য থাকত—‘আমি এখনো অপেক্ষা করছি।’”
আফশান অনুরোধ করে—
“আপনি কি আমার দাদার সেই অপেক্ষার চিঠিগুলোকে আপনার জাদুঘরে রাখবেন?”
রিয়া চোখের জল সামলে লেখে—
“আমার ঠাম্মিও অপেক্ষা করতেন। তারা কেউ দেখা করেননি, কিন্তু আজ, তাদের চিঠিগুলো পাশাপাশি থাকবে—হয়তো কোনো এক অলৌকিক ছায়ায়, তারা বসে পড়বে আবার একসাথে।”
শেষ অধ্যায়ে জাদুঘরের নতুন গ্যালারির নাম হয়—”শেষ দেখা”।
দুই পাশের দেয়ালে ঝুলে থাকে দুই জীবন, দুই রাষ্ট্র, দুই অক্ষর। মাঝখানে বসার জায়গা—যেখানে কেউ চাইলে লিখে যেতে পারে নিজের শেষ দেখা, নিজের শেষ চিঠি।
শেষ লাইনে রিয়া নিজের হাতেই একটি বোর্ডে লিখে রাখে—
“ভালোবাসা যদি সত্য হয়, তাহলে চিঠি কখনো বিলম্বে আসে না—সে ঠিক সময়েই আসে, যখন সে প্রয়োজন।”
আর সেই বোর্ডের নিচে, এক শিশু দাঁড়িয়ে মায়ের হাত ধরে প্রশ্ন করে—
“মা, আমরাও কি বড় হলে কাউকে এমন ভালোবাসতে পারব?”
—