Bangla - সামাজিক গল্প

শেষ ট্রেনের আলো

Spread the love

ঋতব্রত সেনগুপ্ত


অধ্যায় ১:

হাওড়া স্টেশনের ৯ নম্বর প্ল্যাটফর্মটা এই মুহূর্তে যেন নিজেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, সারাদিনের ব্যস্ততা, হইচই আর মানুষের ঢেউয়ের পর এক অপার নিস্তব্ধতায় ডুবে গেছে সে। কেবল মাঝে মাঝে ভেসে আসে ট্রেন ছাড়ার ঘোষণার শব্দ, কিছুটা যান্ত্রিক, কিছুটা নিঃসঙ্গ। স্টেশনের ঘোলাটে আলো, ছায়া আর মাঝেমাঝে হুঁশিয়ারির সাইরেন যেন একরকম কাব্যিক সুর তৈরি করেছে রাতের গভীরে। এই রাত শহরের নয়, এই রাত শুধু প্ল্যাটফর্মের, শুধুই অপেক্ষার।

এই নীরবতার মধ্যে, একটি বেঞ্চের এক প্রান্তে বসে আছেন একজন বৃদ্ধ — নাম অরবিন্দ রায়। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, গায়ে পুরনো সাদা চাদর জড়ানো, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। তাঁর পাশে রাখা একটি সুতির ব্যাগ, যেন তার সঙ্গী বহু বছর ধরে। তাঁর মুখে ক্লান্তি নেই, বরং এক ধরণের স্থিরতা আছে—যেটা বহুদিনের অভিজ্ঞতা আর নিঃসঙ্গতার মধ্যে তৈরি হয়।

আজ তিনি বর্ধমান ফিরছেন শেষ রাতের লোকাল ট্রেনে। যদিও তাঁর ছেলে, রজত, বলেছিল—“বাবা, তুমি কাল সকালে এসো, আমি এসে নিয়ে যাব।” কিন্তু অরবিন্দ একরকম জেদ করেই ঠিক করে ফেলেছেন, “না, আজই ফিরব।” এই ‘আজই’ বলাটা যেন তাঁর নিজের জন্যই এক ছোটো বিজয়। তিনি প্রমাণ করতে চান, এখনো একা চলতে পারেন, এখনো কাউকে পুরোপুরি নির্ভর করে থাকতে চান না।

তিনি চোখ বন্ধ করে বসে আছেন, স্টেশনের নড়াচড়ার শব্দ যেন ফিল্মের ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর হয়ে উঠেছে। হঠাৎ এক কিশোর হকার এসে দাঁড়ায় সামনে।

— “দাদু, চিনেবাদাম নেবেন? একেবারে শেষ স্টক, ঠান্ডায় ভালো লাগবে।”

অরবিন্দ হালকা করে তাকান। ছেলেটার মুখে হাসি, কিন্তু চোখে ক্লান্তি।
— “তুই বাড়ি যাবি না?”
— “আগে সব বিক্রি করতে হবে তো, তারপরই বাড়ি। মা রাগ করবে, কিন্তু পকেট খালি থাকলে বাজার কিভাবে হবে, তাই না?”

বৃদ্ধের মুখে এক আশ্চর্য নরম হাসি ফুটে ওঠে।
— “দে, এক প্যাকেট দে।”
দাম না জিজ্ঞেস করেই পকেট থেকে দশ টাকার একটা নোট এগিয়ে দেন।

ছেলেটা খুশি হয়ে বলে, “আপনার অনেক শুভরাত্রি হোক, দাদু।”
অরবিন্দ শুধু বলেন, “তোরও, পুচকে।”

চিনেবাদামের কাগজ খুলে একটা দুটো তুলে মুখে দিলেন, তারপর আবার জানালার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। একটা গুদামে রাখা কাঠের গাড়ি টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক কুলি। স্টেশনের আলো ধীরে ধীরে কমে আসছে, বাতাস আরও ঠান্ডা হয়ে উঠেছে। কিছুক্ষণ পরে তাঁর সামনে দিয়ে হেঁটে যায় এক পুলিশকর্মী।

— “কাকু, একা যাচ্ছেন?”
— “হ্যাঁ, বর্ধমান যাব।”
— “ছেলে বা কেউ সঙ্গে নেই?”
— “না, ও ব্যস্ত। আমি বলেছি, দরকার নেই। আমি ঠিক আছি।”

পুলিশটা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। হয়তো নিজের বাবার কথা মনে পড়ে গেল। তারপর মাথা নেড়ে চলে গেল।

ঘড়িতে তখন রাত প্রায় দশটা কুড়ি। শেষ ট্রেনের হুইসেল বাজলো একবার, যেন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল — “চল এবার…” অরবিন্দ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন, ব্যাগটা কাঁধে তুলে ট্রেনের দিকে পা বাড়ালেন। এই পদক্ষেপে ছিল না কোনো তাড়াহুড়ো, ছিল না অবসাদের ছায়া — ছিল কেবল অভ্যস্ত এক গাম্ভীর্য, যেন বহুবার এরকম অনেক ট্রেন ধরেছেন তিনি, বহুবার এই স্টেশনে এসেছেন, বহুবার বিদায় জানিয়েছেন।

ট্রেনের দরজায় পৌঁছে একটু দাঁড়িয়ে রইলেন, হাওড়া স্টেশনটা যেন আরেকবার দেখতে চাইলেন শেষবারের মতো। এই জায়গাটার সঙ্গে তাঁর স্মৃতির কত মিশে আছে! এখানেই প্রথম এসে পৌঁছেছিলেন তিনি, যখন কলেজ শেষ করে চাকরির খোঁজে কলকাতায় এসেছিলেন। এখানেই, একদিন অরুণা’র সঙ্গে হাত ধরে হেঁটেছিলেন প্ল্যাটফর্ম ধরে, ভালোবাসা আর স্বপ্নের কথায় বুক ভরেছিল দু’জনের। সেই অরুণা আজ নেই—তবু মনে হয় এই স্টেশনেই কোথাও লুকিয়ে আছে সে, এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে নীরবে।

তিনি ধীরে ধীরে ট্রেনে উঠলেন, জানালার ধারে একটি খালি সিটে বসে পড়লেন। ট্রেন তখনো ছাড়েনি, শুধু হালকা শব্দে গুঁই গুঁই করছে ইঞ্জিন। জানালার কাঁচে মাথা হেলিয়ে অরবিন্দ চোখ বন্ধ করলেন।

অন্ধকার ছেঁকে ঢুকে পড়ে ট্রেনের জানালা দিয়ে। বিদ্যুতের খুঁটি, আলো-ছায়ার খেলা, মাঝে মাঝে রাস্তার মোড়ে ফেলে আসা রিকশা—সব মিলিয়ে যেন জীবনকে এক সিনেমার দৃশ্যে পরিণত করেছে। অরবিন্দ চুপচাপ দেখেন। এক ফোঁটা কান্নাও তাঁর চোখে নেই, শুধু ভেতরে একটা ভারি স্তব্ধতা। অনেক কথার ভিতরেও কিছু কথা থাকে না বলা—সেই না-বলা কথার ভার আজ তাঁর ভেতরে।

ট্রেন চলতে শুরু করল। জানালার কাঁচে তাঁর মুখের প্রতিবিম্ব ফুটে উঠল—চুলে রুপোর ছটা, কপালের ভাঁজে কালের ইতিহাস। প্ল্যাটফর্ম পেছনে সরে গেল। হাওড়া থেকে দূরে যেতে যেতে তাঁর মনেও একটা ছোট্ট শব্দ হলো, যেন নিঃশব্দে কেউ বলল, “ফিরে এসো না আর।”

তবু তাঁর মনে হয়, কেউ অপেক্ষা করছে—হয়তো ছেলে, হয়তো কেউ নয়। কিন্তু এই যাত্রার শেষ কোথায়, তা জানেন না তিনিও। শুধু জানেন, এই ট্রেনটা যেন জীবনের শেষ ট্রেন—যেখানে তিনি যাত্রী, একা, কিন্তু একান্ত নিজস্ব।

অধ্যায় ২:

ট্রেন ছুটছে ধীরে, জানালার ওপার দিয়ে রাতের শহর এক এক করে পিছিয়ে যাচ্ছে, ঠিক যেমন করে সময় আমাদের ছেড়ে যায় নীরবে। অরবিন্দ রায় কাঁচের ওপারে তাকিয়ে আছেন, কিন্তু তাঁর চোখ যেন অতীতের পাতা ওলটাচ্ছে—জীবনের সেই দিনগুলো, যখন ঘর ছিল না, কিন্তু স্বপ্ন ছিল অগুনতি। ট্রেনের ছন্দময় দুলুনিতে তাঁর শরীর যেমন হেলছে, তেমনই মনও এক অন্য সময়ে ফিরে যাচ্ছে, যেন ১৯৬৭-র সেই কলকাতার দুপুরে।

তখন তাঁর বয়স মাত্র একুশ। স্নাতক হয়ে সদ্য হাওড়া স্টেশনে পা রেখেছেন—একটি ঝাঁকড়া ট্রাঙ্ক আর বাবার দেওয়া পাঁচশো টাকা নিয়ে। বর্ধমানের মফস্বলের শান্ত পাড়া ছেড়ে বড় শহরে পা রাখার অনুভূতিটা ছিল অদ্ভুত। হাওড়া স্টেশন তাঁকে তৎক্ষণাৎ গিলে ফেলেছিল এক বিশাল সমুদ্রের মতো—যেখানে প্রত্যেক মানুষ, প্রত্যেক মুখ যেন গন্তব্যহীন, অথচ সবাই যেন কোথাও পৌঁছানোর জন্যই ছুটছে।

“পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলেছিল এক কুলি — ‘সাহেব, কই নেব? বৌবাজার? কলেজ স্ট্রিট? বাই দ্যা আওয়ার?’”
তখনি বুঝেছিলেন, এই শহরে প্রতিটি সেবা, প্রতিটি সাহায্যেরও মূল্য আছে। ঠকবেন না, এটাই ছিল তখনকার অঙ্গীকার।

কয়েকদিন কাটিয়েছিলেন কলেজস্ট্রিটের একটা লজে, চারটা ছেলের সঙ্গে একটা ঘর। চাদর বিছানোর জায়গাটুকুই নিজের দুনিয়া ছিল। সকাল থেকে সন্ধ্যা চাকরির খোঁজ, খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন কাটা, ফর্ম পূরণ, ইন্টারভিউয়ের জন্য ধুতি-শার্ট ইস্ত্রি—এই নিয়েই কাটতো জীবন।

আর এই সময়েই দেখা হয়েছিল অরুণা’র সঙ্গে।

বইয়ের দোকানে—বিশ্বাস নন্দীর স্টলে। অরবিন্দ তখন কলেজের পুরনো ক্লাস নোট খুঁজছিলেন। হঠাৎ পাশ থেকে এক মেয়ের কণ্ঠ ভেসে এল—
— “দাদা, এই ‘ইকোনমিক থিওরি’টা কি নতুন সংস্করণ?”
চোখ তুলে দেখলেন—খুব সাধারণ পোশাক, মুখে অনাবিল সরলতা, চোখে স্পষ্ট কৌতূহল। তখনো বুঝতে পারেননি, সেই চোখই একদিন তাঁর ঘরের জানালা হয়ে উঠবে।

তখনকার দিনগুলো ছিল অদ্ভুত এক যুগল যাত্রা। অরুণা ছিল প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রী, সাহসী, স্পষ্টবাদী, কিন্তু ভীষণ সংবেদনশীল। সন্ধ্যেবেলায় কলেজস্ট্রিটের চায়ের দোকানে বসে দু’কাপ চা আর একটা কাটলেট শেয়ার করে তারা দু’জনে ভবিষ্যতের স্বপ্ন আঁকতো।
— “তুমি কী হতে চাও?”
— “ভেবেছি, স্কুলশিক্ষক। ছোটোদের পড়াতে ভালো লাগে।”
— “তাহলে বাচ্চারা তোমার কণ্ঠে গল্প শুনে ঘুমিয়ে পড়বে।”
এই বলেই অরুণা হেসে ফেলত, আর অরবিন্দ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতেন।

তাঁর প্রথম চাকরি হয়েছিল পার্ক স্ট্রিটের এক ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে কেরানি হিসেবে। মাইনে কম, কিন্তু বুকের মধ্যে তখন একরাশ আত্মবিশ্বাস—অরুণা’র হাত ধরে একদিন ভালোই ঘর বাঁধবেন।

তবে সবটা এত সহজ ছিল না।
অরুণা’র পরিবার ছিল বনেদী, বাবার কড়া অনুশাসন। একদিন অরুণা বলেছিল—
— “আমি তো তোমার সঙ্গে থাকতে চাই, কিন্তু বাবা হয়তো মেনে নেবেন না।”
— “তাহলে কী করবো?”
— “চলে আসবো। কিন্তু তুমি কি আমায় সামলাতে পারবে?”
অরবিন্দ বলেছিলেন, “একটা চেয়ারে বসিয়ে রাখবো, তারপর সারাদিন তোমার গল্প শুনবো। তাতেই জীবন চলে যাবে।”

তারা পালিয়ে বিয়ে করেছিল। রেজিস্ট্রি অফিসে, দুজন বন্ধু আর একজন মিষ্টির দোকানের কর্মচারী সাক্ষী হিসেবে ছিল। সেই দিন অরুণা বলেছিল, “আজ থেকে সব কষ্ট ভাগ করে নিতে হবে, ঠিক আছে?”
অরবিন্দ বলেছিলেন, “তুমি পাশে থাকলে সব কষ্টই অল্প মনে হবে।”

তারপর তারা একত্রে থাকতেন দক্ষিণ কলকাতার ছোট্ট এক ভাড়াবাড়িতে। ছাদের চিলেকোঠায় রোদে বসিয়ে বই পড়া, বিকেলের বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দেওয়া জানালা, মাঝরাতে একসঙ্গে রান্না করা খিচুড়ি—এইসব ছিল তাদের সুখের সংজ্ঞা।

অরুণা পরে একটি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। অরবিন্দ অফিসে উঠতে থাকেন ধাপে ধাপে। এরপর রজত এল জীবনে, তাঁদের একমাত্র সন্তান। অরুণা বলতো, “ও বড় হলে ডাক্তার করবে, কিংবা পাইলট!”
অরবিন্দ বলতো, “যা খুশি হোক, শুধু যেন ভালো মানুষ হয়।”

কিন্তু ভালোবাসার গল্পেও সময় একদিন ফাটল ধরায়।

অরুণা অসুস্থ হয়। প্রথমে সামান্য ক্লান্তি, তারপর ধীরে ধীরে দেহে ছায়া পড়ে। একদিন ডাক্তার জানায়, “এই অসুখের শেষ নেই, শুধু অপেক্ষা।”
অরবিন্দ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। যাকে ছাড়া জীবন শুরু করাই সম্ভব নয়, তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে একটি অনিবার্য বিদায়ের?

শেষ কয়েক বছর অরুণা বিছানায়। রজত তখন কলেজ পড়ুয়া, পড়াশোনার চাপে অন্যমনস্ক। অরবিন্দ অফিস থেকে ফিরে ঘরের সব কাজ করতেন, অরুণা’র পাশে বসে থাকতেন।
একদিন রাতে, অরুণা তাঁর হাত ধরে বলেছিল—
— “তুমি তো একাই চলতে পারবে, না?”
— “তোমার ছায়া তো আমার সঙ্গে থাকবে।”
সেই ছিল শেষ কথোপকথন।

আজ সেই স্মৃতি জানালার কাঁচে জমা পড়ছে শিশির হয়ে।

ট্রেন তখন নদিয়া ছুঁয়ে এগিয়ে যাচ্ছে পূর্বের দিকে। অরবিন্দর মনটা যেন আচমকা খালি হয়ে যায়। তিনি জানালার বাইরে তাকিয়ে বলেন, কেবল নিঃশব্দে,
— “অরুণা, আজও তোমার কথা মনে পড়ে… প্রতিটি ট্রেনজার্নি তোমার হাতের খোঁজে ঘুরে বেড়ায়।”

চোখে জল নেই। এত বছর পর চোখ শুষ্ক হয়, তবু হৃদয় বৃষ্টিতে ভেজে থাকে।

আর সেই অতীত থেকে আজকের এই ট্রেনজার্নিতে, তিনি জানেন, সময় কেবল এগিয়ে যায় না—সে মাঝে মাঝে থেমেও থাকে, একটা স্টেশনে, একজোড়া চোখে, এক পুরনো নাম ধরে ডাকে…
“অরুণা…”

অধ্যায় ৩:

ট্রেন তখন কল্যাণী স্টেশন পেরিয়ে এগোচ্ছে পূর্বের দিকে, জানালার বাইরে তপ্ত হলুদ আলোয় মাঝেমধ্যে ছুটে যাচ্ছে গাছপালা আর ফেলে আসা ছোটো স্টেশন। অরবিন্দ রায় জানালার ধারে বসে আছেন, আগের মতোই শান্ত, পায়ের কাছে রাখা ব্যাগটা তাঁর হাঁটু ছুঁয়ে আছে। রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা, ট্রেনের কামরায় ছড়িয়ে পড়েছে ঘুমঘুম গন্ধ—মিলিয়ে যাওয়া মানুষের কথা, ডালের ভাজা, ট্রেনের বাথরুম থেকে আসা গন্ধ আর সেই ট্র্যাডিশনাল কাঠের আসনের স্মৃতি।

ঠিক তখনই তাঁর সামনের সিটে এক তরুণ উঠে বসল—চুলে হালকা জেল দেওয়া, গায়ে স্লিমফিট শার্ট, কানে হেডফোন, এক হাতে স্মার্টফোন আর অন্য হাতে পেপসি’র বোতল। চট করে তাকিয়ে দেখে নিল সিট নম্বর, তারপর বলল—

— “স্যার, এইটা ৪৫ না ৪৭?”

অরবিন্দ একটু হেসে বললেন,
— “৪৫। তুমি ঠিকই বসেছো।”

তরুণ হেডফোন খুলে বলল,
— “থ্যাঙ্কস স্যার। আসলে আমার অ্যাপে একটু দেরি করে আপডেট দেয়।”

অরবিন্দ বুঝলেন না অ্যাপ মানে ঠিক কী, কিন্তু মাথা নাড়লেন।
তরুণ বোতল থেকে এক চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
— “আপনি বর্ধমান যাচ্ছেন?”
— “হ্যাঁ, তোমার মতো আমিও গন্তব্যের খোঁজে।”

তরুণ হেসে ফেলল,
— “আমি তো শুধু weekend ছুটিতে যাচ্ছি। বাবা-ঠাকুরদার বাড়ি বর্ধমান। এখন কলকাতাতেই চাকরি করি—একটা IT কোম্পানিতে। আপনি কী করেন স্যার?”

— “আমি কিছু করতাম একসময়। এখন শুধু দেখি, ভাবি, আর মাঝে মাঝে ভুলেও যাই।”
তরুণ কৌতূহলী হয়ে তাকাল,
— “মানে?”
— “মানে, আমি অবসরপ্রাপ্ত। কিছু করি না এখন, শুধু থাকি।”

তরুণ এক গাল হেসে বলল,
— “ভালোই তো। ঘোরাঘুরি করেন নিশ্চয়ই? কফি খাওয়া, গল্প লেখা, সিনেমা দেখা এসব?”

অরবিন্দ একটু হেসে বললেন,
— “আমি সিনেমা হলে শেষ ছবি দেখেছিলাম ২০০৪ সালে। তখনও আমার স্ত্রী জীবিত ছিলেন।”
এক মুহূর্তের জন্য তরুণ থেমে গেল। তারপর একটু অপ্রস্তুত হেসে বলল,
— “আমি দুঃখিত, স্যার।”
— “না, না, ঠিক আছে। দুঃখ করার কিছু নেই। স্মৃতিগুলো এখন নরম তুলোর মতো—ব্যথা দেয় না, কিন্তু চেপে রাখে।”

ট্রেন তখন ধীরে ধীরে কমে আসছে গতিতে, যেন এই কথোপকথনের ছন্দ বুঝতে পেরে নিজে থমকে যেতে চাইছে।

তরুণ আবার বলল,
— “আপনার কথায় কবিতা আছে, জানেন?”
— “জানি না। আমি তো কেবল কথা বলি, তুমি শুনে নাও যদি তা কবিতা হয়।”
— “স্যার, আপনি গল্প লিখলে আমি পড়তাম। আপনি Instagram চালান?”

এইবার অরবিন্দ হেসে ফেললেন—খাঁটি এক হাসি, বহুদিন পর যেন হৃদয় থেকে ফুটে উঠল।
— “Instagram চালাই না, চালাতে শিখিনি। তবে তোমার মতো কেউ হয়তো একদিন আমার জীবনটাকেই গল্প বানাবে।”
— “হয়তো আমিই লিখব একদিন। ট্রেনের কামরায় একজন বয়স্ক ভদ্রলোক, যিনি শুধু দেখতে শিখেছেন জীবনকে, নিঃশব্দে।”
— “তবে লেখো, লেখো একবার… ‘শেষ ট্রেনের আলো’ দিয়ে শুরু করো।”
— “ভাল নাম! রাইটারস ব্লক কেটে গেল আমার। স্যার, একটা কথা বলবো?”
— “নিশ্চয়ই।”
— “আপনার মতো হলে বয়সটা কম ভয় লাগত। এখন তো সবাই দৌড়াচ্ছে, জানেন? কোথায় যাচ্ছে কেউ জানে না। সারাক্ষণ ফোন, ফলোয়ার, EMI, প্রেজেন্টেশন, গাড়ি, বাড়ি, আর কিছু নেই।”

অরবিন্দ গভীরভাবে শুনলেন, তারপর বললেন,
— “জীবনটা একটা ট্রেনের মতো। সবাই টিকিট কেটে ওঠে, কিছু স্টেশন মিস করে যায়, কিছুতে দাঁড়ায়। শেষে গন্তব্য একটাই—থামা। কিন্তু কেউই চায় না থামতে। যতদিন না শেষ আলোটা ফুরোয়।”

তরুণ তাকিয়ে থাকল তাঁর দিকে—চোখেমুখে মুগ্ধতা, শ্রদ্ধা। এক সময় গম্ভীর স্বরে বলল,
— “আপনি আমার দেখা সবচেয়ে শান্ত মানুষ।”
— “আমি শুধু ক্লান্ত। আর ক্লান্তির পরেই আসে শান্তি।”

হঠাৎই ট্রেনটা হালকা ধাক্কা খেয়ে দাঁড়াল—পরবর্তী স্টেশন: শক্তিগড়।
তরুণ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
— “স্যার, আমার স্টেশন এসে গেছে। দাদু অপেক্ষা করছেন বাইরের রিকশা স্ট্যান্ডে।”
— “তাহলে ভালো থাকো। আর গল্পটা লিখে নিও, মনে রাখবে, আলো শেষ হয়ে গেলেই আসল গল্প শুরু হয়।”

তরুণ হাত বাড়িয়ে দিল। অরবিন্দ একটু দ্বিধা করলেও হাতটা চেপে ধরলেন। সেই আলতো, অথচ গভীর স্পর্শ যেন প্রজন্মের ব্যবধান মুছে দিল কিছুক্ষণের জন্য।

তরুণ নেমে গেল। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে সে একবার ফিরে তাকাল ট্রেনের জানালার দিকে। অরবিন্দ হালকা হাসি দিয়ে হাত নাড়লেন।

ট্রেন আবার চলতে শুরু করল। জানালার বাইরে সেই আলো-ছায়ার খেলা আবার ফিরে এলো। ভেতরে ছড়িয়ে পড়ল নিঃসঙ্গ এক প্রশান্তি, যেন এই সাক্ষাৎকার অরবিন্দর মনকে অনেকটা হালকা করে দিল।

তিনি জানালার কাঁচে ঠেকানো গালে হাত দিয়ে চোখ বুজলেন, আর মনে মনে বললেন—

“শেষ আলোটা জ্বলছে এখনো… ঠিক যতক্ষণ না গল্পটা শেষ হয়।”

অধ্যায় ৪:

রাত তখন প্রায় পৌনে বারোটা। ট্রেনের গতি ধীরে কমতে শুরু করল। জানালার কাঁচে আলোর রেখা থেমে থেমে ছুটছে। অরবিন্দ রায় ঘুমে ঢুলছিলেন, কিন্তু হঠাৎ হালকা ধাক্কায় চোখ খুলে গেল। আশ্চর্যভাবে ট্রেনটি এক অচেনা স্টেশনে থেমে গেছে।

উঁকি দিয়ে দেখলেন—একটা পরিত্যক্ত, ধূলিধূসর প্ল্যাটফর্ম। স্টেশনের নামফলক অর্ধেক ভাঙা—আংশিক পড়া যায়: “…দীঘা” অথবা “…দিঘি”—অরবিন্দ নিশ্চিত নন। আশেপাশে জনমানব নেই, আলো-ছায়ার খেলা ছাড়া আর কিছু নেই।

তিনি জানালা খুলে বাইরে তাকালেন। বাতাসে একটা অদ্ভুত গন্ধ—জলপাকলের, মাটি ভেজা বৃষ্টির, আর যেন কোনও পুরনো বইয়ের পাতার। ট্রেনের অন্য কামরাগুলোতেও অস্বাভাবিক নিরবতা। লোকেরা কি ঘুমিয়ে পড়েছে, নাকি তিনি কোনও স্বপ্নে প্রবেশ করেছেন?

হঠাৎই একটি কণ্ঠস্বর ভেসে এল প্ল্যাটফর্ম থেকে—
— “রায়বাবু, নেমে আসুন। আপনার জন্যই তো ট্রেনটা থেমেছে।”

অরবিন্দ চমকে গেলেন। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলেন, এক লোক দাঁড়িয়ে আছে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে, হাতে লণ্ঠন, মুখ স্পষ্ট নয়, কিন্তু চোখজোড়া যেন অদ্ভুতভাবে পরিচিত।
— “আপনি কে?”
— “আপনার একজন অপেক্ষমাণ স্মৃতি। নেমে আসুন, সময় শেষ হয়ে আসছে।”

অরবিন্দর মনে হল, এই মুখটা কোথাও দেখেছেন। তিনি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন, শরীর যেন হালকা, অথচ ভারী। দরজা খুলে প্ল্যাটফর্মে নামলেন। ট্রেনটা কেমন নিঃশব্দ, যেন থেমে যাওয়া এক শ্বাস।

প্ল্যাটফর্মে নেমেই আরও বিস্ময়! চারদিক ঘিরে রেখেছে ধোঁয়াটে আলো, যেন কুয়াশার জগত। সামনেই দেখা গেল একটি পুরনো বেঞ্চে বসে আছেন একজন নারী। মুখটি দেখা যাচ্ছে না স্পষ্টভাবে, কিন্তু কাঁধ পর্যন্ত খোলা চুল, মলিন শাড়ি, আর সেই বিশেষ কড়া-মিষ্টি গন্ধ—অরবিন্দর হৃদয় কেঁপে উঠল।

— “অরুণা?”
নারীটি মুখ তুলে তাকালেন।
— “অরবিন্দ, এতদিন পরও চিনতে পারলে?”
— “তুমি… তুমি তো… কিন্তু…”
— “আমি আছি, যেখানে অপেক্ষার শেষ নেই। তুমি তো বলেছিলে, ‘শেষ আলোয়ও আমি তোমায় খুঁজব’। তাই এলাম।”

তাঁদের চোখের মধ্যে দিয়ে সময় গলে যেতে লাগল। চারপাশে আর কিছু নেই, শুধু সেই প্ল্যাটফর্ম, লণ্ঠনের আলো, এবং অরুণা’র সেই শান্ত মুখ।
— “তুমি কেমন আছো?”
— “আমি তো স্মৃতি হয়ে গেছি, অরবিন্দ। আমাকে ছুঁতে পারবে না, কিন্তু ভুলতেও পারবে না।”

তাঁরা অনেকক্ষণ কথা বললেন—কখনও নিঃশব্দে, কখনও শুধু চেয়ে থেকে। কথাগুলো যেন মুখে উচ্চারিত হচ্ছিল না, শুধু মনে বাজছিল এক অলৌকিক সুরে।

— “তুমি কি ফিরে যাবে?”
— “তুমি যদি চাও, আমি থাকব।”
— “না, তুমি যাও। আমি এখনো শেষ আলোটা দেখি নাই।”

এক অদ্ভুত আবেশে হঠাৎই চারপাশ ভেঙে পড়ল। কুয়াশা মিলিয়ে যেতে লাগল, আর দূরে শোনা গেল ট্রেনের হুইসেল—লম্বা, করুণ, যেন কারো বিদায় সুর।

অরবিন্দ চমকে উঠে দেখলেন—তিনি আবার নিজের সিটে বসে আছেন। পাশের সিট খালি, চারপাশে যাত্রীরা ঝিমুচ্ছেন। জানালার বাইরে চলে গেছে সেই অচেনা স্টেশন। ট্রেন আবার ছুটছে।

তিনি কাঁধে হাত রাখলেন। কিছুই নেই। শুধু বুকের ভেতর একটা ধুকধুকানি, আর চোখের কোণে এক বিন্দু জল।

একজন সহযাত্রী জিজ্ঞেস করল,
— “স্যার, কিছু হয়েছে?”
— “না, কিছু না। হয়তো স্বপ্ন দেখছিলাম। হয়তো সত্যি।”

তাঁর মনে হলো, কেউ যেন পাশে বসে হাত রাখছে তাঁর হাতের ওপরে। কেউ, যার ছোঁয়া তিনি চেনেন। জানালার কাঁচে তাঁর ছায়া যেন একা নয়, আরেকটা ছায়া পাশে বসে আছে—অরুণা’র।

আর তিনি হালকা হেসে বললেন নিজেকেই—
“শেষ ট্রেন কেবল গন্তব্যে নিয়ে যায় না, কেউ কেউ তো ফিরেও আসে… তিন নম্বর সিগন্যাল পোস্ট পেরিয়ে।”

অধ্যায় ৫:

ট্রেন এখন কাঁকসা স্টেশন পেরিয়ে আরও পূর্ব দিকে ছুটে চলেছে। মাঝরাত কেটে গিয়েছে, জানালার বাইরে অন্ধকার গহ্বরের মতো গিলে নিচ্ছে সব আলো। অরবিন্দ রায় এবার আর ঘুমোতে পারছেন না। কিছু একটা যেন তাঁর বুকের মধ্যে চাপা পড়ে আছে। স্বপ্ন না বাস্তব, প্ল্যাটফর্মে অরুণা’র মুখ কি সত্যিই দেখেছিলেন? নাকি তার মধ্যে জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস এমন রূপ নিয়েছে?

তিনি ব্যাগ খুলে ওলট-পালট করতে লাগলেন। পুরনো পত্রিকা, চোখের ওষুধ, একটা গামছা—সবকিছুর মধ্যে হঠাৎ একটা ভাঁজ করা হলুদ খাম বেরিয়ে এল। কালচে দাগ পড়ে গেছে, কালি ঝাপসা, খামের কোণে অরুণা’র হাতের লেখা:
“অরবিন্দ, একবার পড়ো…”

হৃদয় ধক ধক করে উঠল। তিনি জানতেন না, এই চিঠিটা এতদিন তাঁর ব্যাগেই ছিল। নাকি আজ রাতেই, কোনো অলৌকিক মুহূর্তে এটি ফিরে এসেছে? খানিকক্ষণ খামটা হাতে ধরে চেয়ে রইলেন, তারপর ধীরে ধীরে খাম ছিঁড়লেন।

চিঠিতে লেখা ছিল:

“অরবিন্দ,

যখন তুমি এটা পাবে, আমি হয়তো থাকব না। কিংবা, তুমি এত দেরিতে পাবে যে আর কিছু বদলানোর সময় থাকবে না। তবুও লিখছি—কারণ তোমার কাছে কোনো দিন বলিনি কিছুটা তৃষ্ণা নিয়ে থেকেছি আমি।

তুমি ভালো থেকো, সেটাই চেয়েছি বরাবর। কিন্তু ভালো থাকাটা শুধু বাইরে থেকে দেখা যায়—ভেতরের শূন্যতাকে ঢাকা যায় না।

আমরা একসঙ্গে থেকেও কিছুই বলিনি একে অপরকে। জানো, শেষ কয়েক বছর আমি প্রতিদিন অপেক্ষা করতাম—তুমি একদিন হঠাৎ এসে বলবে, ‘চলো, আবার যাই পুরুলিয়া’—যেখানে প্রথমবার তোমার হাত ধরেছিলাম। কিন্তু তুমি ব্যস্ত ছিলে, হয়তো ক্লান্তও। আমিও কিছু চাইনি জোর করে।

কিন্তু একটা কথা, অরবিন্দ—যদি কখনও রাতের ট্রেনে একা কোথাও যাও, আর হঠাৎ যদি মনে হয় আমি পাশেই বসে আছি, জানো, আমি সত্যিই থাকব। আমি যেখানেই থাকি না কেন, তোমার নিঃশব্দ যাত্রার সঙ্গী হয়ে যাব, যতক্ষণ না তুমি আলো দেখে ফেলো।

ভালো থেকো।

অরুণা”

চিঠির শেষ লাইন পড়ে অরবিন্দর চোখ জলে ভিজে গেল। হঠাৎই মনে হলো, ট্রেনের আলো নিভু নিভু করছে, যেন ট্রেনটিও স্তব্ধ হয়ে পড়েছে এই মুহূর্তের ভারে। তিনি জানালার বাইরে তাকালেন—ট্রেন তখন ধীরে ধীরে একটি ছোটো, নির্জন স্টেশনে থেমে যাচ্ছে।

স্টেশনের নাম: “অরুণা দিঘি”।

তিনি চমকে গেলেন। এই স্টেশন তো কখনো দেখেননি, কোনও রেল মানচিত্রে এই নাম নেই। গেটের পাশে ছোটো ঝোপের ভেতর দিয়ে সোঁ সোঁ হাওয়া বইছে। একটা বেঞ্চে বসে আছে একজন বাচ্চা মেয়ে, হাতে কাঁথা মোড়া পুতুল।

অরবিন্দ জানেন না এটা বাস্তব, স্মৃতি, না এক অলৌকিক ছায়াজগত। কিন্তু তিনি আর কিছু না ভেবে নামলেন প্ল্যাটফর্মে। বাচ্চা মেয়েটি তাকিয়ে বলল—
— “তুমি চিঠিটা পড়েছো তো?”
— “হ্যাঁ।”
— “তাহলে এবার এগিয়ে যাও। যে কথা বলা হয়নি, সে কথা এবার বোঝা গেছে।”

অরবিন্দ চুপচাপ মাথা নাড়লেন। সেই মুহূর্তে স্টেশনঘড়িতে একটা বাজল, আর ট্রেন আবার হুইসেল বাজিয়ে রওনা দিল।

তিনি দ্রুত উঠে ট্রেনে ফিরে এলেন, জানালায় বসে অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল বুকের মধ্যে চাপা একটা ভার যেন হালকা হয়ে গেছে। পুরনো অভিমান, না বলা ভালোবাসা, আত্মগ্লানি—সব মিলিয়ে একটা স্নিগ্ধ বিষণ্ণতা।

চিঠিটা আবার ভাঁজ করে বুক পকেটে রাখলেন।

আর নিজেকে বললেন—
“আলোটা হয়তো ফুরিয়ে আসছে, কিন্তু এবার আমি প্রস্তুত। এবার আমি বুঝেছি—শেষ স্টেশনটাও কখনও শেষ নয়, যদি কিছু না বলা থেকে যায়।”

অধ্যায় ৭:

ট্রেন এবার নিজের গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছে এসেছে—সেই ছোট্ট স্টেশন, যার নাম আহিরঘাটা, বহুদিন আগে যেখানে অরবিন্দ রায় শিক্ষকতা করতেন। এই স্টেশন বহু পুরনো, ইট-সুরকির পাটাতন, গা ছমছমে নীরবতা, আর ঝুপড়ি দোকানের গন্ধে ভরা। অনেক বছর আগের সেই গ্রাম্য দিনগুলো আজও তার মনে গেঁথে আছে—যেখানে তিনি আর অরুণা একসাথে একটা স্কুল চালাতেন, যেখানে ছাত্রদের নাম মুখস্থ জানতেন, আর দুপুরে খিচুড়ি রান্নার সময় নিজেই হাত লাগাতেন। ট্রেন যখন ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াল, অরবিন্দ রায় জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখলেন, আশেপাশের চেনা দৃশ্যগুলো আজও তেমনই রয়ে গেছে—একটু ধুলোমাখা, একটু ধূসর, আর কিছুটা বিষণ্ণ। নামার সময় বুঝলেন, পায়ে একটু কাঁপুনি—নাকি এটা আসলে ভেতরের উথালপাথাল আবেগ? তিনি একবার থামলেন। জানালার কাচে নিজের প্রতিবিম্বটা দেখলেন। চোখদুটো যেন আরও ক্লান্ত, কিন্তু একইসাথে আরও গভীর। স্টেশনের বুক পেরিয়ে এগিয়ে গেলেন সেই রাস্তার দিকে, যেটা তাঁকে নিয়ে যাবে পুরনো স্কুলের গেটে।

স্কুলের প্রাচীর এখনও টাল খায়নি, যদিও রং খসে গিয়েছে, গেটে তালা পড়ে আছে। কিন্তু পাশেই একটি ছোট বাড়ি—যেখানে এখনো আলো জ্বলছে। দরজা খুলে বেরিয়ে এল একজন যুবক—দীর্ঘ, ছিপছিপে গড়ন, চোখে অদ্ভুত এক দৃঢ়তা। যুবকটি প্রথমে একটু চমকে উঠল, তারপর এগিয়ে এসে বলল, “আপনি কি… অরবিন্দ রায়?” অরবিন্দ এক মুহূর্ত থেমে থাকলেন, মাথা নাড়লেন ধীরে। যুবক বলল, “আমি… রাহুল। আমি অরুণা’র ছেলে। আপনার নাম মা অনেকবার বলেছিল।”
অরবিন্দর বুক ধক করে উঠল। সে যেন বুঝতেই পারল না কীভাবে উত্তর দেবে। অনেক কিছু বলার ছিল, কিন্তু কোনও শব্দ মুখে এল না। রাহুল বলল, “মা বলতেন, আপনি হয়তো আর কখনও ফিরবেন না। কিন্তু আমার বিশ্বাস ছিল, আপনি শেষ আলোয় একবার আসবেন।”
অরবিন্দ একটুও দেরি না করে পকেট থেকে সেই পুরনো চিঠিটা বের করলেন, যেটা বহু বছর পর পড়েছেন। “এই চিঠিটা আমি তখন পড়িনি, জানো। হয়তো পড়লে অনেক কিছু পাল্টে যেত। কিন্তু…”
রাহুল বলল, “কিন্তু সময় সবকিছু বদলে ফেলে না, কিছু কথা থেকে যায় নিজের জায়গায়—যেমন থেকে যায় একটা নামহীন স্টেশন, একটা অপঠিত চিঠি, একটা অসমাপ্ত সম্পর্ক।”
এই কথাগুলো শুনে অরবিন্দ বুঝলেন, রাহুল শুধু রক্তের সম্পর্ক নয়, মনের এক সুদীর্ঘ পথের উত্তরসূরি।

রাহুল তাঁকে ঘরের ভেতর নিয়ে গেল। ভেতরে অরুণা’র ছবি রাখা—একদম ঠিক যেমনটা অরবিন্দর মনে গেঁথে ছিল, খোলা চুল, শান্ত মুখ। ছবির নিচে ধূপের ধোঁয়া উঠছে, আর পাশে রাখা একটি পুরনো খাতা—অরুণা’র নিজের হাতে লেখা ডায়েরি।
রাহুল বলল, “মা মারা যাওয়ার আগে এই খাতাটা আমাকে দিয়ে বলেছিলেন—‘যদি কখনও অরবিন্দ ফিরে আসে, তাকে এটা দিও। সে যেন জানে, অপেক্ষা কখনও ফুরোয় না, শুধু রূপ বদলায়।’”
অরবিন্দ সেই খাতা খুললেন, আর পড়তে শুরু করলেন। প্রথম পাতায় লেখা ছিল—
“আজও জানালার পাশে বসে থাকি, শেষ ট্রেনটা কখন আসে—সেই আলোটা কখন জানালার কাচে পড়ে। আমি জানি, সে ট্রেন একদিন ঠিক আসবে। কেউ একজন জানালার বাইরে খুঁজবে সেই ম্লান ছায়া, যার নাম অরুণা।”

বাকি পৃষ্ঠাগুলোতে শুধু না বলা ভালোবাসার টুকরো টুকরো কথাগুলো—যা অরবিন্দ নিজেও মনে মনে প্রতিদিন বলতেন, কিন্তু মুখে আনতে পারেননি। সেই সন্ধ্যার পর, রাহুল তাঁকে বলে, “চলো, একবার স্কুলটা ঘুরে আসি। তোমার অভিভাবক হিসেবেই এখন আমাকে দেখো।”
অরবিন্দ হেসে ফেললেন, এক অনুচ্চ স্নেহে।
স্কুল চত্বরে পৌঁছে দেখলেন, মাঠটা আগের মতোই আছে, শুধু ছেলেমেয়েদের হাসির শব্দ নেই। সেই লালমাটির ছাতচাপা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন, মনে হল, পাশেই যেন কেউ দাঁড়িয়ে বলছে, “তুমি আবার ফিরে এসেছো, এবার দেরি করো না।”
অরবিন্দ জানেন, ফিরে গিয়ে আর সব ঠিক করা সম্ভব নয়। কিন্তু এই যে ফিরে আসা, এই যে চিঠি পড়া, এই যে কারো চোখে নিজের প্রতিচ্ছবি খোঁজা—এইসবই হল সেই আলো যা শেষ নয়, শেষের আগের আলো।

তিনি মনে মনে বললেন—
“যে ট্রেনটি রাতে আসে, সেটি শেষ ট্রেন নয়; সেটি ফিরে পাওয়ার আলোর নাম, আর সেই আলো কখনও নিভে না।”

অধ্যায় ৮:

রাত পেরিয়ে সকাল হয়েছে, কিন্তু অরবিন্দ রায়ের মনে সময় যেন এখনও থেমে আছে সেই আগের রাত্রির ভেতরে—যেখানে স্টেশনের আলো ঝিমোচ্ছিল, চিঠির অক্ষরগুলো জীবন্ত হয়ে উঠেছিল, আর মুখোমুখি হয়েছিলেন একজন তরুণের, যে ছিল তাঁর অতীতের আত্মদানের ছায়া। আহিরঘাটা স্টেশনের সেই রাত যেন কোনও স্বপ্ন নয়, বরং এমন একটি পরিসর, যেখানে সব হারানো অনুভব ফেরে জীবনের আলোয়।

অরবিন্দ শহরে ফিরলেন। লোকালয়ে, কোলাহলে, অফিসের কড়া আলোয় ফিরেও, তাঁর মন রয়ে গেল কোথাও এক নির্জন জানালার ধারে। তিনি আগে যেভাবে জীবনের থেকে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন, এখন বুঝেছেন—পালানো নয়, থেমে থেকে বোঝা জরুরি। তিনি সেই পুরনো কাগজের বাক্সগুলো খুলতে শুরু করলেন, যেগুলো অনেক বছর আগেই বন্ধ করে রেখেছিলেন। পুরনো নোটবুক, কাটা ফটো, আর ছোট ছোট চিঠির টুকরো—যেগুলো অরুণা তাঁকে কোনওদিন পাঠায়নি, হয়তো পাঠাতে পারেনি। প্রতিটি চিঠির আড়ালে ছিল এক নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস, এক চুপ করে থাকা নারী, যে শুধু অপেক্ষা করে গেছে, উত্তর না পেয়েও প্রশ্ন করে গেছে হৃদয়ের ভাষায়।

এরই মাঝে রাহুলের একটি চিঠি এল—হাতের লেখা ছিমছাম, কিন্তু স্পষ্ট।
“বাবা, স্কুলের মেরামত শুরু করেছি। জানো, তোমার পুরনো রেজিস্টার এখনও রয়ে গেছে। আমি চাই, তুমি একবার ফিরে এসে ক্লাস নাও। আমার ছাত্রছাত্রীরা তোমার গল্প শুনেছে। এবার তারা তোমার মুখ থেকে শুনুক—যেভাবে আলোকে খুঁজে পাওয়া যায় অন্ধকারের মধ্যেও।”

চিঠিটা পড়ে অরবিন্দ জানলেন, তিনিও চাইছেন আবার গিয়ে দাঁড়াতে সেই পুরনো বারান্দায়, সেই কালচে ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে। কিন্তু এবার তাঁর হাতে থাকবে শুধু পাঠ্যপুস্তক নয়—থাকবে অভিজ্ঞতার আলো, ভুল স্বীকার করার সাহস, আর ভালবাসার স্থায়ী ছায়া।

শহরের এক প্রান্তে তাঁর পুরনো বন্ধু রঘু দত্ত এখন একটি বয়স্ক নাগরিক কেন্দ্রে কাজ করেন। রঘু বললেন, “তুই কি জানিস, আলো খোঁজার লোকেরা সবসময় নিঃশব্দ থাকে। কিন্তু যেদিন তারা বলে ওঠে—সেদিন চারপাশের আঁধারও থমকে যায়।”
অরবিন্দ হেসে ফেলেন। “আমি শুধু জানি, এক রাতের ট্রেনে উঠেছিলাম ভুলে যাওয়ার জন্য। অথচ ফিরে এলাম সব মনে পড়ে যাওয়ার ভার নিয়ে।”

এখন অরবিন্দ সপ্তাহে দু’দিন স্কুলে যান, বাকি দিনগুলি তিনি রাহুলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। সেই ডায়েরি, যা অরুণা রেখে গিয়েছিল, তিনি এখন পাতা পাতা করে পড়েন—আর তার প্রতিটি লাইন নিজের জীবন দিয়ে অনুভব করেন। তিনি বুঝেছেন, অরুণা তাঁকে দোষ দিতেন না—তিনি শুধু চেয়েছিলেন, কেউ একজন জানুক, অপেক্ষা অকারণ ছিল না।

এক সন্ধ্যায় অরবিন্দ সেই স্টেশন ঘরের পেছনে বসে আকাশের দিকে তাকান—চাঁদ তখন খণ্ডিত, আলো ছড়ানো ঝাপসা। পাশেই বসে থাকা এক বালিকা জিজ্ঞেস করে, “কাকু, আপনি কি কবি?”
অরবিন্দ হেসে বলেন, “না রে মা, আমি একজন যাত্রী, যে অনেক দেরিতে একটা চিঠি পড়েছে।”
বালিকা আবার জিজ্ঞেস করে, “শেষ ট্রেনটা কি সত্যি চলে যায়?”
তিনি চোখ মেলে বলেন,
“না, শেষ ট্রেনটা কোথাও যায় না। ওটা অপেক্ষা করে। ঠিক যেমন কোনও আলো নিভে যায় না—শুধু একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায়।”

আর তখনই তিনি বুঝলেন—আলো এখনও আছে। ঠিক যেমন অরুণা ছিলেন, রাহুল আছেন, আর সেই সমস্ত চিঠিগুলো, যেগুলো সময়ের বুক চিরে ফিরতে জানে। যে ট্রেন তাঁকে ফিরিয়ে এনেছিল, সে ট্রেন সত্যিই শেষ ট্রেন ছিল না। বরং তা ছিল “শেষের আগের আলো”, যা মানুষকে তার না-পাওয়া, না-কহা ও না-ফেরার কথা মনে করিয়ে দেয়।

অরবিন্দ রায় এখন জানেন—সময় কখনও শেষ হয় না, যদি কেউ একবার হলেও বলে ওঠে—“তখনও আলো ছিল।”

অধ্যায় ৯:

শহরের জীবনযাপন আবার নিজের ছন্দে ফিরেছে, কিন্তু অরবিন্দ রায়ের ভেতরের ছন্দটি আর আগের মতো নেই। এখন প্রতিটি সকাল তার কাছে একটা নতুন সূচনা—যেমনটা আগে ছিল না। অতীতে যিনি নিজের কণ্ঠ হারিয়ে ফেলেছিলেন সময়ের ঝড়ে, তিনি এখন সময়ের গভীর কন্ঠে শোনেন অপেক্ষার প্রতিধ্বনি। এই নতুন জীবনে তাঁর পরিচয় আর একজন প্রাক্তন শিক্ষক নয়—বরং একজন স্মৃতির সাক্ষ্যদাতা।

একদিন সকালে, চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় বসে তিনি ডাকে পেলেন এক অপরিচিত ব্যক্তির কাছ থেকে। পরিচয় দিলেন—তপন ঘোষ, একজন ছোট প্রকাশনা সংস্থার সম্পাদক। তপনের চোখে অদ্ভুত এক ঝলকানি—যেন অরবিন্দর কথা তিনি আগেই জানতেন। তিনি বিনীতভাবে বলেন,
— “আপনার স্কুলে ফেরা, আপনার ট্রেনযাত্রার কথা, আর সেই অরুণা’র চিঠির গল্প রাহুল আমাদের জানিয়েছে। আপনি জানেন কি, এই গল্পটা শুধু আপনার নয়—এটা অনেকের জীবনের প্রতিচ্ছবি।”
অরবিন্দ চমকে গেলেন, “আপনি চাইছেন আমি এটা লিখি?”
— “না, আপনি চাইছেন। আমরা শুধু সেই দরজাটা খুলে দিচ্ছি, যেখান থেকে অন্যরাও ফিরে আসতে পারে নিজের অন্ধকার থেকে। আপনি যদি এই যাত্রার নোটবুক লেখেন, তা হলে আরও অনেক ‘শেষ ট্রেনের আলো’ জ্বলতে শুরু করবে।”

অরবিন্দ রাজি হলেন না তখনই। তিনি চুপ করে থেকেছিলেন। কিন্তু তপনের চোখে একটা ধৈর্য ছিল, বিশ্বাস ছিল। ফিরে এসে নিজের ডেস্কে বসে, সেই পুরনো লেখা খাতা খুলে নিলেন। প্রথম পাতায় লিখলেন—
“এই নোটবুক সেইসব সময়ের জন্য, যারা কখনও ফিরে আসেনি, কিন্তু একটা চিঠি পড়ে যাওয়ার পর জেনেছে—আলো নিভে যায় না।”

নতুন খাতা শুরু হল। পৃষ্ঠা পৃষ্ঠা লেখা হলো সেই স্টেশনটির কথা, যার নাম নেই। সেই ছোট্ট কন্যার কথা, যে প্রশ্ন করেছিল চিঠি পড়া হয়েছে কিনা। সেই প্ল্যাটফর্ম, যেখানে সময় থেমে গিয়েছিল। অরুণা’র সেই অপঠিত চিঠি, সেই ডায়েরি, রাহুলের চোখে ফুটে ওঠা স্পষ্টতা—সবকিছু অরবিন্দ লেখায় ধরে রাখতে লাগলেন।

তার লেখা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল। প্রথমে স্কুলের মধ্যেই পড়া হত। পরে, শহরের কিছু সাহিত্যের মঞ্চ তাঁকে আমন্ত্রণ জানাতে লাগল। তিনি মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের কণ্ঠে পড়তে শুরু করলেন—“একটা ট্রেন আছে, যেটা রাত দুটোয় থামে, যেখানে কোনও স্টেশনের নাম নেই, আর কোনও ঘোষণা শোনা যায় না…”

মানুষ শুনতে লাগল। চোখ ভিজে উঠল। একজন বৃদ্ধ মহিলা একদিন হাত ধরে বললেন, “এই গল্পটা আমি কোনওদিন পড়িনি, কিন্তু আমি জানি আমি এই ট্রেনে একবার উঠেছিলাম।”
একজন যুবক বলল, “আমার বাবাও কোনও চিঠি পড়েননি মা’র মৃত্যুর আগে। এখন আমি বুঝি, কেন তিনি রাতে জানালার ধারে বসে থাকতেন।”

অরবিন্দ বুঝলেন, এই নোটবুকটা শুধু লেখা নয়—এটা মানুষের মনের নিরব যাত্রার দিশারি। শব্দ নয়, অনুভব। আলো নয়, তার অপেক্ষা।

তপন একদিন বললেন, “আমরা এটা বই হিসেবে প্রকাশ করব। নাম ঠিক করা হয়েছে—শেষ ট্রেনের আলো।”
অরবিন্দ হেসে বললেন, “আর সাবটাইটেল থাকবে—নির্বাক সময়ের নোটবুক।”

আর সেই বই প্রকাশের দিন, স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে এক কিশোরী বলল, “এই গল্পটা যদি সিনেমা হতো, তাহলে আমি সেই মেয়েটার চরিত্রে অভিনয় করতাম—যে প্রশ্ন করেছিল, ‘তুমি চিঠিটা পড়েছো তো?’”
অরবিন্দ কাঁপা গলায় বললেন, “তুই তো এখনই সেটা করলি, মা। ধন্যবাদ তোকে।”

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে, ডেস্কের উপর আলো জ্বলছিল। জানালার কাচে ট্রেনের একটা ম্লান প্রতিচ্ছবি পড়েছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে অরবিন্দ শেষ লাইনটি লিখলেন—

“শেষ ট্রেন কেবল একটা বাহন নয়; এটা অপেক্ষার, অনুশোচনার, আর অবশেষে আলোর—একটি সমান্তরাল সময়রেখা। কেউ পড়ে ফেলে চিঠি, আর কেউ হয়ে ওঠে সেই চিঠির লেখক। আর আমি? আমি শুধু এক যাত্রী, যার কাছে এখনও আলো রয়ে গেছে।”

অধ্যায় ১০:

কলকাতার উত্তরের এক সন্ধ্যাবেলায়, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের পাশের ছোট্ট বইমেলায় গিয়ে দাঁড়ালেন অরবিন্দ রায়। হাতে ধরা প্রথম প্রকাশিত বই, তাতে সাদা কভারে কালো কালিতে লেখা—শেষ ট্রেনের আলো: নির্বাক সময়ের নোটবুক। মানুষজন আসছে, বই কিনছে, স্বাক্ষর নিচ্ছে। কিন্তু অরবিন্দর মন তখন অন্য এক স্টেশনে।

তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ই যেন এই ট্রেনযাত্রার মতো ছিল—নির্দিষ্ট গন্তব্যহীন, কিন্তু প্রতিটি স্টপেজে কিছু রেখে যাওয়া, কিছু নিয়ে ফেরা। সেইসব স্মৃতি, যন্ত্রণা, অপূর্ণতা—সবকিছু মিলিয়ে তিনি আজ একজন পূর্ণ মানুষ।

একপাশে রাহুল দাঁড়িয়ে। মাথায় একটু পাক ধরা, চোখে সেই একই সাহসী আলো। পাশে তার স্ত্রী নন্দিনী, আর তাদের কোলে ছোট্ট একটি মেয়ে—ছয় বছরের অরু। হ্যাঁ, নাম রাখা হয়েছে অরুণা’র নামেই। অরবিন্দর চোখে জল এসে পড়ে।

রাহুল বলে, “বাবা, এবার সময় এসেছে নতুন একটি স্কুল শুরু করার। পুরনো স্কুল তো আমরা মেরামত করে নিয়েছি। এখন চাই আরও কিছু বাচ্চাদের হাতে রাখি সেই আলো, যা তুমি দিয়েছো আমাকে।”

অরবিন্দ মাথা নাড়েন। কিন্তু এবার তিনি শুধু পরিকল্পনার মধ্যে নেই, তিনি কাজে নামেন। শহরের প্রান্তে একটি পরিত্যক্ত ভবন, যা আগে একটি দাতব্য হাসপাতাল ছিল, সেটিকে পরিষ্কার করা হয়, ছাদে রঙ করা হয়, শ্রেণিকক্ষে টেবিল-চেয়ার বসানো হয়। নাম দেওয়া হয়—“আলো পাঠশালা”।

এখানে শুধু পড়ানো হয় না। এখানে পড়ানো হয় কীভাবে অপেক্ষা করতে হয়, কীভাবে চিঠি না পেলে কাঁদতে হয় না, বরং নিজের চিঠি নিজেই লিখে ফেলতে হয়। এখানকার প্রতিটি শিক্ষার্থী জানে, অরবিন্দ স্যার সেই মানুষ, যিনি জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা পেয়েছেন শেষ ট্রেন ধরার পর।

একদিন এক কিশোর এসে বলল, “স্যার, আপনি তো অনেক ট্রেনের কথা লিখেছেন। কিন্তু আপনি কি জানেন, আপনি নিজেই একটা ট্রেন—আপনার কাছে এসে সবাই যাত্রা শুরু করে।”

সেই দিন রাতে, অরবিন্দ একা দাঁড়িয়ে ছিলেন সিয়ালদহ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। পাশে বসে থাকা বৃদ্ধ এক যাত্রী বলল, “এই সময় ট্রেন কম আসে, জানেন তো?”
অরবিন্দ হেসে বললেন, “হ্যাঁ। কিন্তু একটা ট্রেন ঠিক আসে—যেটা আলো নিয়ে আসে।”

তিনি জানেন, আজ তিনি আর সেই মানুষ নন, যিনি একসময় চিঠি খুলে পড়েননি। আজ তিনি নিজেই এক চিঠি, যেটা পৌঁছে যাচ্ছে শত শত হৃদয়ে। তাঁর প্রতিটি লেখা, প্রতিটি গল্প এখন আর আত্মগোপন নয়—এটা এখন আত্মবিস্তারের পথ।

শেষ অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন—
“সবশেষে, আমি শুধু বলতে পারি, যে চিঠি একদিন পড়িনি, সেটাই আজ আমার জীবন বদলে দিয়েছে। আমি এখন জানি, কিছু ট্রেন সময়মতো ধরা যায় না, কিন্তু কিছু আলো ঠিক পৌঁছে যায়। আমি সেই শেষ ট্রেনের যাত্রী, যে ফিরে এসে বুঝেছে—যাত্রার শেষে অপেক্ষা করলে, আলো নিজেই পথ দেখায়।”

তারপর থেকে অরবিন্দ আর কোনও চিঠি অপঠিত রাখেননি। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর তিনি লেখেন, ধৈর্যের সঙ্গে, নিঃশব্দ ভাষায়। কারণ তিনি জানেন—
শেষ ট্রেন কখনও সত্যিই শেষ নয়, যদি যাত্রী ঠিক করে, সে আলো হয়ে ফিরবে অন্যদের যাত্রায়।

 

সমাপ্ত

 

1000028172.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *