ঋত্বিক বসু
পর্ব ১: কুয়াশার ভিতর হারিয়ে যাওয়া মানুষ
শীতের সকাল। কলকাতার উত্তর শহরতলির এক পুরনো গলির ভেতর অদ্ভুত কুয়াশা জমে আছে। লাল ইটের বাড়ি, কাঠের দরজা, ম্লান আলো—মনে হয় যেন সময় এখানে থমকে গেছে। গলির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক টালির ছাদওয়ালা পুরনো ডাকঘর। এই ডাকঘরের সামনে থেকেই নিখোঁজ হয়েছিল মানুষটা—সুদীপ্ত মল্লিক। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে, পেশায় কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক।
ঘটনাটা ঘটেছিল মাত্র দু’দিন আগে। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে তিনি প্রতিদিনের মতো চিঠি পাঠাতে এসেছিলেন ডাকঘরে। তখনো কুয়াশা কাটেনি। তিনি ভেতরে ঢুকে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। কয়েক মিনিট পর তাকে দেখা গেল না। আর বেরোলেন না তিনি। সবাই ভেবেছিল, হয়তো অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেছেন। কিন্তু ডাকঘরে তো মাত্র একটি দরজা। সেই একমাত্র দরজা দিয়ে বের হতে কেউ তাকে আর দেখেনি।
এখন থানা-পুলিশ তোলপাড়। তদন্তে নামল কলকাতা পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী—অর্জুন রায়। বয়স চল্লিশ, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, কম কথা, ধূসর কোট পরে সবসময় ঘুরে বেড়ান। তার একটি অদ্ভুত অভ্যাস আছে—ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে প্রথমে দীর্ঘ সময় চুপ করে চারপাশ দেখেন। যেন বাতাসের শব্দ, দেয়ালের ফাঁক, কিংবা কুয়াশার গন্ধ থেকেও তিনি তথ্য বের করে নেন।
অর্জুন ডাকঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। চারপাশ ভিড়ে ঠাসা। সাংবাদিকরা ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে, পুলিশ কর্ডন করে রেখেছে। তিনি ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকে দেখলেন—অল্প আলো, কাঠের কাউন্টার, পুরনো ঘড়ি টাঙানো। ঘড়ির কাঁটা তখনও আটকে আছে সকাল ৯টা ৩৫-এ। অথচ বাইরে সময় চলছে। ঘড়ি বন্ধ হয়ে গেছে ঠিক যেই মুহূর্তে সুদীপ্ত মল্লিক গায়েব হয়েছিলেন।
অর্জুন ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। পাশে দাঁড়ানো ডাকঘরের কর্মচারী ভীত গলায় বলল—
“স্যার, ঘড়িটা প্রতিদিন ঠিকমতো চলে। কিন্তু সেদিন হঠাৎ থেমে গেল।”
অর্জুন কিছু বললেন না। ধীরে ধীরে ঘড়ির নিচের দেওয়ালে হাত বুলিয়ে দিলেন। তারপর হঠাৎ খেয়াল করলেন—ঘড়ির কাঁচে একফোঁটা শুকনো কালি লেগে আছে। কালি, যা সাধারণত পুরনো কলম থেকে বের হয়।
ডাকঘরের ভেতরে একটা চিঠির বাক্স আছে। সেই বাক্সে অর্জুন খুঁজে পেলেন একটি হলদেটে খাম। খামটা অদ্ভুত—প্রেরকের নাম নেই, ঠিকানাও লেখা হয়নি। শুধু বড় করে লেখা—“শেষ চিঠি।”
তিনি খামটা সাবধানে তুললেন। ভেতরে একটি মাত্র কাগজ। সেখানে কালো কালি দিয়ে লেখা—
“যার ইতিহাস নেই, তার বর্তমানও নেই। সূত্র লুকিয়ে আছে কুয়াশার ভেতর।”
অর্জুন কাগজটা পড়তে পড়তে ঠোঁটে সামান্য হাসি টানলেন। কে এই রহস্যময় প্রেরক? আর ইতিহাস অধ্যাপক কেন নিখোঁজ হলেন এই চিঠির সঙ্গে জড়িয়ে?
কিছু উত্তর পাওয়া যাবে হয়তো পরে। আপাতত অর্জুন জানলেন, এই ঘটনা নিছক গায়েব হয়ে যাওয়ার কাহিনি নয়। এর ভেতরে আরও গভীর, আরও অদ্ভুত কোনো সূত্র লুকিয়ে আছে।
কুয়াশা ধীরে ধীরে ঘন হচ্ছিল। আর সেই কুয়াশার ভেতরেই যেন ভেসে উঠছিল এক নতুন ধাঁধার ছায়া।
পর্ব ২: অদৃশ্য দরজা
অর্জুন রায় ডাকঘরের ভেতরে একা দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাইরে থেকে আসা কোলাহল আর কুয়াশার ভেতর ঘেরা নীরবতা যেন এক অদ্ভুত বৈপরীত্য তৈরি করেছিল। তিনি হাতে ধরে আছেন সেই অদ্ভুত খাম—“শেষ চিঠি।” কালির দাগ, থেমে যাওয়া ঘড়ি আর নিখোঁজ অধ্যাপক—সব মিলিয়ে যেন কোথাও একটা অদৃশ্য সুতোর টান অনুভব করছিলেন তিনি।
ডাকঘরের কর্মচারীদের সবাইকে আলাদা করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। তবু কেউ কোনো উত্তর দিতে পারেনি। সবাই একসাথে বলেছে—“আমরা দেখেছি তিনি লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তারপর হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেলেন।”
অর্জুন কাউন্টারের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। কাঠের দেয়াল, পুরনো র্যাক, ধুলো জমা খাতা। কিন্তু তাঁর চোখ থেমে গেল মেঝের এক কোণে। পুরনো কাঠের তক্তা একটু ঢিলা হয়ে আছে। হাঁটু গেড়ে বসে তিনি তক্তাটা ঠুকলেন। ফাঁপা আওয়াজ। সাবধানে চাপ দিলেন। তক্তা আস্তে খুলে গেল, ভেতরে অন্ধকার একটা গর্ত।
অফিসার মিত্র, যিনি তদন্তে সহায়তা করছিলেন, অবাক হয়ে বললেন—
“স্যার! এটা তো কোনো লুকোনো ফাঁদ দরজা।”
অর্জুন চুপচাপ একটা টর্চ বের করলেন। আলো ফেলতেই দেখা গেল সংকীর্ণ সিঁড়ি নেমে যাচ্ছে নিচের দিকে। মাটির গন্ধ ভেসে এল। বহু বছর ধরে কেউ খোলেনি এমন মনে হয়।
“চলো, নামা যাক।” —শান্ত স্বরে বললেন অর্জুন।
সিঁড়ি দিয়ে নামতেই দেখা গেল এক লম্বা সরু করিডর। দেওয়ালে শেওলা আর ভেজা দাগ। বাতাস ভারী আর স্যাঁতস্যাঁতে। করিডরের শেষ মাথায় একটি কাঠের দরজা। দরজায় মরচে ধরা তালা, কিন্তু তালায় ধুলো নেই। যেন সম্প্রতি কেউ খুলেছে।
অর্জুন তালা খোলার চেষ্টা করলেন। আশ্চর্যের বিষয়, তালাটা ইতিমধ্যেই খোলা ছিল। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল একটি অদ্ভুত কক্ষ। ছোট ছোট আলমারি, কিছু পুরনো নথি, আর মাঝখানে একটি ভাঙা কাঠের টেবিল।
টেবিলের উপর ছড়িয়ে আছে অনেক পুরনো কাগজ—চিঠি, মানচিত্র, আর কয়েকটি কালো কালি-লাগানো কলম। কিন্তু যা সবচেয়ে অদ্ভুত, তা হল দেওয়ালের উপর ঝোলানো একটি বিশাল ছবির ফ্রেম। ছবিতে দেখা যাচ্ছে এক প্রাচীন দুর্গ—মনে হচ্ছে বাংলার কোনো অজানা স্থাপত্য। ছবির নিচে লেখা—“ইতিহাস কখনো মরে না।”
অর্জুন ফ্রেমটা ভালো করে পরীক্ষা করলেন। ছবির ডান কোণায় হালকা খাঁজ আছে। তিনি হাত দিয়ে চাপ দিতেই ফ্রেমটা সরে গিয়ে ভেতরে দেখা গেল এক গোপন আলমারি। আলমারির ভেতরে একটি লাল রঙের খাতা।
খাতাটা খুলতেই ভেতরে সুদীপ্ত মল্লিকের হাতের লেখা। কয়েকটি পৃষ্ঠায় বড় বড় অক্ষরে লেখা—
“আমি জানি আমার পেছনে কেউ লেগেছে। তারা আমাকে চিঠি পাঠাচ্ছে। তারা বলছে আমি ইতিহাসের সত্যকে গোপন করেছি। যদি আমি হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাই, এই খাতাটিই আমার শেষ সাক্ষ্য।”
অর্জুন গভীরভাবে খাতার পাতা উল্টে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ চোখ আটকে গেল এক জায়গায়। সেখানে সুদীপ্ত লিখেছেন—
“তারা আমাকে খুঁজছে এক অজানা ইতিহাসের জন্য—‘রাজবাড়ি ষড়যন্ত্র’। সেই ইতিহাস কেউ জানে না। কিন্তু ডাকঘরের এই ভূগর্ভস্থ পথে তাদের ছায়া প্রবেশ করেছে। আমি হয়তো বাঁচব না।”
অর্জুনের ভ্রূ কুঁচকে গেল। “রাজবাড়ি ষড়যন্ত্র”—এই নামটা তিনি আগে কখনো শোনেননি। কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারলেন, সুদীপ্ত মল্লিক নিছক নিখোঁজ হননি। কেউ ইচ্ছে করেই তাঁকে টেনে নিয়ে গেছে।
ঠিক তখনই হঠাৎ শব্দ হলো। করিডরের দিক থেকে ভারী পায়ের আওয়াজ আসছে। অর্জুন টর্চ বন্ধ করে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইলেন। কয়েক সেকেন্ড পর দরজার ফাঁক দিয়ে দেখা গেল দু’জন ছায়ামূর্তি ভেতরে ঢুকছে। তাদের হাতে লণ্ঠন।
একজন ফিসফিস করে বলল—
“বস বলেছে খাতা নিয়ে যা। কেউ যেন কিছু জানতে না পারে।”
অর্জুন দ্রুত খাতা বুকের কাছে চেপে ধরলেন। অন্ধকারে নিঃশব্দে এক কোণে সরে দাঁড়ালেন। দুই ছায়ামূর্তি ঘরটা তন্নতন্ন করে খুঁজল, কিন্তু খাতা পেল না।
তাদের একজন রাগে গালাগাল দিতে দিতে বলল—
“কে যেন আমাদের আগেই এসেছে।”
তারপর তারা দ্রুত বেরিয়ে গেল। করিডর আবার নীরব হয়ে গেল।
অর্জুন ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়লেন। হাতে ধরা খাতা যেন এখন সবচেয়ে মূল্যবান সূত্র। কিন্তু তিনি জানেন, এই খাতার জন্য তাঁকে আরেকটা অদৃশ্য শত্রুর মুখোমুখি হতে হবে।
তিনি করিডর থেকে বেরিয়ে উপরে উঠলেন। বাইরে তখনো কুয়াশা ভাসছে। পুলিশ ভিড় সরিয়ে রেখেছে। অর্জুন বাইরে বের হতেই অফিসার মিত্র দৌড়ে এলেন।
“স্যার, বাইরে একটা খবর এসেছে। সুদীপ্ত মল্লিকের বাসায় নাকি একটা চিঠি এসেছে। সেখানে শুধু লেখা আছে—‘তুমি সত্যকে আড়াল করতে পারবে না।’”
অর্জুন খাতাটা শক্ত করে ধরলেন। মনে মনে ভাবলেন—
“এটা নিছক নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা নয়। এটা শুরু হচ্ছে এক গভীর ষড়যন্ত্রের। আর সেই ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু—‘রাজবাড়ি’। হয়তো সেই অজানা দুর্গ, হয়তো কোনো পুরনো অভিশাপ।”
আকাশে তখনো কুয়াশা ঝুলছে, কিন্তু অর্জুনের চোখে জ্বলছে নতুন এক আগুন। এখন তাঁর লক্ষ্য—“রাজবাড়ি ষড়যন্ত্র” নামক ইতিহাসের পর্দা সরানো।
পর্ব ৩: রাজবাড়ির ছায়া
রাত দশটা বাজে। অর্জুন রায় বসে আছেন নিজের ফ্ল্যাটে, টেবিলের উপর ছড়িয়ে রেখেছেন সেই লাল খাতা। ঘর নীরব, শুধু জানলার বাইরের কুয়াশা-ঢাকা আলোর দপদপানি এসে পড়ছে ভেতরে। তিনি প্রতিটি লাইন মন দিয়ে পড়ছিলেন। সুদীপ্ত মল্লিক যেন মৃত্যুর আগে নিজের ডায়েরিতে ভবিষ্যতের ছায়া এঁকে গেছেন।
খাতায় লেখা—
“রাজবাড়ি ষড়যন্ত্র সেই সময়কার, যখন ব্রিটিশরা বাংলার রাজবংশদের একে একে ভেঙে দিচ্ছিল। এক রাজপরিবারের সম্পদ আর গোপন চিঠি নিয়ে লড়াই হয়েছিল। সেই চিঠিতে নাকি এমন এক সত্য লুকানো আছে, যা গোটা ইতিহাস বদলে দিতে পারে।”
অর্জুন টেবিলে হাত রাখলেন। মনের ভেতর কৌতূহলের সঙ্গে সঙ্গে একটা অদ্ভুত শীতলতা ছড়িয়ে পড়ছিল। কে সেই শক্তি, যে আজও সেই পুরনো ‘রাজবাড়ি ষড়যন্ত্র’-এর সূত্র খুঁজছে? কেন সুদীপ্তকে টেনে নিয়ে যাওয়া হলো?
তিনি ডায়েরির ভেতর আরেকটা সূত্র খুঁজে পেলেন। কয়েকটা পাতায় বারবার এক নাম এসেছে—“মহাস্থান রাজবাড়ি।” জায়গাটা তিনি চিনতে পারলেন না। বই বের করে মানচিত্র ঘাঁটলেন। খুঁজে পেলেন—পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে আছে মহাস্থান নামে একটি ধ্বংসপ্রায় রাজবাড়ি।
অর্জুন জানলেন, এবার তাঁকে সেখানেই যেতে হবে।
পরদিন সকালে তিনি বেরিয়ে পড়লেন। গাড়িতে বসে যাচ্ছিলেন নদীয়ার দিকে। শীতের কুয়াশা তখনো মাটির উপর চাদরের মতো বিছিয়ে আছে। রাস্তার ধারে ঝুপড়ি ঘর, ভাঙা মন্দির, গাছপালার ফাঁক দিয়ে ভেসে আসা গ্রামীণ সুর—সব মিলিয়ে এক অন্য আবহ।
অফিসার মিত্র গাড়ির সঙ্গে ছিল। সে বলল—
“স্যার, শুনেছি ওই রাজবাড়ি নিয়ে নাকি অনেক ভূতের গল্পও প্রচলিত আছে। গ্রামবাসীরা রাতে ওখানে যেতেই ভয় পায়।”
অর্জুন হালকা হেসে উত্তর দিলেন—
“ভূত থাকুক বা না থাকুক, আমি জানি ইতিহাসের অদৃশ্য ছায়া কিন্তু অনেক সময় ভূতের থেকেও ভয়ঙ্কর।”
দুপুর নাগাদ তারা পৌঁছল মহাস্থান গ্রামে। গ্রামটা যেন সময়ের ফাঁদে আটকে আছে। ভাঙা কাঁচা রাস্তা, কাদায় ভরা খাল, আর দূরে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল ভগ্ন রাজবাড়ি। লাল ইটের প্রাচীর ভেঙে গেছে, জানলার কাঠ ভেঙে ঝুলে পড়েছে। তবু তার মধ্যে অদ্ভুত এক গাম্ভীর্য।
গ্রামের লোকজন দূর থেকে চোরাচোখে তাকিয়ে থাকল। একজন বৃদ্ধ এগিয়ে এসে বললেন—
“বাবু, আপনারা ওদিকে যাবেন না। ওই রাজবাড়িতে গেলে মানুষ আর ফেরে না।”
অর্জুন শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন—
“কেন?”
বৃদ্ধ ধীরে বললেন—
“ওই রাজবাড়িতে রাত হলেই আলো জ্বলে ওঠে। অথচ ভেতরে কেউ থাকে না। মাঝে মাঝে কান্নার আওয়াজ শোনা যায়। আমার বাবা বলতেন, ব্রিটিশরা এখানে এক রাজপুত্রকে খুন করেছিল। সেই অভিশাপ আজও আছে।”
অর্জুন ভ্রূ তুলে বললেন—
“অভিশাপ নয়, হয়তো ষড়যন্ত্র। আর সেই ষড়যন্ত্রের ছায়ায় আজও কেউ খেলছে।”
বিকেলের দিকে তিনি রাজবাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলেন। মিত্র সঙ্গে গেল না, বাইরে দাঁড়িয়ে রইল ভয় পেয়ে। অর্জুন টর্চ হাতে একা এগোতে লাগলেন।
ভেতরে ঢুকতেই চারপাশে অন্ধকার, ভাঙা স্তম্ভ আর ঝুলে থাকা মাকড়সার জাল। বাতাসে ধুলো আর বাদুড়ের ডানার শব্দ। অদ্ভুত নীরবতার মাঝে হঠাৎ টর্চের আলোয় দেখা গেল দেওয়ালে আঁকা পুরনো রাজপরিবারের প্রতিকৃতি। ছবিগুলোতে চোখ যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে।
হঠাৎ মেঝেতে পড়ে থাকা একটা লোহার বাক্সে চোখ গেল। বাক্সটা মরচে ধরা, তবু তালা খোলা। ভেতরে আছে কিছু হলদেটে চিঠি।
অর্জুন একটা চিঠি খুললেন। তাতে ইংরেজিতে লেখা—
“Whoever finds this letter, remember—truth must be hidden for the empire to survive.”
(“যে-ই এই চিঠি খুঁজে পাবে, মনে রেখো—সত্যকে গোপন করতেই হবে সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার জন্য।”)
চিঠির নিচে স্বাক্ষর—“Lt. Col. Henry Smith, 1857।”
অর্জুনের চোখ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। এ যেন সত্যিই বিপ্লবের সময়কার কোনো ব্রিটিশ অফিসারের স্বাক্ষরিত দলিল। আর এই দলিল প্রমাণ করতে পারে, ব্রিটিশরা ইতিহাসের কোনো সত্যকে জোর করে আড়াল করেছিল।
ঠিক তখনই পিছন থেকে হঠাৎ একটা শব্দ। কে যেন ফিসফিস করে বলল—
“সত্যকে জানলেই মৃত্যু আসবে।”
অর্জুন ঘুরে দাঁড়ালেন। অন্ধকারের ভেতর এক ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। টর্চের আলো ফেলতেই দেখা গেল কালো চাদরে ঢাকা এক মানুষ, মুখ ঢাকা কাপড়ে।
অর্জুন শান্ত গলায় বললেন—
“তুমি কে? সুদীপ্ত মল্লিক কোথায়?”
ছায়ামূর্তির গলা শোনা গেল—
“অধ্যাপক এখন আমাদের হাতে। তিনি যে গোপন সত্য আবিষ্কার করেছিলেন, তা কেউ জানতে পারবে না। আর তুমি যদি বেশি খোঁজ করো, তুমিও অদৃশ্য হবে।”
বলে ছায়ামূর্তি হঠাৎ করিডরের ভেতরে মিলিয়ে গেল।
অর্জুন দ্রুত দৌড়ে গেলেন, কিন্তু ফাঁকা করিডর ছাড়া আর কিছু পেলেন না। যেন মানুষটা অদৃশ্য হয়ে গেল।
তিনি ফিরে এসে দেখলেন চিঠির বাক্স অদৃশ্য। কারো হাতে সেটা তুলে দেওয়া হলো, যাতে প্রমাণ আর পাওয়া না যায়।
বাইরে এসে দেখলেন অফিসার মিত্র কাঁপতে কাঁপতে অপেক্ষা করছে।
“স্যার, আমি ভেতরে আসিনি, কিন্তু হঠাৎ দেখলাম রাজবাড়ির এক জানলায় আলো জ্বলে উঠল। ওখানে কি কেউ আছে?”
অর্জুন দৃঢ় গলায় বললেন—
“হ্যাঁ, আছে। এমন কেউ, যে ইতিহাসকে চুরি করতে চায়। আর সেই শক্তিই সুদীপ্ত মল্লিককে বন্দি করেছে।”
তিনি জানলেন, খেলা এখন আরও গভীর হয়েছে। রাজবাড়ির অদৃশ্য ছায়ার সঙ্গে এখন তাঁকে মুখোমুখি হতে হবে।
সেই রাতে অর্জুন গ্রামে থেকে গেলেন। চারপাশ অন্ধকার, দূরে রাতের পেঁচার ডাক। খাতার পাতায় বারবার চোখ বোলাচ্ছিলেন। সুদীপ্ত লিখেছিলেন—
“সত্যকে রক্ষা করতে গেলে মৃত্যুকে বরণ করতে হবে।”
অর্জুন মনে মনে বললেন—
“আমি মৃত্যুকে ভয় করি না। কিন্তু আমি ইতিহাসকে মিথ্যার হাতে যেতে দেব না।”
চোখে ভেসে উঠল সেই ছায়ামূর্তি আর তার কথা—“অধ্যাপক আমাদের হাতে।”
অর্জুন জানলেন, এবার তাঁকে খুঁজে বের করতেই হবে সেই অদৃশ্য সংগঠনকে, যারা ‘রাজবাড়ি ষড়যন্ত্র’-এর ছায়া টিকিয়ে রেখেছে আজও।
পর্ব ৪: অদৃশ্য সংগঠন
সকালের কুয়াশা তখনও পুরোপুরি কাটেনি। মহাস্থান গ্রামের ধূলোভরা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন অর্জুন রায়। সারারাত তিনি রাজবাড়ির চারপাশে ঘুরেছেন, খাতার পাতাগুলো আবার পড়েছেন, কিন্তু মনের মধ্যে প্রশ্নগুলো আরও ঘন হয়ে উঠেছে। কে এই অদৃশ্য শক্তি, যারা “রাজবাড়ি ষড়যন্ত্র” আজও টিকিয়ে রেখেছে? আর তারা কেন একজন ইতিহাসের অধ্যাপককে বন্দি করেছে?
গ্রামের চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলেন তিনি। দোকানদার ভীত কণ্ঠে বলল—
“বাবু, কাল রাতে রাজবাড়িতে আলো জ্বলেছিল। আমরা কেউ ওদিকে যাই না। তবে শুনেছি ওখানে এক দল লোক গোপনে মিটিং করে। তারা নিজেদের ‘সংঘ’ বলে ডাকে।”
অর্জুন তাকালেন।
“সংঘ? কেমন সংঘ?”
দোকানদার মাথা নাড়ল।
“কেউ জানে না কারা তারা। শুধু শোনা যায়, রাতের বেলা তারা কালো কাপড় পরে বেরোয়। যাদের চোখে ধরা পড়ে, তারা আর গ্রামে থাকে না।”
অর্জুনের মনে হল, এই ‘সংঘ’-ই হয়তো সেই অদৃশ্য সংগঠন। আর তাদের হাতেই বন্দি সুদীপ্ত মল্লিক।
দুপুর নাগাদ তিনি রাজবাড়ির চারপাশ আবার ঘুরছিলেন। হঠাৎ দূরে এক ছায়া দেখতে পেলেন—একজন কিশোর তাঁকে ইশারা করছে। অর্জুন এগিয়ে গেলেন।
কিশোর বলল—
“আপনি যদি অধ্যাপক মল্লিককে খুঁজছেন, তবে আজ রাতে দক্ষিণ দিকের ভাঙা ফটক দিয়ে ঢুকবেন। কিন্তু সাবধান, তারা আপনাকে দেখতে পেলে বাঁচবেন না।”
অর্জুন কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ছেলেটা দৌড়ে মিলিয়ে গেল। যেন ছায়া থেকে ছায়ায় চলে গেল।
তিনি গভীর শ্বাস নিলেন। এর মানে স্পষ্ট—অধ্যাপক এখনো জীবিত। আর আজ রাতে তাঁকে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে।
রাত নামতেই অর্জুন আবার রাজবাড়ির দিকে গেলেন। এবার মিত্রও সাহস করে সঙ্গে গেল। দুজনেই অন্ধকারে মশাল না জ্বেলে এগোলেন। দক্ষিণ দিকের ভাঙা ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল ভাঙা সিঁড়ি, শুকনো পাতার শব্দ, আর দূরে অদ্ভুত আলো।
তারা আস্তে আস্তে এগোতে লাগলেন। রাজবাড়ির ভেতরে একটা বড় হলঘর। ভেতরে বসে আছে প্রায় দশজন কালো চাদর পরা লোক। মাঝখানে টেবিলের উপর রাখা লাল কাপড় ঢাকা কিছু কাগজ। চারপাশে মশালের আলোয় তাদের মুখ পরিষ্কার বোঝা যায় না।
তাদের নেতা দাঁড়িয়ে বলল—
“আমাদের সংগঠন একশো বছরের পুরনো। ব্রিটিশরা চলে গেছে, কিন্তু আমরা রয়ে গেছি ইতিহাস রক্ষার জন্য। সত্য যদি প্রকাশ পায়, আমাদের অস্তিত্ব থাকবে না। তাই চিঠি, দলিল, খাতা—সবকিছু ধ্বংস করতে হবে।”
অর্জুন ছায়ার আড়াল থেকে শুনছিলেন। হঠাৎ টেবিলের পাশে চোখে পড়ল বাঁধা একজন মানুষ। মুখে কাপড়, হাত বাঁধা। তিনি আর কেউ নন—অধ্যাপক সুদীপ্ত মল্লিক।
অর্জুন মিত্রকে ফিসফিস করে বললেন—
“অধ্যাপককে উদ্ধার করতেই হবে। কিন্তু সরাসরি ঝাঁপালে বিপদ।”
ঠিক তখনই একজন কালো চাদর পরা লোক হঠাৎ উঠে বলল—
“আমাদের ভেতরে একজন গুপ্তচর আছে। সে তথ্য বাইরে ফাঁস করছে।”
সবাই চমকে উঠল। নেতা গম্ভীর গলায় বলল—
“যদি তাকে ধরা না যায়, আজ রাতেই সংগঠন ভেঙে পড়বে।”
অর্জুন বুঝলেন, সেই কিশোর হয়তো সত্যিই তাদের ভেতরের কেউ ছিল, যে বাইরে তথ্য পৌঁছে দিয়েছে।
হঠাৎ তাঁর চোখ পড়ল টেবিলের উপর রাখা লাল কাপড় ঢাকা কাগজের দিকে। সেটা খুলে দেখা গেল একটি নীল নকশা—রাজবাড়ির ভেতরে ভূগর্ভস্থ পথের মানচিত্র। মানচিত্রে এক জায়গায় লাল কালি দিয়ে লেখা—“চূড়ান্ত গোপন চিঠি।”
অর্জুনের বুক ধক করে উঠল। এটাই সেই দলিল, যার জন্য এই ষড়যন্ত্র।
ঠিক তখনই হঠাৎ পিছন থেকে এক লোকের হাত পড়ে তাঁর কাঁধে। কালো কাপড় পরা। অর্জুন মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়িয়ে লোকটিকে মাটিতে ফেলে দিলেন। শব্দে ঘরের সবাই চমকে গেল। মশাল হাতে তারা ছুটে এল।
“কে?”—নেতার গলা কাঁপল।
অর্জুন সামনে এসে দাঁড়ালেন। চোখে ঠান্ডা দৃঢ়তা।
“আমি অর্জুন রায়। সত্যের খোঁজে এসেছি।”
ঘরে এক মুহূর্ত নিস্তব্ধতা। তারপর নেতা ধীরে ধীরে বলল—
“তাহলে তুমি-ই সেই গোয়েন্দা। জানো তো, এখানে ঢুকলে কেউ জীবিত ফেরে না?”
অর্জুন হালকা হাসলেন।
“আমিও জানি, সত্যকে চিরকাল ঢেকে রাখা যায় না।”
তারপর মুহূর্তেই ঘরে লড়াই শুরু হলো। কালো চাদর পরা লোকেরা ঝাঁপিয়ে পড়ল। অর্জুন দক্ষতায় এদিক-ওদিক এড়িয়ে গেলেন, ঘুষি মারলেন, মশাল ফেলে দিলেন। মিত্রও সাহায্য করছিল।
গোলমালের মধ্যে হঠাৎ টেবিল উলটে গেল, মানচিত্র ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। অর্জুন দ্রুত সেটা কুড়িয়ে নিলেন।
তিনি চিৎকার করে বললেন—
“মিত্র! অধ্যাপককে মুক্ত করো!”
মিত্র দৌড়ে গিয়ে সুদীপ্ত মল্লিকের বাঁধন খুলে দিল। অধ্যাপক হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন—
“তাড়াতাড়ি পালাও! তারা আমাদের মারবে।”
অর্জুন দৃঢ় গলায় বললেন—
“না, এখন পালালে চলবে না। সত্যকে লুকিয়ে রাখা মানচিত্র আমাদের হাতে এসেছে। এটাই তাদের ভয়।”
অবশেষে পুলিশের সাইরেন বেজে উঠল। বাইরে অপেক্ষায় থাকা ফোর্স ভেতরে ঢুকে পড়ল। লড়াই আরও বেড়ে গেল। কালো চাদর পরা কয়েকজন পালিয়ে গেল অন্ধকার পথে। কিন্তু নেতাকে ধরা গেল না। সে অদৃশ্য হয়ে গেল করিডরের ভেতরে।
অধ্যাপক কাঁপা গলায় বললেন—
“ওরা আমাকে বলেছিল, রাজবাড়ির ভেতরে যে গোপন চিঠি আছে, সেটা যদি কেউ প্রকাশ করে, তবে অনেক ক্ষমতাবান লোক ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই তারা আমাকে চুপ করাতে চেয়েছিল।”
অর্জুন মানচিত্রের দিকে তাকালেন। সেখানে চিহ্নিত সেই জায়গা—ভূগর্ভস্থ এক গোপন কক্ষ।
তিনি দৃঢ় স্বরে বললেন—
“আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য সেই কক্ষ। সত্য লুকিয়ে আছে ওখানেই।”
সকালের প্রথম আলো তখন পূর্ব দিগন্তে উঠছে। রাজবাড়ির উপর কুয়াশা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। অথচ রহস্য আরও ঘন হয়ে উঠছে।
অর্জুন জানলেন, এখনো খেলা শেষ হয়নি। সত্যিকারের যুদ্ধ শুরু হবে ভূগর্ভস্থ কক্ষে, যেখানে হয়তো লুকানো আছে শতবর্ষের দলিল—“শেষ চিঠি।”
পর্ব ৫: ভূগর্ভস্থ কক্ষ
ভোরের আলোয় মহাস্থান রাজবাড়ির ভগ্ন দেয়াল যেন রক্তিম আভা ছড়িয়ে দিয়েছে। চারপাশে কাকের ডাক, গাছের ডালে ঝুলে থাকা কুয়াশা আর মাটির গন্ধে ভরে আছে বাতাস। অর্জুন রায়, অফিসার মিত্র আর অধ্যাপক সুদীপ্ত মল্লিক দাঁড়িয়ে আছেন রাজবাড়ির আঙিনায়। রাতের লড়াইয়ের ধুলো তখনও পুরোপুরি স্তব্ধ হয়নি। পুলিশের কয়েকজন ভেতরে পাহারা দিচ্ছে, তবে অর্জুন জানেন—যতক্ষণ না গোপন কক্ষের রহস্য ভেদ হচ্ছে, ততক্ষণ খেলা শেষ নয়।
তিনি মানচিত্রটা মেলে ধরলেন। পুরনো কাগজ, জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া। তাতে স্পষ্ট আঁকা আছে রাজবাড়ির ভূগর্ভস্থ পথের নকশা। এক জায়গায় লাল কালি দিয়ে গোল করে লেখা—“শেষ কক্ষ।”
অর্জুন ফিসফিস করে বললেন—
“সত্যিকারের রহস্য লুকিয়ে আছে এই কক্ষে।”
অধ্যাপক মল্লিক কাঁপা গলায় উত্তর দিলেন—
“ওরা আমায় ওই কক্ষ নিয়ে যেতে চেয়েছিল। বলেছিল, ভেতরে এমন কিছু আছে যা যদি প্রকাশ পায়, তবে ইতিহাস নতুন করে লেখা হবে। কিন্তু আমায় দেখাতে দেয়নি। শুধু বলেছিল, সেটা ‘শেষ চিঠি’।“
অর্জুন চোখ সরু করলেন।
“তাহলে চলুন, এবার আমরা নিজেরাই সেই কক্ষের দরজা খুলব।”
রাজবাড়ির পশ্চিম দিক দিয়ে একটা সরু করিডর নেমে গেছে নিচের দিকে। দরজাটা ভাঙা, কিন্তু ভেতরে অন্ধকার গহ্বর। মশাল জ্বেলে তিনজন নামতে লাগলেন।
ভেতরে ঢুকতেই মাটির স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ, ভাঙা ইট আর ঝুলে থাকা বাদুড়। দেওয়ালের গায়ে শেওলা, জায়গায় জায়গায় ব্রিটিশ আমলের ইটের গাঁথুনি। মিত্র কাঁপতে কাঁপতে বলল—
“স্যার, এখানে তো মনে হচ্ছে কবরস্থানের মতো।“
অর্জুন ঠান্ডা গলায় বললেন—
“কবর নয়, ইতিহাসের ভান্ডার।”
করিডরের শেষ মাথায় পৌঁছে তারা দেখতে পেল এক বিশাল লোহার দরজা। মরচে ধরা, কিন্তু এখনো অটুট। দরজার উপর খোদাই করা—
“যে সত্য জানবে, সে রক্ত দেবে।”
অধ্যাপক আঁতকে উঠলেন।
“এটা তো সতর্কবার্তা!”
অর্জুন বললেন—
“এটাই তাদের ফাঁদ। কিন্তু এর পেছনেই সত্য।”
তিনি হাত দিয়ে দরজাটা ঠেললেন। দরজা নড়ল না। তারপর টর্চের আলো ফেলতেই দেখা গেল পাশে ছোট একটা গর্ত, যেখানে রাখা আছে একটা মরচে ধরা চাবি।
চাবিটা ঘুরিয়ে দরজা খুলতেই ভেতর থেকে ধুলো আর বাতাসের ঝাপটা বেরিয়ে এল। তারা ভেতরে ঢুকল।
ভেতরে একটা বিশাল কক্ষ। দেওয়ালে মশাল ধরতেই দেখা গেল চারদিকে পুরনো কাঠের আলমারি, ধুলো ধরা বই, ছেঁড়া দলিল। মাঝখানে একটি পাথরের টেবিল। টেবিলের উপর রাখা আছে একটি লোহার বাক্স।
অর্জুন বাক্সটা পরীক্ষা করলেন। তালা নেই, তবে ঢাকনা ভারী। তিনি ধীরে ধীরে খুললেন।
ভেতরে একটা খাম। পুরনো হলুদ কাগজে মোড়া। খামের উপর লেখা—“The Last Letter – 1857।”
অর্জুন খাম খুললেন। ভেতরে একটি মাত্র কাগজ। কাগজে ইংরেজি হরফে লেখা—
“On this day, we the officers of the East India Company confess:
We betrayed the princes of Bengal, we looted their treasures,
and we silenced their voices.
But one truth we could never erase—
that India shall rise again, and the empire shall fall.”
(“আজকের দিনে আমরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিসাররা স্বীকার করছি:
আমরা বাংলার রাজপুত্রদের বিশ্বাসঘাতকতা করেছি, তাদের ধনসম্পদ লুট করেছি,
তাদের কণ্ঠরোধ করেছি।
কিন্তু একটি সত্য আমরা কোনোদিন মুছে ফেলতে পারিনি—
ভারত আবার উঠবে, আর সাম্রাজ্য পতন হবে।”)
কাগজটা পড়তে পড়তে অধ্যাপকের চোখে জল এসে গেল।
“এটাই সেই দলিল… এটাই প্রমাণ করে ব্রিটিশরা নিজেদের অপরাধ স্বীকার করেছিল। কিন্তু তারা এই চিঠি আড়াল করে রেখেছিল, যাতে ইতিহাসের বইতে কখনো না আসে।”
অর্জুন ধীরে মাথা নাড়লেন।
“তাহলে এটিই ‘শেষ চিঠি’। কিন্তু প্রশ্ন হল—আজকের দিনে কারা চায় এই সত্য লুকিয়ে রাখতে?”
ঠিক তখনই কক্ষের ভেতর প্রতিধ্বনি হয়ে উঠল এক গলা।
“আমরাই।”
তিনজন ঘুরে তাকালেন। দরজার মুখে দাঁড়িয়ে আছে কালো চাদর পরা সেই নেতা। হাতে বন্দুক, চোখে অদ্ভুত ঝলক।
“এই চিঠি যদি বাইরে যায়, তবে আমাদের সংগঠন ধ্বংস হয়ে যাবে। একশো বছর ধরে আমরা ইতিহাসকে পাহারা দিয়েছি। আজ তুমি সেটাকে শেষ করতে চাইছ?”
অর্জুন শান্ত গলায় বললেন—
“তুমি পাহারা দাওনি, তুমি মিথ্যাকে রক্ষা করেছ। ইতিহাস সত্য চায়, মিথ্যা নয়।”
নেতা বন্দুক তুলল।
“তাহলে আজ এখানেই তোমার শেষ।”
অর্জুন মুহূর্তে টেবিলের উপর থেকে ধুলোভরা একটা বই ছুড়ে মারলেন নেতার হাতে। বন্দুক গড়িয়ে পড়ল। মিত্র সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে নেতাকে ধরে ফেলল।
কক্ষের ভেতর আবার নীরবতা নেমে এল।
অধ্যাপক মল্লিক চিঠিটা বুকের কাছে চেপে ধরলেন।
“অর্জুনবাবু, আপনি জানেন না এই দলিলের মূল্য কত। এটা শুধু ইতিহাস নয়, এটা একটা জাতির আত্মসম্মান।”
অর্জুন ধীরে বললেন—
“আমি জানি। তাই আমি এটাকে আদালতের হাতে তুলে দেব। সত্যের জায়গা বইতে, আদালতে—অন্ধকার কক্ষে নয়।”
রাজবাড়ির বাইরে তখন সকাল হয়ে গেছে। পাখির ডাক, গ্রামের লোকজনের ভিড়। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। পুলিশ নেতাকে নিয়ে যাচ্ছে।
অর্জুন, অধ্যাপক আর মিত্র দাঁড়িয়ে আছেন রাজবাড়ির ফটকে। হাতে সেই ‘শেষ চিঠি’।
অর্জুন মনে মনে ভাবলেন—
“একটা রহস্য ভেদ হলো। কিন্তু খেলা এখানেই শেষ নয়। কারণ সংগঠনের আরও লোক বাইরে আছে। তারা চুপ থাকবে না।”
সন্ধ্যায় কলকাতায় ফেরার সময় ট্রেনে বসে অধ্যাপক হঠাৎ বললেন—
“অর্জুনবাবু, আপনি কি খেয়াল করেছেন? মানচিত্রে আরও একটি দাগ ছিল। রাজবাড়ির বাইরে, গ্রামের এক প্রাচীন মন্দিরের নিচে। হয়তো সেখানেও কিছু লুকোনো আছে।”
অর্জুন টেবিলে হাত রাখলেন। চোখে অদ্ভুত দৃঢ়তা।
“তাহলে রহস্য এখনো শেষ হয়নি। সত্যের আরেকটা স্তর খুলতে বাকি।”
ট্রেনের জানলার বাইরে অন্ধকার নামছিল। দূরে আলো ঝলমল করছিল। আর সেই আলো-অন্ধকারের ভেতর যেন ভেসে উঠছিল নতুন এক ষড়যন্ত্রের ছায়া।
পর্ব ৬: মন্দিরের গোপন পথ
ট্রেন যখন হাওড়া পৌঁছল, রাত তখন অনেক। শহরের কোলাহল, বাতাসে ধোঁয়ার গন্ধ, মানুষের চিৎকার—সবই যেন মহাস্থানের রাজবাড়ির অদ্ভুত নীরবতার বিপরীত। কিন্তু অর্জুন রায়ের চোখে একটাই চিন্তা ঘুরছে—মানচিত্রে থাকা দ্বিতীয় চিহ্ন।
অধ্যাপক মল্লিক বারবার বলছিলেন—
“অর্জুনবাবু, মহাস্থান গ্রামের দক্ষিণে পুরনো বিষ্ণুমন্দির আছে। মানচিত্রে সেই মন্দিরের নিচেই চিহ্ন করা ছিল। আমি বিশ্বাস করি, ‘শেষ চিঠি’ শুধু শুরু, আসল রহস্য হয়তো ওখানেই লুকিয়ে আছে।”
অর্জুন সংক্ষিপ্তভাবে উত্তর দিলেন—
“তাহলে আমরা আবার ফিরব। তবে এবার প্রস্তুতি নিয়ে।”
পরদিন ভোরে তারা আবার মহাস্থান রওনা হলেন। সঙ্গে ছিল পুলিশের ছোট দল। অফিসার মিত্র ভেবেছিল রাতের ঘটনার পর হয়তো সব শেষ, কিন্তু অর্জুনের চোখের দৃঢ়তা দেখে বুঝল—এখনও আসল খেলাটা শুরু হয়নি।
গ্রামে পৌঁছেই তারা মন্দিরের পথে হাঁটল। পথটা কাঁচা, দু’পাশে তাল আর খেজুরগাছ। শীতের কুয়াশায় মন্দিরটা দূর থেকে অদ্ভুত লাগছিল—কালো পাথরের গায়ে ফাটল, ছাদের অংশ ভেঙে পড়েছে। গ্রামবাসীরা দূরে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করছিল, কিন্তু কেউ কাছে আসেনি।
একজন বৃদ্ধা কাঁপা গলায় বলল—
“ওই মন্দিরে ভূত আছে। রাতে অদ্ভুত আলো জ্বলে। আমাদের পূর্বপুরুষরা বলে গেছেন, ব্রিটিশরা এখানে রক্ত ঝরিয়েছিল।”
অর্জুন থেমে একবার তাকালেন।
“ভূত নয়, ইতিহাসের ছায়া। আর সেই ছায়ার ভেতরে লুকিয়ে আছে সত্য।”
মন্দিরের ভেতরে ঢুকতেই বাতাস ভারী হয়ে গেল। ভাঙা মূর্তি, দেওয়ালে শেওলা, মাটিতে শুকনো পাতা। কিন্তু অর্জুনের চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছিল মানচিত্রের সঙ্গে মিল। মেঝের মাঝখানে এক অদ্ভুত দাগ চোখে পড়ল। বর্গাকার পাথরের ফাঁক, যেন নীচে ফাঁপা কিছু আছে।
তিনি মশাল নিয়ে মেঝেতে টোকা দিলেন। ফাঁপা আওয়াজ ভেসে এল।
“এখানেই দরজা।”
কয়েকজন পুলিশ মিলে পাথর সরাল। নীচে দেখা গেল এক সরু সিঁড়ি নামছে অন্ধকারে। বাতাসে পচা গন্ধ, যেন বহু পুরনো কিছু লুকিয়ে আছে।
অধ্যাপক মল্লিক ভয়ে থরথর করছিলেন, কিন্তু অর্জুন শান্ত স্বরে বললেন—
“চলুন। সত্যের পথে ভয়কে থামানো যায় না।”
সিঁড়ি বেয়ে নেমে তারা পৌঁছল এক লম্বা করিডরে। দেওয়ালে টর্চ ফেলতেই দেখা গেল অদ্ভুত কিছু খোদাই—সৈন্যদের ছবি, তলোয়ার, আগুন, আর শিকল বাঁধা মানুষ। অধ্যাপক স্তব্ধ হয়ে গেলেন।
“এগুলো তো ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের প্রতীক! মনে হচ্ছে বিদ্রোহীদের এখানে বন্দি রাখা হয়েছিল।”
করিডরের শেষে তারা পেল এক কাঠের দরজা। দরজার উপরে ইংরেজি আর বাংলায় লেখা—
“সত্যকে যিনি রক্ষা করবেন, তিনি মৃত্যুকে চিনবেন না।”
অর্জুন দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন।
ভেতরে ছোট এক কক্ষ। মশালের আলোয় দেখা গেল পাথরের চৌকি। চৌকির উপর একটা বাক্স। বাক্সটা খোলতেই তারা অবাক—ভেতরে ছড়ানো সোনার মুদ্রা, কয়েকটা ব্রিটিশ অফিসারের মেডেল, আর একগুচ্ছ চিঠি।
অর্জুন একটা চিঠি খুললেন। ইংরেজিতে লেখা—
“Confidential: We, the members of the secret order, vow to guard the truth of Bengal’s betrayal.
If exposed, it will destroy not only the empire but also those who came after us.”
(“গোপনীয়: আমরা, গোপন সংঘের সদস্যরা, অঙ্গীকার করছি বাংলার বিশ্বাসঘাতকতার সত্যকে পাহারা দেব। যদি তা প্রকাশ পায়, তবে শুধু সাম্রাজ্যই নয়, আমাদের উত্তরসূরীরাও ধ্বংস হয়ে যাবে।”)
অর্জুন গম্ভীর গলায় বললেন—
“তাহলে বোঝা গেল—এই গোপন সংঘ ব্রিটিশ আমলে তৈরি হয়েছিল। আর আজও তাদের উত্তরসূরীরা বেঁচে আছে। তারাই অধ্যাপককে অপহরণ করেছিল।”
অধ্যাপক মল্লিক হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন—
“দেখুন! ওই কোণে আরেকটা বাক্স আছে।”
বাক্সটা ছোট, লাল কাপড়ে ঢাকা। খুলতেই ভেতরে একটা চামড়ার খাতার মতো জিনিস। প্রথম পাতায় লেখা—“রাজবাড়ি ষড়যন্ত্র: আসল দলিল।”
তারা পাতা উল্টাল। ভিতরে হাতের লেখা, বাংলায়। পড়তে পড়তে অধ্যাপক থমকে গেলেন।
“এটা তো… এটা রাজবাড়ির শেষ রাজপুত্রের লেখা!”
খাতায় লেখা—
“আমাদের মধ্যে কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ব্রিটিশদের হাতে সব সত্য তুলে দিয়েছে। আমরা হারাচ্ছি সবকিছু। যদি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই খাতা পায়, তবে জেনে নেবে, বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের ভেতর থেকেই এসেছিল।”
অর্জুন চোখ সরু করলেন।
“মানে, কেবল ব্রিটিশরা নয়, ভারতীয়দের ভেতর থেকেও কেউ তাদের সাহায্য করেছিল। সেই নামটা যদি প্রকাশ পায়, তবে হয়তো আজও অনেক পরিবার ধ্বংস হবে।”
ঠিক তখনই হঠাৎ কক্ষের বাইরে শব্দ হলো। মশালের আলোয় ছায়া দেখা গেল। কালো চাদর পরা কয়েকজন লোক দৌড়ে আসছে।
অর্জুন দ্রুত খাতা বুকের কাছে চেপে ধরলেন।
“মিত্র! প্রস্তুত হও।”
দরজার ভেতরে ঢুকে পড়ল তিনজন কালো মুখোশধারী। হাতে ছুরি। তারা চিৎকার করে বলল—
“খাতা দাও! না হলে এখানেই মরবে।”
অর্জুন চোখে ঠান্ডা দৃঢ়তা নিয়ে দাঁড়ালেন।
“তাহলে আজ মৃত্যুই সত্যকে পাহারা দেবে।”
লড়াই শুরু হলো। অন্ধকার কক্ষে ছুরির ঝলক, মশালের আলোয় ছায়ার নাচন। অর্জুন একে একে দু’জনকে ফেলে দিলেন। মিত্র একজনকে ধরে ফেলল। বাকিরা পালাল অন্ধকার পথে।
অধ্যাপক মল্লিক ভয়ে কাঁপছিলেন।
“ওরা এত লোক… ওরা থামবে না। আমাদের মেরে ফেলবে।”
অর্জুন শান্ত গলায় উত্তর দিলেন—
“যারা মিথ্যার পাহারা দেয়, তারা একদিন নিজেরাই অন্ধকারে ডুবে যায়। কিন্তু সত্য আলোয় টিকে থাকে।”
ভোরের দিকে তারা কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলেন। হাতে সেই লাল খাতা। বাইরে সূর্য উঠছে, কিন্তু গ্রামের মানুষ দূর থেকে তাকিয়ে আছে আতঙ্কে।
অর্জুন জানেন, এই খাতা প্রকাশ করলে শুধু ইতিহাস নয়, সমাজের অনেক অজানা মুখোশ খুলে যাবে। হয়তো ক্ষমতাশালী পরিবারের নাম বেরিয়ে আসবে, যারা আজও প্রভাবশালী।
তিনি মনে মনে বললেন—
“এখন আসল যুদ্ধ শুরু হবে। এই খাতা আদালতে পৌঁছলে এক নতুন ঝড় উঠবে।”
দূরে রাজবাড়ির ধ্বংসপ্রাচীর দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেন ইতিহাস নিজেই চোখ মেলে তাকিয়ে আছে, অপেক্ষা করছে নতুন অধ্যায়ের জন্য।
পর্ব ৭: বিশ্বাসঘাতকের নাম
মহাস্থানের আকাশে শীতের কুয়াশা তখনও গড়িয়ে পড়ছে। ভোরের আলোতে ভেজা জমি ঝলমল করছে, কিন্তু অর্জুন রায়ের চোখে শান্তি নেই। হাতে ধরা লাল খাতা—“রাজবাড়ি ষড়যন্ত্রের আসল দলিল।”
অধ্যাপক মল্লিক উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন—
“অর্জুনবাবু, আপনি কি খেয়াল করেছেন? এই খাতার প্রতিটি পাতায় শুধু ইতিহাসের বর্ণনা নেই, আছে রক্তের গন্ধও। রাজপুত্র তাঁর মৃত্যুর আগে লিখে গেছেন, তাদের মধ্যে কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। আমি আশঙ্কা করছি, সেই নাম যদি প্রকাশ পায়, তবে আজকের সমাজে অনেক শক্তিশালী মানুষের মুখোশ খুলে যাবে।”
অর্জুন নীরবে মাথা নাড়লেন।
“সত্যি তাই। কিন্তু আমাদের কাজই হল মুখোশ খুলে ফেলা।”
তারা কলকাতায় ফিরে এলেন। শহরের ভিড়, ট্রামের ঘণ্টা, দোকানপাটের ভিড়ে কেউ টের পেল না, তিনজন মানুষের হাতে লুকিয়ে আছে এমন এক দলিল যা হয়তো ইতিহাস নতুন করে লিখে দিতে পারে।
অর্জুন নিজের ফ্ল্যাটে খাতাটা খুলে প্রতিটি লাইন মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলেন। এক জায়গায় তিনি থেমে গেলেন।
লিখা আছে—
“আমাদের মধ্যে যে বিশ্বাসঘাতক, তার নাম আমি লিখে যাচ্ছি। যদি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই খাতা খুঁজে পায়, তবে তারা জানবে—আমাদের পতনের আসল কারিগর একজন ভারতীয়, যিনি পরের প্রজন্মের হাতে ক্ষমতা তুলে দেবে। তাঁর নাম—”
এরপর হঠাৎ পাতা ছিঁড়ে গেছে। কেবল অর্ধেক অক্ষর ভেসে আছে—“শি…”
অর্জুন দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইলেন।
“শি… মানে কে? শিবনাথ? শিরোমণি? নাকি আরও কেউ?”
অধ্যাপক মল্লিক কাঁপা গলায় বললেন—
“এটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক রহস্য। বিশ্বাসঘাতকের নাম আড়াল করা হয়েছে। হয়তো ইচ্ছে করেই পাতা ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে।”
ঠিক তখনই দরজার ঘণ্টা বাজল। অফিসার মিত্র ঢুকল। তার হাতে কিছু খবর।
“স্যার, খোঁজ নিয়ে দেখেছি। মহাস্থান গ্রামের আশেপাশে এখনো কিছু প্রভাবশালী জমিদার পরিবার আছে। তাদের পূর্বপুরুষরা ব্রিটিশদের সঙ্গে কাজ করেছিল। সবচেয়ে বড় পরিবার হল শিবনারায়ণ পরিবার। তারা নাকি একসময় রাজবাড়ির ঘনিষ্ঠ ছিল।”
অর্জুনের চোখ সরু হল।
“শি… দিয়ে নাম শুরু। হতে পারে এটাই সূত্র।”
অধ্যাপক বললেন—
“মানে তাহলে আজও সেই পরিবারের বংশধরেরা আমাদের বিপদ ডেকে আনতে পারে?”
অর্জুন শান্ত গলায় উত্তর দিলেন—
“হতে পারে। আর এ কারণেই সংগঠন এত সক্রিয়। তারা চায় না, সেই নাম প্রকাশ পাক।”
পরদিন বিকেলে অর্জুন গোপনে গেলেন শিবনারায়ণ পরিবারের প্রাসাদে। বিশাল দোতলা বাড়ি, গেটের সামনে গাড়ি, ভিতরে আধুনিক আলোকসজ্জা। কিন্তু দেয়ালে এখনও পুরনো ব্রিটিশ আমলের ছবি ঝোলানো।
ভেতরে দেখা হল বর্তমান কর্তা—অশোক শিবনারায়ণ। বয়স প্রায় পঞ্চাশ, রাজনীতিতে সক্রিয়। হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালেন।
“আরে, বিখ্যাত গোয়েন্দা অর্জুন রায়! কী কারণে আমাদের বাড়িতে?”
অর্জুন ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকালেন।
“শুধু ইতিহাস নিয়ে জানতে এসেছি। আপনার পরিবার তো রাজবাড়ির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিল।”
অশোক হেসে উত্তর দিলেন—
“অবশ্যই। আমাদের পূর্বপুরুষরা রাজবাড়ির পাশে থেকেছেন। তবে বিশ্বাসঘাতকতার গল্প সব বানানো। আমরা দেশপ্রেমিক ছিলাম।”
অর্জুন কিছু বললেন না। শুধু চোখে অদ্ভুত হাসি ফুটল। তিনি জানেন, কেউ যদি মিথ্যা বলে, তাঁর চোখে ঝিলিক আলাদা হয়।
বেরোনোর সময় হঠাৎ প্রাসাদের ভেতরের গ্রন্থাগারে নজর পড়ল। সেখানে এক পুরনো দলিল খোলা ছিল টেবিলে। অর্জুন দূর থেকে দেখলেন পাতার কোণে লেখা—“1857, Mahasthaan.”
অশোক তাড়াতাড়ি বই বন্ধ করে ফেললেন।
“ওসব পুরনো কাগজ। কোনো মূল্য নেই।”
অর্জুন শুধু মাথা নাড়লেন। কিন্তু তাঁর মনে আরও নিশ্চিত হলেন—এই পরিবার কিছু লুকোচ্ছে।
সেদিন রাতে ফ্ল্যাটে ফেরার পর তিনি খাতার অর্ধেক শব্দটা নিয়ে আবার ভেবেছিলেন—“শি…”। এর সঙ্গে মিলে যাচ্ছে শিবনারায়ণ।
কিন্তু ঠিক তখনই জানলার বাইরে এক ছায়া দেখা গেল। অন্ধকারে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। অর্জুন দ্রুত আলো জ্বালালেন। ছায়াটা মিলিয়ে গেল। কিন্তু জানলার পাশে একটা কাগজ পড়ে রইল।
অর্জুন কাগজটা খুললেন। তাতে কালো কালিতে লেখা—
“তুমি সত্য জানবে না। অধ্যাপক তোমার পাশে থাকলেও, শেষতক সে-ই তোমাকে ধ্বংস করবে।”
অর্জুনের চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি জ্বলে উঠল।
“অধ্যাপক? মানে সুদীপ্ত মল্লিক? নাকি আমাকে ভুল পথে চালানো হচ্ছে?”
পরদিন সকালে অধ্যাপক মল্লিককে ডেকে বসলেন।
“অধ্যাপক, আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাই। এই খাতার পাতায় যে নাম আড়াল করা হয়েছে, আপনি কি আগে কখনো এ নিয়ে কিছু জানতেন?”
অধ্যাপক দ্বিধা নিয়ে বললেন—
“না, তবে আমার মনে হয়েছিল, রাজবাড়ির পতনের পেছনে কিছু অভ্যন্তরীণ বিশ্বাসঘাতক ছিল। হয়তো আমি বেশি কৌতূহল দেখিয়েছিলাম, তাই তারা আমায় বন্দি করেছিল।”
অর্জুন গভীরভাবে তাঁর চোখের দিকে তাকালেন।
“তাহলে কেন সেই নোটে লেখা হল, আপনিই আমাকে ধ্বংস করবেন?”
অধ্যাপক হতভম্ব হয়ে গেলেন।
“আমি? অসম্ভব!”
অফিসার মিত্র তখন হঠাৎ বলল—
“স্যার, একটা খোঁজ এসেছে। গতরাতে সংগঠনের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা বলছে, তাদের নেতা আরেকটা আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। লক্ষ্য—অধ্যাপক মল্লিক।”
অর্জুন এক মুহূর্তের জন্য নীরব থাকলেন। তারপর বললেন—
“অধ্যাপক, হয়তো আপনিই এখন তাদের সবচেয়ে বড় টার্গেট। কারণ আপনার কাছে সত্য আছে। আর সত্যকে আড়াল করতে তারা আবার আসবেই।”
রাত নামতেই কলকাতার রাস্তা ফাঁকা হয়ে গেল। কুয়াশা নেমে আসছে। অর্জুন ফ্ল্যাটে বসে খাতাটা পড়ছিলেন। বাইরে হঠাৎ গুলির শব্দ। জানলা ভেঙে ঢুকে পড়ল কালো মুখোশ পরা দু’জন লোক।
“খাতা দাও!”—চিৎকার করে উঠল তারা।
অর্জুন মুহূর্তে টেবিল উলটে দিলেন, খাতা লুকালেন। হাতাহাতি শুরু হল। এক লোককে মাটিতে ফেলে দিলেন, আরেকজন ছুরি চালাল। অর্জুন পাশ কাটিয়ে গেলেন। তখনই পুলিশ এসে ঢুকল। গোলাগুলির মধ্যে একজন মারা গেল, আরেকজন পালাল অন্ধকারে।
অফিসার মিত্র দৌড়ে এসে বলল—
“স্যার, এবার প্রমাণ হয়ে গেল। সংগঠন শেষ চেষ্টায় নেমেছে। তারা খাতা যেকোনো দামে দখল করবে।”
অর্জুন ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকালেন। রাত তখন বারোটা।
“আজ থেকে সময় আমাদের বিরুদ্ধে। এখনই যদি আমরা বিশ্বাসঘাতকের নাম খুঁজে না পাই, তবে সত্য চিরকালের জন্য হারিয়ে যাবে।”
চুপচাপ ফ্ল্যাটের টেবিলে বসে তিনি খাতার ছেঁড়া পাতার দিকে তাকালেন। “শি…” অক্ষরটা যেন চোখে জ্বলছে।
অর্জুন ফিসফিস করে বললেন—
“শি… মানে শিবনারায়ণ? নাকি অন্য কেউ? সত্যিটা খুব কাছেই আছে। কিন্তু সংগঠন আমাদের আগে পৌঁছাতে চাইছে।”
তিনি জানলেন, আগামী কয়েক দিনই ঠিক করবে—এই রহস্য চিরকালের জন্য ঢাকা পড়বে, নাকি ইতিহাসের মুখে আলো পড়বে।
পর্ব ৮: মুখোশের আড়াল
কলকাতার রাত তখন নিস্তব্ধ। জানালার বাইরে কুয়াশার চাদর বিছানো। অর্জুন রায় টেবিলে বসে খাতার ছেঁড়া পাতাটার দিকে তাকিয়ে আছেন। “শি…” অক্ষরটা যেন তাঁর চোখের সামনে ঝিলিক মারছে। সেই সঙ্গে মনে বাজছে কাল রাতের বার্তাটা—“অধ্যাপকই তোমাকে ধ্বংস করবে।”
মনের মধ্যে দ্বন্দ্ব। তিনি কি ভুল পথে হাঁটছেন? শত্রুরা কি ইচ্ছে করে সন্দেহের বিষ বুনছে? নাকি সত্যিই অধ্যাপক মল্লিক কোনো লুকোনো খেলায় আছেন?
অফিসার মিত্র কাগজপত্র গুছিয়ে বলল—
“স্যার, আমার মনে হয় আমাদের সরাসরি শিবনারায়ণ পরিবারের উপর নজর রাখা উচিত। ওই নামের সূত্রই আসল।”
অর্জুন ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন।
“ঠিকই বলছ, তবে তাড়াহুড়ো করলে ভুল হবে। আসল বিশ্বাসঘাতক হয়তো ভিন্ন মুখোশ পরে আছে।”
পরদিন সকালে তিনি গোপনে শিবনারায়ণ প্রাসাদের সামনে গেলেন। ভিতরে জনসভা চলছে। অশোক শিবনারায়ণ বক্তৃতা দিচ্ছেন—
“আমাদের পরিবার শতাব্দীর পর শতাব্দী বাংলার গৌরব রক্ষা করেছে। আমরা ইতিহাসকে সম্মান করি, মিথ্যার বিরুদ্ধে লড়াই করি।”
তাঁর চোখে দৃঢ়তা, ঠোঁটে আত্মবিশ্বাস। কিন্তু অর্জুন ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করলেন, অশোকের বক্তৃতার শব্দ যেন সাজানো। তিনি ঠিক যে জায়গায় মিথ্যা লুকোচ্ছেন, সেখানেই কণ্ঠে কাঁপুনি।
সভা শেষে অশোক ভেতরে চলে গেলেন। অর্জুন ভিড়ের আড়াল থেকে প্রাসাদের ভিতরে ঢুকে পড়লেন। গ্রন্থাগারের দিকে গেলেন, যেখানে আগেরবার তিনি পুরনো দলিল দেখেছিলেন। দরজা আধখোলা। ভেতরে প্রবেশ করতেই শুনলেন অশোক কারও সঙ্গে ফিসফিস করছে।
“আমাদের যেকোনো মূল্যে খাতা চাই। না হলে আমাদের নাম প্রকাশ হয়ে যাবে। সংগঠন ইতিমধ্যেই ক্ষুব্ধ।”
অর্জুন দরজার ফাঁক দিয়ে তাকালেন। অশোকের সামনে বসে আছেন একজন অচেনা মানুষ—কালো কোট, মুখ আড়াল করে রাখা। মানুষটা গম্ভীর গলায় উত্তর দিল—
“তুমি চিন্তা করো না। অধ্যাপক আমাদের ফাঁদে আছে। খুব শিগগিরই খাতা তার হাত থেকে সরিয়ে আনা হবে।”
অর্জুনের চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল। অধ্যাপক মল্লিক? তিনি তো অর্জুনের সঙ্গেই আছেন! তাহলে কি সত্যিই অধ্যাপক দ্বিমুখো খেলা খেলছেন?
ঠিক তখনই আচমকা দরজা কিঞ্চিৎ কড়মড় শব্দ করল। অশোক চমকে ঘুরে তাকালেন। অর্জুন দ্রুত সরে গেলেন ছায়ার আড়ালে। তিনি জানেন, এখন প্রকাশ্যে ধরা পড়লে খাতা আর তাঁর জীবন—দুটোই বিপন্ন হবে।
সেদিন রাতে ফ্ল্যাটে ফিরে অধ্যাপকের মুখোমুখি হলেন।
“অধ্যাপক, আপনি কি নিশ্চিত, আপনাকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল? আপনার নাম নিয়ে তারা যে খেলছে, তাতে সন্দেহ আরও বাড়ছে।”
অধ্যাপক থমকে গেলেন।
“অর্জুনবাবু, আপনি কি আমাকে সন্দেহ করছেন?”
অর্জুন স্থির কণ্ঠে উত্তর দিলেন—
“আমি কাউকেই অন্ধভাবে বিশ্বাস করি না। সত্য প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত না।”
অধ্যাপক হতাশ চোখে তাকিয়ে চুপ করে রইলেন।
রাত গভীর হলে হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। অচেনা কণ্ঠ বলল—
“যদি সত্য জানতে চাও, তবে কাল মধ্যরাতে শিয়ালদহ স্টেশনের পুরনো গুদামে আসো। একাই আসবে। সেখানে বিশ্বাসঘাতকের নাম উন্মোচিত হবে।”
ফোন কেটে গেল।
অর্জুন জানেন, এটা ফাঁদও হতে পারে। কিন্তু তিনি যাবেন। কারণ রহস্যের গিঁট খুলতে হলে ঝুঁকি নিতেই হবে।
মধ্যরাতে শিয়ালদহের গুদাম ফাঁকা। ভাঙা দেওয়াল, ছেঁড়া টিনের ছাদ, বাতাসে মরচের গন্ধ। অর্জুন টর্চ নিয়ে ঢুকলেন। ভেতরে অন্ধকার, কেবল এক কোণে ক্ষীণ আলো। সেখানে দাঁড়ানো কালো কোট পরা এক লোক।
লোকটা ধীরে বলল—
“তুমি জানতে চাও বিশ্বাসঘাতক কে? তবে শুনো—শিবনারায়ণ পরিবার শুধু ব্রিটিশদের সঙ্গে চক্রান্ত করেনি। তাদের সহায়তা করেছিল আরেকজন শিক্ষিত ভারতীয়। সেই সময় তিনি রাজবাড়ির শিক্ষক ছিলেন। তাঁর নাম ছিল… শিবদত্ত মল্লিক।”
অর্জুন স্তব্ধ। মল্লিক? অধ্যাপকের পূর্বপুরুষ?
লোকটা আবার বলল—
“তোমার সঙ্গে থাকা অধ্যাপক সেই বংশধর। তাই সংগঠন তাঁকে টার্গেট করেছে। তারা চায়, মল্লিক পরিবার চিরকালের জন্য কুখ্যাত হোক। কিন্তু অধ্যাপকও বিপদে, কারণ তিনি সত্যি সত্যিই নির্দোষ।”
অর্জুন টের পেলেন, খেলার মোড় আরও জটিল হয়েছে।
ঠিক তখনই বাইরে গাড়ির শব্দ। গুদামের দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ল কালো চাদর পরা কয়েকজন।
“খাতা কোথায়?”—চিৎকার করল তারা।
অর্জুন মুহূর্তে আলো বন্ধ করে ছায়ার আড়ালে সরে গেলেন। অন্ধকারে হাতাহাতি শুরু হল। লোহার রডের আঘাত, বন্দুকের গর্জন। অর্জুন দ্রুত একজনকে নিস্তেজ করলেন, আরেকজনকে ধাক্কা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলেন। কিন্তু তাদের নেতা পালিয়ে গেল।
যখন সব থামল, তখন গুদাম প্রায় ভেঙে পড়ছে। ছায়ামূর্তি যে কথা বলে গিয়েছিল, তা মাথায় বাজছিল—শিবদত্ত মল্লিক।
ভোরে ফ্ল্যাটে ফিরে তিনি অধ্যাপকের সামনে দাঁড়ালেন।
“অধ্যাপক, আপনার পূর্বপুরুষ শিবদত্ত মল্লিকের নাম এসেছে এই ষড়যন্ত্রে। আপনিই সেই বিশ্বাসঘাতকের বংশধর।”
অধ্যাপক ফ্যাকাশে মুখে বসে পড়লেন।
“না… এটা সত্যি হতে পারে না! আমার পরিবার শিক্ষিত ছিল, স্বাধীনতার পক্ষে ছিল।”
অর্জুন ঠান্ডা স্বরে বললেন—
“আমি জানি, আপনি ব্যক্তিগতভাবে নির্দোষ। কিন্তু ইতিহাসের বোঝা কখনও কখনও প্রজন্মের কাঁধে এসে পড়ে।”
অধ্যাপকের চোখে জল গড়িয়ে পড়ল।
“তাহলে আমি আজীবন এই অভিশাপ বহন করব?”
অর্জুন ধীরে বললেন—
“অভিশাপ নয়। বরং এটাই আপনার দায়িত্ব—সত্যকে প্রকাশ করা, যাতে আর কোনো প্রজন্ম মুখোশ পরে না বাঁচে।”
এদিকে সংগঠন আরও হিংস্র হয়ে উঠছে। তাদের গুপ্তঘাঁটি খুঁজে বের করতে পুলিশ ব্যস্ত। কিন্তু অর্জুন জানেন, শেষ লড়াই এখনো বাকি।
তিনি খাতার পাতাগুলো উল্টে দেখলেন। সেখানে একটা লাইন কাঁপা হাতে লেখা—
“যে বিশ্বাসঘাতক আমাদের ধ্বংস করল, তার রক্তের ছায়া বহন করবে ভবিষ্যৎ। তবে সত্য প্রকাশ করলে মুক্তি মিলবে।”
অর্জুন চোখে ঠান্ডা আগুন নিয়ে বললেন—
“তাহলে মুক্তির পথ এখন কেবল একটাই—সত্যকে প্রকাশ্যে আনা।”
রাত নামছিল। আকাশে কুয়াশা জমছিল। শহরের অন্ধকারে যেন আরও গভীর ষড়যন্ত্রের গন্ধ ভেসে আসছিল।
অর্জুন জানলেন, এখন আর ফিরে যাওয়ার পথ নেই।
“বিশ্বাসঘাতকের নাম স্পষ্টভাবে বের না করলে এই যুদ্ধ শেষ হবে না। আর সেই নাম প্রকাশের আগেই সংগঠন আমাদের মেরে ফেলতে চাইবে।”
দূরে ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করছিল। আর সেই শব্দের সঙ্গে সঙ্গে যেন কাছে আসছিল অদৃশ্য মৃত্যুর ছায়া।
পর্ব ৯: রক্তের ছায়া
শহরের আকাশে তখন রাতের কুয়াশা নেমে এসেছে। ল্যাম্পপোস্টের আলো ঝাপসা হয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। অর্জুন রায় জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ধোঁয়ার মতো ঘুরে বেড়ানো নিজের সন্দেহগুলো গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। হাতে লাল খাতা, যার প্রতিটি অক্ষর যেন আরও ভারী হয়ে উঠছে।
খাতার পাতায় ছেঁড়া অংশে লেখা ছিল শুধু—“শি…”। আর গতরাতে গুদামের ছায়ামূর্তি যে নাম ফিসফিস করে দিয়ে গেল—শিবদত্ত মল্লিক।
অর্জুন নিঃশব্দে বললেন,
“বিশ্বাসঘাতকের নাম হয়তো শিবদত্ত। কিন্তু প্রশ্ন হল—কে আজও এই নাম চাপা রাখতে চাইছে? ব্রিটিশরা তো নেই। তাহলে কার স্বার্থ বেঁচে আছে?”
অধ্যাপক মল্লিক বসে আছেন ফ্যাকাশে মুখে। তাঁর কাঁধে যেন শতবর্ষ পুরনো অপরাধের বোঝা।
“অর্জুনবাবু, যদি সত্যিই আমার পূর্বপুরুষ বিশ্বাসঘাতক হয়, তবে আমি কীভাবে মুখ দেখাব সমাজে? ইতিহাসের শিক্ষক হয়ে আমি কি তবে অভিশপ্ত বংশের সন্তান?”
অর্জুন শান্ত গলায় বললেন,
“না, অধ্যাপক। সত্যকে আড়াল করাই অভিশাপ। প্রকাশ করলে অভিশাপ ভাঙে। আপনার দায়িত্ব এখন—যা ঘটেছিল, তার সবটা তুলে ধরা।”
অফিসার মিত্র তখন খবর নিয়ে ঢুকল।
“স্যার, বড় তথ্য মিলেছে। সংগঠনের নেতা লুকিয়ে আছে শিবনারায়ণ প্রাসাদে। পুলিশের সঙ্গে যোগসাজশ থাকায় এখনো ধরা যায়নি। আর শোনা যাচ্ছে, তারা আজ রাতেই বড় আক্রমণ চালাবে।”
অর্জুন চোখ সরু করলেন।
“মানে, তারা আমাদের আগে বিশ্বাসঘাতকের নাম চাপা দিতে চায়। আমাদের দেরি করলে চলবে না।”
সেই রাতেই অর্জুন, অধ্যাপক আর মিত্র বেরোলেন শিবনারায়ণ প্রাসাদের দিকে। চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু কুকুরের ডাক আর ঠান্ডা বাতাসে পাতার খসখসানি।
প্রাসাদের ভেতরে ঢুকে তারা পৌঁছালেন গ্রন্থাগারে। দরজা ভেতর থেকে খোলা। ঘরে আলো জ্বলছে। অশোক শিবনারায়ণ টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে, হাতে এক পুরনো দলিল। পাশে কালো চাদর পরা কয়েকজন লোক।
অশোক গম্ভীর গলায় বলল—
“অর্জুন রায়! তুমি যত চেষ্টাই করো, সত্য প্রকাশ পাবে না। এই খাতা আজই ধ্বংস হবে। আমাদের পরিবার যদি বিশ্বাসঘাতক হয়, তবে আমরা আজকের সমাজে টিকে থাকতে পারব না।”
অর্জুন এগিয়ে এসে বললেন—
“অশোকবাবু, মিথ্যা চিরকাল টিকে থাকে না। আপনার পরিবার হয়তো সত্যিই এই ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল। কিন্তু এখন তা আড়াল করলে আপনার অপরাধ আরও গভীর হবে।”
অশোক দাঁত চেপে বলল—
“তাহলে মরতে প্রস্তুত হও।”
লোকগুলো এগিয়ে এল। মুহূর্তেই ঘরে হাতাহাতি শুরু হলো। বন্দুকের গর্জন, কাঁচ ভাঙার শব্দ, লড়াইয়ের মধ্যে টেবিল উলটে গেল। দলিল ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে।
অর্জুন একে একে তিনজনকে ফেলে দিলেন। মিত্র পুলিশের সাইরেন বাজিয়ে বাহিনী ডাকল। ততক্ষণে অশোক জানালা দিয়ে পালাতে চাইছিল। অর্জুন ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁর হাত চেপে ধরলেন। দু’জনের মধ্যে ধস্তাধস্তি। অবশেষে অশোক মাটিতে পড়ে গেল।
মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা দলিলের মধ্যে এক পাতায় চোখ পড়ল অর্জুনের। সেখানে ইংরেজি অক্ষরে লেখা—
“Signed: Shibdutta Mallick, witness to the betrayal.”
(“স্বাক্ষর: শিবদত্ত মল্লিক, বিশ্বাসঘাতকতার সাক্ষী।”)
অর্জুন স্তব্ধ হয়ে পড়লেন।
“এটা শুধু বিশ্বাসঘাতকতার ইঙ্গিত নয়। তিনি নিজেই স্বাক্ষর করেছেন। মানে সত্যি—অধ্যাপকের পূর্বপুরুষই বিশ্বাসঘাতক।”
অধ্যাপক মল্লিক ভেঙে পড়লেন। তাঁর চোখে জল গড়িয়ে পড়ল।
“না… না… এ আমি মানতে পারি না। আমার রক্তে যদি বিশ্বাসঘাতকতার ছায়া থাকে, তবে আমি জীবিত থেকে কী করব?”
অর্জুন দৃঢ় গলায় বললেন—
“না, অধ্যাপক। আপনি নির্দোষ। পূর্বপুরুষের অপরাধ আপনি মুছতে পারবেন না, কিন্তু আপনি ইতিহাসের সামনে সত্য প্রকাশ করে মুক্তি আনতে পারবেন। আপনার ভয়ই সংগঠনের শক্তি।”
অশোক তখন পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। চিৎকার করে বলছিল—
“তোমরা কিছু জানো না! বিশ্বাসঘাতকতার নাম প্রকাশ হলে শুধু আমাদের পরিবার নয়, আরও অনেকে ধ্বংস হবে। তাই শতবর্ষ ধরে আমরা এটা লুকিয়ে রেখেছি!”
অর্জুন ঠান্ডা দৃষ্টিতে বললেন—
“সত্য চাপা রাখলে একদিন আগুন হয়ে জ্বলে ওঠে। আজ সেই আগুন জ্বলবেই।”
কিন্তু রহস্য এখানেই শেষ হয়নি। দলিলের শেষ পাতায় লেখা—
“Shibdutta was forced. Betrayal was not his choice. He was blackmailed by the British with his family’s life.”
(“শিবদত্তকে বাধ্য করা হয়েছিল। বিশ্বাসঘাতকতা তাঁর নিজের পছন্দ ছিল না। ব্রিটিশরা তাঁর পরিবারকে হত্যা করার হুমকি দিয়েছিল।”)
অর্জুন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
“তাহলে সত্য আরও জটিল। তিনি বিশ্বাসঘাতক, আবার একইসঙ্গে এক শিকারও।”
অধ্যাপক কেঁপে উঠে বললেন—
“মানে আমার পূর্বপুরুষকে দোষারোপ করা ঠিক নয়?”
অর্জুন শান্তভাবে উত্তর দিলেন—
“তিনি ভুল করেছিলেন, কিন্তু সেটা ভয়ে। আর আজও এই সত্য লুকিয়ে রাখা হচ্ছে ক্ষমতার স্বার্থে। এই দলিল ইতিহাসের সামনে রাখতে হবে।”
ঠিক তখনই আলো নিভে গেল। অন্ধকারে গুলির শব্দ। সংগঠনের লোকেরা আবার ঢুকে পড়েছে। পুলিশের সঙ্গে গুলির লড়াই শুরু হলো। অর্জুন খাতা শক্ত করে ধরে অধ্যাপককে আড়ালে সরালেন।
মিত্র চিৎকার করে বলল—
“স্যার, ওরা অনেক! বাইরে থেকে আরও ফোর্স চাই।”
অর্জুন গম্ভীর স্বরে বললেন—
“না, মিত্র। আজ রাতেই খেলা শেষ হবে। সংগঠন যত বড় হোক, সত্যের কাছে টিকতে পারবে না।”
কুয়াশার মধ্যে, আলো-অন্ধকারের যুদ্ধে রাজবাড়ি ষড়যন্ত্রের শেষ অধ্যায় যেন ঘনিয়ে আসছিল। বিশ্বাসঘাতকের নাম প্রকাশ পেল, কিন্তু তার সঙ্গে প্রকাশ পেল আরও ভয়াবহ সত্য—তিনি ছিলেন এক শিকার।
অর্জুন জানলেন, শেষ লড়াই হবে রক্ত আর আগুনের মধ্যে দিয়ে।
“শেষ অধ্যায় এখনই শুরু হচ্ছে।”
পর্ব ১০: শেষ আলোর সাক্ষী
ভোরের আলো তখনও উঠেনি। আকাশে ঘন কুয়াশা, শহরের বাতিগুলো ম্লান হয়ে আসছে। অশোক শিবনারায়ণকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ নিয়ে গেছে, কিন্তু সংগঠনের ছায়া এখনও ঘোরাফেরা করছে। অর্জুন রায় জানেন—শেষ লড়াই এখনো বাকি।
অধ্যাপক মল্লিক নিঃশব্দে বসে আছেন। মুখে পরাজয়ের ছাপ, চোখে দায়িত্বের ভার। তিনি ফিসফিস করে বললেন—
“অর্জুনবাবু, আমার পূর্বপুরুষ শিবদত্ত যদি সত্যিই বিশ্বাসঘাতক হয়ে থাকেন, তবে আমি এই সত্য ইতিহাসে প্রকাশ করব। না লুকিয়ে, না আড়াল করে। এটাই আমার কর্তব্য।”
অর্জুন ঠান্ডা গলায় উত্তর দিলেন—
“আপনার এই সাহসই আপনার মুক্তি। আপনার পরিবারকে অভিশাপ নয়, দায়িত্ব বয়ে বেড়াতে হবে।”
সেই মুহূর্তে খবর এল—সংগঠনের বাকি লোকেরা শহরের বাইরে একটি পুরনো কারখানায় জড়ো হয়েছে। সেখানেই তারা শেষ চেষ্টায় খাতাটা দখল করতে চাইছে।
অর্জুন, মিত্র আর অধ্যাপক দ্রুত রওনা হলেন। গাড়ি ছুটল নির্জন রাস্তায়। কুয়াশার মধ্যে ভাঙা গুদাম, মরচে ধরা ছাদ—ওখানেই শেষ যুদ্ধের মঞ্চ।
ভেতরে ঢুকতেই চারপাশে ছায়া নড়ে উঠল। কালো চাদর পরা অন্তত পনেরো জন দাঁড়িয়ে আছে। মাঝখানে সংগঠনের নতুন নেতা। মুখ ঢাকা, কিন্তু গলায় কর্কশ দৃঢ়তা—
“খাতা আমাদের দাও। না হলে এখানেই মৃত্যু।”
অর্জুন শান্ত স্বরে বললেন—
“ইতিহাসের সত্যকে চাপা রাখা যায় না। তোমরা যতই চেষ্টা করো, এই খাতা আদালতে পৌঁছবেই।”
নেতা বিদ্রূপের হাসি হেসে হাত তুলতেই লড়াই শুরু হয়ে গেল।
গুলির শব্দ, লোহার রডের আঘাত, কুয়াশার ভেতর ধোঁয়া। পুলিশও ঢুকে পড়ল। লড়াই ভয়াবহ। অর্জুন একে একে কয়েকজনকে পরাস্ত করলেন। কিন্তু নেতা ছুরি হাতে অধ্যাপকের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
অর্জুন চিৎকার করলেন—
“সাবধান!”
তিনি দৌড়ে গিয়ে নেতার হাত চেপে ধরলেন। দু’জনের মধ্যে ধস্তাধস্তি শুরু হল। নেতা গর্জে উঠল—
“তুমি ভাবছ জিতে গেছ? আমরা এক প্রজন্ম গেলে আরেক প্রজন্ম জন্ম নেব। সংগঠন অমর।”
অর্জুন চোখে আগুন নিয়ে বললেন—
“মিথ্যা কখনও অমর হয় না। সত্যই টিকে থাকে।”
মুহূর্তে তিনি নেতাকে মাটিতে ফেলে দিলেন। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করল।
গুদামের ভেতর ধুলো-ধোঁয়া ছেয়ে গেলেও, লাল খাতা অক্ষত রইল। অধ্যাপক সেটি বুকের কাছে চেপে ধরে বললেন—
“এটাই আমাদের উত্তরাধিকার। হোক তা বিশ্বাসঘাতকের স্বীকারোক্তি, তবুও এটাই ইতিহাসের আলো।”
অর্জুন মাথা নাড়লেন।
“হ্যাঁ, আর আলো চিরকাল ঢেকে রাখা যায় না।”
কয়েক দিন পর আদালতে খাতা জমা দেওয়া হলো। সংবাদপত্রে শিরোনাম ছাপা হল—
“রাজবাড়ি ষড়যন্ত্রের দলিল উদ্ধার: ইতিহাসে নতুন অধ্যায়”।
জনতা স্তম্ভিত। কেউ রাগে, কেউ গর্বে, কেউ লজ্জায় প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। শিবনারায়ণ পরিবারের নাম প্রকাশ্যে আসল, কিন্তু সঙ্গে এ-ও জানা গেল—শিবদত্ত মল্লিক ব্রিটিশদের চাপে বিশ্বাসঘাতক হয়েছিলেন।
অধ্যাপক মল্লিক সংবাদমাধ্যমের সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন—
“আমি বিশ্বাসঘাতকের বংশধর, কিন্তু আজ আমি সত্য প্রকাশ করছি। আমরা লজ্জা নিয়ে নয়, দায়িত্ব নিয়ে বাঁচব।”
তাঁর কণ্ঠে ছিল দৃঢ়তা, চোখে অশ্রু।
সবাই অবাক হয়ে তাকাল অর্জুনের দিকে। তিনি শুধু হালকা হেসে বললেন—
“আমার কাজ শেষ। সত্য আদালতের হাতে। ইতিহাস এবার নিজের মতো করে বাঁচবে।”
কয়েক দিন পর এক শীতের বিকেলে অর্জুন একা দাঁড়িয়েছিলেন গঙ্গার ধারে। নদীর জলে সূর্যের আলো ভেঙে পড়ছিল। হাতে এক কাপ চা।
মিত্র পাশে এসে বলল—
“স্যার, এই কেস তো আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় তদন্তগুলোর একটা। এতদিন পরে নিশ্চিন্ত লাগছে?”
অর্জুন চুপ করে চা খেলেন। তারপর বললেন—
“নিশ্চিন্ত নয়, বরং ভারমুক্ত। সত্য প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু মনে রেখো, ইতিহাসে প্রতিটি রহস্যের ছায়া আবার ফিরে আসে। আমাদের কাজ শেষ হয় না।”
তিনি নদীর দিকে তাকালেন। ঢেউগুলো ভেঙে যাচ্ছিল, আবার ফিরে আসছিল।
রাত নামতে নামতে শহরের আলো জ্বলতে শুরু করল। অর্জুন হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে বললেন—
“শেষ চিঠির সূত্র আমাকে এক জগৎ থেকে আরেক জগতে নিয়ে গেল। কিন্তু সত্যি বলতে, কোনো কেসই শেষ নয়। কারণ মানুষ যতদিন বাঁচবে, ততদিন ইতিহাসে নতুন রহস্য জন্ম নেবে।”
কুয়াশার ভেতর দিয়ে তাঁর ছায়া মিলিয়ে গেল, রেখে গেল শুধু একটাই বার্তা—
“সত্য চাপা পড়লেও, একদিন না একদিন আলোতে উঠবেই।”
সমাপ্ত




