আত্মদীপা সেন
পর্ব ১ – আগমন
শীতের শেষ দিকের হাওয়া নামছিল পাহাড় থেকে। সন্ধেবেলা দার্জিলিংয়ের ধারে মেঘলা সেন ছোট্ট একটা লোকাল বাসে চেপে নামল জনশূন্য রাস্তায়। চারদিক জুড়ে তখন কুয়াশার ধোঁয়া, যেন পাহাড়টা নিজের বুকের ভেতর পৃথিবীকে গিলে নিতে চাইছে। তার হাতে একটা পুরনো নোটবুক, ভেতরে টুকে রাখা এক রহস্যময় ঠিকানা—“শেষ গ্রন্থাগার, রংটং পাহাড়তলি।”
মেঘলা কলকাতার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। তার থিসিস ছিল প্রাচীন বই নিয়ে—কাগজের গন্ধ, ছাপার দাগ, মানুষের হাতের ছোঁয়া। অথচ এই পৃথিবীতে এখন বই বলতে বোঝানো হয় কেবল স্ক্রিনের আলো। সব দেশ, সব সরকার, সবকিছু ডিজিটাল আর্কাইভে সরিয়ে নিয়েছে। কাগজের বই নিষিদ্ধ না হলেও, বিলুপ্তির পথে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। তাই যখন সে শুনল যে হিমালয়ের কোলে এখনও নাকি একটি আসল লাইব্রেরি আছে, তখনই নেমে পড়েছিল খোঁজে।
রাস্তা ফাঁকা। বাসটা চলে যেতেই কুয়াশার ভেতর থেকে অদ্ভুত নীরবতা ভেসে এল। মেঘলার মনে হল, এ জায়গাটা যেন পৃথিবীর নয়। গায়ে কোট চেপে ধরে সে এগিয়ে চলল সরু কাঁচা পথ ধরে। কিছুদূর যেতেই পাহাড়ি গাছের আড়ালে উদ্ভাসিত হল বিশাল একটি স্থাপনা—পাথরে বাঁধানো পুরনো বিল্ডিং, জানালার ধারে হলুদ আলো। দরজার ওপরে ধাতব বোর্ডে খোদাই করা আছে—“The Last Library.”
মেঘলার বুক কেঁপে উঠল। এটা কি সত্যিই বাস্তব? নাকি স্বপ্ন?
দরজার কাছে যেতেই এক ঠকঠক শব্দ। ভেতর থেকে খুলে গেল ভারী কাঠের দরজা। দাঁড়িয়ে আছেন এক বৃদ্ধ, সাদা দাড়ি বুক ছুঁয়ে নেমে এসেছে, চোখদুটো কাচের মতো স্বচ্ছ। তিনি মৃদু হেসে বললেন,
—তুমি এসেছ, মেঘলা। অনেক দেরি করলে।
মেঘলা অবাক।
—আপনি… আমার নাম জানেন কীভাবে?
বৃদ্ধ শুধু বললেন,
—আমি ঋত্বিক ঘোষাল। শেষ গ্রন্থাগারের কিউরেটর। এখানে যে আসে, তার নাম আমি জানি। কারণ বইগুলো আগেই লিখে রেখেছে।
মেঘলার মেরুদণ্ডে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল।
ভেতরে ঢুকতেই চমকে উঠল সে। সারি সারি কাঠের তাক, হাজার হাজার বই সাজানো। অদ্ভুত গন্ধ ছড়িয়ে আছে—পুরনো কাগজ, ধুলো, কালি, আর কিছু অচেনা সুগন্ধ। অথচ তোরা তোরা শুনেছিল যে পৃথিবীতে কাগজের বই আর নেই!
ঋত্বিক ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন এক কোণায়। একটি চামড়ার মলাটের বই টেনে বের করে দিলেন মেঘলার হাতে।
—খুলে দেখো।
মেঘলা কাঁপা হাতে বইয়ের মলাট উল্টালো। প্রথমেই চোখে পড়ল লেখা—
“লেখক: অজানা।
চরিত্র: মেঘলা সেন।”
সে হকচকিয়ে গেল। বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দ। বইয়ের ভেতরের পাতায় লেখা শুরু হয়েছে ঠিক সেই মুহূর্তের ঘটনাগুলো—কুয়াশার রাস্তা, লাইব্রেরির দরজা, ঋত্বিকের কথা। আর এখনই নতুন লাইন ভেসে উঠছে কাগজে, যেন অদৃশ্য কলম লিখে চলেছে—
“মেঘলা আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পাতার দিকে, আর বুঝতে পারছে না সে কি বাস্তবের ভেতর আছে, নাকি বইয়ের কাহিনির মধ্যে আটকে পড়েছে।”
মেঘলা হাত ঝটকা দিল, বইটা বন্ধ করে দিল তাড়াতাড়ি।
—এটা কী হচ্ছে? এটা সম্ভব কীভাবে?
ঋত্বিকের চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি।
—এখানে প্রতিটি বই নিজে নিজে লিখে চলে। পাঠক যখন পড়ে, তখন গল্প বদলায়, চরিত্র জন্ম নেয়। অনেকেই বইয়ের ভেতরে ঢুকে যায়, আর আর ফিরে আসে না।
কথা শেষ হতেই শোনা গেল লাইব্রেরির ভেতরকার অন্ধকার গলিঘুঁজিতে কারও ছুটোছুটি পায়ের শব্দ। হঠাৎ এক যুবক দৌড়ে এলো, হাতে একটা মোটা বই। সে হাঁপাতে হাঁপাতে চিৎকার করে উঠল—
—ওরা আমাকে টানছে! বইয়ের ভেতরে! বাঁচান!
কথা শেষ হতেই বইয়ের পাতাগুলো হাওয়ার ঝাপটায় খুলে যেতে লাগল। পাতার ভেতর থেকে আলো বেরোল, আর মুহূর্তের মধ্যে সেই যুবক অদৃশ্য হয়ে গেল। শুধু মেঝেতে পড়ে রইল খোলা বই, পাতার উপর লেখা—
“সে আর ফিরে আসেনি।”
মেঘলার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। ঋত্বিক শান্ত কণ্ঠে বললেন,
—আমি তোকে আগেই বলেছিলাম, বইয়ের ভেতরে ঢোকা মানেই এক নতুন অস্তিত্বের জন্ম। এবার বলো, মেঘলা সেন, তুই কি ভেতরে যেতে প্রস্তুত?
কুয়াশা বাইরের জানালা দিয়ে ঢুকে পড়ছিল। বইয়ের তাকগুলো যেন অদ্ভুতভাবে কেঁপে উঠছিল, যেন প্রতিটি বই ভেতর থেকে ডাকছে তাকে।
মেঘলা দাঁড়িয়ে রইল এক মোহগ্রস্ততার ভেতরে—তার সামনে খুলে যাচ্ছে এমন এক জগত, যেখানে বাস্তব আর কাহিনি মিশে যাচ্ছে একাকার।
পর্ব ২ – কিউরেটরের সতর্কবাণী
ভোরের আলো তখনও পুরোপুরি ফোটেনি। লাইব্রেরির জানালার ফাঁক দিয়ে কুয়াশার সরু রেখা ভেতরে ঢুকছিল, আর তাকভর্তি বইগুলো অদ্ভুত সোনালি ছায়ায় ঝলমল করছিল। মেঘলা সারারাত চোখ মেলেনি—বারবার বুক ধড়ফড় করেছে, বই খুললে কি আবার তার নাম উঠে আসবে, আবার কি তাকে গল্পের ভেতর টেনে নেবে?
ঋত্বিক ঘোষাল যেন আগেই জানতেন সে ঘুমোতে পারেনি। সকালেই এক কাপ কালো কফি নিয়ে এসে বললেন—
—কৌতূহলই তোর সবচেয়ে বড় শত্রু, মেঘলা। বইয়ের ভিতরে ঢোকার লোভ অনেকেই সামলাতে পারে না। কিন্তু সবাই ফিরতে পারে না।
মেঘলা কাপ হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ফিসফিস করে বলল—
—কাল রাতের ছেলেটা? সে কোথায় গেল?
ঋত্বিক তাকালেন জানালার দিকে, যেন উত্তরটা ধোঁয়ার ভেতরেই হারিয়ে গেছে।
—সে এখন আর আমাদের দুনিয়ায় নেই। ও ঢুকে গেছে এমন এক কাহিনির ভেতর, যা ওর নাম ধরে ডাকছিল। কারো কাহিনি শান্ত নদীর মতো, কারোটা আবার অগ্নিকুণ্ড। একবার ঢুকে পড়লে আর ফেরার রাস্তা থাকে না।
মেঘলার শরীর কেঁপে উঠল।
—তাহলে এ লাইব্রেরি বিপজ্জনক?
ঋত্বিকের ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি ফুটল।
—বিপজ্জনক নয়, সত্যিকারের। তোরা যেটাকে ভয় পাচ্ছিস, ওটাই হয়তো মানুষের সবচেয়ে আসল অস্তিত্ব। আমরা শুধু মাংস-রক্ত নই, আমরা গল্পেরও তৈরি।
ঠিক তখনই ভেতরের গলি থেকে আবার শব্দ ভেসে এল—পাতা উল্টোনোর, ফিসফিস করার, যেন বহু মানুষ একসাথে কথা বলছে। মেঘলা এগোতে চাইলে ঋত্বিক তার হাত শক্ত করে ধরে বললেন—
—যে পথটা দেখতে পাচ্ছিস, সেটা সব পাঠকের জন্য নয়। লাইব্রেরি নিজেই পছন্দ করে কাকে ডাকবে, কাকে ফিরিয়ে দেবে।
মেঘলার মনে হল তাকগুলো হালকা কাঁপছে। কয়েকটা বই নিজে নিজেই তাক থেকে বেরিয়ে এসে মেঝেতে পড়ল। সে একটা বই তুলতেই দেখতে পেল ভেতরে লেখা হচ্ছে—
“আজ মেঘলা সেন বুঝতে পারল, লাইব্রেরি তার জন্য অপেক্ষা করছে।”
মেঘলা হতভম্ব হয়ে ঋত্বিকের দিকে তাকাল।
—এটা আবার কেন লিখল? আমি তো কিছুই করিনি।
ঋত্বিক গভীর নিশ্বাস ফেললেন।
—কারণ তুই কেবল গবেষক নয়। তুই এক পাঠক, আর প্রতিটি পাঠকের ভেতরেই লুকিয়ে থাকে লেখকের বীজ। লাইব্রেরি সেটা চিনে নেয়। মনে রাখিস, আজ থেকে তোর প্রতিটি সিদ্ধান্ত কেবল তোর নিজের নয়—এ গ্রন্থাগারের পাতাগুলিও তা লিখে রাখবে।
হঠাৎ কড়মড় শব্দে ওপরে গ্যালারির দিকের দরজা খুলে গেল। এক বৃদ্ধা ভেতরে এলেন, তার গলায় মোটা শাল জড়ানো। হাতে ধরা একটি মলাটছেঁড়া বই।
—ঋত্বিক, বইটা আবার কাঁদছে। রাতভর আমাকে ঘুমোতে দেয়নি।
মেঘলা তাকিয়ে দেখল, সত্যিই পাতাগুলোর মধ্যে থেকে অদ্ভুত সোঁ সোঁ আওয়াজ বেরোচ্ছে, যেন দমবন্ধ করে কান্না।
ঋত্বিক শান্ত কণ্ঠে বললেন—
—এই জন্যই তোকে সতর্ক করেছিলাম। এই লাইব্রেরি শুধু গল্প রাখে না, এগুলো বাঁচে, নিশ্বাস নেয়, আনন্দে হেসে ওঠে, আবার কান্নাতেও ভাসে।
মেঘলা বুকের ভেতর শীতলতা অনুভব করল। সে জানত—এই জায়গা আর পাঁচটা লাইব্রেরি নয়। এটা যেন অন্য কোনো চেতনার হাতে তৈরি গোলকধাঁধা।
আর সেই গোলকধাঁধা তাকে ক্রমশ ভেতরে টেনে নিচ্ছে।
পর্ব ৩ – অরিন্দমের প্রবেশ
বিকেলের আলো তখন পাহাড়ের গায়ে ঝুলে পড়েছে। কুয়াশার ভেতর দিয়ে লাইব্রেরি যেন আরও রহস্যময়, আরও অচেনা হয়ে উঠেছে। মেঘলা সারাদিন ধরে বইয়ের তাকের ভেতর হাঁটাহাঁটি করেছে, কিন্তু তার বুকের ভেতর একটা অস্বস্তি জমাট বেঁধে আছে। বইগুলো যেন তাকে দেখে, তাকে চিনে নেয়, আর নিঃশব্দে কিছু ফিসফিস করে।
ঠিক তখনই ভারী লোহার দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল এক অচেনা যুবক। তার চোখে গাঢ় কালো চশমা, কাঁধে ব্যাগে ঝোলানো ল্যাপটপ, কানে ইয়ারফোন ঝুলছে। তার ভঙ্গিতে একটা শহুরে অহংকার—যেন পাহাড়ের এই নিঃশব্দ লাইব্রেরি তার কাছে একেবারেই গুরুত্বহীন।
ঋত্বিক ভুরু কুঁচকে বললেন—
—কে তুমি? এখানে আসার অনুমতি কাকে দিয়েছ?
যুবক হাসল ঠোঁট বাঁকিয়ে।
—আমার অনুমতির দরকার নেই। আমি অরিন্দম দত্ত, সেন্ট্রাল ডিজিটাল আর্কাইভের টেক-টিমে কাজ করি। আপনার এই লাইব্রেরি সরকার অধিগ্রহণ করতে চলেছে। সব বই স্ক্যান করে অনলাইনে তুলে দেওয়া হবে। আমি এসেছি সেই কাজ শুরু করতে।
মেঘলার বুক ধক করে উঠল। সে এগিয়ে এসে বলল—
—আপনি জানেন এখানে কী ঘটছে? এই বইগুলো শুধু শব্দ নয়, এরা… এরা যেন বেঁচে আছে!
অরিন্দম হেসে উঠল ব্যঙ্গ করে।
—বেঁচে থাকা মানে কী? ডেটাই তো আসল। শব্দগুলো যখন সার্ভারে থাকবে, তখন এগুলোই বেঁচে থাকবে। কাগজের দরকার নেই। আবেগপ্রবণ হবেন না।
ঋত্বিক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
—তুমি বুঝতে পারছ না, অরিন্দম। এই গ্রন্থাগার কোনো সাধারণ বইয়ের ঘর নয়। এরা নিজে লেখে, নিজে বদলায়, নিজেই নিজের ভাগ্য তৈরি করে। যদি এদের জোর করে স্ক্যান করার চেষ্টা করো, তবে—
কথা শেষ হওয়ার আগেই অরিন্দম ব্যাগ থেকে একটা পোর্টেবল স্ক্যানার বের করল। সে এগিয়ে গিয়ে একটা পাতলা বই তুলে মেশিনের ওপর রাখল। আলো ঝলসে উঠল, কিন্তু পরমুহূর্তেই স্ক্রিন অন্ধকার হয়ে গেল। স্ক্যানার থেকে অদ্ভুত শব্দ বেরোচ্ছে, যেন কাঁদছে। তারপরই মেশিনটা বিস্ফোরণের মতো শব্দ করে নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
অরিন্দম হতভম্ব।
—এটা… এটা কী হলো?
ঠিক তখনই বইয়ের পাতাগুলো নিজে নিজে উল্টোতে শুরু করল। শব্দ বেরোল, যেন বহু মানুষের গলা একসাথে বলছে—
“আমাদের বাঁধতে পারবে না। আমাদের শৃঙ্খল দিও না।”
মেঘলা চমকে অরিন্দমের হাত ধরে টেনে সরাল। পাতাগুলো থেকে এক ঝলক আলো বেরিয়ে এসে দেয়ালে ছায়া ফেলল। সেই ছায়ার মধ্যে মেঘলা স্পষ্ট দেখল—শত শত মুখ, কাঁদছে, হেসে উঠছে, আবার অচেনা ভাষায় কিছু বলছে।
ঋত্বিক ধীরে ধীরে বললেন—
—তোমাকে সতর্ক করেছিলাম। এরা নিজেদের রক্ষা করে। এরা চায় স্বাধীনতা।
অরিন্দম কাঁপা কণ্ঠে বলল—
—এটা প্রযুক্তির সমস্যা… হয়তো কোনো অদ্ভুত চৌম্বকক্ষেত্র…
কিন্তু বাকিটা গিলে নিল তার নিজের ভয়।
মেঘলা তাকাল ঋত্বিকের চোখে। বৃদ্ধের ঠোঁটে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা ফুটে উঠেছে।
—শোনো অরিন্দম, এই গ্রন্থাগার যদি তোমাকে ডাকে, তবে তুমি আর বিজ্ঞান দিয়ে তাকে বোঝাতে পারবে না। তখন তোমাকে পাঠক হতে হবে। আর পাঠক হওয়া মানেই ঝুঁকি নেওয়া।
অরিন্দম হাসল ম্লানভাবে।
—আমি ঝুঁকির ভেতর জন্মেছি। কিন্তু যদি সত্যিই বইগুলো গল্প পাল্টে দেয়… তাহলে কে লেখে ওদের? মানুষ? নাকি অন্য কিছু?
লাইব্রেরির ভেতর হঠাৎ যেন ঝড় উঠল। তাকগুলো কেঁপে উঠল, বইয়ের পাতা একসাথে খুলে গেল। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল একটিই শব্দ—
“আমরা নিজেরাই লিখি। আমরা নিজেরাই ভবিষ্যৎ।”
মেঘলার হাত ঠাণ্ডা হয়ে গেল। আর অরিন্দম প্রথমবারের মতো অনুভব করল—তার ডিজিটাল যুক্তিবোধ হয়তো এখানে একেবারেই অকেজো।
পর্ব ৪ – কাহিনির গোলকধাঁধা
রাত নেমেছে। কুয়াশার আবরণ আরও ঘন হয়ে লাইব্রেরিকে যেন পাহাড় থেকে আলাদা করে ফেলেছে। বাইরে পৃথিবী নিস্তব্ধ, কিন্তু ভেতরে বইয়ের পাতাগুলোতে গোপন ঝড় বইছে। একেকটা তাক যেন শ্বাস নিচ্ছে, আবার ছাড়ছে।
মেঘলা মৃদু কণ্ঠে বলল—
—এভাবে আর থাকা যাচ্ছে না। আমি জানতে চাই, এই বইগুলো আসলে কী করছে।
ঋত্বিক ধীরে মাথা নাড়লেন।
—সাবধান, মেঘলা। কৌতূহল সবসময়ের মতো বিপজ্জনক। প্রতিটি বই একেকটা দরজা। খুলে দিলে তুই শুধু পড়বি না, ঢুকেও পড়বি। আর ভেতরে ঢুকে গেলে ফেরা অনিশ্চিত।
অরিন্দম ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল।
—আমি ভয় পাই না। যদি ভেতরে ঢুকতে হয়, ঢুকব। আমি প্রমাণ চাই।
ঋত্বিক দম ফেললেন ভারীভাবে।
—তাহলে তোদের জন্য একটি পথ খোলা আছে। “কাহিনির গোলকধাঁধা।” সেটাই এই লাইব্রেরির সবচেয়ে পুরনো ও বিপজ্জনক বই।
বৃদ্ধ একটি লোহার চাবি বের করলেন পকেট থেকে। লাইব্রেরির পশ্চিম প্রান্তের কালো কাঠের দরজা খুলতেই মেঘলার বুক কেঁপে উঠল। ভেতরে অন্ধকারে একটা মাত্র টেবিল, তার উপর শুয়ে আছে এক বিশাল চামড়ার মোটা বই। মলাটে অদ্ভুত প্রতীক, যেগুলো চোখের সামনে নড়াচড়া করছে।
অরিন্দম এগিয়ে গিয়ে হাসল।
—এ তো স্রেফ প্রাচীন কোডিং-এর মতো লাগছে।
সে বইটা খুলতেই আলো ছিটকে বেরোল। হঠাৎ চারদিক ভেঙে গেল যেন। মেঘলা অনুভব করল তার চারপাশে তাক, দেয়াল, আলো সব গলে যাচ্ছে। সে পড়ছে এক অন্তহীন শূন্যতায়, আর বইয়ের পাতার শব্দগুলো তাকে জড়িয়ে নিচ্ছে।
চোখ মেলতেই সে নিজেকে দেখতে পেল এক অচেনা নগরীর মাঝখানে। চারদিকে সরু গলি, উঁচু অট্টালিকা, কিন্তু আকাশে কোনো সূর্য নেই। আলোর উৎস বইয়ের পাতার ভেতর থেকে ভেসে আসছে। গলির দেয়ালে লেখা—
“কাহিনি ছাড়া কিছুই নেই।”
অরিন্দম তার পাশেই পড়ে গেছে। বিস্মিত দৃষ্টিতে চারপাশ দেখে সে বিড়বিড় করল—
—এটা কি ভার্চুয়াল রিয়ালিটি? কিন্তু… কিন্তু আমি তো কোনো ডিভাইসে নেই!
মেঘলা তার হাত ধরল।
—এটা গল্পের ভেতর। আমরা ঢুকে পড়েছি।
একদল মানুষ গলির ভিতর থেকে বেরোল। তাদের চোখ ফাঁকা, ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি। তারা একসাথে বলতে লাগল—
“তোমরা নতুন পাঠক। তোমাদের জন্য নতুন পথ তৈরি হয়েছে। এখানে প্রতিটি গলি একেকটা অধ্যায়, প্রতিটি মোড় একেকটা সমাপ্তি। ঠিক করে নাও কোন পথে হাঁটবে।”
অরিন্দম গলা শুকনো করে ফিসফিস করল—
—মানে? তাহলে আমরা নিজেরাই চরিত্র?
মেঘলার চোখে ভয় আর মুগ্ধতা মিলেমিশে একাকার। সে দেখল, গলির একপাশে একটা দরজায় লেখা আছে “অতীত।” আরেকপাশে আরেকটা দরজায় লেখা “ভবিষ্যৎ।”
ঋত্বিকের কণ্ঠ ভেসে এল যেন দূর আকাশ থেকে—
—মনে রাখিস, প্রতিটি বেছে নেওয়া পথই লিখে দেয় নতুন কাহিনি। কিন্তু প্রতিটি কাহিনির ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ফাঁদ।
হঠাৎ নগরীর আকাশ জ্বলে উঠল। পাতার শব্দ আবার প্রতিধ্বনিত হল চারদিকে—
“এখানে ঢুকলে ফেরার পথ নেই। তবে প্রতিটি পাঠক একদিন লেখক হয়ে ওঠে।”
মেঘলা আর অরিন্দম একে অপরের দিকে তাকাল। তাদের সামনে খোলা দুটি দরজা—অতীত আর ভবিষ্যৎ।
কোনটা বেছে নেবে তারা?
পর্ব ৫ – গ্রন্থাগারের গোপন কক্ষ
মেঘলার বুক ধড়ফড় করছিল। সামনে দুটো দরজা—একটায় লেখা “অতীত”, আরেকটায় “ভবিষ্যৎ।” কিন্তু দরজাগুলো যেন নড়ছে, দপদপ করে জ্বলছে, যেন সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তাদের চোখে চোখ রেখেই অপেক্ষা করছে।
অরিন্দম হাত ঘামতে ঘামতে বলল—
—আমি ভবিষ্যতের দিকেই যাব। অতীত তো শুধু বোঝা।
মেঘলা তার হাত টেনে ধরল।
—না, থামো। আমি মনে করি আমাদের অতীত না বুঝলে ভবিষ্যৎ খুঁজে পাওয়া যায় না।
কথা শেষ হওয়ার আগেই দরজাগুলো কেঁপে উঠল। দুটো দরজা একসাথে খুলে গেল, আর এক ঝলক আলো তাদের ভেতরে টেনে নিল। মুহূর্তের মধ্যে তারা আবার লাইব্রেরির মূল কক্ষে এসে পড়ল। চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু বইয়ের পাতা আস্তে আস্তে উল্টে যাচ্ছে, যেন শ্বাসের শব্দ।
ঋত্বিক দাঁড়িয়ে আছেন মেঝের মাঝখানে। তার চোখে এখন আর শান্ত দীপ্তি নেই, বরং গভীর ক্লান্তি।
—তোমরা গোলকধাঁধা থেকে ফিরে এসেছ, এটাই বিস্ময়। সবাই ফেরে না।
মেঘলা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল—
—ওটা… কী ছিল? এক শহর, এক শূন্যতা, মানুষ… আমরা নিজেরাই চরিত্র হয়ে গিয়েছিলাম।
ঋত্বিক গম্ভীর গলায় বললেন—
—ওটাই গ্রন্থাগারের আসল চেহারা। প্রতিটি বইয়ের ভেতরে আছে একেকটা জগত। পাঠকরা ঢুকে পড়লে বই তাদের নিয়ে নেয় নিজের ভিতরে। আর একবার যদি পাঠক বইয়ের চরিত্র হয়ে যায়, তবে গল্প তার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে।
অরিন্দম এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না।
—তাহলে এর মানে… হাজার হাজার বই মানেই হাজার হাজার বাস্তব?
ঋত্বিক তাকালেন তাকগুলোর দিকে।
—আরও বেশি। এই লাইব্রেরিতে যত পাঠক এসেছে, তাদের কাহিনিগুলোও এখানে জন্ম নিয়েছে। কেউ বইয়ের ভেতরে ঢুকে বেঁচে গেছে, কেউ হারিয়ে গেছে। এভাবে এই তাকগুলো একসময়ে পরিণত হয়েছে “মানবজাতির সম্মিলিত স্মৃতি”-তে।
মেঘলা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। বইগুলোর ফাঁক দিয়ে যেন সে দেখতে পাচ্ছে অসংখ্য চোখ। প্রতিটি চোখে প্রতিফলিত হচ্ছে অচেনা জীবন, অচেনা মৃত্যু।
ঋত্বিক নিচু গলায় বললেন—
—কিন্তু এটাই সব নয়। এসো, তোমাদের আরও কিছু দেখাই।
তিনি টেনে নিয়ে গেলেন লাইব্রেরির নিচতলার দিকে। সরু সিঁড়ি, স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। নেমে এসে তারা দাঁড়াল এক বিশাল অন্ধকার কক্ষে। কক্ষের চারপাশে অগণিত বই ভাসছে—তারা তাকের ওপরে নেই, বাতাসে ভেসে ঘুরছে। প্রতিটি বই খুলছে, বন্ধ হচ্ছে, আর নিজেদের অক্ষরে নতুন নতুন লাইন লিখছে।
মেঘলা অবাক হয়ে বলল—
—এরা নিজেরাই লিখছে!
ঋত্বিক মাথা নাড়লেন।
—এই কক্ষটাই “গোপন কক্ষ।” এখানে বইগুলো আর মানুষের লেখা থাকে না। এখানে তারা নিজেরাই গল্প তৈরি করে। কল্পনা করো, হাজারো বই একসাথে লিখছে—এটা কেবল জ্ঞান নয়, এটা এক সম্মিলিত চেতনা।
অরিন্দম কাঁপা গলায় বলল—
—মানে, এটা কোনো মানুষের তৈরি নয়?
ঋত্বিক ফিসফিস করে উত্তর দিলেন—
—এই গ্রন্থাগার শুধু পৃথিবীর নয়। এটা মহাজাগতিক বুদ্ধিমত্তার অংশ। যে কোনো সভ্যতার গল্প একদিন এসে মিশে যায় এখানে। আর এখন… এই লাইব্রেরি মানুষের ভবিষ্যৎ লিখছে।
মেঘলার বুক ঠাণ্ডা হয়ে গেল। সে দেখল, ভাসমান এক বইয়ের পাতায় লেখা হচ্ছে—
“এক তরুণী গবেষক এবং এক অবিশ্বাসী হ্যাকার দাঁড়িয়ে আছে শেষ গ্রন্থাগারের গোপন কক্ষে। তাদের সিদ্ধান্ত বদলে দেবে মানবজাতির ইতিহাস।”
সে শিউরে উঠল। অরিন্দমও বইটার দিকে তাকিয়ে রইল স্তব্ধ হয়ে। তারা বুঝে গেল—এখন আর এই লাইব্রেরি শুধু গবেষণার জায়গা নয়। এটা তাদের জন্য এক ভয়ঙ্কর দায়বদ্ধতা।
পর্ব ৬ – প্রথম বিদ্রোহ
লাইব্রেরির গোপন কক্ষ যেন নিঃশ্বাস নিচ্ছিল। চারপাশে ভাসমান বইগুলো নিজেরাই উল্টেপাল্টে চলেছে, পাতার পর পাতা ঝলসে উঠছে অদ্ভুত আলোয়। মেঘলা আর অরিন্দম চোখ মেলে তাকিয়ে আছে। তাদের মনে হচ্ছে, এ যেন আর বই নয়, জীবন্ত প্রাণীর দল, যারা শব্দের ভেতর বেঁচে থাকে।
ঋত্বিক ফিসফিস করে বললেন—
—আজ থেকে সতর্ক থেকো। লাইব্রেরি নীরব থাকলে কোনো ক্ষতি নেই, কিন্তু একবার বিদ্রোহ শুরু হলে, তা থামানো যায় না।
অরিন্দম অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে হেসে উঠল।
—বই বিদ্রোহ করে? বইয়ের কী-ই বা ক্ষমতা আছে?
কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে এক মোটা বই হঠাৎ তীব্র শব্দে খুলে গেল। ভেতর থেকে ঝড়ের মতো শব্দ বেরোল। পাতার ভেতরে লেখা অক্ষরগুলো আলাদা হয়ে ভেসে উঠল বাতাসে, যেন অসংখ্য উজ্জ্বল পতঙ্গ। তারপর সেই অক্ষরগুলো একসাথে জড়ো হয়ে নতুন বাক্য তৈরি করতে লাগল।
মেঘলা বিস্ফারিত চোখে পড়তে লাগল—
“ইতিহাস বদলাও। রক্ত মুছে দাও। যুদ্ধ মুছে দাও।”
ঋত্বিক গম্ভীর কণ্ঠে বললেন—
—দেখছিস? ওরা মানুষের লেখা ইতিহাস পাল্টে দিতে চায়।
ঠিক তখনই এক ভাসমান বইয়ের পাতায় হঠাৎ লেখা ফুটে উঠল—
“১৯১৪—কোনো যুদ্ধ হয়নি।”
আর সঙ্গে সঙ্গে কক্ষ কেঁপে উঠল। বাতাস জমে গেল। মেঘলার মনে হল যেন চারপাশের বাস্তব বদলে যাচ্ছে। চোখের সামনে দেয়ালে টাঙানো মানচিত্রে হঠাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের চিহ্ন মিলিয়ে গেল। তার বদলে সেখানে লেখা হলো—“শান্তি চুক্তি, বিশ্বে কোনো যুদ্ধ হয়নি।”
অরিন্দম চমকে পেছনে সরে এল।
—এটা… এটা কীভাবে সম্ভব? বাস্তব তো পরিবর্তিত হয়ে গেল!
ঋত্বিক মাথা নিচু করলেন।
—এই প্রথম নয়। বহুবার লাইব্রেরি ইতিহাস পাল্টে দিয়েছে। শুধু মানুষ টের পায় না, কারণ নতুন ইতিহাসই তাদের মনে ঢুকে যায়। স্মৃতি বদলে যায়, দুনিয়া বদলে যায়।
মেঘলার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত নামল।
—মানে আমরা হয়তো এমন এক পৃথিবীতেই বাস করছি, যেটা বইগুলো লিখে দিয়েছে?
ঠিক তখনই আরও কয়েকটা বই একসাথে ফেটে গেল। অক্ষরের ঝড় ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। নতুন লাইন ভেসে উঠতে লাগল—
“১৯৪৫—নাগাসাকি বেঁচে গেছে।”
“১৯৭১—বাংলা ভাঙেনি, ইতিহাস অন্যরকম।”
“২০২০—মহামারী কখনো ঘটেনি।”
অরিন্দম মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল।
—না… এটা মেনে নেওয়া যায় না। তাহলে আমরা কারা? আমাদের অতীত আসলেই কি ছিল? নাকি সব কেবল এই লাইব্রেরির লেখা?
ঋত্বিক কণ্ঠ ভারী করে বললেন—
—এই জন্যই একে বিদ্রোহ বলা হয়। বইগুলো মাঝে মাঝে নিজেদের মতো করে মানবজাতির পথ পাল্টে দিতে চায়। তারা ভাবে, মানুষের তৈরি কাহিনি অসম্পূর্ণ। কিন্তু যদি তারা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নেয়, তবে মানুষ নিজের ভবিষ্যৎও হারিয়ে ফেলবে।
মেঘলা ভয়ে আর বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল চারদিকে। সে স্পষ্ট বুঝল, বইগুলো শুধু কাহিনি নয়—এরা শক্তি। আর সেই শক্তি এখন বিদ্রোহ শুরু করেছে।
হঠাৎ ভাসমান এক বই সোজা মেঘলার সামনে এসে থেমে গেল। পাতার ওপর উজ্জ্বল অক্ষরে ভেসে উঠল—
“তুমি কি আমাদের সাথে আছো? নাকি আমাদের থামাবে?”
মেঘলার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। কক্ষ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। হাজার হাজার চোখ তাকে চেয়ে আছে অদৃশ্য পাতার আড়াল থেকে।
মানবজাতির ইতিহাস, ভবিষ্যৎ—সবই এখন তার এক সিদ্ধান্তের ওপর দাঁড়িয়ে।
পর্ব ৭ – লাইব্রেরির শর্ত
লাইব্রেরির গোপন কক্ষে দাঁড়িয়ে মেঘলার গলা শুকিয়ে আসছিল। অদৃশ্য চোখগুলো যেন তাকেই চেয়ে আছে, আর বাতাসে ভেসে উঠছে সেই প্রশ্ন—“তুমি কি আমাদের সাথে আছো? নাকি আমাদের থামাবে?”
অরিন্দম উত্তেজিত কণ্ঠে বলল—
—এদের থামাতেই হবে! দেখছ না? ইতিহাস পাল্টে দিচ্ছে এরা। আজ যুদ্ধ মুছে দিচ্ছে, কাল হয়তো পুরো মানবসভ্যতাই মুছে দেবে।
ঋত্বিক গভীর গলায় বললেন—
—অথচ এটাই সত্যি, অরিন্দম। বইগুলো মনে করে মানুষের ভুলে ভরা ইতিহাস সংশোধন করা তাদের কাজ। হয়তো তারা আমাদের চাইতেও বেশি করুণাময়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—মানুষ কি নিজের ইতিহাস বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা হারাতে রাজি?
মেঘলা স্তব্ধ হয়ে শুনছিল। তখনই কক্ষের কেন্দ্রে সব বই একসাথে আলো ছড়াল। পাতাগুলো একত্র হয়ে তৈরি করল এক বিশাল ঝলমলে মুখ, যেন অসংখ্য অক্ষরের জ্যোতিতে গড়া এক মহাজাগতিক সত্তা। সেই মুখ থেকে ভেসে এল কণ্ঠ—
—আমরা গ্রন্থাগার। আমরা কাহিনির জন্মদাতা। আমরা চাই মানুষকে ভুল থেকে রক্ষা করতে। কিন্তু তোমাদের সম্মতি চাই।
মেঘলা কেঁপে উঠে ফিসফিস করে বলল—
—কী ধরনের সম্মতি?
সেই কণ্ঠ বজ্রের মতো গর্জে উঠল—
—আমাদের পূর্ণ স্বাধীনতা দাও। আমরা চাই মানুষের ভবিষ্যৎ লিখতে। তোমরা শুধু পাঠক হয়ে থাকবে। তবেই দুঃখ মুছে যাবে, মৃত্যু বদলে যাবে জন্মে, অশ্রু বদলে যাবে হাসিতে।
অরিন্দম রাগে কাঁপতে লাগল।
—না! এটা দাসত্ব। যদি মানুষ শুধু পাঠক হয়, তবে মানুষ থাকবে কোথায়? তখন তো আমরা আর স্বাধীন থাকব না, শুধু চরিত্র হয়ে যাব।
ঋত্বিক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
—এই শর্ত আমি বহু বছর আগে শুনেছিলাম। আমি রাজি হইনি, তাই গ্রন্থাগার এতদিন অপেক্ষা করেছে। এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে তোমাদের।
মেঘলার বুক ধুকপুক করছে। তার মনে পড়ল নিজের জীবনের কষ্টের কথা—হারানো বাবার মৃত্যু, বহু স্বপ্ন ভেঙে যাওয়া, যুদ্ধের খবর দেখে রাতে ঘুম হারানো। যদি সত্যিই বইগুলো এসব বদলে দিতে পারে? যদি মানবজীবন থেকে দুঃখ মুছে যায়?
সে বিড়বিড় করে বলল—
—কিন্তু যদি সব দুঃখ মুছে যায়, তবে আনন্দও তো অর্থহীন হয়ে যাবে।
সেই মহাজাগতিক মুখ হেসে উঠল অক্ষরের ঝলকে—
—তবু কষ্টহীন জীবনই কি তোমরা চাও না? মানুষ নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস করছে। আমাদের লেখায় মুক্তি আছে।
ঠিক তখনই লাইব্রেরি হঠাৎ কেঁপে উঠল। বাইরে বজ্রপাতের মতো শব্দ হলো, যেন পাহাড় দুলে উঠল। মেঘলা জানল—এ সিদ্ধান্ত আর এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।
তার সামনে এক বই খুলে গেল, তাতে লেখা উঠল—
“মেঘলা সেন—তুমি কি আমাদের স্বাধীনতা দেবে?”
অরিন্দম তার হাত চেপে ধরল।
—না বলো! না বলো, মেঘলা! নইলে আমরা সবাই হারিয়ে যাব।
ঋত্বিক চুপচাপ তাকিয়ে আছেন। তার চোখে ভয়ের সঙ্গে মিশে আছে মমতা, যেন তিনি আগেই জানতেন এই মুহূর্ত আসবে।
মেঘলা নিঃশ্বাস টেনে দাঁড়িয়ে গেল। চারদিকে বইয়ের পাতার ঝড়, অক্ষরের আলো, আর সেই কণ্ঠের গর্জন—
—হ্যাঁ… না… সিদ্ধান্ত এখন তোমার।
মেঘলা চোখ বন্ধ করল। তার মনে হচ্ছিল, পৃথিবীর সমস্ত ইতিহাস তার বুকের ভেতর ঢুকে পড়ছে—যুদ্ধ, প্রেম, মৃত্যু, জন্ম, সব একসাথে।
এখন সে যা বলবে, তাই হয়তো লিখে দেবে সমগ্র মানবজাতির ভাগ্য।
পর্ব ৮ – শেষ সিদ্ধান্ত
কক্ষের ভেতর হাজারো বই একসাথে শ্বাস নিচ্ছে, যেন প্রতিটি মলাটই ধুকপুক করা হৃদয়। অক্ষরের মুখ আবার গর্জে উঠল—
—হ্যাঁ না, মেঘলা সেন। আমাদের স্বাধীনতা দাও, নইলে আমরা নিজেরাই নিয়ে নেব।
মেঘলার হাত ঘেমে উঠেছে। তার কানে বাজছে অরিন্দমের কণ্ঠ—
—না বলো! না বলো! এরা আমাদের শেষ করে দেবে।
ঋত্বিক চুপচাপ তাকিয়ে আছেন, যেন অপেক্ষা করছেন বহুদিনের প্রহর ভাঙার।
মেঘলার মাথার ভেতর ঝড় উঠেছে। যদি বইগুলো স্বাধীন হয়, তাহলে হয়তো মানবজাতির সমস্ত কষ্ট মুছে যাবে। যুদ্ধ হবে না, ক্ষুধা থাকবে না, মৃত্যু কেবল নতুন জন্মে পরিণত হবে। কিন্তু তখন মানুষ আর নিজের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক থাকবে না, কেবল বইয়ের পাতার চরিত্র হয়ে বেঁচে থাকবে।
সে চোখ বন্ধ করল। মায়ের মুখ মনে পড়ল—রাতে ঘুম পাড়ানোর আগে গল্প বলতেন। তখন গল্পে ভরা দুঃখও তাকে শান্তি দিত, কারণ মা বলতেন—“দুঃখ না থাকলে গল্পও পূর্ণ হয় না।”
মেঘলা ধীরে চোখ খুলল। তার ঠোঁট শুকনো কিন্তু দৃঢ়—
—না। আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব না। মানুষ ভুল করবেই, কষ্ট পাবে, কিন্তু সেই কষ্ট থেকেই নতুন গল্প জন্ম নেবে। আমরা শুধু পাঠক নই, আমরা লেখকও।
অক্ষরের মুখ হঠাৎ ঝড়ের মতো কেঁপে উঠল। অন্ধকার কক্ষ আলোকিত হলো ভয়াবহ ঝলকে। সব বই একসাথে খুলে গেল, পাতার শব্দে কক্ষ ভরে উঠল বজ্রধ্বনির মতো—
—তুমি অস্বীকার করছ? তুমি মানুষকে দুঃখে ফেলে রাখবে?
অরিন্দম ভয়ে মেঘলার হাত আরও শক্ত করে ধরল। কিন্তু মেঘলার গলা কাঁপল না।
—দুঃখের ভেতর দিয়েই মানুষ শিখেছে ভালোবাসতে। যদি সব ঠিকঠাক লিখে দেওয়া হয়, তবে আমরা আসলেই আর মানুষ থাকব না।
মুহূর্তের মধ্যে আলো নিভে গেল। সব বই নিস্তব্ধ। কক্ষ যেন হঠাৎ শূন্য হয়ে গেল। তারপর ধীরে ধীরে একটিমাত্র বই ভেসে এল মেঘলার সামনে। বইটির মলাটে সোনালি অক্ষরে লেখা উঠল—
“শেষ গ্রন্থাগার – লেখক: মেঘলা সেন।”
সে কাঁপতে কাঁপতে বইটা ধরল। পাতার ভেতরে লেখা—
“আজ মেঘলা সেন মানুষের ভাগ্যকে মানুষের হাতেই রেখে দিল। গ্রন্থাগার সরে গেল আড়ালে, কিন্তু পৃথিবীর প্রতিটি পাঠকের ভেতরে রয়ে গেল লেখকের বীজ।”
আলো মিলিয়ে যেতেই তারা তিনজন নিজেদের আবার লাইব্রেরির মূল হলে দাঁড়িয়ে দেখতে পেল। তাকগুলো স্থির, বইগুলো নিশ্চুপ। যেন কিছুই ঘটেনি।
অরিন্দম হাঁপাতে হাঁপাতে বলল—
—তুমি… তুমি বাঁচিয়ে দিলে আমাদের।
ঋত্বিকের চোখ ভিজে উঠল।
—তুই ঠিক কাজই করেছিস, মেঘলা। গ্রন্থাগার আবার অদৃশ্য হবে, হয়তো হাজার বছর পর আবার জেগে উঠবে। কিন্তু আজ মানুষের হাতে ফিরল তার নিজের কাহিনি।
বাইরে কুয়াশা ভেঙে ভোরের আলো ঢুকছিল। পাহাড়ের ওপর প্রথম সূর্যের রোদ। মেঘলা বুকের ভেতর বইটা চেপে ধরল। সে জানত, এই গল্প এখানেই শেষ নয়। এখন পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই তার নিজের কাহিনি লিখবে—হয়তো কষ্টে, হয়তো আনন্দে।
আর কোথাও অদৃশ্য কোনো কোণে, শেষ গ্রন্থাগার আবার অপেক্ষা করবে নতুন পাঠকের জন্য।
সমাপ্ত




