Bangla - রহস্য গল্প

শেষের গন্ধ

Spread the love

অনিন্দ্য সেন


সকালটা অন্য দিনের মতোই ছিল—আলোর বন্যা ছড়িয়ে পড়ছে শেক্সপিয়র সরণির খোলা জানলা দিয়ে, পাখির ডানার শব্দ মিশে যাচ্ছে ঘড়ির টিকটিক শব্দে। কিন্তু অনির্বাণ বসুর নাকে সকালটা কেমন যেন অন্যরকম গন্ধ নিয়ে হাজির হয়েছিল। এই গন্ধটা সে এর আগে কখনও পায়নি। যেন বাদামি কাগজের ভাঁজে পুরনো অভিমানের মত গন্ধ, যেন এক মৃত নারীর ঠোঁটে লেগে থাকা শেষ হাসির ছায়া।

অনির্বাণ, পেশায় এক ‘নোজ’—অর্থাৎ পেশাদার ঘ্রাণবিশেষজ্ঞ। বিদেশ থেকে স্নাতক করে ফিরে এসে গত পাঁচ বছর ধরে সে কলকাতার সবচেয়ে অভিজাত পারফিউম ব্র্যান্ড ‘সুরভি’তে কাজ করে। তার কাজ নতুন সুগন্ধের সন্ধান, নতুন ঘ্রাণের সংমিশ্রণ তৈরি করা, যেগুলো মানুষ পরে গায়ে মাখবে আর স্মৃতি জাগবে। কিন্তু আজ সে কোনো বোতল থেকে নয়, বরং নিজের ঘরের বাতাসেই পেল এই অদ্ভুত ঘ্রাণ।

“নতুন কিছু তৈরি করছ?” দরজায় দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল তার সহকর্মী ও বন্ধু নীলাঞ্জনা।

“না রে… আজ সকালেই একটা গন্ধ নাকে এল, যা আমি চিনতেই পারছি না। কিসের যেন পচা মধু, তার উপর গন্ধরাজের হালকা আভা, কিন্তু… কেমন যেন…” অনির্বাণ থেমে গেল।

নীলাঞ্জনা মুচকি হেসে বলল, “গন্ধ নিয়েই যদি ভুল করিস, তবে আমাদের চাকরি যাবে কে বাঁচাবে?”

“আমি ভুল করছি না,” অনির্বাণ কপালে হাত রাখল, “এই গন্ধটা আমি সত্যি কোথাও পাইনি আগে। অথচ, এটা বাস্তব। এবং এটা ঘরে আসেনি… মনে হচ্ছে যেন বাতাসই আজ একটু অন্যরকম।”

বিকেলে অনির্বাণ অফিসে গিয়ে জানল, শহরের দক্ষিণ কলকাতায় আজ সকালে এক বৃদ্ধার রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। খবরে বলা হয়েছে—বৃদ্ধা ছিলেন একসময়কার বিখ্যাত পারফিউম শিল্পী, তার নাম মীনাক্ষী দে।

“অদ্ভুত ব্যাপার!” নীলাঞ্জনা খবরের কাগজটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিল, “দেখ… রিপোর্টে লেখা আছে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে একটা অদ্ভুত গন্ধ টের পেয়েছে, যেটা নাকি টিকে ছিল অনেকক্ষণ।”

অনির্বাণ চুপ করে খবরটা পড়ল।
– ‘ঘরের ভেতর একটা ঘন সুগন্ধ পাওয়া গেছে, যা অনেকটা পুরনো চন্দনের মত, কিন্তু তার ভিতরে যেন মধুর গন্ধ আর একটা গা ছমছমে অনুভূতি। পুলিশ সন্দেহ করছে বিষক্রিয়া, তবে কিছু বোঝা যাচ্ছে না।’

সে চমকে উঠল। ঠিক এই গন্ধটিই তো সে সকালে নিজের ঘরেই পেয়েছিল!

রাতে সে নিজেই গেল মীনাক্ষী দের বাড়ি। পুরনো ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের বাড়ি, ছায়াঘেরা বারান্দা, ভাঙাচোরা জানলা। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সে দেখল এক বয়স্ক লোক হেঁটে আসছে—পুলিশের পোশাকে।

“আপনি কে?”

“আমি অনির্বাণ বসু। পারফিউম নিয়ে কাজ করি। আমি খবরটা পড়ে… যদি একটু ঘরটা দেখতে পারি… হয়তো সাহায্য করতে পারি।”

“আপনি কি এই গন্ধ চিনতে পারেন?” অফিসার একটা কাগজে ছড়ানো তুলোয় ভিজে থাকা বস্তু তার দিকে বাড়িয়ে দিল। অনির্বাণ নাকের কাছে আনতেই চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল।

“এটা ঠিক সেই গন্ধ। আমি এটা কখনও কোনো কমার্শিয়াল পারফিউমে পাইনি।”

“আমরা খুঁজেও কোনো পারফিউম বোতল পাইনি ঘরে। বরং একটা ছোট কাঁচের শিশি ছিল, তাতে লেখা ছিল ‘No. 79’। আপনি কিছু বলতে পারেন?”

‘No. 79’—এই নামটা কোথাও শুনেছে অনির্বাণ। মাথার ভিতরে যেন ঝড় উঠল। পরদিন সে অফিসে গিয়ে পুরনো পারফিউম রিসার্চ ফাইল খুলল। সত্তরের দশকে কলকাতায় এক রহস্যময় ঘ্রাণশিল্পী ছিলেন, যিনি বাজারে কোনো পারফিউম ছাড়তেন না। তিনি শুধু নির্দিষ্ট কিছু অভিজাত ব্যক্তিদের জন্য গন্ধ বানাতেন। তার কোড ছিল—No. 79।

“মানে এই মহিলা সেই শিল্পী? তাহলে তার গন্ধ আজ এত বছর পর… কিন্তু আমি তো ওর সঙ্গে কখনও দেখা করিনি। তবে আমার ঘরে সেই গন্ধ এল কীভাবে?”

প্রশ্নটা শুধু তার মাথায় নয়, যেন বাতাসেই ভাসছিল।

তৃতীয় দিনে আরও এক ঘটনা ঘটল—শহরের আরেক প্রান্তে, এক নামকরা শিল্পপতির অস্বাভাবিক মৃত্যু। একই ধাঁচের গন্ধ পাওয়া গেল ঘরে। আবার ‘No. 79’।

এখন আর অনির্বাণ চুপ করে থাকতে পারল না। সে খুঁজতে শুরু করল সেই ফর্মুলার উৎস। রাতে সে নিজের নাকে গন্ধ শুঁকে বারবার যাচাই করছিল, মস্তিষ্কের ঘ্রাণ-স্মৃতি ঘেঁটে সে বুঝল—এই গন্ধ তৈরি হয়েছে একধরনের পুরনো বার্মা স্যান্ডালউড, রক্তজবা পাপড়ির নির্যাস, সিংহল দ্বীপের এক বিশেষ ফুলের তেল দিয়ে—যার নাম ‘গান্দার’—এবং সবচেয়ে আশ্চর্য—একফোঁটা মানুষের রক্ত!

সে চমকে উঠল।

মানুষের রক্ত দিয়ে পারফিউম?

সেই রাতে এক অচেনা নম্বর থেকে ফোন এল—কোনো কথা নেই, শুধু একটা মৃদু হাসি আর গন্ধরাজ ফুলের গন্ধ যেন ফোনের ওপার থেকে উঠে এল।

অনির্বাণ বুঝল—গল্পটা শুধু সুগন্ধের নয়, এটা এক মৃত্যুর শ্বাসে মিশে থাকা কোনো প্রাচীন প্রতিশোধের গন্ধ… যে গন্ধ শুরু হয়েছে। শেষ হয়নি।

ফোনের ওপার থেকে আসা সেই মৃদু হাসিটা যেন অনির্বাণের মেরুদণ্ড বেয়ে বরফের ধারার মতো বয়ে গেল। একটাও শব্দ হয়নি, অথচ তার মনে হল, একটা অদ্ভুত শব্দ শুনল—জলের গড়িয়ে পড়া? না, কারো নিঃশ্বাস? ফোন কেটে যাওয়ার পরেও যেন সেই গন্ধরাজ ফুলের গন্ধ তার কানে-কানে রয়ে গেল।

সে উঠে গিয়ে জানলা বন্ধ করল। কিন্তু তাতে কিছু বন্ধ হল না। ঘরের প্রতিটা কোণায় যেন সেই গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। তার মগজ তখন ছটফট করছে—এই গন্ধ একসময় পবিত্র ছিল, পুজোর মতো কোমল। এখন তা ভয় পাইয়ে দিচ্ছে।

পরদিন অফিসে গিয়েই সে বলল নীলাঞ্জনাকে, “আমার মনে হচ্ছে আমরা যেটাকে পারফিউম ভাবছি, সেটা আসলে একটা হিউম্যান সিগনেচার। মানে, কেউ ঘ্রাণ দিয়ে ইচ্ছাকৃত ভাবে মেসেজ ছড়াচ্ছে। খুনের সময় ঘ্রাণটা ব্যবহার হচ্ছে যেন একধরনের ট্যাগের মতো।”

নীলাঞ্জনা ভ্রু কুঁচকে বলল, “তুই যা বলছিস, তাতে মনে হচ্ছে এটা একটা সিরিয়াল কিলার কেস। পারফিউম দিয়ে চিহ্ন দিচ্ছে খুনি?”

“ঠিক তাই,” অনির্বাণ বলল, “এবং এই ‘No. 79’ তার সিগনেচার। আমার ধারণা, এই গন্ধটা শুধু পারফিউম নয়। এটা একটা কেমিক্যাল কোডও।”

সে জানত, কোনও ঘ্রাণে ব্যবহৃত উপাদান থেকেই মানুষের মস্তিষ্কে নির্দিষ্ট প্রতিক্রিয়া তৈরি করা যায়। যেমন কিছু গন্ধ অ্যালার্জি ঘটায়, কিছু উদ্বেগ বাড়ায়, কিছু তন্দ্রা আনে। যদি কেউ চায়, তাহলে বিশেষ উপায়ে তৈরি ঘ্রাণ দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্তও করা যায়।

ঠিক সেই সময়েই ফোন এলো কলকাতা পুলিশের পক্ষ থেকে।

“মিস্টার বসু, আপনি কি আজ সন্ধ্যায় আমাদের হোমিসাইড সেলে আসতে পারবেন? আপনাকে একটা বিশেষ বস্তু ঘ্রাণে পরীক্ষা করতে হবে।”

“অবশ্যই,” বলল অনির্বাণ।

ওই সন্ধ্যায় সে গিয়ে পৌঁছাল লালবাজারের পেছনের সেই পুরনো ঘরে—যেখানে খুনের নমুনা রাখা হয়।

একজন অফিসার কাঁচের বাক্সে রাখা একটি কাপড়ের টুকরো দেখাল। “এই রুমালে সেই গন্ধ আছে, যা খুন হওয়া শিল্পপতির ঘরে পাওয়া গিয়েছিল।”

অনির্বাণ চোখ বন্ধ করল। শুঁকে দেখল।

সে বোঝে এই গন্ধ শুধু সুগন্ধ নয়। এতে একটা ভারী দাহ আছে। যেন কোনো বিষাক্ত স্মৃতির গন্ধ। যেন কারো প্রাক্তন জীবন ভেঙে-চুরে দেওয়া হয়েছে, এবং সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে তৈরি হয়েছে এই ঘ্রাণ।

“এই গন্ধ তৈরি করা যায় না হঠাৎ করে,” অনির্বাণ বলল। “এটা অনেক পুরোনো রেসিপি। যেটা হাতে তৈরি হয়, হাই গ্রেড এসেনশিয়াল অয়েল দিয়ে। এবং সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার—এতে হিউম্যান ব্লাড ইউজ করা হয়েছে।”

“আপনি কি নিশ্চিত?”

“হ্যাঁ। আমার অনুমান, এই গন্ধ এক ধরণের ট্রিগার—যেটা মানুষকে either মানসিকভাবে স্তব্ধ করে দেয় বা তাদের sense গুলিয়ে দেয়। কেউ যদি ঘরে ঢোকে এই গন্ধের সময়, তার ওপর প্রভাব ফেলবেই।”

পুলিশ আরও জানাল যে খুন হওয়া বৃদ্ধা মীনাক্ষী দে ও শিল্পপতি সুমন্ত ঘোষ—দুজনেই ১৯৭০-এর দশকে এক গোপন পারফিউম ক্লাবে যুক্ত ছিলেন। নাম ছিল “The Fragrance Circle”।

“আমরা সেই ক্লাবের নাম আগে শুনিনি,” অফিসার বললেন, “তবে আমরা জানি যে এটি শুধুমাত্র ইনভাইটেশন-ভিত্তিক ছিল। এবং সব সদস্য ছিলেন সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি—কবি, শিল্পী, পারফিউম বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক পর্যন্ত।”

অনির্বাণের গলা শুকিয়ে এল।

সে বেরিয়ে এল থানার সামনে। মাথার মধ্যে চক্কর কাটছিল—একটা গন্ধ নিয়ে খুন হচ্ছে, এবং সেই গন্ধ সে নিজে শুঁকেছে। হয়তো কোনোভাবে সে নিজেও এখন এই চক্রের ভিতরে ঢুকে পড়েছে।

রাতে ফিরে সে নিজের পুরনো জার্নাল খুলল—সেখানে একসময় সে কিছু দুঃস্বপ্ন লিখে রেখেছিল। একটা পাতায় লেখা ছিল—“আমি যেন এক বাড়িতে ঢুকেছি। সব কিছুই সাদা। আর সেই সাদা ঘরের ভিতর এক নারী বসে আছেন। তার হাতে এক শিশি। গন্ধে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।”

সে বুঝতে পারল—এই শিশির গন্ধটা তার চেতনায় বহু আগেই ঢুকে পড়েছিল, হয়তো অস্পষ্ট কোনো সংবেদনের আকারে।

ঠিক তখনই আবার সেই ফোন।

এইবার ওপার থেকে একটা কণ্ঠস্বর।

“তুমি তো ভালোই চিনতে পারছো গন্ধটা, অনির্বাণ। কিন্তু যদি গন্ধটা তোমাকেই একদিন মারার জন্য তৈরি হয়?”

সে হিম হয়ে গেল।

“কে আপনি?”

“তুমি কি জানো, তোমার বাবাও ‘Fragrance Circle’-এর সদস্য ছিলেন?”

অনির্বাণ যেন অসাড় হয়ে গেল।

“তুমি জানো না, তোমার বাবার মৃত্যুও ছিল একই রকম। সেই গন্ধ, সেই গোপনীয়তা… তোমাকে আসতে হবে—‘চৌরঙ্গী ৭৯’-এ।”

ফোন কেটে গেল।

‘চৌরঙ্গী ৭৯’?

তবে কি এই ‘No. 79’ শুধু ফর্মুলার নাম নয়—একটি ঠিকানা?

রাত তখন ঘনিয়ে এসেছে। কলকাতার বাতাসে কুয়াশা নেই, তবু ঘ্রাণ ভারী হয়ে উঠছে।

অনির্বাণ জানে—সে এক ভয়ঙ্কর পথের দিকে এগোচ্ছে। গন্ধ যে শুধু স্মৃতি নয়, কখনও তা হয়ে উঠতে পারে শাস্তির হাতিয়ার।

চৌরঙ্গীর ৭৯ নম্বর বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে অনির্বাণ যেন এক গন্ধময় অতীতের মুখোমুখি। বাড়িটা একদম রাস্তার ভিড়ের মাঝে হলেও যেন এক আড়ালে ঢাকা, চোখে পড়ে না এমনভাবে। লাল ইটের পুরনো কাঠামো, মুখ বন্ধ জানালা, নীচে একটি সোনালি পিতলের প্লেটে লেখা—“D. K. Samanta”।

সে জানে না কে এই সমান্ত, তবে অন্তর্গত একটা অনুভূতি বলে—এই বাড়ির ভেতরেই লুকিয়ে আছে সেই ‘Fragrance Circle’-এর শেষ কিছু চিহ্ন, এবং সম্ভবত তার বাবার অতীতও।

গেটটা ধাক্কা দেওয়ামাত্র খুলে গেল। ভিতরে প্রবেশ করতেই এক ঝলক বাতাস এসে ওর মুখে লাগল। সেই একই গন্ধ—গান্দার ফুল, বার্মা চন্দন, রক্তজবা আর এক অদ্ভুত মেটালিক আভা।

ঘরের ভেতরে আলো কম। একটা লম্বা করিডোর, দুই পাশে দরজা। হঠাৎ ডান দিকের দরজা খুলে গেল। এক বৃদ্ধা—ধবধবে সাদা শাড়ি, চোখে পুরু চশমা, ঠোঁটে নিস্তেজ এক হাসি।

“অনির্বাণ বসু?”

সে এক মুহূর্ত থেমে বলল, “হ্যাঁ।”

“তোমার বাবা এখানে আসতেন প্রায়ই। তুমি ঠিকই এসেছে। এসো।”

বৃদ্ধা এগিয়ে চলে গেলেন, অনির্বাণ অনুসরণ করল। তারা ঢুকল এক গোলঘরে—চোখ জুড়িয়ে দেওয়া এক সংগ্রহশালা। দেয়ালে নানা ধরণের পারফিউমের শিশি, পুরনো কাঁচের বোতল, ধুপের কাঠি, শুকনো ফুলের থলি, কিছু ক্যানভাসে আঁকা গন্ধের ম্যাপ। ঘরের মাঝখানে একটি রাউন্ড টেবিল—তার উপর রাখা আছে একটি ছোট চামড়ার বাক্স।

“তোমার বাবার বাক্স,” বৃদ্ধা বললেন, “শেষবার তিনি যখন এখানে এসেছিলেন, তখন এই বাক্সটা দিয়ে যান। তোমার জন্য।”

অনির্বাণ বাক্স খুলতেই চোখ স্থির হয়ে গেল—ভিতরে একটি পুরনো চিঠি, কিছু নোট, আর একটি ছোট কাঁচের শিশি—লেবেলহীন। শিশির রঙ লালচে, যেন বর্গকার রক্ত।

চিঠিতে লেখা—
“অনির্বাণ,
আমি জানি একদিন তুমি এই বাক্স খুলবে। হয়তো তখন সবটাই শেষ হয়ে যাবে। এই গন্ধ, এই ফর্মুলা, এই অভিশাপ—সবকিছুর জন্ম হয়েছিল ভুলে। আমরা সেই ভুলে নেমেছিলাম সৌন্দর্যের সন্ধানে। কিন্তু মানুষের আত্মা দিয়ে যদি ঘ্রাণ তৈরি হয়, তবে সেই ঘ্রাণ শুধু মানুষকে মুগ্ধ করে না, তাকে গ্রাসও করে। আমি চাই তুমি এই গন্ধ ধ্বংস করো, কারণ এই গন্ধই আমাকে একদিন মেরে ফেলবে।”

অনির্বাণ বুঝল—এটা তার বাবার লেখা। এবং তার মৃত্যু কোনো প্রাকৃতিক ঘটনা ছিল না।

“আপনার নাম কী?” সে বৃদ্ধাকে জিজ্ঞেস করল।

“আমার নাম জয়ন্তী মুখার্জি। আমি ‘Fragrance Circle’-এর একমাত্র জীবিত সদস্য। বাকিরা হয় নিখোঁজ, নয় মৃত।”

“আপনি জানেন কে মারছে তাদের?”

“হ্যাঁ,” জয়ন্তী গভীরভাবে বললেন, “মীনাক্ষী দে-এর মেয়ে। রূপসী। সে ছোটবেলা থেকেই মায়ের কাজ শেখার চেষ্টা করত। কিন্তু একদিন মীনাক্ষী ওকে পারফিউম ঘরে ঢুকতে দেয়নি। সে জানত, রূপসীর মধ্যে অদ্ভুত এক নিষ্ঠুরতা আছে। রূপসী চুরি করে ফর্মুলা নিয়েছিল। আর এখন প্রতিশোধ নিচ্ছে।”

“কেন?”

“কারণ, মীনাক্ষী একসময় এক পরীক্ষার সময় নিজের মেয়ের রক্ত ব্যবহার করেছিল ‘No. 79’-এর একটি সংস্করণে। এবং রূপসী সেই গন্ধ নিজেই পরে নিজের শরীরে শুঁকে পাগল হয়ে যায়। সেই পাগলামি এখন কীরকম পরিণত হয়েছে, তা তুমি দেখছ।”

অনির্বাণ কাঁপা গলায় বলল, “সে আমার সঙ্গেও যোগাযোগ করেছে। ফোন করেছিল।”

“তাহলে ও তোমাকেও বেছে নিয়েছে,” জয়ন্তী বললেন, “তুমি এখন শুধু একটা নোজ নও। তুমি সেই গন্ধের শেষ উত্তরাধিকারী।”

ঠিক তখনই বাইরে একটা বিকট শব্দ হল। কাঁচ ভাঙার আওয়াজ। কেউ যেন বাড়ির ভেতরে ঢুকেছে।

“তুমি চলে যাও এখনই,” জয়ন্তী কাঁপা গলায় বললেন, “এই শিশিটা নিয়ে যাও, ওটাই শেষ কপি। বাকিগুলো সে ধ্বংস করেছে। এটা নিয়ে গিয়ে বিশ্লেষণ করো, নইলে শহরের আরও মানুষ মরবে।”

অনির্বাণ শিশি নিয়ে বেরিয়ে এল। পেছনে তাকাতেই দেখল, জয়ন্তীর ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে এক নারীর ছায়া—দীর্ঘ কেশ, মুখ ঢাকা, হাতে কিছু একটা। তারপরই কেবল এক চিৎকার—তীক্ষ্ণ, দীর্ঘ, যন্ত্রণায় পরিপূর্ণ।

সে ছুটে বেরিয়ে এল, গায়ে লেগে থাকল সেই ঘ্রাণ—এবার আর তার প্রিয় সুগন্ধ ছিল না, বরং কবরের পাশে পচা গোলাপের মতো কুৎসিত, বিষাক্ত।

সে সোজা পৌঁছাল কলেজ স্ট্রিটে তার পরিচিত কেমিক্যাল অ্যানালিস্ট রফিক সাহেবের ল্যাবে।

“এই লাল ফ্লুইডটা একটু বিশ্লেষণ করতে হবে,” অনির্বাণ বলল, “আমি জানি এতে হিউম্যান ব্লাড আছে। কিন্তু জানতে চাই আরও কিছু।”

রফিক চোখ বড় করে বলল, “এতে তো একধরনের নিউরোটক্সিন আছে। নাম অজানা, কিন্তু প্রভাব মারাত্মক—মানুষের চিন্তাভাবনা ব্লক করে দিতে পারে, স্মৃতি মুছে ফেলতেও সক্ষম। এটা মেডিক্যালি নিষিদ্ধ কেমিক্যাল!”

“মানে কেউ ইচ্ছা করেই এই গন্ধ তৈরি করছে মানুষকে মগজধোলাই করার জন্য?”

“তুমি যেটা এনেছো, সেটা বেঁচে থাকা মানুষের শরীরে প্রয়োগ করলে তারা নিজের মনের কণ্ঠস্বর হারাতে পারে। একে বলা যায় ঘ্রাণ-ভিত্তিক কন্ট্রোল।”

অনির্বাণ স্তব্ধ হয়ে গেল।

রূপসী শুধু খুন করছে না, সে গন্ধের মাধ্যমে মানুষের ‘will’—ইচ্ছাশক্তি—নিয়ন্ত্রণ করছে! হয়তো শহরের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের ওপর প্রয়োগ করেও ফেলেছে। হয়তো এটাই তার মা-কে ‘শাস্তি’ দেওয়ার পরবর্তী ধাপ—সমগ্র সমাজকে নিজের ঘ্রাণে বাঁধা দেওয়া।

তখনই ফোন বেজে উঠল।

অজানা নম্বর।

“অনির্বাণ,” সেই কণ্ঠস্বর, এবার অনেকটা কোমল, “তুমি যদি সত্যি সত্যি বুঝতে চাও গন্ধের ক্ষমতা কী, তবে এসো। আজ রাত বারোটায়—ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পেছনের গোলাপ বাগানে। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।”

ফোন কেটে গেল।

ঘড়ি তখন সাড়ে দশটা।

ভিক্টোরিয়ার বাতাসে যেন আগে থেকেই ছড়িয়ে আছে সেই গন্ধ।

অনির্বাণ জানে, রাতটা শুধু এক সাক্ষাতের নয়। এ এক পরীক্ষার রাত—গন্ধ বনাম মন, অতীত বনাম সত্য। আর সে, অনির্বাণ বসু, আজ রূপসীর সঙ্গে মুখোমুখি হবে।

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পেছনের গোলাপ বাগান তখন অন্ধকারে ডুবে আছে। শহরের অন্য প্রান্তে আলো জ্বলছে, কিন্তু এখানে শুধু মৃদু হলদেটে রাস্তার আলো, আর তার ফাঁকে ফাঁকে ঘন ছায়া। রাত তখন ঠিক বারোটা।

অনির্বাণ দাঁড়িয়ে আছে বড় গোলাপ গাছটার পাশে, যেখানে সে অনেকদিন আগে মা-বাবার সঙ্গে বেড়াতে এসেছিল ছোটবেলায়। আজ মনে হচ্ছে সেই একই বাগান, কিন্তু গন্ধটা বদলে গেছে। গোলাপের সুগন্ধের ভিতর ঢুকে গেছে এক কাঁচা ধাতব গন্ধ—যা রক্তের মতো তীব্র, মস্তিষ্কে যেন বুলেটের মতো আঘাত করে।

একটা মৃদু শব্দে সে ঘুরে দাঁড়াল।

সামনে দাঁড়িয়ে এক নারী—লম্বা, সাদা কুর্তি, খোলা চুলে হালকা লালচে আভা, চোখে গভীর অন্ধকার। এবং তার চারপাশে বাতাস ভারী—‘No. 79’-এর সেই গন্ধ।

“তুমি রূপসী?” অনির্বাণ জিজ্ঞেস করল।

নারী হেসে বলল, “তুমি কি আমার মুখ দেখে সেটা বলছো, না গন্ধ শুঁকে?”

“দু’টোই,” অনির্বাণ জবাব দিল। “তুমি খুন করছো। তুমি মানুষের স্মৃতি মুছে দিচ্ছো। এটা শুধু প্রতিশোধ নয়, এটা মন নিয়ন্ত্রণ। কেন?”

রূপসী ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে এল। “তুমি জানো, আমার মা আমার শরীরের রক্ত ব্যবহার করেছিল একটা পারফিউম বানাতে। আমি তখন মাত্র বারো। তার চেয়েও বড় যন্ত্রণার বিষয় ছিল—সে আমার ঘ্রাণের ক্ষমতা ব্যবহার করত, কিন্তু আমাকে স্বীকৃতি দিত না। আমি একটা পরীক্ষার অংশ হয়ে উঠেছিলাম—তাদের Fragrance Circle-এর এক ভয়ানক খেলায়।”

“তুমি কি জানো, তারা সবাই মিলে একটা পারফিউম তৈরি করতে চেয়েছিল যা মানুষের মনকে ‘Reset’ করতে পারে? ভুল স্মৃতি মুছে ফেলা, ইচ্ছা নিঃশেষ করা, নিজের মতো মানুষকে চালনা করা—এটাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। আমি ছিলাম সেই গন্ধের প্রথম ‘বেস’। আমি ছিলাম সেই মূল রক্ত যার গন্ধে মন নত হয়। এবং শেষ পর্যন্ত, তারা আমাকে বন্দি করে রাখে। তারা ভয় পেয়েছিল আমি যদি এই ক্ষমতা ব্যবহার করি, তাহলে তাদেরই নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে।”

রূপসীর চোখে তখন ক্ষোভ, কষ্ট, কিন্তু এক অদ্ভুত প্রশান্তি। যেন সে জানে—সে যা করছে, তা ন্যায্য।

“তোমার বাবা জানতেন,” রূপসী বলল, “তোমার বাবাই চেয়েছিলেন এই গন্ধ ধ্বংস করতে। কিন্তু তিনি নিজেও তৈরি করেছিলেন ‘No. 79-এর Revised Copy’। সে জানত এই গন্ধ একদিন ফিরে আসবে। এবং সে বুঝেছিল, শুধু একজন ‘নোজ’ পারে এই গন্ধের শেষ ছুঁতে।”

“তাহলে?” অনির্বাণ জিজ্ঞেস করল। “তুমি আমায় ডাকলে কেন?”

“কারণ,” রূপসী ধীরে ধীরে বলল, “তুমিই সেই শেষ ব্যক্তি, যার নাক এখনো মুক্ত। যে এখনো মনের মধ্যে নিজের ইচ্ছা ধরে রেখেছে। আমি চাই তুমি একটি সিদ্ধান্ত নাও। আমি চাই তুমি বেছে নাও—তুমি এই গন্ধ শেষ করবে, না কি তার ধারক হয়ে যাবে?”

“তুমি কি চাও আমি তোমার হয়ে কাজ করি?”

“না,” রূপসী বলল, “আমি চাই তুমি বোঝো, এই গন্ধ শুধু ক্ষমতার নয়—এটা এক সামাজিক পরীক্ষা। ধরো তুমি কাউকে এমন এক গন্ধ দাও, যার ফলে সে তার দুঃখ ভোলে, ভুলে যায় ব্যথা, কিংবা মেনে নেয় একঘেয়েমি। সমাজ কি সেটাই চায় না? সুখে থাকতে গেলে মানুষ কি ভুলে যেতে চায় না? আমি শুধু সেই ভুলে যাওয়ার রাস্তা খুলে দিয়েছি।”

অনির্বাণ নীরব হয়ে গেল। সত্যিই তো—একটা পারফিউম যদি কাউকে তার ভুলে যাওয়া প্রেম, হারানো মা, বা পুরোনো গ্লানি থেকে মুক্তি দিতে পারে, তবে কি সেটা অন্যায়?

কিন্তু আবার অন্য দিকটা—এই গন্ধ যদি কাউকে হত্যায় প্ররোচনা দেয়? যদি সে তার নিজের ইচ্ছা হারিয়ে ফেলে?

“তুমি তো খুন করেছো,” অনির্বাণ বলল, “তোমার তাত্ত্বিক দর্শন দিয়ে সেই রক্ত ধুয়ে ফেলা যাবে না।”

রূপসী একটু নীচু স্বরে বলল, “তারা আগে মেরেছিল। আমার অস্তিত্ব, আমার কণ্ঠস্বর। আমি শুধু ঘ্রাণ দিয়ে সেই মৃত্যু ফিরিয়ে দিয়েছি।”

হঠাৎই রূপসী তার কুর্তির পকেট থেকে একটি শিশি বার করল—একদম সেই শিশির মতো, যেটা অনির্বাণ পেয়েছিল বাবার বাক্সে।

“এটা শেষ বোতল। এর গন্ধ কেউ নাকে নিলে আর কিছু মনে থাকবে না। শুধু একটা কথায় বিশ্বাস করবে—যা আমি বলব, তা-ই সত্যি। আমি চাই তুমি এটা নাও। অথবা ধ্বংস করো। দুটোই আমার হাতে দিচ্ছি।”

সে শিশিটা অনির্বাণের হাতে দিল।

অনির্বাণ তাকিয়ে রইল শিশিটার দিকে। তার ভিতরে লাল রঙের তরল—যা এখন কেঁপে উঠছে, যেন ভিতর থেকে কারো নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসছে।

একটা গাড়ির হর্ন ভেসে এল দূরে, কিন্তু এখানে যেন শব্দ পৌঁছাচ্ছে না। কেবল গন্ধ। এবং সেই গন্ধ ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে।

অনির্বাণ জানে, সে এই মুহূর্তে ইতিহাসের এক ঘ্রাণবিন্দুতে দাঁড়িয়ে। সে যদি এটা রেখে দেয়, তবে হয়তো সভ্যতা নতুন পথে যাবে—চিন্তা ছাড়া, দুঃখ ছাড়া, হয়তো শান্তিতে—কিন্তু তা কি মানুষের প্রকৃত অস্তিত্ব?

সে এক নিঃশ্বাসে শিশিটা ছুঁড়ে দিল মাটিতে।

কাঁচ ভেঙে গেল। গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে।

রূপসী কিছু বলল না। কেবল চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল। তার ঠোঁট থেকে ধীরে ধীরে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল।

“ভেবেছিলাম, তুমিই নেবে দায়িত্ব। কিন্তু বুঝলাম, তুমি এখনও মানুষ।”

অনির্বাণ কিছু বলল না।

তখনই দূর থেকে ভেসে এল পুলিশের সাইরেন। রূপসী আর কিছু না বলে পিছন ঘুরে গেল।

“তুমি কোথায় যাবে?” অনির্বাণ ডেকে উঠল।

“ঘ্রাণ যেখানে শেষ, আমি সেখানে,” সে বলে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।

অনির্বাণ একা দাঁড়িয়ে রইল। ভাঙা শিশির গন্ধ তখনও বাতাসে ভাসছে।

কিন্তু এই গন্ধ এবার আর কাঁপন ধরায় না। বরং মুক্তির মতো লাগে।

ভোরের আলো ছুঁয়ে গেছে ভিক্টোরিয়ার শ্বেতপাথরের গায়ে, ঝোপের ভেজা পাতায় জমেছে শিশির। তবু অনির্বাণ বসু দাঁড়িয়ে, একেবারে স্থির। তার পায়ের নিচে গুঁড়িয়ে পড়ে আছে সেই শিশি—‘No. 79’-এর শেষ বোতল—যার ভিতরের গন্ধ পৃথিবীর সব স্মৃতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারত, বা মুছে দিতে পারত চিরতরে।

পুলিশ আসতেই রূপসী নিখোঁজ। সিসিটিভি নেই, কোনো প্রমাণ নেই, এমনকি বাতাসে ছড়িয়ে পড়া গন্ধটাও ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। অফিসাররা আসে, দেখে একটা কাঁচ ভাঙা, কিছু গোলাপ পাপড়ি, আর অনির্বাণ বসুর মুখ—শান্ত, অথচ ক্লান্ত।

“আপনি একা ছিলেন?” একজন জিজ্ঞেস করে।

“হ্যাঁ,” অনির্বাণ বলে, “তবে আমি যা খুঁজছিলাম, পেয়েছি।”

তারা সন্দেহ করে, কিন্তু কিছু না পেয়ে ফিরে যায়।

অনির্বাণ ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে প্রাচীন শহরের ঘুম ভাঙা পথে। ভোরের চায়ের দোকানে বসে সে এক কাপ লেবু চা নেয়। চায়ের গন্ধটাও আজ ভিন্ন লাগে। আজ তার কাছে গন্ধ মানে শুধু ঘ্রাণ নয়—একটা অস্ত্র, একটা স্মৃতি, একটা অভিশাপ।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সে ভাবে—রূপসী কি সত্যিই ভুল করেছিল? নাকি সে আমাদের এই ভাঙাচোরা পৃথিবীর জন্য একটা নতুন রাস্তা তৈরি করছিল? যদি একজন মানুষ নিজের সমস্ত যন্ত্রণা ভুলে যেতে পারে এক ফোঁটা ঘ্রাণে, তবে তাতে ক্ষতি কী?

কিন্তু অনির্বাণ জানে, ভুলে যাওয়ার স্বাধীনতা যতটা স্বস্তিদায়ক, তার চেয়েও ভয়ংকর তা অন্যের হাতে থাকলে। যদি কোনো সরকার, কর্পোরেট, বা একক ব্যক্তি ঠিক করতে পারে, কার কী মনে থাকবে—তাহলে ব্যক্তিত্ব বলে কিছু থাকবে না।

ঘরে ফিরে সে আবার বাবার লেখা চিঠিটা পড়ে।
“…এই গন্ধ ধ্বংস করো, কারণ এই গন্ধই আমাকে একদিন মেরে ফেলবে।”

সে জানে, রূপসী এখনও বেঁচে আছে। এবং তার হাতে হয়তো নতুন কোনো সংস্করণ আছে—একটা এমন গন্ধ যা আরও বেশি প্রভাব ফেলতে পারে মানুষের স্নায়ুতে।

সেই রাতেই অনির্বাণ বেরোয় এক উদ্দেশ্যে—“The Fragrance Circle”-এর অতীত খুঁজে বার করা।

সে যায় কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের দোকানগুলোয়, পুরোনো সাময়িকপত্র ঘাঁটে। বহু খোঁজাখুঁজির পর পায় একটি ১৯৭8 সালের বাংলা পত্রিকায় ছোট্ট প্রতিবেদন—
“আত্মপ্রকাশ করল ‘The Fragrance Circle’—কলকাতার প্রথম গন্ধ-সন্ধানী সমিতি। সদস্য সংখ্যা ৮। উদ্দেশ্য: ঘ্রাণকে শিল্পের পরিণতিতে নিয়ে যাওয়া।”

সদস্যদের নাম দেওয়া—মীনাক্ষী দে, দীনেশ বসু (তার বাবা), ডঃ অরবিন্দ ঘোষ, কবি অঞ্জন দত্ত, নাট্যকার শিবাশিস রায়চৌধুরী, এবং আরও তিনজন নামহীন সদস্য।

এরপর ওই পত্রিকাতেই কয়েক বছর পর একটা মৃত্যুর খবর—“পারফিউম বিশেষজ্ঞ ডঃ ঘোষের অস্বাভাবিক মৃত্যু”। কারণ হিসাবে বলা—গন্ধজনিত স্নায়ুবিকার।

সে নিশ্চিত হয়—রূপসীর প্রাথমিক পরীক্ষা এই সদস্যদের উপরেই হয়েছিল।

সন্ধেবেলা সে যায় নাট্যকার শিবাশিস রায়চৌধুরীর খোঁজে। এখন বৃদ্ধ, পার্ক সার্কাসে থাকেন এক ফ্ল্যাটে। চোখ কম দেখে, হাঁটা ধীর। তবু তাঁর স্মৃতি এখনও স্পষ্ট।

“আমার গন্ধ এখনো চিনে নিতে পারে মানুষ,” তিনি হেসে বলেন।

অনির্বাণ তাকে সব খুলে বলে—রূপসীর কথা, খুন, সেই ভয়ঙ্কর ফর্মুলা।

শিবাশিস দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “তোমার বাবা আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সৎ ছিল। সে চাইত না এই গবেষণা বেঁচে থাকুক। কিন্তু আমরা… আমরা চেয়েছিলাম একরকম অমরত্ব। একজন শিল্পী যদি নিজের পারফিউম দিয়ে মানুষের মস্তিষ্কে স্মৃতি বসাতে পারে, তবে সে হয়ে উঠবে ঈশ্বর। এই পাপের শাস্তি পেয়েছি আমরা। মীনাক্ষী মেয়েকে ঠেলে দিয়েছিল সেই পরীক্ষায়, আর রূপসী—সে সেই যন্ত্রণা নিয়ে বড় হয়েছে।”

“তাহলে কি তাকে রোখা যাবে না?” অনির্বাণ জিজ্ঞেস করল।

“তুমি পারো,” শিবাশিস বললেন, “কারণ তুমিই এখন সেই নেক্রোস্মেল-এর শেষ কাস্টডিয়ান।”

“নেক্রোস্মেল?”

“হ্যাঁ,” শিবাশিস বললেন, “এই গন্ধের ফর্মুলার কোডনেম ছিল ‘Nekrosmel’—নেক্রো মানে মৃত্যু, স্মেল মানে গন্ধ। যার মাধ্যমে আমরা চেয়েছিলাম মৃত্যুর ভয় দূর করতে। অথচ মৃত্যুকেই ডেকে আনলাম।”

অনির্বাণ বুঝল—এখনো সময় আছে কিছু করার।

সে ফিরে গিয়ে একটি সিদ্ধান্ত নেয়—এই স্মৃতিশক্তিতে বিপজ্জনক ফর্মুলা যদি থাকেই, তাহলে তা রক্ষা করতে হবে, লুকিয়ে রাখতে হবে এমনভাবে, যাতে তা আর কারো হাতে না পৌঁছায়।

সে সেই শিশির কাচের ভগ্নাংশ, বাবার চিঠি ও গন্ধ বিশ্লেষণ নোটগুলো নিয়ে চলে যায় শান্তিনিকেতনে তার এক পুরোনো শিক্ষক, অধ্যাপক সুধীর বাগচীর কাছে—একজন নৃতত্ত্ববিদ, যিনি মগজ ও সংস্কৃতির সম্পর্ক নিয়ে কাজ করেন।

সুধীরবাবু সব শুনে বলেন, “এই গন্ধ মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে—এমন কোনো প্রমাণ আমাদের সভ্যতায় নেই, কিন্তু যদি সত্যিই এর অস্তিত্ব থাকে, তাহলে একে সংরক্ষণ নয়, সুরক্ষিতভাবে মুছে ফেলাই উচিত।”

তারা সিদ্ধান্ত নেন—এই ফর্মুলার সমস্ত নথি ও নমুনা তাঁরা নদিয়ার গোপন গবেষণা কেন্দ্রে তুলে দেবেন, যেখানে তা চিরতরে লক করে রাখা হবে, বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে।

শেষে, এক সন্ধ্যায় অনির্বাণ সেই কাঁচের ভগ্নাংশ, নোটবুক, চিঠি সব পুড়িয়ে দেয় এক আগুনে। শুধু রেখে দেয় একটি রেকর্ডেড ঘ্রাণের ছোট্ট ভাইল—একধরনের শব্দছবি, যা ঘ্রাণের মাধ্যমে ভবিষ্যতে যদি গবেষণা হয়, তবে ব্যবহার হবে।

সে জানে, রূপসী কোথাও রয়েছে—হয়তো পাহাড়ে, হয়তো সমুদ্রে, হয়তো এক গোপন ঘরে নিজের মতো করে এক নতুন গন্ধ বানাচ্ছে। হয়তো সে এবার অন্যভাবে ফিরবে।

কিন্তু আজ অন্তত ‘No. 79’ শেষ হয়েছে।

ভোরের আলোয় অনির্বাণ এক ফোঁটা নিজস্ব তৈরি পারফিউম মেখে বলে, “আজকের গন্ধ শুধু গন্ধ হোক—স্মৃতির নয়, প্রতিশোধের নয়। শুধু জীবনের।”

কলকাতার শরৎকাল—শহরের বাতাসে আলতো ঠান্ডা, পাতার কচকচে শব্দে যেন গোপন কিছু বলে ওঠে বারবার। অনির্বাণ বসু গত কয়েক সপ্তাহে যা কিছু দেখেছে, যা জানেছে, তা যেন এখন এক গভীর নিস্তব্ধতায় গা ভাসিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তার নাক, তার সবচাইতে শক্তিশালী অস্ত্র, এখনও অস্বস্তিতে ফেটে পড়ছে।

তিন সপ্তাহ হয়ে গেল ‘No. 79’-এর শিশি ধ্বংস করার পর। শহর শান্ত। রূপসীর কোনো খবর নেই। পুলিশ কেস বন্ধ করে দিয়েছে তথ্যের অভাবে। অনির্বাণ নিজের অফিসেও ফেরত গিয়েছে—‘সুরভি’ পারফিউম কোম্পানির সেই ঘ্রাণ-ভরা ঘরে। কিন্তু কিছু যেন ঠিকঠাক কাজ করছে না।

সে ঘ্রাণ মিশায়, বিশ্লেষণ করে, ক্লায়েন্টদের জন্য নতুন নোট বানায়, কিন্তু বারবার তার মাথার ভিতর একটা প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসে—সে কি সত্যিই শেষ করেছে সেই গন্ধকে? নাকি যা ধ্বংস হয়, তার ছায়া থেকেই জন্ম নেয় অন্য এক নতুন গন্ধ?

নীলাঞ্জনা একদিন কাজের ফাঁকে জিজ্ঞেস করল, “তুই ঠিক আছিস তো? তোর গন্ধ-নোটগুলো কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে আজকাল।”

অনির্বাণ এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “তুই কি কখনও এমন কিছু গন্ধ পেয়েছিস, যেটা বাস্তবে নেই, তবু মনে হয় যেন কাছেই রয়েছে?”

নীলাঞ্জনা হাসল, “তুই এখন গন্ধ নিয়ে দর্শনে চলে গেছিস দেখছি।”

অনির্বাণ কিছু বলল না। সে জানে—রূপসী এখন অন্তরালে, কিন্তু তার কাজ থেমে যায়নি। হয়তো সে এখন অন্য রূপে, অন্য নাম নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে নিজের ঘ্রাণ-দর্শনের পরীক্ষা।

একদিন দুপুরে সে একটা অদ্ভুত ঘটনা দেখে। অফিসের স্টোররুমে গিয়ে সে খুঁজছিল পুরনো এসেনশিয়াল অয়েল। একটা ড্রয়ার খোলার সঙ্গে সঙ্গে সে পেল এক পাতলা কাগজে মোড়া একটি শিশি—লেবেলবিহীন। কিন্তু গন্ধটা শুঁকেই তার রক্ত জমে গেল।

গন্ধটা অনেকটা ‘No. 79’-এর মতো, কিন্তু একটু আলাদা। যেন তাতে নতুন কিছু মেশানো হয়েছে—হাস্যকরভাবে কোমল, কিন্তু ভিতরে চাপা হিংসা। যেন কারো স্মৃতি নয়, বরং কারো দুঃস্বপ্নের আধা-জাগা ছবি।

সে ভেবেছিল সব পুড়িয়ে ফেলেছে, ধ্বংস করেছে সব প্রমাণ। তাহলে এই শিশি এলো কোথা থেকে? আর কে রাখল এটাকে এখানে?

সেদিন রাতেই আবার ফোন। অজানা নম্বর।
এইবার কণ্ঠস্বর বদলে গেছে—এতদিনের রূপসীর গলা নয়, বরং এক অচেনা পুরুষের। কিন্তু তাতেও লেগে আছে সেই গন্ধ—ফোনের ওপার থেকেও যেন ঘরে ঢুকে পড়ে।

“তুমি ভাবছিলে শেষ হয়েছে?”

“তুমি কে?”

“তুমি যাকে শেষ করেছ ভেবেছিলে, সে শুধু একটা স্তর ছিল। আমরা বহুজন। Fragrance Circle তো মাত্র শুরু।”

অনির্বাণ বুঝতে পারল—সে আসলে যা ভেবেছিল একক ঘটনা, তা আসলে এক বৃহৎ চক্রের এক মুখমাত্র। এবং সেই চক্র এখন তার নাম জানে, তার ক্ষমতা জানে।

পরদিন সকালে সে হাজির হয় শান্তিনিকেতনে অধ্যাপক সুধীর বাগচীর কাছে। তার হাতে শিশিটা।

“আপনি কি এটা পরীক্ষা করতে পারবেন আবার? এই ঘ্রাণটা যেন নতুন কিছু বলছে।”

সুধীরবাবু ঘ্রাণ শুঁকে চমকে উঠলেন। “এটা আর আগের মতো নয়। এর মধ্যে একটা নতুন উপাদান যুক্ত হয়েছে—‘বেলাডোনা অ্যাবসিন্থ’। একটা পুরোনো নিষিদ্ধ হ্যালুসিনোজেনিক পারফিউম উপাদান। যা মানুষের বাস্তবতা বোঝার ক্ষমতা বিকৃত করে। মানে কেউ যদি এটা পরে, সে বুঝতেই পারবে না কী বাস্তব আর কী মায়া।”

অনির্বাণ স্তব্ধ হয়ে গেল।

“তাহলে এবার তারা শুধু স্মৃতি নিয়ন্ত্রণ করছে না—বাস্তবতার সংজ্ঞাও বদলে দিতে চাইছে?”

সুধীরবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “এটা একটা বিপজ্জনক স্তর। একজন মানুষ যদি নিজের বাস্তব অনুভূতি হারিয়ে ফেলে, তবে সে কাউকে মারলে বুঝবেও না সে খুন করেছে। সমাজ তখন আর পরিচালনাযোগ্য থাকবে না।”

অনির্বাণ বলল, “আমাকে জানতেই হবে—এই শিশি কার?”

সে অফিসে ফিরে গিয়ে চুপচাপ সিসিটিভি ফুটেজ চেক করল। গত এক সপ্তাহের মধ্যে কারা স্টোররুমে ঢুকেছিল।

একজন নতুন ইন্টার্ন—নাম শ্রেয়স। শান্ত, লাজুক, সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছে।

অনির্বাণ তাকে ডেকে পাঠাল।

“তুমি এই শিশিটা দেখেছ কখনও?”

শ্রেয়স একটু থতমত খেয়ে বলল, “না… মানে, আমি স্টোররুমে ছিলাম সেদিন, হয়তো কাউকে দেখেছি একটা প্যাকেট রাখছে…”

“কার মতো দেখতে ছিল?”

“একজন মহিলা… হয়তো ক্লায়েন্ট। মুখটা ভালো করে দেখিনি। কিন্তু তার ঘ্রাণ… একটু অদ্ভুত ছিল।”

“কি রকম?”

“অনেকটা… বৃষ্টির গন্ধের মধ্যে পোড়া কাঠ আর বেলফুলের মিশ্রণ।”

অনির্বাণ বুঝল—এটা আবার রূপসীর ছায়া। হয়তো সে নিজে নয়, কিন্তু তার প্রেরিত কেউ। হয়তো রূপসী এখন নিজের একটা ছোট্ট গন্ধ-সংগঠন গড়ে তুলেছে—“Circle”-এর উত্তরসূরি।

সেই রাতে ঘরে বসে অনির্বাণ জানালায় দাঁড়িয়ে। বাতাসে ছড়িয়ে আছে গন্ধরাজের হালকা সুবাস। কিন্তু তার নাকে কেবল একটা প্রশ্ন—গন্ধ কি শুধু স্মৃতি রাখে? নাকি গন্ধ দিয়ে ভবিষ্যৎও লেখা যায়?

হয়তো রূপসী, হয়তো এই অজানা সংগঠন এখন গন্ধকে ব্যবহার করছে ইতিহাসের নিয়ন্ত্রণে। মানুষ যখন চোখ বন্ধ করে হাঁটে, তখন তাদের পথ বাতলে দেয় ঘ্রাণ।

অনির্বাণ জানে, তার যাত্রা এখনও শেষ হয়নি।

শুধু গন্ধ নয়, এখন সে খুঁজবে ঘ্রাণের উৎস, তার রাজনীতি, এবং তার ক্ষমতা।

কারণ এখন সে শুধু এক ‘নোজ’ নয়—সে ‘ঘ্রাণ-রক্ষক’।

সেই রাতে ঘরে ফেরার পর অনির্বাণ বসুর ঘুম আসেনি। চোখ বন্ধ করলেই মনে হচ্ছিল, বাতাসে কেউ যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে—চুপিচুপি, পায়ের শব্দ ছাড়া। কিন্তু তাকে ঠিক চেনা যাচ্ছে না। কেবল একটাই চিহ্ন রেখে যাচ্ছে সে—একটা অদ্ভুত গন্ধ।

সেই গন্ধটা এবার আর ভয়ানক নয়। বরং মায়াময়, ঘোরে ঢোকায়। মনে হয় যেন কোনো পুরনো গল্পের ভেতরে ঢুকে পড়েছে সে—যেখানে বৃষ্টির দিন আর শুকনো কফির কাপ একসঙ্গে রাখা, আর জানলার বাইরে কেউ ডাকছে অচেনা নামে।

অনির্বাণ জানে, এটা আসল নয়। এই গন্ধ বাস্তব নয়। বরং, তার স্মৃতির গভীর স্তরগুলো থেকে কেউ খেলছে তার সঙ্গে।

সে এবার আর বসে থাকতে পারে না। পরদিন সকালে সে যায় তার নিজের তৈরি পারফিউম মিশ্রণঘরে—যেখানে সে একা একা নোট নিয়ে কাজ করে।

তিনটি শিশি খুলে রাখে সে—ল্যাভেন্ডার, ওসম্যান্থাস, আর একধরনের শুষ্ক মিরর অয়েল। এগুলো সে ব্যবহার করত নিজের প্রোটেকশন ঘ্রাণ বানাতে—একধরনের ঘ্রাণ যা মস্তিষ্ককে নিরপেক্ষ রাখতে সাহায্য করে।

সেই মিশ্রণ সে নিজের ঘরের চারপাশে ছড়িয়ে দিল। তারপর নোটবুকে লিখল,
“এখন থেকে আমি প্রতিদিন গন্ধের ডায়েরি লিখব। কোন ঘ্রাণ বাইরে থেকে আসছে, কোনটা আমার ভিতরের। বিভ্রান্ত হলে শেষ হয়ে যাবে।”

প্রথম দিন সে টের পেল, অফিসের করিডোরে কোথাও একটা হালকা গন্ধ ছড়ানো হয়েছে—যা আগে কখনও ছিল না। দ্বিতীয় দিন লিফটের মধ্যে। তৃতীয় দিন সে দেখল, চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়ে তার মাথা ভারী হয়ে যাচ্ছে।

মানে কী? কেউ কি একেবারে শহরের ভিতরেই ছড়িয়ে দিচ্ছে এক নতুন ফর্মুলা?

সে গন্ধ বিশ্লেষণ করল। এবং আবিষ্কার করল সেই একই বেস—‘Nekrosmel’-এর আধার। অর্থাৎ, কোনোভাবে সেই গন্ধ আবার বানানো হয়েছে। এবং এবার তা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে অলক্ষ্যে।

সে বুঝতে পারল—তাকে আবার যেতে হবে উৎসে, অর্থাৎ যেখানে এই পারফিউম তৈরি হচ্ছিল।

তবে কোথায় সেই জায়গা?

হঠাৎ মনে পড়ে গেল সেই পুরনো লিফলেটের কথা, যেটা সে রূপসীর প্রথম ফোনের পর পেয়েছিল। তাতে একটি ঠিকানা ছিল, যেটা সে এতদিন পাত্তা দেয়নি—”Jora Ghat Lane, Tangra.”

কলকাতার পূর্বপ্রান্তে ট্যাংরা এলাকায় অনেক পুরনো চামড়ার কারখানা ছিল। এখনো কিছু আছে। আর ঘ্রাণের সঙ্গে চামড়ার সম্পর্ক বহুকালের।

সে বিকেলেই পৌঁছে যায় সেখানে। গলিটা প্রায় পরিত্যক্ত। ভাঙাচোরা দালান, ময়লার স্তূপ, মাঝে মাঝে একটা করে ধোঁয়া ওঠা চুল্লি। গলি ধরে এগোতেই সে টের পায়—হাওয়ার গায়ে লেগে আছে সেই পুরনো পরিচিত গন্ধ।

তবে এবার তা স্পষ্ট নয়—বরং যেন কোনো যন্ত্রের গন্ধের সঙ্গে মিশে গিয়েছে।

একটা ভাঙা কাঠের দরজায় ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। ভিতরে একটা ল্যাবরেটরির মতো জায়গা—দেয়ালে সারি সারি বোতল, ডিস্টিলেশন মেশিন, কিছু আধুনিক কেমিক্যালের বাক্স। আর মাঝখানে একটা ডায়েরি খোলা পড়ে আছে।

ডায়েরিটা খুলতেই প্রথম পাতায় লেখা—“Nekrosmel v2.0 — রূপসী ঘোষ, ২০২৫”

অনির্বাণের মাথার ভেতর কেবল একটা শব্দ বাজতে থাকে—“v2.0”
অর্থাৎ আগের গন্ধকে নতুন করে তৈরি করা হয়েছে। এবার হয়তো আরও শক্তিশালী, আরও জটিল।

সে ডায়েরির পাতা উল্টাতে থাকে। সেখানে গন্ধের বৈজ্ঞানিক রচনার পাশাপাশি আছে কিছু ব্যক্তিগত নোট।

“মানুষ গন্ধ বিশ্বাস করে বেশি। চোখ দেখে সন্দেহ করে, কান শুনে ভুল বোঝে, কিন্তু নাক… নাক প্রতারণা চিনতে পারে না।”

“v2.0-এ আমি শুধু ঘ্রাণ দিই না। আমি ঘ্রাণের মধ্য দিয়ে অভিপ্রায় ঢুকিয়ে দিই। এবার মানুষ শুধু স্মৃতি ভুলবে না, তারা নতুন বাস্তব বিশ্বাস করবে।”

“পরীক্ষা ১: কলেজ স্ট্রিট — ৭ জন পাঠককে নির্দিষ্ট দোকানে গিয়ে বই না কিনে শুধু তাকিয়ে থাকতে বলা হয়েছে। তারা তাই করেছে।”

“পরীক্ষা ২: স্কুল গেট — ১২ জন অভিভাবক নিজের সন্তানকে চিনতে ভুল করেছে। গন্ধ প্রয়োগ করা হয়েছিল সকাল ৮:১০-এ।”

অনির্বাণ কেঁপে ওঠে।

এর মানে এখন আর এই গন্ধ ‘স্মৃতি নিয়ন্ত্রণ’ নয়, এটা আচরণ নিয়ন্ত্রণ।

এমন সময় পিছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর বলে ওঠে—“তুমি দেরি করেছো, অনির্বাণ।”

সে ঘুরে দেখে, একজন যুবক দাঁড়িয়ে—চোখে কালো চশমা, হাতে গ্লাভস, আর মুখে ঠাণ্ডা হাসি।

“তুমি কে?”

“আমার নাম অনিকেত। রূপসীর প্রথম ছাত্র। এখন সহ-নির্মাতা। এই ল্যাব আমারও।”

“তোমরা কী করছো এটা জানো? মানুষকে পুতুলে পরিণত করছো!”

“তুমি তো বিজ্ঞানী। তুমি জানো, সবকিছুই নিয়ন্ত্রণের খেলা। কেউ টাকার গন্ধে চলে, কেউ প্রেমের। আমরা শুধু তা গন্ধ দিয়ে দিচ্ছি। মানুষের স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। আমরা শুধু ঘ্রাণের ফ্রেমটা দিই।”

“তাহলে তোমরা ঈশ্বর হতে চাইছো?”

“না,” অনিকেত হেসে বলল, “ঈশ্বর নয়, নাকের ভিতরকার ঈশ্বর। মানুষের ইচ্ছার উৎসে গন্ধ থাকে। আমরা শুধু তা লিখছি।”

অনির্বাণ জানত, এবার সে আর পালাতে পারবে না। ল্যাবে সে আর অনিকেত একা। গন্ধ ছড়ানো আছে চারপাশে। একটা মাত্র ভুল—আর তার স্মৃতি হারিয়ে যাবে।

তখনই সে মনে পড়ল নিজের বানানো সেই প্রোটেকশন ঘ্রাণের কথা। সে পকেট থেকে বার করল সেই ছোট শিশি। চোখ বন্ধ করে ঘ্রাণ শুঁকে নিল।

অনিকেত বলল, “তুমি বুঝতেই পারো না এটা কত শক্তিশালী। এবার তুমি—”

“না,” অনির্বাণ বলল, “তুমি ভুল করছো। আমি তোমার গন্ধের ভেতর ঢুকে পড়েছি। এখন আমি জানি, তুমি কী নিয়ে খেলছো।”

সে হাতের শিশিটা ছুঁড়ে মারল ল্যাবের কেমিক্যাল টেবিলে। বিস্ফোরণের মতো শব্দ হয়নি, তবে ধোঁয়া উঠল।

তাদের চারপাশ ঢেকে গেল ধূসর ঘ্রাণে। সেই মিশ্রণ—ল্যাভেন্ডার, ওসম্যান্থাস আর মিররের সুর—মন স্থির রাখার, চেতনা পরিষ্কার করার।

অনিকেত হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল।

অনির্বাণ বলল, “এই গন্ধ দিয়ে আমি আমার ইচ্ছাকে বাঁচিয়ে রেখেছি। এবার দেখ, তুমি বাঁচতে পারো কিনা।”

সে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল।

পেছনে ছড়িয়ে রইল ধোঁয়া, আর এক অসমাপ্ত যুদ্ধের গন্ধ।

ট্যাংরার সেই পুরনো চামড়ার কারখানার মধ্যে অনিকেত ধীরে ধীরে উঠে বসছে ধোঁয়ার মধ্যেই, মুখে এক ধরণের বিস্ময়। সে হয়তো এতটা প্রস্তুত ছিল না। সে ভেবেছিল, অনির্বাণ বসু শুধু একজন পারফিউম বিশারদ, একজন গবেষক। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে—এই মানুষটা ‘ঘ্রাণ’ নিয়ে শুধু খেলা করে না, সে ঘ্রাণকে বোঝে, তার ভিতরের গোপন সংকেতগুলোকে ডিকোড করতে জানে।

“তুমি যা করেছো,” অনিকেত বলল, “তাতে এই গন্ধ মরবে না, বরং ছড়িয়ে পড়বে আরও দ্রুত। কারণ প্রতিটি প্রতিরোধ থেকে জন্ম নেয় এক নতুন আকর্ষণ। প্রতিটি বাধা ডেকে আনে নতুন চক্র।”

“আমার কাজ বাধা দেওয়া নয়,” অনির্বাণ শান্ত গলায় বলল, “আমার কাজ মানুষকে তাদের নিজস্ব ঘ্রাণে ফিরিয়ে দেওয়া। যাতে কেউ তাদের হয়ে অনুভব না করে, কেউ তাদের হয়ে বেছে না নেয়।”

অনিকেত আর কিছু বলল না। শুধু পেছনের ডাস্টবিন থেকে এক পুরোনো নোটবুক তুলে ছুঁড়ে দিল অনির্বাণের দিকে। “নাও, এটা রূপসীর হাতে লেখা শেষ গন্ধ-ডায়েরি। হয়তো এটায় তুমি সত্যিটা খুঁজে পাবে।”

অনির্বাণ সেই খাতা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। ট্যাংরার গলি ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে আবার সেই চেনা কলকাতায় ফিরল—যেখানে সকালে ফুলওয়ালা হাঁকে, চা-ওয়ালা গন্ধ ছড়ায়, বাসের হর্ন আর ভাঙা পানের দোকান মিলে এক অন্যরকম সিম্ফনি তোলে।

তার মনে হল—এই শহরই আসলে পারফিউম। এক বিশাল, জটিল গন্ধের কোলাজ—যা কোনো বোতলে ভরা যায় না, কোনো ল্যাবে বিশ্লেষণ করা যায় না।

ঘরে ফিরে সে খুলল রূপসীর ডায়েরি।

প্রথম পাতায় লেখা—

“আমি রূপসী ঘোষ, একজন ‘ঘ্রাণ-সন্ধানী’। আমার জন্ম হয়েছিল দুর্ঘটনায়—একটি নিষিদ্ধ গন্ধের ফল হিসেবে। মা ভালোবাসেননি, শুধু ব্যবহার করেছেন। বাবা ছিল না। আমি বেড়ে উঠেছি এক কামরায়, চারপাশে গন্ধে গন্ধে। গন্ধই আমার ভাষা, আমার প্রতিশোধ, আমার প্রেম।
আমি যা বানাই, তা শুধু সুগন্ধ নয়—তা আমার চিৎকার। যারা শুনতে পায় না, তারা শুঁকে নিতে পারে।”

ডায়েরির পরের পাতাগুলোতে সে দেখতে পেল একের পর এক গন্ধের মানচিত্র—স্মৃতি মুছে দেওয়া, ঘুমিয়ে পড়া, ভয় জাগানো, প্রেমের ছায়া তৈরি করা, এমনকি নিজের মৃত্যু অনুভব করানোর ঘ্রাণেরও।

শেষ পাতায় লেখা—

“একদিন হয়তো কেউ আমার গন্ধ থামাবে। সে যদি ঘ্রাণ বুঝে, সে যদি জানে কোন স্মৃতি আসল, কোনটা নয়।
আমি চাই সে এসে আমায় বলুক, ‘তোমার গন্ধ কুৎসিত নয়, কিন্তু তা মানুষের জন্য নয়।’
আমি শুধু মুক্তি চেয়েছিলাম। কিন্তু হয়তো আমি ভুল পথ বেছেছিলাম।”

অনির্বাণ চোখ বন্ধ করল।

রূপসী ভুল করেছিল। কিন্তু তার ভুল ছিল তার অতীতের শিকলে বাঁধা। সে একজন নির্যাতিত মানুষ, যে গন্ধকে ব্যবহার করেছে অস্ত্র হিসেবে। তার জ্ঞান ছিল, কিন্তু দিশা ছিল না।

অনির্বাণ ঠিক করল—এই ডায়েরি, এই ফর্মুলা, এই সমস্ত গন্ধের মানচিত্র—সবই সে জমা দেবে তার শিক্ষক সুধীর বাগচীর তত্ত্বাবধানে, যেখান থেকে এগুলো শুধু গবেষণার কাজে ব্যবহার হবে, কোনো ক্ষমতার খেলায় নয়।

সেই সন্ধ্যায়, সেন্ট্রাল লাইব্রেরির এক বন্ধ ঘরে, অধ্যাপক বাগচী নীরবে এই সমস্ত নথি এক সিল করা বাক্সে ভরে রাখলেন। একটি মাত্র চাবি থাকবে অনির্বাণের কাছে।

“তুমি কি জানো,” সুধীরবাবু বললেন, “এই গন্ধ হয়তো আবার ফিরে আসবে একদিন। অন্য নামে, অন্য বোতলে। কিন্তু যেদিন কেউ আবার ভুল পথে হাঁটবে, সেদিন কেউ একজন চাইবে যেন একটা সত্যিকারের ঘ্রাণ তাকে পথ দেখায়।”

“সেদিন আমি থাকব,” অনির্বাণ বলল, “আর যদি না থাকি, কোনো অনির্বাণ আবার জন্ম নেবে। কারণ গন্ধ থেমে থাকলেও, মানুষ তার পথ খোঁজে নাকে ভরসা করেই।”

সেই রাতে, অনির্বাণ নিজের তৈরি নতুন পারফিউমের শিশি খুলল। সেটা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত এক রচনার—নরম, নির্ভেজাল, কোনো চটকদার তেল নেই। কেবল কয়েকটি সহজ উপাদান—মাটির গন্ধ, কাটা ঘাস, এবং বৃষ্টিতে ভেজা ছাদের নুড়ি পাথরের ঘ্রাণ।

সে নাম দিল—“স্মেল অফ ট্রুথ”।

সে জানে, এই গন্ধ হয়তো বাজারে হিট হবে না। কিন্তু যারা ভুলে যেতে চায় না, যারা মনে রাখতে চায়, তারাই একদিন খুঁজবে এই ঘ্রাণ।

ঠিক তখনই একটা বার্তা এল ফোনে।

“আমি এখনো আছি। কেবল গন্ধ বদলে ফেলেছি। তুমি কি শুঁকতে পারবে নতুন চেহারার আমাকে?”
– R

অনির্বাণ ফোন বন্ধ করল।

তার ঠোঁটে হাসি।

সে জানে, রূপসী হারিয়ে যায়নি। সে রয়ে গেছে বাতাসে, স্মৃতির ভিতরে, মানুষের প্রশ্নে।

কিন্তু এবার সে ভয় পায় না। কারণ এবার তার হাতে আছে সত্যিকারের অস্ত্র—চেতনার গন্ধ।

এবং এটাই তার প্রতিরোধ। এটাই তার শান্তি।

সমাপ্ত

1000025120.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *