Bangla - ভূতের গল্প

শূন্য নম্বর ঘর

Spread the love

শিলিগুড়ির পাহাড়ি রাস্তায় সন্ধ্যার অন্ধকার ধীরে ধীরে জমে উঠছিল, হালকা কুয়াশার পর্দা চেপে বসছিল বাতাসের গায়ে। গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সায়ন চৌধুরী নিঃশব্দে পাহাড়ের বুক চিরে চলা রাস্তাগুলোর নিঃসঙ্গ সৌন্দর্য উপভোগ করছিল। সে বহুদিন ধরেই শহরের কোলাহল থেকে দূরে, একা কোথাও যাওয়ার কথা ভাবছিল—শেষমেশ এই পুরনো রিসর্টের খোঁজ পেয়ে বুকিং করে ফেলে। পাহাড়ের গা ঘেঁষে তৈরি রিসর্টটি স্থানীয়দের ভাষায় “নীলবন হিল রিট্রিট” নামে পরিচিত, কিন্তু বছর কয়েক আগে একটি রহস্যজনক ঘটনায় এক পর্যটক নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পর জায়গাটি খানিকটা ভৌতিক তকমা পেয়ে যায়। সায়নের ব্লগ ‘Ghosts of Bengal’-এর পাঠকেরা তাকে অনেকবার বলেছে এই জায়গার কথা লিখতে, আর সেই আগ্রহেই সায়নের এই যাত্রা। গাড়ি থামতেই সে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে দাঁড়াল। ঠান্ডা হাওয়ায় গায়ের টিশার্ট কেঁপে উঠল। পুরোনো কাঠের মতো গন্ধ, কুয়াশার ঘ্রাণ আর কিছুটা অজানা আতঙ্ক—এই সব মিলিয়ে জায়গাটির প্রথম ছাপই একরকম অস্বস্তিকর ছিল। লবির সামনে ছোট্ট ঘন্টি বাজাতেই দরজা খুলে এল স্নিগ্ধা, রিসর্টের রিসেপশনিস্ট, যার চোখে ছিল ক্লান্তি আর মুখে একরকম কৃত্রিম হাসি। “মি. চৌধুরী? আপনিই কি ঘর নাম্বার সাতের জন্য বুকিং করেছিলেন?” সায়ন হ্যাঁ বলতেই সে চাবি এগিয়ে দিল। ভেতরে ঢুকেই সায়নের চোখ আটকে গেল সামনের পুরনো দেওয়ালের দিকে, যেখানে ঘরগুলোর দিকনির্দেশ রয়েছে—১ থেকে ৯। কিন্তু সবচেয়ে নিচে, ঘরের তালিকায়, কোথাও কোনো ‘০০’ নম্বর নেই। অথচ ঠিক সেই সময়, রিসর্টের এক বৃদ্ধ কর্মচারী তার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে ফিসফিস করে বলে উঠল, “রাত বারোটার পর বাইরে বেরোবেন না, বাবু… বিশেষ করে ওই ফাঁকা দিকটায়।”

রাত গড়িয়ে রাত দশটা বাজতেই চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে এল। সায়ন তার নোটবুকে কয়েকটা টুকরো তথ্য লিখছিল—রিসর্টের ইতিহাস, পুরনো পত্রিকায় পাওয়া কেস, স্থানীয়দের কথাবার্তা। এমন সময় ঘরের জানালা দিয়ে দূরে কাঠের করিডোরে হালকা আলোর আভা দেখা গেল, যেটা কোনো লাইট থেকে আসছে না। কৌতূহলী হয়ে সে ব্যাগ থেকে টর্চ বার করে করিডোরে পা রাখল। ঠান্ডা কাঠের মেঝে, আর চারদিকে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা। হঠাৎ করেই তার কানে এলো কান্নার আওয়াজ—এক নারীকণ্ঠ, যেন অনেক দূরের কোনো ব্যথিত আত্মার আর্তি। টর্চের আলো ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল করিডোরের শেষে, যেখানে একটি বন্ধ দরজা দেখা গেল—দরজায় কোনো নাম্বার নেই, শুধু একটুকরো ধুলো-ঢাকা পিতলের ফলক, তাতে ক্ষীণ অক্ষরে লেখা “VOID”. সে অবাক হয়ে পেছনে তাকাল, কেউ নেই। দরজায় হাত রাখতেই একটা শীতল অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল তার আঙুলে, ঠিক যেন কোনো মৃত মানুষের শরীর ছুঁয়ে ফেলেছে। হঠাৎ দরজার ওপাশ থেকে আওয়াজটা আরও স্পষ্ট হল—“আমাকে বের করো…”। ভয় আর উত্তেজনায় পেছন দিকে এক পা এগিয়ে গেল সায়ন, কিন্তু তখনই কারও পায়ের শব্দ—দ্রুতগতিতে ছুটে আসছে যেন কেউ! সে ফিরে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই তার কাঁধে হাত রাখল স্নিগ্ধা, যার চোখে ভয় আর কণ্ঠে ধমক, “আপনি জানেনও না আপনি কী করছেন! ওই দিকটায় যাওয়া মানে মৃত্যু!”

পরদিন সকাল, রোদ উঠলেও রিসর্টে যেন কুয়াশা কাটেনি। সায়নের চোখে ঘুম নেই, রাতে ঘুমোনোর চেষ্টা করলেও সেই কান্নার আওয়াজ বারবার তার ঘুম ছিঁড়ে দিয়ে গেছে। স্নিগ্ধা তাকে ব্রেকফাস্টে ডাকলেও সে কিছুতেই ঘর ছাড়তে চায়নি, শুধু বারবার ভাবছিল—‘VOID’ মানে কী? কেন এই ঘরটিতে কোনো নাম্বার নেই? আর সেই নারী কণ্ঠ—কে সে? সে ঠিক করল, রাতে আবার সেখানে যাবে, কিন্তু এবার রেকর্ডিং ডিভাইস ও ক্যামেরা নিয়ে। সকালবেলা সে রিসর্ট ম্যানেজার প্রবীরবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাইল, কিন্তু শুনল তিনি নাকি শহরে গেছেন কয়েক দিনের জন্য। স্থানীয় ট্যুর গাইড অরিন্দম দত্ত, যাকে সে আগেই ফোনে কথা বলেছিল, রিসর্টে এসে হাজির হল দুপুরের দিকে। সায়ন তাকে আগের রাতে যা ঘটেছিল সব খুলে বলল। অরিন্দম খানিক চুপ করে থেকে বলল, “এই রিসর্টটা আগে এক ব্রিটিশ সাহেবের বাংলো ছিল। শোনা যায়, তার মেয়ে এক পাহাড়ি ছেলের প্রেমে পড়ে আত্মহত্যা করে, আর সেই ঘরটিই ছিল তার ঘর—যেখানে সে গলায় দড়ি দিয়েছিল। তখন থেকে ওই ঘর ‘শূন্য’ হয়ে যায়। কাগজে-কলমে সেটার অস্তিত্ব মুছে দেওয়া হয়, কিন্তু জায়গাটা আর কখনো ফাঁকা হয়নি।” সায়নের চোখ বড় হয়ে উঠল, আর সে বুঝতে পারল, সে কোনো সাধারণ রহস্যে পা রাখেনি—এই ঘর, এই কান্না, আর সেই অদ্ভুত VOID ফলক—সব যেন এক প্রাচীন অভিশাপের দরজা খুলে দিচ্ছে… যার ওপারে যা আছে, তা শুধু ভয় নয়, হয়তো সময়েরও বাইরে কিছু একটায় ডুবে আছে।

রাত দশটা পেরিয়ে গেছে, পাহাড়ি রিসর্টের প্রতিটি জানালা বন্ধ, প্রতিটি আলো নিভে আসছে ধীরে ধীরে, কেবল সায়নের ঘরে এখনো জ্বলছে টেবিল ল্যাম্পের ম্লান আলো। বিছানার ওপর ছড়িয়ে রয়েছে তার ব্লগিং কিট—একটা হাই-ক্যাপাসিটি রেকর্ডার, নৈশদৃশ্য ক্যামেরা, মোবাইল ফোনের ব্যাকআপ ব্যাটারি, আর একটি ছোট নোটবুক, যেখানে সে আজকের সন্ধ্যায় অরিন্দমের কথাগুলো টুকে রেখেছে। তার মাথায় এখন একটাই চিন্তা—‘VOID’ লেখা সেই দরজার ভিতরে কী আছে? কে কাঁদে সেই বন্ধ দরজার পিছনে? নাকি সবটাই হ্যালুসিনেশন? সে নিজেকে বোঝাতে চাইল যে একজন যুক্তিবাদী মানুষ হিসেবে তার দায়িত্ব এখন সত্য খোঁজা, ভয় পাওয়া নয়। রাত এগারোটার কিছু আগে সে পকেটে রেকর্ডার আর ক্যামেরা ঢুকিয়ে দরজার ছিটকিনি খুলল, বাইরে পা রাখতেই ঠান্ডা বাতাসে তার মুখের কাছে ধোঁয়া জমে উঠল। করিডোর একেবারে নিস্তব্ধ, কাঠের ফ্লোরে হালকা কড়কড় শব্দ তুলে সে এগিয়ে চলল সেই পুরনো অংশের দিকে, যেখানে ‘VOID’ লেখা দরজাটা ছিল। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে আজ দরজাটা অদৃশ্য। তার জায়গায় যেন শুধু একটা ফাঁকা দেওয়াল, একটু অদ্ভুতভাবে অন্যরকম শেডে রঙ করা, যেন কিছু লুকোনো রয়েছে। সে পকেট থেকে ক্যামেরা বের করে দেওয়ালের সামনে রাখতেই অদ্ভুত কিছু ঘটল—তার রেকর্ডারে এক নিমেষে শোঁ শোঁ শব্দ শুরু হয়ে গেল, যা সাধারণত কোনো অতিপ্রাকৃত তরঙ্গ ধরলে হয়। আতঙ্ক আর উত্তেজনায় তার গা ঘেমে উঠল, ঠিক তখনই—হঠাৎ দরজা নিজে থেকেই তৈরি হল দেওয়ালে, যেন বাতাসের ছোঁয়ায় রং সরে গিয়ে দরজাটা আবার জেগে উঠল।

সায়ন ভয়কে উপেক্ষা করে ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগিয়ে গেল, তার আঙুল দরজার হাতলে রাখতেই আবার সেই শীতল অনুভূতি। এবার সে হাত সরাল না, বরং ধীরে ধীরে দরজার হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে দরজা ঠেলে দিল। দরজার ওপারে ছিল একটা ছোট, ঘোলাটে ঘর, যেন অনেক বছর ধরেই বাতাস ঢোকেনি, জানালাগুলো বাইরে থেকে পেরেক দিয়ে বন্ধ করা। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুকনো পাতা, পুরনো কাপড়, আর এক কোণে একটা কাঠের চেয়ার, যার পেছনে টাঙানো একটি বিবর্ণ ছবি—এক কিশোরীর, চোখে বিষাদ, আর মুখে যেন অনন্ত অপেক্ষার ছাপ। হঠাৎ সেই নারীকণ্ঠের কান্না আবার শুরু হল, এবার একেবারে তার পেছন থেকে। সায়ন তড়িত্‌গতিতে ঘুরে তাকাল, কিন্তু কেউ নেই। সে রেকর্ডার চালু করল, ক্যামেরা তাক করল চারপাশে। তার ক্যামেরার স্ক্রিনে হঠাৎ ধরা পড়ল—চেয়ারে বসে আছে সেই ছবির কিশোরী, তার গায়ে সাদা রাতের পোশাক, ভেজা চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে মেঝেতে। কিন্তু ক্যামেরায় স্পষ্ট দৃশ্য থাকা সত্ত্বেও বাস্তবে কেউ নেই। ভয় আর বিস্ময়ে হতবিহ্বল সায়ন বুঝতে পারছিল না সে যা দেখছে তা সত্যি, না স্বপ্ন।

ঠিক তখনই ঘর কাঁপতে শুরু করল—চেয়ারের পেছনে হাওয়ায় দুলতে লাগল ছবিটা, ঘরের এক কোনা থেকে যেন অদৃশ্য শক্তি এগিয়ে এলো তার দিকে। সায়ন পেছনে সরে আসতে গিয়েই হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল মেঝেতে। দরজা বন্ধ হয়ে গেল নিজের থেকেই, আর চারপাশে অন্ধকার, শুধুই সেই কান্না, আর মেয়েটির অস্পষ্ট গলা—“আমাকে ওরা মারলো… ওরা চায় না কেউ জানুক…”। সায়ন আর দাঁড়াতে পারল না, তার শরীর জুড়ে যেন বরফ জমে গেছে। সে রেকর্ডারটা চালু রেখেই দরজার দিকে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেল, দরজার কাছে পৌঁছে চিৎকার করে উঠল, “কে ওরা? তুমি কে?” আর তখনই সেই কিশোরীর কণ্ঠে একটা নাম ভেসে এল—“স্নি…গ্ধা…”। হঠাৎ দরজা খুলে গেল, এবং তার সঙ্গে হাওয়ার ঝাপটায় বাইরে এসে পড়ল স্নিগ্ধা, যার মুখ সাদা, চোখে অশ্রু, আর ঠোঁটে শুধুই এই বাক্য—“তুমি ঢুকলে! ওরা এবার তোমায় ছেড়ে দেবে না…”।

পরদিন সকাল, রিসর্টের উঠোনে রোদ ঝলমল করছে, অথচ সায়নের ভেতরটা যেন শীতল পাথরের মতো ভারী হয়ে আছে। গত রাতের ঘটনার পর আর ঘুমোতে পারেনি সে—মাথায় ঘুরছে সেই ঘর, সেই কিশোরীর কান্না, আর শেষ মুহূর্তে উচ্চারিত সেই নাম—“স্নিগ্ধা…”। এতদিন যাকে সহানুভূতিশীল, নিরীহ রিসেপশনিস্ট ভেবেছিল, সে-ই কি এই রহস্যের মূল সূত্র? নাকি তার অতীত কোনোভাবে জড়িয়ে আছে শূন্য নম্বর ঘরের ইতিহাসের সঙ্গে? ব্রেকফাস্টের সময় স্নিগ্ধার মুখে একটুও স্বাভাবিকতার ছাপ ছিল না, বরং সে সায়নের চোখ এড়িয়ে থাকতে চাইছিল। সায়ন কিছু বলল না, বরং তার নোটবুকে একটাই লাইন লিখল—“ঘর নয়, অতীতই বন্দি রয়েছে। কেউ লুকোচ্ছে সত্যটা, মুখোশ পরে।” দুপুরের দিকে সে রিসর্টের পুরনো রেকর্ড খুঁজতে গেল, পুরনো অফিস ঘরের পেছনে থাকা স্টোরঘরে, যেখানে মোটা মোটা খাতা আর ধুলো জমা রেজিস্টার বইতে হয়তো কিছু তথ্য মিলবে। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে সে এক পুরনো রেজিস্ট্রারে পেল ১৯৯৮ সালের এক এন্ট্রি—এক দম্পতি, তাদের ১৫ বছরের মেয়ে, নাম কৃশানী নাথ, যিনি নিখোঁজ হন ১৬ অক্টোবর, রাত্রি ১২টা ২০ মিনিটে। সেই ফর্মের পাশে রিসর্ট কর্মীর সই—‘প্রবীর ঘোষাল’। সায়নের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ম্যানেজার প্রবীর বাবু আজ পর্যন্ত সেই ঘটনার কথা লুকিয়ে রেখেছিলেন।

সন্ধ্যায় সায়ন ফের রিসর্টে ফিরে এসে সোজা চলে গেল রিসেপশনে, যেখানে স্নিগ্ধা একা বসে চা খাচ্ছিল। সে আর কোনো ভূমিকা না দিয়ে সোজা বলল, “তুমি কৃশানীকে চিনতে?” কথাটা শুনেই স্নিগ্ধার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, হাতের কাপটা পড়ে গেল মেঝেতে। দু’জনের মাঝে কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা—তারপর স্নিগ্ধা ফিসফিস করে বলল, “আমি… আমি ওর ছোট বোন… কিন্তু কেউ জানে না এটা।” চোখ ভিজে উঠছিল তার, সে মাথা নিচু করে বলে চলল, “সেই বছর, যখন কৃশানী হারিয়ে যায়, আমরা এখানে এসেছিলাম মা-বাবার সঙ্গে। ও খুব স্বাধীনচেতা ছিল, রিসর্টের এক পাহাড়ি ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে, যার নাম ছিল সাগর। প্রবীর ঘোষাল তখন থেকেই আমাদের চিনত। হঠাৎ একদিন মা-বাবা কৃশানীর ঘরে ঢুকে দেখে সাগর ওর সঙ্গে রয়েছে, ভয়ানক রেগে গিয়ে তারা তাকে মারধর করে, আর কৃশানীকে বন্দি করে ওই ঘরে—‘ঘর শূন্য’ বলে যার দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়।” স্নিগ্ধা থামল, গলা কাঁপছিল তার, “তিন দিন পর কৃশানীকে ওরা মৃত অবস্থায় পায়… বলা হয় আত্মহত্যা করেছে… কিন্তু আমি জানি, ওকে মেরে ফেলা হয়েছিল। বাবা-মা ভয় পেল সামাজিক লজ্জা, আর রিসর্ট ম্যানেজার প্রবীর কাকার সঙ্গে মিলে পুরো ঘটনাটা চাপা দিয়ে দেয়।”

সায়নের গলা শুকিয়ে গেল। তার চোখে যেন একটা ছবি ফুটে উঠল—এক নিষ্পাপ কিশোরী, যার ভালোবাসা ছিল অপরাধ, আর তার মৃত্যু ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল পরিবারের সম্মানের নামে। স্নিগ্ধা বলল, “আমার বয়স তখন আট, কিছুই বুঝতাম না। বড় হয়ে এই রিসর্টেই কাজে যোগ দিই, কেবল ওর স্মৃতি টানতো। মাঝে মাঝে সেই ঘর থেকে কান্না শোনা যেত… জানি, এটা আমার দিদি… সে এখনো ক্ষমা চায়নি, কারণ তার হত্যাকারীরা কেউ শাস্তি পায়নি।” সায়ন বলল, “প্রবীর এখন কোথায়?” স্নিগ্ধা কাঁপা কণ্ঠে বলল, “সে ফিরে আসবে কাল… কিন্তু সে জানে, তুমি ওই ঘরে ঢুকেছ। এবার সে তোমাকেও ছাড়বে না। যাকে সত্য জানার বাসনা ছুঁয়ে যায়, তাকে শেষ করে দেয় এই রিসর্ট।” সায়নের মনে হচ্ছিল, তার সামনে একটা অদৃশ্য জাল ছড়িয়ে পড়ছে—একটা প্রেতাত্মা, একটাই নাম্বারহীন ঘর, এক অব্যক্ত অপরাধ… আর এখন, সেই প্রেতাত্মার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে ওঠার পরিণতি তাকে টেনে নিচ্ছে এক অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে।

রাতের নিঃসাড় হাওয়ায় শোনা যাচ্ছিল শুধু পাহাড়ি ঝোপঝাড়ে বাতাসের গুঞ্জন, আর দূরে কোথাও একটা নাম না-জানা পাখির ক্লান্ত ডাক। সায়নের ঘরে আলো জ্বলছিল, কিন্তু জানালার বাইরে যেন ছায়া ঘুরপাক খাচ্ছিল। স্নিগ্ধা তাকে সাবধান করে চলে গেছে ঘরে, অথচ তার কথাগুলোর প্রতিধ্বনি এখনো কানে বাজছে—“সে জানে তুমি ঢুকেছ… এবার সে তোমাকেও ছাড়বে না।” সায়ন জানে, কাল সকালে প্রবীর ঘোষাল ফিরে আসবে, কিন্তু তার অপেক্ষা করার ইচ্ছে নেই। সে এই রাতেই শেষ সত্যটা সামনে আনবে—কারণ সে বুঝতে পারছে, রিসর্টের মধ্যে এমন কিছু রয়েছে যা শুধু অতীত নয়, বরং এক অভিশপ্ত বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। সায়ন ব্যাগ থেকে রেকর্ডার, ক্যামেরা, আর একটা ছোট টর্চ বার করল, আর হাঁটা শুরু করল সেই পুরনো করিডোরের দিকে—যেখানে রাতের পর রাত কান্না ভেসে আসে, আর দিন হলে কিছুই থাকে না। সে জানে এবার দরজাটা সহজে খুলবে না, কারণ তার আগমনের খবর পেয়ে গেছে কেউ। হঠাৎ করেই করিডোরের বাতি নিভে গেল। গা ছমছমে অন্ধকারে সে টর্চ জ্বালিয়ে এগিয়ে গেল দেওয়ালের সেই জায়গায়, যেখানে কাল রাতেই ‘VOID’ লেখা দরজাটা ফিরে এসেছিল। সেখানে পৌঁছতেই আবার একটা গন্ধ—সন্দেহ, গোপনতা, আর পচে যাওয়া স্মৃতির মতো। হঠাৎ করে দেওয়ালটা ঠান্ডা হয়ে উঠল, আর দরজাটা জেগে উঠল চোখের সামনে, সেই একই লেখাঃ “VOID”। এবার দরজাটা খুলতেই কোনো আওয়াজ হয়নি, শুধু হিমেল বাতাস বেরিয়ে এল ভিতর থেকে।

ঘরের ভিতরে ঢুকে সায়ন প্রথমেই সেই ছবিটাকে লক্ষ্য করল—কৃশানীর মুখে যেন আগের তুলনায় বেশি স্পষ্টতা, চোখ দুটোতে আরও অনন্ত অপেক্ষা। ঘরের এক কোনায় তখনও সেই চেয়ারের গায়ে গন্ধ—মৃত্যুর, দুঃখের, আর নিষ্ঠুরতার। সে ক্যামেরা চালু করল, রেকর্ডার অন করে বলে উঠল, “কৃশানী, আমি এসেছি। এবার আমাকে সত্যটা বলো।” আচমকাই বাতাস ভারী হয়ে উঠল, আর সায়নের সামনে দৃশ্যমান হয়ে উঠল এক ছায়ামূর্তি—তরুণী, ভিজে পোশাক, কাঁধে দাগ, আর চোখে অভিমান। এবার সে চিৎকার করল না, বরং শান্ত গলায় বলল, “ওরা আমাকে আটকে রেখেছিল, আমার কথা কেউ শুনতো না… আমি সাগরকে ভালোবাসতাম, কিন্তু আমার মা-বাবা—ওরা আমাকে ঘরে বন্দি করে রাখে… খাওয়া দেওয়া বন্ধ করে দেয়… আর এক রাতে প্রবীর কাকা এসে…” কিশোরীর কণ্ঠ কেঁপে উঠল, “আমার গলায় চাদর পেঁচিয়ে ধরে ওরা বলে, মুখ বন্ধ রাখ না হলে পরিবারের মান চলে যাবে… আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম… কিন্তু…” কণ্ঠটা ফেটে গেল। সায়নের গলা শুকিয়ে এল। সে জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে বাঁচাতে পারি তোমায়?” কিশোরী বলল, “যদি ও স্বীকার করে, যদি প্রবীর মুখ খুলে সত্যি বলে… আমি মুক্তি পাবো।” ঠিক তখনই ঘরের দরজা খুলে প্রবেশ করল প্রবীর ঘোষাল—তার চোখে লাল রাগ, হাতে টর্চ, আর কণ্ঠে গর্জন, “তুমি এখানে কী করছ? কে তোমাকে ঢুকতে বলেছে এই ঘরে?” সায়ন স্থির গলায় বলল, “তোমার অতীত তোমার পিছু নিয়েছে প্রবীরবাবু, তুমি জানো তুমি কী করেছ।”

প্রবীর এক মুহূর্ত থেমে গেল, তারপর হাসল—ঠান্ডা, গা শিরশির করা এক হাসি। “সবাই জানতাম, ওই মেয়ে বিপদ ডেকে আনবে, মা-বাবার মাথা হেঁট করিয়ে দেবে… আমি শুধু সাহায্য করেছি ওদের—এটাই ছিল সঠিক কাজ। মরেছে তো? মরুক… কিন্তু ঘরটা কেন আজও হাঁপাচ্ছে?” সায়ন ক্যামেরার লেন্স প্রবীরের দিকে ঘুরিয়ে বলল, “এই স্বীকারোক্তি এখন শুধু আমি শুনছি না, পুরো পৃথিবী শুনবে। ক্যামেরা চলছে।” প্রবীর থমকে গেল, তারপর এক ঝাঁপ দিয়ে ক্যামেরা ছিনিয়ে নিতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল মেঝেতে। আর তখনই ঘরের চারপাশ কাঁপতে লাগল, বাতি নিভে এল, ছবির ফ্রেম ভেঙে পড়ল মেঝেতে। সেই কিশোরী ছায়া এগিয়ে এল ধীরে ধীরে প্রবীরের দিকে—তার চোখে এখন ক্রোধ, দীর্ঘ বছর ধরে চেপে রাখা কান্না আর প্রতিশোধের আগুন। প্রবীর আর্তনাদ করে উঠল, “না… না… আমি ভুল করিনি… আমি শুধু…” তার গলা বন্ধ হয়ে এল, মুখ বেঁকে গেল, আর সায়নের সামনে প্রবীরের শরীর হঠাৎ ঠান্ডা ও নিষ্প্রাণ হয়ে এল। ঘর নিস্তব্ধ। ছায়া ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল বাতাসে, আর ছবির ফ্রেমে কৃশানীর মুখে ফুটে উঠল একটুকরো শান্তি। সায়ন শুধু শুনতে পেল, এক স্তব্ধতাভরা ফিসফাস—“ধন্যবাদ…”।

তিন দিন পর, শিলিগুড়ির রিসর্টে আবার সূর্য উঠেছে। পাখির ডাক, পাহাড়ি বাতাস, রিসর্টের পরিচিত ছায়াগুলো যেন ফিরে এসেছে আগের মতো। কিন্তু ভিতরে ভিতরে কিছু বদলে গেছে—ভেঙে গেছে এক প্রাচীন নীরবতা, উন্মোচিত হয়েছে এক কালো অতীত। সায়ন চৌধুরী এখনো রিসর্টেই আছে, তার ঘরে বসে নিজের ল্যাপটপে লিখছে—“The Girl in Room Zero: A Truth Beyond Walls”। ব্লগের জন্য নয়, এবার সে পাঠাচ্ছে এটা কলকাতার এক বড়ো দৈনিক পত্রিকায়, সঙ্গে রেকর্ডিং, ছবি আর সেই ভয়ানক রাতের ভিডিও ক্লিপ। পুলিশের কাছে সব প্রমাণ গেছে। প্রবীর ঘোষালের মৃত্যু ‘হৃদরোগ’ বলে ধামাচাপা দিতে চেয়েছিল রিসর্ট কর্তৃপক্ষ, কিন্তু ভিডিও ফুটেজে তার স্বীকারোক্তি দেখে তদন্তকারীরা এসে হাজির হয়েছে। স্নিগ্ধা নিজের পরিচয় দিয়েছে, তার বয়ানে কৃশানীর মৃত্যুর সত্য প্রকাশ পেয়েছে। সায়ন জানে—এই লেখা শুধু একটি অতিপ্রাকৃত অভিজ্ঞতা নয়, বরং একটি দীর্ঘদিনের ন্যায়বিচারের পথ। “VOID” লেখা দরজাটা এখন বন্ধ, রিসর্ট কর্তৃপক্ষ সেটি পেরেক দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে, দেয়ালে রং করা হয়েছে আবার, যেন কিছুই ঘটেনি। অথচ রাতে হালকা হাওয়ায়, দরজার গায়ে কেউ যেন চুল ছুঁয়ে যায়—সায়নের মনে হয়, এখনও কেউ হয়তো অপেক্ষা করছে, আরও কোনো মুখোশ খুলে যাওয়ার।

সে বিকেলে স্নিগ্ধা এল তার ঘরে, হাতে ছোট্ট একটা কাঠের বাক্স। বাক্স খুলে দেখাল, ভিতরে কৃশানীর পুরনো চিঠি, সাগরের সঙ্গে লেখা কিছু গোপন নোট, আর একটা ছোট লকেট, যেখানে দু’জনের ছবি। চোখে জল নিয়ে বলল, “ওর সবকিছু এখানেই রেখে দিচ্ছি, যেন এখন অন্তত শান্তিতে থাকত পারে।” সায়ন জানে, এই লকেট বা চিঠিগুলো কোনো কোর্টে প্রমাণ হিসেবে হয়তো গ্রহণযোগ্য নয়, কিন্তু কোনো প্রেতাত্মার মুক্তির জন্য যথেষ্ট। দু’জনে মিলে সেই বাক্সটিকে রেখে এল ঘরের এক কোনায়, মেঝের নিচে। বিদায় নেওয়ার সময় স্নিগ্ধা বলল, “আমি আর থাকব না এখানে। রিসর্টকে আর মাফ করা যায় না।” সায়ন মাথা নাড়ল, বলল, “তুমি চাইলে কলকাতায় গিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারো। তোমার অনেক কিছু বলা বাকি আছে।” সে স্নিগ্ধাকে নিজের পরিচিত সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিল। বিদায়ের সময়, স্নিগ্ধা একবার ঘুরে তাকাল ‘VOID’ লেখা দেয়ালের দিকে—কোনো শব্দ নেই, কোনো আওয়াজ নেই। শুধু একটা হালকা বাতাসের গন্ধ—ভেজা চুল আর পুরনো শোকের মতো।

দুপুরে রিসর্ট ছাড়ার আগে সায়ন শেষবারের মতো করিডোরে হাঁটল। করিডোরে এখন আলো ফিরে এসেছে, অতিথিদের কোলাহল আবার ফিরেছে রিসর্টে। কিন্তু সে জানে, তার অভিজ্ঞতা একা তার নয়—তার ব্লগে পোস্ট দেওয়ার পর হাজার হাজার কমেন্ট এসেছে, কেউ বলছে তার শহরে এমন ঘর ছিল, কেউ বলছে এমন অভিশপ্ত ভালোবাসার কাহিনি তারা নিজেও দেখেছে। মানুষ বিশ্বাস করতে চায়, কারণ ‘ভূত’ শুধু একজন মৃতের আত্মা নয়—ভূত মানে সেই সব কথা যা কেউ কখনো শোনেনি, মানে সেই ন্যায়বিচার যা সময় পেরিয়েও অপেক্ষা করে, আর মানে সেই কান্না যা শোনে কেবল সেই, যে সত্য জানতে চায়। গাড়িতে বসে সায়ন মোবাইলে শেষ একটা লাইন টাইপ করল—“Some doors are better closed. But sometimes, we must open them, not for curiosity—but for closure.” সে জানে, শূন্য নম্বর ঘরের দরজা এবার চিরতরে বন্ধ হয়ে গেলেও, তার শব্দ রয়ে গেছে—স্নিগ্ধার চোখে, সায়নের লেখায়, আর কৃশানীর লকেটের সেই ছবিতে, যেখানে ভালোবাসা এখনো আটকে আছে এক অনন্ত ‘VOID’-এর ভিতরে।

কোলকাতা ফিরে আসার পর অনেক রাত পর্যন্ত সায়ন ঘুমোতে পারেনি। শহরের আলো, ট্রাফিক, চায়ের দোকানের কোলাহল—সব কিছুই যেন এক অচেনা নিরাবেগতায় ভরা লাগছিল। এক অদৃশ্য ভার বুকের উপর চেপে বসেছিল, যেমন ভার একসময় সেই পাহাড়ি রিসর্টের শূন্য নম্বর ঘরটিতে জমে ছিল। তার ব্লগ পোস্ট ‘The Girl in Room Zero’ ভাইরাল হয়ে গেছে—হাজার হাজার মানুষ পড়ছে, শেয়ার করছে, আলোচনা করছে। কেউ বিশ্বাস করছে, কেউ করছে না। কেউ লিখেছে, “ভূত বলে কিছু নেই,” আর কেউ লিখেছে, “আমি ঠিক এমন ঘর দেখেছি শিলং-এ।” কিন্তু সায়ন জানে, এটি শুধুমাত্র ভূতের গল্প নয়—এ এক প্রজন্মব্যাপী নীরবতার বিরুদ্ধে উচ্চারিত চিৎকার, যা কেউ শুনতে পায় না, যদি না কেউ কান পাতে দেয়।

স্নিগ্ধা এখন কলকাতাতেই থাকে, একটা এনজিওতে কাজ করছে—নাম “Voice Unheard”, যেটা কাজ করে নিখোঁজ, অবহেলিত মেয়েদের নিয়ে। সে মাঝে মাঝে সায়নের সঙ্গে দেখা করে, কখনও চুপ করে বসে থাকে, কখনও বলে—“ওর জন্য তো কিছুই করতে পারিনি, এবার যদি অন্যদের জন্য পারি।” আর সেই চুপচাপ বসে থাকা মুহূর্তগুলোতেই সায়ন বুঝে যায়—কিছু প্রেতাত্মা মুক্ত হয় না কারণ তারা খুন হয়েছিল, বরং মুক্ত হয় যখন তারা মনে রাখা হয়, শ্রদ্ধা করা হয়, আর বিশ্বাস করা হয়। শূন্য নম্বর ঘরের দরজাটি হয়তো বন্ধ, কিন্তু সেই কান্না, সেই প্রতিক্রিয়া, সেই ছবি—সব আজও সায়নের মাথায় গেঁথে আছে।

একটা নতুন বই লিখছেন সায়ন, “The Silent Echo,” যেখানে সে বর্ণনা করবে তার অভিজ্ঞতাগুলোর আরো গভীরে গিয়ে—কিভাবে এক সময়ের অন্ধকার গোপনীয়তা, যা শূন্য নম্বর ঘরের পিছনে ছিল, এখন মানুষের মধ্যে আলো হয়ে এসেছে। সে লিখবে কৃশানীর গল্প, তার পরিবার, আর সেই অপ্রকাশিত সত্য যা তাকে শান্তি দেবে। বইটির প্রতিটি পৃষ্ঠা সায়নকে আরেকটু আলোকিত করে, তার অনুসন্ধানের যাত্রা এক নতুন দিশায় নিয়ে যায়।

শিলিগুড়ির রিসর্টের ভবনটি এখনও আছে, কিন্তু আজ আর সেখানে কোনো ভয় বা গোপন সন্ত্রাস নেই। অতিথিরা আসছে, হাসছে, আর নির্দ্বিধায় সেখান থেকে যাচ্ছে। কিন্তু সায়ন জানে, কেউ যদি খুব ভালোভাবে খেয়াল করে, তারা হয়তো দেখতে পাবে একদম শেষ কোণায়, শূন্য নম্বর ঘরের কাছে, এক মায়াবী শীতলতা আর একটি নিঃশব্দ কান্না যেখান থেকে কখনও দূরে চলে যায়নি।

রিসর্টটি বন্ধ হয়ে গেছে একদিন, কিন্তু একসময় এক অব্যক্ত সত্য এখানে থাকা ছিল। সেই সত্য এখন ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে, পৃথিবীজুড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, অনেকের মনে আর অনেকের মনেই শান্তি নিয়ে এসেছে।

আর সেই শান্তি, সেই নিঃশব্দ শান্তি—শুধু সায়ন জানে, এটি কীভাবে সমস্ত ঝড়, সমস্ত কান্না আর ভয় জয় করে একটা নতুন দিগন্তে পরিণত হয়েছে।

শেষ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *