পর্ব ১: সেই খামখানা চিঠি
বৃষ্টিভেজা কলকাতার সন্ধ্যায়, ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের লাইব্রেরির নরম আলোয় বসে ছিল অনির্বাণ। ইতিহাসের ছাত্র, বইপাগল, এবং ভীষণরকম নিঃসঙ্গ। লাইব্রেরির শেষ তাক থেকে পুরোনো ধুলোবালিতে মোড়া একটা খাম পেয়েছিল সে। উপরে কোনো প্রেরকের নাম নেই, শুধু একটা লাল মোমের সীল—তার ওপর আঁকা ছিল একটা গোলচিহ্ন, তার ভেতরে চোখের মতো কিছু একটা, যেন কোনো গুপ্ত প্রতীক। খুলতেই ভিতরে পাওয়া গেল হাতের লেখায় লেখা চার লাইনের একটা ছড়া—
“যেখানে সময় থেমে থাকে,
আর ছায়া গিলতে চায় আলো,
তুমি যদি চাও জানতে সত্য,
এসো শূন্যচক্রে, নিঃশব্দ চলো।”
অনির্বাণের বুকের ভিতর কেমন যেন কাঁপুনি ধরল। এতদিনের নিঃসার জীবনটা আচমকা যেন কোনো ছায়া দিয়ে ঘেরা রহস্যে ঢেকে গেল।
সেই রাতেই সে ছড়ার অর্থ খুঁজতে শুরু করল। ‘শূন্যচক্র’ নামটা আগে কখনো শোনেনি। লাইব্রেরির ডিজিটাল আর্কাইভে, পুরোনো পত্রপত্রিকায়, গুগল পর্যন্ত—কোথাও কিছু নেই।
তবে পরদিন, পুরোনো কলকাতার ম্যাপ ঘাঁটতে গিয়ে সে দেখতে পেল ‘রাধাবাজার লেনে’ এক সময় একটা বিল্ডিং ছিল যার নাম ‘Chakra House’। ১৮৭৩ সালের ম্যাপে তার অস্তিত্ব ছিল, কিন্তু এখন তার জায়গায় শুধু ফাঁকা একটা গুদামঘর।
এতদিনের বোরিং অনির্বাণ যেন নিজের মধ্যে একটা অদ্ভুত সাহস খুঁজে পেল। ঠিক করল, সে সেখানে যাবে।
রাত সাড়ে দশটা নাগাদ, ছাতা হাতে, রেইনকোট গায়ে দিয়ে সে পৌছোল সেই রাধাবাজার লেনে। গলিটার শেষ মাথায় একটা পুরোনো লোহার গেট, তালাবন্ধ, কিন্তু তালাটা যেন জংধরা—হাতের সামান্য ধাক্কায় খুলে গেল। ভেতরে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি, আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ধ্বংসস্তূপ।
মাঝখানে একটা সিঁড়ি নিচের দিকে নামছে, অন্ধকারে। ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে নামতে শুরু করল অনির্বাণ। নিচে নেমে দেখে একটা ছোট্ট ঘর, আর ঘরের মধ্যে কাঠের গোল টেবিল ঘিরে চারটে চেয়ারে বসে আছেন চারজন মুখঢাকা মানুষ।
“তুমি অনির্বাণ চৌধুরী?” প্রশ্ন করল একজন, গলায় রুমাল বাঁধা।
“হ্যাঁ। আপনি…আপনারা কে?”
“আমরা শূন্যচক্র। সত্যের খোঁজ যারা করে, তাদেরই আমরা ডাকি। তুমি প্রস্তুত তো?”
“সত্য? কিসের সত্য?”
“এই শহরের অতীতের এমন এক সত্য, যা কেউ জানে না। জানলে সব বদলে যাবে।”
“আর যদি আমি জানতে না চাই?”
“তবে তুমি এখান থেকে বাঁচতে পারবে না। খামটা খুলেছো, এর মানে তুমি চক্রে ঢুকে গেছো।”
অনির্বাণ চুপ করে গেল। তার ঠোঁট শুকিয়ে গেছে, গলা শুকনো, কিন্তু চোখে ছিল অদ্ভুত এক আলো।
“তোমাদের কাছে কী চাই?”
“তোমার সময়, তোমার মস্তিষ্ক, আর তোমার নৈঃশব্দ্য।”
তখনই ঘরের অন্ধকার কোণ থেকে একজন হাত বাড়িয়ে দিল একটা কালো রঙের খাপঢাকা পুস্তিকা। তার ওপরে সেই একই প্রতীক—চোখের মধ্যে গোল চক্র।
“এটা পড়ে ফেল। সত্য শুরু হয় এখান থেকে।”
অনির্বাণ ধীরে ধীরে বইটা হাতে নিল। পাতাগুলো অদ্ভুত কাগজে ছাপা, যেন কোনো প্রাচীন রীতিতে তৈরি। প্রথম পাতায় লেখা—
“অধ্যায় ১: নন্দীর প্রেত এবং বঙ্গীয় ব্রাহ্ম সংহিতা”
সেই রাতেই অনির্বাণ ঢুকে পড়ল এমন এক জগতে, যেখানে ইতিহাস শুধু পুরোনো নয়, ভয়ংকর। শূন্যচক্র শুধু একটা সিক্রেট সোসাইটি নয়, এক অলীক নেটওয়ার্ক—যা ছায়ার মতো ঘিরে আছে কলকাতাকে।
অনির্বাণ বুঝতে পারল, সে নিজের জীবন তো নয়, ইতিহাসের ভাগ্যও বদলে দিতে চলেছে। কারণ সে-ই হবে শূন্যচক্রের পরবর্তী উত্তরাধিকারী—যদি সে টিকে থাকতে পারে।
পর্ব ২: নন্দীর প্রেত ও প্রথম চিহ্ন
ঘরের ভেতর বাতাসটা ভারী হয়ে উঠেছিল। কাঠের দেওয়াল, তেলচিটচিটে টেবিল, আর অদ্ভুত চুপচাপ মুখোশধারী চারজন—এ যেন অনির্বাণের পড়া কোনো প্রাচীন গুপ্তগোষ্ঠীর গোপন সভা, বইয়ের পাতা থেকে লাফিয়ে উঠে আসা একটা জ্যান্ত দৃশ্য। হাতে ধরা কালো মলাটের পুস্তিকাটা ধীরে ধীরে খুলে ফেলল সে।
প্রথম পাতায় লেখা—
“নন্দীর প্রেত ও বঙ্গীয় ব্রাহ্ম সংহিতা
সপ্তদশ শতাব্দীর কলকাতায়, মহামারির অন্ধকারে এক আশ্চর্য ঘটনার সূত্রপাত ঘটে। রাধানাথ নন্দী নামে এক ব্রাহ্মণ, যিনি বৃন্দাবন থেকে ফিরে এসে দাবি করেন, তিনি ঈশ্বরের চিহ্ন দেখেছেন। তাঁর দেখার পরে কয়েক দিনের মধ্যেই মৃত্যু হয় তাঁর—কিন্তু স্থানীয়রা দাবি করেন, তিনি এখনও রাত্রিবেলায় বাড়ির ছাদে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় দেখা দেন। সেই মৃত মানুষটিকে বলা হয় ‘নন্দীর প্রেত’। তাঁর রেখে যাওয়া পাণ্ডুলিপি—বঙ্গীয় ব্রাহ্ম সংহিতা—এক রহস্যময় নথি, যা কোথায় আছে কেউ জানে না। কিন্তু সেই পাণ্ডুলিপি যার হাতে পড়বে, সে দেখতে পাবে শহরের ‘অদৃশ্য নীল রেখা’, যা ভবিষ্যতের দিকে ইঙ্গিত করে। শূন্যচক্রের দায়িত্ব সেই রেখা খুঁজে বার করা।**”
অনির্বাণ পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “কিন্তু এর সঙ্গে আমি কীভাবে যুক্ত?”
ডানদিকে বসা মুখোশধারী মানুষটি এবার মুখ খুলল। “তুমি ইতিহাস বোঝো। তবে যেটা ইতিহাসের বাইরে, যেটা হারিয়ে গেছে অথবা লুকিয়ে রাখা হয়েছে, তার পাঠক দরকার হয়—যারা সাধারণ নও। আমরা সেই পাঠকের সন্ধানে থাকি।”
“তোমার সামনে তিনটি পথ,” বামদিকে বসা নারীস্বর বলল। “এক: তুমি এখানেই থেমে যেতে পারো। আমরা তোমার সব স্মৃতি মুছে দেবো। দুই: তুমি আমাদের হয়ে কাজ করতে পারো, শুধু অনুসন্ধানকারীর মতো। তিন: তুমি সম্পূর্ণভাবে চক্রে ঢুকে পড়ো—তাহলে তোমার পরিচয়, জীবন, সব বদলে যাবে।”
অনির্বাণ চুপ করে ছিল। মাথার ভেতরে ঝড়। সে সাধারণ ছাত্র, ইউনিভার্সিটির বোর্ডিং-এ থাকে, ক্লাস করে, মাঝে মাঝে বই লিখে, কবিতা লেখে, আর নিঃসঙ্গ থাকে। এমন একটা জীবনেই তার পরিচয় ছিল। এখন, মনে হচ্ছিল, কোনো এক গোপন দরজা খুলে গেছে।
“আমি দ্বিতীয় পথ বেছে নিচ্ছি,” সে বলল। “আমি জানতে চাই, অনুসন্ধান করতে চাই, কিন্তু আমি এখনো নিজেকে হারাতে চাই না।”
মুখোশধারীরা একসাথে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
“তবে তুমি শূন্যচক্রের ‘পর্যবেক্ষক’,” মাঝের জন বলল। “তোমাকে এখন প্রথম চিহ্ন খুঁজে বার করতে হবে—নন্দীর প্রেতের ছায়া।”
“মানে?”
“তুমি যাবে উত্তর কলকাতার হাটখোলা লেনে। সেখানে পুরনো একটা বাড়ি আছে, যেখানে একসময় রাধানাথ নন্দী থাকতেন। এখন সেটা জরাজীর্ণ, ভাঙাচোরা, কেউ থাকে না, কেউ যায় না। কিন্তু যেদিন কেউ চক্রে ঢোকে, সেদিনই নাকি নন্দীর প্রেত তাকে দেখা দেয়। তার কাছে একটা প্রশ্ন থাকবে তোমার জন্য। উত্তর দিতে পারলে, তুমি পাবে দ্বিতীয় ধাপের চিহ্ন।”
“আর যদি না পারি?”
“তবে হয়তো ফিরে আসতে পারবে না।”
অন্ধকার আরও ঘন হয়ে এল। চারজন মুখোশধারী ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল ছায়ায়। দরজার পাশে একটা ধাতব ব্যাজ রাখা ছিল। তাতে সেই চিহ্ন—চোখের ভিতর গোল ঘূর্ণি।
“তুমি এটা নিয়ে যাও। এটা শুধু চিহ্ন নয়, দরজা খোলার চাবি।”
অনির্বাণ ব্যাজটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল, মনে হাজারটা প্রশ্ন নিয়ে। রাত তখন প্রায় বারোটা।
হাটখোলা লেনের বাড়িটা খুঁজে পেতে খুব কষ্ট হলো না। প্রায় অদৃশ্য একটা সাইনবোর্ডে লেখা—“নন্দীবাড়ি—১৭০২”। দেয়ালজোড়া ফাটল, সিঁড়ির মুখে মাকড়সার জাল, জানালার কাচে ধুলো।
তবে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে সে ঠিক দেখল—একটা জানালার ভিতর থেকে যেন আলো ছড়াচ্ছে।
কাঁপা হাতে ব্যাজটা বের করে দরজায় স্পর্শ করতেই যেন কারেন্ট খেলে গেল। ধাতব একটা শব্দ—‘চুক্’ করে তালা খুলে গেল। দরজা নিজে থেকেই খুলে গেল।
ভেতরে ঢুকতেই একটা ঠান্ডা বাতাস কানে ফিসফিস করে বলল—“অবশেষে এলি, অনির্বাণ চৌধুরী।”
সে চমকে তাকাল। কেউ নেই। কিন্তু সামনে কাঠের সিঁড়ি, যেখানে বসে আছে এক ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বৃদ্ধ। কিন্তু তার পায়ের কোনো ছায়া নেই।
বৃদ্ধ বলল, “আমি রাধানাথ নন্দী। এই বাড়ির প্রেত। আর তুই চক্রের পাঠক। বল, কেন জানতে চাস অতীত?”
অনির্বাণ গলা শুকনো হলেও উত্তর দিল, “কারণ আমার বিশ্বাস, যা হারিয়ে গেছে, তার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে ভবিষ্যতের বীজ।”
বৃদ্ধের চোখে যেন একটা ঝলক দেখা গেল।
“তুই ঠিক পথে এসেছিস। এখন শোন—তোর জন্য তিনটি সূত্র থাকবে। প্রথম সূত্র: ‘আলোর ভিতর ছায়া থাকে’। এই বাক্য যদি বুঝিস, তবে পরের দরজা খুলবে। দ্বিতীয় সূত্র তুই পাবে ‘তিলজলার নীল ঘর’-এ। আর তৃতীয়টি লুকিয়ে আছে মেটিয়াবুরুজের এক রাজবাড়ির ভেতর।”
“কিন্তু এইসব জায়গায় আমি কী খুঁজব?”
“সময় আসলে বুঝে যাবি। তবে মনে রাখিস—তোর প্রতিটি পদক্ষেপে কেউ একজন তোকে অনুসরণ করছে। তার চোখ শূন্যচক্রেরও ওপরে।”
“কে?”
“যার নাম আমরা উচ্চারণ করি না। কিন্তু তার প্রতীক একটা কালো পাখি—কাক। যদি কাক দেখিস, জানিস, সে কাছেই আছে।”
অনির্বাণ কিছু বলার আগেই বাতাসে ধোঁয়া ঘূর্ণির মতো সবকিছু মিশে গেল। বাড়িটা যেন নিঃশব্দে ঘুমিয়ে পড়ল।
রাস্তায় বেরিয়ে আসতেই তার ফোন বেজে উঠল। অথচ সে ভালো করেই জানে, বাড়ির ভিতর ঢোকার আগে ফোনটা অফ করে রেখেছিল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল—নামহীন নম্বর।
সে ফোনটা ধরে, “হ্যালো?” বলতেই ওদিক থেকে একটা ফিসফিসে গলা বলল—
“তুমি যা দেখছ, তা বাস্তব নয়। আর যা বাস্তব, তা দেখতে পাবে না—যদি না তুমি চোখের ভিতর চোখ রাখো।”
ফোন কেটে গেল।
অনির্বাণ বুঝতে পারল, এখন থেকে কোনো কিছুই আর স্বাভাবিক নয়। শহরটা বদলে গেছে। আর সে ঢুকে গেছে এমন এক চক্রে, যার কেন্দ্রে রয়েছে শূন্য, আর চারপাশে জটলা ইতিহাস, প্রেত, ছায়া, এবং ছদ্মবেশে বসে থাকা কোনো অলঙ্ঘনীয় সত্য।
পর্ব ৩: তিলজলার নীল ঘরে এক ভোররাতের ডাকে
অনির্বাণ সেদিন রাতে ঘুমোতে পারেনি। মাথার ভেতর যেন সারাক্ষণ একটা শব্দ বাজছিল—ছায়া, কাক, শূন্য, চোখ। সকাল হতেই সে ডায়েরি খুলে ফেলল। প্রতিটি কথা লিখে রাখছিল যেন সত্যিটা হারিয়ে না যায়।
বৃদ্ধ প্রেত বলেছিল: দ্বিতীয় সূত্র তিলজলার নীল ঘরে।
তিলজলা, দক্ষিণ কলকাতা। কিন্তু ‘নীল ঘর’—তা কী? অনির্বাণ বাসে করে যাচ্ছিল হেতালপুকুর রোড দিয়ে, কিন্তু কোথাও এমন নামের কোনো বাড়ি নেই। সে শেষমেশ গুগলে খোঁজার বদলে আবার পুরনো শহরের ম্যাপ বের করল, ১৯২৭ সালের এক ডিটেইলড মিউনিসিপ্যাল চার্ট।
সেখানে এক জায়গায় লেখা ছিল “Indigo Storehouse – K.K. Haldar & Sons”। পাশেই নোট—‘color laboratory for textile dyeing (local name: Neel Bari)’।
বুকের ভিতরটা ধকধক করে উঠল।
এটা যে সোজাসুজি একটা হান্ট, তা এখন আর সন্দেহ ছিল না। নীল ঘর মানেই সেই ইন্ডিগো ফ্যাক্টরির পুরনো অংশ—যেখানে নীল রঙ বানানো হতো। এবং ব্রিটিশ যুগে এই সব ঘর নিয়ে বহু ভূতের গল্প চালু ছিল।
অনির্বাণ গন্তব্যে পৌঁছে দেখল—বস্তির পাশে বিশাল লোহার গেট, একপাশে জংধরা বোর্ডে লেখা “KEEP OUT – DANGEROUS STRUCTURE”।
তবু এগোল।
চাবি ছিল না। কিন্তু শূন্যচক্রের ব্যাজটা সে পকেট থেকে বার করে গেটের ফাঁকে রাখতেই এক অদ্ভুত শব্দে গেটের দণ্ড খুলে গেল।
ভেতরে ঠান্ডা, ভেজা গন্ধ, যেন রং আর গোপন ইতিহাসের গন্ধ মিশে এক মরণঘরের বাতাস তৈরি করেছে।
পুরনো কাঠের সিঁড়ি। আর ওপরে উঠে একটা ঘর—নাকি গুহা বলা ভালো—যেখানে সবকিছু নীল। নীল দেওয়াল, নীল কাচ, নীল রঙে ধূসর হয়ে যাওয়া আয়না।
মাঝখানে একটা টেবিলের ওপর রাখা একটা কাঠের বাক্স।
অনির্বাণ এগিয়ে গেল। বাক্স খুলতেই একগুচ্ছ পুরনো কাগজের নোট, তার ওপর লেখা এক পৃষ্ঠার চিঠি।
“আমি করুণাময় হালদার। আমি জানি, তুমি এসেছ।
আমার ভুলের দায় এখন তোর।
১৮৫৯ সালে আমি এক প্রেতসাধনায় যুক্ত হই।
নীল চক্রের একজন পণ্ডিতের পরামর্শে আমরা রঙের ভেতরে আত্মা ধরে রাখতে শিখি।
কিন্তু একটা আত্মা বেরিয়ে যায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে—তাকে বলে ‘নীলভূত’।
সে আজও রয়ে গেছে এই ঘরে।
তুই যদি দেখতে চাস সত্য, তবে আয়নার দিকে তাকাস।
আর ভয় পাস না, ভয় হলে সে আসবে। ভয়ই তার আহার।”
অনির্বাণের কাঁপুনি শুরু হয়ে গেল। ঘরটা নিঃশব্দ। বাইরে পাখির ডাকও নেই।
সে জানে, এখান থেকে সরে গেলে সব শেষ। সে সাহস করে আয়নার দিকে তাকাল।
প্রথমে কিছুই নেই। তারপর ধীরে ধীরে এক ছায়াচরিত্র দেখা দিল—নারীর অবয়ব, চোখের গর্ত শূন্য, আর ঠোঁটে অদ্ভুত এক হাসি।
সে ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছে।
“তুমি কি করুণাময়ের ভুল?”
ছায়াটি থেমে গেল। তারপর ঠোঁট নাড়ল—কিন্তু কোনো শব্দ নেই।
অনির্বাণ এগিয়ে গেল। সাহসে না হলেও, সেই ভয় পেয়ে ফেলার আগেই।
তার মাথার ভেতর একটা গলা বাজল, কারও নয়—তার নিজেরই নয়।
“তুমি যদি সত্য জানতে চাও, তবে আমাকে দাও একটি রঙ—একটি ব্যথা—একটি নাম।”
সে হঠাৎ বলে উঠল—“রঙ: নীল। ব্যথা: অনুতাপ। নাম: হেমাঙ্গী।”
ছায়াটা কেঁপে উঠল। যেন ভিতর থেকে ছিঁড়ে যাচ্ছে। তারপর ধীরে ধীরে মিশে গেল আয়নার ভিতর।
ঘরে বাতাস ফিরল।
টেবিলের উপর আরেকটা কাগজ এসে পড়েছে, কোথা থেকে যেন।
“তৃতীয় চিহ্ন – মেটিয়াবুরুজ রাজবাড়ি
মন্তোষ রায়চৌধুরীর শেষ নোটে যা লেখা, তা কারো চোখে পড়েনি।
তুমি তা দেখতে পাবে, যদি শূন্যচক্রের তৃতীয় সোপানে পৌঁছাতে পারো।
স্মরণ রাখো: কাক এবার কাছে আসবে। চোখ ফেরালে সে ঢুকবে তোর ছায়ায়।”
অনির্বাণ জানে, খেলা এখন শুধু খেলা নয়।
এটা একটা টেস্ট—কাউকে পরিণত করা হচ্ছে এমন কিছুতে, যা মানুষ নয়, যা ইতিহাস নয়—একটা চলমান জীবন্ত আর্কাইভে।
সে বাইরে বেরোতেই দেখে রোদ উঠেছে।
তার গায়ে একটা কাক বসে আছে। ডানাতে কালি, চোখে ছায়া।
অনির্বাণ তাকিয়ে থাকল।
এই প্রথমবার—কাকটা চোখ ফেরাল।
পর্ব ৪: মেটিয়াবুরুজে মন্তোষ রায়চৌধুরীর শেষ নোট
কলকাতা শহরের ইতিহাসে এমন অনেক রাজবাড়ি আছে যাদের নামও মানুষ জানে না, অথচ তারা সাক্ষ্য বহন করে এমন সময়ের, যা সরকারি রেকর্ডে নেই। মেটিয়াবুরুজের যে রাজবাড়িটার কথা বলা হয়েছে, সেটার খোঁজ পাওয়া গেল না কোনো ম্যাপে, না কোনো আর্কাইভে। অনির্বাণ এখন জানে—শূন্যচক্রের সূত্র মানে চিহ্ন নয়, সেটা একধরনের আত্ম-অন্বেষা।
তবে এক জাঁদরেল উকিল বন্ধুর সূত্রে সে জেনে গেল, একসময় নবাব ওয়াজেদ আলির সেনাদের কিছুমান বংশধরেরা মেটিয়াবুরুজের এক রঙমহল ঘর ব্যবহার করত এক গোপন সভার জন্য। রাজবাড়ি এখন ভেঙে পড়েছে, কিন্তু এক বৃদ্ধ কেয়ারটেকার থাকেন, নাম মুন্না খাঁ।
সন্ধে নামে মেটিয়াবুরুজে। ট্রামলাইন ফুরিয়ে গেছে এখানে, দোকানপাটে শুধু হালকা আলো, আর পুরনো ইমারতের দালানঘেরা গলি। গাইড ছাড়াই অনির্বাণ চলে আসে চাঁদপোতা লেনের শেষ প্রান্তে। লাল ইটের পাঁচিল ঘেরা এক বিধ্বস্ত রাজবাড়ি।
মুন্না খাঁ গেটে বসে হুঁকো টানছিলেন। সাদা পাঞ্জাবি, ধুলোমাখা চাদর।
“তুমি কে?”
“আমার নাম অনির্বাণ। মন্তোষ রায়চৌধুরীর শেষ নোট খুঁজছি।”
বৃদ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে বললেন, “তোমার চোখে সেই আলো আছে। চলো, কিন্তু কিছু দেখবে না চোখে—শুধু মনে।”
ভেতরে ঢুকতেই অনির্বাণ দেখে ঘরগুলো প্রায় ভেঙে পড়েছে। দেয়ালে ধ্বংসাবশেষের ফাটল। তবে একটা ঘরে মাটির নিচে ছোট্ট দরজা। মুন্না খাঁ সেটা খুলে বললেন, “এইখানে এক কালে ‘তাম্রকক্ষ’ ছিল—মহারাজা আর তাঁর দুই পন্ডিত এখানে তন্ত্রচর্চা করতেন। মন্তোষবাবু সেই পন্ডিতদের একজন ছিলেন। মৃত্যুর আগের রাতে এখানে এসে বসেছিলেন—আর তারপর আর ওঠেননি। তাঁর রেখে যাওয়া এক টুকরো চিঠি আছে, কিন্তু সেটা কোনো সাধারণ কাগজে নয়।”
অনির্বাণ নিচে নামল। টর্চের আলোয় একটা থরে রাখা ছাইভর্তি পাত্রের ভিতর থেকে মুন্না খাঁ একটা তামার পাত বের করলেন। তাতে খোদাই করা অক্ষরে লেখা—
“যখন চক্র সম্পূর্ণ হয়, তখনই তার কেন্দ্রে ধরা পড়ে শূন্য।
আমি চেয়েছিলাম সময়কে বেঁধে রাখতে, কিন্তু সময় নিজেই আমার ছায়া গিলে ফেলেছে।
যদি কেউ একশো বছরের ঘড়ির শব্দ শুনতে পায়, তবে সে জানতে পারবে—
চক্রে আর একজন আছে, যার নাম কেউ জানে না, কিন্তু সে চক্র তৈরি করেছিল।
আমার চোখ যখন অন্ধ হয়ে এল, আমি একটিমাত্র শব্দ শুনেছিলাম—
‘অন্ধতারা’।”
অনির্বাণ ঠোঁট কামড়ে ধরল। নতুন শব্দ: “অন্ধতারা”—এটা কি কোনো ব্যক্তি? কোনো স্থান? নাকি সংকেত?
হঠাৎ করে ঘরের বাতাস ভারী হয়ে গেল। পাশের দেওয়াল থেকে গড়িয়ে পড়তে লাগল কিছু কালি-ধোঁয়ার মতো কিছু। তার ভেতরে গঠিত হতে লাগল এক ছায়া।
একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল—নরম, পুরুষালি কিন্তু ভাঙা স্বরে।
“তুই আমার নাম শুনেছিস?”
“কে?”
“আমি সেই শূন্য, যে চক্রের জন্ম দিয়েছিল। মন্তোষ ছিল আমার ছাত্র। কিন্তু ও চলে গেল ভুল পথে।”
“আপনি…আপনি কি অন্ধতারা?”
“না। অন্ধতারা কেউ না। অন্ধতারা একটা কক্ষ, একটা পথ, যেখানে সব দেখা যায় চোখ বন্ধ করলেই।”
“আপনি আমাকে এসব বলছেন কেন?”
“কারণ তুই সেই পাঠক, যে এখন চক্রকে জাগাবে। কিন্তু তার আগে তোর নিজের চোখ বন্ধ করতে হবে—অর্থাৎ বিশ্বাস করতে হবে যা দেখা যায় না। বিশ্বাস করতে হবে নিঃশব্দে বাজা ঘড়ির শব্দে।”
“কোথায় পাব আমি সেই ঘড়ি?”
“কলেজ স্ট্রিটের ‘দত্ত লাইব্রেরি’। সেখানেই রয়েছে শেষ চিহ্নের পূর্বাভাস। লাইব্রেরির নীচে ঘড়ির ঘর—যেটা এখন তালা পড়ে আছে। কিন্তু সেই তালা খুলবে শূন্যচক্রের ব্যাজ দিয়ে। সাবধান—ঘড়ির শব্দ শুনলে ভয় পাস না। শব্দটাই প্রশ্ন করবে তোকে। উত্তর দিতে পারলে চক্র সম্পূর্ণ হবে। না পারলে তোর ছায়াও তোকে ছাড়বে না।”
ছায়া মিলিয়ে গেল। মুন্না খাঁ কাঁপা গলায় বললেন, “আপনি শুনলেন না তো কোনো কথা?”
“আমি সব শুনলাম। এখন আমায় যেতে হবে।”
“আপনি চক্রের লোক না?”
“আমি চক্রের পাঠক। হয়তো একদিন আমি চক্র হবো, কিন্তু আজ আমি শুধু শুনি।”
অনির্বাণ বেরিয়ে আসে অন্ধকার মেটিয়াবুরুজের রাজবাড়ি থেকে।
রাস্তায় এসে সে আবার একবার ব্যাজটা দেখে। চিহ্নটা ঝিলমিল করে ওঠে।
এবার তাকে যেতে হবে সেই জায়গায়, যেখানে সময় ঘড়ির শব্দে রূপ নেয়।
কিন্তু সে বোঝে না, তার পেছনে যে একটা ছায়া হাঁটছে নিঃশব্দে—তার চোখও ঝিলমিল করছে, শুধু তাতে শূন্য নেই, অন্ধতা আছে।
পর্ব ৫: দত্ত লাইব্রেরির ঘড়ির ঘর ও নিঃশব্দের জিজ্ঞাসা
কলেজ স্ট্রিটে দত্ত লাইব্রেরি প্রায় সব কলকাতাবাসীরই চেনা, অথচ কেউ জানে না এই লাইব্রেরির নিচে আরেকটা ঘর আছে। ছোটবেলায় একবার সেখানে গিয়েছিল অনির্বাণ—আলোর নিচে জমে থাকা ছায়ার মতো এক ভয়ংকর স্মৃতি রয়ে গেছে তার ভেতরে।
সেই ভোরে সে পৌঁছাল লাইব্রেরির গলির মোড়ে। দোকানগুলো এখনো খোলেনি, শুধু দুধওয়ালা আর সংবাদপত্র বিক্রেতারা। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই একটা পুরোনো ঘ্রাণ তাকে আঘাত করল—ছাপা কাগজ, ধুলো আর শুকনো ছত্রাকের গন্ধ।
দোতলার করিডোর পেরিয়ে সে নামল পিছনের সরু সিঁড়ি দিয়ে—যেটা সাধারণত বন্ধ থাকে। দরজাটা তালা দেওয়া, কিন্তু শূন্যচক্রের ব্যাজ বের করে তার গায়ে ছোঁয়াতেই একটা নিঃশব্দ ক্লিক—আর দরজা খুলে গেল।
ঘরটা নিচে নামতেই ভেতরের বাতাসে একটা কাঁপুনি অনুভব করল অনির্বাণ। যেন কেউ তার শরীরের ভেতরে ঢুকে বসে আছে। একটা কাঠের ঘড়ি ঘরের একপাশে দাঁড়িয়ে—দাঁত বের করা শেয়ালের মতো! খুব পুরোনো এক গ্র্যান্ডফাদার ক্লক, যার কাঁচের ভিতর দুলছে একটা ব্রাসের পেন্ডুলাম।
ঘড়িটা থেমে আছে। ৪:৪৪।
ঘরের এক কোণে টেবিল, তার ওপরে সাদা চাদরে ঢাকা কিছু একটা। অনির্বাণ তা সরাতেই বেরিয়ে এল একটা ছুটকো, ছোট কাগজে মোড়া কিছু, যার গায়ে লেখা—“Answer before the fourth chime. Silence will not save you.”
ঘড়িটা হঠাৎ নিজে থেকেই টিক টিক করে চলা শুরু করল। পেন্ডুলাম দুলছে। আর অনির্বাণ দেখতে পেল ঘড়ির কাচে তার প্রতিবিম্ব স্পষ্ট হচ্ছে না—বাঁকা, ভাঙা, যেন তার চেহারা নয়—অন্য কারও মুখ।
ঘড়ি বেজে উঠল—একবার।
প্রথম প্রশ্ন এল, শব্দ নয়—চোখের সামনে বাতাসে লেখা অক্ষরে:
“What is the color of forgetting?”
অনির্বাণ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, “ছাই।”
ঘড়িটা বেজে উঠল—দ্বিতীয়বার।
দ্বিতীয় প্রশ্ন:
“Who hides in your silence?”
সে ভেতরের দিকে তাকাল—নিজের ছোটবেলার স্মৃতি, মা-র চোখের অশ্রু, বাবার রাগী মুখ, সেই শূন্য বারান্দা। “আমি নিজেই।”
ঘড়ি তৃতীয়বার বাজল।
তৃতীয় প্রশ্ন:
“What begins when everything ends?”
অনির্বাণ চোখ বন্ধ করল। এবার সে আর চিন্তা করল না, সে অনুভব করল।
“শূন্য। চক্র। নতুন পথ।”
চতুর্থ চিমে বাজল না। বরং ঘড়ির কাচ ভেঙে পড়ে গেল মাটিতে।
ঘরের মধ্যে আলো ফেটে পড়ল। দেয়ালের ফাঁক দিয়ে ঝড়ের মতো ধুলো ঢুকছে, আর সেখানে একটা ছায়া।
“তুই উত্তীর্ণ,” সেই ছায়া বলল। “এখন তুই দেখবি শেষ পথ—অন্ধতারা।”
“কোথায় সেটা?”
“তুই যে পথে চলেছিস, তা রাস্তা নয়। একটা মানসপটে তৈরি মানচিত্র। এই ঘরেই অন্ধতারা আছে। শুধু তোকে চোখ বন্ধ করে দেখতে হবে। তুই যদি পারিস, তবে শূন্যচক্রে তোর প্রবেশ চূড়ান্ত হবে।”
“কিন্তু আমি যদি না পারি?”
“তাহলে তুই ফিরে যাবি। কিন্তু যা দেখেছিস, তার ভার তোর সঙ্গেই যাবে। অনেকেই পাগল হয়ে গেছে এইখানে এসে। কেউ কেউ আর বাস্তবকে বিশ্বাস করতে পারেনি। মনে রাখিস, তোর পরীক্ষাটা এখনও বাকি।”
ঘড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একটি ছোট্ট লাল কাগজে মোড়া বস্তু। অনির্বাণ সেটি খুলতেই দেখল একটি চোখ আঁকা, যার মধ্যেই আছে একটি স্পাইরাল। নিচে লেখা:
“অন্ধতারা – মানে যেখানে অন্ধতা আলোকে গ্রাস করে না, বরং আলো সেখানে চোখ বন্ধ রাখে।”
সে জানে, পরবর্তী পর্বে তাকে নামতে হবে নিজের ভিতরে। সত্য খুঁজতে গিয়ে মিথ্যের মতো জিনিসগুলোর ভিতর দিয়ে হাঁটতে হবে।
দত্ত লাইব্রেরির দরজা বন্ধ হয়ে গেল নিজের থেকে। আর অনির্বাণ জানে—পেছনে ফিরে যাবার আর কোনো রাস্তা নেই।
পর্ব ৬: অন্ধতারার দরজা ও চতুর্থ পাঠক
দত্ত লাইব্রেরির ঘড়ির ঘরটা এখন খালি। অনির্বাণ একা দাঁড়িয়ে। বাতাস নিঃশব্দ, পেন্ডুলাম থেমে গেছে, ঘড়ির কাঁচ চূর্ণ হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মেঝেতে। তবু তার মাথার ভিতর যেন কেউ নিঃশব্দে কথা বলছে।
“অন্ধতারা কোথাও বাইরে নেই। সে তোর ভিতরেই ঘুমিয়ে আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, তুই তাকে জাগাতে পারবি কি না।”
সে কাগজে আঁকা চোখের প্রতীকের দিকে তাকিয়ে রইল। এক মুহূর্তে চোখটা যেন নড়ল—না, নড়ে উঠল না, কিন্তু তবু তার চাহনিতে এক চুম্বকত্ব ছিল, যা সরিয়ে নেওয়া যায় না।
ঘড়ির পেছনের দেওয়ালে সে খুঁজে পেল একটা খাঁজ, যেখানে হাত রাখতেই একটা লুকনো প্যানেল খুলে গেল। ভিতরে অন্ধকার ঘর।
সেই ঘরে ঢুকতেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
মুহূর্তের মধ্যেই বাতাস ভারী, ধুলোয় মোড়া, ঠান্ডা আর চুপচাপ।
ঘরের মাঝে রাখা একটা লাল কাপড়ে ঢাকা মঞ্চ। অনির্বাণ কাপড়টা সরাল।
তার নীচে একটা আয়না। তবে এই আয়না স্বচ্ছ নয়—কালো, থিকথিকে, যেন জলের তলায় আলো নেই।
হঠাৎ আয়নার ভেতর ভেসে উঠল এক মুখ—তা তার নিজের, কিন্তু তাতে যেন বয়স নেই। চোখ নেই। আর ঠোঁটে একরকম মৃত হাসি।
“তুই অন্ধতারায় প্রবেশ করেছিস।”
“তুমি কে?”
“আমি চতুর্থ পাঠক। শূন্যচক্রের এক প্রাচীন অভিশাপ। আমি সেই ব্যক্তি, যে দেখেছিল কিন্তু ভুল উত্তর দিয়েছিল। এখন আমি এই ঘরের মধ্যে বন্দী। তুই আমার উত্তরাধিকারী—অন্তত এখন পর্যন্ত।”
“তাহলে কীভাবে আমি নিজেকে বাঁচাব?”
“তুই যদি তিনটি উত্তর ঠিক দিতে পারিস, তাহলে আমি মুক্ত হব, তুই পাবে শেষ চিহ্ন। যদি না পারিস, তুই এই ঘরে আমার জায়গা নেবি। চক্র নতুন পাঠক খোঁজে না—পাঠককেই চক্রে রূপান্তর করে।”
অনির্বাণ কাঁপছিল, কিন্তু পিছিয়ে গেল না।
“আমি প্রস্তুত।”
ঘরটা কেঁপে উঠল। আয়না ঝিলমিল করে উঠল।
প্রথম প্রশ্ন ভেসে উঠল কুয়াশায়—
“কোন শব্দ সবচেয়ে বেশি মিথ্যা?”
অনির্বাণ মাথা নিচু করল। তার মনে পড়ল বাবার মুখ—যখন বলতেন, “আমি তোকে ভালোবাসি”—অথচ কখনো পাশে ছিলেন না।
সে বলল, “ভালোবাসি।”
মেঝে একটানা গম্ভীর কাঁপন তুলল, আয়নার ছায়ামুখ একবার কেঁপে উঠল।
ঠিক।
দ্বিতীয় প্রশ্ন:
“তুই কীভাবে জানবি যে তুই বেঁচে আছিস?”
অনির্বাণ এবার একটু দম নিল। সে বলল, “কারণ আমি ভয় পাই। কারণ আমি স্বপ্ন দেখি। কারণ আমি প্রশ্ন করি।”
আয়নার মধ্যের ছায়া এবার একটু সরল। যেন মাথা নাড়ল সম্মতিসূচক।
ঠিক।
তৃতীয় প্রশ্ন ধোঁয়ার মতো উঁকি দিল—
“শূন্যচক্র আসলে কী?”
অনির্বাণ এক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর বলল, “শূন্যচক্র কোনো সমাজ নয়, কোনো গোষ্ঠী নয়—এটা একটা প্রক্রিয়া। নিজেকে হারিয়ে সত্যকে খুঁজে পাওয়ার যাত্রা। এটা চেতনার অভ্যন্তরীণ পথ, যেখানে অন্ধকারই আলো, আর প্রশ্নই উত্তর।”
আয়নার ছায়া বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে গলিত হতে শুরু করল, যেন জল হয়ে পড়ছে, গলে যাচ্ছে দেয়াল বেয়ে।
একটি শব্দ শুধুই ভেসে এল—“মুক্তি।”
ঘরটা আলোয় ভরে উঠল। আয়নার নিচে খোলা হয়ে গেল আরেকটা খাঁজ। তার মধ্যে রাখা একটি কাঠের বাক্স।
তাতে একটি কালো চাবি। আর নিচে খোদাই করা লেখা—
“চক্র সম্পূর্ণ হল। এখন শেষ পরীক্ষা—দেখা আর না দেখা। তুমি প্রস্তুত, তবে এখনও সম্পূর্ণ নয়। তোমাকে যেতে হবে সেই ঘরে, যেখানে সময় নিজের শরীর ছেড়ে পালিয়েছে। যেখানে কাকদের শব মেলা বসে।”
অনির্বাণ চাবি হাতে তুলে নিল। সেই মুহূর্তে তার চোখের কোণে কাঁটা গলার মতো বেঁধে গেল এক দৃশ্য—একটা ছায়া দাঁড়িয়ে আছে ঘরের কোণায়।
ছায়াটা এবার বলল—“তুই যতই সামনে এগোস, ততই তোর নিজের পেছনের ছায়া গাঢ় হবে। মনে রাখিস, চক্রের কেন্দ্রে শুধুই শূন্য থাকে না, তার গভীরে লুকিয়ে থাকে একজন রক্ষাকর্তা… এবং একজন ধ্বংসকারী।”
“আমি কার পথে হাঁটছি?”
“তা এখনো নির্ধারিত নয়। সব নির্ভর করছে শেষ পটভূমিতে—‘চিহ্নহীন গির্জা’-য়। সেখানেই তোর সামনে খুলবে সমস্ত রহস্য। সেখানেই চক্রের কেন্দ্রে শেষ পাথর বসানো হবে।”
দরজা এবার খুলে গেল নিজের থেকে।
অনির্বাণ জানে, তার ভিতরের ভয় এখন আর পিছন টানে না। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অজানা, কিন্তু সে জানে—পাঠক হিসাবে নয়, এবার সে যাচ্ছি উত্তরদাতা হিসেবে।
পর্ব ৭: চিহ্নহীন গির্জা ও রক্তমাখা মণ্ডপ
কলকাতার এমন এক জায়গা আছে, যার নাম নেই, রাস্তা নেই, অথচ লোককথায় তার উপস্থিতি অস্বীকার করা যায় না। কেউ বলে সেটা নর্থ পোর্ট থানার পাশে পুরোনো এক পরিত্যক্ত গির্জা, কেউ বলে সেটা ময়দান অঞ্চলের ভিতরে লুকোনো। কিন্তু অনির্বাণ জানে, চিহ্নহীন গির্জা খুঁজে পাওয়ার জন্য ম্যাপ নয়, দরকার মানসচোখ।
সে রাতটা একা কাটায় না। শূন্যচক্রের একজন—’ঋদ্ধিমান’—তাকে ফোন করে। কণ্ঠস্বর ভারী, কিন্তু স্থির।
“তুই এখন চক্রের কেন্দ্রে ঢুকতে চলেছিস, অনির্বাণ। আমাদের কেউ তোকে সাহায্য করতে পারবে না। তবে একটা পথ আছে—ভোরবেলা ৪:৪৪ মিনিটে সেন্ট পলস ক্যাথেড্রালের ঘড়ির নিচে দাঁড়াস। কিছু একটা ঘটবে।”
পরদিন ভোররাতে, কুয়াশায় মোড়া শহরের বুক চিরে অনির্বাণ দাঁড়িয়ে রইল সেই স্থানে। বড়ো রাস্তা ফাঁকা, কেবল গাঢ় নীল আলোয় মোড়া গির্জার ছায়া, আর অদ্ভুত নিস্তব্ধতা।
ঠিক ৪:৪৪-তে ক্যাথেড্রালের ঘড়ি একবার বেজে উঠল।
তারপর হঠাৎ করেই একটা পথ খুলে গেল মূল গির্জার পাশে, যেটা আগে ছিল না। একটা ছোট দরজা, ধাতুর, আর তার ওপর আঁকা সেই চক্রচিহ্ন—চোখের ভিতরে ঘূর্ণি।
অনির্বাণ ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ল ভিতরে।
ভেতরটা পুরোনো কাঠের ঘ্রাণে ভরা, ছাদের উপর বিশাল অদ্ভুত জ্যামিতিক রচনার ছবি। চারদিক কালো কাপড়ে ঢাকা, যেন কোনো মৃতদেহকে ঘিরে শেষ প্রার্থনার আয়োজন।
মণ্ডপের মাঝখানে একটি কংকাল-চালিত অঙ্গ থাকে, যেখানে বসানো আছে একটি কাঠের ক্রস, তার গায়ে ঝুলছে রক্তমাখা সাদা কাপড়।
একটি অদৃশ্য কণ্ঠস্বর ভেসে এল—
“তুই এখন কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে। এটা আর শুধু জ্ঞান বা ইতিহাস নয়—এটা চক্রের নাভি। এখানে সব প্রশ্ন থামে, এবং শুরু হয় পরীক্ষার শেষ ধাপ।”
“কি পরীক্ষা?” অনির্বাণ বলল।
“তোর সামনে এখন দুটো পথ। একটায় তুই দেখতে পাবি ‘চক্রের স্রষ্টা’-কে—যে নিজের অস্তিত্ব মুছে দিয়ে এই পথ বানিয়েছে। আর অন্যটায় দেখবি তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে—যে চক্রকে থামাতে চায়। একজন আলোর মতো অন্ধকার, আরেকজন অন্ধকারের ভিতর আলো। প্রশ্ন হল, তুই কাকে বিশ্বাস করবি?”
ঘরের মধ্যে হঠাৎ দুইপাশে খুলে গেল দুটি দরজা। বাঁদিকে এক অদ্ভুত সবুজ আলো, ডানদিকে গাঢ় লাল রং।
অনির্বাণ কাঁপা হাতে ব্যাজটা বের করল। ব্যাজটা এবার নিজেই গরম হয়ে উঠল, আর তার চোখের দিকে চেয়ে থাকল।
সে বাঁদিকে এগিয়ে গেল।
সবুজ আলো তাকে টেনে নিয়ে গেল এক খালি ঘরে। সেখানে একটি ছায়াচ্ছন্ন মানুষ বসে আছেন। চুল ছাঁটা, পরনে সাদাকালো পোশাক, চোখে পট্টি।
“আমি প্রণবেশ মুখোপাধ্যায়। একসময় ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলাম, এখন শূন্যচক্রের স্থপতি। আমি সেই ব্যক্তি যে চক্রকে সৃষ্টি করেছিল।”
“তুমি নিজেকে লুকিয়ে রেখেছ এতদিন?”
“হ্যাঁ। কারণ সত্য যতদিন বাইরে থাকে, সে বিকৃত হয়। আমি চেয়েছিলাম একদিন একজন পাঠক আসবে, যে সমস্ত ধাপ পার হয়ে আমার সামনে দাঁড়াবে, কোনো প্রলোভন ছাড়া। তুই সেই পাঠক।”
“তুমি কি চাইছ আমি চক্রের দায়িত্ব নিই?”
“না। আমি চাই তুই শেষ সত্যটা জানিস। তারপর তুই নিজে বেছে নিস। আর তার জন্য তোর দেখতে হবে অপর দিকটাও।”
“ডানদিকের দরজা?”
“হ্যাঁ। ওখানে যা দেখবি, তা ভয়ংকর। কিন্তু প্রয়োজনীয়।”
অনির্বাণ বেরিয়ে আবার ডানদিকের ঘরে ঢোকে।
এখানে দেয়ালে এক কিশোরের ছবি। তার চোখ কেটে ফেলা। আর ঠিক নিচে, একটি কাঠের টেবিলে পড়ে আছে এক পাণ্ডুলিপি—‘প্রতিক্রান্ত চক্রবলি’।
ভেতর থেকে এক তরুণী বেরিয়ে এল। তার চোখে ভয়, কণ্ঠে আগুন।
“আমার নাম ছিল ঐশানী দাস। আমি চতুর্থ পাঠকের বোন। আমি শূন্যচক্রে ঢুকেছিলাম, বিশ্বাস করে। তারপর দেখলাম, এরা সত্য নয়, এরা গোপনীয়তার অন্ধকারে ফাঁদ পাতে। আমি পালাতে চেয়েছিলাম, পারিনি। এখন আমি তোর সামনে দাঁড়িয়ে কারণ তুই এখনও শেষ সিদ্ধান্ত নেইনি।”
“তাহলে তুমি চাও না আমি চক্রে ঢুকি?”
“আমি চাই তুই সত্য জানিস। কিন্তু মনে রাখিস, প্রণবেশবাবু শুধু নির্মাতা নন, তিনি নিজের নামে একাধিক মিথ্যাও তৈরি করেছেন। চক্র এখন পবিত্র নয়, সে এখন অস্তিত্ব রক্ষা করে শুধুমাত্র ভয় দেখিয়ে।”
“তুমি কী করছ এখানে?”
“আমি চিহ্নহীন গির্জার প্রহরী। আমি চাই একজন সত্য পাঠক সব দেখে, তারপর নিজের পথ বেছে নেয়। তুই সেই সুযোগ পেয়েছিস।”
ঘরটা হঠাৎ ঘূর্ণিতে ভরে গেল। আলো নেমে এল দুই রঙে—সবুজ ও লাল।
অনির্বাণ বুঝল—তার সামনে দুই পথ।
সে পেছন ফিরে তাকাল না। সামনে এগিয়ে গেল একদম মাঝখানে—যেখানে আলো নেই। শুধু শূন্যতা।
সেখানে দাঁড়িয়ে সে চোখ বন্ধ করল।
তার ঠোঁট থেকে একটি বাক্য বেরিয়ে এল—
“আমি কাউকে অনুসরণ করব না। আমি শূন্যচক্র হব না। আমি হব প্রথম শূন্যপাঠক—যে শুধুই দেখে, আর কাউকে বলে দেয় না।”
মণ্ডপ কেঁপে উঠল। ঘরের মেঝে খুলে গিয়ে একটি ধাতব ফলক বেরোল, তাতে লেখা—
“শূন্যচক্র পুনর্গঠিত। নতুন স্তরে উত্তরণ হয়েছে। পাঠক এখন নিজের পথচিহ্ন নিজেই আঁকবে।”
পর্ব ৮: পাঠক-শূন্য ও ছায়ার সনদ
চিহ্নহীন গির্জার কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে, অনির্বাণ বুঝল—সে এখন আর আগের মতো নেই। কেউ তাকে পাঠক বানায়নি, কোনো গোষ্ঠী তাকে গঠন করেনি—তবে সে নিজেই নিজের পথ তৈরির অধিকার অর্জন করেছে। আর এই পরিবর্তনের মুহূর্তে, শহর তার দিকে তাকিয়ে আছে।
ধাতব ফলকের নিচে একটা অদ্ভুত কাঠামো উঠে এল—একটা দেহাকৃতি আসন, ঘিরে মোটা লোহালক্কড়ের ঘূর্ণি, যার ভেতর সাদা পাথরের তৈরি এক থলে। সেটি খুলতেই ভিতরে মিলল একটা পুরনো মুদ্রা, তামার, তাতে খোদাই করা অক্ষর—
“পাঠক-শূন্য”
একই শব্দ তিনবার ঘুরছে মাথার ভিতর। এই পরিচয় কি সম্মান, না অভিশাপ?
ঠিক তখনই বাতাসে এক অদ্ভুত ঝড় উঠল, কিন্তু তার উৎস ছিল ঘরের ভিতর, বাইরে নয়। কুয়াশা পাকিয়ে উঠে আসতে লাগল দেয়ালের ফাটল থেকে, আর তার মাঝে গঠিত হতে লাগল এক চেনা মুখ—চতুর্থ পাঠক। তবে এবার তার মুখ আর ছায়ায় ঢাকা নয়, চোখ দুটো উজ্জ্বল আগুনের মতো।
“তুই যদি শূন্য চক্রকে ভেঙে ফেলতে চাস, তোকে প্রথমে নিজের ছায়াকে মারতে হবে।”
“মানে?”
“তুই যা দেখেছিস, যা জেনেছিস, তা শুধু তোকে নয়, তোকে যারা বিশ্বাস করবে তাদেরও কুর্নিশ করাবে। শূন্যচক্র এমনই—যার কেন্দ্রে কেউ বসে না, সবাই তাকে কেন্দ্র বানায়। কিন্তু এখন তুই এক নতুন চক্র—তোর ছায়া তোকে মানবে না। সে বিশ্বাস করে পুরোনো নিয়মে, পরম্পরায়। তোর সঙ্গে সে যুদ্ধ করবে।”
আলো নিভে গেল।
ঘরটা নেমে এল গাঢ় অন্ধকারে। শুধু একটিমাত্র আলো জ্বলল মেঝেতে—সেখানে দাঁড়িয়ে আছে অনির্বাণ নিজেই, আর তার সামনে… আরেকজন অনির্বাণ। কিন্তু চোখে ঘৃণা, ঠোঁটে বিদ্রুপ।
“তুই কী করিস, বল তো? সত্য খুঁজিস? হাস্যকর! তোকে যে চিঠি দিয়েছিল, সেটা তুই কেন খুলেছিলি? কৌতূহল? নাকি আত্মপ্রমাণের এক বোকা বাসনা?”
“আমি খুঁজতে চেয়েছি কারণ… আমি ভয় পাইনি,” অনির্বাণ জবাব দিল।
“ভয়? তুই ভয় পেয়েছিস প্রতি মুহূর্তে। কিন্তু ভাবিস সাহসী! তুই ভুল করেছিস। শূন্যচক্রকে বদলানো যায় না। সেটা নোংরা হলেও চলে, কারণ ইতিহাসকে কেউ ভালোবাসে না—সে শুধু মানে। তুই বদলাতে গেলে কেউ মানবে না তোকে।”
“তাহলে কি আমি নিজেকে থামিয়ে দিই?”
ছায়া-অনির্বাণ হেসে উঠল, “তুই কিছু করতে পারবি না। কারণ তোকে কেউ বিশ্বাস করবে না। এই শহর তোকে মানবে না। চক্র তোকে ছাড়বে না। তুই থাকবি একটা অর্ধেক পরিচয়ের ভিতর—পাঠক, কিন্তু পাঠক নস্তু; উত্তরদাতা, কিন্তু উত্তরহীন।”
অনির্বাণ এক পা এগিয়ে এসে চুপ করে দাঁড়াল।
“তাহলে তুই এখনো ভাবিস, আমি তোর ছায়া? না কি তুই আমার?”
ছায়া থমকে গেল। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “তুই যদি এই প্রশ্ন তুলতে পারিস, তবে তুইই চক্র।”
ছায়াটা মিলিয়ে গেল।
ভেতরের বাতাস হালকা হল। দরজার দিকে এগিয়ে গেল অনির্বাণ। এবার আর দরজা খুলতে ব্যাজ লাগল না, দরজা নিজে থেকেই খুলে গেল।
বাইরে আলোয় ভেসে এল কলেজ স্ট্রিটের চেনা ছবি। সকাল হয়ে গেছে।
কিন্তু এবার শহরটা যেন নতুন মনে হল। প্রতিটি বইয়ের দোকান, প্রতিটি ট্রামের শব্দ, প্রতিটি হাঁটুরে লোকের মুখে যেন একটি প্রশ্ন—”তুমি জানো তো, সত্যটা ঠিক কোথায় লুকিয়ে?”
অনির্বাণ সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরে হেঁটে চলল, হাতে তার সেই তামার মুদ্রা।
বুক পকেটে তার এক টুকরো কাগজ—যেখানে লেখা ছিল:
“যারা নিজের ছায়াকে জয় করে, তারা আর চক্রের ভিতর থাকে না। তারা হয়ে ওঠে চক্রের বাইরে এক বিন্দু শূন্য—যেখানে সব নতুন করে শুরু হয়।”
সেদিন বিকেলে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে সে নিজের পুরনো চেয়ারে বসে একটা নোট লিখল—
আমি অনির্বাণ চৌধুরী, ইতিহাসের ছাত্র। আজ আমি একটি সত্যকে চোখে দেখেছি, ছুঁয়ে দেখেছি, আর নিজেকে পাল্টে নিয়েছি।
শূন্যচক্র শুধু অতীত নয়, তা ভবিষ্যতেরও দ্বাররক্ষক।
আমি জানি না, কেউ এই নোট পড়বে কিনা।
কিন্তু যদি পড়ে, তবে মনে রাখো—
যখন তোমার কাছে কোনো অচেনা চিঠি আসে, যার গায়ে লাল মোমের সীল আর চোখের প্রতীক, তখন পিছিয়ে যেয়ো না।
কারণ হয়তো, সত্য ঠিক তখনই শুরু হয়।
পর্ব ৯: শূন্যরেখার ওপারে
অনির্বাণের চারপাশের শহরটা যেন ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছিল। আগে যে ট্রামের ঘণ্টি তাকে শুধু যন্ত্রণা দিত, এখন তা শুনলেই তার মনে হয়, শহরটা কিছু বলতে চাইছে। যে বইয়ের দোকানে সে একঘেয়ে ইতিহাসের পাতা ওল্টাত, এখন প্রতিটি পাতার ফাঁকে ফাঁকে সে খুঁজে পায় ইঙ্গিত—চোখের ভিতর চোখ, শব্দের ভিতর নিঃশব্দতা।
সেদিন সন্ধেয় সে আবার হাঁটছিল প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনে দিয়ে। হঠাৎ কেউ কাঁধে হাত রাখল।
“তুমি সেই ছেলেটা? যে শূন্যচক্রের ব্যাপারে জানে?”
ঘুরে দেখে এক মধ্যবয়সী মহিলা, গলায় কাঠের মালা, চোখে গভীর নীল টিপ।
“আপনি কে?”
“আমি মীরাবাঈ। আমি এক সময় পাঠক ছিলাম। আমি চতুর্থ স্তর পর্যন্ত পৌঁছেছিলাম, তারপর পেছন ফিরে গিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি… তুমি তো পার করে এসেছ শূন্যচক্র। এবার একটা প্রশ্ন—তুমি কি থামতে চাও, না সামনে এগোতে?”
“এখনো তো জানি না সামনে কী আছে।”
“যা আছে, তা অন্যরকম। তুমি হয়তো ভাবছো, তুমি যা দেখেছো তা-ই সত্য। কিন্তু চক্রের শেষ নেই। সত্যের কেন্দ্র নেই। তুমি এখন একটা নতুন স্তরে দাঁড়িয়ে—যার নাম ‘শূন্যরেখা’। ওটা একটা মানসিক রেখা, যেখানে পুরনো নিজেকে ফেলে রেখে একজন ‘রচয়িতা’ হতে হয়। তুমি এখনও পাঠক। তুমি কি প্রস্তুত লিখতে?”
অনির্বাণ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। “মানে? লিখতে বলছেন মানে?”
“তুমি যেভাবে শূন্যচক্র দেখেছো, অনুধাবন করেছো, সেই উপলব্ধিগুলোকে শুধু নিজের কাছে রাখলে হবে না। তুমি এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছো যেখানে সত্যকে শুধু দেখা নয়, গড়ে তোলাও জরুরি। তুমি হবে নতুন পথপ্রদর্শক—নতুন পাঠকদের জন্য।”
“আমি কি তাহলে গুরু হবো?”
“না। শূন্যচক্রে কেউ গুরু হয় না। সবাই পথিক। শুধু কেউ একটু আগে হাঁটতে শুরু করে। কিন্তু মনে রাখো, তুমি যা লেখো, তা শূন্যচক্রে অনুরণিত হবে। তাই শব্দের ভার বুঝে ফেলো।”
মীরাবাঈ তাকে একটা পুরনো খাতা দিলেন। তার পাতাগুলো সাদা, কিন্তু হাত দিয়ে ছুঁতেই যেন কাঁপুনি লাগে।
“এটা ‘রেখাবহ’। এ শুধু কাগজ নয়। এতে যা লেখা হয়, তা পরবর্তী পাঠকের মনে প্রবাহিত হয়—স্মৃতির মতো, কিন্তু বাস্তবের চেয়ে প্রবল। তোমাকে এখন লিখতে হবে প্রথম বাক্য, যা তোমার মতো আরেকজন খুঁজে পাবে হয়তো বছর দশ, কিংবা শত বছর পরে। বাক্যটা হতে হবে এমন, যা আলো নয়, ছায়ার ভিতর আলো জাগায়।”
অনির্বাণ খাতাটা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করল কলকাতার ভিড়ের ভেতর দিয়ে।
বৃষ্টি পড়ছিল। রাস্তার আলোয় রিকশাওয়ালার চোখে যেন সে নিজেকেই খুঁজে পেল—একটা অনিশ্চিত যাত্রার চিত্র।
তার মাথার ভেতরে একটা বাক্য ঘুরছে, কিন্তু সে এখনও তা কাগজে নামায়নি।
কফিহাউসের এক কোণে গিয়ে বসে সে কলমটা ছুঁলো। খাতার পাতায় প্রথমবারের মতো কলম স্পর্শ করতেই বাতাস বদলে গেল। জানালার কাচ ঘেমে উঠল, দূরের ট্রামের ঘণ্টি থেমে গেল, এবং অদৃশ্য কণ্ঠস্বর বলল—
“লিখে ফেলো, পাঠক-শূন্য। শূন্যচক্র তোমার অপেক্ষায় আছে।”
অনির্বাণ লিখল—
“যখন সব আলো নিভে যায়, তখন শব্দ নয়—নিঃশব্দই পথ দেখায়। যদি তোমার ভিতরেও সেই অন্ধকার থাকে, তবে তুমি প্রস্তুত। এগিয়ে এসো।”
লিখেই সে খাতা বন্ধ করল।
মুহূর্তের মধ্যেই খাতা মিলিয়ে গেল বাতাসে, আর তার সামনে পড়ে রইল একটি সোনালী পাত। তাতে একটি শব্দ লেখা:
“অগ্নিসংক্রম”
সে বুঝে গেল—পরবর্তী স্তরে যাওয়ার আহ্বান এটি। অগ্নিসংক্রম—অর্থাৎ শুদ্ধিকরণ, উত্তরণ।
তবে এ উত্তরণ বাইরের নয়, ভেতরের।
রাত বাড়ছে। কিন্তু অনির্বাণ জানে, এবার আর গোপনে নয়—তার দায়িত্ব শুরু হল প্রকাশ্যে। সে ইতিহাসের ছাত্র নয়, ইতিহাসের ধারক। সে পাঠক নয়, রচয়িতা। আর প্রতিটি নতুন পাঠকের জন্য, শূন্যচক্রের সেই নিঃশব্দ রাত্রি, সেই খামখানা চিঠি, সেই আয়নার ছায়া আবার অপেক্ষায় থাকবে।
পর্ব ১০ (শেষ পর্ব): অগ্নিসংক্রম ও চক্রের ঋতু
কলকাতার আকাশ যেন কিছুদিন ধরে একটু বেশি নিরব। ট্রামের শব্দও কমে এসেছে, বিকেলের কফিহাউস যেন কম চা খাচ্ছে, এবং দত্ত লাইব্রেরির নিচের ঘর এক অজানা কারণে ঠান্ডা হয়ে গেছে, এমনকি ছত্রাকও জন্মাতে ভয় পাচ্ছে। কারণ অনির্বাণ চৌধুরী অগ্নিসংক্রমে প্রবেশ করেছে।
সেই সোনালী পাতটা হাতে পাওয়ার পর থেকে সে শহরের সঙ্গে কথা বলা শিখে গেছে। রাস্তার দেওয়ালে হঠাৎ ধরা পড়া ছায়া, গলির মুখে ফেলে যাওয়া পানির প্যাকেট, বইয়ের পাতার হঠাৎ খুলে যাওয়া ছবি—সবই যেন ইশারা।
তবে অগ্নিসংক্রম মানে শুধু আত্মশুদ্ধি নয়, এটি শূন্যচক্রের নিজস্ব ভাষা শেখার প্রথম পাঠ।
তাকে প্রথমেই যেতে হয় রাণী রাসমণির গঙ্গাতীরে সেই পুরনো গুদামে, যেখানে নাকি একসময় ব্রিটিশরা গোপনে ধর্মীয় অনুসন্ধান চালাতো। সেখানে এখন শুধু একখণ্ড জমি, যার মাঝখানে একটি অর্ধেক পুড়ে যাওয়া বটগাছ।
গাছটির নিচে একটি বৃত্ত আঁকা ছিল, মাটিতে সাদা চুন দিয়ে। আর সেই বৃত্তের মাঝখানে একটা মাটির পাত্র, তার মধ্যে এক তুষারবৎ ধাতু—যেটা হাত দিলেই গরম হয়ে যায়।
একটি কণ্ঠস্বর ভেসে এল বাতাসে—
“অগ্নিসংক্রমে প্রবেশের অর্থই হল পুরনো নিজের ছারখার হওয়া। তুমি এখন দুটি পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে—শূন্য আর শূন্য-পরবর্তী। বেছে নাও।”
“কি ভাবে?” অনির্বাণ জিজ্ঞেস করে।
“তুমি যদি পাত্রে হাত দাও ও কোনো প্রশ্ন করো না, তবে তুমি পূর্ণ শূন্যপাঠক হবে—অর্থাৎ আর কখনো সাধারণ হতে পারবে না।
আর যদি প্রশ্ন করো, তবে তুমি পাঠক হিসেবেই থাকবে, কিন্তু পথিক নও। তোমার সিদ্ধান্ত হবে শেষ চক্র।”
অনির্বাণ অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ধীরে হাত পাত্রের দিকে বাড়িয়ে দিল।
তার মনে প্রশ্ন ছিল অনেক—সে জানতে চায়: কে ছিল চক্রের প্রথম পাঠক? কে লিখেছিল সেই ছড়ার খাম? প্রণবেশ মুখোপাধ্যায় কি সত্যিই চক্রের জন্মদাতা, না কি সেও কারো তৈরি ছায়া?
কিন্তু এবার সে কোনো প্রশ্ন করল না। শুধু পাত্র ছুঁয়ে বলল—
“আমি আর কিছু জানতে চাই না। আমি শুধু প্রস্তুত।”
এক মুহূর্তে চারদিক আলোয় ছেয়ে গেল, যেন গঙ্গার ওপার থেকে এক সূর্য উঠে এসে তার বুক ফুঁড়ে ঢুকে পড়ল।
তার মনে হল, সে এখন আর শরীর নয়—একটা প্রবাহ, একটা চলমান নাদ, একটা শব্দহীন উচ্চারণ।
পাঁচ মিনিট পর সে চোখ খুলল।
পাত্রটা ঠান্ডা। বৃত্তটা মুছে গেছে। আর বটগাছের গায়ে সে দেখতে পেল লেখা—
“তুমি এখন শূন্যচক্র নও। তুমি চক্রের ঋতু।”
রাতের অন্ধকারে সে হেঁটে গেল বইমেলার মাঠের দিকে, যেখানে সেই মুহূর্তে মঞ্চে কেউ একটি বইয়ের কথা বলছিল—
“এই বইয়ে আমরা শুনি একটি ছেলের কথা, যে খুঁজতে চেয়েছিল কিছু, যা সে নিজেও পুরোপুরি বোঝেনি। সে খুলেছিল এক অচেনা খাম, পড়েছিল এক অদ্ভুত ছড়া, আর ঢুকে পড়েছিল ইতিহাসের সিঁড়ি বেয়ে এমন এক ঘরে, যেখানে আলো থাকলেও দরজা দেখা যেত না।”
অনির্বাণ মাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে শুনছিল। বইয়ের নাম—“শূন্যচক্র: একটি পাঠকের যাত্রা”। লেখক—“অ”।
তাকে কেউ চিনলো না। তার মুখ কোথাও নেই। তার নাম কোনো ব্যানারে নেই। তবু সে হাসল।
কারণ তার কাজ শেষ হয়নি, শুধু শুরু হয়েছে।
সে জানে—কোনো একদিন, কোনো এক কলেজ লাইব্রেরির শেষ তাক থেকে আরেকজন পাবে সেই খাম, সেই মোমের সীল, আর সেই ছড়া।
“যেখানে সময় থেমে থাকে,
আর ছায়া গিলতে চায় আলো,
তুমি যদি চাও জানতে সত্য,
এসো শূন্যচক্রে, নিঃশব্দ চলো।”
তখন সে হয়তো আর কলকাতায় থাকবে না, হয়তো আর কোনো শরীরেও থাকবে না।
কিন্তু সেই মুহূর্তে বাতাসে কেউ অনুভব করবে—কান পাতলে দূরে বাজছে একটা ঘড়ি, একটানা, চারবার।
আর তারপরই খুলে যাবে আরেকটা দরজা।
চক্র চলতেই থাকবে।
[শেষ]