অনিন্দিতা কর্মকার
এক
মেঘলা সেনগুপ্ত কলকাতার ভিড়ভাট্টার ভেতর থেকে ট্রেনে উঠে বসেছে শিলাইদহের উদ্দেশ্যে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী সে, বয়স একুশ, চোখে অগণিত প্রশ্ন ও স্বপ্নের ভিড়। বইয়ের পাতায় পড়ে এসেছে রবীন্দ্রনাথের কথা, পদ্মার ধারে তাঁর কুঠিবাড়ির গল্প, কবিতার জন্মের রহস্য, কিন্তু আজ সে যেন সেই সব গল্পের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাবে। ট্রেনের কামরায় বসে জানলার বাইরে তাকাতেই মেঘলার চোখে ধরা দিল অচেনা অথচ আপন গ্রামবাংলার চিত্র। দূর থেকে দেখা যায় বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত, সবুজের ঢেউ, কাঁচা রাস্তা ধরে হাঁটা কৃষক, শাড়ি পরে মাথায় ঘড়া তোলা নারী—সব যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে। কলকাতার ব্যস্ত শহর থেকে আসা মেঘলার কাছে এই দৃশ্য যেন সময়ের ভিন্ন এক স্রোত। তার মনে হচ্ছিল, ট্রেনের প্রতিটি শব্দ তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কেবল ভৌগোলিক দূরত্বে নয়, বরং অতীতের গভীরে, রবীন্দ্রনাথের সেই সময়ের কাছে। তার হৃদয়ে ধীরে ধীরে জমতে থাকে এক অদ্ভুত উত্তেজনা, আবার সাথে এক ধরনের দ্বিধা—সে কি এই ভ্রমণে নিজের খোঁজ পাবে, নাকি কেবল এক পর্যটকের মতো ঘুরে বেড়াবে?
ট্রেনের জানলা দিয়ে ধানক্ষেতের ফাঁকে ফাঁকে ঝিলমিল করছে জলের আভা। কোথাও দেখা গেল পলাশ ফুলের দাউদাউ লাল আগুন, আবার কোথাও তালগাছের মাথা হেলে আছে মৃদু বাতাসে। মেঘলা অনুভব করল, এই গ্রামবাংলা শুধু ভৌগোলিক স্থান নয়, বরং বাংলার কবিতার প্রাণ। তার মনে পড়ল রবীন্দ্রনাথের সেই পঙ্ক্তি, যেখানে তিনি প্রকৃতিকে আপন করে নিয়েছিলেন, নদীর ঢেউ, খোলা আকাশ, কিংবা কৃষকের মুখ—সবকিছু তাঁর কবিতায় ঢুকে গিয়েছিল। মেঘলার বুকের ভেতরে তখন এক অদ্ভুত আলোড়ন কাজ করছে। ছোট থেকে পরিবারে সবাই চাইত সে যেন “নিরাপদ” কোনো পথে যায়—সরকারি চাকরি, স্থির জীবন। কিন্তু মেঘলার ভেতরে লুকিয়ে আছে কবিতার এক গোপন আগুন। সে লিখতে চায়, গাইতে চায়, নিজের হৃদয়ের আলো পৃথিবীর সাথে ভাগ করে নিতে চায়। কিন্তু সেই আগুনকে জ্বালিয়ে রাখার মতো সাহস কি তার আছে? ট্রেনের শব্দ যেন তাকে বারবার প্রশ্ন করছিল, “তুই কিসের খোঁজে যাচ্ছিস, মেঘলা?” আর সে উত্তর খুঁজে পাচ্ছিল না। কেবল জানত, শিলাইদহের কুঠিবাড়ি তাকে কিছু না কিছু দেবে—সম্ভবত একটুখানি দিশা।
যাত্রা যত এগোতে থাকে, মেঘলার চোখে ধরা পড়ে আরো জীবন্ত দৃশ্য। ছোট ছোট স্টেশনে ট্রেন থামছে, কাকের ডাক শোনা যাচ্ছে, বাচ্চারা দৌড়ে আসছে খোলাভর্তি মুড়ি আর চানাচুর বিক্রি করতে। মেঘলা সেই দৃশ্যগুলোও গভীর মনোযোগে দেখছে, যেন প্রতিটি খুঁটিনাটি কোনো এক অদৃশ্য কবিতার অংশ হয়ে যাচ্ছে। জানলার কাঁচে হেলান দিয়ে সে কল্পনা করতে থাকে—ঠিক একশো বছরেরও আগে হয়তো রবীন্দ্রনাথ এই পথেই চলেছেন, কিংবা একই রকম দৃশ্য দেখে তাঁর মনে জন্ম নিয়েছে কোনো গান, কোনো কবিতা। মেঘলার ভেতর তখন একটা অনুভূতি দানা বাঁধে—সে কেবল শিলাইদহ যাচ্ছিল না, সে আসলে নিজের ভেতরের কণ্ঠস্বরকে খুঁজতে যাচ্ছিল। তার দৃষ্টিতে গ্রামবাংলার প্রকৃতি ধরা দেয় যেন কবিতার ছন্দে, আর ট্রেনের জানালা হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে ভাবে—একদিন হয়তো সেও লিখবে, এমন কিছু যা মানুষকে ছুঁয়ে যাবে। কিন্তু একই সাথে বুকের কোণে গোপন দ্বিধাও আছে—সে কি পারবে? শিলাইদহের যাত্রা তাই শুধু ভ্রমণ নয়, বরং আত্মঅন্বেষণের পথচলা হয়ে ওঠে।
দুই
ট্রেন থেকে নামার পর যখন মেঘলা নৌকার দিকে এগোল, তখন বিকেলের আলোয় চারদিক ভরে উঠেছে এক অদ্ভুত নীরবতায়। দূরে ঝাপসা সোনালি আভা মেখে বইছে পদ্মা নদী, তার ঢেউ যেন মৃদু কণ্ঠে গান গাইছে। নৌকায় উঠে বসতেই মেঘলার বুক ধকধক করতে লাগল—সে যেন রবীন্দ্রনাথের জীবনের সেই অপরিহার্য দৃশ্যের মধ্যে প্রবেশ করছে, যেখানে কবি নদীর বুক চিরে ভেসেছেন, গান লিখেছেন, কল্পনার জগৎ গড়েছেন। পদ্মা নদী মেঘলার কাছে কেবল ভৌগোলিক বিস্তার নয়, বরং এক জীবন্ত চরিত্র, যে নিঃশব্দে কথা বলে, স্নেহে ভরিয়ে দেয়, আবার মাঝে মাঝে ভয়ও জাগায়। নদীর জলে সূর্যের শেষ আলো ভেসে এসে মেঘলার মুখে পড়ে, আর সে অনুভব করে নদী যেন তাকে স্বাগত জানাচ্ছে। জলের মৃদু ঢেউয়ে ভেসে আসে শত শত বছরের স্মৃতি, রবীন্দ্রনাথের লেখা চিঠির প্রতিধ্বনি, কিংবা তাঁর গান—“আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি”—যেন পদ্মার বুকেই জন্ম নিয়েছিল। মেঘলার চোখে ভেসে উঠল কল্পনা—রবীন্দ্রনাথ হয়তো এই নৌকার মতো কোনো এক নৌকায় বসে খাতা খুলেছিলেন, হাতে কলম, সামনে পদ্মার ঢেউ, আর তাঁর ভেতরের অস্থিরতা সুরে পরিণত হয়েছিল।
নৌকার গা ঠেসে বসে মেঘলা গভীরভাবে লক্ষ্য করল নদীর বৈচিত্র্য। কোথাও শান্ত, আয়নার মতো স্থির, আবার কোথাও হালকা ঢেউ উঠছে, যেন খুনসুটি করছে। নৌকার মাঝি ধীর কণ্ঠে একটি পুরোনো গান গাইতে শুরু করল, তাতে যেন নদীর সুর আরও গাঢ় হয়ে উঠল। মেঘলার মনে হচ্ছিল, পদ্মা কেবল নদী নয়, বরং বাংলার আত্মা। এই নদী প্রজন্মের পর প্রজন্মকে জীবন দিয়েছে, গান দিয়েছে, আর সাহস দিয়েছে। সে বুঝতে পারল, কেন রবীন্দ্রনাথ এতবার পদ্মাকে নিজের সৃষ্টির সঙ্গী করেছেন—কারণ পদ্মা একদিকে শক্তি, অন্যদিকে মমতার প্রতীক। নদীর বুকের বিশালতা মেঘলাকে বিস্ময়ে ভরিয়ে দিল; কলকাতার গণ্ডিবদ্ধ জীবনে সে এত খোলা আকাশ, এত দূর বিস্তৃত দিগন্ত কখনো দেখেনি। যেন তার বুকের ভেতরের জমে থাকা দ্বিধা, ভয়, আর অনিশ্চয়তা একে একে নদীর ঢেউয়ের সাথে মিশে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছিল পদ্মা তাকে বলছে—“তুই ভয় পাবি না, তোর ভেতরে যেই আলো আছে, সেটাকে ছড়িয়ে দিতে শিখ।” এই কথাগুলো বাস্তবে কেউ বলে নি, কিন্তু মেঘলার কানে যেন স্পষ্ট শোনা গেল।
সূর্য ধীরে ধীরে পশ্চিম আকাশে লাল আভা ছড়িয়ে দিল, আর পদ্মার ঢেউ সেই আলোকে ঝলমল করে তুলল। মেঘলা জানলার মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে কল্পনায় দেখল—একটি সাদা দাড়িওয়ালা মানুষ নৌকায় বসে আছেন, হাতে কলম, সামনে খাতা খোলা। তিনি কখনো জলে তাকাচ্ছেন, কখনো আকাশে, আর তার ভেতরের সব কথা রূপ নিচ্ছে কবিতায়। মেঘলার হৃদয় কেঁপে উঠল—রবীন্দ্রনাথ যেন তার সামনে বাস্তব হয়ে উঠেছেন। সে নিজেকে সামলাতে না পেরে চোখ বন্ধ করে ফেলল, আর মনে মনে বলল, “আমিও লিখতে চাই, আমিও গাইতে চাই।” নদীর হাওয়ায় তার চুল উড়ছিল, নৌকার পাশে ঢেউ ভাঙছিল, আর সেই মুহূর্তে মেঘলার মনে হলো সে আর একা নেই। পদ্মা তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছে, সঙ্গী হিসেবে পাশে দাঁড়িয়েছে। এই নদী তাকে শেখাচ্ছে—জীবন মানে চলা, গতি, পরিবর্তন। সে উপলব্ধি করল, নিজের ভেতরের দ্বিধা, সমাজের বাঁধন, পরিবারের চাপ—সব কিছুর মধ্যেও তার কলম যদি সৎ হয়, তবে সেটিই হবে তার আসল পরিচয়। পদ্মার বুক থেকে আসা এই শিক্ষা তাকে আরও দৃঢ় করে তুলল। আর সেদিন রাতে, নৌকা থেকে নামার আগেই মেঘলা বুঝে গেল, শিলাইদহ ভ্রমণ কেবল ভৌগোলিক যাত্রা নয়, বরং তার জীবনের গভীরে এক নতুন আহ্বান।
তিন
নৌকা থেকে নেমে যখন মেঘলা কাঁচা পথ ধরে হেঁটে শিলাইদহের কুঠিবাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল, তখন গোধূলির আলো চারদিক ভরে দিয়েছে। প্রথম দেখাতেই তার বুকের ভেতর কেঁপে উঠল—এ যেন কেবল একটি পুরোনো স্থাপনা নয়, বরং এক অদৃশ্য কাব্যের দ্বার। সাদা রঙের দোতলা কুঠিবাড়ি দূর থেকে একেবারেই সাধারণ মনে হলেও কাছে যেতেই দেখা গেল তার প্রতিটি দেওয়ালে লেগে আছে সময়ের ছাপ, ইতিহাসের নিঃশ্বাস। মেঘলার মনে হলো, সে যেন হঠাৎ করেই কোনো স্বপ্নের ভিতরে ঢুকে পড়েছে। এই ঘর, এই বারান্দা, এই জানালা—সবই তার কাছে জীবন্ত হয়ে উঠল, যেন প্রত্যেক ইট, প্রত্যেক কাঠের খুঁটি নিঃশব্দে বলছে রবীন্দ্রনাথের দিনযাপনের গল্প। পদ্মার দিক থেকে আসা হাওয়ায় বারান্দার জানালার কাঁচ খানিকটা কেঁপে উঠল, আর সেই শব্দ মেঘলার কানে পৌঁছাল ফিসফিসের মতো—যেন কবির সৃষ্টির সুর। তার মনে পড়ল, রবীন্দ্রনাথ এখানে বসেই লিখেছিলেন অসংখ্য কবিতা, গান, গল্প; এই কুঠিবাড়িই তার নিভৃত সাধনার জায়গা ছিল। মেঘলার মনে হল, কবির নিঃসঙ্গতা, তার ভেতরের আলো আর অন্ধকার, সবকিছু এই ঘরগুলির দেয়ালে বন্দী হয়ে আছে, আবার একই সাথে আজও নিঃশব্দে বেঁচে আছে।
মেঘলা বারান্দায় পা রাখতেই তার বুকের ভেতর আরও জোরে ধুকপুক করতে লাগল। ভেতরে প্রবেশ করার আগে সে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখল—গাছপালার ছায়া, পাখির ডাক, দূরে পদ্মার স্রোত, আর মাঝেমাঝে গ্রামবাংলার শব্দ—সব মিলিয়ে যেন কুঠিবাড়ির চারপাশে এক অলৌকিক আবহ তৈরি করেছে। ভেতরে ঢুকে সে দেখতে পেল প্রশস্ত ঘর, কাঠের আসবাবপত্র, এবং জানালার ধারে রাখা চেয়ার যেখানে বসে কবি হয়তো নীরবতা ভেঙেছিলেন সুরে। তার মনে হলো, এই আসবাবপত্র কেবল জড় বস্তু নয়, তারা যেন সাক্ষী—কবির একান্ত মুহূর্তগুলির, তার চিন্তার, তার নিঃশ্বাসের। প্রতিটি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে মেঘলার শরীর শিহরে উঠছিল, কারণ সে অনুভব করছিল ফিসফিসানি—যেন কেউ বলছে, “শোনো, এ ঘরে লেখা হয়েছিল সেই গান, ও ঘরে জন্মেছিল কোনো গল্প।” মেঘলার মনে পড়ল রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত কথা—“আমার জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট গানগুলি পদ্মার বুকে জন্ম নিয়েছে।” আজ বুঝতে পারল, কুঠিবাড়ি কেবল চার দেয়াল নয়, বরং এক জীবন্ত ইতিহাস, এক ধ্বনিত স্মৃতি। সে জানল, কবির ছায়া আজও ভেসে বেড়ায় এখানে, তার সৃষ্টির প্রতিধ্বনি আজও শোনা যায় দেয়ালের আড়ালে।
মেঘলা যখন সিঁড়ি বেয়ে উপরের তলায় উঠল, তখন আকাশের রঙ বদলাতে শুরু করেছে। জানালার ফাঁক দিয়ে সন্ধ্যার আলো ঢুকে ঘরটিকে করে তুলল স্বপ্নময়। সে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকাল—দূরে বিস্তীর্ণ পদ্মা, অবারিত আকাশ, আর সেই আকাশের নিচে নিস্তব্ধ কুঠিবাড়ি। তার মনে হলো, এই দৃশ্য কেবল দৃশ্য নয়, বরং এক চিরন্তন কাব্য। সে চোখ বন্ধ করে অনুভব করল, রবীন্দ্রনাথ হয়তো এই জানালাতেই দাঁড়িয়ে নিজের ভেতরের অস্থিরতাকে রূপ দিয়েছিলেন কবিতায়, গান দিয়ে ভরিয়ে তুলেছিলেন নীরবতাকে। মেঘলার কাছে এই অভিজ্ঞতা হয়ে উঠল যেন এক আত্মিক যাত্রা—সে অনুভব করল, তার ভেতরেও হয়তো লুকিয়ে আছে কিছু কথা, কিছু স্বপ্ন, যা কলমের মাধ্যমে বেরিয়ে আসতে চায়। কুঠিবাড়ির প্রতিটি ফিসফিসানি তাকে সাহস দিচ্ছিল, বলছিল—“তোরও লেখার অধিকার আছে, তোরও কণ্ঠ আছে।” সেই মুহূর্তে মেঘলার মনে হলো, সে যেন একা নয়; কুঠিবাড়ির প্রতিটি ইট, প্রতিটি জানালা তাকে সঙ্গ দিচ্ছে। এ যেন শুধু ইতিহাসের স্মৃতি নয়, বরং আজও জীবন্ত এক সত্তা, যে নতুন প্রজন্মকে ডেকে বলে—“তোমরা এসো, শুনো, আর নিজের গান খুঁজে নাও।”
চার
মেঘলা কুঠিবাড়ির আঙিনায় যখন দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকাচ্ছিল, তখন এক বৃদ্ধ ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে এলেন। তার মুখে ছিল অগাধ প্রশান্তি, চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি, আর কণ্ঠে এমন উষ্ণতা যা মেঘলার মনে গভীর বিশ্বাস জাগাল। এই মানুষটিই গ্রামের লোকদের কাছে “দাদামশায়”—কেবল একজন গাইড নন, বরং এক জীবন্ত ইতিহাসের ধারক। তার গায়ের হালকা ধুতি, কাঁধে ঝুলানো সাদা গামছা, আর মুখ ভরা স্নেহময় হাসি মেঘলার মনে করিয়ে দিল গ্রামীণ সরলতার শক্তি। দাদামশায় বিনীতভাবে বললেন, “এসো মা, আমি তোমাকে সব দেখাবো।” সেই আহ্বানে মেঘলা অনুভব করল যেন কুঠিবাড়ির ভেতর দিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য শুধু একজন মানুষ নয়, বরং এক অদৃশ্য আত্মার সঙ্গী এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি হাঁটতে হাঁটতে কুঠিবাড়ির প্রাচীন বারান্দা, লম্বা করিডর, কাঠের দরজা আর জানালা স্পর্শ করতে করতে বলছিলেন, “এখানে বসে কবি লিখেছেন অগণিত গান। এই ঘরেই তিনি চিঠি লিখেছেন বিদেশের বন্ধুদের কাছে, আর এখানেই বসে তিনি গ্রামের মানুষদের সাথে আড্ডা দিয়েছেন।” মেঘলার মনে হচ্ছিল, প্রতিটি বাক্যে তিনি যেন কেবল তথ্য দিচ্ছেন না, বরং সেই মুহূর্তগুলোকে নতুন করে বাঁচিয়ে তুলছেন।
দাদামশায়ের কণ্ঠে এক ধরনের মায়া ছিল, যেন তিনি নিজেই সেই সময়ের মানুষ, যিনি কাছ থেকে দেখেছেন রবীন্দ্রনাথকে। তিনি মেঘলাকে নিয়ে গেলেন কবির শোবার ঘরে, জানালার পাশে রাখা কাঠের চেয়ার দেখিয়ে বললেন, “এই চেয়ারে বসে তিনি অনেক সময় পদ্মার দিকে তাকিয়ে থাকতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কোনো কথা নয়, শুধু নীরব দৃষ্টি। তারপর হঠাৎই তিনি কলম ধরতেন, কাগজে ভরে তুলতেন এমন সব লাইন যা পরে আমরা গাইতে শুরু করি গান হয়ে।” মেঘলা বিস্ময়ে চেয়ারে হাত রাখল, আর মনে হলো যেন সেই কাঠের ভেতরেও জমে আছে কবির নিঃশ্বাসের উষ্ণতা। দাদামশায় আবার বললেন, “কখনও রাতে ঘরের ভেতর থেকে আলোর রেখা বের হতো, সকলে বুঝত কবি জেগে আছেন। লিখছেন, সুর করছেন। সকালে দেখা যেত, একটা নতুন কবিতা লেখা হয়েছে—যা পরদিনই গ্রামের লোকদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে।” তার কণ্ঠে এমন আবেগ ছিল যে মেঘলার মনে হচ্ছিল, সে যেন স্বচক্ষে দেখছে সেই দৃশ্য: জানালার ভেতর আলো জ্বলছে, কবি নিঃশব্দে লিখে চলেছেন, আর পদ্মার বাতাস জানালায় এসে ঠেকছে সঙ্গী হয়ে। দাদামশায় তার গল্পে এমনভাবে পরিবেশন করছিলেন, যেন তিনি নিজেই ছিলেন সেই নীরব দর্শক, যিনি আজও স্মৃতির ভাঁজে বাঁচিয়ে রেখেছেন প্রতিটি মুহূর্ত।
মেঘলা অনুভব করল, দাদামশায় আসলে কেবল একজন গাইড নন—তিনি কুঠিবাড়ির আত্মা, যিনি নতুন প্রজন্মকে ইতিহাসের সাথে সংযোগ করান। তিনি মেঘলাকে দেখালেন কবির পাণ্ডুলিপি, পুরোনো বইয়ের তাক, এমনকি সেই উঠোন যেখানে রবীন্দ্রনাথ গ্রামের মানুষের সাথে বসে সমস্যার কথা শুনতেন। তিনি বললেন, “কবি কেবল নিজের জন্য লিখতেন না, তিনি গ্রামবাংলার জন্য লিখতেন। এই কুঠিবাড়ি তার কাছে ছিল সাধনার জায়গা, আবার মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধের জায়গাও।” মেঘলার চোখে জল এসে গেল—কারণ তার মনে হলো, রবীন্দ্রনাথকে শুধু সাহিত্যিক হিসেবে নয়, একজন মানবিক আত্মা হিসেবে দেখতে পারছে দাদামশায়ের চোখ দিয়ে। পদ্মার বাতাসে দাদামশায়ের কণ্ঠ ভেসে যাচ্ছিল, আর মেঘলার মনে হচ্ছিল, ইতিহাসের দেয়ালগুলো সত্যিই কথা বলছে। কুঠিবাড়ির প্রতিটি কোণ ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে সে বুঝল, এ অভিজ্ঞতা কেবল দর্শন নয়, বরং আত্মিক এক উপলব্ধি। দাদামশায়ের প্রতিটি শব্দ যেন তার হৃদয়ে বীজ বপন করছিল, যা একদিন হয়তো অঙ্কুরিত হয়ে তাকে নিজের সৃজনশীল পথে নিয়ে যাবে। সেই মুহূর্তে মেঘলা অনুভব করল, কুঠিবাড়ি আর দাদামশায়ের গল্প তাকে এক নতুন আলোয় ভরিয়ে দিয়েছে—যা শুধু স্মৃতির নয়, ভবিষ্যতেরও দিশা দেখায়।
পাঁচ
সন্ধ্যার আলোয় কুঠিবাড়ির বারান্দায় বসে মেঘলা যখন পদ্মার দিকে তাকাচ্ছিল, তখন হঠাৎই তার মনে হলো, সময় যেন থমকে গেছে। চারপাশে কেবল ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, হালকা বাতাস, আর দূরের জেলেদের গান—সবকিছু এক অদ্ভুত আবেশে ডুবে গেল। সেই মুহূর্তে মেঘলার মনে হল, তার সামনে বসে আছেন এক ছায়ামূর্তি—শান্ত, গভীর দৃষ্টিতে পদ্মার দিকে তাকিয়ে। রবীন্দ্রনাথের প্রতিচ্ছবি যেন নিঃশব্দে এসে বসেছে তার পাশে। মেঘলা ভয় পেল না, বরং মনে হলো এই উপস্থিতিই ছিল তার অপেক্ষার উত্তর। কবির মুখে যেন এক প্রশান্ত হাসি, চোখে এক অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা, আর সেই নিঃসঙ্গতার ভেতরে লুকানো ছিল এক বিশাল মহাবিশ্বের স্বপ্ন। মেঘলা কল্পনায় শুনতে পেল, তিনি যেন ধীরে ধীরে বলছেন, “মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় সঙ্গী হল প্রকৃতি। পদ্মার এই স্রোতই আমার কাছে ছিল আলাপের সাথী, আমার নীরব শ্রোতা।” মেঘলার বুক কেঁপে উঠল—এ কি সত্যিই তার কল্পনা, না কি কোনো অদৃশ্য জগতের সংযোগ? তার মনে হলো, কবির প্রতিটি শব্দ তার ভেতরে এক নতুন শক্তি ঢেলে দিচ্ছে।
মেঘলার চোখের সামনে দৃশ্যপট বদলে যেতে লাগল। সে দেখল রবীন্দ্রনাথ নিঃসঙ্গ রাতে জানালার পাশে বসে আছেন, হাতে কলম, সামনে সাদা কাগজ। পদ্মার ঢেউ জানালায় এসে বাজছে এক অনন্ত তান, আর সেই তানের সুরে কবির হাত কাগজের ওপর ছুটছে। কখনও তিনি মাথা তুলে দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন, কখনও দূরের আকাশের তারা দেখছেন, আবার কখনও হালকা হাসি ফুটছে তাঁর ঠোঁটে। মেঘলা অনুভব করল, এই নিঃসঙ্গতাই কবির সৃজনশীলতার উৎস—যা তাকে সমুদ্রের মতো গভীর আর আকাশের মতো বিস্তৃত করেছে। তার মনে হলো, কবি কেবল একজন লেখক নন, বরং প্রকৃতিরই এক দার্শনিক, যিনি প্রতিটি গাছ, প্রতিটি নদী, প্রতিটি বাতাসের কণায় কথা খুঁজে পেতেন। মেঘলার চোখ ভিজে উঠল—কারণ সে বুঝতে পারল, সাহিত্য কেবল কাগজের অক্ষরে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা হয়ে ওঠে জীবনের সঙ্গী, নিঃসঙ্গতার প্রতিধ্বনি, আর অনন্ত প্রশ্নের উত্তর খোঁজার পথ। সেই মুহূর্তে সে নিজের হাতের ভেতরও কল্পনায় কলম অনুভব করল, যেন তার ভেতরের কবিতাগুলো বেরিয়ে আসার জন্য অস্থির হয়ে আছে।
এই ছায়ার সংস্পর্শ মেঘলার ভেতরে এক বিশাল রূপান্তর ঘটাল। এতদিন পর্যন্ত সে কবিতা লিখতে চেয়েছিল, কিন্তু তার মনে ছিল দ্বিধা—সে কি পারবে? তার কণ্ঠস্বর কি কখনও পৌঁছাবে মানুষের হৃদয়ে? কিন্তু রবীন্দ্রনাথের প্রতিচ্ছবি তাকে যেন নিঃশব্দে আশীর্বাদ করল। কবির ছায়া বলল না কিছু, কিন্তু তার চোখের গভীরতা মেঘলাকে বোঝাল—লেখা মানে জয় বা পরাজয় নয়, লেখা মানে নিজের ভেতরের সত্যকে প্রকাশ করা। পদ্মার ঢেউয়ের শব্দ, আকাশের তারার ঝিলিক, আর কুঠিবাড়ির নীরবতা মিলে এক অদৃশ্য কণ্ঠে বলল, “তুমি লিখে যাও, বাকিটা সময়ের হাতে ছেড়ে দাও।” মেঘলার মনে হলো, সে যেন নিজের ভেতরে নতুন জন্ম নিল। এই মুহূর্ত থেকে সাহিত্য আর তার কাছে কেবল একটি স্বপ্ন নয়, বরং এক দায়িত্ব, এক পথ, যা তাকে নিজের সত্য ও সৌন্দর্যের দিকে নিয়ে যাবে। রবীন্দ্রনাথের ছায়া ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল, কিন্তু তার অন্তরে জ্বলে উঠল এক অনন্ত প্রদীপ, যা আর কখনও নিভবে না।
ছয়
দুপুরের আলো আস্তে আস্তে নরম হয়ে এলো, পদ্মার ধারে বসে থাকা মেঘলা শুনতে পেল শিশুদের হাসির শব্দ। সে ঘুরে দেখল, একদল গ্রামীণ বাচ্চা নদীর বালুচরে খেলছে—কারও হাতে কাঁচা বাঁশের তৈরি লাটাই, কেউ আবার নদীর জল ছিটিয়ে দিচ্ছে বন্ধুদের দিকে। তাদের সরল হাসি, খালি পায়ে দৌড়োনো, আর নিঃশব্দ আনন্দ মেঘলার মনে এমন প্রশান্তি এনে দিল, যা শহরে বসে সে কখনও খুঁজে পায়নি। মেঘলা যখন কাছে গেল, তখন বাচ্চারা প্রথমে একটু কৌতূহলী চোখে তাকাল, তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে তাকে ঘিরে ধরল। তাদের চোখে প্রশ্ন—এই শহুরে মেয়ে কে, কেন সে এখানে এসেছে? এক ছোট্ট মেয়ে, বয়স হবে হয়তো সাত, মেঘলার শাড়ির আঁচল টেনে বলল, “আপু, তুমি কি কবির বাড়ি দেখতে এসেছো?” প্রশ্ন শুনে মেঘলার বুক ভরে উঠল—কারণ এই বাচ্চাদের মুখেই এখনো রবীন্দ্রনাথ “কবি” হয়ে বেঁচে আছেন।
শিশুরা তাকে বসতে বলল নদীর বালুচরে, আর নিজেদের কণ্ঠে গান শোনাতে শুরু করল। কেউ রবীন্দ্রসঙ্গীতের টুকরো টুকরো লাইন গাইল, কেউ আবার নিজেদের মতো করে লোকগান গেয়ে উঠল। সেই সুরের ভেতরে কোনো কৃত্রিমতা ছিল না—ছিল শুধু জীবনের সরল আনন্দ আর হৃদয়ের খোলা আবেগ। মেঘলা অবাক হয়ে দেখল, এই বাচ্চারা হয়তো স্কুলে যায় না নিয়মিত, কিন্তু গান গাওয়ার সময় তাদের কণ্ঠে যে নিস্তব্ধ সৌন্দর্য ফুটে ওঠে, তা কোনো বড় মঞ্চের শিল্পীর কণ্ঠেও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। গান শেষ হলে তারা কৌতূহলী হয়ে মেঘলাকে প্রশ্ন করতে লাগল—“আপু, তুমি কি গান গাও?” “তুমি কি কবিতা লিখো?” “কবির মতো বই ছাপাবে?”—এই নিষ্পাপ প্রশ্নগুলো শুনে মেঘলা হেসে উঠল, তবে তার চোখে ভিজে উঠল স্বপ্ন আর দ্বিধার জল। সে ভাবল, তার নিজের ভেতরের যে কবিতা এতদিন লুকিয়ে ছিল, তা হয়তো একদিন এই শিশুদের মতো সরল মনের কাছে পৌঁছাতে পারবে। পদ্মার বাতাসে ভেসে আসা তাদের গানের সুর মেঘলার মনে রবীন্দ্রনাথের সেই চিরন্তন স্বপ্নের কথা মনে করাল—গ্রামবাংলাকে গড়ে তোলা, যেখানে প্রতিটি মানুষ শিক্ষা, গান আর সৃজনশীলতার আলোয় জেগে উঠবে।
মেঘলা হঠাৎ উপলব্ধি করল, এই শিশুদের হাসি-গান আসলে এক ধরনের উত্তরাধিকার—যা রবীন্দ্রনাথ রেখে গেছেন। তিনি শুধু সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, তিনি ভেবেছিলেন এই গ্রামগুলির উন্নয়ন নিয়ে, শিক্ষা নিয়ে, স্বনির্ভরতা নিয়ে। এই সরল বাচ্চাদের মুখে যখন গান ধ্বনিত হয়, তখন মনে হয় কবির স্বপ্ন এখনো মাটির গন্ধে বেঁচে আছে। মেঘলার মনে হলো, গ্রামবাংলা আসলে তার নিজের সাহিত্য স্বপ্নেরও ভিত্তি হতে পারে। শহরের আড়ম্বরের ভেতর যে স্বপ্ন সে হারিয়ে ফেলছিল, তা এখানে এসে আবার নতুনভাবে ধরা দিল। পদ্মার ধারে দাঁড়িয়ে মেঘলা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল—সে শুধু কবিতা লিখবে না, তার লেখায় থাকবে মানুষের কথা, গ্রামীণ জীবনের স্বপ্ন, আর রবীন্দ্রনাথের মতোই আলো ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা। নদীর ঢেউ তখনো বালুচরে এসে আছড়ে পড়ছিল, শিশুদের হাসি আকাশে ভেসে যাচ্ছিল, আর মেঘলার মনে হচ্ছিল—এই মুহূর্তটাই তার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা।
সাত
সন্ধ্যার নরম আলোয় কুঠিবাড়ির ঘরে বসে মেঘলা হঠাৎ ব্যাগ থেকে বের করল একটি পুরোনো খাম। সারা দিন পদ্মার স্রোত, দাদামশায়ের গল্প আর শিশুদের গান শুনে তার মনে যে আলোড়ন উঠেছিল, তা যেন আরও গভীর হয়ে উঠল এই খাম হাতে নিয়েই। খাম খুলে বের হলো তার মায়ের চিঠি—অতীব পরিচিত হাতের লেখা, তবু প্রতিটি অক্ষরে যেন ছিল নতুন এক আবেগের ছোঁয়া। মেঘলা পড়তে শুরু করল: “মেঘ, তুমি সেখানে ভালো আছ তো? জানি তুমি কবির বাড়ি দেখতে গেছো, ছোটবেলা থেকে তোমার সেই স্বপ্ন ছিল। আমি শুধু চাই তুমি সুখে থেকো, নিরাপদ থেকো। তবে একটা কথা বারবার মনে হয়—জীবনটা কেবল কবিতায় ভরে রাখা যায় না। সংসার, দায়িত্ব, বাস্তবতা—সবই তো আছে।” মায়ের শব্দগুলো যেন কাগজের অক্ষরে সীমাবদ্ধ থাকল না, বরং মেঘলার কানে মায়ের কণ্ঠ হয়ে বাজতে লাগল। সেই কণ্ঠে ছিল ভালোবাসার সুর, আবার এক অদৃশ্য উদ্বেগও, যা মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে এক মায়ের অস্থিরতার প্রতিচ্ছবি।
চিঠির পরের অংশে মায়ের মমতামিশ্রিত উপদেশ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। তিনি লিখেছেন, “তুমি ছোট থেকে কবিতা লিখতে ভালোবাসো, জানি। তোমার খাতার পাতায় কত শব্দ জমা হয়, কত স্বপ্ন আঁকো। কিন্তু তুমি কি ভেবেছো, কেবল লেখালিখি করে জীবন কাটানো যায় কি না? সমাজ, আত্মীয়স্বজন—সবারই প্রত্যাশা থাকে। আমি চাই না তুমি কোনো কষ্টে পড়ো। হয়তো শিক্ষকতা, বা অন্য কোনো স্থায়ী কাজ করবে, পাশাপাশি কবিতা লিখতে পারবে। এভাবে চলাই কি ভালো নয়?” মেঘলার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। মায়ের এই যুক্তি সে বহুবার শুনেছে, কিন্তু এবার কুঠিবাড়ির প্রাচীন পরিবেশে বসে সেই কথাগুলো যেন আরও ভারি হয়ে উঠল। তার মনে হলো, রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষও কি এমন দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হননি? তিনি কি সবকিছু ছেড়ে কেবল কবিতার পথ বেছে নিয়েছিলেন, না কি সমাজ ও পরিবারের প্রতীক্ষার ভারও বহন করেছিলেন? চিঠির প্রতিটি লাইন মেঘলার মনে প্রশ্নের ঢেউ তুলতে লাগল। সে জানালার বাইরে তাকাল—পদ্মার ধীর স্রোত তাকে মনে করিয়ে দিল, জীবনও বয়ে চলে, কিন্তু কোন গতিপথে বয়ে যাবে, তা ঠিক করা কি এত সহজ?
মেঘলা চিঠিটা বুকে চেপে ধরে দীর্ঘক্ষণ বসে রইল। তার ভেতরে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব জেগে উঠল—একদিকে রবীন্দ্রনাথের ছায়া, কুঠিবাড়ির নিস্তব্ধতা, পদ্মার গান, গ্রামের শিশুদের হাসি—সব তাকে ডাকছে সাহিত্যের পথে। অন্যদিকে মায়ের উদ্বেগভরা কণ্ঠ, সংসারের বাস্তবতার চাপ, সমাজের প্রত্যাশা তাকে টেনে নিচ্ছে প্রচলিত জীবনের পথে। সে বুঝতে পারছিল না, কোনটিকে বেছে নেবে। যদি সে সাহিত্যের পথে হাঁটে, তবে হয়তো অনেক সংগ্রাম, অনেক অজানা ভয় অপেক্ষা করছে। আর যদি সে স্থায়ী, নিরাপদ পথ নেয়, তবে হয়তো তার মনের ভেতরের কবিতা একদিন নিভে যাবে। এই দ্বিধা তার বুকের ভেতর ভারি হয়ে জমতে লাগল। তবু গভীরে কোথাও মেঘলা অনুভব করল—চিঠির প্রতিটি লাইনের আড়ালে তার মা যে ভালোবাসা আর আশীর্বাদ পাঠিয়েছেন, সেটাই তার সবচেয়ে বড় শক্তি। হয়তো মায়ের ভয় মেঘলাকে থামাতে নয়, বরং সতর্ক করে পথ দেখাতে। সেই রাতে মেঘলা ঘুমোতে পারল না, জানালার বাইরে পদ্মার স্রোত দেখল, আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল—সে যেই পথই বেছে নিক না কেন, মায়ের কণ্ঠ আর রবীন্দ্রনাথের ছায়া সবসময় তার সঙ্গী হয়ে থাকবে।
আট
রাতের আকাশে তারারা ঝিকমিক করছে, পদ্মার হাওয়া এসে কুঠিবাড়ির বারান্দায় মৃদু সুর তুলছে। মেঘলা একা বসে আছে, সামনে খোলা ডায়েরি আর হাতে কলম। সেই ডায়েরি তার কাছে যেন কেবল কাগজের খাতা নয়—বরং এক জীবন্ত সঙ্গী, যে তার অন্তরের কথা শোনে, যে তার স্বপ্নগুলো ধরে রাখে। দিনের বেলা দাদামশায়ের গল্প, গ্রামের শিশুদের গান আর মায়ের চিঠির আবেগ তার ভেতরে এক ঝড় তুলেছিল; এখন সেই ঝড় শান্ত হয়ে কাগজের পাতায় রূপ নিতে চাইছে। মেঘলার হাত প্রথমে কাঁপছিল—সে কি পারবে লিখতে? শব্দগুলো কি তাকে মান্য করবে? কিন্তু চারপাশের নীরবতা, দূরে বাজতে থাকা জেলেদের গানের ভাঙা সুর, আর বারান্দার মৃদু আলো তাকে সাহস দিল। কলম যেন ধীরে ধীরে তার হাত ছেড়ে নিজেই লিখতে শুরু করল। মেঘলা অনুভব করল, তার ডায়েরি তাকে ফিসফিস করে বলছে—“লিখে যাও, ভয় পেয়ো না, তোমার স্বপ্নের ঠিকানা এখানেই।”
পাতার পর পাতা ভরে উঠতে লাগল অদ্ভুত এক স্রোতে। মেঘলা লিখতে লাগল পদ্মার কথা—কীভাবে নদী তাকে ডাকছে, কীভাবে স্রোতের ভেতর সে খুঁজে পেয়েছে কবির ছায়া। লিখতে লিখতে সে যেন আর কেবল মেঘলা রইল না, বরং রবীন্দ্রনাথের সেই অদৃশ্য উত্তরসূরি হয়ে উঠল, যে নিজের কণ্ঠে নতুন সুর খুঁজছে। প্রতিটি শব্দে ফুটে উঠছিল তার দ্বিধা, আবার তার আশাও। সে লিখল—“আমি জানি না কোন পথে যাব, কিন্তু লিখতে লিখতেই আমার ভেতরের আলো জেগে ওঠে।” তার ডায়েরি যেন সেই কথাগুলোকে বুকে নিয়ে জীবন্ত হয়ে উঠল। মেঘলার মনে হলো, কলমের নিব থেকে যে অক্ষর জন্ম নিচ্ছে, তা আসলে তার আত্মার প্রতিধ্বনি। কখনও সে থেমে গেল, বাইরে তাকাল—পদ্মার ঢেউয়ের প্রতিটি গর্জন যেন নতুন ছন্দ দিল তার কবিতাকে। তার মনে হলো, প্রকৃতি নিজেই তার কবিতার সহলেখক। কুঠিবাড়ির পুরোনো দেয়ালে রবীন্দ্রনাথের গানের সুর প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, আর সেই প্রতিধ্বনি তার শব্দকে আরও প্রাণবন্ত করছে।
একসময়ে মেঘলা কলম নামিয়ে রেখে ডায়েরির পাতার দিকে তাকাল। সেখানে লেখা আছে তার মনের অন্দরমহলের কথা—যা সে আগে কাউকে বলেনি। ডায়েরি যেন ফিসফিস করে তাকে বলল, “তুমি ভয় পেয়ো না, তোমার শব্দই তোমার পথ।” মেঘলার চোখে জল এসে গেল, কারণ সে উপলব্ধি করল—এটাই তার সত্যিকারের যাত্রা। মায়ের চিঠির উদ্বেগ, সমাজের প্রত্যাশা, ভবিষ্যতের অজানা পথ—সবই আছে, কিন্তু কবিতার ভেতর দিয়ে সে যেন এক মুক্তির দরজা খুঁজে পেয়েছে। ডায়েরি তাকে শিখিয়ে দিল, স্বপ্নকে কাগজে লেখা মানে তাকে বাস্তবে আনার প্রথম পদক্ষেপ। কুঠিবাড়ির বারান্দায় সেই রাতের নির্জনতায় মেঘলা বুঝল, সে হয়তো রবীন্দ্রনাথের মতো বিশাল কিছু হয়ে উঠবে না, কিন্তু তার নিজের সত্যিকারের সত্তা এই ডায়েরির পাতায় চিরকাল বেঁচে থাকবে। সেই মুহূর্তে পাঠকও যেন প্রত্যক্ষ করে, কীভাবে এক তরুণীর অন্তর্দ্বন্দ্ব, স্বপ্ন আর সাহস মিলেমিশে কবিতায় পরিণত হয়। পদ্মার বাতাস তার খাতার পাতায় দোলা দিল, আর মেঘলা অনুভব করল—তার কবিতার খাতা আর কেবল কাগজ নয়, এটি তার আত্মার প্রতিচ্ছবি।
নয়
নদীর ধারে সন্ধ্যা অনেক আগেই গাঢ় অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। কুঠিবাড়ির চারপাশে যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে, শুধু দূরে পদ্মার স্রোতের শব্দ আর রাতজাগা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। মেঘলা জানালার পাশে বসে আছে, চোখ স্থির নদীর দিকে। অন্ধকার জলে চাঁদের আলো ভেসে এসে যেন কাচের মতো ঝিকমিক করছে, আর সে এক অদ্ভুত টান অনুভব করছে। দিনের ব্যস্ততা, মানুষজনের কোলাহল, এমনকি নিজের ভেতরের ভয়ও যেন এই রাতের মধ্যে গলে গেছে। এই নিস্তব্ধতায় সে নিজের হৃদস্পন্দনও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। হঠাৎ মনে হলো, এই জানালা, এই পদ্মা আর এই রাত—সবই যেন তাকে এক অদৃশ্য প্রশ্ন করছে: “তুই কে? কোন পথে চলবি?” মেঘলার বুক ধড়ফড় করতে লাগল, কিন্তু একইসাথে সে অনুভব করল—নিজেকে জানার এটাই আসল সময়।
এই নিস্তব্ধ মুহূর্তেই মেঘলার কল্পনায় যেন রবীন্দ্রনাথ এসে দাঁড়ালেন। না, তিনি শারীরিকভাবে নেই, কিন্তু বাতাসে, পদ্মার ঢেউয়ে, এমনকি কুঠিবাড়ির পুরোনো দেয়ালে তার উপস্থিতি স্পষ্ট। মেঘলা শুনতে পেল, এক কোমল অথচ দৃঢ় কণ্ঠস্বর তার কানে ভেসে আসছে—“তোর পথ তোরই হাতে।” এই বাক্যটি যেন বজ্রপাতের মতো তার মনে আঘাত করল। সে এতদিন ধরে দ্বিধায় ভুগছিল—মায়ের প্রত্যাশা, সমাজের বাঁধন, নাকি নিজের অন্তরের ডাক? কিন্তু এই কথাটি যেন তাকে বুঝিয়ে দিল, সব উত্তর বাইরের কোথাও নেই, উত্তর লুকিয়ে আছে তার নিজের ভেতরে। পদ্মার জলে চাঁদের আলো যেমন নিজস্ব সৌন্দর্যে ঝলমল করে, তেমনি একজন মানুষের পথও তাকে নিজেকেই খুঁজে নিতে হয়। মেঘলার চোখে অশ্রু ভেসে উঠল, কারণ সে অনুভব করল—তার ভেতরে যে কবিতার আলো জ্বলে উঠেছে, সেটাই তার আসল পরিচয়।
সে রাতটা তাই আর নিছক অন্ধকারে কাটল না, বরং হয়ে উঠল আত্মকথনের রাত। মেঘলা প্রথমবার নিজের সঙ্গে সত্যিকারভাবে কথা বলল। সে ভাবল, “আমি যদি সাহিত্যের পথে যাই, তবে হয়তো সমাজ আমাকে বোঝাবে না, মা কষ্ট পাবেন। কিন্তু যদি না যাই, তবে আমার ভেতরের আলো নিভে যাবে।” জানালার বাইরে তাকিয়ে সে দেখল, নদীর স্রোত থেমে নেই, অবিরাম ছুটে চলেছে—কোনো বাঁধা তাকে আটকাতে পারেনি। পদ্মার এই অনন্তগতি যেন তাকে সাহস দিল। মেঘলা বুঝল, জীবনও আসলে নদীর মতো—যে পথে চলার ডাক আসে, সেদিকেই বয়ে যেতে হয়। কুঠিবাড়ির নিস্তব্ধতা, রাতের আবহ, আর রবীন্দ্রনাথের অদৃশ্য কণ্ঠ মিলে তাকে এক নতুন উপলব্ধি দিল। সে স্থির করল, আগামী দিনের পথ কেবল সে-ই নির্ধারণ করবে, অন্য কেউ নয়। এই আত্ম-উপলব্ধির ভেতর দিয়েই মেঘলা যেন এক নতুন মানুষ হয়ে উঠল—আরো দৃঢ়, আরো আলোকিত, আর নিজের ভেতরের কবিতার স্রোতে ভেসে যেতে প্রস্তুত।
দশ
ভোরের প্রথম আলো যখন পদ্মার জলে এসে পড়ল, মেঘলা তখনও জানালার পাশে বসে ছিল। রাতভর আত্মসংলাপের পরে তার চোখ লালচে হয়ে উঠলেও, ভেতরে এক অদ্ভুত প্রশান্তি নেমে এসেছে। পদ্মার বিস্তৃত বুকে সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়তেই নদী যেন নতুন সুরে বাজতে শুরু করল। সেই স্রোতের সঙ্গে মিশে উঠল গত ক’দিনের সমস্ত অভিজ্ঞতার প্রতিধ্বনি—দাদামশায়ের উষ্ণ কণ্ঠে শোনা রবীন্দ্রনাথের গল্প, কুঠিবাড়ির নিস্তব্ধ দেয়ালে লুকানো অগণিত স্মৃতি, মায়ের চিঠির মায়াময় স্পর্শ, আর গ্রামবাংলার সেই শিশুদল যারা গান গেয়ে তাকে হাসিয়েছিল। প্রতিটি মুহূর্ত যেন তাকে একত্রে ঘিরে ধরল, যেন তারা সকলে মিলে মেঘলাকে বলছে—“তুই নিজের আলো খুঁজে পেয়েছিস।” মেঘলা অনুভব করল, শিলাইদহে আসা শুধুমাত্র একটি ভ্রমণ নয়, বরং তার আত্মার এক নতুন জন্ম। পদ্মার ভোর তাকে জানিয়ে দিল, জীবনেও প্রতিটি সকালই এক নতুন পথের সূচনা।
কুঠিবাড়ির ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে মেঘলার মনে হলো, এই বাড়িটি আর শুধু ইট-পাথরের তৈরি স্থাপত্য নয়। এটি যেন তার অন্তরের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। প্রতিটি জানালা দিয়ে আসা হাওয়ায় সে কবির নিঃশ্বাস টের পাচ্ছে, প্রতিটি দেয়াল যেন তার কলমের আঁচড়ে রঙিন হয়ে উঠছে। হঠাৎ তার মনে হলো, এই বাড়িটি তাকে আর বাঁধছে না, বরং মুক্ত করছে। রবীন্দ্রনাথ যেমন পদ্মার ধারে বসে গান লিখেছিলেন, তেমনি তারও কলম চলতে শুরু করেছে—ডায়েরির পাতায় নয়, বরং হৃদয়ের গভীরে। মায়ের চিঠি তার ভেতরে একসময় দ্বিধা তৈরি করেছিল, কিন্তু এখন সেই চিঠির প্রতিটি অক্ষর যেন নতুন অর্থ নিয়ে ফুটে উঠল। উদ্বেগের মাঝেই মায়ের ভালোবাসা ছিল, আর সেই ভালোবাসা আজ মেঘলাকে আরও দৃঢ় করেছে। সে বুঝল, সাহিত্যের পথ বেছে নেওয়া মানেই পরিবারকে অস্বীকার করা নয়, বরং তাদের স্বপ্নকে নতুনভাবে বাঁচিয়ে তোলা। গ্রামের শিশুরা তাকে যে নিষ্পাপ গান শোনাল, তা যেন তার হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে বলল—সাহিত্য যদি মানুষের জীবনে আলো না জ্বালাতে পারে, তবে তার আর অর্থই বা কী?
এভাবেই নতুন ভোরে মেঘলা নিজের স্বপ্নকে নতুন রূপে খুঁজে পেল। সে অনুভব করল, সাহিত্য শুধু পড়াশোনার বিষয় নয়, কেবল পরীক্ষার খাতায় বাঁধা অক্ষর নয়—বরং জীবনের দিশা। রবীন্দ্রনাথের মতো সাহিত্যের ভেতরে সে খুঁজে পেল প্রকৃতিকে, খুঁজে পেল মানুষকে, খুঁজে পেল নিজের ভেতরের শক্তিকে। পদ্মার স্রোতের মতোই তার জীবনও এগিয়ে যাবে—কখনো মৃদু, কখনো তীব্র, কিন্তু সবসময়ই গতিময়। শিলাইদহ ভ্রমণ তাকে যে শিক্ষা দিল, তা হলো সাহসী হতে হয় নিজের স্বপ্ন বেছে নিতে। জানালার বাইরে তাকিয়ে সূর্যের প্রথম রশ্মিকে বুকে ভরে নিয়ে মেঘলা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল—সে তার কলমকে আর লুকিয়ে রাখবে না। এই নতুন ভোরের মতোই তার কবিতাগুলো মানুষকে আলো দেবে, সাহস দেবে, আর তাকে নিজেকেও পূর্ণতা দেবে। শিলাইদহ তাকে যে শক্তি দিয়েছে, তা নিয়ে সে আবার জীবনের পথে ফিরবে—কিন্তু এবার আর দ্বিধাগ্রস্ত মেঘলা নয়, বরং দৃঢ়চেতা, আলোকিত, নিজের আলোয় দীপ্ত এক নতুন মেঘলা।
—
				
	

	


