Bangla - ভ্রমণ

শিলংয়ের সেই বসন্ত

Spread the love

আকাশ চৌধুরী


অধ্যায় ১: আগমন

শিলংয়ের আকাশটা যেন পুরনো কাচের জানালার মতো — ভেজা, ঝাপসা, আর চুপচাপ। এয়ারপোর্ট থেকে নামতেই ঋতব্রত দত্ত বুঝেছিল, এই জায়গাটার হাওয়ার মধ্যে কিছুর এক নিঃশব্দ আকর্ষণ আছে। উবার বুক করতে করতে চোখ পড়ল চারপাশের ঘন সবুজে ঢাকা টিলাগুলোর দিকে, দূরে একটা ঝরনার শব্দ যেন হালকা করে ছুঁয়ে গেল স্মৃতিকে। অফিসের বার্ষিক কনফারেন্সে আসা, সে কথা ঠিক। কিন্তু মুম্বইয়ের একঘেয়ে কাচঘেরা অফিসকক্ষ থেকে এই ছ’হাজার ফুট উপরের শহরে এসেই তার ভিতরটা অন্যরকম বেজে উঠল। গাড়ি চলছিল টানা পাহাড়ি রাস্তায়, উঁচু-নিচু ধাপ পেরিয়ে। জানালার কাঁচ নামিয়ে ঋতব্রত এক ফোঁটা ঠান্ডা বৃষ্টির জলে নিজের আঙুল ভিজিয়ে ফেলল। হঠাৎ মনে হল, এই হাওয়া কোথাও যেন চেনা। কলেজ জীবনে একটা গানের কথা মনে পড়ে গেল—”এই হাওয়াতে কোথা থেকে আসে, এক চেনা ঘ্রাণ…”। তার ঠিক পাশেই বসে থাকা সহকর্মী অঙ্কিতা মোবাইলে ব্যস্ত, ট্রিপের ছবি ইনস্টাগ্রামে দিচ্ছে, অথচ ঋতব্রতের চোখ আটকে থাকে পাহাড়ি রাস্তার এক মোড়ে — যেখানে অল্প দূরে রঙিন রেইনকোট পরে একটা মেয়ে রাস্তা পার হচ্ছে, চুল ভেজা। কী এক অদ্ভুত আকর্ষণ! কিন্তু ভেতরের যুক্তিবাদী মানুষটা বলে — এ নিছক কাকতাল, স্মৃতিরা শুধু সময় পেলে খোঁচা দেয়। তার মনের গোপন কুঠুরিতে সযত্নে চাপা দেওয়া এক পুরনো নাম, ‘মেঘলা’, যেন এই পাহাড়ি শহরের ধোঁয়াটে আকাশে মিশে গিয়ে আবার ভেসে উঠতে চাইছে।

রিসর্টে পৌঁছাতে সন্ধ্যে পেরিয়ে গেছে। চারদিকে ধোঁয়াশার চাদরে মোড়া বিশাল কাঠের বাংলো, কাঠের বারান্দায় ঝুলছে হলুদ আলোয় ভরা ঝাড়বাতি। একপাশে পাইন গাছের সারি, আর তার নিচে নেমে গেছে সিঁড়ি — কোথায় যেন যায়, অজানা, গভীরের দিকে। ঋতব্রতের ঘরটা ছিল দ্বিতীয় তলায় — জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই দেখা যায় পাহাড়ের ঢালে আলো-ছায়ার খেলা, আর নিচের ক্যান্টিন থেকে ভেসে আসছে সজল মেঘের গন্ধমাখা চায়ের গন্ধ। স্নান করে সে সোফায় বসতেই হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠল — মুম্বই থেকে মা ফোন করেছেন, শরীর ঠিক আছে কিনা জানতে। ছোট কথায় উত্তর দিয়ে ঋতব্রত ফোন রেখে দেয়, কিন্তু জানে, এই প্রশ্ন আসলে শরীরের জন্য নয় — তার একাকীত্ব নিয়ে, সম্পর্কহীনতা নিয়ে, আর হয়তো সেই অনুচ্চারিত প্রশ্ন, “তুই এখনও মেঘলার কথা ভাবিস?” সে ভাবে না, এটা সে নিজেকে বহুবার বলেছে। কিন্তু ওই জানালার কাচে বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে নামার শব্দ শুনে তার মনে হয়, যদি ঠিক এই মুহূর্তে মেঘলা এই শহরের কোথাও থাকে? যদি হঠাৎ দেখা হয়ে যায়? সেই ১৫ বছর আগে কলেজের নাটকের ড্রেস রিহার্সালে যখন প্রথম তাকে দেখেছিল — সে হাসি, সে চোখের জ্যোতি, সবকিছু এতটাই স্পষ্ট আজও! তাদের প্রেম যেমন আবেগপূর্ণ ছিল, বিচ্ছেদটাও ছিল ততটাই হঠাৎ। একটা চাকরির অফার, একটা অনিশ্চয়তা, কিছু না-বলা কথা — সেই সময় ঋতব্রত সম্পর্কটাকে “পজ” করে দিয়েছিল নিজের ক্যারিয়ারের স্বার্থে। মেঘলা কিছু বলেনি, শুধু একদিন চুপচাপ একটা চিঠি রেখে চলে গিয়েছিল — আজও সেই চিঠিটা এক পুরনো ডায়েরির পাতায় সযত্নে ভাঁজ করে রাখা।

রাতে কনফারেন্সের প্রস্তুতি ছিল। তবুও ডিনারের পর, ঋতব্রত একাই হেঁটে গেল রিসর্টের বাগানে। বাতাসে হালকা চন্দনের গন্ধ, মাটি ভেজা, আর আকাশের কোনা দিয়ে যেন একটুখানি চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। দূরে এক কাফে দেখা গেল — ছোট্ট, কাঠের কাঠামো, বাইরে ঝুলছে হ্যান্ডমেড উইন্ড চাইম। কিছু ট্যুরিস্ট ভেতরে ঢুকছে, কেউ কেউ বাইরে বেঞ্চে বসে গিটার বাজাচ্ছে। কেমন যেন সেই পুরনো দিনের ক্যাম্পাসের মতো লাগছে — যেখানে গিটার, চা, আর হালকা বৃষ্টি মানেই মেঘলা এসে বসত পাশে। কী এক চটকদার যুক্তিতে সে সব ছেড়ে চলে এসেছিল! আজ যদি সুযোগ পেত, কিছু ফিরিয়ে দিতে পারত কি? নিজের সেই নিরবিচারে নেওয়া সিদ্ধান্তটাকে একবার হলেও প্রশ্ন করতে পারত? হঠাৎ করেই চোখে ভেসে উঠল সেই মেয়েটি — দুপুরে রাস্তা পার হচ্ছিল রঙিন রেইনকোট পরে — তার চুল, হাঁটার ভঙ্গি, পিঠে একটা কাপড়ের ব্যাগ — সব কিছু কেমন যেন… চেনা। ঋতব্রতের বুক ধুকপুক করে উঠল। যদি… যদি সেটা মেঘলাই হয়? হয়তো কাকতাল। হয়তো না। কিন্তু শিলংয়ের এই বসন্তে, হাওয়ার ভেতর, চায়ের কাপে, ঝিরঝির বৃষ্টিতে, প্রকৃতির প্রতিটি ধাপে যেন পুরনো কোনো প্রতিধ্বনি খেলে যাচ্ছে। সে ভাবল — কিছু সময় থাক না প্রশ্নহীন, যুক্তিহীন, কারণ কখনও কখনও আবেগই সত্য হয়ে ওঠে। হোটেলের ঘরে ফিরে যাওয়ার আগে একবার পেছনে তাকাল সে — সেই কাফেটার দিকে। জানালার পাশে বসে এক মেয়ে বই পড়ছে। তার চুল ভিজে, মাথা নিচু। ঋতব্রতের গলা শুকিয়ে আসে — “মেঘলা?” শব্দটা ঠিক উচ্চারিত হয় না, শুধু মনের ভেতর ঢেউ তোলে।

অধ্যায় ২: অন্য এক সকাল

শিলংয়ের সকালগুলো কেমন যেন ছায়াময়, নির্জন, অথচ চেনা। শহরটা যেন নিজের ভিতরেই কথোপকথন করে চলে — নিঃশব্দে, গভীরে। মেঘলা চট্টোপাধ্যায় জানালার কাচ খুলে মুখটা বাইরে বার করল, ঠান্ডা হাওয়ায় তার চুল এলোমেলো হয়ে উঠল। এই শহরে সে আগে আসেনি, অথচ যেন কতকালের চেনা—ঠিক যেমন কোনো পুরনো কবিতা আবার নতুন করে পড়লে হয়। সাহিত্যপত্রিকার তরফে এই সাহিত্যানুষ্ঠানের জন্য তাকে শিলং পাঠানো হয়েছিল—সেমিনার, আলোচনাসভা, লেখক-সাক্ষাৎকার, এসবই তার কাজের অঙ্গ। কিন্তু তার কাছে এই যাত্রা শুধুই পেশাগত ছিল না—এ ছিল এক ধরনের নির্জনতার খোঁজ, নিজের মধ্যে ডুবে যাওয়ার জায়গা খোঁজা। মেঘলা জানত না কেন এই শহরের প্রতিটা ধোঁয়াশা, প্রতিটা পাইন গাছের গন্ধ তাকে অকারণে স্মৃতিকাতর করে তুলছে। হয়তো কারণ একটাই—এখানে প্রকৃতির মতোই তার মনে থাকা কিছু সম্পর্কও ধোঁয়ায় মোড়া, কিছু প্রশ্ন কখনও জবাব পায়নি। ব্যাগ থেকে ডায়েরি বার করে সে লিখতে বসে গেল কাঠের বারান্দায় — “আজকের সকালটা যেন ঋতুর মত। রোদ নেই, কিন্তু আলো আছে। কুয়াশা আছে, কিন্তু ভয় নেই।” ডায়েরির পাতায় ওই ‘ঋতু’ নামটা যখন লেখে, তার ভেতরের দীর্ঘশ্বাস ধরা পড়ে না কারও কাছে — কিন্তু সে জানে, সেটা ঋতব্রত-রই ছদ্মনাম।

বৃষ্টি পড়ে চলেছে নিঃশব্দে, যেন কেউ সেতার বাজাচ্ছে খুব ধীরে, করুণ সুরে। মেঘলা এক কাপ ব্ল্যাক কফি নিয়ে হেঁটে গেল রিসর্টের পেছনের গার্ডেনটায় — যেখানে সিঁড়ি নেমে গেছে এক ছোট্ট কাফের দিকে। কাফেটা তার চোখে পড়েছিল আগের দিন বিকেলে, যখন সে স্থানীয় পাহাড়ি কবিদের সঙ্গে পরিচিত হতে বেরিয়েছিল। কাঠের কাঠামো, জানালার পাশে বইয়ের তাক, পুরনো রেকর্ড প্লেয়ারে বেজে চলেছে “Winds of the Hills” — সেই সুর যেন তার ভিতরের জমে থাকা কথাগুলোর ভাষা হয়ে উঠছে। একটা কোণের টেবিলে সে গিয়ে বসে, নিজের ডায়েরি খুলে। প্রথম পৃষ্ঠাতেই লেখা সেই চিঠি — যা ১৫ বছর আগে ঋতব্রতকে লিখে সে রেখে গিয়েছিল তাঁর চেয়ারে, বিদায় না জানিয়ে। লেখা ছিল, “ভালোবাসি বলেছিলি, কিন্তু সাহস পেলি না ভালোবাসাটা ধরে রাখতে। আমি তো চেয়েছিলাম না কিছুই—তুই থাকলেই হত।” তখন সে ভেবেছিল, সময়ের সঙ্গে এসব ফিকে হয়ে যাবে। হয়নি। এমনকি অনেক বছর পরে, সম্পর্কের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সে আর কাউকে গ্রহণ করতে পারেনি — কারণ ভেতরে কোনও একটা জায়গা এখনও ঋতব্রতের অপেক্ষায়। ভাবতে ভাবতে সে বাইরে তাকাল, কাচের জানালার ওপারে একজন পুরুষ দাঁড়িয়ে ছিল বৃষ্টির মধ্যে — ছাতা ছাড়াই। তার মুখটা অস্পষ্ট, কিন্তু উচ্চতা, চেহারার রেখা — কেমন যেন অদ্ভুতভাবে পরিচিত লাগল। এক মুহূর্তের জন্য তার হৃদয় কেঁপে উঠল — “সেটা কি ঋত?” না, অসম্ভব। কিন্তু কেন যেন শিলংয়ের এই বৃষ্টি, এই চায়ের গন্ধ, এই কাফে সবকিছু তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেই দিনগুলিতে—কলেজ ক্যাম্পাস, ক্যান্টিনের ধারে বসে থাকা, নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখতে লিখতে অজান্তে ঋতর আঙুলে হাত রেখে ফিসফিস করে বলা, “তুই চলে যাস না…”

সে জানে, এই শহরে কিছু একটা ঘটতে চলেছে। হয়তো একটা সাক্ষাৎ, হয়তো মুখোমুখি না হওয়া কিছু প্রশ্নের উত্তর, অথবা হয়তো পুরনো আবেগের এক নতুন উপলব্ধি। মেঘলা উঠে দাঁড়ায় — ডায়েরি বন্ধ করে ব্যাগে রাখে, বাইরে তাকিয়ে দেখে সেই লোকটা আর নেই। কেবল বৃষ্টির ফোঁটা কাচের গায়ে গড়িয়ে নামছে। একটু থেমে থেকে সে নিজের গাল ছুঁয়ে দেখে — ভেজা, কিন্তু কফির গরম কাপটা আর চোখের কোণের উষ্ণতা আলাদা করা যাচ্ছে না। তার পাশের টেবিলে দু’জন স্থানীয় কলেজ ছাত্র গিটার বাজাতে শুরু করেছে — “রিমঝিম গিরে সাওন…”। গানের প্রতিটা শব্দ যেন তার হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছে। সে বুঝতে পারছে, এখন আর পালানোর কিছু নেই। এখন সে নিজেকেই প্রশ্ন করছে, “তুই যদি আবার ওর সামনে পড়িস, কী বলবি?” হয়তো কিছু না। হয়তো শুধু তাকিয়েই থাকবে — ঠিক যেভাবে ঋত তাকাতো তার দিকে, ধীরে, নিশ্চুপ, অথচ গভীরভাবে। হয়তো সে আবার নতুন করে ভালোবাসা খুঁজে পাবে — অথবা শুধুই এক চিরন্তন অতৃপ্তির চিহ্ন হয়ে থাকবে এই পাহাড়ি শহরের কোনো এক ভিজে দুপুরে। কিন্তু যাই হোক, সে জানে — শিলংয়ের এই বসন্ত শুধু প্রকৃতির নয়, তার হৃদয়েরও।

অধ্যায় ৩: হঠাৎ দেখা

বিকেলটা যেন পাহাড়ের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল ধীরে ধীরে — গাঢ় মেঘের স্নান, গা ছমছমে নীরবতা, আর এক নিঃশব্দ প্রতীক্ষা যেন চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ঋতব্রত বেরিয়েছিল অফিস কনফারেন্সের বিরতিতে কিছু সময় একা কাটাতে — মানসিক ক্লান্তির চেয়ে বোধহয় আত্মিক অস্থিরতাই তাকে টেনে নিয়েছিল রিসর্টের নিচের কাফেটার দিকে। জায়গাটা তার প্রথম দিন থেকেই চোখে পড়েছিল — কাঠের কাঠামো, সাদা কাগজে আঁকা চা-পাতার ছায়া দিয়ে সাজানো লোগো, আর বাইরে দুলতে থাকা রঙিন ছাতার নিচে দুই পাহাড়ি ছেলের বেজে ওঠা হুক গিটার। ভেতরে ঢুকতেই কাচের দেয়ালের ওপাশে পাহাড়ের ঢালে ছড়িয়ে থাকা শহরের আলো-আঁধারি রূপ চোখে পড়ে। ক্যাফেতে বসেই সে একটা দার্জিলিং টি অর্ডার করল। তারপর হঠাৎ তার চোখ পড়ল জানালার পাশে এক কোণার টেবিলে — যেখানে কেউ বসে ছিল, মাথা একটু নিচু, চুল এলোমেলো, এক হাতে কাপ ধরা, আর অন্য হাতে খোলা একটা নীলমলাট ডায়েরি। প্রথমে ঋতব্রত শুধু একবার তাকিয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয়বার চোখ পড়তেই মনে হলো, শরীরটা কেমন যেন জমে গেল। তার বুক ধড়াস করে উঠল। মুহূর্তে মনে পড়ল সেই বিশেষ হাতের ভঙ্গি, কাঁধে ঝোলানো কাপড়ের ব্যাগ, আর ঠোঁটের কোণে যে চিন্তামগ্ন চাপা হাসি… — মেঘলা?

মুহূর্তটা যেন স্থির হয়ে গেল — ঠিক যেমন পুরনো কোনো ছবির ওপর ধুলো জমে গেলে ধীরে ধীরে মুছে তা স্পষ্ট হয়। সেই মুখ, যেটা গত ১৫ বছর ধরে শুধুই স্মৃতিতে ছিল, আজ বাস্তব হয়ে উঠেছে এই কাফের জানালার পাশে। ঋতব্রতের মনে হলো হাঁটার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। সে চেয়েছিল এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকতে, আবার ভাবছিল সোজা বেরিয়ে যায় — কিন্তু পা আর সাড়া দিচ্ছিল না। মেঘলা তখনও তাকে দেখেনি। সে যেন নিজের ভেতরেই ডুবে, ডায়েরির পাতায় কিছু লিখছে, মাঝে মাঝে বাইরের ঝিরঝিরে বৃষ্টির দিকে তাকাচ্ছে — যেন এই প্রকৃতির মধ্যেই তার উত্তরের খোঁজ। ঋতব্রতের হাত কাঁপছিল। সে মনে মনে রিহার্সাল দিতে লাগল — “তুই কেমন আছিস, মেঘলা?”, “এতদিন পর?”, “এই শহরে?” — কিন্তু কোনও বাক্যই মনে হচ্ছিল যথাযথ নয়। এভাবে কি শুরু করা যায় ১৫ বছরের অপেক্ষার পর? চা এসে গেল, কিন্তু সে ছুঁয়েও দেখল না। ঠিক সেই মুহূর্তে মেঘলা হঠাৎ করে চোখ তুলল। তাদের চোখে চোখ পড়ল। না, কোনও মেলোডি বাজেনি, কোনও ক্যামেরা স্লো মোশনে ঘোরেনি — কিন্তু চারপাশটা নিঃশব্দ হয়ে গেল। শুধু একধরনের নীরব বিস্ময় ও গুমরে ওঠা অনুভব যেন সময়কে আটকে রাখল।

মেঘলা প্রথমে অবিশ্বাসে তাকাল। যেন মনের মধ্যে প্রশ্ন ছুটে এল, “স্বপ্ন দেখছি?” তারপর ধীরে ধীরে চেনা চোখদুটি ধরা পড়ল তার চেনা বাস্তবতায়। চোয়ালের সেই নরম রেখা, ঠোঁটের ওপরের সূক্ষ্ম দাগ, আর সেই চুপচাপ তাকানোর অভ্যেস — হ্যাঁ, এ ঋতব্রতই। অনেকগুলো মুহূর্ত পেরিয়ে তার ঠোঁট কাঁপল, কিন্তু শব্দ বেরোল না। যেন সেই পুরনো দিনের একটা সংলাপ থেমে গিয়েছিল, আজও তার শেষ বাক্য বলার অপেক্ষায়। ঋতব্রত একটু এগিয়ে এল, একরকম গুটিয়ে। ঠাণ্ডা গলায় বলল, “তুই… তুই এখানে?” শব্দটা মেঘলার কানে ঝাঁপিয়ে পড়ল না — বরং ধীরে ধীরে গড়িয়ে গেল বুকের ভেতরে জমে থাকা কুয়াশায়। মেঘলা কিছু বলল না, শুধু মাথা হেলিয়ে জানাল — সে বিশ্বাস করছে দৃশ্যটাকে। তারপর আস্তে করে বলল, “তুই ঠিক আছিস?”—সেই প্রশ্ন, যা না বলা ছিল এতগুলো বছর। তারা বসে রইল কিছুক্ষণ — কথা না বলে, শুধু তাকিয়ে, বুঝে নিতে চেষ্টা করে কার মনে কতটা ক্ষত জমে আছে। বাইরে তখনো বৃষ্টি পড়ে চলেছে — দু’জনের মাঝখানে কাচের গায়ে ফোঁটা ফোঁটা জল। কিন্তু এবার, সেই ফোঁটা আর আলাদা করেনি তাদের — বরং মিলিয়ে দিয়েছিল এক পুরনো বসন্তের সঙ্গে, যেখানে এখনো ভালোবাসার রং শুকিয়ে যায়নি।

অধ্যায় ৪: পুরনো গানের মতো

বৃষ্টির ফোঁটাগুলো তখন জানালার কাচে ছন্দ তুলে চলেছে — যেন কোনো অদৃশ্য বাদক সেই ছন্দে ফিরিয়ে আনছে অতীতের কিছু না-বলা কথা। ক্যাফেটার সেই কোণার টেবিলটায় বসে রয়েছে মেঘলা আর ঋতব্রত। শব্দ নেই, শুধু দৃষ্টির আদানপ্রদান, দু’কাপ কফির ধোঁয়া, আর চারপাশে কিছু পাহাড়ি গানের ছায়া। ঋতব্রতের গলার স্বর আজ যেন অনেক নিচু — বা হয়তো অনেক ভারী। প্রথম কথাগুলোর পরে আবার একটা দীর্ঘ নীরবতা নেমে এসেছিল। মেঘলা কাপ থেকে চোখ সরিয়ে বলল, “ভাবিনি, তোকে এই শহরে দেখব।” ঠোঁটে এক অদ্ভুত শুষ্ক হাসি খেলে গেল তার। “আমি তো জানতাম তুই পাহাড়ে যেতে পছন্দ করিস না… বরফকে বলতিস ‘ঠাণ্ডা অস্থিরতা’।” সেই কথায় দুজনেই একটু হেসে উঠল — সেই হাসি, যেখানে অল্প বিষাদ, অল্প লজ্জা, আর একটা অস্বস্তি মিশে থাকে। ঋতব্রত মাথা নিচু করে বলল, “হয়তো এখন অস্থিরতা খুঁজে বেড়াই বলেই পাহাড়ে এসেছি।” কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মেঘলার চোখে কী যেন নড়ে উঠল। হয়তো ব্যথা, হয়তো বোঝাপড়া, অথবা হয়তো—একটা পুরনো অভিমান আবার চোখ রাঙিয়ে উঠল ভিতরে ভিতরে।

মেঘলা জানত, এইভাবে দেখা হবে, কথাও হবে—কিন্তু এত সরলভাবে নয়। তার মনে হচ্ছিল, এই মুহূর্তের জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু আবার এটাও ঠিক—ঋতব্রতের পাশে বসে, তার কণ্ঠস্বর শুনে, পুরনো সম্পর্কের কুয়াশা কেটে আস্তে আস্তে একটা চেনা আলো উঁকি দিচ্ছে। “এই ১৫ বছর…,” মেঘলা বলল, “অনেকবার ভেবেছি তোর সঙ্গে কথা বলব। একটা মেসেজ, একটা মেইল… কিন্তু ঠিক তখনই ভাবতাম, যেটা শেষ হয়ে গেছে, সেটা আবার তুলে কী হবে?” ঋতব্রত চুপ করে ছিল। সে জানত, মেঘলার প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর হয়তো আছে তার ভিতরে, কিন্তু সেগুলো শুধু যুক্তিতে ঠেকানো যায় না। “তুই কিছু বলিসনি,” মেঘলা হঠাৎ চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই শুধু… চলে গেছিলি।” এই কথার মধ্যে যে অভিমান, যে ক্ষরণ, তা পাহাড়ের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল, যেন হঠাৎ হাওয়া থেমে গেল চারপাশে। ঋতব্রত কফির কাপটা রেখে বলল, “আমি ভেবেছিলাম, সময়টা আমার পক্ষে ছিল না। ভেবেছিলাম, আগে নিজেকে তৈরি করব, তারপর তোকে ফিরিয়ে আনব।” মেঘলা উত্তর দিল না, শুধু ধীরে ধীরে ডায়েরির এক পৃষ্ঠা খুলে দেখাল — যেখানে তার নিজের হাতে লেখা ছিল, “ভালোবাসা সময় চায় না, সাহস চায়।” লেখাটা অনেক পুরনো, হয়তো সেই সময়েই লেখা হয়েছিল। সেই বাক্য দেখে ঋতব্রতের চোখ জ্বলজ্বল করছিল, কিন্তু সে নিজেকে শক্ত করে রেখেছিল।

ক্যাফেতে হঠাৎ বাজতে শুরু করল এক পুরনো গান — “চাঁদনী রাতে… যদি কেউ পাশে থাকে…”। গানটা শুনে তারা দুজনেই চুপ করে গেল, যেন কেউ মনের ভেতরে একবারে গেঁথে দেওয়া স্মৃতি খুলে দিল। কলেজে ওরা যখন নাটকের রিহার্সাল করত, মেঘলা মাঝে মাঝে এই গানটা গুনগুন করত — আর ঋতব্রত এক কোণে বসে শুনত, গোপনে, শান্তভাবে। সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়তেই চোখের কোণে জল জমে উঠল। কিন্তু তারা দুজনেই জানত, এই জল কোনো দুর্বলতা নয় — এটা এক ধরনের সাহস, একসঙ্গে সব মেনে নেওয়ার সাহস। বাইরে তখন বৃষ্টি একটু থেমে এসেছে, ছাতার নিচে এক বাচ্চা মেয়ে তার বাবার সঙ্গে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে হাত বার করে ধরছে। মেঘলা সেই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই কি কখনও ভেবেছিলি, আমরা আজ এভাবে মুখোমুখি বসব?” ঋতব্রত বলল, “ভেবেছিলাম না… কিন্তু চেয়েছিলাম। অনেকবার।” মেঘলা তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর এক নিঃশ্বাসে বলল, “আমি তোকে ক্ষমা করে দিয়েছি অনেক আগেই… কিন্তু তোকে ভুলিনি কখনও।” এক মুহূর্তের জন্য ঋতব্রতের চোখ ভিজে গেল। সে হয়তো সেই কথাটার জন্যই অপেক্ষা করছিল সব সময়। দুজনের মাঝখানে এবার আর কোনও কুয়াশা ছিল না, শুধু এক নরম আলো, এক পুরনো গানের মতো অনুভূতি — যেখানে সুরটা আজও থেমে যায়নি।

অধ্যায় ৫: রিসর্টের ছাদে স্মৃতি

রাতটা ছিল নীরব, যেন পাহাড়ের গায়ে হালকা চাদরের মতো কুয়াশা ছড়িয়ে আছে। রিসর্টের মধ্যে সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছে ধীরে ধীরে—কনফারেন্সের ক্লান্তি, সেমিনারের যান্ত্রিকতা আর ট্র্যাভেল-ডেটিনারের মোড়কে ঢেকে যাওয়া হৃদয়ের আবেগ কেউ টের পায়নি। কিন্তু ঋতব্রত ঘুমাতে পারেনি। ক্যাফে থেকে ফিরে আসার পর থেকেই তার মধ্যে একটা অস্থিরতা জন্ম নিয়েছে—এক অদ্ভুত অনুভব, যা এত বছর পর হলেও যেন এখনই থেমে থাকা সম্ভব নয়। মেঘলাকে দেখে যে শূন্যতা এতদিন সে চেপে রেখেছিল, সেটাই যেন আজ মুখ তুলে দাঁড়িয়ে পড়েছে। এক কাপ কফি নিয়ে সে নিঃশব্দে উঠে এল রিসর্টের ছাদে। ছাদটা কাঠের, একপাশে টিম্বার রেলিং, অন্যদিকে ছোট ছোট ফ্লাওয়ার টব, আর ওপরে আকাশ—আধেক মেঘে ঢাকা, আধেক চাঁদের আলোয় ভেজা। দূরের পাহাড়ে একটা কুকুর ডাকছে, অনেক নিচে কোথাও গাড়ির হালকা আলো ভেসে উঠছে আর মিলিয়ে যাচ্ছে। ঋতব্রত রেলিংয়ে হাত রাখে। তার মনোজগতের ভিতর আজ যেন একটা অদৃশ্য দরজা খুলে গেছে—সব শব্দ, সব চুপ থাকা, সব স্মৃতি গড়িয়ে গড়িয়ে বেরিয়ে আসছে।

ঠিক তখনই তার পাশে ধীরে ধীরে পায়ের আওয়াজ। সে ঘুরে তাকিয়ে চমকে উঠল—মেঘলা। একটা লাল শাল গায়ে জড়িয়ে, চুল এলোমেলো, হাতে মাটির কাপ — চায়ের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। কোনও প্রশ্ন নয়, কোনও অনুমতি নয়—শুধু সেই পুরনো অভ্যেস, একসাথে ছাদে বসার, কাঁধে কাঁধ ছোঁয়ার অনুভূতি যেন ফিরে এসেছে। মেঘলা বলল, “তুই ঘুমাসনি?” ঋতব্রত হালকা হাসল, “তুইও না।” তারা পাশাপাশি দাঁড়াল। এরপর একটু নীরবতা। হঠাৎ মেঘলা বলল, “তুই জানিস, তোর চলে যাওয়ার পর আমি আর নাটকে অভিনয় করিনি।” কণ্ঠটা কেঁপে উঠল তার। “তুই ছিলি আমার সবচেয়ে বড় সমালোচক, আবার শ্রোতাও। তুই না থাকলে আমি আর মঞ্চে উঠতে পারতাম না।” ঋতব্রত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আমিও আর লিখিনি… কবিতা, গল্প—সব থেমে গেছিল। আমার ডায়েরির শেষ লেখাটায় তোকে নিয়ে একটা চারলাইন ছিল। তারপর পাতাগুলো খালি।” কথা বলতে বলতে দু’জনের কণ্ঠ কেঁপে উঠছিল, আর হাওয়া যেন তাতে সুর যোগ করছিল।

মেঘলা হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে বলল, “তুই আমাকে বোঝা মনে করেছিলি?” প্রশ্নটা যেন ছুরির মতো কেটে গেল। ঋতব্রত ধীরে ধীরে বলল, “না… আমি নিজেকেই বোঝা মনে করতাম। ভেবেছিলাম তোর জীবন থেকে সরে গেলে তুই স্বাধীনভাবে নিজেকে গড়তে পারবি।” মেঘলা তীব্র গলায় বলল, “তুই আমার হয়ে ভাবার কে? সম্পর্ক মানে একসঙ্গে লড়াই—not sacrifice! তুই নিজের ভয় ঢাকতে গিয়ে আমায় ফেলে দিয়েছিলি।” কথাগুলো পাহাড়ে প্রতিধ্বনি তুলছিল। তারপর হঠাৎ মেঘলা নিজেই চুপ হয়ে গেল। তার চোখ ভিজে উঠেছে, গাল বেয়ে জল গড়াচ্ছে, আর ঠোঁট কাঁপছে। ঋতব্রত এগিয়ে এসে ধীরে করে বলল, “আমি ভুল করেছিলাম… স্বীকার করতে সময় লেগে গেছে।” এক মুহূর্ত তারা দু’জনেই নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর মেঘলা ধীরে ধীরে মাথা রাখল ঋতব্রতের কাঁধে। বাইরে বৃষ্টি নামল আবার, ছাদের কাঠে টাপর টুপ শব্দ। তারা দাঁড়িয়ে রইল সেই বৃষ্টির নিচে, কোনও শব্দ ছাড়াই—শুধু চুপ করে। মনে হচ্ছিল, এই বৃষ্টি ১৫ বছরের সব অপূর্ণতা ধুয়ে-মুছে নিচ্ছে। সেই মুহূর্তে কোনও ভবিষ্যতের কথা তারা ভাবেনি, কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। শুধু একটুকরো আবেগ, এক সন্ধ্যাবেলার শান্তি, আর একটা ছাদ—এই নিয়েই পৃথিবীটা ছোট হয়ে এসেছিল।

অধ্যায় ৬: নীরবতার ভেতরে

শিলংয়ের সকালটা ছিল সেইরকম, যেরকম হয় এক বৃষ্টিভেজা মধ্যরাতের পর—ঝাপসা আলোয় ঢাকা, আকাশের কোণায় জমে থাকা কুয়াশা আর গাছের পাতায় ঝরে থাকা অতৃপ্ত জলের শব্দ। ঋতব্রত দত্ত ঘুম থেকে উঠে দেখল ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁইছুঁই করছে। ছাদের সেই রাতের কথা তার মনে পড়ছে বারবার। মেঘলার মাথা তার কাঁধে রাখা, ঠাণ্ডা বাতাসে জড়িয়ে থাকা একটুকরো নিরবতা—সব যেন অদ্ভুতভাবে বাস্তব, অথচ ধোঁয়াটে। কিন্তু আজ সকালে ঘুম ভাঙতেই একটা খালি অনুভব তাকে গ্রাস করল। প্রথমে মনে হল, বোধহয় কিছু ভুলে গেছে, কিংবা কোনো স্বপ্নের অংশ এখনও মাথায় রয়ে গেছে। কিন্তু পরের মুহূর্তেই বুঝতে পারল, মেঘলার কোনও খোঁজ নেই। না তার রুমে, না রিসর্টের ক্যাফেতে, না বারান্দায়। এক অজানা অস্থিরতা তার বুকের ভিতর ছড়িয়ে পড়ল। সে একঝাঁক প্রশ্ন নিয়ে রিসর্টের রিসেপশনে গেল—মেঘলা চেক আউট করেছে কি না, শহরের কোন জায়গায় যেতে পারে, কোনও মেসেজ রেখে গেছে কি না। কিন্তু কেউ কিছু জানে না।

ঋতব্রত একরকম দৌড়তে দৌড়তে বেরিয়ে পড়ল রিসর্ট থেকে — মুখে শুধু একটা নাম, চোখে সেই রাতের দৃশ্য, আর মনে এক ভয় — “আবার যদি হারিয়ে যায়!” সে প্রথমে গেল সেই কাফেটায় — যেখানে প্রথম দেখা হয়েছিল, যেখানে পুরনো গান আর চায়ের কাপ তাদের ফিরিয়ে দিয়েছিল এক সন্ধ্যের খাঁজে। কিন্তু টেবিল খালি। চেয়ারগুলো এলোমেলো, দেওয়ালের তাকের বইগুলো আজ নির্জীব। বৃষ্টির ফোঁটা জানালায় পড়ে সেই শূন্যতাকে আরও প্রকট করে তুলছে। সে রিকশা ধরে গেল মেইন মার্কেট — হয়তো ওখানে, পুরনো বইয়ের দোকানে বা পাহাড়ি কারুপণ্যের গলিতে। না, কোথাও নেই। হাঁটতে হাঁটতে একসময় সে পৌঁছল শহরের বাইরের দিকে, পাইন গাছের সারির নিচে এক শান্ত জায়গা — যেখানে গড়িয়ে চলা পাহাড়ি রাস্তা হঠাৎ থেমে গেছে এক উঁচু ভিউ পয়েন্টে। হাওয়ায় চুল উড়িয়ে সেই উঁচু পাথরের ওপর কেউ দাঁড়িয়ে ছিল। ঋতব্রতের বুক ধুকপুক করে উঠল — হয়তো… হয়তো সে? কিন্তু কাছে যেতেই দেখা গেল, অন্য কেউ। হতাশ, নিঃশেষ ও অবসন্ন হয়ে সে বসে পড়ল এক পাথরের বেঞ্চে। মাথার ভিতরে গুঞ্জন চলতে লাগল — “কিছু কি ভুল বলে ফেলেছিলাম রাতে? কোথাও কি আবার হারিয়ে ফেলেছি?” হাওয়া তাকে উত্তর দেয় না, শুধু মেঘ উড়ে যায় পাহাড়ের মাথার দিকে।

ঠিক তখনই তার ফোনটা ভাইব্রেট করল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল একটা মেসেজ: “যদি খুঁজে পেতে চাস, সেই পাহাড়ি গ্রামটার কথা মনে আছে তো? যেখানে আমরা একবার ট্রেক করতে গিয়ে পথ হারিয়ে গেছিলাম? আমি ওখানে। একদিনের জন্য। একবার শেষবারের মতো নিজেদের বোঝার সুযোগ দে, ঋত…”
মেসেজটা পড়েই ঋতব্রতের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। “লাউখরা গ্রাম” — সেই নামটা তার মনে পড়ল, যেখানে কলেজ জীবনে এক ঝুঁকিপূর্ণ হাইকিংয়ে তারা দুজন কুয়াশার মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলেছিল, আর এক পাইন গাছের নিচে বসে রাত কাটাতে হয়েছিল — একটানা কথা, গান আর গলায় হাত রাখার সেই অভিজ্ঞতা, যা তখন মনে হয়েছিল অনন্তের মতো। গাড়ি খুঁজে পেল সে, ড্রাইভারকে বলল — “লাউখরা, যত দ্রুত সম্ভব।” পথটা ছিল বিপজ্জনক, সরু, বৃষ্টিতে পিচ্ছিল, কিন্তু ঋতব্রতর চোখে শুধু একটাই লক্ষ্য—মেঘলা। পাহাড়ি গায়ে রোদ পড়ছিল斜ভাবে, আর প্রকৃতি এক নীরব উত্তেজনায় প্রস্তুত হচ্ছিল সেই সাক্ষাতের জন্য, যেটা দুটো আত্মার বহু বছরের অপেক্ষার প্রতীক। গাড়ি যখন গ্রামের সীমানায় ঢুকল, মেঘলা তখন একটা কাঠের ঘরের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল — পাইন গাছের নিচে, সেই চেনা মুখ, সেই চাপা অভিমান, আর তাতেই লুকিয়ে থাকা একটা অশেষ চাওয়া। চোখে চোখ পড়তেই ঋতব্রত বুঝে গেল — এই নীরবতা, এই হারিয়ে যাওয়া আসলে পথ না হারানো, বরং নিজেকে আবার খুঁজে পাওয়ার আর্তি।

অধ্যায় ৭: সত্যি কথা

লাউখরা গ্রামটা যেন অন্য এক দুনিয়া — পাহাড়ের বুকের মধ্যে লুকোনো ছোট্ট এক বসতি, যেখানে মোবাইল সিগনাল যায়-আসে, ঘড়ির কাঁটাগুলো যেন ঢিমে হারে চলে, আর কুয়াশার চাদরের নিচে চাপা পড়ে থাকে শহরের ব্যস্ততা, উদ্বেগ আর মানুষ-মানুষের দূরত্ব। গ্রামের বাইরে কাঠের ছোট্ট হোমস্টের উঠোনে বসে ছিল মেঘলা, সামনে এক কাপ তাজা লাল চা, আর হাতে ডায়েরি। ঋতব্রত গাড়ি থেকে নেমেই কিছু না বলে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল। দুজনের চোখে চোখ পড়ল, কিন্তু আজকের দৃষ্টিটা একেবারে আলাদা — যেন কাঁপতে থাকা হাওয়ার ভিতরেও স্থিরতা আছে। মেঘলা মুখ না তুলেই বলল, “বস।” সেই এক শব্দেই এতদিনের ব্যবধানটা যেন ফাঁক গলে গলে ঢুকে পড়ল পাহাড়ের মাটিতে। ঋতব্রত একটাও শব্দ না করে মেঘলার পাশে বসল। বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল — শুধু পাখিরা জানত কী হতে চলেছে। হঠাৎ মেঘলা ডায়েরি বন্ধ করে বলল, “এই ১৫ বছরে একবারও কি তুই ফিরে তাকিয়েছিলি?”
ঋতব্রত আস্তে মাথা নাড়ল, “প্রতিদিন।”
মেঘলার কণ্ঠে স্পষ্ট হতাশা: “তাহলে এলি না কেন?”
এক দীর্ঘ নীরবতা… তারপর ধীরে ধীরে খুলল ঋতব্রতের মুখ — “আমার বাবা সেসময় ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কলকাতা ছেড়ে তখন মুম্বই যাওয়া ছাড়া কোনও রাস্তা ছিল না। তখন ক্যারিয়ারের কথা নয়, প্রয়োজন ছিল অর্থ, স্থায়িত্ব, চিকিৎসার ব্যবস্থা। আমি… আমি ভেঙে গেছিলাম।”
মেঘলার চোখে তখন হতবাক নীরবতা।
“তুই কিছু বলিসনি,” মেঘলা কাঁপা গলায় বলল।
“পারিনি,” ঋতব্রত চাপা স্বরে বলল, “তোর সামনে দাঁড়িয়ে আমার দুর্বলতা দেখানোর সাহস ছিল না। আমি ভেবেছিলাম, তুই ততদিনে নিজেকে গুছিয়ে নেবি।”
মেঘলা চোখ বন্ধ করল, ঠোঁট কাঁপল।
এই প্রথম সে বুঝতে পারল — সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া মানেই একতরফা ভুল নয়, অনেক সময় নীরবতাও একরকম কষ্টের ভাষা হয়ে ওঠে।

পাহাড়ি হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খুলে যেতে লাগল তাদের মন। মেঘলা বলল, “তুই জানিস, তোর চলে যাওয়ার পরে আমি কারও দিকে তাকাতে পারিনি। নতুন চাকরি, নতুন শহর, নতুন মানুষ — সবই এসেছিল জীবনে, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারিনি কাউকে। মনে হত, যাকে সবচেয়ে বেশি চিনি, সে-ই যখন চুপ করে চলে যেতে পারে, তখন আর কার ওপর নির্ভর করব?”
ঋতব্রতের চোখে জল চলে এল। “আমি জানতাম না… জানলে ফিরে আসতাম।”
“ফিরে আসবি বলে তো কখনও বলিসনি,” মেঘলার গলায় অভিমান।
“কারণ আমি জানতাম না আমি বাঁচব কি না, বাবা বাঁচবে কি না। সময় সবকিছু থেকে আমায় সরিয়ে দিয়েছিল। শুধু তোকে সরাতে পারিনি… তুই ছিলি আমার প্রতিটি লেখায়, প্রতিটি গান শুনলেই মনে পড়ত তোকে। বিশ্বাস কর, মেঘলা, আমি তোকে কখনও ফেলে দিইনি… আমি শুধু নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছিলাম।”
মেঘলা তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ — সেই চেনা চোখে এখন কেবল অনুশোচনা নয়, বরং একটি সত্যিকারের পরিণত ভালোবাসার রেশও।
“আমরা দুজনেই তখন ছোট ছিলাম,” সে বলল, “ভেবেছিলাম ভালোবাসা মানেই পাশে থাকা। বুঝিনি, কখনও কখনও দূরে গিয়েও কেউ থেকে যেতে পারে ভিতরে ভিতরে। তবে তুই যদি তখন বলতি… একটা চিঠিও… আমি হয়তো তোর পাশে থেকে যেতাম।”
ঋতব্রত মাথা নিচু করে বলল, “এই কথাটাই আমাকে প্রতিদিন পোড়ায়।”
এক দীর্ঘ নীরবতা নেমে এল তাদের চারপাশে — যেন আকাশের ধূসরতা কিছুটা হালকা হচ্ছে, সূর্যের আলো পাথরের গায়ে উঁকি দিচ্ছে।

দুজনেই জানত, অতীত আর ফিরে আসবে না। কিন্তু সেই অতীতের মুখোমুখি হয়ে আজ যেন তারা দুজনেই একটু হালকা, একটু মুক্ত। ঋতব্রত ধীরে করে বলল, “আজ তুই যা বললি, সেগুলো আমার জন্য ক্ষমা নয়, তুই আমাকে নতুন করে চিনতে দিলি… নিজের ভেতরের ভাঙাচোরা দেখালিস। আমিও তোর কাছে আমারটা খুলে ধরলাম। সেটা অনেক বড় জিনিস।”
মেঘলা তাকিয়ে বলল, “তুই এখনও কবিতা লেখিস?”
“না, কিন্তু তুই থাকলে হয়তো আবার শুরু করতে পারি।”
মেঘলার ঠোঁটে একটুকরো হাসি — সেই পুরনো হাসি, যা ঋতব্রত সবচেয়ে বেশি চিনত।
তারা দুজনেই তখন পাহাড়ের ঢালে বসে, সেই পুরনো পাইন গাছের নিচে — যেখানে ১৫ বছর আগে তারা পথ হারিয়ে একসাথে বসেছিল। এবার আর পথ হারিয়ে বসা নয় — এবার তারা নিজেরাই পথ খুঁজে নিচ্ছে, একে অপরকে ধরে।

অধ্যায় ৮: আর এক বিকেল

পাহাড়ি বিকেলটার রঙ ছিল অদ্ভুত—হালকা সোনালি, তার ওপর ছায়া পড়ে ছিল পাইন গাছের লম্বা দেহ ছুঁয়ে। পাহাড়ের ঢালে বসেছিল এক স্থানীয় হাট—ছোট ছোট বাঁশের দোচালা দোকান, রঙিন কাপড়, হাতে বানানো কাঠের খেলনা আর গোল কাঁচে বাঁধানো সোনালি কানের দুল। ভেতরের রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল মেঘলা আর ঋতব্রত—একসঙ্গে, কিন্তু আলাদা, যেন সেই পুরনো অভ্যেসের পথ ধরে আবার নতুন করে খুঁজছে নিজেদের। মেঘলা একটা দোকানে দাঁড়িয়ে কাঠের বাঁশি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল, হালকা হেসে বলল, “এই বাঁশি আমাদের কলেজ নাটকে ব্যবহার হয়েছিল মনে আছে?”
ঋতব্রত ঠোঁটে একটা চাপা হাসি এনে বলল, “যেটা তুই বাজাতে পারিসনি কখনও ঠিক মতো।”
মেঘলা চোখ ঘুরিয়ে বলল, “তুই লিখেছিলি, আমি বাজাব—দোষ আমার নয়।”
হাসির মধ্যে যে স্বস্তি, সেটা হয়তো তাদের বহুদিনের অভ্যস্ত ভারটা একটু নামিয়ে রাখার পথ। চারপাশের ভিড়ে স্থানীয় ছেলেমেয়েরা পাহাড়ি ভাষায় কথা বলছে, কোথাও গান হচ্ছে বাঁশি আর ঢোলক নিয়ে, আর কেউ কেউ পিঠে পিঠে শাল গুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রোদে। কিন্তু ঋতব্রত আর মেঘলার এই হাঁটা, এই পাশে-পাশে থাকা, সেটাই তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কোনও চটকদার রোম্যান্স নয়, বরং দু’জন পরিণত মানুষের নিজেকে বোঝা ও গ্রহণ করার গল্প—যা তারা এই পাহাড়ি শহরে খুঁজে পেয়েছে।

হাটের শেষ প্রান্তে একটা নির্জন জায়গা ছিল—একটা পুরনো কাঠের বেঞ্চ, তার পাশে পাইনগাছের সারি, আর নিচে ঢালু উপত্যকা। দুজনে সেখানে গিয়ে বসল। কিছুক্ষণের নীরবতার পর মেঘলা বলল, “জানি না তুই কেমনভাবে ভাবিস, কিন্তু আমার তো মনে হয়, আমরা আর আগের মতো হতে পারব না।”
ঋতব্রত বলল, “আমার তো ঠিক উল্টো মনে হয়—আগে তো ছিলাম স্বপ্নে, এখন হয়তো বাস্তবে হওয়ার সময় এসেছে।”
মেঘলা মাথা নিচু করল, “ভয় পাই… জানিস? আবার একসঙ্গে ভাবতে ভয় পাই। এত বছর পরে আবার যদি কিছু ভেঙে যায়?”
ঋতব্রত একটানা তাকিয়ে ছিল তার দিকে, তারপর বলল, “ভেঙে যাওয়ার ভয় থাকলে কোনো কিছু গড়ে ওঠে না। ভালোবাসা মানেই তো ঝুঁকি। কিন্তু আমি আজ জানি—তুই ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ। আর এই অসম্পূর্ণতাকে আমি আর ভুলে থাকতে চাই না।”
মেঘলা ধীরে ধীরে তাকাল ঋতব্রতের চোখে—যেখানে ছিল কেবল সত্য, কোনও নাটক নয়, কোনও প্রতিশ্রুতির মোড়কে আবেগ নয়—একটা শান্ত গ্রহণযোগ্যতা।
“তুই কি বলছিস, আমরা আবার…”
“আবার শুরু নয়,” ঋতব্রত থামিয়ে বলল, “বরং এবার প্রথমবার, একদম নতুন করে।”
মেঘলা একটু চুপ করে থেকে বলল, “তাহলে, এবার আর পালাবি না তো?”
ঋতব্রতের গলায় ছিল স্থিরতা: “যতবার তুই হাত বাড়াবি, ততবার আমি থাকব। হয়তো না-থাকা সময়গুলোর শোধ মেটাতে।”

সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। হাটের আলো জ্বলে উঠছে একে একে, মানুষজন গুছিয়ে নিচ্ছে তাদের জিনিসপত্র, দোকানপাট বন্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু পাহাড়ের ঢালে সেই বেঞ্চে দুজন মানুষ বসে—তাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিকেলটা কাটিয়ে দিচ্ছে একটানা নীরবতায়। আর সেই নীরবতায় ছিল এক নির্ভরতা, এক নতুন প্রতিশ্রুতি।
হঠাৎ মেঘলা বলল, “একটা কবিতা লেখ… এই মুহূর্তটার জন্য।”
ঋতব্রত একটু হেসে মাথা নাড়ল, তারপর মেঘলার হাত নিজের হাতে ধরে বলল—
“তুই পাশে থাকলে ভয়ও পাহাড় হয়ে দাঁড়ায় না, অন্ধকারেও আলো জ্বলে— শুধু একটা ছায়া চাই, তোর মতো।”

অধ্যায় ৯: বিদায়ের আগে

শিলংয়ের আকাশটা সেই দিন ছিল যেন বিদায়ের মতোই—অদ্ভুত নীল, কিন্তু তার মধ্যে হালকা ধূসর একটা বিষণ্ণতা। রিসর্টের ঘরগুলোতে প্যাকিংয়ের শব্দ, স্যুটকেসে পোশাক গুছোনো, পাস ছাপানো, আর এক ঝাঁক স্যুট পরা সহকর্মীর ব্যস্ত মুখে দেখা যাচ্ছিল শুধুই সময়ের তাড়া। ঋতব্রতের মনটা সকাল থেকেই ভার হয়ে ছিল—যেন এক রকম অভ্যস্ত বিষাদ তাকে আঁকড়ে ধরেছে। তার শরীর কলকাতায় ফেরার প্রস্তুতি নিলেও, মনটা এখনও লাউখরার পাইনগাছের নিচেই রয়ে গেছে। মেঘলার সঙ্গে সময় কাটিয়ে সে বুঝতে পেরেছিল, প্রেম হয়তো আবার ফিরে আসে, যদি তাকে জায়গা দেওয়া যায়, যদি মানুষ নিজেকে উজাড় করে দিতে শেখে। কিন্তু আজ সকালে মেঘলা কোনও মেসেজ করেনি, ফোনও করেনি। শুধু গতরাতে একটা কথা বলেছিল, “ভেবেছিস তো কী চাইছি আমরা?” — সেই বাক্যটায় আজও ওর মনে অদ্ভুতভাবে বেজে চলেছে।

রিসর্ট থেকে বের হওয়ার আগে ঋতব্রত চুপচাপ একা হেঁটে গেল সেই কাফের দিকে, যেখানে প্রথম দেখা হয়েছিল। আজ আর বৃষ্টি নেই, শুধু কিছু শুকনো পাতা পড়ে আছে টেবিলের নিচে, জানালায় আলো এসে পড়েছে সরাসরি। ঠিক সেই জায়গাটায় বসে ছিল মেঘলা। পরনে ছাইরঙা কুর্তা, হাতে একটা খোলা চিঠির খাম, আর পাশে এক কাপ ব্ল্যাক কফি। ঋতব্রত কিছু বলল না। ধীরে এসে চুপ করে বসে পড়ল সামনে। মেঘলা চোখ তুলে তাকাল। “শেষ দিনে আবার এখানে?”
ঋতব্রত বলল, “শেষ বলিস না। শিলং হয়তো শেষ, কিন্তু আমরা তো…”
মেঘলা হালকা হেসে থামিয়ে দিল, “তুই জানিস, আমি আজ সকালেই ডিরেক্টরকে ফোন করেছিলাম। আমি চাইলে কোম্পানি থেকে তিন মাসের সবাটিক্যাল নিতে পারি। তুই?”
ঋতব্রত চমকে উঠল। তারপর একটু হাসল, “আমার বস তোকে আগে থেকে চেনে নাকি? আমার মেল পাওয়ার আগেই ও এক্সটেনশন মঞ্জুর করে ফেলেছে!”
দু’জনেই হেসে উঠল, সেই হাসিতে ছিল মুক্তি, অস্বস্তির কেটে যাওয়া, আর নতুন এক সম্ভাবনার আলো।

তারপর কিছুক্ষণ নীরবতা। বাইরে তখন শিলং শহরের রোদের ঝিলিক ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। শেষ দুপুর। মেঘলা কাপটা রেখে চিঠিটার দিকে ইশারা করল। “এটা আমি তোর জন্য লিখেছিলাম—যদি তুই না আসিস, যদি আমি আবার হারাই।”
ঋতব্রত চিঠিটা হাতে নিল, কিন্তু খোলেনি। বলল, “না, এখন নয়। এটা আমি কলকাতায় গিয়ে পড়ব। তোর লেখা চিঠি… তার জন্য সময় নিয়ে বসতে হয়।”
মেঘলা তার দিকে তাকিয়ে বলল, “তাহলে কী করব আমরা? এক শহরে ফিরে গিয়ে আলাদা ঘর, আলাদা অফিস, আবার নীরবতা?”
ঋতব্রতের গলায় ছিল অদ্ভুত স্পষ্টতা, “না। আমি চাই, আমাদের একটা ঠিকানা হোক, যেখানে তুই আছিস, আমি আছি, আর মাঝখানে এই পাহাড়ি বসন্তটা চিরকাল জেগে থাকে।”
মেঘলা চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকল, যেন সেই বাক্যই ছিল অপেক্ষার শেষ ধাপ।
“তুই নিশ্চিন্ত?”
“জীবনের অনেক কিছু নিয়ে নয়,” ঋতব্রত বলল, “কিন্তু তোর সঙ্গে থাকা নিয়ে আমি আজ নিশ্চিত।”

সন্ধ্যে নামার আগে মেঘলা তার হাতে হাত রাখল—নরম, দৃঢ়, গভীর।
“তাহলে চল,” সে বলল, “এবার আমরা একটা বাড়ি গড়ি—শহরের ভেতরেও একটু পাহাড়, একটু কুয়াশা, একটু শিলং রেখে।”
আর ঠিক সেই মুহূর্তে দূরে কোথাও একটা পাহাড়ি গান বেজে উঠল—পুরনো সুরে, নতুন আবেগে।

অধ্যায় ১০: বসন্ত রেখে যাই

কলকাতার আকাশটা ছিল ম্লান—অফিস বিল্ডিংয়ের মাঝে গায়ে লাগা রোদ কম, ট্রাফিক সিগন্যালে থেমে থাকা ক্লান্ত মুখ অনেক বেশি। কিন্তু তাও, আজকের বিকেলটা অন্যরকম। দক্ষিণ কলকাতার এক ছোট্ট গলিতে, একটা পুরনো দোতলা বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে মেঘলা আর ঋতব্রত। ছাদের এক কোণে তারা গড়ে তুলেছে নিজেদের নতুন ঠিকানা—একটা ছোট্ট টেরেস গার্ডেন, যেখানে কুড়ি-পঁচিশটা গাছ, একটা কাঠের বেঞ্চ, আর দেওয়ালে টাঙানো কাঠের ফ্রেমে লেখা — “যেখানে বসন্ত থেমে ছিল, আমরা শুরু করেছিলাম।” মেঘলা সেখানে একটা পুরনো বাঁশি রেখে দিয়েছে, যেটা শিলংয়ের হাট থেকে কিনেছিল। আর একটি ছোট ডায়রি — পাতাগুলো সাদা, এখন থেকে যেখানে তারা একসঙ্গে লিখবে: যন্ত্রণার গল্প নয়, বরং বাঁচার প্রতিচ্ছবি। ঋতব্রত চেয়ারটা টেনে বসে বলল, “এই শহরের মাঝে, এই একটা ছাদেই আমার শিলংটা আছে।” মেঘলা পাশে বসে বলল, “তবে তো এবার বৃষ্টি হলেও আমরা ভয় পাব না।”

বাড়ির ভেতরে তারা নিজেদের মতো গুছিয়েছে — দেওয়ালে পাইন গাছের পেইন্টিং, বেডরুমের পাশে একটা পড়ার ঘর যেখানে শেলফভরা বই, আর এক কোণে লেখার ডেস্ক। ঋতব্রতের জন্য একটা টেরাকোটা রঙের টাইপরাইটার তারা কিনেছে, যার শব্দে ফিরে এসেছে তার পুরনো কবি-মন। মেঘলা অফিস থেকে ফিরে রোজ সন্ধ্যেয় ব্যালকনিতে বসে চা খায়, আর ওদের দুজনের জীবনে ফিরিয়ে আনে সেই পাহাড়ি বিকেলের নীরবতা। তারা জানে, শহরের জগাখিচুড়ি জীবনে প্রতিদিন প্রেম লিখে যাওয়া সহজ নয়। কিন্তু প্রতিদিন যদি হাতে হাত থাকে, চোখে চোখ থাকে, আর মেঘলা যেমন বলে—“একটা গান থাকুক প্রতিদিনের শেষে”—তাহলে দিনটাও পাল্টে যায়। অফিসের ব্যস্ততা, সাবওয়ের ক্লান্তি, ট্রাফিকের যন্ত্রণা—সবকিছুর মাঝেও এই দুটো মানুষের মধ্যে থেকে গেছে এক পাহাড়ি বসন্ত। যে বসন্ত তারা শিলং থেকে বয়ে এনেছে নিজেদের মধ্যে, হৃদয়ের কোণে।

এক সন্ধ্যেয়, মেঘলা চুপচাপ ছাদে এসে বসে। এক হাতে চা, আরেক হাতে সেই চিঠিটা—যেটা ঋতব্রত শিলং থেকে ফিরেই প্রথম দিন খুলেছিল। সে আজ আবার সেটা পড়ে শুনতে চায়। মেঘলা বলে, “শুনবি?”
ঋতব্রত মাথা নাড়ে।
মেঘলা পড়ে—
“যদি তুই কখনও ফিরে আসিস, তাহলে জেনে রাখিস, আমি অপেক্ষা করিনি — আমি শুধু সেই মুহূর্তটাকে ধরে রেখেছিলাম, যখন তুই বলেছিলি ‘তুই থাকলে আমি ভয় পাই না।’ আমি জানি, আমরা হয়তো পুরনো হতে পারি না আর, কিন্তু আমরা হতে পারি নতুন গল্প। তুই যদি আমায় নিয়ে আবার ভাবতে চাস, আমি তোর পাশে আছি — ঠিক পাইনগাছের ছায়ার মতো। নড়ব না, পালাবো না, শুধু দাঁড়িয়ে থাকব, যতদিন দরকার।”
চিঠি পড়ে শেষ করে মেঘলা চুপ করে থাকে।
ঋতব্রত ধীরে করে তার হাত ধরে, বলে, “এই চিঠিটা শুধু লেখা নয়… এটা তো আমাদের জীবনের প্রতিশ্রুতি হয়ে গেল।”
তারা একসঙ্গে ছাদে বসে থাকে, আকাশে সন্ধ্যার তারা জ্বলে ওঠে। শহরের মধ্যে থেকেও তাদের মনে হয়—তারা যেন এখনও শিলংয়ের সেই বসন্তে আছে।

___

1000033724.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *