Bangla - তন্ত্র

শিবের দশম দরজা

Spread the love

রুদ্রনীল চক্রবর্তী


কলকাতার এক বর্ষণ-ভেজা সন্ধ্যা। শীতের কুয়াশা তখনও নামেনি, কিন্তু বাতাসে একটা আর্দ্র শীতলতা ভাসছে। অর্ণব মুখোপাধ্যায়, শহরের এক জনপ্রিয় দৈনিকের তরুণ অনুসন্ধানী সাংবাদিক, ডেস্কে বসে খুঁটিয়ে দেখছিলো কিছু খবরের কাটিং। বেশ কয়েকদিন ধরেই তার মন অস্থির—একটি নাম বারবার কানে আসছে, এক অদ্ভুত সংবাদ হিসেবে। নামটি—শ্রীশরণানন্দ মহারাজ। তারাপীঠের এই সাধুর সম্পর্কে শোনা যাচ্ছে এমন সব দাবি, যা সাধারণ মানুষ যেমন বিশ্বাস করতে পারছে না, তেমনি অস্বীকারও করতে পারছে না। নাকি তিনি এমন এক আচার জানেন, যা “দশম দরজা” খুলে দিতে পারে। এই দরজা, কথিত আছে, শুধু মৃত্যু-পরবর্তী আত্মাদের জন্য নয়—এটি নরক ও পৃথিবীর মাঝের গোপন পথ, যা মানবচক্ষুর জন্য নিষিদ্ধ। প্রথমে বিষয়টিকে নিছক কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিয়েছিলো অর্ণব, কিন্তু ধারাবাহিকভাবে স্থানীয় ও বহিরাগত মানুষদের মুখে একরকম বর্ণনা শুনে তার মনে প্রশ্ন জেগেছিলো। একজন সাংবাদিকের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা তার কৌতূহল, আর সেটাই তখন অর্ণবের মধ্যে ক্রমশ তীব্র হচ্ছিলো। ডেস্কে রাখা ফোনে নতুন একটি নোটিফিকেশন ভেসে উঠলো—এক স্থানীয় ব্লগে ছাপা হয়েছে, “চন্দ্রগ্রহণের রাতে মহারাজ আবার আচার করবেন।” সেই মুহূর্তে অর্ণব ঠিক করলো, সে বিষয়টি নিজে গিয়ে খতিয়ে দেখবে।

অর্ণবের মনে পড়লো, বছর কয়েক আগে সে একবার তারাপীঠ গিয়েছিলো সাধারণ ভক্তদের ভিড়ে, কিন্তু তখন শুধু মন্দিরের পূজা আর শ্মশানঘাটের ধোঁয়া ভরা দৃশ্য দেখেই ফিরে এসেছিলো। এবার তার ভ্রমণ ভিন্ন হবে—এবার সে গোপনে নজর রাখবে, খুঁজে বের করবে এই সাধুর আসল পরিচয়, আর যদি সত্যিই কিছু অদ্ভুত ঘটে, তবে সেটির প্রমাণও সংগ্রহ করবে। কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে, সে ডেস্কের নোটবুকে একটি প্রাথমিক পরিকল্পনা আঁকল—ভ্রমণের তারিখ, প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের তালিকা (ক্যামেরা, রেকর্ডার, নোটবুক), আর সম্ভাব্য যোগাযোগের নাম। তিয়াশা সেন, সহকর্মী ও বন্ধু, যার ছবি তোলার চোখ অসাধারণ এবং যিনি যুক্তিবাদী হলেও কখনও কোনও অ্যাডভেঞ্চার থেকে পিছিয়ে যান না—তাকে ফোন করে বলল, “একটা বড় কভার স্টোরি পেতে চলেছি, তুমি সাথে থাকবে?” ওপার থেকে তিয়াশার হালকা হাসি আর আগ্রহী কণ্ঠ ভেসে এলো—“শর্ত একটাই, ভূতের গল্প হলে পরে কফির বিল তুমি দেবে।” কথাটা রসিকতা হলেও, অর্ণব বুঝতে পারছিল, তার ভেতরের সাংবাদিকও এবং মানুষটিও এই যাত্রাকে সিরিয়াসলি নিচ্ছে।

যাত্রার আগের রাতটা অর্ণবের জন্য অদ্ভুতভাবে অস্থির ছিল। জানালার বাইরে অল্প বৃষ্টি পড়ছিলো, আর সেই বৃষ্টির ফোঁটায় ভিজে থাকা স্ট্রিটল্যাম্পের আলো অদ্ভুতভাবে কাঁপছিলো। তার চোখে মাঝে মাঝে যেন কিছু ছায়া নড়ে উঠছিলো—যা হয়তো ক্লান্তির ফল, কিংবা হয়তো এই যাত্রার আগাম আতঙ্ক। সে বারবার ইন্টারনেটে “দশম দরজা” শব্দগুচ্ছটি খুঁজলো, এবং পেয়েছিলো ছড়িয়ে থাকা কিছু তথ্য—পুরাণে এক রহস্যময় পথের উল্লেখ, যেটি নাকি যোগীদের ধ্যানমগ্ন অবস্থায় উপলব্ধি হয়, যেখানে নবম দরজা হল মানুষের নয়টি ইন্দ্রিয়ের প্রতীক, আর দশম দরজা সেই সীমার বাইরে। সেখানে নাকি জীবিত মানুষ গেলে ফিরে আসা কঠিন। প্রতিটি সূত্রই আংশিক, অস্পষ্ট, আর যেন ইচ্ছে করেই পূর্ণ সত্যটা লুকিয়ে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু বর্ণনা অর্ণবের মনে ভয় ধরিয়ে দিলো—যেমন, “দশম দরজা খুললে নরকবাসীরা পথ পায় পৃথিবীতে আসার, আর জীবিতদের আত্মায় তাদের ছায়া লেগে যায়।” এ ধরনের কথা, যদিও শুনতে অলৌকিক, সাংবাদিকের যুক্তিবাদী অংশকে ভাবিয়ে তুলেছিলো—এই গল্পটা যদি কেবল কুসংস্কার হয়, তবে এত মানুষ কেন একসঙ্গে একই রকম বর্ণনা দিচ্ছে?

পরের দিন সকালবেলায় ট্রেনে চেপে রওনা দিলো অর্ণব ও তিয়াশা। শহর ছেড়ে ধীরে ধীরে গ্রামীণ দৃশ্য ভেসে উঠছিলো—সবুজ মাঠ, কাদা ভরা রাস্তা, আর মাঝে মাঝে মন্দিরের শিখর। তারাপীঠের নাম শুনলেই সাধারণ মানুষের মনে দেবী তারা, ভক্তির আবহ, আর তান্ত্রিক আচার ভেসে ওঠে; কিন্তু অর্ণবের মাথায় তখন ঘুরছিলো শ্রীশরণানন্দ মহারাজের মুখ, যিনি হয়তো তাকে এমন কিছু দেখাবেন, যা দেখা উচিত নয়। গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছতেই শ্মশানের ধোঁয়া মিশে থাকা বাতাস নাকে এলো, সাথে ভেসে এলো ধাতব ঘণ্টার শব্দ আর কিছু অদ্ভুত মন্ত্রোচ্চারণের আওয়াজ। তিয়াশা জানালার বাইরে তাকিয়ে বলল, “এই শহরটা যেন দিনের আলোতেও রাতে ঢেকে আছে।” অর্ণব নীরব রইলো, তার চোখে তখন একধরনের কৌতূহল আর অজানা ভয়ের মিশেল—কারণ সে জানে, এই যাত্রা হয়তো তার ক্যারিয়ারের সেরা স্টোরি এনে দেবে, আবার হয়তো এমন কিছু ছুঁয়ে দেবে যা থেকে ফিরে আসা সম্ভব নয়।

তারাপীঠে পৌঁছানোর পরই অর্ণব ও তিয়াশা বুঝে গেল, এখানে বাতাসের ঘনত্ব যেন কলকাতার চেয়ে আলাদা—একধরনের অদৃশ্য ভার আর মাটির সঙ্গে মিশে থাকা ধোঁয়ার গন্ধ। বিকেলের আলো তখন ক্রমশ নরম হয়ে আসছে, মন্দির চত্বরের ভিড় ধীরে ধীরে কমছে। দেবী তারার মূর্তির সামনে সিঁদুরে রঙ মেখে ভক্তরা প্রণাম করছে, দূরে শ্মশানঘাটের দিক থেকে ভেসে আসছে ঢাক-ঢোল আর তন্ত্রমন্ত্রের মিলেমিশে যাওয়া শব্দ। অর্ণব ক্যামেরা হাতে নিয়ে মন্দিরের গলিগুলো ঘুরে দেখছিলো—এখানে প্রতিটি দেওয়ালে, দোকানে, এমনকি চায়ের দোকানের বেঞ্চিতেও কোনও না কোনও ভক্তি-তন্ত্রের চিহ্ন। তিয়াশা তার ক্যামেরায় কিছু শট নিচ্ছিলো, কিন্তু তার চোখ বারবার মন্দিরের উত্তর দিকের গলিতে আটকে যাচ্ছিলো। সেখানে আলো কম, আর অদ্ভুতভাবে মনে হচ্ছিলো—ছায়াগুলো যেন একে অপরকে ছাড়িয়ে চলেছে, যেন কেবল মানুষের তৈরি নয়, বরং নিজেরাই চলাফেরা করছে। প্রথমে মনে হলো, হয়তো হাওয়ায় উড়তে থাকা কাপড়ের নড়াচড়া বা দূরের আগুনের প্রতিফলন, কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পর তিয়াশা ধীরে বলে উঠলো, “ওগুলো মানুষ নয়… আমি কেবল লেন্স দিয়ে না, খালি চোখেও দেখছি।” অর্ণব এক ঝলক তাকিয়ে দেখলো—অস্পষ্ট, কুয়াশার মতো ছায়ারা গলির মুখ থেকে শ্মশানের দিকে ধীরে ভেসে যাচ্ছে, আর অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে।

মন্দির চত্বর ছেড়ে তারা দু’জনে শ্মশানের দিকে হাঁটা দিলো। রাস্তার দুই পাশে দোকানগুলো বন্ধ হতে শুরু করেছে, শুধু কয়েকটা আগরবাতি আর প্রদীপ জ্বলছে, যার আলোয় মানুষের মুখে অদ্ভুত ছায়া পড়ছে। শ্মশানের ধারে পৌঁছাতেই এক মধ্যবয়স্ক মানুষ এগিয়ে এসে তাদের পথ রোধ করলো—মাধব পাল, স্থানীয় গাইড। সে কিছুটা সতর্ক দৃষ্টিতে তাদের দেখলো, যেন মেপে নিচ্ছে এরা পর্যটক নাকি অন্য উদ্দেশ্যে এসেছে। অর্ণব নিজের পরিচয় গোপন রেখে শুধু বললো, তারা তারাপীঠের তন্ত্রকথা নিয়ে কিছু ছবি তুলতে এসেছে। মাধব গম্ভীর গলায় বললো, “দিনের বেলা এখানে যা খুশি করতে পারেন, কিন্তু রাত হলে সাবধান। শ্মশানের ছায়া মানুষের নয়।” তিয়াশা মৃদু হাসি দিয়ে বলল, “মানুষের নয় মানে? ভূত?” মাধবের চোখে ঝলক দেখা গেল, সে কাছে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল, “শ্রীশরণানন্দ মহারাজের আচার যখন চন্দ্রগ্রহণের রাতে হয়, তখন ‘দশম দরজা’র ছায়ারা বের হয়। ওরা কারও ক্ষতি করে না, কিন্তু যদি আপনার ছায়ায় মিশে যায়… তখন থেকে আর আপনি মুক্ত নন।” অর্ণব তৎক্ষণাৎ রেকর্ডার চালু করলো, কিন্তু মাধব হাত তুলে থামিয়ে দিলো—“এই কথাগুলো লেখা বা শোনানো যায় না, স্যার। শুধু দেখা যায়।”

রাত নেমে আসার সাথে সাথে শ্মশানের চারপাশ যেন অন্য এক জগতে ঢুকে পড়লো। আগুনের লালচে আলো দূরে টিমটিম করছে, ধোঁয়া মাটির ওপর ঝুলে আছে, আর দূরের বৃক্ষগুলো যেন কালো প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। অর্ণব লক্ষ্য করলো, প্রতিটি ছায়া নির্দিষ্ট কোনও পথ ধরে চলছে—মন্দিরের দিক থেকে শ্মশানের দিকে, যেন কোনও অদৃশ্য ডাকে সাড়া দিয়ে। তিয়াশা তার লেন্সে জুম করে দেখলো, কিছু ছায়া আবার মানুষের দেহের ভেতর দিয়ে চলে যাচ্ছে, কিন্তু কেউ তা বুঝতেও পারছে না। অর্ণবের মনে হচ্ছিলো, সে যেন নিজের চোখে এমন কিছু দেখছে যা আগে শুধু গল্পে শুনেছে। মাধব তাদের নিয়ে শ্মশানের এক কোণে দাঁড় করিয়ে দিলো, যেখানে একটি কালো পাথরের ফটক আছে—ফটকের ওপারে গভীর অন্ধকার, যেন আলো সেখানে ঢুকতে ভয় পাচ্ছে। “এটাই সেই পথ,” মাধব ফিসফিস করে বললো, “চন্দ্রগ্রহণের রাতে মহারাজ এখানে বসেন, আর আচার শুরু করেন। তখন ফটকের ওপারে যা আছে, তা এই পৃথিবীর নয়।” তার গলায় আতঙ্ক আর ভক্তির মিশেল স্পষ্ট ছিলো।

তাদের আলাপ চলছিলো, ঠিক তখনই তিয়াশা ক্যামেরা তোলে একটি ছবি তুললো—শাটারের শব্দের সাথে সাথে সে থমকে গেল। ডিসপ্লেতে দেখা গেল, ফটকের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে এক ছায়ামূর্তি, যার কোনও স্পষ্ট মুখ নেই, কিন্তু দুটো চোখে অস্বাভাবিক সাদা আলো। অর্ণব ছবিটি দেখে প্রথমে ভাবলো, হয়তো লেন্সে আলো পড়ে প্রতিফলন তৈরি হয়েছে। কিন্তু তিয়াশা মাথা নেড়ে বললো, “না… এটা আমি খালি চোখেও দেখেছি। আর ওটা আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল।” হাওয়ায় তখন ঠান্ডা বেড়ে গেছে, আর শ্মশানের ওপরে হঠাৎ করে ঘন কুয়াশা নেমে এসেছে। মাধব দ্রুত তাদের মন্দিরের দিকে ফেরার তাগিদ দিলো—“আজ পূর্ণিমা, আজও ওরা বের হয়। কিন্তু চন্দ্রগ্রহণের রাতে… তখন আপনারা এখানে থাকতে চাইবেন না।” ফেরার পথে অর্ণবের মনে হচ্ছিলো, আজ রাতের এই ছায়াগুলো শুধু প্রস্তাবনা—আসল কাহিনি, আসল আতঙ্ক, এখনও বাকি।

পরদিন ভোরে, মন্দিরের পিছনের সরু গলি পেরিয়ে অর্ণব ও তিয়াশা পৌঁছালো শ্রীশরণানন্দ মহারাজের আশ্রমে। আশ্রম বলতে একতলা মাটির ঘর, চারপাশে নিমগাছ আর তুলসী গাছের বেড়া, আর উঠোনের এক পাশে মাটির চুল্লিতে ধোঁয়া উড়ছে। ভেতরে প্রবেশ করতেই ধূপের ঘন গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠলো। তক্তার ওপর বসে আছেন মহারাজ—দীর্ঘ, শীর্ণ দেহ, কপালে বড় লাল সিঁদুরের টিপ, চুল জটা বেঁধে মাথার ওপরে তুলে রাখা। তার চোখদুটি স্থির, কিন্তু সেই স্থিরতায় এমন এক গভীরতা আছে যেন চোখের ভেতর দিয়ে অর্ণবকে ছিঁড়ে ফেলছে। প্রথমে কোনও কথা না বলে, মহারাজ শুধু তাকিয়ে রইলেন। অর্ণব গলা শুকিয়ে আসা অনুভব করলো, আর তিয়াশা তার ক্যামেরা নামিয়ে রাখলো, যেন এই নীরবতা ভাঙা ঠিক হবে না। কিছুক্ষণ পর মহারাজ ধীরস্বরে বললেন, “তুমি এসেছো প্রশ্ন নিয়ে… কিন্তু সব উত্তর তোমার পক্ষে শোনা ঠিক হবে না।” এই প্রথম অর্ণব বুঝলো, তার কণ্ঠে এমন এক সুর আছে, যা ভক্তি জাগায় না, বরং ভয় ধরিয়ে দেয়—যেন প্রতিটি শব্দ কোনও গভীর গহ্বর থেকে উঠে আসছে।

অর্ণব নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, “আমি শুনেছি, আপনি ‘দশম দরজা’ খুলতে পারেন। এটা কি সত্যি?” মহারাজের ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটলো, কিন্তু সেই হাসি কোনও উষ্ণতার ছিলো না—বরং তা ছিলো যেন সতর্কবার্তা। “সত্যি কি, মিথ্যে কি—তোমার বোধগম্যের বাইরে। কিন্তু হ্যাঁ, দশম দরজা একবার খোলা মানে, সবসময় ফিরে আসার পথ খোলা থাকবে না।” অর্ণব প্রশ্ন করলো, “আপনি বলতে চাইছেন, যারা ওই দরজার ওপারে যায়, তারা আর ফিরে আসতে পারে না?” মহারাজ মাথা নাড়লেন, “কিছু ফিরে আসে… কিন্তু যা ফিরে আসে, তা আর আগের মতো থাকে না। কখনও মানুষ, কখনও শুধু ছায়া।” এই কথায় তিয়াশার চোখ বড় হয়ে গেল, কিন্তু সে চুপ করে রইলো। আশ্রমের ভেতর তখন হঠাৎ করে বাতাস বইতে লাগলো, যদিও জানালাগুলো বন্ধ। ধূপের ধোঁয়া ঘূর্ণি খেয়ে ছাদের দিকে উঠছিলো, আর এক মুহূর্তের জন্য অর্ণব দেখলো—মহারাজের পেছনের দেওয়ালে ধোঁয়ার ভেতর একটি দরজার অস্পষ্ট ছায়া ফুটে উঠেছে।

মহারাজ হাতের আঙুল দিয়ে বাতাসে এক অদ্ভুত চিহ্ন আঁকলেন, আর সঙ্গে সঙ্গে সেই ধোঁয়ার ছায়া মিলিয়ে গেল। তারপর তিনি বললেন, “দশম দরজা কোনও কাহিনি নয়। প্রতিটি মানুষের মধ্যে নয়টি দরজা আছে—চোখ, কান, নাক, মুখ, প্রজননেন্দ্রিয়, আর বর্জনেন্দ্রিয়। কিন্তু দশম দরজা… তা আত্মার পথ। যোগীরা ধ্যানে সেই পথে যায়, কিন্তু তন্ত্রের মাধ্যমে তাকে জাগিয়ে তোলা যায় এই পৃথিবীতেও। সমস্যা হল, একবার খুলে দিলে, সেই পথ দিয়ে কেবল যাওয়া নয়—আসাও শুরু হয়। আর যারা আসে, তারা আলো খোঁজে না, তারা ছায়া খোঁজে।” অর্ণব মনোযোগ দিয়ে প্রতিটি কথা মনে রাখছিলো, যেন শব্দগুলোর ভেতরে লুকিয়ে থাকা কোনও সূত্র খুঁজে পাবে। মহারাজ তাকে সরাসরি তাকিয়ে বললেন, “তুমি দেখতে চাও… তাই না? কিন্তু যদি দেখো, আর তোমার ছায়ায় তারা মিশে যায়, তখন তুমি আর আগের তুমি থাকবে না।” এই কথা বলার সময় মহারাজের চোখে এমন এক জ্যোতি ছিলো, যা অর্ণবের বুকের ভেতর ঠান্ডা স্রোত বয়ে দিলো।

আলাপ শেষ হওয়ার আগে মহারাজ শুধু একটি শর্ত দিলেন—“চন্দ্রগ্রহণের রাতে শ্মশানের ফটকের কাছে আসো, যদি সাহস থাকে। কিন্তু মনে রেখো, আমি তোমাকে ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দেবো না।” তিয়াশা দ্রুত নোট নিচ্ছিলো, কিন্তু তার হাতের লেখা কেঁপে যাচ্ছিলো, যেন কেবল শব্দ নয়, ভয়েরও ছাপ কাগজে পড়ছে। তারা বিদায় নিয়ে বাইরে এল, আর আশ্রমের দরজা পেরোতেই অর্ণব অনুভব করলো, ভিতরের গন্ধ, শব্দ, এমনকি আলো—সবই যেন তার চামড়ায় লেগে আছে। রাস্তা দিয়ে ফেরার সময় তিয়াশা বললো, “ওনার চোখে এমন কিছু ছিলো… যেন আমার মনের ভেতর ঢুকে গেছে।” অর্ণব কোনও উত্তর দিলো না, শুধু মনে মনে ভাবলো—এখন আর ফেরার পথ নেই, কারণ সে জানে, চন্দ্রগ্রহণের রাতে সে অবশ্যই শ্মশানে যাবে, সেই দরজা খোলার মুহূর্ত দেখতে। কিন্তু মহারাজের কথার প্রতিধ্বনি তখনও কানে বাজছিলো—“ফিরে আসার পথ সবসময় খোলা থাকবে না।”

চন্দ্রগ্রহণের আগের রাত। তারাপীঠের আকাশে তখন একরকম চাপা উত্তেজনা, যেন পুরো শহরই নিঃশ্বাস আটকে আছে। দিনের ভিড় অনেক আগেই সরে গেছে, দোকানপাট বন্ধ, আর বাতাসে মিশে আছে মোমবাতি, ধূপ আর গঙ্গাজলের গন্ধ। অর্ণব ও তিয়াশা মাধবের সঙ্গে বসে আছে এক ছোট্ট চায়ের দোকানের পরিত্যক্ত বেঞ্চিতে। চারপাশে ভৌতিক নীরবতা, দূরে শুধু শ্মশানঘাটের দিক থেকে আসা শিয়ালের ডাক। মাধব ফিসফিস করে বলল, “মহারাজ বলেছেন, রাত বারোটায় ফটকের কাছে প্রস্তুত থাকতে। কিন্তু শোনো স্যার, ও আচার যদি শেষ পর্যন্ত চলে, আর তুমি তা দেখতে থাকো… পরে আর স্বাভাবিক থাকতে পারবে না। আমি এমন লোক দেখেছি যারা দেখার পর নিজের ছায়াকে আর বিশ্বাস করতে পারেনি।” তার গলায় ছিলো আতঙ্কের স্পষ্ট ছাপ। অর্ণব নিজের নোটপ্যাডে তার কথা লিখে রাখলো, কিন্তু মনে মনে ঠিক করলো, যাই হোক না কেন, এই সুযোগ হাতছাড়া করবে না। তিয়াশা কফির চুমুক দিয়ে বলল, “ভয় পেলে তো কোনও গল্পই হবে না। আমি আমার ক্যামেরা নিয়ে থাকবো, আর যা হবে তোলা হবে।” তবু তার কণ্ঠে ছিলো একধরনের অস্বস্তি, যা সে লুকাতে পারছিলো না।

রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আকাশে চাঁদ ধীরে ধীরে ফিকে হতে লাগলো, একধরনের লালচে আভা ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। তারা তিনজন ধীরে ধীরে মন্দিরের উত্তরদিকের সরু গলি দিয়ে এগিয়ে গেলো, যেখানে আলো প্রায় পৌঁছায় না। গলির শেষে শ্মশানের ফটক—কালো, সময়ে ক্ষয়ে যাওয়া পাথরের দরজা, যার ওপর খোদাই করা অদ্ভুত প্রতীকগুলো চাঁদের আলোয় ম্লানভাবে ঝলমল করছে। ফটকের ওপারে অন্ধকার, কুয়াশা, আর লালচে আগুনের টিমটিমে আলো। মহারাজ তখনও আসেননি, কিন্তু মাটিতে আগে থেকেই সাজানো আছে আচার সামগ্রী—লাল কাপড়ের ওপর রাখা শ্মশানের ছাই, মানবখুলি, পিতলের প্রদীপ, আর কালো তেলের কুপির সারি। প্রতিটি উপকরণ নিখুঁতভাবে গুচ্ছ করে রাখা, যেন কোনও অদৃশ্য নিয়ম মেনে। অর্ণব এই দৃশ্যের প্রতিটি খুঁটিনাটি খেয়াল করছিলো, তার সাংবাদিকসুলভ অভ্যাসে। তিয়াশা ইতিমধ্যে তার ক্যামেরা দিয়ে কোণ বদলে বদলে শট নিতে শুরু করলো, কিন্তু প্রতিবার শাটারের শব্দ যেন আশেপাশের অন্ধকারকে খানিকটা ভারী করে তুলছিলো।

মাধব দাঁড়িয়ে থেকে প্রায় বিড়বিড় করছিলো, “এখনও সময় আছে, ফিরে যাও। মহারাজের আচার শেষ হয় মানে কেবল দরজা খোলা নয়—ওপারের কিছু আসা শুরু হবে।” তার চোখে একধরনের ব্যক্তিগত আতঙ্ক ছিলো, যেন সে নিজেই একসময় এমন কিছু দেখে এসেছে যা তাকে পাল্টে দিয়েছে। কিন্তু অর্ণব তাকে প্রায় উপেক্ষা করলো, মন তার ফটকের ওপারের অদৃশ্য জগতে। কিছুক্ষণ পর দূর থেকে ভেসে এলো মন্ত্রোচ্চারণের সুর—ধীর, গম্ভীর, আর ভেতরে কাঁপন ধরিয়ে দেওয়ার মতো ছন্দ। অন্ধকারের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলেন মহারাজ—তার গায়ে রক্তিম বসন, কপালে নতুন সিঁদুর, আর হাতে এক পিতলের ঘণ্টা। প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে ঘণ্টার ধ্বনি আর মন্ত্র মিলেমিশে এক অদ্ভুত আবহ তৈরি করছিলো। তিনি এসে ফটকের সামনে বসে পড়লেন, আর আচার শুরু হল। তেলের কুপিতে আগুন ধরানো হলো, যা লাল আভা ছড়িয়ে ফটকের খোদাইগুলোকে জীবন্ত করে তুললো। তিয়াশা শাটার টিপলো, কিন্তু হঠাৎ তার চোখে পড়লো—ছবিতে মহারাজের চারপাশে অদৃশ্য ছায়া যেন ঘুরপাক খাচ্ছে, যদিও খালি চোখে কিছু দেখা যাচ্ছে না।

সময় যেন ধীরে চলতে লাগলো। মন্ত্রের গতি বাড়তে লাগলো, ফটকের ওপাশের কুয়াশা ঘন হয়ে উঠলো, আর বাতাস ঠান্ডা থেকে বরফশীতল হয়ে গেলো। অর্ণবের মনে হচ্ছিলো, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, যেন অদৃশ্য কোনও শক্তি তাকে চেপে ধরছে। মহারাজ একসময় চোখ খুললেন, আর সেই গভীর দৃষ্টিতে অর্ণবের বুকের ভেতর দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো। তিনি হঠাৎ উচ্চস্বরে বললেন, “সময় এসেছে।” সেই মুহূর্তে ফটকের ওপাশ থেকে আসলো এক দীর্ঘ, গভীর শব্দ—না কোনও পশুর, না কোনও মানুষের, বরং এমন কিছু যা এই পৃথিবীর নয়। তিয়াশা এক মুহূর্তের জন্য ক্যামেরা নামিয়ে রাখলো, আর ফিসফিস করে বললো, “তুমি শুনলে?” অর্ণব মাথা নাড়লো, কিন্তু তার চোখ তখন ফটকের ওপর আটকে। কুয়াশার মধ্যে ধীরে ধীরে এক আকৃতি ফুটে উঠছিলো—স্পষ্ট নয়, কিন্তু তাতে মানুষের চেয়েও লম্বা, অস্বাভাবিকভাবে বিকৃত কিছু দাঁড়িয়ে আছে। মাধব এক পা পিছিয়ে গেলো, মুখ ঢেকে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়তে লাগলো। রাত তখন শুধু অন্ধকার নয়, বরং এমন এক প্রহেলিকার দরজা খুলতে চলেছে, যেটি দেখা মানেই আর আগের জীবনে ফেরা সম্ভব নয়।

মন্ত্রোচ্চারণের গতি ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠছিলো। ধূপের গন্ধ এত ঘন হয়ে গেছে যে শ্বাস নিতেই মনে হচ্ছিলো গলা ও ফুসফুস ছাইয়ে ভরে যাচ্ছে। মহারাজের চোখ তখন শক্ত করে বন্ধ, কপাল থেকে ঘাম ঝরছে, কিন্তু ঠোঁট অবিরাম নড়ছে, শব্দে যেন অদ্ভুত টান—একটা সুর যা মানুষের কানে পৌঁছালেও মনে হয় যেন মাথার ভেতর থেকে উঠছে। তার চারপাশে সাজানো ছাইয়ের বৃত্ত ধীরে ধীরে হালকা ধোঁয়া ছাড়তে শুরু করলো, যা ফটকের দিক দিয়ে গিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছিলো। হঠাৎ অর্ণব অনুভব করলো—তার চারপাশের অন্ধকার আর আগের মতো নেই, বরং এক অদ্ভুত চাপ তৈরি হয়েছে, যেন বাতাসের ভেতরে কিছু অদৃশ্য ভারী হয়ে উঠছে। চোখের সামনে, মহারাজের ঠিক পেছনে ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে এক লম্বা কালো ফটক ফুটে উঠতে লাগলো। প্রথমে অস্পষ্ট, তারপর ধীরে ধীরে স্পষ্টতর—দুটি উঁচু, কালো লোহার পাতের মতো দরজা, যার ওপর খোদাই করা আছে অদ্ভুত প্রতীক, যা চোখে পড়ামাত্র মনে হয় ভুলে গিয়েছিলে, অথচ চেনা। সেই ফটকের ওপাশ থেকে ভেসে আসছিলো ফিসফিস শব্দ, যেন হাজার মানুষ একসঙ্গে কোনও গোপন কথা বলছে, আর মাঝে মাঝে সেই ফিসফিসের ফাঁক দিয়ে উঠে আসছিলো এক তীক্ষ্ণ, বেদনাভরা চিৎকার, যা সরাসরি অর্ণবের মেরুদণ্ডে ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দিলো।

অর্ণব স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে, কিন্তু তার পাশের তিয়াশা যেন কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। সে অবাক হয়ে বললো, “কিসের দিকে তাকিয়ে আছো তুমি? ওখানে তো কিছু নেই।” অর্ণব উত্তর দিতে পারলো না, কারণ তার চোখ সেই ফটক থেকে সরছে না। তিয়াশা ক্যামেরা তুলে লেন্স ঠিক করলো—এবং হঠাৎ তার নিঃশ্বাস আটকে গেল। ফটক খালি চোখে তার কাছে অদৃশ্য হলেও, ক্যামেরার ডিসপ্লেতে এক ঝলক দেখা গেল সেটি—অস্পষ্ট, অন্ধকারে মোড়া, কিন্তু স্পষ্টতই লম্বা ও বিকট। তিয়াশা শাটার টিপলো, কিন্তু পরের মুহূর্তেই ডিসপ্লে কালো হয়ে গেল, যেন ক্যামেরা নিজেই ছবি তুলতে অস্বীকার করছে। সে হালকা গলা কাঁপিয়ে বললো, “আমি কিছু… কিছু দেখেছি, কিন্তু সেটা যেন আমার চোখের জন্য নয়।” অর্ণব এবার তার দিকে তাকালো, আর দেখলো তার মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট, তবু কৌতূহল তাকে ঠেকাতে পারছে না।

মহারাজ তখনও মন্ত্রপাঠে নিমগ্ন, কিন্তু তার মুখের ভঙ্গি বদলে গেছে—ঠোঁটের কোণে হালকা টান, কপালে ভাঁজ, যেন তিনি ভেতরের কিছু প্রতিরোধ করছেন। ধোঁয়ার ভেতর ফটক আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে, আর তার দুই দিকের প্রতীকগুলো যেন নড়ছে, পরিবর্তিত হচ্ছে, ঠিক যেমন স্বপ্নে ছবি হঠাৎ আকার বদলে ফেলে। ফটকের ওপাশের শব্দ এবার আরও পরিষ্কার—কেউ যেন ধাক্কা মারছে, ধাতুর শব্দে কেঁপে উঠছে দরজা। অর্ণবের বুকের ভেতর ধপধপানি বাড়ছে, তবু তার চোখে এক অদ্ভুত আকর্ষণ—যেন এই দৃশ্য দেখা তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। হঠাৎ তার মনে হলো, ফটকের ফাঁক দিয়ে কেউ তাকে দেখছে—দুটি চোখ, অস্বাভাবিক লম্বাটে, গভীর কালো, কিন্তু তার মধ্যেই অদ্ভুত জ্যোতি। সেই দৃষ্টি এত গভীর যে মনে হচ্ছিলো, মুহূর্তে তার সমস্ত স্মৃতি, ভয়, আশা—সবকিছু ওই চোখে গলে যাচ্ছে।

এক ঝলকের মতো দৃশ্য বদলে গেল। অর্ণব দেখলো, ফটকের পেছনে এক ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে—মানুষের মতো, তবু কোনওভাবেই মানুষ নয়। তার দেহ লম্বা, হাত-পা অস্বাভাবিকভাবে সরু, আর প্রতিটি নড়াচড়ায় যেন ধোঁয়া উঠে আসে। হঠাৎ ফটকের একপাশ নড়ে উঠলো, আর সেই সঙ্গে মহারাজের কণ্ঠ আরও উচ্চস্বরে উঠলো, যেন তিনি ফটকের ভেতরের কিছুকে ঠেকানোর জন্য লড়াই করছেন। তিয়াশা ক্যামেরা তুললো, কিন্তু এবার লেন্সে শুধু ঘূর্ণায়মান অন্ধকার—কোনও আকার নেই, তবু এমন এক শক্তি আছে যা স্ক্রিনের মাধ্যমে চোখে গিয়ে বিঁধছে। মাধব ফিসফিস করে মন্ত্র পড়ছে, আর ধীরে ধীরে পিছিয়ে যাচ্ছে, যেন আরেক মুহূর্ত থাকলেই সে নিজের মানসিক ভারসাম্য হারাবে। আর ঠিক তখনই, অর্ণবের মনে হলো—ফটকের ওপাশ থেকে তার নাম ডাকা হয়েছে, একবার নয়, দু’বার। শব্দটি এত পরিচিত, এত ব্যক্তিগত, যে সে নিশ্চিত, কেউ তার অতীত থেকে ডাকছে। কিন্তু সেই স্বর ছিলো একেবারেই মানবিক নয়—একটি শব্দে লুকিয়ে ছিলো অন্তহীন শূন্যতার ঠান্ডা প্রতিধ্বনি।

আচার শেষ হওয়ার পর শ্মশানের বাতাস যেন আরও ভারী হয়ে গেছে। ধোঁয়া এখনও ভেসে বেড়াচ্ছিল, মাটির ওপর লালচে আলো আর ধোঁয়ায় মিলেমিশে এক অদ্ভুত ছায়াময় পরিবেশ তৈরি করেছে। অর্ণব প্রথমে অনুভব করলো—কোনও হাওয়া নেই, তবু তার চারপাশের ছায়াগুলো কেবল স্থির নেই। মানুষজনের স্বাভাবিক ছায়া নয়, বরং কিছু দীর্ঘ, বিকৃত, অদৃশ্য শক্তি দ্বারা পরিচালিত। প্রতিটি পা ফেলে যেতেই মনে হচ্ছিলো, কারো অদৃশ্য হাত তার পেছনে ধরে রাখছে। গলির বাতাসে বাতাসের মতো ভেসে যাচ্ছে ফিসফিস—কেউ কেউ মনে করেছিলো, তার নিজের নাম বলা হচ্ছে। অর্ণব স্থির হয়ে দাড়ালো, মনে হচ্ছে, চারপাশের মানুষরা শুধু চলাফেরা করছে না, বরং তাদের সঙ্গে অদৃশ্য কেউ চলছে।

তিয়াশা ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলছে, আর প্রতিটি শটেই ধরা পড়ছে অদ্ভুত ছায়া। কখনও মানুষের লম্বা ছায়া, কখনও ভগ্নাংশে ভাঙা, যেন কেউ গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু অর্ণবের চোখে কিছু দেখা যাচ্ছে না। সে অনুভব করলো, প্রতিটি ছায়া তার নজরে সরাসরি প্রভাব ফেলছে। হঠাৎ একটি ছায়া অর্ণবের পায়ের দিকে নেমে এলো, এবং মনে হলো, শ্বাস আটকে গেল। সে ঘুরে তাকালো—কিছু নেই, শুধু ফাঁকা গলি। তবু অনুভূতিটি অদৃশ্য, শক্তিশালী, যে তাকে বলছে—তুমি আর একা নয়। এই ছায়াগুলো তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে, প্রত্যেকটি মানুষকে আলাদা করে টেনে নিচ্ছে অদৃশ্য পথে। মাধব, যিনি কাছেই দাঁড়িয়ে আছে, চোখ বড় করে বললেন, “তুমি দেখতে পেলে, ধরে ফেলো না—তারা নিজেরাই চলে যাবে না।”

রাস্তায় হেঁটে যেতে যেতে অর্ণব লক্ষ্য করলো, সাধারণ মানুষও কিছুটা অচেতনভাবে ছায়ার প্রভাব অনুভব করছে। কেউ হঠাৎ দিকে দিকে তাকাচ্ছে, কেউ দ্রুত পা বাড়াচ্ছে। প্রতিটি মানুষের পাশ দিয়ে অদৃশ্য লম্বা ছায়া এগোচ্ছে, কখনও ধীরে, কখনও হঠাৎ করে। অর্ণব বুঝতে পারলো, দশম দরজার আভা শুধু এক ব্যক্তির নয়, এটি ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে—যেন শহরের বাতাস, আলো, এবং মানুষের শরীরের সঙ্গে মিশে গেছে। তিয়াশা তার ক্যামেরায় সবকিছু লুকিয়ে ফেলছে—ফলে ছবি শুধু বাস্তব নয়, বরং এক অদৃশ্য সত্তার উপস্থিতিও ফুটে উঠছে। অর্ণবের মনে হচ্ছিলো, এটি কেবল চাক্ষুষ নয়, বরং মানসিক স্তরে আঘাত করছে—যে কেউ এই দৃশ্য দেখছে, সে আর আগের মতো থাকবে না।

ফটকের অভিশাপ যেন ধীরে ধীরে ঢুকে গেছে অর্ণবের ভেতরেও। প্রতিটি ধাপ, প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি দৃষ্টিপাত—সবকিছু যেন তার মনকে টেনে নিচ্ছে অন্য এক বাস্তবতার দিকে। সে ঘুরে তাকাল, তিয়াশার চোখেও আতঙ্ক, কিন্তু ক্যামেরার লেন্সে দৃশ্যটি আরও রহস্যময়। শীতল বাতাসে হঠাৎ এক ফিসফিসানি ভেসে এলো—অরণ্য, নদী, শ্মশান, গলিসহ সমস্ত জায়গায় ছায়ার আওয়াজ। অর্ণব অনুভব করলো, ফটকের ওপারের সেই দরজা শুধু একবার খোলা হয়নি, বরং তার প্রভাব ইতিমধ্যেই চারপাশ ছড়িয়ে পড়েছে। শহরের আলো, মানুষের ছায়া, বাতাস—সবকিছু যেন নতুন রূপ নেয়, আর অর্ণব বুঝতে পারলো, যে অভিশাপ তার ওপর বসেছে, তা শুধুই প্রারম্ভ।

রাতের গভীর অন্ধকারে তারাপীঠের সরু গলিপথ অর্ণবের পদচারণায় কম্পিত হয়ে উঠলো। চারপাশে নিস্তব্ধতা, শুধু দূরের নদীর জল আর কিছু অদ্ভুত ফিসফিসানি ভেসে আসছিল। হঠাৎ অর্ণব অনুভব করলো—কেউ তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ঘুরে তাকাতে সে পেল এক সাদা শাড়ি পরা নারী, যার চোখে অদ্ভুত দীপ্তি, মুখে শান্ত অথচ গভীর রহস্য। প্রথমবারের মতো অর্ণবের মনে হলো—কেউ সত্যিই তার সঙ্গে কথা বলছে, অথচ চারপাশের কেউ তাকে দেখছে না। নারীটি ধীরস্বরে বলল, “আমি অনামিকা। তুমি দেখছ, কিন্তু তারা যা দেখছে তা দেখছো না। দশম দরজা শুধু পথ খুলে দেয় না; যারা প্রহরী, তারা মুক্ত হয়, এবং ছায়ার আকারে মানুষের চারপাশে ঘোরে।” অর্ণব অবাক হয়ে চোখ বড় করলো, মনে হলো—সে কি স্বপ্ন দেখছে, নাকি বাস্তবের সঙ্গে মিশে গেছে কোনও অতিপ্রাকৃত ঘটনা।

অনামিকার কথায় অর্ণব অনুভব করলো, দশম দরজার প্রভাব শুধুই ফটকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তার চারপাশের মানুষ, রাস্তাঘাট, লণ্ঠনের আলো—সবকিছু যেন ধীরে ধীরে ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছে। অনামিকা এগিয়ে এল, তার পদচারণায় মাটি কম্পিত হলো না, অথচ অদৃশ্য শক্তির ছোঁয়া তার চারপাশে ছড়িয়ে পড়লো। সে বলল, “তুমি যে ছায়াগুলো দেখছো, সেগুলো প্রহরীদের। তারা একসময় মানুষের মধ্যে আবদ্ধ ছিলো, কিন্তু দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে তারা মুক্ত হয়েছে। এখন তারা তোমার সঙ্গে আছে, তোমার চোখে দেখা যায়, কিন্তু তারা স্পর্শ করে না—যা স্পর্শ করবে, তা তোমার মানসিক ভারসাম্য।” অর্ণব গভীর নিঃশ্বাস নিলো। তার মনে হচ্ছিলো, এই নারীর উপস্থিতি অদ্ভুতভাবে ভয়ঙ্কর, কিন্তু একধরনের কৌতূহলও জাগাচ্ছে—যেন এই রহস্য উন্মোচন না করলে সে নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবেই খুঁজে পাবে না।

অনামিকা ধীরে অর্ণবের দিকে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল, “দরজার ওপারের শক্তি শুধুমাত্র অস্পষ্ট নয়, এটি মানুষের মনে প্রভাব ফেলে। কেউ যদি দরজা দেখার সময় ভয় পায়, তার ছায়া বিকৃত হয়ে যায়; কেউ সাহসী হলে, তার ছায়া শক্তিশালী হয়, কিন্তু সবই নিয়ন্ত্রণের বাইরে।” অর্ণব বুঝতে পারলো, শহরের প্রতিটি অন্ধকার কোণ, প্রতিটি সরু গলি এখন একধরনের অদৃশ্য প্রহরীর আবাস। অনামিকার কথা শুনতে শুনতে সে লক্ষ্য করলো—পাশের কয়েকজন মানুষও যাদের সে আগের রাতে স্বাভাবিক মনে করেছিলো, তাদের ছায়া হঠাৎ অদ্ভুতভাবে লম্বা, বিকৃত এবং স্থির নয়—নড়ছে, ঘুরছে, যেন নিজের ইচ্ছায় নয়, বরং দরজার প্রভাব দ্বারা পরিচালিত। তিয়াশা ক্যামেরা দিয়ে আবারও ছবি তুললো, কিন্তু ডিসপ্লেতে দেখা গেল—ছবিতে অনামিকা অদৃশ্য, অথচ অর্ণবের চোখে স্পষ্ট।

অনামিকা আরও একটি সতর্কবার্তা দিলো—“যতক্ষণ দরজা খোলা আছে, প্রহরীরা ভ্রমণ করে। তোমার চোখ তাদের দেখতে পাবে, কিন্তু তারা তোমার নিয়ন্ত্রণে নয়। যারা সাহস দেখাবে, তাদের মন ভাঙবে না, কিন্তু যারা ভয় পাবে, তাদের ছায়া ধরে রাখবে।” অর্ণব অনুভব করলো, এটি শুধুমাত্র একটি ব্যক্তির অভিজ্ঞতা নয়, বরং একটি শক্তি যা মানুষের চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে—নদীর ধারের আলো, সরু গলির কোলাহল, মাটির ধোঁয়া—সবই এক অদ্ভুত ছায়ার আকার নিয়েছে। অনামিকা ধীরে অর্ণবের হাত স্পর্শ করলো, কিন্তু স্পর্শ যেন অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে মিলিত হয়ে তার শরীরে প্রবাহিত হলো। সে ভেবেছিলো, এই রাতে তার জীবনের সবচেয়ে বড় রহস্য উন্মোচিত হবে, কিন্তু সেই রহস্য এত গভীর, এত অতিপ্রাকৃত, যে অর্ণব জানতো—দশম দরজা শুধু ফটক নয়, এটি একটি অভিশাপ, এবং অনামিকা শুধু সেই অভিশাপের দূত।

তারাপীঠের সন্ধ্যা তখন এক অদ্ভুত নীরবতায় মোড়ানো। আকাশে ছায়া গাছের পাতা মাটির উপর লম্বা রেখার মতো পড়ে, আর বাতাসে ধোঁয়া এবং ধূলোর গন্ধ মিশে আছে। অর্ণব ও তিয়াশা শ্মশানের ফাঁকা লেনে দাঁড়িয়ে ছিল, তারপর মাধব ফিসফিস করে তাদের কাছে এলেন। তার কণ্ঠে এমন গোপন আতঙ্ক, যেন সে এমন তথ্য জানাচ্ছে যা প্রকাশ করলে নিজের জীবন বিপন্ন হতে পারে। “মহারাজ,” মাধব শুরু করলেন, “সে শুধু আজকের আচার নয়, এক সময় গোপন তান্ত্রিক সংঘের সদস্য ছিলেন। সেই সংঘের সদস্যরা দশম দরজা নিয়ে কাজ করতেন, কিন্তু সবাই ফিরে আসতে পারেনি। যারা ফিরেছে, তারা আর আগের মতো মানুষ নয়—কেবল ছায়ার মতো বেঁচে থাকে।” অর্ণব শ্বাস আটকে পড়লো, মনে হলো তার চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে গেছে। মাধবের কথার সাথে সাথে অর্ণবের চোখে আবারও ভেসে উঠলো আচার শেষে দেখা ছায়াগুলো, যা মানুষের চারপাশে ঘুরছে—হয়তো সেই হারিয়ে যাওয়া আত্মারাই।

মাধব আরও ফিসফিস করে বললেন, “দরজা খুলে যাওয়া মানে শুধু পথ খোলা নয়, বরং অতীতও উন্মুক্ত হয়। যারা হারিয়েছে, তাদের আত্মা সেই সময়ে আটকে যায়, আর প্রহরীর মতো ঘুরে বেড়ায়। মহারাজ একসময় তাদের মধ্যে ছিলেন, কিন্তু নিজের শক্তি ও নিয়ন্ত্রণের কারণে বেঁচে ফিরেছেন। তার অদ্ভুত ক্ষমতা আজও সেই প্রভাব ধরে রেখেছে—যে কোনো আচার বা মন্ত্র পড়লেই হারানো আত্মারা আবার দেখা দেয়।” অর্ণব মনে করলো, দশম দরজার অভিজ্ঞতা শুধুমাত্র শারীরিক নয়; এটি মানুষের আত্মার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। ছায়ার নড়াচড়া, অদ্ভুত হাওয়া, অজ্ঞাত ফিসফিসানি—সবই সেই প্রভাবের প্রতিফলন।

অর্ণব তখন বুঝতে পারলো, অনামিকা ও অন্যান্য ছায়াগুলো কেবল আভাস নয়; তারা বাস্তব। মাধব বললেন, “যারা ফিরে এসেছে, তারা আবার মানব সমাজে মিলতে পারেনি। তারা শুধু অব্যক্ত, অদৃশ্য—যে কেউ দরজার প্রভাব দেখলে তাদের ছায়া দেখতে পায়, কিন্তু স্পর্শ করতে পারে না। যারা সাহস হারায়, তাদের ছায়া শক্তিশালী হয়ে যায়, এবং তারা কখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে না।” অর্ণব ক্যামেরার দিকে তাকাল, তিয়াশার লেন্সে ঠিক সেই ছায়াগুলো ফুটে উঠছে যা চোখে সরাসরি দেখা যায়। প্রতিটি মানুষের পাশে দীর্ঘ, বিকৃত ছায়া—যা ধীরে ধীরে বাস্তবতার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। এই উপলব্ধি তার মনে আতঙ্কের স্রোত বয়ে দিলো, তবু একধরনের কৌতূহল জাগালো—যে রহস্য উন্মোচন না করলে সে ফিরে যেতে পারবে না।

মাধব আরও একবার সতর্ক করলেন, “মহারাজের অতীত মানে আজকের আচারও নিরাপদ নয়। যারা দরজা খুলেছে, তারা সবসময় ফিরে আসেনি। এবং যারা ফিরে এসেছে, তারা সম্পূর্ণ মানুষ নয়। তুমি যে ছায়াগুলো দেখছো, হয়তো সেই হারিয়ে যাওয়া আত্মারাই। তারা তোমার চারপাশে ঘোরছে, তোমার নজরে পড়ছে, কিন্তু তাদের সঙ্গে কোনও শারীরিক যোগাযোগ সম্ভব নয়—যতক্ষণ না দরজার প্রভাব দূর হয়।” অর্ণব অনুভব করলো, দশম দরজার রহস্য এত গভীর, এত অতিপ্রাকৃত, যে এটি কেবল মানুষের চোখে নয়, তার আত্মার সঙ্গে সরাসরি সংযোগ ঘটাচ্ছে। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ফিসফিসানি, প্রতিটি অদৃশ্য ছায়া—সবই এক গভীর প্রহেলের অংশ। রাত তখন আরও অন্ধকার, হাওয়া আরও ঠান্ডা, আর অর্ণবের মনে অনুভূতি জন্ম নিল—দরজা খোলা মানেই ফিরে আসা আর আগের মতো থাকা কখনও সম্ভব নয়।

পূর্ণিমার রাত। তারাপীঠের আকাশে চাঁদ পূর্ণ, হালকা ধোঁয়ায় ঢাকা, যেন চারপাশের অন্ধকারকে আরও গভীর করে তুলছে। শ্মশানের ফাঁকা লেনে বাতাস নীরব, শুধু দূরের নদীর ধারে জল ছাপের শব্দ ভেসে আসছে। অর্ণব, তিয়াশা এবং মাধব মহারাজের নির্দেশে ফটকের কাছে পৌঁছলো। মহারাজের দেহে এক অদ্ভুত শক্তি স্পষ্ট, চোখ বন্ধ হলেও তার দৃষ্টির গভীরতা চারপাশের কুয়াশায় ভেসে আসছে। তিনি ধীরভাবে বললেন, “আজ রাত পূর্ণিমা, দশম দরজা সম্পূর্ণভাবে খোলা হবে। তুমি চাইলে উত্তর পাবে, তবে তার মূল্য চুকাতে হবে—নিজের আত্মার একাংশ।” অর্ণব স্থির হয়ে দাঁড়ালো। মনে হলো, পুরো পৃথিবী হঠাৎ থেমে গেছে। প্রতি শব্দ, প্রতিটি শ্বাস—সবকিছু এত নিখুঁতভাবে শান্ত, যে তাকে ভেতর থেকে কেঁপে উঠতে বাধ্য করছে।

তিয়াশা হঠাৎ অর্ণবের দিকে ছুটে এল, চোখে আতঙ্কের ছাপ। “অর্ণব, তুমি কি বুঝছো কী করতে যাচ্ছো? যদি আত্মার একাংশ হারাও, আর কখনও ফিরে পাবে না!” তার হাত ধরার চেষ্টা করল, কিন্তু অর্ণব নরম ভয়ে না, বরং একধরনের দৃঢ়তার সঙ্গে তার হাত ছাড়লো। মহারাজ তখন মন্ত্রপাঠ শুরু করলেন, ধূপের ধোঁয়া ঘিরে ফেললো তাদের চারপাশ, আর বাতাসে এমন এক চাপ অনুভূত হলো যে মনে হলো পৃথিবীর মাটি নড়ে উঠছে। অর্ণব অনুভব করলো, দরজার প্রভাব তার মন ও শরীরের গভীরে ঢুকে পড়ছে। তিয়াশা ক্যামেরা হাতে ছবি তুলতে চাইলেও চোখে ধরা পড়ছিলো—ফটকের ওপারে অদৃশ্য অন্ধকারে ভেসে উঠছে লম্বা, বিকৃত ছায়া, যেন তার চারপাশের শক্তিকে প্রভাবিত করছে।

মহারাজের কণ্ঠে তীব্রতা বাড়লো, ধোঁয়া ঘন হয়ে গেলো। হঠাৎ ফটকের ওপারে স্পষ্টতর এক দরজা ফুটে উঠলো—কালো, শক্ত, এবং প্রতীক খোদাই করা যা অর্ণবের মনকে কেঁপে দিল। সে লক্ষ্য করলো, ফটকের ভিতরে অদৃশ্য শক্তি, ধূসর ছায়া, এবং অনামিকার মতো প্রহরীরা ঘুরপাক খাচ্ছে। “এবার,” মহারাজ বললেন, “দরজা খোলা—এটি তোমার সময়।” অর্ণব ধীরে ধীরে হাত বাড়ালো, মনে হচ্ছিলো প্রতিটি ধাপ আত্মার সঙ্গে লড়াই। তিয়াশা চিৎকার করে বলল, “না, তুমি এটা করতে পারো না!” কিন্তু দরজার কুয়াশা তার চিৎকারকে শুষে নিল, যেন বাতাসই তাকে নেয়।

শেষ মুহূর্তে অর্ণব দরজার দিকে এক পা বাড়াল। ফটকের ওপারে ফিসফিসানি ভেসে এলো, যা তার নিজের নাম বলছিল। মনে হলো, তার অন্তরের ভয়, আশঙ্কা, কৌতূহল—সবই দরজার শক্তির সঙ্গে মিলিত হয়ে একটি বিশাল চাপ তৈরি করছে। তিয়াশা শেষ চেষ্টা করে তাকে আটকে রাখার, কিন্তু শক্তি এত গভীর, এত অতিপ্রাকৃত, যে সে অচেতনভাবে পিছিয়ে পড়ল। অর্ণব চোখ বন্ধ করে অনুভব করলো, দরজা খুলছে, উত্তর সামনে, কিন্তু আত্মার একটি অংশ যেন ইতিমধ্যেই তার ভেতরে হারাতে শুরু করেছে। রাত তখন সম্পূর্ণ অন্ধকার, ধোঁয়া এবং ছায়ার মধ্যে সমস্ত সত্তার উপস্থিতি স্পষ্ট, আর অর্ণব বুঝতে পারলো—দশম দরজার রহস্য জানতে চাইলে, প্রতিটি ধাপের সাথে আত্মার এক অংশ চিরতরে বিনিময় করতে হবে।

১০

পূর্ণিমার রাতের আকাশে চাঁদ আলো ছড়াচ্ছিল, কিন্তু তার আলো যেন ফাঁকা, অন্ধকারের মধ্য দিয়ে ভেসে যাচ্ছিল। শ্মশানের ফাঁকা লেনে ধোঁয়া ঘন হয়ে উঠছিল, আর বাতাসে এমন এক চাপ অনুভূত হচ্ছিল যা হৃদস্পন্দনকে দ্রুত করতে বাধ্য করছিল। মহারাজ মন্ত্রপাঠ শুরু করলেন, ধূপ জ্বালানো হলো, এবং ফটকের মধ্যে এক ভয়ঙ্কর কালো ছায়া ফুটে উঠল। অর্ণব স্থির হয়ে দাঁড়াল, মনে হলো—প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি পদক্ষেপ তার মনকে টানছে অদৃশ্য দিকে। তিয়াশা হাত ধরে তাকে থামানোর চেষ্টা করল, কিন্তু অর্ণবের চোখে দৃঢ়তা; সে জানে, দরজা খোলার পর ফিরে আসার পথ সবসময় খোলা থাকবে না। ফটকের ওপারে অন্ধকারের ঢেউ বয়ে চলেছে—এক অদৃশ্য ঝড়, যেখানে নরকের প্রতিটি চিৎকার, প্রতিটি ফিসফিসানি তার কানে ভেসে আসছে।

ফটকের ভেতরে ঢুকে অর্ণব দেখলো, পথ যেন অসীম—ধূসর, কুয়াশা-ঢাকা, এবং অন্ধকারে ছায়ারা নাচছে। ছায়াগুলো মানুষের মতো, কিন্তু বিকৃত, দীর্ঘ ও ভীতিকর। প্রতিটি ধাপের সঙ্গে তারা নড়াচড়া করছে, তার চারপাশে ঘুরছে, যেন অদৃশ্য প্রহরীর মতো তার আত্মার অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। ধীরে ধীরে অর্ণব অনুভব করল, দরজার ওপার থেকে আসা শক্তি তার শরীর ও মনকে ঘিরে ফেলছে, নিজের ইচ্ছার সঙ্গে সংঘাত করছে। তিয়াশা চিৎকার করছে, “অর্ণব, ফিরে এসো! তুমি হারাবে—এটি শুধুই পরীক্ষাই নয়, এক অভিশাপ!” কিন্তু তার চিৎকার ফিসফিসানি ও ছায়ার আওয়াজে মিলিয়ে গেল, যেন বাতাসই শব্দকে শোষণ করছে।

প্রতিটি ধাপ অর্ণবকে ভেতরের অন্ধকারে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সে অনুভব করল, প্রতিটি চিৎকার, প্রতিটি ফিসফিসানি কেবল তার চারপাশ নয়, তার ভেতরের আত্মাকেও স্পর্শ করছে। ধীরে ধীরে ফটকের ওপার থেকে এক অদ্ভুত জ্যোতি ফুটে উঠল—অর্ণব দেখল, এক লম্বা পথ, যা নরকের অন্তহীন অন্ধকারের মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে। তবে একই সঙ্গে, সেখানে রহস্যময় শান্তি, এক ধরনের অপার্থিব শক্তি, যা আকর্ষণ করছে। অর্ণব স্থির হয়ে দাঁড়াল—ভিতরে ঢুকবে, নাকি আত্মার একটি অংশকে ছেড়ে বাঁচবে। ছায়াগুলো তার চারপাশে ঘুরছে, অনামিকা ভেসে আসছে অদৃশ্যভাবে, মনে করিয়ে দিচ্ছে—প্রতিটি পছন্দের ফলাফলে আত্মার অংশ বিনিময় বাধ্যতামূলক।

পরদিন সকাল বেলায় তিয়াশা ফিরে এল শ্মশানে। ধোঁয়া তখনো ম্লান, লেন খালি, আর চারপাশে শান্তি। সে ক্যামেরা খুলে দেখলো, শেষ ছবিতে অর্ণব নিজের প্রতিচ্ছবিতে দাঁড়িয়ে আছে—কিন্তু তার চারপাশে ঘন ছায়া, বিকৃত ও অস্পষ্ট, যা যেন সে আর স্বাভাবিকভাবে ছেড়ে আসেনি। অর্ণব কোথায়—ফটকের ভেতরে, নরকের পথে, নাকি আড়ালে, তা স্পষ্ট নয়। ছবিটি স্পষ্টতই জানাচ্ছে, দশম দরজা শুধু পথ খুলে দেয়নি, বরং তাকে ছায়ায় আবদ্ধ করেছে। পাঠকের চোখে অর্ণবের গন্তব্য অজানা থেকে গেল—তবু জানার ইচ্ছা, ভয়ের অনুভূতি, এবং রহস্যের গভীরতা চিরকাল ধরে রাখল দশম দরজার অভিশাপ।

শেষ

1000053188.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *