Bangla - রহস্য গল্প

শিবথাকুরের সিন্দুক

Spread the love

ঈশান মৈত্র


পর্ব ১: পুরীর ডাকে

সকালবেলা, কলকাতার গড়িয়াহাটের এক পুরনো ক্যাফেতে ছ’জন পুরনো বন্ধু বসে আছে—অর্ণব, রাহুল, কিয়া, দৃষ্টি, অদ্বিতী, আর নীলয়। কলেজ ফেস্টে গান, নাটক, ট্রেক—সবকিছুর অভিজ্ঞতা থাকা এই টিম একসাথে বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান করছিল বহুদিন ধরে।

“এইবার সমুদ্র চাই,” বলে উঠল কিয়া, “আর কোনো পাহাড় টাহাড় নয়।”

অর্ণব মুখ তুলে বলল, “পুরী? শ্রীমন্দির, বিচ, খানা-দানা?”

“ডান! ডান!” চেঁচিয়ে উঠল সবাই।

সপ্তাহখানেক পর তারা রওনা দিল পুরীর দিকে। ট্রেনে কাটানো রাত, জানালার বাইরে ছুটে যাওয়া মাঠ আর গাছের ফাঁকে ফাঁকে দূরের আলো যেন নতুন এক অভিযান শুরুর ইঙ্গিত দিচ্ছিল।

পুরী পৌঁছে তারা উঠল সমুদ্রের কাছে একটা ছোট্ট হোটেলে। বালির উপরে দাঁড়িয়ে থাকা হোটেল ‘সাগরপাড়’ একটা পুরনো কাঠের গেস্টহাউস—তাতে একরাশ নস্টালজিয়া আর রহস্যের গন্ধ।

দ্বিতীয় দিন, ভোরের আলো ফোটার আগেই, ওরা চলল সাইকেলে পুরীর একটু দূরের ‘ভুবনেশ্বরী গ্রাম’ নামক একটা পুরনো অঞ্চলের দিকে। স্থানীয়দের কাছ থেকে শুনেছিল, ওখানে একটা ৩০০ বছরের পুরনো শিবমন্দির আছে, যেটা এখন প্রায় পরিত্যক্ত। কিয়াদের অ্যাডভেঞ্চারের নেশা আর পুরাতাত্ত্বিক স্থানের প্রতি অর্ণবের আগ্রহ ওদের টেনে নিয়ে গেল সেই পথে।

“এই রকম প্রাচীন মন্দিরে কিছু না কিছু গুপ্ত রহস্য থাকেই,” বলল অর্ণব। সে কলকাতায় ইতিহাসের ছাত্র, এবং তার ছিল একরাশ বইয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে তৈরি এক জগত।

মন্দিরে পৌঁছেই তারা বুঝল, জায়গাটা অদ্ভুতভাবে নিঃস্তব্ধ। চারপাশে কোনো মানুষজন নেই। গাছের পাতায় হাওয়া খেলে যাওয়ার আওয়াজ, মন্দিরের ভাঙা গম্বুজ থেকে পড়া ধুলোর শব্দ—সবকিছুতেই একটা চাপা থ্রিল।

তারা মন্দিরের ভেতরে ঢুকল। ভিতরটা অনেকটা অন্ধকার, শুধুমাত্র কিছু জায়গায় সূর্যের আলো ঢুকছে ছাদের ফাটল দিয়ে। মাটিতে দেখা গেল একটা খোদাই করা পাথরের ফলক।

দৃষ্টির চোখে পড়ল ফলকের উপর খোদাই করা একটা অদ্ভুত বাক্য—

“যে জানে পঞ্চভূতের রসায়ন, সে-ই খুঁজে পাবে অমর ধন।”

“পঞ্চভূত… মানে?” রাহুল একটু গম্ভীরভাবে বলল।

“মাটি, জল, আগুন, বায়ু, আকাশ। প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে এই পাঁচ উপাদান দিয়েই সৃষ্টি,” উত্তর দিল অর্ণব।

“মানে কি এটা কোনো ধাঁধা?” প্রশ্ন করল নীলয়।

তাদের কেউ জানত না, এই একটা বাক্যই তাদের ছুটির ট্রিপকে একটা হাজার বছরের গুপ্তধনের সন্ধানে টেনে নিয়ে যাবে।

মন্দিরের এক কোণায় একটা ছোট্ট গর্তে রাহুল হোঁচট খেল। গর্তটা ছিল অনেকটা সিন্দুকের ঢাকনার মতো। ধুলো ঝেড়ে দেখা গেল, সেখানেও কিছু লেখা—

“মুঘল সুলতান নাসিরউদ্দিনের শেষ নিদর্শন এখানেই ঘুমিয়ে আছে। সন্ধান পাবে যদি সত্য পথ ধরো।”

“মুঘল সুলতান? পুরীতে?” বিস্মিত হয়ে বলল কিয়া।

অর্ণব বলল, “মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ দিকে অনেকেই কোষাগার লুকিয়ে রেখেছিল বিদেশি আক্রমণের ভয়ে। হয়তো নাসিরউদ্দিন ছিল এমনই কেউ, যে নিজের ধন লুকিয়েছিল এই নির্জন স্থানে।”

হঠাৎই সেই মুহূর্তে মন্দিরের বাইরে একটা আওয়াজ হল। যেন কেউ শুকনো পাতার উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। তারা সবাই চুপ করে গেল। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে, তারা দেখল একটা লোক, চাদরে মোড়া, দূর থেকে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল গাছের ফাঁকে।

“কে ছিল ও?” ফিসফিস করল অদ্বিতী।

“সাজানো নাকি সত্যি কিছু?” বলল রাহুল।

“যাই হোক, একটা জিনিস পরিষ্কার—এখানে কিছু একটা আছে। আমরা ঠিক জায়গায় এসেছি,” বলল অর্ণব, চোখে অ্যাডভেঞ্চারের দীপ্তি।

তারা মন্দির থেকে বেরিয়ে হোটেলে ফিরল। তবে এবার আর সেটা ছিল না একটা সাধারণ বেড়ানোর ট্রিপ। এবার তারা জড়িয়ে গেছে এক হাজার বছরের পুরনো ইতিহাস, ধাঁধা আর গুপ্তধনের জালে।

রাতে, সাগরের গর্জনের মধ্যে, তারা বসে বসে সেই ধাঁধার মানে বের করার চেষ্টা করল।

“পঞ্চভূতের রসায়ন…” অর্ণব তার নোটবুকে লিখল।

রাত বাড়ছিল। কিন্তু তারা জানত না, এই খোঁজ তাদের নিয়ে যাবে পুরীর চেনা-অচেনা পথ ধরে ইতিহাসের এমন এক পরত খুলে, যা কেবল বইয়ে পড়া নয়—জীবনের সবচেয়ে বড় অভিযান।

পর্ব ২: মাটির গভীরে সংকেত

সকালের আলো ফুটতেই ছ’জন বন্ধুর মাথায় ঘুরছিল শুধুই একটাই কথা—“পঞ্চভূতের রসায়ন।” সমুদ্রস্নান, ঝালমুড়ি, আলু চপ—সবকিছুকে যেন আড়ালে ঠেলে দিয়েছে সেই রহস্যময় শিবমন্দির আর ফলকের খোদাই করা শব্দ।

অর্ণবের ধারণা, পঞ্চভূতের প্রতিটি উপাদান হয়তো একেকটা ধাঁধার স্তর। এবং প্রথমটি—‘মাটি’—তার ইঙ্গিত হয়তো মন্দিরের নিচেই কোথাও লুকিয়ে আছে।

“চলো, আবার যাই,” বলল দৃষ্টি। “এবার সঙ্গে টর্চ আর দড়ি নিই। জানি না কী লুকিয়ে আছে নিচে।”

সকাল সাড়ে আটটার দিকে তারা রওনা দিল ‘ভুবনেশ্বরী গ্রাম’-এর সেই শিবমন্দিরে। হোটেলের মালিক বঙ্কিমবাবু তাদের কৌতূহলীভাবে জিজ্ঞেস করলেন, “আবার যাচ্ছো ওদিকে?”

“একটা প্রাচীন স্থাপত্য দেখতে যাচ্ছি,” অর্ণব কৌশলে বলল।

বঙ্কিমবাবু একটু হেসে বললেন, “সাবধানে থেকো। ওই এলাকাটা ভীষণ একা। আর স্থানীয় লোকজন রাতে গেলে ভয় পায়। ভাবে, ওখানে কিছু আছে।”

“কী আছে?” জিজ্ঞেস করল নীলয়।

“সে তো কেউ বলতে পারে না,” বলে বঙ্কিমবাবু ধীরে ধীরে চলে গেলেন।

মন্দিরে পৌঁছেই তারা গেল সেই ফলকটার কাছে। এবার অর্ণব একটা ছোট্ট স্ক্র্যাপিং টুল বার করে ফলকের চারপাশের মাটি খুঁড়তে লাগল। খানিকটা গভীরে গিয়ে ওর টুলটা ঠেকল শক্ত কিছুর গায়ে।

সবাই মাটি সরাতে শুরু করল। ধুলোয় ঢাকা একটা পাথরের বাক্স পাওয়া গেল—বহু পুরনো, একপাশে মোঘলীয় ঘরানার খোদাই। কিয়াদের শ্বাস বন্ধ হয়ে এল উত্তেজনায়।

“এই বাক্সেই কি আছে সেই প্রথম সংকেত?” ফিসফিস করে বলল অদ্বিতী।

বাক্সটা খুলতেই দেখা গেল ভিতরে একটা লোহায় মোড়ানো ছোট্ট নল। নলটা খুলতেই একটা পুরনো পার্চমেন্ট পেপার। তার উপর ধাঁধার মতো লেখা—

“যেখানে মাটি গলে নদী হয়,

সেখানে মৃত বসে গল্প কয়।

আগুনের ছোঁয়া পেলে সে জ্বলে,

জলের আড়ালে তার কথা বলে।”

রাহুল ভুরু কুঁচকে বলল, “এই তো আরও একটা ধাঁধা! এবার মনে হচ্ছে চার উপাদানকে একসঙ্গে যুক্ত করে কিছু বলা হয়েছে।”

অর্ণব মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “না, এটা এখনও ‘মাটি’ সম্পর্কেই। ‘মাটি গলে নদী হয়’—মানে হয়তো যেখানে নদী বাঁক নেয়, সেখানে মাটির স্তরে কিছু পাওয়া যেতে পারে।”

কিয়া বলল, “আর ‘মৃত বসে গল্প কয়’—এর মানে কি কবর বা চিতাস্থল?”

“পুরীর বাইরে কিছু শ্মশানঘাট আছে, যেখানে প্রাচীন কালের চিতার স্মৃতিচিহ্ন আছে,” বলল অদ্বিতী। “একটা আছে, ‘স্বর্ণঘাট’ নামে, স্থানীয় মানুষজন বলে সেখানে এককালে রাজাদের চিতা হতো।”

অর্ণব ফোনে গুগল ম্যাপ খুলে দেখল। স্বর্ণঘাট মন্দির থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। তারা হাঁটতে শুরু করল। পথটা আঁকাবাঁকা, মাঝে মাঝে বনঝোপ, মাঝে মাঝে ধুলিধুসর পাথুরে জমি।

পথে একটা বৃদ্ধা তাদের থামিয়ে বললেন, “সেদিকে যাচ্ছো? সাবধান। ওই জায়গায় এখনো আগুন দেখা যায় মাঝেমাঝে, যেখানে কোনো চিতা নেই। বহু পুরনো আত্মা নাকি…”

“ভূতের গল্প?” রাহুল একটু হাসল।

কিন্তু বৃদ্ধার চোখে ভয়। “সব গল্প নয় ছেলেরামশাই, কিছু জিনিস বিশ্বাস না করলে বিপদ হয়।”

স্বর্ণঘাট পৌঁছে তারা দেখে জায়গাটা নির্জন। ছোট একটা নদীর ধারে কিছু পুরনো পাথরের বেদি—যেগুলো মনে হয় বহু শতাব্দী আগের।

হঠাৎ অদ্বিতীর চোখ পড়ে, একটা পাথরের বেদির পাশের মাটিতে অদ্ভুত চিহ্ন। যেন শিবলিঙ্গের মতো কিন্তু খোদাই করা নয়—মাটি থেকে নিজে থেকেই উঠে আসা, আর তার নিচে একটা গোল ফাটল।

“এই ফাটলটা কিছু লুকিয়ে রাখার জায়গা হতে পারে,” বলল কিয়া।

অর্ণব একটা লম্বা কাঠ দিয়ে নিচে নামাল। একটা ধাতব আওয়াজ পাওয়া গেল।

“কিছু একটা আছে নিচে!”

দড়ি বেঁধে রাহুল নিচে নামল। পাঁচ ফুট গভীরে একটা ধাতব বাক্স। তুলে আনা হলো সেটি।

বাক্সটা খুলতেই ধুলো উড়ে উঠল। ভেতরে একটা ছোট্ট পোড়া মাটির ভাঙা ঠোঙা। তার মধ্যে এক টুকরো খাম। খামের ভিতরে একপাশে একটা লাল রং-এর সিলমোহর, আর অন্যপাশে আরেকটি পাণ্ডুলিপি:

“এই জ্ঞানের শুরু হয়েছিল আগুনের কাছে, শেষ হবে শিবের চরণে।”

নীলয় বলল, “আগুন? তাহলে এবার আমাদের যেতে হবে কোনো পুরনো অগ্নিকুণ্ড বা যজ্ঞস্থলে?”

অর্ণব ফিসফিস করে বলল, “না, এর মানে আরও গভীর। এটা শুধু পঞ্চভূতের অনুসন্ধান নয়। এই একেকটা ধাঁধা আসলে মুঘল আমলের কোনো এক দার্শনিকের তৈরি। আর তারা জানত—সবচেয়ে নিরাপদ জিনিসটা সবার চোখের সামনে রেখেও গোপন রাখা।”

রাত হয়ে আসছিল। বন্ধুরা ফিরে চলল হোটেলে। মাথায় শুধু একটাই ভাবনা—এতবড় মুঘল গুপ্তধন কি সত্যিই তাদের সামনে এগিয়ে আসছে?

কিন্তু তারা জানত না, পুরীর এই নিরীহ গ্রামে, অনেক আগে থেকেই কেউ পাহারা দিয়ে চলেছে এই ধন—আর সেই চোখ এখনও নজর রাখছে ওদের উপর।

পর্ব ৩: আগুনের স্তম্ভ

পুরীর সেই নির্জন সন্ধ্যায়, সাগরের গর্জন আর পাখির ডাকের মধ্যে ছয় বন্ধু একত্রে বসে মোমের আলোয় পরের ধাঁধাটা বিশ্লেষণ করছিল।

“এই জ্ঞানের শুরু হয়েছিল আগুনের কাছে, শেষ হবে শিবের চরণে।”

“এটা মানে দাঁড়ায়, আমাদের পরবর্তী খোঁজ হবে ‘আগুন’ বা ‘অগ্নিতত্ত্ব’-কে ঘিরে,” বলল অর্ণব।

“পুরীতে এমন কোথাও কি আছে, যেখানে অগ্নিকুণ্ড, যজ্ঞস্থান, বা এমন কিছু আছে যার মধ্যে আগুন জ্বালানো হতো নিয়মিত?” দৃষ্টি জিজ্ঞেস করল।

রাহুল ফোনে খোঁজাখুঁজি করে বলল, “একটা পুরনো ধ্বংসপ্রাপ্ত আশ্রমের কথা পেলাম—’বায়ুভবন আশ্রম’ নামে পরিচিত ছিল, কিন্তু এখন অনেকটাই ভগ্ন। স্থানীয় বিশ্বাস, সেখানে একসময় মহাযজ্ঞ হয়েছিল কয়েকদিন ধরে। জায়গাটা শহর থেকে একটু দূরে।”

“তাহলে কালই সকালে সেখানে যাওয়া যাক,” বলল নীলয়।

কিন্তু সেই রাতেই ঘটে গেল কিছু অদ্ভুত।

রাতে হোটেলে ফেরার পর, সবাই ঘুমিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। হঠাৎ অর্ণবের ফোনে এল এক মেসেজ—অজানা নম্বর থেকে।

“তোমরা যা খুঁজছো, সেটা শুধু ধন নয়। সেটা ইতিহাসের ভার। সাবধান। কেউ দেখছে তোমাদের।”

“কে পাঠাতে পারে?” রাহুল বলল।

“আমাদের তো কেউ জানেই না…” কিয়া চুপ করে গেল।

নীলয় বলল, “আমরা একবারে প্রফেশনাল চোরের চক্রের পাল্লায় না পড়ে যাই।”

“অথচ আমরা যে পথে এগোচ্ছি, তাতে কিছু একটা বড় রহস্য জড়িয়ে আছে,” বলল অদ্বিতী। “যদি কেউ গোপনে পাহারা দিয়ে রাখে, তবে সে নিশ্চয়ই চায় না কেউ এটা খুঁজে পাক।”

পরদিন সকালে তারা রওনা দিল বায়ুভবন আশ্রমের উদ্দেশ্যে। রাস্তা ছিল অনেকটাই খারাপ, ঘন গাছের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে পথটা। জায়গাটা শহর থেকে বেশ দূরে, আর আশেপাশে খুব একটা জনবসতিও নেই।

পৌঁছে দেখে, ধ্বংসপ্রাপ্ত কিছু প্রাচীন স্তম্ভ আর পোড়া মাটির গন্ধে ভরা একটা পরিত্যক্ত জায়গা—আশ্রমের ভগ্নাংশ দাঁড়িয়ে আছে সময়ের সাক্ষী হয়ে।

“এটাই সেই বায়ুভবন,” বলল অর্ণব, “আশ্রমে একসময় বাতাস, আগুন ও আকাশতত্ত্ব নিয়ে সাধনা হতো। সম্ভবত সেই আগুনের স্তম্ভ এখানেই আছে।”

তারা চারপাশ খুঁটিয়ে দেখতে লাগল।

একটি আধভাঙা স্তম্ভের গায়ে অদ্ভুত চিহ্ন চোখে পড়ল দৃষ্টির। পাথরের গায়ে খোদাই করা শঙ্খ, অগ্নি, আর চক্রের ছাপ। নিচে লেখা—

“যে আগুন চিরকাল জ্বলে, সে সত্যকে রক্ষা করে। সেই আগুনে ফেলো ভ্রান্তি, খুলে যাবে দরজা।”

“এইটা তো সরাসরি নির্দেশনা,” বলল কিয়া। “কিন্তু কী ফেলবো এখানে?”

“ভ্রান্তি… মানে ভুল? না কি ভয়ের প্রতীক?” বলল নীলয়।

“একটা কাজ করা যাক,” বলল রাহুল। সে ব্যাগ থেকে আগের ধাপে পাওয়া পোড়া ঠোঙার একটা অংশ বার করল। “এটা সেই ‘ভ্রান্তি’র প্রতীক হতে পারে।”

ঠোঙার পোড়া অংশটা তারা রেখে দিল আগুনের স্তম্ভের নিচে, যেখানে পুরোনো চিতাভস্মের মতো কিছু ছিল। সেখানে আবার আগুন জ্বালানোর মতো ছোট একটা পাত্র।

টর্চের আলোয় আশেপাশের শুকনো গাছের ডাল দিয়ে ছোট্ট আগুন তৈরি করল তারা। সেই আগুনের মধ্যে ফেলা হল পোড়া ঠোঙার অংশটা।

অগ্নিশিখা হালকা করে জ্বলে উঠতেই, স্তম্ভের গায়ে থাকা একটা পাথরের খণ্ড টোকা দিয়ে খুলে গেল। তার পেছনে একটা সরু চেম্বার, যার ভিতরে একটা তাম্রপত্র, আর একজোড়া ধাতব রোলার।

তাম্রপত্রে লেখা—

“জল যেখানে পাথর চিরে আসে,

আকাশ যেখানে নিচে নামে,

সেখানে অমর রক্ষক অপেক্ষা করে।

তার চোখে অন্ধকার, হৃদয়ে আলো।”

“এইটা তো জলের ধাঁধা,” বলল অদ্বিতী। “এবার আমাদের যেতে হবে জলতত্ত্বের সন্ধানে।”

“‘পাথর চিরে জল আসে’ মানে হতে পারে ঝরনা বা অনন্তধারা,” বলল কিয়া। “পুরীতে কোথায় এমন কিছু আছে?”

“একটা জিনিস জানো?” বলল অর্ণব, “পুরীর কাছেই একটা জায়গা আছে—‘চন্দ্রভাগা’। সমুদ্র ও নদীর সংযোগস্থলে এমন একটা প্রাকৃতিক ঝরনার মত প্রবাহ আছে। বলা হয় সেখানে জল পাথরের ফাঁক দিয়ে আসে।”

রাহুল বলল, “তা হলে ওটাই আমাদের পরবর্তী গন্তব্য।”

তারা জানে না, আশ্রম থেকে বেরোনোর সময় তাদের গাড়ির পিছনে লুকিয়ে আছে একটি কালো বাইকে আসা মানুষ। চেহারা দেখা যাচ্ছে না, তবে তার হাতে ধরা এক পুরোনো ছবির কপি—ছ’জন বন্ধুর ছবি, যার নিচে লেখা:

“পুণ্যার্থীরা নয়, উত্তরাধিকারীরা।”

পর্ব ৪: জলের আড়ালে

পুরীর সেই ছ’জন বন্ধুর ঘুম হারিয়ে গেছে। একটার পর একটা ধাঁধা খুলছে সামনে রহস্যের দরজা, আর যেন ইতিহাসের ধুলো ঝেড়ে বেরিয়ে আসছে হারিয়ে যাওয়া এক সম্রাটের গল্প।

তারা ঠিক করল—পরদিন সকালে রওনা দেবে চন্দ্রভাগার দিকে। পুরীর সমুদ্র সৈকতের প্রায় দশ কিলোমিটার উত্তরে এই জায়গা, যেখানে নদী আর সমুদ্র মিলেছে এক আশ্চর্য জলে, আর শোনা যায় সেখানে আছে এক রহস্যময় প্রবাহ—যেটা ধ্বংস আর পুনর্জন্মের প্রতীক।

সকালবেলা চায়ের কাপ হাতে সবাই মানসিকভাবে প্রস্তুত হচ্ছিল। দৃষ্টি ট্যুর গাইড বুক খুলে বলল, “চন্দ্রভাগার ওই অংশে কেউ এখন প্রায় যায় না। পাথরের খাঁজের মধ্যে জল আসে অদ্ভুত এক গতিতে, আর স্থানীয় মৎস্যজীবীরা বলে, কিছু জায়গায় রাতের বেলায় আলো দেখা যায়।”

“হয়তো সেখানেই লুকিয়ে আছে সেই ‘আলোকহৃদয় অন্ধপ্রহরী’,” অর্ণব ভাবল।

তারা একটা SUV রেন্ট করে বেরিয়ে পড়ল। সকালটা ছিল রোদেলা, কিন্তু দূর আকাশে কালো মেঘ জড়ো হচ্ছিল।

“মেঘটা ভালো লক্ষণ না,” বলল রাহুল।

“এডভেঞ্চারে ঝড় থাকা চাই,” হেসে উঠল কিয়া।

চন্দ্রভাগায় পৌঁছে দেখে জায়গাটা যেন এক ম্যাজিকাল রিয়ালিজমের দৃশ্য। সামনে নদী আর সমুদ্রের মিলন, পাথরের খাঁজ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। একটা জায়গায় নদীটা নিচে নামা এক খাদের মতো জায়গা দিয়ে চলেছে। হালকা কুয়াশা, আর সেই জলধারার নিচে কিছু একটা নড়ছে যেন।

অর্ণব বলল, “আমরা আগুনের স্তম্ভ থেকে যে তাম্রপত্র পেয়েছিলাম, তার শেষে যে লাইনটা ছিল—

‘তার চোখে অন্ধকার, হৃদয়ে আলো’—

এটা কি কোনো গোপন প্রবেশপথ বোঝাচ্ছে, যেটা দিনের আলোয় দেখা যায় না?”

তারা হাঁটু অবধি জলে নেমে পাথর খুঁজতে শুরু করল। কিয়া হঠাৎ থেমে বলল, “এই পাথরটা কি অদ্ভুত নয়? রঙ অন্যরকম, আর এর গায়ে কিছু খোদাই করা।”

ধুয়ে দেখতেই বোঝা গেল, পাথরের মাঝখানে একচোখা মুখের মতো খোদাই, চোখের জায়গায় একটা ছোট্ট ফুটো।

“এটাই সেই ‘অন্ধচোখ’!” চেঁচিয়ে উঠল দৃষ্টি।

নীলয় বলল, “ফুটোর ভেতর দিয়ে দেখো!”

অর্ণব এক চোখ দিয়ে তাকাল। ফুটোর ওপারে দেখা গেল এক সরু গুহামুখ—পাথরের পিছনের খাঁজের ভেতর দিয়ে ঢোকার রাস্তা। জল চাপা দিয়ে রেখেছিল পথটা।

সাবধানে সবাই এগিয়ে গেল সেই গুহার দিকে। চারপাশে কাঁকড়ার দৌড়, শ্যাওলা, আর পাথরের ঘর্ষণে তৈরি একরকম গুমোট শব্দ।

“টর্চ জ্বালাও,” বলল অদ্বিতী।

ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল, গুহার দেওয়ালে খোদাই করা এক বিশাল চিত্র—মুঘল পোশাক পরা এক রাজার ছবি, হাতে এক সিন্দুক, আর তার পিছনে একটি শিবলিঙ্গ।

“এই কি সেই সুলতান নাসিরউদ্দিন?” ফিসফিস করে বলল কিয়া।

ছবির নিচে ছিল আরেকটি ধাঁধা—

“আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে,

যার ছায়া পড়ে না কখনো,

তাকে খুঁজে নাও।

সে তোমাদের নিয়ে যাবে চূড়ান্ত সত্যের পথে।”

“‘ছায়া পড়ে না কখনো’—মানে?” ভাবল রাহুল।

“একটা প্রাকৃতিক বস্তু, যার ছায়া পড়ে না?” অর্ণব জোরে ভাবতে লাগল।

“না, এটা হয়তো প্রতীকী। হয়তো এমন কোনো কিছু বা কেউ, যে আলোয় থেকেও অন্ধকারে, চিরকাল দেখা যায় না,” বলল দৃষ্টি।

তাদের আলো গুহার শেষ প্রান্তে পৌঁছতেই দেখা গেল একটা চ্যাপ্টা পাথর, যার উপর বসানো একটা ধাতব বল—সূর্যের মতো। আশ্চর্যের বিষয়, টর্চের আলো সেদিকে ফেললেও তার ছায়া নিচে পড়ছে না।

“এই তো! এটা!” বলল অর্ণব।

সেই বলের নিচে ছিল একটা ছোট্ট সুইচের মতো অংশ। টিপতেই সামনের দেয়ালটা ধীরে ধীরে খুলে গেল।

ভিতরে ছিল একটা ধাতব সিঁড়ি, যা নিচে নেমে যাচ্ছে অন্ধকারের দিকে।

“তবে কি আমরা শিবথাকুরের সিন্দুকের কাছাকাছি?” দৃষ্টি কাঁপা গলায় বলল।

কিন্তু কেউ জানে না, ঠিক সেই মুহূর্তে উপরের গুহার মুখে দাঁড়িয়ে আছে সেই কালো চাদর মোড়া লোকটা। তার চোখে ছিল রাত্রির মতো অন্ধকার, আর ঠোঁটে নিঃশব্দ এক বাক্য:

“উত্তরাধিকারীর পরীক্ষা শুরু।”

পর্ব ৫: আকাশতলে অদৃশ্য রক্ষক

সিঁড়ির নিচে নামার সময় চারপাশটা নিঃশব্দ হয়ে গেল। কেবল নিজেদের নিঃশ্বাসের শব্দ আর পায়ের নিচে ভেজা পাথরের টুংটাং আওয়াজ। নিচে নেমে তারা দেখে এক বিশাল গুহাকক্ষ। গুহার ছাদ অনেক উঁচু, যেন নিজেই একটা ছোট্ট আকাশ।

মাঝখানে একটি অষ্টকোণ চিহ্ন। তার কেন্দ্রে বসানো একটি ধাতব স্তম্ভ, মাথায় রৌদ্রচিহ্নের মতো সূর্যাকার বল। চারদিকে প্রাচীন অলংকরণ, মুঘল নকশা, আর অদ্ভুতভাবে স্থাপন করা কিছু ফাঁপা খাঁজ।

“এই কি সেই আকাশতলের কক্ষ?” কিয়া ফিসফিস করল।

“হয়তো এটাই। আর এই স্তম্ভটাই সেই আকাশের প্রতীক, যার ছায়া নেই,” অর্ণব তার খাতা খুলে নোটগুলো মিলিয়ে বলল।

তাদের ঘিরে হঠাৎ একটা চাপা শব্দ। এক কোণ থেকে অদ্ভুত দেখতে ধাতব মানুষের মতো কিছু বেরিয়ে এল। চোখে কালো পাথরের গুঁটি বসানো, হাতে একটি তলোয়ার-আকৃতির কাঠামো। গলার কাছে লেখা—

“শুধু উত্তরাধিকারীই পারে আকাশের নিচে দাঁড়াতে। বাকিরা পাবে শাস্তি।”

সবাই পিছিয়ে গেল। অর্ণব এক ধাপ এগিয়ে বলল, “আমি দাঁড়াচ্ছি।”

সে ধীরে ধীরে অষ্টকোণের কেন্দ্রে গিয়ে দাঁড়াল। ধাতব মানুষটা তার দিকে এগিয়ে এল, তারপর থেমে গিয়ে মাথা নিচু করল।

কোনো শব্দ ছাড়াই, অর্ণবের পায়ের নিচে পাথর সরে গিয়ে খুলে গেল একটি গোল দণ্ডাকৃতি খাঁজ। সেখান থেকে সে বের করল একটি ধাতব রড, যার মাথায় খোদাই করা ত্রিশূল।

“ত্রিশূল! শিবের চিহ্ন!” চেঁচিয়ে উঠল দৃষ্টি।

একসঙ্গে চারদিকের দেওয়ালে আলো জ্বলে উঠল। পাথরের গায়ে লেখা—

“যেখানে ত্রিশূলের ছায়া পড়ে, সেখানেই খুলবে সিন্দুকের দ্বার।”

কিন্তু ধাতব ত্রিশূলের কোনো ছায়া নেই।

“ছায়া তৈরি করতে হবে,” বলল অর্ণব। “আমাদের আলোকে এমনভাবে ফেলতে হবে, যাতে ত্রিশূলের ছায়া কৃত্রিমভাবে ধরা পড়ে।”

তারা সবাই নিজেদের টর্চের আলো ত্রিশূলের দিকে ফেলে একসঙ্গে আলো ফোকাস করল। ছাদে প্রতিফলিত হয়ে সেই ছায়া এসে পড়ল অষ্টকোণের এক পাশে।

সেই জায়গাটায় হঠাৎ একটা ঘূর্ণি আওয়াজ—পাথর সরে গিয়ে বেরিয়ে এল সিঁড়ির আরেক ধাপ, এবার অনেক নিচের দিকে।

এক ধাপ… দু’ধাপ… তারপর এক দীর্ঘ, আঁধার করিডোর।

আর করিডোরের শেষে দেখা গেল এক বিশাল শিবলিঙ্গ। তার পেছনে ঝরনার মতো নেমে আসা জল। ঠিক যেন আকাশ থেকে জল নেমে আসছে শিবের চরণে।

“এই তো… এখানেই শেষ হবে সব,” কিয়া কাঁপা গলায় বলল।

কিন্তু তারা জানে না, ঠিক সেই মুহূর্তে করিডোরের মুখে দাঁড়িয়ে আছে সেই কালো চাদর পরা লোকটি। তার কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বেরোয়—

“তারা এগিয়ে যাচ্ছে। এবার আমারও নামার সময় হয়েছে।”

পর্ব ৬: শিবের চরণে শেষ পরীক্ষা

সিঁড়ির নিচে নামতে নামতে শব্দ থেমে আসে। চারদিক নিঃস্তব্ধ, শুধু নিজস্ব শ্বাসের শব্দে মনে হয় যেন গুহা কথা বলছে।

একসময় তারা পৌঁছায় একটা বিশাল কক্ষে। ঠিক সামনে—পাথরের বিশাল শিবলিঙ্গ। তার পেছনে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসছে এক সরু জলধারা, যা গিয়ে পড়ছে এক পাথরের পাত্রে।

আলো পড়ে শিবলিঙ্গে, আর সেই জলে প্রতিফলিত হচ্ছে আকাশের রং। এই স্থান এক অদ্ভুত পবিত্রতায় পূর্ণ।

“এই তো… শেষ স্তর,” অর্ণব ফিসফিস করে বলল। “এখানেই গোপন আছে সেই সিন্দুক।”

হঠাৎই গুহার ছাদে একটা শব্দ হয়—ধাতব গর্জন। আর একে একে চারপাশে জ্বলে ওঠে মশাল। ঘরের দরজাগুলো বন্ধ হয়ে যায় আপনাতেই।

“এবার পরীক্ষা শুরু,” বলল রাহুল।

শিবলিঙ্গের সামনে একটা পাথরের ফলক উঠে এল, তার উপর লেখা—

“ত্রিশূল যে পাত্রে অমৃত ঢালবে, সে পাবে চাবি।

ভুল করলে, পথ বন্ধ।

ত্রয়ীর রহস্য জেনো—

ভক্তি, ত্যাগ, জ্ঞান।”

“ত্রয়ী মানে তিনটে পাত্র?” কিয়া চারপাশে তাকিয়ে দেখল, তিনটি পাথরের পাত্র রাখা আছে, তিনটা আলাদা চিহ্নসহ—

১. পদ্মফুল

২. জ্বলন্ত অগ্নি

৩. খোলা চোখের প্রতিমা

“কোনটায় অমৃত ঢালব?” অদ্বিতী চিন্তায় পড়ল।

অর্ণব বলল, “ত্রিশূল শিবের প্রতীক। আর শিবের প্রকৃতি ত্যাগ, ধ্যান আর ধ্বংসের মাঝের ভারসাম্য। পদ্মফুল—ভক্তি। আগুন—ত্যাগ। চোখ—জ্ঞান। কিন্তু কোনটা ঠিক?”

কিয়া বলল, “শিব নিজে তো ত্যাগের প্রতীক। সবকিছুর ঊর্ধ্বে।”

“কিন্তু সেই ত্যাগ আসে জ্ঞান ও ভক্তি মিলিয়ে,” দৃষ্টি বলে। “তাহলে কি জ্ঞান?”

রাহুল বলল, “যদি ভুল হয়?”

“তাহলে দরজা চিরতরে বন্ধ,” অর্ণব চোখ বন্ধ করে পাথরের ত্রিশূল তুলল। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল ‘খোলা চোখের প্রতিমা’ পাত্রটির দিকে।

সে ত্রিশূলটি জলপাত্রে চুবিয়ে তুলে নিল কিছু জল। এরপর ধীরে ধীরে ঢেলে দিল চোখের প্রতিমার পাত্রে।

এক মুহূর্ত নীরবতা।

তারপর হঠাৎ শিবলিঙ্গের পেছনে একটা দেয়াল ফেটে খুলে গেল। একটা গোপন প্রকোষ্ঠ।

“সঠিক!” সবাই চেঁচিয়ে উঠল আনন্দে।

ভেতরে ঢুকেই তারা দেখে, সোনার পাথরের তৈরি একটা ছোট ঘর, যার মাঝখানে রাখা একটি ধাতব সিন্দুক। খোদাই করা—”নাসিরউদ্দিন, ১০২৩ হিজরি“।

“হাজার বছরের মুঘল গুপ্তধন!” নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল কিয়ার।

তারা সিন্দুকের ঢাকনা তুলল—ভেতরে ছিল ধাতব মুদ্রা, একগুচ্ছ জহরত, আর অনেকগুলি পার্চমেন্ট—সবই আরবিতে লেখা।

“এটা তো শুধু ধন নয়, ইতিহাস!” অর্ণব বলল। “এতে হয়তো এমন তথ্য আছে যা কখনও প্রকাশ পায়নি।”

ঠিক তখনই কক্ষ কেঁপে উঠল।

“ভূমিকম্প?” চেঁচাল নীলয়।

না। দরজার মুখে দাঁড়িয়ে সেই কালো চাদরে মোড়া লোকটি। এবার সে মুখ থেকে কাপড়টা নামাল।

একজন বয়স্ক মানুষ, কপালে রুদ্রাক্ষর তিলক। চোখে দীপ্তি। বলল,

“আমি রক্ষক। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পাহারা দিয়েছি এই ধন। কিন্তু এবার তোমরাই হলে যোগ্য। উত্তরাধিকারী।”

“তবে আপনি আমাদের আটকাবেন না?” রাহুল জিজ্ঞেস করল।

“আমি তোমাদের নিয়ে যাব পরবর্তী স্তরে। এই ধন শুধু নেওয়ার নয়, এর ব্যাখ্যা, গবেষণা ও রক্ষা করা—এখন সেই দায়িত্ব তোমাদের। রাজা নাসিরউদ্দিন যে সত্য রেখে গেছেন, তা সামনে আনতে হবে।”

অর্ণব মাথা নিচু করে বলল, “আমরা পারব, গুরুজী।”

রক্ষক তাদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন, তারপর বললেন—

“এই পথ শেষ নয়, এ তো শুরু। ‘শিবথাকুরের সিন্দুক’ শুধু ধনের কাহিনি নয়, আত্মপরিচয়ের আর সত্যের পথও বটে।”

পর্ব ৭: পার্চমেন্টের ভিতরে লুকোনো ইতিহাস

সিন্দুক খুলে তারা যে ধন দেখতে পেয়েছিল, তা শুধু চোখ ধাঁধানো সোনা-হীরা নয়—সত্যিকারের সম্পদ ছিল পার্চমেন্টগুলির মধ্যে। পাতলা, প্রায় ছেঁড়া হয়ে আসা কাগজ, আরবি ও ফারসি হস্তাক্ষরে ভরা। সেগুলো হাতে নিয়ে অর্ণব বুঝে ফেলল—এটা শুধুই রাজার গুপ্তধনের হিসেব নয়, ইতিহাসের এমন এক অধ্যায় যা কখনও আলো দেখেনি।

রক্ষক ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বললেন, “নাসিরউদ্দিন ছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেবের অন্যতম বিশ্বস্ত সামন্ত। কিন্তু তিনি তার রাজনীতি আর ধর্মীয় উগ্রতার বিরোধী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন—ভারতের ভবিষ্যৎ মিলে তৈরি হবে ভিন্ন ধর্ম, ভাষা আর বিশ্বাসের বন্ধনে। সেই মতবাদের জন্যই তাকে আড়ালে যেতে হয়েছিল।”

“তবে এই ধন কেন এখানে?” জিজ্ঞেস করল দৃষ্টি।

রক্ষক বললেন, “কারণ নাসিরউদ্দিন বিশ্বাস করতেন, ধন যদি সঠিক মানুষের হাতে না পড়ে, তবে তা বিপদ ডেকে আনবে। এই ধন, এই পাণ্ডুলিপি, সবই ভবিষ্যতের এক দল উত্তরাধিকারীর জন্য রেখে গিয়েছিলেন তিনি।”

অর্ণব একটি পাণ্ডুলিপি খুলে পড়তে শুরু করল—

“আওরঙ্গজেব যখন কাশ্মীর অভিযান চালান, তখন বহু নিরীহ মানুষ পালিয়ে যায়। আমি, নাসিরউদ্দিন, তাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে দেখি মানুষের কান্না আর রক্তের ধারা। আমি বুঝি, সম্রাটের ছায়ায় থেকেও আমি আর থাকতে পারব না। আমি পালাই। আমার সঙ্গে নিয়ে যাই সিন্দুক—সম্রাটের সেই জিনিস, যা পৃথিবী বদলে দিতে পারে।”

“মানে, এই ধনে শুধু সম্পদ নয়, এমন কিছু আছে যা সাম্রাজ্যের গোপন কথা বহন করছে,” কিয়া বলল।

অর্ণব চোখ কপালে তুলে বলল, “এখানে লেখা আছে—‘রুমির এক গোপন পাণ্ডুলিপির অনুবাদ আমার সঙ্গে ছিল, যা মুঘল আদালত নিষিদ্ধ করেছিল। কারণ তাতে লেখা ছিল মানুষের আত্মার মুক্তির কথা, যা কোনো ধর্মের গণ্ডিতে আটকানো যায় না।’”

“তবে এই তো একটা দর্শন, এক বিপ্লব!” বলল অদ্বিতী।

রক্ষক এবার বললেন, “এই পাণ্ডুলিপিগুলো তোমাদের নিয়ে যাবে এমন এক গবেষণার পথে, যা ভারতবর্ষের ইতিহাস নতুন করে লিখবে। কিন্তু মনে রেখো, এখনো অনেকে আছে যারা চায় না এই সত্য বাইরে আসুক।”

ঠিক তখনই ওপরে গুহার মুখে শব্দ—ধোঁয়ার গন্ধ। আগুন?

রাহুল বলল, “দেখি গিয়ে! কেউ গুহায় ঢুকেছে!”

তারা দৌড়ে ওপরে ওঠে। গুহার মুখে একটা বাইক, তার পাশে পেট্রোল ছিটিয়ে আগুন ধরানো হয়েছে।

একজন যুবক, চোখে সানগ্লাস, দাঁড়িয়ে আছে সিন্দুক খোলার ভিডিও-সহ। চিৎকার করে বলল, “তোমরা যা পেয়েছো, সেটা এখন আমার চ্যানেলের এক্সক্লুসিভ! ট্রেজার হান্টারদের ভিউয়ের যুগে তোমরা একশো বছরের পুরনো ভাবনায় আছো!”

অর্ণব রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “তুমি যা করছো তা শুধু ইতিহাস নয়, একটা সাংস্কৃতিক বিশ্বাসকে ধ্বংস করছে।”

যুবক হেসে বলল, “তুমি আমাকে থামাতে পারবে না।”

রক্ষক ছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে হঠাৎই তার সামনে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, “গুপ্তধনের সঙ্গে খেললে, ইতিহাস প্রতিশোধ নেয়।”

হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকাল, গুহার ছাদ কেঁপে উঠল। একটা পাথরের খণ্ড এসে পড়ে বাইকের ওপর। যুবক প্রাণে বাঁচল ঠিকই, কিন্তু ক্যামেরা, মোবাইল, সব ভস্ম।

সে পালিয়ে গেল।

অর্ণব বলল, “আরও আসবে। আমাদের কাজ এখন শুধু গুপ্তধন উদ্ধার নয়, সত্যিকে রক্ষা করা।”

রক্ষক তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমাদের যাত্রা এখন শুরু হল, এই মাটি, এই আকাশ, এই ইতিহাসের অভিভাবক হওয়ার।”

নীলয় ফিসফিস করে বলল, “তবে কি আমরাই হলাম নতুন যুগের ধাত্রী?”

রক্ষক শুধু বললেন, “এই ধন এখন তোমাদের নয়, দেশের।”

পর্ব ৮: সিন্দুক শহরে—পথে বিপদ, পাণ্ডুলিপিতে আগুন

সেই দিনটায় সকালটা একেবারে অন্যরকম লাগছিল। সাগরের হাওয়া ঠাণ্ডা হলেও ছ’জন বন্ধুর হৃদয় উত্তপ্ত—তারা বহন করছে একটা সিন্দুক, যার ভেতরে ইতিহাসের বিস্ফোরণ।

কোনো ধন, কোনো পাথর নয়—এই সিন্দুকের আসল শক্তি ছিল তার ভিতরে থাকা কাগজগুলো।

জ্ঞান, দর্শন, বিদ্রোহ আর ভালবাসার কথা লেখা ছিল সেগুলোতে—যা হারিয়ে গিয়েছিল বহু শতাব্দী আগে।

তারা ঠিক করল, আর কোনো ঝুঁকি নয়। গুপ্তধন নিয়ে তারা ফিরে যাবে কলকাতায়।

সেইখানেই শুরু হবে গবেষণা, বিশ্লেষণ, আর সত্যকে সামনে আনার লড়াই।

রাত্রিবেলা, পুরী স্টেশনে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে কিয়ারা। কিয়ের ব্যাগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পার্চমেন্টগুলো ভরে দেওয়া হয়েছে। বাকি সিন্দুক একটা কাঠের বাক্সে প্যাক করা হয়েছে নিখুঁতভাবে, যেন সামান্য একটা পুরোনো থালা-বাসনের ট্রাঙ্ক।

রাহুল বলল, “স্টেশনে কেউ নজর রাখছে কি?”

“না, এখন পর্যন্ত সব ঠিক আছে,” অদ্বিতী বলল।

অর্ণব মাথা নিচু করে বলল, “কিন্তু একটা কথা ভাবছো তো? এই সিন্দুক নিয়ে শহরে ঢুকলেই ওরা জানবে। সেই ইউটিউব চ্যানেলের লোকটা একা ছিল না। যারা এই ইতিহাস চাপা দিয়ে রাখার চক্রান্ত করে, তারাও আছে। প্রচুর আছে।”

“তবে কি যাবে না?” নীলয়ের গলায় অনিশ্চয়তা।

“যাবই। কিন্তু প্রস্তুতি নিয়ে,” বলল অর্ণব।

ট্রেন ছাড়ল রাত ন’টায়। কামরায় শীততাপ নিয়ন্ত্রিত আলো, চুপচাপ পরিবেশ। সবাই যেন নিঃশব্দে বহন করছে একটা দায়—যা নিজের ইচ্ছায় নেয়নি, কিন্তু পিছিয়েও যেতে পারছে না।

ভোরবেলা যখন হাওড়া স্টেশনে ট্রেন ঢুকল, তখন হালকা কুয়াশা পড়েছে। প্ল্যাটফর্মে নামার মুহূর্তেই রাহুল ফিসফিস করে বলল, “ওই লোকটা… ওটা তো কালকের বাইকওয়ালার মুখ!”

একটা লোক প্যান্ট-শার্ট পরে দাঁড়িয়ে ছিল, কানে ব্লুটুথ। তারা তাকাতেই সে ঘুরে দাঁড়াল, হেসে উঠে চলে গেল ভিড়ের মধ্যে।

“আমাদের ট্র্যাক করছে!” বলল দৃষ্টি।

তারা সিদ্ধান্ত নিল সোজা নিজেদের বাড়ি না গিয়ে, প্রথমে যাবে কলেজ স্ট্রিটের কাছে একটি নির্জন লাইব্রেরিতে—অর্ণবের পরিচিত একজন গবেষক, অধ্যাপক সোমনাথ বসুর কাছে।

লাইব্রেরিতে পৌঁছে অধ্যাপক বসু রীতিমতো চমকে গেলেন পার্চমেন্টগুলোর হাতের লেখা দেখে।

“এগুলো তো… এগুলো সত্যি হলে আমাদের ইতিহাস বই লিখে নতুন করে শুরু করতে হবে,” তিনি ফিসফিস করে বললেন।

“আমরা জানি,” অর্ণব বলল। “তাই আপনার সাহায্য চাই।”

অধ্যাপক বললেন, “এগুলোর স্ক্যান করে সরাসরি প্রকাশ নয়, বরং ধাপে ধাপে ব্যাখ্যা দিয়ে, উৎস খুঁজে, প্রমাণ দিয়ে এগোতে হবে। না হলে সবাই এটাকে ষড়যন্ত্র বলে উড়িয়ে দেবে।”

“কিন্তু তার আগেই যদি এগুলো নষ্ট করে কেউ?” কিয়া ফিসফিস করে বলল।

ঠিক সেই মুহূর্তে, জানালার বাইরে একটা শব্দ।

বিস্ফোরণের মতো কিছু নয়, কিন্তু যেন কাঁচ ফাটল। সবাই ছুটে গেল জানালার দিকে। বাইরে ছড়িয়ে পড়ছে ধোঁয়া। নিচে কেউ একটা পেট্রল বোমা ছুড়েছে লাইব্রেরির দেয়ালে।

রাহুল চিৎকার করে বলল, “সিন্দুক! ব্যাগগুলো সরাও!”

অর্ণব পার্চমেন্ট রাখা ব্যাগটা হাতে নিয়ে জানালার অপর দিক দিয়ে পালাতে উদ্যত। অধ্যাপক বসু বললেন, “এটা নিছক গুপ্তধন নয়, এটা একটি যুদ্ধ। জ্ঞান আর মিথ্যার মধ্যে।”

দৃষ্টির হাতে থাকা পার্চমেন্টের একপ্রান্ত আগুনে লেগে যেতে যেতে অর্ণব বলল, “আরও একজন… একজন রক্ষক চাই আমাদের পাশে।”

“আমি আছি,” বললেন অধ্যাপক।

পেছনে লাইব্রেরির দেয়ালে আগুন জ্বলছে। ছয়জন বন্ধু, এক প্রৌঢ় অধ্যাপক, আর একটি ধুঁকতে থাকা সত্য—পালিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার রাস্তায়।

“এই ইতিহাস পুড়ে গেলে আমরা সবাই হারাবো,” বলল দৃষ্টি।

অর্ণব শুধু বলল, “আরও পাণ্ডুলিপি আছে… যদি সেগুলো খুঁজে পাই, তবে একটা নতুন ভারত খুঁজে পেতে পারি।”

পর্ব ৯: রাজার শেষ চিঠি—যেখানে ভারত নামে ছিল প্রথম

কালরাত্রির ছায়া কাটতে না কাটতেই তারা পৌঁছল উত্তর কলকাতার এক পুরনো দোতলা বাড়িতে। বাড়ির মালিক অধ্যাপক বসুর ছাত্র, নাম দীপু সরকার। ভোর সাড়ে পাঁচটায় হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে দীপু যখন দরজা খুলল, তখন চোখের সামনে ধুলোমাখা, সিন্দুক বহনকারী ছয়জন মানুষকে দেখে কিছুক্ষণ কথা বেরোলো না।

“দাদা…! আপনাদের কী হয়েছে?”

“আমাদের একটু জায়গা চাই,” বলল অর্ণব, গলার স্বর শান্ত অথচ কাঁপা।

ঘরে ঢুকে বসতেই সকালের আলোয় দেখা গেল—দু’টি পার্চমেন্ট আংশিক ঝলসে গেছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটি ঠিকঠাক রয়েছে—একটা পাণ্ডুলিপির পেছনে সোনালি কালিতে লেখা একটা চিঠি, আরবি ও ফারসি হরফে।

অর্ণব আর অধ্যাপক বসু মিলে ধীরে ধীরে অনুবাদ করতে লাগলেন। চিঠিটি নাসিরউদ্দিন নিজের হাতে লিখেছিলেন:

 “যখন আমার মৃত্যু হবে, তখন কেউ জানবে না আমি কোথায় কবরস্থ।

কিন্তু এই সিন্দুক যার হাতে যাবে, সে জানবে আমার মন কোথায় বিশ্রাম চায়।

ভারতবর্ষকে আমি চিনেছিলাম কাব্যের মতো, যুদ্ধের মতো নয়।

আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম এক জায়গার, যেখানে মানুষ ‘ভারত’ নামটিকে উচ্চারণ করবে শান্তির মতো।

আমি সেই নাম লিখে গিয়েছি মাটিতে—চাঁদের আলোয়, নদীর ধারে,

যেখানে পদ্মফুল নিজে থেকে ফোটে,

আর রাত্রির পাখি গান গায়।”

অদ্বিতী ফিসফিস করে বলল, “সে কি তাহলে নিজের কবরের কথা বলছে?”

“না,” বলল অধ্যাপক। “সে বলছে—ভারতের ধারণাটিকে কোথায় সে লিখে রেখে গেছে। হয়তো কবিতার আকারে, হয়তো প্রস্তরে খোদাই করে। কিন্তু কোথায়?”

“‘চাঁদের আলোয়, নদীর ধারে’—এটা কি কোনো নির্দিষ্ট জায়গার ইঙ্গিত?” কিয়া ভাবল।

“‘পদ্মফুল নিজে থেকে ফোটে’—মানে পদ্মনদী?” রাহুল চোখ কুঁচকে বলল।

“কিন্তু সেটা তো এখন বাংলাদেশের অংশ!” দৃষ্টি উত্তেজিত হয়ে উঠল।

অর্ণব বলল, “একসময় পদ্মার পশ্চিম উপকূলে একটা এলাকা ছিল—মুর্শিদাবাদ জেলার কাছে—সেখানেই একটা প্রাচীন স্থানের কথা আমি পড়েছিলাম। নাম ‘ছায়াপুর’। নদীর ধারে গড়া এক জনপদ, যেখানে রাত্রির পাখিদের গান শোনা যেত। সেখানেই হয়তো…”

“সেখানেই হয়তো লেখা আছে সেই প্রথম ‘ভারত’ নামটি,” বলল অধ্যাপক বসু, চোখে জল নিয়ে।

হঠাৎ একটা আওয়াজ হল দরজার কাছে। সবাই চুপ।

“তোমরা যতই পালাও, সত্যকে থামানো যাবে না,” দরজার ওপারে কে যেন ফিসফিস করে বলল।

অর্ণব দ্রুত ব্যাগটা বন্ধ করল। “চলো। ছায়াপুরে যেতে হবে। এখনই।”

পরের দিন সকালে, ছয় বন্ধু, অধ্যাপক বসু, আর দীপু সরকার একটা পুরনো ট্র্যাভেলার ভ্যানে রওনা দিল মুর্শিদাবাদের দিকে।

রাস্তায় তারা আরও একবার পার্চমেন্ট খুলল। এক জায়গায় একটা রংচটা মানচিত্র। তার পাশে ছেঁড়া একটি চরণ:

“যেখানে মাটি প্রথম উচ্চারণ করেছিল ‘ভারত’,

সেখানে শিবও নীরব হয়ে তাকিয়েছিল,

কারণ তিনি জানতেন—

এই নাম কারও একার নয়।

এই নাম সব কিছুর ওপরে।”

সেই চরণ পড়তেই সবার গা শিরশির করে উঠল।

“আমরা কি ইতিহাসের সেই গোপন কেন্দ্রের কাছে চলে আসছি?” ফিসফিস করে বলল দৃষ্টি।

অর্ণব বলল, “আমরা যাচ্ছি শুধু একটি জায়গায় নয়, সময়ের এমন এক ঘরে,যেখানে রাজারা হারিয়ে গেছে, কিন্তু তাদের বিশ্বাস এখনও শ্বাস নিচ্ছে।”

পর্ব ১০: ছায়াপুর—যেখানে নাম লেখা ছিল বাতাসে

সকাল ছ’টা। পুরোনো ট্র্যাভেলার ভ্যানটা গড়গড়িয়ে চলেছে মুর্শিদাবাদের দিকে। রাস্তায় লালমাটির ধুলো, পাশে সরু খাল, আর দূরে রূপালি ঝিলিমিলি আলোয় ঝিকিয়ে উঠছে পদ্মার শাখা নদী। ছয় বন্ধুর চোখে ক্লান্তি থাকলেও মনে ছিল ভয় আর বিস্ময়ের জোয়ার।

“ছায়াপুর এখন আর কোনো ম্যাপে নেই,” অর্ণব বলল। “তবে কয়েকটি ব্রিটিশ মানচিত্রে এই জায়গার নাম ছিল—Schaipur—নদীর তীরে এক প্রাচীন বাগানবাড়ি, যার চারপাশে পদ্মফুল জন্মাত আপনাতেই।”

“তার মানে ঠিক সেই জায়গা, যেটা নাসিরউদ্দিন চিঠিতে বলেছিলেন,” কিয়া বলল।

“আর সেইখানেই হয়তো খোদাই করা আছে প্রথম ‘ভারত’ নামটি,” বলল অদ্বিতী।

বেলা দশটার দিকে তারা পৌঁছল ছায়াপুর। জায়গাটা এখন প্রায় পরিত্যক্ত—কয়েকটা ঘরবাড়ি, কিছু পানের বরজ, আর নদীর ধারে একটা বিশাল বটগাছ। সে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে একটা ধ্বংসপ্রাপ্ত অট্টালিকা—ছাদের একপাশ ভাঙা, দেওয়ালে সবুজ শ্যাওলা, আর জানালায় ভাঙা কাঠের পাল্লা।

“এটাই হয়তো সেই ছায়াপুর হাভেলি,” বলল অধ্যাপক বসু।

তারা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই এক অদ্ভুত নীরবতা ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। যেন এই বাড়ির ইটগুলো আজও শোনে সেই রাজপুরুষের নিঃশব্দ প্রার্থনা।

দেওয়ালের গায়ে অনেক অক্ষর দেখা গেল—কিছু ফারসি, কিছু সংস্কৃত। হঠাৎ একটায় চোখ আটকালো অর্ণবের—

“ভারত”

শুধু একটিই শব্দ। তাম্রফলকে খোদাই করা। পাশে একটি পদ্মচিহ্ন।

“এটাই…” অর্ণবের গলা শুকিয়ে গেল।

“এটাই ভারত নামের প্রথম পদচিহ্ন,” বললেন অধ্যাপক বসু। “কোনো রাজদরবারে নয়, কোনো রাজার শিলালিপিতে নয়—এই নিঃশব্দ, ভাঙা ঘরের ভিতরেই লেখা হয়েছিল ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নামটি।”

তাদের সামনে শুধু একখণ্ড তাম্রফলক নয়—সামনে দাঁড়িয়ে আছে ভারতের আত্মা। ধর্মের ঊর্ধ্বে, শাসকের ঊর্ধ্বে, এক বিশ্বাস—যেখানে মানুষ একসাথে বাস করতে চেয়েছিল, যুদ্ধের বাইরে।

তারা তাম্রফলক তুলে নিল না। বরং চারপাশে খোঁজখুঁজি করে পেল আরও একটি গোপন কক্ষ। সেই কক্ষে ছিল—

১. একটি কাব্যগ্রন্থ, ফারসি ও সংস্কৃতের সংমিশ্রণে লেখা।

২. একটি ছোট ধাতব মূর্তি—শিব ও পদ্মের যুগলচিত্র।

৩. একটি মুদ্রিত কাগজ, লেখা আছে—“এই ভাবনাই ভারত। যদি রক্ষা করতে চাও, একে বেচো না, পোড়াও না—তুলে রেখো না জাদুঘরে। ছড়িয়ে দাও।”

“তবে কি এই ধন শুধু রত্নের ছিল না?” দৃষ্টি বলল।

“এই ধন আসলে দর্শনের। সত্যের। যে সত্য রাজারা হারিয়ে ফেলেছিল। যে সত্য আমরা আবার পেয়ে গেলাম,” বলল অর্ণব।

হঠাৎ বাইরে গর্জন। একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল ভাঙা হাভেলির সামনে।

একদল মানুষ নামল, হাতে ক্যামেরা, ওয়াকিটকি। তাদের গায়ে একটি লোকাল রাজনৈতিক দলের ব্যাজ।

“কী হচ্ছে এখানে?” গলা চড়িয়ে একজন বলল। “এই এলাকাটা আমাদের সংরক্ষিত। আপনারা এখানে কী খুঁজছেন?”

অধ্যাপক বসু সামনে এগিয়ে এসে বললেন, “আমরা খুঁজছিলাম একটুকরো দেশকে। পেয়ে গেছি।”

লোকগুলো ভ্রু কুঁচকে বলল, “আপনারা কি গুপ্তধন পেয়েছেন?”

অর্ণব এগিয়ে এসে বলল, “হ্যাঁ, পেয়েছি। কিন্তু সেটা মুদ্রা নয়, ইতিহাস। আর এই ইতিহাস আমরা তোমাদের হাতে তুলব না, যারা শুধু রাজনৈতিক লাভের জন্য নিজের শিকড় বিকিয়ে দেয়।”

বাকিরা হকচকিয়ে গেল।

অদ্বিতী সেই মুহূর্তে পার্চমেন্টগুলো অধ্যাপক বসুকে দিল। “আপনি এগুলো আন্তর্জাতিক ইতিহাস গবেষণা ফোরামে জমা দিন। প্রকাশ্যে আনুন।”

রাহুল, নীলয়, কিয়া—সবাই মাথা নিচু করে প্রণাম জানাল সেই পদ্মচিহ্ন খচিত “ভারত” শব্দটিকে।

ছায়াপুরের বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে অর্ণব বলল—

শিবঠাকুর এর সিন্দুক খুঁজতে গিয়ে আমরা ফিরে পেলাম একটা হারানো আদর্শ।

একটা নাম।

একটা দেশ।

যার কোনো সীমান্ত নেই—শুধু একটাই অস্তিত্ব, বিশ্বাস।”

(শেষ)

Lipighor_1750608889774.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *