Bangla - রহস্য গল্প

শালিমারের লাশঘর

Spread the love

প্ৰদ্যুত হালদার


অধ্যায় ১ : কনটেইনারের গোপন রহস্য

হাওড়ার শালিমার রেলইয়ার্ড রাতের আঁধারে যেন এক অন্য জগৎ। দিনের কোলাহল, গাড়ির গতি, রেলস্টেশনের ভিড় সব মিলিয়ে এ জায়গাটির অস্তিত্ব কেউ টেরই পায় না। কিন্তু গভীর রাত নামলে, ফাঁকা ফাঁকা রেললাইনগুলোর পাশে লম্বা সারিতে দাঁড়ানো পুরোনো মালগাড়িগুলো অদ্ভুত এক ভৌতিক আবহ তৈরি করে। সেদিনও এমনই এক রাতে, যখন কুয়াশার আস্তর ক্রমশ ঘন হয়ে উঠছে, তখন শ্রমিকদের নজরে আসে এক পুরোনো কনটেইনারের দিক থেকে আসা তীব্র পচা দুর্গন্ধ। প্রথমে তারা ভেবেছিল ইঁদুর বা কুকুর মারা গেছে ভেতরে, কিন্তু গন্ধ যত বাড়তে থাকে, ততই মনে হতে থাকে এর পেছনে কিছু ভয়ঙ্কর লুকিয়ে আছে। চারজন শ্রমিক টর্চ নিয়ে এগিয়ে যায়, হাতের লোহার রড দিয়ে কনটেইনারের দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে। দরজা আধখোলা হতেই এক প্রবল বাতাসে সেই দুর্গন্ধ আরও ছড়িয়ে পড়ে, আর তার সঙ্গে মৃদু গুঞ্জনের মতো একটা শব্দও কানে আসে—যেন লোহার ভেতর থেকে অচেনা কোন যন্ত্র কাজ করছে। কনটেইনারের ভেতরে টর্চের আলো ফেলতেই তারা দেখে এক অজ্ঞাত পুরুষের মৃতদেহ পড়ে আছে, ঠান্ডা, নিথর, আর মুখে যেন দীর্ঘ যন্ত্রণার ছাপ। ভয়ে শ্রমিকরা পিছিয়ে যায়, একজন ছুটে গিয়ে খবর দেয় ইয়ার্ডের নিরাপত্তারক্ষীদের। মুহূর্তের মধ্যেই এলাকা পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে ঘিরে ফেলে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায় গোয়েন্দা দীপায়ন মুখার্জী—শহরের বিশেষ শাখার নামকরা অফিসার। লম্বা চেহারা, কালো কোটের ভেতর থেকে সিগারেট বের করে এক টান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে, চোখে সেই চিরচেনা কৌতূহলের দ্যুতি। তার সঙ্গে আছে শৈশবের বন্ধু শুভায়ন ঘোষ, শহরের একটি ইংরেজি দৈনিকের ক্রাইম রিপোর্টার। শুভায়ন এক হাতে ক্যামেরা আর অন্য হাতে নোটবুক নিয়ে প্রতিটি খুঁটিনাটি নথিভুক্ত করছে। কনটেইনারের ভেতরে ঢুকে দীপায়ন মৃতদেহের দিকে তাকাতেই অনুভব করল কিছু যেন অস্বাভাবিক। দেহটির গায়ে পুরোনো ধূসর শার্ট, জীর্ণ প্যান্ট, কিন্তু হাতে অদ্ভুত ধরণের চামড়ার ব্যান্ড বাঁধা, যেখানে অচেনা প্রতীকের ছাপ। পুলিশ মৃতদেহ তল্লাশি করে পকেট থেকে যা বের করে তা দেখে সকলে স্তব্ধ—একটি মেডিকেল রিপোর্ট, কিন্তু তাতে তারিখ লেখা “এপ্রিল ২০৪০”। দীপায়নের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হলো। এখনও ২০২৫ সাল, তাহলে পনেরো বছর পরের রিপোর্ট এখানে এল কীভাবে? রিপোর্টে স্পষ্ট করে লেখা রোগীর নাম, চিকিৎসকের সই, হাসপাতালের লোগো—সব কিছু যেন নিখুঁতভাবে মুদ্রিত। শুভায়ন অবাক হয়ে দীপের দিকে তাকাল, “দেখলি? এটা কি তবে কারও চালাকি? নাকি…” বাক্যটা শেষ করতে পারল না সে। দীপ ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছুঁড়ে ধীরে বলল, “চালাকি হলে এটার কাগজ এতটা নিখুঁতভাবে ভবিষ্যতের তারিখ দেখাবে না। এর পেছনে অন্য কিছু আছে।”

শালিমার ইয়ার্ডের অন্ধকারে তখন কনটেইনারের চারপাশে জমে উঠেছে তুমুল উত্তেজনা। সাধারণ মানুষ দূর থেকে ব্যারিকেডের আড়াল দিয়ে তাকিয়ে আছে, ফিসফিস করে বলছে ভূতের কাহিনি, কেউ কেউ বলছে সময় ভেদ করে কোনো অচেনা ট্রেন এসেছে। পুলিশ কনটেইনার সিল করে ফরেনসিক দলের হাতে তুলে দেয়, আর মৃতদেহ সরিয়ে নেওয়া হয় মর্গে। কিন্তু রিপোর্টের সেই তারিখ এবং মৃতের হাতে বাঁধা অদ্ভুত ব্যান্ড—এসবই রহস্যকে আরও গভীর করে তোলে। শুভায়ন ডায়েরিতে লিখল—“আজ শালিমারের অন্ধকারে যা দেখলাম, সেটা হয়তো সাধারণ অপরাধ নয়। হয়তো সময়ের গহ্বর খুলেছে, আর তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে মৃত্যু।” দীপ জানত, এই মামলায় শুধু খুন বা চুরি নয়, এর পেছনে হয়তো বিজ্ঞানের অদ্ভুত খেলা আছে। রাত বাড়তে থাকে, কুয়াশা ঘন হতে থাকে, আর শালিমারের পরিত্যক্ত লাইন ধরে গা ছমছমে পরিবেশে শুরু হয় এক অজানা যাত্রা—যার নাম হবে পরবর্তীকালে, “শালিমারের লাশঘর”।

অধ্যায় ২ : প্রমাণের প্রথম ছাপ

রাতভর শালিমার ইয়ার্ডে পুলিশি টহল আর ফরেনসিক দলের ভিড় শেষে ভোরবেলা মৃতদেহ ও কনটেইনার থেকে সংগৃহীত প্রমাণাদি নিয়ে যাওয়া হলো লালবাজারের ল্যাবে। শহর তখনও ঘুমিয়ে, হাওড়ার নদীপাড়ে সকালের কুয়াশা সরে যেতে শুরু করেছে। ঠিক তখনই ফরেনসিক এক্সপার্ট ডঃ মেহরাজ আনোয়ার নিজের ল্যাবরুমে বসে গভীর মনোযোগে রিপোর্টটি খুঁটিয়ে দেখছেন। বয়স পঁয়তাল্লিশ, গম্ভীর, সংযমী, আর পেশার প্রতি তার এক অদ্ভুত দায়বদ্ধতা। ফাইলের ভেতরে রাখা মেডিকেল রিপোর্টের কাগজ হাতে নিয়ে তিনি অবাক হলেন—এটি সাধারণ কাগজ নয়, বরং তাতে ব্যবহার করা হয়েছে এমন এক ধরনের সিন্থেটিক ফাইবার যা এখনো ভারতের কোনো প্রিন্টিং টেকনোলজিতে ব্যবহৃত হয়নি। কালি পরীক্ষা করতে গিয়ে তিনি দেখলেন, এর রাসায়নিক গঠন ২০২৫ সালের প্রচলিত কালি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, যেন আরও উন্নত কোনো প্রযুক্তিতে তৈরি। ল্যাবের মাইক্রোস্কোপিক স্ক্যানার ঘোরাতে ঘোরাতে তিনি নিজেই ফিসফিস করে বললেন, “এটা… এটা তো সময়ের আগের কোনো জিনিস।” তিনি যখন মৃতদেহ পরীক্ষা করতে গেলেন, তখন আরেকটি চমক অপেক্ষা করছিল। অজ্ঞাত পুরুষের শরীরে বিকিরণজাত চিহ্ন, যেন কোনো অদৃশ্য রেডিয়েশন দীর্ঘ সময় ধরে তার দেহে প্রভাব ফেলেছে। সাধারণ রেলইয়ার্ডে এমন বিকিরণ আসা সম্ভব নয়। ফলে, প্রশ্নটা বড় হতে লাগল—দেহটি কোথা থেকে এল?

এদিকে, একই সময়ে লালবাজারে বসেছেন কমিশনার সৌরভ চক্রবর্তী। তিনি কঠোর স্বভাবের মানুষ, সোজাসাপ্টা এবং বাস্তববাদী। কোনো অতিপ্রাকৃত বা কাল্পনিক তত্ত্বে তার বিশ্বাস নেই। সকালে মেহরাজের প্রাথমিক রিপোর্ট হাতে আসতেই তার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। দীপায়ন আর শুভায়নও তখন অফিসে উপস্থিত। মেহরাজ যখন বোঝাচ্ছেন কাগজের সিন্থেটিক প্রকৃতি, কালি-সংক্রান্ত অদ্ভুত রাসায়নিক গঠন আর মৃতদেহের বিকিরণ চিহ্ন, তখন কমিশনার টেবিলে হাত ঠুকে বললেন, “এইসব বাজে গল্প আমি শুনতে চাই না। এটা নিছক একটা ফেক ডকুমেন্ট। কেউ চতুরভাবে ভবিষ্যতের তারিখ বসিয়ে বিভ্রান্ত করতে চাইছে। আর ওই দেহ—খুন করা হয়েছে, তারপর কনটেইনারে ফেলে দেওয়া হয়েছে।” তার এই দৃঢ় কণ্ঠে ঘরটা কেঁপে ওঠে। দীপ সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়ার রিং তুলতে তুলতে ঠাণ্ডা স্বরে বলল, “কমিশনার, যদি এটা জাল হত, তাহলে অন্তত কাগজ আর কালি আমাদের পরিচিত হতো। এখানে কিন্তু সবই অপরিচিত। এমনকি রেডিয়েশনও।” শুভায়ন তৎক্ষণাৎ যোগ করল, “আমরা সাংবাদিকরা ফেক ডকুমেন্ট প্রচুর দেখেছি। কিন্তু এর কাগজ ছুঁলেই বোঝা যায়—এটা অন্য কিছু।” সৌরভ চক্রবর্তী কিন্তু এসব শুনে আরও চটে গেলেন। তিনি মনে মনে ভাবলেন, দীপ হয়তো আবার কোনো অযথা ফ্যান্টাসি তত্ত্বে ঢুকছে, যা পুলিশের ইমেজ খারাপ করবে। তাই তিনি সরাসরি আদেশ দিলেন—“এই মামলাকে সাধারণ খুন হিসেবে চালিয়ে যান। বেশি বাড়াবাড়ি করবেন না।”

কিন্তু ফরেনসিক রিপোর্ট দীপকে অন্য কিছুর দিকে টেনে নিল। রাতে সে একা বসে মেহরাজের বিশ্লেষণ আবার পড়ল। রিপোর্টে লেখা—“কাগজের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কার্বন ন্যানোটিউবের মতো ফাইবার ব্যবহৃত হয়েছে, যা বর্তমান প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রিতে এখনো কার্যকর হয়নি। কালি-সংক্রান্ত বিশ্লেষণে পাওয়া গেছে এমন কিছু যৌগ, যা ২০৩৫ সালের পর তৈরি হওয়া মলিকিউলার প্রিন্টিং প্রযুক্তির সঙ্গে মিলে যায়।” দীপ ভুরু কুঁচকে ভাবল—এর মানে যদি সত্যি হয়, তবে রিপোর্টটা সত্যিই ভবিষ্যৎ থেকে এসেছে। সে মনে মনে বুঝল, কমিশনারকে বোঝানো যাবে না, কিন্তু মেহরাজের কথাগুলো উপেক্ষা করার উপায় নেই। এদিকে শুভায়ন তার পত্রিকার জন্য খবর লিখতে গিয়ে বারবার দ্বিধায় পড়ছে—কোনটা লিখবে আর কোনটা বাদ দেবে। সে জানে যদি ‘২০৪০ সালের মেডিকেল রিপোর্ট’ অংশটা লিখে দেয়, পুরো শহর হইচই করে উঠবে, আর পুলিশ তাকে চেপে ধরবে। কিন্তু সত্যকে চেপে রাখা কি সম্ভব? রাত যত বাড়ছে, শালিমারের অন্ধকার থেকে আসা গন্ধ, সেই কনটেইনারের দৃশ্য আর মৃতদেহের রহস্য দীপের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, দূরে ট্রেনের হুইসেল শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে গোটা শহর যেন অজানা কোনো ঘটনার অপেক্ষায় নিস্তব্ধ হয়ে আছে। দীপ জানত—এই কেস সাধারণ নয়, আর এই প্রমাণই প্রথম ছাপ, যা একদিন হয়তো প্রমাণ করে দেবে—সময়কে ভেদ করে কেউ একজন ফিরে এসেছে।

অধ্যায় ৩ : লীনার আবির্ভাব

শালিমারের ঘটনার দ্বিতীয় দিন সকালে কমিশনার সৌরভ চক্রবর্তীর নির্দেশে রেলওয়ে বিভাগের সঙ্গে যৌথ বৈঠক ডাকা হলো। তদন্তে দ্রুত অগ্রগতি না হলে বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে আরও ছড়িয়ে পড়বে, আর তিনি সেটা একেবারেই চান না। রেলওয়ের বিভিন্ন শাখার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন, আর তাদের মধ্যে ছিলেন একজন তরুণী সিগন্যাল ইঞ্জিনিয়ার—লীনা দত্ত। বয়স মাত্র ছাব্বিশ, কিন্তু কাজের অভিজ্ঞতা আর আত্মবিশ্বাসে সে সমবয়সীদের থেকে অনেকটা এগিয়ে। লম্বা দেহ, গাঢ় বাদামী চোখ আর গলায় ঝোলানো অফিসিয়াল আইডি কার্ড—তাকে প্রথম দেখাতেই বোঝা যায় সে পেশাদার। লীনা যখন কনটেইনার নিয়ে কথা বলতে শুরু করল, তখন পুরো ঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেল। সে স্পষ্ট জানাল, শালিমার ইয়ার্ডে যে কনটেইনার পাওয়া গেছে, তার কোনো রেকর্ড নেই রেলওয়ের অফিসিয়াল ডাটাবেসে। সাধারণত প্রতিটি কনটেইনারের একটি নির্দিষ্ট নম্বর থাকে, যেটি প্রবেশ থেকে গন্তব্য পর্যন্ত সবসময় নথিভুক্ত থাকে। কিন্তু এই কনটেইনারের নম্বর ট্র্যাক করতে গিয়ে দেখা গেছে, সেটি ডাটাবেসে নেই। এমনকি আগের রাতের সিসিটিভি ফুটেজেও দেখা যাচ্ছে না যে কবে বা কীভাবে কনটেইনারটি ইয়ার্ডে এসেছে। যেন হঠাৎ করেই অদ্ভুতভাবে তা হাজির হয়েছে, ঠিক মাঝরাতে।

দীপায়ন বিষয়টি শোনার পর চুপচাপ লীনাকে লক্ষ্য করতে লাগল। মেয়েটির কথার মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক মিশে আছে, যদিও সে সেটি আড়াল করার চেষ্টা করছে। দীপের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা তাকে শিখিয়েছে—মানুষের চোখ কখনো মিথ্যা বলে না। লীনার চোখের গভীরে সেই আতঙ্ক স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, যেন সে নিজে কিছু জানে, কিন্তু মুখ খুলতে চাইছে না। বৈঠক শেষে যখন সবাই বেরিয়ে যাচ্ছিল, দীপ বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল লীনার জন্য। লীনা বেরিয়ে আসতেই দীপ তাকে থামাল—“মিস দত্ত, আপনি বলছিলেন কনটেইনারটা কোনো রেকর্ড ছাড়া হাজির হয়েছে। এটা কি প্রযুক্তিগত ত্রুটি হতে পারে?” লীনা কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, “ত্রুটি হলে সিস্টেমে অন্তত কোনো ভাঙা ট্রেস থাকত। এখানে কিছুই নেই। মনে হচ্ছে পুরো ডাটাবেস যেন একে অস্বীকার করছে।” শুভায়ন সঙ্গে সঙ্গে হেসে বলল, “মানে, ভূতের কনটেইনার?” লীনা ঠোঁট কামড়ে ফেলল, উত্তর দিল না। তার মুখের অভিব্যক্তি যেন মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠল, তারপর বলল, “আমি কিছু জানি না। তবে কনটেইনারটা যেভাবে এসেছে, সেটা সাধারণ কোনো ব্যাপার নয়।” দীপ লক্ষ্য করল, কথার শেষে লীনার চোখের পলক পড়ার গতি বেড়ে গেল, আর কপালে ছোট ছোট ঘাম জমতে শুরু করেছে।

সেই রাতেই দীপ তার অফিসে বসে লীনার দেওয়া তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করছিল। টেবিলে রাখা কনটেইনার নম্বর, রেলওয়ের প্রবেশ রেকর্ড আর ফরেনসিক রিপোর্ট—সব মিলিয়ে একটি অদ্ভুত সমীকরণ তৈরি হচ্ছিল। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। দরজা খুলতেই দেখা গেল, লীনা দাঁড়িয়ে আছে। গাঢ় নীল শাল জড়িয়ে যেন চুপচাপ কাঁপছে। দীপ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “এত রাতে? কী হয়েছে?” লীনা আস্তে করে ভেতরে ঢুকল, চারপাশে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, “আমি জানি কিছু ব্যাপার। কিন্তু কমিশনারের সামনে বলা সম্ভব নয়। সবাই ভাববে আমি পাগল।” দীপের দৃষ্টি তার চোখে আটকে গেল—সেখানে শুধু ভয় নয়, গভীর এক গোপন আড়াল করা আছে। লীনা ধীরে ধীরে বলল, “কনটেইনারটা একেবারেই রেকর্ড ছাড়া আসেনি। আমি সিগন্যাল সিস্টেমে হঠাৎ অস্বাভাবিক এক ফ্লাকচুয়েশন দেখেছিলাম। যেন কয়েক সেকেন্ডের জন্য সিগন্যাল রিডার পুরোপুরি বিকৃত হয়ে গিয়েছিল, তারপর আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। ওই বিকৃতির মুহূর্তের পরেই কনটেইনারটা হাজির হয়। আপনি যদি এটা কাউকে বলেন, তারা বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আমি চোখে দেখেছি।” দীপ চুপ করে শোনে গেল। তার মনে হচ্ছিল—শালিমারের এই রহস্য হয়তো সাধারণ খুন বা অপরাধ নয়, বরং সময় আর বাস্তবতার সীমানা ভেদ করার মতো কিছু। লীনার আতঙ্কিত কণ্ঠস্বর আর চোখের অদ্ভুত অস্বস্তি প্রমাণ করছিল, এই তরুণী কোনো গভীর সত্যের সাক্ষী, যা হয়তো তাকে আজীবন তাড়া করে ফিরবে। সেই রাতেই দীপ বুঝল, তদন্তে নতুন অধ্যায় শুরু হলো—লীনার আবির্ভাব।

অধ্যায় ৪ : শালিমারের ছায়া

শুভায়ন ছিল কৌতূহলী মানুষ, আর সাংবাদিক বলেই সে কোনো ঘটনা ঘটলে সেটিকে শুধু রিপোর্টে সীমাবদ্ধ রাখত না—নিজে প্রমাণ খুঁজতে চাইত। শালিমার ইয়ার্ডের রহস্য যখন দিনে দিনে গভীর হচ্ছে, তখন রাত নামতেই সে ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। দূরে মালবাহী রেলের লম্বা সারি, মরচে ধরা লোহার গন্ধ, আর শূন্যে ঝুলে থাকা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা পুরো জায়গাটিকে ভৌতিক করে তুলেছিল। শুভায়ন জানত, এই নির্জনতায় অনেক কিছু ধরা যায় যা দিনের কোলাহলে সম্ভব নয়। ট্রাইপড বসিয়ে সে কয়েকটা ছবি তুলছিল, হঠাৎ লেন্সের ভেতর এক অদ্ভুত ছায়ামূর্তি ধরা পড়ল। প্রথমে সে ভেবেছিল হয়তো শ্রমিকদের কেউ। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই লক্ষ্য করল—ছায়াটা স্থির দাঁড়িয়ে আছে, আর পরের মুহূর্তেই হাওয়ার মতো মিলিয়ে গেল। শুভায়নের বুক কেঁপে উঠল। সে ছবি চেক করতে গিয়ে দেখল, ক্যামেরায় ছায়ামূর্তিটা অস্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে, যেন মানুষ নয়, বরং আলো আর অন্ধকারের মিশ্রিত এক বিভ্রম। আশেপাশে তাকিয়ে সে হঠাৎ অনুভব করল—কেউ যেন দূর থেকে তার প্রতিটি নড়াচড়া লক্ষ্য করছে। বুকের ভেতর ধকধক শুরু হলো, কিন্তু সে ভয়ের মাঝেই বুঝল, সাংবাদিকের কাজ হলো সত্য উদঘাটন করা। ক্যামেরা বুকে ঝুলিয়ে সে সিগন্যাল রুমের দিকে এগোল, যেখান থেকে রাতের আলো নিভু নিভু ভেসে আসছিল।

সিগন্যাল রুমে ঢুকেই শুভায়ন থমকে গেল। ঘরের ভেতরে বৈদ্যুতিক তারগুলো অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছিল, যেন কেউ অদৃশ্য হাতে তারগুলিকে টানছে। মেশিনের বোর্ডে ছোট ছোট লাইটগুলো অনবরত জ্বলছে আর নিভছে, কোনো সিস্টেমেটিক ধারা ছাড়াই। এমনকি দেয়ালে টাঙানো ঘড়ির কাঁটা কয়েক মুহূর্তের জন্য থেমে গিয়ে আবার ঘুরতে শুরু করল। শুভায়ন ভয়ে কেঁপে উঠলেও সঙ্গে সঙ্গে ফোন বের করে রেকর্ড করতে লাগল। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো—ক্যামেরায় কোনো কিছুই স্পষ্ট ধরা পড়ছিল না। শুধু দপদপে আলো আর স্ট্যাটিক নয়েজের মতো একটা ঝাপসা ছবি। সেই সময় হঠাৎ দরজায় দাঁড়িয়ে দীপ বলল, “আমি জানতাম তুমি এখানে আসবে।” শুভায়ন ঘাম ভেজা কপাল মুছতে মুছতে উত্তর দিল, “তুইও কি দেখলি? তারগুলো নিজেরাই কাঁপছে।” দীপ একপাশে দাঁড়িয়ে গভীরভাবে দৃশ্যটা পর্যবেক্ষণ করছিল। তার অভিজ্ঞ চোখে এটা কোনো সাধারণ বৈদ্যুতিক গোলযোগ মনে হচ্ছিল না। ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে সে হাত রাখল দেয়ালে, আর আশ্চর্যজনকভাবে বুঝল—ঘরজুড়ে যেন এক অচেনা কম্পন ছড়িয়ে আছে। এটি বিদ্যুতের ঝাঁকুনি নয়, বরং সময়ের ভেতর দিয়ে সৃষ্ট এক অদৃশ্য তরঙ্গের মতো।

দীপের মনে দৃঢ় হলো, শালিমারের ইয়ার্ডে শুধু অপরাধ বা রহস্যই লুকিয়ে নেই, বরং এখানে ঘটছে সময়–সংক্রান্ত কোনো অজানা ঘটনা। সে বলল, “শুভ, এ শুধু প্রযুক্তির গোলযোগ নয়। মনে হচ্ছে এখানে কোনো সময়ের ফাঁক তৈরি হচ্ছে। ঠিক যেমন ভৌতবিজ্ঞানে টাইম–ডাইলেশন বা কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন নিয়ে পড়ি। এই কনটেইনার, মৃতদেহ, মেডিকেল রিপোর্ট—সবই হয়তো সেই অজানা ফাঁক দিয়ে এসেছে।” শুভায়ন বিস্মিত হয়ে তাকাল, “মানে তুই বলতে চাইছিস ভবিষ্যৎ থেকে কিছু এসে পড়েছে?” দীপ চুপ করে সিগন্যাল রুমের দিকে তাকিয়ে রইল। জানালার বাইরে আবারও অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি দেখা গেল, এবার যেন আরও কাছে। শুভায়নের বুকের ধড়ফড় বেড়ে গেল, কিন্তু দীপ স্থির গলায় বলল, “যে-ই হোক, ওরা শুধু তাকিয়ে নেই। ওরা এই জায়গার সঙ্গে বাঁধা পড়েছে। আমাদের বুঝতে হবে—শালিমারের এই ছায়া আসলে কী।” সেই মুহূর্তে বাইরে দূরে ট্রেনের হুইসেল বাজল, আর তার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের আলো নিভে গেল একেবারে। অন্ধকারের ভেতরে শুধু শোনা গেল বৈদ্যুতিক গুনগুন, আর অচেনা কোনো শক্তি যেন পুরো পরিবেশকে গ্রাস করে নিচ্ছে। সেই রাতেই দু’জন বুঝল—শালিমারের ছায়া শুধু রহস্য নয়, বরং আসন্ন বিপদের পূর্বাভাস।

অধ্যায় ৫ : মৃতদেহের পরিচয়

ফরেনসিক ল্যাবের সাদা আলোর নিচে বসে দীপ, শুভায়ন আর ডঃ মেহরাজ নিঃশব্দে অপেক্ষা করছিলেন। ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে আসার সঙ্গে সঙ্গেই পুরো ঘরে যেন এক অদ্ভুত ভারী নীরবতা নেমে এল। মেহরাজ ফাইল খুলে ধীরে ধীরে পড়তে শুরু করলেন, তার কপাল কুঁচকে গেল বিস্ময়ে। তিনি গলা পরিষ্কার করে বললেন, “মৃতদেহটির নাম অর্ণব সেনগুপ্ত। বয়স আজ হলে প্রায় পঁয়তাল্লিশ। আশ্চর্যের বিষয়, এই নাম আমি আগে শুনেছি।” দীপ সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করল, “আপনি কি তাকে চিনতেন?” মেহরাজ মাথা নেড়ে বললেন, “ব্যক্তিগতভাবে নয়, কিন্তু বৈজ্ঞানিক মহলে অর্ণব সেনগুপ্ত এক সময় বেশ আলোচিত নাম ছিল। তিনি ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানী, গবেষণার ক্ষেত্র—টাইম ডাইলেশন আর কোয়ান্টাম টানেলিং। বছর দশেক আগে হঠাৎ করেই তিনি নিখোঁজ হয়ে যান, তখন খবরের কাগজে বেশ চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছিল। পুলিশের রেকর্ড বলছে, তিনি কোথাও উধাও হয়ে গিয়েছিলেন, আর কেউ কোনোদিন তার হদিশ পায়নি।” শুভায়ন হতভম্ব হয়ে বলল, “মানে, মৃতদেহটা সেই অর্ণব সেনগুপ্তের? কিন্তু যদি সে দশ বছর আগে নিখোঁজ হয়ে থাকে, তবে এখন তার দেহটা এতটা অক্ষত অবস্থায় কীভাবে মিলল? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, তার পকেটে পাওয়া মেডিকেল রিপোর্টে যে তারিখ লেখা আছে সেটা তো ২০৪০ সাল!” দীপ কোনো উত্তর দিল না, বরং ফাইলের পাতায় স্থির চোখে তাকিয়ে থাকল, যেন লাইনগুলোর আড়াল থেকে অদ্ভুত সত্য উঁকি দিচ্ছে।

অর্ণব সেনগুপ্ত নামটার সঙ্গে যুক্ত রহস্যগুলো একে একে ভেসে উঠতে লাগল। তার গবেষণার নথি অনুযায়ী তিনি বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন সময়ের গঠন আর ভাঙন নিয়ে। কোয়ান্টাম টানেলিং নিয়ে তার থিসিসে উল্লেখ ছিল, কণাগুলো মাঝে মাঝে এমনভাবে এক বিন্দু থেকে আরেক বিন্দুতে পৌঁছে যায়, যেন মাঝের বাধা অতিক্রম করে নয় বরং বাইপাস করে চলে যায়। এই তত্ত্বকে যদি বৃহত্তর স্কেলে প্রয়োগ করা যায় তবে বস্তু, এমনকি মানুষও, সময়ের সীমারেখা ভেদ করে অন্য প্রান্তে পৌঁছতে পারে। তার গবেষণায় এই ধারণাটাই তাকে বিতর্কিত করে তোলে। বৈজ্ঞানিক মহলের অনেকেই তাকে স্বপ্নবাজ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, আবার অনেকেই মনে করতেন তিনি হয়তো যুগান্তকারী কিছু আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে ছিলেন। তার হঠাৎ অন্তর্ধান সবাইকে দ্বিধায় ফেলে দিয়েছিল—সে কি ব্যর্থ পরীক্ষার ফলে মারা গেছে, নাকি কোনো গোপন প্রজেক্টের জন্য তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে? এখন, মৃতদেহের অদ্ভুত পুনঃআবির্ভাব যেন প্রমাণ করছে, অর্ণব শুধু সময়ের সঙ্গে খেলা করছিলেন না, হয়তো সেই খেলার বলি হয়ে পড়েছিলেন। ডিএনএ রিপোর্টের সঙ্গে পাওয়া মেডিকেল রিপোর্টের কাগজ ও কালি আবারও রহস্য গভীর করল—কারণ বিশ্লেষণে প্রমাণ মিলেছে, এগুলো এখনকার প্রযুক্তিতে তৈরি নয়। মানে এগুলো সত্যিই ভবিষ্যৎ থেকে আসা কাগজ। শুভায়নের মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল প্রশ্ন, “তাহলে কি সত্যিই অর্ণব ভবিষ্যৎ থেকে ফিরে এসেছে? নাকি সে কোথাও সময়ের ফাঁদে আটকে গিয়েছিল?”

দীপ দীর্ঘক্ষণ নীরব থেকে বলল, “অর্ণবের নিখোঁজ হওয়া কোনো সাধারণ ঘটনা ছিল না। আমি মনে করি, তিনি নিজের গবেষণা দিয়ে এমন কিছু স্পর্শ করেছিলেন যা আমাদের জানা বিজ্ঞানকে অতিক্রম করে। আর সেই কারণেই হয়তো তিনি সময়ের বাইরে সরে গিয়েছিলেন। এই দেহ তার প্রমাণ।” মেহরাজ একটু দ্বিধায় পড়লেন, বললেন, “কিন্তু যদি সে সত্যিই ভবিষ্যৎ থেকে ফিরে এসে মারা গিয়ে থাকে, তবে তার পকেটে রিপোর্টটা কেন ছিল? কার জন্য রেখে গিয়েছিল সেটা?” দীপ তাকাল শুভায়নের দিকে, তারপর ধীরে বলল, “হয়তো আমাদের জন্য। হয়তো সে জানত, একদিন তার দেহ এই জায়গায় পাওয়া যাবে, আর তার সঙ্গে লুকিয়ে থাকবে এক অমীমাংসিত প্রশ্ন। প্রশ্নটা হলো—সময় কি কেবল এগোয়, নাকি কখনো ফিরে আসে?” ঘরের ভেতর ভারী নীরবতা নেমে এল। বাইরের আকাশে ট্রেনের সিটি ভেসে এলো, যেন অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ একসঙ্গে সাড়া দিচ্ছে। সেই মুহূর্তে তিনজনই বুঝতে পারল—অর্ণব সেনগুপ্তর মৃত্যু শুধু এক বিজ্ঞানীর সমাপ্তি নয়, বরং সময়ের অদ্ভুত খেলার প্রথম ইঙ্গিত। এখন তাদের কাজ হলো সেই খেলাটার নিয়ম খুঁজে বের করা, আর তাতে হয়তো তাদের নিজেদের জীবনও সময়ের ফাঁদে জড়িয়ে পড়তে চলেছে।

অধ্যায় ৬ : গোপন ফাইল

শুভায়ন তার সাংবাদিকসুলভ কৌতূহলকে দমাতে পারল না। মৃতদেহের পরিচয় জানার পর থেকে তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগছিল একটি প্রশ্ন—অর্ণব সেনগুপ্তর গবেষণাগুলো কি আদৌ কোথাও সংরক্ষিত আছে? দীর্ঘ খোঁজাখুঁজির পর সে পৌঁছল এক পুরোনো আর্কাইভে, যেখানে বহুদিন ধরে অগোছালোভাবে রাখা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের নথি আর গবেষণাপত্র। ধুলোমলিন ফাইলের স্তুপে ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে তার চোখে পড়ল একটি ফোল্ডার, যার মলাটে অর্ণবের নাম লেখা। হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজগুলো খুলে দেখতে গিয়ে শুভায়ন বুঝতে পারল, এগুলো সাধারণ বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ নয়, বরং অর্ণবের ব্যক্তিগত গবেষণার নোট, স্কেচ আর অদ্ভুত সমীকরণে ভরা। ফাইলের ভেতরে কিছু ডায়াগ্রাম আঁকা ছিল, যেগুলো প্রথম দেখায় জটিল সার্কিট বা কোনো পরীক্ষামূলক মেশিনের ব্লুপ্রিন্ট মনে হচ্ছিল। পৃষ্ঠার ওপর বড় হরফে লেখা ছিল—“Chrono-Gate”। শুভায়নের হাত কেঁপে উঠল। প্রতিটি পাতায় লেখা ছিল সময় সম্পর্কিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার নথি, যেখানে বলা হয়েছে কীভাবে কোয়ান্টাম স্তরে ক্ষুদ্র এক “ফাঁক” বা “গেট” তৈরি করা যায়, যার ভেতর দিয়ে বস্তু বা কণা সামান্য সময়ের সীমানা অতিক্রম করতে পারে। লেখা ছিল—“যদি এই ফাঁককে স্থিতিশীল রাখা যায়, তবে বৃহত্তর জগতেও সময়ের ভেতর ভ্রমণ সম্ভব।” শুভায়ন বুঝতে পারল, এ কোনো সাধারণ বৈজ্ঞানিক কল্পনা নয়; বরং একজন মানুষের আজীবনের গবেষণা, যা হয়তো তার জীবনকেই গ্রাস করে ফেলেছিল।

সে রাতেই শুভায়ন ফাইলগুলো নিয়ে দীপের কাছে হাজির হলো। দীপ মনোযোগ দিয়ে পাতাগুলো একে একে পড়তে লাগল। পাতার ভেতর থেকে যেন অর্ণবের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছিল—তার হতাশা, তার আশা আর তার ভয়। এক জায়গায় অর্ণব লিখেছিলেন, “সময়ের ভেতর ফাঁক তৈরি করা মানেই অজানা শক্তিকে আহ্বান করা। এর পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ, যদি গেট বন্ধ না হয়। পরীক্ষার সময় সামান্য ভুল মানেই হয়তো আমি নিজেই সেই অন্ধকারে হারিয়ে যাব।” দীপ গভীরভাবে শ্বাস নিল, তারপর ধীরে বলল, “অর্ণব সম্ভবত ঠিক এটিই ঘটিয়েছিলেন। তিনি হয়তো নিজের শরীরেই পরীক্ষার ঝুঁকি নিয়েছিলেন, আর সেই ‘Chrono-Gate’-এর ভেতর ঢুকে পড়ে আটকে গিয়েছিলেন। হয়তো সময়ের ঢেউ তাকে ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়, আবার কোনো অদ্ভুত শক্তি তাকে টেনে নিয়ে আসে এই বর্তমানের ভেতরে।” শুভায়ন হকচকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “মানে মৃতদেহটা যে অবস্থায় আমরা পেয়েছি, সেটা কোনো দুর্ঘটনা নয়, বরং পরীক্ষার সরাসরি ফল?” দীপ মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, আর সেই কারণেই তার শরীরে বিকিরণজনিত চিহ্ন পাওয়া গেছে। সময়ের স্রোত ভেদ করা মানে সাধারণ শক্তি নয়—এমন এক শক্তির স্পর্শ, যা মানুষের শরীরের সঙ্গে মানানসই নয়।” দুইজনেরই মনে হলো, তারা হয়তো এমন এক কিছুর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে যা শুধু বৈজ্ঞানিক রহস্য নয়, বরং অস্তিত্বের সীমাকেও চ্যালেঞ্জ করছে।

তবে ফাইলের শেষ পাতাগুলোই সবচেয়ে চমকপ্রদ। সেখানে অর্ণব নিজের হাতে আঁকা একটি অর্ধসমাপ্ত যন্ত্রের ছবি এঁকেছিলেন, যার নাম তিনি দিয়েছিলেন—“Chrono-Gate Prototype 1.0”। পাশে লেখা সতর্কবার্তায় তিনি লিখেছিলেন, “এই যন্ত্রকে সক্রিয় করার পর তা কখন, কোথায় খুলবে তা নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। একবার খোলা হলে গেটটি হয়তো অজানা সময়ের দিকে নিয়ে যাবে।” দীপ দীর্ঘক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকল। তার চোখে ভেসে উঠছিল শালিমার ইয়ার্ডের অদ্ভুত বৈদ্যুতিক কম্পন, সিগন্যাল রুমের কাঁপা তার, আর রাতের অচেনা ছায়ামূর্তি। সে ধীরে বলল, “সব কিছু মিলে যাচ্ছে। কনটেইনার, মৃতদেহ, মেডিকেল রিপোর্ট—সবই এই যন্ত্রের ফল। সম্ভবত শালিমার ইয়ার্ড কোনোভাবে সেই গেটের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। অর্ণবের পরীক্ষা এখানেই ঘটেছিল।” শুভায়নের কণ্ঠ কেঁপে উঠল, “মানে যন্ত্রটা কি এখনও সক্রিয় আছে?” দীপ কোনো উত্তর দিল না। শুধু ফাইলের পাতায় আঙুল রেখে বলল, “আমাদের সাবধান হতে হবে। কারণ যদি সত্যিই ‘Chrono-Gate’ এখনও কোথাও খোলা থাকে, তবে এই রহস্য শুধু অর্ণব সেনগুপ্তর মৃত্যুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। হয়তো পুরো শহরই সময়ের ফাঁদে জড়িয়ে পড়বে।” সেই মুহূর্তে ঘরের বাতাস যেন হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে গেল, আর দুইজনই অনুভব করল—অর্ণব যে বিপদের কথা লিখে গিয়েছিলেন, সেটি হয়তো এখনও অন্ধকারে সক্রিয় হয়ে আছে।

অধ্যায় ৭ : লীনার সত্য

দীপ ও শুভায়নের সন্দেহ দিন দিন বেড়েই চলছিল। শালিমার ইয়ার্ডের প্রতিটি সূত্র যেন লীনার দিকে ইঙ্গিত করছিল, কিন্তু সে সবসময় রহস্যময়ভাবে এড়িয়ে যাচ্ছিল প্রশ্ন। এক সন্ধ্যায় দীপ ঠিক করল, লীনার অতীত খুঁজে দেখা দরকার। কিছুটা খোঁজখবর নিয়ে সে পৌঁছে গেল এক পুরোনো ফ্ল্যাটে, যেখানে লীনার শৈশব কেটেছিল। ফ্ল্যাটের প্রতিবেশীরা জানালেন, লীনার মা ছিলেন একজন অধ্যাপিকা, পদার্থবিদ্যার শিক্ষক এবং একইসঙ্গে অর্ণব সেনগুপ্তর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী। দীপ অবাক হয়ে শুনল, লীনার মায়ের নাম ছিল সোহিনী দত্ত—অর্ণবের অন্যতম প্রাক্তন ছাত্রী। প্রতিবেশীরা বলল, সোহিনী প্রায়ই অর্ণবের কথা বলতেন, আর তার হঠাৎ নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে এক ধরনের বিষণ্নতায় ভুগতেন। সেই সময় লীনার বয়স খুব কম হলেও, তার চোখে মায়ের অদ্ভুত দুশ্চিন্তা ও গোপন আতঙ্ক স্পষ্ট ছিল। সোহিনী একদিন সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলেছিলেন, “অর্ণব মারা যায়নি, সে সময়ের ভেতরে আটকে গেছে।” লোকজন তখন ভেবেছিল, শোকের চাপে তিনি পাগল হয়ে গেছেন। কিন্তু দীপের মনে হলো, এই কথার ভেতরে কোনো গভীর সত্য লুকানো আছে, যা হয়তো অর্ণবের গবেষণার সঙ্গেই মিশে আছে।

পরের দিন লীনাকে মুখোমুখি বসিয়ে দীপ নীরবে বলল, “আমরা জানি তুমি কেবল একজন সিগন্যাল ইঞ্জিনিয়ার নও। তোমার মায়ের নাম সোহিনী দত্ত। তিনি অর্ণব সেনগুপ্তর প্রাক্তন ছাত্রী ছিলেন, তাই তো?” লীনা প্রথমে চমকে উঠল, চোখ নামিয়ে রাখল কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। আমি এতদিন এটা গোপন রেখেছিলাম, কারণ ভেবেছিলাম কেউ বিশ্বাস করবে না। মা সবসময় বলতেন, অর্ণব স্যার কোনো ‘টাইম লুপ’-এর মধ্যে আটকে পড়েছেন। তিনি অদৃশ্য হয়ে গেছেন, কিন্তু পুরোপুরি হারিয়ে যাননি। মা বিশ্বাস করতেন, কোনো একদিন সময়ের ফাঁক দিয়ে তিনি আবার ফিরে আসবেন।” শুভায়ন তীব্র কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তাহলে তুমি কেন এসব লুকিয়ে রাখছিলে?” লীনার কণ্ঠ কেঁপে উঠল, “কারণ আমি নিজেই নিশ্চিত ছিলাম না। মায়ের মৃত্যুর পর আমি তার জমানো কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে অর্ণব স্যারের গবেষণার কিছু কপি পাই। মা সেগুলো বছর বছর ধরে গোপনে সংগ্রহ করেছিলেন, হয়তো কেউ চুরি করে নেবে এই ভয়ে কাউকে জানাননি। আমি যখন বড় হই, তখনই বুঝতে পারি, এই গবেষণা সাধারণ কোনো বৈজ্ঞানিক কল্পনা নয়, এর ভেতরে এমন কিছু আছে যা বাস্তবকে বদলে দিতে পারে।”

এরপর লীনা একগুচ্ছ কাগজের ফাইল বের করল, যেগুলো তার মা সংরক্ষণ করে গিয়েছিলেন। পাতাগুলোয় ছড়ানো ছিল অদ্ভুত অঙ্ক, গ্রাফ আর ব্লুপ্রিন্ট, যেগুলো দীপ আগেই দেখেছিল শুভায়নের খুঁজে পাওয়া আর্কাইভ ফাইলের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ছিল, একটি পাতায় সোহিনীর হাতের লেখায় লেখা ছিল—“অর্ণব এখনও বেঁচে আছে। সে একটি টাইম লুপে আবদ্ধ, যেখানে কয়েক সেকেন্ড অনন্তকাল হয়ে যায়। তাকে মুক্ত করার উপায় খুঁজে বের করতে হবে।” দীপ সেই লাইন পড়তেই কেঁপে উঠল। লীনা ম্লান হাসি দিয়ে বলল, “মা বলতেন, সময় কোনো সরলরেখা নয়, এটা একধরনের বৃত্ত, যেখানে মানুষ সহজেই আটকে পড়তে পারে। হয়তো অর্ণব স্যার সেই বৃত্তেই বন্দি ছিলেন। তার দেহ আমরা পেয়েছি, কিন্তু তার অস্তিত্ব হয়তো এখনও কোথাও লুপের মধ্যে ভাসছে।” শুভায়ন হতভম্ব হয়ে বলল, “মানে আমরা যেটা কনটেইনারে দেখেছি, সেটা হয়তো কেবল এক প্রক্ষেপণ? তার প্রকৃত সত্তা এখনও ঘুরছে সময়ের ভেতর?” দীপ গম্ভীরভাবে বলল, “এখন আর কোনো সন্দেহ নেই—অর্ণবের গবেষণা, শালিমারের অদ্ভুত ছায়া, কনটেইনারের রহস্য—সবকিছুই একটাই সূত্রে বাঁধা। প্রশ্নটা শুধু রহস্য ভেদ করার নয়, বরং এই অস্বাভাবিক শক্তির সঙ্গে আমরা কিভাবে মোকাবিলা করব।” লীনার চোখে জল এসে গেল। সে ফিসফিস করে বলল, “আমার মা সারা জীবন অপেক্ষা করেছেন স্যারের ফিরে আসার জন্য। হয়তো এই তদন্তই সেই অপেক্ষার উত্তর দেবে।” ঘরে যেন এক অদৃশ্য ভারী নীরবতা নেমে এলো, আর তিনজনই বুঝতে পারল—এখন তারা এমন এক গোপন সত্যের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে, যা কেবল অর্ণব সেনগুপ্তর মৃত্যু নয়, বরং সময়ের অন্তহীন রহস্যকে স্পর্শ করছে।

অধ্যায় ৮ : টাইম লুপের দরজা

শালিমার ইয়ার্ড দিনের বেলায়ও যেন অদ্ভুত নির্জনতায় মোড়া থাকত, আর রাত নামলেই সে নির্জনতা আরও ভুতুড়ে হয়ে উঠত। দীপ ও শুভায়ন ঠিক করেছিল, এবার তাদের গভীরে ঢুকতেই হবে। লীনার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ইয়ার্ডের এক প্রান্তে একটি বহুদিনের পরিত্যক্ত সিগন্যাল টানেল রয়েছে, যা বহু বছর ধরে ব্যবহার হয়নি। টানেলের প্রবেশপথে ভাঙাচোরা ইট আর মরচেধরা লোহার গেটের ভেতর দিয়ে যখন তারা প্রবেশ করল, তখন বাতাসে ভেসে এল একধরনের গুমোট গন্ধ, যেন ধুলো, মরচে আর কিছু অচেনা ধাতব অম্লের মিশ্রণ। টানেলের ভেতরে যতই তারা এগোতে লাগল, চারপাশের বাতাসে তীব্র এক ধরনের গুঞ্জন ধরা পড়তে থাকল—মনে হচ্ছিল, অদৃশ্য কোনো মেশিন অবিরত কম্পন ছড়িয়ে দিচ্ছে। শুভায়ন তার ক্যামেরা অন করে চারপাশে আলো ফেলল, আর আলোয় ধরা পড়ল ভাঙাচোরা দেওয়াল জুড়ে অদ্ভুত জ্যামিতিক দাগ, যেন বিদ্যুতের ঝলকানিতে কোনোদিন পাথরে পুড়ে যাওয়া দাগ। হঠাৎই তারা দুজন অনুভব করল, তাদের শরীরের লোম খাড়া হয়ে উঠছে—ম্যাগনেটিক ফিল্ডের শক্তি এতটাই তীব্র যে, হাতঘড়ি থেকে শুরু করে ধাতব চেইন পর্যন্ত সামান্য কাঁপতে শুরু করল। দীপ ফিসফিস করে বলল, “এটাই সেই জায়গা। এখানে কোনো ‘সময় ফাঁটল’ খুলে গেছে।”

তারা যতই ভেতরে এগোল, কম্পন ততই বেড়ে চলল। শুভায়ন মনে করল, যেন সময় এখানে আলাদা ছন্দে চলেছে। তার হাতের ঘড়ির কাঁটা কখনো দ্রুত ঘুরছে, কখনো আবার থেমে যাচ্ছে। টানেলের গভীরে গিয়ে তারা দেখতে পেল একটি নির্দিষ্ট জায়গায় বাতাস তরঙ্গের মতো কাঁপছে, যেন গরম দিনে দূরে মাটির ওপরে মরীচিকা ভেসে ওঠে। কিন্তু এখানে মরীচিকা নয়—বরং এক অদৃশ্য দরজা, যেখানে আলো অদ্ভুতভাবে বাঁক নিচ্ছে। শুভায়ন অবাক হয়ে ক্যামেরা তুলতেই লেন্স ঝাপসা হয়ে গেল, ছবি স্পষ্ট ধরা পড়ল না। দীপ সামনে এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়াতে চেষ্টা করতেই হঠাৎ যেন বিদ্যুৎ শক খেয়ে সে পিছিয়ে এল। তার চোখ বিস্ফারিত—“এটা সত্যিই টাইম লুপের প্রবেশদ্বার। হয়তো এখান দিয়েই অর্ণব টেনে নেওয়া হয়েছিল।” তাদের বুক ধড়ফড় করতে লাগল, কারণ তারা বুঝে গিয়েছিল এই টানেল কেবল ভৌতিক অস্বাভাবিকতার জায়গা নয়, বরং সময়ের প্রবাহে ছিদ্র তৈরি হয়ে গেছে। সেই ফাঁক থেকে অদ্ভুত শক্তি বেরিয়ে আসছে, যা মানুষের দেহ, যন্ত্রপাতি, এমনকি চিন্তাকেও বদলে দিতে পারে। শুভায়ন ভয়ে গলা শুকিয়ে গেলেও ক্যামেরার শাটার থামাল না—সে জানত, এই দৃশ্য প্রমাণ হিসেবে জরুরি। কিন্তু ক্যামেরায় কিছুই ধরা পড়ল না, শুধু ঝাপসা আলোকচ্ছটা।

ঠিক সেই মুহূর্তেই টানেলের অন্ধকারে কিছু নড়াচড়া হলো। দুজনেই ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেল, কয়েক কদম দূরে এক লম্বাটে ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। ছায়াটি যেন কোনো মানুষ, আবার পুরোপুরি মানুষও নয়—তার শরীরের রেখাগুলো একবার স্পষ্ট হয়, পরক্ষণেই মিলিয়ে যায়, যেন একসাথে একাধিক ফ্রেমে সে উপস্থিত। দীপ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল; শুভায়নের মনে হলো, এই ছায়ামূর্তি ঠিক সেই রাতের অদ্ভুত অবয়ব, যা সে ক্যামেরায় ধরতে চেয়েছিল। হঠাৎ ছায়াটি তীব্র গতিতে তাদের দিকে এগিয়ে এল। বাতাস কেটে গেল, চারপাশের আলো ঝলমল করে উঠল। শুভায়ন ক্যামেরা ছুড়ে ফেলে প্রাণপণে দৌড়াতে চাইল, কিন্তু শরীর যেন আটকে যাচ্ছিল। দীপ তাড়াতাড়ি তার হাত টেনে নিল, দুজনেই টানেলের দেওয়ালে হোঁচট খেয়ে পড়ল। ছায়ামূর্তি হাত বাড়াল—না, হাত নয়, যেন অদৃশ্য কোনো স্পর্শ তাদের ঘিরে ধরল। ঠান্ডা শীতল এক দমকা হাওয়া তাদের বুকের ভেতরে ঢুকে পড়ল, আর দুজনেরই মনে হলো, সময় যেন থেমে গেছে। ঠিক তখনই টানেলের সেই কাঁপা বাতাস ভয়ংকর শব্দ করে উঠল, যেন পুরো টানেল ধসে পড়বে। দীপ সর্বশক্তি দিয়ে শুভায়নকে টেনে নিয়ে অন্ধকার করিডর থেকে দৌড় দিল, পিছনে ছায়ামূর্তি ঝাপসা হয়ে মিলিয়ে গেল সেই আলোড়িত ফাঁটলের ভেতরে। শ্বাস নিতে নিতে তারা বাইরে এসে পড়ল, কিন্তু দুজনেরই চোখেমুখে আতঙ্ক স্পষ্ট। দীপ ঘামভেজা কণ্ঠে বলল, “এটা শুধু ছায়া নয়… হয়তো অর্ণবের অস্তিত্বেরই কোনো বিকৃত প্রতিচ্ছবি। সময়ের লুপ তাকে ছিঁড়ে দিয়েছে, আর সেই টুকরোগুলো এই টানেলের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে।” শুভায়ন হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “মানে আমরা যা দেখলাম, সেটা মানুষ নয়, সময়ের ফাঁদে বন্দি এক ছায়া?” দুজনেই বুঝে গেল, তারা এখন এমন এক দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, যার ওপারে পা দিলেই হয়তো তারা নিজেরাও আর কোনোদিন ফিরে আসতে পারবে না।

অধ্যায় ৯ : অতীতের মুখোমুখি

রাতের অন্ধকারে শালিমারের টানেল থেকে বেরোনোর পর দীপ ও শুভায়নের শরীর এখনও কাঁপছিল। অদ্ভুত সেই ছায়ামূর্তির স্পর্শ যেন তাদের রক্তের ভেতরে শীতলতা গেঁথে দিয়েছিল। বাইরে এসে তারা শ্বাস নিতে পারলেও, মনের ভেতরে প্রশ্ন জমাট বাঁধছিল—কে বা কী ছিল সেটা? লীনা সেই সময় টানেলের বাইরে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। তাদের আতঙ্কিত মুখ দেখে সে দ্রুত এগিয়ে এলো। শুভায়ন তাড়াহুড়ো করে যা ঘটেছে তা বলতে শুরু করতেই লীনার চোখ ছলছল করে উঠল। সে ধীরে ধীরে বসে পড়ল, যেন এই মুহূর্তের জন্য সে বহুদিন ধরে প্রস্তুত ছিল। দীপ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি জানো ওটা কী?” লীনা কাঁপা গলায় উত্তর দিল, “হ্যাঁ… ওটা আর কেউ নয়, ভবিষ্যৎ থেকে আসা আরেকজন পরীক্ষার শিকার।” তিনজনের নিস্তব্ধতার ভেতর লীনার স্বর যেন গভীর শোক আর অপরাধবোধে ভরা ছিল।

সে বলতে শুরু করল, “মা শুধু অর্ণব স্যারের ছাত্রীই ছিলেন না, তাঁর গবেষণার অন্যতম সহযোগীও ছিলেন। অর্ণব যখন ‘Chrono-Gate’ তৈরির কাজে ব্যস্ত ছিলেন, মা তাঁকে সাহায্য করতেন। প্রথমদিকে তাঁরা ভেবেছিলেন এটি একধরনের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা, যার সীমাবদ্ধতা থাকবে। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা দেখলেন, সময়ের সীমানা অতি সহজেই ভেঙে যেতে পারে। প্রথম যে মানুষকে পরীক্ষায় ব্যবহার করা হয়েছিল, তিনি আর কেউ নন, সেই ছায়ামূর্তি। ভবিষ্যতের এক পরীক্ষাগারে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল কয়েক মিনিটের জন্য, কিন্তু টাইম-গেটের সমন্বয় সঠিকভাবে কাজ করেনি। ফিরে আসার সময় তাঁর শরীর আর আত্মা পুরোপুরি অক্ষত থাকেনি। আধা অংশ বাস্তবে, আধা অংশ সময়ের ভেতরে আটকে গেল। তাই আজ আমরা তাঁকে মানুষরূপে নয়, ছায়ার মতো দেখি।” লীনার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল। শুভায়ন ভয়ার্ত দৃষ্টিতে বলল, “মানে ও এখন একধরনের জীবন্ত প্রেতাত্মা?” লীনা মাথা নেড়ে ফিসফিস করে বলল, “না, ও প্রেতাত্মা নয়… ও আসলে বেঁচে আছে, কিন্তু বিকৃত অবস্থায়। আর ও-ই ছিল সেই মানুষ, যে বহুদিন ধরে অর্ণবকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছিল।”

দীপ বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। তার মনে হলো যেন রহস্যের পর্দা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে, কিন্তু প্রতিটি পর্দার আড়ালে আরও ভীতিকর অন্ধকার। সে গম্ভীর গলায় বলল, “মানে অর্ণবও একই টাইম-গেট পরীক্ষার শিকার?” লীনা চোখ মুছতে মুছতে বলল, “হ্যাঁ। মা সবসময় বলতেন, অর্ণব এক ‘টাইম লুপ’-এ বন্দি। ছায়ামূর্তিটি যতবার চেষ্টা করেছে, অর্ণবকে ফেরানোর প্রক্রিয়ায় সে নিজেই আরও বিকৃত হয়েছে। তবু সে হাল ছাড়েনি। তার একটাই উদ্দেশ্য—অর্ণবকে সময়ের শেকল থেকে ফিরিয়ে আনা।” শুভায়ন আড়চোখে দীপের দিকে তাকাল, যেন জিজ্ঞেস করছে—তাহলে এখন কী করব? দীপ দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিল, “যদি সত্যিই ছায়ামূর্তিটি অর্ণবকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে থাকে, তবে সে শত্রু নয়। কিন্তু তার অস্তিত্বই এখন ভয়ংকর। হয়তো সে নিজেই জানে না, কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।” লীনা কাঁপা কণ্ঠে যোগ করল, “মা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অপরাধবোধে ভুগেছেন। তিনি বলতেন, মানুষের উচিত ছিল না সময়ের সাথে এমন খেলা করা। কারণ সময় প্রতিশোধ নেয়, আর প্রতিশোধ সবসময় ভয়াবহ হয়।” কথাগুলো শুনে তিনজনের উপর নেমে এলো ভারী নীরবতা। তারা বুঝতে পারল, শালিমারের অন্ধকারে এখন তারা শুধু অতীতের কোনো বৈজ্ঞানিক রহস্যের মুখোমুখি নয়, বরং মানবজীবনের সীমারেখাকেই অতিক্রম করে ফেলা এক দানবীয় পরীক্ষার দায়ের সামনে দাঁড়িয়ে।

অধ্যায় ১০ : সময়ের লাশঘর

শালিমার ইয়ার্ডের রাত তখন হাহাকার করা ঝড়ো বাতাসে ভরে উঠেছে। আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানি, আর মাটির নিচ থেকে যেন কাঁপন উঠছে। ঠিক সেই সময় পুরোনো সেই কনটেইনারের ভেতরে অদ্ভুত শব্দ শুরু হলো—প্রথমে গুমগুম আওয়াজ, পরে ধীরে ধীরে যেন অদৃশ্য মেশিন চালু হয়ে গিয়েছে। দীপ, শুভায়ন আর লীনা দৌড়ে সেখানে পৌঁছাল। কনটেইনারের ধাতব দেয়াল থেকে অদ্ভুত আলো ছড়াচ্ছিল, যেন ভেতর থেকে সময় ফেটে বেরিয়ে আসছে। দরজা সামান্য খোলা ছিল, ভেতরে তাকাতেই তারা হতভম্ব হয়ে গেল। মৃত অর্ণবের দেহ তখনো সেখানে শায়িত, তার পকেট থেকে বেরিয়ে থাকা সেই ২০৪০ সালের মেডিকেল রিপোর্ট জ্বলজ্বল করে উঠছে। হঠাৎই কনটেইনারের অন্ধকার কোণ থেকে ছায়ামূর্তিটি বেরিয়ে এলো। তার শরীর কাঁপছিল, আলোর ঝলকে কখনো দেখা যাচ্ছিল মাংস, কখনো শুধু অদৃশ্য ছায়া। মনে হচ্ছিল, সে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে, আবার সময়ের স্রোতের সাথেও যুদ্ধ করছে। অর্ণবের দেহ, রিপোর্ট আর ছায়ামূর্তি—তিনটি জিনিস যেন একসাথে কোনো অচেনা যোগসূত্র তৈরি করল। মুহূর্তের মধ্যেই কনটেইনারের ভেতর বিকিরণ বেড়ে গিয়ে এমন তীব্র আলো সৃষ্টি করল যে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা দীপ, শুভায়ন আর লীনা চোখ ঢাকতে বাধ্য হলো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা টের পেল, চারপাশের সবকিছু অস্বাভাবিকভাবে বদলে যাচ্ছে। ইয়ার্ডের ভাঙাচোরা ট্র্যাকগুলো যেন নতুন হয়ে উঠছে, আবার পরক্ষণেই মরচে ধরা হয়ে যাচ্ছে। এক সেকেন্ড তারা দাঁড়িয়ে আছে ২০২৫ সালে, আরেক সেকেন্ডেই চারপাশ যেন ২০৪০ কিংবা আরও অচেনা কোনো সময়ে চলে যাচ্ছে। সময় যেন ভেঙে পড়েছে, আর সেই ভাঙা টুকরোর ভেতরে তাদের টেনে নিচ্ছে এক ভয়ংকর লাশঘর। অর্ণবের মৃতদেহ হঠাৎই চোখ মেলে তাকাল—না, সেটা জীবিতের দৃষ্টি নয়, বরং সময়ের গভীর থেকে আসা এক শূন্য দৃষ্টি। ছায়ামূর্তিটি কনটেইনারের ভেতর হাত বাড়িয়ে অর্ণবকে স্পর্শ করল। মুহূর্তের মধ্যেই দুজনের শরীর আলোকচ্ছটায় একাকার হয়ে গেল। তাদের চারপাশে ঘূর্ণিঝড়ের মতো সময়চক্র তৈরি হলো, আর সেই চক্রের ভেতর মেডিকেল রিপোর্ট পুড়ে গিয়ে ছাই হয়ে গেল। দীপ ও শুভায়ন প্রাণপণে কনটেইনার থেকে দূরে সরে যেতে লাগল, কিন্তু আলো ও বিকিরণ এতটাই প্রবল হয়ে উঠল যে তারা আরেক মুহূর্ত থাকলে হয়তো পুড়ে যেত। কেবল এক মুহূর্তের সিদ্ধান্ত তাদের বাঁচিয়ে দিল। কিন্তু ঠিক সেই সময়ে লীনা, যে একটুও নড়েনি, ধীরে ধীরে কনটেইনারের ভেতরের দিকে এগিয়ে গেল। তার চোখে আতঙ্কের বদলে এক অদ্ভুত শান্তি। দীপ চিৎকার করে ডাকল, কিন্তু লীনা আর পিছন ফিরে তাকাল না। আলো ম্লান হয়ে এলে দেখা গেল, লীনা আর নেই।

নীরবতা নেমে এলো ইয়ার্ডে। দীপ ও শুভায়ন হাঁপাতে হাঁপাতে মাটিতে বসে পড়ল। চারপাশে আর কোনো আলো নেই, শুধু পুড়ে যাওয়া লোহার গন্ধ। কনটেইনার এখন খালি, অর্ণবের দেহ, ছায়ামূর্তি, এমনকি লীনা—সব মিলিয়ে গেছে। শুভায়নের চোখে জল চলে এল, সে ফিসফিস করে বলল, “ও কোথায় গেল?” দীপ কোনো উত্তর দিল না, শুধু শূন্য চোখে কনটেইনারের ভেতর তাকিয়ে রইল। হঠাৎই অদূরে ট্র্যাকের ওপরে চাকার শব্দ শোনা গেল। তারা দুজনই চমকে ঘুরে তাকাল। অন্ধকারের মধ্যে থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো আরেকটি নতুন কনটেইনার। কোনো রেকর্ড ছাড়াই, হঠাৎ করেই যেন ইয়ার্ডে এসে দাঁড়াল সেটা। কনটেইনারের দরজা অল্প খোলা, ভেতরটা অন্ধকারে ঢাকা। দীপ ও শুভায়ন নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইল। দুজনেই জানত, এবার ভেতরে কী আছে কেউ জানে না—কিন্তু এটা নিশ্চিত, শালিমারের লাশঘর এখনও শেষ হয়নি। বরং সময়ের এই খেলা আবারও শুরু হতে চলেছে, আর হয়তো এবার তারা নিজেরাই তার অংশ হয়ে যাবে।

***

1000056165.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *