Bangla - ভূতের গল্প

শালবনের শব

Spread the love

পুরুলিয়ার দিকে রওনা দেওয়ার সময় কলকাতার আকাশ ছিল রৌদ্রঝলমলে, কিন্তু দলের ভিতরে যেন এক চাপা উত্তেজনার ঘূর্ণি চলছিল। রুদ্র, অভিজিৎ, ইরা আর সঞ্জনা – এই চারজনের দলটার নেতৃত্বে ছিল রুদ্র, একজন বাস্তববাদী ডকুমেন্টারি নির্মাতা যিনি সব কিছুকে যুক্তির চোখে দেখতে অভ্যস্ত। তবু এই বিশেষ প্রজেক্টটা ছিল অন্যরকম – কারণ এটি ছিল একটি পরিত্যক্ত আদিবাসী গ্রামের লোককাহিনি নিয়ে, যেখানে কথিত আছে, পূর্ণিমার রাতে মৃতরা উঠে আসে মাটির নিচ থেকে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, তারা পুরুলিয়ার এক গভীর শালবনের ভেতর অবস্থিত জামদা নামের একটি গ্রামে যাবে – একটি গ্রাম যা দীর্ঘদিন আগে উধাও হয়ে গেছে, যেখানে আর কেউ থাকে না, অথচ গ্রামের গল্প আজও ভেসে আসে স্থানীয় লোকমুখে। ভোরবেলা তারা এনফিল্ড বাইক আর জিপে করে হাওড়া থেকে রওনা দেয়, রাস্তায় গাড়ির ঝাঁকুনিতে সঞ্জনা ঘুমে ঢলে পড়ে, ইরা তার ডায়েরিতে নোট নিতে থাকে, আর অভিজিৎ ড্যাশবোর্ডে বসানো ক্যামেরা দিয়ে বুনো প্রকৃতির দৃশ্য ধরে রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সেই সময়, রুদ্র চিন্তায় ডুবে ছিল – সে জানত, তারা যা করতে যাচ্ছে, তা একধরনের সাংস্কৃতিক দলিল রচনার প্রচেষ্টা, কিন্তু মনে মনে একটা অজানা ভয়ও চুপচাপ গেঁথে বসেছিল—লোককাহিনির পিছনে সত্যি কিছু থাকলে?

দুপুর নাগাদ তারা পুরুলিয়ার কেন্দ্রীয় শহর পার হয়ে ঢুকে পড়ে গাড়ি-চলাচলের অযোগ্য এক কাঁচা রাস্তায়, যার দুই ধারে দিগন্তব্যাপী শালগাছ সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে। এই রাস্তায় তাদের সঙ্গে যোগ দেন বিপ্লব হাঁসদা—একজন স্থানীয় আদিবাসী পথপ্রদর্শক যিনি একসময় এই অঞ্চলের স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। বিপ্লবের চোখে ছিল অদ্ভুত এক নিস্পৃহতা, আর গলায় কেমন একটা ভারী, গভীর সুর—যেন বহুদিন মাটির নিচে জমে থাকা ধ্বনি। তার মুখে খুব বেশি কথা ছিল না, কিন্তু যখন রুদ্র প্রশ্ন করল জামদা গ্রামের ইতিহাস নিয়ে, সে শুধু বলল, “সেই গ্রামে রাত পোহায় না বাবু। মানুষ ঘুমোত না, আর মাটি নিঃশ্বাস ফেলত।” এমন কথার মাঝে অভিজিৎ হেসে বলে উঠল, “এইসবই লোকের বানানো হরর ফোকলোর—তাই তো আমরা এখানে এসেছি, একটা মজাদার ডকু বানাতে।” ইরা তখন গম্ভীরভাবে বলে ওঠে, “সব লোককাহিনিই কি বানানো? কখনো হয়তো আমরা কল্পনা দিয়ে সেই ভয়গুলোকে ঢেকে ফেলেছি। হয়তো।” কিছুটা নীরবতা নেমে এল গাড়ির ভিতরে। বাইরের প্রকৃতি তখন বদলে যেতে শুরু করেছে—শালগাছের ছায়া এত ঘন হয়ে উঠেছে যে রোদের রেখাও ঢুকে পড়তে পারছে না। কুয়াশার মতো হালকা ধুলো আর গাছেদের পাতার ফাঁকে গা ছমছমে বাতাস বয়ে যাচ্ছিল।

সন্ধ্যের ঠিক আগে তারা পৌঁছে যায় জামদা নামক সেই পরিত্যক্ত গ্রামে। গাড়ি আর বাইক রেখে তারা হাঁটতে শুরু করে গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, আর প্রায় আধঘণ্টা হাঁটার পর তারা সামনে দেখতে পায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পোড়া কুঁড়েঘর, একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত মণ্ডপ, আর তার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা একটি পাথরের মূর্তি – এক অচেনা মুখ, যার চোখ গর্ত হয়ে গেছে, আর ঠোঁটে যেন জমাট হাহাকার লেগে আছে। আশেপাশে কোথাও কোনো পাখির ডাক নেই, নেই কোনো মানুষের অস্তিত্ব—শুধু পাতার ওপর পড়ে থাকা শূন্যতা আর শুকনো মাটির স্তব্ধতা। ক্যাম্প সেটআপ করতে করতে সঞ্জনা বারবার কানে হাত দিয়ে বলছিল, “এখানে কেমন একটা শব্দ হচ্ছে… খুব নিচু ফ্রিকোয়েন্সিতে। যেন মাটির নিচ থেকে কেউ ডাকছে।” ইরা তখন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক পোড়া মাটির ঘরের দেওয়ালে খোদাই করা চিহ্ন দেখিয়ে বলে, “এই চিহ্নটা আমি একটা পুঁথিতে দেখেছি—এর মানে দাঁড়ায়: ‘তারা শুয়ে আছে, জাগানোর আগে ভাবো।’” সেই মুহূর্তে রুদ্র প্রথমবারের মতো ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে যেতে অনুভব করে পিঠের নিচ দিয়ে। আকাশে তখনই পূর্ণিমার চাঁদ উঠে এসেছে। সাদা আলো ছড়িয়ে পড়েছে পুরো শালবনের মাথায়। বাতাস নিঃশব্দ, যেন প্রকৃতি অপেক্ষা করছে কিছু ঘটবার।

রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে শালবনের ভেতরে এক অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা দিল। দিনের বেলা যে গাছগুলো ছায়া দিত, এখন তারা যেন অন্ধকারের ঘন ঘেরাটোপ তৈরি করে ফেলেছে—একটা গুহার মতো গা ছমছমে পরিবেশ। ক্যাম্পফায়ারের চারপাশে রুদ্র, ইরা, অভিজিৎ আর সঞ্জনা বসে আছে, এবং গাইড বিপ্লব হাঁসদা একটু দূরে একটি শালগাছের গুঁড়ির পাশে চুপ করে বসে তামাকের ধোঁয়া ছাড়ছে। ক্যামেরা, সাউন্ড রেকর্ডার, ব্যাটারি – সব প্রস্তুত, কিন্তু যেন কিছু একটা শুরু করতে সবাই ভয় পাচ্ছে। এই ভয়ের উৎস ঠিক অজানা নয় – জায়গাটার নিস্তব্ধতা এতই ঘন যে মনে হচ্ছিল কেউ বা কিছু এই গভীরতা থেকে তাকিয়ে আছে, নিঃশব্দে পর্যবেক্ষণ করছে তাদের। হঠাৎ ইরা বলে উঠল, “এই ঘরগুলোর প্রতিটা যেন কিছু একটা লুকিয়ে রেখেছে। এই পোড়া গন্ধ, এই থমথমে পরিবেশ… এমনটা আমি কখনও অনুভব করিনি।” রুদ্র তখন ঠাণ্ডা গলায় বলে, “ঠিক তাই তো আমাদের এখানে আসা। ভয়টা যত বেশি সত্যি মনে হবে, দর্শকের অনুভব তত গভীর হবে। ক্যামেরায় এটা ধরতে পারলেই প্রজেক্টটা অন্য লেভেলে চলে যাবে।” অভিজিৎ তখন ক্যামেরার লেন্স ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল, তার চোখে একটু অস্বস্তি – সে দেখেছিল একটা ঘরের ভিতর থেকে কী যেন সরে গেল, কিন্তু জোর করে নিজেকে বোঝায় যে এটা নিশ্চয়ই বাতাস বা ইঁদুর।

ইরা তখন একটি পোড়া ঘরের দরজার কাছে গিয়ে খুঁজে পায় একটি আধা-পোড়া কাপড়ের বস্তা, যার ভেতরে কয়েকটা মাটির তৈরী পুতুল, শুকনো লাল সিঁদুর, ও একটি পুরনো খাতা থাকে। সে শুদ্ধ হাতে সেই খাতা উল্টাতে থাকে, পৃষ্ঠাগুলো ছিঁড়ে পড়ছিল, কিন্তু একটি পাতায় অদ্ভুত লিপিতে লেখা ছিল: “পূর্ণিমার রাতেই তারা ফিরে আসে—কেননা সেই রাতেই তাদের ঘুম ভাঙে। মাটি মনে রাখে, যাকে কাঁদায়, তাকেই ফিরিয়ে আনে।” ইরার মুখে কেমন এক তীব্র বিস্ময়ের ছাপ পড়ে। সে দৌড়ে গিয়ে রুদ্রকে দেখায় লেখাটা। রুদ্র একটু থেমে বলে, “সত্যি বলছো? এটা কি কারও ফিকশন, না লোকাচার?” ইরা শান্তভাবে উত্তর দেয়, “এই স্ক্রিপ্টটা সাঁওতালি লিপির আদিরূপ, যেটা আমি সিংবঙা উৎসব নিয়ে গবেষণার সময় দেখেছিলাম। কিন্তু এই বাক্যগুচ্ছ একেবারে ভিন্ন—এর মধ্যে একটা রীতিমাফিক ভয় আছে।” সঞ্জনা সেই সময় ফায়ারের কাছে বসে তার হ্যান্ড-রিকর্ডারে জায়গার আওয়াজ রেকর্ড করছিল। হঠাৎ তার কানে আসে এক অস্পষ্ট ঘষা ঘষা আওয়াজ, ঠিক যেন মাটি কেটে কেউ কিছু টেনে আনছে। সে চমকে ওঠে, চারদিক দেখে, কিন্তু সবাই ব্যস্ত থাকায় কিছু না বলেই রেকর্ডিং চালিয়ে যায়। তবে সে বুঝতে পারে, রাত যত গাঢ় হচ্ছে, শব্দটা তত জোরালো হচ্ছে – যেন শালগাছের নিচে কেউ হাঁটছে, ধীরে ধীরে।

পৃথিবীর কোন অংশে কোন সময় ঠিক কোন জিনিস জেগে ওঠে, তা কেউ জানে না—শুধু প্রকৃতির গভীরতাই জানে। সেই গভীরতার প্রান্তেই দাঁড়িয়ে ছিল জামদা, এক গ্রাম যার মাটি মানুষকে গিলেছিল বলে জনশ্রুতি। সেদিন রাতে, তারা ক্যাম্পফায়ারের চারপাশে বসে চুপ করে ছিল। অদ্ভুতভাবে পোকামাকড়ের কোনো শব্দ ছিল না, কোনো ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকও না। শুধু দূরে, অতি ক্ষীণ একটা কান্নার মতো শব্দ যেন বয়ে আসছিল বাতাসে। অভিজিৎ ক্যামেরা ঘুরিয়ে বারবার বলছিল, “আমি একটা ছায়া দেখছি ওই ভাঙা ঘরের সামনে। এটা কি কারও প্রতিচ্ছবি, না অন্য কিছু?” রুদ্র তখন বলল, “রাতের প্রতিচ্ছবি হ্যালুসিনেশন হতে পারে। তবে ক্যামেরা চালিয়ে রাখো।” সেই সময় ইরার চোখ পড়ল একটি পোড়ো মন্দিরের দিকে, যার ভিতরে পাথরের ভাঙা মূর্তি—আধা-মানব, আধা-অজানা কিছু—এক চোখ গর্ত, অন্য চোখে কাদা জমে থাকা। মূর্তির নিচে লেখা ছিল: “আমরা ছিলাম, আছি, আবার উঠব—তোমাদের নিচে।” এই লেখার ভাষা প্রাচীন, কিন্তু ইরার শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা এই লেখাকে বোঝার জন্য যথেষ্ট। তার বুক কেঁপে ওঠে, ঠোঁট শুকিয়ে আসে। তখনই এক ঝাপটা বাতাস এসে ফায়ার নিভিয়ে দেয়। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কুয়াশা যেন জড়িয়ে ধরে তাদের চতুর্দিক, আর সেই মুহূর্তে সবাই শুনতে পায়—মাটির নিচ থেকে ধীরে ধীরে আসছে সেই ঘষা শব্দ… যেন বহুদিন পর কেউ জেগে উঠছে।

পূর্ণিমার চাঁদ তখন মাথার ওপরে উঠে পড়েছে, আর শালবনের প্রতিটি গাছে তার হালকা সাদা আলো ছড়িয়ে পড়েছে যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি ঘুম ভাঙাতে চাইছে। ক্যাম্পফায়ার আবার জ্বালানো হয়েছে, কিন্তু আগুনের আলো যেন অল্প দূর গেলেই অন্ধকারে গিলে যায়। সেই অন্ধকার কুয়াশার চাদরে ঢেকে থাকা, আর মনে হচ্ছিল, প্রতিটি শালগাছ যেন সেই আঁধারে দাঁড়িয়ে গভীর কিছু শুনছে। রুদ্র পুরো ইউনিটকে প্রস্তুত থাকতে বলল—এটাই সেই সময় যখন লোককাহিনির তথাকথিত “ঘটনা” ঘটে। ক্যামেরা চালু, বুম মাইক অন, সাউন্ড রেকর্ডার রেডি, এবং ড্রোনও প্রস্তুত করা হল রাতের শট নেওয়ার জন্য। অভিজিৎ হালকা আতঙ্কে চোখ কুঁচকে বলল, “ড্রোন উঠলে যদি ওপরে কিছু দেখা যায়?” সঞ্জনা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, “মানে?” অভিজিৎ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “ধরো যদি কোনো ছায়া আসে… ওই গাছগুলোর ওপরে?” রুদ্র তখন শান্ত গলায় বলে, “ছায়া থাক, না থাক… এই ক্যামেরাই প্রমাণ করবে সত্যটা। সেই জন্যই তো আমরা এখানে।” ইরা তখন পাশে দাঁড়িয়ে পূর্ণিমার আলোয় পুঁথির পাতাগুলোর ছবি তুলছিল। পাতাগুলোর গায়ে হালকা কাদামাটির দাগ ছিল, যা পরিস্কার করা সত্ত্বেও ফিরে আসছিল—যেন কেউ বারবার সেই কাদার দাগ রেখে যাচ্ছিল সেখানে।

রাত তখন প্রায় ১টা। ক্যাম্পের চারদিকে চারটি ক্যামেরা বসানো হয়েছে, ড্রোন বাতাসে উড়ছে আর তার স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে একটি বিস্তৃত শালবনের মাথা, যার ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে কুয়াশার আস্তরণ নামে। অভিজিৎ তখন ক্যামেরা চালাতে চালাতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায়—তার স্ক্রিনে ধরা পড়েছে কিছু একটা নড়াচড়া করছে একটি পোড়ো ঘরের ছায়ায়। সে বলল, “এইটা তো ক্যামেরায় ধরা পড়ছে! কিছু একটা নড়ছে।” রুদ্র দ্রুত এগিয়ে এসে মনিটরে তাকায়। সেখানে দেখা যাচ্ছে—একটা আবছা ছায়া, অন্ধকার থেকে উঠে এসে আবার অন্ধকারেই মিলিয়ে যাচ্ছে। কেউ কিছু বলতে পারে না, কিন্তু সেই মুহূর্তেই ইরা জোরে বলে ওঠে, “এই শব্দটা শুনছো?” সবাই একসঙ্গে থেমে যায়। বাতাস নিঃশব্দ, কিন্তু ঠিক সেই নিস্তব্ধতার মাঝেও তারা শুনতে পায় এক অস্পষ্ট ঘর্ষণের শব্দ—মাটি চিরে আসা কিছুর সুর। সঞ্জনা রেকর্ডার কানে লাগিয়ে বলে, “এই শব্দ তো আগে আসেনি… এটা যেন মাটির তলায় কী যেন হেঁটে বেড়াচ্ছে।” বিপ্লব তখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে বলে, “এখনও সময় আছে, ফিরে চলুন। যারা একবার এই শব্দ শুনেছে, তারা শহরের শব্দ আর শুনতে পায় না।” ইরা রুষ্ট গলায় বলে ওঠে, “আমরা পালিয়ে গেলে ইতিহাস মুছে যাবে, বিপ্লবদা। আপনি যা জানেন, সেটা আমাদের সাহায্য করতে পারে। আমরা সত্য বের করতে এসেছি।” কিন্তু বিপ্লব শুধু বলে, “সত্য যদি মৃত হয়, তাকে আবার টেনে তোলা ঠিক নয়।”

সেই মুহূর্তে দূর থেকে আসে একটি ঝড়ো হাওয়ার ঝাপটা—ক্যাম্পের এক পাশে রাখা লাইটস্ট্যান্ড পড়ে যায়, ক্যামেরার এক ইউনিট হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়, আর বাতাসে ভেসে আসে কাঁচ ভাঙার মতো আওয়াজ। অভিজিৎ দৌড়ে গিয়ে লাইটটা ঠিক করার চেষ্টা করে, আর সঞ্জনা রেকর্ডারের হেডফোনে শোনে অদ্ভুত ফিসফিসানি—যেমন একটি কণ্ঠস্বর বলছে, “তারা ফিরে আসছে… তারা মাটি ছেড়ে উঠবে।” ইরার চোখ তখন গড়িয়ে যায় সেই পোড়ো মন্দিরের দিকে—সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা পাথরের মূর্তিটি যেন আরও উঁচু হয়ে গেছে, তার চোখের কোটর গভীর হয়ে উঠেছে, যেন সেখানে আলো গিলে ফেলা হচ্ছে। রুদ্র ক্যামেরা চালিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। হঠাৎই ক্যামেরার লেন্স ঝাপসা হয়ে আসে, মনিটরে দেখা যায় ধূসর ছায়া—একটা শরীর, আধা মাটি মাখা, নাক-মুখ বিহীন এক আকৃতি যা ঝুঁকে আছে ঠিক ক্যামেরার দিকে। সে এতটাই কাছে যে স্ক্রিনে শুধু তার মাটির ফাটলে ভর্তি মুখ দেখা যায়। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকায়। ক্যামেরা বন্ধ। ক্যাম্প নিস্তব্ধ। কেউ কিছু বলছে না—শুধু বাতাসে ভাসছে সেই অদ্ভুত শব্দ, যেটা কানে নয়, মগজে শোনা যায়।

রাত তখন দুটো পেরিয়ে গেছে। পুরো শালবন যেন থেমে গিয়েছে সময়ের বাইরে। চারপাশে কুয়াশা আর অন্ধকার এত ঘন হয়ে গেছে যে হাত বাড়ালেও কেউ নিজের আঙুল দেখতে পারত না। ক্যাম্পফায়ারের আগুন নিভে গেছে কয়েক মিনিট আগে, এবং এক অদ্ভুত ঠান্ডা বয়ে যাচ্ছে গাছের ভেতর দিয়ে। এই ঠান্ডা কেবল আবহাওয়ার নয়, এটি মনের গভীরের আতঙ্ককে স্পর্শ করে এমন এক হিমস্রোত, যা মানুষের শরীরকে ভিতর থেকে জমিয়ে দেয়। ক্যামেরা ও রেকর্ডার সমস্ত বন্ধ হয়ে গেছে। অভিজিৎ বারবার তার ক্যামেরা অন করার চেষ্টা করছিল, কিন্তু ব্যাটারি যেন হঠাৎ করেই সব ফুরিয়ে গেছে। রুদ্র তখন সতর্ক গলায় বলে, “এটা কোনো ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফ্লাক্সের প্রভাব হতে পারে… হয়তো।” কিন্তু তার কণ্ঠেও স্পষ্ট দ্বিধা আর আতঙ্ক। সঞ্জনা, রেকর্ডার কানে লাগিয়ে, হঠাৎ জোরে বলে ওঠে, “এইটা কী আওয়াজ? কারা যেন কাঁদছে!” সে রেকর্ডারের ভলিউম বাড়ায়, আর তখন স্পষ্টভাবে সবাই শুনতে পায়—একসঙ্গে অনেকগুলো মেয়েলি কণ্ঠ, কান্না আর কিছু বেহায়া গোঙানির মতো শব্দ, যেন কেউ মাটি চিরে উঠে আসতে চাইছে, কিন্তু কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে টেনে ধরেছে নিচে। সেই কান্নার মাঝে বারবার ভেসে আসে একটা বাক্য, স্পষ্ট সাঁওতালি টানে উচ্চারিত: “এখনও পূর্ণিমা বাকি আছে…”

ক্যাম্পের চারপাশে অন্ধকার গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে উঠছিল, আর ঠিক সেই সময়, শালগাছের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে এক ছায়ামূর্তি। সে কোনো শব্দ করে না, কোনো পায়ের আওয়াজও হয় না, কিন্তু হাওয়ার গতি থেমে যায় যেন। ইরা প্রথম দেখে তাকে—একটা অদ্ভুত পাথরের মতো শরীর, যার গায়ে কাদা, মাটি আর শিকড় জড়িয়ে আছে। চোখের জায়গায় গর্ত, মুখ নেই, কেবল ঠোঁটের রেখার জায়গায় জমাট মাটির ফাঁক। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ক্যাম্পের দিকে, আর হঠাৎ করেই মাটি যেন নিজে থেকেই কাঁপতে শুরু করে। রুদ্র ক্যামেরা হাতে উঠে দাঁড়ায়, কিন্তু তার পা কাঁপছে। বিপ্লব হাঁসদা, এতক্ষণ যার মুখে কোনো শব্দ ছিল না, এবার উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “সে এসেছে… মৃতদের কণ্ঠে যে কথা বলে, সে এসেছে। এখন এই বন আর তোমাদের নয়।” তখনই আরও তিনটি ছায়ামূর্তি মাটির নিচ থেকে উঠে আসে, যেন একসঙ্গে কেউ টেনে তোলে কাদার পর্দা সরিয়ে। তারা হাঁটছে না—তারা যেন মাটির উপরে ভেসে ভেসে এগিয়ে আসছে। আর সেই সময়, মন্দিরের ভাঙা ঘন্টাটা হঠাৎ বেজে ওঠে, যেন কারও হাতে না থেকেও। একটা ভয়াবহ অনিয়ন্ত্রিত শব্দে কেঁপে উঠে শালবনের বাতাস।

ইরা, সঞ্জনা ও অভিজিৎ ভয়ে দৌড়ে যায় গাড়ির দিকটায়, কিন্তু পথ নেই—কুয়াশা এত ঘন যে কোনদিকে গেলে কিসে ধাক্কা লাগবে বোঝা যাচ্ছে না। তারা পেছনে তাকিয়ে দেখে রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে একা, ক্যামেরা হাতে, চোখ স্থির, যেন এক অলৌকিক ট্রান্সে চলে গেছে। তার ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই মুখবিহীন ছায়া, এখন যার মুখে দেখা যাচ্ছে হালকা একটা হাসি—তবে সেটা মানুষের হাসি নয়, সেটার মধ্যে কাদা আর মৃত্যুর গন্ধ। ছায়ামূর্তিটি মাটি থেকে একটি পাথরের মতন জিনিস তুলে রুদ্রের দিকে এগিয়ে দেয়, আর সেই মুহূর্তে ক্যামেরার মনিটরে স্পষ্ট দেখা যায় এক ফ্রেম, যেখানে রুদ্রের মুখের ওপর বসে আছে এক ছায়ামূর্তি, যেটা তার মাথার উপর হাত রেখেছে। সাউন্ড রেকর্ডারে ধরা পড়ে একটিমাত্র বাক্য: “জেগে থাকো… মাটির নিচের নিঃশ্বাস এখন তোমার ভিতর।” তারপর, হঠাৎ সব নীরব। ক্যাম্প নিস্তব্ধ। ছায়ারা নেই, আওয়াজ নেই, এমনকি বাতাসও থেমে গেছে। ইরা আর সঞ্জনা দৌড়ে ফিরে এসে দেখে রুদ্র পড়ে আছে ক্যামেরা হাতে, মুখ থমথমে, চোখ খোলা—কিন্তু সে কিছু দেখছে না। তার চোখের মণি স্থির, এবং ঠোঁট কাঁপছে… যেন সে নিঃশব্দে কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু শব্দ বেরোচ্ছে না। অভিজিৎ তখন জোরে বলে ওঠে, “এই জায়গাটা… এটা মানুষকে খায়, সরাসরি না… কিন্তু ভিতর দিয়ে।”

চাঁদের আলো একটু একটু করে পাতলা হচ্ছিল। গভীর রাতে ঠান্ডা হাওয়ার সঙ্গে মিশে আসছিল শালপাতার খসখস শব্দ, আর তার ফাঁকে ফাঁকে শোনা যাচ্ছিল অদ্ভুত সব ধ্বনি—কখনো কারও নিঃশ্বাসের মতো ভারি, কখনোবা থমথমে স্তব্ধতার বুক চিরে হঠাৎ ভেসে ওঠা একটি মেয়েলি হাসি। অভ্র, সোমা, রাজর্ষি ও দীপ্ত তখন গ্রামের কেন্দ্রস্থলে একটি বিশাল পুরনো কুয়োর ধারে দাঁড়িয়ে। দিনের আলোয় এটি অনেকটাই নিরাপদ ও উপেক্ষণীয় মনে হলেও এখন, এই রাতের নিস্তব্ধতায়, এর ভেতরে যেন গুমরে গুমরে উঠে আসছিল শতাব্দীপ্রাচীন কাহিনি। কুয়োর চারপাশে পাথরের রেলিংগুলো ভাঙাচোরা, পাঁক ভর্তি জল নিচে কালো অন্ধকারের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। দীপ্ত সবার সামনে কুয়োর গায়ে একটি মাইক্রোফোন বসিয়ে বললো, “সাউন্ড রেকর্ড হচ্ছে। কেউ কিছু শুনলে সঙ্গে সঙ্গে জানাও।” হঠাৎ, ঠিক তখনই কুয়োর ভিতর থেকে যেন কারও গলার আওয়াজ ভেসে এলো—খুব নিচু, চাপা স্বরে বলা হল, “ঘর খোল, আমরা ফিরেছি…”। চারজন একসঙ্গে স্তব্ধ। কুয়োর নিচে কেউ আছে? নাকি বাতাসে ধোঁকা? রাজর্ষি ধীরে ধীরে একটা ছোটো পাথর কুয়োর ভেতরে ফেলল। ‘চপ্‌’ করে আওয়াজ হলো, কিন্তু সেই সঙ্গে যেন আরও একটা ফিসফিস শব্দ—”আর কেউ নেই আমাদের ওপরে, তোমরাই এখন অতিথি।”

তাদের ক্যামেরা ও সাউন্ড রেকর্ডারে সেই শব্দ ধরা পড়েছে কিনা তা নিশ্চিত হতে সবাই দ্রুত ল্যাপটপে ক্লিপটি চালালো। ভয়ংকরভাবে সেই শব্দ ঠিকই রেকর্ড হয়েছিল। অভ্র স্পষ্ট শুনতে পেল—একটা কাঁপা গলা বলছে, “কুয়োর নিচে রাত কাটাও, তবে বুঝবে আমাদের যন্ত্রণা।” সোমার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সে কাঁপা গলায় বললো, “এই শব্দটা কেমন যেন মেয়েদের, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে যেন আরও অনেকগুলো গলা একসঙ্গে মিশে গেছে।” দীপ্ত এক মুহূর্তে সাহস করে বলে উঠল, “আমরা যদি রাতটা এখানে কাটাই, তবে হয়তো আমরা ওদের দৃষ্টিতে পরিণত হতে পারি—না, শুধু ক্যামেরা নয়, আমাদের শরীরও হয়তো এদের স্মৃতির অংশ হয়ে উঠবে।” কথাটা হঠাৎই অদ্ভুত শোনাল, কিন্তু বাকিরা ততক্ষণে বুঝে গিয়েছিল—এখন পেছন ফেরার উপায় নেই। তারা চারজন নিজেদের কুয়োর ধারে পাথরের মেঝেতে বসিয়ে নিল। রাত গভীর হতে থাকল, চাঁদের আলো ম্লান হয়ে যাচ্ছিল, কুয়োর জল যেন নড়ছে, ওঠা-নামা করছে ধীরে ধীরে। রাজর্ষি হঠাৎ গম্ভীর স্বরে বলল, “তোমরা খেয়াল করেছ? গ্রামের মানুষগুলো বলেছিল, পূর্ণিমার রাতে মৃতরা মাটির নিচ থেকে ফিরে আসে। এই কুয়োটা হয়তো সেই মাটি—যেখানে ওরা ঘুমোয়।”

ঠিক তখনই, চারদিকে বাতাস থেমে গেল। পাতা নড়া বন্ধ। যেন কেউ নিঃশব্দে হাঁটছে চারদিক থেকে। কুয়োর পাশের ঝোপে দমবন্ধ করা নড়াচড়া। দীপ্ত দ্রুত ক্যামেরা ঘুরিয়ে ধরলো ঝোপের দিকে—কিন্তু ফ্রেমে ধরা পড়ল না কিছুই, শুধু কুয়োর ওপরে একটা দীর্ঘ ছায়া। সেই ছায়া ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিল, মাথা নিচু, কাঁধ ঝুঁকে থাকা, যেন কুয়োর জল থেকে উঠছে। দীপ্ত ক্যামেরার পিছনে দাঁড়িয়ে শ্বাস আটকে দেখল—ছবিতে কিছুর মুখ নেই, শুধু কাদায় ঢাকা এক শরীর, যার হাড়গুলো স্পষ্ট। হঠাৎ সেই কুয়োর ধারে বসা পাথরগুলো একে একে ঠকঠক করে নড়ে উঠতে লাগল, আর চারপাশে অজস্র কণ্ঠস্বর একসঙ্গে গুঞ্জন তুলল—“ফিরে এসেছি… একে একে… সব…”। চারজন ক্যামেরা ফেলে উঠে দাঁড়াল, পালাবার রাস্তা খুঁজছে। কিন্তু পেছনে তাকাতেই দেখল—গ্রামের রাস্তা কোথায়? শালগাছগুলো যেন ছায়া দিয়ে চারদিক ঘিরে ফেলেছে। তারা বুঝল, এই কুয়োর ধারে তারা শুধু রেকর্ড করতে আসেনি, তারা চলে এসেছে এক অন্য জগতে, যেখানে আতঙ্ক ছায়ার মতো ঘুরে বেড়ায়। রাত তখন অন্ধকারের গভীর খাদে ঢুকে গেছে, আর কুয়োর নিচ থেকে উঠছে একটার পর একটা অদৃশ্য কণ্ঠস্বর—নিমগ্ন, বিকৃত, কিন্তু ভয়ানক বাস্তব।

অরণ্যের বুক চিরে চলতে চলতে রাত আরও গাঢ় হয়ে উঠল। সবার চোখে-মুখে ক্লান্তি আর উদ্বেগের ছায়া, কিন্তু ক্যামেরা চালু ছিল টুকরো টুকরো ফুটেজ সংগ্রহে। হঠাৎ ঝোপের আড়াল থেকে একটা মৃদু কান্নার আওয়াজ ভেসে এল, যেন কোনো নারী রাতের গভীরে হাহাকার করে উঠেছে। রণদীপ এক মুহূর্ত থেমে ক্যামেরা ঘুরিয়ে শব্দের উৎস খুঁজতে লাগল, আর অর্ক প্রজ্বলিত টর্চের আলো ফেলল সামনে। কিন্তু কিছুই দেখা গেল না—শুধু দুলে ওঠা পাতার শব্দ, আর ওই কান্না, যেটা যেন আরও দূরে সরে গেল। ঠিক সেই সময় ইমন অনুভব করল তার পিঠে কে যেন হালকা একটা স্পর্শ করল। চমকে সে ঘুরে দাঁড়ায়, কিন্তু পেছনে কেউ নেই। রাতের নিস্তব্ধতা এতটাই গভীর যে নিজেদের নিঃশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত গা ছমছমে লাগছিল।

তারা গ্রামে পৌঁছাল যখন রাত প্রায় দুটো। মাটির কুড়ে ঘরগুলো ভেঙে পড়েছে, দু-একটা এখনও দাঁড়িয়ে থাকলেও ছাদের ওপর জন্মেছে আগাছা। চারপাশে একটা অদ্ভুত গন্ধ—মাটি, পচন, আর যেন পুড়ে যাওয়া কিছু একটা। অর্ক একটি কুড়ে ঘরে ঢুকে পড়ে টর্চের আলোয় দেখল কিছু ছেঁড়া কম্বল, একটা কুঁজো লোহার হাঁড়ি, আর পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মাটির পুতুল। পুতুলগুলোর মুখে এক অদ্ভুত হাহাকার—যেন তারা কোনো অসহনীয় যন্ত্রণা প্রকাশ করছে। রণদীপ ক্যামেরা ঘোরাচ্ছিল, কিন্তু তার হাতে হঠাৎ কাঁপুনি শুরু হয়। “দেখেছ? ওই পুতুলটা কি একটু নড়ল?” তার প্রশ্নে কেউ সাড়া দেয় না, কারণ বাকিরাও তখন অন্ধকারের মধ্যে কিছু যেন ঘোরাফেরা করছে তা টের পাচ্ছিল। ইমন ফিসফিস করে বলল, “আমাদের বেরিয়ে যাওয়া উচিত। কিছু ঠিকঠাক লাগছে না।”

কিন্তু তখনই মাটির নিচ থেকে একটা গোঙানির শব্দ ওঠে—ভেতরে গুমগুম আওয়াজ, যেন কেউ কষ্ট পাচ্ছে। সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ে, টর্চের আলো ঘুরতে থাকে চারপাশে, আর তখন দেখা গেল—একটা পুরনো কুয়োর পাশে জমে থাকা শুকনো পাতা ধীরে ধীরে সরছে, আর নিচে থেকে একজোড়া মাটিধরা হাত উঠে আসছে। সবাই স্তব্ধ, যেন শরীর জমে গেছে। হাতে ধীরে ধীরে একটা কাদামাখা মুখ দেখা দিল—চোখদুটি বন্ধ, কিন্তু ঠোঁট নড়ছে, যেন কিছু বলতে চাইছে। রণদীপ ক্যামেরা চালু রেখেছিল, আর সেই দৃশ্য ধারণ করতে করতে তার মুখে ফিসফিস করে এল—“এটা কি সেই পূর্ণিমার রাত?”… আর ঠিক তখনই কুয়োর অপর পাশে থাকা আরেকটা ঘর থেকে শব্দ হল—একটি শিশু কাঁদছে, কিন্তু সেই কণ্ঠস্বর যেন এই দুনিয়ার নয়।

মাটির নিচ থেকে কাদা-মাখানো মুখটা ধীরে ধীরে ওপরে উঠতেই যেন বাতাস থমকে গেল। এক ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতা গ্রাস করল পুরো গ্রামটাকে—পাখিরা থেমে গেছে, গাছপালার দুলুনি বন্ধ, এমনকি নিজেদের শ্বাসের আওয়াজও যেন কানে তীব্র ঠেকছিল। অর্ক ঘামে ভিজে গেছে, হাতে ধরা টর্চটা কাঁপছে। কুয়োর মুখ থেকে উঠে আসা সেই মানবাকৃতি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল—তার মুখে কোনো চোখ নেই, কেবল দুধসাদা এক জোড়া ফাঁকা খোপ, ঠোঁটে একধরনের বিকৃত হাসি। রণদীপ ক্যামেরা চালু রেখেছে ঠিকই, কিন্তু তার চোখের পাতা যেন ভারি হয়ে আসছে, সে গলা চেপে ধরে বলল, “আমরা যা দেখছি, সেটা কি সত্যি?” সেই অদ্ভুত দেহটা নিঃশব্দে উঠে দাঁড়িয়ে চারজনের দিকে তাকিয়ে থাকল, অথচ তার চোখ নেই—তবুও যেন সে সবাইকে দেখে ফেলছে।

তখনই পাশের কুড়ে ঘরের জানালার ভেতর থেকে একটা টুকরো প্রতিচ্ছবি দেখা গেল—সাদা শাড়ি পরা এক নারী, যার চুল ভিজে কাঁধের ওপর লেপ্টে আছে, মুখ ঢাকা, শুধু পায়ের ছায়া দেখা যাচ্ছে। ইমন থেমে গিয়ে ডান হাতে ক্যামেরার দ্বিতীয় লেন্স চালু করল, নৈঃশব্দ্যকে ভেঙে দিয়ে বলল, “ওটা কি সেই মহিলার ছায়া, যাকে এখানে খুঁজতে এসেছিলাম?” তার কথা শেষ হতেই হঠাৎ বাতাস এক অদ্ভুত কাঁপন শুরু করল, যেন কেউ কান্না চেপে ধরে কাঁপছে, আর সেই কাঁপনের সঙ্গেই পুরনো ঘরটার দরজা নিজে থেকেই খুলে গেল। ঘরের ভিতরটা ধীরে ধীরে আলোকিত হয়ে উঠল টর্চের আলোয়—একটা পাথরের ফলক, যার গায়ে কালি দিয়ে আঁকা মূর্তি, আর নিচে লেখা আছে কিছু সংস্কৃত শব্দ। সেই ভাষা কেউ ঠিক বুঝতে পারল না, কিন্তু অর্ক বলল, “এইটা হয়তো কোনো তান্ত্রিক রীতির অংশ… এখানে ওরা কিছু封 করেছে… কেউ বা কিছু।”

হঠাৎ, মাটির নিচ থেকে উঠে আসা সেই অন্ধ প্রেতাকৃতি এগিয়ে এল, কিন্তু তার পা ছিল না—যেন সে মাটি থেকে তৈরি হয়েছে, আর আবার মাটিতেই মিশে যাবে। সে কারও দিকে সরাসরি এগোয়নি, বরং চলে গেল সেই ঘরের দিকে, যেখানে সাদা শাড়ির মহিলার ছায়া দেখা গিয়েছিল। সে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একবার গা দুলিয়ে তারপর মিলিয়ে গেল হাওয়ায়। সবাই হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে, কেউ কথা বলতে পারছে না। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে ঘরের ভিতর থেকে সেই নারীকণ্ঠ আবার শোনা গেল—কান্না নয়, এবার যেন কোনো মন্ত্র পড়ছে ধীরে ধীরে। ভয় আর কৌতূহলের দ্বন্দ্বে জর্জরিত হয়ে ইমন, রণদীপ, অর্ক আর শ্রেয়া এগিয়ে গেল ঘরের দরজার দিকে, কিন্তু দরজার চৌকাঠের সামনে পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে তারা দেখল—ভিতরে কেউ নেই, ঘর ফাঁকা, শুধু সেই পাথরের ফলকের গায়ে ধোঁয়ার মতো কিছু ভেসে উঠছে—একটা মুখ, যার চোখ থেকে রক্তের মতো জল গড়িয়ে পড়ছে।

ঘর থেকে বের হতেই চারপাশে কুয়াশা জমে গেছে ঘন সাদা আবরণে। এবার কেউ কিছু বলছে না, শুধু হেঁটে চলেছে। কিন্তু সেই সময় অর্ক থেমে গেল। সে পেছন ফিরে দেখল সেই পুতুলগুলো—যেগুলো তারা প্রথমে দেখেছিল—এখন মাটির মধ্যে নড়ছে, হাত-পা নাড়ছে, আর ফিসফিস করছে নিজেদের মধ্যে। অর্ক ক্যামেরা জুম করে ধরতেই দেখা গেল—একটা পুতুলের মুখে তাদের চারজনের মুখ ফুটে উঠেছে, যেন কেউ প্রতিটি তাদের কপালে ভবিষ্যতের দুঃস্বপ্ন লিখে দিয়েছে। তখনই শ্রেয়ার গলা থেকে একটা ফিসফিসানি বেরিয়ে এল, “পূর্ণিমা রাতের আগেই আমাদের এখান থেকে বেরোতে হবে… না হলে আমরা ফিরব না।” কিন্তু অর্ক তখনও দেখছিল—একটা পুতুল তার মুখে তাকিয়ে আছে, আর সেই পুতুলটার ঠোঁট নড়ছে—অডিও রেকর্ডারে বাজল একটাই শব্দ: “তোমরা দেরি করে ফেলেছ।”

অরণ্যের মধ্যে আরও গভীর রাত নামছে, যেন শালবনের প্রতিটি পাতাও শ্বাস বন্ধ করে আছে। শীতল বাতাসে মাটি আর পচা পাতার গন্ধ মিশে এক রকম দমবন্ধ করা অনুভূতি তৈরি করছে। ক্যাম্পফায়ারের আলো মৃদু হয়ে এসেছে, তবু কেউ সাহস করে ঘুমোতে পারছে না। অরিন্দম ক্যামেরা আর সাউন্ড রেকর্ডার নিয়ে বসে, যেন কোনো কিছু আবার ঘটার অপেক্ষায়। হঠাৎ করেই বনের নীরবতা ভেঙে এক অদ্ভুত আওয়াজ শুনতে পাওয়া গেল—মাটির নিচে কিছু যেন কাঁপছে, ফেটে উঠছে। অরিন্দম, সোহিনী, ঋদ্ধি, মেহুল—চারজনেই একসাথে ক্যাম্পের বাইরে ছুটে আসে। সেখানে তারা দেখে, গাছের ছায়ার নিচে মাটি থরথর করে কাঁপছে। মাটি ফেটে বেরিয়ে এল এক জোড়া হাত, সাদা, কাদা-মাখা, ফ্যাকাশে—যেন বহু বছর মাটির নিচে থাকার পরেও হাড়গুলো সজীব হয়ে উঠেছে। সবাই হতবাক। কণ্ঠ শুকিয়ে এসেছে সোহিনীর, সে ক্যামেরা চালু করে রেকর্ডিং শুরু করে, কিন্তু তার হাত কাঁপছে এতটাই যে দৃশ্যটা ঠিকভাবে ধরা পড়ছে না। একজন মৃত ব্যক্তি, যাকে যেন কল্পনার ভয়াবহতাও ধারণ করতে পারে না, ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াচ্ছে। চোখদুটি গহীন অন্ধকারে যেন জ্বলজ্বল করছে, অথচ সেখানে কোনো পুতলি নেই। মৃতদেহটি যেন শুধু উঠেই থেমে থাকেনি, তার পেছন পেছন আরও কয়েকটি মৃতদেহ মাটি চিরে উঠে আসছে—একেকটি যেন মৃত্যুর গভীরতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে জেগে উঠেছে।

সোহিনী ভয়ে চিৎকার করে ওঠে, কিন্তু সেই চিৎকার যেন বাতাসে হারিয়ে যায়। ঋদ্ধি মেহুলকে ধরে পিছনে টানতে টানতে বলল, “চলো এখান থেকে, এখনই চলো!” কিন্তু অরিন্দম তখনও ক্যামেরা হাতে দৃশ্যগুলো ক্যাপচার করতে ব্যস্ত, যেন এই শক এবং আতঙ্কের মাঝেও এক সাংবাদিকের নেশা তাকে গেঁথে রেখেছে। মৃতদেহগুলোর চোখ নেই, মুখ নেই, তবুও তাদের শরীর জুড়ে আছে একরকম সজীবতা, যেন এক অভিশপ্ত জীবনের চেতনা। তাদের গায়ে আছে আদিবাসী গয়নার ছিটেফোঁটা, গলার মালা, কপালে সিঁদুরের ছোপ, পেছনে মাটির ছোপে ধরা পড়েছে তাদের মাটির ঘরের ভাঙা অংশ। এই মৃতেরা যেন এই জায়গার প্রাচীন ইতিহাসকে বহন করে আসছে। তারা ধীরে ধীরে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে, কেউ ক্যাম্পের দিকে আসছে, কেউ গাছের গোড়ায় গিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকছে। তাদের মুখে কোনো শব্দ নেই, তবুও একরকম অনন্ত হাহাকার বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। হঠাৎ করেই একটা মৃতদেহ সোজা ক্যাম্পের একপাশে রাখা রেকর্ডিং বক্সের সামনে এসে দাঁড়াল, আর যেন গলা ছেড়ে কাঁদতে লাগল—কিন্তু সেই কান্না শোনা যায় না, কেবল অনুভব করা যায় হৃদপিণ্ডের গহ্বরে।

ঋদ্ধি আর মেহুল তখন ক্যাম্পফায়ার নিভিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে চেষ্টা করে, কিন্তু তাদের পেছনে অরিন্দম নেই। সোহিনী, যাকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা চলছিল, হঠাৎ থেমে বলল, “অরিন্দমকে রেখে যাব না। ও একা পড়ে আছে।” সেই মুহূর্তেই ক্যাম্পের পাশে আরেকটি মৃতদেহ মাটি থেকে উঠে এসে সরাসরি অরিন্দমের দিকে এগিয়ে গেল। অরিন্দম কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর ক্যামেরা ফেলে পিছিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু মৃতদেহটি তখনও তাকে এক দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে। তারপর হঠাৎ করেই—এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে—সে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, আর নিজের দুই হাত প্রসারিত করল অরিন্দমের দিকে। যেন সে কিছু চাইছে, কিছু ফিরিয়ে দিতে চাইছে। অরিন্দম কাঁপতে কাঁপতে বলল, “আমরা তো শুধু সত্যিটা জানতে এসেছি, তোমাদের কষ্টের ইতিহাস শুনতে এসেছি…” তখন মৃতদেহটি তার কণ্ঠের শব্দে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। সেই মুহূর্তে আরও কয়েকজন মৃতদেহ তাদের চারদিকে ঘিরে ফেলেছে। একসাথে কেউ কথা বলছে না, কেউ হাঁটছে না—তবুও সেই নিরবতা যেন মৃত্যুর থেকেও ভয়ঙ্কর। শালবনের নৈশব্দ্যে তখন শুধুই কেঁপে ওঠা বাতাস, আর মৃতদের নিঃশব্দ উপস্থিতি, যারা ফিরে এসেছে… আবারও বলার জন্য, আবারও দেখানোর জন্য যে, মৃতরা সবসময় শান্তিতে ঘুমায় না।

শালবনের নিঃশব্দতা যেন হঠাৎ করে নিজের রক্তক্ষয়ী ইতিহাসের ঝাঁপি খুলে বসেছে। পূর্ণিমার আলো ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠছে আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গা ছমছমে বাতাস বয়ে চলেছে আদিবাসী গ্রামের পথে। ক্যামেরাম্যান রাজর্ষি এবং রেকর্ডিস্ট দীপু ক্যামেরা আর বুম নিয়ে পুবের দিকে ছুটে গিয়েছে, যেখানে একটা ছায়াময় কাঠামো নড়ে উঠেছিল; সম্ভবত একটা মানুষের অর্ধেক শরীর মাটি থেকে উঠে দাঁড়াতে চাইছে। আর পিছনের দিকে, তমাল আর অদ্রীকা দাঁড়িয়ে ছিল একটা ঝুপড়ি ঘরের দরজার সামনে, যেখানে ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসছিল অদ্ভুত এক রিদমিক গলার আওয়াজ—যা একাধারে শোকসঙ্গীত, একাধারে পূজা। তারা কাঁপতে কাঁপতে ঘরের দিকে এগোতেই দরজা খুলে গেল নিজে থেকেই। ভিতরে ছিল মাটির মেঝে, মাঝখানে একটা বড় লাল পাটির মতো কিছু রাখা, আর তার ওপরে একজন মহিলা, অর্ধনগ্ন, নাচতে নাচতে গান গাইছে একটা অজানা ভাষায়। তার চোখদুটো রক্তাভ, মাথাভর্তি চুল উল্টোদিকে বাঁধা, যেন পেছনের অতীতে সে কিছু গেঁথে রেখে এসেছে। অদ্রীকার পা যেন আটকে গেল মাটির সঙ্গে, কিন্তু তমাল তাকে টেনে নিয়ে গেল বাইরের দিকে, কিন্তু তখনই তাদের পেছনে দরজাটা জোরে বন্ধ হয়ে গেল। ভিতরের আওয়াজ আরও জোরালো হয়ে উঠল, আর সেই সঙ্গে মাটির নিচ থেকে যেন শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ আসতে লাগল।

গ্রামের কুয়োর ধারে রাজর্ষি আর দীপু যেটা দেখল, তা সোজাসুজি ক্যামেরায় ধরার মতো না। কুয়োর পাশ থেকে পাঁচ-ছয়টা মাটি-মাখা মানুষ ধীরে ধীরে উঠে আসছে, চোখদুটো বন্ধ, কিন্তু যেন দিকনির্দেশ পাওয়ার অপেক্ষায়। তাদের গায়ের গন্ধ, ভেজা মাটি আর পুরনো রক্তের মিশ্রণ। দীপু চিৎকার করে বলল, “এগুলো অ্যাড-অন না… এগুলো জাস্ট… মৃত!” রাজর্ষি তাকে বলল পালিয়ে যেতে, কিন্তু দীপু তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন, সে শুধু ক্যামেরার ফ্রেমে চোখ রাখছে, যেখানে এক বৃদ্ধ, মাথা ভরা ছাই মেখে, তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তার গলায় একটা হাড়ের মালা, চোখে শূন্যতা। রাজর্ষি দীপুর হাত ধরে টান মারতেই একটা বাচ্চা ছেলের কণ্ঠস্বর ভেসে এল—“আমায় ছেড়ে যেয়ো না…”। তারা দুজনেই পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখল, এক দশ-বারো বছরের ছেলের আধভাঙা দেহ, চোখে অনুরোধ আর গলায় কাঁটার মালা। ভয় আর কৌতূহলের এই সীমান্তরেখা পেরিয়ে দীপু ক্যামেরা ফেলে দিয়ে দৌড় দিল। রাজর্ষি কাঁপতে কাঁপতে কুয়োর ধারে তাকাল, যেখানে এখন মৃতদের সারি বসে গুনগুন করে একসঙ্গে কিছু বলছে। পুরোনো কোনো ভাষায়, এক ধরনের গান—যেটার সুরে যন্ত্রণা, কিন্তু এক ধরনের নিয়তি মেনে নেওয়ার সুরও।

তমাল আর অদ্রীকা আবার ফিরে আসে দলের বাকি সদস্যদের খোঁজে, কিন্তু রাস্তা আর আগের মতো নেই। যে পথ দিয়ে তারা এসেছিল, তা যেন সরে গেছে, যেন বনটাই তাদের তাড়িয়ে দিয়েছে। বাতাসে ঘোরাঘোরি করছে ছিন্নমস্তা মূর্তির মুখ, পেছনে এক ছায়াময় হাত বারবার ছুঁয়ে যাচ্ছে তাদের ঘাড়। তারা বুঝে যায়, এই গ্রামে রাত কাটানো মানেই একটা অদৃশ্য সীমানা পার করে ফেলা—যেখান থেকে ফেরা মুশকিল। ঠিক তখনই তারা শুনতে পায়, গ্রামের প্রান্তে এক জায়গায়, ঢাক বাজছে—পুরোনো ধাঁচের শবনাচের তালে। অদ্রীকা বলল, “এটা একটা উৎসব… মৃতদের উৎসব।” আর তমাল জবাব দিল, “না, এটা ওদের ফেরার উৎসব—আমরা ভুল জায়গায় এসেছি ভুল সময়ে।” চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ক্যামেরা, মাইক, বুম—সব এখন অপ্রাসঙ্গিক। সময় যেন থেমে গেছে। তারা পা রাখে সেই উৎসবের দিকে, এই বুঝে যে এখন থেকে ওরাই ‘দর্শক’ নয়, বরং ‘অংশগ্রহণকারী’। শালবনের রাত গাঢ়তর হচ্ছে, আর মৃতরা একে একে মাটির বুক চিরে নিজেদের জায়গা নিচ্ছে। এই রাত এখনও শেষ হয়নি।

রাতের আকাশে তখনও পূর্ণিমার চাঁদ টগবগ করে জ্বলছে, আর শালগাছের পাতায় তার রুপালি আলো ছায়া ফেলে দিচ্ছে গা ছমছমে ছায়াছবি। ক্যামেরা পড়ে আছে একপাশে, চারদিকে হাহাকার আর ধ্বংসের চিহ্ন। মাটির নিচ থেকে যারা উঠেছিল, তারা আবার মিশে যাচ্ছে মাটির বুকেই, কিন্তু তার আগে তারা একবার করে তাকিয়ে নিচ্ছে সোহম, রুদ্র, তিশা আর রীনার দিকে—তাদের চোখে নেই ক্ষোভ, নেই রাগ, শুধু এক নিঃশব্দ আর্তনাদ, যেন কিছু বলার আছে, কিন্তু বলা হয়নি। তিশা তখন হাঁটু গেড়ে বসে, তার গায়ে কাদা, মুখে রক্ত আর চোখে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি। রীনা স্রেফ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, কিছুতেই সে বিশ্বাস করতে পারছে না এই বাস্তবতাকে। রুদ্রের হাত থেকে আগুনের টর্চ পড়ে যায় মাটিতে, সেই আলোয় হঠাৎ দেখা যায় মাটির ভেতর থেকে উঠে আসা এক বৃদ্ধা—মুণ্ডিহারা অবস্থায়ও সে যেন তিশার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে নেয়। তিশা ফিসফিসিয়ে বলে, “তুমি… তুমি আমার দিদিমা?”, আর সেই মুহূর্তে ঝড় ওঠে শালবনে, যেন শতবর্ষের নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো একসাথে। ক্যামেরার ফুটেজে ধরা পড়ে সেই শালবনের মাঝখানে এক বৃত্ত, যেখানে মাটির ওপর গাছের ডাল দিয়ে আঁকা এক লালচে আলপনা, আর তার মাঝখানে বসে আছে তিশা, চোখ বন্ধ, ঠোঁটে এক অদ্ভুত মন্ত্র, যেন কারও প্রাচীন স্মৃতি তাকে গ্রাস করে নিয়েছে।

রাত্রির সেই তাণ্ডব থেমে গেলে দেখা যায়, গোটা দলটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে—সোহম পড়ে আছে একটি শালগাছের গোড়ায়, মাথায় আঘাত, নিঃশ্বাস মৃদু। রীনা আধা-অচেতন অবস্থায় তিশার পাশে, তার কাঁধে বিশাল এক আঁচড়ের দাগ, কিন্তু চোখে এখনও ভয়ের ছাপ। রুদ্র তখনও ক্যামেরা চালিয়ে রাখে, হাত কাঁপছে, কিন্তু সে জানে—এই ফুটেজ শুধু ইতিহাস নয়, এই হচ্ছে এক জাতির লুকিয়ে রাখা কান্না। সেই শালবনের মৃতেরা মাটির নিচে ফিরে গেলেও তাদের চিহ্ন, তাদের ব্যথা, আর এক টুকরো আত্মা থেকে গেল চারপাশে—পাতা নড়ার শব্দে, বাতাসের গন্ধে, আর তিশার দেহের মধ্যে। সকালে যখন পুলিশ ও গ্রামবাসীরা পৌঁছায়, তারা দেখে তিনজনকে উদ্ধার করা যাচ্ছে—চতুর্থজন, তিশা, কোথাও নেই। শুধু তার গলার মালার একটি ভাঙা দানা পড়ে আছে সেই বৃত্তের মাঝখানে, আর সেখানে মাটির গায়ে আঁকা অদ্ভুত এক প্রতিকৃতি, যা দেখতে অনেকটাই তিশার মতো।

ঘটনার পরে এক মাস কেটে যায়। রুদ্র আর রীনা কলকাতায় ফিরে আসে, কিন্তু তারা আর আগের মানুষ থাকে না। সোহমের স্মৃতি কিছুটা হারিয়ে গেছে, সে রাতে কী হয়েছিল—তার অধিকাংশই তার মনে নেই। শুধু মাঝে মাঝে স্বপ্নে সে দেখে এক শালবনের পথ, এক রক্তমাখা চাঁদ, আর একজন মেয়েকে, যার কণ্ঠে বাজে এক আদিবাসী গান। রীনা সেই সব ফুটেজ একত্র করে একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করে—নাম দেয় “শালবনের শব”, কিন্তু কেউ চায় না সেটা মুক্তি পাক। বিভিন্ন প্রযোজক দেখে চমকে যায়, ভয় পায়। কেউ কেউ বলে, এটা নাকি “অভিশপ্ত ফুটেজ”—যারা দেখে, তারা রাতে ঘুমাতে পারে না। শেষমেশ, রুদ্র নিজের চ্যানেলে সেই ভিডিও প্রকাশ করে, আর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তা ভাইরাল হয়ে যায়। দর্শকরা বিস্ময়ে দেখে সেই রাতের ভয়াবহতা, কিন্তু তাদের জানা থাকে না সত্যিকারের অভিশাপের কথা—তিশার গলা থেকে বলা শেষ মন্ত্র, যা একপ্রকার পুনর্জন্মের ডাক। শেষ দৃশ্যে দেখা যায়, কোনও এক অজানা শালবনের ভেতরে, একটি মেয়ের পা হেঁটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, তার গায়ে একটি লাল শাড়ির আঁচল, আর বাতাসে ভেসে আসছে সেই একই গান—“ধোনি হো ধোনি হো, মাতি কা রাগ…”, যেন শালবনের শবরা কখনও পুরোপুরি বিদায় নেয় না।

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *