Post Views: 47
সোমনাথ দত্ত
এক
কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের অডিটোরিয়ামে সেদিন ছিল ‘ইস্টার্ন ফরেস্ট কনজারভেশন’ নামে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার। চারপাশে ব্যানার, স্টল, আর নানা দেশের বিজ্ঞানী, গবেষক ও শিক্ষার্থীরা ভিড় জমিয়েছিল। আলো-আঁধারির হলঘরে মাইক্রোফোনে চলছিল বক্তৃতা, আর পাশে বড় স্ক্রিনে ভেসে উঠছিল বনের প্রাণিকুল, বিরল উদ্ভিদ আর সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ছবি। প্রথম সেশনের শেষে, চায়ের বিরতিতে, ড. অনির্বাণ সেনগুপ্ত দাঁড়িয়ে ছিলেন কফির কাপ হাতে, একদম কর্নারের দিকে। গম্ভীর মুখ, পরিমিত কথা বলা মানুষ তিনি, কিন্তু প্রকৃতি নিয়ে কথা উঠলে চোখে একধরনের শিশুসুলভ উচ্ছ্বাস জ্বলে ওঠে। ঠিক তখনই এক পরিচিত মুখ—গাঢ় বাদামি চামড়া, খসখসে হাত, মাথায় ধুলো-ধূসরিত টুপি—হেঁটে এলেন তাঁর দিকে। লোকটি নিজের নাম বলল—দুলাল মাঝি, পশ্চিম মেদিনীপুরের ঝাড়গ্রামের কাছে বসবাসকারী এক স্থানীয় গাইড ও প্রাক্তন শিকারি। পরিচয়ের পর পরই দুলাল নিচু স্বরে বলল, “ডক্টরবাবু, আপনি তো বনের অনেক খবর রাখেন, কিন্তু আমাদের শালবনের ফিসফিসের কথা জানেন?” অনির্বাণ কপালে ভাঁজ ফেললেন, নামটা শুনেছেন হয়তো কোনো লোককথায়, কিন্তু বিস্তারিত কিছু জানা নেই। দুলাল এক চুমুক চা নিয়ে বলল, “রাতের বেলা, বিশেষ করে পূর্ণিমায়, বনজুড়ে গাছগুলো কথা বলে। শোনার মতো কথা নয়—যেন শত মানুষের একসাথে কানে কানে কিছু বলা, কিন্তু একটাও শব্দ ঠিক বোঝা যায় না। যারা গেছে খুঁজতে, অনেকে আর ফিরে আসেনি।” চারপাশের ভিড়ের মধ্যে এই গল্প যেন অন্য এক স্তব্ধতা সৃষ্টি করল—অনির্বাণ বুঝলেন, লোকটা বাড়িয়ে বলছে কি না, তা জানার উপায় নেই, কিন্তু গলায় এমন একরকম ভয় মেশানো দৃঢ়তা ছিল যা সহজে অভিনয় করা যায় না।
দু’দিন পরেই অনির্বাণ সিদ্ধান্ত নিলেন এই বিষয়টি যাচাই করার। বহু বছর ধরে ভারতের শালবন ও মিশ্র অরণ্যের জীববৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করেছেন তিনি, কিন্তু কোনো বন নিয়ে এত রহস্যময় কাহিনি শোনেননি। বৈজ্ঞানিকভাবে ভাবলে, রাতে বাতাসে পাতার ঘর্ষণ, পোকামাকড়ের ডাক বা দূরের প্রাণীর শব্দ মানুষের মনে বিভ্রম সৃষ্টি করতে পারে—কিন্তু এই ফিসফিস গল্পে আরও গভীর কিছু আছে বলে তাঁর অনুভূতি হচ্ছিল। তাই তিনি গঠন করলেন একটি ছোট দল, যেখানে প্রত্যেকের ভূমিকা আলাদা। প্রথমেই তিনি যোগাযোগ করলেন রোহিনী দত্তের সঙ্গে, যিনি অভিজ্ঞ বন্যপ্রাণী ফটোগ্রাফার এবং সাহসী অভিযাত্রী। রোহিনী তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলেন, কারণ এমন গল্প ক্যামেরায় ধরা পড়লে সেটি হবে তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতম বড় অর্জন। এরপর এলেন অমিতাভ পাল—প্রফুল্ল স্বভাবের ভিডিওগ্রাফার ও ডকুমেন্টারি নির্মাতা, যিনি ভৌতিক ও রহস্যময় লোককথা নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসেন। আরেকজন হলেন সুজাতা রায়, তুলনামূলকভাবে নীরব প্রকৃতির, কিন্তু অডিও সিগন্যাল বিশ্লেষণে অসাধারণ দক্ষ। সুজাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা প্রকল্পে অস্বাভাবিক প্রাকৃতিক শব্দ নিয়ে কাজ করেছেন, আর এখানে তাঁর দায়িত্ব হবে ‘ফিসফিস’ রেকর্ড ও বিশ্লেষণ করা। শেষ পর্যন্ত দুলাল মাঝিকে দলনেতা হিসেবে যুক্ত করা হলো, কারণ বন ও এলাকার ইতিহাস তাঁর মতো ভালো আর কেউ জানে না। পরিকল্পনা হলো, পূর্ণিমার আগে এক সন্ধ্যায় তাঁরা শালবনের ভেতরে প্রবেশ করবেন, একটি নির্দিষ্ট স্থানে ক্যাম্প গাড়বেন, এবং রাতভর পর্যবেক্ষণ চালাবেন।
তাদের প্রস্তুতি চলাকালীন সবার মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতি কাজ করছিল। অনির্বাণের মধ্যে ছিল একধরনের বৈজ্ঞানিক কৌতূহল, কিন্তু একই সঙ্গে এক অজানা চাপা শঙ্কা। রোহিনী ব্যস্ত ছিলেন উচ্চমানের ক্যামেরা, নাইট ভিশন লেন্স, আর ব্যাটারি প্যাক গুছিয়ে রাখতে—তাঁর চোখে ছিল শিকারীর মতো শিকার পাওয়ার আগ্রহ। অমিতাভ, নিজের কাঁধে ভারী ভিডিও ক্যামেরা ঝোলাতে ঝোলাতে, মাঝেমাঝে ঠাট্টা করছিলেন—“ভূত যদি আসে, ইন্টারভিউও নেব!”—যদিও তাঁর চোখে মাঝে মাঝে এক অদৃশ্য উদ্বেগের ছায়া দেখা যাচ্ছিল। সুজাতা ছিলেন সবচেয়ে নীরব; তিনি শব্দ-রেকর্ডারের তারগুলো পরখ করছিলেন, আর নিজের নোটবুকে কিছু গাণিতিক হিসাব লিখছিলেন। দুলাল, বাকিদের মতো প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন না; তিনি বসেছিলেন এক কোণে, চোখ আধবোজা, মুখে চাপা গাম্ভীর্য—যেন জানেন, তাঁরা যা খুঁজতে যাচ্ছেন, তা খুঁজে পাওয়া কারও জন্য ভালো নাও হতে পারে। যাত্রার আগের রাতেই দুলাল অনির্বাণকে আলাদা করে বলেছিল, “ডক্টরবাবু, ফিসফিস শোনার লোভে অনেকেই গিয়েছে, কিন্তু বনের পথ নিজেই ওদের ফিরতে দেয়নি। আপনি বিজ্ঞানী, তাই ভাবছেন সব ব্যাখ্যা আছে, কিন্তু কিছু জিনিস ব্যাখ্যার বাইরে।” অনির্বাণ হেসে এড়িয়ে গেলেও, সেই কথাগুলো মনের ভিতরে কোথাও গেঁথে রইল—হয়তো সেই কারণেই তাঁর রাতের ঘুম তেমন হলো না, আর ভোরের আলো ফোটার আগেই তিনি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন, এক জঙ্গলের ভিতরে, যেখানে গাছেরা নাকি কথা বলে।
দুই
ঝাড়গ্রামের রাস্তায় গাড়ি চলছিল ধীরে ধীরে, চারপাশে কেবলই সবুজ আর মাটির রাস্তার ধুলোর গন্ধ। ভোরের সূর্যের আলো গাছের মাথা ছুঁয়ে পড়ছিল রাস্তার উপর ছায়াছায়া ফেলে। দুলাল মাঝি গাড়ির সামনে বসে পথ দেখাচ্ছিল, মাঝে মাঝে হাত তুলে দিক নির্দেশ দিচ্ছিল—কোথাও বাঁ দিকে, কোথাও আবার সরু কাঁচা পথে সোজা। গাড়ি যখন শালবনের গেটের মতো দেখতে কাঠের খুঁটি পেরিয়ে ঢুকল, সবাই যেন একটু চুপ হয়ে গেল। সারি সারি শালগাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে, পাতাগুলো অল্প বাতাসে দুলে এক অদ্ভুত সুর তুলছিল—যা প্রথমে মনে হলো সাধারণ পাতার শব্দ, কিন্তু শুনতে শুনতে বোঝা গেল, এর ভেতরে যেন এক রহস্যময় ছন্দ আছে। রোহিনী কাঁচের জানালা নামিয়ে ক্যামেরা হাতে নিলেন, কয়েকটি দৃশ্য বন্দি করলেন, আর অমিতাভ নিজের ফোনে ভিডিও চালু করলেন, যেন এই মুহূর্ত হারিয়ে না যায়। অনির্বাণ গভীর মনোযোগে গাছের গুঁড়ি, পাতার রঙ, আর বনের ঘ্রাণ পর্যবেক্ষণ করছিলেন—কিন্তু তাঁরও মনে হচ্ছিল, দিনের আলো সত্ত্বেও এখানে কিছু একটা অন্যরকম, যা শহরের মানুষের কাছে অপরিচিত।
গাড়ি থামতেই দুলাল নিচু গলায় বলল, “এখান থেকে হেঁটেই যেতে হবে। গাড়ি আর এগোবে না।” সবাই ব্যাগ কাঁধে তুলে নিল, আর সরু মাটির পথ ধরে জঙ্গলের ভিতরে ঢুকতে লাগল। যতই ভেতরে ঢোকা গেল, ততই বনের পরিবেশ পাল্টে গেল—বাতাস ঠান্ডা, মাটিতে শুকনো পাতার চাদর, আর উপরে ঘন সবুজ ছাতা, যেখানে সূর্যের আলো কেবল দাগ কেটে ঢুকছে। হঠাৎ যেন কারও কারও কানে ভেসে এলো দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ—যা মিলিয়ে গেল পাতা ঝরার মৃদু আওয়াজে। সুজাতা কাঁধের উপর থেকে তাকিয়ে বলল, “শুনলেন? কারও নিঃশ্বাসের মতো শোনাল!” অমিতাভ হেসে উঠল, “ওহ, এ তো শুধু বাতাস!” কিন্তু তার হাসির ভেতরেও অস্বস্তি লুকোতে পারল না। ঠিক তখনই দুলাল থেমে গেল, গাছের গায়ে হাত রেখে বলল, “এই পথে একসময় গ্রামের মানুষ যেত। কিন্তু সেই গ্রাম আর নেই।” বাকিরা প্রশ্ন করার আগেই সে আবার হাঁটতে শুরু করল।
বিকেল নাগাদ তাঁরা শিবিরের জন্য একটি ফাঁকা জায়গা বেছে নিল—চারপাশে শালগাছের প্রাকৃতিক প্রাচীর, মাঝখানে শুকনো মাটির জমি। রোহিনী আর অনির্বাণ তাঁবু খাটানোর কাজ শুরু করলেন, অমিতাভ ভিডিও ক্যামেরা সেট করল বিভিন্ন দিকের দিকে, আর সুজাতা রেকর্ডিং সরঞ্জাম সাজাতে লাগলেন। দুলাল এক কোণে আগুন জ্বালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল, মাঝে মাঝে চুপচাপ চারপাশে তাকাচ্ছিল, যেন কিছু খুঁজছে বা কিছু থেকে সতর্ক থাকছে। কাজের ফাঁকে সে বলল, “রাতের পরে শব্দ শুনলে সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেবেন না, আর চেষ্টা করবেন না খুঁজে বের করতে সেটা কোথা থেকে আসছে। এখানে শব্দ ডাকের মতো।” বাকিরা হেসে উড়িয়ে দিল—রোহিনী বলল, “আমরা তো খুঁজতেই এসেছি, না হলে এতদূর কেন?” দুলাল কিছু বলল না, শুধু আগুনে শুকনো কাঠ ফেলল, আর আকাশে তখন ধীরে ধীরে নেমে আসছিল গোধূলির অন্ধকার, যা বনের গায়ে অদ্ভুত ছায়া আঁকতে লাগল, যেন শালগাছেরাও প্রস্তুত হচ্ছে রাতের সেই ফিসফিসের জন্য।
তিন
সূর্য একসময় গাছের মাথার আড়ালে মিলিয়ে গেল, আর শালবনের উপর নেমে এল ধূসর ছায়ার চাদর। গোধূলির শেষ আলো ধীরে ধীরে নিভে গেলে চারপাশে কেবল আগুনের ক্ষীণ কমলা আলো আর দূরের পোকামাকড়ের মৃদু ডাক শোনা যাচ্ছিল। দলের মধ্যে কেউই তখন খুব জোরে কথা বলছিল না—একটা অদ্ভুত চাপা উত্তেজনা যেন সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। সুজাতা চুপচাপ নিজের সরঞ্জাম বের করল—ছোট ছোট তার, মাইক্রোফোন, আর একটি উন্নতমানের সাউন্ড রেকর্ডার। সে মাটিতে বসে কানে হেডফোন লাগিয়ে শব্দের দিক নির্ণয় করতে শুরু করল। অনির্বাণ এক কোণে নোটবুকে দিনের পর্যবেক্ষণ লিখছিলেন, আর রোহিনী ত্রিপডে ক্যামেরা বসাচ্ছিলেন। দুলাল তখনও চুপচাপ, কিন্তু মাঝে মাঝে গাছের দিকে তাকাচ্ছিল, যেন অন্ধকারে কিছু দেখছে। রাত যত গভীর হচ্ছিল, বাতাসের শীতলতা ততই বেড়ে যাচ্ছিল—এমন ঠান্ডা যা দিনের উষ্ণতার সঙ্গে একদম বেমানান।
হঠাৎ সুজাতার হাত কেঁপে উঠল। সে হেডফোন কানে দিয়ে আঙুল তুলে বাকিদের চুপ থাকতে ইশারা করল। প্রথমে মনে হলো, হয়তো বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দ, কিন্তু মনোযোগ দিয়ে শুনলে বোঝা গেল—এটা বাতাস নয়। শব্দটা যেন বহু মানুষের কণ্ঠ একসঙ্গে, কিন্তু খুব নিচু স্বরে, ধীর গতিতে কিছু বলছে। প্রতিটি শব্দ মিশে আছে এক অদ্ভুত প্রতিধ্বনিতে, যা চারপাশের গাছের গায়ে লেগে ফিরে আসছে। যেন কারওা ফিসফিস করার ধ্বনি কেবল কানে নয়, হাড়ের ভেতর পর্যন্ত প্রবেশ করছে। রোহিনী সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা চালু করল, নাইট ভিশন মোডে লেন্স ঘুরিয়ে চারপাশ স্ক্যান করতে লাগল—কিন্তু কিছুই দেখা গেল না, শুধু শালগাছের স্থির গুঁড়ি আর পাতার হালকা নড়াচড়া। অথচ শব্দটা থামল না, বরং ক্রমে আরও স্পষ্ট হতে লাগল, যেন তারা ঠিক ক্যাম্পের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। সুজাতা ফিসফিস করে বলল, “এগুলো কোনো ভাষা… কিন্তু চেনা নয়।” অনির্বাণ তৎক্ষণাৎ রেকর্ডারের দ্বিতীয় ডিভাইসও চালু করলেন, যাতে কোনো শব্দ হারিয়ে না যায়।
অমিতাভ, যিনি সাধারণত ভয়ের মুহূর্তেও মজা করে পরিস্থিতি হালকা করার চেষ্টা করেন, এবারও হেসে বললেন, “ঠিক আছে, ভূতদাদা-দিদি, আমরা চলে এসেছি, আপনারা কি চা খাবেন?” কিন্তু সেই হাসির নিচে তাঁর কণ্ঠে কাঁপুনি ধরা পড়ল, আর চোখের কোণে একধরনের অস্বস্তি স্পষ্ট হলো। দুলাল কিছু বলল না—সে কেবল ধীরে ধীরে আগুনের শিখা বাড়িয়ে দিল, যেন আলোটা আরও শক্তিশালী হয়। মুহূর্তের জন্য ফিসফিস কিছুটা ক্ষীণ হলো, কিন্তু তারপর আবার ফিরে এল, এবার আরও গভীর, যেন বনজুড়ে অদৃশ্য মুখগুলো একসঙ্গে কিছু জপছে। রোহিনী ক্যামেরা লেন্স সরিয়ে অন্ধকারে তাকিয়ে রইল, মনে হচ্ছিল শব্দটা কোথাও খুব কাছ থেকে আসছে—কিন্তু অদ্ভুতভাবে, শব্দের উৎস যেন দিক নির্ধারণ করা যাচ্ছে না, এক মুহূর্তে ডান দিক, পর মুহূর্তেই বাঁ দিকে। সুজাতা চোখ বড় বড় করে বলল, “এগুলো কেবল শব্দ নয়… এরা আমাদের খুঁজছে।” বাকিরা কিছু বলল না, কিন্তু আগুনের আলোতে তাঁদের মুখে যে গাঢ় ছায়া নেমে এলো, তাতে বোঝা গেল—রাতের প্রথম ফিসফিস ইতিমধ্যেই সবার মনে অদৃশ্য ভয়ের বীজ বপন করে দিয়েছে।
চার
ভোরের কুয়াশা শালবনের বুকে ছড়িয়ে পড়েছিল, সূর্যের প্রথম আলো পাতার ফাঁক দিয়ে এসে পড়লেও তা যেন ঘন ধোঁয়ার ভেতর ডুবে গিয়ে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। অনির্বাণ ঘুম থেকে উঠে সবার দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত অস্বস্তি অনুভব করলেন—হাওয়ায় অচেনা কিছুর গন্ধ, যেন ভেজা মাটির সঙ্গে পুরোনো কাঠের পচা গন্ধ মিশে আছে। সুজাতা সাউন্ড রেকর্ডার বন্ধ করতে গিয়ে লক্ষ্য করল, গত রাতের রেকর্ডিংয়ের শেষ দিকে মৃদু কিন্তু নিয়মিত কিছু খসখস শব্দ ধরা পড়েছে, যা বাতাসে পাতার নড়াচড়ার মতো হলেও তার মধ্যে এক ধরনের ছন্দ আছে—যেন ইচ্ছে করেই কেউ পায়ের শব্দ আড়াল করার চেষ্টা করছে। তাঁরা চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন, শিবিরের মাটিতে হালকা চাপে গঠিত কিছু দাগ রয়েছে—মানুষের পায়ের ছাপ, কিন্তু সেগুলো অদ্ভুতভাবে অসম্পূর্ণ, কিছু জায়গায় গোড়ালি আছে কিন্তু আঙুলের দিক নেই, আবার কোথাও কেবল আঙুলের চিহ্ন, গোড়ালি উধাও। রোহিনী নিচু হয়ে সেগুলো ভালো করে পর্যবেক্ষণ করছিল, আর অমিতাভ কৌতুকের ভঙ্গিতে বলল, “হয়তো রাতের বেলায় কোনো শালবনের ভূত এসে আমাদের চারপাশে নাচানাচি করেছে!” কিন্তু তার কণ্ঠে মজার সুর থাকলেও চোখের গভীরে এক চিলতে শঙ্কা ফুটে উঠেছিল। দুলাল কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ অস্থিরভাবে চারপাশে তাকাল, যেন কোনো অদৃশ্য চাপ তার ওপর নেমে এসেছে, তারপর সে ধীরে ধীরে বলল, “আমরা যে পথে এসেছিলাম, সেটা এইদিকে ছিল… কিন্তু এখন এখানে কিছুই নেই।”
সবাই প্রথমে ভেবেছিল দুলালের হয়তো ভুল মনে হয়েছে, কিন্তু কয়েক কদম এগোতেই তারা বুঝতে পারল ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয়। গতকাল যে পথ দিয়ে তাঁরা জঙ্গলের ভেতরে এসেছিল—যেখানে গাছগুলো তুলনামূলকভাবে দূরে দূরে ছিল, আর কিছু পুরনো পড়ে থাকা গাছপালা পথের ধারে চেনার মতো দাগ এঁকে রেখেছিল—সেই সবকিছু যেন রাতারাতি বদলে গেছে। তাদের সামনে এখন ঘন গাছের দেয়াল, শালগাছের গুঁড়ি এত কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে যে, মাঝ দিয়ে একজন মানুষও সোজা হয়ে হেঁটে যেতে পারবে না। অমিতাভ মোবাইলের জিপিএস চালু করার চেষ্টা করল, কিন্তু সিগন্যাল প্রায় নেই, মাঝে মাঝে একবার-দু’বার ওঠা নামা করছে, আর কম্পাসের কাঁটা এলোমেলো ঘুরছে। অনির্বাণ গম্ভীর মুখে বললেন, “এটা কাকতালীয় হতে পারে না… গাছের এমনভাবে অবস্থান বদলানো অসম্ভব।” সুজাতা ভাবছিল, হয়তো গত রাতে অজান্তে তাঁরা অন্য কোনো দিক ঘুরে শিবির গড়েছে, কিন্তু তারপর তার চোখে পড়ল—শিবিরের পাশে সেই একই পাথুরে দাগ, যা গতকালও ছিল। মানে তাঁরা ঠিক সেই জায়গাতেই আছেন, শুধু চারপাশের দৃশ্যটাই পাল্টে গেছে। দুলাল তখনো ফিসফিস করে নিজের সঙ্গে কিছু বলছিল, যা শুনে রোহিনী কাছে গিয়ে জানতে চাইল। দুলাল নিচু স্বরে বলল, “এই বনের গাছেরা কখনো কখনো পথ পাল্টে দেয়… যাতে কেউ বেরোতে না পারে।” বাকিরা তার কথায় বিশ্বাস না করলেও, চোখেমুখে যে অস্বস্তি জমে উঠছিল, তা চাপা রাখা গেল না।
এরপর তাঁরা অন্য দিক দিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করল। কিন্তু প্রতিবার কয়েকশো মিটার এগোতে না এগোতেই দেখতে পেল—পথ হঠাৎ করেই গাছের দেয়ালে আটকে যাচ্ছে, আর বাতাসে ভেসে আসছে সেই মৃদু ফিসফিস, যা আগের রাতের চেয়ে আরও স্পষ্ট। কখনো মনে হচ্ছিল, যেন কারও নাম ধরে ডাকা হচ্ছে, আবার কখনো অচেনা ভাষায় দ্রুত কিছু বলা হচ্ছে, যা বোঝা যায় না, কিন্তু তাতে এক ধরনের জরুরি সতর্কবার্তার সুর আছে। অমিতাভ বিরক্ত হয়ে চিৎকার করে বলল, “যেই হোক, যদি আমাদের সঙ্গে মজা করে থাকে, বেরিয়ে আসো!” কিন্তু জবাবে কেবল সেই ফিসফিস আরও ঘন হয়ে উঠল, যেন কাছ থেকে আসছে। রোহিনী ক্যামেরা তুলে চারপাশে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল, কিন্তু লেন্সে শুধু গাছ আর কুয়াশা—কোনো নড়াচড়া নেই। অনির্বাণ দলের সবাইকে শান্ত থাকতে বললেন, কিন্তু তার নিজের কণ্ঠও শুষ্ক হয়ে গিয়েছিল। তখন সুজাতা হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল, “তোমরা খেয়াল করেছো, আমরা যত এগোচ্ছি, আলো তত কমছে?” সত্যিই, দিনের মাঝামাঝি সময়েও যেন সূর্যের আলো গাছের ফাঁক দিয়ে ঢুকছে না, সবকিছু ধূসর অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। দুলাল তখন থেমে গিয়ে বলল, “আমরা যদি আজ রাতের আগে পথ না পাই, তবে আর ফিরতে পারব না।” তার চোখে ভয় এমনভাবে ফুটে উঠেছিল, যা আর কৌতুক করে ঢাকা যায় না—এবার সবাই বুঝতে পারল, তারা সত্যিই পথ হারিয়েছে, আর এই জঙ্গল হয়তো তাদের ইচ্ছে মতো বেরোতে দেবে না।
পাঁচ
শালবনের প্রান্তে বসে থাকা দলটি সেদিন দুপুরের গরম এড়াতে এক ছায়াঘেরা স্থানে বিশ্রাম নিচ্ছিল। গাছের পাতা দিয়ে সূর্যের আলো ছেঁকে এসে মাটিতে ছায়ার নকশা আঁকছিল, কিন্তু দুলালের চোখে সেই আলোও এক ধরনের অশুভ আভা ছড়াচ্ছিল। অনেকক্ষণ নীরব থাকার পর সে ধীরে ধীরে কথা শুরু করল—গলায় দ্বিধা, চোখে সতর্কতা। “এই বন কিন্তু শুধু গাছপালা আর পশুপাখির নয়,” সে বলল, যেন প্রতিটি শব্দের আগে ভাবছে তা বলা উচিত কি না। বাকিরা থেমে শুনতে লাগল। দুলাল বলল, বহু বছর আগে এই বনের কাছেই ছিল একটি ছোট্ট গ্রাম, যেখানে প্রায় পঞ্চাশ-ষাটটি পরিবার বাস করত। লোকেরা ছিল শান্ত-স্বভাব, জমি-চাষ আর শিকার করেই দিন চলত। কিন্তু এক পূর্ণিমার রাতে অদ্ভুত ঘটনা ঘটে—সকালে দেখা যায় পুরো গ্রাম ফাঁকা, মানুষ, গরু, কুকুর—কেউ নেই, শুধু ঘরের দরজা খোলা, রান্নাঘরে আধপোড়া হাঁড়ি, আর মাটিতে কিছু উল্টে পড়ে থাকা পাত্র। প্রথমে ভাবা হয়েছিল, হয়তো ডাকাতি বা কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয়, কিন্তু চারপাশের জঙ্গল খুঁজেও কাউকে পাওয়া যায়নি। পুলিশের তদন্ত ব্যর্থ হয়, আর ঘটনা ধীরে ধীরে লোককথায় রূপ নেয়।
দুলাল আরও গম্ভীর হয়ে বলল, “বুড়োদের মুখে শুনেছি, সেই রাতে নাকি গ্রামে একটা হঠাৎ শব্দ উঠেছিল—যেন দূর থেকে অনেকগুলো মানুষ একসাথে ফিসফিস করছে, আবার যেন বাতাস বয়ে যাচ্ছে শালগাছের ভেতর দিয়ে। যারা তখন ঘুম থেকে উঠেছিল, তারা নাকি আলো দেখতে পেয়েছিল—গাছের গুঁড়ির ফাঁক দিয়ে নড়াচড়া করা আলো। তারপরেই নাকি সবাই হারিয়ে যায়।” সুজাতা কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, “তাহলে আপনি বলতে চাইছেন, ওই ফিসফিস শব্দটা… মৃতদের?” দুলাল মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, গ্রামবাসীরা বলে, যাদের আত্মা শান্তি পায়নি, তারা পূর্ণিমার রাতে এই বনের মধ্যে ফিরে আসে। তারা নাকি জীবিতদের ডাক দেয়—ডাক শোনার পর যে এগিয়ে যায়, সে আর ফেরে না।” রোহিনী ঠোঁট চেপে হাসল, যেন অবিশ্বাসের ভান করছে, কিন্তু তার চোখে যে এক ধরনের উদ্বেগের ছায়া নেমে এসেছে, তা কেউ এড়াতে পারল না। অমিতাভ কিছু বলার চেষ্টা করল, কিন্তু বাতাসে এক অদৃশ্য ভার যেন সবাইকে চুপ করিয়ে দিল।
মুহূর্তের জন্য চারপাশের জঙ্গলও যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। পাখির ডাক থেমে গেছে, দূরের বাঁশঝাড়ের হাওয়ার সুরও নিস্তব্ধ। দলের কারও মুখে আর আগের মতো রসিকতার ছাপ নেই—বরং চোখে এক অদ্ভুত কৌতূহল আর লুকনো ভয়। রাত্রির সেই অস্পষ্ট ফিসফিসের কথা মনে পড়তেই সবার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। দুলাল শেষবারের মতো সতর্ক করে বলল, “যদি আবার শব্দ শোনো, কৌতূহল বশে এগোবে না। কারণ, যে ডাক একবার শোনে, সে হয়তো ভাবে, শুধু শব্দের উৎস খুঁজছে—কিন্তু আসলে, সেই সময়েই সে বেছে নিচ্ছে পথ হারানোর।” কথাগুলো বাতাসে মিলিয়ে গেল, কিন্তু যেন মাটির গন্ধ, শালপাতার ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে থাকা অদৃশ্য উপস্থিতি, আর সেই বহু পুরনো রহস্য সবাইকে নিঃশব্দে ঘিরে ধরল। মনে হচ্ছিল, বন যেন তাদের শ্বাসপ্রশ্বাস শুনছে, অপেক্ষা করছে, আর পূর্ণিমার রাতের আগমনকে ধীরে ধীরে ত্বরান্বিত করছে।
ছয়
অমিতাভের ড্রোনটি আকাশে উড়তে উড়তে শালবনের উপর দিয়ে ধীরে ধীরে ঘুরছিল। সকালের হালকা কুয়াশা তখনও পাতলা পর্দার মতো গাছের ডালে ঝুলে আছে। সবার চোখ ছিল রিমোটের স্ক্রিনে, যেখানে ঘন সবুজের ভেতর দিয়ে সূর্যের আলো টুকটুক করে ফুটে উঠছে। হঠাৎই ফুটেজে এক অদ্ভুত ছায়া দেখা গেল—লম্বা, স্থির, আর কেমন যেন মানুষের মতো, কিন্তু স্পষ্ট নয়। সেটা যেন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে, গাছের কাণ্ডের আড়াল থেকে সরাসরি ড্রোনের দিকে তাকিয়ে আছে। অমিতাভের মুখে রসিকতার কোনো চিহ্ন নেই, বরং এক ধরনের আতঙ্ক জমে আছে। হাওয়ার ঝাপটা সত্ত্বেও ছায়াটি নড়ছে না, আর সেই স্থিরতা যেন শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দিচ্ছে। ঠিক তখনই ড্রোনের স্ক্রিন কেঁপে উঠল, ফুটেজে দাগ পড়ল, আর হঠাৎই ‘সিগন্যাল লস’ লেখা ভেসে উঠে সঙ্গে সঙ্গে ড্রোনের শব্দ থেমে গেল। কয়েক মুহূর্ত কেউ কিছু বলতে পারল না—সবাই চুপচাপ, শুধু চারপাশের বনের নিস্তব্ধতায় দূরের পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ শোনা যাচ্ছিল। অমিতাভ রিমোটের বোতাম চাপতে থাকল, কিন্তু কোনো সাড়া নেই। তার কণ্ঠে হতাশা আর ভয়ের মিশ্র সুর, “এটা এমন হবার কথা নয়…”
রোহিনী আর অনির্বাণ তখন দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল—ড্রোন উদ্ধার করতে হবে, না হলে ফুটেজও হারিয়ে যাবে। দুলাল প্রথমে বাধা দিল, বলল, “ওদিকে যাবেন না, বনের ওই অংশটা অচেনা।” কিন্তু তাদের কৌতূহল আর দায়িত্ববোধ বেশি ছিল। দু’জনে মিলে বনের ভেতর ঢুকতেই শালগাছের ঘন ছায়া তাদের মাথার ওপর অন্ধকারের ছাউনি ফেলে দিল। বাতাসের ভেতর ছিল অদ্ভুত ঠান্ডা, আর মাটিতে শুকনো পাতার মচমচে শব্দ পায়ের তলায় ছন্দহীনভাবে বাজছিল। ড্রোনের পড়ে থাকার শব্দ বা আলো পাওয়া যায়নি, বরং বনের গভীরে যেতে যেতে এক অদ্ভুত গন্ধ নাকে এল—যেন পচা কাঠ আর ভেজা মাটির মিশ্রণ। তাদের টর্চলাইটের আলো মাঝে মাঝে গাছের বাকলে পড়ে যেন অদ্ভুত ছায়া তৈরি করছিল, যা মুহূর্তে মানুষের অবয়বের মতো লাগছিল। দূরে কোথাও যেন পায়ের আওয়াজও মিলছিল, কিন্তু সেটা মানুষের কিনা বোঝা যাচ্ছিল না। অনির্বাণ থেমে বলল, “আমাদের মনে হচ্ছে কেউ আমাদের দেখছে।” রোহিনীর গলায় ছিল নিঃশ্বাস আটকে আসার সুর, কিন্তু সে কিছু বলল না—শুধু হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল।
হঠাৎই তারা দেখতে পেল, মাটিতে উল্টে পড়ে আছে ড্রোনটি—তার একপাশে স্ক্র্যাচ লেগে গেছে, আর প্রপেলার ভেঙে গেছে। কিন্তু তাদের দৃষ্টি আটকে গেল ড্রোনের ঠিক পাশের মাটিতে—সেখানে বড় বড় শুকনো পাতার মধ্যে দিয়ে স্পষ্টভাবে খোদাই করা আছে কয়েকটি অদ্ভুত প্রতীক। প্রতীকগুলো দেখতে গোলাকার, তার ভেতরে সর্পিল রেখা, আর মাঝে মাঝে এমন চিহ্ন যা যেন মানুষের চোখ বা হাতের মতো অবয়ব নির্দেশ করছে। মাটি এমনভাবে আঁচড়ানো যেন ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ এই চিহ্ন তৈরি করেছে, আর তার চারপাশে অদ্ভুতভাবে পাতাগুলো সরিয়ে রাখা হয়েছে। রোহিনী নিচু হয়ে টর্চের আলো ফেলতেই বুঝল, এগুলো পুরনো নয়—একদম তাজা, যেন কয়েক ঘণ্টা আগে আঁকা হয়েছে। বাতাসে হঠাৎ যেন ফিসফিসে শব্দ ভেসে এল, খুব ক্ষীণ, কিন্তু শব্দের তীব্রতা এমন যে মনে হচ্ছিল কানের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। অনির্বাণ থরথর করে উঠল, চারপাশে তাকাল, কিন্তু কিছু দেখা গেল না। ঠিক তখনই ডালপালা ভাঙার শব্দ এল তাদের পেছন থেকে—এক মুহূর্তের জন্য দু’জনের দৃষ্টি মিলল, আর বুঝে গেল যে তারা একা নয়।
সাত
শিবিরের ম্লান আলোয়, রাতের আর্দ্রতা যেন গায়ে চেপে বসেছে। সবাই ছোট্ট লণ্ঠনের চারপাশে বসে আছে, আর সুজাতার চোখ কম্পিউটার স্ক্রিনে স্থির। দিনের বেলায় রেকর্ড করা অদ্ভুত ফিসফিসগুলো সে বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে ভেঙে ভেঙে বিশ্লেষণ করছে। একেকটি সাউন্ডওয়েভ সে আলাদা করছে, অডিও ফ্রিকোয়েন্সি গ্রাফে উঠছে রহস্যময় ঢেউয়ের মতো রেখা। কানের কাছে রাখা হেডফোনে সুজাতা যখন মনোযোগ দিয়ে শুনছে, তার ভুরু কুঁচকে আসছে—কারণ শব্দের ভেতরে সে কিছু পুনরাবৃত্ত ধ্বনি শনাক্ত করেছে। সে জানায়, এই ধ্বনিগুলো কোনো প্রাকৃতিক শব্দ নয়, বরং গঠিত বাক্য। শব্দের প্যাটার্ন তুলনা করতে গিয়ে তার মনে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো আর্কাইভে দেখা একটি প্রাচীন লিপির কথা—যা পশ্চিম মেদিনীপুর অঞ্চলে কয়েকশো বছর আগে ব্যবহার হত। সবার চোখ তখন বড় বড় হয়ে গেছে, কারণ অর্থ বোঝার আগে থেকেই এক অজানা আতঙ্কে সবাই থম মেরে গেছে। বাইরে রাতের জঙ্গলে হঠাৎ কোথাও দূরে শুকনো পাতার মচমচ শব্দ শোনা গেলেও কেউ আর সেদিকে তাকায় না—সব মনোযোগ স্থির থাকে সুজাতার ঠোঁটে, যেখান থেকে বেরোতে চলেছে সেই গোপন বার্তার অর্থ।
ঘণ্টাখানেক ধরে ডিকোড করার পর, অবশেষে সুজাতা ধীর স্বরে পড়ে শোনায় অনুবাদ—“থেমো না… আসো আমাদের কাছে…”। এক মুহূর্তে শিবিরের ভেতরের বাতাস যেন আরও ভারী হয়ে যায়। অমিতাভ চমকে বলে ওঠে, “মানে… এরা তো আমাদের ডাকছে!” রোহিনী অস্বস্তিতে গলা শুকিয়ে যায়, দুলাল আবার চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে থাকে। অনির্বাণ হেসে হালকা করার চেষ্টা করলেও সেই হাসি কেমন যেন কেঁপে ওঠে—কারণ বার্তাটি শোনার পর তাদের সবার মনের মধ্যে একই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে—কে বা কারা এই কথা বলছে, আর কেন তাদের কাছে ডাকছে? সুজাতা আরও জানায়, এই ভাষাটি বহু আগেই হারিয়ে গেছে, কেবলমাত্র কিছু শিলালিপি আর মৌখিক কিংবদন্তিতে তার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। আর সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো, রেকর্ডিংয়ের সময় যে শব্দগুলো ধরা পড়েছিল, তার টাইমস্ট্যাম্প অনুযায়ী প্রতিটি ফিসফিস যেন তাদের পদক্ষেপের সাথে সাথে বদলাচ্ছিল—যেন অদৃশ্য কেউ তাদের প্রতিটি নড়াচড়া লক্ষ্য করছিল। বাইরে হাওয়া তখন শালপাতা কাঁপিয়ে অদ্ভুত সুর তুলছে, আর লণ্ঠনের আলো কাঁপতে কাঁপতে দেয়ালে লম্বা ছায়া ফেলছে—যেন সেই ছায়াগুলোও কথা বলার অপেক্ষায়।
দলটির মধ্যে তখন দ্বিধা আর ভয়ের অদ্ভুত মিশ্রণ। কেউ কেউ প্রস্তাব দেয়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু দুলাল ঠাণ্ডা গলায় বলে, “যদি সত্যিই এরা হারিয়ে যাওয়া গ্রামের আত্মারা হয়, তাহলে পালালেও কি রক্ষা পাবেন?” বাক্যটি যেন সবার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দেয়। অমিতাভ প্রস্তাব রাখে, পরের দিন সকালের আলো ফোটার আগেই তারা শালবনের গভীরে ঢুকে সেই শব্দের উৎস খুঁজবে—কিন্তু রোহিনী তাতে তীব্র আপত্তি জানায়, কারণ এখন পর্যন্ত যত ঘটনা ঘটেছে, তাতে প্রতিটিই তাদের অজানার দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। বাইরে হঠাৎ কোনো একদিকে হুড়মুড়িয়ে কিছু দৌড়ে যায়, হয়তো বন্যপ্রাণী, হয়তো নয়—কিন্তু সেই মুহূর্তে কারও সাহস হয় না শিবিরের বাইরে গিয়ে তা নিশ্চিত করার। সুজাতার কম্পিউটার স্ক্রিনে শেষবারের মতো সেই সাউন্ডওয়েভ গ্রাফ দেখা যায়, যেখানে ফিসফিস শব্দগুলো আবারও ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু মনে হচ্ছিল, দূরে কোথাও থেকে তারা এখনও ফিসফিস করছে—“থেমো না… আসো আমাদের কাছে…”।
আট
রাত গভীর হতেই শালবনের চারপাশের নীরবতা আরও ঘন হয়ে আসে। দিনের বেলা পাখির ডাক, বাতাসের শব্দ আর পাতার মর্মর ধ্বনি যেটুকু শব্দ এনে দেয়, তাও যেন এই সময় থেমে যায়। হোটেলের ঘরে বসে রোহিনী তার ল্যাপটপে দিনের ছবি গুছোচ্ছিল, কিন্তু মাথায় এক অদ্ভুত কৌতূহল ঘুরপাক খাচ্ছিল—দুপুরে বনের ভেতর থেকে যে আলোর ঝলক সে দেখেছিল, তার উৎস কি সত্যিই কোনও বৈজ্ঞানিক কারণে সম্ভব, নাকি লোককথার রহস্যময় ছায়া এখনো এই জায়গায় লুকিয়ে আছে? অনির্বাণ তাকে একাধিকবার সাবধান করেছিল রাতে একা বেরোতে না, বিশেষ করে এই বনে। কিন্তু রোহিনীর স্বভাবটাই আলাদা—যখন তার মনে হয় কোথাও কোনো গল্প, কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে, তখন সে সমস্ত ভয়কে দূরে সরিয়ে ঝুঁকি নিয়ে ফেলতে দ্বিধা করে না। তাই রাত প্রায় সাড়ে দশটার সময়, হাতে ক্যামেরা, গলায় টর্চ ঝুলিয়ে, সে চুপচাপ বেরিয়ে পড়ে। চাঁদের আলোয় আলোকিত সরু পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হচ্ছিল যেন প্রতিটি গাছের ছায়া, প্রতিটি নড়াচড়া তাকে লক্ষ্য করছে। বাতাসে ছিল এক ধরনের শীতলতা, যা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠতে বাধ্য করে। দূরে কোথাও এক অদৃশ্য পাখি ডেকে উঠল, তার সুরে যেন সতর্কবার্তা লুকিয়ে ছিল। রোহিনী তার ক্যামেরার ফ্ল্যাশ একবার চালিয়ে নিল—আলোয় কয়েকটি শুকনো পাতা ঝরে পড়তে দেখা গেল, কিন্তু আশেপাশে কোনও মানুষের চিহ্ন নেই।
কিছুটা হাঁটার পর সে পৌঁছে যায় বনের ভেতরকার এক ফাঁকা জায়গায়, যেখানে একটি পুরনো, কুঁড়েঘরের মতো কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে—যেন বহু বছর ধরে এখানে পড়ে আছে, কিন্তু তবুও অদ্ভুতভাবে অক্ষত। কুঁড়েঘরের চারপাশে গাছের শেকড়গুলো মাটির উপর উঠে এসেছে, যেন প্রকৃতি নিজেই তাকে আঁকড়ে ধরেছে। টর্চের আলো যখন দেয়ালে পড়ল, রোহিনীর শ্বাস আটকে গেল—দেয়ালে হাতের ছাপ, অসংখ্য, যেন বিভিন্ন মাপের হাত দিয়ে লেপে দেওয়া হয়েছে কাদামাটি। কিছু হাতের ছাপ বড়, প্রায় প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের, আবার কিছু ছোট, যেন শিশুদের। হাতের আঙুলগুলো লম্বাটে, আর কাদার রঙ আশ্চর্যজনকভাবে গাঢ়, যেন পুরনো রক্তের মতো। রোহিনী ক্যামেরা তুলে কয়েকটি ছবি তুলল, আর সেই সময় হঠাৎ করেই বাতাসের মধ্যে এক অদ্ভুত গন্ধ ভেসে এলো—পচা কাঠ আর ভেজা মাটির মিশ্রণ, কিন্তু তার মধ্যে একধরনের ধাতব স্বাদ মিশে আছে, যা মানুষ রক্ত দেখলে যেমন অনুভব করে। কুঁড়েঘরের ভেতর থেকে যেন খুব ধীরে ধীরে এক ধরনের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। রোহিনী থমকে দাঁড়াল, মনে হল হয়তো কোনও পশু ভেতরে আছে, অথবা… কেউ। তার পা কেমন করে যেন ধীরে ধীরে দোরগোড়ার দিকে এগোতে লাগল, কিন্তু সেই মুহূর্তেই হঠাৎ পেছন থেকে একটা চাপা, ভাঙা শব্দ শোনা গেল—যেন কারও পায়ের নিচে শুকনো ডাল ভেঙে গেছে। রোহিনী দ্রুত পেছনে তাকাল, কিন্তু সেখানে কেবল ছায়া আর ঘন অন্ধকার। পরের কয়েক সেকেন্ডে, ঠিক কী ঘটেছিল, সে নিজেও বুঝে উঠতে পারেনি। একটা হালকা বাতাস বয়ে গেল, আর তারপর টর্চের আলো হঠাৎ নিভে গেল।
পরদিন সকালে, অনির্বাণ খবর পেল গ্রাম থেকে—রোহিনী রাতে ফিরে আসেনি। তড়িঘড়ি সে ও সায়ন্তী মিলে বনে ঢুকে পড়ল, স্থানীয় দুই যুবককে সঙ্গে নিয়ে। প্রায় এক ঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পর তারা দেখতে পেল রোহিনীর ক্যামেরা পড়ে আছে কুঁড়েঘরের সামনের শুকনো ঘাসের উপর, যেন হঠাৎ হাতছাড়া হয়ে পড়ে গেছে। ক্যামেরার স্ক্রিন ভেঙে গেছে, কিন্তু মেমোরি কার্ড অক্ষত। অনির্বাণ ক্যামেরা হাতে তুলে দেখে বুঝল, এই জায়গাটা বনের সেই অংশ, যেটা স্থানীয়রা ‘নিষিদ্ধ অঞ্চল’ বলে এড়িয়ে চলে। কুঁড়েঘরের দেয়ালের হাতের ছাপগুলি দেখে তার মনে হল—এটা কেবল অলংকার নয়, বরং কোনও চিহ্ন, হয়তো সতর্কবার্তা। সায়ন্তীর চোখে ভয় ফুটে উঠল, কিন্তু অনির্বাণের মনে হচ্ছিল, রোহিনী কোথাও কাছেই আছে, আর তার নিখোঁজ হওয়ার রহস্য উন্মোচনের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে এই ঘরের ভেতরেই। চারপাশের গাছের ফাঁক দিয়ে সকালের আলো এসে পড়ছিল, কিন্তু তাতেও যেন এই জায়গার অন্ধকার কিছুতেই কমছিল না। অনির্বাণ একবার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ভেতরে তাকাল—মেঝেতে ধুলো জমে আছে, আর তার উপর কয়েকটি অদ্ভুত চিহ্ন আঁকা, যেন কারও হাতে তৈরি। সে অনুভব করল, বনের এই কুঁড়েঘর শুধু কোনও সাধারণ স্থাপনা নয়—এটা যেন সময়ের ফাঁদ, যা অতীতের রহস্য ধরে রেখেছে, আর যে কেউ তার কাছে পৌঁছোলে তাকে নিজের মধ্যে টেনে নেয়। রোহিনী কি সেই ফাঁদের শিকার হয়েছে? নাকি সে এই রহস্যের গভীরে কোথাও লুকিয়ে আছে, অপেক্ষা করছে মুক্তির? অনির্বাণ জানত, উত্তর পাওয়া যাবে কেবল এই কুঁড়েঘরের ভেতর পা রাখলেই—যদিও তার জন্য বড় মূল্য চোকাতে হতে পারে।
নয়
অমিতাভ, রোহিনী, অনির্বাণ এবং সুজাতা মাটির কুঁড়েঘরের ভেতরে ঢুকতেই একটা ভ্যাপসা, পচা গন্ধ তাদের ঘিরে ধরে। জানালা নেই, দরজার ফাঁক দিয়ে যে আলো ঢুকছিল, তা ধুলো আর মাকড়সার জালে প্রায় মিলিয়ে যাচ্ছিল। ভেতরের মেঝে ঠান্ডা, স্যাঁতসেঁতে, আর এক কোণে খড়ের স্তূপের নিচে অমিতাভের টর্চের আলো কেমন যেন ধাতব কিছুতে পড়ে চকচক করে ওঠে। খড় সরাতেই দেখা যায় কিছু অদ্ভুত জিনিস—কয়েকটি পুরনো অস্থি, যা মানুষেরই বলে মনে হয়; এক গলার হার, যার মধ্যে অদ্ভুত চিহ্ন খোদাই করা; আর একটি পুরনো চামড়ায় বাঁধা ডায়েরি। ডায়েরির মলাট শুকিয়ে ফেটে গেছে, কালি ফ্যাকাশে, কিন্তু পাতাগুলিতে কালো অক্ষরগুলো এখনও স্পষ্ট। রোহিনী হাতে গ্লাভস পরে সাবধানে প্রথম পৃষ্ঠা খুলতেই একটা শীতল হাওয়া যেন ঘরের ভেতর দিয়ে বয়ে যায়, আর বাইরে শালবনের ফিসফিসানি যেন হঠাৎ তীব্র হয়ে ওঠে। সুজাতা কাঁপা গলায় বলে, “মনে হচ্ছে… কেউ যেন চায় না আমরা এটা পড়ি।” কিন্তু তবুও অমিতাভ পাতাগুলি উল্টাতে থাকে।
ডায়েরির প্রথম দিকের লেখা বোঝা যায়, কয়েকশো বছর আগে এই অঞ্চলে এক ছোট গ্রাম ছিল, যেখানে মানুষরা শালগাছের নিচে উৎসব করত, পূর্ণিমার রাতে দেবতার উদ্দেশ্যে নৈবেদ্য দিত। কিন্তু একদিন বাইরের একদল কাঠুরে আসে—তারা বলে, এই বিশাল শালবন কেটে ফেলা হবে রাজ্যের নতুন প্রাসাদ বানাতে। গ্রামবাসীরা বাধা দিলে মারধর হয়, তারপর শুরু হয় রক্তপাত। ডায়েরির লেখক—সম্ভবত গ্রামের প্রধান—বর্ণনা করেছে, কীভাবে কাঠুরেরা তাদের ঘর জ্বালিয়ে দেয়, শিশু থেকে বৃদ্ধ, সবাইকে হত্যা করে, আর তাদের দেহ গাছের নিচে ফেলে রেখে যায়। কিন্তু সেই রাতেই ঘটে অদ্ভুত ঘটনা—যে গাছগুলির নিচে মৃতদেহ ফেলা হয়েছিল, সেখান থেকে ভয়ঙ্কর শব্দ শোনা যায়, গাছের ডালপালা যেন অমানবিক শক্তিতে কাঁপতে থাকে। কয়েকজন কাঠুরে পালাতে গিয়ে বনের ভেতরেই হারিয়ে যায়, আর যারা বেঁচে ফিরে আসে তারা বলে, গাছের ফাঁকে ফাঁকে চোখের মতো কিছু জ্বলজ্বল করছিল। ডায়েরির মাঝের পাতায় লেখা, “আমরা মরে গেছি, কিন্তু গাছ আমাদের ছাড়েনি—আমরা এখন এই বনের শ্বাসে মিশে গেছি, আমাদের আত্মা আর শরীর আলাদা নয়।” এরপরের অংশ পড়তে পড়তে রোহিনীর শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়, কারণ এখানে লেখা আছে, “আমরা প্রতি পূর্ণিমায় ডাক পাঠাব, যতদিন না নতুন আত্মারা এসে আমাদের সাথে মিশে যায়।”
শেষ পাতায় ডায়েরির লেখাটি আরেক ধাপ ভয়াবহ—এখানে একটা অভিশাপের কথা বলা আছে। লেখা, “যে কেউ এই বনের গাছ কাটতে চাইবে বা মৃতদের বিশ্রাম নষ্ট করবে, সে এই বনেই হারিয়ে যাবে, তার দেহ গাছের শিকড়ের নিচে পচে যাবে, আর আত্মা বেঁধে থাকবে চিরকাল।” পাতা শেষ হতেই, যেন সময় মিলিয়ে যায়—বাইরের ফিসফিসানি হঠাৎ কর্কশ হাসিতে বদলে যায়, আর কুঁড়েঘরের দেয়ালগুলো কেঁপে ওঠে। সুজাতা ডায়েরি বন্ধ করে ব্যাগে ঢোকাতে যায়, কিন্তু তখনই গলার হারটা নিজে থেকে মাটিতে পড়ে যায় এবং অস্থির স্তুপের ভেতর থেকে যেন একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। অমিতাভ সবাইকে তাড়াতাড়ি বাইরে নিয়ে আসে, কিন্তু দরজা খোলার মুহূর্তে তারা দেখে, বাইরে শালগাছগুলো আগের চেয়ে আরও কাছে চলে এসেছে—যেন গাছের দল ধীরে ধীরে তাদের ঘিরে ফেলছে। রোহিনী ফিসফিস করে বলে, “এখন বুঝতে পারছি… ফিসফিসানি কেন থামছিল না—ওরা আমাদের ডাকছিল।” আর তখনই বাতাসে ভেসে আসে সেই প্রাচীন ভাষার মন্ত্রোচ্চারণ, যা সুজাতা আগেই অনুবাদ করেছিল—”থেমো না… আসো আমাদের কাছে…”—যেন শালবনের প্রতিটি গাছ, প্রতিটি ডালপালা একসাথে তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে ডাকছে।
দশ
পূর্ণিমার সেই রাতের আকাশ ছিল অসাধারণ উজ্জ্বল, কিন্তু শালবনের ভেতর চাঁদের আলো যেন গিয়ে থেমে যাচ্ছিল—গাছের অন্ধকারে আলোর প্রবেশ ছিল অসম্ভব। বাতাসের মধ্যে এমন এক অদ্ভুত ভার ছিল, যা শ্বাস নিতে কষ্ট দিচ্ছিল। দলের প্রত্যেকের চোখে আতঙ্ক স্পষ্ট, কিন্তু কেউ মুখ খুলছিল না। হঠাৎ করেই ফিসফিসানি তীব্র হতে শুরু করল—যেন শত শত গলা একসাথে একই কথা বলছে, আর সেই শব্দ সরাসরি তাঁদের মাথার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। দুলাল, যিনি এতদিন শান্তভাবে সবাইকে পথ দেখিয়েছেন, এবার মরিয়া ভঙ্গিতে চিৎকার করে বললেন, “সবাই আমার পেছনে আসো—দৌড়াও!” গাছের সারির ফাঁক দিয়ে যেন অদৃশ্য হাত নড়ছে, পাতার ফাঁক দিয়ে লম্বা ছায়াগুলো প্রসারিত হয়ে তাঁদের দিকে এগিয়ে আসছে। রোহিনী অনুভব করল, তার পা যেন ভারী হয়ে গেছে, মাটির নিচ থেকে অদৃশ্য শিকড় বেরিয়ে এসে তাকে আঁকড়ে ধরেছে, কিন্তু দুলাল তাকে টেনে তুলতেই সে আবার দৌড়াতে শুরু করল। ডালপালা ভাঙার শব্দ, শুকনো পাতার কচমচ আওয়াজ, আর সেই অবিরাম ফিসফিস—সব মিলে বনের ভেতর এক বিভীষিকাময় কোলাহল তৈরি করেছিল।
তারা যতই দৌড়াচ্ছিল, ততই মনে হচ্ছিল বন যেন শেষ হচ্ছে না, বরং আরও গভীরে ঢুকে যাচ্ছে। চাঁদের আলো ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছিল, যেন ঘন কুয়াশা পুরো পথ ঢেকে ফেলেছে। সুজাতা হঠাৎ পিছনে তাকিয়ে চমকে উঠল—তার মনে হল গাছের ছায়ার ভেতর অসংখ্য জ্বলন্ত চোখ তাকিয়ে আছে। সে এক মুহূর্ত থমকে গেল, আর বাকিরা বুঝতেই পারল না যে সে থেমে গেছে। অনির্বাণ ডাকে, কিন্তু বাতাসের মধ্যে তার ডাক ডুবে যায় ফিসফিসের স্রোতে। ঠিক তখনই সবাই একসাথে শুনল, সেই কণ্ঠগুলো আর ভীতিকর নয়, বরং যেন অনুনয়ের সুরে ডাকছে—“থেমো না… আসো আমাদের কাছে…”। দুলাল আর পিছনে না তাকিয়ে সবাইকে বনের প্রান্তের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন, কারণ তিনি জানতেন, একবার থেমে গেলে আর ফিরে আসা সম্ভব নয়। হঠাৎ করে দূরে প্রথম আলোর রেখা দেখা গেল, আর সেই মুহূর্তে বনের শব্দ থেমে গেল—যেন সব প্রাণী, সব ছায়া একসাথে নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।
ভোরের প্রথম আলো তাঁদের বাঁচিয়ে দিল, কিন্তু ততক্ষণে তাঁরা বুঝতে পারলেন সুজাতা নেই। শ্বাসকষ্টে হাঁপাতে হাঁপাতে সবাই চারদিকে তাকাল, কিন্তু কোথাও তার চিহ্ন নেই। ঠিক তখনই রোহিনী মাটির ওপর পড়ে থাকা একটি রেকর্ডার দেখতে পেল—সুজাতার প্রিয় রেকর্ডার, যা সে কখনো হাতছাড়া করত না। অনির্বাণ সেটি তুলে নিতেই হালকা ‘প্লে’ বোতাম চাপা পড়ে গেল, আর স্পিকারের ভেতর থেকে সেই পরিচিত কিন্তু শিরদাঁড়া ঠান্ডা করে দেওয়া ফিসফিস ভেসে এল—“আরও একজন এসে গেছে…”। সেই শব্দ শোনার পর কারও কিছু বলার সাহস রইল না; সবাই কেবল একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল, যেন বুঝতে পারছিল, সুজাতা আর এই পৃথিবীতে নেই—সে এখন সেই শালবনের অভিশপ্ত ফিসফিসের অংশ হয়ে গেছে, আর হয়তো কোনো এক পূর্ণিমার রাতে তার কণ্ঠও মিলিয়ে যাবে সেই অসংখ্য অদৃশ্য কণ্ঠের ভিড়ে, যারা চিরকাল নতুন আত্মার অপেক্ষায় থাকে।